Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প460 Mins Read0

    সম্পাদক ও বন্ধু

    “দেখো সুরনাথ, তোমার কাগজের এ সংখ্যাটি তেমন সুবিধে হয় নি।”

    “কেন বলো দেখি?”

    “নিজেই ভেবে দেখো, তা হলেই বুঝতে পারবে। যখন সম্পাদকী করছ, তখন কোন্ লেখাটা ভালো, আর কোন্‌টা ভালো নয় তা নিশ্চয় বুঝতে পার।”

    “অবশ্য লেখা বেছে নিতে না জানলে সম্পাদকী করি কোন্ সাহসে? এ সংখ্যায় কি আছে বলছি। শাস্ত্রী মহাশয়ের ‘কালিদাস, মুণ্ড না জটিল’, পি. সি. রায়ের ‘খদ্দর- রসায়ন, বিনয় সরকারের ‘নয়া টঙ্কা’, সুনীতি চাটুজ্যের ‘হারাপ্‌পার ভাষাতত্ত্ব’, রাখাল বাড়ুজ্যের ‘বঙ্গদেশের প্রাক-ভৌগোলিক ইতিহাস’, বীরবলের ‘অন্নচিন্তা’, শরৎ চাটুজ্যের ‘বেদের মেয়ে, প্রমথ চৌধুরীর ‘উত্তর দক্ষিণ’, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের ‘সংগীতের X-RAY’, অতুলচন্দ্র গুপ্তের “ইসলামের রসপিপাসা’—এ-সব লেখার কোনোটিরই কি মূল্য নেই!”

    “আমি ও-সব দর্শন-বিজ্ঞান, হিস্টরি-জিওগ্রাফি, ধর্ম ও আর্ট প্রভৃতি বিষয়ের পণ্ডিতি প্রবন্ধের কথা বলছি নে। আর ‘বেদের মেয়ে’র সঙ্গে তো আমি ভালোবাসায় পড়ে গিয়েছি। আর বীরবলের ‘অন্নচিন্তা’ পড়ে আমার চোখে জল এসেছিল।”

    “তবে কোনটিতে তোমার আপত্তি?”

    “এবার কাগজে যে কবিতাটি বেরিয়েছে সেটি কি?”

    “পিয়া ও পাপিয়া’র কথা বলছ? ও-কবিতার ত্রিপদী কি চতুষ্পদী হয়ে গিয়েছে? ওতে কবিতার মাল-মশলা কি নেই?”

    “সবই আছে, নেই শুধু মস্তিষ্ক।”

    “মস্তিষ্ক না থাক, হৃদয় তো আছে?”

    “হৃদয়ের মানে যদি হয় ‘ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো’, তা হলে অবশ্য ও-ছাইয়ের সে আধার আছে। ও-কবিতার পিয়া-পাপিয়ার কথোপকথন কার সাধ্য বোঝে, বিশেষত যখন ওর ভিতর পিয়াও নেই, পাপিয়াও নেই।”

    “ও-দুটির কোনোটির থাকবার তো কোনো কথা নেই। কবির আজও বিয়ে হয় নি—তা তার পিয়া আসবে কোথেকে? আর ছেলেটি অতি সচ্চরিত্র—তাই কোনো অবিবাহিতা পিয়া তার কল্পনার ভিতরই নেই। আর সে জ্ঞান হয়ে অবধি বাস করছে হ্যারিসন রোডে, দিবারাত্র শুনে আছে শুধু ট্রামের ঘরঘড়ানি—পাপিয়ার ডাক সে জন্মে শোনে নি। ও-পাড়ার কৃষ্ণদাস পালের ও দ্বারবঙ্গের মহারাজার প্রস্তরমূর্তি তো আর পাপিয়ার তান ছাড়ে না!”

    “দেখো, এ-সব রসিকতা ছেড়ে দাও। যেমন কবিতার নাম, তেমনি কবির নাম। উক্ত মূর্তিযুগলও এ-দুটি নাম একসঙ্গে শুনলে হেসে উঠত, যদিচ হাস্যরসিক বলে তাদের কোনো খ্যাতি নেই।”

    “কবির নাম তো অতুলানন্দ। এ নাম শুনে তোমার এত হাসি পাচ্ছে কেন?”

    “এই ভেবে যে, ওরকম কবিতা সেই লিখতে পারে যার অন্তরে আনন্দ অতুল। যার অন্তরে আনন্দের একটা মাত্রা আছে, সে আর ছাপার অক্ষরে ও ভাবে পিউ পিউ করতে পারে না।”

    “ও নামে তোমার আপত্তি তো শুধু ঐ ‘অ’ উপসর্গে?”

    “হ্যাঁ, তাই।”

    “দেখো, ছোকরার বয়েস এখন আঠারো বছর। যখন ওর অন্নপ্রাশন হয়, নন্-কো- অপারেশনের বহু পূর্বে, তখন যদি ওর বাপ-মা ঐ উপসর্গটি ছেঁটে দিয়ে ওর নাম রাখতেন ‘তুলানন্দ’–তা হলে দেশসুদ্ধ লোকও হেসে উঠত। এমন-কি,

    -কি, যমুনালাল বাজাজও হাসি সম্বরণ করতে পারতেন না।”

    “তোমার এ কথা আমি মানি। কিন্তু আমি জানতে চাই, এ কবিতা তুমি ছাপলে কেন? তুমি তো জান, ও রচনা সেই জাতের, যা না লিখলে কারো কোনো ক্ষতি ছিল না।”

    “অতুলানন্দ যে রবীন্দ্রনাথ নয়, সে জ্ঞান আমার আছে। সুতরাং ও কবিতাটি না ছাপলে কোনো ক্ষতি ছিল না।”

    “তবে একপাতা কালি নষ্ট করলে কেন? কবিতার মতো ছাপার কালি তো সস্তা নয়।”

    “কেন ছেপেছি, তা সত্যি বলব?”

    “সত্যি কথা বলতে ভয় পাচ্ছ কেন?”

    “পাছে সে কথা শুনে তুমি হেসে ওঠ।”

    “কথা যদি হাস্যকর হয়, অবশ্য হাসব।”

    “ব্যাপারটা এক হিসেবে হাস্যকর।”

    “অত গম্ভীর হয়ে গেলে কেন? ব্যাপার কি?”

    “অতুলের কবিতা না ছাপলে তার মা দুঃখিত হবে বলে।”

    “আমি তো জানি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহৃদয় পরীক্ষকেরা যে ছেলে গোল্লা পেয়েছে, বাপ-মার খাতিরে তার কাগজে শূন্যের আগে টাকা ৯ বসিয়ে দেন। সাহিত্যেও কি মার্ক দেবার সেই পদ্ধতি?”

    “না। সেইজন্যেই তো বলতে ইতস্তত করছি।”

    “এ ব্যাপারের ভিতর গোপনীয় কিছু আছে নাকি?”

    “কিছুই না; তবে যা নিত্য ঘটে না, সে ঘটনাকে মানুষে সহজভাবে নিতে পারে না। এই কারণেই সামাজিক লোকে এমন অনেক জিনিসের সাক্ষাৎ নিজের ও অপরের মনের ভিতর পায়, যে জিনিসের নাম তারা মুখে আনতে চায় না, পাছে লোকে তা শুনে হাসে। আমরা কেউ চাই নে যে, আর পাঁচজনে আমাদের মন্দ লোক মনে করুক; আর সেই সঙ্গে আমরা এও চাই নে যে, আর-পাঁচজনে আমাদের অদ্ভুত লোক মনে করুক। প্রত্যেকে যে সকলের মতো, আমরা সকলে তাই প্রমাণ করতেই ব্যস্ত।”

    “যা নিত্য ঘটে না, আর ঘটলেও সকলের চোখে পড়ে না, সেই ঘটনার নামই তো অপূর্ব, অদ্ভুত ইত্যাদি। অপূর্ব, মানে মিথ্যে নয়, কিন্তু সেই সত্য যা আমাদের পূর্বজ্ঞানের সঙ্গে খাপ খায় না। ফলে আমরা প্রথমেই মনে করি যে, তা ঘটে নি, কেননা, তা ঘটা উচিত হয় নি। আমাদের ঔচিত্যজ্ঞানই আমাদের সত্যজ্ঞানের প্রতিবন্ধক। ধরো, তুমি যদি বল যে তুমি ভূত দেখেছ, তা হলে আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করব, আর যদি তা না করি তো মনে করব, তোমার মাথা খারাপ হয়েছে।”

    “তা তো ঠিক। যে যা বলে, তাই বিশ্বাস করবার জন্য নিজের উপর অগাধ অবিশ্বাস চাই। আর নিজেকে পরের কথার খেলার পুতুল মনে করতে পারে শুধু জড়পদার্থ, অবশ্য জড়পদার্থের যদি মন বলে কোনো জিনিস থাকে।”

    “তুমি যেরকম ভণিতা করছ, তার থেকে আন্দাজ করছি, “পিয়া ও পাপিয়া’র আবির্ভাবের পিছনে একটা মস্ত রোমান্স আছে।”

    “রোমান্স এক বিন্দুও নেই। যদি থাকত, ইতস্তত করব কেন? নিজেকে রোমান্সের নায়ক মনে করতে কার না ভালো লাগে? বিশেষত তার, যার প্রকৃতিতে romanticism এর লেশমাত্রও নেই? ও প্রকৃতির লোক যখন একটা রোমান্টিক গল্প গড়ে তোলে তখন অসংখ্য লোক তা পড়ে মুগ্ধ হয়—কারণ, বেশির ভাগ লোকের গায়ে romanticism এর গন্ধ পর্যন্ত নেই। মানুষের জীবনে যা নেই, কল্পনায় সে তাই পেতে চায়। আর তার সেই ক্ষিধের খোরাক জোগায় রোমান্টিক সাহিত্য। যে গল্পের ভিতর মনের আগুন নেই, চোখের জল নেই, বাসনার উনপঞ্চাশ বায়ু নেই, আর যার অন্তে খুন নেই, আত্মহত্যা নেই, তা কি কখনো রোমান্টিক হয়? ‘পিয়া ও পাপিয়া’র পিছনে যা আছে সে হচ্ছে সাইকোলজির একটি ঈষৎ বাঁকা রেখা। আর সে বাঁক এত সামান্য যে সকলের তা চোখে পড়ে না, বিশেষত ও-রেখার গায়ে যখন কোনো ডগডগে রঙ নেই। এইজন্যই তো ব্যাপারটি তোমাকে বলতে আমার সংকোচ হচ্ছে। এ ব্যাপারের ভিতর যদি কোনো নারীর হরণ কিম্বা বরণ থাকত, তা হলে তো সে বীরত্বের কাহিনী তোমাকে স্ফূর্তি করে বলতুম।”

    “তোমার মুখ থেকে যে কখনো রোমান্টিক গল্প বেরুবে, বিশেষত তোমার নিজের সম্বন্ধে, এ দুরাশা কখনো করি নি। তোমাকে তো কলেজের ফার্স্ট ইয়ার থেকে জানি। তুমি যে সেণ্টিমেন্টের কতটা ধার ধারো তা তো আমার জানতে বাকি নেই। তুমি মুখ খুললেই যে মনের চুল চিরতে আরম্ভ করবে, এতদিনে কি তাও বুঝি নি, মানুষের মন জিনিসটিকে তুমি এক জিনিস বলে কখনোই মান নি। তোমার বিশ্বাস, ও এক হচ্ছে বহুর সমষ্টি। তোমার ধারণা যে, মনের ঐক্য মানে তার গড়নের ঐক্য। মনের ভিতরকার সব রেখা মিলে তাকে একটা ধরবার ছোঁবার মতো আকার দিয়েছে। আর এ-সব রেখাই সরল রেখা। তুমিও যে মানসিক বঙ্কিম রেখার সাক্ষাৎ পেয়েছ, এ অবশ্য তোমার পক্ষে একটা নতুন আবিষ্কার। এ আবিষ্কারকাহিনী শোনবার জন্য আমার কৌতূহল হচ্ছে, অবশ্য সে কৌতূহল scientific কৌতূহল মনে কোরো না, তোমার মনের গোপন কথা শোনবার জন্য আমি উৎসুক।

    “ব্যাপারটা তোমাকে সংক্ষেপে বলছি। শুনলেই বুঝতে পারবে যে এর ভিতর আমার নিজের মনের কোনো কথাই নেই—সরলও নয়, কুটিলও নয়। এখন শোনো।—

    “ব্যাপারটা অতি সামান্য। আমি যখন কলেজ থেকে এম. এ. পাস করে বেরোই তখন অতুলের মার সঙ্গে আমার বিয়ের কথা হয়েছিল। প্রস্তাবটি অবশ্য কন্যাপক্ষ থেকেই এসেছিল। আমার আত্মীয়রা তাতে সম্মত হয়েছিলেন। তাঁদের আপত্তির কোনো কারণ ছিল না, কেননা, ও পরিবারের সঙ্গে আমাদের পরিবারের বহুকাল থেকে চেনা-শোনা ছিল। ও পক্ষের কুলশীলের কোনো খুঁত ছিল না, উপরন্তু মেয়েটি দেখতে পরমা সুন্দরী না হলেও সচরাচর বাঙালি মেয়ে যেরকম হয়ে থাকে তার চেয়ে নিরেস নয় বরং সরেস, কারণ তার স্বাস্থ্য ছিল, যা সকলের থাকে না। আমার গুরুজনরা এ প্রস্তাবে আমার মতের অপেক্ষা না রেখেই তাঁদের মত দিয়েছিলেন। তাঁরা যে আমার মত জানতে চান নি তার একটি কারণ—তাঁরা জানতেন যে, মেয়েটি আমার পূর্ব- পরিচিত। ‘ওর চেয়ে ভালো মেয়ে পাবে কোথায়?’-এই ছিল তাঁদের মুখের ও মনের কথা। আমার মত জানতে চাইলে তাঁর একটু মুশকিলে পড়তেন। কারণ আমি তখন কোনো বিয়ের প্রস্তাবে সহজে রাজি হতুম না, সুতরাং ও প্রস্তাবেও নয়। হুড়কো মেয়ে যেমন স্বামী দেখলেই পালাই-পালাই করে, আমার মন সেকালে তেমনি স্ত্রী-নামক জীবকে কল্পনার চোখে দেখলেও পালাই-পালাই করত। তা ছাড়া সেকালে আমার বিবাহ করা আর জেলে যাওয়া দুইই এক মনে হত। ও কথা মনে করতেও আমি ভয় পেতুম। তুমি মনে ভাবছ যে, আমার এ কথা শুধু কথার কথা; একটা সাহিত্যিক খেয়াল মাত্র। আমি যে ঠিক আর-পাঁচজনের মতো নই, তাই প্রমাণ করবার জন্য এ-সব মনের কথা বানিয়ে বলছি; সাহিত্যিকদের পূর্বস্মৃতির মতো এ পূর্বস্মৃতিও কল্পনা-প্রসূত। কেননা, আমিও গুরুগৃহ থেকে প্রত্যাবর্তনের কিছুকাল পরেই গৃহস্থ হয়েছি। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারবে যে, মানুষের মৃত্যুভয় আছে বলে মানুষ মৃত্যু এড়াতে পারে না—পারে শুধু কষ্টে-সৃষ্টে মৃত্যুর দিন একটু পিছিয়ে দিতে। আর মজা এই যে, যার মৃত্যুভয় অতিরিক্ত সে যে ও ভয় থেকে মুক্তি পাবার জন্য আত্মহত্যা করে, এর প্রমাণও দুর্লভ নয়। অজানা জিনিসের ভয় জানলে দেখা যায় ভুয়ো

    “সেই যাই হোক, এই বিয়ে ভেঙে গেল। আমিও বাঁচলুম। কেন ভেঙে গেল শুনবে? মেয়ের আত্মীয়রা খোঁজ-খবর করে জানতে পেলেন যে, আমি নিঃস্ব-অর্থাৎ আমাদের পরিবারের বা’র-চটক দেখে লোকে যে মনে করে যে সে-চটক রুপোর জলুস, সেটা সম্পূর্ণ ভুল। কথাটা ঠিক। আমার বাপ-থুড়োরা কেউ পূর্বপুরুষের সঞ্চিত ধনের উত্তরাধিকারের প্রসাদে বাবুগিরি করেন নি, আর তাঁরা বাবুগিরি করতেন বলেই ছেলেদের জন্যও ধন সঞ্চয় করতে পারেন নি। আমাদের ছিল যত্র আয় তত্র ব্যয়ের পরিবার। কন্যাপক্ষের মতে এরকম পরিবারে মেয়ে দেওয়া আর তাকে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া দু’ই সমান।

    “আমাদের আর্থিক অবস্থার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে লতিকার আত্মীয়-স্বজন আমার চরিত্রের নানারকম ত্রুটিরও আবিষ্কার করলেন। আমি নাকি গানবাজনার মজলিসে আড্ডা দিই, গাইয়ে-বাজিয়ে প্রভৃতি চরিত্রহীন লোকদের সহবত করি; পান খাই, তামাক কাই, নস্যি নিই, এমন-কি, Blue Ribbon Societyর নাম লেখানো মেম্বার নই। এক কথায় আমি চরিত্রহীন।

    “আমার নামে লতিকার পরিবার এই-সব অপবাদ রটাচ্ছে শুনে আমার গুরুজনেরাও মহা চটে গেলেন। কারণ, তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে আমাকে ভালোমন্দ বলবার অধিকার শুধু তাঁদেরই আছে, অপর কারও নেই; বিশেষত আমার ভাবী শ্বশুরকুলের তো মোটেই নেই। ছোটোকাকা ওদের স্পষ্টই বললেন যে, ‘শ্যাম্পেন তো আর গোরুর জন্য তৈরি হয় নি, হয়েছে মানুষের জন্য, আর আমাদের ছেলেরা সব মানুষ, গোরু নয়।” ভাঙা প্রস্তাব জোড়া লাগবার। যদি কোনো প্রস্তাবনা থাকত তো ছোটোকাকার এক উক্তিতেই তা চুরমার হয়ে গেল। আমি আগেই বলেছি যে, এ বিয়ে ভাঙাতে আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। সেই সঙ্গে সব পক্ষই মনে করলেন যে, আপদ শান্তি। তবে শুনতে পেলুম যে, একমাত্র লতিকাই প্রসন্ন হয় নি। কোনো মেয়েই তার মুখের গ্রাস কেউ কেড়ে নিলে খুশি হয় না। উপরন্তু আমার নিন্দাবাদটা তার কানে মোটেই সত্যি কথার মতো শোনায় নি। যখন বিয়ের প্রস্তাব এগোচ্ছিল, তখন বাড়িতে আমার অনেক গুনগান সে শুনেছে। দুদিন আগে যে দেবতা ছিল, দুদিন পরে সে কি করে অপদেবতা হল, তা সে কিছুতেই বুঝতে পারলে না। কারণ, তখন তার বয়েস মাত্র ষোলো—আর সংসারের কোনো অভিজ্ঞতা তার ছিল না। আমার সঙ্গে বিয়ে হল না বলে সে দুঃখিত হয় নি, কিন্তু আমার প্রতি অন্যায় ব্যবহার করা হয়েছে মনে করে সে বিরক্ত হয়েছিল।

    “লতিকার আত্মীয়েরা আমার চরিত্রহীনতার আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই আর-একটি সচ্চরিত্র যুবককে আবিষ্কার করলেন। আমার সঙ্গে বিয়ে ভাঙবার এক মাস পরেই সরোজরঞ্জনের সঙ্গে লতিকার বিয়ে হয়ে গেল। এতে আমি মহা খুশি হলুম। সরোজকে আমি অনেক দিন থাকতে জানতুম। আমার চাইতে সে ছিল সব বিষয়েই বেশি সৎপাত্র। সে ছিল অতি বলিষ্ঠ, অতি সুপুরুষ, আর এগজামিনে সে বরাবর আমার উপরেই হত। সরোজের মতো ভদ্র আর ভালো ছেলে আমাদের দলের মধ্যে আর দ্বিতীয় ছিল না। উপরন্তু তার বাপ রেখে গিয়েছিলেন যথেষ্ট পয়সা। আমার যদি কোনো ভগ্নী থাকত তা হলে সরোজকে আমার ভগ্নীপতি করবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতুম। বিধাতা তাকে আদর্শ জামাই করে গড়েছিলেন।

    “আমি যা মনে ভেবেছিলুম হলেও তাই। সরোজ তার স্ত্রীকে অতি সুখে রেখেছিল। আদর-যত্ন অন্ন-বস্ত্রের অভাব লতিকা একদিনের জন্যও বোধ করে নি। এক কথায় আদর্শ স্বামীর শরীরে যে-সব গুণ থাকা দরকার, সরোজের শরীরে সে-সবই ছিল। এ-দাম্পত্য জীবন যতদূর মসৃণ ও যতদূর নিষ্কণ্টক হতে পারে, দম্পতির তা হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বিবাহের দশ বৎসর পরেই লতিকা বিধবা হল। সরোজ উত্তর- পশ্চিম প্রদেশে সরকারি চাকরি করত। অল্পদিনের মধ্যেই চাকরিতে সে খুব উন্নতি করেছিল। ইংরেজি সে নিখুঁতভাবে লিখতে পারত, তার হাতের ইংরেজির ভিতর একটিও বানান ভুল থাকত না, একটিও আর্য প্রয়োগ করত না। এক হিসেবে তার ইংরেজি কলমই ছিল তার উন্নতির মূল। যদি সে বেঁচে থাকত তা হলে এতদিনে সে বড়ো কর্তাদের দলে ঢুকে যেত। বুদ্ধিবিদ্যার সঙ্গে যার দেহে অসাধারণ পরিশ্রম-শক্তি থাকে, সে যাতে হাত দেবে তাতেই কৃতকার্য হতে বাধ্য। লতিকা একটি আট বছরের ছেলে নিয়ে দেশে ফিরে এল।

    “এরপর থেকেই তার অন্তরে যত স্নেহ ছিল, সব গিয়ে পড়ল তার ঐ একমাত্র সন্তানের উপর। ঐ ছেলে হল তার ধ্যান ও জ্ঞ্যান। ঐ ছেলেটিকে মানুষ করে তোলাই হল তার জীবনের ব্রত।

    “এ পর্যন্ত যা বললুম, তার ভিতর কিছুই নূতনত্ব নেই। এ দেশে, এবং আমার বিশ্বাস অপর দেশেও, বহু মায়ের ও-অবস্থায় একই মনোভাব হয়ে থাকে। তবে লতিকা তার ছেলেকে শুধু মানুষ করে তুলতে চায় না, চায় অতি-মানুষ করতে। আর এ অতি- মানুষের আদর্শ কে জানে? শ্রীসুরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, ওরফে আমি। এ কথা শুনে হেসো না। সে তার ছেলেকে পান-তামাক খেতে শেখাতে চায় না, সেই শিক্ষা দিতে চায় যাতে সে আমার মতো সাহিত্যিক হয়ে উঠতে পারে। লতিকাকে তার স্বামী কিছু লেখাপড়া শিখিয়েছিল, আর সেই সঙ্গে তাকে বুঝিয়েছিল যে, সুরনাথ যা লিখেছে, তার চাইতে সে যা লেখে নি, তার মূল্য ঢের বেশি। অর্থাৎ আমি যদি আলসে না হতুম তো দশ ভল্যুম হিস্টরি লিখতে পারতুম, আর না হয় তো পাঁচ ভল্যুম দর্শন। আমার ভিতর নাকি শক্তি ছিল তার আমি সদ্‌ব্যবহার করি নি; এই কারণে সে মনে করে, আমিই হচ্ছি ওস্তাদ সাহিত্যিক। ফলে তার ছেলের সাহিত্যিক শিক্ষার ভার আমার উপরেই ন্যস্ত হয়েছে। আর এই ছেলেটির নাম অতুলানন্দ। আমি জানি সে কখনো সাহিত্যিক হবে না, অন্তত আমার জাতের বাজে সাহিত্যিক হবে না। কারণ ছেলেটি হচ্ছে হুবহু সরোজের দ্বিতীয় সংস্করণ। সেই নাক, সেই চোখ, সেই মন, সেই প্রাণ! এই ছোকরা কর্মক্ষেত্রে বড়োলোক হতে পারে, কিন্তু কাব্যজগতে এর বিশেষ কোনো স্থান নেই। সরোজের মতো এরও মন বাঁধা ও সোজা পথ ছাড়া গলিঘুঁজিতে চলতে চায় না। এর চরিত্রে ও মনে বেতালা বলে কোনো জিনিস নেই। আমার ভয় হয় এই যে, এর মনের ছন্দকে আমি শেষটা মুক্ত-ছন্দ না করে দিই। কারণ, তা হলে অতুল আর সে মুক্তির তাল সামলাতে পারবে না। হাঁটা এক কথা, আর বাঁশবাজি করা আলাদা। কিন্তু অতুলকে এক ধাক্কায় সাহিত্যজগৎ থেকে কর্মক্ষেত্রে নামিয়ে দেওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ তা করতে গেলে লতিকার মস্ত একটা illusion ভেঙে দিতে হবে, আর সঙ্গে সঙ্গে নিজের ঘরেও অশান্তির সৃষ্টি হবে। আমার স্ত্রী হচ্ছেন লতিকার বাল্যবন্ধু ও প্রিয়সখী। অতুলকে সরস্বতী ছেড়ে লক্ষ্মীর সেবা করতে বললে আমাকে দুবেলা এই কথা শুনতে হবে যে, পরের জন্যে কিছু করা আমার ধাতে নেই। তাই নানাদিক ভেবেচিন্তে আমি তাকে কবিতা-রচনায় লাগিয়ে দিলুম। জানতুম ও বাঁধা ছন্দে, বাঁধি গতে যা-হয়-একটা-কিছু খাড়া করে তুলবে। এই হচ্ছে ‘পিয়া ও পাপিয়া’র জন্মকথা। এ কবিতা ছাপার অক্ষরে ওঠবার ফলে লতিকা ওকে পাঁচশো টাকা দিয়ে এক সেট শেক্সপিয়ার কিনে দিয়েছে। মনে ভেবো না যে, অতুলের মায়ের খাতিরে আমি তার মাথা খাচ্ছি। ও ছেলের মাথা কেউ খেতে পারবে না। অতুলের ভিতর কবিত্ব না থাক্‌ মনুষ্যত্ব আছে, আর সে মনুষ্যত্বের পরিচয় ও জীবনের নানা ক্ষেত্রে দেবে। ও যখন জীবনে নিজের পথ খুঁজে পাবে, তখন কবিতা লেখবার বাজে শখ ওর মিটে যাবে। আর, তখনো যদি ওর কলম চালাবার ঝোঁক থাকে তো আমি যা লিখি নি—কেননা লিখতে পারি নি—ও তাই লিখবে; অর্থাৎ হয় দশ ভল্যুম ইতিহাস, নয় পাঁচ ভল্যুম দর্শন। পদ্য লেখার মেহন্নতে ওর গদ্যের হাত তৈরি হবে।

    “ওর অন্তরে যে কবিত্ব নেই, তার কারণ ওর বাপের অন্তরে তা ছিল না, ওর মার অন্তরেও তা নেই—অবশ্য কবিত্ব মানে যদি sentimentalism হয়।

    “এখন যে কথা থেকে শুরু করেছিলুম সেই কথায় ফিরে যাওয়া যাক। আমার প্রতি লতিকার এই অদ্ভুত শ্রদ্ধার মূলে কি আছে? এ মনোভাবের রূপই বা কি, নামই বা কি? একে ঠিক ভক্তিও বলা যায় না, প্রীতিও বলা যায় না। সুতরাং এ হচ্ছে ভক্তি ও প্রীতি-রূপ মনের দুটি সুপরিচিত মনোভাবের মাঝামাঝি সাইকোলজির একটি বাঁকা রেখা।

    “আর এ যদি ভক্তিমূলক প্রীতি অথবা প্রীতিমূলক ভক্তি হয়, তা হলেও সে ভক্তি- প্রীতি কোনো রক্তমাংসে-গড়া ব্যক্তির প্রতি নয়, অর্থাৎ ও মনোভাব আমার প্রতি নয়; কিন্তু লতিকার মগ্ন-চৈতন্যে ধীরে ধীরে অলক্ষিতে যে কাল্পনিক সুরনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় গড়ে উঠেছে, তারই প্রতি—অর্থাৎ একটা ছায়ার প্রতি, যে ছায়ার এ পৃথিবীতে কোনো কায়া নেই। আমি শুধু তার উপলক্ষ মাত্র। আমার অনেক সময়ে মনে হয় যে, তার মনে আমার প্রতি এই অমূলক ভক্তির মূলে আছে আমার প্রতি তার আত্মীয়-স্বজনের সেকালের সেই অযথা অভক্তি। এ হচ্ছে সেই অপবাদের প্রতিবাদ মাত্র। এ প্রতিবাদ তার মনে তার অজ্ঞাতসারে আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে। দেখছ এর ভিতর কোনো রোমান্স নেই, কেননা, এর ভিতর যা আছে, সে মনোভাব অস্পষ্ট—অতুলের মধ্যস্থতাই একমাত্র স্পষ্ট জিনিস।”

    “রোমান্স নেই সত্য, কিন্তু এই একই ব্যাপারের ভিতর ট্রাজেডি থাকতে পারে।”

    “কিরকম?”

    “আমি এইরকম আর-একটি ব্যাপার জানি, যা শেষটা ট্রাজেডিতে পরিণত হয়েছিল। আজ থাক্, সে গল্প আর-এক দিন বলব। কত ক্ষুদ্র ঘটনা মানুষের মনে যে কত বড়ো অশান্তির সৃষ্টি করতে পারে, তা সে গল্প শুনলেই বুঝতে পারবে।”

    ভাদ্র ১৩৩৪

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.