Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গাছের পাতা নীল – আশাপূর্ণা দেবী

    আশাপূর্ণা দেবী এক পাতা গল্প298 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৪. সংসারের ঘটনা

    বিজয়াই ছেলেকে নিয়ে বসলেন।

    সংসারের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানিয়ে আক্ষেপ করলেন। সরোজাক্ষ যে বিজয়ার উপর শত্রুতা সাধতেই চাকরি ছেড়ে সংসারটাকে ভাসাতে বসেছেন, সেকথাও বলতে ছাড়লেন না।

    কমলাক্ষ অবশ্য ওটা মানল না।

    বলল, এ-ধারণার কোনও মানে হয় না তোমার। বাবা তো চিরদিনই ওইরকম অদ্ভুত আদর্শবাদী। একটা অবাস্তব পৃথিবীতেই বাস করলেন বরাবর। আর তোমরা কেই বা নয়? তুমি আছো তোমার নিজের বানানো এক অলৌকিক স্বর্গে, বাবা আছেন তাঁর আদর্শের পৃথিবীতে। আর আমরা, তোমাদের অভাগা সন্তানরা, মোহমুক্ত চোখ নিয়ে তোমাদের করুণা করছি। তা যাক, শ্ৰীমতী মীনাক্ষী দেবী গেলেন কোথায়? এসে পর্যন্ত তো তাঁর টিকি দেখছি না।

    মীনা?

    বিজয়া ঠোঁট উলটে ছোট ছেলের কাছে তাঁর ছোট মেয়ের পাখা গজানোর বার্তা শোনান এবং শিগগিরি যে সে একটা অজাত-কুজাতকে বিয়ে করে বসবে, এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেন।

    কমলাক্ষ মার কথাকে খুব একটা গুরুত্ব দেয় না বটে, কারণ বরাবরই জানে মার তিলকে তাল করা রোগ, তবে দাদা বউদির নতুন উন্নতির বিশদ খবরে চমকৃত না হয়ে পারে না। যা রটে তার কিছুও তো বটে।

    আর দিদি? দিদির খবর কী?

    দিদি!

    বিজয়া ঠোঁটের সেই একই ভঙ্গি করেন, তিনিও সুবিধে পেলে বউদির দলেই যান, তবে কিপটে বলেই একটু রক্ষে। দুটিতেই তো সমান কিপটে! আসে যায়, এক পয়সার মিষ্টি কখনও হাতে করে আসে না।

    মার এই একঘেয়ে কথা আর ভাল লাগছিল না কমলাক্ষর। তাই সে যাই, একটু ঘুরে আসি।বলে উঠে দাঁড়ায়।

    এখন আবার কোথায় ঘুরতে যাবি মাথায় ফেট্টি নিয়ে?

    মাথায় ফেট্টি? হু:, ওতে লজ্জা কী? ও তো বিজয়-গৌরবের স্বাক্ষর!

    বলে হাসতে হাসতে চলে যায় কমলাক্ষ।

    কিন্তু নীচতলায় সারদাপ্রসাদ ধরে।

    তোমার আর কবছর বাকি?

    আর এক বছর, কমলাক্ষ হেসে বলে, যদি অবশ্য ফেল না করি। কেন বলুন তো?

    সারদাপ্রসাদ বলে, অ্যাঁ? ফেল করবে কেন?

    পাশ করছি কেন এই ভেবেই তো অবাক হচ্ছি মাঝে মাঝে। সারা বছরই তো ফাঁকি দিই।

    সারদা গম্ভীর হয়।

    বলে, বাবার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা পয়সা। সে পয়সা এইভাবে অপচয় করো?

    কমলাক্ষও সহসা গম্ভীর হয়।

    বলে, হঠাৎ এ-প্রশ্নটা আপনার মাথায় উদয় হল যে?

    হওয়ার কারণ রয়েছে। তোমার বাবা কলেজ ছেড়ে দিয়েছেন জানো না বোধহয় তুমি!

    জানতাম না। মার কাছে জানলাম।

    তা এখন তো সংসারের কথা সকলকেই ভাবতে হবে, সারদাপ্রসাদ তার মুখে বেমানান একটা গাম্ভীর্য নিয়ে বলে, নীলু তো ঝেড়ে জবাব দিয়েছে।

    কমলাক্ষ হালকা গলায় বলে, বাবাকে ওই পাগলামিটা ছাড়তে হবে। আবার গিয়ে জয়েন করতে হবে।

    ছেড়ে দিয়ে আবার?

    সারদাপ্রসাদ অবাক চোখে তাকায়।

    কমলাক্ষ ওই অবাকটা বোঝে না। বলে, সেটা অসম্ভব নয়। বুঝিয়ে একটা চিঠি লিখলেই হবে। বললেই হবে হঠাৎ ঝোঁকের মাথায় কাজটা করেছিলাম

    তোমার বাবার কথা হচ্ছে কমল!

    সারদার গলা শান্ত শোনায়।

    কমলাক্ষ চঞ্চল হয়ে ওঠে। কমলাক্ষ অশান্ত গলায় বলে, বাবা তো চিরকালই একটা অবাস্তব বুদ্ধিতে চললেন। অন্য অন্য জায়গায় মাস্টাররা ঠেঙানি খেয়ে আবার হেঁট মুখে এসে কাজ করছে, আর বাবা একটু ঘেরাও হয়ে–আশ্চর্য! ঘেরাও আবার আজকাল কে না হচ্ছে? আচ্ছা আমি একটু বেরোচ্ছি।

    কমলাক্ষ বেরিয়ে যায়।

    পিছনের চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে দেখে না।

    দেখে না তাই ভাল। দেখলে চমকে যেত। সারদাপ্রসাদ নামের মানুষটার চোখে যে এমন আগুন জ্বলতে পারে সেটা তার ধারণার বাইরে।

    .

    আবার যে চোখ দুটো সর্বদাই প্রায় আগুনের ঢেলার মতো জ্বলত, সেই চোখ এমন মলিন নিষ্প্রভ নিভে যাওয়া কয়লার মতো দেখাতে পারে তেমন ধারণাও ছিল না একজনের।

    কিন্তু দেখাচ্ছে তাই।

    দিবাকরের চোখ দুটো যেন নিভে যাওয়া কয়লার মতো হয়ে গেছে।

    কাল বিকেল চারটের গাড়িতে যেতে পারবে মীনাক্ষী?

    মীনাক্ষী অস্বস্তির গলায় বলে,আচ্ছা ভোরবেলার কোনও গাড়ি ধরো না, যাতে সন্ধের গাড়িতে ফিরে আসা যায়।

    তেমন কোনও গাড়ি নেই মীনাক্ষী! যেভাবেই যাও একটা রাত কাটাতে হবে।

    তারপর দিবাকর বোঝতে বসে, শুধু দিনের আলোয় গিয়ে ঘুরে এলে, গ্রামের যথার্থ দৈন্য, যথার্থ চেহারা ধরা পড়বে না। তার জন্যেও অন্তত মীনাক্ষীর রাতটুকু থাকা উচিত-দেখবে–অন্ধকার মানে কী! দেখবে–অসহায়তা মানে কী! দেখবে কী আমাদের দেশ!

    কিন্তু এতদিন দিবাকর তো অন্য কথাই বলেছে।

    তা বলেছে বটে!

    কিন্তু কেন বলেছে?

    জ্বালায়।

    ভেবেছে মনের মুক্তি এলেই বুঝি অবস্থারও মুক্তি আসবে। এখন বুঝছে সেটা ভুল।

    অনেক কথা হয়!

    অনেক কাঠ-খড় পোড়ে।

    অবশেষে মীনাক্ষী রাজি হয়।

    বাড়িতে কী বলবে?

    বলুক না সাহসের সঙ্গে, একজন সহপাঠীর গ্রাম দেখতে যাচ্ছি। অনেকদিন ধরে বলছে।

    .

    কথা দিয়ে এল।

    কিন্তু যেন মনের মধ্যে একটা পাষাণভার। আস্তে আস্তে বাড়ি ঢুকছিল, হঠাৎ কমলাক্ষকে দেখে যেন হাতে স্বর্গ পেল।

    ছোড়দা তুই কখন এলি? হঠাৎ এখন? মাথায় কী হল?

    একঝাঁক প্রশ্ন।

    কমলাক্ষ যতটা সংক্ষিপ্ত করে সম্ভব উত্তরটা দিয়ে বলে ওঠে, তোমার কী ব্যাপার শ্রীমতী মীনাক্ষী দেবী, শুনলাম তোমার নাকি পাখা গজিয়েছে, তুমি নাকি উড়ছ, কোনদিন না হঠাৎ ফুড়ুৎ করে বনে পালাও।

    শোনা হয়ে গেছে সব? মীনাক্ষী হালকা গলায় বলে, যাক বাঁচা গেছে, আমাকে আর খাটতে হল না।

    তারপর মীনাক্ষী নিজের সমস্যার কথা পাড়ে।

    কিন্তু কমলাক্ষ যেন এক ফুয়ে উড়িয়ে দেয় তার মনের পাথর।

    এই ব্যাপার। এর জন্যে এত চিন্তা? নাঃ, তোদের এ যুগে জন্মানোই ভুল হয়েছে। ওই বিজয়া দেবীরই সমকালীন তুই। একদিনের জন্যে সহপাঠীর দেশে বেড়াতে যাবি, তাই নিয়ে এত দুশ্চিন্তা, এত ভাবনা!

    আহা আমার নিজের জন্যে যেন–মীনাক্ষী ঝংকার দিয়ে ওঠে,আমাদের বাড়িটি কেমন, জানো না বুঝি? পারমিশন পেতে। এই কথাই বলে। বাধা তার নিজেরই মধ্যে, তা বলে না।

    ওইখানেই ভুল। কমলাক্ষ বলে, ওটা পাবার চেষ্টামাত্র না করে নিজের মনে কাজ করে যাও, দেখবে সব সহজ হয়ে যাবে। এত কিছু নাবালিকা নও তুমি যে, একদিনের জন্যে কোথাও যেতে পাবে না। এটা কি ঊনবিংশ শতাব্দী নাকি?

    মীনাক্ষী হয়তো একটু আশ্বস্ত হয়, কিন্তু মীনাক্ষী আশ্চর্য হয়। কতদিন আসেনি কমলাক্ষ! এর মধ্যে কী অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে তার।

    কমলাক্ষই সর্বদা বলত,আরে বাবা, একটু বাধ্য বাধ্য ভাব, একটু মত নেওয়া নেওয়া খেলা, এগুলো করলেই যদি বুড়ো ভদ্রলোককে, আর পুণ্যশীলা মহিলাটিকে সন্তুষ্ট রাখা যায়, করলে ক্ষতি কী? সত্যি তো আর খোসামোদ করছ না? একটু ভোয়াজ দেখাচ্ছ, মিটে গেল সমস্যা।আসল কথা কাজ হাসিল। সেটা লাঠি মেরেও হয়, তোয়াজ করেও হয়। আমার মতে, তোয়াজটা অনেক সহজ। একটা যন্ত্র ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করলেও তেল দিতে হয়। আর এ তো মানুষ! দেখবি যথাসময়ে একটু তেল প্রয়োগে সব শান্ত।

    কিন্তু এ কমলাক্ষ নতুন।

    এর ভাষায় যেন দিবাকরের সুর।

    পুরনো দিবাকরের।

    এ বলতে চায়, সাবালক হয়েও নাবালকের ভূমিকা অভিনয় করে চোলো না। তুমি হচ্ছ তোমার। তুমি কারও ইচ্ছের পুতুল নও।

    মা বাপ সম্মানের জিনিস, কিন্তু যতক্ষণ তাঁরা নিজেরা সম্মাননীয় রাখেন নিজেদের

    একদা তাঁরা এই হতভাগ্যদের পৃথিবীতে এনেছিলেন বলেই তাদের কিনে রেখেছেন? কে তাঁদের আনতে মাথার দিব্যি দিয়েছিল?

    কেউ না।

    তাঁরা নিজেদের খেয়াল চরিতার্থ করতে যা করেছেন, আমরা তার অবাঞ্ছিত আকস্মিক ফলমাত্র।

    .

    কমলাক্ষর নতুন মতবাদে অবাক হয়ে যায় মীনাক্ষী। আর তারপরই সেই অবাক হওয়া মন আস্তে আস্তে সাহসী হয়ে ওঠে। সত্যিই বটে, কী তুচ্ছ একটা ব্যাপারকে কতটা উচ্চ মূল্য দিচ্ছে সে। ভারী তো কাণ্ড!

    দিবাকরের সঙ্গে একটা ট্রেনে চেপে বসবে, নামবে, তার মার কাছে গিয়ে দাঁড়াবে। তারপর দারিদ্র্যের ঘরের আন্তরিকতার যত্ন সানন্দে গ্রহণ করে একটা রাত কাটিয়ে সকালে চলে আসা। এর জন্যে এত ভাবছে কেন?

    তুই তো এখন আছিস?

    তাই ভাবছি। অন্তত যতদিন না মাথাটা সারে।

    ঠিক আছে। যদি গৃহকর্তা বা গৃহিণী বিশেষ আপত্তি শুরু করেন, তুই ম্যানেজ করে দিবি।

    মীনাক্ষীর বুকের পাষাণভারটা নামে। মীনাক্ষী প্রস্তুত হয়।

    .

    সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফেরে নীলাক্ষ, সঙ্গে স্ত্রী। শ্বশুরবাড়ি থেকে তুলে এনেছে।

    মাঝে-মাঝেই এ ব্যবস্থা হয়।

    নীলাক্ষ অফিস যাবার সময় সুনন্দাকে তার বাপের বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যায়, সুনন্দা সেখান থেকেই ছেলেকে স্কুল থেকে আনিয়ে নেয়। আবার এ-বেলা নীলাক্ষ শুধু স্ত্রীকে নিয়ে ফেরে, পুত্র থাকে। নিজেরা বেড়িয়ে ফিরে তাকে উদ্ধার করে আনে সেই রাত্রে।

    বিজয়া যে ছোট ছেলেকে বলেছিলেন, ভাইপোকে দেখতে চাস তো তার মামার বাড়িতে যেতে হবে–কথাটা নেহাত অত্যুক্তি নয়।

    ব্যবস্থাটা ক্রমশই এই খাতে গড়াচ্ছে।

    আগে এত পিত্রালয়-প্রীতি ছিল না সুনন্দার, ক্রমশই বাড়ছে। আবার তার মায়েরও মাতৃস্নেহ বাড়ছে। একদিন মেয়েকে না দেখলেই নাকি তিনি চক্ষেহারা হন। অথচ আগে হতেন না।

    কমলাক্ষকে দেখে অবশ্য খুশি হয় সুনন্দা, কিন্তু কমলাক্ষ হয় না। বিচ্ছুর অভাবটা তার বড় বেশি লাগে।

    নিজে সে অনেক বদলেছে, তার হৃদয়যন্ত্রে সম্পূর্ণ নতুন সুর, অথবা অসুর। কিন্তু বাড়ির এই সুর বদল তার ভয়ংকর খারাপ লাগছে।

    যেন যে জিনিসটা রেখে গিয়েছিল, সে জিনিসটা তার অনুপস্থিতিতে হারিয়ে গেছে।

    হয়তো এইরকম হয়।

    মানুষ নিজে প্রতিনিয়ত বদলায়, কিন্তু আশা করে, আমার পারিপার্শ্বিকতা অবিচল অবিকৃত থাকুক। নিজে সে তার মূল্য দিক বা না দিক, থাকাটা দরকার।

    কমলাক্ষ তেমন করে কথা কইল না।

    কমলাক্ষ তার নিজের ঘরে গিয়ে অসময়ে শুয়ে পড়ল।

    কমলাক্ষ সর্বপ্রথম হাতজোড় করে বলেছিল, মাথার ব্যান্ডেজ প্রসঙ্গটা বাদে, অন্য প্রসঙ্গ।

    তবু সুনন্দা বরকে বলল, আমার আজ বেরোতে ইচ্ছে করছে না।

    কেন? কমলাক্ষবাবুর আপ্যায়নের জন্যে? নীলাক্ষ ব্যঙ্গের গলায় বলে, বাবু তো ভাল করে কথাই কইলেন না।

    সুনন্দা ভুরু কোঁচকায়।

    সুনন্দা ফিরে দাঁড়িয়ে বলে, হঠাৎ এমন অদ্ভুত ধারণা হল কেন তোমার যে, আমি তোমার ছোট ভাইয়ের সেবাযত্নের জন্যে বাড়ি বসে থাকতে চাইছি?

    তবে খামোকা বাড়ি বসে থাকবে কেন?

    প্রত্যেকেরই ভাল লাগা, ভাল না-লাগা ব্যাপারটা আছে। আজ আমার ভাল লাগছে না।

    নীলাক্ষ তবু কয়েকবার স্ত্রীকে অনুরোধ উপরোধ করল।

    তারপর বিরক্ত হয়ে চলে গেল।

    সুনন্দা এদিকের ছায়াও মাড়াল না। সুনন্দা অন্ধকার বারান্দায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।

    সুনন্দার মনের মধ্যে যেন একটা ভাঙা গ্রামোফোন রেকর্ড বাজতে লাগল। যে রেকর্ডের কথাগুলো হচ্ছে এইরকম–এই বাড়িতে ওকেই সবচেয়ে ভালবাসতাম আমি। মানে যখন আমি সত্যিকার আমি ছিলাম। আর ও-ও আমার সবচেয়ে প্রীতির চক্ষে দেখত। এখন ও আমায় ঘৃণা করছে। করছে সেটা তো দেখতেই পেলাম।

    শুধু ওরই নয়, এখন আমি আমার সমস্ত পুরনো পরিচিত জগতের কাছেই ঘৃণিত। কারণ আমার পুরনো আমিকে ভস্ম করে সেই ভস্মের টীকা পরে নৃত্য করছি।

    তার বদলে আমি কী পেয়েছি?

    পেয়েছি মেহেরা সাহেবের প্রেমমুগ্ধ দৃষ্টি। পেয়েছি শকুন্তলা রায়ের ঈর্ষা। আর পেয়েছি জগৎকে তুচ্ছ করবার ক্ষমতা।

    এখন আমি আমার স্বামীকে অনায়াসে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে পারি। শ্রীমতী বিজয়া দেবীকে অবহেলার চরম দেখাতে পারি। পারি আরও অনেক কিছুই।

    কারণ এই গৃহগণ্ডির বাইরে আমার যে একটা মূল্য আছে সেটা টের পেয়েছি আমি।

    পাওয়ার খাতায় আরও জমা পড়েছে।

    কিন্তু সুখ পেয়েছি কি?

    নিদেন শান্তি?

    অথবা আরও সস্তা জিনিস, স্বস্তি?

    পাইনি।

    ওর কোনওটাই পাইনি।

    কারণ ওর বদলে ওই দামি দামি জিনিসগুলো আমি সত্যি চাইনি। আমি শুধু আমার স্বামীর ওপর আক্রোশ করে নিজেকে ধ্বংস করেছি।

    এখন ও আমাকে ভয় পায়।

    এটাকে যদি সুখ বলো তো সুখ।

    অথচ কমল আমায় অগ্রাহ্য করে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল বলে আমার পৃথিবীটা বিস্বাদ হয়ে যাচ্ছে।

    আমি চোরের উপর রাগ করে মাটিতে ভাত খেয়েছি। আমি ওর উপর প্রতিশোধ নিতে গিয়ে নিজের উপর প্রতিশোধ নিয়েছি।

    আমার শ্বশুর আমায় শ্রদ্ধা করতেন, এখন আমি তাঁর সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে পারি না।

    অথচ আমি ওঁর ঘরের সামনে দিয়ে মাতাল হয়ে টলতে টলতে আসি।

    এই অদ্ভুত জীবনটার পরিসমাপ্তি কী, জানি না।

    হয়তো যখন আমার ছেলে বড় হয়ে আমায় ঘৃণা করবে, তখন এর পরিসমাপ্তির চেহারা দেখতে পাব।

    সুনন্দা নীচে রাস্তার দিকে তাকায়।

    কতটুকু দুরত্ব?

    হঠাৎ এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়লে এখুনি সব প্রশ্নের উত্তর মিলে যেতে পারে কি?

    এই মুহূর্তে সেইরকম একটা ইচ্ছে দুর্দম হয়ে উঠছে।

    আশ্চর্য!

    একটা খুদে ছেলে আমায় ঘৃণা করছে, তাই আমার কাছে সমস্ত পৃথিবীটা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে?

    ছিঃ!

    পেটে আজ আনন্দরস পড়েনি, তাই এমন দুরবস্থা।

    শুনেছি মাতালদের মদ না খেলে অকারণ বিষাদ রোগ হয়।

    আমারও তাই হয়েছে।

    কী মজা! কী মজা! আমিও মাতাল। তার মানে আমি জাতে উঠেছি। আমি অভিজাত হয়েছি। আর আমায় গেরস্ত ঘরের বউ বলে চেনা যাবে না।

    শকুন্তলা রায়ের পর্যায়ে উঠে গেলাম আমি।

    কী মজা!

    কিন্তু এত মজার মধ্যেও আমার কান্না পাচ্ছে কেন? আজ তো আমি নেশা করিনি। আমার শরীরের সব রক্তই কি তবে মদ হয়ে গেছে? নেশা না করেও নেশা হয়? তাই শুধু শুধু কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে, শুধু শুধু হাততালি দিতে ইচ্ছে করছে।

    ও-মা-গো, আমি কী করি?

    .

    ঝিকিমিকি বেলায় এই বাড়িটায় ওকে নিয়ে এসে ঢুকল দিবাকর। কিন্তু সেই ঝিকিমিকির পরমায়ু যে বেশি নয়, তা ধরা পড়ছে তার লালচে আভায়।

    কিন্তু বাড়িটা কি গরিবের পাতার কুটির?

    যে কুটিরে দিবাকরের মহীয়সী জননী তাঁর অগাধ স্নেহসাগর নিয়ে অপেক্ষা করে বসে থাকেন দিবাকরের আশায়?

    না, সে বাড়ি এ নয়।

    এ কোনও বিগতকালের ধনীর পরিত্যক্ত অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ।

    যতক্ষণ স্টেশন থেকে হাঁটাপথে আসছিল মীনাক্ষী, ততক্ষণ বেশ ভালই লাগছিল তার। ঝোঁপঝাড় গাছপাতার মাথায় পড়ন্তবেলার আলোর লুকোচুরি, ছবিতে দেখা কুঁড়েঘরের মতো উঁচু উঁচু মাটির দাওয়া দেওয়া পাতার কুঁড়ে, পানাপুকুর, পায়েচলা পথ, ক্কচিৎ এক-আধটি গ্রামবধুর জল আনতে যাওয়ার দৃশ্য, মনের জগতে পাড়াগাঁয়ের যে ছবি আঁকা আছে, তার সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে।

    দিবাকর এইগুলোর পরিচয় দিতে অনর্গল কথা বলছিল, কিন্তু মীনাক্ষীর মনে হচ্ছিল এত কথার দরকার ছিল না। এর আর পরিচিতি দেবার কী আছে? আঁকা ছবিতে যা দেখেছে, সিনেমার ছবিতে যা দেখেছে, তারই জীবন্ত সংস্করণ বই তো নয়!

    অনেকবার ভাবল বলে যে, দিবাকর তুমি একটু কম কথা বলো, শান্ত হও, ধীরে কথা কও, ওরে মন নত করো শির।কারণ সন্ধ্যা আসছে।

    কিন্তু বলতে পারল না।

    বলবার ফাঁক পেল না।

    আবার কোনও এক সময় যখন ফাঁক পেল, তখন নিজেই কথার বীজ পুঁতে বসল। বলল,আচ্ছা, তোমাদের এখানে ইটের দেয়াল করতে নেই নাকি? সমস্তই তো দেখছি মাটির বাড়ি।

    দিবাকর মৃদু হেসে বলে, মাটির মানুষদের দেশ যে।

    তারপর পকেট থেকে রুমাল বার করে অকারণ তার সেই অগ্নি-গোলকের মতো চোখ দুটো মুছে নিয়ে বলে, এই মাটির দুখানা ঘর তুলতেই এদের যথাসর্বস্ব বাঁধা পড়ে, সারাজীবন ঋণ আর শোধ করে উঠতে পারে না।

    মীনাক্ষী একটু ছেলেমানুষি গলায় বলে, বাঃ, তা কেন? মিস্ত্রিকে না দিয়ে নিজেরা করে নিলেই পারে? কী আর শক্ত?

    দিবাকর উচ্চতরালে হেসে ওঠে। নির্জন পথে পথ চলতে দিবাকরের সেই হাসিটায় হঠাৎ যেন গা ছমছম করে ওঠে মীনাক্ষীর।

    এতে এত হাসির কী আছে? ভয় ভাঙতেই বোধ করি তীক্ষ্ণ প্রশ্ন করে মীনাক্ষী, এতে এত হাসির কী আছে? যারা ঘর বানায় তারাও তো মানুষ? চাষা-টাষা মানুষরা যদি নিজেরা খেটেখুটে

    নিজেরা খেটেখুটেই করে নেয় মীনাক্ষী, মিস্ত্রির স্বপ্ন দেখে না এরা। মেয়ে-পুরুষ, বালবাচ্চা সবাই মিলে খাটে। কিন্তু মাল-মশলা তো চাই?

    মাল-মশলা? মীনাক্ষী অবাক হয়ে বলে, মাল-মশলা আবার কী? শুধু তো মাটি! চারদিকে এত মাঠ–।

    নাঃ তোমাকে যতটুকু অবোধ ভেবে রেখেছিলাম, দেখছি তার দশগুণ অবোধ তুমি। মাঠ পড়ে আছে বলেই কি মাটি নেওয়া যায়? যার জমি সে আপত্তি করবে না? তা ছাড়া বাঁশ বাখারি, দড়ি পেরেক, এইসব চাই না?

    বাঃ, ওর এত কী দাম!

    অনেক দাম মীনাক্ষী, এদের কাছে ওই তুচ্ছ বস্তুগুলোই অনেক দামি।

    দিবাকরের গলার স্বর ভারী হয়ে আসে। দিবাকর আস্তে মীনাক্ষীর কাঁধের উপর একটা হাত রেখে বলে, শহুরে নাট্যকাররা এদের দুঃখ দুর্দশায় বিগলিত চিত্তে জোরালো নাটক লিখে মঞ্চস্থ করে বাহবা লোটেন, কিন্তু জানো, এদের দুঃখের এক সহস্রাংশও তাতে প্রকাশ হয় না। এদের কথা ভাবো মীনাক্ষী! গভীর ভাবে ভাবো।

    মীনাক্ষী চুপ করে গিয়েছিল।

    মীনাক্ষীর মনটা ভারী ভারী হয়ে গিয়েছিল। মীনাক্ষীর মনে পড়েনি দিবাকরের হাতটা তার কাঁধের উপর রয়ে গেছে।

    এক সময় দিবাকর আবার হালকা গলায় বলে, নাঃ, তোমার মনটা খারাপ করে দিলাম। কী জানো? দেশে এলেই–যাক গে, ওসব কথা থাক। হ্যাঁ, কী বলছিলে তখন? এখানে পাকাবাড়ি আছে কিনা। তা একেবারে নেই, তা নয়। অনেক হতভাগ্যের মধ্যে, এক-আধজন ভাগ্যবানও থাকে তো৷

    দিবাকর, তুমি যে বলেছিলে স্টেশন থেকে খুব বেশি দূরে নয় তোমাদের বাড়ি, কিন্তু অনেকক্ষণ তো হাঁটছি।

    গ্রামের হিসেবে এইই সামান্য মীনাক্ষী! তোমার বুঝি খুব কষ্ট হচ্ছে?

    না না, কষ্ট হতে যাবে কেন? এমনি বলছি।

    আর একটু কষ্ট করতে হবে।বলেছিল দিবাকর।

    তারপর বেলা যখন মরণোন্মুখ, তখন দিবাকর এই ধ্বংসগ্রস্ত পোড় অট্টালিকাটায় এসে ঢুকল মীনাক্ষীকে নিয়ে।

    মীনাক্ষী অবাক হয়ে বলে, এখানে কী? এটা তোমার বাড়ি নাকি?

    না। আমার কেন হবে? দিবাকর হঠাৎ যেন ব্যঙ্গের গলায় কথা কয়ে ওঠে,নিন্দে করছিলে এখানে কোঠাবাড়ি নেই বলে, তাই কোঠাবাড়ি দেখাতে নিয়ে এলাম।

    ওর এই স্বরটা ভাল লাগল না মীনাক্ষীর। ভয়ানক অস্বস্তি হল কপাট উড়ে যাওয়া জানলা দরজার ফোকরগুলো দেখে। ভয় করে উঠল ভাঙা দেয়ালের গায়ে গায়ে গাছের শিকড় নামা দেখে।

    মীনাক্ষী তাই রুক্ষ গলায় বলে উঠল, নিন্দে আবার কখন করলাম? শুধু জিজ্ঞেস করেছি। ঘাট হয়েছে বাবা! চলল চলল, সন্ধে হয়ে আসছে, কোথা থেকে হয়তো সাপ-খোপ বেরিয়ে পড়বে ।

    দিবাকর একটা নির্লজ্জ হাসি হেসে বলে, এক্ষুনি চলে যাব মানে? এত কলাকৌশল করে এত তোড়জোড় করে আসা কি এক্ষুনি চলে যাবার জন্যে?

    সহসা চারধারের ভাঙা দেয়ালগুলো ভূমিকম্পে দুলে ওঠে, ঝিকিমিকি আলোটা মুহূর্তে গাঢ় অন্ধকারের গহ্বরে ডুবে যায়, একটা দাঁতখিচনো দৈত্য ওই ফোকরে ফোকরে উঁকি দিয়ে দিয়ে বেড়ায়।

    মীনাক্ষীর হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়।

    মীনাক্ষীর বুকের ভিতরে প্রকাণ্ড একটা পাথরের চাঁই এসে বসে।

    তবু মীনাক্ষী চিৎকার করে ওঠে, ভাঙা ভাঙা গলায়।

    একথার মানে কী দিবাকর?

    দিবাকর বিচলিত হয় না।

    দিবাকর তেমনি নির্লজ্জ হাসি হেসে বলে, মানে অতি প্রাঞ্জল। কলকাতার সমাজে কোনওখানে তো পাওয়া যাবে না তোমায়, তাই অনেকদিনের একটা বাসনা পূরণ করতে এত কাঠখড় পোড়ানো

    দিবাকর!

    মীনাক্ষী তীব্র তিরস্কারে চেঁচিয়ে ওঠে, এতবড় শয়তান তুমি?

    দিবাকর রূঢ় গলায় বলে, গরিব যদি জগতের কোনও ভোগ্যবস্তুর দিকে হাত বাড়ায় তা হলেই সে শয়তান বলে গণ্য হয়। কিন্তু এছাড়া তোমায় আমি পেতাম কী করে?

    পাওয়া!

    মীনাক্ষী অন্ধকার হয়ে যাওয়া পটভূমিকায় তার একদার প্রেমাস্পদের মুখটা দেখবার চেষ্টা করে। সবটা মিলিয়ে শুধু একটা ছায়ামাত্র দেখতে পায়। তার উদ্দেশেই ক্ষুব্ধ গলায় বলে, একে তুমি পাওয়া বলো?

    বলি। তাই বলি– দিবাকর নিষ্ঠুর গলায় বলে,এইমাত্র স্বর্গ থেকে পড়নি তুমি মীনাক্ষী, এই পৃথিবীটাকে দেখনি তা নয়। আমাদের মতো রক্তমাংসের মানুষের কাছে পাওয়ার আর কোন অর্থ আছে তুমিই বলো?

    দিবাকর, এত নীচ হোয়য়া না, নিজেকে এত ছোট কোরো না। তোমার সভ্যতার কাছে, তোমার ভদ্রতার কাছে নিজেই তুমি এ প্রশ্নের উত্তর চাও।

    সভ্যতা? ভদ্রতা? ওগুলো তো স্রেফ এক-একটা মেকি শব্দ। আমি ওর ধার ধারি না। আমি ঠিক করেছি

    তুমি কী ঠিক করেছ, সেটা আমার না জানলেও চলবে–মীনাক্ষী ভিতরের ভয় চাপা দিয়ে সহজ ভাব দেখায়। যেন দিবাকর নামের ওই ছেলেটা একটা বাজে বিষয় নিয়ে তর্ক করছে এইভাবে জোরে জোরে বলে, তোমার বাড়ি দেখার সাধ আমার মিটেছে, এখন দয়া করে এখান থেকে বেরিয়ে চলো দিকি। স্টেশনের দিকে চলল। অদ্ভুত! যেন একটা হিন্দি সিনেমার ভিলেনের অভিনয় করতে বসেছ তুমি।

    দিবাকর পকেট থেকে একটা টর্চ বার করে। এদিকে ওদিক দেখে নিয়ে আবার পকেটে পুরে ফেলে মীনাক্ষীর একটা হাত চেপে ধরে কাছে টানবার চেষ্টা করে বলে, ঠিকই বলেছ। তোমাদের তথাকথিত রোমান্টিক নায়ক হবার বাসনা আমার নেই। ভিলেনই হতে চাই আমি। অনেক চেষ্টা করে, অনেক মিথ্যের আশ্রয় নিয়ে এ ব্যবস্থা করেছি, দয়া করবার ক্ষমতা আজ আমার নেই। এ বাড়ির ও-পাশের একটা অংশ বাসযোগ্য আছে, এবং বাস করেও একজন। আমার প্রতি দয়াপরবশ হয়ে সে আজকে ঘরের অধিকার ছেড়ে চলে গেছে। একদা কোনও এক রাজা-মহারাজার বাগানবাড়ি ছিল এটা

    দিবাকর! আমি তোমার এই বাড়ির ইতিহাস জানবার জন্যে ব্যগ্র নই। হাতটা ছাড়িয়ে নেয় মীনাক্ষী, খুব খারাপ লাগছে আমার।

    কিন্তু হাতের তালুটা বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল তার। ওই লোকটা যে একদা তার বন্ধু ছিল, এটা আর মনেও পড়ছে না। একটা হিংস্র জানোয়ারের সামনে পড়ার মতোই অবস্থা হচ্ছে তার। আর ছুটে পালাবার চিন্তাটাই পেয়ে বসে তাকে।

    কিন্তু সূর্যালোকের শেষ কণিকাটুকুও যে মুছে গেল! মীনাক্ষী চারধারে গাঢ় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। মীনাক্ষী তবু সেই অন্ধকারেই সেই ভাঙা অট্টালিকার দেউড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসে। ছুটতে চেষ্টা করে।

    কিন্তু কোথায় ছুটবে?

    এই নীর অন্ধকারে কে জানে কোথায় আছে কাঁটা ঝোঁপ, কোথায় আছে ডোবা পুকুর। দিবাকর এগিয়ে আসে। বলে, মীনাক্ষী, বৃথা ছেলেমানুষি কোরো না। এটা লোকালয়ের থেকে অনেক দূরে, চেঁচিয়ে মরে গেলেও কেউ শুনতে পাবে না। আর পৃথিবীর কেউ জানতেও পাবে না, তোমাকে আমি কয়েক ঘণ্টার জন্যে পৃথিবী থেকে চুরি করে এনে—-

    মীনাক্ষী হঠাৎ নিচু হয়ে একখানা ভাঙা ইট কুড়িয়ে নেয়। ঘৃণার গলায় বলে, ইতর শয়তান, ছোটলোক! আর এক পা-ও যদি এগোও, তোমার প্রাণের চিন্তাও করব না আমি তা জেনো৷

    করো, তবে খুনই করো আমায় দিবাকর যেন কৌতুকের গলায় বলে, ভেবেছিলাম একরাতের জন্যে স্বর্গের টিকিট কিনছি, তা যখন হবে না, তখন তোমার হাতে মরেই স্বর্গে যাই।

    পাকা অভিনেতা দিবাকর দাস, তেমনি ভাবেই বলে, মনে একটা অহংকার ছিল, বুঝি গরিব চাষা হয়েও রাজকন্যার ভালবাসা পেয়েছি। দেখছি সে অহংকার মিথ্যে।

    মীনাক্ষী একটু নরম হয়।

    নরম গলাতেই বলে, সেটা বুঝতে পেরেছ তার জন্যে ধন্যবাদ। আশা করি বুঝে ফেলে আবার সেই মিথ্যেটাকে গায়ের জোরে সত্যি করে তোেলার চেষ্টা করতে যাবে না। নাও, টর্চটাকে বার করো দিকি, চলো–

    হঠাৎ হেসে ওঠে দিবাকর, জোরে জোরে বলে, যার অন্য জোর নেই, তার গায়ের জোরই ভরসা। মিথ্যে আর ভুগিও না, হাতের ইটটা ফেলল। আশ্বাস দিচ্ছি, জগতের কেউ জানতে পারবে না। আবার তোমায় যথাযথ ফেরত নিয়ে যাব।

    তোমার কৃপার কথা মনে থাকবে–মীনাক্ষী অন্ধকারেই ক্ষীণ নক্ষত্রলোককে ভরসা করে এগোতে এগোতে বলে, তবে দরকার হবে না, আমি নিজেই যেতে পারব।

    মীনাক্ষী চেষ্টা করে করে অন্ধকারেই এগোতে থাকে।

    কিন্তু মীনাক্ষীর নিয়তি বুঝি অলক্ষ্যে ক্রুর হাসি হাসে। ঠিক সেই সময় সহসা শূন্য প্রান্তরের দিকে দিকে তীব্র চিৎকারে আকাশ সচকিত করে তোলে স্বেচ্ছাবিহারী গ্রাম্য শেয়ালের দল।

    মীনাক্ষী যে-শত্রুর ভয়ে পালাচ্ছিল সেই শত্রুকেই ডেকে ওঠে, দিবাকর টর্চটা ধরো। তোমার ধর্মের দোহাই।

    কিন্তু দিবাকর কি ওকে আলো দেখাবার জন্যে, ওর ফিরে যাবার পথ সুগম করার জন্যে টর্চটা ধরে? দিবাকর কি ধর্মের ধার ধারে?

    তা ধারে না, তা ধারে না।

    দিবাকর সত্যি সত্যিই সস্তা নাটকের ভিলেনের ভূমিকায় অভিনয় করে।

    মীনাক্ষীর হাতের ইট কোনও কাজে লাগে না।

    অন্ধকারে স্থানচ্যুত হয়ে কোথায় হারিয়ে যায়।

    মীনাক্ষীও বুঝি হারিয়ে যায় একটা অতলস্পর্শী অন্ধকারের মধ্যে।

    .

    লে বাবা! আমি এলাম মাথা ফাটিয়ে, আবার তুই এলি জ্বর করে–কমলাক্ষ চেঁচিয়ে বলে, ও মা দেখে যাও তোমার ছোট মেয়ে ফিরেছেন। তবে শুধু হাতে নয়, গ্রাম থেকে বেশ একখানি উপহার নিয়ে।…ব্যাপার কী বল দিকি? পাড়াগাঁয়ের মাটিতে গিয়েই কি ডোবার জলে ডুব দিয়েছিলি নাকি?

    হ্যাঁ দিয়েছিলাম! তাই দিয়েছিলাম। মীনাক্ষী ক্লান্ত গলায় বলে, এখন একটু শুতে দে দিকি।

    শুতে চায় মীনাক্ষী।

    নিজেকে ছেড়ে দিয়ে শুয়ে পড়তে চায়। কোনও কিছু ভাববে না, কোনও ঘটনা বিশ্লেষণ করতে বসবে, কাউকে দোষ দিতে যাবে না, নিজেকে ধিক্কার দেবে না, শুধু একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে একটু ঘুমোবে।

    কিন্তু কে তাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দেবে?

    অনভিজ্ঞ ওই ছেলেটা জ্বরশব্দটাকে বিশ্বাস করে নিচ্ছে বলেই কি বিজয়ানামের ভয়ানক অভিজ্ঞ তীক্ষ্ণদৃষ্টি মহিলাটি তাই বিশ্বাস করবেন?

    .

    এ সংসারে একটিমাত্র মানুষ সুখী ছিল, প্রকৃত সুখী।

    কিন্তু তারও সুখ গেছে।

    তার সেই মনোরম গৃহকোটরটি ছেড়ে পৃথিবীর হাটে নেমে দিশেহারা হয়ে যাচ্ছে সে। ভাবছে–

    আশ্চর্য! কী বুদ্ধিহীন এই পৃথিবী! এ পৃথিবী যেন তার জানা জগতের বাইরের আর কিছু জানতেই চায় না। শুধু তাই নয়, যেটা তার অজানা তাকে ব্যঙ্গ করে, বিদ্রূপ করে, হাস্যকর বলে স্রেফ উড়িয়ে দেয়। একবার কৌতূহলের বশেও উলটে দেখতে রাজি হয় না।

    দীর্ঘদিনের সাধনার ফল, প্রাচীন ভারতের জ্ঞান ও আধুনিক জগতের বিজ্ঞানের পাণ্ডুলিপির বোঝা বয়ে পৃথিবীর দরজায় ঘুরে এই মূর্খ পৃথিবী সম্পর্কে হতাশ হয়ে এখন সারদাপ্রসাদ চাকরি খুঁজছে।

    অথচ জগতের কোনও কাজই জানে না সে। তবু সে শুধু যাকে পায় তাকেই বলে বসে, দাদা, একটা চাকরি জোগাড় করে দিতে পারেন?

    তবে ঝোঁক তার প্রেসে কাজ করবার।

    হয়তো ওই প্রেসের চাকরির ঝোঁকের অন্তরালে কোনও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার আশা প্রচ্ছন্ন আছে। তার।

    কিন্তু সবাই চায় পূর্ব অভিজ্ঞতা!

    আগে কোথায় কাজ করেছেন? কোন প্রেসে?

    করিনি কোথাও। এখানে করব বলে এসেছি।

    ওঃ, তা হঠাৎ প্রেসে কাজ করতে ইচ্ছে হল যে? অন্য কোথায় কাজ করতেন? ছেড়ে এলেন কেন এ বয়েসে?

    সারদাপ্রসাদ বিরক্ত হয়।

    রেগে রেগে বলে,কেন, কী বিত্তান্ত, এত কৈফিয়ত আপনাকে দিতে যাব কেন মশাই? আপনার চাকরি খালি আছে কিনা তাই বলুন।

    অপর পক্ষই কি তবে ছেড়ে কথা কইবে, মেজাজ দেখাবে না? নাই বা তাকে বহাল করা হচ্ছে, চাকরি যে চাইতে এসেছে, সে-ই চাকর। অতএব মনিবের গলাতেই বলে তারা, আছে খালি। কিন্তু আপনাকে দেব না। তবে এইটুকু জেনে যান, ওইসব কেন কী বিত্তান্ত না জেনে কেউ আপনাকে একখানা অফিসারের চেয়ারে বসিয়ে দিতে আসবে না। একটা বেয়ারার কাজ করতে এলেও শুধু আপনার কেন, আপনার সাত পুরুষের ঠিকুজি কুষ্ঠির বিত্তান্ত জানতে চাইবে।

    কেন? কেন শুনি মশাই? দাগী আসামি নাকি?

    ওরা হ্যা-হ্যা করে হেসে ওঠে।

    বলে, ওঃ চিড় খাওয়া! তাই বলি।

    চিড় খাওয়া ব্রেনের লোক স্বাভাবিক হয় না।

    কিন্তু সরোজাক্ষর ব্রেনেও কি চিড় খেয়েছে? তাই তিনি বাড়ির চৌকাঠের বাইরে পা দেওয়াটাও ছেড়ে দিয়েছেন?

    ডাক্তারের নিষেধকাল কবে পূর্ণ হয়ে গেছে, তবু মানুষটা ঘর ছেড়ে নড়ে না, এ কী কুদৃশ্য!

    কমলাক্ষ মায়ের কাছে এসে বলে, ব্যাপারটা কী বলল তো মাদার? কর্তা আর রাস্তায় বেরোন না কেন? অসুখ তো কিছু দেখি না।

    বিজয়ার মাথার মধ্যে এখন সর্বদাই আগুন জ্বলছে। বিজয়া তাঁর ছোট মেয়েকে উঠতে বসতে ভস্ম করছেন আর নিজের মৃত্যুকামনা করছেন।

    তাই বিজয়া তাঁর অনেকদিন পরে বাড়ি আসা ছোট ছেলেটাকেও রেয়াত করে কথা বলেন না। কড়া গলায় উত্তর দেন, কেন বেরোন না তা আমায় জিজ্ঞেস করতে এসেছিস কেন? আমায় রাতদিন তার সঙ্গে গলাগলি করতে দেখছিস বুঝি? যা না, নিজে জিজ্ঞেস করছে না।

    আমি? বাপস!

    কমলাক্ষ ভয়ের ভান করে।

    কেন, বাপস কেন? বিজয়া তিক্ত গলায় বলেন, নিজের বাপ বই পাড়ার লোক নয়, পাগল-ছাগল হয়ে যাচ্ছে কিনা তোরা দেখবি না তো দেখবে কে?

    আমার দরকার নেই বাবা!

    কমলাক্ষ বলে, আমি শিগগিরই চলে যাচ্ছি বাবা! বাড়ির যা অবস্থা দেখছি।বাড়ির কর্তাটি তোমার ভাষায় পাগল-ছাগল হয়ে যাচ্ছে, বাড়ির গিন্নি সর্বদাই সিংহবাহিনী, বাড়ির বড় ছেলে গোল্লার দোরে গিয়ে বসে আছেন, বাড়ির বড় মেয়ে একবার করে এসে ছটা বিকীর্ণ করে চলে যাচ্ছেন, বাড়ির ছোট মেয়ে মিছিমিছিজ্বর বলে রাতদিন শুয়ে আছেন, আর বাড়ির যে একটা মজার মানুষ ছিল, সে রাস্তায় চাকরি দেবে গো? চাকরি দেবে গো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    বিজয়ার মাথায় আগুন জ্বলছে, তবু বিজয়া থমকে ভুরু কোঁচকান। বিজয়া বলেন, চাকরি চাকরি করছে কে?

    কেন, শ্রীযুক্ত পিসেমশাই!কমলাক্ষ হো হো করে হেসে ওঠে, বাবা চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, তাই উনি সংসারের ভার নেবেন। সোজাসুজি বাবার চেয়ারটায় গিয়ে বসলেই পারেন।

    বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, চাকরি খুঁজছে? সংসারের জন্যে? তাই বুঝিয়েছে বুঝি তোকে? ওই একখানা লোক! কী ঘুঘু, কী ঘুঘু! তোদের সবাইকে ও এক হাটে বেচে অন্য হাটে কিনতে পারে। রাতদিন ঘুরে বেড়াচ্ছে ও কেন জানিস? ওর সেই মস্ত দামি মহাভারতখানি ছাপাবার তালে। সেই বই ছাপলেই নাকি পৃথিবী জুড়ে ধন্যি ধন্যি পড়ে যাবে। সব বদমাইশি। ওই ছল করে সারাজীবন শালার ঘাড় ভেঙে রাজার হালে কাটিয়ে এল, এখন দেখছে সেখানে মৌচাকের মধু শুকিয়ে এসেছে, তাই নিজের নেশার খরচটার জন্যে হন্যে হয়ে বেড়াচ্ছে।

    নেশা? আরে দূর! কমলাক্ষ বলে ওঠে,ও অপবাদটি অন্তত ও ভদ্রলোককে দিও না।

    বলেই হঠাৎ চুপ করে যায়।

    কমলাক্ষর মনে হয় জগতের কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।

    বিজয়া ছেলের এই ভাবান্তর দেখেন এবং তার কারণটাও অনুমান করতে পারেন।

    তাই বিজয়া চাপা রোষের গলায় বলেন, সংসারসুদ্ধ সকলেরই তো ব্যাখ্যা করলি, বলি, বাড়ির বউয়ের কথাটা বুঝি বলতে সাহস হল না?

    কমলাক্ষ একটু চুপ করে থাকে।

    তারপর অস্তে বলে, সাহস হল না নয় মা, রুচি হল না।

    আস্তেই বলে।

    কারণ সুনন্দা এখন বাড়ি আছে।

    কেন কে জানে সুনন্দা এখন প্রায়ই বাড়ি থাকছে।

    সুনন্দা বাপের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছে।

    সুনন্দা সন্ধ্যাবেলায় সেজেগুজে নীলাক্ষর সঙ্গে বেরোচ্ছে না।

    কিন্তু কেন?

    বিজয়া মনে-মনেই প্রশ্ন করেন, কেন? হঠাৎ এ পরিবর্তন কেন?

    চোরের মন ভাঙা বেড়ায়, তাই বিজয়া নিজের ভাঙা বেড়াটার দিকেই তাকান। বিজয়ার নিশ্চিত বিশ্বাস হয়, সুনন্দা মীনাক্ষীকে সন্দেহ করছে। সুনন্দা মীনাক্ষীকে লক্ষ করবার জন্যেই বাড়িতে থাকছে।

    সন্দেহ করতেই পারে।

    মেয়েমানুষের চোখ! ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়। মীনাক্ষীর যে কোনও অসুখ করেনি, মীনাক্ষী যে শুধু মরমে মরে পড়ে আছে, একথা সুনন্দা বুঝতে পেরেছে।

    বিজয়া ভাবেন, আমি কি একদিন ওই পাজি বউটার সঙ্গে কোনও উপলক্ষে ঝগড়া বাধিয়ে ওকে বাড়িছাড়া করব?

    তা হলে হয়তো মীনাক্ষীর ব্যাপারটা লোক জানাজানি হয়ে যাবে না। তা হলে হয়তো মীনাক্ষী আস্তে আস্তে সামলে ওঠবার সময় পাবে। তারপরেই ধরে বেঁধে একটা বিয়ে দিয়ে দেবেন তার।

    হয়তো সুনন্দার পরিবর্তনের মূলে অন্য কিছু।

    হয়তো সুনন্দা তার ননদের দিকে তাকায়ওনি, তবু বিজয়া ওই কথাই ভাবছেন।

    কিন্তু একদিন সত্যিই সুনন্দা তাকিয়ে দেখল।

    সুনন্দা লক্ষ করল মীনাক্ষীর জন্যে কোনও ডাক্তার আসে না, মীনাক্ষী উঠে গিয়ে ভাতটাতও খায়, অথচ মীনাক্ষী কলেজ যায় না, রাতদিন ঘরের মধ্যে পড়ে থাকে।

    সুনন্দা ভাবে, তবে কি মীনাক্ষী কোনও পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি? তাই লজ্জায় এরকম করছে?

    হয়েছে ভাল।

    বাবা বাড়ি থেকে বেরোনো ছেড়েছেন, বাবার মেয়েও তাই করছে। আর বাবার পুত্রবধূও সুনন্দা মনে মনে যেন নিজের জন্যেই ব্যঙ্গ হাসি হাসে, বাবার পুত্রবধূও বাইরের পৃথিবী থেকে ডানা গুটিয়ে নিয়ে এসে ঘরে বসতে চাইছে। এবার কি তবে ব্রতকথার গল্পের মতো অতঃপর সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে ঘরকন্না করবে?

    না কি এ শুধু কোনও একটা ঝড়ের আগের গুমোট?

    সুনন্দাও নিজের ঘরেই থাকতে ভালবাসে।

    যেন এটা একটা হোটেল।

    একই রান্নাঘরে রান্না হয় এদের, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন পরিবারের লোক, ঘরে ঘরে বাস করে।

    একদা যে এরা একই পরিবারভুক্ত ছিল, এরা একই জায়গায় বসে গল্প করত, খেত, পরস্পরের দিকে তাকালো, পরস্পরের কথা জানত, তা আর যেন এখন কারুর মনে পড়ে না।

    অথচ ছিল সে অবস্থা।

    সরোজকে কখনওই বেশি কথা বলতেন না, তবু তাঁর আশেপাশে এসে বসত সবাই।

    সুনন্দা বলত, বাবা, এই বইটার এখানটা ঠিক বুঝতে পারছি না, বলুন তো লেখক এখানে কী বলতে চেয়েছেন?

    মীনাক্ষী বলত, উঃ কী করে যে বউদি অত মোটা মোটা বইগুলো এক-একদিনে শেষ করে!

    কমলাক্ষ তখন তো বাড়িতেই।

    কমলাক্ষ চাপা গলায় বলত, মানুষ যে কেন পড়ার বইয়ের বোঝা টানার পরও আবার বই পড়তে বসে, এ আমার বুদ্ধির বাইরে। রেখে দাও বউদি, বই রেখে দাও, নইলে এ বাড়ির কর্তার হাওয়া গায়ে লাগবে। তার চেয়ে একহাত ক্যারাম হয়ে যাক।

    নীলাক্ষ বলত, দ্যাখ কমল, লেখাপড়া শিখে ঢিকিয়ে টিকিয়ে চাকরি করে কিছু হয় না। যদি বড়লোক হতে চাস তো ব্যবসা করতে হবে। বিজনেস জিনিসটা কী, সেটাই শিখতে চেষ্টা কর এখন থেকে।

    ময়ূরাক্ষীও তখন বাড়িতে।

    ময়ূরাক্ষী তখন কুমারী।

    ময়ূরাক্ষী বলত, থামো তুমি দাদা! বাঙালির মাথায় ওসব হয় না। যারা লোটা কম্বল সম্বল করে দুপয়সার ছোলাভাজা খেয়ে দিন কাটিয়ে দিতে পারে, তারাই পারে ওসব। বাঙালির রুচি আলাদা।

    আর হঠাৎ সেই আসরে পাগলা সারদাপ্রসাদ এসে পড়ে বলে উঠত, তোরা এইসব বাজে কাজে মত্ত হয়ে সময় নষ্ট করছিস, অথচ আমার সেই নতুন চ্যাপ্টারটা শুনতে বলছি, সময়ই হচ্ছে না তোদের! অথচ শুনলে বুঝতিসকী ইন্টারেস্টিং! রাবণ স্বর্গের সিঁড়ি গাঁথছিল, গাঁথতে গাঁথতে অসমাপ্ত রেখে মরে গেল। আসলে ব্যাপারটা কী? রাবণ দূরপাল্লার রকেটের পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছিল। আরও কিছুদিন সে পরীক্ষা চালিয়ে যেতে পারলে কাজটায় সফল হতে পারত, চাঁদে মঙ্গলে শুক্রে যেতে পারত। কিন্তু তার আগেই রাবণব্যাটা একটা পাপযুদ্ধে নেমে ধ্বংস হল। যেমন এখন ভিয়েতনামের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। কিন্তু কে বলতে পারে রাবণের সেই ফরমুলাটাই কোনওরকমে এ যুগে কারও হস্তগত হয়েছে কিনা। সেকালে লোকে মন্ত্রগুপ্তি করতে ওইসব ফরমুলা তামার সিন্দুকে পুরে জলে ভাসিয়ে দিত।তা সেই রাবণের ফরমুলাই পাক, কিংবা নিজেরাই আবিষ্কার করুক, এ যুগ কিছু নতুন করছে না, সেটাই তোমাদের শোনাতাম।

    .

    কিন্তু সারদাপ্রসাদের কথা কেউই শুনতে চাইত না। পাশ কাটাত। কিন্তু তাকে অপমান করে নয়, কৌশল করে।

    তারপর ওর আড়ালে হাসাহাসি করত।

    সেই পারিবারিক আসরে অনুপস্থিত থাকতেন শুধু বিজয়া। বিজয়া তাঁর ঠাকুরঘরের দুর্গে বসে থাকতেন।

    কিন্তু আজকাল বিজয়া আর অষ্টপ্রহর সেই দুর্গে বসে থাকতে পাচ্ছেন না।

    বিজয়া যেন ছটফটিয়ে নেমে আসছেন।

    বিজয়ার গলা যখন-তখনই দোতলায় একতলায় শোনা যাচ্ছে।

    বিজয়ার কি হঠাৎ খেয়াল হয়েছে বাড়ির গিন্নি নিজেকে সংসার থেকে ভাসিয়ে রাখলে সংসারটা ভেসে যায়?

    বিজয়ার কথা বিজয়াই জানেন, তবে সরোজাক্ষ মাঝে মাঝে বিস্মিত হন। সরোজাক্ষ জীবনে যা না করেছেন, তাই করেন এক এক সময়। বিজয়া কী বলছেন শুনতে চেষ্টা করেন।

    বিজয়ার উচ্চ চিৎকার থেকেই সরোজাক্ষ একদিন টের পান, সারদাপ্রসাদ চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছেন।

    অথবা বেড়াচ্ছেন না, ছল করে রাস্তায় ঘুরছেন।

    সরোজাক্ষ স্তব্ধ হয়ে যান।

    সরোজাক্ষ নিজের কর্তব্য নির্ণয় করতে বসেন।

    কিন্তু একদিন বিজয়ার আশঙ্কা সত্য হয়।

    সুনন্দা তার ননদের দিকে তাকায়।

    সুনন্দা একদিন তার ঘরে ঢুকে পড়ে বলে, তোর কী হয়েছে বল তো মীনা?

    জানলা দিয়ে পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে ঘরের দেয়ালে পড়েছিল, মীনাক্ষী তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে জানলাটা বন্ধ করে দিল।

    ওই পড়ন্ত বেলার ঝিকিমিকি আলোকে বড় ভয় মীনাক্ষীর। ওটা যেন একটা সর্বগ্রাসী কালো দৈত্যের সোনালি মুখোশ। মুহূর্তে ছিঁড়ে যাবে মুখোশটা, মুহূর্তে সেই কালো দৈত্যটা তার লোমশ থাবাটা বাড়িয়ে মীনাক্ষীকে চেপে ধরবে, সেই থাবার মধ্যে নিষ্পিষ্ট হয়ে যাবে মীনাক্ষী, মুছে যাবে মীনাক্ষী নামের মেয়েটা।

    .

    কিন্তু মীনাক্ষী নামের সেই মেয়েটা কি আছে এখনও? সেই ভীরু অথচ বিদ্রোহী, মৃদু অথচ সতেজ, এমনি উলটোপালটা উপাদানে গঠিত সেই মেয়েটা?

    নিজে তো সে ভাবছে, সে শেষ হয়ে গেছে, মুছে গেছে, মরে গেছে। তাই পৃথিবীর দিকে পিঠ ফিরিয়ে চুপ করে বিছানায় পড়ে আছে সে।

    এই পৃথিবীর দিকের একটি দরজা মাঝে মাঝে ঝড়ের ধাক্কায় খুলে যায়, আর সে ঝড় আছড়ে আছড়ে পড়ে মীনাক্ষীর উপর। রাতদিন শুয়ে থেকে থেকে আর কত মুখ পোড়াবে? বাড়ির লোক তো কানা নয়, তারা ভাবছে কী? জ্বর বলে শুয়ে থাকলেই তো আর লোকের সন্দেহের হাত এড়ানো যায় না? বলবে না তারা, এতদিন ধরে জ্বর যদি তো ডাক্তার আসে না কেন?

    কিন্তু মীনাক্ষী সেই ঝড়ের মুখে বোবা কালা পাথর। মীনাক্ষী দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকে।

    কখনও কখনও সেই ঝড় আবার কাছে এসে ফিসফিস গলায় কথা কয়, মীনাক্ষীর গালে কপালে উত্তপ্ত নিশ্বাসের তাপ এসে লাগে। কেলেঙ্কারি তো করেই এসেছ বুঝতে পারছি, এখন চূড়ান্ত বিপদ কিছু ঘটেছে কিনা তাই বলো। তা হলে শতজন্মের নরক ভোগ স্বীকার করে নিয়েও তার ব্যবস্থা করতে হবে।

    পাথরের কি অনুভূতি থাকে?

    পাথরও কি ভয়ে বিস্ময়ে ঘৃণায় শিউরে উঠতে পারে?

    বোঝা যায় না।

    বোঝা গেলে হয়তো একটা তীব্র চিৎকার দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেত। ছি ছি! ছি ছি!

    বলে উঠত–এই আমার পুণ্যবতী আর ধর্মশীলা মা।

    আর্তনাদটা ওঠে না।

    বোবা দেয়ালের দিকে মুখ করে পড়ে থাকে একটা বোবা পাথরের পুতুল।

    ঝড়টা অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে অন্য একটা ঘরে গিয়ে আছড়ে পড়ে। যে ঘরটা নাকি তার চিরশত্রুর ঘর।

    মান-অপমানের মাথা খেয়ে তোমার কাছেই এসে পড়তে হল বউমা! তবে এও বলে রাখছি বাছা, এ কলঙ্ক শুধু একা আমারই নয়, তোমাদেরও। তোমার এই শ্বশুরকুলের কলঙ্কের কথা যদি রাষ্ট্র হয়, তো চুনকালি তোমাদের মুখেও পড়বে। আমি তো লক্ষ্মীছাড়া মেয়েকে জিজ্ঞেস করে করে হার মেনে গেছি, একটা বাক্যি বার করতে পারিনি মুখ থেকে। তুমি একবার চেষ্টা করে দেখো দিকি। আমার ভাগ্যিক্রমে আজকাল যখন বাড়িতে থাকচ্ছ।

    সুনন্দা শুনল৷ সুনন্দাও প্রায় পাথরের পুতুলের মতোই ভাবশূন্য মুখে তার শাশুড়ির উত্তেজনা রক্তিম মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

    ওটাই এখন ওর প্রকৃতি।

    যেন কিছু বুঝতে পারছি না।

    তুমি সব বিশদ বোঝাবে, তবে আমি বুঝব।

    অথচ সুনন্দা সবই টের পাচ্ছে।

    কারণ সুনন্দা আজকাল প্রায়ই বাড়িতে থাকছে। আর মেয়েমানুষের প্রখর দৃষ্টিতে ঘটনার স্পষ্ট চেহারাটা ধরা পড়তে দেরি হচ্ছে না।

    তবু সুনন্দা অবোধ সাজল।

    তাকিয়ে রইল ভাবশূন্য চোখে।

    দেখে অবশ্য হাড় জ্বলে গেল বিজয়ার, তবু বিজয়া মনের রাগ মনে চেপে আবার বললেন, লক্ষ্মীছাড়িকে বোঝাও গে একটু, এভাবে পড়ে থাকলে লোকলজ্জা বাড়বে বই কমবে না। আর এও জিজ্ঞেস করো গে একটা কিছু ঘটিয়ে বসেছে কিনা। ভগবান, এমন কপালও করে এসেছিলাম!

    কপালের দুঃখ গাইতে পারেন বিজয়া, কারণ এই ভয়াবহ সংকটের সময় কিনা বড় মেয়ে কাছে নেই। সে গেছে বম্বে বেড়াতে। অজন্তা ইলোরা দেখে তবে ফিরবে।

    মেয়ে থাকলে কি তিনি বউয়ের শরণাপন্ন হতেন? তা ছাড়া এখন যে আবার ঢঙিনী ঢং করে বাড়িতেই থাকছেন বেশি বেশি। বেশিরভাগ দিনই নীলু একা বেরিয়ে যাচ্ছে। কী কারণ কে জানে! বিজয়াকে পাহারা দিচ্ছে নাকি?

    হ্যাঁ, এ কথাও ভাবতে দ্বিধা করেন না বিজয়া, হয়তো বিজয়ার উপর চোখ রাখতেই সুনন্দা বাড়ি বসে থাকছে। হয়তো দেখছে বিজয়া কী করেন।

    যাক এখন একটি মোক্ষম চাল দেওয়া গেল, ভাবলেন বিজয়া, এ বাড়ির কলঙ্ককালিমা যে ওদের গালেও উঠবে সেটা বুঝিয়ে ছেড়েছি। এ কাহিনী আর বাপের বাড়ি গল্প করতে যাবে না। তা ছাড়া এ আস্থা আছে বউয়ের উপর, নিষেধ করলে বলবে না কাউকে। সে বরং নিজের বড় মেয়ের সম্পর্কে বিশ্বাস কম। তার পেটে কথা থাকে না।

    বিজয়া তাই ভাবলেন, মান সম্মান খুইয়ে বউয়ের শরণ নিয়ে এখন উদ্ধার তো হই। তবু নিজ কপালকে ভর্ৎসনা করলেন।

    বউ কিন্তু সেই দুঃখে সমবেদনা দেখাল না, শুধু অবাক গলায় বলল, আপনি যে কী সম্পর্কে কথা বলছেন, কিছুই তো বুঝতে পারলাম না।

    বিজয়া একটু থতমত খেলেন, তারপরই এই হাড়ে বজ্জাত বউয়ের ন্যাকামিতে নিজের হাড়টাই জ্বলে গেল তাঁর। তবু সামলে বললেন, কী সম্পর্কে সেটা কি আর তোমার মতো বুদ্ধিমতাঁকে খুলে বলতে হবে বউমা? দেখছ তো ছোট ননদটাকে? আর ওর কী হয়েছে, তাও অবশ্যই অনুমান করতে পারছ?

    অনুমান? আমি?

    সুনন্দা আকাশ থেকে পড়ে।

    আমি কী অনুমান করব? আমি কি ডাক্তার? স্লো ফিভার–মানে ঘুসঘুসে জ্বর কত কারণেই হয়।

    জ্বর? জ্বরটা সত্যি ওর গায়ে নাকি বউমা? বিজয়া তীব্র চাপাগলায় বলেন,ও তো মনের জ্বর। সেই জ্বরে জর্জর হচ্ছে। সেই একদিন কোন চুলোয় রাত কাটিয়ে এসে কী সর্বনাশ যে ঘটাল কে জানে!

    সুনন্দা অমায়িক গলায় বলে, পাড়াগাঁয়ে রাত কাটালে মশা থেকে ম্যালেরিয়া হতে পারে, জল থেকে বিকোলাই হতে পারে, ব্যাঙ থেকে—

    থামো বউমা, তুমি আর ন্যাকামি কোরো না। বিজয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলেন, মেয়েমানুষ হয়ে মেয়েমানুষের কী জ্বালা জানো না? তদবধি ও কেন ঘরের কোণে মুখ গুঁজে পড়ে আছে তা জানো?

    শরীর খারাপ হলে তো থাকবেই।

    তা সেই খারাপটাই কোন জাতের সেটাই দেখো। দেখে তার প্রতিকার করো। মশা ছারপোকা সাপ ব্যাঙ ছাড়াও শত্রু আছে মেয়েমানুষের। সেই শত্রুর নিপাত চেষ্টা করতে হবে।

    এবার সুনন্দা ঘৃণা আর রাগের সংমিশ্রণে গঠিত একটা ভাব নিয়ে বলে, এসব কী বলছেন আপনি! মীনাক্ষী না আপনার নিজের মেয়ে?

    বিজয়া ধিক্কারে বিচলিত হন না। বলেন, নিজের মেয়ে বলেই তো এত জ্বালা বউমা! পাড়ার মেয়ে হলে কি আর এইভাবে মরমে মরতাম? এখন দেখো গে যাও বাছা। তোমার উপর সব দায় ফেলে দিলাম! যা প্রতিকার করবার করো।

    বললেন, অনায়াসেই বললেন এই মান-খোওয়ানো কথা।

    কিন্তু সুনন্দা সেই ধুলোয়-পড়া সম্মানের দিকে না তাকিয়ে স্থির গলায় বলে, আপনি কিছু নিশ্চিত হয়েছেন?

    তা নিশ্চিত ছাড়া আর কী? বিজয়া কপালে করাঘাত করেন, কী হাল হয়েছে মেয়েটার, তাকিয়ে দেখলে বুঝতে! লেখাপড়ায় এত মন ছিল, সে জিনিস ভাসিয়ে দিল। বই ছুঁচ্ছে না, কলেজ যাচ্ছে না।

    বিজয়া হঠাৎ আঁচলে চোখ মোছেন।

    সুনন্দা নির্নিমেষে একবার সেদিকে তাকিয়ে দেখে আরও স্থির ধাতব গলায় বলে, আপনি কী ধরনের প্রতিকারের কথা বলছেন?

    বিজয়ার গায়ে বিষ ছড়ায়।

    বিজয়ার গায়ে আগুন ছড়ায়।

    তবু বিজয়া মেজাজ শান্ত রেখে ক্ষুব্ধ ব্যঙ্গের হাসি হেসে বলেন, সেকথা কি আমি তোমাকে শেখাতে যাব বউমা? তোমাদের একালে কত ব্যবস্থা হয়েছে, তোমরা আধুনিক মেয়েরা সেসবের কত জানো শোনো। প্রাণটা যাতে না যায়, সেভাবে

    কথার মাঝখানে কথা বলে ওঠে সুনন্দা। হেসে উঠে বলে,আমাদের একাল তা হলে আপনাদেরও কিছু কিছু সুবিধে করে দিচ্ছে? আচ্ছা ঠিক আছে, দেখি কী করতে পারি।

    .

    এ ঘরে সুনন্দা দৈবাৎই আসে।

    বলতে গেলে আসেই না।

    আজ এল।

    এসে মীনাক্ষীর পড়ার চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসে পড়ে সহজ আন্তরিক গলায় বলল,কী রে মীনা, তুই নাকি পড়া ছেড়ে দিবি বলেছিস?

    মীনাক্ষী এ আক্রমণে ভুরুটা একটু কোঁচকাল। বুঝতে পারল না, এটা আবার কী!

    স্ব-ইচ্ছেয় এসেছে, না কারও প্রেরিত দূত হয়ে? কার হবে? ছোড়দাটাও তো চলে গেছে। মার প্রেরিত নিশ্চয়ই নয়। তবে কি বাবার? মীনাক্ষী নিজের মৃত্যুকে ডাকতে লাগল। আকস্মিক মৃত্যু।

    সুনন্দা আবার বলল, মা বলছিলেন, তুই নাকি আর কলেজ-টলেজ যাস না, বই স না। অথচ জ্বরটর সব বাজে কথা।

    সুনন্দার গলায় কোন বহু যুগের আগের ঘরোয়া সুর।

    সুনন্দা কতকাল এ সুরে কথা বলেনি। মীনাক্ষীর কী হল কে জানে, সুনন্দার নিজের কানটাই যেন অনাস্বাদিত একটা স্নিগ্ধস্বাদে ভরে গেল। যেন এখনও এই সহজ ঘরোয়া কথা বলার শক্তিটা তার আছে। দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেছে সুনন্দা। কাটা-ছাঁটা গলায় মাপামাপা কথা বলতে বলতে সুনন্দা যেন যান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল, সুনন্দা তাই এই আকস্মিক আবিষ্কার হয়ে যাওয়া শক্তিটার স্বাদ আর-এক গণ্ডুষ পান করতে চাইল।

    সুনন্দা বলল, হল কি তোর? সারা বছর ফাঁকি দিয়ে, এখন বুঝি পরীক্ষার সময় ভয় ধরেছে?

    ভয়। পরীক্ষার!

    মীনাক্ষী হঠাৎ উঠে বসল।

    মীনাক্ষীও বুঝি সুনন্দার এই নতুন রূপে অথবা পুরনোকালের রূপে বিচলিত হল। তাই মীনাক্ষী কথা বলল।

    উদাস বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি আর তোমাদের সেই মীনাক্ষী নেই বউদি।

    সুনন্দা নির্লজ্জ বেশ করে পার্টিতে গিয়ে মদ খায়, সুনন্দা মেহেরা সাহেবের গায়ে ঢলে পড়ে হি-হি করে হেসে তার স্বামীর কর্মোন্নতির সহায়তা করে, সুনন্দা সর্বপ্রকার ভাবপ্রবণতাকে ব্যঙ্গ হাসি দিয়ে বিদীর্ণ করে, তবু মীনাক্ষীর ওই বিষণ্ণ মুখটার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ মায়ায় মন ভরে গেল তার। সুনন্দার মনে হল, হয়তো বা বিজয়ার সন্দেহটাই সত্যি।

    কিন্তু সুনন্দা সেই জটিল সন্দেহটা নিয়ে কোনও প্রশ্ন করল না, হেসে উঠে বলল, নেই? তুই আর সে মীনাক্ষী নেই? কন্ধকাটা শাঁখচুন্নি হয়ে গেছিস?কই বুঝতে পারছি না তো? ঠিক তো আগের মতোই দুই হাত দুই পা দুই চোখ দুই কান ও একটি মাথাসমেত আস্ত একটা মানুষকেই দেখছি।

    মীনাক্ষী অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, বাইরে থেকে যা দেখা যায় সেটাই তো সব নয়।

    সুনন্দা এক মুহূর্ত কী ভাবল, তারপর কৌতুকের গলায় বলে উঠল, সর্বনাশ! এ মেয়েটা কী বলে গো! ভিতরের অদৃশ্য কোটরে কিছু ঘটনা ঘটাচ্ছিস নাকি রে বাবা!

    মীনাক্ষী চমকে ওঠে।

    মীনাক্ষীর মনটা হঠাৎ বিমুখ হয়ে ওঠে।

    ওঃ তাই!

    বিদ্রূপ করতে আসা হয়েছে।

    ওই মমতার কণ্ঠটুকু তা হলে ছল!

    মীনাক্ষীর সেই বিষণ্ণ-বিধুর স্বরটুকুতে রূঢ়তার ছাপ পড়ে। মীনাক্ষী ঈষৎ সোজা হয়ে বসে বলে,ও, অনুসন্ধানে এসেছ?

    সুনন্দা গম্ভীর হয়।

    বলে, তোর অবশ্য সেটাই মনে হওয়া স্বাভাবিক। আমার প্রতি এর চাইতে উচ্চ ধারণা আর কীই বা হবে! কিন্তু এ ধারণা বদলালেও পারতিস! যদিও মার নির্দেশেই এসেছি আমি, তোকে সদুপদেশ দিয়ে প্রতিকারে প্ররোচিত করবার হুকুম নিয়ে। তবু থাক।সুনন্দা মুখ ফিরিয়ে বলে, ভেবে এক এক সময় হাসি পায় মীনা, অথচ একদা বাংলাদেশের লক্ষ্মী বউয়ের আদর্শটাই আমার আদর্শ ছিল।

    মীনাক্ষী একটু চুপ করে থেকে বলে, হয়তো আদর্শ নামের লোকটা একদম ক্ষমতাহীন, ঘটনাচক্রই সমস্ত কিছুর নিয়ামক।

    তা বটে! ঘটনাচক্রের কোপে পড়ে আমি তো একদিন তোদের মৈত্র পদবি ছেড়ে মিসেস মেহেরা হতে বসেছিলাম। শেষে আবার ওই ঘটনাচক্রই রক্ষে করল। একটা মদে চুরচুরে লোকের প্রেম নিবেদনের উপর আস্থা রাখা সমীচীন মনে হল না। এর জন্যে তোমার দাদা খুব ক্ষুব্ধ হলেন। ভেবেছিলেন ওই পদবি বদলের বদলে একটা বিরাট অঙ্কের চেক বাগাতে পারবেন। তা সে আশায় ছাই পড়ল। হতভাগাটাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে এসে আবার তোমার দাদার স্কন্ধে ভর করলাম।

    বউদি।

    মীনাক্ষীর এই কদিনের নীরব হয়ে থাকা কণ্ঠে একটা তীব্র সুর ঝলসে ওঠে,দাদার মূর্তিটাকে এতটা নারকীয় করে বলবার দরকার ছিল না। তোমাকে তো কেউ কিছু বলতে যায়নি।

    মীনাক্ষী ভেবেছিল, এ অপমানে সুনন্দা ঠিকরে উঠে বেরিয়ে যাবে। কিন্তু তা গেল না সুনন্দা। ও সেই একই ভাবে চেয়ারের পিঠটায় দোলা দিতে দিতে বলে, তোকেও তো কেউ কিছু বলতে আসেনি। তবু তুই মৃত্যুশয্যার পণ নিয়ে পড়ে আছিস কেন? বিবেক না কী যেন সেই আছে না একটা? সেটাই হুকুম করে। সে যাক, মায়ের হুকুম হয়েছে তোমার যদি কোনও দুর্ঘটনা ঘটে থাকে তো, প্রতিকার অফিসে নিয়ে যেতে।

    বউদি!

    মীনাক্ষী তীব্র গলায় বলে ওঠে, মা বলেছেন এই কথা?

    বললেন তো

    কেমন একটা ঘৃণায় আর ধিক্কারে মীনাক্ষীর ঠোঁটটা যেন বেঁকে যায়। মীনাক্ষী তীব্রতর গলায় বলে, মা না রাতদিন ঠাকুর পুজো করেন? মা না মশা ছারপোকা পিঁপড়ে মারাকেও জীবহত্যা বলে ধরেন?

    সুনন্দা হঠাৎ হেসে ওঠে।

    সুনন্দা বলে, মানুষ নামের জীবটা এমনি সব উলটোপালটা জিনিস দিয়েই তৈরি রে মীনা! ওইজন্যেই বোধহয় বলে পঞ্চভূতের দেহ। কিন্তু এ ছাড়া আর উপায়ই বা কী বল?

    মীনাক্ষী আবার শুয়ে পড়ে।

    মীনাক্ষী দেয়ালমুখো হয়।

    মীনাক্ষী যেন ধূসরকণ্ঠে বলে,পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। সেটা আরও একটা পাপ দিয়ে হয় না।

    পাপ!

    সুনন্দা যেন আকাশ থেকে পড়ে। সুনন্দার চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে। সুনন্দা ব্যঙ্গের গলায় বলে, কোন যুগে আছিস তুই যে, তাই এখনও পাপ পুণ্য, পাপের প্রায়শ্চিত্ত, এইসব পচা পুরনো শব্দগুলো নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিস? রাবিশ!

    কিন্তু এ ব্যঙ্গ কাকে করে সুনন্দা?

    সত্যিই কি মীনাক্ষীকে?

    মীনাক্ষীর দিক থেকে কোনও উত্তর আসে না। মীনাক্ষী যেন আবার পৃথিবীর দিকে পিঠ ফিরোয়।

    সুনন্দা ওর ওই পৃথিবীর দিকে পিঠ ফিরোনো ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আস্তে বলে,দেখ মীনা, অসতর্কে কাউকে যদি কুকুরে কামড়ায়, সে কি সেই কামড়ের বিষটাকে দূর করবার চেষ্টা না করে তাকে আঁকড়ে বসে বলে,বিষটা থাক! আমার অসাবধানতার প্রায়শ্চিত্ত করব।

    মীনাক্ষী তথাপি নীরব।

    সুনন্দা একটু অপেক্ষা করে ক্ষুব্ধ হাসি হেসে বলে, এ যুগের সভ্য সমাজকে তেমন করে দেখবার সুযোগ তোর আসেনি মীনা, তাই তুই এখনও তোর সেই প্রপিতামহীর সংস্কারের বালিতে মুখ গুঁজে পড়ে আছিস। এভাবে অসুবিধে-মুক্ত হওয়াটা এখন এত বেশি স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে, ও নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে, এটা শুনলেই লোকে হাসে।

    বিউদি, আমার এসব কথা শুনতে কষ্ট হচ্ছে।

    সুনন্দা একটু হেসে আস্তে কৌতুকের গলায় বলে, তার মানে অপরাধীটি নেহাত আততায়ী নয়? তোমার প্রেমপাত্র। তাই তার দেওয়া উপহার

    বউদি! আমাকে নিজের ধরনে মরতে দাও।

    সুনন্দা যেন একটা বাচ্চার অভিমান দেখছে, তাই সুনন্দা বলে ওঠে,এই তো নিজের ধরনে মরাটা তো হয়েই গেছে। এইবার আমাদের ধরনে বাঁচাবার চেষ্টা করব আমরা।

    দোহাই তোমাদের বউদি! আমার জন্যে তোমরা একটু কম ভেবো। আমি নিজেই এত বেশি ভাবছি যে, যথেষ্টর অতিরিক্ত হয়ে যাচ্ছে।

    তবু তো বোকার মতো ডিসিশান নিচ্ছিস। আদি-অনন্তকাল ধরে যা চলে আসছে, হয়তো অনন্তকাল ধরেই চলবে, সেই সহজ পথটা ছেড়ে অন্য পথ ধরে চলতে চাইছিস। সেটা চাইলে সমাজে চলে না মীনা! যে প্রপিতামহীর সংস্কারের কথা বলছি, তাঁরও পিতামহী প্রপিতামহীদের আমল থেকেই সমাজের সমস্ত পবিত্রতা আর শুচিতার সংস্কারের অন্তরালে প্রবাহিত হয়ে চলেছে বিপন্মুক্তির অভিযান। পরিবারের সুনাম যাবে, বংশে কলঙ্ক পড়বে–এই ভয়ংকর ভয়ে জলজ্যান্ত মেয়েগুলোকেই রাতারাতি ভ্যানিশ করে দিয়েছে মানুষ–এ ইতিহাসও তো কম নেই? মোট কথা, পাপ পুণ্য ধর্ম বিবেক, ওগুলোর ধার ততক্ষণই ধারে মানুষ, যতক্ষণ অবস্থাটা থাকে বেশ পোেষা জন্তুর মতো শান্ত শিষ্ট বাধ্য। কিন্তু যে মুহূর্তে মানুষ দেখবে অবস্থা অসুবিধের হয়ে উঠেছে, সেই মুহূর্তেই তার পাপ পুণ্য ধর্ম বিবেক, এসবের সংস্কার মুছে যাবে। সেই অসুবিধেটা দূর করতে, করতে পারবে না এমন কাজ নেই। এই হচ্ছে সংস্কারের মূল্য, এই হচ্ছে চিরন্তন মূল্যবোধের মূল্য। পাপ পুণ্য ধর্ম অধর্মের একটা ফাটকাবাজার আছে বুঝলি? স্বার্থ আর সুবিধে এঁরাই হচ্ছেন সে বাজারের মালিক।

    মীনাক্ষী ওদিকে পিঠ ফিরিয়ে থেকেই বলে, তোমার এই দামি-দামি কথাগুলো থাক বউদি, আমার ভাল লাগছে না।

    সুনন্দা তবু যেন হাসির গলায় বলে, তা হলে বলছিস হেরে ফিরে যাব?

    তোমার কোনটা হার কোনটা জিত জানি না বউদি, শুধু জানি আমিই বড় বেশি হেরে গেছি।

    সুনন্দা তবু অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, সুনন্দা তবু বোঝাতে চেষ্টা করে এ যুগ এই তুচ্ছ ব্যাপারটাকে নিয়ে চিন্তা করে না, এটাকে নিতান্তই অ্যাকসিডেন্ট বলে মনে করে। তারপর ফিরে যায়।

    যাবার সময় শুধু আবারও বলে, বুঝলাম লোকটা তোর প্রেমাস্পদ, তাই পাপ প্রায়শ্চিত্ত এইসব শব্দগুলো বেছে নিয়ে মনকে চোখ ঠারছিস। কিন্তু তোর এই প্রায়শ্চিত্ত পদ্ধতিটা কোন মাটিতে বসে চালাবি তাই ভাবছি। যুগ যতই উদার আর প্রগতিশীল হোক, তুমি যে একটা গোত্র-পরিচয়হীন প্রাণীকে স্নেহের ছায়ায় আশ্রয় দিয়ে মানুষ করতে বসবে, সেটি চলবে না। কর্ণকে চিরদিনই কুন্তীর ক্রোড়চ্যুত হতেই হয়। হাজার হাজার বছরের পৃথিবীতে সমাজের কত পরিবর্তনই হল, কিন্তু কর্ণকুন্তী সংবাদটা অপরিবর্তিতই রয়ে গেল।

    .

    সুনন্দা হেরে ফিরে গেল।

    কিন্তু বিজয়া কি হার মানবেন?

    বিজয়া নিজের খুব শক্ত অসুখ বলে বড় মেয়েকে তারকরান। বিজয়ার এক ভক্ত গুরুভাইকে এই তারবার্তা প্রেরণের ভার দেন বিজয়া।

    .

    নীলাক্ষ বড় মুশকিলে পড়ে গেছে।

    নীলাক্ষ বাইরের জগতে ঘুরছে যেন হালভাঙা নৌকোর মতো, হাতিয়ারহীন সৈনিকের মতো। অথচ কিছুতেই যেন সুনন্দাকে বশে আনতে পারছেনা। সুনন্দা প্রায় রোজই বলে-মাথা ধরেছে, বলে, জ্বর আসছে–বলে, মুড নেই।

    আশ্চর্য!

    এই যে মেহেরা সাহেব গাড়ি পাঠাতে চাইছে এবং সেইসঙ্গে এ ইশারাও জানাচ্ছে বেশি চালাকি চালালে নীলাক্ষ নামক মিথ্যে বাঘটাকে পুনর্মুষিক করে দেবে, এটা কি কম যন্ত্রণার?

    তুই তুচ্ছ একটা মেয়েমানুষ, একটু উপকারে লাগিস বলেই না তোকে এত তোয়াজ করা, নইলে তোর কাছে হেঁট হতে আসি আমি? সেই সুযোগটুকু পেয়ে তুই আমাকে দেখাতে আসিস মুড?

    অনবরত মনে মনে এই কথাগুলোই মনের মধ্যে ফুঁসতে থাকে নীলাক্ষর, কী দাম তোর? কী ছিলি আগে? সেই তো এক হাঁড়িঠেলা মা আর বাজারবওয়া বাপের বেটি। চেহারা তো ছিল তেল-জবজবে গাঁইয়া একটা মেয়ের মতো। সাতচড়ে রা বেরোতো না।কে তোকে এতখানি করে তুলল? ঘসে মেজে পিটিয়ে বুঝিয়ে, কে তোকে বাইরের পৃথিবীর যোগ্য করে তুলল? কে তোকে ওইসব লাখপতি কোটিপতিদের চোখের সামনে নিয়ে গিয়ে তুলে ধরল? এই আমি নয়? এখন আমায় তুই মুড দেখাতে আসিস? কারণ আমি তোকে মাথায় তুলেছি বলে, কেমন? সেই যে সেদিন? মেহেরা সাহেবটার সঙ্গে বলতে গেলে কেলেঙ্কারির তো কিছু বাকি ছিল না, তবু কিছু বলেছি আমি? দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করিনি? করেছিলাম কেন, না তুই আমার সাহায্যকারিণী সহধর্মিণী এই বিশ্বাসে। আর তোর বুদ্ধির উপর আস্থার বশে। বিশ্বাস রেখেছিলাম, আর একটু প্রশ্রয় দিয়ে তুই ওই মাতালটাকে কাত করে, তারপর সম্মানহানির ছুতো করে একটা মোটা খেসারত বাগাবি৷ তা নয়, তুই খালি হাতে ফিরে এসে স্বামীকে নস্যাৎ করতে কাটা কাটা বুলি ছাড়লি! একবার একটু এদিক ওদিকে সব সতীত্ব ধ্বংস হয়ে গেল তোমার!! ওটাও একটা শো বাবা, জানতে আর বাকি নেই। হয়তো কোনওদিন আমাকেই হুট আউট করে দিবি।

    সারাক্ষণ মনের মধ্যে এই গজরানি নিয়ে কাটাচ্ছে নীলাক্ষ। অথচ সুনন্দাকে বাগ মানাতে পারছে না।

    এমনকী বাপের বাড়িতেও তেমন বেশি বেশি যাচ্ছে না। সুনন্দার মা পর্যন্ত অনুযোগ করছেন, সুনু আর আসছে না কেন বাবা? বিচ্ছু বাবুকেও দেখতে পাচ্ছি না অনেকদিন

    কিন্তু কেন সুনন্দার এই পরিবর্তন?

    এ বাড়ির ছোট ছেলেটা, একদা নাকি যার বউদির প্রতি ছিল অগাধ শ্রদ্ধা ভালবাসা, সে অবজ্ঞা করেছে বলে?

    আরে দূর দূর!

    সুনন্দা কি পাগল? সেই ছেলেটা আবার একটা মনুষ্য পদবাচ্য নাকি? তাই তার একটু শ্রদ্ধা অশ্রদ্ধার প্রশ্নে সুনন্দা নামের দামি মানুষটা নিজেকে বদলাতে বসবে? তবে হয়তো তার ওই অবজ্ঞার আরশিতে হঠাৎ নিজের এই আত্মঘাতী মূর্তিটা দেখতে পেয়ে থমকে দাঁড়িয়েছে সুনন্দা। হয়তো ভাবছে, কার উপর আক্রোশ করে এই আত্মহনবনের যজ্ঞ করতে বসেছি আমি? যার উপর আক্রোশ, সে কি আক্রোশেরই যোগ্য?

    গভীরে তলিয়ে গেলে হয়তো দেখা যায় আক্রোশের পাত্র নীলাক্ষ নামের ওই অর্থলোভী স্বার্থপর অন্তঃসারশূন্য লোকটাই নয়। হয়তো এ বাড়িতে যে আর একটি আত্মচিন্তা-কেন্দ্রিক পুরুষ নিজেকে সংসারের সমস্ত মালিন্য থেকে ভাসিয়ে নিয়ে উর্ধ্বে স্থাপন করে রেখেছেন, তিনি।

    অভিমান বুঝি সুনন্দার তাঁরই উপর। যেন উনি রক্ষা করতে পারতেন, উনি সে কর্তব্য পালন করেননি। উনি কেবলমাত্র আপন অহমিকার পরিমণ্ডলে বাস করেছেন, আপন সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার দিকে সজাগ থেকেছেন। তার মানে উনি গৃহকর্তার কর্তব্য পালন করেননি। উনি ভেবেছেন পাছে কেউ ওঁর নির্দেশ না মানে!

    কিন্তু সুনন্দার বাবা তো এমন নয়?

    তিনি নিজের ওই সম্মানহানির ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকেন না কখনও। তিনি স্ত্রী পুত্র পরিবারকে বকেন, শাসন করেন, ভালবাসেন। অতএব তাঁর শাসিত প্রজাকুল সেটাকেই স্বাভাবিকনীতি ভেবে তটস্থ থাকে।

    কিন্তু সরোজাক্ষ যদি হঠাৎ শাসন করতে নেমে আসেন? কেউ কি স্বাভাবিক ভাববে? শাসিতা নিজেদের অপমানিত ভাববে।

    অথচ আমি সেইরকমই একটি সংসার চেয়েছিলাম– সুনন্দা ভাবে, সেই আমার ধারণাগত পারিবারিক আদর্শের ছাঁচে তৈরি সংসার। চেয়েছিলাম কল্যাণী বধু হতে, সেবাময়ী স্ত্রী হতে, স্নেহময়ী মা হতে। আমি তা হতে পেলাম না। আমার স্বামীর লোভের আগুনে ধ্বংস হয়ে গেলাম আমি।আমি নির্লজ্জ পোশাক পরাটাই বাহাদুরি বলে গণ্য করতে শিখলাম, লোকব্যবহারে আমি শালীনতা বর্জন করতে শিখলাম, আমি অকল্যাণের মশাল হাতে নিয়ে জীবনের সমস্ত মূল্যবোধগুলিকে পুড়িয়ে দিতে শিখলাম।

    তার মানে আমি জগতের সেই চরমতম বোকামির নিদর্শন–চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়ার উদাহরণ হলাম। অথচ লোকে আমায় বুদ্ধিমতী বলত। আর আমিও বিশ্বাস করতাম সে কথা।

    আপন জীবনটুকুকে যে নিজের মতো করে সাজাতে পারে না, ধুলোয় ছড়িয়ে ফেলে, তার আবার বুদ্ধির বড়াই!

    .

    কিন্তু শুধু সুনন্দাই নয়, আরও একজন ওই শব্দটা ব্যবহার করে প্রবল কণ্ঠে।

    বুঝলেন কাকিমা, এ যুগের সবাই বুদ্ধির বড়াই করে। ভাব দেখায় যেন সব বোঝে। আমি বলব, কিছু বোঝে না।

    বিরাট একবোঝা কাগজ হৈমবতীর টেবিলে বসানো, তার দুদিকে দুজন বসে। হৈমবতী আর সারদাপ্রসাদ।

    হৈমবতী নাকি তাঁর কোনও এক বান্ধবীর কাছে শুনেছেন পুস্তক প্রকাশনের ব্যবসাটা খুব লাভজনক। টাকায় টাকা আয়। তাই তিনি একটি পাবলিশার হয়ে বসতে চান। এবং প্রথম বই হিসেবে সারদাপ্রসাদের ওই গবেষণা-পুস্তকটি গ্রহণ করতে চান।

    ওই কাগজের বোঝা তাই নিয়ে এসেছেন সারদাপ্রসাদ।

    সারদাপ্রসাদ উদাত্তকণ্ঠে বলেন, দাদার পরে এই প্রথম আর একজনকে দেখলাম যে-লোক ভারতবর্ষের ঐতিহ্য সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল। অথচ চিরদিনই বউদির মুখ থেকে আপনার সমালোচনাই শুনে এসেছি, আপনি নাকি ফ্যাসানি, আপনি নাকি মেমসাহেব।

    বলে ফেলে একথা সারদাপ্রসাদ। আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির আশায় তোয়াজ করতেও নয়, আর বিজয়ার নিন্দে করতেও নয়। অথবা বিজয়ার নামে লাগিয়ে দিয়ে সুয়ো হতেও নয়। বলে নিতান্তই আবেগের বশে।

    হৈমবতী নিজেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন, জানিয়েছেন সেই সেইদিন থেকে তাঁর মাথায় ওই বইটাকে কেন্দ্র করে একটা বিজনেস-চিন্তা ঘুরছে। তাই তিনি প্রেসের মালিক-টালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা বয়ে দেখেছেন, এইবার কাগজপত্র কিনে শুরু করবেন। এখন সারদাপ্রসাদ কতটা অ্যাডভান্স চান, সেইটাই হৈমবতীর জিজ্ঞাসা।

    সারদাপ্রসাদ প্রথমে চমকে উঠেছিল। রক্তিম মুখে বলেছিল, আপনার কাছে অ্যাডভান্স নেব? বলেন কী?

    কিন্তু হৈমবতী বুঝিয়েছেন, বিজনেসের ব্যাপারে সমস্ত কেতাকানুন মেনে শুরু করাই সঙ্গত; নইলে নিজের কাছে গুরুত্ব থাকে না, কেমন যেন এলেবেলে মনে হয়।

    সারদাপ্রসাদ এ যুক্তিতে ভিজেছে। সারদাপ্রসাদ অতএব বলেছে, আপনি যা বলেন।

    হৈমবতী বলেছেন, আমার তো বাপু এই প্রথম ব্যবসায় নামা। বেশি দিতে পারব না। প্রথমে হাজার তিনেক দিই, তারপর আরম্ভ হলে–

    অঙ্কটা সারদাপ্রসাদের কাছে আশাতীত। আর সে কথাটা প্রকাশ করতে কুণ্ঠাও বোধ করেনি সে। কিন্তু হৈমবতী যে সব হিসেব-নিকেশ করে কাজে নামছেন। হৈমবতী তো জানছেন, যে তিনটি খণ্ডে বইটি সম্পূর্ণ, তার এক-একটা খণ্ডই অন্তত ত্রিশ টাকা করে হবে। দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ডটা অবশ্য এখনও লেখা হয়নি, কিন্তু মালমশলা তো সবই মজুদ, লিখতে আর কতক্ষণ? প্রথম খণ্ড ছাপতে ছাপতেই হয়ে যাবে। তা সে যাক, যে বইয়ের দাম হবে তিরিশ টাকা, তার জন্যে অগ্রিম অন্তত ওই তিন হাজার না দিলে প্রকাশিকার সম্ভ্রম থাকবে কেন?

    সারদাপ্রসাদ বলে, আশ্চর্য! আপনি একজন বিধবা মহিলা, আপনি সাহস করছেন, অথচ এই শহরের তাবড় তাবড় প্রকাশকমশাইরা বলেন, রিস্ক নিতে পারব না। তার মানে জিনিসটার প্রতি আস্থা নেই। তার মানে ভিতর থেকে কোনও প্রেরণা নেই। তার কারণ দেশ সম্পর্কে চিন্তা করেনি কোনওদিন। শুনলে অবাক হবেন, সেদিন একটি ছোকরাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা বলো তো এই যে আমাদের দেশে আকাশ-প্রদীপ দেওয়ার রীতি আছে, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কী? ছোকরা বাংলায় এম-এ, খুব নাকি ভাল ছাত্র, বলল কিনা, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বলে কিছু নেই, সম্পূর্ণ কুসংস্কার। স্রেফ মরা গোরুর ঘাস খাওয়ার ব্যাপার! মরে-যাওয়া পিতৃপুরুষের প্রেতদের জন্য যমপুরীতে আলো দেওয়া হয়। বলে সে কী ব্যঙ্গ হাসি! অথচ একটু ভেবে দেখলেই তাৎপর্যটা দেখতে পেত। তখন ছোকরার চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম,ওহে বাপু, ওটা হচ্ছে গোলা লোকদের জন্যে ব্যাখ্যা! মানুষ জাতটা তো এক নম্বরের অবাধ্য? ভাল কথা কিছু শুনবে না তো? তাই একটা রূপকের বহিরঙ্গ। আসলে শ্যামাপোকার উৎপাত থেকে আত্মরক্ষার উপায়। বাড়িতে উঁচুতে একটা করে আলো জ্বললে পোকাগুলো সেখানেই ভিড় করবে। তা ছোকরা কথাটা বিশ্বাস করল কিনা কে জানে! হেসে চলে গেল। দেওয়ালির আলো ও আতসবাজির তাৎপর্যটাও বুঝিয়ে দেব ভেবেছিলাম, সময়ই দিল না। তা যাক সেকথা, আপনি তা হলে মনস্থই করে ফেলেছেন?

    হৈমবতী প্রায় হইচই করে ওঠেন, মনস্থ বলে মনস্থ। আমি তো দিন গুনছি। তবে কিন্তু ওই যা বলেছি, একটি শর্তে। কিছুতেই যেন –

    হ্যাঁ, একটি শর্ত হৈমবতী করেছেন তাঁর জামাইয়ের সঙ্গে। হৈমবতী যে প্রকাশিকা হতে চলেছেন, এটা যেন এখন না প্রকাশ হয়ে পড়ে। সবাইকে তিনি তাক লাগিয়ে দিতে চান।

    সারদাপ্রসাদ সেকথা বিশ্বাস করেছে বইকী! এবং তাতে আমোদই অনুভব করেছে।

    সারদাপ্রসাদ ঘাড় হেলিয়ে বলে, তা আবার বলতে! এ শুধু আপনি জানবেন, আমি জানব, আর কম্পোজিটার জানবে। আচ্ছা তা হলে চলি। সময় অন্তর একটু দেখবেন উলটেপালটে।না কি একেবারে ছাপা হলেই?

    হৈমবতী ঘাড় হেলিয়ে বলেন, তাই ভাল।

    কিন্তু ওই যা বললাম কাকিমা, প্রুফটা আমার নিজের দেখা দরকার।

    হ্যাঁ সে তো নিশ্চয়, হৈমবতী অমায়িক গলায় বলেন,তুমি নিজে না দেখলে তো যা তা কাণ্ড হয়ে যাবে।

    সারদাপ্রসাদ উচ্ছ্বসিত হয়।

    এই, এইজন্যেই আপনাকে এত পুজ্যি করি কাকিমা! বোঝেন সব জিনিসটা। একটা অক্ষরের এদিক ওদিকে যে জিনিসটা একেবারে মার্ডার কেস হয়ে যাবে, একথা কজন বোঝে?

    সারদাপ্রসাদ শেষবারের মতো পরম স্নেহভরে কাগজের বোঝাগুলোর উপর হাত বুলিয়ে বলে, তা হলে রইল? দেখবেন যেন কিছু

    না না, এ আমি এখুনি যত্ন করে তুলে রাখছি।

    সারদাপ্রসাদ আবার একটু বসে।

    একগ্লাস জল চায়।

    জল খাওয়ার অবকাশে আরও বার দুই-তিন কাগজগুলো স্পর্শ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, যাক, আপনি আমায় বাঁচালেন। চাকরি খুঁজে খুঁজে বেড়ানোর দায় থেকে বাঁচালেন!

    চাকরি?

    হৈমবতী যেন আকাশ থেকে পড়েন। হৈমবতী যেন কোনওদিন শোনেননি, সারদাপ্রসাদ নামে অবোধ প্রাণীটা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে চাকরি খুঁজে বেড়াচ্ছে।

    তাই আকাশ থেকে পড়া গলায় বলেন, চাকরি?

    সারদাপ্রসাদ হেসে ওঠে।

    যেন সবটাই কৌতুকের বিষয়।

    বলে,আর বলেন কেন? ওইসব গণ্ডমুখ পাবলিশারদের উপর চটেমটে গিয়ে খাতাপত্তর গুটিয়ে চাকরিই খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। করতে তো হবে একটা কিছু?

    হৈমবতী ঈষৎ হেসে বলেন, তা তো সত্যি! সরোজও তো

    না না সেজন্যে নয়, সেজন্যে নয়। দাদার কীসের অভাব? হাতির জন্যে মশা কী করবে? এ কেবল আমার নিজেরই জন্যে। মানে চুপ করে কি দিন কাটানো যায়?

    সারদাপ্রসাদ তাড়াতাড়ি পালায়।

    হৈমবতী অনেকক্ষণ সেইদিকে তাকিয়ে থাকেন। হৈমবতীর মুখে একটা বিচিত্র বিষণ্ণ হাসি ফুটে ওঠে।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleজহুরী – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article একটি সন্ধ্যা একটি সকাল – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    আশাপূর্ণা দেবী

    বিবাগী পাখি – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    কুমিরের হাঁ – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ঠিকানা – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ততোধিক – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    ১. খবরটা এনেছিল মাধব

    April 7, 2025
    আশাপূর্ণা দেবী

    নতুন প্রহসন – আশাপূর্ণা দেবী

    April 7, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }