Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী এক পাতা গল্প865 Mins Read0

    ০৩. গ্রহের ফের

    গ্রহের ফের

    সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার তখন সবেমাত্র ধরার বুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

    খেলার মাঠের ভিড় কমে গেছে, কোলাহলও মিলিয়ে আসছে। প্লেয়ারেরা প্রায় চলে গেছে, দুই-একজন মাত্র রয়েছে।

    কৃষ্ণা একপাশে একখানা বেঞ্চের ওপর তখনও বসেছিল, পাশে ছিল একটি ছেলে-বয়স চোদ্দ কি পনেরো হবে।

    ছেলেটি স্থানীয় এস-ডি-ও মিঃ অতুল মিত্রের একমাত্র সন্তান দেবু,-কৃষ্ণা এদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে।

    পূজার দীর্ঘ অবকাশ, কলেজ-স্কুল সবই বন্ধ। কৃষ্ণা স্কটিশ চার্চ কলেজে আই-এ পড়ছে। সম্প্রতি ছুটি হয়েছে, কলকাতায় ছুটির সময় সে থাকতে পারেনি।

    অতুল মিত্রের বাড়ি কৃষ্ণাদের বাড়ির ঠিক পাশে, তিনি কৃষ্ণার বাবার বন্ধুস্থানীয় ছিলেন। পিতৃমাতৃহীনা এই মেয়েটিকে তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খুব স্নেহ করতেন। কলকাতায় থাকতে মিসেস মিত্র প্রায়ই কৃষ্ণাকে নিমন্ত্রণ করে খাওয়াতেন, তাদের বাড়ি যাওয়া-আসা করতেন। কৃষ্ণা তাঁকে মায়ের মতো ভালোবেসেছিল।

    সবচেয়ে কৃষ্ণাকে ভালোবেসেছিল দেবু; সে কষ্ণার অলৌকিক কীর্তিকাহিনি শুনে তার একান্ত ভক্ত হয়ে পড়েছিল। সাধারণত সে যে-সব মেয়েকে চারদিকে দেখতে পায়, কৃষ্ণা তাদের অন্তর্গত ছিল না এবং এইখানেই ছিল কৃষ্ণার বৈশিষ্ট্য।

    দেবু পিতামাতার নিকট গল্প শুনেছে কৃষ্ণা খুব ভালো মোটর চালাতে জানে, পাকা ঘোড়সওয়ারও তার নিকট পরাজিত হয়, রিভলভার ছুঁড়তে সে সিদ্ধহস্ত। মেয়ে হলেও সে পুরুষের মতো অসীম শক্তি ও সাহসের অধিকারিণী,-ইত্যাদি ইত্যাদি শুনে বালক দেবু এই মেয়েটিকে সত্যই ভক্তি-শ্রদ্ধা করতে শিখেছে, কৃষ্ণার যে কোনো কাজ সে সম্ভ্রমের চোখে দেখে।

    কৃষ্ণা কাল মাত্র এখানে এসেছে, দেবু কালই কৃষ্ণার কাছে গল্প শোনবার জন্য ঘুরে বেড়িয়েছিল, কিন্তু মা তাকে ধমক দিয়ে নিরস্ত রেখেছেন। কৃষ্ণা এখানে যখন এসেছে, দিন-কয়েক থাকবে, তখন যথেষ্ট গল্প দেবু শুনতে পাবে। মানুষটা কেবলমাত্র ট্রেন হতে নেমেছে, এখনই জ্বালাতন করা মোটেই উচিত নয়, ইত্যাদি বলে তিনি দেবুকে বুঝিয়েছেন।

    আজ সকালের দিকে গল্পটা কেবল শুরু হয়েছিল, এমনই সময় মাস্টার এসে সব নষ্ট করে দিয়েছিলেন। তারপর সমস্ত দিনই সে-সব গল্প শোনবার অবকাশ হয়নি, কৃষ্ণা সর্বদা মায়ের কাছে থাকায় দেবু তাকে উত্ত্যক্ত করবার সাহস পেত না; এই সন্ধ্যায় বেড়াতে আসবার সময় সে কৃষ্ণাকে পেয়ে বসেছে।

    এ পর্যন্ত সহপাঠীদের কাছে কৃষ্ণার সম্বন্ধে তার অনেক গল্প করা হয়েছে। তাদেরই মধ্যে দু-একজন কাল কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা করতে আসবে, সেজন্য আজ দেবুর ব্যস্ততার সীমা নেই-সব কথা কৃষ্ণাকে আজই তার জানিয়ে রাখা দরকার-নচেৎ কাল তাকে বন্ধুদের কাছে অপদস্থ হতে হবে।

    দেবু সেবার যখন পিতার সঙ্গে কলকাতায় গিয়েছিল, কৃষ্ণা তখন রেঙ্গুনে গিয়েছিল; ইচ্ছা থাকলেও, সে না থাকায় দেবু তাকে দেখতে পায়নি। উপযাচক হয়ে সে নিজেই কৃষ্ণাকে দু-তিনখানা পত্র দিয়েছে-এবার পূজার ছুটিতে কৃষ্ণাদিকে বসিরহাটে আসতেই হবে, না এলে দেবু অত্যন্ত কষ্ট পাবে-ইত্যাদি। সেই পত্রেরই শেষের দিকে মিসেস মিত্র লিখে দিয়েছিলেন-এখানে আসা চাই কৃষ্ণা, দেবু বড় হয়ে তোমায় দেখেনি; যদি তুমি না আস, সে নিজেই কলকাতায় যাবে।

    দেবু প্রলোভন দেখিয়ে লিখেছিল-কলকাতা থেকে বসিরহাট বেশি দূর নয়, খুব কাছে। কৃষ্ণাদি বাংলার পল্লীগ্রাম কোনোদিন দেখেননি, এখানে এলে অনেক কিছু দেখতে পাবেন-অনেক কিছু নতুন জ্ঞানলাভ করতে পারবেন।

    কৃষ্ণা এসেছে, দেবুর সঙ্গে পরিচয় বেশ ঘনিষ্ঠভাবে হয়েছে। দেবু একটি একটি করে প্রশ্ন করে তার জ্ঞাতব্য বিষয় সবগুলি জেনে নিয়েছে।

    সন্ধ্যার অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে এসেছিল, কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল; বলল, ‘আর না দেবু, এবার চল, বাড়ি যাই; আর দেরি করলে তোমায় আবার মাস্টারমশাইয়ের কাছে বকুনি খেতে হবে।’

    ‘বকুনি!’

    কথাটা দেবু হেসে উড়িয়ে দিতে গেলেও পারল না।

    বাড়ির দিকে অগ্রসর হতে হতে কৃষ্ণা বলল, ‘আজ আর নয়, কাল রবিবার আছে, তোমার ছুটি, বন্ধুদের নিয়ে এস-অনেক গল্প করা যাবে। বুঝলে?’

    দেবু উৎসাহিত হয়ে বলল, ‘কিন্তু তোমাকেও কাল আমাদের সঙ্গে যেতে হবে কৃষ্ণাদি! আমার বন্ধুরা তোমায় নিমন্ত্রণ করার জন্যে আসবে-তখন কিন্তু তুমি না বলতে পারবে না।’

    আশ্চর্য হয়ে কৃষ্ণা বলল, ‘নিমন্ত্রণ আবার কিসের? কোথায় যেতে হবে তোমাদের সঙ্গে?’

    দেবু বলল, ‘কাল আমরা পিকনিক করতে যাব কি না! নদীর ধারে পিকনিক হবে, তোমাকেও সেখানে যেতে হবে। আমাদের স্কুলের দু-চারজন মাস্টার থাকবেন, আর থাকব আমরা-প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন স্কুলের ছেলে। বিশেষ করে আমি যখন থাকব দিদি, তোমার এতটুকু অসুবিধে হবে না-আগে থেকেই বলে রাখছি!’

    কৃষ্ণা বালকের কথা শুনে হাসল। বলল, ‘তাই কি হয় ভাই? আর কোনো মেয়ে যখন ওতে থাকবে না, আমার একা যাওয়া কি উচিত?’

    দেবু কৃষ্ণার হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরল, ‘বাঃ, কোনো মেয়ের সঙ্গে বুঝি তোমার তুলনা হতে পারে? তোমার মতো কোনো মেয়ে কাজ করতে পারে-এই যেমন- যেমন-‘

    কৃষ্ণা তাতে বাধা দিল-‘থাক, আর কাজের নাম উল্লেখ করতে হবে না। আমার কথা হচ্ছে কি জানো-কাজের সময় সকলের সঙ্গে মিলে-মিশে কাজ করা যায়, তা বলে এইসব আমোদ-প্রমোদ নয়।’

    বিমর্ষ হয়ে দেবু বলল, ‘পিকনিকটাকে তুমি কেবল আমোদ-প্রমোদই বল কৃষ্ণাদি! ওতে কত জ্ঞান অর্জন করা যায়, কত নূতন জিনিস দেখা যায়-‘

    কৃষ্ণা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সহাস্যে বলল, ‘অমনি দুঃখু হয়ে গেল? আচ্ছা, চল মাসিমাকে জিজ্ঞাসা করা যাক। যদি তিনি বলেন, তাহলে না হয় যাব তোমার সঙ্গে-‘

    ‘সত্যি’

    দেবু আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

    * * * * *

    কৃষ্ণার যাওয়া হল না।

    মিসেস মিত্র মত দিলেন না, কাজেই দেবুকে একাই যেতে হল।

    কৃষ্ণার সঙ্গে কথা রইল, রাত্রে কৃষ্ণা তার গল্প বিস্তৃতভাবে শোনাবে। দেবুর বন্ধুরা এখন তাড়াতাড়ি বলে কিছু শুনতে পেল না, পিকনিক সেরে রাত্রে তারা এখানে আসবে।

    মিসেস মিত্র বললেন, ‘এখানে তোমায় ওরা এতটুকু পড়ার সময় দেবে না কৃষ্ণা! যে রকম ব্যাপার দেখছি, তাতে কোনদিন দেখব স্কুলসুদ্ধ ছেলে তোমায় ঘিরে ফেলবে!’

    কৃষ্ণা হেসে বলল, ‘আমি তো এখানে পড়তে আসিনি মাসিমা,-এসেছি বেড়াতে, গল্প করতে, দেবুকে আমার খুব ভালো লাগে মাসিমা, ভারী ভালো ছেলে। পড়াশুনায়ও বেশ ভালো। দেখলুম, অনেক বাইরের জ্ঞানও আছে।’

    মিসেস মিত্র বললেন, ‘ওর বাবা ওকে কেবল পড়ার বই পড়ান না, তাঁর কাছে বাইরের বই পড়ে গল্প করতে হয়, আলোচনা করতে হয়। সেইজন্যই ওর বাইরের জ্ঞান হয়েছে মা! নইলে কেবল পড়ার বইয়ের মধ্যেই ওর জ্ঞান থাকত।’

    বাইরে তখন বিপুল আয়োজন চলছিল। পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছে শহর হতে কয়েক মাইল দূরে, ইছামতী নদীর তীরে একটা বাগানের মধ্যে। ছেলেরা একদিন মাস্টারমহাশয়ের সঙ্গে এদিকে বেড়াতে এসে ভবিষ্যৎ পিকনিকের জন্য এই জায়গাটি ঠিক করে গিয়েছিল। একখানা লরি ও তিনখানা মোটর ঠিক করা হয়েছে। হাকিম-সাহেবের বাড়ি হতে সবগুলি ভর্তি হয়ে ছাড়বে, ঠিক করা আছে। সেই কথা অনুসারে ভোর হতে হতে ছেলেরা এসে জুটেছে, লরি ও মোটর-গাড়িগুলিও এসেছে। লরিতে করে জিনিসপত্র, দুজন ভৃত্য, কয়েকটি ছেলে ও একজন শিক্ষক আগে রওনা হলেন। বাকি তিনখানা মোটর পূর্ণ করে ছেলেদের নিয়ে শিক্ষকেরা অগ্রসর হলেন।

    দেবুর জীবনে এই প্রথম গ্রামাঞ্চল পরিদর্শন করা, আনন্দ ও উৎসাহের তার শেষ ছিল না। ছোটবেলা হতে সে তার স্বাস্থ্যহীনতার জন্য মাসিমার কাছে দিল্লিতে ছিল, মাত্র বছরখানেক কলকাতায় এসেছিল, এবং সেখান থেকে এখানে এসেছে মাত্র পাঁচ মাস!

    এই পাঁচ মাস এখানে সে স্কুলে ভর্তি হয়েছে। তার বেড়াবার স্থান সীমানাবদ্ধ, চাপরাশির সঙ্গে স্কুলে যায় ও আসে, বিকেলে চাপরাশির সঙ্গে বেড়াতে যায়। কোনো সময়ে একা বার হবার উপায় তার নেই।

    মিঃ মিত্রের ভয় বড় কম নয়, অতি সামান্য কারণেও তিনি অত্যন্ত ভীত হয়ে ওঠেন। দেবুর দিকে তাই তাঁর সতর্ক দৃষ্টি অত্যন্ত বেশি,-তাকে কোথাও ছেড়ে দিতে ভয় পান।

    পিকনিকের স্থানটি দেখে দেবুর আনন্দ ধরছিল না। একদিকে নদী বহে চলছে,-তাতে কত মাছ লাফাচ্ছে, জলের মধ্যে চিকমিক করে বেড়াচ্ছে! নদীর উপর দিয়ে কত পাখি দেশ-দেশান্তরে উড়ে চলেছে!

    বাগানের খানিকটা স্থান পরিষ্কার করে নিয়ে সেখানে রন্ধনের আয়োজন করা হল; শিক্ষকেরা ছেলেদের কাজ ভাগ করে দিলেন, ছেলেরা মহানন্দে কাজে লাগল।

    কতগুলি ছেলে কেবল হৈ-হৈ করে বেড়াচ্ছিল,-দেবু ছিল এদের মধ্যে একজন। বয়োজ্যেষ্ঠ ছেলেরা এদের কাজে টানেনি, তাদের ছুটি দেওয়ায় তারা মনের আনন্দে ছুটোছুটি করতে লাগল।

    কয়েকটি ছেলে নদীতে স্নানে নেমে সাঁতার দিতে আরম্ভ করল। দেবু নদীতে নামল না, সে সাঁতার জানত না,-সেইজন্য নদীর তীরে তীরে সে বেড়াতে লাগল।

    আহারাদি দুপুরের মধ্যে মিটে গেল-ছেলেরা তখন ভ্রমণে বেরুলো।

    দলছাড়া হয়ে পড়ল দেবু।

    ইচ্ছা করেই সে দলের সঙ্গে মিশল না, একা সে নদীর তীরে বেড়াতে লাগল, তার সঙ্গীরা গ্রামের দিকে চলে গেল।

    দেবুর নদী বড় ভালো লাগে। জলে কেমন সাঁ-সাঁ করে চলে যায়, নৌকাগুলো কেমন দুলতে দুলতে চলে! দেবুর এসব দেখতে বড় ভালো লাগে।

    নদীর ধারে একখানা বজরা নোঙর করা। এই বজরার সুন্দর সবুজ রংটি দেবুর চিত্তাকর্ষণ করল। প্রথম দর্শনেই বোঝা যায়, এই বজরাটি সাধারণ বজরা হতে পৃথক, অন্ততপক্ষে অনভিজ্ঞ দেবুর ধারণা তাই। বজরাটিতে যে কামরা ছিল, তার শার্সি-খড়খড়িগুলো খোলা ছিল। তীর হতে দেবু দেখল, কামরাটি বেশ সুসজ্জিত-তাতে লোকজন আছে মনে হল।

    যে সরু পথটি এঁকে-বেঁকে ইছামতী নদীর জলগর্ভে নেমেছে, দেবু সেই পথের উপর দাঁড়িয়ে পড়ল-বজরার নাম ‘মোহিনী’।

    ‘কি খোকা, কি দেখছ?’

    এই কর্কশ কণ্ঠস্বরে দেবু চমকে উঠে মুখ ফেরাল। ঠিক তার পিছনে দাঁড়িয়ে একটি লোক, মনে হয় গ্রামের পথে এসেছে।

    লোকটিকে দেখে দেবু মোটেই খুশি হতে পারল না। লোকটির একটি চোখ নেই; সে চোখটা ঠেলে বার হয়েছে, কপালের মাঝখানে একটা আব আছে। মাথার চুল খুব ছোট করে ছাঁটা, গায়ের রং নিকষ কালো; লম্বায় সে পুরো পাঁচ হাত, তেমনই চওড়া তার বুক, শক্তিশালী হাত-পা। তার পরনে একটা সবুজ ডোরা লুঙ্গি, গায়ে একটা হাতকাটা বুক-খোলা বেনিয়ান।

    দেবু নির্বাকভাবে চেয়ে আছে দেখে লোকটা আরও একটু কাছে সরে এল। দেবুর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে সে তার স্বাভাবিক কর্কশকণ্ঠে বলল, ‘তোমাদের বাড়ি কি এই গাঁয়ে খোকা?’

    তার বার বার খোকা সম্বোধনে দেবু মনে মনে বেশ একটু গরম হয়ে পড়েছিল, তথাপি পরম ধৈর্যের সঙ্গে সে বলল, ‘আমার নাম খোকা নয়, আমি দেবী মিত্র, বসিরহাটের হাকিমের ছেলে!’

    ‘ও আপনি হাকিমের ছেলে! সেলাম!’

    লোকটা নত হয়ে একটা লম্বা সেলাম বাজাল।

    ‘ছোট হুজুর, আমাদের বজরাখানা দেখছেন বুঝি? আমি এই বজরার মাঝি, আমার নাম ইসমাইল-বজরাখানা আমাদের জমিদারবাবুর-মানে টাকির বাবুদের। আপনি যদি দেখতে চান, ভালো করে দেখতে পারেন হুজুর!’

    দেবুর কৌতূহল হচ্ছিল কম নয়, তথাপি দু-একবার ইতস্তত করে সে বলল, ‘কিন্তু তোমাদের জমিদারবাবু-‘

    ইসমাইল আবার লম্বা এক সেলাম বাজাল। বলল, ‘তিনি এখানে বজরা লাগিয়ে শিকার করতে গেছেন, ফিরতে সন্ধে হয়ে যাবে। আপনি বজরায় বেড়িয়ে যেতে পারেন ততক্ষণ; কতক্ষণই বা লাগবে, না হয় আধ ঘণ্টাই লাগবে! তার বেশি তো নয়!’

    ‘আধ ঘণ্টা-‘

    দেবু একবার এদিকে, একবার ওদিকে চাইল-ইছামতীর দুই তীর যেন ঘুমিয়ে আছে, জনমানবের সাড়াশব্দ নেই, দু-একটা গরু কেবলমাত্র চরছিল।

    সঙ্গীরা কতক্ষণে ফিরবে, কে জানে? তাদের ফিরে আসতে আসতে দেবুর বজরা দেখা শেষ হয়ে যাবে। দেবু ভয় কাকে বলে জানে না; অন্য ছেলে হলে হয়তো রাজি হত না, কিন্তু সাহসী দেবু রাজি হল; বলল, ‘আধ ঘণ্টাই বা লাগবে কেন, পাঁচ মিনিটের দেখাতেই তো দেখা হয়ে যায়।’

    ইসমাইল বিনীত কণ্ঠে বলল, ‘পাঁচ মিনিট আর দশ মিনিট-দুটোর মধ্যে তফাৎই বা এমন কি আছে হুজুর? আচ্ছা, আসুন-‘

    সে অগ্রসর হল, সঙ্গে সঙ্গে অদম্য কৌতূহলী দেবুও চলল।

    * * * * *

    বজরায় দু’খানি ছোট কামরা-অতি সুন্দরভাবে সজ্জিত। ভিতরের কামরাটিতে একপাশে একখানা স্প্রিংয়ের খাট, পাশে একখানি ছোট টেবিল, তার সামনে একখানি স্প্রিংয়ের চেয়ার।

    জন চার-পাঁচ মাল্লা বিশ্রাম করছিল-ইসমাইল ও দেবুকে দেখে তারা ধড়ফড় করে উঠে বসল।

    ইসমাইল তীক্ষ্নদৃষ্টিতে তাদের পানে একবার তাকিয়ে দেবুকে সঙ্গে নিয়ে প্রথম কামরাটিতে প্রবেশ করল। এ কামরাটিও বেশ সুসজ্জিত; দেখে মনে হয়, এই কামরাটিতে আহারাদি কার্য সম্পন্ন হয়।

    ভিতরের কামরাটিতে প্রবেশ করে ইসমাইল বলল, ‘বসুন হুজুর, এসেছেন যখন দু-পাঁচ মিনিট না বসে যাওয়া হবে না। আমার মনিব যখন ফিরবেন, এসব মাল্লারাই বলবে আপনি এসেছিলেন; তখন আপনাকে আমি খাতির করে বসাইনি জানলে তিনি আমায় তখনই জবাব দেবেন।’

    অধৈর্য হয়ে দেবু বলল, ‘আর বসতে হবে না-বসতে গেলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আমি বরং দাঁড়িয়েই সব দেখে নেমে যাই,-আমার সঙ্গীরা এখনই ফিরবে কিনা! পাঁচটার সময় আমাদের এখান থেকে স্টার্ট করবার কথা।’

    ইসমাইল বিনীত হাসি হেসে বলল, ‘এই সবে সাড়ে তিনটে বেজেছে হুজুর! আমি আপনাদের পিকনিক করবার বাগান দেখে এসেছি, আপনাকে নিজে সঙ্গে করে ঠিক চারটার সময় ওখানে পৌঁছে দেব। আপনি ঐ চেয়ারে বসুন, আমি এক গ্লাস সরবৎ আপনাকে এনে দিই। এই দারুণ রোদে মানুষের জলপিপাসা পায় বই কি!’

    দেবু টেবিলের বইগুলো দেখতে দেখতে বলল, ‘না, না, তোমায় আবার সরবৎ তৈরি করে আনতে হবে না। আমার মোটেই জলপিপাসা পায়নি।’

    ইসমাইল হাতজোড় করল। বলল, ‘তাও কি হয় হুজুর! আমার মনিব শুনতে পেলে তখনই আমায় জবাব দেবেন, সে কথাটা একবার ভাবুন।’

    বেচারা মনিবের ভয়েই জড়োসড়ো!

    এমন বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জমিদারবাবুরা কেমন করে পছন্দ করলেন, খানিক আগেই দেবু এই কথা ভেবেছিল। এখন তার মনে হল,-না, লোকটার গুণ আছে; কেবল চেহারা দেখে মানুষ বিচার করা ভুল।

    ইসমাইল বলল, ‘আপনি ততক্ষণ বইগুলো দেখুন হুজুর। ওগুলো আমাদের খোকাবাবুর বই। বাবু খোকাবাবুকে সঙ্গে করে এনেছেন কিনা, সবাই শিকার করতে গেছেন। এই আপনারই মতো খোকাবাবু! গুলি যা ছুঁড়তে পারেন, একেবারে অব্যর্থ লক্ষ্য; এই কিছুদিন আগে আমাদের চাটগাঁয়ের জঙ্গলে একটা মস্তবড় বাঘ মেরেছেন।’

    শুনতে শুনতে দেবু ম্লান হয়ে পড়ে।

    খোকাবাবুর বাবা তাকে এই বয়স হতেই কত বড় শিকারি করে তুলেছেন, আর তার বাবা তাকে কোণের মধ্যে সযত্নে ঢেকে রেখেছেন, বাইরের মুক্ত আলো-বাতাসটুকু উপভোগ করবার সুযোগটুকু পর্যন্ত দেননি।

    মুখ তুলে সে ইসমাইলকে দেখতে পেল না। সে বোধহয় সরবৎ আনতে গেছে।

    বাংলায়-ইংরাজিতে কয়েকখানা বই, সবগুলিতেই অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, বাঙালি ও বিদেশি ছেলেদের অসীম শক্তি ও সাহসিকতার পরিচয়।

    কৃষ্ণাদির জীবনটাও তো অ্যাডভেঞ্চারময়। মেয়ে হয়ে সে যতখানি শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিয়েছে, বাংলার কয়জন ছেলে তা পারে?

    ‘হুজুর, সরবৎ!’

    ইসমাইল সরবতের গ্লাসটা দেবুর সামনে টেবিলের উপর রাখল। বলল, ‘খেয়ে নিন হুজুর!’

    সামনের সরবতের গ্লাস দেখলে, তৃষ্ণা না থাকলেও তৃষ্ণা জাগে। দেবু গ্লাসটা উঠিয়ে নিল; জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের বাড়ি বুঝি চট্টগ্রামে?’

    ইসমাইল উত্তর দিল, ‘আজ্ঞে হাঁ।’

    গ্লাসে অল্প অল্প চুমুক দিতে দিতে সঙ্গে সঙ্গে বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে দেবু বলল, ‘ওখানে বুঝি খুব বন-জঙ্গল আর খুব বাঘ আছে?’

    উৎসাহিত হয়ে ইসমাইল বলল, ‘তা আছে বৈকি হুজুর! অনেক বন আর খুব বাঘ আছে। বড় হুজুর-মানে আপনার বাবা যদি কখনো ওদিকে বদলি হন, দেখতে পাবেন সে কি বন, আর সেই বনের মধ্যে কি বাঘের ডাক!’

    গ্লাসটা শেষ করে টেবিলে রেখে, দেবু একটু নড়ে-চড়ে ভালো হয়ে বসল। বলল, ‘বাঘ লোকালয়ে আসে?’

    কল্পনায় সে দেখছিল, পিতা চট্টগ্রামে বদলি হয়েছেন, সেখানকার বাসার আশেপাশে বাঘ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

    ইসমাইল মাথা কাত করে বলল, ‘তা আসে বৈকি হুজুর! দিনের বেলায় না এলেও রাত্রে ওদের গতিবিধি সর্বত্র, তখন ওদের আটকাবে কে? আচ্ছা, আপনি একটু পড়ুন হুজুর, আমি মাল্লাদের একবার দেখে আসি। কোনো ভয় নেই, আমি এখনই আপনাকে নিজে নিয়ে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব।’

    সে চলে গেল।

    দেবু দুই-একটা হাই তুলছিল, কয়েকবার আড়মোড়া দিল। হঠাৎ কেমন যেন আলস্য বোধ হচ্ছিল, মনে হল, খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিই! কোনোদিন দিনের বেলা সে ঘুমায় না, আজ শেষ রাত্রে উঠেছে, সারাটা দিন ছুটাছুটি করে এতটুকু বসলেই ক্লান্তিভরে চোখ বুজে আসা আশ্চর্যজনক নয়।

    বইখানা টেবিলের উপর খোলা পড়ে রইল। দেবু তারই উপর দিয়া দুটি হাত বিস্তৃত করে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের উপর মাথা রেখে এক মিনিটের মধ্যে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হল।

    এরই একটু পরে দরজার ওপর এসে দাঁড়াল ইসমাইল।

    দেবুর পানে তাকিয়ে তার বীভৎস মুখ আরও কুশ্রী কদাকার হয়ে উঠল। দাঁতের উপর দাঁত রেখে সে কড়মড় করল।

    তারপর কামরায় প্রবেশ করে সে দেবুর পাশে দাঁড়িয়ে বার দুই উচ্চকণ্ঠে ডাক দিল-‘হুজুর, হুজুর।’

    হুজুরের সাড়া নেই, গভীর নিদ্রায় হুজুর মগ্ন, কানের কাছে ঢাক-ঢোল বাজালেও যেন ঘুম ভাঙবে না! ইসমাইল দু’বার ঠেলা দিল-দেবুর চৈতন্য নেই।

    ক্ষুদ্র বালকের দেহটা অনায়াসে দু’হাতে তুলে ইসমাইল স্প্রিংয়ের খাটে শুইয়ে দিয়ে আলনা হতে একখানা চাদর নিয়ে পা হতে মাথা পর্যন্ত আগাগোড়া ঢেকে দিল।

    তারপর সন্তর্পণে জানালাগুলো বন্ধ করল। একটিমাত্র দরজায় বার হতে চাবি লাগিয়ে সে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল।

    ‘রহিম নোঙর তোলো।’

    আকাশ তখন অকস্মাৎ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে ফেলেছে, সমস্ত পৃথিবীতে একটা থমথমে ভাব, মনে হয় শীঘ্রই ঝড় আসবে।

    রহিম সেই কালো আকাশটার পানে একবার তাকাল। ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কিন্তু ঝড় আসবে যে কর্তা!’

    ইসমাইল ভ্রূ-কুঞ্চিত করে বলল, ‘যারা সমুদ্রে সাঁতার কাটে, ডিঙি ভাসায় তালগাছের মতো উঁচু ঢেউয়ের ওপর, এটুকু নদীতে এতটুকু মেঘ দেখে ঝড়ের ভয় তারা করে না রহিম! তুমি নোঙর তোলো।’

    আর দ্বিরুক্তি না করে রহিম ও অন্যান্য মাল্লারা নোঙর তুলল।

    সাঁ-সাঁ করে বজরা ভেসে চলল।

    * * * * *

    অন্ধকার ক্রমেই বাড়ছিল।

    মিঃ মিত্র কোর্ট হতে অনেকক্ষণ আগে ফিরেছেন। সন্ধ্যা হতে দেবুর ফেরবার প্রত্যাশা করছেন-দেবু ফিরল না দেখে তাঁর উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল।

    কৃষ্ণা ও মিসেস মিত্র ভিতরের দিকে একটি ঘরে বসে গল্প করছিলেন, মিঃ মিত্র সেই ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালেন।

    বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আগেই বারণ করেছিলুম ও সব পিকনিক- টিকনিকে দেবুর যোগ দিয়ে কাজ নেই। আমার কথা তো কানে নিলে না,-নিজে তাড়াতাড়ি মত দিয়ে বসলে। এখন এই যে রাত নটা বাজতে চলল, দেবু এখনও এল না।’

    বাধা দিয়ে মিসেস মিত্র বললেন, ‘তোমার অস্থিরতা সবচেয়ে বেশি। দেবু তো একা যায়নি, অনেক ছেলেপুলে গেছে, চার-পাঁচজন টিচার সঙ্গে গেছেন-ভয়ের কারণটা ওখানে কি থাকতে পারে বল দেখি? সকলে যখন ফিরবে, দেবুও তখন ফিরবে, তার জন্যে ভাবনার কোনো কারণ নেই।’

    একখানা চেয়ারে বসে পড়ে মিঃ মিত্র বললেন, ‘ভয়ের কারণ নেই তুমি তো বলছ, কিন্তু সেই পত্রখানার কথা ভুলে যাওনি বোধ হয়?’

    মিসেস মিত্রের মুখখানা বিবর্ণ হয়ে উঠল। তাঁর মুখের পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা আশ্চর্য হয়ে গিয়ে বলল, ‘আপনি অমনি ভয় পেয়ে গেলেন মাসিমা! কিসের পত্র, কোথাকার পত্র, আমি তো কিছুই বুঝতে পারলুম না।’

    মিসেস মিত্র শুষ্কমুখে একটু হেসে কি বলতে গেলেন, মিঃ মিত্র বাধা দিয়া বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘চাপা দেওয়ার মতো এতে কিছু নেই। যা সত্য, তা বরং কৃষ্ণাকে বলা যেতে পারে। কৃষ্ণার যা সাহস আর শক্তি আছে, তার এতটুকু তোমার তো নেই-ই, আমার পর্যন্ত নেই। ওর আর কতটুকু বা বয়স! এই বয়সেই কৃষ্ণা যা বীরত্বের পরিচয় দিয়েছে, তার এতটুকু আমাদের এদেশের পুরুষদের পর্যন্ত নেই। আমার মনে হয়, কৃষ্ণাকে সব কথা বলাই ভালো; আমার-তোমার চেয়ে ওর বুদ্ধি অনেকগুণ বেশি, ও সব বুঝবে!’

    মিসেস মিত্র ক্লিষ্টকণ্ঠে বললেন, ‘তুমি সব জান,-তুমিই বল।’

    ব্যগ্র হইয়া কৃষ্ণা বলল, ‘ব্যাপার কি মেসোমশাই?’

    মিঃ মিত্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ব্যাপার অত্যন্ত সাধারণ, একটা ডাকাতির মামলা মাত্র। ব্যাপার হল এই-আমি যখন রংপুর জেলায় নীলফামারীতে ছিলুম, সেখানে একটা ডাকাতি কেসে দলপতি সমেত কুড়িজন ডাকাতের বিচার করি। তাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান দুই জাতই ছিল, আর দেশও সকলের ভিন্ন ভিন্ন জেলায় ছিল। কেউ ছিল চব্বিশ পরগনার, কেউ চট্টগ্রামের, কেউ হুগলির, কেউ মজঃফরপুরের, কেউ বা বালেশ্বর জেলার। দলটি বেশ নাম করে ফেলেছিল-লোকে বেশ চিনেছিল। দৈবক্রমে এদের মধ্যে একজন ধরা পড়ে, আর সে-ই সব সন্ধান দেয়।’

    কৌতূহলাক্রান্ত কৃষ্ণা হাতের বইখানা নামিয়ে মিঃ মিত্রের পানে চাইল। বলল, ‘তারপর কি হল মেসোমশাই?’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘তাদের সব জেলের হুকুম হয়। সেই দলের দলপতির নাম ছিল খাঁজাহান-অতি কুৎসিত চেহারার লোক। তাকে দেখেই মনে হত, পৃথিবীতে হেন অপকর্ম নেই, যা সে করতে পারে না। তার বাড়ি চট্টগ্রামে, কিন্তু কোন গ্রামে, কে জানে?

    জেলে থাকতেই এই খাঁজাহান, যে লোকটা তাদের নাম প্রকাশ করে দিয়েছিল, হাতের একটা রডের আঘাতে তার মাথা ফাটিয়ে তাকে খুন করে। খুন করার অপরাধে তার তখন হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরের আদেশ।’

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ‘তারপর?’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘বিচারের সময় দণ্ডাদেশ পেয়ে সকল আসামী যেমন শাসায়, সেও আমায় তেমনি শাসিয়ে গিয়েছিল কারণ আমি ছিলুম প্রধান সাক্ষী। সে বলেছিল, জেল হতে আগে সে ফিরে আসুক, তারপর আমায় দেখে নেবে। ভয় করবার কোনো কারণ তখন ছিল না, কারণ এরকম শাসানি শুনে শুনে আমি বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছলুম।’

    মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘তার কুৎসিত চেহারার জন্যে সত্যিই সে মনে বেশ একটা ছাপ দিয়েছিল, আজও তার কথা আমার মনে পড়ে। অসম্ভব লম্বা-চওড়া, অসম্ভব কালো, কপালে একটা আব। আরও একবার জেল খাটতে গিয়ে মারামারি করার ফলে তার একটা চোখ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়।’

    কৃষ্ণা বিকৃতমুখে বলল, ‘সাংঘাতিক লোক!’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘সাংঘাতিক হাজারবার! তার বিচার করতে গিয়ে শুনি, সে নাকি পনেরো-কুড়ি বার জেলখানায় গেছে। আসামির ডেকে দাঁড়িয়ে সে হেসে বলেছিল, ‘জেলের ভয়ে আমায় কাবু করতে পারবেন না হাকিম সাহেব! বারো বছর বয়স হতে জেলের সঙ্গে আমার পরিচয়’।

    কৃষ্ণা হেসে ফেলল। বলল, ‘ওস্তাদ লোক।’

    মিঃ মিত্র হাসলেন না। গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘তারপরের কথাগুলো আগে শোন মা, শেষকালে তোমার মন্তব্য ব্যক্ত করো।

    হঠাৎ একদিন সংবাদপত্রে দেখি, ‘দ্বীপান্তর-দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত কয়েদির অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পলায়ন।’ এদিকে কোথাও সে পালানোর সুযোগ পায়নি, সমুদ্রে জাহাজ যখন চলতে শুরু করেছিল-প্রহরীদের হয়তো সেখানে পালানোর সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ছিল না, সেই রকম সময়ে সে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে সাঁতার কেটে পালায়।’

    কৃষ্ণার চক্ষু বিস্ফারিত হয়ে উঠল। বিস্মিতকণ্ঠে সে বলল, ‘কি ভয়ানক!’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘কিন্তু ভুল করো না মা! ওরা সমুদ্রতীরের অধিবাসী, সমুদ্রের ঢেউ দেখে ওরা ভয় পায় না, বরং সেই ঢেউয়ের মাথায় লাফ খায়। খাঁজাহানকে ধরবার জন্য গভর্নমেন্ট মোটা টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন, কিন্তু কেউ তার সন্ধান পায়নি।’

    কৃষ্ণা ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বলল, ‘কবে সে তার প্রথম বিচারের সময় আপনাকে শাসিয়ে গিয়েছিল সেই কথা ভেবে আপনি আজও ভয়ে ভয়ে থাকেন মেসোমশাই?’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘না, আজ মাত্র কয়েক মাস আগে এখানে আমার নামে সে একখানা পত্র দিয়েছে, সেই পত্রখানা পড়ে অবধি আমার মনে ভয় হয়েছে। তোমার মাসিমার কাছে সে পত্র আছে, সেখানা বরং তুমি পড়ে দেখতে পার কৃষ্ণা!’

    স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে মিঃ মিত্র বললেন, ‘সে পত্রখানা কৃষ্ণাকে দাও, ও একবার দেখবে।’

    মিসেস মিত্র উঠে ড্রয়ার খুললেন।

    মিঃ মিত্র চেয়ারে হেলে পড়ে হতাশা-পূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ‘পত্রখানা পড়লেই তুমি বুঝতে পারবে-সে প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্যে কি রকম ব্যগ্র হয়ে উঠেছে! তার ধারণা, যে লোকটা তাদের নাম প্রকাশ করেছে, আমি তাকে অনেক প্রলোভন দেখিয়েছি, নইলে সে কখনও নাম বলত না। তার এতটা রাগ হওয়ার কারণ, তাকে যখন জেলে দেওয়া হয়, তখন তার ছেলের খুব অসুখ ছিল; দ্বীপান্তর থেকে সে সাঁতার দিয়ে পালিয়ে আসে ছেলের জন্যে, কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখে, তার ছেলে নেই। তাই তার যত রাগ!’

    এই সময় মিসেস মিত্র পত্রখানা এনে দিলেন। মিঃ মিত্র কথা শেষ না করতেই তাড়াতাড়ি পত্র খুললেন।

    ‘এই দেখ কৃষ্ণা, তুমি পড়।’

    কৃষ্ণা পত্রখানা পড়ল!

    মহামান্য হাকিম সাহেব-

    খবরের কাগজে দেখে থাকবে আমি জাহাজ হতে পালিয়েছি। দিনরাত এদিক-ওদিক ঘুরে অবশেষে তোমায় পত্র লিখছি-কেন জান?

    তোমার ওপর আমার মর্মান্তিক আক্রোশ। আর আক্রোশ ছিল যার ওপর সেই হতভাগ্য নবীনের মাথা এক ডাণ্ডার আঘাতে চুরমার করে দিয়েছি। সে যদি প্রলোভনে ভুলে আমাদের নাম না করত, আমি ধরা পড়তুম না, তোমার কাছে বিচার হত না, আমার ছেলেও মরত না।

    রাগ সামলাতে পারিনি, তাই নবীনকে খুন করেছি। দ্বীপান্তর যাওয়ার পথে পালিয়ে আমার দেশে গিয়ে দেখলুম, আমার একমাত্র ছেলে মারা গেছে; আমার স্ত্রী তার শোকে আর আমার শাস্তির আদেশ শুনে আত্মহত্যা করেছে।

    আমি একা বেঁচে আছি, আর আমার কেউ নেই। আমি খোদার নামে শপথ করেছি এর প্রতিশোধ নেব। জনাব হাকিম সাহেব, তোমার ছেলেকে আমি নেব, বুঝাব ছেলে হারালে বাপের কি যন্ত্রণা হয়!

    তোমার কাছে প্রার্থনা করেছিলুম, আমায় সাত দিনের মতো ছেড়ে দাও, আমি ছেলেকে একবার দেখে আসি। তুমি জান না-খাঁজাহান ডাকাত, খুনি হতে পারে, সে মিথ্যাবাদী নয়, সে কথা দিয়ে কথা রাখে। আমায় যদি একটিবার দেখতে যেতে দিতে, আমার এতটুকু ক্ষোভ থাকত না। সেদিন তুমি হেসেছিলে, বিদ্রূপ করেছিলে, বলেছিলে আমার ছেলের মরাই ভালো; সেও তো বড় হয়ে আবার ডাকাতি করবে!

    তোমার বিদ্রূপ আমার বুকে বিঁধে আছে জনাব হাকিম সাহেব। আমি তোমায় দেখাব খাঁজাহান কথায় যা বলে কাজেও তাই করে। তোমার নাম আছে, যশ আছে, টাকা আছে,আমি তোমাদের কাছে ঘৃণিত দস্যু হলেও তোমাদের সব থেকেও যে কিছু নেই, তাই প্রমাণ করব।

    খাঁজাহান

    কৃষ্ণা যখন মুখ তুলল তখন মিঃ মিত্র হাতখানা আড়াআড়ি ভাবে চোখের উপর রেখেছেন, মিসেস মিত্র ঊর্ধ্বপানে তাকিয়ে আছেন।

    পত্রখানা ভাঁজ করে খামের মধ্যে পুরতে পুরতে কৃষ্ণা বলল, ‘এ পত্র দেখছি কয়েকমাস আগেকার লেখা। এ পত্র কয়মাস আগে পেয়ে আজ তার জন্যে ভীত হলে চলে না মেসোমশাই! আপনার দেবু যে রকম সুরক্ষিতভাবে গেছে, তাতে সহজে কেউ তার এতটুকু অনিষ্ট করতে পারবে না। পাঁচজন শিক্ষক, অতগুলি ছেলে; তা ছাড়া কয়েকজন চাকর, ড্রাইভারও রয়েছে; একা তো সে যায়নি।’

    মিঃ মিত্র একটু যেন ভরসা পেলেন, বললেন, ‘তাই হোক মা, তোমার কথাই সত্য হোক, দেবু ফিরে আসুক। আর কোনোদিন ওকে আমি কোথাও পাঠাব না।’

    স্ত্রীর পানে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমিও আর কোনোদিন ওকে কোথাও পাঠানোর প্রস্তাব কর না, বলে রাখছি।’

    তিনি উঠলেন।

    * * * * *

    দারোয়ান এসে জানাল, স্কুলের এক বাবু দেখা করতে এসেছেন-সঙ্গে আছে তিন-চারটি ছেলে।

    প্রায় সঙ্গে সঙ্গে স্কুলের একজন শিক্ষক ও কয়েকটি ছেলে প্রবেশ করল।

    বিবর্ণ মুখে মিঃ মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘দেবু কই?’

    শিক্ষক হেমবাবু উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বললেন, ‘সে বাড়ি আসেনি? আমরাও যে তাই জানতে এলুম।’

    মিঃ মিত্র নির্বাকে কেবল হেমবাবুর পানে তাকিয়ে রইলেন, একটি কথাও তাঁর মুখ হতে বের হল না।

    কৃষ্ণা কাছে একখানা চেয়ারে বসে ছিল, উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি বসুন, ছেলেরাও বসুক, অমন হাঁফাতে হাঁফাতে দাঁড়িয়ে কোনো কথা হয় না।’

    ‘আর কথা। আমার সর্বনাশ হয়েছে, কৃষ্ণা-‘

    মিঃ মিত্র সামনের টেবিলটার উপর ঝুঁকে পড়লেন।

    কৃষ্ণা ধমকের সুরে বললেন, ‘আপনি অমন অস্থির হবেন না মেসোমশাই! কোথায় কি হল না হল তার ঠিক নেই, আগে থেকে একেবারে মুষড়ে পড়ছেন! আপনি বসুন, আগে সব কথা শোনা যাক।’

    শ্রান্ত হেমবাবু বসে পড়লেন, ছেলে তিনটিও বসল।

    নিজের চেয়ারখানা সরিয়ে তাঁদের কাছে বসে কৃষ্ণা ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কখন ওখান থেকে রওনা হয়েছেন?’

    প্রবীণ হেমবাবু একটা নিঃশ্বাস ফেলে মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, ‘আমাদের ব্যবস্থা ছিল, ঠিক বেলা পাঁচটায় আমরা ওখান হতে রওনা হব, আধঘণ্টার মধ্যে এখানে পৌঁছে যাব; কিন্তু-‘

    কৃষ্ণা বলল, ‘সব ছেলে ঠিকমতো হাজির হল-কেবল দেবুকে পাননি-না?’

    হেমবাবু নির্বাকে মাথা কাত করে জানালেন, তার কথাই সত্য।

    মিঃ মিত্র মুখ তুললেন, বললেন, ‘আর ও সব কথা-‘

    কৃষ্ণা হাত তুলল, ‘আঃ চুপ করুন না মেসোমশাই! নিজে যখন কিছুই পারবেন না, অন্যের কাজে বাধা দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই আপনার। আপনি একজন তৃতীয় লোকের মতো নির্বাক হয়ে থাকুন। আমায় যদি আপনার বিশ্বাস হয়, এখনকার মতো আমার হাতে ভার দিন দেখি।’

    ‘আর এখন-‘

    মিঃ মিত্র অতি করুণভাবে হাসলেন।

    কৃষ্ণা হেমবাবুর পানে চাইল, বলল, ‘মেসোমশাইয়ের এখন মাথার ঠিক নেই, আপনি আমাকেই সব কথা বলতে পারেন। আপনি বোধহয় দেবুর কাছে আমার নাম শুনেছেন, আমার নাম কৃষ্ণা-কৃষ্ণা চৌধুরী-‘

    শুধু হাসির রেখা ওষ্ঠে ফুটিয়ে হেমবাবু বললেন, ‘দেবুর কাছে শুধু কেন মা, খবরের কাগজে কিছুদিন আগে তোমার ফটো দেখেছি, তোমার কথা পড়েছি। হ্যাঁ, তুমি কি জিজ্ঞাসা করবে কর, আমি আর এইসব ছেলেরা যে যা জানি, বলব।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আপনাদের ওখানে খাওয়া-দাওয়া হল কখন-কখন পৌঁছালেন, ছেলেরা কি করছিল-এই সব কথাগুলো আমি শুনতে চাই।’

    হেমবাবু বললেন, ‘আমরা এক ঘণ্টার মধ্যেই গিয়ে পৌঁছাই। জায়গাটা ইছামতী নদীর ধারে-‘

    মিঃ মিত্র একটা আর্তনাদ করলেন, ‘সর্বনাশ! দেবু নদীতে পড়ে যায়নি তো? ওদিকে নদী যা চওড়া, আর ও নদীতে যা হাঙর! মাঝে মাঝে কুমিরও দেখা যায়-‘

    হেমবাবু বললেন, ‘না, বাগানটা নদীর পাশে হলেও ছেলেদের ওপরে সর্বদা আমাদের দৃষ্টি ছিল। কয়েকজন ছেলে নদীতে নেমে সাঁতার কেটেছে, কিন্তু তাদের মধ্যে দেবু ছিল না। সে জলকে ভয়ানক ভয় করে দেখলুম, জল হতে অনেক তফাতে সে ছিল।’

    একটা নিঃশ্বাস ফেলে মিঃ মিত্র বললেন, ‘জন্মে পর্যন্ত তার স্বাস্থ্য খারাপ থাকার জন্যে মাসির কাছে ছিল কিনা, তার মাসি তাকে কোথাও যেতে দিত না-তাই সে জলও বড় একটা দেখেনি-‘

    কৃষ্ণা সে কথায় কর্ণপাত করল না, হেমবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘যতক্ষণ রান্না-বান্না হচ্ছিল, দেবু ওখানেই ছিল?’

    হেমবাবু ছেলে তিনটিকে দেখিয়ে বললেন, ‘দেবু এদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে ততক্ষণ কাটিয়েছে। রান্না হয়ে গেলে ছেলেদের আগেই দিয়ে দেওয়া হয়, ওরা খেয়ে নিয়ে গ্রাম বেড়ানোর কথা বলে। আমি ওদের মধ্যে দশ-পনেরো জন ছেলেকে নিয়ে গ্রামের দিকে যাই, আমাদের সঙ্গে দেবুও ছিল। অনেক দূর গিয়ে খেয়াল হল দেবু আসেনি। একটি ছেলে বললে, আসতে আসতে ফিরে গেছে, বলেছে গ্রামে গিয়ে কি দেখবে, তার চেয়ে নদী দেখতে ভালো।’

    মিঃ মিত্র মাথায় হাত বোলালেন-

    কৃষ্ণা বলল, ‘এই ছেলেরা কিছু জানে-যারা আপনার সঙ্গে এসেছে?’

    হেমবাবু বললেন, ‘এরা জানে বলেই এসেছে। নরেন, তোমার সঙ্গে দেবু কি বলে গেছে এঁকে বল দেখি।’

    দেবুর চেয়ে ছেলেটি দুই-এক বৎসরের বড় হবে,-সে বলল, ‘দেবু গ্রামে না গিয়ে সেইখানেই দাঁড়াল। নদীর তীরে একখানা খুব সুন্দর বজরা নোঙর করা ছিল, সে সেইখানা দেখছিল দেখতে পেলুম।’

    ‘বজরা-সুন্দর বজরা!’

    কৃষ্ণা বিস্মিত হয়ে নরেনের পানে তাকাল।

    উৎসাহিত নরেন বলল, ‘ভারী চমৎকার দেখতে। সবুজ রঙের বজরা, জানলা-দরজা সব সাদা,-দেখলে চোখ ফেরানো যায় না।’

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ‘বজরায় লোকজন ছিল?’

    নরেন মনে করে বলল, ‘ভেতরে কেউ ছিল কিনা দেখতে পাইনি, তবে বাইরের দিকে দু-চার জন লোক বসে গল্প করছিল দেখেছি।’

    পাশের ছেলেটি বলল, ‘আমি আর একজন বিশ্রী চেহারার লোককে দেখেছিলুম। সে যা ভীষণ চেহারা, লম্বা ঠিক তালগাছের মতো, তেমনি কালো তার গায়ের রং, দাঁতগুলো এত বড় বড় আর বার হয়ে রয়েছে-আমি একবার তার দিকে চেয়েই ছুটে পালিয়েছি, আর তার পানে ফিরেও চাইনি।’

    মিঃ মিত্র সচকিত হয়ে উঠলেন-‘বিশ্রী চেহারা? বলতে পার খোকা-তার একটা চোখে ঢেলা বার করা অর্থাৎ ঠেলে বার হয়েছে কিনা, আর কপালে একটা আব আছে কিনা?’

    ছেলেটি কুণ্ঠিত হয়ে আমতা আমতা করে বলল, ‘তা তো আমি দেখিনি। আমি একবার মাত্র তার পানে চেয়েই ছুট দিয়েছি। পেছনে সে আমায় ডাকছিল-বিশ্রী কর্কশ তার গলার স্বর, আমি তবু ফিরে চাইনি। এই মহিমের সঙ্গে নাকি তার কথাবার্তা হয়েছিল, মহিমকে জিজ্ঞাসা করুন।’

    মহিম ছেলেটি মাথা চুলকিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ….আমি খাওয়া-দাওয়ার আগে একাই বজরাটার কাছে গিয়েছিলুম। তখন সেই লম্বা লোকটা আমায় কাছে ডাকলে; যদিও ভয় হচ্ছিল, তবু সাহস করে তার কাছে গেলুম; সে আমায় অনেক কথা জিজ্ঞাসা করলে। আমরা কয়জন এসেছি, কয়জন টিচার সঙ্গে এসেছেন, কখন ফিরব, সব কথা সে জিজ্ঞাসা করল; আমিও সাহসে ভর করে সব বললুম।’

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের সকলের নাম, বাপের নাম সব জিজ্ঞাসা করেছিল?’

    মহিম উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ-সব-‘

    কৃষ্ণা বলল, ‘দেবুর কথাও হয়েছিল?’

    মহিম বলল, ‘হ্যাঁ, সব হয়েছে। সে আবার দেখতে চাইলে কোনটি হাকিমের ছেলে!-তখন দেবু তীরে দাঁড়িয়ে ছেলেদের জলে সাঁতার কাটা দেখছিল, আমি তাকে দেখিয়ে দিলুম-‘

    আর্দ্র কণ্ঠে মিঃ মিত্র বললেন, ‘আর দেখতে হবে না কৃষ্ণা, দেবু খাঁজাহানের হাতে পড়েছে। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে সে আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আজ সুযোগ আর সুবিধা পেয়ে সে দেবুকে চুরি করে নিয়ে পালিয়েছে।’

    কৃষ্ণা দৃঢ়কণ্ঠে বলল, ‘তাই বলে হাত-পা ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটি তো উচিত নয় মেসোমশাই! যা হোক একটা কিছু করতে হবে তো? বেশ বোঝা যাচ্ছে সে আগেই দেবুর পরিচয় নিয়েছিল, তারপর যে কোনোরকমে ভুলিয়েই হোক বা জোর করেই হোক, তাকে বজরায় তুলে নিয়ে গেছে। আচ্ছা মহিম ভাই, তোমরা যখন গ্রাম দেখে ফিরেছিলে, বজরাখানা তখনও সেখানে ছিল?’

    মহিমা মাথা নাড়ল, ‘না, সেখানে বজরা ছিল না।’

    ‘হুঁ’ বলে কৃষ্ণা কি ভাবতে লাগল।

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘আচ্ছা, যে লোকটার সঙ্গে তোমার কথা হয়েছিল, তার চেহারাখানা কি রকম বল দেখি?’

    মহিম আতঙ্কে শিউরে উঠল, বলল, ‘আমি অমন বিশ্রী চেহারা কখনও দেখিনি স্যার! কপালে একটা আব, একটা চোখ ঠেলে বার হয়েছে। যেমন বিশ্রী কালো রং, তেমনি লম্বা-চওড়া-‘

    ‘কৃষ্ণা, আর রক্ষা নেই! দেবু খাঁজাহানের হাতে গিয়ে পড়েছে! খাঁজাহানের ধারণা তার ছেলে আমার জন্যেই মরেছে,-তার পত্রের ভাবে তাই বুঝায়। সে আমায় অমনি নিষ্কৃতি দেবে না কৃষ্ণা, আমার ওপর দিয়ে সে মর্মান্তিক প্রতিশোধ নেবে-‘

    মিঃ মিত্র উঠে দাঁড়ালেন, হাত দু’খানা আড়াআড়ি ভাবে বুকের উপর রেখে তিনি ঘরের মধ্যে পায়চারি করে বেড়াতে লাগলেন।

    * * * * *

    পুলিশে খবর দেওয়া হল, পুলিশ এনকোয়ারি শুরু হল।

    ভ্রূকুঞ্চিত করে কৃষ্ণা বলল, ‘আপনার পুলিশ ওই মোটামুটি তদন্ত করবে মেসোমশাই, যেমন সাধারণত হয়ে থাকে। খবরের কাগজে দেখছেন তো? প্রায়ই লোকের ছেলে-হারানোর খবর পাওয়া যায়। সে সব জায়গাতেও তো পুলিশ এনকোয়ারি চলে, তবে সে সব ছেলেদের পাওয়া যায় না কেন ভাবুন।’

    মিসেস মিত্র ক্রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ‘এসব ছেলেদের নিয়ে তারা কি করে?’

    কৃষ্ণা বলল, ‘কলকাতায় ব্যোমকেশবাবুকে চেনেন তো মাসিমা-যিনি আমাদের তদন্তের ভার নিয়েছিলেন? কেবল আমাদের কেন, অনেক লোকের অনেক কিছু তদন্ত তিনি করে থাকেন। তাঁর কাছে আমি শুনেছিলুম, একদল লোক আছে যারা এমনই সব ছেলেদের দিয়ে ভিক্ষা করায়, দরকার বোধে তাদের অন্ধ করে, খোঁড়া করে, আবার সময় সময় বোবাও করে দেয়।’

    ‘উঃ!’ মিসেস মিত্র অর্ধ-চেতনাহীনভাবে চেয়ারে হেলে পড়লেন।

    কৃষ্ণা তাঁর গায়ে হাতখানা রেখে বলল, ‘কিন্তু এই কথাটি শুনেই তো ভয় পেলে চলবে না মাসিমা। বরং এই সব বাইরের বিষয়ও ভাবুন। ভাবুন, এমনি করে কত ছেলেমেয়ে আমাদের চলে যাচ্ছে-হারিয়ে যাচ্ছে!’

    মিসেস মিত্র দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ভগবান দেবুকে রক্ষা করুন।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘কাকাবাবুর মুখে শুনেছি-একটা দল আছে যারা ছেলেদের চুরি করে দূরদেশে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে তাদের চুরি-ডাকাতি করতে শেখায়। তাদের দেহই শুধু নয়, মনকে পর্যন্ত তারা এমন কলুষিত করে তোলে যা বলার নয়। কাকাবাবু এ সব দলকে চেনেন, তাঁকে একবার খবর দিলে ভালো হয়।’

    মিসেস মিত্রের একান্ত জিদে মিঃ মিত্র কলকাতার বিখ্যাত ডিটেকটিভ ব্যোমকেশবাবুকে একখানা টেলিগ্রাম করে দিলেন,-‘বিশেষ দরকার, এখনই আসা চাই।’

    সেদিন কোর্টের বাইরে আসামাত্র একটি জীর্ণবেশ ভিখারি মিঃ মিত্রের সামনে হাত পাতল, করুণ সুরে বলল, ‘দু’দিন খেতে পাইনি সাহেব, একটা পয়সা।’

    কোর্টের আরদালি, চাপরাশিরা ছুটে এল, হৈ হৈ করে তারা ভিখারিকে বের করে দিল।

    নিজের বাংলোর কাছে এসে সেই ভিখারিকে সেখানে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে মিঃ মিত্র আশ্চর্য হয়ে গেলেন।

    ভিখারি হাত পেতে বলল, ‘কোর্টের সামনে হুজুরের আরদালি-চাপরাশিরা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিল; বাধ্য হয়ে হুজুরের বাংলোয় এসেছি। যদি কিছু পাই, ভারী খুশি হয়ে খেয়ে বাঁচব।’

    মিঃ মিত্র হুঙ্কার ছাড়লেন, ‘রামসিং, তেগবাহাদুর, এই উসকো জলদি নিকাল দেও।’

    আদেশমাত্র ভোজপুরী রামসিং ও নেপালি তেগবাহাদুর এসে ভিখারিকে চেপে ধরল।

    সেই সময় বাইরে গোলমাল শুনে কৃষ্ণা এসে দরজায় দাঁড়াল।

    ভিখারি মৃদু মৃদু হাসছে, বলছে-‘ধাক্কা দিচ্ছ কেন বাবা, একটু ভদ্রভাবেই না হয় নিয়ে চল-‘

    ‘অ্যাঁ, কাকাবাবু-আপনি!’

    কৃষ্ণা দ্রুত নেমে এল-বলল, ‘কি করছ তোমরা, এ যে কাকাবাবু! কলকাতা হতে মেসোমশাইয়ের তার পেয়ে এসেছেন।’

    সন্ত্রস্তে রামসিং ও তেগবাহাদুর তখনই সরে দাঁড়াল। মিঃ মিত্রের মুখে কেবল একটি মাত্র শব্দ উচ্চারিত হল, ‘ব্যোমকেশবাবু!’

    পরমুহূর্তে তিনি ভিখারি বেশধারী ব্যোমকেশকে দৃঢ় আলিঙ্গন করলেন এবং সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বৈঠকখানায় বসালেন।

    তিনি হাতজোড় করে বললেন, ‘আমায় মাপ করুন ব্যোমকেশবাবু,-আপনি যে এমন ভিখারির বেশে এখানে আসবেন, কোর্টের সামনে হাত পাতবেন, তা আমি মোটে স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।’

    ব্যোমকেশবাবু বললেন, ‘এতে আপনার এতটা সঙ্কুচিত বা লজ্জিত হওয়ার কারণ নেই মিঃ মিত্র! আপনি যে আমায় চিনতে না পেরে অপমান করেছেন, সেটা আমার লজ্জা নয়, সেটাকে আমি অহঙ্কার বলে জানব-আমার ছদ্মবেশের গর্ব বলে মানব।’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘বাস্তবিক আপনার ছদ্মবেশ চমৎকার হয়েছে। কলকাতায় আপনাকে কতদিন দেখেছি, তবু আমি আপনাকে চিনতে পারলুম না! আচ্ছা, আপনি ও-পোশাক ছাড়ুন, চা খান, আমিও এ-পোশাক খুলে আসি।’

    পোশাক খুলে চা ও জলখাবার খাবার পর মিঃ মিত্র ব্যোমকেশকে সমস্ত কথা খুলে বললেন। শুনতে শুনতে ব্যোমকেশের মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। বললেন, ‘আমায় একবার সেই জায়গাটা দেখতে হবে মিঃ মিত্র, যেখানে বজরাখানা ছিল।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আজ রাত হয়ে এসেছে কাকা, কাল ভোরের দিকে যাওয়া যাবে। আমি ড্রাইভারকে বলে রেখেছি, ভোর হলেই চলে যাবেন। আমি মহিমকেও এই মাত্র খবর পাঠিয়েছি, কাল ভোরে সে আসবে, জায়গাটা সে দেখিয়ে দেবে।’

    সে রাত্রিটা কোনোরকমে কাটিয়ে ভোর হলেই কৃষ্ণা ব্যোমকেশকে গিয়ে ডাকল, ‘উঠুন কাকাবাবু, সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে।’

    মহিম ও কৃষ্ণাকে নিয়ে ব্যোমকেশ মোটরে উঠলেন।

    যেতে যেতে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি সে লোকটাকে দেখেছো খোকা? কি রকম দেখতে বল তো?’

    মহিমের মুখে লোকটির বর্ণনা শুনতে শুনতে ব্যোমকেশের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

    কৃষ্ণা বুঝল, তিনি তাকে চিনেছেন।

    ব্যোমকেশ সোৎসাহে চিৎকার করলেন, ‘আরে সে লোকটাকে আমি যে বেশ চিনি! একবার কেন, দু-তিনটে ডাকাতি কেসে তার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়েছে যে!’

    কৃষ্ণা বলল, ‘তবে এবারেও তো আপনি অতি সহজে তাকে ধরতে পারবেন কাকাবাবু?’

    ‘সহজে?’

    ব্যোমকেশ একটু হাসলেন, বললেন, ‘নিতান্ত সহজে ধরা পড়ার পাত্র খাঁজাহান নয় কৃষ্ণা! ওকে ধরতে বড় বেগ পেতে হয়। মিঃ মিত্র তার বিচার করেছিলেন বটে, কিন্তু তার সম্বন্ধে বিশেষ কিছুই জানেন না। আমাদের সব খবর রাখতে হয় বলে আমরা সব জানি। সে লোকটা বড় সহজ লোক নয়, অনেক কীর্তি তার আছে, আমাদের পুলিশের লোক প্রত্যেকে তাকে চেনে।’

    কৌতূহলী হয়ে কৃষ্ণা বলল, ‘আপনি যা জানেন, তাই কিছু সংক্ষেপে বলুন কাকাবাবু, বুঝতে পারি লোকটা কি রকম।’

    ব্যোমকেশ বললেন, ‘শোন বলছি। ওই খাঁজাহানের আসল বাড়ি কক্সবাজারে; বুঝতেই পারছ সমুদ্রতীরে যারা বাস করে, সমুদ্রে সাঁতার দিয়ে পালানো তাদের পক্ষে কিছু অসম্ভব ব্যাপার নয়। লোকটা ছোটবেলা হতে ভীষণ ডানপিটে ছিল। প্রমাণাভাবে অনেক খুনের ব্যাপার হতে সে নিষ্কৃতি পেয়েছে, কেবল জেল খেটেই খালাস। ওর একটা দল আছে যারা সর্বাংশে ওকেই অনুসরণ করে চলে, সংখ্যায় প্রায় শ’দুই লোক হবে।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘মস্ত বড় ডাকাতের দল!’

    ব্যোমকেশ বললেন, ‘হ্যাঁ। এরা কেবল জলে নৌকাযোগে ডাকাতিই করে না, স্থলেও করে থাকে। আর কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চলে এরা সীমাবদ্ধ নয়, সারা বাংলায় এদের দল চলাফেরা করে, সময় ও সুযোগমতো চুরি-ডাকাতি, খুনও করে থাকে।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘এখানেও তো একটা ডাকাতি-মামলায় ধরা পড়েছিল শুনলুম। তারপর জেলে গিয়ে একটা খুন করে, সেই জন্যে তাকে জাহাজে করে দ্বীপান্তরে পাঠানো হচ্ছিল, আর সেই জাহাজ হতে-‘

    ব্যোমকেশ বাধা দিলেন, ‘সে পালিয়ে যায়, জলে লাফ দিয়ে পড়ে। অসুখের ভান করে সে পড়ে থাকত; যা কিছু খেত সব বমি করে ফেলত। অসুস্থ রোগিকে তেমনভাবে পাহারা দেওয়ার আবশ্যকতা প্রহরী বোধ করেনি, তাই সে পালাতে পেরেছিল। যাই হোক-সে এবার প্রতিহিংসা ব্রত নিয়েছে দেখতে পাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে একটা ব্যবসাও খুলেছে জান কৃষ্ণা?’

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ‘ছেলে-চুরির ব্যবসা?’

    ব্যোমকেশ উত্তর দিলেন, ‘ঠিক তাই। এই সব ছেলেদের নিয়ে গিয়ে সে কোথায় রাখছে, সে সন্ধান আমরা আজও পাইনি, অথচ কৰ্তৃপক্ষের কাছে ধমক খেতে খেতে আমাদের প্রাণ গেল! দেখি যদি কোনোরকমে সন্ধান পাই, তখন একবার ওই খাঁজাহানকে দেখে নেব।’

    মোটর এই সময় থেমে গেল, ড্রাইভার দরজা খুলে দিতে মহিম, কৃষ্ণা ও ব্যোমকেশ নেমে পড়লেন।

    সামনের নদীতীর নির্দেশ করে মহিমা বলল, ‘এই যে, এই জায়গায় বজরাটা নোঙর করা ছিল দেখুন।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘দেখছেন কাকাবাবু, বজরা শহরের দিকে যায়নি। এইদিক বরাবর চলে গেছে যে দিক দিয়ে অন্য নদীর সহযোগিতায় সাগরের বুকে পড়তে পারে।’

    ব্যোমকেশ চিন্তিত মুখে বললেন, ‘কিন্তু সাগরের বুকে বজরা বেয়ে চলা-‘

    কৃষ্ণা একটু হেসে বলল, ‘কক্সবাজারের লোকেরা খুব পারবে কাকাবাবু! এই তো আপনি বললেন তারা সমুদ্রকে ভয় করে না। সত্যি, যারা সাগরের বুকে ডিঙি ভাসায়, তারা একটা বজরা ভাসিয়ে চলতে পারবে না?’

    কাছাকাছি কোনো লোককেই দেখা গেল না যাকে ব্যোমকেশবাবু দু-একটা প্রশ্ন করতে পারেন।

    বাধ্য হয়ে তিনি আবার মোটরে উঠলেন।

    * * * * *

    মিসেস মিত্র বসিরহাটে থাকতে আর রাজি নন, বাধ্য হয়ে মিঃ মিত্র তিনমাসের ছুটি নিয়ে কলকাতায় রওনা হলেন।

    কৃষ্ণাকে মিসেস মিত্র ছেড়ে দেননি-পুত্রের শোকে তিনি অধীর হয়ে উঠেছিলেন। ব্যোমকেশবাবু এখানকার তদন্ত শেষ করে সেইদিনই কলকাতায় চলে গেছেন, তাঁর আর কোনো খোঁজ নেই।

    কলকাতায় ফিরে নিজের বাড়িতে এসে প্রণবেশের সঙ্গে দেখা হল।

    প্রণবেশ কৃষ্ণার আপাদ মস্তক একবার তীক্ষ্নদৃষ্টিতে দেখে নিয়ে বললেন, ‘এখনই চলে এলে যে কৃষ্ণা, একমাস ওখানে থাকার কথা ছিল না?’

    কৃষ্ণা বলল, ‘মাসিমা-মেসোমশাই চলে এলেন কিনা, কাজেই বাধ্য হয়ে আমাকে অনেক আগেই চলে আসতে হল মামা!’

    প্রণবেশ ভালো করে জেঁকে বসলেন-‘হ্যাঁ, বল তো কৃষ্ণা, ওঁদের ব্যাপারখানা কি? খবরের কাগজ দেখি, বড় বড় অক্ষরে লিখেছে এস-ডি-ও-র একমাত্র পুত্র অপহরণ। তারপরই দেখি আমাদেরই মিঃ মিত্রের ছেলে দেবুকেই তারা নিয়ে গেছে, কোথায় নাকি পিকনিক করতে গেছল-সেখান হতে। সেদিন ব্যোমকেশবাবু নাকি তদন্তের ভার নিয়ে গিয়েছিলেন; শুনলুম তুমিও নাকি ইচ্ছা করেছ এর তদন্ত করতে।’

    কৃষ্ণা হাসল। বলল, ‘আমার ইচ্ছেটা তুমি এখানে এত দূর থেকে কি করে জানতে পারলে মামা?’

    প্রণবেশ ভ্রূ-কুঞ্চিত করে বললেন, ‘কালকের কাগজে দিয়েছে যে, তুমি দেখনি বুঝি?’

    তিনি টেবিলের উপরের সেদিনের সংবাদপত্রখানা খুলে দেখালেন।

    কৃষ্ণা দেখে আশ্চর্য হল, সংবাদপত্রে স্পষ্ট লেখা রয়েছে, ‘বিখ্যাত বার্মিজ-দস্যু ইউউইনের চক্রান্ত যে মেয়েটির অসামান্য চাতুর্যের দ্বারা ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া গিয়াছে সেই অসীম সাহসিকা ও প্রখর বুদ্ধিশালিনী কুমারী কৃষ্ণা চৌধুরী এই তদন্তের ভার নিজের হাতে লইয়াছেন।’

    কৃষ্ণা কাগজখানা সরিয়ে রেখে বলল, ‘অথচ ভার আমি নিইনি মামা, নেব ভেবেছি আর সেইজন্যে আমার এক বন্ধু চন্দ্রিকাকেও পত্র লিখেছি। তাদের বাড়ি চট্টগ্রামে, সেখানেই গিয়ে উঠব। যাবে মামা? ওদিককার প্রাকৃতিক শোভা নাকি ভারী সুন্দর! একদিকে চন্দ্রনাথ পাহাড়, অন্যদিকে সমুদ্র,-সে-সব নাকি দেখবার মতো জিনিস!’

    প্রণবেশ ধীরে ধীরে মাথা দোলালেন। সন্দিগ্ধভাবে বললেন, ‘একবার যা সমুদ্র দেখেছি বর্মামুলুকে যেতে, আর দেখার ইচ্ছে নেই বাপু, সত্যি কথাই বলছি।’

    বলতে বলতে তিনি শিউরে উঠলেন।

    কৃষ্ণা বলল, ‘এবার তো জাহাজে পাড়ি দিতে হবে না মামা! থাকবে তো চট্টগ্রামে একজনের বাড়িতে, বড় জোর তীর হতে সমুদ্র দেখবে আর পাহাড়ে উঠবে-চন্দ্রনাথ দেখবে, এইমাত্র, আর তো কিছু নয়।’

    প্রণবেশ তৎক্ষণাৎ রাজি।

    সন্ধ্যার দিকে মিঃ মিত্র এসে উপস্থিত হলেন, তাঁর মুখখানা বিবর্ণ মলিন।

    একখানা চেয়ারে বসে পড়ে হতাশাপূর্ণ কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘আবার একখানা লাল অক্ষরে লেখা পত্র পেয়েছি কৃষ্ণা! পুলিশের হাতে দেওয়ার আগে ব্যোমকেশবাবুর কাছে নিয়ে গেলুম; দেখলুম, তিনি বাড়ি নেই, কাল নাকি চট্টগ্রামে রওনা হয়েছেন। তোমাকে দেখাতে আনলুম পত্রখানা। একবার দেখে ঠিক কর দেখি, ওরা যে ভয় দেখাচ্ছে তা সত্য না মিথ্যা!’

    পকেট হতে একখানা কভারসুদ্ধ পত্র বের করে তিনি কৃষ্ণার হাতে দিলেন। তাড়াতাড়ি পত্রখানা খুলে ফেলে কৃষ্ণা পড়ল :

    মহামান্য হাকিম সাহেব,

    অকস্মাৎ কিছু টাকার দরকার হওয়ায় বাধ্য হয়ে তোমার ছেলেকে অপহরণ করতে হল। ঠিক প্রতিহিংসাবশেও বটে, নিজের টাকার দরকারেও বটে। কোথায় তাকে রেখেছি, তা বলব না-তবে মোটের ওপর জেনো, সে ভালোই আছে; খাওয়া, স্নান, ঘুম-তার বাড়ির মতোই চলছে। উপস্থিত তোমায় জানাচ্ছি-তার জীবনের ততক্ষণ পর্যন্ত আশঙ্কা নেই, যতক্ষণ বুঝছি তোমায় দিয়ে আমাদের দরকার মিটবে। আমার উপস্থিত দশ হাজার টাকার বড় দরকার, এই টাকাটা তোমার কাছে চাই। যদি পাই, তোমার ছেলেকে আমরা নিজেরা তোমার বাড়িতে পৌঁছে দেব কথা দিচ্ছি, আর একথাও মনে রেখ, খাঁজাহান খোদার নাম করে যে শপথ করে, সে শপথ রাখে।

    এই দশ হাজার টাকার কথা কাউকে না জানিয়ে কোনো লোকের হাত দিয়ে পাঠাবে। বাগবাজারের খালের ওধারে খানিকদূর সোজা গিয়ে দক্ষিণ দিকের একটা বস্তির-না চিহ্নিত দরজায় আঘাত করলেই দরজা খুলে যাবে। সেই ঘরের মেঝেয় টাকা রেখে পিছন দিকে না চেয়ে বেরিয়ে আসবে। বার বার সাবধান করছি, সঙ্গে পুলিশ যেন না থাকে, আর টাকা রেখে আসবার সময় পিছন দিকে ফিরে চাইবে না।

    আর এক কথা-সবগুলি যেন দশ টাকার নোট হয়, এমন কি একশো টাকার নোটও আমি চাইনে।

    তোমার পুত্রের জীবনের বিনিময়ে দশ হাজার টাকা এমন কিছু বেশি নয়। আমি জানি-তোমার পিতৃ-সঞ্চিত, এমন কি নিজের উপার্জিত অনেক দশ হাজার টাকা আছে, তা হতে একটা দশ হাজারের নোটের গোছা পুত্রের জন্য অনায়াসে ব্যয় করতে পার। যদি না দাও, পুত্রের ছিন্নমুণ্ড সত্বরই উপহার পাবে।

    আগামী শনিবার রাত্রি দশটা হতে এগারোটা পর্যন্ত টাকা পাঠানোর সময় মনে থাকে যেন।

    খাঁজাহান

    কৃষ্ণা মুখ তুলল।

    উত্তেজিত প্রণবেশ বললেন, ‘ব্যোমকেশবাবু মিথ্যে চট্টগ্রামে গেছেন, খাঁজাহান তো এখানেই আছে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘যতদূর মনে হয়, খাঁজাহান গিয়ে আবার ফিরে এসেছে। দেবুকে এখানে রাখেনি, তাকে চট্টগ্রামে তার নিভৃত জায়গায় রেখে ট্রেনে করে ফিরে আসা খাঁজাহান কেন, একজন সামান্য লোকের পক্ষেও কষ্টকর নয় মামা।’

    প্রণবেশ চটে উঠে বললেন, ‘কেন, তাকে বুঝি এখানে কোথাও রাখতে পারে না? এই যে সেদিন ব্যোমকেশবাবু বড়বাজারের দিকে একটা বাড়ি হতে অমন দশজন ছেলেকে বার করলেন-‘

    কৃষ্ণা বলল, ‘সেইজন্যেই ওরা সাবধান হয়েছে, জেনেছে, এখানকার আড্ডার সন্ধান পুলিশ জেনেছে, তাই বাইরে কোথাও জায়গা করেছে। কাকাবাবু বিনা সন্ধানে চট্টগ্রামে যাননি-কোনো খোঁজ পেয়ে চলে গেছেন কাউকে না জানিয়ে।’

    প্রণবেশ বললেন, ‘ওটা ডাকাতদের মানুষের চোখে ধুলো দেওয়ার কৌশল মাত্র। আমি বলছি, দেবু এখনও এখানে আছে, এরপর তাকে সময় আর সুযোগ বুঝে ওরা সরাবে। ওরা বেশই জানে, ছেলে-চুরির সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ছুটেছে, সে অবস্থায় চট্টগ্রামের মতো দূর জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভবপর নয়।’

    কৃষ্ণা চুপ করে রইল।

    মামার কথাটা সত্য হতেও পারে! এ-কথা সত্য, সেই নীল রংয়ের বজরায় করে তারা যে দেবুকে নিয়ে গেছে, পুলিশ এ-খোঁজ পেয়ে অনুসন্ধান করবে এবং সে মুহূর্তে ধরা পড়াও অসম্ভব নয়, বরং কিছুদিন কলকাতার কোনো স্থানে লুকিয়ে রেখে গোলমালটা একটু থামলে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘ওসব তো পরের কথা, এখন আমি কি করব তাই বল। সামনে শনিবার, এই দিনে যদি টাকা না পাঠাই, তাহলে হয়তো তারা দেবুকে হত্যা করবে। খাঁজাহান সব পারে কৃষ্ণা, আমায় শাস্তি দিতে সে শিশুহত্যাও করতে পারে।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আজ আপনি বাড়ি যান মেসোমশাই, আমি ভেবে দেখি কি করা উচিত, তারপরে আমি আপনাকে গিয়ে জানাব।’

    ব্যাকুলভাবে মিঃ মিত্র বললেন, ‘না দিলে যদি তারা দেবুকে হত্যা করে আর তার ছিন্নমুণ্ড পাঠায়?’

    সেই কল্পনা করেই তিনি শিউরে উঠলেন।

    কৃষ্ণা শান্তকণ্ঠে বলল, ‘আপনি আমায় ভার দিন মেসোমশাই! আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, দেবুকে আমি ফিরিয়ে এনে দেব, জীবন্ত এনে দেব। আপনি আমায় এতটুকু বিশ্বাস করুন দেখি! আমায় আশীর্বাদ করুন আমি যেন আমার কথা রাখতে পারি।’

    মিঃ মিত্র সজল চোখে বললেন, ‘কিন্তু তুমি মেয়েমানুষ মা!’

    দৃঢ়কণ্ঠে কৃষ্ণা বলল, ‘মেয়েরাও মানুষ মেসোমশাই। তারাও যে শিক্ষা পেলে ছেলেদের মতোই কাজ করতে পারে, আমি শুধু সেইটাই দেখাতে চাই। চিরদিন মেয়েরা অন্ধকারে অনেক পিছনে পড়ে আছে, আমি তাদের জানাতে চাই, পিছিয়ে নয়-সামনে এগিয়ে চলার দিন এসেছে, কাজ করার সময় এসেছে,-মেয়েরা এগিয়ে চলুক, তাদের শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিক।’

    * * * * *

    হঠাৎ যখন ঘুম ভেঙে গেল, দেবু উঠে বসবার চেষ্টা করল।

    কিন্তু একি, তার পা বাঁধা রয়েছে যে!-এমন করে তাকে বাঁধল কে?

    সে একবার চিৎকার করে ডাকতে গেল-‘মা!’

    শুষ্ককণ্ঠে কোনো ভাষা ফুটে না। পিপাসায় কণ্ঠ শুকিয়ে গেছে, একটু জল পেলে সে বেঁচে যায়, অনেকটা শক্তি ফিরে পায়।

    দেবু গোঁ গোঁ করতে লাগল।

    পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করল একজন লোক, পা হতে মাথা পর্যন্ত তার কালো কাপড়ে আচ্ছাদিত। একবার দেবুর পানে তাকিয়ে সে পাশেই যে জলের কুঁজো ছিল তা হতে গ্লাসে জল ঢেলে নিয়ে দেবুর মুখে অল্প অল্প ঢেলে দিল। আধ-ঘুমন্ত অবস্থায় জলপান করতে করতে দেবুর মনে হচ্ছিল-সে বাড়িতেই আছে, মা তাকে জল খাওয়াচ্ছেন।

    জল খাবার পর তার প্রকৃত জ্ঞান ফিরে এল, সে ভালো করে তাকাল।

    কালো পোশাক পরা লোকটির দিকে তাকিয়ে ভয়ে সে আঁতকে ওঠে! বাঁধা হাত দুখানা এক করে সে মুখের উপর চাপা দেয়।

    লোকটা গ্লাস রেখে আস্তে আস্তে চলে গেল, দেবুও একটা নিশ্বাস ফেলে হাত নামাল।

    প্রথমটায় তার মনে হয়েছিল-সে স্বপ্ন দেখছে! হাত তুলতে গিয়ে, পা নাড়তে গিয়ে বন্ধন অনুভব করে সে বুঝল, এ স্বপ্ন নয়, বাস্তবিক সত্য।

    কেমন করে সে এখানে এল-তাই সে ভাববার চেষ্টা করতে লাগল।

    ক্রমশ তার মনে পড়ল-শহর হতে দূরে ইছামতীর তীরে সে পিকনিক করতে গিয়েছিল। একটা কুৎসিত লোক তাকে প্রলোভন দেখিয়ে বজরায় তোলে, কি একটা সরবৎ খেতে দেয়, তার পরই সে ঘুমিয়ে পড়ে। সে কি এখনও ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এই সব অদ্ভুত স্বপ্ন দেখছে?

    মাথা ফিরিয়ে সে একবার স্থানটাকে দেখে নিল। ছোট একখানা ঘর, মাটির দেওয়াল, উপরে টালির ছাদ,-বাতাস চলাচলের জন্য উপরের দিকে একটু ফাঁক আছে; দেয়ালে একটি রুদ্ধ জানালা, রুদ্ধ একটি দরজাও আছে। এত অন্ধকার, সবকিছুই অস্পষ্টভাবে দেখা যায়।

    এ নিশ্চয়ই স্বপ্ন। দেবুর জীবনে এতবড় ঘটনা সত্য হবে কি করে!

    দেবু নড়াচড়া করল। চিৎকার করে ডাকল, ‘মা-ওমা, একবার এস এদিকে।’

    সঙ্গে সঙ্গে কালো পোশাক পরা সেই লোকটি প্রবেশ করল। তাকে দেখে দেবু এবার চোখ ঢাকল না, বিস্ফারিত নেত্রে তার পানে তাকিয়ে রইল। লোকটিও তার পানে তাকিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, একটা কথাও উচ্চারণ করল না।

    সাহসে ভর করে দেবু জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’

    সে উত্তর দিল না। এমনভাবে তাকিয়ে রইল, যেন সে দেবুর প্রশ্ন শুনতে পায়নি।

    দেবু আবার জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম কি?’

    এবার সে লোকটি মুখ নাড়ল, অর্থাৎ সঙ্কেতে জানতে চাইল, ‘কি?’

    বিরক্ত হয়ে দেবু চিৎকার করে বলল, ‘তোমার নাম কি তাই জানতে চাচ্ছি।’

    লোকটি কানে হাত দিল, মুখে হাত দিল, সঙ্কেতে জানাল সে কানে শুনতে পায় না, কথা বলতেও পারে না।

    দেবু ইশারায় তাকে চলে যেতে বলল। লোকটা যেমন এসেছিল, তেমনই আস্তে আস্তে চলে গেল।

    এতক্ষণে দেবুর মনে হল, সে বাড়িতে নেই, সেই লম্বা লোকটা তাকে কোনো উদ্দেশ্যে চুরি করে এনেছে। নিশ্চয়ই সরবতের সঙ্গে কোনো ঔষধ মিশিয়ে তাকে খাইয়েছিল, তাই সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এইবার তার নিজের বিপদ বুঝবার জ্ঞান এল, সে বুঝল এদের নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে।

    প্রথমটায় সে হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিল, এতক্ষণে তার লুপ্ত সাহস ফিরে এল।

    আস্তে আস্তে সে উঠে বসল।

    হাত তার খোলা, কিন্তু পায়ে লোহার শিকল দিয়ে বাঁধা, যেন সে উঠে দাঁড়াতে না পারে-কোনোরকমে পলায়ন করতে না পারে!

    তথাপি দেবু বৃথাই সেই শিকল ধরে টানাটানি করল, কিছুতেই সে শিকল খুলতে পারল না। হায় রে, সে যদি স্যান্ডো কি ভীম ভবানী হত! তা হলে এ শিকল সে অনায়াসে ছিঁড়ে ফেলত!

    নিস্তব্ধে সে বসে রইল।

    কতক্ষণ কেটে গেল কে জানে!

    অকস্মাৎ দরজা খোলার শব্দে তার বাহ্যজ্ঞান ফিরে এল। দেখল, সেই কালো লোকটা তার জন্য ভাত এনেছে। জলের গ্লাস ও ভাতের থালা দেবুর সামনে নামিয়ে দিয়ে ইঙ্গিতে সে খাবার কথা জানিয়ে দিল।

    দেবু ভাতের দিকে চাইল না, যেমন বসে ছিল, তেমনই বসে রইল।

    ‘উঁ-উঁ-‘

    লোকটা আঙুল দিয়ে ভাত দেখিয়ে একটা অস্পষ্ট শব্দ করছিল, অর্থাৎ ‘ভাত খাও, আমি থালা-গ্লাস নিয়ে যাব।’

    দারুণ ক্রোধে দেবু জলের গ্লাস ও ভাতের থালা দূরে টান মেরে ফেলে দিল। ইশারায় জানাল, সে কিছুই খাবে না।

    লোকটি নির্বাকভাবে খানিকক্ষণ তার পানে তাকিয়ে থেকে থালা-গ্লাস নিয়ে চলে গেল। দরজাটা খোলা রইল ইচ্ছা করেই সে দরজা দিল না।

    পালাবার এই সুযোগ।

    দেবু হাত-পায়ে ভর দিয়ে হামাগুড়ির মতো দরজার দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করতে লাগল।

    ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার উপর দাঁড়াল একজন লোক-তার পানে চেয়ে দেবু মুখ ফিরাল। এ সেই লোক-সেই কপালে আব, একটা চোখ নেই।

    মিষ্টকণ্ঠে সে বলল, ‘কি খোকা, খাবার দিলে সে খাবার অমন করে ছুঁড়ে ফেলে দিলে কেন?’

    দেবু সবেগে মাথা নাড়ল, ‘না, আমি তোমাদের এখানে কিছু খাব না।’

    লোকটি হাসল, সে হাসিটাও অতি বিশ্রী! মনে হয়, সে দাঁত বের করে ভয় দেখাচ্ছে!

    সে বলল, ‘না খেয়ে ক’দিন থাকতে পারবে খোকা? ক্ষিদের চোটে বাঘ ধান খায় তা তো জানো?’

    দেবু গুম হয়ে বসে রইল, একটি কথাও বলল না; একবার তাকিয়ে দেখল না।

    লোকটি কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘শোন খোকা, আমার কথামতো কাজ না করলে আমি তোমায় ছেড়ে দেব না, তুমি তোমার বাপ-মাকেও আর দেখতে পাবে না। যদি আমার কথামতো কাজ কর, শিগগিরই তোমায় আমি দিয়ে আসব কথা দিচ্ছি।’

    বাপ-মায়ের কাছে দেবু যেতে পারবে-আনন্দ হবার সঙ্গে সঙ্গে দেবু লোকটার বিকট মুখের পানে তাকিয়ে মুষড়ে পড়ল।

    লোকটি বাইরের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিত করতেই সেই কালা-বোবা লোকটি নূতন থালা সাজিয়ে ও অন্য গ্লাসে জল এনে দেবুর সামনে রাখল। কেবল মুক্তি পাবার আশায় দেবু খেতে বসল।

    বিশ্রী লোকটি বলল, ‘তুমি এখান হতে পালানোর চেষ্টা করলেও পালাতে পারবে না। এমন জায়গায় তোমায় রাখা হয়েছে, সেখান থেকে হাজার চিৎকার করলেও বাইরের কেউ শুনতে পাবে না। যে লোক তোমায় দেখাশোনা করে, সে কালা-বোবা; কাজেই তাকে কোনো কথা বলাও তোমার ভুল হবে।

    আমি আজ চলে যাচ্ছি, দু-চারদিন পরে ফিরে তোমার সঙ্গে দেখা করব। তখন দেখব, যদি তুমি বেশ ভালো ছেলে হয়ে আমাদের কথামতো কাজ করছ, তাহলে তোমায় ছেড়ে দিতেও পারি-অর্থাৎ এর মধ্যে যদি তোমার বাবা টাকাটাও পাঠান।’

    দেবু শঙ্কিত কণ্ঠে বলল, ‘বাবা টাকা পাঠাবেন কেন?’

    লোকটি আবার হাসল। বলল, ‘তোমার মুক্তিপণ, কিন্তু ওসব কথা তুমি বুঝবে না খোকা। তোমায় কয়েকখানা বই পাঠিয়ে দেব এখন, তুমি বই পড়, খাও-দাও ঘুমাও-বুঝলে?’

    সে চলে যাচ্ছিল, দেবু চিৎকার করল, ‘শোন, শোন, তোমার নামটা কি আমি ভুলে গেছি।’

    সে উত্তর দিল, ‘আমার নাম খাঁজাহান-‘

    দেবু সন্দিগ্ধভাবে বলল, ‘কিন্তু তুমি আমায় আগে এ-নাম তো বলনি-‘

    খাঁজাহান বলল, ‘না, তখন অন্য নাম বলেছিলুম, এ নাম বলার দরকার তখন হয়নি।’

    সে ফিরতে দেবু আবার চিৎকার করল, ‘আর একটা কথা! আমি কোথায় আছি সে-কথাটা আমায় বলে যাও, একি বসিরহাট না আর কোনও দেশ?’

    খাঁজাহান বলল, ‘না, উপস্থিত তুমি কলকাতায় আছ, কয়েকদিন বাদে তোমায় অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে।’

    খাঁজাহান বের হবার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

    দেবু কলকাতায় আছে?

    কান পেতে সে শুনবার চেষ্টা করল, মুখর কলকাতার কোনো শব্দ কানে আসে কিনা-নাঃ, সব নিস্তব্ধ।

    দেবু ভাবতে লাগল পিতামাতার কথা, তার কৃষ্ণাদির কথা।

    কৃষ্ণাদি কতবড় ডিটেকটিভের কাজ করেছে, কিভাবে নিজেকে রক্ষা করেছে, সে-সব গল্প সে শুনেছে। নিশ্চয়ই কৃষ্ণাদি এবারেও নিশ্চেষ্ট থাকবে না, দেবুকে উদ্ধার করবার ভার সে নিজেই গ্রহণ করবে। একদিন হয়তো দেবু শুনতে পাবে, কৃষ্ণাদি দরজার কাছে ডাকছে, মুক্ত দ্বারপথে একদিন সে কৃষ্ণাদিকে দেখতে পাবে!

    দেবু সেই দিনটার কথা ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে।

    * * * * *

    ব্যোমকেশ ফিরেছেন।

    শনিবার সকালে তিনি কৃষ্ণার সঙ্গে দেখা করতে এলেন।

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ‘কোনও সন্ধান মিলল কাকাবাবু?’

    ব্যোমকেশ বললেন, ‘অনেক খোঁজ করলুম, জলপথ বা স্থলপথে বিশ্রী চেহারার কোনো লোক কোনো ছেলেকে নিয়ে ওখানে যায়নি। কক্সবাজারে খাঁজাহানের খোঁজ নিয়ে জানলুম, তাকে ওখানকার লোক আজ কয় বছর দেখেনি। পুলিশ অনুসন্ধান করছে, কিছু খবর পেলেই আমায় তার করবে।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘মানুষ না হয় লুকোতে পারে, কিন্তু অতবড় বজরাখানা তো এই কয়দিনে লুকোতে পারে না কাকাবাবু! সে জিনিসটার কোনও খোঁজ পেলেন কি?’

    ব্যোমকেশ অবহেলার সুরে বললেন, ‘মানুষই যদি না পাওয়া গেল, ফাঁকা বজরা নিয়ে আমার কি লাভ হবে বল।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘সেটার সন্ধান পেলে মানুষের সন্ধান মিলতো।’

    ব্যোমকেশ একটু হাসলেন। বললেন, ‘কিছু করতে হবে না, আমি চারিদিকে খবর দিয়েছি, দেবুর ফটো আর খাঁজাহানের ফটো সব থানায় পাঠিয়েছি। সকলে জেনেছে, যে এদের ঠিক সন্ধান দিতে পারবে, সে পাঁচশো টাকা পুরস্কার পাবে। তুচ্ছ বজরার জন্যে মাথা খারাপ করে কোনো লাভ নেই; সেটা উপলক্ষ মাত্র, গেল বা থাকল তাতে কি আসে যায়?’

    ঠিক এই সময়ে প্রণবেশ হাঁফাতে হাঁফাতে প্রবেশ করলেন। ব্যোমকেশকে না দেখে তিনি সোৎসাহে বলে উঠলেন, ‘ঠিক তোমার কথামতো একখানা বজরার সন্ধান মিলেছে কৃষ্ণা, ঠিক যেমন বলেছিলে তেমনি-‘

    বলতে বলতে ব্যোমকেশের পানে দৃষ্টি পড়ল। ‘এই যে ব্যোমকেশবাবু, নমস্কার!’

    কথার সঙ্গে সঙ্গে শ্রান্তভাবে প্রণবেশ একখানা চেয়ারে বসে পড়লেন।

    একটু হেসে ব্যোমকেশ বললেন, ‘আপনাকে ভারী ক্লান্ত দেখাচ্ছে প্রণবেশবাবু! কোথায় যাওয়া হয়েছিল? বজরার সন্ধানে?’

    একটা আড়মোড়া ছেড়ে, হাই তুলে প্রণবেশ বললেন, ‘যা বলেছেন! কাল রাত তখন এগারোটা হবে, পাগলি মেয়ে বজরাখানার কথা একজনের কাছে শুনেই লাফিয়ে উঠল সেখানে যাওয়ার জন্যে! আরে মশাই, ছেলের মতো বুদ্ধি আর সাহস থাকলেও তুই মেয়ে-তোর কি ওই রাত্রে সেই বিদ্যাধরী নদীর ধারে একটা জংলা গ্রামে যাওয়া উচিত? ওকে বুঝিয়ে নিরস্ত করে সেই রাত্রে নিজেই গেলুম!’

    ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তারপর, দেখলেন বজরা?’

    তাঁর কণ্ঠস্বরে ব্যঙ্গ মিশ্রিত।

    প্রণবেশ সোৎসাহে বললেন, ‘দেখলুম, তাতে উঠলুম, বেড়ালুম। আর সব ঠিক হলেও মূলে গরমিল হয়ে যাচ্ছে কৃষ্ণা! আচ্ছা, তুমি চল, আমি ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে রেখে এসেছি, বেশিদূর নয়, মাইল কয়েক হবে, তুমি নিজের চোখে দেখে আসবে। আপনিও আসুন না ব্যোমকেশবাবু!’

    অনিচ্ছার সঙ্গে ব্যোমকেশ বললেন, ‘আসল উদ্দেশ্য ছেড়ে মিথ্যে গিয়ে হয়রান হওয়া মাত্র। বলছেন যখন, চলুন যাচ্ছি; কিন্তু তার আগে একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, বজরা না হয় দেখলেন, উঠলেন, কিন্তু শুধু দেখলেই কি চোরের দল ধরা পড়বে, বলুন?’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আপনার উত্তর আমি দিচ্ছি কাকাবাবু! অনেক সময় এতটুকু সূত্র ধরে অপরাধীর খোঁজ করা হয়, আর অপরাধী ধরাও পড়ে। ধোবার বাড়ির চিহ্ন ধরে যদি বড় বড় চুরি-ডাকাতি খুনের কিনারা হয়, বজরা হতেও এই ছেলে-চুরির কিনারা হতে পারে।’

    প্রণবেশ বললেন, ‘আমি আরও একটা কাজ করেছি কৃষ্ণা, আমাদের মহাদেও আমার সঙ্গে ওখানে গিয়েছিল তো! তাকে ভোর হতে বসিরহাটের সেই ছেলেটিকে আনতে পাঠিয়েছি। বজরাটা সে বেশ চেনে, দেখলেই বুঝতে পারবে। আচ্ছা যাও, তুমি প্রস্তুত হয়ে এস, আমি ততক্ষণ চা খেয়ে নিই।’

    এই পাগলামি ব্যাপারের মধ্যে যোগ দিতে ব্যোমকেশের ইচ্ছা ছিল না, তবু বাধ্য হয়ে তাঁকে থাকতে হল।

    অবিলম্বে কৃষ্ণা প্রস্তুত হয়ে এল এবং তিনজনে ট্যাক্সিতে উঠলেন। প্রণবেশের নির্দেশমতো ট্যাক্সি চলল।

    প্রণবেশ বলতে লাগলেন, ‘তোমার মহিম ভাইটি এতক্ষণ বোধহয় এসে পৌঁছাল আর কি! সে এখানেই এসেছে কিনা! কাল তোমার সন্ধানে এখানে এসেছিল, তুমি বাড়ি ছিলে না, তাই দেখা হয়নি। সে বরানগরে তার মামার বাড়ি এসেছে, মহাদেও এতক্ষণ তাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেছে।’

    দীর্ঘ পথ-হুস-হুস শব্দে খোলা পথে ট্যাক্সি ছুটে চলছে।

    দূরের বিদ্যাধরী নদী ক্রমশ নিকটে এল। জেলেরা নৌকায় বসে মাছ ধরছে দেখা গেল। তীরের দিকে কয়েকখানা নৌকা বাঁধা আছে, সেইখানে একখানা বজরাও নোঙর করা আছে।

    ট্যাক্সি থামবার আগেই মহিমকে দেখা গেল-সে ট্যাক্সির নিকট ছুটে এল।

    কৃষ্ণা নামল, প্রণবেশ ও ব্যোমকেশও নামলেন।

    প্রণবেশ বললেন, ‘এই সামনের বজরাখানা দেখ কৃষ্ণা-মহিম, এই বজরাটাই তুমি দেখেছিলে না?’

    সাদা বজরার পানে তাকিয়ে মহিম হতাশভাবে বলল, ‘এ বজরা নয় দিদি, সেখানা সবুজ রংয়ের ছিল; জানলা-দরজা সাদা ছিল। এ বজরা সাদা রংয়ের, এর দরজা-জানলা সব সবুজ দেখছি।’

    ব্যোমকেশ হাসলেন। বললেন, ‘কেমন, আমি আগেই বলেছিলুম না অনর্থক পণ্ডশ্রম!’

    কৃষ্ণা ভ্রূ-কুঞ্চিত করল। তাঁর কথার উত্তরে কিছু না বলে মহিমকে লক্ষ করে বলল, ‘রং ছাড়া আর কোনো তফাৎ আছে কি?’

    মহিম ভালো করে দেখে বলল, ‘না, এটা যদি সবুজ রংয়ের হত তাহলে-‘

    কৃষ্ণা এগিয়ে গেছে।

    বজরায় মাঝি-মাল্লা কেউ নাই। একজন মাত্র লোক কেবিনের মধ্যে আগাগোড়া ঢাকা দিয়া শুয়ে আছে। প্রণবেশের ধমকে সে মুখ খুলে জানাল বজরায় মাঝি-মাল্লা সব কোথায় গিয়েছে তা সে জানে না, তার ভয়ানক জ্বর, নড়বার সম্ভাবনা নেই।

    বাস্তবিকই তার জ্বর এসেছে। প্রণবেশ তথাপি তার কপালে হাত দিয়ে দেখল।

    ওদিকে কৃষ্ণা ডাকছে।

    প্রণবেশকে পাশে ডেকে নিয়ে গিয়ে কৃষ্ণা মুষ্টিবদ্ধ হাতখানা খুলল। প্রণবেশ দেখল, তার হাতে সাদা রং লেগে আছে।

    কৃষ্ণা বলল, ‘আমার আগেই সন্দেহ হয়েছে মামা-এই বজরায় ঐ ছেলে নিয়ে খাঁজাহান এক কলকাতা ছাড়া আর কোথাও যেতে পারে না! বজরা এই পর্যন্ত এনে এখান হতে ট্যাক্সিতে করে দেবুকে সে কলকাতায় নিয়ে গেছে। বজরা পাছে ধরা পড়ে, তাই সঙ্গে সঙ্গে বজরার রং পালটে দিয়েছে; সবুজ রংয়ের পরে সাদা রং লাগিয়েছে। দেখ, রং এখনও কাঁচা রয়েছে, হাত দিতেই উঠে গেছে, আর সেই জায়গায় সবুজ রং বার হয়ে পড়েছে।’

    প্রণবেশ গম্ভীরভাবে পরীক্ষা করলেন, তার পর তীরে ব্যোমকেশের কাছে ফিরে গিয়ে বললেন, ‘আপনি কৃষ্ণার যুক্তি উড়িয়ে দিয়েছেন ব্যোমকেশবাবু! আপনি নিজে দেখতে পারেন এই বজরাটায় সবুজ রং ছিল, সম্প্রতি সাদা রং দেওয়া হয়েছে। হাত দিয়ে জোরে ঘষে দেখুন, সাদা রং উঠে গিয়ে সবুজ রং বার হয়ে পড়বে।’

    ব্যোমকেশ পরীক্ষা করলেন। কেবলমাত্র বললেন, ‘হুঁ!’ আর একটা কথাও তাঁর মুখে শোনা গেল না।

    ফিরবার সময় মহিমকেও এই ট্যাক্সিতে তুলে নেওয়া হল। বরানগরে তার মামার বাড়িতে তাকে নামিয়ে এবং ব্যোমকেশকে তাঁর বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে, কৃষ্ণা মাতুলসহ যখন নিজের বাড়িতে ফিরল, তখন বেলা প্রায় দুটো বাজে।

    একটু বিশ্রাম করে স্নানান্তে আহারে বসে কৃষ্ণা বলল, ‘আমি একটা পথ দেখতে পেয়েছি মামা! কেবল তোমাকে আমি সঙ্গে নেব, আর ইনস্পেক্টার মিঃ চ্যাটার্জির সাহায্য নিতে হবে।’

    ক্ষুধার্ত প্রণবেশ ততক্ষণ কয়েক গ্রাস ভাত উদরস্থ করেছেন, এক গ্লাস জল খেয়ে কতকটা সুস্থ হয়ে বললেন, ‘এইবার কথাবার্তা বলা যেতে পারে, উদর-দেবতা কতকটা প্রকৃতিস্থ হয়েছেন। হ্যাঁ, কি বলছিলে? মিঃ চ্যাটার্জির সাহায্য নেবে। কেন, আমাদের ব্যোমকেশবাবু-‘

    কৃষ্ণা বলল, ‘কাকাবাবু বোঝেন একরকম, কাজ করেন অন্যরকম। ওঁর মনের ধারণা, উনি যা করবেন তাই নির্ভুল, অন্যে যা করবে সে সবই ভুল। আমি যে এতবড় একটা সূত্র এনে দিলুম, সেটাও উনি উড়িয়ে দিচ্ছেন। ওঁর ওপরে নির্ভর করে থাকলে শুধু হবে না মামা! এস, আমারা দুই মামা-ভাগনিতে অন্যদিক দিয়ে কাজ করি। যেমন করেই হোক, দেবুকে ফিরিয়ে আনার কথা,-উনি ওঁর বুদ্ধি আর মত নিয়ে কাজ করুন, আমরা আমাদের বুদ্ধি আর মত নিয়ে কাজ করি।’

    প্রণবেশ তৎক্ষণাৎ রাজি হলেন। উপস্থিত ডিটেকটিভগিরির ছোঁয়াচ তাঁরও লেগেছে-এ-কাজে বিপদের আশঙ্কা থাকলেও আনন্দ বড় কম নয়!

    * * * * *

    সেদিন শনিবার।

    কৃষ্ণা প্রণবেশের সঙ্গে মিঃ মিত্রের বাড়ি উপস্থিত হল।

    মিসেস মিত্র অসুস্থ-তিনি উপরের ঘরে শুয়ে আছেন, একজন নার্স তাঁর নিকটে রয়েছে। কৃষ্ণাকে দেখে মিসেস মিত্র তার হাত দুখানা ধরে কেঁদে বললেন, ‘দেবুকে না এনে দিলে আমি বাঁচব না কৃষ্ণা! তুমি কতবার কত কাজ করেছ-ধরতে গেলে অসাধ্য সাধন করেছ। আমাকে বাঁচাও, দেবুকে এনে দাও।’

    কৃষ্ণা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘কাঁদবেন না মাসিমা, আমি মেসোমশাইকে কথা দিয়েছি-দেবুকে যেখান হতে পারি, এনে আপনাদের দেব। আপনি ভাববেন না, আমি সেইজন্যেই ঘুরছি।’

    মিঃ মিত্রের সন্ধানে সে পাশের ঘরে গেল।

    মিঃ মিত্র টেবিলের উপর নোটের তাড়া সাজিয়ে রাখছেন। সবগুলিই দশ টাকার নোট। কৃষ্ণা দেখে বুঝল, দেবুর মুক্তিপণ হিসাবে এই দশ হাজার টাকা তিনি তারই কথামতো গুছিয়ে রাখছেন।

    একটা ছোট সুটকেসে দশ হাজার টাকার নোট গুনে রেখে কৃষ্ণা বলল, ‘আপনি ভাববেন না মেসোমশাই, দেবুকে খাঁজাহান উপস্থিত কলকাতাতেই রেখেছে, এই সব হাঙ্গামার জন্যে তাকে দূরে কোথাও নিয়ে যেতে পারেনি। যে বজরায় করে তাকে চুরি করে এনেছিল, কাল আমি সে বজরা দেখে এসেছি।’

    ‘সেই বজরা দেখেছ!’

    মিঃ মিত্র প্রায় চিৎকার করে উঠলেন।

    কৃষ্ণা বলল, ‘হ্যাঁ, এখান হতে কয়েক মাইল দূরে বিদ্যাধরী নদীর তীরে সেই বজরা আছে, রংটা কেবল বদলেছে এইমাত্র। যাই হোক, আপনি কাল সকালে খোঁজ পাবেন আমরা কতদূর কি করতে পারলুম।’

    মিঃ মিত্র জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু তোমার সঙ্গে যাবেন না?’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আপনার এখানে আসার আগে তাঁর কাছে গিয়েছিলুম, শুনলুম তিনি আজ অন্য একটা ব্যাপারে ব্যস্ত; কমিশনার কি কাজের জন্যে তাঁকে নাকি বর্ধমানে পাঠাচ্ছেন!’

    হতাশ হয়ে মিঃ মিত্র কপালে হাত দিলেন।

    কৃষ্ণা আর অপেক্ষা করল না, নীচে নেমে এল। প্রণবেশকে সে বৈঠকখানায় বসিয়ে ওপরে গিয়েছিল, ফিরে তাঁকে দেখতে পেল না।

    কৃষ্ণা মিনিট-পাঁচেক অপেক্ষা করে আবার ওপরের দিকে যাবার জন্য ফিরছিল, এমন সময় প্রণবেশ ফিরে এলেন।

    উত্তেজিত কণ্ঠে তিনি বললেন, ‘একটা লোক বরাবর আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে কৃষ্ণা! আমরা এ বাড়িতে ঢুকলেও সে লোকটা যায়নি, এ পথে পায়চারি করে বেড়াচ্ছিল। আমি বাইরে বার হয়ে লোকটাকে লক্ষ করছিলুম; কারণ আমরা যখন আসি, তখন আমাদের পিছনে পিছনে সে আসছিল। তাকে এখানে পায়চারি করতে দেখে আমার সন্দেহ হল। আমি খানিকক্ষণ ঘরে বসে জানালা দিয়ে দেখি, সে এই বাড়িটার পানেই চেয়ে আছে। বার হয়ে যেমন তাকে জিজ্ঞাসা করেছি-তুমি এ বাড়িটার দিকে লক্ষ করছ কেন? সে পাশের গলি দিয়ে ছুটে চলে গেল।’

    কৃষ্ণা গম্ভীর হয়ে বলল, ‘খাঁজাহানের লোক নাকি মামা?’

    প্রণবেশ উত্তেজিত কণ্ঠেই বললেন, ‘নিশ্চয়।’

    কৃষ্ণা চিন্তিত মুখে বলল, ‘খাঁজাহানই ওকে পাহারায় রেখেছে। জানে-আজ টাকা দেওয়ার দিন, মিঃ মিত্র আমার ওখানে যাওয়া-আসা করেন,-কাজেই আমি হয়তো তাঁর বিপদে কোনও কাজের ভার নিতে পারি, সেই সন্দেহ করেছে। আচ্ছা, করুক, তুমি চল মামা, একটা রিকশা বরং ডাকো-দুজনে তাতেই যাই।’

    তাই হল, একটা রিকশায় দুজনে বাড়ি ফিরলেন।

    কৃষ্ণার পরামর্শানুসারে প্রণবেশ বিকালে থানায় গিয়ে ইনস্পেক্টার মিঃ চ্যাটার্জির সঙ্গে গোপনে কিছু কথাবার্তা বলে এলেন।

    বিকাল হতেই আকাশে মেঘ জমে ছিল, সন্ধ্যা হবার সঙ্গে সঙ্গে মুষলধারে বৃষ্টি পড়তে লাগল।

    ভ্রূ-কুঞ্চিত করে কৃষ্ণা বলল, ‘আসুক বৃষ্টি, তবু আমরা ভয় পাব না, কি বল মামা?’

    প্রণবেশ একটু মুষড়িয়ে পড়ছিলেন। বললেন, ‘ও অঞ্চলটা তত সুবিধার নয় কিনা, বাগবাজারের খালের ওধারে বস্তিগুলোতে যত বদলোক থাকে-‘

    কৃষ্ণা বাধা দিয়ে বলল, ‘তাতো জেনেই যাচ্ছি। যাক, তুমি ততক্ষণ প্রস্তুত হও, আমিও প্রস্তুত হয়ে আসি।’

    আজই দুপুরের দিকে প্রণবেশ গিয়ে স্থানটাকে চিনে এসেছেন, রাত্রির অন্ধকারেও খালের ওধার চিনে যাওয়া বিশেষ কষ্টসাধ্য হত না-যদি এই বৃষ্টিটা না আসত।

    প্রণবেশ প্রস্তুত হয়ে নিলেন। কৃষ্ণা তখনও আসেনি, ঘড়িতে এদিকে প্রায় নয়টা বাজে। ভবানীপুর হতে বাগবাজার বাসে যেতেও বড় কম সময় লাগবে না-সেজন্য প্রণবেশ চঞ্চল হয়ে কৃষ্ণাকে ডাকবার জন্য ভিতরের দরজার দিকে অগ্রসর হলেন।

    এমন সময় বাইরের দরজা পথে ঘরে প্রবেশ করল একটি কিশোর ছেলে-একখানা লুঙ্গি তার পরনে, গায়ে একটা ডোরা-কাটা বেনিয়ান, মাথায় একটা পাঞ্জাবি ধরনের পাগড়ি, পায়ে নাগরা।

    বিস্মিত চোখে প্রণবেশ তার পানে তাকিয়ে আছেন দেখে সে হেসে উঠল-‘আমায় তাহলে সত্যই চেনা যাচ্ছে না মামা! সাজটা বেশ ভালো হয়েছে স্বীকার কর?’

    ‘আরে আমাদের কৃষ্ণা!’

    বাস্তবিকই চেনা যায় না। প্রণবেশ যাকে চব্বিশ ঘণ্টা দেখছেন, তাকে ছদ্মবেশে দেখেও যখন চিনতে পারলেন না, তখন বোঝা যায়, কৃষ্ণার ছদ্মবেশ নির্ভুল হয়েছে।

    প্রণবেশ মাথা দুলিয়ে বললেন, ‘কেউ বুঝতে পারবে না মা, কেউ তোমায় চিনতে পারবে না, এ বিষয়ে আমি তোমায় একেবারে অভয় দিচ্ছি। কিন্তু আর তো দেরি করলে চলবে না, নটা যে বাজল!’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আর দেরি কিসের! আমি ঝি-চাকর, দারোয়ান সকলকে বলে এসেছি, আর ওদের বলার দরকার নেই, তুমি সুটকেসটা নিয়ে বার হয়ে এস।’

    সদর রাস্তায় এসে উভয়ে বাসে উঠলেন।

    পাশের সিটে কুলিবেশী দুইজন কনস্টেবল মিঃ চ্যাটার্জির আদেশে প্রণবেশের সঙ্গে চলেছে, খালের ওধারে মিঃ চ্যাটার্জি নিজে থাকবেন।

    কৃষ্ণা তার চিরসঙ্গী রিভলভারটি নিতে ভোলেনি। পকেটে সে সেটা রাখেনি, কোমরবন্ধে সন্তর্পণে আটকে রেখেছিল। প্রণবেশের নিকটেও একটা রিভলভার ছিল, যদিও গুলি ছোড়া প্রণবেশের অভ্যাস নেই, তথাপি কাজে লাগতে পারে।

    শ্যামবাজারের মোড়ে বাস হতে নেমে ব্রিজ পার হয়ে প্রণবেশ বামদিককার পথ ধরলেন। কৃষ্ণা পাশে চলল, কুলিবেশী কনস্টেবল দুজন দূরে দূরে চলল।

    খালের ধারে কয়েকখানা নৌকা নোঙর করা আছে। একখানাতে মাদল বাজিয়ে দাঁড়ি-মাঝিরা গান ধরেছিল, বেশ বোঝা যায় তারা প্রকৃতিস্থ নেই।

    পথে একজন লোকের সঙ্গে প্রণবেশের ধাক্কা লেগে গেল, প্রণবেশ চটে উঠলেন-হয়তো হাতাহাতিই করে বসতেন! কৃষ্ণা চুপি চুপি বলল, ‘চিনতে পারছ না মামা, মিঃ চ্যাটার্জি!’

    পাশে পাশে চলতে চলতে ইনস্পেক্টার মিঃ চ্যাটার্জি চাপা সুরে বললেন, ‘চারিদিকে পুলিশ রেখেছি, আজ ঠিক ধরা যাবে। আপনারা কি টাকা এনেছেন সঙ্গে?’

    কৃষ্ণা হাসল, ‘পাগল! আপনার কথাই শুনেছি মিঃ চ্যাটার্জি, সুটকেসে কেবল কাগজ ভরা।’

    ‘আচ্ছা, আমি চলছি, লোক আসছে-‘

    মাতালের মতো টলতে টলতে মিঃ চ্যাটার্জি একটা গানের সুর ভাঁজতে ভাঁজতে একটা গলি-পথে চলে গেলেন।

    আর খানিকদূর গিয়ে একটা গলির মুখে একটা লোককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। কর্কশকণ্ঠে সে বলল, ‘কে তোমরা? এখানে কাকে চাই?’

    কৃষ্ণা উত্তর দিল, ‘এখানে-নং বাড়িতে দরকার আছে।’

    লোকটা সরে দাঁড়াল।

    অন্ধকার পিছলপথে সাবধানে চলতে চলতে প্রণবেশ ভয়ার্ত মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘লোকটা দলের লোক, বাড়ির নম্বর জেনেই ছেড়ে দিলে-দেখলে তো? যাই হোক, এই বস্তিতে আসা আমাদের উচিত হল না কৃষ্ণা! এই জলকাদা আর এই রাত, আলো প্রায় নেই বললেই হয়। এ রকম জায়গায় লোকে হাজার চিৎকার করলেও কোনো লোক আসবে না।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘তুমি চুপ কর মামা! আমাদের আশেপাশে অত পুলিশ, নিজে মিঃ চ্যাটার্জি রয়েছেন, ভয় পাওয়ার কারণটা কি? কিছু বেগতিক দেখলেই হুইসল দেবে, চারিধার হতে পুলিস এসে পড়বে, ওরা দলসুদ্ধ গ্রেপ্তার হবে, আমরাও দেবুকে পাব।’

    বলতে বলতে পাশের ঘরের দরজার উপর দৃষ্টি পড়ল-বলল, ‘এই তো সেই নম্বর মামা!’

    প্রণবেশ পকেট হতে টর্চ বের করে সেই আলোতে নম্বর দেখলেন, বললেন, ‘হ্যাঁ, সেই নম্বরই বটে।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি সুটকেসটা ওখানে নামানোর সঙ্গে সঙ্গে হুইসল দিও।’

    সে বারাণ্ডায় উঠে দরজায় আঘাত করতেই দরজা খুলে গেল, কৃষ্ণা ভিতরে প্রবেশ করল।

    হুইসল বার করবার অবকাশ প্রণবেশ পেলেন না; পকেটে হাত দেবার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় একটা প্রচণ্ড আঘাত,-প্রণবেশের চক্ষুর সামনে সব কিছু ঝাপসা হয়ে গেল, কাঁপতে কাঁপতে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।

    মনে হল-কৃষ্ণার চিৎকার কানে এল কিন্তু প্রণবেশ তখন সংজ্ঞাহীন।

    * * * * *

    পরদিন সংবাদ-পত্রে বড় বড় অক্ষরে প্রকাশিত হল-‘ভীষণ কাণ্ড! বাগবাজার খালের নিকটে ভয়ানক ব্যাপার!’

    তারপরে লেখা-

    ‘আমাদের দেশের লোক নিশ্চয়ই কুমারী কৃষ্ণা চৌধুরির কথা আজও ভুলে যাননি। এই অল্পবয়স্কা মেয়েটি সত্যই বাঙালির গৌরব। সম্প্রতি এঁকে পাওয়া যাচ্ছে না। কুমারীর ডিটেকটিভ কাজের উপর আগ্রহই তাঁকে ঘরছাড়া করে বাইরে টেনে এনেছিল। পাঠকের স্মরণ আছে, বসিরহাটের এস.ডি.ও. মিঃ মিত্রের ছেলেটি কিছুদিন পূর্বে অপহৃত হয়। এই ছেলেটি কুমারীর আত্মীয়। যদিও ছেলেটিকে অনুসন্ধান করে বের করার ভার পুলিশের হাতে দেওয়া হয়েছে, তথাপি অদম্য উৎসাহ বশে কুমারী নিজেও তার অনুসন্ধান ব্যাপারে যুক্ত হন। সম্ভবত, কোনো সন্ধান পেয়ে তিনি তাঁর মাতুল প্রণবেশবাবুর সঙ্গে গতকল্য রাত্রে খালের ধারে যান। পুলিশ প্রণবেশবাবুকে একটা গলির মধ্যে মূর্ছিত অবস্থায় পেয়েছে, দুর্দান্ত লোকদের লাঠির আঘাতে তাঁর মাথা ফেটেছে। কুমারীর কোনো সন্ধান নেই। প্রণবেশবাবুকে মেডিকেল কলেজে দেওয়া হয়েছে, তিনি সুস্থ হয়ে না ওঠা পর্যন্ত কুমারীর সম্বন্ধে কিছু জানা যাবে না।’

    চকিত এই সংবাদটা সারা কলকাতা শহরে ছড়িয়ে পড়ল, বর্ধমানে বসে ব্যোমকেশও শুনতে পেলেন। তাড়াতাড়ি করে সেখানকার কাজ মিটিয়ে দিয়ে তিনি কলকাতায় এসে পৌঁছালেন।

    কৃষ্ণার উপর রাগ হয়েছিল কম নয়। একে ছেলেমানুষ, তার উপর সে স্ত্রীলোক; এসব ব্যাপারে হাত দেওয়ার তার কোনো দরকার ছিল না। ব্যোমকেশ যখন ভার নিয়েছে, এ ব্যাপারের চূড়ান্ত একটা কিছু তিনিই করবেন।

    প্রণবেশকে দেখতে মেডিকেল কলেজে সেদিন বিকালে তিনি গিয়েছিলেন।

    প্রণবেশের জ্ঞান ফিরেছে, নার্স দুই-একটি কথা ছাড়া বেশি কথা বলতে দিল না। মাথায় চাড় লেগে রক্ত ছুটতে পারে। হার্টও দুর্বল, উত্তেজনা এখন মোটেই ভালো নয়।

    খানিকটা এদিক-ওদিক ঘুরে ব্যোমকেশ যখন বেরোলেন তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।

    তাঁর পরিচিত আবদুল মেছোবাজারে একটা বস্তিতে বাস করে, তার কাছে তাঁর দরকার ছিল। আবদুল এককালে নামজাদা গুন্ডা ছিল, অনেকবার সে জেলও খেটেছে। উপস্থিত সে ভদ্রভাবে বাস করছে ব্যোমকেশ তাকে অনেক দিক দিয়ে সাহায্য করেছেন। যাতে সে ভদ্রভাবে কোনো কাজ করে জীবিকার্জন করতে পারে, তার উপায়ও তিনি করে দিয়েছেন। উপস্থিত আবদুল একটা ছোটখাটো মনিহারী দোকান করে তার আয়ে স্বচ্ছন্দে দিন চালাচ্ছে।

    ব্যোমকেশ জানেন সে অনেক সন্ধান রাখে, সেইজন্য সেই সন্ধ্যায় তার কাছে গিয়া উপস্থিত হলেন। অনেক কাল আবদুলের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। বলা বাহুল্য, আবদুল তাঁকে দেখে ভারী খুশি হল, তাড়াতাড়ি একখানা টুল পেতে দিল।

    টুলের উপর বসে ব্যোমকেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার কাজ-কর্ম আজকাল কেমন চলছে আবদুল? অনেকদিন তো আমাদের ওদিকে যাওনি, মাস আষ্টেক হবে বোধহয়-না?’

    কুণ্ঠিত হয়ে আবদুল বলল, ‘ছেলেমেয়ে সব দেশ হতে এসেছে কিনা, তাদের নিত্য অসুখ-বিসুখ, এই দোকান-চালানো-এক দণ্ড ফুরসত পাইনে, সে জন্যে মাপ করবেন বাবু!’

    দু-পাঁচটা সাংসারিক কথাবার্তার পর গলার সুর একেবারে খাদে নামিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, ‘একটা জরুরি দরকারে তোমার কাছে এসেছি আবদুল, তা বোধ হয় বুঝেছ?’

    হেসে আবদুল বলল, ‘তা বুঝেছি বই কি বাবু! দরকার না থাকলে আপনি আবদুল মিঞার দোকানে আসবেন না তা জানি। বলুন-আপনার কি দরকার? জানা থাকলে উত্তর দেব।’

    ব্যোমকেশ বললেন, ‘তোমার তো অনেক লোকের সঙ্গে চেনা-শোনা আছে, খাঁজাহান নামে কাউকে চেন? সে জেলের মধ্যেই খুন করে দ্বীপান্তরে যেতে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ে পালিয়ে যায়?’

    আবদুল হাসল, বলল, ‘তাই বলুন! আপনি খাঁজাহানকে খুঁজতে এসেছেন? কিন্তু তাকে তো আর এখানে পাবেন না বাবু! কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত সে এখানে ছিল, রাত্রে চলে গেছে।’

    আশ্চর্য হয়ে ব্যোমকেশ বললেন, ‘কোথায় চলে গেল?’

    আবদুল বলল, ‘বোধহয় তার নিজের দেশে গেছে।’

    ব্যোমকেশ একটু চিন্তা করে বললেন, ‘ট্রেনে গেছে?’

    আবদুল বলল, ‘ঠিক বলতে পারিনে। তার নিজের বজরা আছে, নৌকোও আছে; কিসে যে গেল, তা জানি না।’

    ব্যোমকেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন, তার পর বললেন, ‘তুমি ঠিক বলতে পারবে আবদুল এই খাঁজাহান লোকটা কিসের ব্যবসা করে? আমি শুনেছি সে নাকি ছেলেমেয়ে চুরির ব্যবসা করে, এ পর্যন্ত অনেক ছেলেমেয়ে সে চুরি করেছে, তাদের দিয়ে নানারকম কাজ করিয়েছে। এ সব সম্বন্ধে তুমি কিছু জান?’

    আবদুল বলল, ‘কতকটা জানি বাবু। সম্প্রতি একটি ছেলেকে দেখেছি, চমৎকার ফুটফুটে ছেলে! এই কিছুদিন আগে কোথা হতে তাকে ধরে এনেছে। তাকেও বোধ হয় কাল সঙ্গে করে নিয়ে গেছে, সে নিজে যেখানে গেছে। আপনি তার খোঁজ নিতে যদি কাল আসতেন, আমি ঠিক খোঁজ দিতুম।

    আপনার অনেক নিমক খেয়ছি বাবু, নিমকহারামি করলে অমার সর্বনাশ হবে। সেইজন্যই আপনি যার খোঁজ চাইবেন, জানাশোনা থাকলেই বলে দেব। খাঁজাহানের এখানে দুই জায়গায় ডেরা ছিল, একটা বাগবাজারের খালের ওধারে বস্তিতে-যেখানে ওই এক ভদ্রলোকের মাথা ফেটেছে সেইখানে। আর একটা আছে বড়বাজারে, সেখানে হিন্দু কয়েকজন লোক তার কাজ চালায়। আমি নম্বর দিচ্ছি, আপনি গিয়ে খোঁজ নেবেন।’

    সে একখানা কাগজে দু’জায়গার নম্বর লিখে দিল, ব্যোমকেশ উঠলেন।

    সে রাত্রে তিনি বের হলেন না, পরদিন দুজন কনস্টেবল সহ একবার বড়বাজারে ও একবার বাগবাজারে অনুসন্ধান করলেন। দুই স্থানই শূন্য, কেউ নেই। বিফল-মনোরথ হয়ে ব্যোমকেশ ফিরলেন।

    * * * * *

    কৃষ্ণা বন্দিনী হয়েছে।

    কি অন্ধকার স্যাঁতসেঁতে ঘর! এর উপর কতকগুলো বিচালি পাতা, তার উপর একখানা বিলাতি কম্বল বিছানো, এই কৃষ্ণার শয্যা।

    মাথার পাগড়ি খুলে কোথায় পড়েছে, কে জানে? কৃষ্ণার চুল বেরিয়ে পড়েছে।

    সেই অন্ধকার ঘরে কৃষ্ণা একবার কোমর বন্ধটা পরীক্ষা করে। না, রিভলভারটা ঠিকই আছে, কেউ তার গায়ে হাত দেয়নি।

    কি আশ্চর্য ঘরখানা! কৃষ্ণা তাই ভাবে।

    মামাকে পথে রেখে অসীম সাহসে ভর করে সে ঘরের ভিতর প্রবেশ করেছিল। পত্রে লেখা ছিল-

    টাকা রেখে পিছনে চাইবে না, সোজা বার হয়ে আসতে হবে।

    কিন্তু খাঁজাহান কাঁচা ছেলে নয়। সে পূর্বাবধি সন্ধান রেখেছে। ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে, খালের মধ্যে নৌকায় তার লোক আছে, সে সব সন্ধান রাখে। কৃষ্ণা যে পুলিশ সঙ্গে করে এনেছে, সে তা জানে।

    কৃষ্ণা ঘরে পা দিতেই দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে ঘরের মেঝেটা সরসর করে নীচের দিকে নেমে গেল। কৃষ্ণা প্রথমটায় একটু ভয় পেয়েছিল, তার পরই পড়ে যাবার ভয়ে চট করে বসে পড়ল।

    ঘরের মেঝে যেখানে এসে স্থির হল, তার চারিদিকে দেয়াল,-অনুমানে মনে হয়, এটা ভূগর্ভস্থ একটা ঘর। আলো না থাকলেও বাতাস আছে, বেশ ঠান্ডাও আছে। কোন দিক দিয়ে কেমন করে বাতাস আসছে তা কৃষ্ণা বুঝতে পারল না। অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে সে ঘরের অবস্থানটা বুঝে নিল-বিছানাটাও দেখে নিল।

    চমৎকার!

    কোথায় দেবুকে মুক্তি দেবার জন্য-মায়ের কোলে তাকে ফিরিয়ে দেবার জন্য সে এসেছিল, অবশেষে সে নিজেই হল বন্দিনী! এখন তার উদ্ধারের উপায় করবে কে? কৃষ্ণা অধর দংশন করল।

    প্রণবেশ কোথায় রইল কে জানে? এমনও হতে পারে, এরা তাকেও বন্দী করেছে! হয়তো কৃষ্ণার পাশে এমনই একটা ঘরে তাকে রেখেছে, কৃষ্ণার মতো প্রণবেশও মাথায় হাত দিয়া ভাবছে।

    নাঃ ওসব ভাবনা থাক, কৃষ্ণাকে আগে দেখতে হবে মুক্তির পথ কোনদিকে-বাতাস আসার গতি নির্ণয় করে সেই গতিপথে তাকে চলতে হবে।

    আলো হতে অন্ধকারে এলে অন্ধকারের তীব্রতা বেশি অনুভূত হয়; কিন্তু অন্ধকারে থাকতে গেলে তার মধ্য দিয়েই অনেক কিছু দেখা যায়। খানিকক্ষণ দৃষ্টি চালনা করে কৃষ্ণা বুঝল, ঘরটার ওপরের দিক ফাঁকা, কাঠের ছাদ দেওয়া। কোনো স্প্রিংয়ের সাহায্যে ছাদটা সরসর করে নীচে নেমে যায় এবং কোনো কিছু তার ওপর থাকলে, কাতভাবে ঢেলে দিয়ে আবার সোজাভাবে উপরে উঠে যায়।

    দেয়ালে দুটো কিল দিয়ে সে বুঝল, দেয়াল পাতলা কাঠের। ওধারেও শব্দ হচ্ছিল। দেয়ালের গায়ে কান রেখে কৃষ্ণা বুঝল, ওধারেও কেউ আছে, তার কিলের প্রত্যুত্তরে সেও দেয়ালের গায়ে দুটো কিল বসিয়ে তার অস্তিত্ব জানাচ্ছে।

    কে ওখানে?-প্রণবেশ, দেবু-অথবা তারই মতো আরও কাকে পাশের ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে?

    কৃষ্ণা চারিদিকে চাইল।

    অনেক উপরে একটা জাফরি দেখা যায়, সেখান হতে বাতাস আসছে বোঝা গেল। বাইরের বাতাস আসবার সোজা পথ পেয়েছে, আলো সোজাভাবে আসতে পারেনি। হয়তো ওই জাফরি দিয়ে ওধারে কে আছে তা দেখা যাবে!

    কিন্তু অত ওপরে সে নাগাল পাবে কেমন করে?

    কৃষ্ণা যখন উপায় চিন্তা করছে এমনই সময় লোহার দরজাটা ঝন-ঝন করে খুলে গেল। কৃষ্ণা চেয়ে দেখল, দরজার ওপর একটা লম্বা লোক এসে দাঁড়িয়েছে।

    ওখানে যে দরজা আছে তা কৃষ্ণা দেখেনি, এতক্ষণে দৃষ্টি পড়ল। দরজার ওধারেও অন্ধকার, তবে এমনভাবে জমাট বেঁধে নেই। একটু হালকা থাকার জন্য মানুষটিকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।

    কৃষ্ণার মনে হল, দরজার বাইরে এই ভূগর্ভে নামবার জন্য একটা সিঁড়ি আছে, সেই সিঁড়ি হয়তো ওপরকার কোনো ঘরের মধ্য দিয়ে নেমে এসেছে।

    লোকটির হাতে টর্চ ছিল, সেই টর্চের আলো ফেলে সে ঘরের ভিতরটা দেখে নিল। কৃষ্ণার চোখের ওপর তীব্র আলো লাগতেই সে দু’হাতে চোখ ঢাকল।

    লোকটা হো-হো করে হেসে উঠল-বিশ্রী কর্কশ হাসি।

    খানিকক্ষণ হেসে, হাসি থামিয়ে সে জিজ্ঞাসা করল, ‘তারপর আছ কেমন মেয়ে গোয়েন্দা? ঘোল খাচ্ছ তো?’

    দারুণ ঘৃণায় কৃষ্ণা উত্তর দিল না।

    লোকটি বলল, ‘তোমার বাহাদুরি আছে বটে, সে জন্যে তোমায় প্রশংসা না করে পারিনে। পুরুষ যা করতে ভয় পায়, মেয়ে হয়ে তুমি তাই করতে এসেছ। কিন্তু বুঝতে পারেনি-তুমি এসেছ খাঁজাহানের গর্তে, যে তোমাকে কোনোরকমে সরিয়ে আনবার চেষ্টা করছিল, তুমি নিজেই এসে তার গর্তে ঢুকেছ। বুঝলে মেয়েটি-আমিই সেই খাঁজাহান, একবার চেয়ে দেখ।’

    টর্চের আলো সে নিজের মুখের ওপর ফেলল।

    কি কদাকার চেহারা! কৃষ্ণা যা শুনেছিল, তা অপেক্ষাও ভীষণ।

    ঘৃণা হল-ভয় হল না। ভয় কৃষ্ণার হয় না-তাই সে জিজ্ঞাসা করল, ‘আমায় আনবার চেষ্টা করেছিলে কেন?’

    খাঁজাহান বলল, ‘শুনলুম তুমি নাকি ছেলেটাকে বার করবার ভার নিয়েছ, তাই। তুমি বড় চালাক মেয়ে, তাই আমাদের হাকিম সাহেব টাকা দিলেও তুমি সে টাকা আনোনি। চারদিকে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করে সুটকেস ভরে কতকগুলো কাগজপত্র নিয়ে এসেছ। তুমি জান না তোমার বাড়ি হতে আমার লোক তোমাদের পিছু নিয়ে এসেছে, তোমার আর তোমার মামাকে এ পর্যন্ত আসবার অবকাশ আমিই দিয়েছিলুম কেননা-‘

    বাধা দিয়ে উৎসুককণ্ঠে কৃষ্ণা বলল, ‘আমার মামা কোথায়? তাঁকেও বন্দি করেছ নাকি?’

    গম্ভীর হয়ে খাঁজাহান বলল, ‘না, নিরেট লোকটাকে আটক করে রেখে তো কোনো লাভ নেই! নিজে হতে কিছু করবার ক্ষমতা তার নেই-কোনোদিন হবেও না। তার মাথায় এক লাঠির ঘা বসিয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছ, কিছুদিন সেখানে থাকবে-বুঝলে?’

    কৃষ্ণা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, বলল, ‘বুঝেছি। দেবুকে তার বাপের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যে আটকেছো, আমিও যাতে তার সন্ধান না করতে পারি তার জন্যে বন্দি করেছ। কিন্তু আমাদের নিয়ে করবে কি শুনি?’

    ‘কি করব?’

    টুকরো টুকরো হাসি হেসে খাঁজাহান বলল, ‘কি করব তা আজ রাত্রেই দেখতে পাবে!’

    তার সে হাসি দেখে কৃষ্ণা চিন্তিত হল, বলল, ‘খুন করবে?’

    খাঁজাহান বলল, ‘খুন করলে তো সবই ফুরিয়ে যাবে, আমার তাতে লাভ হবে কি? সোজা কথায় বলছি শোন। তোমরা এখান থেকে চালান হবে। আচ্ছা, বারোটা বাজে, লক্ষ্মী হয়ে বিছানায় শোও, আমি একবার দেখে গেলুম তুমি কি করছ। এখানে তুমি যত যাই কর না, বাইরের কেউ শুনতে পাবে না। এ ঘর মাটির মধ্যে-তা সহজেই বুঝতে পারছ। কলকাতার মতো জায়গায় এ রকম ঘর থাকে ভেবে তুমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছ-কেমন? এ রকম কল্পনা তুমি বোধহয় কোনোদিন করওনি। আচ্ছা-আমি চললুম।’

    ঝন-ঝন করে আবার দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

    টর্চের আলোয় কৃষ্ণা দেখেছিল-ঘরের দেয়ালে মাঝে মাঝে এক-এক জায়গা উঁচুমতো আছে, কোনো রকমে সেই উঁচু জায়গায় পা রেখে ওপর দিকে ওঠা যায়।

    খাঁজাহান চলে যাওয়ার খানিকক্ষণ পরে সে দেয়ালে আবার কিল মারল,-ওদিক হতেও শব্দ হল। ওদিকে যে আছে, তার কণ্ঠস্বর শোনবার জন্য কৃষ্ণা উঠে দাঁড়াল।

    উঁচু জায়গায় পা দিতে পা পিছলিয়ে যায়, হাতেও কিছু ধরা যায় না। কৃষ্ণা মেঝেয় হাত ঘষে খসখসে করে নিল,-কোনো রকমে এইটুকু উঠে সে যদি জাফরিটা ধরতে পারে, অন্ততপক্ষে পাঁচ-দশ মিনিট সে ঝুলে থাকতে পারবে!

    প্রায় আধঘণ্টার চেষ্টায় জাফরির কাছাকাছি গিয়ে পিছলিয়ে পড়তে পড়তে কৃষ্ণা জাফরি ধরে ফেলল, তার পর দু’হাতে ভর দিল।

    ও ঘরের বন্দি জানে না, এ ঘরে এই মেয়েটি কেবল তার সাড়া নেবার জন্য দীর্ঘস্থায়ী পরিশ্রম করেছে-সে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে।

    কৃষ্ণা ডাকতে লাগল, ‘এ ঘরে কে? কে আছ সাড়া দাও, কথা বল।’

    নিদ্রিত বন্দির ঘুম ভেঙে গেল, সে ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল-‘কে, কৃষ্ণাদি? তুমি এসেছ? আমায় মুক্তি দিতে এসেছ?’

    ‘অ্যাঁ-দেবু!’

    কৃষ্ণা মাথা ঘুরে প্রায় পড়ে যায় আর কি!

    দেবু জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কোথায় কৃষ্ণাদি?’

    কৃষ্ণা উত্তর দিল, ‘এই যে-তোমার মাথার ওপরে এই জাফরিতে। তোমায় মুক্ত করতে এসে আমিও বন্দি হয়েছি যে-এই আজই রাত্রে!’

    দেবু হতাশায় কেঁদে ফেলে, ‘সর্বনাশ! তাই এরা আর খানিক আগে বলেছিল-আমাদের দুজন বন্দীকে নিয়ে আজই ওদের নৌকো ছাড়বে, আমাদের নাকি অজ্ঞান করে নিয়ে যাবে। আমি তো জানি নে তুমি এসেছ, ভাবছি আর কাকে আটক করেছে। কি হবে কৃষ্ণাদি-আমি মুক্তি পাব না?’

    কৃষ্ণা উত্তর দেবার আগেই আবার ঝন-ঝন করে শব্দ হল, সঙ্গে সঙ্গে ও পাশটায় ধুপ করে শব্দ হল। কৃষ্ণা বোধ হয় ওপর হতে পড়ে গেল!

    দেবু শুনল, পাশের দিকে দুমদাম শব্দ। একবার রিভলভারের শব্দ হল, গুলিটা দেবুর দিককার দেয়ালে এসে বিঁধল। ভীত দেবু দু’হাতে কান ঢেকে তার বিছানায় মুখ গুঁজল।

    কখন ঘুম এল-দেবু নিস্তব্ধভাবে ঘুমাতে লাগল।

    আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে দুজন লোক এসে দাঁড়াল, পিছনে লণ্ঠন হাতে খাঁজাহান।

    সে আদেশ দিল, ‘এটাকেও ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে ফেল। হাত-পা বাঁধতে হবে না, নৌকোয় নিয়ে গিয়ে সেই ওষুধটা এক ডোজ খাইয়ে দিলে দুদিন জাগবে না, তার মধ্যে তোমরা নিরাপদ জায়গায় গিয়ে পৌঁছাবে। মেয়েটাকেও অজ্ঞান করা হয়েছে, দুজনকে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় রেখ, হঠাৎ জ্ঞান হলেও কেউ যেন কাউকে দেখতে না পায়।’

    ঘুমন্ত দেবুর ক্লোরোফর্মে আরও নিবিড় ঘুম এল। খাঁজাহানের আদেশে লোক দুটি তাকে বয়ে নিয়ে চলল।

    চলতে চলতে খাঁজাহান বলল, ‘মেয়েটা বড় শয়তান। ওর কাছে যে রিভলভার ছিল, তা আগে দেখা হয়নি। গায়ে জোরও আছে, বাঙালি মেয়েদের মতো দুর্বল নয়। আমি কাল-পরশু রওনা হব, তোমরা ততক্ষণ এগিয়ে যাও। মেয়েটাকে খুব সাবধান, সেটা যেন কেউটে সাপের বাচ্চা!’

    রাত্রি তখন তিনটে,-

    নিস্তব্ধ পথ ধরে লোক দুটি মূর্ছিত দেবুকে নিয়ে খালে নৌকায় উঠল।

    সবাই প্রস্তুত ছিল-খাঁজাহান ইঙ্গিত করতেই নৌকা ছেড়ে দিল।

    * * * * *

    যখন কৃষ্ণার জ্ঞান ফিরে এল, তখন তার নিজেকে ভারী দুর্বল মনে হচ্ছিল। বোধ হচ্ছিল কতকাল সে যেন রোগশয্যায় পড়ে আছে, মোটে নড়বার ক্ষমতাও তার নাই।

    ক্ষীণকণ্ঠে সে ডাকল, ‘এখানে কে আছ? একটু এদিকে এস-একটু জল দাও-‘

    কালো পোশাক পরা একজন লোক ভিতরে প্রবেশ করল, এ সেই লোকটি-যে দেবুর ভার নিয়েছিল।

    লোকটি জিজ্ঞাসুভাবে মুখ নাড়ল, অর্থাৎ-‘কি চাই?’

    তার মুখের ভাব দেখে কৃষ্ণা বুঝল সে কথা বলতে পারে না; কৃষ্ণা বলল, ‘একটু জল দাও।’

    লোকটা পাশের কুজো হতে একটা গ্লাসে জল গড়িয়ে আনল। কৃষ্ণা গ্লাসটা কম্পিত হস্তে ধরতে গেল। সে ইশারায় নিষেধ করে চামচে করে কৃষ্ণার মুখে অল্প অল্প করে জল ঢেলে দিল।

    জল পান করে কৃষ্ণা তার পানে তাকাল, আনমনেই বলল, ‘চাকরটি জুটেছে ভালো-বোবা! তার ওপর কালাও বোধ হয়!’

    লোকটি বাইরে চলে গেল।

    কৃষ্ণা একবার চারদিকে চেয়ে দেখল।

    একটি পুরাতন জরাজীর্ণ ঘর, দেয়ালের চুন-বালি খসে গিয়ে ছোট সাইজের ইঁট বেরিয়ে পড়েছে। ইঁটের গড়ন দেখে মনে হয়, বহু প্রাচীন যুগে এগুলি প্রস্তুত হয়েছিল-বর্তমান যুগের নয়। ঘরের কোনোদিকে জানলা নেই-চারিদিক মন্দিরের ধরনে গোল ভাবে গাঁথা, উপর দিকে উঁচু হয়ে উঠেছে। ঘরের এই গড়ন দেখে মনে হয়-এটি কোনো দেবতার মন্দির ছিল, বর্তমানে হয়েছে কৃষ্ণার বন্দিশালা।

    বহুক্ষণ চেষ্টার পর কৃষ্ণা উঠে বসল। এই সময় কালো পোশাকপরা লোকটি নির্বাকে একটি পাত্রে গরম দুধ এনে দাঁড়াল এবং ইঙ্গিতে দুধটা খেতে বলল।

    কৃষ্ণা দুধ খেয়ে নিয়ে পাত্রটা তাকে ফিরিয়ে দিল। তার পর আস্তে আস্তে উঠল।

    হাঁটুতে যেন জোর নেই-মাথা ঘোরে, দেহ টলে। সে দেয়াল ধরে দরজার দিকে অগ্রসর হল, লোকটা কোনো বাধা দিল না।

    দরজার কাছে এসে কৃষ্ণা বসে পড়ল।

    এ কি নিবিড় বন! অদূরে দেখা যাচ্ছে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি, একটার পর একটা মাথা তুলে দণ্ডায়মান। পর্বতের নীচে এই গভীর বন-ঙয়তো মন্দিরের চারিদিক এমনই বনে ঢাকা, পাহাড়ে ঘেরা।

    কৃষ্ণার আর্তকণ্ঠে একটি মাত্র শব্দ বার হল, শব্দটা নিজের কানে পৌঁছাবার সঙ্গে সঙ্গে সে সামলে গেল। মুখ ফিরিয়ে দেখল-তার নির্বাক সঙ্গীটি ছায়ার মতো তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।

    আস্তে আস্তে কৃষ্ণা ফিরল, আবার এসে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল, ক্লান্ত চোখ দুটি তার বুঁজে এল।

    একটু তন্দ্রা এসেছিল-হঠাৎ কি একটা শব্দে কৃষ্ণার সে তন্দ্রাভাব দূর হয়ে গেল। খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে সে সভয়ে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল।

    প্রকাণ্ড বড় একটা সাপ-পাহাড়ি অজগর, বিরাট শরীর নিয়ে প্রায় নড়তে পারে না। এত বড় আর এত মোটা সাপ কৃষ্ণা কেন-অনেকেই চোখে দেখেনি!

    সাপটা খোলা দরজার ওপর থেকে এতখানি মাথা উঁচু করে কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে ছিল, তার চোখ দুটো যেন জ্বলছিল, জিভটা বার বার বের করছিল।

    অর্ধ-মূর্ছিতার মতো কৃষ্ণা শুধু তার পানে চেয়ে রইল। সে এতটুকু নড়তে পারল না, একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারল না।

    তার নির্বাক সঙ্গী কোথায় গেল? হয়তো এই বিরাটকায় জীবটিকে দেখে দূরে পালিয়েছে! প্রাণের ভয় সকলেরই আছে তো!

    সাপটা সর-সর করে ঘরে ঢুকল, দড়ির খাটিয়ায় বসে কৃষ্ণা সভয়ে চোখ বুঁজলো। সে বেশ বুঝেছিল, এই ঘরটা এই সাপের বিশ্রামস্থল, হয়তো বনে বনে ঘুরে আশ্রয় নিতে সে এখানে আসে। অনাহূত কৃষ্ণা আজ তার আশ্রয়স্থল দখল করেছে, কৃষ্ণাকে সে কোনো মতেই ক্ষমা করবে না।

    আস্তে আস্তে কৃষ্ণা আবার চোখ মেলল-সাপটা নির্জীবের মতো মেঝেয় শুয়ে আছে। ভালো করে তাকিয়ে কৃষ্ণা দেখল, বিরাটকায় সাপটি লম্বায় দশ-বারো হাতের কম নয়, পরিধিও তার তেমনই।

    প্রায় ঘণ্টাখানেক কৃষ্ণা আড়ষ্টভাবে এই ভীষণ জীবের সামনা-সামনি বসে রইল।

    ঘণ্টাখানেক পরে সাপটি নড়ল, তার মাথা হতে পা পর্যন্ত অতি সুন্দর একটি হিল্লোল চলে গেল, আস্তে আস্তে মাথা তুলে সে একবার কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে বের হয়ে গেল।

    মিনিট পাঁচেক পরে কৃষ্ণার বডিগার্ড বোবা লোকটি এসে দরজায় দাঁড়াল, তার দু’চোখ বিস্ফারিত। মুখে একটা আঙুল দিয়ে অপর হাতখানা দিয়ে সঙ্কেতে সে বোঝাবার চেষ্টা করল-‘উঁ-উঁ-উঁ-‘

    এতক্ষণে কৃষ্ণার সাহস ফিরে এল। সে বেশ বুঝল, বোবা লোকটি পাশেই কোথায় লুকিয়ে পড়েছিল। তার ভয়ার্তভাব দেখে সাহস দেবার জন্য সঙ্কেতে সে বোঝাল-কোনো ভয় নেই, সে নিজেও ভয় পায় না, সাপটা চলে গিয়েছে।

    ঠিক এমন সময়ই দুর্গম জঙ্গল ও পাহাড় ঘেরা স্থানে উপর্যুপরি কয়েকবার বন্দুকের শব্দ শুনে কৃষ্ণা চমকে উঠল। কালা লোকটি কিছুই শুনতে পেল না, কৃষ্ণা উঠতেই সে বাধা দিল।

    তার হাতখানা ঠেলে দিয়ে কৃষ্ণা বাইরে এসে দাঁড়াল। খানিক আগে যতটা দুর্বল বলে নিজেকে মনে হচ্ছিল, এখন যেন তা অপেক্ষা অনেকটা জোর পেয়েছে।

    খানিক দূরে ধোঁয়া দেখা গেল-সঙ্গে সঙ্গে আবার বন্দুকের শব্দ!

    প্রহরী লোকটা কৃষ্ণার হাত ধরে টানল-দূরে ধোঁয়া দেখাল-কেবল শব্দ করল, ‘উঁ উঁ!’

    রাগ করে কৃষ্ণা বলল, ‘থাক, হনুমানের মতো আর উঁ উঁ করতে হবে না, আমি সব বুঝেছি।’

    ফিরে গিয়ে সে আবার নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ল।

    মিনিট কুড়ি পরে বাইরে তিন-চারজন লোকের পদশব্দ শোনা গেল, একজন বলল, ‘কি জাঁদরেল সাপ! সাত-আটটা গুলি খেয়ে তবে মরল!’

    আর একজন বলল, ‘আমি ও ঘর হতে বার হতেই দেখি এই দরজা দিয়ে বার হচ্ছে। মেয়েটাকে কামড়ায়নি, কামড়ালে সর্দার আমাদের বাঁচতে দিত না, তার এক-এক গুলিতেই আমরা সাবাড় হয়ে যেতুম।’

    এদের কথা হতে কৃষ্ণা বুঝল-কেবল বোবা-কালা লোকটি এখানে তার পাহারায় নেই, দলের আরও লোক আছে, হয়তো সেদিকে দেবুকে এনে তারই মতো অবস্থায় রেখেছে।

    সাপটাকে এরা মেরে ফেলেছে, কৃষ্ণা সে জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মরতে সে ভয় পায় না-কিন্তু বীরের মতো সে মরতে চায়, সাপের কামড়ে মরতে চায় না।

    কৃষ্ণা ঠিক করল, আর একটুজোর পেলেই সে বের হবে, চারিদিকটা একবার দেখে নেবে।

    হয়তো বোবা-কালা লোকটা এবার দরজায় চাবি দেবে। কৃষ্ণার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত দরজা খোলা ছিল, এখন জ্ঞান হয়েছে, বেশিক্ষণ তাকে মুক্ত রাখবে না।

    ভাবতে ভাবতে নিজের অজ্ঞাতে কৃষ্ণা কখন ঘুমিয়ে পড়ল।

    যখন ঘুম ভাঙল, তখন বিস্মিত চোখে দেখল, তার অনুমানই সত্য হয়েছে। ঘরের এক কোণে একটা প্রদীপ টিম-টিম করে জ্বলছিল, তার ম্লান আলোয় কৃষ্ণা দেখল, একটি মাত্র দরজা বাইরে থেকে বন্ধ হয়ে গেছে।

    ভেজানো আছে কি সত্যই বন্ধ হয়ে গেছে, দেখবার জন্য সে দরজার কাছে এসে কপাট ধরে টানল-একবার জোরে ধাক্কা দিল।

    সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে রুক্ষকণ্ঠে কে বলল, ‘চুপ করে থাক-আর দরজায় ধাক্কা দিতে হবে না। আমাদের রতনকে কালা-বোবা আর ভালোমানুষ পেয়ে যখন-তখন বার হয়ে আসছিলে, এইবার বোঝ মজা; আর বার হতে হবে না।’

    কৃষ্ণা ফিরে এল।

    বুঝল, তার ওপর কড়া পাহারা শুরু হল; বাইরের আলো পাওয়া তার পক্ষে কষ্টকর হবে।

    * * * * *

    উপায় চিন্তা করতে কৃষ্ণাকে বিশেষ বেগ পেতে হল না।

    প্রথম দিন তাকে যে লোকটা আহার্য দিতে এল, কৃষ্ণা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমাদের সর্দার এখানে এসেছে?’

    লোকটা খিঁচিয়ে উঠল, ‘এসেছে নয়-এসেছেন বল।’

    কৃষ্ণা ভুল সংশোধন করল-বলল, ‘আচ্ছা তাই, তিনি কি এসেছেন?’

    লোকটি বলল, ‘আমি জানিনে। তোমায় খেতে দেওয়া হয়েছে খেয়ে নাও, তোমার সঙ্গে কথা বলা নিষেধ।’

    কৃষ্ণা উঠতে উঠতে বলল, ‘তুমি না হয় কিছু বলবে না, তবু কথা বলতে পার তো? বাবা, কয়দিন একটা বোবা-কালা লোক যা দিয়েছিল, আমার প্রাণান্ত হত তাকে ইশারা করতে করতে।’

    সে আহার করতে বসল, লোকটা দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।

    কৃষ্ণার কথা শুনে সে খুশি হয়েছে বোঝা গেল। কৃষ্ণা আহার করতে করতে জিজ্ঞাসা করল, ‘যদি দরকার পড়ে তোমায় কি বলে ডাকব বল দেখি।’

    লোকটি উত্তর দিল, ‘আমার নাম সীতারাম।’

    ‘সীতারাম-সীতারাম!’

    কৃষ্ণা বার-কয়েক নামটা মুখস্থ করল। বলল, ‘যাক, আর ভুল হবে না। হাজার হোক, ঠাকুর-দেবতার নাম তো! ভোরবেলা ঘুম ভেঙে উঠেই সে নাম নিতে হয়।’

    সীতারাম আরও খুশি হয়ে উঠল।

    কৃষ্ণা আহার করতে করতে কথায় কথায় আলাপ করে নিল, তার দেশ কোথায়, দেশে কে কে আছে-কি ভাবে তাদের দিন কাটে-ইত্যাদি।

    প্রথম দিন এই ভাবে গেল।

    দু-চার দিন কেটে গেলে কৃষ্ণা একদিন জিজ্ঞাসা করল, ‘বলতে পার সীতারাম, আমাকে এরা কি করবে?’

    কয়দিনে সীতারাম এই ছোট মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছে। কথায় কথায় সেদিন বলে ফেলেছে, দেশে তার কৃষ্ণার মতো একটি মেয়ে আছে-ঠিক এমনই গল্প করে।

    সীতারাম কৃষ্ণার প্রশ্নের উত্তরে বলল, ‘সর্দারের কথা আমি তো জানিনে। তবে সেদিন আমাদের রহিম ভাই বলেছিল তোমায় নাকি আরাকানে নিয়ে যাবে-সেখানে মগদের কাছে বিক্রি করে সর্দার কিছু টাকা পাবে।’

    কৃষ্ণার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

    শুনতে পায়, খাঁজাহান মগ-সর্দারকে খবর দিয়েছে, সেও পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে এসে পড়বে এবং টাকা দিয়ে কৃষ্ণাকে নিয়ে যাবে।

    কৃষ্ণা নীরব হয়ে থাকে।

    এ স্থানের কথাও সে সীতারামের মুখে শুনতে পায়। এটা একটা মন্দিরই ছিল, এর ওদিকে আরও বারোটি এইরকম মন্দির আছে। সর্দার ছেলে-বিক্রয়ের ব্যবসা করে। এখানে উপস্থিত কয়েকটি ছেলে আছে, আর কয়েকটি সপ্তাহখানেকের মধ্যে বিভিন্ন প্রদেশে চালান গিয়েছে। এই মন্দিরের ওধার দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদ বয়ে চলেছে, এখানে নৌকাপথে সবাই যাওয়া-আসা করে। তিনদিকে ভীষণ বন-বড় বড় পর্বতশ্রেণি, আর একদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ; এখানে হতে কেউ কোনো দিন পালাতে পারেনি, পালালেও বাঘ-ভাল্লুকের আক্রমণে মরতে হবে।

    কৃষ্ণা কিন্তু পালানোর আশা রাখে।

    পাঁচ-সাত দিন পরেই আরাকানি মগ-সর্দার এসে পড়বে, তখন আর তার পালাবার জো থাকবে না, যদি পালাতে হয় এই উপযুক্ত সময়।

    সেদিন খোলা দরজাপথে কার আর্ত চিৎকার শুনে সে চমকে উঠেছিল। সীতারামকে জিজ্ঞাসা করে জানতে পারল, একটা বাঙালির ছেলে ছুটে বেরিয়ে এসেছে, তাকে ধরে কোঁড়া অর্থাৎ কাঁটাওয়ালা চাবুক লাগানো হচ্ছে। যারা পালাবার চেষ্টা করে, তাদের এই দণ্ড দেওয়া হয়।

    কৃষ্ণা শাস্তির কথা শুনল বটে, কিন্তু তাহলেও তার মন হতে পলায়নের সঙ্কল্প দূর হল না।

    সেদিন রাত্রে-

    সীতারাম খাবার নিয়ে এসে ডাকছিল-কৃষ্ণা ঘুমের ভান করে বিছানায় পড়েছিল। সীতারাম বিছানার পাশে এসে মুখ নিচু করে ডাকবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা তীরবেগে উঠেই তার গলা দুই হাতে চেপে ধরল এবং এমন একটা পেষণ কণ্ঠনালীতে দিল যে, সীতারাম হাত দিয়ে তাকে ধরবার সঙ্গে সঙ্গে তার হাত শিথিল হয়ে পড়ল এবং দমবন্ধ অবস্থায় সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

    তখনও কৃষ্ণা তাকে ছাড়েনি, অসীম শক্তিতে তার কণ্ঠনালীতে পেষণ দিচ্ছিল। যখন বুঝল সে মূর্ছিত হয়ে পড়েছে, তখন তারই পরিধানের কাপড় দিয়ে তার হাত ও পা শক্ত করে বাঁধল, মুখের মধ্যে খানিকটা কাপড় গুঁজে দিল।

    নিজে সে অত্যন্ত শ্রান্ত হয়ে পড়েছিল; খানিকটা হাঁপিয়ে তার পর সীতারামের টর্চটা নিল। তার পকেটে যে একটা ছোরা ও রিভলভার ছিল, কৃষ্ণা তা নিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল। দরজার তালায় চাবিটা লাগানো ছিল, সে দরজায় চাবি দিয়ে পাশের দিকে অগ্রসর হল।

    বোধ হয় শুক্লা পঞ্চমী কি ষষ্ঠীর রাত্রি, চাঁদের আলোয় চারিদিকটা দেখা যাচ্ছিল। দক্ষিণে ছয়টি এবং বামে ছয়টি সারি সারি মন্দির। সামনে দিয়ে যাবার ভরসা কৃষ্ণার হল না, পিছন দিক দিয়ে সে অগ্রসর হল।

    সীতারামের মুখে সে সকালে খবর পেয়েছিল, এখানে আজ বেশি লোক নেই, দু-চারজন মাত্র আছে। মন্দিরের ও-ধারে একটা খোলা জায়গায় লণ্ঠন জ্বলছিল, তার চারপাশে পাঁচ-ছয়জন লোক বসে ছিল। তাদের মধ্যে কেউ গান গাইছে, কেউ চিৎকার করে সা-রে-গা-মা সাধছে। কৃষ্ণা বেশ বুঝল, এরা কেউই প্রকৃতিস্থ নেই, সকলেই রীতিমতো মাতাল হয়েছে।

    মন্দিরের পিছনে দারুণ অন্ধকারে কতকগুলো স্তূপীকৃত ইঁটে পা বেধে কৃষ্ণা একবার হুড়মুড় করে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাতাল লোকগুলো হল্লা করে উঠল। কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি উঠে একটু দূরে একটা ঘন ঝোপের আড়ালে বসে পড়ল।

    পাঁচ-ছয়জন লোক লণ্ঠন নিয়ে মন্দিরের পিছনে দেখতে এসেছিল; লণ্ঠন উঁচু করে চারধার দেখে একজন বলল, ‘না, ও কিছু নয়; বনের মধ্যে জীবজন্তু আনাগোনা করছে; চল-ফেরা যাক।’

    তারা ফিরল, কৃষ্ণা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল!

    আস্তে আস্তে উঠে সে আবার মন্দিরের পিছনে এসে দাঁড়াল-লক্ষ করতে লাগল লোকগুলো কি করে!

    ঘণ্টাখানেক হল্লা করে তারা পাশের একটা ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিল। তারা স্বপ্নেও ভাবেনি, এই নদী পাহাড় ও জঙ্গলের মধ্যে কেউ এসে বন্দী ছেলেদের মুক্ত করতে পারে!

    খানিক পরে কৃষ্ণা এগিয়ে এল। যে ঘরে লোকগুলো প্রবেশ করেছিল, সেই ঘরের দরজার ছিদ্রপথে উঁকি দিয়ে দেখল, লণ্ঠনটা মৃদুভাবে জ্বলছে, চারজন লোক যে যেখানে পেরেছে পড়ে ঘুমোচ্ছে, তাদের নাক ডাকার শব্দে মনে হয় যেন মেঘ গর্জন করছে!

    নিঃশব্দে কৃষ্ণা সরে পড়ল।

    সীতারামের চাবির থলো সে পেয়েছে। একমুহূর্তে টর্চের আলোয় চাবি দেখে নিয়ে সে একটা মন্দিরের দরজা খুলে ফেলল-

    ‘কে?’

    কণ্ঠস্বর পরিচিত।

    ‘দেবু?’

    সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা টর্চ জ্বালাল।

    দেবুই বটে, সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসল-চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কৃষ্ণা খপ করে তার মুখ চেপে ধরল, ‘চুপ-আমি কৃষ্ণাদি। শিগগির বার হয়ে এস, একটুও দেরি কর না!’

    দেবু প্রস্তুত-লাফ দিয়ে উঠল।

    ‘কিন্তু এই সব জায়গায় আরও যে পাঁচ-সাতজন ছেলে আছে কৃষ্ণাদি! ওদের নিয়ে যাবে না?’

    কৃষ্ণা অধীর হয়ে বলল, ‘এখন থাক, পরে পুলিস নিয়ে এসে ওদের নিয়ে যাব-এদের দলসুদ্ধ ধরব। তুমি এস-ছুটে চল, আমাদের নদীর দিকে যেতে হবে! শুনেছি নদীতে সর্বদাই এদের নৌকো থাকে, কোনো রকমে নৌকো বেয়ে এখান থেকে পাঁচ-সাত মাইল দূরে গৌহাটিতে আমাদের পৌঁছাতে হবে। এস-‘

    সামনে টর্চের আলো ফেলে কৃষ্ণা ও দেবু ছুটল। জঙ্গল পদে পদে বাধা দিতে লাগল, কিন্তু আজ তারা কিছু গ্রাহ্যের মধ্যে আনল না।

    প্রায় এক মাইল ছুটে তারা ব্রহ্মপুত্রের তীরে পৌঁছল।

    জলের কল্লোল ও স্রোত দেখে দেবু আঁতকে উঠল-‘ওরে বাসরে! এই নদীতে কি করে যাব কৃষ্ণাদি?’

    কৃষ্ণা ইতস্তত টর্চের আলো ফেলে নৌকো দেখছিল। সীতারামের মুখে সে শুনেছে, এখানে নাকি এই দস্যুদলের যাতায়াতের জন্য সর্বদা নৌকো বাঁধা থাকে। বলল, ‘ভয় নেই, আমি তোমায় ঠিক নিয়ে যাব, আমার ওপর নির্ভর কর দেবু! আমি তোমায় ঠিক পৌঁছে দেব তোমার মা-বাবার কাছে।’

    দেবুর চোখে জল এল, সে আবার পিতা-মাতার কোলে ফিরতে পাবে! এ যে কি আনন্দ, তা বলা দুঃসাধ্য! কতকাল সে মাকে দেখেনি, পিতাকে দেখেনি!-

    একটা গাছ নদীর বুকে ঝুঁকে ছিল, তারই তলায় নৌকোখানাকে দেখা গেল।

    কৃষ্ণা বলল, ‘এস দেবু, নৌকোয় ওঠো, আমি দাঁড় বাইতে জানি, তোমায় ঠিক নিয়ে যাব। এখন তোমার কোনো কথা শুনব না, আগে গৌহাটিতে পৌঁছাই, এদের দলসুদ্ধু ধরিয়ে দিই, তারপর তোমার গল্প শুনব-আমার গল্প শুনাব।’

    দেবুকে টেনে নৌকোয় বসিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা নৌকো খুলে দিল, ক্ষুদ্র নৌকো স্রোতের মুখে ভেসে চলল।

    * * * * *

    দেবুকে সঙ্গে নিয়ে কৃষ্ণা যখন গৌহাটির একটা ঘাটে নামল, রাত তখন এগারোটা বেজে গিয়েছে, পথে লোকচলাচলও কম।

    পথের লোককে জিজ্ঞাসা করে কৃষ্ণা থানার খোঁজ পেল।

    আজ রাতটা কেটে গেলে কাল ভোরেই দস্যুদল জানতে পারবে কৃষ্ণা পালিয়েছে, একা যায়নি, সঙ্গে করে নিয়ে গেছে দেবুকে-সর্দারের আদেশে যার উপর সকলের তীক্ষ্ন দৃষ্টি ছিল-যেহেতু তার মূল্য একদিন দশ হাজার টাকা হলেও আজ মূল্য দাঁড়িয়েছে কুড়ি হাজার টাকা।

    আজ রাত্রেই আরাকানের সর্দারকে নিয়ে খাঁজাহান ফিরবে। কাল সকালে যখন কৃষ্ণার ঘরে হাত-পা বাঁধা সীতারামকে দেখতে পাবে, দেবুর শূন্য ঘর দেখবে, তখনই সে সেখানকার আড্ডা তুলবে, তাকে ধরা এবং হতভাগ্য আর কয়েকটি শিশুকে মুক্তি দেওয়া আর হবে না।

    ইনস্পেক্টর সুরঞ্জনবাবু আবশ্যকীয় কাজ সেরে কেবলমাত্র উঠেছিলেন, এমনই সময় কৃষ্ণা দেবুকে নিয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইল।

    এত রাত্রে একটি মেয়ে দেখা করতে চায়-নিশ্চয়ই বিপদগ্রস্তা হয়ে এসেছে। সুরঞ্জনবাবু তাকে তাঁর নিকট আসতে আদেশ দিলেন।

    কৃষ্ণা ও দেবু এসে দাঁড়াল।

    কৃষ্ণা একটা নমস্কার করে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনার নামই বোধ হয় সুরঞ্জনবাবু, এই থানার ইনস্পেক্টর?’

    সুরঞ্জনবাবু উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমিই সুরঞ্জন গুপ্ত। আমিও জানতে চাই আপনি আর এই ছেলেটি কি দরকারে এত রাত্রে আমার কাছে এসেছেন?’

    একটু দম নিয়ে কৃষ্ণা বলল, ‘বলছি। আমার নাম কৃষ্ণা চৌধুরী, আর এই ছেলেটি বসিরহাটের এস.ডি.ও. মিঃ মিত্রের ছেলে দেবীপ্রসাদ মিত্র। যাকে খুঁজে বার করবার জন্যে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, আর প্রত্যেক থানায় জানানো হয়েছে-আপনি নিশ্চয় তা জানেন।’

    ‘ও হো-আর বলতে হবে না মা লক্ষ্মী, আমি চিনেছি-চিনেছি! তাহলে আমি তোমায় ‘তুমি’ বলেই সম্বোধন করব। বস মা, এই চেয়ারখানায় বস; খোকা, তুমিও বস।’

    সুরঞ্জনবাবু অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।

    কৃষ্ণা বলল, ‘আমরা বসতে আসিনি, আপনাকে পুলিশ নিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই যেতে হবে-খাঁজাহানকে দলসুদ্ধ গ্রেপ্তার করতে হবে। আজ এখনই যদি না যান, আর কখনও তাকে ধরতে পারবেন না, তার দলের লোকদেরও নয়। কাল ভোরে যখন তারা দেখবে, আমি নেই, দেবু নেই-সঙ্গে সঙ্গে তারা ওখানকার আড্ডা তুলবে; যে ছেলেগুলিকে আজও তারা আটক করে রেখেছে, তাদেরও আর পাওয়া যাবে না।’

    ইনস্পেক্টর মহা ব্যস্ত হয়ে উঠলেন, ‘খাঁজাহান! কোথায় সে? কোথায় গেলে তাকে দলসুদ্ধ ধরতে পারা যাবে বল তো?’

    কৃষ্ণা বলল, ‘আমি পথ চিনে এসেছি, আপনাকে ঠিক নিয়ে যেতে পারব। দেবু এখানে থাকবে-ওকে নিয়ে যাব না, কি বলুন?’

    সুরঞ্জনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কিসে যেতে হবে? এখান হতে সে জায়গা কতদূর?’

    কৃষ্ণা বলিল, ‘দশ-বারো মাইল হবে মনে হয়। জায়গাটার নাম কি আমি জানিনে। ভয়ানক বন-আর তিন দিকে পাহাড়-একদিকে ব্রহ্মপুত্র নদ। আমি ওদেরই নৌকোয় করে দেবুকে নিয়ে পালিয়ে এসেছি। স্থলপথ আছে কি না জানিনে, জলপথ দিয়ে আমি আপনাদের ঠিক জায়গায় নিয়ে যেতে পারব।’

    আশ্চর্য হয়ে গিয়ে সুরঞ্জনবাবু বললেন, ‘নিজে নৌকো বেয়ে দশ মাইল আসতে পারলে মা?’

    কৃষ্ণা অধীর হয়ে বলল, ‘আমি নৌকো বাইতে জানি। তা ছাড়া স্রোতের মুখে ভেসে আসতে বিশেষ কষ্টও তো হয়নি। আপনি আর দেরি করবেন না, ওরা এই রাতটুকু মাত্র ওখানে আছে। ঘড়ি দেখুন, বারোটা বেজে গেছে।’

    সুরঞ্জনবাবু ব্যস্তভাবে উঠলে, বললেন, ‘তোমরা একটু বস, আমি লোকজন ঠিক করে নিই। মোটর-লঞ্চ যাব, বেশিক্ষণ দেরি হবে না পৌঁছাতে।’

    তিনি বেরিয়ে গেলেন।

    দেবু ভীত কণ্ঠে বলল, ‘আমি তোমায় ছাড়ব না কৃষ্ণাদি! তোমার সঙ্গে আমিও যাব।’

    কৃষ্ণা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে স্নেহপূর্ণ কণ্ঠে বলল, ‘বোকা ছেলে। বুঝতে পারছ না, ওখানে গিয়ে তোমায় নিয়ে আমি আরও বিব্রত হয়ে পড়ব। তুমি এখানে কিছু খেয়ে দিব্যি আরামে ঘুমোবে। সকাল হতে হতে ওদের দলকে দল গ্রেপ্তার করে নিয়ে আমি ফিরে আসব দেখ।’

    দেবুকে দুধ খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে কৃষ্ণা সুরঞ্জনবাবুর সঙ্গে বার হল।

    কয়েকখানা লঞ্চ জোগাড় হয়েছে, প্রত্যেকটিতে সশস্ত্র পুলিশ রয়েছে। পুলিশ-সাহেব নিজেও চলেছেন; বিখ্যাত দস্যু খাঁজাহান যেন কোনোক্রমে না পালাতে পারে সে জন্যে সকলকেই সন্ত্রস্ত ও সাবধান দেখা গেল। কতকগুলি জোরালো আলো নেওয়া হয়েছে, বনের মধ্যে কেউ যদি লুকোয়, আলোর সাহায্যে ধরা যাবে।

    লঞ্চ চলতে লাগল-

    সুরঞ্জনবাবু বললেন, ‘জায়গাটা আমি বুঝেছি, সেদিকে একবার আমরা শিকার করতে গিয়েছিলুম। কোন যুগের কয়েকটা ভাঙা মন্দির সেখানে আজও আছে, দু-চারজন ঐতিহাসিক সে সব সন্ধান নিয়ে গেছেন জানি। কিন্তু সে তো গৌহাটি হতে বড় কম দূর নয়, জলপথে অতখানি নৌকো বেয়ে আসাও কম শক্তির কাজ নয়! যাই হোক, এতদিন তোমার নাম শুনেছি, তোমার গল্পই শুনেছি, আজ চোখে দেখে বুঝছি, তোমার মতো মেয়ের দ্বারা সবই সম্ভব! আমি প্রার্থনা করি, ঘরে ঘরে তোমার মতো অসীম শক্তিশালিনী মেয়ে জন্মাক; দেশের কলঙ্ক, জাতির কলঙ্ক মুছে যাক।’

    কৃষ্ণা নিস্তব্ধে তাঁর পার্শ্বে বসেছিল, সুরঞ্জনবাবু পুলিশ সাহেব মিঃ ব্রাউনকে কৃষ্ণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন। জিজ্ঞাসিত হয়ে কৃষ্ণার নিজের কাহিনি বলল।

    মিঃ ব্রাউন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কতদিন এদের কাছে রয়েছ মিস চৌধুরি?’

    কৃষ্ণা একটু ভেবে বলল, ‘আজ কত তারিখ তা আমার জানা নেই। মামার সঙ্গে যেদিন আমি বাগবাজারের খালধারে যাই, সেদিন ছিল বোধহয় পাঁচই অক্টোবর। আজ কত তারিখ হল বলুন তো?’

    সুরঞ্জনবাবু বললেন, ‘তা প্রায় একমাস হল আর কি! আজ নভেম্বরের তিন তারিখ হল।’

    কৃষ্ণা একটা নিঃশ্বাস ফেলল, ‘উঃ আমাদের কলেজ কবে খুলে গেছে! আমার এতদিন শুধু শুধু নষ্ট হল।’

    সে নিস্তব্ধে বাইরের অথই জলের পানে তাকিয়ে রইল।

    * * * * *

    মন্দিরের সংলগ্ন একটা টানা লম্বা ঘর, জন পনেরো লোক বসে ছিল, মাথার ওপর একটা পেট্রোম্যাক্স হুকে জ্বলছিল।

    কৃষ্ণা ফিসফিস করে বলল, ‘এই ঘরে প্রায় সবাই আছে। খাঁজাহান ওই মাঝখানে বসে। দেখুন, খুব বিশ্রী দেখতে-একটা চোখ নেই, কপালে একটা আব। ওরা এখানে ছিল না, রাত্রে ফিরবে শুনেছিলাম। ওর পাসে ওই আরাকানি সর্দার বসে, ওরই কাছে আমায় বিক্রি করার কথা হচ্ছে শুনুন।’

    জানালার ফাঁক দিয়ে ঘরের সব দেখা যাচ্ছিল, কথাও শোনা যাচ্ছিল। বেশ বোঝা গেল, দর-দস্তুর হচ্ছে। খাঁজাহান মোটা দর দিয়াছে, সর্দার দু-এক হাজারের জন্য দর কষাকষি করছে।

    অবশেষে একটা মাঝামাঝি রফা হয়ে গেল। সর্দারের সঙ্গে কয়েকজন সঙ্গী ছিল, সর্দারের আদেশ পেয়ে তাদের মধ্যে একজন এক বান্ডিল নোট খাঁজাহানের সামনে রাখল।

    নোটগুলো তুলে নিয়ে গুনতে গুনতে খাঁজাহান বলল, ‘রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তোমরা এখনই মেয়েটাকে নিয়ে রওনা হতে পার। তবে ওকে খুব সাবধানে রাখবে, একদিন সে বার্মা-মুল্লুকে ছিল-ওসব দেশ তার বেশ জানা-শোনা আছে।’

    ‘বার্মা-মুল্লুকে ছিল?’

    আরাকানি সর্দার বিস্ফারিত চোখে বলল, ‘কোথায় ছিল?’

    খাঁজাহান বলল, ‘রেঙ্গুনে। ওর বাবা মিঃ চৌধুরি সে অঞ্চলে খুব নামকরা লোক ছিলেন, ডিটেকটিভের কাজ সে তার বাপের কাছে শিখেছে। ওকে খুব সাবধানে না রাখলে এমনভাবে পালাবে সর্দার, আর ধরতেও পারবে না। তোমায় আরও অনেক মেয়ে বিক্রি করেছি তো! সে সব মেয়ে হতে এ মেয়ে একেবারে আলাদা, এ কথা সর্বদা মনে রেখ।’

    নোট গুনে খাঁজাহান নিজের বিশ্বস্ত অনুচরের হাতে দিয়ে উঠল, বলল, ‘এতক্ষণ নিশ্চয়ই মেয়েটা ঘুমাচ্ছে, ঘুমন্ত অবস্থায় ক্লোরোফর্ম দিয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে। রাত থাকতে থাকতে এ এলাকা ছেড়ে যেও সর্দার, একবার তোমার এলাকার মধ্যে গিয়ে পড়লে-‘

    হঠাৎ সে স্তব্ধ হয়ে গেল।

    জীর্ণ দরজার বাইরে থেকে কে সজোরে আঘাত করল, সে আঘাতে মুহূর্তমধ্যে ঝনঝন করে দরজা ভেঙে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে প্রবেশ করলেন, মিঃ ব্রাউন, পার্শ্বে সুরঞ্জনবাবু ও কৃষ্ণা, পশ্চাতে অগণ্য সশস্ত্র পুলিশ! সকলেরই হাতে উদ্যত রিভলভার!

    ‘এ কি!’

    খাঁজাহান চেঁচিয়ে উঠল।

    পাশেই একটা চৌকির উপর তাদের রিভলভার, ছোরা প্রভৃতি ছিল; সেদিকে অগ্রসর হতেই মিঃ ব্রাউন বললেন, ‘সব মাথার ওপর হাত তোল, যে না তুলবে তাকে গুলি করে মারা হবে।’

    প্রাণের মমতা মানুষের অত্যন্ত বেশি। তাই সকলেই এমন কি দুর্দান্ত দস্যু খাঁজাহান পর্যন্ত ওপর দিকে হাত তুলল।

    পুলিশ হাতকড়া নিয়ে অগ্রসর হতেই হঠাৎ আলোটা দপ করে নিভে গেল, অন্ধকার ঘরে, ছুটাছুটি, মারামারি, দাপাদাপি আরম্ভ হয়ে গেল, এরই মধ্যে কয়েকটা রিভলভারের গুলিও ছুটল।

    বাইরে যারা অন্য ঘরের মাতাল লোক কয়টিকে আলোর সাহায্যে গ্রেপ্তার করেছিল, তারা আলো নিয়ে ছুটে এল।

    দস্যুদল অস্ত্র পায়নি। অন্ধকারে অস্ত্র আহরণ করতে গিয়ে সুরঞ্জনবাবু, মিঃ ব্রাউন ও কৃষ্ণার গুলিতে কয়েকজন সাংঘাতিকরূপে আহত হয়েছে।

    হাতাহাতি যুদ্ধেও দস্যুদল জয়লাভ করতে পারল না; দশ-বারো মিনিটের মধ্যে সকলেরই হাতকড়া পরতে হল, পায়ে বেড়ি পরতে হল। কোমরে দড়ি বেঁধে প্রত্যেক কনস্টেবল প্রত্যেকটি কয়েদির ভার নিল।

    খাঁজাহান বিস্মিত নেত্রে কৃষ্ণার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে কৃষ্ণা একটু হাসল, বলল, ‘খাঁ সাহেব, আমি দেবুকে নিয়ে সন্ধ্যাবেলাতে পালিয়েছি। তোমার সীতারামকে অজ্ঞান করে হাত-পা বেঁধে আমার বন্দীশালায় ফেলে রেখেছি, আমায় আনতে গেলে তাকেই দেখতে পেতে। তার চাবি দিয়ে দেবুর বন্দিশালার দরজা খুলে তাকে নিয়ে তোমাদেরই নৌকোয় গৌহাটি পর্যন্ত পৌঁছালুম। দেবুকে থানায় রেখে ইনস্পেক্টর সুরঞ্জনবাবু, পুলিশ-সাহেব আর এই সব কনস্টেবলদের পথ দেখিয়ে এনেছি।’

    খাঁজাহানের একটা চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল, সে হাতকড়া বাঁধা হাত দুখানা আন্দোলন করে দাঁতের উপর দাঁত রেখে কেবল বলল, ‘শয়তানি।’

    কৃষ্ণা বলল, ‘শয়তানি ছাড়া শয়তানের কাজ পণ্ড করতে কেউ পারে না খাঁ সাহেব! আমাকে খুব চড়াদামে এই মগ-সর্দারের কাছে বিক্রি করেছ; এই শয়তান সর্দার আবার আমার আগে আরও অনেক মেয়েকে কোথায় কোথায় বিক্রি করেছে কে জানে! নিজের কথাতেই ধরা পড়ে গেছ খাঁ সাহেব, এবার আর জাহাজ থেকে পালাতে হবে না জেন।’

    খাঁজাহান গর্জে উঠল, ‘আগে তোকে খুন করলেই ভালো হত।’

    সুরঞ্জনবাবু হেসে বললেন, ‘তা যখন করনি, এখন আর পস্তানো মিথ্যে। তবে এটা সত্যি কথা, এবার তোমায় কি রকম পাহারায় কোথায় পাঠানো হবে সে সম্বন্ধে সরকার বাহাদুর বিশেষ সচেতন থাকবেন। বাইরে বেশ ফরসা হয়ে এসেছে, এখন তা হলে শিকল বাজিয়ে এস।’

    কৃষ্ণা নিজেই চাবি খুলে বন্দীশালা হতে আটটি ছেলেকে বাইরে আনল।

    জীর্ণশীর্ণ তাদের চেহারা। নভেম্বরের এই শীতে তাদের একখানি করে কম্বল সম্বল।

    এই হতভাগ্য ছেলেগুলি বিশ্বাস করতে পারছিল না, সত্যই তারা মুক্তি পেয়েছে! যখন তারা সত্য বলে জানল, তখন আনন্দে কেউ কাঁদল, কেউ নাচল, কেউ হাসল।

    এই আনন্দময় দৃশ্যে সকলের চোখেই জল এসে পড়েছিল।

    বেচারা সীতারামকে যখন টেনে বের করা হল, সে শুধু হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। তারও হাতে হাতকড়ি ও কোমরে দড়ি, পায়ে বেড়ি পড়ল।

    দলবদ্ধভাবে এতগুলো কয়েদি ঝম-ঝম করে শিকল বাজিয়ে অগ্রসর হল। পিছনে চলতে চলতে মিঃ ব্রাউনকে লক্ষ করে কৃষ্ণা বলল, ‘আরও অনেকগুলি ছেলেকে পরশু আর কাল চালান করা হয়েছে। কোথায় দিয়েছে তা জানে একমাত্র খাঁজাহান। চেষ্টা করলে এখনও তারা মুক্তি পেতে পারে মিঃ ব্রাউন, তাদের পাওয়া যেতে পারে।’

    এই মেয়েটির শক্তি, সাহস ও মার্জিত কথাবার্তায় মিঃ ব্রাউন মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন; বললেন, ‘আমি নিশ্চয়ই চেষ্টা করব মিস চৌধুরি! আশা করছি তুমি দু-চার দিন গৌহাটিতে থেকে দেখে যেতে পারবে।’

    কৃষ্ণা মাথা নাড়ল, বলল, ‘আমি আজই দেবুকে নিয়ে কলকাতায় ফিরব মিঃ ব্রাউন! ওর মায়ের কাছে আমি কথা দিয়েছি-তাঁর ছেলেকে তাঁর কোলে ফিরিয়ে দেব। আমি আর একদিনও কোথাও থাকতে পারব না। এরপরে যখন বিচার হবে, তখন আসব, এখন আমায় ক্ষমা করবেন।’

    মিঃ ব্রাউন উজ্জ্বল চোখে কৃষ্ণার পানে চাইলেন।

    * * * * *

    এ যেন স্বপ্ন!

    দেবুকে নিয়ে কৃষ্ণা ফিরেছে!

    মিসেস মিত্র দেবুকে বুকের মধ্যে নিয়ে নিঃশব্দে হু-হু করে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। মিঃ মিত্র আনন্দে ছুটবেন কি নাচবেন ঠিক করতে না পেরে কেবল কৃষ্ণার হাত দুখানা চেপে ধরলেন। দেবু মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে ফুলে ফুলে কাঁদতে লাগল।

    এই ধাক্কা সামলাতে খানিকক্ষণ কেটে গেল।

    মিসেস মিত্র দেবুকে ছেড়ে কৃষ্ণাকে কোলে টেনে নিলেন, তার মাথায় হাত রেখে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘তোমায় কি বলে আশীর্বাদ করব মা, তা আমি নিজেই ঠিক করতে পারছি নে। তোমার কথা তুমি রেখেছ, তুমি জীবন্ত দেবুকে আমার কোলে ফিরিয়ে এনে দিয়েছ। আমার-‘

    কৃষ্ণা তাঁর পায়ের ধুলো নিয়ে মাথায় দিল, বলল, ‘আশীর্বাদ করুন, আমার যেন এই রকমই শক্তি ও সাহস থাকে, যেন প্রত্যেকের উপকারে লাগতে পারি, নিজের জন্ম যেন এমনি করে পরের কাজে সার্থক করতে পারি, আর বাঙালি মেয়ের ভীরুতার অপবাদ ঘুচাতে পারি।’

    মিঃ মিত্র এতক্ষণে একটা সিগার ধরাবার অবকাশ পেলেন; একটা কাজ তাঁর মনে পড়ে গেল। তিনি উঠে ড্রয়ারটা খুলে একটা ছোট সুটকেস বের করে কৃষ্ণার সামনে রেখে বললেন, ‘এতে দেবুর মুক্তিপণ সেই দশ হাজার টাকার নোট আছে। তোমার মামা হসপিটাল হতে ফিরে আমায় দিয়ে গেছেন। আমি এ টাকা রেখে দিয়েছি, যে দেবুকে এনে দেবে তাকে দেব প্রতিজ্ঞা করেছি। এ টাকা তোমাকেই নিতে হবে কৃষ্ণা!’

    সঙ্কুচিতা কৃষ্ণা বলল, ‘আপনি ওকথা বলবেন না মেসোমশাই! আমার ভাই নেই, দেবুকে আমি নিজের ভাই বলেছি, তাকে উদ্ধার করতে পেরেছি, সেজন্যে আপনার কাছ হতে টাকা নেব-ছিঃ!’

    মিসেস মিত্র সমস্যার সমাধান করে দিলেন, বললেন, ‘টাকা থাক, ওতে কয়েকখানা ডায়মন্ড কিনে আমি একটা হার গড়িয়ে কৃষ্ণার গলায় পরিয়ে দেব।’

    তাই ঠিক হল।

    কৃষ্ণা সেদিন বাড়ি আসতে পারল না। মিঃ মিত্র প্রণবেশকে পত্র লিখে পাঠালেন ‘বিশেষ দরকার, এখনই আসা চাই।’

    চাপরাশির সঙ্গে প্রণবেশ এসে পৌঁছলেন; তারপর বিশেষ ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করলেন; ‘কি দরকার মিঃ মিত্র? ওদের কোনো খবর পেয়েছেন কি?’

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘বসুন তো, আপনাকে একটা মজার ব্যাপার দেখাব।’

    পাশের দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল, সেখানে দেবুর হাত ধরে কৃষ্ণা সহাস্যমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

    ‘কৃষ্ণা!-দেবু!’

    প্রণবেশ চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলেন।

    কৃষ্ণা ও দেবু প্রণবেশকে প্রণাম করল। প্রণবেশ দু’হাতে দুজনের হাত ধরে সজলনেত্রে তাকিয়ে রইলেন।

    মিঃ মিত্র বললেন, ‘কৃষ্ণা যা করে দেবুকে এনেছে, সে এক অলৌকিক গল্প প্রণবেশবাবু! আমরা কতকটা শুনেছি, আপনিও খাওয়ার টেবিলে বসে শুনবেন।’

    রুদ্ধশ্বাসে প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ডাকাতের দল আছে না গেছে?’

    কৃষ্ণা বলল, ‘দলকে দল ধরা পড়েছে, গৌহাটির জেলে আছে। বিচারের সময় দেবু আর আমি সাক্ষ্য দিতে আবার যাব। দেবু তখন কামাখ্যা পাহাড়, উমানন্দ, ভুবনেশ্বরীও দেখবে কিনা!’

    প্রণবেশ বলে উঠলেন, ‘আমিও তোদের সঙ্গে যাব।’

    মিসেস মিত্র হাসিমুখে বললেন, ‘যদিও দরকার নেই এ মেয়ের বডিগার্ডের, তবু আমরা দুজনেও সঙ্গে যাব প্রণবেশবাবু! একটা দল বেঁধে বেশ হৈ-হৈ করতে করতে যাওয়া যাবে, কি বলুন?’

    প্রণবেশ মহাখুশি হয়ে হাসতে লাগলেন।

    বলা বাহুল্য-সংবাদ পেয়েই ব্যোমকেশও ছুটে এলেন। কৃষ্ণা ও দেবুর মুখে তিনি সব গল্পই শুনলেন; কিন্তু খুশি যে হননি, তা তাঁর অন্ধকার মুখ দেখেই বোঝা যায়।

    তিনি গম্ভীর ভাবে কেবল বললেন, ‘হুঁ, মেয়েদের অত সাহস ভালো নয়।’

    কৃষ্ণা তাঁকে প্রণাম করে বলল, ‘আশীর্বাদ করুন, বাংলার সকল মেয়ের বুকেই যেন এই রকম শক্তি ও সাহস জাগে, বাংলা যেন আবার বীর জননীতে ভরে ওঠে!’

    __

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.