Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী এক পাতা গল্প865 Mins Read0

    ০৯. বনে-জঙ্গলে কৃষ্ণা

    বনে-জঙ্গলে কৃষ্ণা

    এক

    বিদেশ যাত্রা

    বিদ্যুৎবেগে ট্রেণ চলেছে-

    বম্বেমেল ছুটেছে-ছোট-খাটো ষ্টেশনে দাঁড়ায় না, বড় ষ্টেশনে দাঁড়াচ্ছে মুহূর্ত্তের জন্য, সেইটুকু সময়ের মধ্যে যাত্রীরা নামছে, উঠছে।

    একটা কামরায় কোণ নিয়ে বসেছে কৃষ্ণা; সেকেণ্ড ক্লাস কামরা-লোক বিশেষ নাই। ছোট্ট কামরাটির মধ্যে যে একজন লোক ছিলেন, তিনি বিছানা বিছিয়ে তার উপর শুয়ে পড়েছেন, ট্রেণের সঙ্গে ঘুমও এসেছে হয়তো।

    কৃষ্ণা চলেছে বিলাসপুর-তার বান্ধবীর বাড়ী বেড়াতে। বান্ধবী মীনার পিতা বিলাসপুরে বদলী হয়ে এসেছেন পুলিশ-সুপারের পোষ্টে, ছুটিতে মীনা পিতামাতার কাছে এসেছে। আসার সময় কৃষ্ণাকে বিশেষ অনুরোধ করে এসেছে, সে যেন অন্ততঃপক্ষে দু-চার দিনের জন্যও বিলাসপুর আসে, দুই বান্ধবীতে মিলে তারা ছুটি উপভোগ করবে।

    কলকাতার জীবন একঘেয়ে-কাজেই দুর্ব্বিষহ হয়ে ওঠে মাঝে মাঝে; কৃষ্ণার তাই বিলাসপুর যাওয়ার সঙ্কল্প ভালই লেগেছিল।

    মাতুলকেও সে সঙ্গে নিতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রণবেশ রাজী হননি। বক্রমুখে বলেছেন-”এই দারুণ গরমে আমি মধ্যপ্রদেশে যেতে পারব না কৃষ্ণা। কলকাতার গরমে মোটা মানুষ আমি হাঁপিয়ে মরছি-তবু তো কলকাতার শহর-আছে ফ্যান, আছে বড় বড় পার্ক, গঙ্গার ধার, দিব্যি হাওয়া খেয়ে বেড়াও। এ সব ফেলে আমি যাই আর কি গরমে পচে মরতে সেই মধ্যপ্রদেশে!”

    কৃষ্ণাকে নিবৃত্ত করবার জন্য তিনি কম চেষ্টা করেননি, কিন্তু কৃষ্ণা তার সঙ্কল্প ত্যাগ করেনি।

    প্রণবেশ বলেছিলেন, ”বনমালীকে বরং সঙ্গে নিয়ে যাও কৃষ্ণা, বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, তবু বিশ্বাসী একজন লোক সঙ্গে থাকলে ভালো হবে।”

    কৃষ্ণা একটু হেসেছিল, বলেছিল, ”এ পর্য্যন্ত কাউকেই আমার সঙ্গে যেতে হয়নি মামাবাবু, ভগবানের ইচ্ছায় যেটুকু শক্তি আমার আছে তাতে আমি নিজেকে সকল বিপদ-আপদ হতে রক্ষা করতে পারি।”

    বেশ আরামে বসেছে কৃষ্ণা, বিছানাটা যদিও সে পেতে নিয়েছে, তবু শয়ন করেনি। কোন দিনই সে চলন্ত ট্রেণে শয়ন করতে পারে না। বসে বসে থেকে একটু তন্দ্রার ভাব এসেছিল মাত্র।

    কোন ষ্টেশন, সেটা সে জানে না। অল্পক্ষণের জন্য ট্রেণখানা থেমেছিল মাত্র, তারপরই জোর চলবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণার তন্দ্রালু ভাবটা হঠাৎ দূর হয়ে গেল।

    একটা ভীষণ শব্দ কানে আসে-দুৰ্য্যাগের রাতের বজ্রপাতের মতই সে শব্দ, চোখের উপর যেন শত-বিদ্যুৎ চমক হেনে যায়; কৃষ্ণার মনে হয় কে যেন তাকে তুলে বহু দূরে আছড়ে ফেলে দিলে, সঙ্গে সঙ্গে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললে।

    দুই

    দুর্ঘটনা

    ট্রেণ অ্যাকসিডেণ্ট-

    পরদিন সকালে পথে পথে হকার ছোটে সংবাদপত্র বহন করে, উচ্চকণ্ঠে চীৎকার করে, ”ভীষণ ট্রেণ দুর্ঘটনা-ভীষণ ট্রেণ দুর্ঘটনা, বম্বেমেল ধ্বংস, শত শত যাত্রী হতাহত”-

    বজ্রধ্বনির মতোই কথাটা কানে আসে।

    প্রণবেশ ধড়মড় করে উঠে বসেন, দুই হাতে ঘুমন্ত চোখ ডলে ভালো করে তাকান, কান পাতেন-

    একি স্বপ্ন না সত্য, ট্রেণ দুর্ঘটনা, বম্বেমেল ধ্বংস?

    হ্যাঁ, হকার চীৎকার করে চলেছে রাজপথে-বম্বেমেল ধ্বংস, শত শত যাত্রী হতাহত-

    সে কি কথা-

    কৃষ্ণা যে বম্বেমেলেই রওনা হয়েছে, সেই মেলই ধ্বংস হল নাকি?

    ”বনমালী-বনমালী”-

    ভগ্নকণ্ঠে ডাকতে ডাকতে প্রণবেশ ঘরের বাইরে আসেন, কাগজ, একখনা কাগজ যোগাড় কর বনমালী-এখনি-

    বনমালী সবিনয়ে বললে, ”আজ্ঞে, আমাদের কাগজ তো এসেছে, আপনি সেই কাগজখানাই দেখুন না, আর অন্য কাগজে কি দরকার?”

    নিচে বৈঠকখানা ঘরে টেবিলের উপর প্রাত্যহিক ইংরাজী ও বাংলা দুখানা কাগজ পড়ে আছে। প্রণবেশ ক্ষিপ্রহস্তে একখানা কাগজ তুলে নেন-প্রথম পৃষ্ঠাতেই বড় বড় অক্ষরে লেখা-

    বম্বেগামী মেল ধ্বংস

    তারপর যা লেখা রয়েছে, তার সারমর্ম্ম এই যে :-

    খড়্গপুরে ষ্টেশন ছেড়ে ট্রেণ কিছুক্ষণ দ্রুত চলছিল; পথিমধ্যে লাইনের গণ্ডগোলে ট্রেণ ভীষণ শব্দ করে অকস্মাৎ গতি রুদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাইনচ্যুত হয়। কয়েকখানি বগি চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে, যাত্রী যারা ছিল তাদের মধ্যে অনেকেই বাঁচেনি। ইঞ্জিনখানি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, কেবল পিছনের ২।৩ খানি বগি রক্ষা পেয়েছে। আহতদের হসপিটালে পাঠানো হয়েছে, মৃতদের উপযুক্ত ভাবে সৎকার করবার ব্যবস্থা হয়েছে।

    প্রণবেশ আতিপাঁতি করে দেখেন-এই ট্রেণ-দুর্ঘটনায় হতাহতদের নামের তালিকা পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু সংবাদপত্র গত-রাত্রের ট্রেণ-ধ্বংসের সংবাদটা সংক্ষেপে দিয়েছে মাত্র, আগামীকাল নিশ্চয়ই নাম প্রকাশ হবে।

    আগামী কাল পর্য্যন্ত প্রণবেশ অপেক্ষা করতে পারেন না। সংবাপদত্রখানা ফেলে তিনি খানিক নিস্তব্ধে বসে ছিলেন-তারপর উঠে তাড়াতাড়ি বার হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে নিলেন।

    বনমালী জিজ্ঞাসা করে, ”কি হয়েছে বাবু, কাগজে কি লিখেছে?”

    রুদ্ধকণ্ঠে প্রণবেশ উত্তর দিলেন, ”ভয়ানক খবর বনমালী, কৃষ্ণা যে ট্রেণে যাচ্ছিল, সেই ট্রেন ধ্বংস হয়েছে। আমি খবর নিতে যাচ্ছি, দেখি কি ব্যাপার ঘটলো? ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে যদি না ফিরি, জেনো আমি চলে গেছি, কৃষ্ণাকে না নিয়ে আমি ফিরব না।”

    দ্রুত তিনি বার হয়ে পড়লেন, পিছনপানে তাকাবার ইচ্ছা তাঁর আর ছিল না; একবার মানিব্যাগটা দেখে নিলেন-কয়েকখানা নোট আছে-এই যথেষ্ট।

    জনবহুল পথের ফুটপাত ধরে তিনি হন হন করে হাঁটতে শুরু করেন। এক জায়গায় তে-মাথার মোড়ে ক্রশিংয়ের মুখে হঠাৎ তাঁকে বাধা পেতে হয়, সেই মুহূর্ত্তে সারি সারি মোটর আসতে থাকে।

    তাঁর পাশ দিয়ে চলতে চলতে একখানা জিপ গাড়ী আচমকা থেমে যায়, ভিতর হতে কে তাঁর নামধরে ডাকে, ”প্রণববাবু যে-এ রকম হন্তদন্ত ভাবে ছুটেছেন কোথায়?”

    বলতে বলতে মুখ বাড়ান ব্যোমকেশ-”আসুন আসুন, চটপট উঠে পড়ুন গাড়ীতে, দেরি করবেন না।”

    থতমত খেয়ে যান প্রণবেশ; সেই মুহূর্ত্তে গাড়ী হতে নেমে পড়ে তাঁর হাত ধরে টানতে টানতে ব্যোমকেশ তাঁকে গাড়ীতে তুলে নিয়ে নিজেও উঠে পড়েন, ড্রাইভার গাড়ী চালায়-

    ব্যোমকেশ হাঁফ ছেড়ে বললেন, ”যাচ্ছেন নিশ্চয়ই হাওড়া ষ্টেশনে-সেটা তো স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, নয় কি প্রণববাবু?”

    রুদ্ধ কণ্ঠে প্রণবেশ বললেন, ”তাই বটে। এইমাত্র হকারের চীৎকার শুনে কাগজ দেখে তাড়াতাড়ি বার হয়ে পড়েছি। সাংঘাতিক কাণ্ড-বম্বেমেলে অ্যাকসিডেণ্ট;-এ রকম তো হয় না কোনদিন!”

    ব্যোমকেশ বললেন, ”কিন্তু আজকাল ভীষণ অ্যাকসিডেণ্ট ঘটছে ট্রেণে, কাগজ খুললেই দেখা যায়, কোথাও না কোথাও অ্যাকসিডেণ্ট ঘটেছে। আপনাদের জানাশুনা কেউ ছিল নাকি ঐ ট্রেণে?”

    অধীর কণ্ঠে বলে ওঠেন প্রণবেশ, ”হাঁ হাঁ, আমাদের যে সর্ব্বনাশ হয়ে গেল ব্যোমকেশবাবু, ওই ট্রেণে কৃষ্ণাও যে কাল গেছে তার বন্ধুর বাড়ী বিলাসপুরে।”

    ব্যোমকেশ পাথর হয়ে যান, অনেকক্ষণ পরে তাঁর মুখ দিয়ে একটি মাত্র শব্দ প্রকাশ হয়, ”আপনি কি বলছেন প্রণববাবু-কৃষ্ণা এই ট্রেণে ছিল?”

    কান্নাভরা সুরে প্রণবেশ বললেন, ”নইলে এই সকালবেলায় এরকমভাবে হাওড়ায় ছুটছি? কি সর্ব্বনাশ হল ব্যোমকেশবাবু, আমি কিছুই ভেবে ঠিক করতে পারছি না-”

    বলতে বলতে নিতান্ত অকস্মাৎ প্রণবেশ ক্ষুদ্র শিশুর মতো কেঁদে ফেলেন।

    আস্তে আস্তে তাঁর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ব্যোমকেশ বললেন, ”অধীর হবেন না, কাঁদবেন না প্রণববাবু, আমার মন বলছে, নিশ্চয়ই কৃষ্ণা বেঁচে আছে। সে আবার আমাদের কাছে নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। আমি বলছি কৃষ্ণার কোনো অকল্যাণ হবে না, হতে পারে না।”

    লজ্জিতভাবে প্রণবেশ রুমালে মুখ মুছলেন।

    ব্যোমকেশ বললেন, ”এই ট্রেণ-অ্যাকসিডেণ্ট ব্যাপারটা সহজে হয়নি, দুর্ঘটনাও নয়, এর মূলে একটা মস্ত বড় ষড়যন্ত্র আছে প্রণববাবু। আজ এই ট্রেনে দুজন বন্দী পুলিশ-বেষ্টিত হয়ে নাগপুর যাচ্ছিল, বেশ বুঝেছি তাদের জন্যই এই অ্যাকসিডেণ্ট ঘটেছে।’

    ”বন্দী নাগপুর যাচ্ছিল!”

    প্রণবেশ আশ্চর্য্য হয়ে যান, ”সেই দুজন বন্দীর জন্যে ট্রেণ ধ্বংস হল, এতগুলি লোক মরলো, কত লোক চিরকালের মতো অকর্ম্মণ্য হয়ে রইলো-এ কি একটা সম্ভবপর কথা ব্যোমকেশবাবু?”

    ব্যোমকেশ মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ”রিপোর্ট আমি এখনই পাব, বিশেষ করে সেই জন্যেই হাওড়ায় যাচ্ছি প্রণববাবু। আমাদের সাহেব ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন এই ব্যাপারে। এই দুজন বন্দী-আলি মহম্মদ আর রজনী দত্ত, এদের এখান হতে সরানো হচ্ছে, এখানকার জেল এদের কাছে সুদৃঢ় নয়-অতি সাংঘাতিক লোক এরা, দুনিয়ায় হেন কাজ নেই যা এরা দুজনে করতে পারে না। এদের নাগপুর জেলে রাখা হবে ঠিক হয়েছে, কোনরকমে পুলিশ-পাহারায় নাগপুর ষ্টেশন পর্য্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমাদের ছুটি। কিন্তু হঠাৎ ঘটলো পথের মধ্যে বিপত্তি-এখন তারা যদি হত বা আহত হয়ে সেখানে পড়ে থাকে তা হলে আমাদের চিন্তার কারণ নেই। কিন্তু ওই বিষয়েই আমার সন্দেহ জাগছে, তারা হত বা আহত কিছুই হয়নি, তারা নিরাপদে পালিয়ে বেঁচেছে।”

    প্রণবেশ বিস্ময়ে তাঁর পানে তাকিয়ে থাকেন।

    তিন

    কোথায় কৃষ্ণা?

    আলি মহম্মদ ও রজনী দত্ত! সাধারণের কাছে এরা বিভীষিকাই ছিল বটে। আলি মহম্মদ লাহোরের অধিবাসী; পাঞ্জাবে সে অমানুষিক কার্য্য-কলাপের জন্য বিখ্যাত হয়ে পড়েছিল। তাকে ধরে দেওয়ার জন্য সেখানে দু’হাজার টাকা ঘোষণা করা হয়েছিল, অথচ তাকে এ পর্য্যন্ত কেউই করতে পারেনি।

    পাঞ্জাব পুলিশের অত্যাচারে উত্ত্যক্ত হয়েই আলি মহম্মদ বাংলাদেশে চলে এসেছে। এখানে তার স্থান করে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি; তার ভক্ত বাংলাদেশেও যথেষ্ট ছিল, তারা সমাদরের জন্য পাঞ্জাবের বীরকেশরী আলি মহম্মদকে গ্রহণ করেছিল।

    এমন কি রজনী দত্ত, বাংলার পুলিশ যার কাছে হার মেনেছে, সেও আলি মহম্মদের বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিয়েছিল।

    সোনায় সোহাগা মিলেছিল আলি মহম্মদ ও রজনী দত্তের একত্র সম্মেলনে। এই দুই মাণিকজোড় শুধু বাংলাদেশে নয়, আসাম বিহারেও আগুন জ্বালিয়েছে।

    বহু কষ্টে সম্প্রতি এরা ধরা পড়েছিল এবং বিচারও হয়েছিল। কৃষ্ণা যে ট্রেণে রওনা হয়েছে সেই ট্রেণেই এই দুই বন্দীকে নাগপুর জেলে পৃথক পৃথক সেলে আবদ্ধ করে রাখবার জন্য পাঠানো হচ্ছিল। এই বর্ত্তমান দুর্ঘটনায় এরা বেঁচে আছে বা আহত হয়েছে, অথবা পলায়ন করেছে সে খবর সংগ্রহ করবার জন্য সকলেই উৎসুক হয়ে উঠেছে।

    একখানা রিলিফ ট্রেণ রাত্রেই ঘটনাস্থলে চলে গেছে, তাতে ডাক্তার, ঔষধ, নার্স ও স্বেচ্ছাসেবক-দল রওনা হয়েছেন। ব্যোমকেশ প্রণবেশকে নিয়ে মোটরযোগে ঘটনাস্থলে রওনা হলেন।

    নির্দ্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাতে বেশীক্ষণ লাগালো না। মোটর থামতেই ব্যোমকেশ নেমে পড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রণবেশও নামলেন।

    পুলিশ স্থানটি ঘিরে রেখেছে; চারিদিকে ভীষণ ভিড়, সেই ভিড় ঠেলে প্রণবেশ ভিতরে অগ্রসর হলেন।

    শোনা গেল-যারা আহত হয়েছে তাদের খড়্গপুর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে, যারা জীবন হারিয়েছে তাদের মৃতদেহ লাইনের পাশে রাখা হয়েছে; যার যে আত্মীয়-স্বজন আছে তারা এসে যাতে মৃতদেহ সনাক্ত করতে পারে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সংবাদপত্রের সংবাদদাতা কয়জনকে দেখা গেল, তাঁরা সকলেই খবর সংগ্রহের চেষ্টায় ফিরছেন।

    ব্যোমকেশ নিজের পরিচয় দিয়ে তাড়াতাড়ি মৃতদেহগুলি দেখতে গেলেন, নিশ্বাস রুদ্ধ করে প্রণবেশও তাঁর অনুবর্ত্তী হলেন।

    বহু লোক মারা গেছে, স্ত্রী পুরুষ শিশু-কিন্তু এদের মধ্যে দেখা গেল না কৃষ্ণাকে; প্রণবেশ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, দু’হাত কপালে রেখে পরম নাস্তিক প্রণবেশ এই প্রথম ভগবানকে প্রণাম করলেন।

    মৃতের মধ্যে কৃষ্ণা বা বন্দী দুজনের কাহাকেও পাওয়া গেল না; রক্ষী তিনজনকে মৃত দেখা গেল, আর পাঁচজন যে আহত হয়ে খড়্গপুর হসপিটালে স্থান পেয়েছে তাতে ব্যোমকেশের অণুমাত্র সন্দেহ ছিল না।

    প্রণবেশকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আবার মোটরে উঠে বসলেন, খড়্গপুর হাসপাতালে যাওয়ার নির্দ্দেশ পেয়ে ড্রাইভার মোটর চালালো।

    একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ব্যোমকেশ বললেন, ”দেখা যাক-যদি আহত হয়ে এরা হাসপাতালে গিয়ে থাকে। যাদের যাদের চোট লাগেনি, রিলিফ ট্রেণে তাদের দেখা গেল, মৃতদের সকলকেও দেখা হল, রইল এখন বাকি আহতদের দেখা। আমার মনে হয় কৃষ্ণাও আহত হয়ে হাসপাতালে গেছে, ওখানে গেলে ঠিক জানা যাবে প্রণববাবু।”

    প্রণবেশ তখন ভাবছিলেন, হাসপাতালে গিয়ে কৃষ্ণার একবার দেখা পেলে হয়, তাকে তিনি যা তিরস্কার করবেন তা তাঁর মনেই আছে। তিনি বার বার নিষেধ করেছেন, এ সময় কোথাও গিয়ে দরকার নেই, তবু সে জোর করে চলে গেছে। তবু অনেক সৌভাগ্য তিনি সঙ্গে যাননি, গেলে তো এই রকমই দুর্ঘটনার মধ্যে পড়তে হতো, তখন কে যে কার খোঁজ করত তার ঠিক নাই।

    ট্রেণ ধ্বংসের বীভৎস দৃশ্যটা মনে জাগছিল প্রণবেশের। বম্বেমেলের কয়েকটি বগির চিহ্নমাত্র নাই, পিছনের কয়খানা বর্ত্তমান থাকলেও অক্ষত নাই, আরোহীরাও কম-বেশী জখম হয়েছে।

    প্রণবেশ অন্যমনস্কভাবে থাকেন, কে জানে-হাসপাতালে কৃষ্ণাকে কি অবস্থায় দেখতে হবে, সেই ভাবনাই তিনি করছিলেন।

    চার

    ভাবনার কথা

    হাসপাতালে অ্যাকসিডেণ্টে আহত রোগীদের জন্য একটা ঘর ছেড়ে দিতে হয়েছে, তা ছাড়া অন্য অন্য ওয়ার্ডের শূন্য বেডগুলিও পূর্ণ হয়ে গেছে।

    ব্যোমকেশের পরিচিত ডাঃ মিত্র এখানকার বড় ডাক্তার, তিনিও এখানে উপস্থিত ছিলেন। নার্স, ডাক্তার, চাকর-বাকর প্রভৃতির ছুটছুটি-সব মিলে এবং আহত রোগীদের আর্ত্তনাদে হাসপাতাল শব্দময় হয়ে উঠেছিল।

    ডাক্তার মিত্র ব্যোমকেশকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন, শঙ্কিত-কণ্ঠে বললেন, ”সাংঘাতিক ব্যাপার মিঃ ইনস্পেক্টর, বম্বেমেলে যে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে এ আমাদের স্বপ্নেরও অতীত। এত লোক আহত হয়েছে যে, আমরা হাসপাতালে তাদের স্থান দিতে পারিনি, অনেককে প্রাথমিক-চিকিৎসা করে ছেড়ে দিতে হয়েছে, অনেককে আবার বাইরেও বেড দিতে হয়েছে।”

    ব্যোমকেশ ম্লানকণ্ঠে বললেন, ”তাছাড়া কত লোক যে মারা গেছে তারও ঠিক নেই ডাঃ মিত্র। বহু মৃতদেহ রাখা হয়েছে দেখলুম, তাদের আত্মীয়স্বজন যদি কেউ থাকেন এসে যা হয় তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করলে ভালো হয়। আমার বিশেষ পরিচিত কয়েকজন এই ট্রেণে নাগপুর, বিলাসপুর, কেউ বা বম্বে যাচ্ছিল, তাদের কাউকেই তো দেখতে পেলুম না সেখানে। যদি কেউ আহত হয়ে এখানে এসে থাকে, সেই খোঁজে এসেছি। একবার দেখতে পারি মিঃ মিত্র সব বেডগুলো?”

    ”নিশ্চয়-নিশ্চয়-”

    ডক্টর মিত্র তখনই সঙ্গে একজন লোক দেন, সমস্ত ওয়ার্ডগুলো এঁরা যাতে দেখতে পারেন। নিজে তিনি এখন মহাব্যস্ত, এক মুহূর্ত্ত সময় তাঁর নাই।

    একে একে সমস্ত রোগীকে দেখা হল, কৃষ্ণার দেখা পাওয়া গেল না, প্রণবেশ পাথর হয়ে যান-

    ”কি হল ব্যোমকেশবাবু, কৃষ্ণা?”-তিনি কেঁদে ফেললেন।

    ব্যোমকেশ ধমকের সুরে বললেন, ”থামুন প্রণববাবু, হাসপাতালে শত শত লোকের সামনে ছেলেমানুষের মতো কাঁদবেন না, ওতে লোকে আমোদই পাবে মাত্র।”

    একটু থেমে চিন্তিত সুরে তিনি বলেন, ”আমার মনে হয়, কৃষ্ণা সেদিন ট্রেণে ওঠেনি, তাও তো হতে পারে-”

    প্রণবেশ স্তম্ভিত কণ্ঠে বললেন, ”ওঠেনি তো যাবে কোথায়? সে আমাকে বলে এলো, তার সুটকেস, বিছানাপত্র সব নিয়ে গেল, আপনি বলছেন সে এ ট্রেণে কাল যায়নি, বনমালী নিজে গিয়ে ট্রেণে তুলে দিয়ে এসেছে; সেটাও কি মিথ্যা হবে ব্যোমকেশবাবু?”

    ব্যোমকেশ বললেন, ”আপনাদের বনমালী কি শেষ পর্য্যন্ত-অর্থাৎ ট্রেণ ছাড়ার সময় পর্য্যন্ত ষ্টেশনে ছিল, সে কথা আপনি ঠিক জানেন?”

    প্রণবেশ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বললেন, ”না, কারণ ট্রেণে উঠে ঠিক হয়ে বসে কৃষ্ণা তাকে বিদায় দিয়েছিল। বনমালী ট্রেণ ছাড়ার সময় পর্য্যন্ত থাকতে চেয়েছিল, কৃষ্ণা তাকে আর দরকার হবে না বলে বাড়ি পাঠিয়েছে।”

    সোৎসাহে ব্যোমকেশ বললেন, ”তবেই বুঝুন ব্যাপার,-আমার কথা মিথ্যে হওয়ার নয়; কৃষ্ণা যে কোনো কারণেই হোক-বনমালী চলে যাওয়ার পর নেমে পড়েছে। বুঝলেন প্রণববাবু, আমরা ভাগ্য মানি, আমরা অদৃষ্ট মানি। ভাগ্যে অকালমৃত্যু নেই বলেই কৃষ্ণা এ যাত্রা বেঁচে গেছে জানেন।”

    তিনি খুশীমনে হাসলেও প্রণবেশ এত সহজে ভাগ্যের উপর বোঝা চাপিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারেন না; তিনি উদ্বিগ্ন-কণ্ঠে বললেন, ”কিন্তু সে গেল কোথায়? ফিরলেও বাড়ি না গিয়ে বা আমায় কোনো খবর না দিয়ে-”

    মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ব্যোমকেশ বললেন, ”হয়তো বিশেষ কারণ আছে, খবর দেওয়ার সময় সে পায়নি। কৃষ্ণার মতো মেয়ে তো, তার ধরা-ছোঁওয়া পেতে কেউ পারবে না-আপনি আমি পাব এও সম্ভবপর নয়। নিশ্চিন্ত থাকুন প্রণববাবু, সে হয়তো দু-এক দিনের মধ্যেই ফিরবে। যাক-আসুন, আমি দেখি-আমার বন্দীর সাথীরা কেউ এখানে এসেছে কিনা। আসুন প্রণববাবু, খুঁজে দেখি-”

    তিনি অগ্রসর হন-

    মাথায় ব্যাণ্ডেজ বাঁধা যে লোকটি একটি ‘বেডে’ পড়েছিল, তার দিকে দৃষ্টি পড়তেই ব্যোমকেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন, ”এই দেখুন, লালু সিংকে পেয়েছি, এদিক-ওদিক হয়তো আর কয়জনও আছে, আসুন দেখা যাক।”

    লালু সিং তখনও মূর্চ্ছিত-মাথায় তার ভীষণ আঘাত লেগেছে। অন্যত্র এক ‘বেডে’ দেখা মিললো কিষেনজীর, একখানা পায়ের যন্ত্রণায় সে অধীর হয়ে উঠেছে।

    তবু তার মুখে কিছু খবর পাওয়া যায়-সে জানালে-বন্দী দুজন নিরাপদে পলায়ন করেছে রক্ষীদের অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে। কামরার যাত্রীদের মধ্যে কয়েকজন তাদের আক্রমণ করে। তাদের সঙ্গে হাতাহাতি বেধে যায় শেষ পর্য্যন্ত। এর মধ্যে কোন ফাঁকে বন্দী দুইজন চলন্ত ট্রেন হতে কিভাবে নেমে পড়েছে, তা তারা জানতেও পারেনি। এই লোকগুলোকে আক্রমণ করতে তারা শেষ পর্য্যন্ত গুলি চালাতে বাধ্য হয়। ঠিক এমনই সময় ট্রেণখানা হঠাৎ কেমন একটা বাধা পেয়ে থমকে যায়, সেইটুকু সময়ের অবকাশে বন্দী-চারজন লাফিয়ে পড়ে খোলা দরজা পথে; প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রেণে অ্যাকসিডেণ্ট ঘটে যায়, এইটুকু সময়ের মধ্যে কি যে ঘটে গেল তা কেউই বুঝতে পারেনি।

    মোটের উপর কিষেনজীর একেবারেই জ্ঞান ছিল না, যখন জ্ঞান ফিরেছে সে অনুভব করেছে কিসের তলায় সে চাপা পড়ে আছে। যতটুকু শক্তি তার সে চীৎকার করেছে, তারপর কারা যে এসে তাকে মুক্ত করেছে তার খবর সে জানে না।

    হাউ হাউ করে সে কাঁদে, যন্ত্রণায় অধীর হয়ে ওঠে, চীৎকার করে।

    ব্যোমকেশ পিছন ফিরে প্রণবেশকে দেখতে পান না; তিনি তাড়াতাড়ি বাইরে আসেন।

    বাইরে একখানা বেঞ্চে বসে পড়েছেন প্রণবেশ, অতি প্রিয়জনকে শ্মশানে দগ্ধ করে ফিরে এসে মানুষ যেমন ভাবে হাঁটু ভেঙ্গে বসে পড়ে, তাঁর অবস্থা ঠিক তেমনই।

    ব্যোমকেশ কাছে এসে দাঁড়াতেই প্রণবেশ দুই হাতে মুখ ঢাকেন, তাঁর করাঙ্গুলির ফাঁক দিয়ে অশ্রুধারা ঝরে ঝরে পড়ে।

    তাঁর বেদনায় সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা ব্যোমকেশ খুঁজে পান না। এতক্ষণ প্রণবেশকে যতই কেন না বুঝান, তাঁর মনেও আশা ছিল, হাসপাতালে আহত অবস্থায় কৃষ্ণাকে তাঁরা নিশ্চয়ই দেখতে পাবেন। প্রণবেশকে যা তা বলে সান্ত্বনা দেওয়া আর চলে না-কিন্তু সত্য কথা-কৃষ্ণা গেল কোথায়? জীবিত যারা, ফিরে গেল, তাদের মধ্যে সে নাই, হতাহতের মধ্যেও সে নাই, তবে-

    মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা জাগে-আলি মহম্মদের হাতে সে বন্দিনী হয়েছে হয়তো। অ্যাকসিডেণ্টে সে মারা যায়নি, সামান্য হয়তো আহত হয়েছিল; আলি মহম্মদের দলীয় লোকেরা যারা পূর্ব্ব নির্দ্দেশমতো যথাস্থানে ট্রেণ ধ্বংস করেছে, তারা নিশ্চয়ই শেষ ব্যাপার দেখবার জন্য ঘটনাস্থলেই ছিল; তারাই কৃষ্ণাকে বন্দিনী করে নিয়ে যায়নি তো?

    অসম্ভব নয়! আলি মহম্মদ না হোক-রজনী দত্ত কৃষ্ণাকে খুব ভালোরকম চেনে। এককালে সে ইউনিভার্সিটির ভালো ছেলে ছিল, কিন্তু ঘটনাচক্রে পড়ে সে অসৎ পথ অবলম্বন করেছে। কৃষ্ণার দিকে তার বিশেষ দৃষ্টি ছিল, এমনকি একবার সে গোপনে একখানা পত্রও দিয়েছিল-যদি কৃষ্ণা তাকে বিবাহ করতে রাজি হয়, এসব জঘন্য কাজ ছেড়ে দেবে, তার প্রচুর সম্পত্তি সে কৃষ্ণাকে দেবে, কৃষ্ণা শুধু সম্মতি দিক, তাকে বিবাহ করতে রাজি হোক।

    দারুণ ঘৃণায় কৃষ্ণা পত্রখানা ছিঁড়ে ফেলেছিল। এ কথা সংগোপনে ব্যোমকেশকেই মাত্র বলেছিল, আর কাউকে জানায়নি।

    আজ সেই কথাই ব্যোমকেশের মনে হয়, তবু তিনি প্রণবেশকে কোনো কথাই বললেন না। তাঁকে অনেক বুঝিয়ে তবে তিনি উঠাতে পারলেন।

    রুমালে মুখ মুছে আর্দ্রকণ্ঠে প্রণবেশ বললেন, ”আমার মনে হয় ব্যোমকেশবাবু, কৃষ্ণা আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল; সেই রকম সময় কেউ-বা কারা তাকে ধরে নিয়ে গেছে।”

    ব্যোমকেশ বলেলন, ”আমারও তাই মনে হচ্ছে। যাই হোক, সে মেয়ে বন্দিনী থাকবার মেয়ে নয় জানি। যারা নিয়ে গেছে, তারা কৃষ্ণাকে নিশ্চয়ই চেনে না; এ মেয়ে যে জ্বলন্ত আগুন, সে প্রমাণ তারা আজ না হোক-দু’দিন পরেও পাবে। আপনি অতখানি নার্ভাস হয়ে পড়বেন না প্রণবেশবাবু, আশা রাখুন, সে আজ না হোক-দু’দিন পরে ফিরবেই। চলুন এবার-আর দেরী করে এখানে ফল নেই।”

    জড়ভাবাপন্ন প্রণবেশকে টেনে নিয়ে তিনি মোটরে উঠলেন।

    পাঁচ

    বিপদের উপর বিপদ

    ধীরে ধীরে কৃষ্ণার চৈতন্য ফিরে আসছে।

    কি যে কাণ্ড ঘটেছে, তা সে কিছুতেই ঠিক করতে পারছিল না।

    মাথার মধ্যে সব যেন গোলমাল হয়ে গেছে। সারা দেহে মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা, বাম হাতখানাও একেবারে অসাড় হয়ে গেছে।

    চোখ মেলতে দেখতে পায় অন্ধকার আকাশ, চারিদিকে জমে রয়েছে নিকষ কালো অন্ধকার। আকাশে চাঁদ নাই, একটি তারা নাই, কালো মেঘের তলায় তারা কোথায় আত্মগোপন করেছে।

    এ কোন জায়গা-এখানে কৃষ্ণা কি করে এলো?

    বহু চেষ্টার পর আস্তে আস্তে মনে পড়ে, সে বিলাসপুর রওনা হয়েছিল, আজ রাত্রেই বম্বেমেলে উঠেছে সে। সেই ট্রেণেই কোনো অ্যাকসিডেণ্ট ঘটেছে, হঠাৎ যেন লক্ষ পাওয়ারের আলো তার সামনে জ্বলে উঠেছিল, সঙ্গে সঙ্গে কর্ণভেদী ভীষণ শব্দ।

    যাত্রীরা নিশ্চিন্ত আরামে শুয়েছিল, ঘুমিয়েছিল, কেউ ভাবতে পারেনি এই পথে বম্বেমেলে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ একেবারে অসম্ভব ব্যাপার, ভয়াবহ কাণ্ড।

    কৃষ্ণা অনুভব করতে চেষ্টা করে-কোথায় পড়ে আছে সে। কোনোদিকে আলো দেখা যায় না, শুধু হতাহতদের আর্ত্ত চীৎকার কানে আসছে। নিজের উঠবার তার ক্ষমতা নাই, দেহে তার এতটুকু শক্তি নাই যার জোরে সে উঠতে পারে।

    ”মাগো-”

    কেবল একটি শব্দ তার মুখে ফুটে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে তার উপরে ছড়িয়ে পড়ে অত্যুজ্জ্বল টর্চের আলো, টর্চধারীকে পিছনে দেখা যায় না।

    ”ইস-দেখ দেখ নেহালচাঁদ, এখানে একটি মেয়ে পড়ে রয়েছে, আগে দেখ একে, গায়ে গহনাপত্র নিশ্চয়ই আছে।”

    অকস্মাৎ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে কৃষ্ণা-আর তা হওয়ারই কথা। অ্যাকসিডেণ্টের খবর পরবর্ত্তী ষ্টেশানে পৌঁছাতে বা নিকটবর্ত্তী গ্রাম হতে সাহায্যকারীরা এসে পৌঁছাতে যতটুকু বিলম্ব হয়, সেইটুকু সময়ের মধ্যে দুর্ব্বৃত্তেরা যতটুকু পারে অপহরণ করবার সুযোগ পেলে তা ব্যর্থ করে না। এরা ঠিক সেই উদ্দেশ্যেই এসেছে, যে যতটুকু পারে লুণ্ঠন করে সাহায্যকারীরা আসবার আগেই সরে পড়বে।

    নেহালচাঁদ নামধারী লোকটা অগ্রসর হয়ে আসে, টর্চের আলো আবার কৃষ্ণার গায়ে ছড়িয়ে পড়ে; সানন্দে নেহালচাঁদ উত্তর দেয়, ”জী হাঁ, গাও মে বহুৎ গহনা ভি হায়।”

    কৃষ্ণার দক্ষিণ হাতখানা চেপে ধরে সে জোর করে চুড়িগুলি খুলে নিতে চায়।

    মানুষের স্পর্শে অকস্মাৎ কৃষ্ণার আত্ম-অনুভূতি ফিরে আসে; সে তীরবেগে উঠে বসলো এবং সঙ্গে সঙ্গে শ্মশ্রূগুম্ফবেষ্টিত নেহালচাঁদের মুখ লক্ষ্য করে জোরে মুষ্ট্যাঘাত করলে।

    ”কেয়া তাজ্জব-কেয়া তাজ্জব!”

    নেহালচাঁদ পিছনে সরে আসে, দুই হাতে নিজের নাক-মুখ চেপে ধরে।

    মুহূর্ত্তে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বাঘের মতো লাফিয়ে পড়তে যায় কৃষ্ণার উপর-

    ”রোখকে-রোখকে নেহালচাঁদ।”

    পেছন হতে কে বজ্রকণ্ঠে আদেশ করে, নেহালচাঁদ থমকে দাঁড়িয়ে যায়।

    অন্ধকারে একটা মানুষের দীর্ঘাকৃতিটাই শুধু চোখে পড়ে, মানুষ চেনা যায় না।

    টর্চের আলো আবার ছড়িয়ে পড়ে কৃষ্ণার উপরে, সঙ্গে সঙ্গে নিভে যায়।

    অদূরে দেখা যায় কতকগুলো আলো ছুটে আসছে এদিকে, বহু কণ্ঠের চীৎকারধ্বনি শোনা যায়-ওদিকের লাইনের উপর ট্রেণের শব্দ কানে আসে।

    দীর্ঘাকৃতি লোকটি আদেশ করে, ”সরে পড়, চটপট সরে পড় তোমরা-এই মেয়েটিকে কেউ কাঁধে তুলে নাও। একে নিয়ে যাও এখন, তারপর আমরা ফিরে গিয়ে সব ব্যবস্থা ঠিক করবো।”

    দূরের আলো কাছে এসে পড়ে; সাহায্যকারীরা এসে পড়েছে।

    কৃষ্ণা চীৎকার করতে যায়-

    সঙ্গে সঙ্গে লোহার মতো একখানা হাত তার কণ্ঠ চেপে ধরে পেষণ দেয়, মুহূর্ত্তে কৃষ্ণা তার নবপ্রাপ্ত চৈতন্য হারিয়ে ফেলে।

    তারপর কি হল, সে তা জানে না। এক বিপদ হতে উত্তীর্ণ হতে না হতে অন্য এক বিপদ এসে উপস্থিত হল, এর কল্পনা কেউই করতে পারেনি।

    মুহূর্ত্তে এসে পড়লো সাহায্যকারী লোকজন, ট্রলী ট্রেণ-সকাল না হওয়া পর্য্যন্ত বিশেষ কিছু ব্যবস্থা হল না, তবুও যতদূর পারা গেল, সাহায্যকারীরা তা করলে।

    ট্রেণে ছিলেন নাগপুরের পুলিশ-সুপারিনটেনডেণ্ট মিঃ রবসন, তাঁর সহকারী মহাদেব সিংহ, মৃতদেহ তাঁদের উদ্ধার হল, কাগজপত্রের ব্যাগ পাওয়া গেল না।

    হয়তো যারা ইচ্ছা করে এই অ্যাকসিডেণ্ট ঘটিয়েছে, তারাও এখানে উপস্থিত ছিল এবং সাহায্যকারীদের দলে মিশে যথেষ্ট পরোপকার করছিল!

    এই অসংখ্যের মধ্যে কোথায় গেল একটি মেয়ে কৃষ্ণা-কেউ তার খোঁজ নিলে না।

    ছয়

    ডাক্তার

    কৃষ্ণার জ্ঞান ফিরে এলো।

    এও এক পরম বিস্ময়। রাত্রে যখন অত বড় আঘাতের পর তার চেতনা ফিরেছিল, সে আশপাশের মাথার উপর চারিদিকে দেখেছিল নিকষ কালো অন্ধকার। আজ দ্বিতীয়বার যখন তার জ্ঞান ফিরলো, সে দ্বিতীয়বার ধাঁধায় পড়ে গেল।

    রাত্রে সে পড়েছিল রেল-লাইনের ধারে, মাঠ কি জঙ্গলের মধ্যে, তা সে দেখতে পায়নি। বর্ত্তমানে সে দেখছে সে একটি ঘরে পড়ে আছে, বিচালির উপর একখানা কম্বল পেতে দিয়ে তার শয্যা রচনা করা হয়েছে।

    সমস্ত দেহে অসহ্য ব্যথা, গলায় সবচেয়ে ব্যথা বেশী। খুব সম্ভব সেই লোকটি যে সজোরে গলা টিপে ধরেছিল, তার জন্যই গলায় এত বেশী ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।

    কৃষ্ণা আস্তে আস্তে উঠে বসে।

    বাঁ হাতখানা দারুণ ফুলে উঠেছে, হাতখানা নাড়া যাচ্ছে না।

    ট্রেণ অ্যাকসিডেণ্টে আঘাত লেগেছে, উপযুক্ত চিকিৎসা এখনই করা দরকার, কিন্তু কে তা করছে, কে তাকে দেখছে, যন্ত্রণায় কৃষ্ণা মুখ বিকৃত করে মাত্র।

    আশপাশে তাকায় কৃষ্ণা। ছোট একটি ঘর, উপরের দিকে একটি জানালা আছে-গরাদে থাকলেও জাল দিয়ে জানালাটি ঘেরা। একটিমাত্র দরজা একদিকে রয়েছে, আর একদিকে কপাটহীন একটি দরজার মতো দেখা যায়। খুব সম্ভব এই পথে বাথরুমে যাওয়া যায়।

    কৃষ্ণা উঠবার চেষ্টা করে, দু-একবার চেষ্টায় দেয়াল ভর করে সে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। নিজেকে সে অত্যন্ত দুর্ব্বল মনে করছে, দাঁড়াতে গিয়ে পা দুখানা তার কাঁপছে।

    তবু দেয়াল ধরে সে আস্তে আস্তে অগ্রসর হয়। বাথরুমই বটে এপাশে; দুইটি বালতিতে জল আছে, একটা ছোট টিনের মগও সেখানে রয়েছে। খানিকটা জল চোখে মুখে মাথায় দিয়ে কৃষ্ণা অনেকটা আরাম পায়। তারপর ফিরে আসে তার বন্দীগৃহের মধ্যে।

    রুদ্ধ দরজাটার কাছে গিয়ে সে দাঁড়ায়, একবার ধাক্কা দেয়-কে জানে, ওদিকে কোনো প্রহরী আছে কি না, থাকলে নিশ্চয় সাড়া দেবে।

    দরজার বাইরে সাড়া পাওয়া যায়, কে হুঙ্কার ছাড়ে, ”বেসামাল মাৎ করো, নিদ যাও।”

    নিদ যাবে কৃষ্ণা-তার আর জেগে কাজ নাই?

    হাসি আসে।

    ঘরের এককোণে গ্লাস মুখে চাপা দেওয়া একটা কুঁজো দেখতে পেলে সে,-এক গ্লাস জল খেয়ে শরীরটা অনেক সুস্থ মনে হল।

    ফিরে এসে বসলো সে নিজের গদিওয়ালা বিছানার উপর।

    অকূল ভাবনা তার।

    কোথায় এসেছে, কেন এবং কারা তাকে নিয়ে এসেছে, সে তার কিছুই জানে না। দীর্ঘাকৃতি যে লোকটি তাকে নিয়ে আসতে আদেশ করলে, সেই বা কে, তাকে বয়ে নিয়ে আসবার আদেশই বা করলে কেন?

    এমন নির্জ্জন-এ কোন জায়গা? ট্রেণে কে অকস্মাৎ অ্যাকসিডেণ্ট ঘটালো-তার মূলে কিছু আছে কি?

    না জানি কত লোক এ ঘটনায় মারা গেছে, কত লোক কম-বেশী আহত হয়েছে। রাত্রের ঘটনা সকালের কাগজে বিশদভাবে না হোক আংশিকভাবে নিশ্চয়ই প্রকাশিত হয়েছে, সে সংবাদ কলকাতায় পৌঁচেছে, মামাও সে খবর পেয়েছেন! বম্বেমেলে কৃষ্ণা রওনা হয়েছে, মামা বার বার বলে দিয়েছেন-পৌঁছেই যেন একখানা টেলিগ্রাম করা হয়, পরে পত্র লিখলেও চলবে। মামা সংবাদপত্রে নিশ্চয়ই বম্বেমেল দুর্ঘটনার কথা জেনেছেন, কি করছেন তিনি-কে জানে?

    বাইরে কে যেন দরজায় শব্দ করে, মনে হয় কে দরজা খুলছে।

    পরমুহূর্ত্তে আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে যায়, কে একজন লোক দরজা খুলে দিয়ে সসম্ভ্রমে সরে দাঁড়ায়, পিছন হতে এগিয়ে আসেন একজন লোক-দরজার পরদা সরিয়ে তিনি দাঁড়ান।

    পোষাক-পরিচ্ছদে তাঁর আভিজাত্য ফুটে আছে, মাথায় একটি ফেজ টুপি।

    মৃদু হাস্যে তিনি বললেন, ”আপনার কোনো কষ্ট হচ্ছে কি? হাতের ব্যথাটা কি রকম আছে দেখবার জন্যেই শুধু আমি এসেছি।”

    কৃষ্ণার মুখখানা বিকৃত হয়ে ওঠে, সে প্রবল বিরাগভরে মুখ ফিরিয়ে নেয়, লোকটার মুখ পর্য্যন্ত দেখবার প্রবৃত্তি তার হয় না।

    ভদ্রলোক তার বিরাগ বুঝতে পারেন; বিনীত কণ্ঠে বললেন, ”জানি আপনার যথেষ্ট কষ্ট হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই, আরও দু-পাঁচ দিন আপনাকে এখানে এই রকম কষ্টে থাকতে হবে। তবে আপনার হাতখানার অবস্থা নাকি ভালো নয়, সেইজন্যে আমায় একবার দেখবার আদেশ দেওয়া হয়েছে; আদেশ পালন না করলে আমায় শাস্তি ভোগ করতে হবে, সেইজন্যেই আমি এসেছি। তাছাড়া হাতটার চিকিৎসা যদি না হয়, এরপর ওই হাতখানা হয়তো আপনাকে বাদ দিতে হবে।”

    ”বাদ দিতে হবে!”

    কৃষ্ণা আতঙ্কে শিউরে ওঠে।

    হাতের জন্য তার যন্ত্রণা হচ্ছে বড় কম নয়। প্রায়ান্ধকার ঘরের মধ্যে সে হাতের অবস্থা চোখে দেখতে পাচ্ছে না, না পেলেও হাত যে নিদারুণ রকম ফুলে উঠেছে, তা সে বুঝতে পেরেছে। যে করেই হোক, তাকে হাতের চিকিৎসা করাতেই হবে। ছোট একটা ক্ষত হয়েছে, এ হতে গ্যাংগ্রিণ হতে কতক্ষণ লাগে?

    ভদ্রলোক বললেন, ”শুনেছি আপনি শিক্ষিতা মেয়ে-যদিও আপনার পরিচয় আমি জানিনে, তাই বলতে পারছি এবং আপনিও বুঝতে পারছেন, একখানা হাতের মূল্য বড় কম নয়। শত্রুপক্ষীয় লোক ভেবে আপনি আমায় দেখাতে চান না, কিন্তু ডাক্তার হিসাবে দেখতে দিতে আপত্তির কারণ থাকতে পারে না।”

    কৃষ্ণা শুষ্ককণ্ঠে বললে, ”তার চেয়ে আমায় ছেড়ে দিলেই ভালো হয় না কি?”

    ডাক্তার একটু হাসলেন, বললেন, ”সেটা যাঁরা আপনাকে এনেছেন, তাঁরা বুঝবেন, আমার তা বুঝবার কি জানবার কোনো অধিকার নেই, কাজেই আপনার প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারলুম না। আমি এসেছি আপনার আহত হাতখানা দেখতে,-কাল যার জন্যে আপনাকে ইনজেক্ট করতে হয়েছিল।”

    ”কাল আমাকে ইনজেকশান দিয়েছেন?”

    কৃষ্ণা যেন আকাশ হতে পড়ে, ”কৈ, আমি তো কিছুই জানিনে। আমি এখানে কয়দিন এসেছি ডাক্তার সাহেব, একথাটা জানতে পারি কি?”

    ডাক্তার উত্তর দিলেন, ”পরশু রাত্রে এসেছেন, কাল আপনার জ্ঞান ছিল না, তাই কিছু জানতে পারেননি। কিন্তু আমি আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে পারব না, হাতখানার অবস্থা দেখে আপনাকে আর একটা ইনজেকশান দিতে পারলেই আমার কাজ শেষ হয়।”

    কৃষ্ণা হাত দেখায়, প্রায়ান্ধকার ঘরে ডাক্তার টর্চ জ্বেলে হাতের অবস্থা দেখেন, গম্ভীর মুখে একটা ইনজেকশান দিয়ে দেন, কৃষ্ণা মুখখানা বিকৃত করে মাত্র।

    ডাক্তার বিদায় নেওয়ার উদ্যোগ করলেন; কৃষ্ণা বললে, ”এদের কারও সঙ্গেই তো আমার দেখা হওয়ার কোনো উপায় নেই। আপনি দয়া করে ওদের একবার জানাবেন কি-কেন ওরা আমায় এখানে আটক করে রেখেছে, কি উদ্দেশ্য আছে ওদের?”

    ”জানাব” বলে ডাক্তার পিছনে ফেরেন। কৃষ্ণা দেখতে পেলে না-তাঁর মুখে মৃদু হাসির রেখা ভেসে উঠেছে। কৃষ্ণা শুধু দেখতে পায়-দ্বাররক্ষী সসম্মানে মাথা অবনত করে, ডাক্তার চাপাসুরে তাকে কি উপদেশ দিয়ে চলে যান।

    দ্বাররক্ষী দরজা বন্ধ করে দেয়।

    সাত

    পুরাতন ভৃত্য

    কৃষ্ণার বেশ একটু তন্দ্রা এসেছিল-

    নিতান্ত অসময়ে আস্তে আস্তে দরজা খুলে যায়, মুখ বাড়িয়ে যে লোকটি ঘরের ভিতর তাকায়, আজ দ্বাররক্ষার ভার তার উপর পড়েছে।

    অকস্মাৎ কৃষ্ণার তন্দ্রা ছুটে যায়, সে ধড়মড় করে উঠে বসে; খোলা দরজায় যে লোকটির মাথা দেখা যাচ্ছিল, তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ”কে, কে ওখানে দাঁড়িয়ে?”

    ”চুপ, আমি দিদিমণি।”

    লোকটি এবার দরজার উপর দাঁড়ায়। আবছা অন্ধকারে কৃষ্ণা তাকে চিনতে পারে না, সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলে, ”তুমি কে?”

    সে ফিসফিস করে উত্তর দেয়, ”আমি ভীম, আপনাদের চাকর-রতন ঘোষের ছেলে দিদিমণি।”

    ”ভীম-তুমি এখানে?”

    কৃষ্ণা যেন আকাশ হতে পড়ে।

    পিতার পুরাতন ভৃত্য ছিল রতন;-দেশ হতে সে বার্ম্মায় গিয়েছিল, জীবনও ক্ষয় করেছে সেখানে। দু-চার বৎসর অন্তর একবার দেশে আসতো মাস পাঁচ-ছয়ের মতো, আবার ফিরে যেতো বার্ম্মায়। রতন একবার কৃষ্ণার জীবন রক্ষা করেছে নিজের জীবন বিপন্ন করে-সে কথা কৃষ্ণা আজও ভোলেনি। শিশুকাল হতে সে রতনকে দেখে এসেছে, তার কোলে পিঠে মানুষ হয়েছে। বড় হয়ে রতনের পরিচয় পেয়েছে-পিতার গ্রামের ছেলে সে, একই সঙ্গে খেলাধূলা করেছে, গ্রামের পাঠশালায় পড়েছে। বনমালী ভৃত্য হিসাবে থাকলেও রতন ঠিক ভৃত্য হিসাবে ছিল না। তার স্ত্রী একটিমাত্র পুত্র ভীমকে নিয়ে বাড়িতে থাকতো, সে সব কথা সে রতনের মুখেই গল্প শুনেছিল।

    রতন বার্ম্মাতেই মারা গেছে।

    কলকাতায় ফিরে নানা ঘটনাবলীর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে ভীমের কথা কৃষ্ণার মনে ছিল না। বৎসরখানেক পরে সে ভীমকে পত্র দেওয়ায় ভীম এসেছিল, মাস পাঁচ-ছয় থাকার পরে ভীম কোথায় চলে যায়, কিছুদিন পরে খবর পাওয়া যায়, ভীম কোনো একটা ডাকাতি কেসে জেলে গেছে। জেলে কৃষ্ণা তার সঙ্গে দেখা করেছিল, সেদিন ভীম দিদিমণির পায়ে হাত দিয়ে শপথ করেছিল, সে মুক্তিলাভ করেই কৃষ্ণার কাছে আসবে।

    কিন্তু সে আর আসেনি; মুক্তি পেয়েই সে কোথায় গেছে কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতদিন পরে আজ এইখানে দেখা গেল ভীমকে।

    ভীম দরজা হতেই প্রণাম করে চাপা সুরে বললে, ”এখান হতেই দণ্ডবৎ হচ্ছি দিদিমণি, দরজা ছেড়ে ওদিকে যেতে গেলে যদি কেউ দেখতে পায়-সে বিপদের মধ্যে পড়া উচিত নয়। এক কাজ করি দিদিমণি, দরজা আমি বন্ধ করে রাখি, আপনি দরজার কাছে এসে এই ফাঁক দিয়ে কথা বলবেন-খাঁসাহেব কোনো সন্দেহ করতে পারবে না।

    বলতে বলতে সে দরজা বন্ধ করে দেয়।

    কৃষ্ণা দরজার কাছে সরে আসে।

    দরজায় ফাঁক আছে, সে এতদিন তা লক্ষ্য করেনি; সম্ভব ভীমই কোনোরকমে এই ফাঁক বার করেছে।

    ”খাঁসাহেবের নাম করছো ভীম, তিনি কে?”

    কৃষ্ণার প্রশ্নের উত্তরে ভীম আশ্চর্য্য হয়ে যায়, ”আপনি খাঁসাহেবকে চেনেন না দিদিমণি? তিনি যে প্রতিদিন আপনাকে দেখে গেছেন, ওষুধপত্র দিয়ে গেছেন। তিনি আবার ডাক্তারীও জানেন কিনা।”

    ”ও” বলে কৃষ্ণা চুপ করে যায়; তারপর জিজ্ঞাসা করে, ”কিন্তু তুমি এখানে কি করে এলে, সেটাই যে আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হচ্ছে।”

    ভীম হাসে, তার হাসির শব্দ কৃষ্ণা শুনতে পায়; ভীম বললে, ”সত্যি কথাই বলব দিদিমণি, আমার মনিব রজনী দত্ত, আমি তাঁর কাজের একটা ভার নিয়ে আপনার কাছে গিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের কথা, তিনি আমায় যে কাজের ভার দিয়েছিলেন, আমি তার কিছুই করতে পারিনি। নিমকহারামি করতে পারলুম না, সে কথা স্পষ্টই বাবুকে জানিয়ে আমি শেষ পর্য্যন্ত সরে এলাম।”

    কৃষ্ণা বললে, ”অতটা সাধুতা না দেখালেই হতো ভীম, আমার বুকে ছুরি বসিয়ে চলে গেলেই তোমার বাবুর বাসনা সিদ্ধ হতো নিশ্চয়।”

    ভীম সঙ্কুচিত কণ্ঠে বলে, ”ও কথা বলবেন না দিদিমণি; আমি একথা কোনোদিনই ভুলব না-আমার বাবা আপনার বাবার অন্নে প্রতিপালিত হয়েছিলেন। শুধু তিনি নন, আমিও আপনাদের অন্নে মানুষ হয়েছি। আর সব করতে পারব-আপনাদের অনিষ্ট আমি বেঁচে থাকতে কোনোদিন করতে পারব না, একথা জেনে রাখবেন।”

    কৃষ্ণা মুহূর্ত্ত চুপ করে থাকে, তারপর বললে, ”অনিষ্ট না করতে পারো, তোমার দিদিমণির যাতে উপকার হয়, তা কি করতে পারবে না? তুমি কি চাও-আমি এখানে এই অবস্থায় মরবো, জীবনে স্বাধীনতা কোনোদিন পাব না? তুমি নিশ্চয় জানো-রতনকাকা আমায় নিজের মেয়ের মতো মানুষ করেছিলেন।”

    অধৈর্য্য ভাবে ভীম বলে উঠলো, ”জানি দিদিমণি, সবই জানি। আপনি এটুকু জেনে রাখুন, কেবল আপনার জন্যেই আমি আজ এখানকার পাহারার ভার নিয়েছি। আমি জানতাম না-এরা আপনাকে এখানে আটক করে রেখেছে, কাল মাত্র শুনেছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন দিদিমণি, ভীম ঘোষ বেঁচে থাকতে কেউ আপনার এতটুকু ক্ষতি করতে পারবে না।”

    ব্যগ্র কণ্ঠে কৃষ্ণা বললে, ”কিন্তু কবে আমি মুক্তি পাব ভীম, আমি যে আর থাকতে পারছিনে।”

    ভীম উত্তর দেয়, ”আর দু-একদিন আপনাকে থাকতেই হবে দিদিমণি। আজ সন্ধ্যায় খাঁসাহেবদের সঙ্গে আমাকে ময়ূরভঞ্জে যেতে হবে, পরশুদিন আমি ফিরব, খাঁসাহেব দু’দিন ওখানে থাকবে। সেই সময় আপনাকে আমি কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে আসব।”

    হঠাৎ থমকে চুপ করে যায় ভীম-ফিসফিস করে বলে, ”লোক আসছে, সরে যান ওখান থেকে।”

    কৃষ্ণা সরে এসে নিজের শয্যায় বসলো।

    আট

    দরদী আবু

    এরা কে, কি মতলবে তাকে নিয়ে এসেছে, বন্দিনী করে রেখেছে, কৃষ্ণা তাই বুঝতে পারে না।

    ভীমও তো কই ফিরল না। যখন সে ফিরবে বলেছিল, সে সময় তো কেটে গেছে। ওরা কি ভীমকে এখান থেকে সরিয়ে দিলে? আবার হতাশ হয়ে পড়ল কৃষ্ণা।

    বেশ বুঝতে পারা যাচ্ছে, চতুর খাঁসাহেব বা তাঁর মনিব রজনী দত্ত যে কোনো রকমে তাকে আটক করেছেন, হয়তো ভীমকে সন্দেহ করেন তাঁরা, সেইজন্যেই কৃষ্ণার কাছে সে আর আসতে পারেনি।

    সুযোগ খোঁজে কৃষ্ণা, যে উপায়েই হোক তাকে পলায়ন করতেই হবে।

    যে লোকটি নিয়মিত তাকে আহার্য্য দিয়ে যায়-সে এদেশের লোক নয়, কোনো ভাষাই সে বোঝে না। কৃষ্ণা কয়দিন তার সঙ্গে কথা বলবার চেষ্টা করে নিরাশ হয়েছে।

    সেদিন হঠাৎ সে অনুপস্থিত হল, একটি অল্পবয়স্ক ছেলে কৃষ্ণার খাবার নিয়ে এল।

    কৃষ্ণা আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট দেখলে ছেলেটিকে। ছেলেটিকে দেখে সে খুশীই হয়। পনেরো-ষোল বছরের ছেলেটি, বাঙ্গালায় কথা বলে, যদিও জাতিতে উড়িয়া। কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”যে লোক খাবার আনতো, সে আজ এল না কেন খোকা?”

    সে উত্তর দিলে, ”তার অসুখ করেছে, তাই যে কয়দিন সে ভালো না হয়, আমিই খাবার আনব।”

    দু-এক দিনেই কৃষ্ণা তার সঙ্গে পরিচয় করে ফেললে।

    এর নাম আবু। এর বাবা এদের দলেরই লোক। আবু পিতার কাছেই থাকে।

    কথায় কথায় কৃষ্ণা জানতে পারে-উপস্থিত এখানে দলের পাঁচ-সাতজন লোক মাত্র আছে, খাঁসাহেব কি কারণে ময়ূরভঞ্জের দিকে কোথায় গেছেন, দত্তসাহেবও কিছুদিন কোথায় আত্মগোপন করেছেন। পুলিশ নাকি এদিকটায় ঘোরাঘুরি করছে।

    কৃষ্ণাকে আবু বলেছিল, ”তোমাকে এরা এখান নিয়ে এসেছে কেন জানো দিদিমণি? রজনীবাবু আমাদের খাঁসাহেবের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন-তোমাকে আরবে নিয়ে যাওয়া হবে, তোমার টিকিট করা হয়ে গেছে প্লেনের, আজ-কালের মধ্যেই তোমায় নিয়ে যাবে ওরা।”

    ”আরবে-মানে একেবারে ভারতের বাইরে?”

    মনে মনে কৃষ্ণা অধীর হয়ে ওঠে, মুখে বলে, ”কি করব বাপ, বন্দিনী হয়ে আছি, ওরা যেখানে খুশী সেখানে নিয়ে যাবে, আমি কি করব আবু?”

    কিশোর আবু উত্তেজিত হয়ে ওঠে-”কেন কিছু করতে পারবে না দিদিমণি? হিন্দু মেয়ে তুমি-তোমাকে ওরা নিয়ে যাবে আরবের কোন সুলতানের হারেমে তুলে দিতে-তুমি কি চুপ করে থাকবে? তুমি যদি চাও, আজই আমি তোমায় সঙ্গে করে নিয়ে কাছাকাছি একটা পুলিশ থানায় তোমায় পৌঁছে দেব, সেখান হতে সহজেই তুমি কলকাতায় ফিরে যেতে পারবে দিদিমণি।”

    কৃষ্ণা যেন হাত বাড়িয়ে স্বর্গ পায়, দুই হাতে সে কিশোর আবুর হাত দুখানা চেপে ধরে, ব্যগ্র কণ্ঠে বললে, ”পারবে আবু-পারবে আমায় আজ এখান হতে বার করে দিতে?”

    আবু বললে, ”পারব বই কি দিদিমণি, তোমাদের আশীর্ব্বাদে আবু না পারে এমন কাজ নেই। আমার বাবা উড়িয়া হলেও আমার মা বাঙ্গালী ছিল দিদিমণি, সেইজন্যে আমি বাঙ্গালী প্রত্যেক মেয়েকে আমার মা বলে ভাবি। আমি সব জানি দিদিমণি,আমিও সুযোগ খুঁজছিলুম, তুমি তৈরী থেকো, সন্ধ্যেবেলা আমি আসব।”

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করলে, ”কিন্তু দরজায় যে লোক থাকে-”

    আবু অবজ্ঞার সঙ্গে উত্তর দিলে, ”উঃ, তার কথা আর বলতে হবে না, সে আমি ঠিক করে নেব, তোমার ভাববার কারণ নেই।”

    সে বার হয়ে যায়।

    আর কৃষ্ণা! সে আর প্রস্তুত হবে কি-সর্ব্বদাই সে তো প্রস্তুত হয়েই আছে।

    মনে সন্দেহও জাগে-হয়তো আবু আসবে না, আসতেও পারবে না, ভীমের মতো ওকেও ওরা কোনোরকমে আটক করবে। তবে একটা ভরসার কথা, এসময়ে এদের এখানে লোক বেশী নেই, সবাই বাইরে বাইরে আছে।

    মনে তার একটু আশা উঁকি মারে-আজ রাত্রেই সে মুক্তি পেতে পারবে।

    কি করছেন মামাবাবু তাই বা কে জানে! ট্রেণ দুর্ঘটনার কথা তিনি শুনেছেন, হয়তো ঘটনাস্থলে এসে আতিপাতি করে খুঁজেছেন, সে মারা গেছে, এই কথাই তিনি ঠিক জেনে নিয়েছেন, অথচ সে বেঁচে আছে! হঠাৎ যখন গিয়ে দাঁড়াবে, তখন মামাবাবু কি করবেন! যদি অবশ্য সে এখান থেকে মুক্তি পায়!

    বাইরে হয়তো সন্ধ্যা নেমে আসে, ঘরের মধ্যে অন্ধকার ঘন হয়ে জমে; কৃষ্ণা ব্যগ্রভাবে অপেক্ষা করে-কখন তার দরজায় করাঘাতের শব্দ হবে।

    রাত্রি বাড়ে-চারিদিককার নিস্তব্ধতা গম গম করে। বাইরে কথার শব্দ পাওয়া যায়, আবুর কণ্ঠস্বর, দ্বাররক্ষীর সঙ্গে সে কথা বলছে।

    না, আবু বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, সে এসেছে। ভীমকে কৃষ্ণা বিশ্বাস করে ঠকেছে, ভীম নিজের কথা রাখতে পারেনি, হয়তো মিথ্যা কথাই বলে গেছে। কিংবা তার পক্ষে কোনো কিছু করা সম্ভব হয়নি।

    কৃষ্ণা উৎকীর্ণ হয়ে থাকে-কখন আবু দরজায় আঘাত করবে। দরজা সে ভিতর হতে অর্গলরুদ্ধ করে রেখেছে, এখানে কাউকে সে বিশ্বাস করে না।

    দরজায় করাঘাত শোনা যায়-আবু চাপাসুরে ডাকছে, ”দিদিমণি-জেগে আছ দিদিমণি-”

    কৃষ্ণা ক্ষিপ্রহস্তে দরজা অর্গলমুক্ত করে, খোলা দরজায় দেখা গেল আবুকে।

    ”শিগগির বার হয়ে এসো দিদিমণি, এক মিনিট দেরী করো না। খাঁসাহেব আর দত্ত দুজনেই ফিরে এসেছে, আজ রাত্রেই তোমায় ওদের মোটরে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। এখন ওদের মন্ত্রণা হচ্ছে-এখনই হয়তো আসবে, শিগগির পা টিপে টিপে বার হয়ে এসো।”

    আবু ঘনীভূত অন্ধকারের মধ্যে সন্তর্পণে অগ্রসর হয়, তার পিছনে চলে কৃষ্ণা।

    পুরাতন অট্টালিকা-সেকালের প্রকাণ্ড বড় প্রাসাদ, বহু অলিগলি ঘুরে কৃষ্ণা আবুর সঙ্গে একেবারে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে।

    ফিসফিস করে কৃষ্ণা বললে, ”তোমার কথা আমি কোনোদিনই ভুলব না আবু ভাই, তুমি আজ আমার যে উপকার করলে-”

    বাধা দেয় আবু, ”থাক, থাক দিদিমণি, আগে তোমায় থানায় পৌঁছে দেই, তারপর কথা বলো। এখনই যদি ওরা তোমার ঘরে যায়, তোমায় দেখতে না পায়, চারিদিকে লোক ছুটবে জোরালো আলো নিয়ে-সে আলোয় আমরা লুকিয়ে থাকতে পারবো না। আমায় ওরা সঙ্গে সঙ্গে গুলি করে মারবে দিদিমণি, ওদের দয়া-মায়া বলে কোনো কিছু নেই।”

    সে দ্রুত চলতে থাকে, পিছনে কৃষ্ণাও দ্রুত চলে। মাঝে মাঝে আবুকে থামতে হয় কৃষ্ণার জন্য, তার মতো অত জোরে কৃষ্ণা ছুটতে পারছে না।

    আবুর মুখেই শুনতে পাওয়া যায়-মিথ্যা কথা বলে সে দ্বাররক্ষীকে সরিয়ে দিয়েছে। খাঁসাহেব জরুরী দরকারে ডাকছেন বলে সে তাকে পাঠিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে দরজা খুলেছে। এতক্ষণ সে ফিরে এসেছে। দরজায় তালাবন্ধ দেখে সে নিশ্চয়ই কোনো সন্দেহ করেনি।

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে, ”থানা এখান হতে কতদূর?”

    আবু হিসাব করে উত্তর দেয়, ”তা অনেকদূর দিদিমণি, মাইল তিনেক তো নিশ্চয়ই, বেশী হবে ছাড়া কম নয়।”

    বলতে বলতে সে পিছনে তাকায়।

    শঙ্কিত কণ্ঠে বললে, ”সর্ব্বনাশ, ওরা জানতে পেরেছে, আলো দেখা যাচ্ছে-নিশ্চয়ই খুঁজতে বার হয়েছে। দৌড়াও দিদিমণি, ওই গাছটার উপরে যদি কোনোরকমে উঠতে পারো।”

    কৃষ্ণা উত্তর দেয়, ”খুব উঠতে পারবো আবু ভাই, তুমিও উঠে পড় তাড়াতাড়ি।”

    বহুদূরে মোটরের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে, আর খানিক এগিয়ে এলেই কৃষ্ণা ধরা পড়বে।

    আবু তর তর করে সামনের বড় অশ্বত্থ গাছটায় উঠে পড়ে, কৃষ্ণাও কোনোরকমে উঠে ঘন পাতার আড়ালে আত্মগোপন করে।

    উঁচু-নিচু পথের উপর দিয়ে মোটরের গতি ব্যাহত হচ্ছিল তাই এটুকু সময় পাওয়া গেল।

    মোটরখানা সেই গাছের তলা দিয়েই চলে যায়, মোটর আরোহীরা জানতে পারলে না যাকে তারা খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই এই গাছের পাতার ফাঁকে আত্মগোপন করে তাদের গতিপথ নিরীক্ষণ করছে।

    অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ থাকে কৃষ্ণা, আবুর কোনো সাড়া পাওয়া যায় না।

    আর জনপ্রাণীর দেখা পাওয়া যায় না। কৃষ্ণা চাপা সুরে ডাকে, ”এসো আবু, নেমে পড়।”

    আবুর শঙ্কিত কণ্ঠস্বর শোনা যায়, ”ধরা পড়ব দিদিমণি, আমায় ওরা খুন করে ফেলবে।”

    কৃষ্ণা শক্তকণ্ঠে বললে, ”গাছের ওপর থেকেই কি তুমি বাঁচবে আবু? আর খানিক পরে সকাল হয়ে যাবে, পথ দিয়ে চলতে চলতে যে কেউ তোমায় দেখতে পাবে। সে রকম ভাবে ধরা পড়ে ওদের শাস্তি বহন করার চেয়ে নিরাপদ জায়গায় যাওয়ার চেষ্টা করা কি ভালো মনে করো না?”

    অগত্যা পক্ষে আবুকে নামতে হয়, পিছনে পিছনে কৃষ্ণাও নামে।

    নয়

    আবার বিপদ

    সোজা হয়ে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে কে যে কঠিন দুই হাতে ধরে ফেলে, কৃষ্ণা তাকে দেখতে পায় না। একদিকে সোজা দৌড় মারে আবু।

    বিদ্রূপের সুরে কে বলে, ”এই যে, এবার পেয়েছি তোমায় কৃষ্ণা দেবী, বড় নাকাল করেছো আমাদের। উঃ, অনেক মেয়ে দেখেছি, তোমার মতো অদ্ভুত ক্ষমতা সত্যই দেখিনি।”

    সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল টর্চের আলো জ্বলে ওঠে, সেই আলোয় লোকটাকে আবছা দেখা যায়।

    মুহূর্ত্তমাত্র কৃষ্ণা নিস্তব্ধ থাকে, তারপরই অকস্মাৎ একখানা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে লোকটার নাকের উপর প্রবলবেগে ঘুষি চালায়।

    ”উঃ-”

    শব্দটা করবার সঙ্গে সঙ্গে সে কৃষ্ণাকে ছেড়ে দিয়ে দুই হাতে আহত নাক চেপে ধরে।

    সেই অবকাশে কৃষ্ণা দ্রুত ছুটতে আরম্ভ করে।

    কোথায় সরে গেছে আবু, অন্ধকারে কোথায় আত্মগোপন করেছে কে জানে। অন্ধকার অজানা পথ ছেড়ে কৃষ্ণা পাশের ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে নেমে পড়ে।

    এতক্ষণ লোকটা নিজেকে সামলে নিয়েছে, তীক্ষ্ন একটা হুইসলের শব্দ কৃষ্ণার কানে আসে। এই শব্দে যে সঙ্কেত আছে, তা কৃষ্ণা বুঝতে পারে; সে জানে এই শব্দ শুনে সকলেই এদিকে ছুটে আসবে, মুহূর্ত্তমধ্যে সে ধরা পড়বে।

    মোটর প্রস্তুত, পাপিষ্ঠ রজনী দত্ত ও খাঁসাহেব ফিরে এসেছে, আজ রাত্রেই তাকে নিয়ে তারা রওনা হবে। না, যেমন করেই হোক, কৃষ্ণাকে ওদের হাত এড়াতে হবে।

    নিঃশ্বাস বন্ধ করে কৃষ্ণা ছোটে।

    পিছনে যেন কয়েকটি পদশব্দ শোনা যায়, কারা ছুটে আসছে। সৌভাগ্যের কথা, ওদের হাতে আলো নাই, আলো থাকলে এই মুহূর্ত্তে কৃষ্ণাকে দেখতে পেতো।

    কিন্তু কৃষ্ণা আর ছুটতে পারে না। ট্রেণ অ্যাকসিডেণ্টের পর হতে তার পায়ে জুতা নেই, শুধু পায়ে ঝোপ-জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটতে ছুটতে পা দুখানা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে উঠেছে।

    হাঁপাতে হাঁপাতে একটা অন্ধকার ঝোপেরে আড়ালে এসে কৃষ্ণা বসে পড়ে।

    অনুসরণকারী কাছে এসে পড়েছে। পদশব্দ শুনে বুঝা যাচ্ছে একজন লোক মাত্র, বেশী নয়। একজন লোককে হয়তো কোনোরকমে জখম করা যেতে পারে, কৃষ্ণার সে শক্তি ছিল, কিন্তু এখন কয়দিন অর্দ্ধাহারে অনিদ্রায়, উদ্বেগে চিন্তায় কৃষ্ণা সত্যই নিজেকে দুর্ব্বল মনে করছে। হয়তো বেশীদূর সে দৌড়ায়নি, তবু মনে হচ্ছে, সে অনেকখানি পথ দৌড়িয়েছে, হাঁপিয়ে উঠেছে, এখন একটি হাত বা পা তুলবার ক্ষমতাও তার নাই।

    দুই হাতে কম্পমান বুকখানা চেপে ধরে ঝোপের মধ্যে আত্মগোপন করতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে সে।

    অনুসরণকারী ঝোপের বাইরে দাঁড়াল বলে মনে হল, পদধ্বনি তার থেমে গেছে।

    নিঃশ্বাস বন্ধ করে কৃষ্ণা, আবার ধরা সে পড়েছে, নিষ্কৃতির পথ আর নাই।

    ”দিদিমণি, কৃষ্ণা দিদিমণি-”

    ভীমের কণ্ঠস্বর, শুনেই কৃষ্ণা বুঝতে পারে।

    কৃষ্ণা বিশ্বাস করতে পারে না ভীম একা, তাই কোনো সাড়া দিলে না।

    ভীমের মৃদু কণ্ঠস্বর আবার শোনা যায়, ”ভয় নেই দিদিমণি, আমি ভীম, বিশ্বাস করুন আমি একা-আমি নিমকহারামী করব না।”

    কৃষ্ণা আস্তে আস্তে উঠে বসলো।

    ভীম বললে, ”ঝোপের বাইরে আসুন-ভয় নেই, আমি আপনার অনিষ্ট করব না, ভগবানকে ধন্যবাদ যে, এদিকটায় আমি এসেছি-ওরা ওদিকে খুঁজছে। আর কেউ এদিকে এলে আপনার নিস্তার ছিল না। আসুন দিদিমণি’-”

    অতি কষ্টে কোনোরকমে কৃষ্ণা দাঁড়াল, আর্দ্রকণ্ঠে বললে, ”আমি যে হাঁটতে পারছিনে ভীম, পা কেটে গেছে, এক পা চলবার ক্ষমতা আার নেই।”

    ভীম একমুহূর্ত্ত ভাবে, তারপর বললে, ”আমি আপনাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে পারব দিদিমণি। এসময় লজ্জা-সঙ্কোচ করবেন না, আমাকে আপনার নিজের ভাই বলে ভাবুন।”

    বলতে বলতে সে কৃষ্ণাকে অবলীলাক্রমে নিজের স্কন্ধের উপর তুলে নিলে। অন্ধকারে অতি সহজেই সে চললো দ্রুত-অতি দ্রুত ছুটতে থাকে ভীম; কৃষ্ণাকে সে কোনো নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেবে।

    কৃষ্ণার সৌভাগ্যবশেই ভীম এদিকটা খুঁজবার ভার নিয়ে এসেছিল। বিভিন্ন দিকে লোক ছুটেছে-ভোরের আলো তখনও আকাশের কালো বুক উজ্জ্বল করে তোলেনি-এই রাতটুকুর মধ্যে কৃষ্ণাকে বহন করে অনেকখানি পথ ছুটে এসে পরিশ্রান্ত ভীম কৃষ্ণাকে নামিয়ে বসে পড়ে।

    হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, ”আর ভয় নেই, দিদিমণি, এই সামনে ষ্টেশন দেখা যাচ্ছে, আপনি আস্তে আস্তে এটুকু হেঁটে গিয়ে প্রথম যে ট্রেণ আসবে তাতে উঠে কলকাতায় চলে যান।”

    কৃষ্ণা বললে, ”আর তুমি কি করবে ভীম,-তুমিও আমার সঙ্গে কলকাতায় চল না কেন?”

    মলিন হাসি হাসে ভীম, নিজের কপালে হাত বুলায়, ম্লান কণ্ঠে বলে, ”কোনো উপায় নেই দিদিমণি, আমার কোথাও যাওয়ার উপায় নেই, মরি-বাঁচি আমায় এদের কাছেই থাকতে হবে।”

    নরহত্যার অভিযোগে অভিযুক্ত ভীম। তাকে ধরে দিতে পারলে পাঁচশত টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা আছে, ভীম আর ফিরতে পারে না ওদের কবল থেকে।

    তার দুঃসময়ে যখন কোথাও সে আশ্রয় পায়নি, সেই সময়ে রজনী দত্ত তাকে আশ্রয় দিয়েছে, তাকে বাঁচিয়েছে। এখনও সে তাদের কেনা চাকর। ওদের হাত থেকে পালিয়ে যাবেই বা সে কোথায়? দল ছেড়ে গেলেও তাকে যে কোনোরকমে হোক মৃত্যুবরণ করতে হবে।

    যে রাত্রে কৃষ্ণাকে মুক্ত করে দেওয়ার কথা ছিল হঠাৎ সেই সন্ধ্যায় তাকে খাঁ-সাহেবের সঙ্গে যেতে হয়। মনে হয় দলের কেউ কৃষ্ণার সঙ্গে তার কথোপকথনের কথা খাঁ-সাহেবের কানে তুলে দিয়েছিল। রজনী দত্ত ভীমকে বিশ্বাস করলেও খাঁ-সাহেব তাকে বিশ্বাস করেনি, সেই জন্যই তার আদেশে ভীমকে তার অনুবর্ত্তী হতে হয়েছিল।

    আবুর কথা জিজ্ঞাসা করে কৃষ্ণা,-

    ভীম জানালো-আবুর কথা কেউ এখনও ভাবেনি, তাকে কেউ সন্দেহ করেনি। ভীম একাই জানে আবুর সহায়তায় কৃষ্ণা পলায়ন করেছে, খাঁ-সাহেব বা রজনী দত্ত আবুকে মোটেই অপরাধী ভাবেনি।

    ক্ষুদ্র ষ্টেশন-আবছা অন্ধকারে কৃষ্ণা নাম পড়তে পারলে না। ভীমের সাহায্যে কোনোরকমে ষ্টেশনের বাইরে বারাণ্ডায় একখানা বেঞ্চের উপর এসে বসলো; তখনও নিজেকে সে ক্লান্ত মনে করছিল।

    ভীম বিদায় নেয়-সকাল হয়ে আসছে, তার উপর যাতে কারও সন্দেহ না হয় সেজন্য তাকে এখনই ফিরতে হবে।

    সারা রাত্রির পরিশ্রমে ক্লান্ত কৃষ্ণার বুঝি চোখ ঘুমে ভেঙ্গে আসে। প্রাণপণ চেষ্টায় সে জেগে থাকতে চায়, কিন্তু ক্লান্ত মস্তিষ্কে জাগার চেষ্টা তার ব্যর্থ হয়।

    তখনও ফরসা হয়নি, ট্রেণ আসতে বিলম্ব আছে, ষ্টেশনে লোকজন নাই।

    নিঃশব্দে ওয়েটিং রুম হতে কালো পোষাক পরিহিত দু’জন লোক বার হয়ে আসে। অন্ধকারে তাদের দেখতে পায় না কৃষ্ণা।

    একজন পকেট হতে একটা শিশি বার করে ছিপি খুলে পিছন থেকে শিশিটা কৃষ্ণার নাসাগ্রে ধরলো। উগ্র ক্লোরোফর্ম্মের প্রভাবে কৃষ্ণার চৈতন্য ফিরবার আর কোনও সম্ভাবনা রইল না।

    ষ্টেশন মাষ্টারের ঘর হতে একজন লোক বার হয়ে আসে। কালো পোষাক পরিহিত লোকটি কেবল বললে, ”ধন্যবাদ মাষ্টার বাবু, তোমার প্রাপ্য টাকা এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি না জানালে এর এখানে আসার কথা জানতে পারতাম না, তোমার এ উপকার চিরদিন আমার মনে থাকবে।”

    দ্বিতীয় ব্যক্তিকে লক্ষ্য করে সে বললে, ”ধর দত্ত, নিয়ে চল গাড়িতে, দেরী করো না।”

    দু’জনে কৃষ্ণার অচৈতন্য দেহ ধরাধরি করে লাইনের অপর পার্শ্বে একটি গাছতলায় কালো রংয়ের যে মোটরখানা অপেক্ষা করছিল তাতে তুলে দিলে, নিজেরাও উঠে বসলো-

    মোটর উল্কাগতিতে ছুটলো।

    কালো পোষাকটা খুলে ফেলে আলি মহম্মদ শ্রান্ত কণ্ঠে বললে, ”উঃ শয়তানী যা কষ্ট দিয়েছে দত্ত,-এ রকম কষ্ট কখনও পাইনি জীবনে। আজই এদের নিয়ে যাব ভেবেছিলাম, তা আর হলো না, সকাল হয়ে এসেছে, জানাজানি হয়ে যাবে। যাই হোক, কাল রাত্রে একে আর যে কয়জন যোগাড় করা হয়েছে তাদের নিয়ে রওনা হতে হবে মনে রেখো।”

    রজনী দত্ত নিঃশব্দে মাথা কাত করে।

    আলি মহম্মদ বললে, ”দুর্গাপুরের কাছাকাছি আমি নেবে যাব, তোমার হাতে কয়েকটি মেয়ের ভার দেওয়া রইলো দত্ত, বিশেষ করে এ মেয়েটিকে সাবধান। এর পরিচয় আমার চেয়ে তুমিই বেশী জানো দত্ত, তোমাকে যা ঘোল খাইয়েছে সে কথা মনে রেখে সাবধান হয়ে কাজ করো। ঘণ্টাখানেকের আগে এর চৈতন্য ফিরবে না, তার অনেক আগে তুমি দুর্গাপুর পৌঁছাতে পারবে।”

    মোটর একটা জায়গায় এসে থেমে গেল-আলি মহম্মদ নেমে পড়লো। বলে গেল,”সন্ধ্যার পরে এদিককার বন্দোবস্ত ঠিক করে আমি আসছি, এর মধ্যে যা যা করবার তুমি করবে।”

    মোটর আবার চলতে সুরু করলো।

    দশ

    পুত্রবধূ নিখোঁজ

    কৃষ্ণার নিখোঁজ সম্বন্ধে আজও কোনো সুরাহা হল না, এর মধ্যেই নূতন করে আবার মাথায় এসে চাপলো ব্যবসায়ী ভকতরাম লোহিয়ার কেস-

    ব্যোমকেশ নিরুপায় হয়ে টেকো মাথায় হাত বুলান।-অত্যন্ত অসহায় মনে করেন নিজেকে।

    লোহিয়র পুত্রবধূ সেদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি।

    পুত্র দেবীপ্রসাদও সঙ্গে ছিলেন; মেট্রো সিনেমা হতে বার হয়ে সামনেই দেখতে পেয়েছিলেন নিজের মোটরখানা-ড্রাইভার পাশেই অপেক্ষা করছিল। পার্ব্বতীবাই-কে মোটরে তুলে দিয়ে, নিজে উঠবার সময় জনৈক বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে যাওয়ায়, একটু আলাপ করছিলেন ভদ্রতা হিসাবে।

    ড্রাইভার সবিনয়ে জানালে যে, বাবু যতক্ষণ কথা বলছেন, সে ততক্ষণ মোটরখানা ঘুরিয়ে নিচ্ছে।

    নিজের গাড়ী, নিজের ড্রাইভার, অবিশ্বাসের হেতু ছিল না। সুখন সিং বহুকালের পুরাতন ড্রাইভার। বাড়ির মেয়েদের মোটরে নিয়ে সে যে-কোনো স্থানে যায়, তাকে সন্দেহ করা চলে না।

    বন্ধুর সঙ্গে মিনিট পাঁচেক কথাবার্ত্তা বলে দেবীপ্রসাদ অগ্রসর হয়ে যান, কিন্তু মোটর সেখানে নেই দেখতে পান।

    পার্ব্বতীবাই নিশ্চয়ই ড্রাইভারকে হুকুম দিয়েছে এবং তারই আদেশে সুখন সিং বাধ্য হয়ে বাড়ী চলে গেছে তাকে নিয়ে-দেবীপ্রসাদ তাই ভাবলেন। একখানা ট্যাক্সি নিয়ে তিনি বাড়ী এসে দেখলেন পার্ব্বতী তখনও এসে পৌঁছায়নি।

    চিন্তা হয় বইকি। পুনার মেয়ে পার্ব্বতী, পিতা তার সেখানে ব্যবসা উপলক্ষে বহুকাল রয়েছেন, পার্ব্বতী এতকাল সেখানেই কাটিয়েছে। বাংলাদেশ-বিশেষ করে জনবহুল কলকাতা সহর তার একেবারেই অপরিচিত। মাত্র সাতমাস তার বিবাহ হয়েছে, এর মধ্যে কয়দিন মাত্র স্বামীর সঙ্গে সে বাড়ির বার হয়েছে।

    রাত্রি ক্রমে বাড়ে, সুখন সিংয়ের মোটর ফেরে না।

    কোনো অ্যাকসিডেণ্ট হয়নি তো? কলকাতার পথে নিত্য মোটর ট্রাম বাস অ্যাকসিডেণ্ট হচ্ছে, মেট্রো সিনেমা হতে ক্লাইভ ষ্ট্রীটে আসতে পথে হয়তো কোনো বিপদ ঘটেছে।

    পিতাকে জানাতে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন এবং সেই মুহূর্ত্তে পুলিসে ফোন করেন-আটটা হতে রাত্রি দশটার মধ্যে পথে কোনো মোটর অ্যাকসিডেণ্ট ঘটেছে কিনা সেকথা তিনি জানতে চান।

    রায় বাহাদুর ভকতরাম লোহিয়া-পুলিসের কাছে শুধু নয়, সকলেরই তিনি বিশেষ পরিচিত। বড় ব্যাঙ্কার, বড় ব্যবসাদার,-দান-ধ্যান ক্রিয়া-কর্ম্মে তাঁর নাম যথেষ্ট।

    স্থানীয় পুলিস অফিসার ফোনে সেই মুহূর্ত্তে জানান-এ মুহূর্ত্তে কোথাও কোনো অ্যাকসিডেণ্ট হয়নি। বালীগঞ্জ হতে শ্যামবাজার পর্য্যন্ত গত তিন-চার ঘণ্টা সম্পূর্ণ নিরাপদ আছে।

    ভকতরাম জানান তাঁর পুত্রবধূ মেট্রো হতে বার হয়ে হঠাৎ অদৃশ্য হয়েছেন। তিনি এখনই থানায় আসছেন-সমস্ত ঘটনা মুখেই বিবৃত করবেন।

    দেবীপ্রসাদকে সঙ্গে নিয়ে তিনি নিজেই থানায় উপস্থিত হন ও ডাইরী করে দেন।

    সারা রাত্রি দারুণ উৎকণ্ঠায় কেটে গেল। সকাল বেলা পুলিস হতে খবর আসে-রায় বাহাদুরের বর্ণিত নম্বরের মোটর পাওয়া গেছে। সহর হতে দূরে যাদবপুবের দিকে একটা পথের ধারে সম্পূর্ণ অব্যবহার্য্য অবস্থায় সেখানা পড়ে আছে, লোকজন কাউকে দেখা যায়নি।

    দেবীপ্রসাদ পাগলের মতো ছুটাছুটি করেন। রায় বাহাদুর বন্ধু ব্যোমকেশকে খবর দিয়ে আনান এবং বিশেষ করে তাঁকে এ কেস হাতে নিতে অনুরোধ করেন।

    কেবলমাত্র তাঁর অনুরোধেই নয়, পুলিসের বড় কর্ত্তার আদেশে ব্যোমকেশকে এই কেস হাতে নিতে হয় দারুণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

    একে কৃষ্ণার কোনো সন্ধান করতে পারেননি, নামকরা দুজন আসামী কিভাবে বম্বে- মেল ধ্বংস করে নিজেরা পলাতক হয়েছে সে সন্ধান আজও করে উঠতে পারেননি, তার উপর আবার এই কেস তাঁর মাথায় পড়ায় ব্যোমকেশ অধীর হয়ে উঠলেন।

    পুলিসের পক্ষে দারুণ কলঙ্ক। সে দিনই তো কমিশনার স্পষ্টই বলেছেন-”বাংলার পুলিস অকেজো হয়ে পড়েছে বটে,-নইলে বিখ্যাত দস্যু সর্দ্দার আলি মহম্মদ জেল বদলীর সঙ্গে অতগুলি পুলিস পাহারার মধ্যে বম্বেমেল হতে পালাতে পারে? কৃষ্ণাদেবীর তো কোনো সন্ধানই পাওয়া গেল না, অন্ততঃপক্ষে তাঁর মৃতদেহটাও তো পাওয়া উচিত ছিল। ব্যোমকেশবাবু মোটা মাইনে খাচ্ছেন আর পেট মোটা করে মহা আরামে ঘুম দিচ্ছেন। ওঁর অন্ততঃপক্ষে বোঝা উচিত ছিল কতখানি দায়িত্ব ওঁর মাথায় রয়েছে।”

    মরমে মরে যান ব্যোমকেশ, সেই মুহূর্ত্তে মনে হয়-”ধরণী দ্বিধা হও, তোমার গর্ভে প্রবেশ করে লজ্জা নিবারণ করি।”

    এমনই সময় এসে পড়ল ভকতরাম লোহিয়ার পুত্রবধূর অন্তর্হিত হওয়ার ব্যাপার এবং তার অনুসন্ধানের ভার, ব্যোমকেশ অস্থির হয়ে ওঠেন।

    অনুসন্ধানের কাজ যথানিয়মে সুরু হয়।

    সুখন সিংয়ের অনুসন্ধান চলে।

    দেবীপ্রসাদ বললেন, ”সুখন আমাদের বহুকালের পুরানো লোক, বয়সও তার কম নয়, পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। সে যে এরকম কাজ করতে পারে, আমি তা বিশ্বাস করতে পারিনে ব্যোমকেশবাবু।”

    গম্ভীর মুখে ব্যোমকেশ বলেন, ”মানুষের মতিভ্রম হতে কতক্ষণ? মতিভ্রম হলে মানুষের বিবেচনা শক্তি থাকে না। কাজেই সুখন সিংয়ের সাধুতা আমি কখনই বিশ্বাস করতে পারিনে দেবীপ্রসাদবাবু। যতদূর সম্ভব মনে হয় সুখন সিং কোনো একটা দলভুক্ত লোক ছিল অথবা টাকার লোভে দলভুক্ত হয়েছিল। সম্প্রতি আমাদের আইবি অফিসার মিঃ ঘোষের মুখে খবর পেলুম কয়েক জায়গায় কয়েকটি সুন্দরী মেয়ে অপহৃতা হয়েছে। অবশ্য এরা সকলেই যে ধনী গৃহের বধূ-কন্যা তা নয়, মধ্যবিত্ত বা দরিদ্র ঘরের মেয়েও আছে-এদের শুধু এক জায়গায় মিল আছে,-সকলেই পরমা সুন্দরী। এতে মনে হয় একটা নতুন দলের মন্ত্রণায় আপনাদের বিশ্বস্ত ড্রাইভার সুখন সিং এই কাজ করেছে।”

    দেবীপ্রসাদ একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন, ভকতরাম নিজের শয়নকক্ষ ছেড়ে বার হলেন না।

    এমনই সময় অকস্মাৎ আবিষ্কৃত হল সুখন সিংয়ের মৃতদেহ-

    গ্যারেজের পাশে ড্রাইভারের ঘর। এ ঘরের দিকে এই দু’দিন কেউই দৃষ্টি দেয়নি। কি দরকারে ড্রাইভারের ঘর দেখতে গিয়ে দরজার চাবি খুলেই দ্বারোয়ান চীৎকার করে উঠেছে।

    দেখা যায়, ছোরা-বিদ্ধ সুখন সিং তার নিজের ঘরেই পড়ে আছে।

    ব্যোমকেশ আসেন এনকোয়ারীতে, তাঁর সঙ্গে আসেন তাঁর সহকারী বিনয়বাবু।

    দু’দিন হয়ে গেছে সুখন সিং নিখোঁজ হয়েছে, সে মোটরে এ বাড়ির বধূকে নিয়ে পলায়ন করেছে, তার নামে ওয়ারেণ্ট বার হয়েছে, ফটো প্রকাশ হয়েছে এবং যে তাকে ধরিয়ে দেবে তার নাম পুরস্কার ঘোষণা পর্য্যন্ত হবার ঠিক হয়েছে। আর সেই লোক মৃতাবস্থায় তার নিজের কামরাতেই পড়ে আছে, তার দরজা চাবিবন্ধ; সে ঘরখানা এই দু’দিনের মধ্যে দেখা হয় নাই, এমনই আশ্চর্য্য ব্যাপার।

    ঘরের মধ্যে এমন কিছু পাওয়া গেল না যাতে সন্দেহ হতে পারে এবং যা নিয়ে তদন্ত চলতে পারে। স্বাভাবিক হত্যা ছাড়া এ আর কিছুই নয়-পুলিসের এই মাত্র রিপোর্ট।

    বিনয় দাস বললেন, ”আমার মনে হয় স্যার, সুখন সিং সেদিন মোটর নিয়ে বার হয়নি, হয়তো তাকে দুপুরের দিকেই হত্যা করা হয়েছে, সেটা অবশ্য ডাক্তারী পরীক্ষায় জানা যাচ্ছে। সুখন সিংয়ের মতোই কোনো লোক তারই পোষাক পরে দেবীবাবু আর তাঁর স্ত্রীকে সিনেমায় নিয়ে গিয়েছিল। এদের পরিকল্পনা নিশ্চয়ই আগে হতেই করা ছিল-অন্ততঃ দেখেশুনে তাই মনে হচ্ছে।”

    ব্যোমকেশ কেবল একটি শব্দ করেন, হুম-

    শব্দটা অনেকটা দীর্ঘশ্বাসের মতোই শোনায়।

    তিনিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছেন।

    এ সময় কৃষ্ণা থাকলে অনেক কাজ হত। অসাধারণ তীক্ষ্নবুদ্ধিসম্পন্ন এই মেয়েটিকে তিনি কোনোদিনই কোনো যুক্তিতর্ক দিয়ে পরাস্ত করতে পারেননি। কিন্তু কোথায় হারিয়ে গেল কৃষ্ণা?

    সে নিহত হয়নি,-হলে তার মৃতদেহ নিশ্চয়ই পাওয়া যেত, আহত হলে যে কোনো হাসপাতালে পাওয়া যেত। কেউ তাকে ঘটনাস্থল হতে মূর্চ্ছিতাবস্থায় সরিয়ে নিয়ে গেছে।

    প্রণবেশ এই প্রশ্নটাই সেদিন করেছিলেন। বেচারা প্রণবেশ, আজ তাঁকে দেখলে কেউ চিনতে পারে না। তাঁর যে বিরাট বপু নিয়ে লোকে বিদ্রূপ করেছে, সেই বপু আজ অর্দ্ধেক শুকিয়ে গেছে। প্রতিদিন তিনি পুলিস অফিসে যাতায়াত করছেন, দু’এক দিন খড়্গপুরেও চলে গেছেন, উন্মাদের মতো মাঠের ধারে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন, লোকজনদের জিজ্ঞাসা করেছেন তারা কেউ একটি সুন্দরী মেয়ের খবর জানে কিনা। সে ট্রেণ অ্যাকসিডেণ্টের দিন ট্রেণেই ছিল। রাঁধুনি মোক্ষদা বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদে আর বহু পুরাতন ভৃত্য বনমালী ম্লান মুখে উদাস চোখে চেয়ে থাকে।

    দিন যত যায়-কৃষ্ণার বেঁচে থাকার সম্ভাবনাও তত কম হতে থাকে।

    খবর পেয়ে মৃন্ময় আসেন-প্রণবেশের বন্ধু পুলিস অফিসার, বর্ত্তমানে মুর্শিদাবাদে বদলী হয়েছেন।

    অনেকক্ষণ নিস্তব্ধে তিনি বসে থাকেন তারপর দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, ”না না, কখনই হতে পারে না প্রণব, কৃষ্ণা মরতে পারে না। আমি জোর করে বলছি-সেদিন ট্রেণে ছিল আলি মহম্মদ-এ সব তার কীর্ত্তি। তোমাদের এখানকার রজনী দত্ত আলি মহম্মদের দলের একটি ছোটখাট সর্দ্দার বিশেষ, কিন্তু আলি মহম্মদের তীক্ষ্ন বুদ্ধির কাছে সে কিছুই নয়। আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আলি মহম্মদকে যেদিন নাগপুর জেলে পাঠানো হয় তার অনুচরেরা আগেই তাদের কাজের প্রোগ্রাম ঠিক করে রেখেছিল। এদের পক্ষে পনেরো-কুড়ি হাজার টাকা এঞ্জিনের ড্রাইভার বা গার্ডকে ঘুষ খাওয়ানো নিতান্ত কঠিন ব্যাপার নয়। সে জন্যেই ট্রেণটা জংশন ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে দু’এক সেকেণ্ডের জন্যে গতি হ্রাস করবার সঙ্গে সঙ্গে এরা যে কোনোরকমে পূর্ব্ব-ব্যবস্থা মতো কনেষ্টবলদের তন্দ্রার সুযোগ নিয়ে নেমে পড়ে এবং পুনরায় ট্রেণ জোরে চলবার মুহূর্ত্তে ডিনামাইট বা সেই জাতীয় আর কোনো বিস্ফোরক বস্তু দিয়ে বম্বেমেল ধ্বংস করে। এই রকম সুযোগে কৃষ্ণাকে অচৈতন্যাবস্থায় তারাই নিয়ে গেছে এ কথা আমি জোর করেই বলছি।”

    হতবুদ্ধির মতো প্রণবেশ বললেন, ”কৃষ্ণাকে তারা চিনলো কি করে?”

    মৃন্ময় বললেন, ”না চিনলেও সুন্দরী মেয়ে হিসাবে তারা নিয়ে গেছে। আমি খবর পেয়েছি-যে কয়েকটি মেয়ে বাংলার বিভিন্ন স্থান হতে অপহৃতা হয়েছে, তারা সবাই সুন্দরী এবং অল্পবয়স্কা। আমি খবর পেয়েছি-এই সব মেয়েদের আরবে বা টার্কিতে এরা অর্থাৎ অপহরণকারীরা নিয়ে যাবে-এর জন্যে এরা মোটা টাকাও পাবে।”

    ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকেন প্রণবেশ, জিজ্ঞাসা করেন, ”নিয়ে গিয়ে কি করবে?”

    ”কি করবে-?” হাসেন মৃন্ময়-”হারেমবাসিনী করবে। কোনও সুলতান হয়তো তাঁর হারেম এই রকম সব সুন্দরী মেয়ে দিয়ে সজ্জিত করবেন। হয়তো বলবেন-ওঁদের ওখানেও তো সুন্দরী মেয়ে ঢের আছে, তবু মানুষের রুচি তো-তিনি বোধ হয় এই সব মেয়েই পছন্দ করেন।”

    প্রণবেশ দুই হাতে নিজের মাথার চুলগুলা টানেন।

    মৃন্ময় ব্যোমকেশকে কোনো কথা জানাতে চান না। তাঁকে তিনিও বিশ্বাসও করেন না। লম্বা একমাসের ছুটি নিয়ে মৃন্ময় এসেছেন। এই একমাসের মধ্যে কৃষ্ণাকে তিনি খুঁজে বার করবেনই-অবশ্য যদি সে জীবিত থাকে-এই তাঁর পণ।

    বন্ধুর দৃঢ়তায় প্রণবেশ ভরসা পান।

    এগারো

    নূতন বন্দিনী

    এবার অত্যন্ত বাধ্য মেয়ের মতোই থাকবে কৃষ্ণা-এই সে ঠিক করেছে।

    মোটরে আসার সময় পথের মাঝেই তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল। আলি মহম্মদ ও রজনী দত্তের কথাবার্ত্তা সবই সে শুনেছে। যতখানি ক্লোরোফর্ম্ম করা তাকে দরকার ছিল, ততখানি তাকে দেওয়া হয়নি, স্বাভাবিকভাবে বাইরের খোলা বাতাসে তাই তাড়াতাড়ি তার জ্ঞান ফিরেছিল।

    জ্ঞান ফিরলেও সে মূর্চ্ছিতার মতোই পড়ে ছিল। এদের কথাবার্ত্তা শুনে সে বুঝেছিল-প্রথমে তারা তাকে চেনেনি, সাধারণ একটি মেয়ে মনে করে তাকে তাদের গুপ্ত আবাসে নিয়ে এসেছিল। প্রথম তাকে চিনতে পারে রজনী দত্ত এবং আলি মহম্মদকে সে চিনিয়ে দেয় কৃষ্ণাকে।

    সে রাত্রে আবুর সাহায্যেই যে কৃষ্ণা পলায়ন করেছিল তারা সে সন্দেহ করেনি। আবু যেমন ছিল তেমনই আছে-নূতন আড্ডাস্থল দুর্গাপুরে ভোরের সময় কৃষ্ণাকে নিয়ে যখন রজনী দত্ত পৌঁছালো তখন ধরাধরি করে কৃষ্ণাকে গাড়ী হতে নামানোর সময় দূর হতে আবু আবার তাকে বন্দিনী অবস্থায় দেখে বিবর্ণ হয়ে গেল।

    কৃষ্ণাকে রাখা হল একটি ঘরে-আবু রজনী দত্তের আদেশে চৌকীর উপর বিছানা করে দিলে তাতেই কৃষ্ণাকে শোয়ান হল।

    আবু রইলো তার পরিচৰ্য্যায়। এই কিশোর ছেলেটিকে সবাই বিশ্বাস করতো। কারণ অনেক অসাধ্য কাজ সে করে থাকে আর ছোটখাটো বেঁটে এই ছেলেটিকে দিয়ে এরা বহু কাজ করিয়েও নেয়।

    রজনী দত্ত আবুকে আদেশ করে যায়-জ্ঞান ফিরলে জল বা চা-বিস্কুট প্রভৃতি যা লাগবে তা যেন দেওয়া হয়।

    দরজা ভেজিয়ে দিয়ে রজনী দত্ত চলে যায়।

    আস্তে আস্তে কৃষ্ণা চোখ মেলে-”কি খবর আবু ভাই,-বেশ তো বহাল তবিয়তে রয়েছো,-চমৎকার-”

    আবু আকাশ হতে পড়ে। বিস্ময়ে বলে, ”তুমি অজ্ঞান হওনি দিদিমণি-জেগেই আছো নাকি?”

    কৃষ্ণা হাসে, বলে, ”খানিক সময় জ্ঞান ছিল না এ কথা ঠিক, তবে মোটরে খানিকদূর আসতে আসতেই আমার জ্ঞান ফিরেছিল, তবু আমি মূর্চ্ছিতের ভাবেই যে পড়েছিলাম একথাও সত্য। যাক, এদের ব্যাপারটা কতকটা আমি বুঝেছি। আবু ভাই-এরা চুরি ডাকাতি লুণ্ঠন সবই করেছে, এখন একটা নূতন ব্যবসায়ে নেমেছে তা বুঝেছি। সে ব্যবসা মেয়ে সংগ্রহ করা,-কেবল বড়লোকের স্ত্রী-কন্যাই নয়, গরীবের ঘরের সুন্দরী মেয়ে পর্য্যন্ত। শুনলুম আরও কয়েকটি মেয়ে সংগ্রহ হয়েছে, এখন এদের চালান করবার চেষ্টা চলছে।”

    আবু মখের উপর আঙ্গুল রাখে-”চুপ-”

    বাইরে যেন কার পদশব্দ শোনা গেল, হয়তো দরজার সুমুখ দিয়ে কে যেন চলে গেল।

    খানিকক্ষণ উভয়েই নীরব-

    তারপর আবু ফিস ফিস করে বললে, ”যা শুনেছো সবই সত্যি দিদিমণি। আমি তোমায় সেই দিনই বলেছিলাম এরা তোমাদের আরবদেশে নিয়ে যাবে। পাঁচ-ছয়টি মেয়ে এরা সংগ্রহ করেছে, তার মধ্যে কাল একটি মেয়ে এনেছে-বেচারা কাল হতে আহার-নিদ্রা ত্যাগ করে পড়ে আছে।”

    ”তাই নাকি-”

    কৃষ্ণা উঠে বসে।

    আবু আগে দরজাটা ভিতর হতে খিল বন্ধ করে দিয়ে ফিরে আসে, বললে, ”হ্যাঁ তোমার পাশের কামরায় তাকে রেখেছে-এই কাঠের পার্টিশানের ওদিকে চমৎকার সুন্দর মেয়ে, ঠিক মা সরস্বতীর মতো। গায়ে অনেক হীরের গয়না ছিল, খাঁ-সাহেব সব খুলে নিয়েছে কালকেই। আহা, মেয়েটি কি কান্নাই না কাঁদছে-”

    ”আবু-”

    বাইরে কে ডাকে। নিঃশব্দে বিড়ালের মতো পা টিপে আবু অগ্রসর হয়ে যায়, তার ইঙ্গিত মতো কৃষ্ণা আবার মূর্চ্ছিতের ভানে শুয়ে পড়ে।

    দরজা খুলতেই প্রবেশ করলে আলি মহম্মদ, তার সঙ্গে একটি স্থূলাঙ্গিনী মেয়ে, কুৎসিত চেহারা তার। আলি মহম্মদ জিজ্ঞাসা করে, ”জ্ঞান ফেরেনি এখনও?”

    আবু সসম্ভ্রমে উত্তর দেয়, ”না সাহেব।”

    আলি মহম্মদ চিন্তিত মুখে অগ্রসর হয়ে আসে, সন্তর্পণে কৃষ্ণার হাতখানা তুলে ধরে নাড়ির গতি পরীক্ষা করে।

    বললে, ”না ভালোই আছে। যাক, তোমার ছুটি আবু, রমলা এদের দেখাশুনা করবে, তুমি তোমার নিজের কাজে যেতে পারো।”

    বিবর্ণ মুখে সেলাম দিয়ে একবার করুণ চোখে কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে আবু পায় পায় বার হয়ে যায়।

    রমলা সব দিক দেখেশুনে নেয়। তারপর আলি মহম্মদের সঙ্গে বাইরের দিকে চলতে চলতে বললে, ”সব ঠিক হয়ে যাবে সাহেব, আপনাকে কিছু ভাবতে হবে না। যত বড় দুর্দ্দান্ত মেয়ে হোক, চাবকে সব ঠিক করে দেব।”

    তারা বার হয়ে যায়, সঙ্গে সঙ্গে দরজার চাবি বন্ধের শব্দ কানে আসে।

    একমাত্র বন্ধু ছিল আবু,-তার সাহায্য পাওয়ার পথও রুদ্ধ হয়ে গেল।

    কাঠের পার্টিশানের ওপাশে কথার শব্দ পাওয়া যায়। রমলার পুরুষালী কণ্ঠস্বর কানে আসে, সগর্জ্জনে সে বলে, ”দাঁতে দড়ি দিয়ে পড়ে থাকলেই মনে করেছো তোমায় ছেড়ে দেব-তা স্বপ্নেও ভেবো না। ভালো কথায় বলছি খাও, নইলে নল চালিয়ে খাওয়াব।”

    কে যেন আর্ত্তকণ্ঠে বলছে, ”তোমাদের পায়ে পড়ি, আমায় ছেড়ে দাও, তোমরা যা চাও আমি তাই দেব। কত টাকা চাও বল-আমি তা দেব।”

    রমলার তীক্ষ্ন হাসির শব্দ কানে আসে। ”রাখ রাখ তোমার টাকার কথা-সে কথা খাঁ-সাহেবকে বলো, আমায় বলে কি হবে। তুমি খাবে তো খাও বলছি, আমি যে জন্য এসেছি তাই করো।”

    দৃপ্ত কণ্ঠস্বর কানে আসে, ”না, আমি খাব না।”

    ”খাবে না বই কি,-আলবৎ খেতে হবে; পেটে পা দিয়ে তোমায় খাওয়াব তা জানো, চাবুক মেরে খাওয়াব-”

    হয়তো তার হাতে চাবুক আছে। সেই চাবুক সে শূন্যে চালায়, সপাত সপাত শব্দ কানে আসে, সঙ্গে সঙ্গে চলে তার তর্জ্জন-গর্জ্জন-

    কৃষ্ণা শয্যা ত্যাগ করে, আগে দরজাটা ভিতর হতে অর্গলরুদ্ধ করে সাবধান হয়, তারপর কাঠের পার্টিশানটার কাছে গিয়ে খোঁজ করে কোনো জায়গায় এতটুকু ফাঁক আছে কিনা যেখান হতে পাশের ঘরটা দেখা যায়।

    কয়েকখানি তক্তা মেঝে হতে ছাদ পর্য্যন্ত পৌঁছে রীতিমতো একটি দেয়াল সৃষ্টি করেছে। কোনো জায়গাতেই ফাঁক পাওয়া যায় না, তবু কৃষ্ণা খুঁজে বেড়ায়।

    দেয়ালের কাছে ফাঁক দেখা গেল একটু,-অপর ঘরে তখন সত্যিই চাবুক চলেছে, আর্ত্ত চীৎকার কানে আসছে-”মেরো না, তোমার পায়ে পড়ি,-আর মারলে আমি মরে যাব-”

    ফাঁক দিয়ে দেখে কৃষ্ণা-

    মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মেয়েটি ছটফট করছে, চীৎকার করবার ক্ষমতা তার নাই, যন্ত্রণায় সে যেন মূক হয়ে গেছে। শয়তানী রমলা চাবুকটা হাতে নিয়ে বলছে-”হ্যাঁ, আমি ফিরে এসে যেন তোমার খাওয়া হয়ে গেছে দেখতে পাই, নইলে এই চাবুকের শাস্তি আবার পেতে হবে।”

    দরজার দিকে সে অগ্রসর হতেই কৃষ্ণা এসে দরজার খিল খুলে দিয়ে নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে।

    কিন্তু রমলা এ ঘরে এলো না, সম্ভব সে অন্য ঘরের বন্দিনীদের তত্ত্বাবধান করতে গেল।

    বারো

    রমলার বিস্ময়

    সকাল বেলায় রমলা দরজা খোলে, কৃষ্ণা তখন উঠে বসেছে।

    খুশি হয়ে রমলা বললে, ”বাঃ, এই যে লক্ষ্মী মেয়ের মতো উঠেছো দেখছি। শরীর বেশ ভালো তো এখন?”

    কৃষ্ণা ম্লান হাসি হাসে, বললে, ”বন্দিনীর শরীরের ভালো-মন্দের খবর নিয়েই বা কি লাভ হবে বাই?”

    রমলা বললে, ”লাভ আছে বইকি কৃষ্ণাদেবী, বাঘকে লোকে খাঁচায় রাখে, রীতিমতো তাকে যত্ন করতে হয়, তার খাওয়া কতখানি এবং কোন সময় দিতে হবে, কতখানি সে ঘুমায়, কতবার তত্ত্বাবধানকারীকে এসে খোঁজ রাখতে হয়, সে কথাটা নিশ্চয়ই জানো।”

    কৃষ্ণা সকৌতুকে তার পানে তাকায়, বললে, ”ঠিক কথা বলেছো বাই, তবে বাঘ কিন্তু অত আদব-কায়দা বা আদর-যত্ন বোঝে না। তাই যে লোক তাকে যত বেশীই আদর-যত্ন করুক না কেন, সুযোগ পেলে তারই ঘাড় মটকে সে রক্ত খায়, সে কথাটা তুমিও বোধ হয় শুনেছো।”

    রমলার মুখখানা বিবর্ণ হয়ে যায়। তখনই সে নিজেকে সামলে নেয়, বললে, ”জানি বই কি কৃষ্ণাদেবী, সেই জন্যেই তো তাকে তত বেশী সাবধানে রাখতে হয় যতটা আর কোনো জীবের বেলায় দরকার হয় না।”

    কৃষ্ণা বললে, ”সঙ্গে সঙ্গে একথাও মনে রাখা উচিত, সে সর্ব্বদা মুক্তির সুযোগ খোঁজে-”

    রমলা হাসে। বললে, ”সর্ব্বদাই তা মনে আছে। সেই জন্যে উপযুক্ত পাহারায় রেখেও শক্ত তত্ত্বাবধায়কের প্রয়োজন হয়।”

    কৃষ্ণা বললে, ”জানি সেই জন্যেই এসেছো রমলাবাই, তাহলে বোঝা যাচ্ছে, আলি সাহেব যথাসাধ্য সতর্কতা অবলম্বন করেছেন, ভারত ছেড়ে না যাওয়া পর্য্যন্ত বাই আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন-আনন্দের কথা। নিশ্চয়ই এর জন্যে সুলতানের কাছ হতে রমলাবাইও মোটা টাকা পুরস্কার পাবেন তত্ত্বাবধায়িকা হিসাবে।”

    রমলা একেবারে নির্ব্বাক হয়ে যায়, বিস্ময়ে সে কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে থাকে, বুঝতে পারে না-এ কথা কৃষ্ণা কি করে জানতে পারলে। খানিক নিস্তব্ধ থেকে বললে, ”দেখছি, তুমি অনেক কথাই জেনেছো, মনে হচ্ছে, হয় আবু নয় বাঙ্গালী রজনী দত্ত তোমায় এ সম্বন্ধে কিছু জানিয়েছে। সেদিন তোমার পালানোর ব্যাপারে ভীমের হাত ছিল। সে যেমন বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল তার ফলও হাতে হাতে পেয়েছে। সে কথাটা শুনতে পাবে একদিন।”

    কৃষ্ণা মনে মনে শঙ্কিত হয়ে উঠলেও মুখে প্রচুর শান্ত ভাব দেখিয়ে বললে, ”কি শাস্তি তাকে পেতে হলো রমলাবাই?”

    রমলা উত্তর দেয়, ”আমাদের সর্দ্দার আলি সাহেবের এক গুলিতে তাকে মরতে হয়েছে। তার স্ত্রী আছে এখানে-আমাদেরই দলের মেয়ে ছিল সে, কোন কুলগ্নে ভীমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল কে জানে। ভীমের বিশ্বাসঘাতকতার কথা সেও শুনল। দাঁড়িয়ে দেখল তার শাস্তি। মুখে একটি কথা বলবার সাহস আছে তার? নীরবে চোখ মুছে আবার তার নিজের কাজ করছে।”

    কৃষ্ণা বললে, ”থাক রমলাবাই, ভীমের পরিবারের কথা জানবার ইচ্ছে আমার নেই, আমার নিজের কথাই আমি বলি, আমি জেনেছি তোমরা আমায় কোথায় আরবে বা আফ্রিকায় পাঠাবে-এতে কি লাভ হবে তোমাদের আমি তাই জিজ্ঞাসা করছি।”

    ”লাভ!” হাসে রমলা। বলে, ”সে কথা তোমার জেনে লাভ নেই কৃষ্ণাদেবী, আমাদের লাভ-লোকসান আমরাই বুঝব।”

    কৃষ্ণা বলে, ”ভালো কথা, কিন্তু আর একটা কথা বলতে পারবে?-তুমি এদের দলে এসে জুটলে কি করে? দশ বছরের জন্যে তুমি জেলে গিয়েছিলে, তিন বছরও তো এখনও হয়নি।”

    রমলা যেন চমকে ওঠে, পরমুহূর্ত্তে নিজেকে সামলে নেয়, ”সে সব কৈফিয়ৎও কি তোমাকে দিতে হবে নাকি কৃষ্ণাদেবী?”

    সে গর্জ্জন করে, ”আজ তোমায় হাতে পেয়েছি, সহজে তোমায় ছাড়ব না, রায়জীকে ফাঁসিতে ঝুলানোর শোধ আমি এবার নেব।”

    কৃষ্ণা নিঃশব্দে হাসে মাত্র।

    রমলা আর খানিক তর্জ্জন-গর্জ্জন করে বার হয়ে যায়, কৃষ্ণা দরজা ভিতর দিক হতে বন্ধ করে। কাঠের দেয়ালের পাশে সে গিয়ে দাঁড়ায়। ফাঁক দিয়ে দেখতে পায়-পাশের ঘরে আবছা অন্ধকারে বসে মেয়েটি ফুলে ফুলে কাঁদছে।

    কৃষ্ণা ফিসফিস করে ডাকে, ”শোন, এই যে এদিকে-আমি এদিকের ঘর হতে কথা বলছি। কেঁদো না, এই দেওয়ালের দিকে সরে এসো একবার, আমার কথা শোন।”

    মেয়েটি চমকে উঠে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে, হঠাৎ বুঝতে পারেনি, কোনদিক হতে কে কথা বলছে।

    কৃষ্ণা আবার ডাকে, ”এই যে-এদিকে এসো-‘

    মেয়েটি এতক্ষণে যেন বুঝতে পারে-তারই মতো আর কোনও মেয়েকে এরা পাশের কামরায় রেখেছে, সেই তাকে ডাকছে। উঠে দাঁড়ায় সে, সন্তর্পণে হেঁটে আসে কাছে।

    কৃষ্ণা বললে, ”আমি কালও তোমায় দেখেছি, ওই রাক্ষসীটা তখন তোমায় চাবুক মারছিল, তুমি কাঁদছিলে। তারপর-কাল কিছু খেয়েছিলে, না খাওনি?”

    মেয়েটি খানিক সময় স্তব্ধ হয়ে থাকে, তারপর বললে, ”আপনি জানলেন কি করে সে কথা?” এরপরই ম্লানকণ্ঠে বললে, ”আপনার সব কথা শুনবার পথ আছে, এখান হতে আপনি শুনেছেন বুঝেছি। না,-আমি কাল এক গ্লাস সরবৎ ছাড়া আর কিছুই খাইনি, কিছু খাওয়ার ইচ্ছেও আমার নেই।”

    কৃষ্ণা বললে, ”কিন্তু না খেয়ে বা লাভ কি? এরপর শরীর এমন দুর্ব্বল হয়ে পড়বে তখন পালানোর পথ পেলেও পালাতে পারবে না।”

    ”পালাতে পারবো আপনি সত্যি বলছেন?”-অধীর আগ্রহে সে আরও কাছে এগিয়ে আসে, জিজ্ঞাসা করে-”আচ্ছা, এরা আপনাকেও আটক করে রেখেছে-না? আপনি কতদিন আছেন এখানে, এ জায়গার নাম কি? আপনাকে কোথা হতে এরা নিয়ে এলো-?”

    কৃষ্ণা হাসে, বললে, ”ধীরে প্রশ্ন কর,-একসঙ্গে অতগুলো প্রশ্ন করলে আমার পক্ষে উত্তর দেওয়া শক্ত হয়। আমি কলকাতারই মেয়ে, আজ কুড়িদিন প্রায় আমি আটক রয়েছি, এবার তোমার পরিচয়টা দাও দেখি-”

    মেয়েটি পরিচয় দেয়-

    কলকাতার বিখ্যাত ধনী ভকতরাম লোহিয়ার পুত্রবধূ পার্ব্বতীবাই-সেদিন সিনেমা দেখতে গিয়ে নিজের মোটরে স্বামীর জন্য সে অপেক্ষা করছিল সিনেমা ভাঙ্গবার পর। সেই সময় কি একটা উৎকট গন্ধ তার নাকে আসে-তারপরের ঘটনা সে আর জানে না। হয়তো সে জ্ঞান হারিয়েছিল, জ্ঞান হতে দেখেছিল, দুজন লোক তাকে ধরাধরি করে গাড়ী হতে নামাচ্ছে,-তারপরকার ঘটনা সে আর জানে না-একটা চীৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল আবার। সেই অবস্থায় এরা তাকে এখানে এনেছে।

    ভকতরাম লোহিয়াকে কৃষ্ণা চেনে। তাঁর পুত্র দেবী প্রসাদের বিবাহের নিমন্ত্রণ রাখতে সে গিয়েছিল এবং একটি আংটি পার্ব্বতীবাইকে উপহার দিয়েছিল। মুহূর্ত্তের দেখা সুন্দরী মেয়েটিকে কৃষ্ণা ঠিক চিনতে পারেনি,-তবে রমলাকে সে চিনেছিল।

    বরানগরের পথে সশস্ত্র মোটর ডাকাতিতে ধরা পড়ে যায় রায়জী অর্থাৎ অমল রায় এবং তার সহকারিণী দুর্গাবাই। তাদের দুর্ভাগ্যক্রমে সেই পথেই মোটরে আসছিল কৃষ্ণা ও প্রণবেশ। বরানগরে একটা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিল তারা। নিমন্ত্রণ রক্ষা করে দুপুরেই ফিরছিল। মোটর ডাকাতিটা ঘটে একেবারে চোখের উপর। একটি নামকরা মিলের টাকা ব্যাঙ্কে জমা দেওয়ার জন্য পাঠানো হচ্ছিল, একথা অমল রায় যে-কোনোরকমে জেনেছিল। মিলের মোটরের পিছনে মোটর চালিয়েছিল নিজে দুর্গাবাই, অমল রায়ের সুযোগ্য সহকারিণী। মিলের মোটরে ছিল দুজন কর্ম্মচারী ও দুজন দ্বারোয়ান। দিবা দ্বিপ্রহরে জনবিরল পথে পিছনের মোটরখানা এ মোটরের উপর এসে পড়তেই মোটরখানা জখম হয়ে যায়। এরই মধ্যে অমল রায়ের সহকর্ম্মী তিনজন এবং সে নিজে মোটরে লাফিয়ে উঠে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে গুলি চালায়। তার ফলে দুজন জখন হয় এবং আর দুজন সেই মুহূর্ত্তে মারা যায়, ড্রাইভার এক লম্ফে উধাও হয়।

    স্বপ্নেও তারা ভাবেনি কৃষ্ণার মোটর সবেগে পিছনে এসে পড়েছে। কৃষ্ণার মোটর তাদের অনুসরণ করেছে সে খবরও তারা জানেনি।

    কিছুটা পথ অতিক্রম করে শ্যামবাজারের মোড়ে গাড়ীর পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পুলিসের নির্দ্দেশে সেই দু’এক মিনিট সময়ের মধ্যে কৃষ্ণা পুলিসের সাহায্য নিয়ে সামনের গাড়ী আটক করে।

    আত্মরক্ষার চেষ্টা করে অমল রায়, তারা গুলি ছুড়ে পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু কয়েকজন পুলিস আহত হওয়া সত্ত্বেও তারা গ্রেপ্তার হয়, কুড়ি হাজার টাকা-যা তারা লুণ্ঠন করেছিল সবই পাওয়া যায়।

    বিচারে নরহত্যার অপরাধে অমল রায়কে ফাঁসিতে জীবন বিসর্জ্জন দিতে হল-তার তিনজন সঙ্গী গেল যাবজ্জীবনের জন্য দ্বীপান্তরে; আর প্রধান সহকর্ম্মিণী দুর্গাবাইয়ের হল দশ বৎসরের সশ্রম কারাদণ্ড।

    কিন্তু তিন বৎসর না যেতেই দুর্গাবাই পলায়ন করলে। কি ভাবে সে পলায়ন করলে বহরমপুর জেল হতে-কৃষ্ণা তাই ভেবে পায় না।

    পুলিস এ মেয়েকে খুঁজে বার করবার চেষ্টায় ফিরছে, পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে-কৃষ্ণা সে কথা জানে না অথবা সে কথা কোনো দিন কানে এলেও অন্তরে যায়নি। এখানে-মেদিনীপুর জেলার অখ্যাতনামা পল্লীতে দুর্দ্দান্ত দস্যুসর্দ্দার আলি মহম্মদের আস্তনায় সেদিনকার দুর্গাবাই যে দশ বৎসরের জন্য জেলে প্রেরিত হয়েছিল তাকে রমলাবাই নামে আত্মপ্রকাশ করতে দেখে সে প্রথমটা বিস্মিত হলেও ঘটনাটা বিস্মৃত হয়নি।

    রমলার শাসানি যে মিথ্যা হবে না, তা সে জানে। আলি মহম্মদকে একদিন সে চিকিৎসকরূপে দেখেছে, সেইটুকু পরিচয়ের মধ্যে কৃষ্ণা জেনেছে কৃষ্ণাকে অর্থোপায়ের যন্ত্র বলেই সে জানে এবং সেই জন্যই যাতে তার অনিষ্ট হয় তা খাঁ সাহেব করবে না। যেমন করেই হোক তাকে সুস্থ রাখতে চেষ্টা করবে, আর সেই-জন্যই সে কোনো অত্যাচার করবে না।

    তেরো

    রহস্যময় কিশোর

    ব্যোমকেশ অথই জলে পড়ে আছেন, সম্প্রতি একটি ছেলে ধরা পড়েছে। ছেলেটি প্রণবেশবাবুর বাড়ীতে বে-আইনীভাবে লুকিয়ে ছিল। হয়ত চুরির মতলবে ঢুকেছিল। এ রকম তো কত চোর ধরা পড়ে। বিচারে তাদের শাস্তি হয়-দাগী হলে জেলের মেয়াদ বেশী হয়। কিন্তু ছেলেটি বেশ একটু রহস্যময়। তার কাছে একখানা চিঠি পাওয়া গেল। চিঠিটা ছিল বড়বাজারের ধনী ব্যবসায়ী শিউলাল মিশ্রের নামে। শিউলাল মিশ্রের পরিচয় কলকাতা পুলিসের অজানা নাই-তবু প্রমাণাভাবে তাকে গ্রেপ্তার করতে পারা যায়নি। শিউলালের নানারকমের কারবার চলে। লোকটি খুব সাধু-ব্যবসায়ী নয়। সেই জন্যই ছেলেটিকে হাজতের লক-আপে রাখা হয়েছে।

    লোহিয়া বহুকালের ব্যবসায়ী-শিউলাল তাঁর তুলনায় অল্পদিন মাত্র ব্যবসায় ক্ষেত্রে নামলেও এরই মধ্যে তিনি বেশ জমিয়ে ফেলেছেন-ফলে লোহিয়ার যথেষ্ট ক্ষতি হচ্ছে। আর দিনদিন শিউলাল ব্যবসায়ে প্রসারতা লাভ করছেন।

    দেবীপ্রসাদ পিতার সমস্ত কাজকর্ম্মের ভার নিয়েছেন-তিনি বেশ বুঝেছিলেন, শিউলাল যদি এভাবে কারবার চালায়, কিছুদিন পরে লোহিয়া কোম্পানীর অস্তিত্বও থাকবে না-মর্ম্মান্তিক আক্রোশে তিনি দগ্ধ হচ্ছিলেন। কিন্তু উপায় নাই।

    মজঃফরপুর জেলার লোক শিউলাল মিশ্র, এই তো সেদিন একটা লোটা মাত্র সম্বল করে তিনি সোনার দেশ বাংলায় এসেছিলেন, পাঁচ বছর হল না নাম করতে, তারপর চার বছরের মধ্যে হল গাডীü, বাড়ী, ব্যবসার প্রসারতা।

    তিন পুরুষের ব্যবসা ভকতরাম লোহিয়ার নষ্ট হতে বসেছে। লোহিয়ার অনুরোধে পুলিস তার পেছনে আছে। পুলিসে তার পূর্ব্ব পরিচয় খুঁজে ফেরে, কে এই শিউলাল, কি নিয়ে সে ব্যবসায় নামলো, কোথায় তার বাড়ী, জগতে তার আর কে আছে ইত্যাদি।

    পরিচয় সামান্যই মেলে।

    কিছুদিন আগেকার ডাকাতি কেসের আসামী দুর্গাবাই শিউলালের ভগিনী-দশ বৎসরের জন্য তার জেল হয়, কিন্তু অনেক টাকা সম্ভব ঘুস দেওয়ার ফলে দুর্গাবাই কোনোরকমে জেল হতে পলায়ন করে। ব্যোমকেশের কাছে দুর্গাবাইয়ের বিবরণ পাওয়া যায়। এ মেয়ে সামান্য মেয়ে নয়-অনেক পুরুষের উপরে যায়। দুনিয়ায় হেন কাজ নাই যা দুর্গাবাই পারে না।

    এমন ভগিনীর ভাইয়ের উপর সন্দেহ হওয়া স্বাভাবিক। পুলিস শিউলালের গতিবিধির উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখলেও তাকে ধরা-ছোঁয়ার মধ্যে পায় না।

    সহরের বিভিন্ন স্থানে শিউলালের চারটি হোটেল চলে, তার মধ্যে ‘হোটেল প্যারিস’ প্রসিদ্ধ। শিউলাল নিজে ওই হোটেলের ত্রিতলে থাকে, পরিবার বলতে তার কেউই নাই।

    পুলিসের লোক কতবার এই হোটেলে রুম নিয়েও বাস করে এসেছে। কে কে আসে কার কার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ এই সব খবর সংগ্রহ করতে হয়েছে এই সব লোকদের মধ্যস্থতায়।

    কিন্তু এমন কিছু খবর পাওয়া যায়নি যাতে শিউলালকে সন্দেহ করা চলে। অত্যন্ত সদালাপী, মিষ্টভাষী শিউলাল-প্রত্যেকের সঙ্গেই তার ঘনিষ্ঠতা, বন্ধুত্ব।

    ব্যোমকেশ যে ছেলেটিকে গ্রেপ্তার করেছেন-সে যে শিউলালের দলের চর এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সে প্রণবেশের বাড়ীতে ঢুকতে গেল কেন? ঠিক হয়েছে-কৃষ্ণার ওপর ওদের রাগ আছে। তার পেছনেই চর লাগিয়েছে হয়তো। ব্যোমকেশবাবু কিছুর যেন একটা কিনারা করতে পেরেছেন। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। ডায়েরীতে তাঁর সিদ্ধান্তগুলি গুছিয়ে লিখতে থাকেন।

    মৃন্ময় ও প্রণবেশবাবু ব্যোমকেশবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। ব্যোমকেশবাবু তখনও লিখছিলেন। লেখা বন্ধ করে দুই বন্ধুকে খাতির করে বসালেন। তারপর হাসিমুখে বললেন, ”চারদিকে আমার এত ঝঞ্ঝাট যে আর হাঁফ ফেলবার এতটুকু অবকাশ আমার নেই মৃন্ময়বাবু। আপনি এসেছেন শুনেও আমি দেখা করতে যেতে পারিনি, আপনি হয়তো রাগ করেছেন এজন্য-”

    মৃন্ময় শশব্যস্ত ভাবে বললেন, ”সে কি কথা ব্যোমকেশবাবু, আপনি কাজে ব্যস্ত, কত বড় দায়িত্বশীল এ কাজ তা আর কেউ না বুঝলেও আমি বুঝি; কেননা আমরা এক গোয়ালেরই গরু তো! না, না, আপনি নিজের কাজ করে যান, এ শুধু আপনারই গৌরব নয় ব্যোমকেশবাবু, এ আমাদের সমস্ত বাঙ্গালী জাতির গৌরব যে আমাদের এই বাংলাদেশে আপনার মতো একজন সুদক্ষ পুলিস অফিসার আছেন। বাস্তবিক আমরা যে কতখানি গর্ব্ব করি আপনাকে নিয়ে সে কথা আপনাকে বলে জানানো যায় না।”

    ব্যোমকেশ তাঁর মুখের পানে তাকান; কথাটা বিদ্রূপ কি যথার্থ তাতে সন্দেহ জাগে।

    লক-আপের ছেলেটিকে দেখতে চান মৃন্ময়-

    ব্যোমকেশ বিরক্তিভাবে বলেন, ”এমন একগুঁয়ে ছেলে আমি খুব কম দেখেছি মশাই, কিছুতেই যদি তার মুখ দিয়ে একটি কথা বার করতে পেরেছি। জোর জবরদস্তি, ভালো কথা ঢের বলেছি, সে একটি বর্ণ উচ্চারণ করলে না। দেখতে চান বলুন, যদি কোনো কথা বার করতে পারেন।

    হাজতের একটা প্রায়ান্ধকার ঘরে রাখা হয়েছে কিশোর ছেলেটিকে। দেখলেই মনে হয় সে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, সেটা সহজে কারুর কাছে প্রকাশ করছে না। মৃন্ময় বললেন, ”আমি ছেলেটিকে দু’একটি প্রশ্ন করব।”

    ব্যোমকেশবাবু বললেন, ”বেশ তো-দেখুন না যদি কোনো কিছু বের করতে পারেন।”

    মৃন্ময় ঘরের ভিতরের দরজাটা ভেজিয়ে দেন, ছেলেটি বিস্ময়ে তাঁদের পানে তাকিয়ে থাকে।

    চাপাসুরে মৃন্ময় বললেন, ”কেন খোকা তুমি মিছামিছি হাজতে পচে মরছ। এক ট্রেসপাস ছাড়া তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই-আমার কথার জবাব দাও। তোমাকে এখুনিই ছেড়ে দেওয়া হবে। প্রণববাবুর বাড়িতে তুমি ঢুকেছিলে কেন? অথচ তোমার কাছে রয়েছে শিউলালের চিঠি।”

    ছেলেটি চুপ করে রইলো। কোনো জবাব দিল না।

    মৃন্ময় বললেন, ”তোমাকে যদি আমরা ছেড়ে দিই তাহলে তুমি কোথায় যাবে? শিউলালের কাছে না প্রণববাবুর কাছে?”

    ছেলেটির চোখ দুটো চক চক করে ওঠে। বলে যে, প্রণববাবুর সঙ্গে তার দরকার আছে।

    -”তাহলে এই প্রণববাবু আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন, তোমার কি বলবার আছে এঁকে বল।”

    প্রণববাবু এগিয়ে আসেন। ছেলেটি বিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকায়।

    প্রণবেশ বললেন, ”হাঁ, আমিই প্রণববাবু; তোমাকে তো আমি চিনি না।”

    ছেলেটি ইতস্ততঃ করতে থাকে। ব্যোমকেশবাবু বললেন, ”আমরা বাইরে যাবো কি?”

    ছেলেটি একটু ভেবে বলল, ”না-ইনি যদি সত্যিই প্রণববাবু না হন, তাহলেও আপনারা পুলিসের লোক। আপনাদের কাছেই আমার কথাগুলো বলে যাওয়াই ভাল। আপনারা কৃষ্ণাদেবী নামে কোনো মেয়েকে চেনেন?”

    প্রণবেশ লাফিয়ে উঠলেন। মৃন্ময় তাঁকে একটা চিমটি কেটে চুপ করতে বললেন।

    মৃন্ময় বললেন, ”হাঁ জানি-কয়েকদিন যাবৎ মেয়েটিকে পাওয়া যাচ্ছে না। বোম্বে- মেলের অ্যাকসিডেণ্টের সঙ্গে সঙ্গেই সে নিখোঁজ হয়েছে। সেই ট্রেণেই সে ছিল। অথচ অ্যাকসিডেণ্টে সে মারা পড়েনি, এখবর আমরা পেয়েছি।”

    ছেলেটি নির্ব্বাক হয়ে যায়, শুধু চেয়ে থাকে। তারপর আস্তে আস্তে সে বলে যায়, ”কৃষ্ণা দিদিমণিকে আটক করে রেখেছে যারা তাদের কাছে আমি কাজ করি। আমার নাম আবু। তাদের সঙ্গে শিউলালের যোগাযোগ আছে।” তারপর একটা একটা করে সব কথাই বলল!

    ট্রেণ অ্যাকসিডেণ্ট আলি মহম্মদের দলের লোকদের কীর্ত্তি, কৃষ্ণাকে অপহরণ এবং কেবল তাকেই নয় আরও কয়েকটি মেয়েকে তারা অপহরণ করেছে, উদ্দেশ্য তাদের আরবে নিয়ে গিয়ে কোনো সুলতানকে বিক্রয় করবে। মেদিনীপুরে এক গ্রামে তাদের রেখেছে, শিউলাল এদের টাকা দিচ্ছে প্রচুর এবং সেই জন্যই তারা সহজে এ সব কাজ সম্পন্ন করতে পারছে। আলি মহম্মদের পত্র নিয়ে আবু শিউলালের কাছে এসেছে, প্লেন ঠিক করে সে ফিরে যাবে কথা আছে। আবু শিউলালের কাছে যায়নি, তার দিদিমণির মামা প্রণববাবুর সন্ধান করতে গিয়েই পুলিসের হাতে ধরা পড়েছে।

    প্রণবেশ উত্তেজিত ভাবে কি বলতে যান, মৃন্ময় তাঁকে বাধা দেন, বললেন, ”তুমি প্রণববাবুর নাম জানলে কার কাছে?”

    ”আজ্ঞে ভীমকে যখন গুলি করে মারা হয় তখন সে চুপি চুপি এক সুযোগে বলে গেছে-কৃষ্ণাদেবীর মামা প্রণববাবু কলকাতার অমুক জায়গায় থাকেন।”

    ”কাকে গুলি করে মারা হল?”-সবিস্ময়ে তিনজনে একসঙ্গে প্রশ্ন করেন।

    ”আজ্ঞে ভীমকে-কৃষ্ণা দিদিমণির পালানোর সুযোগ সে করে দিয়েছিল। রেল ষ্টেশন পর্য্যন্ত দিদিমণিকে পার করে দিয়েছিল সে। তারপর ষ্টেশনে দিদিমণি আবার ধরা পড়েন। আমাদের ওখানে বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি গুলি করে মারা। কোনো মায়া- দয়া নেই ওদের। জানি না আমার বরাতে কি আছে!”

    ছেলেটি চুপ করল। ব্যোমকেশবাবু বললেন, ”তুমি আমাদের তাদের সেই আড্ডায় নিয়ে যেতে পারবে আবু,-আমরা তাহলে উদ্ধার করতে পারব!”

    আবুর মুখখানা খুশীতে ভরে ওঠে। বললে, ”নিশ্চয়ই পারব, আপনারা আমায় নিয়ে চলুন। কিন্তু আমার বাঁচাবার ভার আপনাদের ওপর রইল।”

    মৃন্ময় বললেন, ”তোমার কিছু ক্ষতি হবে না আবু ভাই, তুমি আমাদের যে উপকার করলে এর উপযুক্ত পুরস্কার দেব। একটু অপেক্ষা কর এখুনিই আমরা তৈরী হয়ে আসছি।”

    চৌদ্দ

    পলায়ন

    ”পার্ব্বতী-পার্ব্বতীবাই জেগে আছ?”

    কৃষ্ণার আহ্বানে পার্ব্বতী সজাগ হয়ে ওঠে। উত্তর দেয়, ”জেগেছি দিদিমণি।”

    কৃষ্ণা বলে, ”এদিকে এগিয়ে এসো, কথা শোন।”

    পার্ব্বতী দেয়ালের কাছে সরে আসে।

    কৃষ্ণা বললে, ”শোন, কাল সকালেই আমাদের এখান হতে প্লেনে করে ওরা নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। যেমন করেই হোক আমাদের সরাবেই এখান হতে-বিপদের গুরুত্বটা বোঝ একবার।”

    ওধারে পার্ব্বতীর ভয়ার্ত্ত কণ্ঠস্বর শোনা যায়-”কাল ভোরেই! হায় ভগবান, তবে উপায়!”

    কৃষ্ণা বললে, ”উপায় করতে হবে। তোমার ঘরের দিকে এই দেয়ালের জোড়ের মুখ,-যদিও অন্ধকার তবু চেষ্টা করে দেখ তো-কোথাও কোনও পেরেক আছে কিনা; হাত বুলালেই বুঝতে পারবে।”

    কয়েক মিনিট অতীত হয়, পার্ব্বতীর উৎফুল্ল কণ্ঠস্বর শোনা যায়-”পেয়েছি দিদিমণি, পেয়েছি-”

    কৃষ্ণা বললে, ”চাড় দিয়ে ওটা তুলবার চেষ্টা কর, হয়তো একটু জোর লাগবে, তা লাগুক, নিজেকে বাঁচানোর জন্য করতেই হবে।”

    ওধারে পার্ব্বতীবাইয়ের ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস পড়ে ঘস ঘস শব্দ শোনা যায়, কৃষ্ণা উৎকর্ণ হয়ে থাকে; জোড়ের মুখের পেরেকটা কোনোরকমে সরাতে পারলে এই তক্তাগুলি কিছুটা ঢিলে হয়ে যাবে, তখন তক্তা সরানোর সুযোগ পাবে।

    বারাণ্ডায় আলি মহম্মদের সঙ্গে রমলার কথাবার্ত্তা কৃষ্ণা শুনেছে। বলছিল, ”শিউলাল ফোন করেছেন, কাল সকালেই তাঁর কোম্পানীর প্লেন আসছে, সেই প্লেনেই এদের নিয়ে রওনা হওয়া চাই। আবুর কোনো খবর নেই। ছোঁড়াটাকে পাঠানোই ভুল হয়েছিল। থাকগে কাল ভোরেই আমরা এখান থেকে উড়ে যাবো।”

    সংক্ষেপে শিউলাল ফোন করেছেন যেন কেউ কোনো সন্দেহ না করতে পারে, কেবল যারা বুঝবার তারাই বুঝতে পারবে।

    এই রাতটুকু মাত্র-তারপরেই আসবে প্রভাত। সেই প্রভাতের কল্পনা করতেও দেহে-মনে আতঙ্ক জাগে।

    মড় মড় করে পেরেকটা ঘসার সঙ্গে সঙ্গে একফালি তক্তা ভেঙ্গে পড়ে। অত্যন্ত খুশি হয়ে ওঠে কৃষ্ণা, এবার এদিক হতে সহজেই সে তক্তা সরাতে পারবে। তারপর পাশের লম্বা তক্তায় ভর দিয়ে খানিকদূর উপর দিকে উঠতে পারলে সে উপরের জাল ঘেরা জানালাটা পাবে, সেই তার খসিয়ে ওই পথে নামবার সুযোগ পাবে নিশ্চয়ই। একমাত্র এই উপায় ছাড়া মুক্তির আর পথ নাই। আজ কয়দিন ধরে উপরের ওই ছোট জানালাটা কৃষ্ণা লক্ষ্য করেছে। এই দেয়ালের ওদিকে পড়বে বাগান, সেখান হতে পলায়ন করা কিছু কষ্টকর হবে না মনে হয়।

    একখানা তক্তা ভেঙ্গে পড়তেই সে আর কয়েকখানা তক্তা চড়ে দিয়ে খসিয়ে ফেলে।

    আস্তে আস্তে পার্ব্বতীর পাশে এসে দাঁড়ায় সে, বললে, ”আমরা পালাতে চাই পার্ব্বতী, দেখ ওপরে ওই জানালায় উঠবার সাহস হবে তোমার? বাইরে বোধ হয় চাঁদের আলো ছড়িয়ে পড়েছে, জানালার তারের মধ্যে এসেছে চাঁদের আলো। রাত্রি এখন গভীর, দরজার বাইরে যে রক্ষী আছে সে সম্ভব ঘুমে অচেতন, তাই ঘরের ভিতরকার কোনো শব্দ সে পায়নি।”

    সম্মুখাগত বিপদের আশঙ্কায় অধীর হয়ে উঠেছে পার্ব্বতী। বললে, ”পারব দিদিমণি।”

    কৃষ্ণা তাকে উৎসাহিত করে নিজে কাঠ বেয়ে উপরে উঠে যায় উপায় ঠিক করতে।

    তারের বন্ধনী পর্য্যন্ত পৌঁছে থেমে সে হাত দিয়ে পরীক্ষা করে-

    বহু পুরাতন ঝর-ঝরে তার অল্প অনায়াসেই ছিঁড়ে পড়বে। কাঠের পার্টিশান ভাঙ্গতে হাতের বহুস্থান কেটে গেছে, রক্ত পড়ছে হাত দিয়ে, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়ার এখন সময় নেই।

    টান দিয়ে জীর্ণ তারের বন্ধনী কৃষ্ণা ছিঁড়ে ফেলে। ছোট জানালাটার ভিতর দিয়ে অনায়াসে সে গলে বার হতে পারে। সেখান হতে মুখ বাড়িয়ে সে বাইরের দিকে তাকায়-

    অনেক-অনেক নীচে ওদিকে নামতে হবে, লাফ দেওয়া চলবে না, হাত-পা ভাঙ্গবে, জখম হবে এবং আবার ধরা পড়বে, পাশেই দ্বিতলের জলের নল নীচে পর্য্যন্ত নেমে গেছে দৃষ্টি পড়লো।

    স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে কৃষ্ণা-

    এতক্ষণে সে পিছনে ফিরলো, ঘরের মধ্যে লক্ষ্য করে ডাকে, ”পার্ব্বতী-পার্ব্বতীবাই উঠে এসো ওই কাঠ ধরে, তোমায় আগে নামিয়ে দেই।”

    ”এই যে, নামাচ্ছি-”

    কথার সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ন এক ঝলক হাসির শব্দ কানে আসে। তারই সঙ্গে পার্ব্বতীবাইয়ের ভয়ার্ত্ত একটা স্বর-”হা ভগবান,-”

    রমলার কণ্ঠস্বর বুঝতে কৃষ্ণার বিলম্ব হয় না। মুহূর্ত্তে ঘরটা উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে, জোরালো টর্চের আলো কৃষ্ণার উপরে এসে পড়ে। সে দেখতে পায় পার্ব্বতীর গলাটা রমলা চেপে ধরেছে। হাতের টর্চ মাটিতে পড়ে জ্বলছে।

    যতটুকু সময়ে পার্ব্বতীবাইকে রমলা কাবু করতে পারে, ততটুকু সময়ের মধ্যে কৃষ্ণা নিজের কর্ম্মপন্থা ঠিক করে ফেলে।

    রমলা বিকৃত কণ্ঠে বলে, ”নেমে এসো কৃষ্ণাদেবী, নচেৎ তোমায় গুলি করতে বাধ্য হব।” টর্চের আলোয় তার এক হাতে রিভলভারটা চক চক করে ওঠে, পার্ব্বতী ততক্ষণ মেঝেয় লুটিয়ে পড়েছে, সম্ভব তার জ্ঞান নাই।

    কৃষ্ণা তখন ওপারে লাফিয়ে পড়বার উদ্যোগ করেছে,-বুঝতে পেরে রমলাও প্রস্তুত হয়।

    ”গুড়ুম-”

    তার আগেই নল হাতে পেয়ে কৃষ্ণা টুপ করে নেমে পড়ে।

    রমলার চীৎকারে এবং গুলির শব্দে ঘুমন্ত পুরী সজাগ হয়ে ওঠে, সবাই ছুটে এই দিকেই আসে। এই সুযোগে কৃষ্ণা নল বেয়ে তরতর করে নীচে নেমে পড়ে।

    শুক্লা অষ্টমীর চাঁদ তখন অস্তাচলে যাচ্ছে, তার স্তিমিত আলোয় কৃষ্ণা দেখতে পেলে সে একটা জঙ্গলাকীর্ণ বাগানের মধ্যে এসে পড়েছে। বহু ঝোপ এবং বড় বড় গাছ থাকায় মনে হয় দিনের বেলাতেও এখানে লুকোনো চলে।

    চারিদিকে তখন আলো জ্বলে উঠেছে, লোকজন ছুটাছুটি করছে। এখনই তারা এই জঙ্গলে খুঁজতে আসবে-তারা জেনেছে কৃষ্ণা এই দিকেই নেমেছে।

    উপায় নাই-কোনো উপায় নাই এই জঙ্গল ভেঙ্গে পালাবার। সেবার এক ঝোপের আড়ালে আত্মগোপন করেছিল সে, ভীম সে যাত্রা তাকে রক্ষা করেছিল-কিন্তু এবার-

    কৃষ্ণা অধর দংশন করে।

    বিপদে আত্মহারা হওয়া কৃষ্ণার স্বভাব নয়, মুহূর্ত্তে সে উপায় ঠিক করে নেয়। সামনেই যে মস্ত বড় আমগাছটা দিকে দিকে শাখা-প্রশাখা বিস্তারিত করে দাঁড়িয়ে আছে, কৃষ্ণা সেই গাছে উঠে পড়লো।

    তর তর করে সে উঠে গেল বহুদূর-একেবারে আগার দিকে, নীচে হতে যেখানে সহজে চোখ পড়বে না, বিপুল পত্রভারে সমস্ত আবৃত।

    এদিক-ওদিক আলো দেখা যায়।

    কোথাও কাঁটার ঝোপ, কোথাও গর্ত্ত, এসব এড়িয়ে অনুসন্ধানকারীরা জোরালো টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে ছুটে চলে-

    রমলাকেও দেখা যায়,-আলি মহম্মদের সঙ্গে সেও ছুটেছে,-তার কথা শোনা যায়, ”বেশীদূর যেতে পারেনি সাহেব, এই কাছাকাছিই কোথাও আছে। ও মেয়ে আবার গাছেও উঠতে পারে বোধ হয়, তাই গাছগুলোও দেখা দরকার”-বলতে বলতে সে ইতস্ততঃ উপর দিকে আলো ফেলে।

    অসীম সৌভাগ্য-কৃষ্ণার পরণে সাদা কাপড় ছিল না-এখানে সে পরবার জন্য দুইখানি কালো কাপড় পেয়েছিল যাতে ময়লা বোঝা যায় না। আজ এই কালো কাপড়ই তাকে রক্ষা করলো। অনুসন্ধানকারীরা এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়লো, নিঃশব্দ হয়ে গেল সমস্ত বাগান-চারিদিক।

    সেবার আবু ছিল, আজ কৃষ্ণা একা। এই গাছ হতে নেমে কোথায় কোনদিকে যাবে তা সে জানে না, অথচ গাছে থাকবার ভরসাও তার নেই। প্রায় একঘণ্টা গাছে অপেক্ষা করে কৃষ্ণা আস্তে আস্তে নামে।

    মাটিতে পা পড়তেই কি যেন তার পায়ে ঠেকে, হাতে করে তুলে নেয় সেটা-

    আনন্দে ঝলসে ওঠে কৃষ্ণার মুখ। এতদিনে সত্যকার বন্ধু সে পেয়েছে-

    একটি গুলিভরা রিভলভার,-

    সম্ভব কারও পকেট বা হাত হতে দৌড়ানোর সময় পড়ে গেছে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেও কেউ খুঁজতে আসেনি, কোথায় পড়েছে সে স্থান নির্ণয় করতে পারেনি হয়তো।

    কৃষ্ণা আর কিছু ভয় করে না, বন্ধু পেয়েছে। নির্ভয়ে পথ চলে-অন্ধকারে কাঁটাবন মাড়িয়ে কাদা ভেঙ্গে কৃষ্ণা পথ চলে। কিসের উপর পা পড়তেই সেটা হিলবিল করে নড়ে উঠতেই কৃষ্ণা আতঙ্কে তিনহাত পেছিয়ে আসে, অন্ধকারেও দেখা যায়, বিরাটকায় একটি সাপ সামনে দিয়ে চলে যায়।

    ললাটের ঘাম মুছে ফেলে কৃষ্ণা-

    বাঁকের মুখেই বাধা পায় সে-কে একেবারে তার সামনে এসে পড়েছে-

    ”কে?”

    প্রশ্নটা লোকটির মুখে উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা এগিয়ে আসে, পলায়নের পথ নাই দেখেই বাঘিনীর মতো অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই লোকটির উপর, দুই হাতে তার কণ্ঠনালি এমনভাবে চেপে ধরে যাতে লোকটি আত্মরক্ষা করবার এতটুকু সুযোগ পেলে না। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণা পায়ের হাঁটু দিয়ে তার তলপেটে এমন জোরে আঘাত করলে যাতে লোকটার সর্ব্বশরীর অবশ হয়ে এলো এবং সঙ্গে সঙ্গে সে মাটির উপর লুটিয়ে পড়ল।

    মূর্চ্ছিত লোকটাকে ফেলে কৃষ্ণা দাঁড়ায়। কি দুর্দ্দান্ত সাহসের পরিচয় দিয়েছে সে। রিভলভার সে ছুড়তে পারতো কেবল শব্দ হওয়ার ভয়ে ছোড়েনি। দিশেহারা কৃষ্ণা সামনের দিকে ছোটে। মনে হয় সে একটা চওড়া পথে এসে পড়েছে। জনমানবশূন্য পথ, দু’একটা শৃগাল এদিক-ওদিক করতে মানুষ দেখে সভয়ে পালায়।

    কোনদিক ঠিক করতে না পেরে কৃষ্ণা ছোটে।

    পনেরো

    আ বাপস শয়তানী!

    ফাঁড়ির জমাদার সুখনলাল অনেক রাত্রি পর্য্যন্ত কাজ করে কেবলমাত্র শুয়েছে।

    উপর হতে হুকুম এসেছে-খবর পাওয়া গেছে কয়েকজন নামকরা দুর্বৃত্ত লোক দেবীপুর, দুর্গাপুর প্রভৃতি স্থানে নিজেদের আড্ডা স্থাপন করেছে। এরা এদিক-ওদিক লুঠতরাজ ডাকাতি প্রভৃতি করে এখানে আত্মগোপন করে থাকে। তারা জানে এখানে পুলিস চট করে তাদের সন্ধান করতে পারবে না।

    সুখনলালের উপর জোর হুকুম এসেছে এদের সন্ধান নিয়ে অবিলম্বে খবর জানাতে হবে। আজ সন্ধ্যায় মেদিনীপুরের ইনস্পেক্টার মুরারি বসু এখানে এসেছেন, রাত্রে তিনি ফাঁড়িতেই আছেন। কাল সকালে, সুখনলালকে নিয়ে তিনি পুলিস সহ দুর্গাপুরের দিকে যাত্রা করবেন, সুখনলালকে এই কথা জানানো হয়েছে।

    স্থূলদেহ ও স্থূলবুদ্ধি সুখনলাল ঘর্ম্মাক্ত হয়ে উঠেছে। এইতো দুর্গাপুর-তার এলাকার মধ্যে এখানে অতবড় একটা দস্যুদল ঘাঁটি করলে সে কি কিছু জানতে পারতো না? সম্প্রতি ওখানকার জোতদার এমদাদ আলির বাড়িতে কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসেছে। এমদাদ আলির প্রকাণ্ড বাগান-বাড়িতে তারা আছে। বাংলাদেশের লোক তারা নয়; তাদের বাড়ি গোরখপুর জেলায়-যে গোরখপুর জেলায় সুখনলালের দেশ। আজও প্রতিদিন মেদিনীপুর জেলার এই অখ্যাতনামা এক গ্রামের প্রান্তে ফাঁড়িতে বসে সে-ঘরের স্বপ্ন সে দেখে।

    শুধু গোরখপুর জেলার লোক বলেই তারা সুখনলালের বন্ধুত্বের গৌরব লাভ করেছে!

    এই ক-জন লোক ছাড়া দুর্গাপুর এলাকার আর কোথাও কেউ এসেছে, সে খবর সুখনলালের জানা নেই।

    ঘুমের আমেজ বেশ জমে এসেছে, এমন সময় কে যেন তার দরজায় সজোরে আঘাত করে ডাকে, ”জমাদার সাহেব, জলদি উঠিয়ে। একঠো আওরৎ ভাগতা হ্যায়, উনকো ম্যয় লায়া।”

    ধড়মড় করে উঠে বসে সুখনলাল, লণ্ঠনের আলো বাড়িয়ে দিয়ে দরজা খুলে দেয়।

    একজন কনষ্টেবল দাঁড়িয়ে আছে-তার পাশে একটি মেয়ে,-মেয়েটি ভয়ানক হাঁফাচ্ছে।

    সুখনলাল লণ্ঠন উঁচু করে একবার দেখে নেয়-বাঙালীর ঘরের সুন্দরী মেয়ে, বয়স খুব কম। দেখে তাকে অত্যন্ত ক্লান্ত মনে হচ্ছে।

    বিতৃষ্ণার সুরে সুখনলাল বললে, ”হাজতে রাখো। কাল ফজেরে ইনস্পেক্টর সাহেব-কো পাশ লে যানে হোগা।”

    কোন গোলমাল করতে জমাদার রাজি নয়।

    মেয়েটি দৃপ্তকণ্ঠে বললে, ”না, হাজতে আমি যাব না। আমার কথা আছে জমাদার সাহেব, এখনই তোমায় তা শুনতে হবে।”

    ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সুখনলাল-ফাঁড়ির জমাদার হর্ত্তাকর্ত্তা বিধাতৃস্থানীয়, তাকে কিনা এই একরত্তি মেয়েটা হুকুম করে!

    ক্রুদ্ধ কণ্ঠে সে গর্জ্জন করে-”অ্যাই, দিকদারী মাৎ করো। ইনস্পেক্টর সাহেবকা নিদ টুটনেসে গোঁসা হো যায়গা।”

    মেয়েটি বেপরোয়া হুকুমের সুরে বলে, ”ভালোই হয়েছে, তোমার ইনস্পেক্টর সাহেবকেই আমার দরকার। তাঁকে ডেকে দাও।”

    সুখনলাল হেসে ওঠে-কনষ্টেবলের দিকে চেয়ে হুকুম দেয়-”লে যাও হাজতখানা।”

    কনষ্টেবল মেয়েটির হাত ধরতে আসবা মাত্র সে পেছিয়ে যায়। গর্জ্জে ওঠে, ”ডাকো ইনস্পেক্টর সাহেবকে, আমার দরকার তাঁকেই।” রিভলবার বার করে কৃষ্ণা।

    ”আ বাপস শয়তানী!”

    সুখনলাল দশ পা পেছিয়ে যায়, ততক্ষণ কনষ্টেবল ঘরের বদ্ধ দরজায় গিয়ে পরিত্রাহি চিৎকার করছে-”ইনস্পেক্টর সাব, জান গিয়া-মেরা জান গিয়া, লেকেন জমাদার সাবকো বি জান গিয়া!”

    দরজাটা অকস্মাৎ খুলে যায়, রিভলবার হাতে বার হয়ে আসেন ইনস্পেক্টর মুরারি বোস। তাঁর সঙ্গে সদর থেকে যে পনেরো জন সশস্ত্র কনষ্টেবল এসেছে, তারাও শশব্যস্তে ছুটে আসে।

    উদ্যত রিভলভার হস্তে মুরারি বোস এগিয়ে আসেন।

    মেয়েটি ততক্ষণ হাতের রিভলভার মাটিতে রেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে!

    ”নমস্কার ইনস্পেক্টর সাহেব, আমি ডাকাত নই, চোর নই, আপনাদের খুন করতেও আসিনি। বড় বিপদে পড়েছি, তাই সাহায্য চাইতে ফাঁড়িতে এসে আরও বেশী বিপদে পড়েছি। আপনাকে দেখে মনে একটু ভরসা পাচ্ছি। আশা করি, দয়া করে আপনার রিভলভারটা নামাবেন। আমার রিভলভার মাটিতে ফেলেছি। নিরস্ত্র একটা মেয়ের কাছে আপনার ভয় নেই।”

    ফাঁড়ি তখন আলোকিত হয়ে উঠেছে লণ্ঠনের আলোয়। মেয়েটির পানে তাকিয়ে ইনস্পেক্টর মুরারি বোস যেন হতভম্ব হয়ে যান! মনে হয়, কবে কলকাতায় লালবাজারে পুলিস-অফিসে একে দেখেছেন যেন! ”আপনি-আপনি-কৃষ্ণা চৌধুরী না?”

    বাধা দিয়ে মেয়েটি বললে, ”হ্যাঁ, আপনার অনুমান সত্য ইনস্পেক্টর সাহেব। ব্যোমকেশবাবু আমার কাকা,-একদিন লালবাজারে আপনাকে দেখেছিলুম।”

    ”কৃষ্ণা! আপনি নিরুদ্দিষ্টা কৃষ্ণাদেবী?”

    মুরারি বোস স্তম্ভিত হয়ে যান।

    কৃষ্ণা বললে, ”হ্যাঁ, আমিই কৃষ্ণা। কি করে আমি এখানে এসেছি, সে কথা পরে বলব। আপনি, কিন্তু দেরী নয়-এখনই জনকয়েক পুলিস নিয়ে আমার সঙ্গে দুর্গাপুরে চলুন-একটুও দেরী করবেন না!”

    ”দুর্গাপুরে!” মুরারি বোস দৃপ্ত হয়ে ওঠেন, ”এখনই যাচ্ছি কৃষ্ণাদেবী, আমি তো দুর্গাপুরে সার্চ করবার জন্যেই এসেছি। এখনই…এখনই!”

    চটপট তিনি প্রস্তুত হয়ে নেন, কনষ্টেবলরাও প্রস্তুত হয়।

    জুতার তলায় রবারের সোল লাগিয়ে নেওয়া হয়। নিঃশব্দে পনেরো জন লোক তিন মাইল দূরে দুর্গাপুর গ্রাম অভিমুখে যাত্রা করে।

    কৃষ্ণা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করে, ”কটা বাজলো মুরারিবাবু?”

    মুরারিবাবুর হাতের ঘড়িতে দেখা গেল প্রায় চারটা বাজে।

    অধীর হয়ে ওঠে কৃষ্ণা! ”তাড়াতাড়ি চলুন, যত তাড়াতাড়ি পারি ওখানে পৌঁছানো চাই। ওদের প্লেন প্রস্তুত, ভোরের সময় ক’জন বন্দিনী-মেয়ে নিয়ে প্লেন আরবে ষ্টার্ট করবে, তখন আমাদের সব চেষ্টা মিথ্যা হবে!”

    মুরারি বোস আশ্চর্য্য হয়ে যান-কৃষ্ণা এত দ্রুত চলতে পারে! বাতাসের মতো কৃষ্ণা ছুটে চলেছে, তার নাগাল ধরতে তিনি হাঁপিয়ে উঠছেন, সময় সময় তাঁকেও দৌড়োতে হচ্ছে।

    এখনও তার সম্বন্ধে কোনো কথা জানা হয়নি, তাকে কিছু জিজ্ঞাসা করবার সময় সে দিচ্ছে না। কোনো কথা বলতে গেলেই বাধা দিচ্ছে, বলছে, ”জানতে পারবেন ইনস্পেক্টর সাহেব। সবই আমি জানাব। কিন্তু ওই অভাগিনী মেয়ে কটিকে উদ্ধার করবার আগে আমি কোনো কথা বলব না।”

    দুর্গাপুরে যখন তাঁরা পৌঁছোলেন, তখন পূবের আকাশ লাল হয়ে উঠেছে। ভোরের সূচনা মাত্র। পথের ওপাশে দেখা গেল-ক’টা আলো ইতস্ততঃ যাতায়াত করছে। মনে হচ্ছে, কতকগুলি লোক খুব ব্যস্তভাবে ছুটোছুটি করছে। কৃষ্ণা আগে চলছিল, হঠাৎ সে থামে-সঙ্গে সঙ্গে সবাই থেমে যায়।

    ষোল

    শয়তানের ফন্দী

    ভোরের আবছা আলোর মধ্যে দেখা গেল, বিস্তীর্ণ মাঠের মাঝখানে বিশালাকায় কি-একটা দাঁড়িয়ে আছে।

    চাপা সুরে কৃষ্ণা বলে, ”এগিয়ে আসুন মুরারিবাবু। ওই প্লেন অপেক্ষা করছে। ওরা এখনই প্লেনে উঠে পালাবে।”

    গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে তাঁরা দেখেন।

    প্রভাতের আবছা আলোয় দেখা গেল, বিস্তীর্ণ মাঠের ওদিক থেকে কজন লোক কি যেন বয়ে নিয়ে আসছে।

    কৃষ্ণা বললে, ”বন্দিনী মেয়ে ক’টির মুখ বেঁধে ওরা নিয়ে আসছে মুরারিবাবু। মনে হয়, ওদের হাত-পাও বেঁধেছে।”

    মুরারি বোস গণনা করেন-একটি, দুটি করে সাতটি মেয়ে।

    তিনি বাহির হয়ে পড়ছিলেন, কৃষ্ণা বাধা দিলে, ”অপেক্ষা করুন, ওদের দলের আলি মহম্মদ, রজনী দত্ত, রমলাবাই, এরা এসে পৌঁছোক, একসঙ্গে সব ক’টিকে গ্রেপ্তার করবেন।”

    ”আলি মহম্মদ-রজনী দত্ত,-বম্বেমেলে যাদের নাগপুর নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল?”

    বিস্ময়ে মুরারি বোস প্রশ্ন করেন।

    কৃষ্ণা উত্তর দেয়-”এবং তার সঙ্গে জেল-ফেরার দুর্গাবাই-যাকে রমলাবাই বলছি। এতগুলি ফেরারী আসামীকে একসঙ্গে হাতে পাবেন মুরারিবাবু-এ বড় কম সৌভাগ্য নয়!”

    মাঠের ওপারে দেখা গেল চার-পাঁচজন লোক। আলি মহম্মদকে দুজন লোক ধরে ধরে আনছে-মনে হচ্ছে, সে অত্যন্ত অসুস্থ।

    খুশী হয়ে ওঠে কৃষ্ণা।

    তাহলে গত রাত্রে খোদ আলি মহম্মদকেই সে আক্রমণ করেছিল! অন্ধকারে তারা কেউ কাউকে চিনতে পারেনি। কৃষ্ণাকে চিনতে পারলে আলি মহম্মদ তাকে সহজে ছাড়তো না-মুক্তির সম্ভাবনাও আজ সুদূরপরাহত হতো!

    ভগবানকে ধন্যবাদ দেয় কৃষ্ণা!

    উঃ, একটুর জন্য কি বাঁচাই বেঁচেছে সে! রমলা ছিল তাদের রক্ষক, বন্দিনীদের ভিন্ন-ভিন্ন কামরায় রেখে সে নিজে পাহারা দিত। আলি মহম্মদ কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী শিউলালের চিঠি পেয়ে আজ ভোরেই এখান থেকে সদলবলে সরে পড়বার ব্যবস্থা করেছিল এবং সেই কথাই রমলাকে বলতে এসেছিল। কৃষ্ণা যে অত রাত্রেও দরজায় কান পেতেছিল, তা ওরা জানতে পারেনি!

    আর কোনো মেয়েকে তাদের ভয় ছিল না! কৃষ্ণার সাহস, বুদ্ধি, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ভয়ের কারণ ছিল বলেই কৃষ্ণাকে তারা অত্যন্ত সতর্কভাবে রেখেছিল।

    হয়তো তারা আজ বিলম্ব করেই রওনা হতো। কিন্তু কৃষ্ণার অকস্মাৎ পলায়নে সত্যই তারা শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল এবং ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে এখান হতে সরে পড়বার ব্যবস্থা করেছে।

    অসুস্থ আলি মহম্মদকে অতি সন্তর্পণে তুলে দিয়ে রজনী দত্ত, রমলাবাই উঠতে যাচ্ছে…

    ”সবুর কর দুর্গাবাই, শয়তান রজনী দত্ত-থামো-থামো।”

    পনেরো জন সশস্ত্র পুলিস সহ মুরারি বোস দ্রুত অগ্রসর হয়ে এসে তাদের ঘিরে দাঁড়ালেন। তাঁর আদেশে দুজন কনষ্টেবল লাফ দিয়ে প্লেনে উঠে আগেই পাইলটকে বন্দী করে ফেললে।

    এগিয়ে আসে কৃষ্ণা-

    ”নমস্কার রমলাবাই-নমস্কার রজনী দত্ত!”

    ”হ্যাঁ, নমস্কার-নমস্কার!”

    দ্রুত হস্তে রজনী দত্ত আর রমলা রিভলভার বার করে তোলবার সঙ্গে সঙ্গে কৃষ্ণার হাতের রিভলভারের গুলি অব্যর্থ লক্ষ্যে ছুটে রমলার হাতের রিভলভারে লাগে, সেটা ছিটকে দূরে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে গুলি ছুটে যায়।

    রজনী দত্ত নিজের হাতের রিভলভার ফেলে দেয়, হতাশ কণ্ঠে বলে, ”না, আর পালাবার চেষ্টা করব না কৃষ্ণাদেবী, আমি ধরা দিচ্ছি।”

    দলসুদ্ধ গ্রেপ্তার হয়।

    সকলের হাতে হাতকড়া ওঠে।

    বাঘিনীর মতো রমলা গর্জ্জন করে, ”তুমি বার-বার আমায় আঘাত হানছো কৃষ্ণাদেবী,-বার-বার হাত ছাড়িয়ে পালিয়েছো। হাওড়ায় পুলিস দিয়ে ঘেরবার সময় তোমায় লক্ষ্য করে বোমা মারলুম, সে বোমা লাগলো অন্য লোকের গায়ে। বোকা-ভারি বোকা আমাদের আলি সাহেব-তাই কিছুতেই তোমার এতটুকু অনিষ্ট করতে দেয়নি। তোমার হাত যখন সেপটিক হল-তখন ডাক্তার আলি সাহেব তোমার চিকিৎসা করে তোমায় ভালো করে তুললো-এ কি বোকার কাজ নয়? কতবার বলেছি, শত্রুর শেষ রেখো না আলি সাহেব, একে শেষ করে দাও, কিন্তু কেন যে আলি সাহেব তোমায় এতটুকু দুঃখ-কষ্ট দিতে চাইল না, তা বুঝিনে। আজ তার সেই বোকামির জন্যে নিজেও গেল-আমরাও গেলুম!”

    রমলা কড়াসুদ্ধ হাত কপালে তুলে আঘাত করে।

    অসুস্থ আলি মহম্মদের জন্য একখানা খাটিয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

    কৃষ্ণার পানে তাকিয়ে ম্লান হাস্যে ক্লান্ত কণ্ঠে আলি মহম্মদ বললে, ”আমার জন্যে আপনাদের ব্যস্ত হতে হবে না কৃষ্ণাদেবী, আপনাদেরও খুব বেশী কষ্ট দেব না। দুর্গাবাই আমার বোকামির কথা বলেছে, আমায় ধিক্কার দিয়েছে। শুধু আজ নয় কৃষ্ণাদেবী, সে প্রায় আমায় উত্তেজিত করবার চেষ্টা করে, কিন্তু আমি আপনার অনিষ্ট করতে পারিনি। হয়তো কষ্ট অনেক দিয়েছি, সে জন্যে আমায় মাপ করবেন।”

    ক্লান্ত ভাবে সে চোখ বুজলো।

    সতেরো

    আনন্দ উৎসব

    মেদিনীপুর রওনা হওয়ার মুখে বাধা পড়ে। ইনস্পেক্টর মুরারি বোস টেলিগ্রাম করেছেন-আসামী নিয়ে তিনি আসছেন।

    ব্যোমকেশের নামে টেলিগ্রাম দেখে মৃন্ময় আশ্চর্য্য হন, প্রণবেশকে এ কথা জানান।

    প্রণবেশ আর্ত্তকণ্ঠে বললেন, ”আসামী নিয়ে আসছেন তিনি! তাহলে কৃষ্ণা নেই, মৃন্ময়!”

    তাঁর চোখের জল মানা মানতে চায় না, সকলের দিকে পিছন করে তিনি বারবার চোখ মোছেন।

    আসামীদের নিয়ে যথাসময়ে মুরারি বোস এসে দাঁড়ালেন। এঁদের মধ্যে ছিল কৃষ্ণা।

    ”কৃষ্ণা! অ্যাঁ, কৃষ্ণা এসেছে, আমার মামণি!”

    প্রণবেশ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারেন না, হাসবেন কি, কাঁদবেন-ঠিক করতে পারেন না!

    কৃষ্ণা মামার হাত দুখানা চেপে ধরে-”হ্যাঁ মামা, আমি এসেছি। আমি মরিনি মামা-এরা আমায় আটক করে রেখেছিল, আমি পালিয়ে এসেছি।”

    ব্যোমকেশ বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন।

    মুরারি বোস সহাস্যে বলেন, ”কৃষ্ণাদেবীকে প্রথমে আমি চিনতেই পারিনি ব্যোমকেশবাবু। উনি যখন ফাঁড়িতে এসে সাহায্য চাইলেন, আমি ওঁকে অন্য কেউ ভেবেছিলুম! উঃ, কি কষ্টই না পেয়েছেন উনি! সেদিন রাতদুপুরে যে ভাবে ওদের আড্ডা থেকে পালিয়েছেন, আমি জোর করে বলব-কোনো পুরুষ তেমন করে পালাতে পারতেন না! আপনাদের প্রধান আসামী আলি মহম্মদকে আজ আমরা গ্রেপ্তার করতে পারতুম না যদি কৃষ্ণাদেবীর হাতে সে জখম না হতো! বাস্তবিক ওঁর শক্তি, সাহস আর উপস্থিতবুদ্ধি দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি।”

    এমন সময় একজন কনষ্টেবল এসে সেলাম দেয়, তাকে দেখে সবাই উৎসুক ভাবে তাকান।

    কৃষ্ণা জিজ্ঞাসা করে, ”কি খবর রামসিংহ?”

    সে সসম্ভ্রমে উত্তর দেয়, ”ডেপুটী কমিশনার সাহেব আপনার ফোন পেয়েই শিউলালকে গ্রেপ্তার করেছেন। তাকে লালবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, আমাকে খবর দিতে পাঠালেন।”

    কৃষ্ণার সঙ্গে এসেছে অপহৃতা পার্ব্বতীবাই এবং আরও কটি মেয়ে। এরা সবাই বন্দিনী ছিল।

    খবর পেয়ে দেবীপ্রসাদ ছুটে এলেন, পার্ব্বতীবাই কেঁদে ভাসিয়ে দিলে।

    দেবীপ্রসাদ আর্ত্তকণ্ঠে বললেন, ”আপনার উপকার আমি কোনোদিন ভুলব না কৃষ্ণাদেবী। আমি শিউলালের সম্বন্ধে খবর নিয়ে জেনেছি দুর্গাবাঈ তার ভগ্নী-এরা দুই ভাই-বোন নানা উপায়ে অর্থ সঞ্চয় করতো। ব্যবসা-ক্ষেত্রে শিউলাল আমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরাজিত হয় দেখে এক ঢিলে দুই পাখি মারবার ব্যবস্থা করে। আরবের দিকে এক সুলতান নাকি সুন্দরী মেয়ে চান। তিনি তাঁর বেগম-মহলটা সেকালের নবাব-বাদশাদের মতো হারেম করতে চান। তাই মোটা টাকা দিয়ে সুন্দরী মেয়ে সংগ্রহ করেন। শিউলাল কোনো সূত্রে এই খবর পেয়ে লোক-মারফৎ সুন্দরী মেয়ে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। আলি মহম্মদের দলকে অজস্র টাকা দিয়ে সেই বাঁচিয়ে রেখেছিল। আমার স্ত্রীকে সে এই জন্যই সরায়। আমার ড্রাইভারকে খুন করে তার পোশাক পরে আলি মহম্মদের লোক মোটর চালিয়ে নিয়ে যায়, আমরা কেউ ধরতে পারিনি। আপনাকেও ওরা এই উদ্দেশ্যে নিশ্চয় সরিয়েছিল!”

    কৃষ্ণা বললে, ”ঠিক তাই। পরে বুঝলুম। ওরা আমায় আটক করে রাখলেও আমি আর একবার পালিয়েছিলুম। আবু বলে একটি ছেলে সে সময় আমার যথেষ্ট উপকার করেছিল।”

    মৃন্ময় বলে উঠলেন, ”হ্যাঁ, আমরা তার কাছেই তোমার খবর পেয়েছি কৃষ্ণা। তোমার ওখানে সে আমাদের নিয়ে যাচ্ছিল আজ। সে বাড়িতে খেতে গেছে-এখনই এলো বলে!”

    আবু এখানে আছে শুনে কৃষ্ণা আশ্চর্য্য হয়!

    কৃষ্ণা বলে, ”আবুর উপকার আমার মনে থাকবে আর মনে থাকবে আমাদের পুরানো চাকরের ছেলে ভীমকে-বেচারা আমার জন্যেই আলি মহম্মদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে, তার কথা ভুলব না।” কৃষ্ণার কণ্ঠস্বর আর্দ্র হয়ে ওঠে।

    দেবীপ্রসাদ সবিনয়ে জানান-”আজ সন্ধ্যায় লোহিয়া হাউসে আপনাদের সকলের চা পানের নিমন্ত্রণ রইলো-অবশ্য করে সকলকেই যেতে হবে।”

    বিদায় নিয়ে তিনি সস্ত্রীক চলে যান। অন্য মেয়েদের নিজ নিজ গৃহে পাঠাবার ব্যবস্থা করে মৃন্ময় আর প্রণবেশের সঙ্গে কৃষ্ণা দীর্ঘদিন পরে নিজের বাড়িতে ফিরে আসে।

    মাকে কৃষ্ণা বলে সব কথা!

    মায়ের আনন্দ ধরে না! অন্ন-জল ত্যাগ করে যেভাবে মায়ের দিনরাত্রিগুলো কেটেছে-তা জানেন শুধু অন্তৰ্য্যামী ভগবান। দিনরাত তেত্রিশ কোটী দেবতাকে ডেকেছেন মা-কত না মানত করেছেন ঠাকুরদের কাছে-”তাকে এনে দাও ঠাকুর…ষোড়শোপচারে তোমাদের পূজা দেবো…বুক চিরে রক্ত দেবো।”

    মায়ের প্রাণের আকুল-প্রার্থনা ঠাকুর-দেবতা শুনেছেন…নাহলে অমন রাক্ষসদের গ্রাস থেকে মেয়ে কি ফিরতে পারতো!

    মা বলেন-”এবার থেকে কিন্তু…”

    বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বলে-”ও কথা বলো না মা-বিপদ হবে না? ভালো কাজে জেনো, ভগবান চিরদিন সহায় হন!”

    সন্ধ্যায় লোহিয়া হাউসে মহা-উৎসব।

    ভকতরাম লোহিয়া নিজে এক ছড়া বহুমূল্য জড়োয়া নেকলেস উপহার দিলেন কৃষ্ণাকে-নিজের জীবন বিপন্ন করেও সে এতগুলি মেয়ের ইজ্জত রক্ষা করেছে! এতগুলো দাগী আসামী একসঙ্গে গ্রেপ্তার হয়েছে শুধু তারই সাহস আর বুদ্ধির বলে-ইনস্পেক্টর মুরারি বোসও সেজন্য বহু স্তুতি জানালেন।

    আঠারো

    নতুন অতিথি

    পরের দিন বাড়িতে মা করেছেন পূজার আয়োজন-সত্যনারায়ণের পূজা…চণ্ডীপাঠ… বিরাট ব্যাপার।

    কৃষ্ণাকে মা বলেছেন-”তোমার কোনো কাজে কখনও বাধা দিইনি….আজ আমার একটা কেথা তোমাকে রাখতে হবে কৃষ্ণা!”

    হেসে কৃষ্ণা বলে-”কি কথা মা?”

    মা বললেন-”আজ যে-লোকই আসুক তোমার কাছে-তার যত দরকারী কাজই থাকুক-তুমি বাড়ি থেকে বেরুতে পাবে না। পূজার সময় তোমাকে ঠাকুর-ঘরে থাকতে হবে!…পূজার পর শান্তিজল নেবে…তারপর যখন চণ্ডীপাঠ হবে-সেখানে বসে শুনবে।”

    কৃষ্ণা হাসলো, বললে-”তুমি কিন্তু অবাক করেছো মা…সত্যনারায়ণের পূজা…তার সঙ্গে চণ্ডীপাঠ! বৈষ্ণব আর শাক্ত…দু-ই এক করে তুলেছো।”

    মা রাগ করলেন। মা বললেন-”এ নিয়ে তামাসা করতে নেই, কৃষ্ণা। নারায়ণ আর চণ্ডী কি আলাদা? সব দেবতা এক। আমরা নিজেদের মনস্তুষ্টির জন্য কখনো তাঁকে ভাবি নারায়ণ বলে-কখনো ডাকি চণ্ডী বলে! ভগবান এক-আমরা তাঁর কত নাম দিয়েছি। কখনো তাঁকে ডাকি, পুরুষ ভাবে, বাবা। আবার বড় বিপদে মা বলে ডাকি! তখন ভগবান মেয়ে…মা…দুর্গা, চণ্ডী, কালী। আমি এই বুঝি বাছা। পণ্ডিতেরা কি বলে, তা দেখবার দরকার নেই আমার।”

    কৃষ্ণা বললে-”তুমি ঠিক বুঝেছো মা। ভগবান এক…আমরা মানুষ, তাঁকে কখনো পুরুষ মনে করি-কখনো মেয়ে মনে করি।”

    মা বললেন-”একালে তোমরা না মানতে পারো…কিন্তু আমি মানি, এই যে এত বিপদ-আপদের মুখে ছুটে যাও-তাঁর দয়া আছে বলেই না শুধু-”

    বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বলে-”ভালো কাজ করতে যত বিপদে পড়ি…আমার বিশ্বাস, মা-ভগবান সে-বিপদে রক্ষা করবেন। নাহলে মানুষের সাধ্য কতটুকু বলো? সত্যি বলছি মা, এ বিশ্বাস আমার আছে বলে, সেই বিশ্বাসের জোরেই আমার সাহস আসে-কখনো ভয় হয় না।”

    পূজা চণ্ডীপাঠের পর খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘরে বসে গল্প হচ্ছে-প্রণবেশ, ব্যোমকেশ, মৃন্ময় আর কৃষ্ণা। এত বড় ব্যাপার যা হলো-কৃষ্ণার জীবনে কদিন এক রোমাঞ্চকর পঞ্চাঙ্ক নাটকের অভিনয় যেন! সে নাটকের নানা দৃশ্যের খুঁটিনাটি, নানা কথা-মামাবাবুর নানা প্রশ্নে কৃষ্ণাকে বলতে হচ্ছে, এমন সময়ে বাহিরে বড় মোটর এসে দাঁড়ালো। বনমালী এসে খবর দিলে-”দেবীপ্রসাদবাবু এসেছেন দিদিমণি। সঙ্গে একটি মেয়েছেলে-আর এই এত ভেট।”

    কৃষ্ণা ছুটে গিয়ে অভ্যর্থনা করে তাঁদের নিয়ে এসে ঘরে বসালো। বনমালী নিয়ে এলো গাড়ি থেকে নামিয়ে এত বড় ঝোড়া-ঝোড়ার মধ্যে রকমারি ফল, মেওয়া; ফুল; আর কাগজের বাক্স; বাক্সে বেশ দামী বেনারসী শাড়ী-কৃষ্ণার জন্য।

    কৃষ্ণা বললে, ”এ আবার কি দেবীবাবু?”

    দেবীপ্রসাদ বললেন, ”আমি আনিনি, বহিন। এ-সব এনেছেন ইনি।” এ-কথা বলে দেবীপ্রসাদ ইঙ্গিত করলেন পার্ব্বতীবাইয়ের দিকে আঙুল দেখিয়ে।

    কৃষ্ণা তাকালো পার্ব্বতীবাইয়ের দিকে। পার্ব্বতীবাইয়ের আজ লজ্জা নেই-মুখ থেকে ঘোমটার আবরণ তুলে পার্ব্বতীবাই বললে-”বোনের ভালোবাসা। ভেট নয়, কৃষ্ণা বহিন!”

    ভালোবাসার দান-এতে না বলা চলে না। তারপর পরিচয়…ব্যোমকেশ, প্রণবেশ, বনমালী-কেউ বাদ গেল না। শেষে মা এলেন। মাকে প্রণাম করলেন দেবীপ্রসাদ আর পার্ব্বতীবাই। মা হেসে পার্ব্বতীবাইয়ের চিবুকে হাত দিয়ে চুম্বন নিলেন; দেবীপ্রসাদের মাথায় হাত রেখে আশীর্ব্বাদ করলেন।

    দেবীপ্রসাদ বললেন-”আপনার মেয়ের ঋণ এ-জন্মে শোধ দেবার নয়। উনি যা করেছেন, ভগবান তার জন্য-”

    বাধা দিয়ে কৃষ্ণা বললে-”থামুন দেবীবাবু। এ-সব কথা আমার ভালো লাগে না। মানুষ হয়ে মানুষের বিপদে দেখা-মানুষের কর্ত্তব্য। সে কর্ত্তব্য যে করে, তাকে এত সাধুবাদ দেবার কি দরকার, আমি বুঝি না। এ-সব কথা আমায় যদি বলেন, তাহলে আমি ভয়ানক রাগ করবো।”

    হেসে দেবীপ্রসাদবাবু বলেন-”আচ্ছা, আচ্ছা-আর বলবো না।”

    তারপর নানা কথা…মা বললেন পার্ব্বতীবাইকে-”সব শুনলুম মা, তোমাকে যে-ভাবে পাজীগুলো নিয়ে গিয়েছিল। কলকাতার সহরে ঐ ভিড়ের রাস্তা-সেখান থেকে এমন মানুষ-চুরি হতে পারে, এ যে স্বপ্নের অগোচর!”

    প্রণবেশ বলে উঠলেন-”কেন হতে পারবে না দিদি? মেয়েছেলেরা যত চালাক হোক, তারা মেয়েছেলে! ট্যাক্সিতে একা পেয়ে আচমকা তাকে নিয়ে ট্যাক্সিতে উধাও হওয়া-ভিড়ের মধ্যে খুব সহজ। কে কাকে নিয়ে চলেছে, কে বুঝবে আসল খবর? তার উপর সব মানুষ সমান নয়। দেখে বুঝেও অনেকে ভাবে, যাক গে-পরের ব্যাপারে মাথা গলিয়ে কেন মিথ্যা সুস্থ শরীর ব্যস্ত করি!”

    হেসে কৃষ্ণা বললে-”কিন্তু মামা, তোমাকেও একদিন এমনি ট্যাক্সিতে করে-! আসলে আগে থেকে ফন্দী করে থাকলে আচমকা এমন নিয়ে যাওয়া আশ্চর্য্য কি, মা! তারপর ঐ ক্লোরোফর্ম্ম!”

    মা যেন শিউরে ওঠেন! মা বলেন-”সত্যি! তাই বলি, পথে-ঘাটে চলতে হলে বেশ সাবধান হয়ে চলবে। সব সময় হুঁশ রেখো। তাহলে তবু-”

    এমন নানা কথায়-বার্ত্তায় অন্তরঙ্গতা জমে উঠলো দেবীপ্রসাদ আর পার্ব্বতীবাইয়ের সঙ্গে। মা বললেন-”এসো মা, এসো বাবা, দুজনে মাঝে-মাঝে এসো।”

    ”আসবো মা, বহিনের কাছে মাঝে-মাঝে আসবো।” এ-কথা বলে তাঁরা যখন বিদায় নিলেন, রাত তখন প্রায় দশটা।

    ঊনিশ

    কৃষ্ণার বিনয়

    এরই দু’একদিন পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হল-কুমারী কৃষ্ণা চৌধুরীর অসাধারণ কর্ম্ম-নৈপুণ্যের ফলে পলাতক যে সব আসামী ধরা পড়েছে, তাদের সর্দ্দার আলি মহম্মদ সাহেব গত রাত্রে পুলিস হাসপাতালে দেহত্যাগ করেছে।

    খবর পেয়ে কৃষ্ণা যখন পুলিস হাসপাতালে এল, তখন মৃতদেহ বার করে গোর-স্থানে নিয়ে যাবার উদ্যোগ হচ্ছে।

    কৃষ্ণা উপহার দিলে একগুচ্ছ লাল গোলাপ-যা ছিল আলি মহম্মদের বড় প্রিয়-কৃষ্ণা সে-কথা জানে।

    আলি মহম্মদের আত্মার সদগতি কামনা করে সে উঠে দাঁড়াল। তার মনে হল, মৃতের আত্মা তাকে ক্ষমা করেছে!

    আলি মহম্মদ যত নৃশংস, যত দুর্দ্দান্তই হোক, কৃষ্ণা তার কাছে চির-কৃতজ্ঞ। নিজের হাতের মধ্যে পেয়েও এত বড় শত্রুর সে এতটুকু অনিষ্ট করেনি, বরং চিকিৎসা করে তাকে সুস্থ করেছে! বাইরে থেকে বিচার করলে তাকে দারুণ অভিশাপ, বিভীষিকা বলে মনে হয়, কিন্তু তার অন্তরে ছিল দয়া, মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা-সে-খবর ক’জন রাখে?

    হাসপাতালের মেট্রন একখানা পত্র কৃষ্ণার হাতে দিলেন, বললেন, আলি সাহেব মারা যাওয়ার দু’দিন আগে নিজের হাতে পত্র লিখে তাঁর কাছে রেখেছেন। প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পর যেন এই পত্র কৃষ্ণাদেবীর হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়।

    মেট্রন সে-প্রতিজ্ঞা রক্ষা করলেন!

    এনভেলপ-আঁটা পত্রখানা কৃষ্ণা নিজের ভ্যানিটি-ব্যাগে যখন ভরে নিলে, তখন তার চোখ দুটি একেবারে শুষ্ক ছিল না।

    বাড়ীতে ফিরে এলো কৃষ্ণা। এক মৃন্ময়, দ্বিতীয় প্রণবেশ-দুজনে মিলে সমস্ত বাড়ী মুখরিত করে তুলেছেন। তাঁদের পঞ্চাশবার চা জোগাতে মোক্ষদার আজ এতটুকু বিরক্তি নেই, বনমালীও নির্ব্বাক হয়ে ফাই-ফরমাশ খাটছে। তারও বিরক্তি নেই।

    কৃষ্ণাকে মৃন্ময় মহা-কলরবে সম্বর্দ্ধনা করেন-”প্রাণ খুলে তোমাকে আজ আশীর্ব্বাদ করছি কৃষ্ণা,-তুমি যে কাজ করেছো, সত্যি, তার তুলনা নেই! আমাদের গভর্ণর সাহেব প্রস্তাব করে পাঠিয়েছেন, তোমায় একটা সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়া হবে সরকার থেকে।”

    ক্লান্ত ভাবে কৃষ্ণা বলে, ”আমি সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করব মামাবাবু,-সম্মানের পুরস্কার নেবার মতো ঢের লোক আছে-আমার এ ঘাড় তেমন মজবুত নয়-অত ভার বইতে পারবে না! আপনি দয়া করে এই কথাটা জানিয়ে দিলে খুব ভালো হবে।”

    সে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল, প্রণবেশ বাধা দিলেন-”যেয়ো না কৃষ্ণা-একটা কথা শুনে যাও।”

    কৃষ্ণা ফিরে দাঁড়াল।

    ভূমিকা না করেই প্রণবেশ বললেন, ”সত্যি, আমি আশ্চর্য্য হয়ে গেছি কৃষ্ণা-আলি মহম্মদের সমাধি হবে শুনেই তুমি সেখানে ছুটলে! পরম শত্রু সে-আর তোমাদের যা করেছে, করুক-তবে, নির্দ্দোষ নিরীহ ক’টি মেয়েকে যে শয়তান পাঠাচ্ছিল কোন সুলতানের হারেমে, মেয়েদের বেচে প্রচুর অর্থলাভ করবে এই ছিল যার উদ্দেশ্য-সেই পরম-শত্রুর সমাধির ব্যাপারে যোগ দিতে গেলে তুমি, এটা কি রকম হল, শুনি? উচিত কি অনুচিত, একবার ভাবলে না!”

    কৃষ্ণার মুখ কঠিন হয়ে ওঠে…প্রণবেশকে সে জবাব দেয়, ”উচিত কি অনুচিত, তা আমি বুঝিনে মামা, আমি জানি-শত্রু যদি মানুষ হয়, তবে তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেও সুখ আছে। আলি মহম্মদের সমাধি-ক্ষেত্রে আমি উপস্থিত হয়েছি, তার অতি প্রিয় গোলাপ উপহার দিয়েছি-আমার কাছে এ পরম সান্ত্বনা। নাহলে আইনের চোখে না হোক, তোমাদের চোখে না হোক, আমার বিবেকের কাছে আমি অপরাধিনী হতুম! কারণ আমার হাতে জখম না হলে সে মরতো না,-এক কথায় আামিই তাকে হত্যা করেছি!”

    বলতে বলতে কৃষ্ণা চলে যায়।

    প্রণবেশ আশ্চর্য্য হয়ে মৃন্ময়ের পানে তাকান-মৃন্ময় তখন অন্যমনস্কভাবে জানালা দিয়ে বাইরের পানে তাকিয়ে আছেন।

    কুড়ি

    আলি মহম্মদের পত্র

    মৃত্যুর দু’দিন আগে সে এক সিষ্টারের কাছ হতে একটা কলম আর একটু কাগজ চেয়ে নিয়ে কম্পিত হস্তে কোনোরকমে লিখেছে পত্র।

    কৃষ্ণা চকিতের জন্য পত্রখানার পানে তাকিয়ে থাকে-তারপর পড়ে।

    ইংরাজীতে লেখা পত্র। অন্য ভাষায় লিখলে কৃষ্ণা বুঝতে পারবে না, তাই ইংরাজীতে পত্র লিখেছে :-

    কুমারী কৃষ্ণা দেবী!

    মরণ-পথের যাত্রী আমি। জানি, হয়তো দু’একদিনের মধ্যেই আমায় চলে যেতে হবে। সে জন্য আমার বড় দুঃখ নাই, আমার কাছে পৃথিবী বড় পুরাতন হয়ে পড়েছে।

    এক অভিজাত-ঘরে আমার জন্ম, কিন্তু বাল্যকাল হতে সুশিক্ষা না পাওয়ার ফলে আজ আমি ঘৃণিত দস্যু, নরহত্যাকারী ছাড়া আর কিছুই নই!

    আমার জীবনের গতি হল ভিন্ন পথে-সে পথে আমার উপযুক্ত সঙ্গী মিললো।

    কেবল পাঞ্জাব নয়-সমস্ত সিন্ধুপ্রদেশ আমি জ্বালিয়ে দিয়েছি। আমাকে যারা বিপথে চালিত করেছিল, আমার পৈত্রিক সম্পত্তি যারা গ্রাস করেছিল, তাদের প্রত্যেককে জীবন্তদগ্ধ করেছি।

    শান্তি জীবনে পাইনি, শান্তি কাকেও দিইনি। আমার স্ত্রী আমায় সদুপদেশ দিয়েছিল, তাকে নিজের হাতে মৃত্যুর পথে পাঠিয়েছি।

    পাঞ্জাব পুলিস আমায় ধরবার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে; আমি তখন এলুম বাংলায়। শিউলাল হল আমাদের পেট্রন। অনেক সঙ্গী পেলুম। এখানেও আমার কাজ আরম্ভ হল।

    চমকে উঠেছিলুম সেদিন, সেদিন শিউলাল প্রস্তাব করেছিল এখান থেকে সুন্দরী মেয়ে সংগ্রহ করে আরবে পাঠাতে হবে। প্রথমে রাজি না হলেও শেষটায় রাজি হয়েছিলুম। ভেবে দেখলুম, চমৎকার ব্যবসা, এতে অনেক টাকা আয় হবে।

    ডাকাতি গুণ্ডামির সঙ্গে চললো মেয়ে-সংগ্রহ। তোমাদের আগেও দু-দল মেয়ে আরবে প্রেরিত হয়েছে।

    গ্রেপ্তার হলাম এবং দীর্ঘকাল কারাবাসের আদেশ হল আমার এবং রজনী দত্তের। আমাদের এখানে রাখতে কর্ত্তৃপক্ষ সাহস করলেন না, তাই আমাদের নাগপুরে পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের দলের লোকেরা নিষ্ক্রিয় ছিল না-বম্বে মেল ধ্বংস করে তারা আমাদের উদ্ধার করে। লুঠতরাজ করে সেই রাত্রে অনেক অর্থ এবং কটি সুন্দরী মেয়ে সংগ্রহ করি। তার মধ্যে ছিলে তুমি একজন।

    সত্যই তোমার পরিচয় পেয়ে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম কৃষ্ণাদেবী। নিজে চিকিৎসা-বিদ্যা একটু-আধটু জানতাম, তোমার হাতের ক্ষত আমিই চিকিৎসা করে ভালো করেছি।

    রমলা বা দুর্গাবাই জেল হতে পালিয়ে আমাদের কাছে এসেছিল। বম্বে মেল ধ্বংস, আমাদের পলায়ন এবং ক’টি মেয়ে অপহরণে বাংলার পুলিস ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল,-তারা স্থানে স্থানে ঘাঁটি ফেলে খুঁজছিল। আমরা তোমাদের নিয়ে পলায়ন করবার সুযোগ পেলাম না।

    আশ্চর্য্য হয়ে গেলাম তোমার সাহস, ধৈর্য্য আর বুদ্ধি দেখে। একবার ভীমকে হাত করে তুমি পালিয়েছিলে, বিচার করে আমি ভীমকে হত্যা করেছি।

    দুর্গাবাই তোমাকে হত্যা করার জন্য আমায় প্ররোচিত করেছে,-আমি তা করতে পারিনি!

    তুমি আমায় এটুকু বিশ্বাস করো কৃষ্ণাদেবী, আমি তোমায় কিছুতেই আরবে পাঠাতাম না। রজনী দত্তের সঙ্গে আমার সে পরামর্শ হয়েছিল। যে রাত্রে তুমি পালিয়েছিলে, সেই রাত্রেই সে তোমাকে নিয়ে সোজা কলকাতায় যাত্রা করতো। আমাকে বাধ্য হয়ে এদের সঙ্গে যেতে হতো। রজনী দত্ত-শুনলাম, বিচারে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছে-সে এ-কাজ করতে রাজি হয়েছিল। সে বলেছিল, তোমায় কলকাতায় পৌঁছে দিয়ে সে বর্মায় চলে যাবে, সেখানে তার ভগ্নী আছেন।

    আমার এতটুকু দুঃখ নেই কৃষ্ণাদেবী। তুমি আমায় যে রকম আহত করেছো, তাতে আমার পেট হতে নীচের ভাগটা এত বেশী জখম হয়েছে, যে-কোনো মুহূর্ত্তে আমি মরব।

    পত্র রেখে যাচ্ছি।

    জানি না, এ পত্র তুমি পাবে কি না। যদি পাও, হতভাগ্য সর্ব্বহারা দীন আলি মহম্মদের কথা এক একবার মনে করো কৃষ্ণাদেবী, তার জন্য একটি ফোঁটা চোখের জল ফেলো। বিদায়।

    হতভাগ্য-

    আলি মহম্মদ

    কৃষ্ণা সজল চোখ মুছে ফেলে-তারপর পত্রখানা নিয়ে গিয়ে মৃন্ময়ের হাতে দেয়, আর্দ্র কণ্ঠে বলে-”পড়ুন মামাবাবু।”

    মৃন্ময় পত্র পড়েন, সঙ্গে সঙ্গে প্রণবেশও ঝুঁকে পড়েন।

    __

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleগোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী
    Next Article গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    Related Articles

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.