Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গৃহদাহ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প403 Mins Read0
    ⤶

    গৃহদাহ

    একচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

    ফিরিবার পথে গাড়ির কোণে মাথা রাখিয়া চোখ বুজিয়া অচলা এই কথাটাই ভাবিতেছিল, আজিকার এই মূর্ছাটা যদি না ভাঙ্গিত। নিজের হাতে নিজেকে হত্যা করিবার বীভৎসতাকে সে মনে স্থান দিতেও পারে না, কিন্তু এমনি কোন শান্ত স্বাভাবিক মৃত্যু—হঠাৎ জ্ঞান হারাইয়া ঘুমাইয়া পড়া—তার পরে আর না জাগিতে হয়। মরণকে এমন সহজে পাইবার কি কোন পথ নাই? কেউ কি জানে না?

    সুরেশ তাহাকে স্পর্শ করিয়া কহিল, তুমি যে আর কোথাও যেতে চেয়েছিলে, যাবে?

    চল।

    এর পরে কাল ত এখানে মুখ দেখানো যাবে না।

    কিন্তু তিনি ত কোন কথাই কাউকে বলবেন না।

    সুরেশের মুখ দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল, ক্ষণকাল মৌন থাকিয়া আস্তে আস্তে বলিল, না। মহিমকে আমি জানি, সে ঘৃণায় আমাদের দুর্নামটা পর্যন্ত মুখে আনতে চাইবে না।

    কথাটা সুরেশ সহজেই কহিল, কিন্তু শুনিয়া অচলার সর্বাঙ্গ শিহরিয়া উঠিল। তারপরে যতক্ষণ না গাড়ি গৃহে আসিয়া থামিল, ততক্ষণ পর্যন্ত উভয়েই নির্বাক হইয়া রহিল। সুরেশ তাহাকে সযত্নে, সাবধানে নামাইয়া দিয়া কহিল, তুমি একটুখানি ঘুমোবার চেষ্টা কর গে অচলা, আমার কতকগুলো জরুরি চিঠিপত্র লেখবার আছে। বলিয়া সে নিজের পড়িবার ঘরে চলিয়া গেল।

    শয্যায় শুইয়া অচলা ভাবিতেছিল, এই ত তাহার একুশ বৎসর বয়স, ইহার মধ্যে এমন অপরাধ কাহার কাছে সে কি করিয়াছে যেজন্য এতবড় দুর্গতি তাহার ভাগ্যে ঘটিল। এ চিন্তা নূতন নয়, যখন-তখন ইহাই সে আপনাকে আপনি প্রশ্ন করিত এবং শিশুকাল হইতে যতদূর স্মরণ হয় মনে করিবার চেষ্টা করিত। আজ অকস্মাৎ মৃণালের একদিনের তর্কের কথাগুলি তাহার মনে পড়িল এবং তাহারই সূত্র ধরিয়া সমস্ত আলোচনাই সে একটির পর একটি করিয়া মনে মনে আবৃত্তি করিয়া গেল। নিজের বিবাহিত জীবনটা স্বামীর সহিত একপ্রকার তাহার বিরোধের মধ্যে দিয়াই কাটিয়াছে। কেবল শেষ কয়টি দিন তাঁহার রুগ্নশয্যায় স্বামীকে সে বড় আপনার করিয়া পাইয়াছিল। তাঁহার জীবনের যখন আর কোন শঙ্কা নাই, মন যখন নিশ্চিন্ত নির্ভর হইয়াছে, তখনকার সে স্নিগ্ধ, সহজ ও নির্মল আনন্দের মাঝে অপরের দুর্ভাগ্য ও বেদনা যখন তাহার বড় বেশি বাজিত তখন একদিন মৃণালের গলা জড়াইয়া ধরিয়া অশ্রুরুদ্ধস্বরে কহিয়াছিল, ঠাকুরঝি, তুমি যদি আমাদের সমাজের, আমাদের মতের হতে, তোমার সমস্ত জীবনটাকে আমি ব্যর্থ হতে দিতুম না।

    মৃণাল হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, কি করতে সেজদি, আমার আবার একটা বিয়ে দিতে?

    অচলা কহিয়াছিল, নয় কেন? কিন্তু থামো ঠাকুরঝি, তোমার পায়ে পড়ি, আর শাস্ত্রের দোহাই দিয়ো না। ও মল্লযুদ্ধ এত হয়ে গেছে যে, হবে শুনলেও আমার ভয় করে।

    মৃণাল তেমনি সহাস্যে বলিয়াছিল, ভয় করবার কথাই বটে। কারণ তাঁদের হুড়োমুড়িটা যে কখন কোন্‌দিকে চেপে আসবে তার কিছুই বলবার জো নাই। কিন্তু একটা কথা তুমি ভাবোনি সেজদি, যে, তাঁরা যুদ্ধ করেন কেবল যুদ্ধ ব্যবসা বলে, কেবল তাতে গায়ে জোর আর হাতে অস্ত্র থাকে বলে। তাই তাঁদের জিতহার শুধু তাঁদেরই, আমাদের যায় আসে না। আমাদের ত কোন পক্ষই কোন কথা জিজ্ঞেসা করেন না।
    অচলা প্রশ্ন করিয়াছিল, কিন্তু করলে কি হতো?

    মৃণাল বলিয়াছিল, সে ঠিক জানিনে ভাই। হয়ত তোমারি মত ভাবতে শিখতুম, হয়ত তোমার প্রস্তাবেই রাজি হতুম, একটা পাত্রও হয়ত এতদিনে জুটে যেতে পারত। বলিয়া সে হাসিয়াছিল।

    এই হাসিতে অচলা অতিশয় ক্ষুব্ধ হইয়া উত্তর দিয়াছিল, আমাদের সমাজের সম্বন্ধে কথা উঠলেই তুমি অবজ্ঞার সঙ্গে বল, সে আমি জানি। কিন্তু আমাদের কথা না হয় ছেড়েই দাও, যাঁরাই এই নিয়ে যুদ্ধ করেন, তাঁরা কি সবাই ব্যবসায়ী? কেউ কি সত্যিকার দরদ নিয়ে লড়াই করেন না?

    মৃণাল জিভ কাটিয়া বলিয়াছিল, অমন কথা মনে আনলেও পাপ হয় সেজদি। কিন্তু তা নয় ভাই। কাল সকালেই ত আমি চলে যাচ্ছি, আবার কবে দেখা হবে জানিনে, কিন্তু যাবার আগে একটা তামাশাও কি করতে পারব না? বলিতে বলিতেই তাহার চোখে জল আসিয়া পড়িয়াছিল। সামলাইয়া লইয়া পরে গম্ভীর হইয়া কহিয়াছিল, কিন্তু তুমি ত আমার সকল কথা বুঝতে পারবে না ভাই। বিয়ে জিনিসটি তোমাদের কাছে শুধু একটা সামাজিক বিধান। তাই তার সম্বন্ধে ভালমন্দ বিচার চলে, তার মতামত যুক্তিতর্কে বদলায়। কিন্তু আমাদের কাছে এ ধর্ম। স্বামীকে ছেলেবেলা থেকে এই রূপেতেই গ্রহণ করে আসি। এ বস্তুটি যে তাই সকল বিচার-বিতর্কের বাইরে।

    বিস্মিত অচলা প্রশ্ন করিয়াছিল, বেশ তাও যদি হয়, ধর্ম কি মানুষের বদলায় না ঠাকুরঝি?

    মৃণাল কহিয়াছিল, ধর্মের মতামত বদলায়, কিন্তু আসল জিনিসটি কে আর বদলায় ভাই সেজদি? তাই এত লড়াই-ঝগড়ার মধ্যেও সেই মূল জিনিসটি আজও সকল জাতিরই এক হয়ে রয়েছে। স্বামীর দোষ-গুণের আমরাও বিচার করি, তাঁর সম্বন্ধে মতামত আমাদেরও বদলায়—আমারাও ত ভাই মানুষ! কিন্তু স্বামী জিনিসটি আমাদের ধর্ম, তাই তিনি নিত্য। জীবনেও নিত্য, মৃত্যুতেও নিত্য। তাঁকে আর আমরা বদলাতে পারিনে।

    অচলা ক্ষণকাল স্থির থাকিয়া কহিয়াছিল, এই যদি সত্যি, তবে এত অনাচার আছে কেন?

    মৃণাল বলিয়াছিল, ওটা থাকবে বলেই আছে। ধর্ম যখন থাকবে না, তখন ওটাও থাকবে না। বেড়াল-কুকুরের ত ভাই অনাচার নেই।

    অচলা হঠাৎ কথা খুঁজিয়া না পাইয়া কয়েক মুহূর্ত চুপ করিয়া থাকিয়া বলিয়াছিল, এত যদি তোমার সমাজের শিক্ষা, তবে শিক্ষা যাঁরা দেন, তাঁদের এত সন্দেহ, এত সাবধান হওয়া তবু কিসের জন্যে? এত পর্দা, এত বাধাবাধি—সমস্ত দুনিয়া থেকে আড়াল করে লুকিয়ে রাখবার এত প্রাণপণ চেষ্টা কেন? এত জোর-করা সতীত্বের দাম বুঝতুম পরীক্ষার অবকাশ থাকলে।
    তাহার উত্তাপ দেখিয়া মৃণাল চমকিয়া হাসিয়া কহিয়াছিল, এ বিধি-ব্যবস্থা যাঁরা করে গেছেন, উত্তর জিজ্ঞাসা কর গে ভাই তাঁদের। আমরা শুধু বাপ-মায়ের কাছে যা শিখেছি, তাই কেবল পালন করে আসচি। কিন্তু একটা কথা তোমাকে জোর করে বলতে পারি সেজদি, স্বামীকে ধর্মের ব্যাপার, পরকালের ব্যাপার বলে যে যথার্থই নিতে পেরেচে, তার পায়ের বেড়ি বেঁধেই দাও আর কেটেই দাও, তার সতীত্ব আপনা-আপনি যাচাই হয়ে গেছে। বলিয়া সে একটুখানি থামিয়া ধীরে ধীরে বলিয়াছিল, আমার স্বামীকে ত তুমি দেখেচ? তিনি বুড়োমানুষ ছিলেন, সংসারে তিনি দরিদ্র, রূপ-গুণও তাঁর সাধারণ পাঁচজনের বেশি ছিল না, কিন্তু তিনিই আমার ইহকাল, তিনিই আমার পরকাল। এই বলিয়া সে চোখ বুজিয়া পলকের জন্য বোধ করি বা তাঁহাকেই অন্তরের মধ্যে দেখিয়া লইল, তার পরে চাহিয়া একটুখানি ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, উপমাটা হয়ত ঠিক হবে না সেজদি; কিন্তু এটা মিথ্যা নয় যে, বাপ তাঁর কানা-খোঁড়া ছেলেটির উপরেই সমস্ত স্নেহ ঢেলে দেন। অপরের সুন্দর সুরূপ ছেলে মুহূর্তের তরে হয়ত তাঁর মনে একটা ক্ষোভের সৃষ্টি করে, কিন্তু পিতৃধর্ম তাতে লেশমাত্র ক্ষুণ্ণ হয় না। যাবার সময়ে তাঁর সর্বস্ব তিনি কোথায় রেখে যান, এ ত তুমি জানো। কিন্তু নিজের পিতৃত্বের প্রতি সংশয়ে যদি কখনো তাঁর পিতৃধর্ম ভেঙ্গে যায়, তখন এই স্নেহের বাষ্পও কোথাও খুঁজে মেলে না। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ও চিন্তার ধারা আলাদা ভাই, আমার এই উপমাটা ও কথাগুলো তুমি হয়ত ঠিক বুঝতে পারবে না, কিন্তু এ কথা আমার ভুলেও বিশ্বাস করো না যে, স্বামীকে যে স্ত্রী ধর্ম বলে অন্তরের মধ্যে ভাবতে শেখেনি, তার পায়ের শৃঙ্খল চিরদিন বন্ধই থাক, আর মুক্তই থাক এবং নিজের সতীত্বের জাহাজটাকে যে যত বড়, যত বৃহৎই কল্পনা করুক, পরীক্ষার চোরাবালিতে ধরা পড়লে তাকে ডুবতেই হবে। সে পর্দার ভিতরে ডুববে, বাইরেও ডুববে।

    তাহাই ত হইল। তখন এ সত্য অচলা উপলব্ধি করে নাই, কিন্তু আজ মৃণালের সেই চোরাবালি যখন তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া অহরহ রসাতলের পানে টানিতেছে, তখন বুঝিতে আর বাকি নাই, সেদিন কি কথাটা সে অত করিয়া তাহাকে বুঝাইতে চাহিয়াছিল। নিরবরুদ্ধ সমাজের অবাধ স্বাধীনতায় চোখ-কান খোলা রাখিয়াই সে বড় হইয়াছে, নিজের জীবনটাকে সে নিজে বাছিয়া গ্রহণ করিয়াছে, এই ছিল তাহার গর্ব, কিন্তু পরীক্ষার একান্ত দুঃসময়ে এ-সকল তাহার কোন কাজে লাগিল না। তাহার বিপদ আসিল অত্যন্ত সঙ্গোপনে বন্ধুর বেশে; সে আসিল জ্যাঠামহাশয়ের স্নেহ ও শ্রদ্ধার ছদ্মরূপ ধরিয়া। এই একান্ত শুভানুধ্যায়ী স্নেহশীল বৃদ্ধের পুনঃ পুনঃ ও নির্বন্ধাতিশয্যে যে দুর্যোগের রাত্রে সে সুরেশের শয্যায় গিয়া আত্মহত্যা করিয়া বসিল, সেদিন একমাত্র যে তাহাকে রক্ষা করিতে পারিত, সে তাহার অত্যাজ্য সতীধর্ম—যাহা মৃণাল তাহাকে জীবনে মরণে অদ্বিতীয় ও নিত্য বলিয়া বুঝাইতে চাহিয়াছিল। কিন্তু সেদিন তাহার বাহিরের খোলসটাই বড় হইয়া তাহার ধর্মকে পরাভূত করিয়া দিল। তাহাদের আজন্ম শিক্ষা ও সংস্কার ভিতরটাকে তুচ্ছ করিয়া, কারাগার ভাবিয়া বাহিরের জগৎটাকে চিরদিন সকলের উপর স্থান দিয়াছে; যে ধর্ম গুপ্ত, যে ধর্ম গুহাশায়ী, সেই অন্তরের অব্যক্ত ধর্ম কোনদিন তাহার কাছে সজীব হইয়া উঠিতে পারে নাই। তাই বাহিরের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে সেদিনও সে ভদ্রমহিলার সম্ভ্রমের বহির্বাসটাকেই লজ্জায় আঁকড়াইয়া রহিল, এই আবরণের মোহ কাটাইয়া আপনাকে নগ্ন করিয়া কিছুতে বলিতে পারিল না, জ্যাঠামশাই, আমি জানি, আমার এতদিনের পর্বত-প্রমাণ মিথ্যার পরে আজ আমার সত্যকে সত্য বলিয়া জগতে কেহই বিশ্বাস করিবে না; জানি, কাল তুমি ঘৃণায় আর আমার মুখ দেখিবে না, তোমার সতী-সাধ্বী পুত্রবধূর ঘরের দ্বারও কাল আমার মুখের উপর রুদ্ধ হইয়া লাঞ্ছনা আমার জগদ্ব্যাপ্ত হইয়া উঠিবে। সে সমস্তই সহিবে, কিন্তু তোমার আজিকার এই ভয়ঙ্কর স্নেহ আমার সহিবে না। বরঞ্চ এই আশীর্বাদ আমাকে তুমি কর জ্যাঠামশায়, আমার এতদিনের সতী নামের বদলে তোমাদের কাছে আজকার কলঙ্কই যেন আমার অক্ষয় হইয়া উঠিতে পারে। কিন্তু হায় রে! এ কথা তাহার মুখ দিয়া সেদিন কিছুতেই বাহির হইতে পারে নাই।

    আজ নিষ্ফল অভিমান ও প্রচণ্ড বাষ্পোচ্ছ্বাসে কণ্ঠ তাহার বারংবার রুদ্ধ হইয়া আসিতে লাগিল, এবং এই অখণ্ড বেদনাকে মহিমের সেই নিষ্ঠুর দৃষ্টি যেন ছুরি দিয়া চিরিতে লাগিল।
    এমন করিয়া প্রায় অর্ধেক রাত্রি কাটিল। কিন্তু সকল দুঃখেরই নাকি একটা বিশ্রাম আছে, তাই অশ্রু-উৎসও একসময়ে শুকাইল এবং আর্দ্র চক্ষুপল্লব দুটিও নিদ্রায় মুদ্রিত হইয়া গেল।

    এই ঘুম যখন ভাঙ্গিল, তখন বেলা হইয়াছে। সুরেশের জন্য দ্বার খোলাই ছিল, কিন্তু সে ঘরে আসিয়াছিল কিনা, ঠিক বুঝা গেল না। বাহিরে আসিতে বেহারা জানাইল, বাবুজী অতি প্রত্যুষেই এক্কা করিয়া মাঝুলি চলিয়া গিয়াছে।

    কেউ সঙ্গে গেছে?

    না। আমি যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তিনি নিলেন না। বললেন, প্লেগে মরতে চাস ত চল্‌।

    তাই তুমি নিজে গেলে না, কেবল দয়া করে এক্কা ডেকে এনে দিলে? আমাকে জাগালি না কেন?

    বেহারা চুপ করিয়া রহিল।

    অচলা নিজেও একটু চুপ করিয়া প্রশ্ন করিল, এক্কা ডেকে আনলে কে? তুই?

    বেহারা নতমুখে জানাইল, ডাকিয়া আনিবার প্রয়োজন ছিল না; কাল তাহাকে বিদায় দিবার সময় আজ প্রত্যুষেই হাজির হইতে বাবু নিজেই গোপনে হুকুম দিয়াছিলেন।

    শুনিয়া অচলা স্তব্ধ হইয়া রহিল। সে যাহা ভাবিয়াছিল, তাহা নয়। কাল সন্ধ্যার ঘটনার সহিত ইয়ার সংস্রব নাই। না ঘটিলেও যাইত—যাওয়ার সঙ্কল্প সে ত্যাগ করে নাই, শুধু তাহারি ভয়ে কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রাখিয়াছিল মাত্র।

    জিজ্ঞাসা করিল, বাবু কবে ফিরবেন, কিছু বলে গেছেন?

    সে সানন্দে মাথা নাড়িয়া জানাইল, খুব শীঘ্র, পরশু কিংবা তরশু, নয় তার পরের দিন নিশ্চয়।

    অচলা আর কোন প্রশ্ন করিল না। কাল সিঁড়িতে পড়িয়া গিয়া আঘাত কত লাগিয়াছিল, ঠিক ঠাহর হয় নাই, আজ আগাগোড়া দেহটা ব্যথায় যেন আড়ষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। তাহারই উপর রামবাবুর তত্ত্ব লইতে আসার আশঙ্কায় সমস্ত মনটাও যেন অনুক্ষণ কাঁটা হইয়া রহিল। মহিম কোন কথাই যে প্রকাশ করিবে না, ইহা সুরেশের অপেক্ষা সে কম জানিত না, তবুও সর্বপ্রকার দৈবাতের ভয়ে অত্যন্ত ব্যথার স্থানটাকে আগলাইয়া সমস্ত চিত্ত যেমন হুঁশিয়ার হইয়া থাকে, তেমনি করিয়াই তাহার সকল ইন্দ্রিয় বাহিরের দরজায় পাহারা দিয়া বসিয়া রহিল। এমনি করিয়া সকাল গেল, দুপুর গেল, সন্ধ্যা গেল। রাত্রে আর তাঁহার আগমনের সম্ভাবনা নাই জানিয়া নিরুদ্বিগ্ন হইয়া এইবার সে শয্যা আশ্রয় করিল। পাশের টিপয়ে শূন্য ফুলদানি চাপা দেওয়া কোথাকার এক কবিরাজী ঔষধালয়ের সুবৃহৎ তালিকাপুস্তক ছিল, টানিয়া লইয়া তাহারই পাতার মধ্যে শ্রান্ত চোখ-দুটি মেলিয়া হঠাৎ এক সময়ে সে নিজের দুঃখ ভুলিয়া কোন্‌ এক শ্রীমন্মহারাজাধিরাজের রোগশান্তি হইতে আরম্ভ করিয়া বামুনঘাটি মাইনর স্কুলের তৃতীয় শিক্ষকের প্লীহা-যকৃৎ আরোগ্য হওয়ার বিবরণ পড়িতে পড়িতে ঘুমাইয়া পড়িল।

    দ্বিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

    বেহারা বলিয়াছিল, বাবু ফিরিবেন পরশু কিংবা তরশু কিংবা তাহার পরের দিন নিশ্চয়।

    কিন্তু এই তাহার পরের দিনের নিশ্চয়তাকে সমস্তদিন ধরিয়া পরীক্ষা করিবার মত শক্তি আর অচলার ছিল না। এই তিনদিনের মধ্যে রামবাবু একদিনও আসেন নাই। তাঁহার আসাটাকে সে সর্বান্তঃকরণে ভয় করিয়াছে, অথচ এই না আসার নিহিত অর্থকে কল্পনা করিয়াও তাহার দেহ কাঠ হইয়া গিয়াছে। তিনি অসুস্থ ছিলেন, এবং ইতিমধ্যে পীড়া যে বাড়িতেও পারে, এ কথা তাহার মনেও উদয় হয় নাই। কেবল আজ সকালে ও-বাড়ির দরোয়ান আসিয়াছিল, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ না করিয়া বাহিরে পাঁড়েজির নিকট হইতেই বিদায় লইয়া ফিরিয়া গিয়াছে। সে কেন আসিয়াছিল, কি খবর লইয়া গেল, কোন কথা অচলা ভয়ে কাহাকেও জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিতে পারিল না, কিন্তু তাহার পর হইতেই এই বাড়ি, ঘরদ্বার, এই-সব লোকজন সমস্ত হইতে ছুটিয়া পলাইতে পারিলে বাঁচে, তাহার এমনি মনে হইতে লাগিল।

    বেহারাকে ডাকিয়া কহিল, রঘুবীর, তোমার বাড়ি ত এই দিকে, তুমি মাঝুলি গ্রামটা জানো?

    সে কহিল, অনেককাল পূর্বে একবার বরিয়াত গিয়েছিলাম মাইজী।

    কতদূর হবে বলতে পারো?

    রঘুবীর এদেশের লোক হইলেও বহুদিন বাঙালীর সংস্রবে তাহার অনেকটা হিসাববোধ জন্মিয়াছিল, সে মনে মনে আন্দাজ করিয়া কহিল, ক্রোশ ছয়-সাতের কম নয় মাইজী।

    আজ তুমি আমার সঙ্গে যেতে পারো?

    রঘুবীর ভয়ানক আশ্চর্য হইয়া বলিল, তুমি যাবে? সেখানে যে ভারী পিলেগের বেমারী।

    অচলা কহিল, তুমি না যেতে পারো, আর কোন চাকরকে রাজি করিয়ে দিতে পারো? সে যা বকশিশ চায়, আমি দেবো।

    রঘুবীর ক্ষুণ্ণ হইয়া কহিল, মাইজী, তুমি যেন পারবে, আর আমি পারব না? কিন্তু রাস্তা নেই, আমাদের ভারী গাড়ি ত যাবে না। এক্কা কিংবা খাটুলি—তার কোনটাতেই ত তুমি যেতে পারবে না মাইজী!

    অচলা কহিল, যা জোটে, আমি তাতেই যেতে পারবো। কিন্তু আর ত দেরি করলে চলবে না রঘুবীর। তুমি যা পাও একটা নিয়ে এসো।

    রঘুবীর আর তর্ক না করিয়া অল্পকালের মধ্যেই একটা খাটুলি সংগ্রহ করিয়া আনিল এবং নিজের লোটা-কম্বল লাঠিতে ঝুলাইয়া সেটা কাঁধে ফেলিয়া বীরের মতই পদব্রজে সঙ্গে যাইতে প্রস্তুত হইল। বাড়ির খবরদারীর ভার দরোয়ান ও অন্যান্য ভৃত্যদের উপরে দিয়া কোন এক অজানা মাঝুলির পথে অচলা যখন একমাত্র সুরেশকেই লক্ষ্য করিয়া আজ গৃহের বাহির হইল, তখন সমস্ত ব্যাপারটাই তাহার নিজের কাছে অত্যন্ত অদ্ভুত স্বপ্নের মত ঠেকিতে লাগিল। তাহার বার বার মনে হইল, এই বিচিত্র জগতে এমন ঘটনাও একদিন ঘটিবে, এ কথা কে ভাবিতে পারিত।
    ধূলা-বালির কাঁচা পথ একটা আছে। কিন্তু কখনও তাহা সুবিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে অস্পষ্ট, কখনও বা ক্ষুদ্র গ্রামের মধ্যে লুপ্ত, অবরুদ্ধ। গৃহস্থের সুবিধা ও মর্জিমত তাহার আয়তন ও উদ্দেশ্য পরিবর্তিত হইয়া কখনো বা নদীর ধার দিয়া, কখনো বা গৃহপ্রাঙ্গণের উপর দিয়াই সে গ্রামান্তরে চলিয়া গিয়াছে। প্রথম কিছুদূর পর্যন্ত তাহার কৌতূহল মাঝে মাঝে সজাগ হইয়া উঠিতেছিল। একটা মৃতদেহ একখণ্ড বাঁশে বাঁধিয়া কয়েকজন লোককে নিকট দিয়া বহন করিয়া যাইতে দেখিয়া সংক্রমণের ভয়ে তাহার দেহ সঙ্কুচিত হইয়াছিল, ইচ্ছা করিয়াছিল, জিজ্ঞাসা করিয়া লয়, কিসে মরিয়াছে, ইহার বয়স কত এবং কে কে আছে। কিন্তু পথের দূরত্ব যত বাড়িয়া চলিতে লাগিল, বেলা তত পড়িয়া আসিতে লাগিল এবং কাছে ও দূর গ্রামের মধ্য হইতে কান্নার রোল যত তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিতে লাগিল, ততই সমস্ত মন যেন কি একপ্রকার জড়তায় ঝিমাইয়া পড়িতে লাগিল।

    বহুক্ষণ হইতে তাহার তৃষ্ণাবোধ হইয়াছিল, এখানেই কতকটা পথ নদীর উচ্চ পাড়ের উপর দিয়া যাইতে যাইতে একটা ঘাটের কাছে আসিয়া সে ডুলি থামাইয়া অবতরণ করিল এবং হাত-মুখ ধুইয়া জল খাইবার জন্য নীচে নামিতেই তাহার চোখে পড়িল, গোটা-দুই অর্ধগলিত শব অনতিদূরে আটকাইয়া রহিয়াছে। ইহাদের বীভৎস বিকৃতি তাহার মনের উপর এখন কোন আঘাতই করিল না। অত্যন্ত সহজেই সে হাত-মুখ ধুইয়া জল খাইয়া ধীরে ধীরে গিয়া তাহার খাটুলিতে বসিল। কোন অবস্থাতেই ইহা সে তাহার পক্ষে সম্ভবপর, কিছুকাল পূর্বে এ কথা বোধ করি সে চিন্তাও করিতে পারিত না।

    ইহার পর হইতেই প্রায় গ্রামগুলাই পরিত্যক্ত, শূন্য, কদাচিৎ কোন অত্যন্ত দুঃসাহসী ব্যক্তি ভিন্ন যে যেথায় পারিয়াছে পলায়ন করিয়াছে। কোথাও শব্দ নাই, সাড়া নাই, ঘরদ্বার রুদ্ধ, অপরিচ্ছন্ন—মনে হয় যেন কুটীরগুলা পর্যন্ত মরণকে অনিবার্য জানিয়া চোখ বুজিয়া অপেক্ষা করিয়া আছে। এই মৃত্যুশাসিত নির্জন পল্লীগুলির ভিতর দিয়া চলিতে রঘুবীর ও বাহকদিগের চাপা-গলা এবং ত্রস্ত-ভীত পদক্ষেপে প্রতিমুহূর্তেই অচলাকে বিপদের বার্তা জানাইতে লাগিল, কিন্তু মনের মধ্যে তাহার ভয়ই হইল না, ইহার সহিত তাহার যেন কোন আজন্ম পরিচয় আছে, সমস্ত অন্তঃকরণ এমনি নির্বিকার হইয়া রহিল।

    এইভাবে বাকি পথটা অতিবাহিত করিয়া ইহারা যখন মাঝুলিতে উপস্থিত হইল, তখন বেলা শেষ হইয়া আসিয়াছে। অচলার দৃঢ়-বিশ্বাস ছিল, তাহাদের পথের দুঃখ পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই অবসান হইবে। গ্রামের কৃতজ্ঞ নরনারী ছুটিয়া আসিয়া তাহাদের সংবর্ধনা করিয়া ডাক্তার সাহেবের দরবারে লইয়া যাইবে, তথায় রোগী ও তাহাদের আত্মীয় বন্ধু-বান্ধবের আনাগোনায়, ঔষধ-পথ্যের বিতরণের ঘটায় সমস্ত স্থানটা ব্যাপিয়া যে সমারোহ চলিতেছে, তাহার মধ্যে অচলার নিজের স্থানটা যে কোথায় হইবে, ইহার চিত্রটা সে একপ্রকার কল্পনা করিয়া রাখিয়াছিল। কিন্তু আসিয়া দেখিল, তাহার কল্পনা কেবল নিছক কল্পনাই। তাহার সহিত ইহার কোথাও কোন অংশে মিল নাই, বরঞ্চ যে চিত্র পথের দুই ধারে দেখিতে দেখিতে সে আসিয়াছে, এখানেও সেই ছবি। এখানেও পথে লোক নাই, বাড়িঘর-দ্বার রুদ্ধ, ইহার কোথায় কোন্‌ পল্লীতে সুরেশ বাসা করিয়াছে, খুঁজিয়া পাওয়াই যেন কঠিন।
    এই গ্রামে প্রত্যহই একটা হাট আজও বসে বটে এবং অন্য সময়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরাদমে চলিতেও থাকে সত্য, কিন্তু এখন দুর্দিনের বেচা-কেনা সারিয়া লোকজন অপরাহ্ণের বহু পূর্বেই পলাইয়াছে—ভাঙ্গা হাটের স্থানে স্থানে তাহার চিহ্ন পড়িয়া আছে মাত্র।

    রঘুবীর খোঁজাখুঁজি করিয়া একটা দোকান বাহির করিল। বৃদ্ধ দোকানী ঝাঁপ বন্ধ করিতেছিল; সে কহিল, তাহার ছেলেমেয়েরা সবাই স্থানান্তরে গিয়াছে, কেবল তাহারা দুইজন বুড়া-বুড়ী দোকানের মায়া কাটাইয়া আজিও যাইতে পারে নাই। সুরেশের সম্বন্ধে এইটুকু মাত্র সন্ধান দিতে পারিল যে, ডাক্তার নন্দ পাঁড়ের নিমতলার ঘরে এতদিন ছিলেন বটে, কিন্তু এখনও আছেন কিংবা মামুদপুরে চলিয়া গিয়াছেন সে অবগত নয়।

    মামুদপুর কোথায়?

    সিধা ক্রোশ-দুই দক্ষিণে।

    নন্দ পাঁড়ের বাড়িটা কোন্‌ দিকে?

    বৃদ্ধ বাহির হইয়া দূরে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া একটা বিপুল নিমগাছ দেখাইয়া দিয়া কহিল, এই পথে গেলেই দেখা যাইবে।

    অনতিকাল পরে ভীত পরিশ্রান্ত বাহকেরা যখন নিমতলায় আসিয়া খাটুলি নামাইল, তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে। বাড়িটা বড়, পিছনের দিকে দুই-একটা পুরাতন ইঁটের ঘর দেখা যায়; কিন্তু অধিকাংশই খোলার। সম্মুখে প্রাচীর নাই—চমৎকার ফাঁকা। গৃহস্বামীকে দরিদ্র বলিয়াও মনে হয় না, কিন্তু একটা লোকও বাহির হইয়া আসিল না। কেবল প্রাঙ্গণের একধারে বাঁধা একটা টাটু-ঘোড়া ক্ষুৎপিপাসার নিবেদন জানাইয়া অত্যন্ত করুণকণ্ঠে অতিথিদের অভ্যর্থনা করিল।

    সদর দরজা খোলা ছিল, রঘুবীর সাহস করিয়া ভিতরে গলা বাড়াইতেই দেখিতে পাইল, পাশের বারান্দায় চারপাইয়ের উপর সুরেশ শুইয়া আছে এবং কাছেই খুঁটিতে ঠেস দিয়া একজন অতিবৃদ্ধ স্ত্রীলোক বসিয়া ঝিমাইতেছে।

    বাবুজী।

    সুরেশ চোখ মেলিয়া চাহিল এবং কনুইয়ে ভর দিয়া মাথা তুলিয়া ক্ষণকাল তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া প্রশ্ন করিল, কে, বেয়ারা? রঘুবীর?

    রঘুবীর সেলাম করিয়া কাছে গিয়া দাঁড়াইল, কিন্তু প্রভুর রক্ত-চক্ষুর প্রতি চাহিয়া তাহার মুখের কথা সরিল না।

    তুই এখানে?

    রঘুবীর পুনরায় সেলাম করিল এবং বাহিরের দিকে ইঙ্গিত করিয়া শুধু কেবল বলিল, মাইজী—

    এবার সুরেশ বিস্ময়ে সোজা উঠিয়া বসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, তোকে পাঠিয়েছেন?

    রঘুবীর ঘাড় নাড়িয়া জানাইল, না, তিনি নিজেই আসিয়াছেন।

    জবাব শুনিয়া সুরেশ এমন করিয়া তাহার মুখের প্রতি একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল, যেন কথাটাকে ঠিকমত হৃদয়ঙ্গম করিতে তাহার বিলম্ব হইতেছে। তার পরে চোখ বুজিয়া ধীরে ধীরে শুইয়া পড়িল, কিছুই বলিল না।

    অচলা আসিয়া যখন নীরবে খাটিয়ার একধারে তাহার গায়ের কাছেই উপবেশন করিল, তখন কিছুক্ষণের নিমিত্ত সে তেমনি নিমীলিত-নেত্রে মৌন হইয়া রহিল, ভদ্রতা রক্ষা করিতে সামান্য একটা ‘এসো’ বলিয়াও ডাকিতে পারিল না। শিশুকাল হইতে চিরদিন অত্যধিক যত্ন-আদরে লালিত-পালিত হইয়া আবেগে ও প্রবৃত্তির বশেই সে চলিয়াছে, ইহাদের সংযত করার শিক্ষা তাহার কোনকালে হয় নাই। এই শিক্ষা জীবনে সে প্রথম পাইয়াছিল, কেবল সেইদিন, যেদিন তাহার মুখের হাসিকে পদাঘাত করিয়া মুখ ফিরাইয়া মহিম ঘরে চলিয়া গেল। সেদিন একনিমেষে তাহার বুকের মধ্যে নীরবে যে কি বিপ্লব বহিয়া গেল, সে শুধু অন্তর্যামীই জানিলেন এবং আজও কেবল তিনিই দেখিলেন, ঐ শান্ত অচঞ্চল দেহটার সর্বাঙ্গ ব্যাপিয়া কতবড় ঝড় প্রবাহিত হইতেছে। সেদিনও মহিমের আঘাতকে সে যেমন করিয়া সহ্য করিয়াছিল, আজও তেমনি করিয়াই সে তাহার উন্মত্ত আবেগের সহিত নিঃশব্দে লড়াই করিতে লাগিল—তাহার লেশমাত্র আক্ষেপ প্রকাশ পাইতে দিল না।
    এমন করিয়া যে কতক্ষণ কাটিত বলা যায় না, কিন্তু বাহকদের আহ্বানে রঘুবীর বাহিরে চলিয়া গেলে, সেই শব্দে সুরেশ ধীরে ধীরে চোখ মেলিয়া চাহিল। কহিল, তুমি আমার চিঠি পেয়েছ? অচলা মুখ তুলিয়াই আস্তে আস্তে বলিল, না।

    সুরেশ একটু বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, চিঠি না পেয়েই এসেছ, আশ্চর্য! যাই হোক, এ ভালই হল যে একবার দেখা হল। বলিয়া একটা কথার জন্য তাহার আনত মুখের প্রতি একমুহূর্ত চাহিয়া থাকিয়া নিজেই কহিল, আমার জন্য তোমাকে অনেক দুঃখ পেতে হল—খুব সম্ভব যতদিন বাঁচবে, এর জের মিটবে না, কিন্তু সমস্ত ভুল হয়েছিল এই যে, মহিমকে তুমি যে এতটা বেশি ভালবাসতে তা আমিও বুঝিনি, বোধ হয় তুমিও কোনদিন বুঝতে পারোনি! না?

    কিন্তু অচলা তেমনি অধোমুখে নিরুত্তরে বসিয়া রহিল দেখিয়া সে আবার বলিল, তা ছাড়া আমার বিশ্বাস, মানুষের মন বলে স্বতন্ত্র কোন একটা বস্তু নেই। যা আছে, সে এই দেহটার ধর্ম। ভালবাসাও তাই। ভেবেছিলাম, তোমার দেহটাকে কোনমতে পেলে মনটাও পাবো, তোমার ভালবাসাও দুষ্প্রাপ্য হবে না—কে জানে হয়ত সত্যিই কোনদিন ভাগ্য সুপ্রসন্ন হতো—হয়ত যা সর্বস্ব দিয়ে এমন করে চেয়েছিলাম, তাই তুমি একদিন নিজের ইচ্ছেয় আমাকে ভিক্ষে দিতে। কিন্তু আর তার সময় নেই; আমি অপেক্ষা করবার অবসর পেলাম না। বলিয়া সে পুনরায় কনুইয়ে ভর দিয়া মাথা তুলিল এবং সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোকের মধ্যে নিজের দুই চক্ষের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করিয়া অচলার আনত মুখের প্রতি নিবদ্ধ করিয়া স্তব্ধ হইয়া রহিল।

    একজনের এই একাগ্র দৃষ্টি আর একজনের সন্নত দৃষ্টিকে যেন আকর্ষণ করিয়া তুলিল—কিন্তু পলকমাত্র। অচলা তৎক্ষণাৎ চোখ নামাইয়া লইয়া অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে অত্যন্ত লজ্জার সহিত কহিল, এদেশ থেকে ত সবাই পালিয়েছে—এখানকার কাজ যদি তোমার শেষ হয়ে থাকে ত বাড়ি, কিংবা আরও কত দেশ আছে—তুমি চল, ডিহরীতে আর একদণ্ড টিকতে পাচ্চিনে।

    সে আমার বেশি আর কে জানে? বলিয়া একটা নিশ্বাস ফেলিয়া সুরেশ বালিশে মাথা দিয়া শুইয়া পড়িল এবং কিছুক্ষণ নিঃশব্দে স্থিরভাবে থাকিয়া ধীরে ধীরে বলিতে লাগিল, অনেক কষ্টে আজ সকালে দু’খানা চিঠি পাঠাতে পেরেছি। একখানা তোমাকে, আর একখানা মহিমকে। সে যদি না এর মধ্যে চলে গিয়ে থাকে ত নিশ্চয় আসবে, আমি জানি।

    শুনিয়া অচলা ভয়ে, বিস্ময়ে চমকিয়া উঠল, কহিল, তাঁকে কেন?

    সুরেশ তেমনি ধীরে ধীরে বলিল, এখন তাকেই আমার একমাত্র প্রয়োজন। ছেলেবেলা থেকে সংসারের মধ্যে অনেকদিন অনেক গ্রন্থিই পাকিয়েছি, আর তাদের খোলবার জন্যে এই মানুষটিকে চিরদিন আবশ্যক হয়েছে! তাই আজও তাকেই আমার ডাক দিতে হয়েছে। এত ধৈর্য পৃথিবীতে আর ত কারও নেই!

    অচলার বুকের মধ্যে তোলপাড় করিতে লাগিল, কিন্তু সে অধোমুখে স্থির হইয়া শুনিতে লাগিল। সুরেশ বলিল, আমার চিঠির মধ্যে প্রায় সব কথাই লেখা আছে—পড়লেই টের পাবে। সেদিন তোমার হাতে আমার সমস্ত সম্পত্তির পাকা উইলখানাই দিয়েছি। ইচ্ছে করলে তার অনেক জিনিসই তুমি নিতে পারো, কিন্তু আমি বলি, নিয়ে কাজ নেই। বরঞ্চ আমি বেঁচে থাকলেও যেমন গরীব-দুঃখীরাই সমস্ত পেতো, আমার মরণের পরেও যেন তারাই পায়। আমার কিছুর সঙ্গেই আর তুমি নিজেকে জড়িয়ে রেখ না অচলা—তুমি নিশ্চিন্ত হও, নির্বিঘ্ন হও—আমার সমস্ত সংস্রব থেকে তুমি নিজেকে যেন সর্বতোভাবে বিচ্ছিন্ন করতে পারো। চেষ্টা করলে পৃথিবীতে অনেক দুঃখই সহা যায়—আমার দেওয়া দুঃখেও যেন একদিন তুমি অনায়াসে সইতে পারো।
    তাহার আচরণে ও কথা বলার ভঙ্গিতে অচলার মনের মধ্যে আসিয়া পর্যন্তই কেমন যেন ভয় ভয় করিতেছিল, এই শেষের কথাটায় সে যথার্থই ভীত হইয়া বলিয়া উঠিল, তুমি এ-সব কথা তুলচ কেন? উঠে বস না! যাতে আমরা এখনি বার হয়ে পড়তে পারি, তার উদ্যোগ করে দাও না!

    তাহার আশঙ্কা ও উত্তেজনা লক্ষ্য করিয়াও সুরেশ কোন উত্তর দিল না। যে বৃদ্ধা খুঁটি ঠেস দিয়া ঝিমাইতেছিল, সে সজাগ হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, বাবু এখন ঘরের মধ্যে যাবেন, না আলোটা বাইরে এনে দেবে—তাহারও কোন জবাব দিল না; মনে হইতে লাগিল, সহসা যেন সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। উদ্বিগ্ন অচলা তাহার পূর্ব প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি করিতে যাইতেছিল, সুরেশ চোখ মেলিয়া অত্যন্ত সহজভাবে কহিল, এখনও তোমাকে আমার আসল কথাটাই বলা হয়নি অচলা, আমি মরতে বসেছি—আমার বাঁচবার বোধ করি আর কোন সম্ভাবনাই নেই।

    প্রত্যুত্তরে শুধু একটা অস্ফুট, অব্যক্ত কণ্ঠস্বর অচলার গলা হইতে বাহির হইয়া আসিল, তার পরেই সে মূর্তির মত নিস্পন্দ হইয়া বসিয়া রহিল।

    সুরেশ বলিতে লাগিল, আগে থেকেই আমি উইল করে রেখেছি বটে, কিন্তু কেউ যদি মনে করে, আমি ইচ্ছে করে মরচি, সে অন্যায়, সে মিথ্যা—সে আমার মরার বেশি ব্যথা হবে। আমি সতর্কতার এতটুকু ত্রুটি করিনি, কিন্তু কাজে লাগল না। যদি কখনো তোমাকে কেউ জিজ্ঞাসা করে, তাদের তুমি এই কথাটা বলো যে, সংসারে আরও পাঁচজনের যেমন মৃত্যু হয়, তাঁরও মৃত্যু তেমনি হয়েছে,—মরণকে কেবল এড়াতে পারেন নি বলেই মরেছেন, নইলে মরবার ইচ্ছে তাঁর ছিল না। মরণের মধ্যে আমার কোন হাত, কোন বিশেষত্ব ছিল, এই অপরাধটা আমাকে যেন কেউ না দেয়।

    অচলা কিছুই বলিল না। কথা কহিবার শক্তি যে তাহার শুকাইয়া গিয়াছিল, এ কথা সেই প্রায়ান্ধকারের মধ্যে তাহার ভয়ার্ত মুখের প্রতি চাহিয়া সুরেশ ধরিতে পারিল না। ক্ষণকাল আপনাকে সে সংবরণ করিয়া লইয়া পুনরায় বলিতে লাগিল, আমি না এসে থাকতে পারিনে বলেই তোমাকে লুকিয়ে সেদিন ভোরবেলায় পালিয়ে এসেছিলুম। এসে দেখি, গ্রাম প্রায় শূন্য। এ বাড়িতে একটা চাকর মরেছে এবং তার কোন গতি না করেই বাড়িসুদ্ধ সবাই পালাতে উদ্যত হয়েছে। তাদের নিরস্ত করতে পারলুম না বটে; কিন্তু মড়াটার একটা উপায় হল। ফিরে এসে ভাবলুম, আমিও বাড়ি চলে যাই; কিন্তু দুপুরবেলা মামুদপুর থেকে একটা ছেলে কাঁদতে কাঁদতে এসে জানালে, তার মায়ের খুব অসুখ। তাকে অস্ত্র করতে গিয়েই নিজের এই বিপদ ঘটালুম। এমন অনেক ত করেছি, আমি সাবধানও কম নই, কিন্তু এবার দুর্ভাগ্য এমনি যে, এক্কার চাকায় বুড়ো আঙুলের পিছনটা যে ঘষে গিয়েছিল, সেটা কেবল চোখে পড়ল হাতের রক্ত ধুতে গিয়ে। তাড়াতাড়ি ফিরে এসে যা করবার সমস্তই করলুম, বাড়ি যাবার উপায় থাকলে আমি চলেই যেতুম, কিছুতেই থাকতুম না, কিন্তু কোন উপায় করতে পারলুম না। কাল রাত্রে জ্বরবোধ হ’ল—এ যে কিসের জ্বর সে যখন বুঝতে আর বাকি রইল না, তখন অনেক কষ্টে, অনেক চেষ্টায় একটা লোক দিয়ে তোমাদের দু’জনকে দু’খানা চিঠি লিখে পাঠিয়েছি।
    অচলা অশ্রু-ব্যাকুলকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, কিন্তু এখন ত উপায় আছে, আমার ডুলিতে তোমাকে নিয়ে এখনি আমি বেরিয়ে পড়ব—আর একমিনিট থাকতে দেব না।

    কিন্তু তুমি?

    আমি হেঁটে যাবো—আমার কথা তুমি কিছুতে ভাবতে পাবে না।

    হেঁটে যাবে? এতটা পথ?

    তোমার পায়ে পড়ি, তুমি আর বাধা দিয়ো না, বলিতে বলিতেই অচলা কাঁদিয়া ফেলিল।

    সুরেশ পলকমাত্র মৌন হইয়া রহিল, তার পরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া ধীরে ধীরে বলিল, আচ্ছা, তাই চল। কিন্তু বোধ হয়, এর আর প্রয়োজন ছিল না।

    অচলা বাহিরে আসিয়া দেখিল, গাছতলায় বসিয়া রঘুবীর নীরবে চানাভাজা চর্বণ করিতেছে। কহিল, রঘুবীর, বাবুর বড় অসুখ, তাঁকে এক্ষুণি নিয়ে যেতে হবে। ডুলিওয়ালাদের বল, তারা যত টাকা চায়, আমি তার চেয়ে বেশি দেব—কিন্তু আর একমিনিটও দেরি নয়।

    প্রভুপত্নীর ব্যাকুল কণ্ঠস্বরে রঘুবীর চমকাইয়া উঠিয়া দাঁডাইল, কহিল, কিন্তু তারা ত দু’জনকে বইতে পারবে না মাইজী!

    না না, দু’জনকে নয়। আমি হেঁটে যাবো, কিন্তু আর একমিনিটও দেরি চলবে না রঘুবীর, তুমি শিগ্‌গির যাও—কোথায় তারা?

    রঘুবীর কহিল, ভাড়ার টাকা নিয়ে তারা দোকানে গেছে খাবার কিনতে। এখুনি ডেকে আনচি মাইজী, বলিয়া সে অভুক্ত চানাভাজা গাত্রবস্ত্রের খুঁটে বাঁধিতে বাঁধিতে একপ্রকার ছুটিয়া চলিয়া গেল।

    ফিরিয়া আসিয়া অচলা সুরেশের শিয়রে বসিল, এবং হাত দিয়া তাহার কপালের উত্তাপ অনুভব করিয়া আশঙ্কায় পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মুনিয়ার মা কেরোসিনের ডিবা জ্বালিয়া অনতিদূরে মেঝের উপর রাখিয়া গিয়াছিল, তাহার অপর্যাপ্ত ধূমে সমস্ত স্থানটা কলুষিত হইয়া উঠিতেছিল, সেইটা সরাইতে গিয়া একটা ঔষধের শিশি অচলার চোখে পড়িল; জিজ্ঞাসা করিল, একি তোমার ওষুধ?

    সুরেশ বলিল, হাঁ, আমারই। কাল নিজেই তৈরি করেছিলুম, কিন্তু খাওয়া হয়নি। দাও—

    কথাটা অচলাকে তীব্র আঘাত করিল, কিন্তু না খাওয়ার হেতু লইয়াও আর সে কথা বাড়াইতে ইচ্ছা করিল না। ঔষধ দিয়া শিয়রে আসিয়া সে আবার তেমনি নীরবে উপবেশন করিল। অনেকক্ষণ হইতেই সুরেশ মৌন হইয়াই ছিল, কিন্তু সে নিঃশব্দে কত বড় যাতনা সহিতেছে, ইহাই উপলব্ধি করিয়া অচলার বুক ফাটিতে লাগিল।

    বিলম্ব হইতেছে—রঘুবীরের দেখা নাই। মাঝে মাঝে সে পা টিপিয়া উঠিয়া গিয়া দরজায় মুখ বাড়াইয়া অন্ধকারে যতদূর দেখা যায়, দেখিবার চেষ্টা করিতে লাগিল, কিন্তু কোথাও কাহারও সাড়া নাই। অথচ পাছে এই উৎকণ্ঠা তাহার কোনমতে সুরেশের কাছে ধরা পড়িয়া যায়, এই ভয়েও সে ব্যাকুল হইয়া পড়িল।

    রাত্রি বাড়িয়া যাইতে লাগিল, খুঁটির কাছে মুনিয়ার মায়ের নাসিকা ডাকিয়া উঠিল—এমন সময় ক্ষুধিত পথশ্রান্ত রঘুবীর ভগ্নদূতের ন্যায় উপস্থিত হইয়া ম্লান মুখে জানাইল বেহারারা ডুলি লইয়া বহুক্ষণ চলিয়া গিয়াছে, কোথাও তাহাদের সন্ধান মিলিল না।

    অচলা সমস্ত ভুলিয়া বিকৃত-কণ্ঠে বারংবার প্রশ্ন করিতে লাগিল, তাহারা কখন গেল? কোন্‌ পথে গেল? এবং কিজন্য গেল? আমাদের যা-কিছু, সমস্ত দিলেও কি আর একখানা সংগ্রহ করা যায় না?
    রঘুবীর অধোমুখে স্তব্ধ হইয়া রহিল। এই নিদারুণ বিপত্তি তাহারই অবিবেচনায় ঘটিয়াছে, ইহা সে জানিত; তাই সে তাহার প্রাণপণ চেষ্টা নিষ্ফল করিয়া তবেই ফিরিতে পারিয়াছিল।

    কিন্তু আরও একজন তাহারি মত নিঃশব্দে স্থির হইয়া শয্যার ’পরে পড়িয়া রহিল। এই চঞ্চলতার লেশমাত্রও যেন তাহাকে স্পর্শ করিতে পারিল না। রঘুবীর চলিয়া গেলে সে আস্তে আস্তে বলিল, ব্যস্ত হয়ে কি হবে অচলা, তাদের পেলেও কোনও লাভ হতো না। এই ভাল—আমার এই ভাল।

    আর অচলা কথা কহিল না, কেবল সেই অনন্ত পথযাত্রীর তপ্ত ললাটে ডান হাতখানি রাখিয়া পাষাণ-প্রতিমার ন্যায় স্থির হইয়া রহিল।

    তাহার চারিদিকে জনহীন পুরী মৃত্যুর মত নির্বাক্‌ হইয়া আছে। বাহিরে গভীর রাত্রি গভীরতর হইয়া চলিয়াছে, চোখের উপর কালো আকাশ গাঢ় হইয়া উঠিয়াছে—সেইদিকে চাহিয়া তাহার কেবলই মনে হইতে লাগিল ইহার কি প্রয়োজন ছিল! ইহার কি প্রয়োজন ছিল!

    এই যে তাহার জীবন-কুরুক্ষেত্র ঘেরিয়া এতবড় একটা কদর্য সংগ্রাম চলিয়াছে, সংসারে ইহার কি আবশ্যক ছিল? দুনিয়ার সমস্ত জ্বালা, সমস্ত হীনতা, সকল স্বার্থ মিটাইয়া সে কি ওই রাত্রির মত আজই শেষ হইয়া যাইবে? তার পরে সমস্ত জীবনটা কি তাহার কুরুক্ষেত্রের মত কেবল শ্মশান হইয়া যুগ যুগ পড়িয়া রহিবে? এখানে কি চিতার দাহচিহ্ন কোনদিন মিলাইবে না? পৃথিবীতে ইহাও কি প্রয়োজনের মধ্যে?

    কিন্তু এ কুরুক্ষেত্র কেন বাধিল? কে বাধাইল? এই যে মানুষটি তাহার সকল ঐশ্বর্য, সকল সম্পদ, সকল আত্মীয়-পরিজন হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া এমন একান্ত নিরুপায়ের মরণ মরিতে বসিয়াছে, এই কি কেবল এতবড় বিপ্লব একা ঘটাইয়াছে? আর কি কাহারও মনের মধ্যে লুকাইয়া কোন লোভ কোন মোহ ছিল না? কোথাও কোন পাপ কি আর কেহ করে নাই?

    কিন্তু সহসা চিন্তাটাকে সে যেন সজোরে ঠেলিয়া ফেলিয়া একটুখানি নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। কে যেন দুই হাত দিয়া চাপিয়া তাহার কণ্ঠরোধ করিতে বসিয়াছিল। সেই সময় সুরেশও জল চাহিল। হেঁট হইয়া মুখে তাহার জল দিয়া আবার অচলা স্থির হইয়া বসিল। তাহার শ্রান্তি নাই, ক্লান্তি নাই, চোখ হইতে নিদ্রার আভাসটুকু পর্যন্ত যেন তিরোহিত হইয়া গিয়াছে। সেই দুটি শুষ্ক চোখ মেলিয়া আবার সে নীরব আকাশের প্রতি একদৃষ্টে তাকাইয়া রহিল। বহুদিন পূর্বে অনেক যত্ন করিয়া যে মহাভারতখানি শেষ করিয়াছিল—আজ তাহারই শেষ সর্বনাশ যেন তাহারই মনের মধ্যে ছায়াবাজির ন্যায় প্রবাহিত হইয়া যাইতে লাগিল। সেখানে যেন কত রক্ত ছুটিতেছে, কত অজানা লোক মিলিয়া কাটাকাটি মারামারি করিয়া মরিতেছে—কত শত-সহস্র চিতা জ্বলিতেছে, নিবিতেছে—তাহার ধূমে ধূমে সমস্ত স্বর্গ-মর্ত্য একেবারে যেন আচ্ছন্ন একাকার হইয়া গিয়াছে!

    কিছুক্ষণের জন্য সুরেশ বোধ হয় তন্দ্রামগ্ন হইয়া পড়িয়াছিল—তাহার সাড়া ছিল না। কিন্তু এমন করিয়া যে কতক্ষণ গেল, কি করিয়া বাহিরে যে সময় কাটিতে লাগিল, কি করিয়া যে রাত্রি প্রভাতের পথে অগ্রসর হইতেছিল, সেদিকেও অচলার চৈতন্য ছিল না। তাহার নিমীলিত চক্ষের কোণ বাহিয়া জল পড়িতেছিল, স্রস্ত হাতদুটি সুরেশের বালিশের উপর পড়িয়া, সে একান্ত-মনে বলিতেছিল, হে ঈশ্বর! আমি অনেক দুঃখ, অনেক ব্যথা পাইয়াছি, আজ আমার সকল দুঃখ, সকল ব্যথার পরিবর্তে একে তুমি ক্ষমা করিয়া কোলে তুলিয়া লও; আমার মা নাই, বাপ নাই, স্বামী নাই—এত বড় লজ্জা লইয়া কোথাও আমার দাঁড়াইবার স্থান নাই। আমি কত যে সহিয়াছি, সে ত তুমি জান—আর আমাকে বাঁচিতে দিয়ো না প্রভো! আমাকেও তোমার কাছে টানিয়া লও!
    কথাগুলি সে যে কতভাবে কতরকমে মনে মনে আবৃত্তি করিল, তাহার অবধি নাই—অশ্রুজলও যে কত ঝরিয়া পড়িল তাহারও সীমা নাই।

    মাইজী।

    তখন সবেমাত্র প্রভাত হইয়াছে, অচলা চমকিয়া দেখিল, রঘুবীর কাহার যেন প্রবেশের অপেক্ষায় সদর-দরজা উন্মুক্ত করিয়া দাঁড়াইয়াছে।

    কি রঘুবীর? বলিয়াই যাহার সহিত তাহার চোখে চোখে দেখা হইয়া গেল, সে মহিম। একবার সে কাঁপিয়া উঠিয়াই দৃষ্টি অবনত করিল।

    দ্বারের কাছে মুহূর্তের জন্য মহিমের পা উঠিল না, এখানে এমন করিয়া যে আবার তাহার সহিত দেখা হইবে, ইহা সে প্রত্যাশা করে নাই। কিন্তু পরক্ষণেই ধীরে ধীরে সে কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে প্রশ্ন করিল, এখন সুরেশ কেমন আছে?

    অচলা মুখ তুলিল না, কথা কহিল না, শুধু মাথা নাড়িয়া বোধ হয় ইহাই জানাইতে চাহিল, সে ইহার কিছুই জানে না।

    মিনিট-খানেক স্থির থাকিয়া মহিম সুরেশের ললাট স্পর্শ করিতেই সে চোখ মেলিয়া চাহিল। সেই জ্যোতিহীন রক্তনেত্রের প্রতি চাহিয়া মহিমের গলা দিয়া সহসা স্বর ফুটিল না। তার পরে কহিল, কেমন আছ সুরেশ?

    ভালো না—চললুম। তুমি আসবে আমি জানি—আমার সুমুখে এসে বস।

    মহিম উঠিয়া গিয়া শয্যার একাংশে তাহার পায়ের কাছে বসিল। বলিল, ডিহরীতে ডাক্তার আছে, আমার এক্কায় কোনমতে—

    সুরেশ মাথা নাড়িয়া বলিল, না টানাটানি করো না, মজুরী পোষাবে না। আমাকে quietly যেতে দাও।

    কিন্তু এখনো ত—

    হ্যাঁ, এখনো হুঁশ আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে ভুল হচ্ছে। আমার জীবনটা গরীব-দুঃখীর কাজে লাগাতে পারলুম না, কিন্তু সম্পত্তিটা যেন তাদের কাজে লাগে মহিম। তাই কষ্ট দিয়ে এতদূর তোমাকে টানে এনেছি, নইলে মৃত্যুকালে ক্ষমা চেয়ে কাব্য করবার প্রবৃত্তি আমার নেই।

    মহিম নীরব হইয়া রহিল।

    সুরেশ বলিতে লাগিল, ও-সব আমি বিশ্বাসও করিনে, ভালও বাসিনে। একটা দিনের ক্ষমার প্রতি আমার লোভও নেই। ভাল কথা, একটা উইল আছে। অচলাকে আমি কিছুই দিইনি—আর তাকে অপমান করতে আমার হাত উঠল না। তবে দরকার বোঝ ত সামান্য কিছু দিয়ো।
    মহিম ব্যাকুল হইয়া উঠিল, আর আমাকে কেন এর মধ্যে জড়াচ্ছো সুরেশ?

    সুরেশ বলিল, ঠিক এই জন্যই যে, তোমাকে জড়ানো যায় না। যার লোভ নাই, যার ন্যায়ান্যায়ের বিচার—হঠাৎ উপরের দিকে দৃষ্টি তুলিয়া কহিল, কিন্তু সারারাত তুমি বসে আছ অচলা—যাও, হাতমুখ ধোও গে। মুনিয়ার মা সমস্ত দেখিয়ে দেবে—যাও—

    সে উঠিয়া গেলে কহিল, কেবল একটা জিনিসের জন্য আমার ভারী দুঃখ হয়। অচলা যে তোমাকে কত ভালবাসত, সে আমিও বুঝিনি, তুমিও বোঝোনি—ও নিজেও বুঝতে পারেনি। সেটা তোমার দারিদ্র্যের সঙ্গে এমনি ঘুলিয়ে উঠল যে—যাক! এমন সুন্দর জিনিসটি মাটি করে ফেললুম—না পেলুম নিজে, না পেতে দিলুম অপরকে। কিন্তু কি আর করা যাবে! পিসীমাকে একটু দেখো—শোকটা তাঁর ভারী লাগবে।

    বৃদ্ধ মুনিয়ার মা ঔষধের শিশি লইয়া কাছে দাঁড়াইতেই সে উত্ত্যক্তস্বরে বলিয়া উঠিল, না না, আর ঔষধ নয়। একটু জল দে। একটা নাটক লিখতে আরম্ভ করেছিলুম মহিম, আমার ড্রয়ারে আছে—পারো ত পড়ো।

    মহিম তাহার মুখের পানে চাহিতে পারিতেছিল না, অধোমুখে শুনিতেছিল—এইবার চোখ তুলিয়া কি একটা বলিবার চেষ্টা করিতেই সুরেশ থামাইয়া দিয়া বলিল, আর না মহিম, একটু ঘুমুই। খাবার-দাবার সমস্ত যোগাড় আছে, কিন্তু সে ত তোমাদের ভাল লাগবে না। বলিয়া সে চোখ বুজিল।

    মহিম ক্ষণকাল চুপ করিয়া আস্তে আস্তে বলিল, আমার শেষ অনুরোধ একটা রাখবে সুরেশ ?

    কি?

    তুমি ভগবানকে কোনদিন ভাবোনি, তাঁর কথা—ও আমার ভাল লাগে না। বলিয়া সুরেশ মুখখানা বিকৃত করিয়া পাশ ফিরিয়া শুইল। মহিম প্রাণপণে একটা অদম্য দীর্ঘশ্বাস চাপিয়া লইয়া নির্বাক হইয়া রহিল।

    ত্রিচত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

    রামবাবু বাড়ি ছিলেন না। পরদিন বক্সার হইতে ফিরিয়া মহিমের চিঠি পড়িয়া বাহির হইতে মুহূর্ত বিলম্ব করিলেন না—সমস্ত পথ ঘোড়াটাকে নির্মম ছুটাইয়া আধমরা করিয়া তুলিয়া যখন মাঝুলিতে পৌঁছিলেন তখন বেলা অবসান হইতেছে। পুলিশের দারোগা ভাবিয়া দোকানী স্বয়ং পথ দেখাইয়া নন্দ পাঁড়ের নিমতলায় আনিয়া উপস্থিত করিল এবং এক্কা হইতে অবতরণকালে সসম্মানে ঘোড়ার লাগাম ধরিল। ইহারই কাছে খবর পাইয়া জানিলেন, অচলাও আসিয়াছে। সদর-দরজা খোলা ছিল, ভিতরে পা দিয়াই ব্যাপারটা বুঝিতে বাকি রহিল না। ঘণ্টা-দুই হইল সুরেশের মৃত্যু হইয়াছে। খাটিয়ার উপর তাহার মৃতদেহ আপাদমস্তক চাপা দেওয়া এবং অনতিদূরে পায়ের কাছে অচলা চুপ করিয়া বসিয়া।

    অকস্মাৎ এই দৃশ্য বৃদ্ধ সহিতে পারিলেন না—মা গো! বলিয়া উচ্ছ্বসিত শোকে কাঁদিয়া উঠিলেন।

    অচলা মুখ তুলিয়া একবার চাহিল মাত্র, তার পরে তেমনি অধোমুখে নিঃশব্দে বসিয়া রহিল। এই আর্তকণ্ঠ যেন শুধু তাহার কানে গেল, কিন্তু ভিতরে পৌঁছিল না।

    মহিম বাটীর মধ্যে কাঠের সন্ধান করিতেছিল, ক্রন্দনের শব্দে বাহির হইয়া আসিল। কহিল, সুরেশ এই কতক্ষণ মারা গেল রামবাবু! আপনি এসেছেন, ভালই হয়েছে, নইলে একলা বড় অসুবিধে হতো।

    রামবাবু নীরবে চোখ মুছিতে লাগিলেন। তিনি কি করিবেন, কি বলিবেন, কি করিয়া ওই মেয়েটার চোখের উপর ঐ ভীষণ নিদারুণ কার্যে সাহায্য করিতে অগ্রসর হইবেন, তাহার কূলকিনারা ভাবিয়া পাইলেন না।

    মহিম কহিল, নদী দূরে নয়, রঘুবীর কিছু কিছু কাঠ বয়ে নিয়ে গেছে, আরও কিছু কাঠ পাওয়া গেছে—সেইটে পাঠিয়ে দিয়ে আমরা তিনজনেই ওকে নিয়ে যেতে পারবো। নইলে গ্রামে আর লোক নেই, থাকলেও বোধ হয় কেউ বাঙালীর মড়া ছোঁবে না।

    রামবাবু তাহা জানিতেন। অচলার অগোচরে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করিলেন, আমরা দু’জন আর কে?

    মহিম বলিল, রঘুবীরও হয়ত সাহায্য করতে পারে।

    শুনিয়া বৃদ্ধ ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, কহিলেন, না না, সে কিছুতেই হলে চলবে না। ব্রাহ্মণের শব আর কাকেও আমি ছুঁতে দিতে পারব না। নদী যখন দূরে নয়, তখন আমাদের দু’জনকেই যেমন করে হোক নিয়ে যেতে হবে।

    বেশ তাই, বলিয়া মহিম পুনরায় ভিতরে গিয়া কাষ্ঠ-সংগ্রহে প্রবৃত্ত হইল। রামবাবু সেই বারান্দায় একপ্রান্তে মুখ ফিরাইয়া খুঁটি ঠেস দিয়া নিঃশব্দে বসিয়া রহিলেন।

    তাঁহার বয়স হইয়াছে; এই সুদীর্ঘকালের মধ্যে অনেক মৃত্যু দেখিয়াছেন, অনেক গভীর শোকের মধ্যে দিয়াও তাঁহাকে ধীরে ধীরে পথ চলিতে হইয়াছে। সুদুঃসহ দুঃখের সে করুণ সুর একে একে তাঁহার হৃদয়-বীণায় বাঁধা হইয় গিয়াছে, আজিকার এই ব্যাপারটা সেই তারে ঘা দিয়া যেন কেবলি বেসুরে বাজিতে লাগিল। একদিন এই সুরমাই জ্যাঠামশাই বলিয়া তাঁহার বুকের উপর আছাড় খাইয়া পড়িয়াছিল—সে ছবি তিনি ভুলেন নাই। আজও তাঁহার পিতৃস্নেহ যেন সেই বস্তুটার লোভেই ভিতরে ভিতরে গুমরিয়া মরিতে লাগিল। তাহাকে কি সান্ত্বনা দিবেন তিনি জানেন না, তাহাকে প্রবোধ দিবার মত সংসারে কোথায় কি আছে তাহাও তিনি অবগত নন; তবুও তাঁহার শোকাতুর মন যেন কেবলি চাহিতে লাগিল, একবার মেয়েটাকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বলেন, ভয় কি মা! আজও যে আমি বাঁচিয়া আছি।
    কিন্তু সে সুর বাজিল কৈ? তাঁহার সে তৃষ্ণা মিটাইতে কেহ ত একপদ অগ্রসর হইয়া আসিল না! সুরমা যে তেমনি নীরবে, তেমনি দূরতম অনাত্মীয়ের ব্যবধান দিয়া আপনাকে পৃথক্‌ করিয়া রাখিয়া দিল!

    দুঃখের দিনে, বিপদের দিনে, ইহাদের অনেক দুর্জ্ঞেয় বেদনা, নির্বাক্‌ মর্মপীড়ার পাশ দিয়া তাঁহাকে চলিতে হইয়াছে, প্রছন্ন রহস্যের ইঙ্গিত মাঝে মাঝে তাঁহাকে খোঁচা দিয়া গিয়াছে, কিন্তু কোনদিন আপনাকে আহত হইতে দেন নাই—সমস্ত সংশয় স্নেহের আবরণে চাপা দিয়া, বাহিরের আকাশ নির্মল মেঘমুক্ত রাখিয়াছেন; কিন্তু আজ সদ্যবিধবার ওই একান্ত অপরিচিত নিষ্ঠুর ধৈর্য তাঁহার এতদিনের আড়াল-করা স্নেহের গা চিরিয়া কলুষের বাষ্পে হৃদয় যেন ভরিয়া দিতে লাগিল।

    সূর্য অস্ত গেল। মহিম ওদিকের কাজ একপ্রকার শেষ করিয়া কাছে আসিয়া কহিল, রামবাবু, এইবার ত ওকে নিয়ে যেতে হয়। অচলার দিকে ফিরিয়া বলিল, আলোটা জ্বেলে দিয়েছি, তুমি মুনিয়ার মার কাছে বসে থাকো, আমাদের ফিরতে বোধ হয় খুব বিলম্ব হবে না।

    অচলা কোন কথাই বলিল ন। রামবাবু আত্মসংবরণ করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তিনি মাথা নাড়িলেন। অচলার আনত মুখের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া রুদ্ধ স্বর পরিষ্কার করিয়া ভগ্নকণ্ঠে কহিলেন, মা, একথা বলতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে, কিন্তু স্ত্রীর শেষ কর্তব্য ত তোমাকে করতে হবে। তোমাকেই ত মুখাগ্নি—বলিতে বলিতে তিনি হুহু করিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন।

    অচলার শুষ্ক মুখ, ততোধিক শুষ্ক চোখ-দুটি বৃদ্ধের প্রতি নিবদ্ধ করিয়া মুহূর্তকাল স্থির হইয়া রহিল, তার পরে শান্ত মৃদুকণ্ঠে কহিল, মুখাগ্নির আবশ্যক হয় ত আমি করতে পারি। হিন্দুধর্মে এর যদি কোন সত্যকার ফল থাকে, তা আর আমি ব্যর্থ করতে চাইনে। আমি তাঁর স্ত্রী নই।

    রামবাবু বজ্রাহতের ন্যায় পলকহীন চক্ষে চাহিয়া থাকিয়া অবশেষে আস্তে আস্তে বলিলেন, তুমি সুরেশের স্ত্রী নও?

    অচলা তেমনি অবিচলিতস্বরে বলিল, না, উনি আমার স্বামী নন।

    চক্ষের নিমিষে রামবাবুর সমস্ত ঘটনা স্মরণ হইয়া গেল। তাঁহার বাটীতে আশ্রয় গ্রহণ করা হইতে আরম্ভ করিয়া সেদিনের সে মূর্ছা পর্যন্ত যাবতীয় ব্যাপার বিদ্যুদ্বেগে বার বার তাঁহার মনের মধ্যে আবর্তিত হইয়া সংশয়ের ছায়ামাত্রও কোথাও অবশিষ্ট রহিল না। এ কে, কার মেয়ে, কি জাত—হয়ত-বা বেশ্যা—ইহাকে মা বলিয়াছেন, ইহার ছোঁয়া খাইয়াছেন—ইহার হাতের অন্ন তাঁহার ঠাকুরকে পর্যন্ত নিবেদন করিয়া দিয়াছেন। কথাগুলা মনে করিয়া ঘৃণায় যেন সর্বাঙ্গ তাঁহার ক্লেদসিক্ত হইয়া গেল এবং যে স্নেহ এতদিন তাঁহাকে শ্রদ্ধায় মাধুর্যে করুণায় অভিষিক্ত রাখিয়াছিল, মরুভূমির জলকণার ন্যায় সে যে কোথায় অন্তর্হিত হইল তাহার আভাস পর্যন্ত রহিল না।

    কিন্তু কেবল তিনিই নন, মহিমও স্তম্ভিতের ন্যায় দাঁড়াইয়া ছিল, সে চকিত হইয়া কহিল, সে যখন হবার জো নেই রামবাবু, চলুন, আমরা নিয়ে যাই।

    চলুন, বলিয়া বৃদ্ধ স্বপ্নচালিতের ন্যায় অগ্রসর হইলেন। তাঁহার নিজের দুর্ঘটনার কাছে আর সমস্ত দুর্ঘটনাই একেবারে ছায়ার মত ম্লান হইয়া গিয়াছে— তাঁহার দুই কান জুড়িয়া কেবল বাজিতেছে— জাতি গেল, ধর্ম গেল, এই মানব— জন্মটাই যেন ব্যর্থ বৃথা হইয়া গেল।
    সুরেশের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যেমন তেমন করিয়া সমাধা করিতে অধিক সময় লাগিল না। সমস্তক্ষণ রামবাবু একটা কথাও কহিলেন না এবং ফিরিয়া আসিয়া সোজা এক্কা প্রস্তুত করিতে হুকুম দিলেন।

    মহিম জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কি যাচ্চেন?

    রামবাবু কহিলেন, হাঁ। আমাকে ভোরের ট্রেনে কাশী যেতে হবে, এখন না বেরোলে সময়ে পৌঁছুতে পারব না।

    তাঁহার মনের ভাব মহিমের অবিদিত ছিল না এবং প্রায়শ্চিত্তের জন্যই যে তিনি কাশী ছুটিতেছেন, ইহাও সে বুঝিয়াছিল; তাই অতিশয় সঙ্কোচের সহিত কহিল, আমি বিদেশী লোক, এদিকের কিছুই জানিনে। দয়া করে যদি এঁর কোন যাবার ব্যবস্থা—, কথাটা শেষ হইতে পাইল না। অচলাকে সঙ্গে লইবার প্রস্তাবে বৃদ্ধ অগ্নির ন্যায় জ্বলিয়া উঠিলেন— দয়া! আপনি কি ক্ষেপে গেলেন মহিমবাবু?

    মহিম এ প্রশ্নের প্রতিবাদ করিল না। সভয়ে, সবিনয়ে কহিল, বোধ হয় দু— তিন দিন ওঁর খাওয়া হয়নি। এই মৃত্যুপুরীর মধ্যে ভয়ানক অবস্থায় ফেলে যাওয়া—

    তাহার এ কথাও শেষ করিবার সময় মিলিল না। আচারনিষ্ঠ ব্রাহ্মণের জন্মগত সংস্কার আঘাত খাইয়া প্রতিহিংসায় ক্রুর হইয়া উঠিয়াছিল; তাই তীব্র শ্লেষে বলিয়া উঠিলেন, ওঃ— আপনিও যে ব্রাহ্ম, সেটা ভুলে গিয়েছিলাম, কিন্তু মশাই, যত বড় ব্রহ্মজ্ঞানীই হোন, আমার সর্বনাশের পরিমাণ বুঝলে, এই কুলটার সম্বন্ধে দয়ামায়া মুখেও আনতেন না। বলিয়া গাড়িতে উঠিয়া বসিয়া কহিলেন, যাক, ব্রহ্মজ্ঞানে আর কাজ নেই— প্রাণ বাঁচাতে চান ত উঠে বসুন, জায়গা হবে।

    মহিম নিঃশব্দে নমস্কার করিল। সর্বনাশের পরিমাণ লইয়াও দ্বন্দ্ব করিল না, প্রাণ বাঁচাইবার নিমন্ত্রণও গ্রহণ করিল না। তিনি চলিয়া গেলে শুধু বুক চিরিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস পড়িল মাত্র।

    সর্বনাশের পরিমাণ! তাই বটে!

    ভিতরে বসিয়া গাড়ির শব্দে অচলাও ইহা অনুভব করিল। কেন তিনি ভিতরে প্রবেশ করিলেন না, একটা কথা পর্যন্ত বলিয়া গেলেন না, তাহাও অত্যন্ত সুস্পষ্ট।

    এতক্ষণ সুরেশের অনিবার্য মৃত্যু যে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তার উপলক্ষ সৃষ্টি করিয়া একটা অন্তরাল রচিয়াছিল, তাহাও নাই; এইবার মহিম অত্যন্ত সম্মুখে, অত্যন্ত কাছাকাছি আসিয়া দাঁড়াইবে, কিন্তু আর তাহার মন কিছুতেই সাড়া দিতে চাহিল না। নিজের জন্য লজ্জা বোধ করিতেও সে যেন ক্লান্তিতে ভরিয়া উঠিল।

    মহিম আসিয়া দেখিল, সে কেরোসিনের আলোটা সম্মুখে রাখিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছে। কহিল, এখন তুমি কি করবে?

    আমি? বলিয়া অচলা তাহার মুখের প্রতি চাহিয়া কত কি যেন ভাবিতে লাগিল; শেষে বলিল, আমি ত ভেবে পাইনে। তুমি যা হুকুম করবে, আমি তাই করব।

    এই অপ্রত্যাশিত বাক্য ও ব্যবহারে মহিম বিস্মিত হইল, শঙ্কিত হইল। এমন করিয়া সে একবারও চাহে নাই। এ দৃষ্টি যেমন সোজা, তেমনি স্বচ্ছ। ইহার ভিতর দিয়া তাহার বুকের অনেকখানি যেন বড় স্পষ্ট দেখা গেল। সেখানে ভয় নাই, ভাবনা নাই, কামনা নাই, কল্পনা নাই — যতদূর দেখা যায়, ভবিষ্যতের আকাশ ধুধু করিতেছে। তাহার রঙ নাই, মূর্তি নাই, গতি নাই, প্রকৃতি নাই— একেবারে নির্বিকার, একেবারে একান্ত শূন্য।
    উপদ্রুত, অপমানিত, ক্ষতবিক্ষত নারী— হৃদয়ের এই চরম বৈরাগ্যকে সে চিনিতে পারিল না। একের অভাব অপরের হৃদয়কে এমন নিঃস্ব করিয়াছে কল্পনা করিয়া তাহার সমস্ত মন তিক্ততায় পূর্ণ হইয়া গেল। কিন্তু নিজের দুঃখ দিয়া জগতের দুঃখের ভার সে কোনদিন বাড়াইতে চাহে না, তাই আপনাকে আপনার মধ্যে ধরিয়া রাখাই তাহার চিরদিনের অভ্যাস। পাছে এই বক্ষভরা তিক্ততা তাহার কণ্ঠস্বরে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠে, এই ভয়ে সে অন্যত্র চক্ষু ফিরাইয়া লইয়া কিছুক্ষণ মৌন হইয়া রহিল; তার পরে সহজ গলায় বলিল, আমি কেন তোমাকে হুকুম দেব অচলা, আর তুমিই বা তা শুনতে বাধ্য হবে কিসের জন্য?

    কিন্তু তুমি ছাড়া আর যে কেউ নাই, কেউ ত আমার সঙ্গে আর কথা কবে না! বলিয়া অচলা তেমনি একইভাবেই মহিমের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।

    মহিম কহিল, এই কি আমার কাছ তুমি প্রত্যাশা কর?

    বোধ হয় প্রশ্নটা অচলার কানেই গেল না। সে নিজের কথার রেশ ধরিয়া যেন আপনাকে আপনিই বলিতে লাগিল, তোমাকে হারিয়ে পর্যন্ত ভগবানকে আমি কত জানাচ্চি, হে ঈশ্বর! আমি আর পারিনে— আমাকে তুমি নাও! কিন্তু তিনিও শুনলেন না, তুমিও শুনতে চাও না। আমি আর কি করব!

    মহিম কোন জবাব না দিয়া বাহিরে চলিয়া গেল, কিন্তু এই নৈরাশ্যের কণ্ঠস্বর, এই নিরভিমান, নিঃসঙ্কোচ, নির্লজ্জ উক্তি আবার তাহার চিত্তকে দ্বিধাগ্রস্ত করিয়া তুলিল। এই সুর কানের মধ্যে লইয়া সে বাহিরে প্রাঙ্গণে বেড়াইতে বেড়াইতে ইহাই ভাবিতে লাগিল, কি করা যায়! আপনার ভারে সে আপনি ভারাক্রান্ত, আবার তাহারি মাথায় সুরেশ যে তাহার সুকৃতি ও দুষ্কৃতির গুরুভার চাপাইয়া এইমাত্র কোথায় সরিয়া গেল, এ বোঝাই বা সে কোথায় গিয়া কি করিয়া নামাইবে?

    রঘুবীর অনেক পরিশ্রমে খবর লইয়া আসিল যে, ডিহরীর পথে ক্রোশ— তিনেক দূরে কাল সকালেই একটা হাট বসিবে, চেষ্টা করিলে সেখানে গো— শকট পাওয়া যাইতে পারে।

    মহিমকে অত্যন্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিতে দেখিয়া সে সঙ্কোচের সহিত জানাইল, নিজে সে এখনি যাইতে পারে, কিন্তু এ গ্রামে বোধ হয় কেহ ভয়ে আসিতে চাহিবে না। কিন্তু মাইজী যদি এই পথটুকু—অচলা শুনিয়া বলিল, চল; এবং তৎক্ষণাৎ উঠিতে গিয়া সে পা টলিয়া পড়িতেছিল, মহিম হাত বাড়াইতেই সজোরে চাপিয়া ধরিয়া নিজেকে স্থির করিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু লজ্জায় বিতৃষ্ণায় মহিমের সমস্ত দেহ সঙ্কুচিত হইতে লাগিল, নিজের হাতটা সে টানিয়া লইবার চেষ্টা করিতে করিতে কহিল আজ না হয় থাক।

    কেন? এই যে তুমি বললে, এখানে থাকা উচিত নয়। আর ডিহরী থেকে গাড়ি আনিয়ে যেতেও কালকের দিন কেটে যাবে?

    কিন্তু তুমি যে বড় দুর্বল—

    অচলা হাত ছাড়ে নাই, সে হাত ছাড়িল না। শুধু মাথা নাড়িয়া কহিল, না চল। আর আমি দুর্বল নয়, তোমার হাত ধরে যত দূরে বল যেতে পারব।

    চল, বলিয়া মহিম রঘুবীরকে অগ্রবর্তী করিয়া যাত্রা করিল। সে মনে মনে নিশ্বাস ফেলিয়া আপনাকে আপনি সহস্রবার প্রশ্ন করিতে লাগিল, ইহার শেষ হইবে কোথায়? এ যাত্রা থামিবে কখন এবং কি করিয়া?

    চতুশ্চত্বারিংশ পরিচ্ছেদ

    ডিহরীর বাটীতে পৌঁছিয়া অচলা সেই মোটা খামখানি বাহির করিয়া বলিল, এই তার উইল। মহিম হাত পাতিয়া গ্রহণ করিল। তাহার মনে পড়িল, ইহার মধ্যে সুরেশের চিঠি আছে। পত্রে কোন্‌ অচিন্তনীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করা আছে, কোন্‌ দুর্গম রহস্যের পথের ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে, তদ্দণ্ডেই জানিবার জন্য মনের মধ্যে তাহার ঝড় বহিতে লাগিল, কিন্তু এই প্রচণ্ড ইচ্ছাকে সে শান্তমুখে দমন করিয়া কাগজখানি পকেটে রাখিয়া দিল।

    অচলা কহিল, তুমি কি আজই ডিহরী থেকে চলে যাবে?

    হাঁ, এখানে থাকবার আর আমার সুবিধা হবে না।

    আমাকে কি চিরকাল এখানেই থাকতে হবে?

    মহিম একমুহূর্ত মৌন থাকিয়া কহিল, তুমি কি আর কোথাও যেতে চাও?

    অচলা কহিল, কাল থেকেই আমি তাই কেবল ভাবচি। শুনেচি, বিলেত অঞ্চলে আমার মত হতভাগিনীদের জন্যে আশ্রম আছে, সেখানে কি হয় আমি জানিনে, কিন্তু এদেশে কি তেমন কিছু,— বলিতে বলিতেই তাহার বড় বড় চোখ—দুটি জলে টলটল করিতে লাগিল। এই প্রথম তাহার চক্ষে অশ্রু দেখা দিল।

    মহিমের বুকে করুণার তীর বিঁধিল, কিন্তু সে কেবল ধীরে ধীরে উত্তর দিল, আমিও জানিনে, তবে খোঁজ নিতে পারি।

    কখনো তোমাকে চিঠি লিখলে কি তুমি জবাব দেবে না?

    প্রয়োজন থাকলে দিতে পারি। কিন্তু আমার গুছিয়ে নিয়ে বার হতে দেরি হবে—আমি চললুম।

    অচলা তাহার শেষ দুঃখকে আজ মনে মনে স্বামীর পায়ে নিঃশেষে নিবেদন করিয়া দিয়া সেইখানেই মাটিতে মাথা ঠেকাইয়া প্রণাম করিল এবং তিনি বাহির হইয়া গেলে চৌকাঠ ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

    পথে চলিতে চলিতে মহিম ভাবিতেছিল, রামবাবুর বাটীতে আর একমুহূর্তও থাকা চলে না, অথচ শহরের মধ্যে আর কোথাও একটা দিনের জন্য আশ্রয় লওয়া অসম্ভব। যেমন করিয়াই হোক, এ দেশ হইতে আজ তাহাকে বাহির হইতে হইবে, তা ছাড়া নিজের জন্য তাহার এমন একটা নিরালা জায়গার প্রয়োজন, যেখানে দু’দণ্ড স্থির হইয়া বসিয়া শুধু কেবল খামখানার ভিতর কি আছে, তাই নয়, আপনাকে আপনি চোখ মেলিয়া দেখিবার একটুখানি অবসর মিলিবে।

    অচলাকে তিল তিল করিয়া ভালবাসিবার প্রথম ইতিহাস তাহার কাছে অস্পষ্ট, কিন্তু এই মেয়েটিকেই কেন্দ্র করিয়া তাহার জীবনের উপর দিয়া যাহা বহিয়া গিয়াছে, তাহা যেমন প্রলয়ের মত অসীম, তেমনি উপমাবিহীন। আবার নিঃশব্দ সহিষ্ণুতার শক্তিও বিধাতা তাহাকে হিসাব করিয়া দেন নাই। তাহার গৃহ যখন বাহির এবং ভিতর হইতে জ্বলিয়া উঠিল, তখন সে ঐখানে দাঁড়াইয়াই ভস্মসাৎ হইল—এতটুকু অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সংসারে ছড়াইতে পাইল না। কিন্তু আজ তাহার শক্তির ডাক কেবল সহিবার জন্য পড়ে নাই—সামঞ্জস্য করিবার জন্য পড়িয়াছে। আজ একবার তাহার জমা-খরচের খাতাখানা না মিলাইয়া দেখিলে আর চলিবে না। কোথাও একটু নির্জন স্থান আজ তাহার চাই-ই চাই।
    বাটীতে পৌঁছিয়া নিজের জিনিসপত্রগুলা সে তাড়াতাড়ি গুছাইয়া লইল, পাঁচটার ট্রেনের আর ঘণ্টা-খানেক মাত্র সময় আছে। রামবাবুর কাশী হইতে ফিরিতে সম্ভবতঃ বিলম্ব হইবে, কারণ যথার্থই তিনি প্রায়শ্চিত্ত করিতে গিয়াছেন এবং তাহার পূর্বে জলস্পর্শ করিবেন না বলিয়া গিয়াছেন। সুতরাং তাঁহার সহিত দেখা করিয়া বিদায় লওয়া চলে না। এই কর্তব্যটা সংক্ষিপ্ত পত্রে শেষ করিয়া দিতে সে কাগজ-কলম লইয়া বসিল। দুই-এক ছত্র লিখিয়াই তাঁহার সেই ক্রুদ্ধ মুখের উগ্র উত্তপ্ত বিদ্রূপগুলাই তাহার মনে হইতে লাগিল; এবং ইহারই সহিত আর একজনের অশ্রুজলে অস্পষ্ট অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরের কাতর প্রার্থনাও তাহার কানে আসিয়া পৌঁছিল। তন্দ্রার মধ্যে বেদনার ন্যায় এতক্ষণ পর্যন্ত ইহা তাহার চৈতন্যকে সম্পূর্ণ জাগ্রত রাখিয়াও রাখে নাই, ঘুমাইয়া পড়িতে দেয় নাই, কিন্তু রামবাবুর সেই কথাগুলা যেন ধাক্কা মারিয়া চমক ভাঙ্গিয়া দিল।

    এই প্রাচীন ব্যক্তির সহিত তাহার পরিচয় বেশিদিনের নয়, কিন্তু ইঁহার দয়া, ইঁহার দাক্ষিণ্য, ইঁহার ভদ্রতা, ইঁহার অকপট ভগবদ্ভক্তি ও ধর্মনিষ্ঠার অনেক কাহিনী সে শুনিয়াছে—এইগুলি এখন অকস্মাৎ তাহার রুদ্ধ চক্ষুতে যেন একটা সম্পূর্ণ অপরিদৃষ্ট দিক নির্দেশ করিয়া দিল।

    এই বৃদ্ধ অচলাকে তাঁহার সুরমা—মা বলিয়া, কন্যা বলিয়া অভিহিত করিয়াছেন। এই মেয়েটি ভিন্ন তিনি কখনো কোন পরগোত্রীয়ার হাতের অন্ন স্পর্শ করেন নাই, ইহাও মহিমের কাছে স্নেহচ্ছলে গল্প করিয়াছেন, সুতরাং সর্বনাশটা যে তাঁহার কোন্‌ দিক দিয়া পৌঁছিয়াছিল, ইহা অনুমান করা মহিমের কঠিন নয়; কিন্তু এখন এই কথাটাই সে মনে মনে বলিতে লাগিল, অচলার অপরাধের বিচার না হয় পরে চিন্তা করিবে, কিন্তু এই আচারপরায়ণ ব্রাহ্মণের এই ধর্ম কোন্‌ সত্যকার ধর্ম, যাহা সামান্য একটা মেয়ের প্রতারণায় একনিমিষে ধূলিসাৎ হইয়া গেল, যে ধর্ম অত্যাচারীর আঘাত হইতে নিজেকে এবং অপরকে রক্ষা করিতে পারে না, বরঞ্চ তাহাকেই মৃত্যু হইতে বাঁচাইতে সমস্ত শক্তি অহরহ উদ্যত রাখিতে হয়, সে কিসের ধর্ম, এবং মানবজীবনে তাহার প্রয়োজনীয়তা কোন্‌খানে? যে ধর্ম স্নেহের মর্যাদা রাখিতে দিল না, নিঃসহায় আর্ত নারীকে মৃত্যুর মুখে ফেলিয়া যাইতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করিল না, আঘাত খাইয়া যে ধর্ম এতবড় স্নেহশীল বৃদ্ধকেও এমন চঞ্চল প্রতিহিংসায় এরূপ নিষ্ঠুর করিয়া দিল, সে কিসের ধর্ম? ইহাকে যে স্বীকার করিয়াছে, সে কোন্‌ সত্যবস্তু বহন করিতেছে? যাহা ধর্ম সে ত বর্মের মত আঘাত সহিবার জন্যই! সেই ত তার শেষ পরীক্ষা!

    তাহার সহসা মনে হইল, তবে কি তাহার নিজের পলায়নটাও—কিন্তু চিন্তাটাকেও সে তেমনি সহসা দুই হাতে ঠেলিয়া ফেলিয়া কলমটাকে তুলিয়া লইল এবং ক্ষুদ্র পত্র অবিলম্বে শেষ করিয়া স্টেশনের উদ্দেশে যাত্রা করিল।

    ট্রেন আসিলে যে কামরার দ্বার খুলিয়া মহিম ভিতরে প্রবেশ করিবার উদ্যোগ করিল, সেই পথেই একজন বৃদ্ধ-গোছের ভদ্রলোক একটি বিধবা মেয়ের হাত ধরিয়া নীচে নামিয়া পড়িলেন।

    বৃদ্ধ কহিলেন, এ কি, মহিম যে?

    মৃণাল পায়ের কাছে গড় হইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, সেজদা, যাচ্ছো কোথায়? বলিয়া উভয়েই বিস্ময়াপন্ন হইয়া দেখিল মহিম গাড়িতে উঠিয়া বসিয়াছে।

    মহিম কহিল, আমি কলকাতায় যাচ্চি; সুরেশবাবুর বাড়ি বললেই গাড়োয়ান ঠিক জায়গায় নিয়ে যাবে। সেখানে অচলা আছে।

    কেদারবাবু আচ্ছন্নের মত একদৃষ্টে দাঁড়াইয়া রহিলেন। মহিম বলিল, সুরেশের মৃত্যু হয়েছে। অচলা আমাকে একটা আশ্রমের কথা জিজ্ঞাসা করেছিল মৃণাল, কিন্তু আমি তার জবাব দিতে পারিনি। তোমার কাছে হয়ত সে একটা উত্তর পেতেও পারে।

    মৃণাল তাহার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া শুধু কহিল, পাবে বৈ কি, সেজদা। কিন্তু আমার সকল শিক্ষা ত তোমারি কাছে। আশ্রমই বল আর আশ্রয়ই বল, সে যে তার কোথায়, এ খবর সেজদিকে আমি দিতে পারব, কিন্তু সে ত তোমারই দেওয়া হবে।

    মহিম কথা কহিল না। বোধ হয় নিজেকে সে এই তীক্ষ্ণদৃষ্টি রমণীর কাছ হইতে গোপন করিবার জন্যেই মুখ ফিরাইয়া লইল।

    গাড়ির বাঁশী বাজিয়া উঠিল। মৃণাল বৃদ্ধের স্খলিত ডান হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া বলিল, চল বাবা, আমরা যাই।

     

    ⤶
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচরিত্রহীন – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article নববিধান – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }