Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প460 Mins Read0

    একটি সাদা গল্প

    একটি সাদা গল্প

    আমরা পাঁচজনে গল্প লেখার আর্ট নিয়ে মহা তর্ক করছিলুম, এমন সময়ে সদানন্দ এসে উপস্থিত হলেন। তাতে অবশ্য তর্ক বন্ধ হল না, বরং আমরা দ্বিগুণ উৎসাহে তা চালাতে লাগলুম—এই আশায় যে, তিনি এ আলোচনায় যোগ দেবেন; কেননা আমরা সকলেই জানতুম যে, এই বন্ধুটি হচ্ছেন একজন ঘোর তার্কিক। এম.এ. পাস করবার পর থেকে অদ্যাবধি এক তর্ক ছাড়া তিনি আর-কিছু করেছেন বলে আমরা জানি নে। কিন্তু তিনি, কেন জানি নে, সেদিন একেবারে চুপ করে রইলেন। শেষটা আমরা সকলে এক-বাক্যে তাঁর মত জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন, “আমি একটি গল্প বলছি শোনো, তার পর সারা রাত ধরে তর্ক করো। তখন সে তর্ক ফাঁকা তর্ক হবে না।”

    সদানন্দের কথা

    আমি যে গল্প বলতে যাচ্ছি, তা অতি সাদাসিধে। তার ভিতর কোনো নীতিকথা কিংবা ধর্মকথা নেই, কোনো সামাজিক সমস্যা নেই—অতএব তার মীমাংসাও নেই, এমন-কি, সত্য কথা বলতে গেলে কোনো ঘটনাও নেই। ঘটনা নেই বলছি এইজন্যে যে, যে ঘটনা আছে তা বাঙলা দেশে নিত্য ঘটে থাকে—অর্থাৎ ভদ্রলোকের মেয়ের বিয়ে। আর হাজারে নশো নিরেনব্বইটি মেয়ের যে ভাবে বিয়ে হয়ে থাকে এ বিয়েও ঠিক সেই ভাবে হয়েছিল—অর্থাৎ এ ব্যাপারের মধ্যে পূর্বরাগ অনুরাগ প্রভৃতি গল্পের খোরাক কিছুই ছিল না। তোমরা জিজ্ঞেস করতে পার যে, যে ঘটনার ভিতর কিছুমাত্র বৈচিত্র্য কিংবা নূতনত্ব নেই তার বিষয় বলবার কি আছে? এ কথার আমি ঠিক উত্তর দিতে পারি নে। তবে এই পর্যন্ত জানি যে, যে ঘটনা নিত্য ঘটে এবং বহুকাল থেকেই ঘটে আসছে, হঠাৎ এক-এক দিন তা যেন অপূর্ব অদ্ভুত বলে মনে হয়; কিন্তু কেন যে হয়, তাও আমরা বুঝতে পারি নে। যে বিয়েটির কথা তোমাদের আমি বলতে যাচ্ছি তা মামুলি হলেও আমার কাছে একেবারে নূতন ঠেকেছিল। তাই চাইকি তোমাদের কাছেও তা অদ্ভুত মনে হতে পারে, সেই ভরসায় এ গল্প বলা।

    এ গল্প হচ্ছে শ্যামবাবুর মেয়ের বিয়ের গল্প। শ্যামবাবুর পুরো নাম শ্যামলাল চাটুজ্যে, এবং তিনি আমার গ্রামের লোক।

    শ্যামলাল যে বৎসর হিস্টরির এম.এ. তে ফার্স্ট হন, তার পরের বৎসর যখন তিনি ফার্স্ট ডিভিসনে বি.এল. পাস করে কলেজ থেকে বেরোলেন, তখন তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা তাঁকে হাইকোর্টের উকিল হবার জন্য বহু পীড়াপীড়ি করেন। শ্যামলাল যে দশ-পনেরো বৎসরের মধ্যেই হাইকোর্টের একজন হয় বড়ো উকিল, নয় অন্তত জজ হবেন, সে বিষয়ে তাঁর আপনার লোকের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। কেননা যা যা থাকলে মানুষ জীবনে কৃতী হয়, শ্যামলালের তা সবই ছিল-সুস্থ শরীর, ভদ্র চেহারা, নিরীহ প্রকৃতি, স্থির বুদ্ধি, কাজে গা ও কাজে মন। কিন্তু শ্যামলাল তাঁর আত্মীয়স্বজনের কথা রাখলেন না। উকিল হতে তাঁর এমন অপ্রবৃত্তি হল যে কেউ তাঁকে তাতে রাজি করাতে পারলেন না; এ অনিচ্ছার কারণও কেউ বুঝতে পারলেন না। তাঁর আত্মীয়েরা শুধু দেখতে পেলেন যে, উকিল হবার কথা শুনলেই একটা অস্পষ্ট ভয়ে তিনি অভিভূত হয়ে পড়তেন। তাই তাঁরা ধরে নিলেন যে এ হচ্ছে সেই জাতের ভয় যা থাকার দরুন কোনো কোনো মেয়ে হুডুকো হয়; ও একটা ব্যারামের মধ্যে; সুতরাং কি বকে-ঝকে, কি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, কোনোমতে ও রোগ সারানো যাবে না। অতঃপর তাঁরা হার মেনে শ্যামলালকে ছেড়ে দিলেন; তিনিও অমনি মুন্সেফি চাকরি নিলেন।

    তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা যাই ভাবুন, শ্যামলাল কিন্তু নিজের পথ ঠিক চিনে নিয়েছিলেন। যার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না, অনেক সময়ে দেখতে পাওয়া যায়, সেই অবাধ্য প্রবৃত্তি কিংবা অপ্রবৃত্তিগুলোই মানুষের প্রধান সুহৃৎ। শ্যামলাল হাইকোর্টে ঢুকলে উপরে ওঠা দূরে থাক্, একেবারে নীচে তলিয়ে যেতেন। তাঁর ঘাড়ে কেউ কোনো কাজ চাপিয়ে দিলে এবং তা করবার বাঁধাবাঁধি পদ্ধতি দেখিয়ে দিলে শ্যামলাল সে কাজ পুরোপুরি এবং আগাগোড়া নিখুঁতভাবে করতে পারতেন। কিন্তু নিজের চেষ্টায় জীবনে নিজের পথ কেটে বেরিয়ে যাবার সাহস কি শক্তি তাঁর শরীরে লেশমাত্র ছিল না। পৃথিবীতে কেউ জন্মায় চরে খাবার জন্য, কেউ জন্মায় বাঁধা খাবার জন্য। শ্যামলাল শেষোক্ত শ্রেণীর জীব ছিলেন।

    পৃথিবীতে যত রকম চাকরি আছে, তার মধ্যে এই মুন্সেফিই ছিল তাঁর পক্ষে সব চাইতে উপযুক্ত কাজ। এ কাজে ঢোকার অর্থ কর্মজীবনে প্রবেশ করা নয়, ছাত্রজীবনেরই মেয়াদ বাড়িয়ে নেওয়া। অন্তত শ্যামলালের বিশ্বাস তাই ছিল, এবং সেই সাহসেই তিনি ঐ কাজে ভর্তি হন। এতে চাই শুধু আইন পড়া আর রায় লেখা। পড়ার তো তাঁর আশৈশব অভ্যাস ছিল, আর রায় লেখাকে তিনি এগজামিনের প্রশ্নপত্রের উত্তর লেখা হিসেবে দেখতেন। ইউনিভারসিটির এগজামিনের চাইতে এ এগজামিন দেওয়া তাঁর পক্ষে ঢের সহজ ছিল, কারণ এতে বই দেখে উত্তর লেখা যায়।

    ২

    চাকরির প্রথম পাঁচ বৎসর তিনি চৌকিতে চৌকিতে ঘুরে বেড়ান। সে-সব এমন জায়গা যেখানে কোনো ভদ্রলোকের বসতি নেই, কাজেই কোনো ভদ্রলোক তাদের নাম জানে না। শ্যামলালের মনে কিন্তু সুখ সন্তোষ দুইই ছিল। জীবনে যে দুটি কাজ তিনি করতে পারতেন—পড়া মুখস্থ করা এবং পরীক্ষা দেওয়া—এ ক্ষেত্রে সে-দুটির চর্চা করবার তিনি সম্পূর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন। এই পাঁচ বৎসরের মধ্যে Tenancy Act. Limitation Act এবং Civil Procedure Code এর তিনি এতটা জ্ঞান সঞ্চয় করেছিলেন যে, সে পরিমাণ মুখস্থবিদ্যা যদি হাইকোর্টের সকল জজের থাকত তা হলে কোনো রায়ের বিরুদ্ধে আর বিলেত-আপীল হত না।

    শ্যামলালের স্ত্রী বরাবর তাঁর সঙ্গেই ছিলেন; কিন্তু তাঁর মনে সুখও ছিল না, সন্তোষও ছিল না; কেননা যে-সব জিনিসের অভাব শ্যামলাল একদিনের জন্যও বোধ করেন নি, তাঁর স্ত্রী সে-সকলের—অর্থাৎ আত্মীয়স্বজনের অভাব, মেলামেশার লোকের অভাব, এমন-কি, কথা কইবার লোকের পর্যন্ত অভাব প্রতিদিন বোধ করতেন।

    চাকরির প্রথম বৎসর না যেতেই শ্যামলালের একটি ছেলে হয়। সেই ছেলে হবার পর থেকেই তাঁর স্ত্রী শুকিয়ে যেতে লাগলেন, ফুল যেমন করে শুকিয়ে যায়, তেমনি করে অর্থাৎ অলক্ষিতে এবং নীরবে। শ্যামলাল কিন্তু তা লক্ষ্য করলেন না। শ্যামলাল ছিলেন এক-বুদ্ধির লোক। তিনি যে কাজ হাতে নিতেন, তাতেই মগ্ন হয়ে যেতেন; তার বাইরের কোনো জিনিসে তাঁর মনও যেত না, তাঁর চোখও পড়ত না। তা ছাড়া তাঁর স্ত্রীর অবস্থা কি হচ্ছে, তা লক্ষ্য করবার তাঁর অবসরও ছিল না। ঘুম থেকে উঠে তিনি রায় লিখতে বসতেন; সে লেখা শেষ করে তিনি আপিসে যেতেন; আপিস থেকে ফিরে এসে আইনের বই পড়তেন; তার পর রাত্তিরে আহারান্তে নিদ্রা দিতেন। তাঁর স্ত্রী এই বনবাস থেকে উদ্ধার পাবার জন্য স্বামীকে কোনো লোকালয়ে বদলি হবার চেষ্টা করতে বারবার অনুরোধ করতেন, কিন্তু শ্যামলাল বরাবর একই উত্তর দিতেন। তিনি বলতেন, “তোমরা স্ত্রীলোক, ও-সব বোঝ না; চেষ্টা-চরিত্তির করে এসব জিনিস হয় না। কাকে কোথায় রাখবে, সে-সব উপরওয়ালারা সব দিক ভেবেচিন্তে ঠিক করে। তার আর বদল হবার জো নেই।” আসল কথা এই যে, তিনি বদলি হবার কোনো আবশ্যকতা বোধ করতেন না, কেননা তাঁর কাছে লোকসমাজ বলে কোনো পদার্থের অস্তিত্বই ছিল না। আর তা ছাড়া সাহেব-সুবোর কাছে উপস্থিত হয়ে দরবার করা তাঁর সাহসে কুলোত না। তাঁর স্ত্রী অবশ্য এতে অত্যন্ত দুঃখিত হতেন, কেননা তিনি এ কথা বুঝতেন না যে, নিজ চেষ্টায় কিছু করা তাঁর স্বামীর পক্ষে অসম্ভব।

    ফলে, আলো ও বাতাসের অভাবে ফুল যেমন শুকিয়ে যায়, শ্যামলালের স্ত্রী তেমনি শুকিয়ে যেতে লাগলেন। আমি ঘুরে ফিরে ঐ ফুলের তুলনাই দিচ্ছি, তার কারণ শুনতে পাই সেই ব্রাহ্মণকন্যা শরীরে ও মনে ফুলের মতোই সুন্দর, ফুলের মতোই সুকুমার ছিলেন, এবং তাঁর বাঁচবার জন্য আলো ও বাতাসের দর্শন ও স্পর্শনের প্রয়োজন ছিল। ছেলে হবার চার বৎসর পর তিনি একটি কন্যাসন্তান প্রসব করে আঁতুড়েই মারা গেলেন।

    তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুতে শ্যামলাল অতিশয় কাতর হয়ে পড়লেন। তিনি তাঁর স্ত্রীকে যে কত ভালোবাসতেন তা তিনি স্ত্রী বর্তমানে বোঝেন নি, তার অভাবেই মর্মে মর্মে অনুভব করলেন। জীবনে তিনি এই প্রথম শোক পেলেন; কেননা তাঁর মা ও বাবা তাঁর শৈশবেই মারা যান, এবং তাঁর কোনো ভাইবোন কখনো জন্মায় নি, সুতরাং মরেও নি। সেইসঙ্গে তিনি এই নতুন সত্যের আবিষ্কার করলেন যে, মানুষের ভিতর হৃদয় বলে একটা জিনিস আছে—যা মানুষকে শাসন করে, এবং মানুষে যাকে শাসন করতে পারে না।

    স্ত্রীর মৃত্যুতে শ্যামলাল এতটা অভিভূত হয়ে পড়লেন যে তিনি নিশ্চয়ই কাজকর্মের বার হয়ে যেতেন, যদি-না তাঁর একটি চার বৎসরের ছেলে আর একটি চার দিনের মেয়ে থাকত। তাঁর মন ইতিমধ্যে তাঁর অজ্ঞাতসারে জীবনের মধ্যে অনেকটা শিকড় নামিয়েছিল। তিনি দেখলেন যে, এই দুটি ক্ষুদ্র প্রাণী নিতান্ত অসহায়, এবং তিনি ছাড়া পৃথিবীতে এদের অপর কোনো সহায় নেই। তাঁর নব-আবিষ্কৃত হৃদয় তাঁর চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে যে, চাকরির দাবি ছাড়া পৃথিবীতে আরো পাঁচ রকমের দাবি আছে, এবং কলেজ ও আদালতের পরীক্ষা ছাড়া মানুষকে আরো পাঁচ রকমের পরীক্ষা দিতে হয়। তাঁর মনে এই ধারণা জন্মাল যে, তিনি তাঁর স্ত্রীকে অবহেলা করেছেন; এ জ্ঞান হওয়ামাত্র তিনি মনস্থির করলেন যে, তাঁর ছেলে-মেয়ের জীবনের সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি নিজের এবং একমাত্র নিজের ঘাড়েই নেবেন। স্বামী হিসেবে তাঁর কর্তব্য না-পালন করা রূপ পাপের প্রায়শ্চিত্ত তিনি সন্তানপালনের দ্বারা করতে দৃঢ়সংকল্প হলেন।

    এই জীবনের পরীক্ষা তিনি কি ভাবে দিয়েছিলেন এবং তার ফলাফল কি হয়েছিল, সেই কথাটাই হচ্ছে এ গল্পের মোদ্দা কথা

    ৩

    শ্যামলাল আর বিবাহ করেন নি। তার কারণ, প্রথমত তাঁর এ বিষয়ে প্রবৃত্তি ছিল না, দ্বিতীয়ত তিনি তা অকর্তব্য মনে করতেন। তার পর তাঁর মেয়েটির মুখের দিকে তাকালে, আবার নতুন এক স্ত্রীর কথা মনে হলে তিনি আঁৎকে উঠতেন। তাঁর মনে হত, ঐ মেয়েটিতে তাঁর স্ত্রী তার শরীরমনের একটি জীবন্ত স্মরণচিহ্ন রেখে গিয়েছে।

    কোনো কাজ হাতে নিয়ে তা আধা-খোঁড়া ভাবে করা শ্যামলালের প্রকৃতিবিরুদ্ধ, সুতরাং এই সন্তান-লালনপালনের কাজ তিনি তাঁর সকল মন সকল প্রাণ দিয়ে করেছিলেন। শ্যামলাল যেমন তাঁর সকল মন একটি জিনিসের উপর বসাতে পারতেন, তেমনি তিনি তাঁর সকল হৃদয় দুটি-একটি লোকের উপরও বসাতে পারতেন। এক্ষেত্রে তাঁর সকল হৃদয় তাঁর ছেলে-মেয়ে অধিকার করে বসেছিল, সুতরাং তাঁর হৃদয়বৃত্তির একটি পয়সাও বাজে খরচে নষ্ট হয় নি। ফলে, তাঁর ছেলে ও মেয়ে শরীর ও মনে অসাধারণ সুস্থ ও বলিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। কেননা এ কাজে শ্যামলালের ভালোবাসা তাঁর কর্তব্যবুদ্ধির প্রবল সহায় হয়েছিল।

    তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি চৌকির হাত থেকে উদ্ধার পেয়ে, বছর-দশেক মহকুমায় মহকুমায় ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। কিন্তু সে-সব দুর্গম স্থানে—পটুয়াখালি দক্ষিণ- শাহাবাজপুর কক্সবাজার জেহানাবাদ প্রভৃতিই ছিল তাঁর কর্মস্থল। আজ এখানে, কাল ওখানে—এই কারণে তিনি তাঁর ছেলেকে স্কুলে দিতে পারেন নি, ঘরে রেখে নিজেই পড়িয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, বিদ্যাবুদ্ধিতে তাঁর সঙ্গে ও-সব জায়গার কোনো স্কুল- মাস্টারের তুলনাই হতে পারে না। ফলে বীরেন্দ্রলাল যখন পনেরো বৎসর বয়সে প্রাইভেট স্টুডেন্ট হিসেবে ম্যাট্রিকুলেশান দিলে তখন সে অক্লেশে ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করলে।

    শ্যামলাল তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর আবার বই পড়তে শুরু করলেন—কিন্তু আইনের নয়। তার কারণ, ইতিমধ্যে আগাগোড়া দেওয়ানী আইন মায় নজির তাঁর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, সুতরাং নূতন Law Reports ছাড়া তাঁর আর কিছু পড়বার প্রয়োজন ছিল না। কিন্তু বই পড়া ছাড়া সন্ধেটা কাটাবার আর কোনো উপায়ও ছিল না। সুতরাং শ্যামলাল হিস্টরি পড়তে শুরু করলেন, কেননা সাহিত্যের মধ্যে একমাত্র হিস্টরিই ছিল তাঁর প্রিয় বস্তু। ঐ হিস্টরিই ছিল তাঁর কাব্য, তাঁর দর্শন, তাঁর নভেল, তাঁর নাটক। তিনি ছুটির সময় এক-একবার কলকাতায় গিয়ে সেকেণ্ড-হ্যাণ্ড বইয়ের দোকান থেকে সস্তায় হিস্টরির যে বই পেতেন তাই কিনে আনতেন, তা সে যে দেশেরই হোক, যে যুগেরই হোক আর যে লেখকেরই হোক। ফলে, তাঁর কাছে সেই-সব ইতিহাসের কেতাব জমে গিয়েছিল যা এ দেশে আর কেউ বড়ো একটা পড়ে না। যথা, Gibbon’s Decline and Fall, Mill’s History of India, Grote’s Greece, Plutarch’s Lives, Macaulay’s History of Engladn, Lamartine’s History of the Girondists, Michelet’s French Revolution, Cunningham’s History of the Sikhs, Tod’s Rajasthan ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তাঁর পুত্র বীরেন্দ্রলাল বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই ভালো করে বুঝুক আর না বুঝুক, এই-সব বই পড়তে শুরু করেছিল; এবং পড়তে পড়তে শুধু ইতিহাসে নয় ইংরেজিতেও সুপণ্ডিত হয়ে উঠেছিল। অর্থাৎ বীরেন্দ্রলাল নিজের শিক্ষার ভার নিজের হাতে নিয়েছিল; কিন্তু শ্যামলাল তা লক্ষ্য করেন নি।

    ম্যাট্রিকুলেশান পাস করবার পর শ্যামলাল ছেলেকে কলেজে পড়বার জন্য কলকাতায় পাঠাতে বাধ্য হলেন, এবং সঙ্গে সঙ্গে তিনিও বেহারে বদলি হয়ে গেলেন। তার পর চার বৎসরের মধ্যে বীরেন্দ্রলাল অবলীলাক্রমে ফার্স্ট ডিভিসনে আই. এ. এবং বি. এ. পাস করলে। তাঁর ছেলের পরীক্ষা পাস করবার অসাধারণ ক্ষমতা দেখে শ্যামলাল মনস্থির করলেন যে, তাকে এম. এ. পাসের পর সিভিল সার্ভিসের জন্য বিলেতে পাঠাবেন। বীরেন্দ্রলাল যে সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে, সে বিষয়ে তার বাপের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।

    বিলেতে ছেলে পড়াবার টাকারও তাঁর সংস্থান ছিল। শ্যামলাল জানতেন যে, খাওয়ার উদ্দেশ্য জীবন ধারণ করা এবং পরার উদ্দেশ্য লজ্জা নিবারণ করা; সুতরাং তাঁর সংসারে কোনোরূপ অপব্যয় কিংবা অতিব্যয় ছিল না। কাজেই তাঁর হাতে দশ- বারো হাজার টাকা জমে গিয়েছিল।

    ছেলে কলকাতায় পড়তে যাবার পর থেকে শ্যামলালের দৈনিক জীবনের একমাত্র অবলম্বন হল তাঁর কন্যা। ইতিমধ্যে পড়ানো তাঁর এমনি অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল যে, কাউকে না কিছু পড়িয়ে তিনি আর একদিন থাকতে পারতেন না। কাজেই তিনি তাঁর সকল অবসর তাঁর এই কন্যার শিক্ষায় নিয়োগ করলেন। তাঁর যত্নে, তাঁর শিক্ষায়, তাঁর মেয়ের মন—ফুল যেমন উপরের দিকে আলোর দিকে মাথা তুলে ফুটে ওঠে, সেই রকম ফুটে উঠতে লাগল। লোকালয়ের বাইরে থাকায় তার চরিত্রও ফুলের মতো শুভ্র এবং ফুলের মতোই নিষ্কলঙ্ক হয়ে উঠেছিল। শ্যামলাল, তাঁর মেয়েকে এত লেখাপড়া শেখাবার এত বড়ো করে রাখবার ভবিষ্যৎ ফল যে কি হবে তা ভাববার অবসর পান নি। তাঁর মনে শুধু একটি অস্পষ্ট ধারণা ছিল যে, একদিন তাঁর মেয়ের বিবাহ দিতে হবে; তবে কবে এবং কার সঙ্গে, সে বিষয়ে তিনি কখনো কিছু চিন্তা করেন নি। তাঁর বিশ্বাস ছিল যে তাঁর মেয়ের বিয়ের ভাবনা নেই; অমন স্ত্রী পেলে যে-কোনো সুশিক্ষিত এবং সচ্চরিত্র যুবক নিজেকে ধন্য মনে করবে। আসল কথা, সমাজ বলে যে একটি জিনিস আছে, সে কথাটা তিনি সমাজ থেকে দূরে এবং আলগা থাকার দরুন একরকম ভুলেই গিয়েছিলেন। তাঁর মেয়ে যে অনায়াসে Tod’s Rajasthan এবং Plutarch’s Lives পড়তে পারে, এতেই তিনি তাঁর জীবন সার্থক মনে করতেন। ফলে, তাঁর ছেলে যখন এম. এ. দেবার উদ্যোগ করছে, তখন তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবার কোনো উদ্যোগ করলেন না; যদিচ তখন তার বয়েস প্রায় ষোলো। তাঁর মেয়ের জন্য যে একটি স্বামী-দেবতা কোনো অজ্ঞাত গোকুলে বাড়ছে এবং সে স্বামী যে দেবতুল্য হবে, সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনো সন্দেহ ছিল না।

    এই সময়ে শ্যামলালের জীবনে একটি অপূর্ব ঘটনা ঘটল। একদিন তিনি তাঁর কর্মস্থলে তারে খবর পেলেন যে বীরেন্দ্রলাল কোনো পলিটিকাল অপরাধে কলকাতায় গ্রেপ্তার হয়েছে। সেইসঙ্গে তাঁর বাড়িও খানাতল্লাসী হল। তাঁর ছেলের যে কস্মিনকালে ফৌজদারী আদালতে বিচার হতে পারে, এ কথা তিনি কখনো স্বপ্নেও ভাবেন নি। সুতরাং এ সংবাদে তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়লেন। ব্যাপারটা তাঁর কাছে এতই নতুন লাগল যে, এ ক্ষেত্রে তাঁর কি করা কর্তব্য তিনি ঠাউরে উঠতে পারলেন না।

    এর পর শ্যামলালের দেহমনে এমন অবসাদ, এমন জড়তা এসে পড়ল যে তাঁর পক্ষে আর কাজ করা সম্ভব হল না। তিনি এক বৎসরের ছুটির দরখাস্ত করলেন; এবং সে দরখাস্ত তখনই মঞ্জুর হল। কেননা উপরওয়ালাদের মতে তাঁর ছেলের মতিভ্রংশতার জন্য শ্যামলাল যে কতকটা দায়ী, তার প্রমাণ তাঁর ঘরের বই। এ শুনে শ্যামলাল অবাক হয়ে গেলেন। তিনি জানতেন, হিস্টরি হচ্ছে শুধু পড়বার জিনিস, মানুষের জীবনের সঙ্গে তার যে কোনো যোগাযোগ থাকতে পারে এ কথা পূর্বে কখনো তাঁর মনে হয় নি।

    নূতনের সঙ্গে কারবার করবার অভ্যাস তাঁর ছিল না। কাজেই তাঁকে তাঁর মেয়ের পরামর্শমত চলতে হল। তিনি উকিল-কৌসুলি দিয়ে বীরেন্দ্রলালকে রক্ষা করবার চেষ্টা করলেন। ফলে, তাঁর ছেলে রক্ষা পেলে না; মধ্যে থেকে তাঁর যা-কিছু টাকা ছিল, সব উকিল-কৌসুলির পকেটে গেল। এই নতুনের সংঘর্ষে শ্যামলালের জীবনের জোড়া- সুখস্বপ্নের মধ্যে একটি ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, আর তাঁর কন্যার ফুটন্ত ফুলের মতো মনটির উপর বরফ পড়ে গেল।

    ৪

    ছুটি নিয়ে শ্যামলাল বাড়ি যাবেন স্থির করলেন। আজ বিশ বৎসর পর তাঁর মনে আবার দেশের মায়া জেগে উঠল। তাঁর মনে ছেলেবেলাকার সুখের স্মৃতি সব ফিরে এল; তাঁর মনে হল, তাঁর পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটাই হচ্ছে পৃথিবীতে একমাত্র স্থান যেখানে শান্তি আছে—ও যেন মায়ের কোল। শ্যামলাল সেই মায়ের কোলে ফিরে গেলেন। কিন্তু তাঁর কপালে সেখানেও শান্তি জুটল না।

    দেশে পদার্পণ করবামাত্র তিনি ঘোরতর অশান্তির মধ্যে পড়ে গেলেন। তাঁর আত্মীয়স্বজনেরা একবাক্যে তাঁকে ছি ছি করতে লাগল। মেয়ে এত বড়ো হয়েছে অথচ বিয়ে হয় নি, তার উপর সে আবার পুরুষের মতো লেখাপড়া জানে—এই দুই অপরাধে তাঁর মেয়েকেও দিবারাত্র নানারূপ লাঞ্ছনাগঞ্জনা সহ্য করতে হল।

    এই লোকনিন্দায় শ্যামলাল এতটা ভয় পেয়ে গেলেন যে, তিনি মেয়ের বিয়ের জন্য একেবারে উতলা হয়ে উঠলেন। পাঁচজনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শক্তি শ্যামলালের ধাতে ছিল না।

    তাঁর মেয়ের জন্য পাত্র খোঁজার ভার শ্যামলাল তাঁর খুড়োর হাতে দিলেন। তাঁর খালি এই একটি শর্ত ছিল যে, পাত্র পাস-করা ছেলে হওয়া চাই। তাঁর মেয়ে যে মূর্খের হাতে পড়বে, এ কথা ভাবতেও তাঁর বুকের রক্ত জল হয়ে যেত।

    কিন্তু তাঁর এ পণ বেশি দিন টিকল না, কেননা ও মেয়েকে বিয়ে করতে কোনো পাস-করা যুবক স্বীকৃত হল না।

    কারো কারো নারাজ হবার কারণ হল, মেয়ের বয়েস। যদিচ তার বয়েস তখন ষোলো তবু জনরবে স্থির হল বিশ। এও শ্যামলালের খুড়োর দোষে। তিনি প্রমাণ করতে চাইলেন শ্রীমতীর বয়েস বারো, পশ্চিমের আবহাওয়ার গুণে বাড়টা কিছু বেশি হয়েছে বলে দেখতে ষোলো দেখায়। তিনি যদি নাতনীর বয়স চার বৎসর কমাতে না চেষ্টা করতেন তা হলে আমার বিশ্বাস লোকমুখে তা চার বৎসর বেড়ে যেত না।

    কারো-বা নারাজ হবার কারণ, মেয়ের শিক্ষা। ইংরেজি-পড়া মেয়ে যে মেম হয়েছে, সে বিষয়ে গ্রামের লোকের মনে কোনো সন্দেহ ছিল না। আর মেম-বউ ঘরে আনবার মতো বুকের পাটা ক’জনের আছে? অবশ্য এ ভয় পাবার কোনো কারণ ছিল না। বিলাসিতা শ্রীমতীর শরীরমনকে তিলমাত্রও স্পর্শ করে নি, এবং নেপথ্যবিধান করাটা যে নারীধর্ম এ জ্ঞান লাভ করবার তার কখনো সুযোগ ঘটে নি।

    অধিকাংশ পাত্রের নারাজ হবার কারণ, শ্যামলালের বরপণ দেবার অসামর্থ্য। তাঁর চিরজীবনের সঞ্চিত ধন তিনি বর্তমান উকিল-কৌসুলিদের দিয়ে বসেছিলেন, ভাবী উকিল-কৌসুলিদের জন্য কিছুই রাখেন নি।

    এর জন্য আমি কাউকে দোষ দিই নে, কেননা এ মেয়ে বিয়ে করতে আমিও রাজি হই নি; যদিচ আমি জানতুম যে, শ্যামলালের আমার উপরই সব চাইতে বেশি ঝোঁক ছিল। আমার নারাজ হবার একটু বিশেষ কারণ ছিল। শ্রীমতীর নামে গ্রামের লোকে নানারূপ কুৎসা রটিয়েছিল, তার কারণ, সে শুধু ষোড়শী নয়, অসাধারণ রূপসী। আমি অবশ্য সে কুৎসার এক বর্ণও বিশ্বাস করি নি; কিন্তু আমি বয়েসকে ভয় না করলেও রূপকে ভয় করতুম।

    সে যাই হোক, মাস পাঁচ-ছয় চেষ্টার পর শ্যামলাল এম. এ., বি. এ. জামাই পাবার আশা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। শেষটায় তিনি মেয়ের বিয়ের সম্পূর্ণ ভার খুড়োর হস্তে ন্যস্ত করলেন। শ্যামলাল অবশ্য তাঁর খুড়োকে ভক্তি করতেন না, কেননা তাঁর চরিত্রে ভক্তি করবার মতো কোনো পদার্থ ছিল না। কিন্ত শ্যামলাল বুঝলেন যে, যে বিষয়ে তিনি কাঁচা—অর্থাৎ সংসারজ্ঞান — সে বিষয়ে তাঁর খুড়ো শুধু পাকা নয়, একেবারে ঝুনো; অতএব তাঁর পক্ষে খুল্ল- তাতের উপর নির্ভর করাই শ্রেয়।

    কিন্তু এ ক্ষেত্রে খুড়োমহাশয়ের সকল চতুরতা ব্যর্থ হল, কেননা, তাঁর পিছনে টাকার জোর ছিল না। যেমন মাসের পর মাস যেতে লাগল, শ্যামলাল তত বেশি উদ্‌বিগ্ন ও তাঁর খুড়ো সেই পরিমাণে হতাশ হয়ে পড়তে লাগলেন; কেননা, মাসের পর মাস মেয়েরও বয়েস বেড়ে যেতে লাগল এবং সেই সঙ্গে এবং সেই অনুপাতে লোকনিন্দার মাত্রাও বেড়ে যেতে লাগল। এই পারিবারিক অশান্তির ভিতর একমাত্র প্রাণী যে শান্ত ছিল, সে হচ্ছে শ্রীমতী। এই-সব লাঞ্ছনা গঞ্জনা নিন্দা কুৎসা তাকে কিছুমাত্র বিচলিত করেনি। তার কারণ, তার মনের উপর যে বরফ পড়েছিল তা এতদিনে জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল। নিন্দাবাদ প্রভৃতি তুচ্ছ জিনিসের ক্ষুদ্র কষ্ট সে- মনকে স্পর্শ করতে পারত না। তার এই স্থির ধীর আত্মপ্রতিষ্ঠ ভাবকে গ্রামের লোক অহংকার বলে ধরে নিলে। এর ফলে শ্রীমতীর বিরুদ্ধে তাদের বিদ্বেষবুদ্ধি এতটা বেড়ে গেল যে, শ্যামলাল আর সহ্য করতে না পেরে মেয়েকে নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হলেন। তিনি মনে করলেন, মেয়ের কপালে যা লেখা থাকে তাই হবে, এ উপস্থিত উপদ্রবের হাত থেকে তাকে উদ্ধার করা তাঁর পক্ষে একান্ত কর্তব্য। শ্যামলাল খুড়োমহাশয়কে তাঁর অভিপ্রায় জানালেন, তিনিও তাতে কোনো আপত্তি করলেন না। খুড়োমহাশয় বুঝলেন, আর কিছুদিন থাকলে তাঁকে স্বীকার করতেই হবে যে, তিনি অকৃতকার্য হয়েছেন। কিন্তু সময় থাকতে যদি শ্যামলাল বিদায় হন তা হলে তিনি পাঁচজনকে বলতে পারবেন যে, শ্যামলাল অত অধীর না হলে তিনি নিশ্চয়ই তার মেয়ের ভালো বিয়ে দিয়ে দিতে পারতেন। অতঃপর পাঁজিপুথি দেখে শ্যামলালের যাত্রা করবার দিন স্থির হল।

    যেদিন শ্যামলালের বাড়ি ছাড়বার কথা ছিল, তার আগের দিন তাঁর খুড়োমহাশয় বেলা বারোটার সময় হাসতে হাসতে শ্যামলালের কাছে এসে বললেন, “বাবাজি! তোমাকে আর কাল বাড়ি ছাড়তে হবে না। তোমার মেয়ের বর ঠিক হয়ে গেছে। উপরে তো ভগবান আছেন, তিনি কি আমাদের পরিবারে একটা কলঙ্ক হতে দেবেন?”

    শ্যামলাল একেবারে আনন্দে অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কে?”

    “ক্ষেত্রপতি মুখুজ্যে।”

    “কোন্ ক্ষেত্রপতি মুখুজ্যে?”

    “আমাদের গ্রামের ক্ষেত্রপতি হে, দক্ষিণপাড়ায় যার বড়ো বাড়ি।”

    “আপনি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?”

    “মেয়ের বিয়েকে, বাবাজি, আমি নই, তুমিই রসিকতা মনে কর।”

    “বলেন কি, তার স্ত্রী তো আজ সবে তিনদিন হল মারা গেছে!”

    “সেইজন্যেই তো সে এই বিষয়ে প্রস্তাব করে পাঠিয়েছে। তার স্ত্রী বেঁচে থাকলে তো আর তুমি তোমার মেয়েকে সতীনের ঘর করতে পাঠাতে না।”

    “কিন্তু ক্ষেত্রপতি যে আমার একবয়সী?”

    “দোজবরে বলেই তো সে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। বিশ- একুশ বছরের মেয়েকে তো আর কোনো বিশ-একুশ বছরের ছেলে বিয়ে করবে না। এতদিন তো চেষ্টা করে দেখেছ।”

    “কিন্তু আমার মেয়ের বয়স তো আর বিশ-একুশ নয়।”

    “বাবাজি, আমার কাছে আর মিছে কথা বলে কি হবে? আমিই তো বলে বেড়াচ্ছি যে ওর বয়েস বারো কি তেরো। আসল বয়েস আর কেউ জানুক আর না জানুক—আমি তো জানি। তোমাকে তো সেদিন জন্মাতে দেখলুম, তুমি কি আমাকে ভোগা দিতে পার?”

    “কিন্তু ক্ষেত্রপতি যে আকাট মূর্খ, সে তো এন্‌ট্রান্সও পাস করে নি।”

    “সেইজন্যেই তো তোমার মেয়ে বিয়ে করতে সে রাজি হয়েছে। তোমার টাকা দেবার সামর্থ্য নেই আর বিনে পয়সায় পাস-করা ছেলে মেলে না, এর প্রমাণ তো হাজার বার পেয়েছ।”

    শ্যামলাল বুঝলেন যে তাঁর খুড়োর সঙ্গে আর তর্ক করা অসম্ভব, কেননা খুড়োমহাশয়ের কথাগুলো যে সবই সত্য, তা তিনি অস্বীকার করতে পারলেন না; অথচ এ বিবাহের প্রস্তাবে তাঁর হৃদয়মন একেবারে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তাঁর মনে হচ্ছিল যে, ক্ষেত্রপতির সঙ্গে বিয়ে দেওয়া আর শ্রীমতীকে জ্যান্ত গোর দেওয়া একই কথা। তাই তিনি চুপ করে রইলেন। তাঁর খুড়ো ধরে নিলেন যে, সে মৌন-সম্মতির লক্ষণ। তিনি অমনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়ে ক্ষেত্রপতিকে পাকা কথা দিয়ে এলেন। স্থির হল, ক্ষেত্রপতি তাঁর বিগত স্ত্রীর আদ্যশ্রাদ্ধ করেই আগত স্ত্রীকে ঘরে আনবেন।

    ক্ষেত্রপতির এ বিবাহ করবার আগ্রহের একমাত্র কারণ, শ্রীমতী সুন্দরী এবং কিশোরী। সুন্দরী স্ত্রীলোককে হস্তগত করবার লোভ ক্ষেত্রপতি জীবনে কখনো সংবরণ করতে পারেন নি; এবং এ ক্ষেত্রে বিবাহ ছাড়া শ্রীমতীকে আত্মসাৎ করবার উপায়ান্তর নেই জেনে তিনি তাকে বিবাহ করতে প্রস্তুত হলেন। এ বিষয়ে তাঁর কোনো দ্বিধা হল না, কেননা তিনি লোকনিন্দাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করতেন। তিনি গ্রামের কাউকে ভয় করতেন না, সকলে তাঁকে ভয় করত; তার কারণ তিনি পুলিসে চাকরি করতেন, তার উপর তাঁর দেহে বল, মনে সাহস ও ঘরে টাকা ছিল। এ তিন বিষয়ে গ্রামের কেউ তাঁর সমকক্ষ ছিল না।

    শ্যামলালের খুড়ো তাঁকে এসে যখন জানালেন যে তিনি ক্ষেত্রপতিকে পাকা কথা দিয়ে এবং বিয়ের দিন স্থির করে এসেছেন, তখন শ্যামলাল বললেন, “আপনি যাই বলুন, আর না বলুন, আমি এ বিবাহ কিছুতেই হতে দেব না, প্রাণ গেলেও নয়।”

    এ কথা শুনে খুড়োমহাশয় “ভদ্রলোককে কথা দিয়ে সে কথার আর কিছুতেই অন্যথা করা যেতে পারে না” এই বলে চীৎকার করতে লাগলেন। বাড়িতে হুলস্থুল পড়ে গেল। কিন্তু শ্যামলাল যে সেই “না” বলে চুপ করলেন, তার পর আর কোনো কথা কইলেন না। তার কারণ, হাজার চীৎকার করলেও তাঁর খুড়োর কোনো কথা শ্যামলালের কানে ঢুকছিল না; তাঁর শরীর মন ইন্দ্রিয় সব একেবারে অবশ অসাড় হয়ে গিয়েছিল, মাথায় বজ্রাঘাত হলে মানুষের যেমন হয়।

    এ মহাসমস্যার মীমাংসা শ্রীমতী করে দিলে। সকলের সকল কথা শুনে, সকল অবস্থা জেনে, শ্রীমতী বললে এ বিবাহ সে করবেই। সে বুঝেছিল যে, তার বিবাহ না হওয়াতক্ তার বাপের বিড়ম্বনার আর শেষ হবে না। তা ছাড়া সে কোনো দুঃখকষ্টকেই আর ভয় করত না, বরং তার মনে হত যে তার পক্ষে জীবনে নিজে সুখী হবার ইচ্ছাটাও একটা মহাপাপ, সে ইচ্ছাটা যেন তার নির্মম স্বার্থপরতার পরিচয় দেয়।

    শ্যামলাল অবশ্য মেয়ের মতে মত দিলেন, কিন্তু ব্যাপারখানা যে কি হল, তা তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। এইটুকু শুধু বুঝলেন যে, পুরাতনের সংঘর্ষে তাঁর জোড়া- সুখস্বপ্নের আর-একটিও ভেঙে চুরমার হয়ে গেল।

    এর পর এক মাস না যেতেই শ্যামলালের মেয়ের বিয়ে হল। সে বিবাহ-সভায় আমি উপস্থিত ছিলুম। সেই আমি প্রথম ও শেষ শ্রীমতীকে দেখি। তার রূপের খ্যাতি পূর্ব থেকেই শুনেছিলুম, কিন্তু যা দেখলুম তাতে মনে হল, সুন্দরী স্ত্রীলোক নয়—শ্বেতপাথরে খোদা দেবীমূর্তি; তার সকল অঙ্গ দেবতার মতোই সুঠাম, দেবতার মতোই নিশ্চল, আর তার মুখ দেবতার মতোই প্রশান্ত আর নির্বিকার। বর-কনে মানিয়েছিল ভালো, কেননা ক্ষেত্রপতিও যেমন বলিষ্ঠ তেমনি সুপুরুষ; তার বয়েস পঁয়তাল্লিশের উপর হলেও ত্রিশের বেশি দেখাত না, আর তার মুখও ছিল পাষাণের মতোই নিটোল ও কঠিন। আমার মনে হল, আমি যেন দুটি statueর বিয়ের অভিনয় দেখছি। বর-কনেতে যে মন্ত্র পড়ছিল, তা প্রথমে আমার কানে ঢোকে নি, তার পর হঠাৎ কানে এল ক্ষেত্রপতি বলছেন, “যদস্তু হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব।” এ কথা শোনামাত্র আমি উঠে চলে এলুম। বুঝলুম, এ অভিনয় সত্যিকার জীবনের, তবে তা comedy কি tragedy তা বুঝতে পারলুম না।

    অগ্রহায়ণ ১৩২৩

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.