Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী এক পাতা গল্প865 Mins Read0

    ০৪. কলঙ্কী চাঁদ

    কলঙ্কী চাঁদ

    এক

    পাড়ায় রীতিমতো চাঞ্চল্য জেগে উঠেছে, সবাই জানে মিঃ সেন আজই এসে পৌঁছাবেন। আজ কয়দিন হতে সকলের মুখে এ সংবাদ বিঘোষিত হচ্ছে।

    মিঃ সেন আসছেন করাচি হতে। এ পাড়ার মহামান্য অতিথি শুধু তাঁকে বলা চলে না, তিনি এই দেশেরই ছেলে। বাল্য হতে যৌবনকাল তিনি এখানেই অতিবাহিত করেছেন। করাচিতে তিনি ব্যবসায়ে যথেষ্ট উন্নতি করেছেন। তাঁর কার্যক্ষেত্র শুধু করাচিতেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিস্তৃত হয়েছে। প্রায় কুড়ি-পঁচিশ বৎসর পরে তিনি ফিরছেন বাংলায়-তাঁর নিজের দেশে, নিজের পাড়ায়, পৈতৃক ভিটাতে।

    শোনা যাচ্ছে তিনি এবার এখানে এসে থাকবেন; মেয়ের বিবাহ দিতে হবে- এখান হতে সে বিবাহের সম্বন্ধ দেখা চলবে। সুদূর করাচিতে মনের মতো পাত্র পাওয়া যায়নি, এই জন্যই বিশেষ করে তাঁর এখানে আসা।

    মস্ত বড় বাড়িটায় আজ বড় সমারোহ পড়ে গেছে। কত লোকজন আসা-যাওয়া করছে। বাড়িটা দেবদারু-পাতা ও ফুলের মালায় সাজানো হয়েছে। গেটের দুইদিকে মঙ্গল-কলস সাজানো হয়েছে, অর্থাৎ অনুষ্ঠানের আর কোনো ত্রুটিই নেই।

    আর-সকল মেয়ের মতো কৃষ্ণাও তার ঘরের জানলায় দাঁড়িয়ে এই সমারোহ দেখছিল। পাশাপাশি বাড়ি-জানলার সামানা-সামনি ঘরটা মিঃ সেনের হলঘর, ও-বাড়ির জানলায় দাঁড়ালে এ-বাড়ির হলঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়। পাশের আর দু-একখানা ঘরও চোখে পড়ে।

    কৃষ্ণার জানলায় বরাবর পর্দা দেওয়া থাকে, আজ কৌতূহলবশে সে-পর্দা সে সরিয়ে ফেলেছে। হলঘরের জানলাটা দিয়ে সুসজ্জিত ঘরের ভিতরটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

    ও-বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আজ বড় কম আসেনি, বন্ধু-বান্ধবও নিমন্ত্রিত হয়েছে। জানলা দিয়ে কৃষ্ণা দেখতে পায় গৃহস্বামী মিঃ সেনকে-বৈকালে তিনি এসেছেন। কৃষ্ণা কলেজে ছিল, আজ পাঁচটা পর্যন্ত ক্লাস থাকায় তার ফিরতে দেরি হয়ে গেছে।

    কয়দিনই সংবাদপত্রে মিঃ সেনের আগমন-বার্তা পড়তে পড়তে বিরক্তি জেগে গিয়েছিল। মামা প্রণবেশ বলেছিলেন, ”আমাদের দেশের কাগজগুলোর কথাই আলাদা! দেখছ তো, সবগুলো কাগজ মিঃ সেনের প্রশংসায় একেবারে মুখর হয়ে উঠেছে, তবু তো সে লোকটাকে এখনও চোখে দেখেনি-তার কাজের কোনো পরিচয় পায়নি!”

    কৃষ্ণা বলেছিল, ”চোখে না দেখলেও কাজের পরিচয় পাওয়া যায় বইকি মামা! এই দেখ না, তার প্রমাণ হিটলার, মুসোলিনি, চার্চিল এবং আরও কত জগদ্বরেণ্য লোক-যাঁরা একসময় ছিলেন অথবা এখনও আছেন। আমরা তাঁদের চোখে দেখিনি, অথচ তাঁদের কাজের পরিচয় অন্তর দিয়ে পেয়েছি। তেমনি মিঃ সেনকে চোখে না দেখলেও তাঁর কাজের পরিচয় এরা পেয়েছে। সেই জন্যেই তাঁর প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।”

    প্রণবেশ কেবল মুখ বিকৃত করলেন, অর্থাৎ তিনি মিঃ সেনকে মোটেই মেনে নিতে পারছেন না।

    কৃষ্ণা মামার এই তাচ্ছিল্য ভাব দেখে খুশি হল না। মামার সঙ্গে আর কোনো কথা না বলে সে চেয়ারখানা জানলার কাছে টেনে এনে বসল। এ-ঘরের আলো সে নিবিয়ে দিলে-যাতে ও-বাড়ির কেউ তাকে দেখতে না পায়।

    প্রতিদিন এ-ঘরের জানলা বন্ধ থাকে, কৃষ্ণা কোনোদিন এ-ঘরের ভিতরটা দেখতে পায়নি। আজ বিস্মিতচোখে সে এই আধুনিক ধরনে সুসজ্জিত ঘরখানার মধ্যে তাকিয়ে মনে মনে গৃহস্বামীর সৌন্দর্য-রুচির তারিফ না করে পারলে না।

    অতিথি-অভ্যাগত যাঁরা এসেছেন, তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন দেখে স্পষ্টই জানা যায়, এঁরা সবাই উচ্চপদস্থ ধনী। দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত যারা, তারা মিঃ সেনের গেটের তকমা-আঁটা দারোয়ানের হাত এড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে পারেনি।

    হলঘরে যখন চলছিল আলাপ-আলোচনা, ও-দিককার ঘরে সেই সময় যে লোকটি প্রবেশ করলে, তার পানে তাকিয়ে হঠাৎ কৃষ্ণা চমকে উঠল।

    এই দীর্ঘাকৃতি সুপুরুষ যুবকটিকে সে যেন আরও কোথায় দেখেছে। অনেকদিন আগে দেখা, কৃষ্ণা ঠিক মনে করতে পারছে না, মনে করবার চেষ্টা করতে লাগল।

    কৃষ্ণা যুবকটির পানে তাকিয়ে রইল।

    দেখা গেল, সে যে-দরজা দিয়ে প্রবেশ করলে, সেই দরজাটি বন্ধ করে দিলে। তারপর সরে গেল অন্যদিকে। তাকে আর দেখা না গেলেও তার ছায়াটা দেয়ালের গায়ে দেখা যাচ্ছিল।

    ছায়া খানিকটা নড়ে বেড়াল, তারপর স্থির হয়ে এক জায়গায় দাঁড়াল, নিচু হয়ে কি যেন খুলবার চেষ্টা করতে লাগল।

    মিনিট আট-দশ পরে আবার ঘরের দরজা খুলে লোকটি বার হয়ে গেল।

    হলঘরে সে আসবে প্রত্যাশায় কৃষ্ণা হলঘরের দিকে চাইলে, কিন্তু লোকটি হলঘরে আর ফিরে এল না।

    সম্ভবত সে এই বাড়িরই লোক, মিঃ সেনের খুব নিজের জন। ও-ঘরটা বোধহয় তার জন্যই নির্দিষ্ট হয়েছে; গোলমাল মিটে গেলে, অতিথি-অভ্যাগতেরা বিদায় নিলে, সে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়বে।

    প্রণবেশ পাশের ঘর হতে হাঁক দেন, ”কই তোমার দেখা হল কৃষ্ণা? খাবার দেওয়া হয়েছে, রাত যে অনেক হয়ে গেল!”

    কৃষ্ণা উঠল।

    পেটুক প্রণবেশ অস্থির হয়ে পড়েছেন; সামনে খাবার, কিন্তু কৃষ্ণা না এলে তিনি খেতেও পারেন না।

    নিঃশব্দে কৃষ্ণা এসে খেতে বসল।

    খেতে খেতে হঠাৎ প্রণবেশের হুঁশ হল, কৃষ্ণা নিবিষ্ট ভাবে কি ভাবছে! তিনি বললেন, ”কি হল কৃষ্ণা? হঠাৎ এত ভাবনার কারণটা বুঝতে পারছি না তো?”

    কৃষ্ণা চিন্তিতমুখে বললে, ”লোকটাকে ঠিক চিনতে পারলুম না মামা, তাই ভাবছি।”

    প্রণবেশ বিস্মিত হয়ে বললেন,-”লোকটা-মানে? কোন লোকটাকে তুমি আবার দেখতে পেলে কৃষ্ণা, যাকে দেখে এত ভাবনায় পড়ে গেছ?”

    কৃষ্ণা রাগ করে বললে, ”ভাবতে দাও মামা। ও লোকটা যেই হোক, আমি মন খুঁজে ঠিক ওকে বার করবই। মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি, খুব ভালোভাবেই চিনি। অনেক দিন পরে বলে ঠিক মনে করতে পারছি নে। যাক, তুমি গোলমাল করে দিও না বাপু-আমি ঠিক বার করবই।”

    প্রণবেশ চুপ করে গেলেন।

    ভাগনী হলেও কৃষ্ণাকে তিনি বেশ একটু সমীহ করে চলেন। তাঁর নিজের বুদ্ধির চেয়ে কৃষ্ণার বুদ্ধি-জ্ঞান যে অনেক বেশি, তা তিনি স্বীকার করেন। তাঁর নিজের সাহস নাই, ভাগনী কৃষ্ণার সাহসে তিনি দীপ্যমান।

    চুপচাপ তিনি খেয়ে নিলেন।

    দুই

    সকালে কৃষ্ণার ঘুম ভেঙে গেল।

    প্রণবেশ তার রুদ্ধ দ্বারে তখনও আঘাত করে ডাকছেন, তাঁর কণ্ঠস্বর উত্তেজনায় পূর্ণ।

    ”ওঠো, ওঠো কৃষ্ণা, ভয়ানক ব্যাপার! উঃ, কি ঘুমই তুমি ঘুমোতে পার যে কৃষ্ণা! বাড়ির পাশে এত-বড় ব্যাপার, এত চিৎকার-তবু তোমার ঘুম ভাঙে না!”

    কৃষ্ণা তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলে দিলে।

    হাঁপাতে-হাঁপাতে প্রণবেশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে একখানা চেয়ারে বসে পড়লেন।

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”ব্যাপারটা কি মামা? তুমি যেন রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছ! তোমায় দেখে মনে হচ্ছে, জাপান একেবারে এসে পড়েছে, গড়ের মাঠে তাদের প্লেন নেমেছে, আর ওরা দলে দলে মার্চ করে আসছে! কি হয়েছে বল দেখি!”

    প্রণবেশ রীতিমতো রেগেছিলেন, তিনি মুখখানা গুম করে রইলেন, উত্তর দিলেন না।

    কৃষ্ণা বললে, ”রাগ করো না মামা! বল দেখি কি হয়েছে পাশের বাড়িতে?”

    প্রণবেশ বললেন, ”কাল রাত্রে পাশের বাড়িতে সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওই যে আমাদের মিঃ সেন-তাঁর একটি মাত্র মেয়ে; সেই মেয়েটি আর আয়রন-চেস্টের ভিতরকার জিনিসপত্র সব অন্তর্ধান!”

    কৃষ্ণা কৌতূহল দমন করতে পারে না, ”কি কথা বলচো মামা? কিছুই বুঝতে পারলুম না!”

    প্রণবেশ বললেন, ”কাল সেই ভিড়ের মধ্যে তাঁর মেয়ে রত্না কোথায় হারিয়ে গেছে! তার মানে, মিঃ সেনের মেয়ে-যার বিয়ে দেওয়ার জন্যে করাচি হতে তিনি এখানে এসেছেন! আর আয়রন-চেস্টের মধ্যে ছিল মূল্যবান দলিলপত্র, আর ছিল একছড়া দামি মুক্তোর মালা-এইগুলো নাকি গেছে! আশ্চর্য এই যে, আরও কত দামি হীরে, মানিক, মুক্তো, টাকাকড়ি রয়েছে, চোর তার কিছুই নেয়নি!”

    কৃষ্ণা ব্যগ্রকণ্ঠে বললে, ”তুমি এসব খবর সংগ্রহ করলে কোথা হতে মামা?”

    প্রণবেশ বললেন, ”ব্যোমকেশবাবু এনকোয়ারিতে এসেছিলেন যে! তিনি সামান্য এই খবরটা দিলেন। আমায় বলে দিলেন, এনকোয়ারি শেষে তিনি এখানে এসে তোমায় দেখে যাবেন। বহুদিন তোমার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি-সেই কথাই বলছিলেন।”

    কৃষ্ণা বললে, ”একটু বসো মামা, আমি চট করে মুখ-হাত ধুয়ে আসি।”

    বাথরুমে প্রবেশ করে চোখে-মুখে জল দিতে দিতে কৃষ্ণা ভাবছিল সেই লোকটার কথা-যাকে সে পাশের কামরায় দরজা বন্ধ করতে দেখেছিল।

    তার মন যেন বলছিল-এ সেই লোকটার কাজ, সে ছাড়া আর কেউ এ কাজ করেনি! কিন্তু কে সে লোকটা? মুখ-হাত ধুয়ে সে তার ‘চিত্র-সংগ্রহ’খানা একবার দেখবে! এই চিত্র-সংগ্রহে সে অনেকের ফটো জোগাড় করে রেখেছে। প্রণবেশ তার এই সংগ্রহকে হেসে ওড়াতে চেয়েছেন, ছেলেমানুষের খেয়াল বলে উড়িয়ে দিয়েছেন! কৃষ্ণার দৃঢ় বিশ্বাস, তার এই চিত্র-সংগ্রহ তাকে অনেক সাহায্য করবে-হয়তো গতকাল রাত্রের দেখা লোকটির চেহারা ও পরিচয় এতে মিলবে।

    তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে এ-ঘরে এসে কৃষ্ণা দেখলে তার চা ও টোস্ট এসে গেছে। সে আলমারি খুলতে যাচ্ছে দেখে প্রণবেশ বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ”মুখের গরম চা-টা জুড়িয়ে যাচ্ছে, আগে খেয়ে নাও, তারপর যা হয় কর।”

    কৃষ্ণা একটু হেসে নিয়ে চা খেতে বসল; বললে, ”সেই লোকটাকে একবার দেখতে হবে মামা! তার ছবি আর পরিচয় আমার চিত্র-সংগ্রহে রয়েছে।”

    প্রণবেশ মুখ বিকৃত করে বললেন, ”হ্যাঁ, তোমার চিত্র-সংগ্রহে গরু-হারালেও পাওয়া যাবে, তার হারানোর ছবিও আছে।”

    কৃষ্ণা শূন্য চায়ের কাপ নামিয়ে আলমারি খুলে মোটা চিত্র-সংগ্রহখানা বার করে এনে টেবিলের উপর রাখলে, তারপর এক-এক করে পাতা ওল্টাতে লাগল।

    দেশ-বিদেশের অপরাধীর ফটো-পরপৃষ্ঠায় তাদের পরিচয়। কে কি করেছে-কে কতবার কোথায় কতদিনের জন্য জেল খেটেছে-এ-সব কাটিং কৃষ্ণা সযত্নে রেখে দিয়েছে।

    পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে হঠাৎ সে থেমে গেল। সানন্দে চেঁচিয়ে উঠল, ”পেয়েছি-পেয়েছি মামা, সে লোককে পেয়েছি, এই দেখ।”

    প্রণবেশ ছবিটার দিকে ঝুঁকে পড়লেন, সবিস্ময়ে বললেন, ”আহা, এই লোকটাকে যে কাল আমি ওদের সঙ্গে আসতে দেখেছি!”

    কৃষ্ণা বললে, ”আর আমি একে ওদের ওই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে দেখেছি। চেনা মুখ-একে আমি বেশ চিনি মামা। রোস, এর পরিচয়টা আগে বার করি।”

    পাতা ওল্টাতেই চোখে নামটা পড়ল, সমর সিং-পাঞ্জাব।

    তারপর তার পরিচয়। দ্বীপান্তরের কয়েদি সে, মাত্র দেড় বৎসর আন্দামানে সে বাস করেছিল, তারপর সে পলায়ন করে। তার পলায়ন-ব্যাপারটা বড় আশ্চর্য! কেউ বলে সে জেলে নৌকা করে পালিয়েছে, কেউ বলে সাঁতার দিয়ে সে পালিয়েছে, কেউ কেউ আবার এরোপ্লেনের নামও করে। যেদিন সমর সিং নিরুদ্দেশ হয়, সেইদিনই সকালের দিকে ব্রিটিশের একখানা এরোপ্লেন এখানে এসেছিল। সামনে ব্রিটিশের চিহ্ন নিয়ে প্লেনখানা নেমে এসেছিল, আর সকলের মতো সেও তা দেখেছিল নিশ্চয়।

    কেউ কেউ বলে, এই প্লেনে সে পালিয়েছে। ব্রিচিশের চিহ্ন আঁকা থাকলেও প্লেন ব্রিটিশের নয়। নিশ্চয়ই জার্মানির; আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশের চিহ্ন এঁকেছিল।

    বলা বাহুল্য-এই ঘটনার অনেক আগে দ্বিতীয় মহাসমর শুরু হয়েছে-জার্মানি বিপুল বিক্রমে দেশের পর দেশ জয় করেই চলেছে। ওদিকে জাপানও অনেক সৈন্য নিয়ে ভারত আক্রমণের কল্পনা করছে। এই সময় কেউ-বা হচ্ছে ক্রোড়পতি, কেউ-বা হচ্ছে পথের ভিখারি। অদৃষ্ট চেঞ্জ করার এই সময়।

    প্রণবেশ ঝুঁকে পড়ে ছবিখানা দেখলেন, বললেন, ”কি অপরাধে সে আন্দামানে গিয়েছিল তা কিছু লেখা নেই কৃষ্ণা?”

    কৃষ্ণা পাতা উল্টে পড়লে, ”অপরাধ-ডাকাতি, নরহত্যা প্রভৃতি। এরও আগে সমর সিং জেল খেটেছে, অতি অল্প বয়স হতেই সে চুরি-জুয়াচুরি প্রভৃতি কাজে ধরা পড়ে, জেলও খাটে। তার সমস্ত কাহিনিই পড়ব নাকি মামা?”

    প্রণবেশ একটা আড়মোড়া ছেড়ে বললেন, ”আর না, যা শুনেছি ওই ঢের। দেখি গিয়ে-ব্যোমকেশবাবু আসবেন বলেছেন, এলে তাঁর মুখে অনেক খবর পাওয়া যাবে মনে হয়।”

    তিনি উঠলেন!

    তিন

    ইন্সপেক্টর ব্যোমকেশবাবু তদন্ত সেরে এলেন, সদর দরজা হতে ডাক দিলেন, ”কই গো, আমার কৃষ্ণা-মা কোথায়?”

    কৃষ্ণা হাসিমুখে বার হয়ে এল-

    ”এই যে, বাড়িতেই আছি কাকাবাবু! সামনে একজামিন আসছে কিনা, পড়াশুনো নিয়ে একটু ব্যস্ত থাকতে হয়েছে। বসুন আপনি।”

    ব্যোমকেশ জেঁকে বসলেন।

    ”আজই না হয় একজামিনের জন্যে পড়াশুনার চাপ পড়েছে, এতদিন তো এ চাপ ছিল না, মা, তবু তো মনে করে একবার যাওনি! কাকাবাবু বেঁচে আছে কি মরেছে সে খবরটাও তো নাওনি!”

    কৃষ্ণা বললে, ”খবর প্রায়ই নিই কাকাবাবু, আপনি প্রায়ই এদিক-ওদিক করেন কিনা-জানতেও পারেন না কে গেল না-গেল।”

    ব্যোমকেশ একটু হেসে বললেন, ”যাক, তোমার কথাই মেনে নিলুম। তারপর কাজের কথা হোক। তোমার মামার সঙ্গে প্রথমেই দেখা। উনি বলছিলেন, কাল রাত্রে নাকি একজন লোককে তুমি ও-বাড়িতে দেখেছ। তারপর সে লোকটাকে নাকি তুমি বিলক্ষণ চেন।”

    কৃষ্ণা স্তব্ধ হয়ে রইল। মামাবাবুর ওপর তার রাগ হল বড় কম নয়! এত শীঘ্র ব্যোমকেশকে এ-সব কথা জানানো তার উদ্দেশ্য ছিল না। ব্যোমকেশবাবুকে সে একদিক দিয়ে পিতার বন্ধু হিসাবে শ্রদ্ধা-ভক্তি করে, কিন্তু পুলিশ হিসাবে তাঁকে সে উচ্চ সম্মান দিতে পারে না। কয়েকটা তদন্তক্ষেত্রে সে দেখেছে, ব্যোমকেশবাবু নিজে যা সত্য বলে মনে করেন, তার ওপর আর কাউকে কথা বলতে দিতে তিনি চান না। নিজেকে তিনি অভ্রান্ত বলে মনে করেন, আর কাউকে তাঁ পথে আসতে দিতে অসম্মত।

    কিন্তু কৃষ্ণাও অতি চালাক মেয়ে, ছোটবেলা হতে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে জড়িয়ে পড়ে অভিজ্ঞতা তার বড় কম হয়নি। ব্যোমকেশবাবু তাঁর তদন্তের ফল নিয়ে নিজে প্রচার করে লোকের কাছ হতে প্রশংসা অর্জন করতে চান, সে তার জানে। তাঁর নিজের যে বিশেষ কোনো ক্ষমতা নাই, তাও সে জানে।

    সে বললে, ”মামা বুঝি এর মধ্যেই আপনাকে এ-সব খবর দিয়ে ফেলেছেন। নাঃ মামার কোনো জ্ঞান নেই, চিরকাল মামা সমান থেকে গেলেন!” বলতে বলতে সে চুপ করে গেল।

    ব্যোমকেশবাবু বললেন, ”না-না, প্রণবেশবাবুর কোনো দোষ নেই কৃষ্ণা-মা! আমিই জানতে চাইলুম, তিনি কিছু জানেন কিনা। পাশাপাশি জানলা, তোমাদের জানলা হতে ও-বাড়ির অনেক-কিছু দেখা যায় কিনা? ভাবলুম, ও-বাড়িতে অত সমারোহ ব্যাপার, পরিচয় না থাকলেও জানলা দিয়ে তোমরা হয়তো অনেক-কিছু দেখে থাকবে। তদন্তের কোনো সূত্রই তো পাচ্ছি নে, সেইজন্যে আমি তাঁকে বিশেষ করে গোপনে ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলুম।”

    ”গোপনে ডেকে?”

    কৃষ্ণার ভ্রূ কুঞ্চিত হল…তখনই স্বাভাবিক হল। সে বললে, ”হাঁ, গোপনে না হলে তো আপনাদের পুলিশের এনকোয়ারি চলবে না! যাক, মামা কি বললেন শুনি?”

    ব্যোমকেশবাবু হাসবার চেষ্টা করলেন, বললেন, ”তিনি তোমার কথা বললেন; বললেন, তুমি একজন লোককে সন্দেহজনক ভাবে ও-বাড়ির ঘরে ঘুরতে দেখেছ। সে লোকটাকে তোমার পরিচিত বলে মনে হয়, কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও তাকে মনে করতে পারছ না।”

    যাক, মামাবাবুর ঘটে তবু এতটুকু বুদ্ধি আছে! কৃষ্ণার দেখা লোকটার কথা বলে ফেলেই বুঝি ভবিষ্যতের কথা মনে হয়েছে! তিনি কৃষ্ণার ডাইরির কথা একেবারে গোপন করে গেছেন। কৃষ্ণা এই গোপনতার জন্য মনে মনে ধন্যবাদ দিলে।

    সে মাথা নেড়ে চিন্তিত মুখে বললে, ”সত্যি কাকাবাবু, আমি একজন লম্বা অথচ সুন্দর লোককে ওই ঘরের মধ্যে ঘুরতে দেখেছি। তাকে প্রথমে আমি বাড়ির কোনো লোক বলেই ভেবেছিলুম, পরে তার চালচলন দেখে আমার কিরকম যেন সন্দেহ হয়েছিল।”

    ব্যোমকেশবাবু উৎসাহে সোজা হয়ে বসলেন, ”অ্যাঁ, বল কি! তোমার পর্যন্ত সন্দেহ হয়েছে? তবে সে বেটা ডাকাত না হয়ে যায় না! যাক, বল দেখি মা, কি তুমি দেখেছিলে? আগে বল দেখি, সে লোকটা কোন দেশীয়? বাঙালি, পাঞ্জাবি, ম্যাড্রাসি, অথবা বার্মিজ, আরাকানি, তিব্বতি-”

    কৃষ্ণা একটু হেসে বললে, ”তাই যদি বলতে পারতুম কাকাবাবু, তাহলে তো ভাবনাই থাকত না। লোকটা চুপি চুপি ঘরে ঢুকল, দরজা দিলে, তারপর খানিক পরে বার হয়ে গেল, এইটুকুই দেখেছি। তারপর যা কিছু আপনারা তা করবেন।”

    ব্যোমকেশবাবু দুই হাতে মাথাটাকে চেপে ধরে খানিক নিস্তব্ধে বসে রইলেন, তারপর শান্তকণ্ঠে বললেন, ”দেখা যাক, যা সূত্র পেলুম, এর ওপর দিয়ে আর-কিছু আবিষ্কার করতে পারি কিনা! একটা কথা মা, যদি সে লোকটাকে ধরতে পারি, তুমি চিনতে পারবে নিশ্চয়ই?”

    কৃষ্ণা বললে, ”আশা তো হয় পারব, কিন্তু আপনি উঠছেন কেন কাকাবাবু? বসুন, আজ এখানেই যা হয় দুটো খেয়ে যান। বেলা যথেষ্ট হয়ে উঠেছে, এখন বাড়ি যাবেন, স্নান করবেন…”

    ব্যোমকেশবাবু একটা হাই তুলে আড়মোড়া ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললেন, ”এখনও অনেক কাজ বাকি আছে মা, এখন খাওয়া-দাওয়ার সময় কোথায়? আচ্ছা, কথা রইল, মাঝে-মাঝে এখানেই এখন আসতেই হবে তো! এর মধ্যে একদিন যা হয় খাওয়া যাবে।”-

    তিনি বার হয়ে গেলেন, কৃষ্ণাও সঙ্গে সঙ্গে দরজা পর্যন্ত গেল।

    তাঁকে বিদায় দিয়ে ফিরতেই দেখা হল প্রণবেশের সঙ্গে।

    রাগ করে কৃষ্ণা বললে, ”তুমি তো বেশ মানুষ মামা! দেখা হতে না হতে কাকাবাবুর কাছে খবর দিয়েচ, আমি চোরকে চিনি?”

    প্রণবেশ বললেন, ”তাতে আর কি হল? বেচারারা এতটুকু সূত্র না পেয়ে হাঁপিয়ে উঠেছে। ভাবলুম, আমরা যেটুকু জানি ওদের জানাই, তাতে যদি কোনো উপকার হয়! কিন্তু ওদের জানাতেও তো আমাদের কোনো বাধা নেই কৃষ্ণা, তুমি তো এর মধ্যে জড়াচ্ছ না-কাজের ভারও নিচ্ছ না-তবে আর কি?”

    কৃষ্ণা মাথা নাড়লে, ”ক্ষেপেচ মামা, সামনে একজামিন আসছে, মাত্র কয়টা মাস বাকি, এখন যদি পড়াটা ভালো করে না করি, ফেল করে বসে থাকব। পরীক্ষা দিয়ে ফেল হওয়ার গ্লানি আমি সইতে পারব না মামা-আর কিই-বা দরকার পরের জন্যে খাটতে যাওয়ার? যাদের গেছে তারা তো আমায় বলছে না। পুলিশের কাজ নিয়ে, পুলিশের কৃতিত্ব বাড়িয়ে আমার কি লাভ হবে?”

    সে ঘরে প্রবেশ করে বই খুলে বসল।

    চার

    সন্ধ্যার পর-মুহূর্ত।

    ছাদের উপর হতে বেড়িয়ে এসে কৃষ্ণা কেবলমাত্র বইখানা খুলে বসেছে।

    হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে প্রবেশ করে প্রণবেশ বললেন, ”এই দেখ কৃষ্ণা, যা মনে করেছিলুম, ঠিক তাই ঘটেছে। এই নাও-মিঃ সেন এসেছেন, তাঁর কার্ড দিয়েছেন। বাইরের ঘরে তাঁকে বসিয়ে রেখে এসেছি, একটিবার চল। এবার তো বলতে পারবে না যে, আমিই তাঁদের খবর দিয়েছি!”

    কার্ডখানা নিয়ে কৃষ্ণা তার ওপর চোখ বুলোলে।

    মিঃ সেন নিজেই এসেছেন। আজই সকালে বাড়ির দাসী বলছিল, ”ওরা তোমার নাম করছিল দিদিমণি, গিন্নি-মা নাকি ভয়ানক কান্নাকাটি করছেন, তোমায় তিনি চাচ্ছেন।”

    তাকে কোনোরকমে থামিয়ে দিলেও কৃষ্ণা বুঝেছিল তার ডাক বোধহয় আসবে। ডাক এলেও সে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল। নিজের ক্ষতি করে পরের কাজ করবার ইচ্ছা তার এখন নাই।

    সে উঠল-

    ভ্রূ কুঞ্চিত করে বললে, ”আমি যা বলব, তুমি আর তার ওপর কোনো কথা বলতে যেও না মামা! শুধু ‘হ্যাঁ’, ‘না’ বলে যেও, বুঝেছ?”

    সে অগ্রসর হল।

    বৈঠকখানায় টেবিলের ধারে একখানা চেয়ারে এক ভদ্রলোক বসে অন্যমনস্কভাবে বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছিলেন! কৃষ্ণা পরদা সরাতেই তিনি তার পানে চাইলেন।

    কৃষ্ণা হাত দুখানা কপালে ছোঁয়ালে।

    পিছন হতে প্রণবেশ বললেন, ”ইনিই আমার ভাগনী কুমারী কৃষ্ণা; আর কৃষ্ণা, ইনিই মিঃ সেন-করাচি হতে আজ পাঁচদিন মাত্র কলকাতায় এসেছেন।”

    মিঃ সেন হাতখানা কপালে রাখলেন, হাসির রেখা তাঁর মুখে ফুটল না, মুখখানা কেবল বিকৃত হয়ে উঠল।

    কৃষ্ণা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে একবার তাঁকে দেখে নিলে।

    বয়স বোধহয় পঁয়তাল্লিশ হবে। মাথার চুলে সাদা রং ধরেছে। লম্বা-চওড়া চেহারা, মনে হয় না তাঁর কোনোদিন শক্ত অসুখ-বিসুখ হয়েছে। উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, চোখ বেশ বড়, তাঁর মুখ দেখলেই তাঁর প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়।

    মিঃ সেন শান্তকণ্ঠে বললেন, ”বস মা, তোমায় আপনি বলতে পারব না, আমার মেয়ের মতোই তুমি-তোমায় তার মতোই দেখছি। আশা করছি তুমিও আমায় তোমার পিতা-কাকার মতো মনে করবে।”

    কৃষ্ণা বসল; বললে, ”আমায় মেয়ের মতো মনে করুন-আপনাকেও আমি আমার কাকাবাবু বলে জানলুম। কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছিনে, আপনি হঠাৎ এই রাত্রে আমাদের বাড়ি এসেছেন-আমি-আমি-”

    মিঃ সেন একটু হেসে বললেন, ”কেন যে এসেছি মা, তা নিশ্চয়ই বুঝেছ। তোমারই বাড়ির পাশে আমি এসেছি। নিজের বাড়ি হলেও আমি বহুকাল এখানে আসিনি, এ-বাড়ি ভাড়া দেওয়া ছিল, এ-সব তো জান?”

    কৃষ্ণা বললে, ”হ্যাঁ, আপনার আসার আগে আপনার পুরনো বাড়িতে একজন পাঞ্জাবি ভদ্রলোক বাস করতেন দেখেছি। বৎসর দুই হল তিনি উঠে যাওয়ার পরে বাড়ি মেরামত শুরু হয়।”

    মিঃ সেন বললেন, ”তিনি অনেককাল এ বাড়িতে ছিলেন শুনেছি। তোমাদের সঙ্গে নিশ্চয়ই পরিচয়ও ছিল?”

    প্রণবেশ উত্তর দিলেন, ”না, সে ভদ্রলোক কারও সঙ্গে বড় একটা মিশতেন না। একাই তিনি থাকতেন, তাঁর আত্মীয়-স্বজন মাঝে মাঝে দেশ হতে আসতেন বটে, দু-চার দিনের বেশি কেউ থাকতেন না দেখেছি।”

    কৃষ্ণা বললে, ”তাঁর শুধু একজন আরদালি ছিল, সে সর্বদা তাঁর কাছে থাকত। বাবুর্চি ছিল, দারোয়ান দু-জন ছিল। মোট কথা আপনার অত-বড় বাড়িতে মাত্র ছ-সাতজন লোক থাকত।”

    মিঃ সেন বললেন, ”যাক, তাঁর খবর নিয়ে আমার কোনো লাভ নেই। আমার নিজের কথা যা বলতে এসেছি, সেই কথাই বলি। তুমি তো সব জান মা, আমি যেদিন এসেছি, সেই রাত্রেই আমার বাড়িতে যে দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, সে-কথা বোধহয় আজ শহরের কারও অজানা নেই।”

    কৃষ্ণা বললে, ”সবই জানি কাকাবাবু, আপনার বাড়ির দুর্ঘটনার কথা না জানে এমন লোকই নেই। আসা মাত্রই এমন অবস্থায় পড়া, এ বড়ই দুঃখের কথা কাকাবাবু! আমরা পাড়াসুদ্ধ লোক আপনার এ অবস্থার জন্যে বড় মর্মাহত হয়েছি, যদিও আপনার সঙ্গে কারুরই পরিচয় ছিল না!”

    মিঃ সেন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন; বললেন, ”আজ পাঁচদিন হল, পুলিশ তদন্তের ভার নিয়েছে, কিন্তু এ পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি। আমি আগে জানতে পারিনি, মাত্র কাল জানতে পেরেছি, তুমি এ পর্যন্ত যে কোনো কাজ হাতে নিয়েছ- কোনোটাতেই ব্যর্থ হওনি। আমার স্ত্রী বিশেষ করে ধরেছেন, যাতে তুমি এই ভারটা হাতে নাও, আমার রত্নাকে ফিরিয়ে আন।”

    ”আমি!”

    কৃষ্ণা সচকিত হয়ে ওঠে, বলে, ”আমি কি করব কাকাবাবু?”

    মিঃ সেন তার হাত দুখানা চেপে ধরলেন; রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ”আমার মুখের পানে একবার চাও মা! আমারও সেই একমাত্র মেয়ে, আজ পাঁচ দিন তাকে আমরা দেখিনি। ছেলেমানুষ সে-কে বা কারা তাকে কোথায় নিয়ে গেল, কি অবস্থায় তাকে রেখেছে তাই-বা কে জানে। এর চেয়ে সে যদি কোনো অসুখে আমাদের চোখের সামনে মারা যেত, আমার অভিযোগ থাকত না কারও কাছে। আমার মুখ চেয়ে, আমার স্ত্রীর-তার মায়ের দুর্ভাগ্যের কথা ভেবে, তুমি এ ভার নাও মা! আমি জানি পুলিশের দ্বারা বিশেষ-কিছু হবে না-যদি হয় তোমার দ্বারাই হবে।”

    কৃষ্ণা খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে।

    প্রণবেশ বলতে গেলেন, ”কিন্তু ওর যে একজামিন আসছে, মিঃ সেন!”

    তাঁর দিকে ফিরে মিঃ সেন বললেন, ”আমি তা জানি প্রণবেশবাবু, আমি সেই জন্যে কৃষ্ণার দয়াপ্রার্থী হচ্ছি। আমি শুনলুম, কিছুদিন আগে কৃষ্ণা তার আত্মীয় একটি ছেলেকে কিরকম ভাবে ফিরিয়ে এনেছে, দেশের সকল লোকেই সেজন্যে ধন্য-ধন্য করেছে। আমি একটা কথা বলছি কৃষ্ণা-তুমি যদি ইচ্ছা কর তবে এ ভার নিও, যদি মনে কর এ কাজ নিলে তোমার বিশেষ ক্ষতি হবে-তা হলে নিও না।”

    কৃষ্ণা নিস্তব্ধে ভাবছিল, বললে, ”আমি কাল আপনাকে জানাব কাকাবাবু- আজকের রাতটা আমাকে ভেবে ঠিক করতে দিন।”

    মিঃ সেন উঠে দাঁড়ালেন; বললেন, ”ভালো কথা, কাল সকালেই আমি তোমার কাছে আসব।”

    কৃষ্ণা সঙ্গে সঙ্গে চলতে চলতে বললে, ”না, আপনাকে আর আসতে হবে না কাকাবাবু, আমিই কাল আপনার বাড়িতে যাব সকালে।”

    ফিরে দাঁড়িয়ে মিঃ সেন বললেন, ”আমি কিন্তু নিশ্চিন্ত রইলুম মা! নিজের কোনো ক্ষতি না করে যদি হয় তাই কর।”

    বাইরের দরজার কাছে তাঁর দারোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তার সঙ্গে তিনি চলে গেলেন।

    প্রণবেশ দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন, ”আশ্চর্য, দেখেছ কৃষ্ণা?”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ”কি দেখব, মামা?”

    প্রণবেশ বললেন, ”আমার হঠাৎ মনে হল, ওই গলিটার মোড়ে একজন লোক দাঁড়িয়ে ছিল, আমারা এখানে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে সে সাঁ করে সরে গেল! লোকটা কে ঠিক করতে পারলুম না।”

    কৃষ্ণা একটু হেসে বললে, ”এবার মামার দেখছি একটু ডিটেকটিভগিরি করতে ইচ্ছে হয়েছে। পথ-চলা লোক পথ দিয়ে যেতে হয়তো দাঁড়িয়েছে, অমনি তোমার চোখ পড়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সন্দেহও হয়েছে। যাও, তুমি তোমার কাজ কর গিয়ে, আমি পড়তে বসি।”

    সে পড়তে বসল।

    পাঁচ

    টক-টক-টক-

    সামনের দরজায় কে আঘাত করছিল। এখনও একঘণ্টা হয়নি মিঃ সেন বাড়ি গেছেন।

    প্রণবেশ তাঁর ঘরে বিছানায় শুয়ে পড়ে একখানা উপন্যাস পড়ছিলেন। প্রণবেশ আজকাল ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়েন এবং সেগুলো বিশেষ করে রবার্ট ব্লেকের সম্বন্ধে লেখা। কোনোকালে তিনি এ-সব বই পড়েননি, এবং বরাবর এ-ধরনের উপন্যাসগুলোকে তিনি ‘গাঁজা’ নাম দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন। আজকাল দেখা যায়, কৃষ্ণাকে গোপন করে তিনি এইসব বই পড়েন।

    ”কে? কে দরজায় ডাকে?”

    প্রণবেশ বিরক্তিভরে হাঁক দিলেন, ”ভগবান দেখ তো, দরজায় কে ডাকে!”

    ভগবান উড়িষ্যাদেশবাসী, এ বাড়িতে রন্ধন করে। তার সাড়া পাওয়া গেল না।

    কৃষ্ণা পাশের ঘর হতে বললে, ”ভগবানকে তুমিই তো খানিক আগে কি আনতে বাজারে পাঠালে মামা! তুমিই একবার দেখ না, মিঃ সেন বোধহয় আবার ফিরে এসেছেন-আবার হয়তো কি বলতে চান।”

    বিরক্ত হয়ে প্রণবেশ অগত্যা উঠলেন।

    যেমন চিত্তাকর্ষক বইখানা, তেমনই চিত্তাকর্ষক স্থান!….রবার্ট ব্লেককে ডাকাতেরা হাত-পা বেঁধে পর্বত-চূড়ায় রেখে বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

    আপন মনে গজ গজ করতে করতে প্রণবেশ দরজা খুলে দিলেন।

    পথের উপরে সদৃশ্য একখানি মোটরকার দাঁড়িয়ে আছে। সুদৃশ্য পোশাক পরা দুজন আরদালি নীচে দাঁড়িয়ে, তাদের তকতকে তকমাগুলো পথের ম্লান আলোতেও ঝিকমিক করছিল।

    ব্ল্যাক-আউটের রাত-সামনের লাইটপোস্টের তলায় যেটুকু আলো পড়েছিল, তাতে যেটুকু দেখা যায়। গাড়ির হেডলাইট নেবানো ছিল-একপাশের একটি আলো ম্লানভাবে জ্বলছিল।

    গাড়ির মধ্যে মানুষ আছে বোঝা যাচ্ছে। জ্যোৎস্নার শুভ্র আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিথিটা বোধহয় দ্বাদশী-ত্রয়োদশী হবে। ব্ল্যাক-আউট হলেও জ্যোৎস্নায় চারিদিক উজ্জ্বল দেখা যাচ্ছে। গাড়ির মধ্যে যে লোক আছে, জ্যোৎস্নার আলোয় তাকে আবছা মাত্র দেখা যায়।

    আরদালি প্রণবেশকে সেলাম দিল। সসম্ভ্রমে বলল, ”রাজা বাহাদুর আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চান, হুজুর!”

    ”রাজা বাহাদুর!”

    প্রণবেশ যেন আকাশ হতে পড়েন!

    মনে হয়, গরিবের কুঁড়েঘরের দরজায় হাতি বাঁধা। তাঁদের জীর্ণ বাড়ির দরজায় রাজা বাহাদুর স্বয়ং এসে হাজির, এ যেন আরব্য উপন্যাসের গল্প!

    যে মন নিয়ে প্রণবেশ দরজা খুলেছিলেন, সে মন বদলে গিয়েছিল। তিনি সন্ত্রস্ত ভাবে বললেন, ”রাজা বাহাদুর-মানে?”

    ড্রাইভারের পাশে যে ভদ্রলোক বসেছিলেন, তিনি নেমে এলেন। প্রণবেশ তাঁকেই রাজা বাহাদুর ভেবে সসম্ভ্রমে অভিবাদন করলেন।

    প্রত্যভিবাদন করে ভদ্রলোক বললেন, ”আমিই রাজা বাহাদুরের কাজ নিয়ে এসেছি। কুমারী কৃষ্ণা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে চাই-বিশেষ দরকার।”

    ”আসুন।”

    প্রণবেশ ভদ্রলোককে বৈঠকখানায় বসিয়ে কৃষ্ণার পড়ার ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।

    কৃষ্ণা বাইরে কথার শব্দ শুনে জানালার কাছে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। বই রেখে সে মুখ তুলে বললে, ”উঃ, কি সৌভাগ্য দেখেছ মামা, এখনও তদন্তের ভার পর্যন্ত নিইনি, এর মধ্যে রাজা বাহাদুরের গাড়ি এসে দাঁড়াল দরজায়! এরপর দেখবে কত মহারাজা, কত নবাব, চাইকি, সম্রাট পর্যন্ত আমাদের কুঁড়েঘরের দরজায় দাঁড়াবে!”

    বলতে বলতে সে হেসে উঠল।

    তারপর বললে, ”কিন্তু বোকার মতো কাজ করছ মামা! রাজা বাহাদুর নামটাই শুনে এলে, কোথাকার রাজা তা কিছু জিজ্ঞাসা করে এলে না? আমি নিজে গিয়ে জিজ্ঞাসা করব, সেটা একবারে ভদ্রতা-বিরুদ্ধ হবে যে!”

    প্রণবেশ মাথা চুলকোলেন। তাই তো, কোথাকার রাজা সেটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। বললেন, ”তোমায় জিজ্ঞাসা করতে হবে না কৃষ্ণা, কথায় কথায় সেটা আপনিই বার হয়ে পড়বে। তুমি প্রস্তুত হয়ে এস, আমি ততক্ষণ গিয়ে বসছি।”

    তিনি চলে গেলেন।

    প্রস্তুত হতে কৃষ্ণার দশ মিনিট সময় লাগল। দশ মিনিট পরে সে যখন বৈঠকখানার দরজার বাইরে গিয়ে দাঁড়াল, তখন প্রণবেশের কথাই শোনা যাচ্ছিল, সে ভদ্রলোকের কথা শোনা গেল না।

    কৃষ্ণা ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গে প্রণবেশ যেন বেঁচে গেলেন!

    ”এই যে কৃষ্ণা এসেছে। কৃষ্ণা, এঁর পরিচয়টা দিই, ইনি-ইনি সেক্রেটারি অব…”

    কথাটা শেষ না করে তিনি জিজ্ঞাসু চোখে ভদ্রলোকের পানে তাকালেন।

    নাঃ, মামার বুদ্ধি আছে, অন্ততপক্ষে রবার্ট ব্লেকের নভেল পড়ে পড়ে মামার বুদ্ধি খুলেছে। এরপর হয়তো মামাই একজন নামজাদা ডিটেকটিভ হয়ে পড়বেন। কৃষ্ণা সে আশাও রাখে।

    ভদ্রলোক কৃষ্ণাকে অভিবাদন করলেন; বললেন, ”শিকারপুরের রাজা বাহাদুরের সেক্রেটারি, আমার নাম-রাম সিং।”

    কৃষ্ণা প্রত্যভিবাদন করে বসল।

    প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ”শিকারপুরটা কোথায়? এই বাংলাদেশে?”

    রাম সিং মাথা নাড়লেন, ”না স্যার, শিকারপুর পাঞ্জাবের মধ্যে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হতে মোটরে ঘণ্টা-তিনেকের পথ হবে।”

    প্রণবেশ হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, ”কত স্পিডে গাড়ি চলবে সেটা বলুন, না হলে বুঝব কি করে?”

    ভদ্রলোক বিস্ফারিত চোখে প্রণবেশের পানে চেয়ে রইলেন।

    কৃষ্ণা বললে, ”আঃ, কি কর মামা? সব তাতেই তোমার এমনি কথা। লোকে তো তা বুঝবে না, তারা অন্য কিছু মনে করে।”

    তারপর রাম সিং-এর দিকে ফিরে সে বললে, ”মামার ও কথা ছেড়ে দিন। কত স্পিডে মোটর চলে তা জানবার দরকার নেই আমার। আপনি কি দরকারে আমার কাছে এসেছেন, আমি শুধু সেই কথাটাই জানতে চাচ্ছি।”

    রাম সিং ভালো হয়ে বসলেন; বললেন, ”রাজা বাহাদুর নিজেই আসতেন, কিন্তু শরীর তাঁর বড় অসুস্থ। মন খারাপ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছেন। আমাকেই তিনি তাড়াতাড়ি পাঠালেন।”

    কৃষ্ণা অধৈর্য হয়ে বললে, ”আসল কথাটা বললে বাধিত হব মিঃ সিং! আমার কাজ আছে, বাজে কথায় বেশি সময় নষ্ট করার ইচ্ছা আমার নেই, সেইজন্যে যত তাড়াতাড়ি হোক-”

    রাম সিং যেন সন্ত্রস্ত্র হয়ে উঠলেন! দু-হাত জোড় করে অপরাধীর মতো বললেন, ”আমি ক্ষমা চাচ্ছি কৃষ্ণা দেবী। আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করছি, এজন্যে আমি বড় অনুতপ্ত। যাই হোক, যত কমে হয়, আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।”

    এক মুহূর্ত নীরব থেকে তিনি বললেন, ”আমাদের শিকারপুর একটা বড় স্টেট। আমাদের রাজার বার্ষিক আয় অন্ততপক্ষে দশ লাখ টাকার কম নয়।”

    প্রণবেশ উসখুস করলেন, কৃষ্ণা নিস্তব্ধে রাম সিং-এর পানে চেয়ে রইল।

    রাম সিং তাঁর চোখের দৃষ্টি দুজনের ওপর বুলিয়ে নিলেন, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ”এই রাজ্যের রাজা ছিলেন আমাদের রাজা বাহাদুরের কাকা। তিনি উইল করে তাঁর সমস্ত সম্পত্তি রাজা বাহাদুরকে দিয়ে গেছেন।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ”উইল করে কেন? উত্তরাধিকার সূত্রে সে সম্পত্তি তো এঁরই পাওয়ার কথা?”

    রাম সিং একটু হেসে বললেন, ”গোল বেধেছে যে ওইখানে। তাঁর অন্য ভাইয়েরও এক ছেলে আছে, সেই রাজ্যের কর্তা হয়ে পড়ত। রাজা বাহাদুরের সঙ্গে তাঁর এতটুকু কি নিয়ে মতান্তর, তারপর মনান্তর হয়। রাজা বাহাদুর তাঁকে কিছু না দিয়ে উইল করে এই ছেলেকেই দিয়ে যান। এইবার বুঝলেন কথা?”

    কৃষ্ণা বললে, ”বুঝেছি, আর সঙ্গে সঙ্গে এও বুঝেছি, রাজা বাহাদুরের উইল হারিয়েছে এবং ওয়ারিশান অন্য উইল প্রকাশ করেছে।”

    চমৎকৃত রাম সিং বললেন, ”চমৎকার, আপনি ঠিক ধরেছেন কৃষ্ণা দেবী! এইজন্যেই যে আপনার এত নাম তা বুঝেছি। আজই ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে দেখা-”

    কৃষ্ণা বাধা দিলে, ”কিন্তু তিনি তো এখানে নেই, দ্বারভাঙায় গেছেন আজ ক’দিন হল।”

    রাম সিং বললেন, ”গিয়েছিলেন, কিন্তু ফিরেছেন। কলকাতায় আসেননি, ট্রেনে তাঁর সঙ্গে দেখা। তিনি বর্ধমানে নেমে গেলেন, আমি পাঞ্জাব হতে সোজা কলকাতায় এলুম। তিনিই আপনার কথা বার বার করে বলে দিলেন-যাতে আপনি এই ভারটা হাতে নেন।”

    ”আমি নেব?” কৃষ্ণা স্পষ্টই হেসে ফেললে।

    তারপর একটু থেমে আবার তখনই বললে, ”আপনারা আমায় কি ভেবেছেন বলুন তো, সিং সাহেব? আমায় এত বড় করে বাড়িয়ে তুলেছেন যা শুনে আমার হাসি আসছে। আমি মেয়ে-তারপর বাংলাদেশের মেয়ে, আমার শক্তি কতটুকু-সাহসই বা কতখানি? কোথায় পাঞ্জাবে একজন রাজার উইল চুরি গেছে, তার তদন্তের ভার নেব আমি? এ একেবারে অসম্ভব কথা! হতে পারে, নিতান্ত আত্মীয়স্থলে বা সম্পূর্ণ নিজের জন্যে আমি কিছু কাজ করেছি, তা বলে আমি যে ডিটেকটিভের পেশা নিইনি এ কথা তো জানেন। আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমি এ কাজ পারব না। আর যা পারব না, তার জন্যে আমায় অন্যায় অনুরোধও করবেন না।”

    রাম সিং মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে রইলেন। তারপর ধীরকণ্ঠে বললেন, ”আমি সে কথাও রাজা বাহাদুরকে বলেছি কৃষ্ণা দেবী! তিনি তা না শুনে আগেই এই চেকখানা পাঠিয়ে দিয়েছেন, আর আপনাদের দুজনের শিকারপুর যাওয়ার খরচ এই পাঁচশো টাকা দিয়েছেন। আপনি কাল আমার সঙ্গে চলুন আপনার মামাকে নিয়ে। অবস্থা এবং কাল-পাত্র বুঝে আপনি এ ভার নেবেন, নচেৎ আবার ফিরে আসবেন। না হয় আট-দশ দিন থেকে একটা নূতন দেশ দেখে আসবেন কৃষ্ণা দেবী, সেটাও তো কম লাভ নয়! কত লোক পাঞ্জাবে বেড়াতে যায়…রঞ্জিত সিংহের কীর্তিকলাপ দেখতে যায়…”

    কৃষ্ণা বাধা দিলে। পাঁচ হাজার টাকার চেক ও পাঁচ শত টাকার নোট সরিয়ে রাম সিং-এর সামনে রেখে সে বললে, ”ধন্যবাদ! কিন্তু আমি এত সহজে প্রলোভনে মুগ্ধ হইনে মিঃ সিং। টাকা আপনি নিয়ে যান। সত্যিই যদি কেউ শিকারপুরের রাজা থাকেন-তাঁকে ফিরিয়ে দেবেন; বলবেন, আমি এখন পাঞ্জাব ভ্রমণে যেতে অপারগ। যদি সত্যিই সে দিন আসে, সে সুযোগ পাই-বেড়াতে যাব। রঞ্জিত সিংহের কীর্তি দেখে আসব, এখন আমার সে-সময় নেই।”

    সে উঠে দাঁড়াল, ”নমস্কার, কিছু মনে করবেন না, অপরাধ ক্ষমা করবেন।”

    এই বলে সে বার হয়ে গেল।

    আরক্তমুখে রাম সিং উঠে দাঁড়ালেন।

    ছয়

    কৃষ্ণা সকালবেলা চা পান করেই ও-বাড়িতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল।

    প্রণবেশ কাল রাত হতে রাগ করে কৃষ্ণার সঙ্গে কথা বলেননি। এমন বোকা মেয়ে তিনি কখনও দেখেননি। শিকারপুরে গিয়ে বললেই হত, এ কাজ করব না। সত্যই পরের ব্যয়ে পাঞ্জাব দেখা হত।

    ”পঞ্চনদীর তীরে, বেণী পাকাইয়া শিরে,

    দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে

    জাগিয়া উঠিল শিখ

    নির্মম নির্ভীক!”

    সেই পঞ্চনদীর তীরে কত সহজে যাওয়া যেত, অত বড় একজন রাজার অতিথি হয়ে কত সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যেত, বোকা মেয়েটা স্বেচ্ছায় সব নষ্ট করল!

    চায়ের টেবিলেও তিনি কথা বললেন না। অত্যন্ত রাগ করে চায়ের কাপ এক চুমুকে শেষ করলেন। তাঁর মুখ দেখেই কৃষ্ণা বুঝেছিল মামার বড় রাগ ও দুঃখ হয়েছে। সকৌতুকে সে জিজ্ঞাসা করল, ”মিঃ সেনের বাড়িতে যাবে না মামা?”

    প্রণবেশ উত্তর দিলেন না।

    কৃষ্ণা এগিয়ে এসে তাঁর মাথার ওপর হাত রাখলে, একটু হেসে সে বললে, ”ছেলের বড় রাগ হয়েছে দেখছি! ছিঃ, মায়ের ‘পরে রাগ করতে আছে বুঝি?”

    প্রণবেশ গোঁ-গোঁ করলেন, বললেন, ”রাগ আমি করিনি, দুঃখ আমার হয়েছে সে কথা ঠিক। লোকটা নিয়ে যেতে চাইছিল। যেতেই না হয় শিকারপুরে-ওখানে গিয়ে বললেই হত-তুমি পারবে না। তবু কয়টা দিন থেকে পাঞ্জাব দেশটা দেখে আসা যেত। বল কি-আলেকজান্ডার ওইখানেই না পুরুকে বন্দী করেছিলেন, শেষে সসম্ভ্রমে ছেড়ে দেওয়ার পথ পাননি। রঞ্জিত সিংহের বীরত্বের কাহিনিতে উজ্জ্বল পাঞ্জাব-যে ছিল ব্রিটিশের কাছে বিভীষিকা-কালান্তক যম!”

    কৃষ্ণা গম্ভীর মুখে বলল, ”সবই স্বীকার করছি মামা! কিন্তু তুমি কি করে বুঝলে সত্যিই শিকারপুর নামে এক রাজ্য আছে, আর তার রাজার উইল হারিয়েছে? তুমি কি করে বুঝলে এর নাম রাম সিং, আর সে আমায় সত্যই একটা কেস দিতে এসেছে? এরা সেই দল মামা, যারা মিঃ সেনের মেয়ে আর মুক্তোমালা নিয়ে পালিয়েছে। পাছে আমি মিঃ সেনের কেস হাতে নেই, এই জন্যে টাকার লোভ দেখিয়ে আমায় অন্ততপক্ষে দিন সাত-আটের মতো ওরা কলকাতার বাইরে নিয়ে যেতে চায়।”

    প্রণবেশ এতখানি হাঁ করে ফেললেন! সত্যই এ-সব কথা মোটে তাঁর মনেই হয়নি!

    কৃষ্ণা বললে, ”ও-বাড়ি চল, ওখানেই আমাদের এ-সব কথাবার্তা হবে এখন। আমি মিঃ সেনের কেস নিজেই নেব মামা! এতে একটি বাঙালি ভদ্রলোকের মান-সম্ভ্রম অর্থই কেবল রক্ষা পাবে না-একটি মেয়ের ইজ্জত রক্ষা হবে, প্রাণ বাঁচবে। এটা কতকটা যেন দেবুর ব্যাপারের মতো জটিল লাগছে! আমার মনে হয়, মিঃ সেনের সঙ্গে ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে চোরের দলের শত্রুতা ছিল। এই উপযুক্ত অবসর পেয়ে তারা দুর্দান্ত প্রতিশোধ নিয়েছে। আচ্ছা, ও-বাড়ি চল তো, আগে জানা যাক ব্যাপারটা কি হয়েছে! তারপর নিজের মন্তব্য প্রকাশ করব।”

    মিঃ সেনের বাড়ির সামনে দারোয়ান, সে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিলে।

    মিঃ সেন নীচের বৈঠকখানাতেই অপেক্ষা করছিলেন,-কৃষ্ণাকে দেখেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন, সাগ্রহে তাদের দু-জনকে বসিয়ে একটা ঘণ্টা বাজালেন।

    বৈঠকখানার সামনে অপেক্ষমাণ যে ভৃত্য সর্বদা দাঁড়িয়ে থাকে, সে ভিতরে আসতে মিঃ সেন তাকে বললেন, ”ভিতরে গিন্নিমাকে খবর দাও, কৃষ্ণা দেবী এসেছেন।”

    তারপর কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে ম্লান হাসি হেসে তিনি বললেন, ”দুর্ভাগিনী মা, মেয়ের জন্য অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছেন মা, তোমার সঙ্গে তিনি দেখা করবেন; তুমি এলে যেন খবর দেওয়া হয়, এই কথা বারবার বলে দিয়েছেন।”

    কৃষ্ণা বললে, ”আমি তাঁর সঙ্গে পরে দেখা করব; আগে আপনাকে জানাই- আমি আপনার কেস নিলুম; আজ হতেই আমি আপনার মেয়ের জন্য খাটব। আগে আমি যা-যা জিজ্ঞাসা করব তার উত্তর দিন দেখি, কারণ আমি তো কিছুই জানিনে। এ কেস নেব কি নেব না, প্রথমত এই ছিল আমার প্রশ্ন। তার সমাধান আমার কাল রাত্রেই হয়ে গেছে-আপনি আসার একঘণ্টা পরেই।”

    বিস্ময়ে মিঃ সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ”কি রকম?”

    কৃষ্ণা গতকাল রাত্রের ঘটনা বিবৃত করলে, বললে, ”আমি বেশ বুঝেছি কাকাবাবু, তারা সব সময় আপনার বাড়ির ওপর দৃষ্টি রেখেছে। আপনি কাল ও-বাড়ি গেছেন, কেস আমি নেব কিনা আজ জানাব এও ওরা শুনেছে, সেইজন্যে আপনি আসার একটু পরেই মস্ত বড় প্রলোভন নিয়ে আমায় লোভ দেখাতে গিয়েছিল। এতেই বোঝা যায় ওরা আমায় বিশেষ রকম চেনে না-অর্থাৎ আমি যে টাকার লোভে কাজ করিনে, ওরা তা জানে না; তাই ভেবেছিল মোটা টাকার লোভ দেখালেই আমি ওদের সঙ্গে চলে যাব।”

    বলে সে হাসতে লাগল।

    প্রণবেশ বললেন, ”আবার বলে কিনা ব্যোমকেশবাবু নাকি বলেছেন!”

    কৃষ্ণা বললে, ”ওইখানেই যে ধরা পড়ে গেল! কাকাবাবু গেছেন দ্বারভাঙা; বর্ধমানে তিনি নামবেন কি করে, আর কেনই বা বর্ধমানে যাবেন? আমি জানি তাঁর ফিরতে দিন পনেরো দেরি হবে-অথচ এ লোকটা চট করে তাঁর নাম করে ফেললে!”

    মিঃ সেনের পানে চেয়ে সে বললে, ”থাক ও-সব, ওদের এ জুয়াচুরি ধরা পড়ে গেছে ওরা জেনেছে; এরপর অন্য কোনো রকম করবে। আপনি বলুন কাকাবাবু, আগে আমায় আপনার সমস্ত কথা জানতে দিন। আপনি যে খুব বড় ব্যবসায়ী, প্রাচ্যে আর পাশ্চাত্যে আপনার নানা রকম ব্যবসা চলেছিল, এ কথাটা আর সকলের মতো আমিও জানি। বলতে পারেন-এই ব্যবসা ক্ষেত্রে নেমে আপনার সঙ্গে শত্রুতা হয়েছে এ রকম লোক কে কে আছে?”

    মিঃ সেন একটা নিঃশ্বাস ফেললেন, বললেন, ”আজ আমি নিজেই তোমায় সব জানাব মা! তুমি কেস যখন নিয়েছ, তখন সবই তোমার জানা দরকার।”

    তিনি উঠে ঘরে খানিকটা পদচারণা করলেন-বেশ বোঝা যাচ্ছে তিনি বিলক্ষণ উত্তেজিত হয়েছেন।

    ভিতর দিককার দরজা-পথে এই সময় যে মহিলাটি প্রবেশ করলেন, তাঁর পরিচয় না পেলেও কৃষ্ণা বুঝল ইনিই মিসেস সেন।

    স্ত্রীর পানে দৃষ্টি পড়তেই মিঃ সেন থমকে দাঁড়ালেন।

    ”হ্যাঁ, তুমি এসেছ! এস, কৃষ্ণার সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দিই। কৃষ্ণা, এই আমার স্ত্রী, রত্নার মা। আর দেখ-এরই নাম কৃষ্ণা, তোমার রত্নার দিদি; আর ইনি হচ্ছেন প্রণবেশবাবু-কৃষ্ণার মামা।”

    কৃষ্ণা নমস্কার করল, প্রণবেশও সসম্ভ্রমে মাথা নোয়ালেন।

    মিঃ সেন বললেন, ”কৃষ্ণা, তোমার কাকিমার সঙ্গে ভিতরে যাও, ভিতর-বাড়িটা দেখে এস-রত্নার ঘরটাও-”

    বলতে বলতে তাঁর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল। মিসেস সেন পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, বেশ বোঝা গেল নিঃশব্দে তিনি চোখের জল ফেলছেন।

    কৃষ্ণা তাঁর পাশে গিয়ে দাঁড়াল, আর্দ্র কণ্ঠে ডাকলে, ”কাকিমা!”

    মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে মিসেস সেন বললেন, ”এস মা! ওঁরা এখানে কথাবার্তা বলুন, আমরা ভিতরে যাই, তোমাকে আমি সবকিছু দেখিয়ে দিই।”

    সাত

    রত্নার ঘরে পৌঁছে কৃষ্ণা একবার চারিদিক দেখল, কিন্তু পাওয়ার মতো কিছুই নাই।

    যেদিন তাঁরা এসে পৌঁছেছেন, সেই রাত্রেই ঘটেছে এই কাণ্ড।

    মিসেস সেন রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, ”সেই রাত্রে বড় ক্লান্ত হয়ে মা আমার এই ঘরে এসে শুয়ে পড়েছিল। সকালে উঠে আর তাকে দেখতে পাইনি। সকালেই পুলিশে খবর দেওয়া হয়েছিল; পুলিশ এল, তদন্তও করল। কলকাতা শহরের মধ্যে একটা বাড়ির দোতলা হতে মেয়েকে কেমন করে ঘুমন্ত অবস্থায় চুরি করে নিয়ে যায়, আমি তাই ভেবে ঠিক করতে পারছিনে!”

    কৃষ্ণা ততক্ষণ তীক্ষ্ননেত্রে চারিদিক দেখছিল। ঘরের সামনে রেলিং দেওয়া বারান্দা,-নীচে বাগান, বাগানে নানারকম ফুলগাছ।

    কৃষ্ণার ঘরের জানালা হতে এ-সব দেখা যায় না, বাগানও দেখা যায় না। এর ঠিক বিপরীত দিকে গলিপথের ওপাশে কৃষ্ণার বাড়ি। ওপাশের ঘরগুলো চোখে পড়ে।

    কৃষ্ণা রত্নার ঘরের বাইরে বারান্দায় এল। প্রকাণ্ড বড় বারান্দা এধার হতে ওধার পর্যন্ত চলে গেছে। কৃষ্ণা রেলিং দেখতে দেখতে চলল কোণের দিকে। গিয়ে সে থমকে দাঁড়াল। সেখানকার রেলিংটা খানিকক্ষণ লক্ষ করে সে নীচের বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়ল।

    মিসেস সেন উৎকণ্ঠিত ভাবে বললেন, ”কিছু কি বোঝা যাচ্ছে মা?”

    কৃষ্ণা একটু হেসে বললে, ”সবই জানাব কাকিমা; এখান হতে নীচে যাওয়ার সিঁড়ি আছে কি?”

    মিসেস সেন উত্তর দিলেন, ”না, সিঁড়ি ওদিকে বারান্দা ঘুরে গেলে পাওয়া যাবে।”

    কৃষ্ণা বলল, ”আমি একবার নীচে বাগানে যাব, আপনার একজন ঝিকে বলুন না আমার সঙ্গে যেতে।”

    মিসেস সেন বললেন, ”আমিই যাচ্ছি।”

    হাসিমুখে কৃষ্ণা বললে, ”আপনি আর যাবেন কেন কাকিমা? আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দেখুন, আমি ফিরে এসে সব বলছি।”

    দাসীর সঙ্গে সে নীচে বাগানে চলে গেল।

    নীচে এসে সে বুঝল তার অনুমান সত্য; সে যা সন্দেহ করছে, তাতে তার ভুল হয়নি। সে বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না যখন ঘুমিয়ে পড়েছিল, দুর্বৃত্তেরা সেই সুযোগে কোনো ঔষধ দিয়ে তাকে অজ্ঞান করেছিল; তারপর বারান্দা হতে যে কোনো রকমে রেলিংয়ের ওপর দিয়ে তাকে নীচে বাগানে নামানো হয়, রেলিংয়ের লোহার গায়ে তখনো একগোছা চুল ছিঁড়ে আছে, কৃষ্ণা সন্তর্পণে সেই চুলের গোছা নিজের ব্যাগে পুরে রাখল।

    কৃষ্ণা বুঝল-সিঁড়ি দিয়ে আনার সাহস চোরদের হয়নি; কারণ, ও-দিককার বারান্দায় আলো জ্বলছিল এবং সিঁড়ি দিয়ে লোক ওঠা-নামা করছিল। তা ছাড়া নীচের ফুলবাগানেও লোক ছিল; তারাও নিশ্চয়ই তিন-চারজন লোক হবে।

    কৃষ্ণার বুঝতে দেরি হল না যে, এরা রত্নার অচেতন দেহটাকে ধরে মাটিতেও নামিয়েছিল। সে জায়গায় ছোট ফুলগাছগুলোর মধ্যে কতকগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে গেছে, কতকগুলো তাজা থাকলেও মাটির ওপরে কাত হয়ে পড়েছে।

    বাগানের মধ্যে একদিকে একটিমাত্র ছোট দরজা আছে। দাসীর মুখে শোনা গেল- ঘটনার পরদিন সকাল বেলায় এই দরজা খোলা পড়ে ছিল, সে ওপরের বারান্দা হতে দেখতে পেয়ে বন্ধ করে গেছে।

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”দরজার কথা তুমি পুলিশকে, মানে ব্যোমকেশবাবুকে বলেছিলে কি?”

    দাসী মাথা নেড়ে বললে, ”না, বলা হয়নি। আমি বলতে গিয়েছিলুম, কিন্তু আমি যতবার বলতে গেলুম,-তাঁরা কেউ কান দেননি।”

    কৃষ্ণা শুধু একটা শব্দ করল,-তারপর নিঃশব্দে দরজার দিকে এগিয়ে চলল।

    দরজাটা খুলতেই একটা গলিপথ চোখে পড়ে। গলিপথে খানিকটা গেলে বড় রাস্তা পাওয়া যায়।

    কৃষ্ণা বেশ বুঝল অচৈতন্যা রত্নাকে যে কোনো কৌশলে হোক রেলিং টপকে নীচে নামানো হয়েছে-সেখান হতে এ পর্যন্ত বয়ে আনা তাদের পক্ষে অসম্ভব হয়নি। ব্ল্যাক-আউটের রাত্রে হঠাৎ কিছু চোখে পড়ে না। সন্ধ্যা হতে রাত দশটা পর্যন্ত মৃদুভাবে আলো জ্বললেও তারপর অন্ধকারের রাজত্ব। হিসাব করে দেখা গেল, যে রাত্রে রত্না অপহৃতা হয়েছে সেটা শুক্লা তৃতীয়ার রাত্রি ছিল। চাঁদ কিছুক্ষণের জন্য উঠে ডুবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাঢ় অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছিল। পথে গলির মুখে মোটরখানা দাঁড়িয়ে থাকলেও তাতে নিশ্চয়ই এমন কিছু চিহ্ন ছিল, যা দেখে পাড়ার কোনো লোক বা পুলিশ দৈবক্রমে এসে পড়লেও সন্দেহ করতে পারেনি।

    কিছুদিন আগে কাছাকাছি যদুবাবুর বাজারের কাছে ধনী ব্যবসায়ী রামচাঁদ তেওয়ারির বাড়িতে সাংঘাতিক ডাকাতি হয়েছিল। সেখানে খানিক দূরে যে গাড়িখানা দাঁড়িয়ে ছিল, তাতে নাকি ডাক্তারের রেড ক্রশ চিহ্ন আঁকা ছিল; সেই জন্যই কেউ সন্দেহ করতে পারেনি।

    একমাত্র ডাক্তারের সাত খুন মাপ-এই ডাকাতের দল সে কথা জানে; এবং জানে বলেই এরা হয়তো এখানেও সেই রকম কোনো রেড ক্রশ চিহ্ন ব্যবহার করেছিল।

    কৃষ্ণা ফিরে এল।

    বিষণ্ণ মুখে সে বললে, ”কোনো ঠিকানা পেলুম না কাকিমা-বাগানের ওই দরজা-পথে তাকে নিয়ে গেছে, মোটামুটি এইটুকু শুধু জানলুম। পথের ওপর মোটর ছিল, তাতে করে রত্নাকে নিয়ে গেছে, এইটুকুও বোঝা গেল।”

    মিঃ সেন এই সময় অন্তঃপুরে এসে দাঁড়ালেন, বললেন, ”এই কাগজপত্রগুলো পড়ে দেখ কৃষ্ণা, এতে আমার অনেক কিছু জানবার জিনিস তুমি পাবে। সব কথা সব সময় আমার মনে থাকে না, মনে কার কিছু বলতেও পারিনে। তুমি বাগান, পথ, ঘর সবই দেখে এসেছ-জানিনে, কোনো সূত্র পেয়েছ কিনা! এইমাত্র ব্যোমকেশবাবুর তার পেলুম, তিনিও রওনা হয়েছেন দ্বারভাঙা হতে। একখানা পত্রও তার সঙ্গে এসেছে, সেখানেও এই সময় পড়ে দেখ, তা হলেও কিছু জানবে। পত্রখানা তিনি আগেই লিখে পোস্ট করেছেন-তার করেছেন আজই ঘণ্টা-দুই আগে মাত্র।”

    একখানা পত্র তিনি কৃষ্ণার কাছে দিলেন-

    পত্র লিখেছেন ব্যোমকেশবাবু।

    প্রিয় মিঃ সেন-

    আপনার চাকর সুন্দরলালের সন্ধানে এখানে এসেও তাকে পেলুম না। আপনি যখন বাংলায় আসেন, সে বাড়ি যাবে বলে ছুটি নিয়েছিল এবং রওনাও হয়েছিল বললেন। আমার এখানে আসা মিথ্যে হলেও আমি তার সম্বন্ধে আরও খোঁজ নিচ্ছি। আপনাকে জানাচ্ছি, আপনার কোনো দাস-দাসী এখন ছুটি চাইলেও যেন তা না পায়। ইতি-

    পত্রখানা ফিরিয়ে দিয়ে কৃষ্ণা একটু হেসে বললে, ”কাকাবাবুর সব তাইতেই বাড়াবাড়ি, এখানকার তদন্ত আগে করা উচিত। যাই হোক, তিনি ফিরলেও আপনি তাঁকে জানাবেন না আমি তদন্ত করছি। আমার সম্বন্ধে কোনো কথাই কাউকে জানানোর দরকার নেই।”

    কাগজপত্রগুলো সে মিঃ সেনের হাত হতে নিয়ে বললে, ”এগুলো আমি দুপুরে নিশ্চিন্ত ভাবে দেখব কাকাবাবু! আশা করছি, এগুলো পড়েই আমি সব জানতে পারব। আর একটা কথা-রত্নার একখানা ফটো আমায় দেবেন; আর সেই মুক্তোর মালা-তার সম্বন্ধে কিছু বললেন না তো?”

    মিসেস সেন বিরক্তিপূর্ণ কণ্ঠে বললেন, ”চুলোয় যাক মুক্তোর মালা! আগে রত্নার খোঁজ হোক, তারপর আর সব-তোমার মুক্তোর মালাই বল আর উইল-পত্রই বল।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞসা করলে, ”উইল-পত্র কিসের?”

    মিঃ সেন বললেন, ”উইল-পত্র নয়, মুক্তোর মালাটাই আসল জিনিস। এর দাম এ পর্যন্ত কেউ ঠিক করতে পারেনি, তাই এর পরিচয় যারা পেয়েছে, তাদের লোভ দুর্বার। যে কোনো রকমে এই মুক্তোর মালা তারা হস্তগত করবেই-এই তাদের পণ। কোনো রকমে এই মালা আমার হাতে এসে পড়েছিল। যতদিন করাচিতে ছিলুম, এর সন্ধান কেউ ঠিক না জানলেও, এটা কোথায় তারই অনুসন্ধান চলছিল। এখন বুঝতে পারছি, ওরা আমার পিছনে পিছনে এখানে এসেছিল; সেইদিন রত্নার গলায় ছিল সেই মুক্তোর মালা, সেই মুক্তোর মালা সুদ্ধ সে অপহৃত হয়েছে।”

    তিনি দুই হাতে মাথার চুলগুলো ধরে টানছিলেন-তাঁর মুখখানা রক্তবর্ণ হয়ে উঠেছিল।

    তাঁর অবস্থা দেখে কৃষ্ণা তাঁকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহসী হল না।

    তাঁদের কাছ হতে বিদায় নিয়ে সে নীচে নেমে এল; কিন্তু বাইরে ফিরে এসে প্রণবেশকে সে দেখতে পেলে না। দারোয়ানকে জিজ্ঞাসা করে জানলে প্রণবেশ একজন বাবুর সঙ্গে আগেই কোথায় চলে গেছেন!

    কৃষ্ণা দারোয়ানকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরল।

    আট

    কৃষ্ণা মিঃ সেনের ইতিবৃত্ত পড়তে শুরু করে।

    ”সমস্ত কথা লিখে রেখে যাচ্ছি। যদি হঠাৎ আমার মৃত্যু হয়, আমার স্ত্রী-কন্যা জানতে পারবে। মৃত্যু অর্থে আমি স্বাভাবিক মৃত্যু বলছিনে-আমি নিহত হব এবং সর্বদা আমি এই আশঙ্কাই করছি। আমি ধনী, আমি বিখ্যাত ব্যবসায়ী; আমার ব্যবসাক্ষেত্র শুধু করাচি নয়, কেবল দিল্লি-কলকাতা নয়, আমার ব্যবসাক্ষেত্র নিউইয়র্কে আছে, ইংল্যান্ডে আছে, কেপ টাউনে আছে।

    উপস্থিত আমি সব ব্যবসাক্ষেত্র হতে সরে দাঁড়িয়েছি, কেবল কলকাতার ব্যবসা রাখব এবং এখন হতে কলকাতায় নিজের বাড়িতেই থাকব। আমি এখন হতে সকলকে জানিয়ে রাখছি রত্নার বিয়ে দিতে হবে, তার জন্যে আমায় বাংলায় থাকতে হবে। আর একমাত্র মেয়েকে বাংলায় রেখে আমি বা অমলা এত দূর দেশে থাকতে পারব না, এ কথা সবাই বুঝবে।

    আজ মনে পড়ছে আমার প্রথম জীবনের কথা। পঁচিশ বছর আগে, কুড়ি বছরের তরুণ যুবক আমি; সেদিন একা নিঃসম্বল অবস্থায় বহুদূরে যাত্রা করেছিলাম। ম্যাট্রিক পাশ করেছিলাম-ছোটবেলা হতে ব্যবসার দিকে দৃষ্টি ছিল; আর পড়তে চাইনি বলে বাবা আমায় বাড়ি হতে চলে যেতে বলেছিলেন।

    নিঃসম্বল অবস্থায় এসে পৌঁছালাম দিল্লিতে, সেখান হতে এলাম লাহোরে; এখানে এসে কি ভাবে যে আমার অদৃষ্ট ফিরে গেল, সে কথা আজ গোপনই থাক।

    আমার ম্যানেজার ছিল মোহন সিং।

    লোকটা যে কি প্রকৃতির ছিল, তা আজ বলতে পারব না। আমাকে দিয়ে সে অনেক কাজ করিয়েছে, সে সব কথা লিখতে আজ আমার লেখনী অবশ হয়ে পড়ে। কিন্তু এ সব কথা আজ থাক। মোহন সিং আজ পরলোকে-আমার কাজের কেউ আজ সাক্ষী নাই!

    আমার পিছনে ঘুরছে পান্না সিং-মোহন সিংয়ের উত্তরাধিকারী। বহু কষ্টে আমি যে মুক্তোর মালা সংগ্রহ করেছি-যার মূল্য আজও নিরূপিত হয়নি, তার দাবি নিয়ে সে একদিন এসেছিল; আমি অপমান করে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছি। সে আমায় শাসিয়ে গেছে-এ মুক্তোর মালা সে নেবেই।

    কিন্তু জীবন থাকতে এ মালা আমি দিতে পারব না। কাগজ-পত্র যা কিছু ছিল সব আমি পুড়িয়ে ফেলেছি। আমার অবর্তমানে এ মালার অধিকারিণী হবে আমার স্ত্রী অমলা। সে যদি ইচ্ছা করে, এ মালা রত্নাকে দিতে পারে।”

    লেখাটা এইখানেই শেষ। এর সঙ্গে কয়েকখানা পত্র ছিল, কৃষ্ণা একখানা খুলল।

    পত্র লিখছে পান্না সিং-লাহোর হতে পত্র আসছে। সে জানাচ্ছে তার প্রাপ্য জিনিস তাকে দেওয়া হোক। যে মুক্তোর মালা আজ মিঃ সেন হস্তগত করেছেন, সেই মুক্তোর মালা তার পিতা কাবুলের আমিরের নিকট হতে পেয়েছেন। বাচ্চাই সাকো মোহন সিংয়ের কাজে প্রীত হয়ে এই মালা তাকে পুরস্কার দিয়েছিলেন। পিতার জিনিস পুত্র আজ পাওয়ার দাবি করে, তার জিনিস তাকে ফিরিয়ে দেওয়া উচিত।

    কৃষ্ণা আর একখানা পত্র পড়ল,-পান্না সিং লাহোর হতে লিখছে। এ পত্রে সে রীতিমতো ভয় প্রদর্শন করেছে। মালা যদি তাকে ফিরিয়ে দেওয়া না হয়, সে মিঃ সেনের সর্বনাশ করবে।

    ভ্রূ কুঞ্চিত করে কৃষ্ণা ভাবে। মিঃ সেনের পূর্বের জীবন-যাত্রা-প্রণালী কি ছিল, তা কে জানে? তিনি নিজেও তা কিছু বলতে চাননি, বরং সবই যে গোপন করে গেছেন, তাঁর লেখা পড়ে স্পষ্টই তা বোঝা যাচ্ছে।

    কাগজপত্রগুলো গুটিয়ে রেখে কৃষ্ণা প্রণবেশের খোঁজ করল, শুনলে সে এখনও ফেরেনি, কখন ফিরবে তারও ঠিক নাই।

    কৃষ্ণা একাই বার হয়ে পড়ল। ভৃত্যকে হুুঁশিয়ার থাকতে বলে মিঃ সেনের বাড়ি চলল।

    মিঃ সেন ওপরে ছিলেন-কৃষ্ণা খবর পাঠাতে তিনি তাকে ওপরে আসবার জন্য অনুরোধ করে পাঠালেন। কৃষ্ণা ওপরে চলে গেল।

    নিজের ঘরে মিঃ সেন শুয়েছিলেন, কৃষ্ণাকে দেখে উঠে বসলেন, বললেন, ”বস মা, কাগজ-পত্র সব দেখা হয়ে গেছে?”

    কৃষ্ণা বসল, কাগজগুলো তাঁর টেবিলের ওপর রেখে বললে, ”হ্যাঁ সব পড়েছি কাকাবাবু! কিন্তু অনেক কিছু বুঝতে পারলুম না। বেশ বুঝছি আপনি আগেকার মতো স্বচ্ছন্দে কারও সঙ্গে মিশতে পারছেন না, কি যেন গোপন করে যাচ্ছেন, কাউকে জিজ্ঞাসা করতেও পারছেন না এবং সেই জন্যে আমার হাতে সব ভার দেওয়া সত্ত্বেও আপনি কোনো কথা বলতে পারলেন না! বলুন, আমার অনুমান সত্য কিনা?”

    মিঃ সেন যেন হেসে কথাটা উড়িয়ে দিতে চান। তিনি বললেন, ”হ্যাঁ, কিছু কিছু গোপন করতে হয়েছে-জীবনের সব কথা বলা যায় না। তবে এ কথা সত্য মা, এতবড় আঘাত সইবার মতো পাপ আমি করেছি। মুক্তোর হারের কথা যা পড়েছ, তার সম্বন্ধে আমি যা বলছি শোন।

    একসময় আফগানিস্থানে যে ষড়যন্ত্র চলে, যার জন্যে মহানুভব আমানুল্লা এবং রানি সুরিয়া নিজেদের দেশ হতে নির্বাসিত হয়ে পরের দেশে নিতান্ত সাধারণের মতো জীবনযাত্রা নির্বাহ করতে যান, তা তুমি নিশ্চয়ই পড়েছ। তারপর বিদ্রোহীরা বাচ্চাই সাকোকে আফগানিস্থানের সিংহাসনে বসায়। কেউ বলে সে ভিস্তিওয়ালার ছেলে-কেউ বলে সে একজন বিখ্যাত ডাকাতের দলের সর্দার।

    সর্দার হোক বা নাই হোক, সে যে সত্যই একজন ডাকাত ছিল এবং আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান, খাইবার পাস প্রভৃতি জায়গায় ডাকাতি করে বহু অর্থ সংগ্রহ করেছিল, এ-কথা তো সেদিনকার কাহিনি পড়ে অস্বীকার করতে পারবে না মা! যে কয়দিনই সে আমিরের তক্তে বসে থাক, সেই কয়দিনের কাহিনিই যে বিচিত্র!”

    অধৈর্য হয়ে কৃষ্ণা বললে, ”সে সব জানি কাকাবাবু, কিন্তু তার সঙ্গে আপনাদের সম্পর্ক কি, শুধু সেইটাই জানতে চাই।”

    থতমত খেয়ে মিঃ সেন বললেন, ”সম্পর্ক কিছু আছে বই কি!-তবে সে আমার সঙ্গে নয়, আমার ম্যানেজার মোহন সিংয়ের সঙ্গে ছিল, আর তার ছেলে পান্না সিংয়ের সঙ্গে হয়তো আজও আছে। মোহন সিং হিন্দু হলেও, বাচ্চাই সাকোর দক্ষিণ হাত ছিল। পান্না সিং প্রকাশ্যভাবে না মিশলেও, পিতার সম্পত্তি দখল করেছিল। বাচ্চাই সাকো একটা ডাকাতিতে কোনো প্রাচীন মন্দিরের কোনো দেবতার গলা হতে একছড়া মুক্তোর হার পেয়েছিল। মোহন সিং আবার তার কাছ হতে চুরি করে দল হতে পালিয়ে আসে।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করল, ”সেই অমূল্য সম্পদ মুক্তোর মালা মোহন সিংয়ের কাছ হতে আবার আপনি পেলেন কি করে কাকাবাবু?”

    বিব্রত হয়ে মিঃ সেন বললেন, ”যদি বলি, মোহন সিং আমায় দিয়েছিল?”

    কৃষ্ণা মৃদু হেসে মাথা নাড়লে, বললে, ”এটা একেবারেই অসম্ভব হবে কাকাবাবু! সেইজন্যে আমি আপনার এ কথা বিশ্বাস করতে পারলুম না। মোহন সিং এই মহামূল্য মালা তার পুত্রকে না দিয়ে, আপনাকে দিয়েছে এবং তারপর তার পুত্র সেই মালা পাওয়ার দাবি করছে আপনার কাছে, এ যে একবারে অসম্ভব! আমি বুঝতে পারছি, আপনি বিশ্বাস করে সব কথা আমায় বলতে পারছেন না। বললে হয়তো আমি তদন্তের অনেক সুযোগ পেতুম! যাই হোক-বলুন বা নাই বলুন, আমি যখন এ কেস হাতে নিয়েছি, তখন যেমন করে পারি রত্নাকে উদ্ধার করবই।”

    এই বলে সে উঠে দাঁড়াল।

    বিবর্ণ মুখে মিঃ সেন কি বলতে যাচ্ছিলেন, তাঁকে বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বলল, ”আপনার কাছে আর কিছু জানবার আমার দরকার হবে না, সূত্র আমি পেয়েছি, এবং এইজনেই আমি আজই পাঞ্জাবে রওনা হব। আমি বুঝতে পেরেছি, এর মধ্যে অনেক গলদ আছে এবং আপনিও নির্দোষী নন। তবু বলছি, সন্তান-শোকে কাতরা একটি মাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছি; তাই কাজ আমি করে যাবই।”

    সে একটা নমস্কার করে বার হয়ে গেল। মিঃ সেন বজ্রাহতের মতোই বসে রইলেন।

    নয়

    পাঞ্জাব মেল ছুটে চলেছে।

    এই ট্রেনের একখানি সেকেন্ড ক্লাস কামরায় বসে কৃষ্ণা ও প্রণবেশ।

    স্বপ্নের দেশ পাঞ্জাব-সত্যই দেখা হবে। প্রণবেশ মনে মনে আবৃত্তি করেন-

    ”দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে

    জাগিয়া উঠিল শিখ

    নির্মম-নির্ভীক!”

    কৃষ্ণা একটা কোণে ঠেস দিয়ে চোখ মুদে বসে থাকে, প্রণবেশ জানালা-পথে বাইরের পানে চেয়ে থাকেন।

    পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগ-কত-বড় বিখ্যাত স্থান-বর্তমানে ইতিহাসের বুকেও তা রক্তাক্ষরে লেখা রয়েছে! পাঞ্জাব বহু পূর্ববর্তী যুগ হতে অগ্রবর্তীর পথে চলেছে; তার হাতে রয়েছে আলো, সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে সারা ভারতের বুকে, সারা বিশ্বের মুখে।

    বীরের দেশ পাঞ্জাব।

    কলকাতার বাসে ট্রামে ট্যাক্সিতে দেখা যায় পাঞ্জাবিদের। তারা পাগড়ি ছাড়েনি, পোশাক ছাড়েনি, হাতের লৌহ-বলয় খোলেনি, শ্মশ্রু-গুম্ফ মুণ্ডন করেনি। আজ তারা সারা দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে সামান্য-সামান্য কাজ নিয়ে, কিন্তু শতাব্দী পূর্বেও এদের এই শোচনীয় অবস্থার কথা কেউ ভাবেনি, ওরা নিজেরাও কল্পনা করেনি।

    পরের দেশের কথা বলতে, বাংলার কথা মনে পড়ে। পাঞ্জাবে বীর ছিল, তাদের বংশধরেরা আজ কলকাতার পথে ছড়িয়ে পড়েছে ড্রাইভার-কন্ডাক্টর-রূপে। আর তারা নিজেরাই বা কি? বাংলায় কি বীর জন্মেনি? চাঁদ রায়, কেদার রায়, ঈশা খাঁ, প্রতাপাদিত্য, রাজা গণেশ, মিরকাশিম, সিরাজদ্দৌলা প্রভৃতির বংশধরেরা আজ কোথায়? তারা কি কাজ করছে? তারা আজ কলম-পেষা কেরানি হয়েছে, একমাস কোনোরকমে ভূতের মতো খেটে, বেতনটা পকেটস্থ করে হাসিমুখে বাড়ি ফিরছে।

    প্রণবেশের রক্ত গরম হয়ে ওঠে।

    তিনি চক্ষু মুদে দেখতে পান বাংলার রণক্ষেত্র; তিনি সেখানে বীর কেদার রায়ের উত্তরাধিকারী রূপে অস্ত্রশস্ত্র সহ অবতীর্ণ হয়েছেন।

    হঠাৎ চমক ভেঙে যায়, প্রণবেশ সতর্কভাবে উঠে বসেন। তাঁর পাশে এক পাঞ্জাবি ভদ্রলোক কখন এসে বসেছেন। তন্দ্রার ঘোরে বীরত্বের অভিনয় করতে তাঁর গায়ে হাত লেগে গেছে!

    অপ্রস্তুত প্রণবেশ ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

    পাঞ্জাবি ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, ”আপনার এমন কিছু অপরাধ হয়নি বাবুসাহেব! দেখছি, আপনি বাঙালা দেশ হতে আসছেন-এতদূর ভ্রমণে মানুষের ক্লান্তি আসে, তার মধ্যে কারও গায়ে হাত-পা লেগে যাওয়া বিচিত্র নয়। যাক আপনি যাচ্ছেন কোথায়?”

    প্রণবেশ উত্তর দিলেন, ”উপস্থিত লাহোর যাব-তারপর সম্ভব করাচি যাওয়া হবে।”

    ভদ্রলোক আশ্চর্য হয়ে বললেন, ”লাহোর হয়ে আবার করাচি? বিশেষ দরকারে ঘুরতে এসেছেন বুঝি?”

    প্রণবেশ একবার কৃষ্ণার পানে তাকালেন, সে গভীরভাবে ঘুমোচ্ছে।

    দু-এক কথা হতে হতে পাঞ্জাবি ভদ্রলোকের সঙ্গে বেশ পরিচয় হয়ে গেল। তিনি পাঞ্জাবি মুসলমান, তাঁর নাম রসিদ আলি, লাহোরে তাঁর বাড়ি। ব্যবসার জন্য তাঁকে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াতে হয়, বাড়িতে থাকতে পান খুব কম সময়। প্রায় বছরখানেক পরে এই তিনি বাড়ি ফিরছেন, মাত্র এক সপ্তাহ বাড়ি থাকতে পাবেন, সামনের হপ্তায় আবার তাঁকে চলতে হবে ডেরাগাজিখাঁতে, সেখানেও তাঁর কারবার আছে।

    প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ”করাচি কোনোদিন গিয়েছিলেন?”

    রসিদ আলি সহাস্য মুখে বললেন, ”অনেকবার। ওখানে যে আমার কারখানা আছে। আজকাল মিলিটারির জন্যে অনেক কিছু সাপ্লাই করতে হচ্ছে কিনা! আমি তো এই সেখান হতেই ফিরছি! যা যুদ্ধ চলছে, এতে সকলকেই বিপর্যস্ত করে ফেললে; মানুষের প্রাণ বাঁচলে তবে তো আর সব! শুনছি, জার্মানরা এদিকে আসার চেষ্টা করছে তাহলেই দফা শেষ।”

    প্রণবেশ গভীর হতাশের সুরে বললেন, ”দফা শেষ বলে দফা শেষ! ওদিকে মণিপুরের পথে জাপান যা এগিয়ে আসছে-বাংলা তো গেল বলে।”

    রসিদ আলি চিন্তিত মুখে বললেন, ”কিন্তু আমি যা শুনেছি তাতে মনে হয়, মণিপুর পর্যন্ত যারা দখল করেছে তারা জাপানি নয়, আমাদেরই ভারতবাসী। আমাদের সৈন্যেরা যুদ্ধ করছে ভারতবাসীর সঙ্গে, তারা নাকি স্বতন্ত্র একটা সৈন্যদল গঠন করেছে, এদের নেতা নাকি আপনাদের একজন বাঙালি।”

    প্রণবেশ বিস্ময়ে বললেন, ”ভারতবাসীর সঙ্গে ভারতবাসীর যুদ্ধ? কই, কাগজে পড়িনি তো। আর আমাদের একজন বাঙালি তাদের নেতা-আমাদের বাঙালি?”

    রসিদ আলি একটু হেসে বললেন, ”অবশ্য সংবাদ এখনও সত্য বলে স্বীকৃত হয়নি, কাজেই এসব কথা নিয়ে আলোচনা না করাই ভালো। আমাদের এই পাঞ্জাবের অনেক লোক ওদের সৈন্যদলে গেছে কিনা! যাক, আগে তা সরকারি ভাবে স্বীকৃত হোক, তারপর কথাবার্তা চলবে। আপনারা লাহোরে যাচ্ছেন, আমার মনে হয়, এদেশ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। লাহোরে থাকবেন কোথায়?”

    কৃষ্ণা যে এদের কথার মধ্যে কখন জেগে উঠে নিদ্রার ভানে চোখ বুজে পড়েছিল, তা প্রণবেশ জানতে পারেননি! এই সময় সে চোখ মেললে, স্পষ্ট কণ্ঠে বললে, ”আমাদের থাকবার জায়গা আছে, রসিদ আলি সাহেব।”

    তার কণ্ঠস্বরে সচকিত হয়ে রসিদ আলি তার পানে চাইলেন। বিনীত অভিবাদন করে বললেন, ”আপনি জেগেছেন! আমাদের কথাবার্তায় আপনার ঘুমটা ভেঙে গেল এজন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি, মিস, মিস-”

    কৃষ্ণা বলে দিলে, ”কৃষ্ণা দেবী।”

    রসিদ আলি তাড়াতাড়ি নিজেকে সংযত করে উচ্চারণ করলেন, ”হ্যাঁ, কৃষ্ণা দেবী, কৃষ্ণা দেবী।”

    এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ”ওখানে আমার বাড়ি আছে, পরিবারবর্গ সবই বাড়িতে আছেন। যদি অসুবিধা না হয়, আপনারা মামা-ভাগনী যে কয়দিন লাহোরে থাকবেন আমার বাড়িতে থাকতে পারেন; আতিথ্যের কোনো ত্রুটি হবে না, এ কথা আমি জোর করে বলতে পারি।”

    কৃষ্ণা তাঁকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলে না, বললে, ”উপস্থিত আমার এক আত্মীয় ওখানে আছেন, তাঁর কাছে যাচ্ছি। যদি তিনি ওখানে না থাকেন, বাধ্য হয়ে আপনার কাছে যাব রসিদ আলি সাহেব!”

    এরপর চলল নানা গল্প। ক্রমশ লাহোরও নিকটবর্তী হয়ে আসছে। রসিদ আলি নামবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন; বললেন, ”আপনার আত্মীয়ের বাড়ি কোথায় জানতে পারি কি কৃষ্ণা দেবী? ধরুন, যদি আপনারা না আসতে পারেন, আমি নিজেই যাব। বলবেন-এটা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি দেখাবে, কিন্তু তারও আগে মনে রাখবেন, আপনারা বাঙালি; আমাদের দেশে আপনারা যে কারণেই পদার্পণ করুন, আপনারা আমাদের সম্মানীয় অতিথি, আপনাদের খাতির-যত্ন না করলে আমাদের দেশের নিন্দা হবে যে!”

    কৃষ্ণা উত্তর দিলে, ”আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ রসিদ আলি সাহেব! আমি নিজেই জানিনে আমার আত্মীয় কোথায় থাকেন। স্টেশনে তাঁদের লোক গাড়ি নিয়ে এসে থাকবে এইটুকুই জানিয়েছেন তিনি। আপনার নাম প্রত্যেকে জানেন, কাজেই, দরকার হলে আপনার বাড়ি আমরাই খুঁজে বার করে নেব।”

    স্টেশনে ট্রেন থামতেই রসিদ আলি ব্যক্তসমস্ত ভাবে নিজের ছোট অ্যাটাচিকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লেন।

    কৃষ্ণাও মামার সঙ্গে নামল। কিন্তু তাঁরা কেউই জানতে পারলেন না, যখন তাঁরা একখানা ট্যাক্সি ভাড়া করে থানার দিকে অগ্রসর হলেন, তখন আর একখানা ট্যাক্সি রসিদ আলিকে নিয়ে তাঁদের পিছনে পিছনে যাচ্ছিল।

    দশ

    থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী-অমল চ্যাটার্জি। স্টেশন হতে পুলিশ লাইনের ফোন নিয়ে কৃষ্ণা অপরিচিত চ্যাটার্জিকে ফোন করেছিল। সামনা-সামনি সব কথাই হল।

    অমল চ্যাটার্জি এখানে বহুকাল আছেন, তাঁর প্রথম কাজও হয় এইখানে। রিটায়ার করবার সময়ও হয়ে এসেছে।

    মহা সমাদরে তিনি এই মেয়েটিকে নিজের বাসায় জায়গা দিলেন। সংসারে তাঁর একটি ভাইঝি ছাড়া আর কেউই নাই। তার বিবাহ দিয়ে জামাতাকে তিনি পুলিশে চাকরি করে দিয়ে নিজের বাড়িতেই রেখেছেন।

    রাত্রে গল্প চলছিল।

    মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”তুমি যে সন্ধান নিতে এসেছ মা, তার সন্ধান সবটা না হোক, কিছুটা আমি দিতে পারব আশা করছি! তুমি কি জানতে চাও, বল?”

    কৃষ্ণা বললে, ”পঁচিশ বছর আগে মিঃ সেন নামে একজন লোক দিল্লি হতে এখানে এসেছিলেন, আমি তাঁর আগেকার জীবনী জানতে চাচ্ছি।”

    ”মিঃ সেন,…মিঃ সেন…”

    মিঃ চ্যাটার্জি ভাবছিলেন। সুযোগ পেয়ে প্রণবেশ বললেন, ”বাস্তবিক কথা বলতে গেলে বলতে হয়, তাঁর কেসই আমরা নিয়েছি, তদন্তেও এসেছি এখানে। কলকাতার পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণাকে চেনেন বলেই তাকে পরিচয়-পত্র দিয়েছেন; আর যেখানেই যাক, সেখানকার পুলিশকে অনুরোধ করেছেন, যেন দরকার পড়লে সাহায্য করেন। মিঃ সেনের কাজ নিয়েও তাঁর সম্বন্ধে আমরা খোঁজ নিতে এসেছি; কারণ, তাঁর কোনো পরিচয় আমরা পাইনি।”

    কৃষ্ণা বললে, ”অথচ বুঝতে পারছি, তাঁর জীবনের প্রথম দিকটা বড় জটিল, সে জটিলতা আজও কাটেনি। মোহন সিংয়ের বাড়ি শুনেছি এই লাহোরে, তার ছেলে পান্না সিং।”

    ”মোহন সিং-পান্না সিং? রোস, রোস, এবার ঠিক পেয়েছি।”

    মিঃ চ্যাটার্জির মুখখানা উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

    ”মিঃ সেন মানে, অমলেন্দু সেন তো? মোহন সিংয়ের নাম করতেই চিনেছি। এই মোহন সিং ছিল বিখ্যাত ডাকাতের সর্দার, এখানে তার বাড়ি হলেও, এখানকার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল না বললেই হয়! সে যে কখন যাওয়া-আসা করত, তার কোনো সন্ধান আমরা করতে পারিনি।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”সে কোথায় থাকত?”

    মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”সীমান্ত প্রদেশ সে একেবারে জ্বালিয়ে দিয়েছে, যে কোনো জায়গায় তার নাম শুনতে পাবে। কেবল পুলিশ নয়, মিলিটারির লোক পর্যন্ত তাকে ধরবার চেষ্টা করেছিল, বেশি তাড়া খেয়ে সে আফগানিস্থানে পালায়। বাচ্চাই সাকোর নাম বোধহয় জান?”

    এ যেন আরব্য উপন্যাসের গল্প! কৃষ্ণা আশ্চর্য হয়ে শুনছিল আর ভাবছিল আফগানিস্থানের দুর্ভাগ্য আমির আমানুল্লার কথা।

    সে বললে, ”হ্যাঁ, সেদিন আফগানিস্থানের সম্বন্ধে পড়লুম। আগে এ ঝোঁক ছিল না। যেদিন মুক্তোর হারের কথা শুনলুম, সেইদিন আমি ওদের ইতিহাস পড়তে শুরু করি।”

    মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”দুর্ভাগ্যবশত অমলেন্দু সেন অদৃষ্ট-পরিবর্তনের সুযোগ না পেয়ে মোহন সিংয়ের সঙ্গে মেশে, আর তারা দু-জনেই আফগানিস্থানে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল। বাচ্চাই সাকোর এই পরিচয় পাওয়া যায়, সে নাকি ছিল এক চাষার ছেলে, তার বাপ কতদিন ভিস্তির কাজ করেছিল। বাচ্চাই সাকো শিক্ষার ধার দিয়েও কোনোদিন যায়নি, ডাকাতি করে সে প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করত। এর দলে লোক ছিল বড় কম নয়, এদের মধ্যে মোহন সিং আর অমলেন্দু সেন বিশিষ্ট স্থান নিয়েছিল। আমানুল্লা যখন চলে যান, বাচ্চাই সাকো কয়েকদিনের জন্যে তাঁর আসন অধিকার করেছিল, পরে অবশ্য তার শাস্তি তাকে পেতে হয়েছিল। ধরা পড়বার ভয়ে মোহন সিং আর অমলেন্দু সোজা তখন চলে যায়-করাচি।”

    তিনি থামলেন।

    প্রণবেশ অবাক হয়ে শুনছিলেন, একটিমাত্র শব্দ তাঁর মুখ হতে বার হল-”বাবা!”

    মিঃ চ্যাটার্জি একটু হেসে বললেন, ”এরা দুজনেই ছদ্মবেশে এখানে ছিল। প্রচুর অর্থ এরা নিয়ে এসেছিল ব্যবসা করতে। এখানে অমলেন্দু নাম বদলে, নাম নিলে কুমারেশ সেন, আর মোহন সিং নাম নিলে, শার্দললাল চোপরা। এদের ব্যবসা দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। শুধু বাংলা কেন, সকল দেশের লোকই এদের বিভিন্ন ব্যবসার সঙ্গে পরিচিত হল।”

    কৃষ্ণা বললে, ”হঠাৎ দুজন লোক ভুঁইফোঁড়ের মতো উঠে এত-বড় নাম-এত-বড় ব্যবসাক্ষেত্র পেতে বসল, আপনাদের তাতে এতটুকু সন্দেহ হয়নি?”

    মিঃ চ্যাটার্জি একটু হেসে বললেন, ”তাই কি হতে পারে? একটা কথা, এরা দু-জন বেশির ভাগই কখনও ইংল্যান্ডে, কখনও নিউজিল্যান্ডে, কখনও ব্রিটিশ সোমালিল্যান্ডে কাটিয়েছে; কবে যে করাচি এসেছে, কবে যে ভারতের বিভিন্ন অংশে ঘুরেছে, বহুকাল তার কোনো খোঁজ পাইনি। প্রায় পনেরো বছর পরে গত বছর সঠিক সন্ধান পেয়ে, মোহন সিংয়ের নামে ওয়ারেন্ট নিয়ে যখন তাকে গ্রেপ্তার করতে গেলুম, তখন সে ইহলোকে ছিল না; শুনলুম, তার আগের দিন মাত্র সে নিহত হয়েছে।”

    কৃষ্ণা বললে, ”আর, মিঃ সেন?”

    মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”ভদ্রলোকের অদৃষ্ট ভালো। সামান্য যা প্রমাণ পেলুম, তাতে তাঁকে বড় জোর ধরে হাজতে দেওয়া চলে, দ্বীপান্তর বা ফাঁসি দেওয়া যায় না। তারপরে তাঁকে নাড়তে আর সাহস হল না। বিরাট ধনী লোক, শেষটায় তাঁকে ধরতে গিয়ে, নিজেই যদি বিপদে পড়ি!

    একমাত্র আমিই তাঁর প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত কাহিনি জানি। আমি বলতে গেলেও আমার কথা যে কেউ বিশ্বাস করবে না, তা আমি জানতুম বলেই বলিনি। কিন্তু একটা কথা আমি বলে রাখি, আইন মোহন সিংয়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াক, যত খুশি প্রমাণ তুমি সংগ্রহ কর, আমি বলব, সে ছিল অমলেন্দুর হাতের পুতুল মাত্র। বুদ্ধি-চাতুর্যে তোমাদের মিঃ সেন অনেক ওপরে চলেন।”

    একটা নিশ্বাস ফেলে কৃষ্ণা বললে, ”বুঝেছি, সেইজন্যেই তিনি একটি কথাও বললেন না। নিজের এত-বড় ক্ষতি হল তবু তিনি সত্য কথা আমাদের জানালেন না!”

    মিঃ চ্যাটার্জি একটু হাসলেন; বললেন, ”কি করে জানাবেন? তাহলে যে তাসের ঘর খসে পড়বে! এক কথায়-সমস্ত যাবে, অবশেষে আজীবনের জন্যে জেল খাটতে হবে! সে যা হোক, তোমাদের যা কিছু কাজ, তা এইখানেই হবে, সাতদিনে তোমরা অনেক সন্ধান পাবে। মোহন সিংয়ের ছেলে পান্না সিংয়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে, তাকেও আমরা খুঁজছি-পাইনি। তার বিরুদ্ধে অপরাধ গুরুতর; সে আফগানিস্থানে কাজ করেছে, তার জন্যে-যদি সে ভারতে আসে, তাহলে তাকে ধরে ওদের হাতে দিতে হবে, ভিন্ন রাষ্ট্র ওর বিচার করবে। শুধু তাই নয়, সে রাজদ্রোহী, জার্মানির গুপ্তচর, সম্প্রতি তারও প্রমাণ পেয়েছি।”

    এগারো

    মিঃ চ্যাটার্জির ভাইঝি প্রতিমা সেদিন কৃষ্ণাকে নিয়ে লাহোরের দ্রষ্টব্য জিনিসগুলো দেখতে যাওয়ার কথা বললে।

    মিঃ চ্যাটার্জি মত দিলেন; বললেন, ”আমি থানা হতে দু-জন কনস্টেবলকে পাঠাব, তারা তোমাদের সঙ্গে থাকলে ভালোই হবে। প্রণবেশবাবু যাবেন কি?”

    প্রণবেশ মাথা নাড়লেন, ”না, আমি ওদের সঙ্গে যাব না, আমি আপনাদের সঙ্গে থানায় যাই।”

    তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে প্রতিমা কৃষ্ণাকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল। কৃষ্ণার লাহোরে আর থাকার দরকার ছিল না। মিঃ সেনের সম্বন্ধে সে অনেক কিছু জানতে পেরেছে।

    মিঃ চ্যাটার্জির ডাইরি সে দেখেছে, তাতে মিঃ সেনের সম্বন্ধে অনেক কিছু লেখা ছিল।

    প্রথমেই ছিল পরিচয়।

    ”নাম-অমলেন্দু সেন, কলকাতায় বাড়ি, ভাগ্যান্বেষণে এসেছে লাহোরে। শুনলাম, প্রথমে নাকি দিল্লিতে গিয়েছিল। মোহন সিংয়ের সঙ্গে এইখানে তার পরিচয় হয় এবং সে মোহন সিংয়ের নির্দেশমতো লাহোরে তার বাড়িতে এসে থাকে।

    তখন পান্না সিংয়ের বয়স বোধহয় তিন-চার বছর হবে। সে আজ পঁচিশ বছর আগেকার কথা। সে লোকটা আশ্চর্য রকম ভোল ফিরিয়েছে, আজ তার চেহারা দেখে কেউ তাকে চিনতে পারবে না। পরিচয় না পেলে, আমিই চিনতে পারতুম না! পনেরো বছর পরে প্রথম তাকে দেখলুম করাচিতে-তার স্ত্রীকেও দেখলুম; একটি মেয়ে হয়েছে, তাকেও দেখা গেল।”

    এর পর-পৃষ্ঠায় লেখা :

    ”মোহন সিং নিহত হয়েছে। করাচিতে তার নাম হয়েছিল মিঃ চোপরা, এই নামেই সে পরিচিত ছিল। সে লাহোরে নিজের বাড়িতে এসেছিল ছদ্মবেশে, এইখানেই কে তাকে হত্যা করেছে! দীর্ঘদিন পরে তাকে দেখলুম। কেউ তাকে চিনতে পারেনি, তার আত্মীয়-স্বজন তাকে চিনলেও, না-চেনবার ভান করেছে। তার পুত্র পান্না সিং প্রথমটা শবদেহ দেখে চমকে উঠেছিল, তারপরই দৃঢ়কণ্ঠে জানালে সে একে চেনে না। আমি চিনলেও আমার কথা সত্য বলে প্রমাণিত হল না।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করেছিল, ”পান্না সিং এখানেই ছিলেন তো?”

    মিঃ চ্যাটার্জি উত্তর দিয়েছিলেন, ”হ্যাঁ, এখানেই ছিল। লোকটার উপর পুলিশের সন্দেহ পড়েছে, সে একজন গুপ্তচর; তা ছাড়া পিতার গুণ তারও আছে; পেলে তাকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে-তাকেও আমরা খুঁজছি।”

    কৃষ্ণার মনে পড়েছিল, মিঃ সেন যেদিন তাদের বাড়ি গিয়েছিলেন, সেদিন একজন লোক তার সঙ্গে দেখা করেছিল এবং নিজেকে এক রাজার কর্মচারী নামে পরিচয় দিয়েছিল, সে কথাটা বলতে গিয়ে সে চেপে গেল।

    এখানে আসবার সময় রসিদ আলি নামে যে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তার কথা সেদিন সে তুলেছিল।

    ”আপনি রসিদ আলি নামে কোনো ভদ্রলোককে চেনেন? তাঁর চেহারা দেখে আর কথাবার্তা শুনে তাঁকে বেশ সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভব বলেই মনে হয়। আমাদের তিনি নিজের বাড়িতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, বাড়ির ঠিকানাও আমাকে দিয়েছেন।”

    মিঃ চ্যাটার্জি উত্তর দিয়েছিলেন, ”আমি নাম শুনে ঠিক চিনতে পারছিনে, দেখলে হয়তো চিনতে পারব। যতদূর সম্ভব, মনে হয় এ নামে কেউ এখানে নেই! আমার বোধ হয় এসব পান্না সিংয়ের কারসাজি।”

    এরপর কৃষ্ণা এ সম্বন্ধে আর কোনো কথা বলেনি।

    দু-জন কনস্টেবল তাদের সঙ্গে চলল। নিশ্চিন্ত হয়ে প্রণবেশ মিঃ চ্যাটার্জির সঙ্গে থানায় গিয়ে বসলেন।

    মিঃ চ্যাটার্জি গল্প করেন, তাঁর দীর্ঘ কার্যকালের মধ্যে কতবার তাঁকে কত বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে!

    প্রণবেশ জিজ্ঞাসা করলেন, ”আপনি বাংলায় বহুদিন যাননি বোধহয়?”

    হিসাব করে মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”বহুদিন, আজ বোধহয় তেইশ বছর আমি বাংলা ছাড়া। এইবার পেনশান হলে বাংলায় গিয়ে থাকব, এদেশে থাকতে আর ভালো লাগছে না।”

    প্রণবেশ বাংলার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন! তেইশ বৎসর আগেকার বাংলার সঙ্গে বর্তমান বাংলার তুলনা করেন, ”দেখুন, সেদিনকার বাংলা আর আজকের বাংলায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য। কেউ ভাবতে পারেনি, বাংলাদেশের লোকেরা সত্যি মানুষ হবে!

    মনে করুন একদিনের কথা-একজন ইংরেজ বলেছিলেন, বাঙালি ভীরু, বাঙালির ঘরমুখো টান, বাঙালি পরিশ্রম করতে পারে না। আজকের বাঙালিকে যদি তিনি দেখতে পেতেন নিশ্চয়ই এক হাজার বার কান মলতেন, এ কথা ঠিক।”

    মিঃ চ্যাটার্জি চোখ মুদে বাংলার রূপ কল্পনা করেন।

    সন্ধ্যার মৃদু অন্ধকার তখন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। মিঃ চ্যাটার্জি উঠলেন, বললেন, ”এতক্ষণ ওরা ফিরেছে, চলুন, বাড়ি যাওয়া যাক।”

    বাড়িতে ফিরে খবর পাওয়া গেল, এখনও কেউ ফেরেনি।

    উদ্বিগ্ন ভাবে মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”ফেরেনি কি রকম কথা? এদের বলে দেওয়া আছে, সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরতেই হবে। বিপদ চারিদিকে তো বড় কম নয়! এইজন্যেই আমি নিজে ছাড়া আর কারও সঙ্গে এদের পাঠাইনে। আজ নেহাৎ ওদিকে জরুরি কাজ ছিল, তাই যেতে পারিনি। ভালোয় ভালোয় এরা এখন ফিরলে বাঁচি!”

    প্রণবেশও বিলক্ষণ চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন; বললেন, ”একবার খুঁজে দেখলে হত না?”

    মলিন হেসে মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”ক্ষেপেছেন! এত বড় শহরটায় কোথায় খুঁজব তাদের? দেখি আর ঘণ্টাখানেক, তারপর পুলিশের সাহায্য নিতে হবে।”

    কলকাতা হলে প্রণবেশ বার হয়ে পড়তেন, কিন্তু বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, পথঘাট পর্যন্ত চেনা-জানা নাই। বিষণ্ণ মুখে একখানা বই টেনে নিয়ে বসলেন তিনি।

    মিঃ চ্যাটার্জি আর খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে উঠলেন, বললেন, ”আমি একবার বার হচ্ছি প্রণবেশবাবু! আপনি বাড়িতে থাকুন, কোথাও যেন যাবেন না! ফিরতে হয়তো আমার দেরি হবে, আপনি খাওয়া-দাওয়া করে নেবেন।”

    প্রণবেশ বললেন, ”আমায় নিয়ে চলুন না আপনার সঙ্গে।” মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”অনেক ভেবেই আমি আপনাকে সঙ্গে নিতে চাচ্ছিনে প্রণবেশবাবু! যদি ওরা ফেরে, আপনি তখনই থানার নম্বরে ফোন করলে আমি জানতে পারব, সেই জন্যেই বিশেষ করে আপনাকে রেখে গেলুম।”

    তিনি তাড়াতাড়ি বার হয়ে গেলেন।

    বারো

    গাড়ি আস্তে আস্তে চলছিল।

    দর্শনীয় স্থানগুলি দেখে ফেরবার সময় প্রতিমা বলল, ”একমাইল দূরে একটা বাগান আছে, শুনছি, সেটা নাকি দেখবার মতো। সেটা দেখে যাই, কেমন? এরপর আমার যে আর দেখা হবে, সে আশা তো নেই! কাকা কোথাও যেতে দেন না। ওঁর মনে সর্বদা ভয়, পাছে কোনো বিপদে পড়ি! পুলিশে কাজ করে করে ওঁর মনে এই আতঙ্ক জন্মে গেছে!”

    প্রতিমার আদেশে মোটর ভিন্নপথে চলল।

    চৌমাথার কাছে এসে মোটর চলতে বাধা পেলে-চারিদিকে গাড়ি, লোকজন।

    কনস্টেবল দু-জন নেমে পথ পরিষ্কার করছিল। মোটর আস্তে আস্তে চলতে চলতে বাঁ-দিককার খোলা পথ পেয়ে হঠাৎ দ্রুত চলতে শুরু করল। পিছনে বহুদূরে কনস্টেবলের চিৎকার শোনা গেল, ”এই ড্রাইভার, রোখো রোখো!”

    গাড়ি থামল না, বরং তার গতি আরো বর্ধিত হল।

    প্রতিমা চিৎকার করে উঠল, ”এই উল্লুক, কিধার যাতা হ্যায়? গাড়ি ঘুমাও।”

    ড্রাইভার তার কথায় কর্ণপাত করলে না, গাড়ি পূর্ণবেগে ছুটতে লাগল।

    প্রতিমা গাড়ির দরজা খুলতে যাচ্ছিল, বুদ্ধিমতী কৃষ্ণা তার হাত চেপে ধরল; চাপা সুরে বললে, ”তুমি করছ কি প্রতিমা? গাড়ির দরজা খুললেই কি তুমি লোকের সাহায্য পাবে? দেখছ না, গাড়ি শহর ছাড়িয়ে গ্রাম্য পথে চলেছে! এখানে পথে বেশি লোক নেই, পুলিশও নেই যে, বে-আইনি গাড়িচালানো থামিয়ে দেবে। ড্রাইভার লোকটার নিশ্চয়ই কোনো বদ মতলব আছে, সেইজন্যে কনস্টেবল দু-জন নামতেই সে ভিন্নপথে গাড়ি চালিয়েছে। চেঁচালে বা লাফিয়ে পড়লেও কোনো ফল হবে না। দেখা যাক না, আমাদের নিয়ে এ লোকটা কি করে!”

    বেচারা প্রতিমা ভরসা পায় না, ভয়ে সে কাঁপতে থাকে।

    তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কৃষ্ণা বললে, ”ভয় পাচ্ছ কেন প্রতিমা? আমার পরিচয় তো তুমি জান। সাহস আর শক্তি না থাকলে আমি এই তদন্তের ভার নিয়ে লাহোরে আসতুম না। তুমি শুনেছ তো, আমি কত বিপদে পড়েছি, বুদ্ধি করে পালিয়েও এসেছি! আমার উপর নির্ভর কর-আমি যেমন করে পারি তোমায় ঠিক তোমার কাকার কাছে পৌঁছে দেব।”

    হু-হু করে মোটর ছুটছিল। অন্ধকার বেশ ঘন হয়ে এসেছে, দূরে-দূরে আলোগুলো দেখা যাচ্ছে। এরা যে কোথায় যাচ্ছে তা কে জানে!

    আস্তে আস্তে গাড়ির গতি কমতে কমতে একসময় ঝপ করে থেমে গেল।

    কৃষ্ণা চোখ মুদে ভবিষ্যৎ ভাবছিল। নিজের জন্য সে ভয় পায় না, কিন্তু এই ছোট মেয়েটি-কতই-বা বয়স তার! বড় জোর পনেরো বৎসর হবে-এ অত্যন্ত ভয় পেয়েছে।

    ড্রাইভার নেমে পড়ে দরজা খুলে ফেললে। কর্কশ কণ্ঠে ডাকলে, ”নেমে এস।”

    গাড়ির মধ্যে কেউই নড়ল না।

    ড্রাইভার রুক্ষভাবে বললে, ”ভালো কথায় না এলে আমাদের দলের লোকেরা জোর করে টেনে-হিঁচড়ে তোমাদের নামাবে। এখানে কেউ নেই, কাজেই চিৎকার করলেও কোনো ফল হবে না, তা জান তো?”

    কৃষ্ণা চুপি চুপি প্রতিমাকে বললে, ”নেমে এস প্রতিমা, দরকার নেই এদের চটিয়ে। ওদের হাতে আমরা যখন পড়েছি, শেষ পর্যন্ত আমাদের দেখা দরকার ওরা কি করে! পালানোর পথ যখন নেই, আমাদের সহ্যই করতে হবে।”

    উভয়ে গাড়ি হতে নামল।

    এতক্ষণে বাইরের দিকে দৃষ্টি পড়ল। মোটরখানা একটা বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। মোটরের চারিধার ঘিরে বোধহয় পনেরো-কুড়িজন লোক দাঁড়িয়ে। অন্ধকারে তাদের মূর্তি স্পষ্ট দেখা না গেলেও প্রতিমা ভয়ে দুই হাতে মুখ ঢাকা দিল। সে অন্ধকারে চাইতে পারলে না।

    কৃষ্ণা সোজাভাবে দাঁড়িয়ে একবার সব দিকে চোখ বুলিয়ে নিল।

    একজন এগিয়ে এল, ”কি খবর আনোয়ার, এদের কোথা হতে আনলে?”

    ড্রাইভার আনোয়ার উত্তর দিলে, ”যেখান হতেই আনি, জেনে রেখ, সর্দারের হুকুমে এদের আনা হয়েছে। এদের নিয়ে যাও। মেয়েদের যেখানে রাখা হয়-সেইখানে রাখ। সর্দার এলে তখন যা হয় বিবেচনা করা যাবে।”

    প্রতিমা প্রায় কেঁদে ফেললে, ”কৃষ্ণাদি, এরা বলে কি? আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে?”

    কৃষ্ণা চাপা-সুরে বললে, ”চুপ-যেখানে নিয়ে যায় চল। সহজে না গেলে এরা আমাদের জোর করে টেনে নিয়ে যাবে, সেটা নিশ্চয়ই ভালো নয়।”

    উভয়ে অত্যন্ত বাধ্য ভাবে এদের আদেশমতো পিছনে পিছনে চলল। আনোয়ার কোথায় গেল তা দেখতে পাওয়া গেল না।

    কোথায় তারা যাচ্ছে তা তারা জানে না। বাড়িটার মধ্যে প্রবেশ করে একটা সুড়ঙ্গপথে তারা চলছিল। এই সুড়ঙ্গপথ কোথায় গিয়ে শেষ হবে তাই বা কে জানে!

    সামনে লোকটির হাতে একটা মশাল ছিল, সেই মশালের আলোয় কৃষ্ণা দেখলে, যে-পথ দিয়ে তারা চলেছে তার সবটাই খিলানের মতো গাঁথা। অপরিসর সরু পথ, দুই দিককার দেয়াল প্রায় গায়ে লাগে, মাথার ওপরে হাতখানেক জায়গা ফাঁক আছে মাত্র।

    চামচিকার গন্ধ পাওয়া যায়-বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ! কৃষ্ণা নাকের ওপর রুমাল চাপা দিল। উৎকট গন্ধ সে সহ্য করতে পারছিল না। মনে হয়, এই সুড়ঙ্গপথের দু-দিকে দরজা আছে এবং সে দরজা বিশেষ দরকার না পড়লে খোলা হয় না।

    প্রতিমা কৃষ্ণার হাতখানা শক্ত করে ধরেছিল, আর সে হাতখানা বরফের মতো ঠান্ডা! আর একটি কথাও সে বলেনি। কৃষ্ণা বুঝতে পারল সে কতখানি আতঙ্কিত হয়েছে।

    মিনিট কুড়ি গিয়ে সামনের লোকটি থামল, তার সামনে খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে পৌঁছোতে এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস এসে কৃষ্ণার সর্বাঙ্গে স্নিগ্ধ প্রলেপ দিয়ে গেল।

    কৃষ্ণার মনে হল, সে যেন আবার জীবন্ত জগতে ফিরে এল! মনে হল তারা একটি বাড়ির প্রাঙ্গণে এসে পৌঁছেছে। জন পাঁচ-সাত লোককে এখানে দেখা গেল। নিঃশব্দে তারা এগিয়ে চলল, তাদের পিছনে চলল কৃষ্ণা ও প্রতিমা।

    একটা অন্ধকার ঘরের মধ্যে তাদের ঠেলে দিয়ে একজন রুক্ষকণ্ঠে বলল, ”নাও, এই ঘরে এখন বিশ্রাম কর। সর্দার ফিরলে তোমাদের সম্বন্ধে যা হয় করবেন তিনি।”

    অন্ধকার ঘর-অনুভবে বোঝা যায়, মেঝেয় মাদুর বিছানো রয়েছে।

    কৃষ্ণা বললে, ”বস প্রতিমা, যেমন-তেমন করে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া যাক। সকাল হলে দিনের আলোয় দেখে তবু বোঝা যাবে আমরা কোথায় এসেছি! উপস্থিত রাতটা আমাদের এমনিভাবে কাটানো ছাড়া আর উপায় নেই।”

    প্রতিমা তার গা ঘেঁষে পড়ল। অতি কষ্টে বললে, ”এই অন্ধকারে যদি সাপে কামড়ায় কৃষ্ণাদি?”

    কৃষ্ণা একটু হেসে বললে, ”কামড়ালেও উপায় নেই ভাই! সাপই হোক, আর বাঘই হোক, তাদের সঙ্গে আমাদের থাকতেই হবে। আমার কোলে মাথা রেখে তুমি ঘুমোও; আমি জেগে আছি, কোনো ভয় নেই।”

    প্রতিমা বসে রইল, বললে, ”আমি যদি ওই বাগানটা দেখতে যাওয়ার কথা না বলতুম, তাহলে এ দুর্ঘটনা ঘটত না কৃষ্ণাদি! আমাকে এই ড্রাইভারই বলল, সুন্দর একটা বাগান আছে, কতদিন কত লোককে সে সেই বাগান দেখিয়ে এনেছে! তোমরা যখন গুরুদ্বার দেখছিলে, তখনই ড্রাইভার আমায় এ-কথা বলল। আমি এতটুকু সন্দেহ করিনি! কৃষ্ণাদি, দু-জন কনস্টেবল সঙ্গে রয়েছে, এ-রকম বিপদে পড়বার কথা আমি একটুও ভাবিনি।”

    কৃষ্ণা তার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললে, ”অবুঝ মেয়ে, এ বিপদ ঠিক ঘটতই। অনেকদিন হতে-যতদিন আমি মিঃ সেনের এই কেস হাতে নিয়েছি ততদিন ওরা প্রতিক্ষণে আমায় অনুসরণ করে ফিরছে। আমায় যে ওরা কোনোরকম বিপদে ফেলবেই-তা আমি জানি, সেইজন্যে খুব সাবধানে চলেছি আমি। আমরা যেদিন লাহোরে এসেছি, সেইদিনই ওদের লোক আমাদের সঙ্গ নিয়েছে। আমার বড় দুঃখ হচ্ছে এইজন্যে যে, আমার অবশ্যম্ভাবী বিপদের অংশ তুমি কেন নিতে এলে?”

    একটুখানি চুপ করে থেকে সে বললে, ”এই ড্রাইভার কত দিন তোমাদের কাছে কাজ করছে প্রতিমা?”

    প্রতিমা বললে, ”আমাদের পুরনো ড্রাইভার কাল হতে হঠাৎ দারুণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে, এই ড্রাইভার তারই ভাইপো। সেই একে দিয়েছে কাল হতে কৃষ্ণাদি! তখন জানতুম না যে এদের সবাই আট-ঘাট বেঁধে এই ষড়যন্ত্র করেছে।”

    বাইরে কুকুরের ঘেউ-ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছিল। কৃষ্ণা খানিকক্ষণ কান পেতে থেকে বললে, ”এটা বোধহয় ওদের বন্দিশালা। যাক, সেটা কাল সকালে দেখা যাবে এখন।”

    কৃষ্ণার নির্ভীকতা প্রতিমাকে কতকটা আশ্বস্ত করেছিল।

    তেরো

    খট-খট-খট-

    দরজার চাবি কে খুললে!

    আজ ছ-দিন কৃষ্ণা ও প্রতিমা এখানে বন্দিনী অবস্থায় রয়েছে।

    বাড়িটায় দু-খানা ছোট ছোট ঘর আছে। এর মধ্যেই তারা চলাফেরা করতে পারে। ওদিকে আরও ঘর আছে, কিন্তু মাঝখানে খুব উঁচু পাঁচিল থাকায় ও-ধারের কোনো খবর পাওয়া যায় না।

    ছোট ঘরটায় কোন সময় কে খাবার রেখে যায়! কাল হঠাৎ একজন লোককে দেখা গিয়েছিল। দুই ঘরের মাঝখানকার দরজা বন্ধ করে সে খাবার দেয়, কৃষ্ণা দরজা খুলতেই সে বার হয়ে গিয়েছিল।

    এদের মতলব কি, কৃষ্ণা বুঝতে পারে না। তাকে না হয় তদন্তে ব্যাঘাত করবার জন্য আটক করতে পারে, বেচারা প্রতিমা কি অপরাধ করেছে? এই পাঁচ দিন সে আহার প্রায় ত্যাগ করেছে বললেই হয়। তাদের খেতে দেওয়া হয় পাঞ্জাবি রুটি আর জল। এ রকম খাওয়া প্রতিমার একেবারে দুঃসাধ্য।

    এ-ঘরের দরজা কে খুলছে! কৃষ্ণা সচকিত হয়ে উঠল।

    প্রতিমা পাশে পড়ে ঘুমোচ্ছে, সে কিছুই জানল না। দরজার সামনে সর্বদা প্রহরী থাকে, কয়দিনের অভিজ্ঞতায় কৃষ্ণা তা বুঝছে। সম্ভব, সে-ই দরজা খুলে দিল।

    খোলা দরজা-পথে সকালের আলো ছড়িয়ে পড়ল অন্ধকার এই ঘরের মধ্যে।

    দরজার ওপর যে দাঁড়াল, তার পানে তাকিয়ে কৃষ্ণা আশ্চর্য হয়ে গেলেও সে-বিস্ময় সে সামলে নিল; দাঁতের ওপর দাঁত রেখে অস্ফুটে শুধু বললে, ”হ্যাঁ, আমিও তাই ভেবেছিলুম।”

    অত্যন্ত সহজ ভাবেই সে হাত দু-খানা কপালে ঠেকিয়ে বললে, ”সুপ্রভাত, রসিদ আলি সাহেব! আপনারই প্রত্যাশা আজ ক-দিন এসে পর্যন্ত করছি, ভাবছি, আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এলুম, আপনার দেখা নেই কেন?”

    তার নির্ভীক অসঙ্কুচিত ভাব দেখে রসিদ আলি সত্যই বিস্মিত হয়ে গেলেন! কোনো মেয়ে যে এ-রকম অবস্থায় পরিহাস করতে পারে, তাঁর ধারণারই অতীত। এ মেয়ের অনেক কীর্তির কথা তিনি শুনেছেন, এখন চাক্ষুষ দেখে তিনি বুঝলেন, যা তিনি শুনেছেন-কৃষ্ণার শক্তি ও সাহস তার চেয়েও অনেক বেশি।

    তিনি বললেন, ”বাস্তবিক আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি যে, তুমি এ-রকম বিপদের মধ্যেও অটুট থাকতে পার। সেই দিনই তোমাকে আমার এই কুঁড়েঘরে আনবার ইচ্ছা ছিল-তাহলে আজ পর্যন্ত যত খবর সংগ্রহ করেছ, তার কিছুই সংগ্রহ হত না এ-কথা সত্য। তবে এ-সম্বন্ধে তুমি নিশ্চিন্ত থাক কৃষ্ণা দেবী, অন্ততপক্ষে মাস-তিনেক তোমাকে আমার অতিথি হয়ে থাকতে হবে।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”এতদিন থাকতে হবে কেন?”

    রসিদ আলি বললেন, ”তুমি এমন অনেক কিছু সংগ্রহ করেছ, যেগুলো প্রকাশ করতে আমরা ইচ্ছুক নই। আমি তোমায় মুক্তি দিতে পারি একটি শর্তে। তুমি কাগজপত্র যা কিছু সংগ্রহ করেছ, সেগুলো যদি আমায় দাও।”

    কৃষ্ণা একটু হাসল-”অর্থাৎ আমার সমস্ত কষ্টটাই ব্যর্থ হয়ে যাক। শুনুন, রসিদ আলি সাহেব-”

    বাধা দিয়ে রসিদ আলি বললেন, ”আরও আগে আমার সত্যকার পরিচয় দিয়ে রাখি। আমার নাম রসিদ আলি নয়, আমার নাম-পান্না সিং। মিঃ সেন যে মোহন সিংয়ের সর্বনাশ করেছেন, পথের ভিখারি করে হত্যা করেছেন,-আমি সেই মোহন সিংয়ের ছেলে পান্না সিং।”

    কৃষ্ণা শান্তকণ্ঠে বললে, ”আমি তা জানি মিঃ সিং! আন্দাজে আমরা অনেক কিছু ধরতে পারি, শেষে সেইটাই সত্য হয়ে যায়, দেখা যায়। আমি আজ আপনার বন্দিনী,-এ আশঙ্কাও আমি কয়েকদিন আগে করেছিলুম। সেইজন্যে যা-কিছু আমি সংগ্রহ করেছিলুম, সবই নিরাপদে পাঠানো হয়ে গেছে যথাস্থানে। মিঃ সিং, আপনি কেবল একটা অপরাধেই অপরাধী নন। আপনার অপরাধের শেষ করা যায় না-তার কিছু আমি সংগ্রহ করেছি।”

    পান্না সিং মুহূর্তকাল নীরব রইলেন, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ”সে সব তুমি কোথায় পাঠিয়েছ?”

    কৃষ্ণা মৃদু হাসলে, বললে, ”একে একে সব কিছুই আপনি সংগ্রহ করতে চান দেখছি! বেশ, আমি মোটামুটি বলছি-সে-সব গেছে পুলিশের হাতে, পৌঁছোবে গভর্নমেন্টের দপ্তরে, আর খুব শীঘ্রই আপনি গ্রেপ্তার হবেন জেনে রাখুন।”

    পান্না সিং হো-হো করে হেসে উঠলেন-”বালিকা, তুমি কাকে ভয় দেখাচ্ছ জান? তুমি যে সব প্রমাণ এ-দিক ও-দিক হতে সংগ্রহ করেছিলে, সে-সব ভুল-সবই মিথ্যা। তবু তুমি যা পাঠিয়েছিলে, তা যদি সত্যই গভর্নমেন্টের হাতে পড়ত, তাহলে আমায় একটু ফ্যাসাদে পড়তে হত বটে। কিন্তু তুমিও জেনে রেখ কৃষ্ণা দেবী, পান্না সিং এত কাঁচা ছেলে নয়-সে তোমার মতো লক্ষ মেয়েকে সামান্য পিঁপড়ের মতো টিপে মারতে পারে। তুমি যা প্রমাণ পাঠিয়েছিলে, তা আমার হস্তগত হয়েছে-এই দেখ।”

    পকেট হতে তিনি কতকগুলো কাগজ-পত্র বার করে দেখালেন। বিস্মিত কৃষ্ণা দেখল, তার যা প্রমাণ সংগ্রহ সবই তিনি পেয়েছেন।

    কয়েকটা দিনের প্রাণপাত পরিশ্রমের ফল! কৃষ্ণা অধর দংশন করলে।

    পান্না সিং কাগজ-পত্রগুলো পকেটে রেখে বললেন, ”যে দিন তোমার হাতে তদন্তভার দিতে মিঃ সেন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিলেন, সেদিন আমিই আমার সহকারী সমর সিংকে তোমার কাছে পাঠিয়েছিলুম। ভেবেছিলুম, অন্ততপক্ষে বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে তোমাকে কলকাতা হতে সরিয়ে আনব, তাতে তোমারই ভালো হত কৃষ্ণা দেবী! তুমি জান না, মিঃ সেন কি প্রকৃতির লোক, তাঁর জন্যে কি শাস্তি তোলা আছে!”

    কৃষ্ণা বললে, ”আমি মিঃ চ্যাটার্জির কাছ হতে কিছু শুনেছি।”

    পান্না সিং বললেন, ”তিনি আর কতটুকু জানেন? আজ আমাকে রাজদ্রোহী বলে তুমি জান, এ কথা সত্য। আমি ভারতের অনেক খবর জাপান আর জার্মানিকে জানাচ্ছি। তোমার কাছে অস্বীকার করব না-এসব সত্য। আমাকে এ পর্যন্ত কেউ সন্দেহ করতে পারেনি-হয়তো পারতও না, যদি না তুমি আসতে। আমার দলে বহু লোক আছে, যারা চুরি, ডাকাতি, নরহত্যা করতে ইতস্তত করে না।”

    কৃষ্ণা শান্ত-কণ্ঠে বললে, ”তা জানি আমি।”

    পান্না সিং জোর করে বললেন, ”না, তুমি তা জানতে না-কেবল মাত্র সন্দেহ করেছিলে। রসিদ আলি নাম নিয়ে আমি বরাবর কলকাতা হতে তোমাদের সঙ্গে এখানে এসেছি। মিঃ চ্যাটার্জির বাড়িতে তোমাদের কখন কি কথাবার্তা হত তাও আমি সব শুনেছি। আমার দৃষ্টি এড়িয়ে তুমি চলতে পারনি কৃষ্ণা দেবী! তবে হ্যাঁ, এ কথা আমি স্বীকার করব, তোমার শক্তি আছে, তোমার সাহস আছে। তোমার সম্বন্ধে আমি সব ব্যবস্থা ঠিক করে রেখেছি। তোমায় আমি সহজে ছাড়ব না, কারণ, তুমি আমাদের দলের অনেক কথা জেনে ফেলেছ।”

    কম্পিত কণ্ঠ যথাসাধ্য সংযত করে কৃষ্ণা বললে, ”আপনি যে দস্যু দলপতি, রাজদ্রোহী-এ সন্দেহ অনেকেই করে।”

    পান্না সিং বললেন, ”করে, কিন্তু সাহস করে এ কথা বলতে পারে না, কারণ, দেশে সবাই আমায় চেনে। আমার দানে অনেক কাজ হয়েছে, গভর্নমেন্ট আমায় খাতির করে। চট করে কেউ আমার নামে কোনো কথা বলবার সাহস পাবে না। কিন্তু তুমি মেয়েমানুষ হয়ে আজ ক-দিন মাত্র এসে, এ-দিক ও-দিক ঘুরে অনেক প্রমাণ সংগ্রহ করেছ এবং সে-সব পাঠাতেও গিয়েছিলে।”

    পান্না সিংয়ের মুখ লাল হয়ে উঠেছিল। বেশ বোঝা যাচ্ছিল, তিনি সহজে কৃষ্ণাকে মুক্তি দেবেন না।

    কৃষ্ণা এক মুহূর্ত নীরব থেকে বললে, ”আমি একটা কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, মিঃ সিং! এই মেয়েটি কি অপরাধ করেছে, একে কেন আটক করে রেখেছেন? একে যদি অনুগ্রহ করে কোনোরকমে পাঠিয়ে দেন, তাহলে বড় ভালো হয়। বেচারি আহার ত্যাগ করেছে। আমি নিজের জন্যে ভাবছি না, এই ছোট মেয়েটির জন্যেই ভাবনা হচ্ছে। আমি একা বেশ থাকতে পারব। দয়া করে একে যদি পাঠিয়ে দেন।”

    পান্না সিং বললেন, ”ওকে আমি রাখতেও চাই নে। ঠিক সেই কথা বলতেই আমি এসেছিলুম। কাল সকালের মধ্যে ওকে আমি পাঠিয়ে দেব। আচ্ছা, আর আমার কোনো কথা নেই, এবার আমি যাচ্ছি। তোমার যদি কোনো অসুবিধা হয় আমায় জানাতে পার।”

    ”অসুবিধা!”

    কৃষ্ণা একটু হেসে বললে, ”কোনো অসুবিধা নেই মিঃ সিং। এর জন্যে ধন্যবাদ!”

    ”আশ্চর্য মেয়ে!”

    পান্না সিং বার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ হয়ে গেল।

    চোদ্দো

    দিনের পর দিন যায়।

    দুটি মেয়েরই কোনো সন্ধান মেলে না। প্রণবেশ অস্থির হয়ে উঠলেন।

    ঠিক এমন সময় ব্যোমকেশবাবু এসে উপস্থিত হলেন। প্রণবেশকে লাহোরে দেখে তিনি একেবারে আকাশ হতে পড়লেন।

    ”আরে, প্রণবেশবাবু যে; আপনি এখানে! কৃষ্ণা কোথায়?”

    প্রণবেশ একটা দীর্ঘ-নিশ্বাস ফেললেন, বললেন, ”তাকে আর ইন্সপেক্টর মিঃ চ্যাটার্জির ভাইঝিকে আজ ক-দিন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।”

    ব্যোমকেশবাবু বিস্ময়ে বলে উঠলেন, ”সে কি? খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না-মানে?”

    প্রণবেশ সমস্ত ঘটনা বললেন।

    কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে তপ্ত কণ্ঠে ব্যোমকেশ বললেন, ”আমিও বেশ বুঝেছি, আপনারা চোরের সন্ধানে লাহোরে এসেছেন। শুনলুম এখানকার লোকেই মিঃ সেনের সর্বনাশ করেছে, নামও তিনি কয়েকজন লোকের দিয়েছেন। আগে বললে আমাকে আর চাকরদের পেছনে ছোটাছুটি করতে হত না, কোথায় দ্বারভাঙা, আর কোথায় কাঠমুন্ডু, কোথায় নদীয়া, আর কোথায় মুর্শিদাবাদ করে!

    যাই হোক, খবর যখন পেয়েছি, এবার ঠিক চোর ধরতে পারব বামাল-সমেত, সে ভরসা রাখি। আমি ভাবছি শুধু কৃষ্ণার কথা। মেয়ের সাহসও তো বড় কম নয়! বার বার বিপদে পড়ছে, তবু তার এ ঝোঁক কাটল না? আরে, গোয়েন্দাগিরি কি সবার ধাতে পোষায়? এ-সব পুরুষের কাজ-মেয়ে হয়ে তুই করতে আসিস কেন?”

    প্রণবেশ কৃষ্ণাকে চেনেন-ব্যোমকেশবাবুর কথা তাঁর অসহ্য মনে হয়।

    সেদিন রাত্রি তখন বারোটা-

    মিঃ চ্যাটার্জি ঘুমিয়ে পড়েছেন, প্রণবেশ তখনও বই পড়ছেন।

    সদর দরজায় করাঘাত শোনা যায়, কে যেন ডাকছে, ”কাকা-কাকাবাবু?”

    প্রণবেশ, মিঃ চ্যাটার্জিকে ডাকতেই তিনি ধড়মড় করে উঠে পড়লেন।

    গভীর রাত্রে ফিরেছে প্রতিমা, কৃষ্ণা ফেরেনি। দরজা খোলবামাত্র সে ছুটে ভিতরে প্রবেশ করল, যেন কে তার পিছনে তাড়া করেছে!

    এই ক’দিন প্রতিমা শুকিয়ে আধখানা হয়ে গেছে, তাকে দেখে মনে হয়, যেন সে দীর্ঘকাল রোগ ভোগ করেছে। খানিকক্ষণ সে বিশ্রাম করলে, পরে মিঃ চ্যাটার্জি জিজ্ঞাসা করলেন, ”ব্যাপার কি মা? তুমি এলে, কৃষ্ণা এল না?”

    প্রতিমা কম্পিত কণ্ঠে উত্তর দিল, ”ওরা কৃষ্ণাদিকে ছাড়লে না কাকাবাবু! আজই কৃষ্ণাদিকে ওরা ওখান হতে কোথায় জানি নিয়ে গেল।”

    ”নিয়ে গেল! ছাড়ল না?”

    প্রণবেশ আর্তনাদ করে উঠলেন।

    মিঃ চ্যাটার্জি বললেন, ”আপনি শান্ত হোন প্রণবেশবাবু, আমায় আগে সব কথা শুনতে দিন।…তোমরা কোথায় ছিলে প্রতিমা?”

    প্রতিমা উত্তর দিলে, ”তা জানি নে কাকাবাবু! শহর হতে অনেক দূর, মোটরে দু-তিন ঘণ্টার পথ, সেখানে একটা বাড়িতে আমাদের আটক করে রেখেছিল। আজ সন্ধ্যাবেলায় তারা আমাকে মোটরে উঠিয়ে দিল আর কৃষ্ণাদিকে আলাদা মোটরে তুলে নিয়ে কোথায় চলে গেল, কিছু জানি নে। কৃষ্ণাদি আমায় শুধু বলে দিয়েছে, সে দু-তিন দিনের মধ্যেই হারানো মেয়েটিকে নিয়ে ফিরবে, আমরা যেন তার জন্যে না ভাবি!”

    প্রণবেশের যেন কান্না পায়!

    কি দরকার ছিল কৃষ্ণার এখানে আসার? কাজ যখন মিটে গেল, তখন ফিরে গেলেই হত!

    বেচারা প্রতিমা বেশি কথা বলতে পারে না। একটা কথা তার মুখে শোনা যায়; ডাকাতের দলের সর্দার নাকি কৃষ্ণাকে কোন সুলতানের বেগম করে দেবে, সেইজন্যেই কৃষ্ণাকে নিয়ে গেছে।

    প্রণবেশের দুটি চক্ষু জ্বলে ওঠে।

    সুলতানের হারেমে বেগম হয়ে থাকবে কৃষ্ণা? সে মেয়ে সে নয়। তার পরিচয় যে পায়নি, সে-ই এ কল্পনা করতে পারে।

    প্রতিমা বললে, ”মোটরে তোলবার সময় আর একটি মেয়েকেও আমি দেখেছি, তাকেও কৃষ্ণাদির গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে। ওদের নিয়ে ডাকাতেরা যাবে আফগানিস্থান পার হয়ে, টার্কিতে না কোথায়! সেখানে গিয়ে নাকি-”

    কথা শেষ করতে পারে না, তার চোখে জল আসে।

    নিষ্ফল আক্রোশে প্রণবেশ ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন।

    পনেরো

    মোটর ছুটে চলেছে। খাইবার পাসের পথ।

    কোথাও সরু, কোথাও চওড়া। একদিকে উঁচু পাহাড়শ্রেণি, আর একদিকে ধু-ধু করছে মাঠ।

    কৃষ্ণার পাশে একটি মেয়ে।

    এতক্ষণ বাদে সকালের আলোয় কৃষ্ণা তাকে দেখতে পেলে। বাঙালির মেয়ে দেখলেই চেনা যায়।

    ঝাঁ করে মনে পড়ে গেল, রত্নার কথা। যার সন্ধানে কৃষ্ণা লাহোরে এসেছে, এই কি সেই?

    জীর্ণ-শীর্ণ চেহারা হলেও কৃষ্ণা দেখলে, মেয়েটি সুন্দরী, বয়স বড়-জোর পনেরো-ষোলো হবে।

    গাড়ির সামনে ড্রাইভারের পাশে বসে পান্না সিং। কৃষ্ণাকে আর এই মেয়েটিকে সে টার্কিতে নিয়ে চলেছে। তাদের কথাবার্তায় কৃষ্ণা বুঝতে পেরেছে, কোথায় কোন সুলতানকে ভেট দিতে তাদের নিয়ে চলেছে।

    কৃষ্ণা অধর দংশন করলে।

    পাশের মেয়েটি তার পানে চেয়ে ছিল, সেও বোধহয় বিস্মিত হয়ে ভাবছিল-এ মেয়েটি কে?

    কৃষ্ণা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলে, ”তুমি বাঙালি-মেয়ে মনে হচ্ছে, তোমার নাম জানতে পারি?”

    তেমনই চাপা সুরে সে উত্তর দিলে, ”আমার নাম-রত্না।”

    ”রত্না?”

    কৃষ্ণার চোখ দুটি দৃপ্ত হয়ে ওঠে, ”তুমি রত্না…মিঃ সেনের মেয়ে…কলকাতা হতে এরা তোমায় চুরি করে এনেছে? আঃ, আমি যে তোমাকেই খুঁজতে এসে আরও অনেক নতুন তথ্য আবিষ্কার করে বন্দিনী হয়েছি!”

    রুদ্ধকণ্ঠে রত্না বলল, ”আপনি আমায় খুঁজতে এসেছেন? আমার বাবা আপনাকে পাঠিয়েছেন? বাবা ভালো আছেন? আমার মা?”

    বলতে বলতে তার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ল।

    ব্যস্ত হয়ে কৃষ্ণা বললে, ”চুপ, কেঁদ না। এরা এখন জানতে পারলে, তোমার যেমন বিপদ, আমারও তেমনি বিপদ হবে। সবাই ভালো আছে, তোমার কোনো ভাবনা নেই। আমি তোমার মাকে কথা দিয়ে এসেছি, তোমায় নিয়ে গিয়ে তাঁকে দেব। কিন্তু তোমায় নিয়ে যাওয়াই মুস্কিল, এই পথটা পার হলেই আফগান-সীমান্তে পড়ব, তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। এইবেলাই আমায় উপায় ঠিক করতে হবে, তাই ভাবছি।”

    রত্না উদগ্রীব হয়ে তার পানে চেয়ে রইল।

    সামনের আসনে পান্না সিং এতক্ষণ সজাগ থেকে এইবার ঝিমিয়ে পড়েছে। কৃষ্ণা আস্তে আস্তে মাথা উঁচু করে দেখলে, তার রিভলভারটা তার পাশে পড়ে আছে। লক্ষ করে বোঝা গেল, সেটা পাঁচ-ঘরা এবং প্রত্যেকটিতে গুলি ঠাসা আছে।

    ভাগ্য-পরীক্ষা…এবং এই একবারই মাত্র সুযোগ এসেছে তার। ল্যাণ্ডি-কোটাল পর্যন্ত ব্রিটিশ রাজত্বের সীমানা, তার ওধারে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা সকল স্বাধীনতা হারাবে।

    ড্রাইভার আবিষ্টচিত্তে সতর্কতার সঙ্গে মোটর চালিয়ে যাচ্ছে, আশপাশের দিকে তার দৃষ্টি ছিল না। এই সুযোগে অতি সতর্কভাবে কৃষ্ণা আস্তে আস্তে হাত বাড়ালে।

    পান্না সিং ঘুমিয়ে পড়েছে, বুঝতেও পারলে না, তার পাশ হতে কেউ রিভলভার তুলে নিলে।

    ”এই, রোখো…রোখো।”

    সোজা পথে বহুদূরে সামনের দিকে একখানা মোটর দেখা যাচ্ছিল, সম্ভবত মিলিটারি-কার। এ-পথে প্রায়ই মিলিটারি-কার আসা-যাওয়া করে।

    কৃষ্ণার কথা শুনে ড্রাইভার পিছন ফিরলে, পান্না সিংয়ের তন্দ্রাও মুহূর্তে দূর হয়ে গেল। বিস্মিত নেত্রে সে চেয়ে দেখলে, কৃষ্ণা তার পাঁচ-ঘরা রিভলভার উদ্যত করে ধরেছে।

    ”একি কৃষ্ণা দেবী!”

    কৃষ্ণা গর্জন করে উঠল, ”চুপ, এখনই গুলি ছুঁড়ব যদি গোলমাল কর। তোমারই রিভলভার, তুমি জান এতে পাঁচটা মুখ…দু-জন মানুষকে মারতে পাঁচটা গুলিই যথেষ্ট।”

    পান্না সিংয়ের কপালে কয়েকটা রেখা জেগে উঠল। কৃষ্ণা যে কথামতো কাজ করবে, তা সে জানে, তাই চুপ করে রইল।

    কৃষ্ণা ড্রাইভারকে আদেশ দিলে, ”গাড়ি ঘোরাও। নইলে ওই যে মিলিটারি-কার আসছে, ওদের কাছে আমি তোমাদের পরিচয় দেব; তাতে যে তোমাদের মঙ্গল হবে না, তা নিশ্চয়ই বুঝছ!”

    ড্রাইভার আনোয়ার দ্বিরুক্তি না করে গাড়ি ফেরালে।

    মিলিটারি-কার মোটরের পাশ দিয়ে বার হয়ে গেল।

    পান্না সিং হতাশ কণ্ঠে বললে, ”তুমি যে আমায় এভাবে জব্দ করতে পারবে কৃষ্ণা দেবী, আমি তা ভাবতে পারিনি। যাই হোক, তুমি মনে কর না, রিভলভারটা হস্তগত করেই আমায় জব্দ করতে পেরেছ, আমি-”

    বলতে বলতে হঠাৎ হাত বাড়িয়ে সে কৃষ্ণার গলাটা চেপে ধরল, কর্কশ রুক্ষকণ্ঠে বললে, ”তোমায় কুকুরের মতো হত্যা করব, তারপর তোমায় এইখানে ফেলে দিয়ে চলে যাব। আমি পান্না সিং, আমার অসাধ্য কোনো কাজ জগতে নেই। তোমায় আমি সহজে-”

    তার সবল হাতের পেষণে কৃষ্ণার দম বন্ধ হয়ে আসে।

    আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার হাতের রিভলভার গর্জন করে ওঠে-”গুডুম!”

    গুলি গিয়ে লাগল পান্না সিংয়ের বাহুতে, সঙ্গে সঙ্গে তার কঠিন পেষণ হতে কৃষ্ণা মুক্তি পেল।

    ”হল্ট!”

    কাছেই যে আর একখানা মিলিটারি-কার এসে পড়েছে এবং দাঁড়িয়ে গেছে, তা কেউই লক্ষ করেনি। তাতে যে চারজন সৈনিক ছিল, তারা একসঙ্গে বন্দুক তুলেছে, আদেশ পালন না করলেই গুলি করবে।

    মোটর থেমে গেল।

    পান্না সিং তখন চোখ মুদে বসে পড়েছে,-অজস্র রক্তস্রোতে তার দেহ ভেসে যাচ্ছে।

    মিলিটারি-কার হতে সৈনিকেরা নেমে এল।

    কৃষ্ণার পরিচয় চাইতে সে নিজের পরিচয় দিয়ে তাদের সাহায্যে লাহোর যেতে চাইলে।

    রাজদ্রোহীকে ও ড্রাইভারকে তারা বন্দী করলে। নিজেদের মোটরে কৃষ্ণা ও রত্নাকে লাহোর পৌঁছে দেওয়ার ভার গ্রহণ করলে তারা।

    ষোলো

    এর পরের কথা :

    কৃষ্ণা কলকাতায় ফিরল রত্নাকে নিয়ে। মিঃ সেন তখন শয্যাগত, বাঁচবার আশা নেই তাঁর।

    রত্নাকে বুকের মাঝে নিয়ে তিনি ঝরঝর করে চোখের জল ফেললেন, তাঁর মরতে আর কোনো দুঃখ নেই।

    সকলকে তিনি ঘর হতে বিদায় দিলেন, কৃষ্ণার সঙ্গে তাঁর অনেক কথা আছে।

    কৃষ্ণা তাঁর কাছে চেয়ারখানা টেনে নিয়ে এসে বসল।

    ক্ষীণ-কণ্ঠে মিঃ সেন জিজ্ঞাসা করলেন, ”তুমি সব শুনেছ মা?”

    কৃষ্ণা উত্তর দিল, ”সব শুনেছি কাকাবাবু। পান্না সিং হসপিটালে মারা যাওয়ার সময় সব কথা বলে গেছে। ওখানকার পুলিশও সব জেনেছে, তারা হয়তো শিগগিরই আপনার গ্রেপ্তারি-পরোয়ানা নিয়ে আসবে।”

    ”আর গ্রেপ্তারি-পরোয়ানা!”

    মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে হাসি ফুটল।

    ”আমার যেখান হতে ডাক এসেছে কৃষ্ণা, আমি সেখানে যাচ্ছি; পুলিশ আমার কিছুই করতে পারবে না। এতদিন কোনো কথা বলতে পারিনি; আমার স্ত্রী, কন্যা, কেউ কোনো কথা জানে না। তুমি অনেকটা জেনেছ বলেই তোমায় সব বলছি; কিন্তু শোনবার আগে প্রতিজ্ঞা কর, আমার স্ত্রী, কন্যা কাউকে কোনো কথা জানাবে না?”

    কৃষ্ণা বললে, ”আমি প্রতিজ্ঞা করছি কাকাবাবু!”

    একটা শান্তির নিশ্বাস ফেলে মিঃ সেন বললেন, ”তুমি শুনেছ, আমি কপর্দকহীন অবস্থায় প্রথমে দিল্লি যাই, কিন্তু লাহোরে গিয়ে আমার সৌভাগ্যলাভ হয়। মোহন সিংয়ের পরিচয় তুমি পেয়েছ। সে খাইবার পাসে ডাকাতি করত, এতে সে প্রচুর অর্থ উপার্জন করত। আমিও তার সঙ্গে যোগ দিয়ে অনেক ডাকাতি, অনেক নরহত্যা করেছি। একবার ধরা পড়বার সম্ভাবনায় আমরা আফগানিস্থানে পালাই, সেখানে বাচ্চাই সাকোর সঙ্গে আমরা যোগ দিই। বাচ্চাই সাকো যখন দণ্ডিত হয়, তার অসীম ধন-সম্পত্তি নিয়ে আমরা পালিয়ে আসি আবার ভারতবর্ষে।

    তারপর করাচিতে ছদ্মবেশে ছদ্মনামে আমরা ব্যবসা খুলি; এই ব্যবসাক্ষেত্র ক্রমে দেশ-বিদেশে প্রসারিত হয়। পুলিশ আমাদের সন্দেহ করেছিল; বিশেষ করে লাহোরে ইনস্পেক্টার মিঃ চ্যাটার্জি কিছুদিন আমাদের পিছনে ঘুরেছিলেন, কিন্তু আমাদের ধরতে পারেননি।

    যে মুক্তোর মালা নিয়ে এত গোলমাল, সেই মালা নিয়েই মোহন সিংয়ের সঙ্গে আমার বিবাদ বাধে। এই অতি সুন্দর মুক্তোর মালা ছিল আফগানিস্থানের আমিরের। বাচ্চাই সাকো এটা অধিকার করে মাত্র তিন দিন গলায় দিয়েছিল, তারপরেই তার জীবনের যবনিকাপাত হয়। এই মুক্তোর মালার যখন অন্বেষণ হচ্ছিল, তখন মোহন সিং এটা লুকিয়ে ফেলে।

    আমি এই মুক্তোর মালা নেওয়ার জন্য অধীর হয়ে উঠেছিলুম। অবশেষে মাত্র বৎসরখানেক আগে এটা আমার হাতে আসে।

    মোহন সিং আমার সঙ্গে বিবাদ করে এই মুক্তোর মালা লাহোরে তার বাড়িতে রাখবার জন্যে নিয়ে যায়, কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে হয়নি তাকে। আমার প্রেরিত লোক পথেই তাকে হত্যা করে মালা নিয়ে আসে।

    সেও আমায় বঞ্চিত করবার চেষ্টা করেছিল। মুক্তোর সৌন্দর্য তাকেও মুগ্ধ করেছিল, কিন্তু আমি স্বহস্তে তাকে হত্যা করে এ মালা নিয়েছি।

    পান্না সিং সব জানত। সে নিজে কোনোদিন ডাকাতি করেনি, কিন্তু তার অনেক দল ছিল, লাভের বখরা ছিল পান্না সিংয়ের। শুনলুম, সে বিদেশি রাজ্যের সঙ্গে যোগ দিয়ে, ব্রিটিশের সর্বনাশ করবার চেষ্টাও করেছিল।

    আমি জীবন-ভোর পাপ কাজই করে এসেছি মা, জীবনে তাই কোনোদিন শান্তি পেলুম না। মোহন সিংয়ের মৃত্যুর পর পান্না সিংয়ের ভয়েই আমি সব ব্যবসা তুলে দিয়ে কলকাতায় বাস করতে এসেছিলুম। কিন্তু যেদিনই এসেছি, সেইদিনই রত্নার গলার মুক্তোমালা পান্না সিংয়ের চোখে পড়ে এবং সে তার লোক দিয়ে মুক্তোর মালা-সুদ্ধ রত্নাকে চুরি করে নিয়ে যায়।

    আমাকে তিলে-তিলে মারা ছিল তার উদ্দেশ্য; কিন্তু আমি যে বিবেক-দংশনে নিজেই মৃত্যুবরণ করছি, তা সে জানত না।

    যাক, আমার মেয়ে ফিরেছে, অভিশপ্ত মুক্তোর মালা যেখানেই থাক, আমি শান্তি পেয়েছি। আমার বিশাল সম্পত্তি আমি জনহিতকর বিবিধ কাজে দান করে গেলুম। আমার স্ত্রী, তুমি আর তোমার মামা, এর ট্রাস্টি রইলে। আমার রত্নার বিবাহ দিও, আমি আর কিছুই চাইনে।”

    এরই দু-দিন বাদে মিঃ সেন মারা গেলেন।

    শহরসুদ্ধ লোক বাড়িতে ভেঙে পড়ল, সংবাদ-পত্রে প্রকাশ হল তাঁর ছবি, তাঁর পরিচয়; দেশসুদ্ধ লোক হাহাকার করতে লাগল-এমন ধার্মিক দয়াশীল লোক আর হবে না।

    প্রণবেশ কেবল মাথা চুলকোন, একটু হেসে কি বলতে যান! কৃষ্ণা ধমক দেয়, ”চুপ করে থাক মামা। একটি কথাও যেন মুখ দিয়ে বার না হয়।”

    ব্যোমকেশবাবু কৃষ্ণাকে লক্ষ করে বলেন, ”সবই হল-মেয়েও ফিরল। যদি আর কয়েকটা দিন বাঁচতেন!”

    বলা বাহুল্য, কাজ কিছু হোক না হোক, মিঃ সেন কৃষ্ণাকে মোটা টাকা পুরস্কার দিয়ে গেছেন।

    কৃষ্ণা মাঝে মাঝে অবসরকালে সেই টাকার স্তূপ টেবিলের উপর সাজিয়ে রাখে, আর নিজে তার সামনে বসে ভাবে, ‘কাকাবাবু চলে গেছেন, কিন্তু উদার হাতে তিনি আমায় দান করে গেছেন এক রাজার ঐশ্বর্য!’

    তাঁর স্নেহ, দয়া-মায়া, উদারতা,-স্বাস্থ্য, সাহস, জ্ঞান ও বিদ্যা-বুদ্ধি-অতুলনীয় ও লোভনীয়। মোট কথা, মানুষের পক্ষে গৌরবের যা কিছু, সবই তাঁর ছিল! কিন্তু মোহন সিংয়ের প্রতি তাঁর যে ব্যবহার-তারও যে তুলনা হয় না…এমনি নির্মম…এমনি পৈশাচিক!

    মানুষের চরিত্রে কি এমন অপূর্ব সংমিশ্রণও সম্ভব? এ যেন চাঁদে কলঙ্ক!…কলঙ্কী চাঁদ!

    __

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.