Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী এক পাতা গল্প625 Mins Read0

    ০৩. বিজয়িনী শিখা

    বিজয়িনী শিখা

    এক – অসীম বোস

    হাওড়া ষ্টেশনের ভেতরে ঢুকে দশ নম্বরের প্লাটফরমের দিকে হন হন করে ছুটছিল কুমারী অগ্নিশিখা রায়। নানা রকমের লোকের ভিড় ঠেলে ঘন ঘন হাতঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে যাচ্ছে সে। তার পিছন পিছন চলেছে তার চির অনুগত ভৃত্য রতন। রতনের হাতে একটা স্যুটকেশ আর কাঁধে একটা বেডিং হোল্ড—অলে শক্ত করে বাঁধা।

    বেচারী রতন। ভারী বোঝা কাঁধে নিয়ে শিখার সঙ্গে তাল রেখে চলতে পারছিল না সে। কিন্তু পদে পদে বাধা পেয়েও তাড়াতাড়ি যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল সে।

    দশ নম্বর প্লাটফরমের গেট ছাড়িয়েই শিখা দেখতে পেল যে, তাদের ট্রেনখানা দাঁড়িয়ে আছে। হাতঘড়িটা আর একবার দেখে নিয়ে শিখা বলল, ”ইস, বড্ড দেরী হয়ে গেছে!”

    এই সময় ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা বেজে উঠলো।

    শিখা বলল, ”যে কোন একটা সেকেণ্ড ক্লাশ কম্পার্টমেণ্টে উঠে পড় রতন, এখন আর বাছ—বিচার করবার সময় নেই।”

    সামনের একখানা সেকেণ্ড ক্লাশ কামরায় উঠে পড়ে রতন। তাড়াতাড়ি শিখাও উঠে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে ট্রেনও ছেড়ে দেয়।

    শিখা তখন রতনের দিকে তাকিয়ে বলে, ”কি যে গড়িমসি করিস রতন, আর একটু হলেই ট্রেনটা মিস্ করেছিলুম আর কি—”

    তার কথা শেষ না হতেই কে যেন বলে ওঠে, ”শিখা দেবী যে!—যাচ্ছেন কোথায়?”

    ঘাড় ফিরিয়ে শিখা দেখল, পাশের বেঞ্চে বসে আছে অসীম বোস আর তার সঙ্গে একজন অপরিচিত প্রৌঢ় ভদ্রলোক।

    অনেকদিন পরে দেখা হল অসীম বোসের সঙ্গে। শিখা হাত তুলে নমস্কার করল।

    ”চিনতে পেরেছেন?”—সহাস্যে প্রশ্ন করল অসীম।

    ”খুব—অনেকদিনের পরে দেখা হল কিন্তু।” শিখাও হেসে জবাব দিল।

    ”তা কতদূর যাওয়া হবে?”

    ”গোকর্ণ পর্য্যন্ত।”

    ”গোকর্ণ! কোন তদন্তের ব্যাপারে নাকি?”

    শিখা মৃদুহেসে উত্তর দিল, ”না, তদন্তের ব্যাপারে নয়, ওখানে আমার মামা—বাড়ী। অনেকদিন যাওয়া হয় না, তাই। তা আপনি?”

    ”আমরা যাচ্ছি শিকারে। এই ভদ্রলোক মস্ত বড় শিকারী”—পাশের প্রৌঢ় ভদ্রলোকের দিকে একটা আঙুল বাড়িয়ে একবার শিখার দিকে একবার ভদ্রলোকের দিকে চাইল অসীম বোস।

    ”নমস্কার!” শিখা ভদ্রলোককে অভিবাদন জানাল।

    ভদ্রলোক তখন মিটিমিটি হাসছিলেন আর মাথাটা নাড়ছিলেন। অসীমের কথায় যেন তিনি খুব খুশী হয়েছেন। তিনিও শিখাকে প্রতিনমস্কার করলেন।

    অসীম বলল, ”গোয়েন্দাগিরি করছেন আজকাল সে খবর শুনেছি। তা শিকার—টিকারের ঝোঁকও আছে নিশ্চয়, চলুন না আমাদের সঙ্গে।”

    ”ধন্যবাদ। আপাতত সে ইচ্ছে নেই, অনেকদিন মামার বাড়ী যাইনি, নইলে এ সুযোগটা ছাড়তুম না। পরে সুবিধা হলে নিশ্চয়ই যাবো।”

    রতন ততক্ষণ শিখার বিছানাটা খুলে দিয়েছে সীটের ওপর। তার ওপরে পরম নিশ্চিন্তে শিখা তার দেহটা এলিয়ে দিল।

    পুরানো দিনের অনেক কথাই মনে পড়ে শিখার। এই অসীম বোসকে দেখেই বোধহয় কথাগুলো মনের মধ্যে জেগে উঠেছে তার।

    ট্রেন ছুটছে হু হু করে। ছোট—বড় অনেকগুলো ষ্টেশনই পার হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। ট্রেন চলার একঘেয়ে একটানা শব্দ বিরক্তিকর হলেও তার মধ্যে এমন একটা ছন্দ রয়েছে যে, শিখার চিন্তা—সূত্র বাধা পায় না তাতে। বাইরে নিকষ কালো অন্ধকার। খোলা জানালা দিয়ে তারই দিকে চেয়ে আছে শিখা।

    অসীম বোসের বাবা সরকারী দপ্তরে বড় চাকরী করতেন। পয়সাও করেছিলেন যথেষ্ট। চট্টগ্রামে যখন বদলী হয়ে এসেছিলেন তিনি, শিখা তখন খুবই ছোট, সবে মাত্র স্কুলে ঢুকেছে। অসীম উঁচু ক্লাশে পড়ত। লেখাপড়ায় অসীম খুবই ভাল ছিল। অসীমের বাবা ছেলের পেছনে খরচও করতেন খুব। দু—তিন জন প্রাইভেট টিউটার রেখেছিলেন তার জন্য। বলতেন, ”একমাত্র ছেলে, মানুষ না করতে পারলে আমার টাকা—পয়সা মান—সম্ভ্রমের মূল্য কি?”

    পাড়াতেও অসীমের সুখ্যাতি ছিল খুব। যেমন মিশুক তেমনি বিনয়ী ছিল সে। ছেলের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে তার বাবা মনে মনে তাসের প্রাসাদ রচনা করতেন। প্রচুর পয়সা ছিল তাঁর, তার ওপর হীরের টুকরো ছেলে। মানুষ আর কি আশা করে?

    কিন্তু ভগবান তাঁর এ সুখে বাদ সাধলেন। তাঁর সুখের স্বপ্ন সফল হবার আগেই হঠাৎ একদিন তিনি করোনারী থ্রম্বোসিস রোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। প্রচুর পয়সাও তাঁকে রক্ষা করতে পারল না। অসীম তখন ম্যাট্রিক ক্লাশের ছাত্র।

    ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিল অসীম, ফলটাও ভাল করল। কিন্তু কোথা থেকে কি যে হ’ল, কলেজে ঢুকেই তার মাথাটা গেল বিগড়ে। অল্পদিনের মধ্যেই লেখাপড়া ছেড়ে দু—হাতে বাপের পয়সা ওড়াতে লাগল সে। তারপর কোথায় যে, সে ছিটকে বেরিয়ে গেল, কেউ জানে না। তাই এতদিন পরে নিতান্ত অপ্রত্যাশিত ভাবে ট্রেনের মধ্যে অসীম বোসের সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ায় শিখার ইচ্ছা হচ্ছিল জিজ্ঞাসা করে, কোথায় আছেন, কি করছেন আজকাল—কিন্তু পরের সম্বন্ধে বেশী অনুসন্ধিৎসু হওয়া ভদ্রতা নয় মনে করে স্যুটকেশ থেকে একখানা বই বের করে তারই পাতা ওল্টাতে লাগল সে। কিন্তু বইয়ের পাতায় মন বসাতে পারল না। আবার তার মনে হয় অসীম বোসের কথা।

    বাপের পয়সা ত সব উড়িয়েছে অসীম। পরণে দামী স্যুট, চলেছে শিকারে, সঙ্গে সঙ্গতিপন্ন বন্ধু—করছে কি ও আজকাল!

    অসীমের দিকে চোখ পড়তে বড়ই অস্বস্তি বোধ করতে লাগল শিখা। অসীম তার সেই শিকারী বন্ধুকে ফিস ফিস করে কি যেন বলছিল আর সেই শিকারী ভদ্রলোকও মাথা নেড়ে নেড়ে তার কথায় সায় দিচ্ছিল এবং মাঝে মাঝে আড়চোখে শিখার দিকে চাইছিল।

    কি আলোচনা করছে ওরা? শিখার দিকেই বা তাকাচ্ছে কেন লোকটা? বইয়ের পাতায় চোখ রেখে কান রাখল শিখা ওদের দিকে। ওরা কিন্তু তখনই চুপ করে গিয়ে অন্য কথা পাড়ল। তার একবর্ণও বুঝতে পারল না শিখা। তবুও সে তাদের কথার দিকেই কান রাখল।

    দুই – আততায়ীর আক্রমণ

    সেকেণ্ড ক্লাশ কামরা হলেও কামরাটা খুব ছোট ছিল না। কামরার তিন দিকে গদি—আঁটা চওড়া বসবার জায়গা। একদিকের সীট অধিকার করে বসে ছিলেন দুজন বিহারী ভদ্রলোক। তাঁদের দেখে সম্ভ্রান্ত লোক বলেই মনে হয়। একজন ভৃত্য শ্রেণীর লোকও তাঁদের সঙ্গে ছিল। তার সাজ—পোষাকের ঘটা দেখলে রাজা—মহারাজার ভৃত্য বলেই মনে হয়।

    বিহারী ভদ্রলোক দুজন নিজেদের ভাষায় কথাবার্ত্তা বলছিলেন। সেদিকেও শিখার কানটা মাঝে মাঝে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের ভাষার একবর্ণও শিখা বুঝল না।

    কিছুক্ষণের মধ্যে অসীম তাদের সঙ্গে আলাপ করতে সুরু করল। গায়ে পড়ে আলাপ করার স্বভাব অসীম বোসের ছেলেবেলা থেকেই। অল্পক্ষণের মধ্যে ওদের আলাপ বেশ জমে উঠল। এতে শিখারও সুবিধা হ’ল অনেক। ওদের গল্প শুনতে শুনতে শিখার সময়ও বেশ কেটে যেতে লাগল। বিহারী ভদ্রলোকেরা ভাঙা—ভাঙা বাংলা—হিন্দী মিশিয়ে কথা বলছিলেন অসীম বোসের সঙ্গে।

    ওদের টুকরো টুকরো কথা থেকে শিখা ওদের বিষয়ে অনেক কিছুই জানতে পারে।

    এই ট্রেনের ফার্ষ্ট ক্লাশে চলেছেন রাজাবাহাদুর পূর্ণেন্দু নারায়ণ পাণ্ডে। যিনি কথা বলছিলেন তিনি রাজাবাহাদুরের সেক্রেটারী, আর তাঁর সঙ্গী রাজাবাহাদুরের একজন নিকট আত্মীয়।

    রাজাবাহাদুর বিহারের কোন এক বড় জমিদারির বারো আনা সম্পত্তির মালিক। সম্প্রতি তিনি ভাগলপুরে চলেছেন। সেখানে তাঁর শ্বশুরবাড়ী। স্ত্রী ও কন্যার ইচ্ছায় একবার শ্বশুরবাড়ী হয়ে জমিদারিতে ফিরবেন। কলকাতার কোন এক সেফ ডিপজিট ভল্টে তাঁর কয়েক লক্ষ টাকার অলঙ্কার গচ্ছিত ছিল, এবারে সেগুলো তুলে নিয়ে জমিদারিতে ফিরে যাচ্ছেন।

    তারপর সেক্রেটারী সাহেব তাঁর প্রভুর বিপুল ঐশ্বর্য্যের গল্প ফাঁদলেন। প্রভুপত্নীর গলায় যে জড়োয়ার নেকলেসটা আছে তারই দাম কমপক্ষে এক লাখ টাকা।

    শিখা আড়চোখে তাকাল অসীমের দিকে। সে লক্ষ্য করল যে, অসীম আকুল আগ্রহে সেক্রেটারীর কথাগুলো গিলছে। একবার সে বলল, ”কত টাকার দামের জিনিস রাজা বাহাদুরের সঙ্গে রয়েছে?”

    সেক্রেটারী উৎসাহিত হয়ে বললেন, ”কমপক্ষে লাখ লাখ টাকার তো বটেই—”

    ”এত টাকার জিনিস সঙ্গে যাচ্ছে, তার জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিশ্চয় করা হয়েছে, সঙ্গে সশস্ত্র পাহারা আছে নিশ্চয়ই?” জিজ্ঞাসা করে অসীম।

    সেক্রেটারী হেসে উঠে বলেন—”রিজার্ভ—করা কামরায় ট্রাভেল করছেন রাজাবাহাদুর, সঙ্গে আছেন তাঁর স্ত্রী, যুবতী কন্যা, আর ইয়া গাল—পাট্টাওয়ালা দুজন ভোজপুরী দরোয়ান। তাছাড়া বডিগার্ড হিসেবে আছেন একজন সুদর্শন যুবক। যুবকটি শিক্ষিত এবং রসিক। হাসি গল্পে এমন মাতিয়ে রাখতে পারেন যে কেউ ঘুমুতেই পারবে না একটুও। শুনতে পাই, কুমারী রুমা নাকি ঐ যুবকের প্রেমে পড়ে গেছেন। তাহলেই বুঝতে পারছেন যে, বিপদের আশঙ্কা কিছু থাকতেই পারে না।”

    অসীম তখন ”তা তো বটেই” বলে উঠে গেল নিজের সীটে। এক জায়গায় স্থির থাকতে পারে না সে। আবার নিজের সঙ্গী সেই খ্যাতনামা শিকারীর সঙ্গে গল্পে মেতে গেল। কিন্তু এত ফিস ফিস করে আলাপ সুরু করল যে, শিখা তার একটি বর্ণও শুনতে পেল না।

    শুনেই বা লাভ কি তার? বাইরে সীমাহীন নিবিড় অন্ধকার—আকাশে বোধ হয় মেঘ করেছে, একটি নক্ষত্র পর্য্যন্ত দৃষ্টিগোচর হয় না।

    সেই অন্ধকারে চিক—চিক করছে খদ্যোতিকার দল। তাদের সেই মিটমিটে ভ্রাম্যমাণ আলোয় মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে। পৃথিবী ও আকাশের মধ্যে যেন একটুও ব্যবধান নেই, সব একাকার হয়ে মিশে গেছে।

    শিখার চোখে ঘুম নেই, ঘুমোবার চেষ্টাও করে না সে। কি জানি কেন তার মনে হচ্ছে ঘুমোবার রাত আজ নয়। মন তার বলছে, এই রাতেই গুরুতর কোন একটা ঘটনার সঙ্গে তাকে জড়িয়ে পড়তে হবে। গন্তব্যস্থলে যাওয়া তার আর হয়ে উঠবে না।

    কয়েকটা ষ্টেশন পার হয়ে গেল ট্রেনটা। ষ্টেশনে ষ্টেশনে একবার অল্পক্ষণের জন্য থামে আবার সরব গর্জ্জনে অন্ধকারের রাজত্বের দিকে ছুটে চলে।

    হঠাৎ অসীম বোস আর তার সঙ্গীর দিকে চাইতেই শিখা আশ্চর্য্য হয়ে গেল। দুজনে দুপাশ ফিরে বসে আছে, দুজনেরই মুখ অসম্ভব গম্ভীর, দুজনের মধ্যে যেন ভীষণ ঝগড়া হয়ে গেছে। হঠাৎ এরকম মূর্ত্তি কেন ওদের? একবারও তো ওরা চেঁচিয়ে কথা বলেনি, তবে ওদের মধ্যে ঝগড়া হ’ল কখন?

    পরের ষ্টেশনেই সেই প্রৌঢ় ভদ্রলোক নেমে গেলেন। যাবার সময় একটি কথাও তিনি বললেন না। অসীমও যেমন চুপচাপ বসেছিল তেমনই গম্ভীর মুখে বসে রইল। মুখটা যেন তার আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।

    তার পরের ষ্টেশনে শিখাদের কামরাতে উঠল দুজন নবাগত বিহারী। বেশ যোয়ান চেহারা, কিন্তু সাজ—পোষাক দেখে মনে হয় ভৃত্য শ্রেণীর লোক। অসীম বলে উঠল, ”এটা সেকেণ্ড ক্লাশ—এটা তোমাদের গাড়ী নয়।”

    তাদের মধ্যে একজন দাঁত বের করে হি—হি করে হাসতে লাগল। আর একজন ততক্ষণে শিকারী ভদ্রলোকের পরিত্যক্ত সীটটা দখল করে নিয়েছে।

    অসীম বোস একবার তার দিকে আর একবার তার সঙ্গীর দিকে চেয়ে চুপ করে গেল।

    শিখারও ভয়ানক অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। কিছুক্ষণ অস্বস্তি ভোগ করবার পর সে উঠে দাঁড়াল। তার পায়ের কাছে বসে রতন ঢুলছিল অনেকক্ষণ থেকেই। ওপাশে রাজা বাহাদুরের সেক্রেটারীও ঢুলছেন। ঘুমুচ্ছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

    রতনকে ধাক্কা দিয়ে ডেকে তুলল শিখা। তার কানে কানে চুপি চুপি বলল, ”আর ঘুমিও না, সজাগ থাকো রতন, ব্যাপার ভাল বলে মনে হচ্ছে না। যদি বিপদ দেখ, সঙ্গে সঙ্গেই ঐ চেনটা টেনে দেবে।”

    ঘুম চোখে রতন বলল, ”আপনার যেমন কথা—গোয়েন্দাগিরি করে করে সব সময়েই চোর—ডাকাত দেখছেন আপনি। ট্রেনের মধ্যে আবার কি বিপদ হবে? তাছাড়া আমাদের কাছে আছেই বা কি?”

    ”না রতন, আমাকে এখন অনেকেই চেনে। যদি এই গাড়ীতে ডাকাতের দল থাকে তা হলে তারা আমাকেও আক্রমণ করতে ছাড়বে না।”

    ”আপনার যেমন কথা, ডাকাতদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই—”

    রতনের কথা শেষ হ’ল না, হঠাৎ কামরার আলোগুলো নিবে গেল। ব্যাপার সন্দেহজনক মনে করে শিখা তার বালিশের তলা থেকে রিভলভারটা বের করতে চেষ্টা করল। কিন্তু বালিশের তলায় হাত দেবার আগেই দুখানি বজ্রকঠিন বাহুর বাঁধনে শিখা একেবারে কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। শিখা চীৎকার করে উঠল, ”অসীম বাবু, চেন টেনে দিন, রতন চেন টেনে একেবারে ঝুলে পড়, তোমার মাথার ওপরেই চেন রয়েছে।”

    রতনের মুখ থেকে কোন জবাব এল না। শুধু একটা গোঁ গোঁ শব্দ শিখা শুনতে পেল। অসীমের দিক থেকেও কোন সাড়াশব্দ নেই।

    আর একটি কথাও শিখার মুখ থেকে বের হ’ল না। ক্লোরোফরমের উগ্র গন্ধ তার নাকে আসতেই সে বুঝতে পারলো এখন আর কোন চেষ্টাই সফল হবে না। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। নিজের বিছানার ওপরেই শিখা ঢলে পড়ে!

    কে চেন টেনেছিল জানা গেল না, হঠাৎ ট্রেনের গতি হ্রাস হতে হতে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রেনটা একেবারে থেমে গেল। অন্যান্য কামরার ভেতর থেকে সঙ্গে সঙ্গে একটা কোলাহল উঠল—হঠাৎ ট্রেন থামল কেন তারই গবেষণার কোলাহল।

    এই সকল কোলাহলের একটি কথাও শিখার বা তার সহযাত্রীদের কানে এল না। সকলেই তখন ক্লোরোফরমের প্রভাবে চৈতন্যহীন।

    তিন – রাজাবাহাদুরের কামরায়

    রাজাবাহাদুরের কামরায় গল্পের আসর বেশ জমে উঠেছে তখন। বক্তা রাজাবাহাদুরের বডি—গার্ড ও ভাবী জামাতা মিঃ বদরীপ্রসাদ, আর শ্রোতা রাজাবাহাদুর ও তাঁর কন্যা রুমা দেবী। রাণীজি ইতিপূর্ব্বেই বিছানা নিয়েছেন, সর্ব্বাঙ্গে তিনি একখানা চাদর মুড়ি দিয়েছেন। ভোজপুরী দুজনও ডালপুরী খেয়ে লম্বা হয়েছে।

    বদরীপ্রসাদের কর্ত্তব্যজ্ঞান প্রখর। তিনি যে রাজাবাহাদুরের বডি—গার্ড সে কথাটা মুহূর্ত্তের জন্যও ভুল হয়নি তাঁর। সমস্ত রাত্রি জেগে কাটাবার জন্য তিনি প্রস্তুত হয়ে রয়েছেন। কুমারী রুমা নিজের সীট থেকে মাঝে মাঝে মুখ ফিরিয়ে মৃদু মৃদু হাসছিল। বদরীপ্রসাদের অপূর্ব্ব কথা বলার ভঙ্গী রাজাবাহাদুরকেও পরিতুষ্ট করে রেখেছিল। অনেকক্ষণ থেকে তাঁর ঘন ঘন হাই উঠছিল। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছিল তাঁর। বদরীপ্রসাদের গল্প তাঁকে এতক্ষণ জাগিয়ে রাখলেও আর বোধহয় তিনি বসতে পারছেন না। বদরীপ্রসাদকে বলে তিনি একটু গড়িয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। রাজা—রাজড়ার শরীর, তাতে আবার ট্রেনের ধকল—সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর নাক ডাকতে লাগল।

    বদরীপ্রসাদ তখন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রুমার দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। রুমার দৃষ্টি এতক্ষণ তাঁর দিকেই ছিল। চোখে চোখে দৃষ্টির বিনিময় হল। বদরীপ্রসাদ সে চোখের ভাষা হয়ত বুঝেছিলেন, তাই ধীরে ধীরে উঠে রুমার পাশটিতে গিয়ে বসলেন। রুমার দিকে হাতটি বাড়িয়ে দিতেই সেও তার ডান হাতখানি বাড়িয়ে দিল। দুজনের হাতে হাতে ধরা রইল অনেকক্ষণ। দুজনের মুখেই কথা নেই। রাজকন্যার আয়ত আঁখির দিকেই বদরীপ্রসাদের প্রেম—ছলছল দৃষ্টি নিবদ্ধ। ধীরে ধীরে বদরীপ্রসাদ বললেন, ”এবারে ফিরে গিয়েই আমরা প্রাণে—প্রাণে বাঁধা হয়ে যাবো।”

    রুমা মুখে কোন কথা না বললেও তার চপল আঁখি—পল্লব দুটি বলতে চাইল, ”তোমার কথাই সত্যি হোক।”

    পরের ষ্টেশনে এসে গাড়ী থামল। রাজকুমারীর হাত ছাড়িয়ে বদরীপ্রসাদ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ষ্টেশনের দিকের দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ষ্টেশনের মিটমিটে আলোতে বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। লোকজনের ওঠানামা, তাদের খাপছাড়া মৃদু কোলাহল শোনা যায়। বদরীপ্রসাদের কিন্তু সেদিকে কান ছিল না। তিনি তখন হয়ত ভাবছিলেন, অদূর ভবিষ্যতের একটি দিনের কথা, যেদিন শাস্ত্রসম্মত ভাবে কুমারী রুমার অঙ্গ স্পর্শ করবার অধিকার তিনি পাবেন…

    ট্রেন ছাড়ার হুইসল পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে বিরাট অঙ্গ দুলিয়ে ট্রেন চলতে সুরু করল। বদরীপ্রসাদ খোলা দরজাটা ধরে বাইরের সূচীভেদ্য অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে তখনও দাঁড়িয়ে।

    ষ্টেশনের এলাকা ছাড়িয়ে ট্রেন স্পীড দিল। ক্রমশঃ স্পীড বাড়াত লাগল ট্রেনের। বদরীপ্রসাদ নিজের ভাবনায় বিভোর ছিলেন। হঠাৎ কামরার আলোগুলো নিবে গেল। বদরীপ্রসাদের মনে হ’ল কামরার অন্য ধারের দরজা খুলে কয়েকজন লোক ভিতরে ঢুকছে। লোকগুলো বোধ হয় ফুটবোর্ডে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ! বদরীপ্রসাদের সারা দেহে রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে। তাঁর মনে হয় যে, রাজাবাহাদুর, রাণীজী আর বিশেষ করে কুমারী রুমার ভার রয়েছে তাঁর উপরে। কর্ত্তব্য স্থির করতে দেরী হয় না তাঁর। অন্ধকারেই ছুটে যান নিজের বিছানার দিকে। রিভলভারটা বালিশের তলায় রেখেছিলেন। খালি হাতে দস্যুদের সঙ্গে যুদ্ধ করা সম্ভব নয় মনে করে তিনি রিভলভারটা নিতে ছোটেন।

    কিন্তু রিভলভারটা হস্তগত করবার আগেই অন্ধকারে কে একজন তাঁর উপরে লাফিয়ে পড়ে। তিনি চীৎকার করে ওঠেন। তাঁর মনে হয় কামরার মধ্যে কারা যেন দুপদাপ শব্দে ছুটাছুটি করছে। তিনি প্রাণপণে মুক্তি লাভ করতে চেষ্টা করেন আততায়ীর কবল থেকে। কিন্তু আততায়ীর দেহে ছিল অসুরের মত শক্তি। সহজেই সে কাবু করে ফেলে বদরীপ্রসাদকে। বদরীপ্রসাদ তখন অনন্যোপায় হয়ে চীৎকার করে ওঠেন, ”রুমা, রুমা, শীগগির চেনটা টেনে দাও! দরোয়ান! রাজাবাহাদুর!—”

    কিন্তু তাঁর সেই চীৎকারে কোনই কাজ হয় না। দুর্ব্বৃত্তরা তখন সবাইকে অজ্ঞান করে ফেলেছে ক্লোরোফরম করে। তাঁর নাকেও চেপে ধরা হয় ক্লোরোফরম ভেজানো রুমাল।

    আততায়ীর কবল থেকে উদ্ধার পেতে শেষ চেষ্টা করেন বদরীপ্রসাদ। কিন্তু আততায়ীর বজ্রপেষণ থেকে মুক্ত হতে পারেন না তিনি। ক্লোরোফরর্মের মিষ্টি গন্ধটা তাঁর নাকের ভিতর দিয়ে মাথায় ঢোকে। মাথাটা ঝিম ঝিম করে ওঠে তাঁর। একটু পরেই তিনি সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন।

    এদিকে দুর্ব্বৃত্তরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করে গেল। মহারাজা, রাণীজী এবং দরোয়ান দু’জনকে ক্লোরোফরম করেই নিশ্চিন্ত হয় না তারা। ওঁদের সবাইকে তারা ভাল করে বেঁধে ফেলে। বাঁধা—ছাঁদা হয়ে গেলে রাণীজীর গলা থেকে জড়োয়ার নেকলেসটা খুলে নেয় ওরা। নেকলেসের হীরেগুলো সেই অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে ওঠে। আর একজন গহনার বাক্সটা বের করে আনে রাজাবাহাদুরের মাথার নীচে থেকে।

    এইভাবে কাজ শেষ করে তারা চলে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়। যাওয়ার সময় কুমারী রুমার অচেতন দেহটি কাঁধে তুলে নেয় একজন।

    এই সময় হঠাৎ ট্রেনের গতি হ্রাস পায়। কেউ চেন টেনেছিল হয়তো। দস্যুরাও এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিল। ট্রেন একেবারে থেমে যাবার আগেই তারা চলন্ত গাড়ী থেকে নেমে অন্ধকারে গা ঢাকা দিল।

    * * * *

    হঠাৎ মাঝপথে আলো নিভে যেতে আর ট্রেনটা থেমে যেতে যাত্রীরা উৎসুক হয়ে জানালা দিয়ে মুখ বাড়াতে লাগল। সকলের চোখেই বিস্ময়ের চিহ্ন—সকলেই জানতে চায় কি হয়েছে। সেই অন্ধকারের রাজত্বের মধ্যে যাত্রীদের কোলাহল ক্রমশঃ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠল।

    হঠাৎ ট্রেন থেমে যাওয়ায় এবং সারা ট্রেনের যাত্রীরা চেঁচামেচি শুরু করে দেওয়ায় গার্ড তাঁর কামরা থেকে নেমে আসেন। নীচে নামতেই তিনি লক্ষ্য করেন যে, একমাত্র তাঁর কামরাটি ছাড়া সারা ট্রেনটাই অন্ধকার হয়ে গেছে।

    তাঁর মনে হয় যে, নিশ্চয়ই কেউ ইলেকট্রিক তারের সংযোগ কেটে দিয়েছে। ব্যাপার দেখে ইঞ্জিনের ড্রাইভার এবং ফায়ার—ম্যানরাও নেমে এসেছিল। গার্ডের হাতে একটা টর্চলাইট ছিল। প্রথমেই তিনি ইলেকট্রিক তারের সংযোগটা কোথা থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে সেইটে দেখতে চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেই তারের কাটা জায়গাটা দেখতে পেলেন তিনি। গার্ডের বগী আর তার পরের বগীখানার ভিতরে যে ফাঁকটা ছিল সেখান থেকেই কেটে দেওয়া হয়েছিল ইলেকট্রিকের তারটা।

    তিনি তখন তাড়াতাড়ি তাঁর কামরায় ঢুকে যন্ত্রপাতির বাক্সটা বের করে এনে তাঁর টর্চটা একজন ফায়ার—ম্যানের হাতে দিলেন। ফায়ার—ম্যান টর্চ ধরে থাকলো আর গার্ড সেই কাটা তারটাকে জুড়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিছুক্ষণের চেষ্টাতেই তারটা জুড়ে দিতে পারলেন তিনি। তার জুড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আবার আলো জ্বলে উঠলো ট্রেনের কামরাগুলোতে।

    আলো জ্বলে উঠবার সঙ্গে সঙ্গেই কৌতূহলী যাত্রীরা নেমে এসে গার্ড আর ড্রাইভারকে ঘিরে ধরে নানারকম প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে দিল।

    গার্ড বললেন—”আপনারা ব্যস্ত হবেন না, ইলেকট্রিকের তার কাটা গিয়ে ট্রেনের আলো নিবে যাওয়ায় কেউ হয়তো ভয় পেয়ে চেন টেনে দিয়েছিলেন। এক্ষুণি সব ঠিক হয়ে যাবে।”

    গার্ডের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই একজন যাত্রী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বললেন—”শীগগির এদিকে আসুন স্যার। ফার্ষ্ট ক্লাশ কম্পার্টমেণ্টে খুন হয়েছে।”

    ”খুন হয়েছে! বলেন কি?”

    ”ঠিকই বলছি স্যার। রাজাবাহাদুর পূর্ণেন্দু পাণ্ডের রিজার্ভ করা কম্পার্টমেণ্টের সবাইকে মরার মত পড়ে থাকতে দেখে এলাম।”

    গার্ড বললেন—”তা আপনি ও কামরায় গিয়েছিলেন কেন?”

    যাত্রীটি বললেন—”গিয়েছিলাম ঐ কামরার দরজাটা খোলা রয়েছে দেখে।”

    গার্ড তখন ড্রাইভার আর ফায়ার—ম্যানদের চেনের সঙ্গে সংলগ্ন হাতলওয়ালা পাখাটাকে ঠিক করতে বলে ছুটলেন রাজাবাহাদুরের কামরার দিকে।

    রাজাবাহাদুরের কামরায় প্রবেশ করেই বিস্ময়ে অবাক হয়ে গেলেন গার্ড। তিনি দেখতে পেলেন যে রাজাবাহাদুর, রাণীজী, দরোয়ান দু’জন এবং আরও একজন সুদর্শন তরুণকে মুখ হাত পা বেঁধে রাখা হয়েছে।

    রাজাবাহাদুরের কাছে গিয়ে তাঁর গায়ে হাত দিতেই গার্ড বুঝতে পারলেন যে, তিনি অচৈতন্য।

    দরোয়ান দু’জন এবং সেই তরুণটিরও জ্ঞান নেই। মহারাণীর দেহে তিনি আর হাত দিলেন না। কিন্তু তাঁর বুঝতে বিলম্ব হ’ল না যে মহারাণীও অজ্ঞান হয়ে আছেন।

    এই অবস্থায় তিনি কি করবেন না করবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না।

    চলন্ত গাড়ীর মধ্যে এই রকম একটা কাণ্ড কি করে ঘটতে পারে ভেবে ঠিক করতে পারেন না তিনি। তাঁর এখন কর্ত্তব্যই বা কি? ট্রেনই বা কতক্ষণ ‘ডিটেন’ করে রাখা যায়? মাঝপথে ট্রেন থামায় একটা টেলিফোন বা টেলিগ্রাম করবেন, তারও উপায় নেই।

    তিনি তখন গাড়ী ছেড়ে দেওয়াই ঠিক করলেন। রাত শেষ হয়ে এসেছিল প্রায়।

    পরবর্ত্তী ষ্টেশন কাটোয়া। ওখানে পুলিশও আছে, সুতরাং যা করবার হয় ওখানে গিয়েই করতে হবে।

    এই ভেবে গার্ড বেরিয়ে এলেন রাজাবাহাদুরের কামরা থেকে। বলা বাহুল্য, বেরিয়ে আসবার সময় একদিকের দরজায় ভিতর থেকে ‘ক্যাচ’ আটকে দিয়ে অন্যদিকের দরজাটা চাবি দিয়ে বন্ধ করে দিলেন তিনি।

    এ ছাড়া আর করবারই বা কি ছিল তাঁর?

    একটু পরেই ট্রেন আবার চলতে আরম্ভ করলো।

    চার – গৌরীপুরের রাজকুমার

    কাটোয়া ষ্টেশনে গাড়ী থামতেই শিখার জ্ঞান ফিরে এল। বড়ই দুর্ব্বল মনে হচ্ছিল তার সারা দেহটা। রতন একদৃষ্টিতে শিখার দিকে চেয়ে বসে ছিল। তার চোখের কোণ থেকে গণ্ডদেশ পর্য্যন্ত অশ্রুরেখা সুস্পষ্ট।

    শিখাকে উঠে বসতে দেখে উচ্চৈঃস্বরে কেঁদে উঠল রতন। বলল—”আর দরকার নেই দিদিমণি, চলুন কলকাতায় ফিরে যাই।”

    শিখা কিছুটা প্রকৃতিস্থ হয়ে রাত্রির ঘটনাটা মনে করবার চেষ্টা করে। সব কথা যখন তার ভাল করে মনে পড়ল, তখন চারদিকে একবার ভাল করে দেখে নিল সে। পুলিশের লোকে ষ্টেশন প্রায় ভর্ত্তি।

    রাজার সেক্রেটারী আর রাজার সেই আত্মীয়টি কামরাতে নেই। অসীম বোসেরও কোন পাত্তা নেই।

    ”চলুন, এই ষ্টেশনেই নেমে আমরা বাড়ী ফিরে যাই।”

    ”একটু চুপ কর দিকি রতন, আমাকে একটু ভাবতে দাও, আর বাড়ী ফিরেই বা যাবো কেন?”

    কিন্তু নিশ্চিন্ত হয়ে ভাবতে পারে না শিখা। হঠাৎ দুপদাপ শব্দ করে কয়েকজন সিপাই নিয়ে একজন পুলিশ অফিসার ঢুকে পড়েন সেই কামরায়। পুলিশ অফিসারটি তাঁর মুখখানা অসম্ভব গম্ভীর করে শিখার দিকে তাকিয়ে বললেন—”কি হয়েছিল বলুন ত আপনাদের কামরায়?”

    ”এধারে যে দু’জন বিহারী ভদ্রলোক ছিলেন তাঁরা কোথায় গেলেন?”—শিখা পাল্টা প্রশ্ন করলো পুলিশ অফিসারকে।

    পুলিশ অফিসার বললেন—”তা জানিনে, আপনাকে যা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সেই কথার উত্তর দিন আগে!”

    ”কি উত্তর দেবো আমি বলুন? আমার মনে হয় রাজাবাহাদুরের কামরায় ডাকাতি হয়েছে। আপনি দয়া করে বলুন, রাজাবাহাদুর কেমন আছেন?”

    ”তিনি এখন একটু ভালই আছেন, তবে তাঁর মেয়েকে পাওয়া যাচ্ছে না আর তাঁর গহনার বাক্সটাও চুরি হয়েছে।”

    ”আর তাঁর স্ত্রীর গলায় যে জড়োয়ার নেকলেসটা ছিল?”

    ”সেটাও গেছে, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে যে তাঁর গলায় নেকলেস ছিল?—রাজাবাহাদুর কি আপনার পরিচিত?”

    ”মোটেই না, এখনও পর্য্যন্ত রাজ—পরিবারের কাউকে আমি দেখিনি।”

    ”তবে?” সন্দিহান দৃষ্টিতে পুলিশ অফিসার শিখার দিকে চাইলেন।

    ”আরো অনেক খবর আপনাদের দিতে পারি আমি। ওঁরা যাচ্ছিলেন ভাগলপুর, রাণীর বাপের বাড়ীতে, সেখান থেকে যাবেন নিজের ষ্টেটে, সঙ্গে আছেন রাজাবাহাদুরের ভাবী জামাতাও। কলকাতার সেফ ডিপজিট ভল্ট থেকে উইথড্র করা কিছু গহনা—গাঁটি সঙ্গে নিয়ে রাখেন রাজাবাহাদুর।—আর কি শুনতে চান?”

    পুলিশ অফিসারের চোখ—দুটো বিস্ময়ে বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তিনি বললেন—”কিছু মনে করবেন না, আপনাকে আমরা অ্যারেষ্ট করলুম।”

    ”অ্যারেষ্ট করলেন! আমার অপরাধ?”—নির্ব্বিকারভাবে শিখা বলল।

    ”আমার সন্দেহ আপনি আসামীদের জানেন।”

    ”এই অপরাধ?—কিন্তু জানি বললে ভুল বলা হবে—একটা অনুমান করেছি বৈকি!”

    ”তা আপনি যতই চাপতে চেষ্টা করুন না কেন, আপনার কথাতেই আপনি ধরা পড়ে গেছেন, আপনাকে আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে। আপনার সঙ্গের এই ছোকরাটিকেও যেতে হবে। হাত—পা বেঁধে ওসব মায়াকান্নার মানে আমরা বুঝি।—এই উসকো হাতকড়া লাগাও।”

    একজন কনষ্টেবল এগিয়ে এল হাতকড়া নিয়ে।

    শিখা প্রতিবাদ করে উঠল। সে বলল—”এ কি অন্যায় আব্দার আপনার! আমাদের অ্যারেষ্ট করবার ফল খুব ভাল হবে না, তা মনে রাখবেন।”

    পুলিশ অফিসারের মেজাজ হঠাৎ রুক্ষ হয়ে উঠল। শিখার কথা শেষ হবার আগেই তিনি বলে উঠলেন—”আপনার উপদেশ শুনতে আমরা রাজী নই। রাজাবাহাদুরের কামরাতেও একই ভাবে ক্লোরোফরম ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ও কামরার ঘটনার সঙ্গে এ কামরা জড়িত এবিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। আপনাদের নেমে যেতে হবে আমাদের সঙ্গে, আপনি তার জন্য তৈরী হন।”

    ”আমি তৈরী”—দাঁত চেপে শিখা বলল।

    ”ইস—মেয়ে ত নয় যেন আগুনের ফুলকি। গৌরীপুরের রাজকুমার ঠিকই বলেছিলেন। আপনার জিনিসপত্র সার্চ করবো।”

    ”স্বচ্ছন্দে”—এত দুঃখেও হাসি পেলো শিখার। সে উঠে দাঁড়াল।

    ”না না, আপনার বডি সার্চ করবে মেয়ে—পুলিশ”—শিখার বালিশটা তুলে একদিকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন পুলিশ অফিসার। অমনি তার ছোট অটোমেটিক রিভলভারটা সকলের চোখের সামনে চকচক করে উঠল।

    ”তবে, মাথার চুল পাকতে চলল এই কাজ করে। এই—আউর একঠো হাতকড়া।”

    ”মাথার সব চুলগুলো পেকে গেলেও মাথার বুদ্ধি এক কড়াও বাড়েনি আপনার!” শিখার চোখ দুটো জ্বলতে লাগল।

    পুলিশ অফিসারের মুখখানা লাল হয়ে উঠল। বললেন—”আচ্ছা, চল তুমি আগে আমাদের ডেরায়—মেয়ে—পুলিশ দিয়ে কি করে সায়েস্তা করতে হয় তা আমার জানা আছে।”

    ”আপনি বাঙালী?”—শিখা সংযতভাবে প্রশ্ন করল।

    ”নিশ্চয়ই—নইলে গভর্ণমেণ্টের এই ডিপার্টমেণ্ট এত এফিসিয়েণ্ট।”

    ”বাড়ীতে আপনার মা, বোন, হয়ত আমারই মত একটা মেয়ে আছে নিশ্চয়—”

    ”তাতে কি হয়েছে?”

    ”দেখছেন আমিও বাঙালী। তা হলে তাদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলেন আমার সঙ্গেও সেভাবে কথা বলছেন না কেন?”

    ”কি বলতে চাও তুমি?”

    ”আমি বলতে চাই—আগে থেকেই কেন মাথা গরম করছেন? একটু মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করলে আপনার তদন্তের সুবিধা হত। এই নিন আমার নামের কার্ড—আমি কথা দিচ্ছি আপনাকে সাহায্য করে আপনার সুনাম বাড়াতে পারব।”

    শিখা হাতব্যাগ খুলে তার নামের কার্ডখানা পুলিশ অফিসারের হাতে দিল।

    কার্ডখানা পড়েই পুলিশ অফিসারের মাথা ঘুরে গেল। ”আপনি—আপনিই কুমারী অগ্নিশিখা রায়!—তা আপনি এখানে এলেন কি করতে?” তিনি নিজের হাতেই রতনের হাতকড়া খুলে দিলেন।

    ”যাচ্ছিলুম মামার বাড়ী—গোকর্ণে। কিন্তু বোঝেনই তো। ঢেঁকী স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। এই দেখুন, কি এক উড়ো ঝঞ্ঝাট এসে উপস্থিত হ’ল। সঙ্গে কার্ড না থাকলে তো হাজতবাসই করিয়ে ছাড়তেন আপনি! যাই হোক, আমার কথা বলে আর কি হবে? ডাকাতদের কথাই বলি। আমাকে ওরা চিনতে পেরেছিল তাই ‘সাবধানের মার নেই’ মনে করেই আমাকে আক্রমণ করেছিল ওরা। দুঃখের বিষয়, সব জেনেশুনেও আত্মরক্ষা করতে পারলুম না বা ওদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করতে পারলুম না। এখন আর ওদের ধরা খুব সহজ হবে না।”

    ”বলুন না কাদের সন্দেহ করেন? আপনি না সাহায্য করলে এ তদন্তের কোন কূল—কিনারাই হবে না।”

    ”আমি এখন ঠিক বলতে পারছি না, তবে কথা দিচ্ছি, মামার বাড়ী থেকে ফিরে এসে নিশ্চয় আপনাকে সাহায্য করব—আচ্ছা, ঐ দিকের বার্থে যে সুটপরা ভদ্রলোক ছিলেন তিনি কোথায় গেলেন?”

    ”তিনি তো গৌরীপুর না কোথাকার রাজকুমার—তাঁরও গেছে হাজার দশ—বারো টাকা নগদ। তিনি নেমে গেলেন পুলিশে ডায়েরী করতে, রেল কর্ত্তৃপক্ষের নামে ড্যামেজের মামলা করবেন বলেও বললেন তিনি। ভদ্রলোককে এমন ঘায়েল করে গেছে যে, ভাল করে হাঁটতেই পারছেন না। চোট লেগেছে বেশী তাঁর পায়ে। যত রাজা—রাজড়া এই গাড়ীতে ট্রাভেল করছিলেন তা কি আগে জানতুম। তাহলে তার উপযুক্ত ব্যবস্থাও করা হ’ত।”

    ”হুঁ—তা রাজকুমারটি নাম কি বলে গেলেন?” শিখা গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করল।

    ”এই যে আমার ডায়েরীতে লেখা রয়েছে—কুমারবাহাদুর জীবেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী।”

    শিখা না হেসে থাকতে পারল না। বলল—”এই কুমারবাহাদুরের যদি দেখা পান, তাঁর ওপর একটু কড়া নজর রাখবেন।”

    ”কেন? কেন?—”

    ”নিশ্চিত না জেনে সব কথার জবাব দেব কি করে? সবই তো সন্দেহের ওপর।”

    ”উনিই তো বলে গেলেন একটা ডাকাত দল আড্ডা নিয়েছে এই গাড়ীতে। তাদের দলপতি হচ্ছে একটা মেয়ে—”

    হো হো করে হেসে উঠল শিখা। বলল—”সাবাস জীবেন্দ্রনারায়ণ!”

    পুলিশ অফিসার শিখার এ হাসির অর্থ হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তখন শিখার কাছে বিদায় নিয়ে গাড়ী থেকে নেমে গেলেন।

    পাঁচ – ধানক্ষেতের ডাকাত

    কাটোয়া থেকে ট্রেন ছাড়লে রতন বললে—”তাড়াহুড়া করে বেরুনো হয়েছে দিদিমণি, যাত্রাটা ভাল হয়নি—চলুন আমরা কলকাতায় ফিরে যাই।”

    ”না না রতন, এখন আমাদের কলকাতায় ফেরা হবে না। মামার বাড়ী থেকে ফিরে আমরা এই ডাকাতির তদন্তের একটা শেষ দেখে তবে ফিরব।”

    ”না দিদিমণি, আমার মন ভাল বলছে না।”—কাঁদো কাঁদো হয়ে রতন বলল।

    ”আচ্ছা সামনের ষ্টেশনে নেমে যা হোক ভাবা যাবে ‘খন।”

    বিকালে ময়নামতী ষ্টেশনে ট্রেন এসে পৌঁছল। রতন বিছানাপত্র গোছগাছ করে নিয়ে নেমে পড়ল।

    শোনা গেল গোকর্ণ এখান হতে প্রায় দশ মাইল দূরে—শিখা বিব্রত হয়ে পড়ে। রতন বলল—”এতদূরে যখন এসেছি, তখন একবার ঘুরেই আসা যাক না।”

    ”বেশ, তাহলে কিছু খাবার—দাবারের যোগাড় করা আর গাড়ী পাওয়া যায় কিনা একটা খোঁজ নাও।” সঙ্গে সঙ্গে রতন চলে গেল গাড়ীর খোঁজে। কিছুক্ষণ পরে ফিরে এসে বলে—”গাড়ী আছে দিদিমণি, ঘোড়ার গাড়ী, গরুর গাড়ী, আবার দু’একখানা সাইকেল রিকসাও আছে দেখছি। কি গাড়ী ঠিক করব বলুন?”

    শিখা বললে—”মোটর হলেই সুবিধা হতো; অচেনা অজানা পথ, অন্ধকার রাত—ভয় থাকতো না। যাই হোক, তুমি একখানা ঘোড়ার গাড়ীই ঠিক করে ফেল।”

    ষ্টেশনের বাইরে একখানি মাত্র ঘোড়ার গাড়ী ছিল। ভাড়া ঠিক করে রতন শিখাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে তাকে উঠতে বলে, নিজেও উঠে পড়লো।

    পথ ভালো, পাকা রাস্তা।

    দু’দিককার দরজা খোলাই রইলো—শিখা দ্বার—পথে আসন্ন সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারের দিকে চেয়ে ছিল। রতন সামনের সীটে বসে থাকতে থাকতে একটু তন্দ্রা উপভোগ করছিল। এটি তার একটি বিশেষ স্বভাব, যে কোন যানবাহনের ঝাঁকুনিতে তার ঘুম আসে।

    ”রতন—”

    শিখার ডাকে রতন সচকিত হয়ে ওঠে—”আমি জেগে আছি দিদিমণি, একটুও ঘুমাইনি।”

    শিখা গম্ভীরভাবে বললে—”হ্যাঁ, তা দেখতেই পাচ্ছি।”

    শিখার চিন্তার শেষ নেই। রতনেরও ঢুলুনির শেষ নেই। আবার ঢুলতে লাগল রতন।

    একটা বাঁক ফিরবার মুখে গাড়ীটা হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেল—কোচম্যানের মুখে একটা সভয় উক্তি শোনা গেল—”ইয়া আল্লা, মেহেরবান খোদা—”

    কি হ’ল, গাড়ী হঠাৎ থেমে গেল, কোচম্যান সভয়ে বার বার খোদার নাম করছে—কারণ কি?

    রিভলভারটাকে হাতে নেয় শিখা। দরজা—পথে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে—”কি হ’ল, গাড়ী থামল কেন?”

    কোচম্যান গোঁ গোঁ করে কি যে বলে তা বোঝা যায় না।

    শিখা অন্ধকারে লক্ষ্য করবার চেষ্টা করে—তারপর রতনের দিকে তাকিয়ে ফিস ফিস করে বলে—”আমার টর্চটা চট করে স্যুটকেশ থেকে বার কর রতন—খুব তাড়াতাড়ি—”

    রতনের তন্দ্রা আগেই ছুটে গিয়েছিল। আগেই টর্চ বার করেছে, শিখা বলবামাত্র তার হাতে সেটা দিলে।

    ডানহাতে উদ্যত রিভলভার ধরে রেখে বাম হাতে শিখা টর্চের আলো ফেললে।

    পথের ধারে দু’জন লোক লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে। হয়ত তারা এগিয়ে আসছিল, উজ্জ্বল টর্চের আলো চোখে পড়তেই থমকে দাঁড়িয়েছে।

    ”কি চাও তোমরা?”—অকম্পিত কণ্ঠে শিখা প্রশ্ন করে।

    উত্তরে শোনা যায় বিকট তীক্ষ্ন হাসির শব্দ—হা হা হা হা হা—

    কোচবক্সের উপর থেকে কোচম্যান জড়িতকণ্ঠে বলে—”ও রমজানের দল, আর রক্ষা নাই।”

    কোচম্যানের কথায় কান না দিয়ে শিখা রতনকে বলে—”তোমার রিভলভারটা তুলে নাও রতন,—এ দু’জনকে গুলি করতে আমার রিভলভারই যথেষ্ট, তবু তোমারটা প্রস্তুত রাখো—”

    সঙ্গে সঙ্গে ওদিক থেকেও টর্চের আলো পড়ে। একটি ছোট লাঠি কোচম্যানের মাথার দিকে তীর বেগে ছুটে আসে। কোচম্যান মাথা সরিয়ে হাত তুলে সেটা রুখতে চেষ্টা করল কিন্তু টাল রাখতে না পেরে কোচবক্স থেকে নীচে পড়ে গেল।

    শিখা একটি মুহূর্ত্তও নষ্ট করল না। এক হাতে টর্চ ধরে সঙ্গে সঙ্গেই সে ফায়ার করে।

    অব্যর্থ লক্ষ্য তার। গুলি লাগে ডাকাতদের একজনের পায়ে। পায়ে গুলি বিঁধতেই সে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে, হাতের লাঠি তার পড়ে যায়।

    হাতের আলোটা খানিক দূরে ছুঁড়ে ফেলে সে। হয়তো আরও দু’—একজন লোকও ছিল, দেখা গেল আহত লোকটিকে ধরাধরি করে নিয়ে তারা পাশের ধানক্ষেতের মধ্যে ঢুকে পড়ে কোথায় মিলিয়ে গেল।

    দিগন্তপ্রসারী ধানের ক্ষেত;—এত বড় ধানের গাছ শিখা ক্যানিং অঞ্চলে ছাড়া আর কোথাও দেখেছে বলে মনে হয় না। এই ক্ষেতের মধ্যে যত লোকই লুকিয়ে থাক, তাদের খুঁজে বের করা সহজ নয়!

    মামার কাছে সে রাঢ় দেশের সুখ্যাতি শুনেছে। গল্পের ছলে তিনি বলেছিলেন,—”সে কি তোদের এদিককার ধানের ক্ষেত শিখা? তোদের দেশে যেমনি না মাঠ, তেমনি না ধানক্ষেত,—বড় জোর কোমর সমানও হয় কি না সন্দেহ। আমাদের ওদিকে গিয়ে দেখবি মাইলের পর মাইল দেড় মানুষ সমান উঁচু ধানক্ষেত, হাজার মানুষ লুকিয়ে থাকলেও দেখতে পাবি নে।”

    এতদিনে শিখা বুঝতে পারল যে, মামা নেহাৎ মিথ্যা কথা বলেননি। কিন্তু এই ধানক্ষেতে যে, ডাকাতদলের বাসা আছে সে কথা তো তিনি একবারও বলেননি। কোচম্যানের আঘাতটা খুব জোরই লেগেছিল। কিন্তু জানটা তার খুব কড়া ছিল। কোন রকমে উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল—”ভাগ্যিস আপনাদের কাছে বন্দুক ছিল।—”

    চাবুকটা টেনে নিয়ে শিখা বলল—”নাও—চাবুক ধর, গাড়ী হাঁকাও, আর কোন ভয় নেই।”

    এতক্ষণে সহিস গাড়ীর পিছন থেকে বেরিয়ে এসেছে। কোন ফাঁকে সে গাড়ীর পিছনে গিয়ে লুকিয়েছিল। কোচম্যান তার হাতে চাবুকটা দিয়ে বলল—”তুই গাড়ী হাঁকা, আমার মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে।”

    সহিস কাঁপতে কাঁপতে বলল—”আমি পারবুনি বাবা—রমজানের দল, সহজে ছাড়বেনি।”

    শিখা বলল—”কিচ্ছু দরকার নেই। তোমরা গাড়ীর ভিতরে বসো—রতন উঠে এসো আমার কাছে, আমিই গাড়ী হাঁকাব। নেহাৎ অশুভক্ষণে আমাদের যাত্রা হয়েছিল রতন। আর দেরী করো না,—দাও—চাবুক আমাকে দাও।”

    শিখা চাবুক হাতে করে লাগাম টানতেই ঘোড়া ছুটতে আরম্ভ করল। রতন রিভলভার হাতে নিয়ে শিখার পাশে বসে রইল। গাড়ী যেন পাকা গাড়োয়ানের হাতে চলেছে। রতন অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল—”গাড়ী চালাতে শিখলেন কবে দিদিমণি?”

    ”চট্টগ্রামে থাকতে—”

    রতন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে।

    ছয় – মামা-ভাগ্নী

    গোকর্ণ গ্রামখানা নেহাৎ ছোট নয়। বহু লোকের বাস এখানে। বাজার, হাট, হাইস্কুল, হাসপাতাল, এক কথায় সবই আছে। এখান থেকে ছয় মাইল দূরে মুর্শিদাবাদ জেলার কাঁদি মহকুমা।

    রাত্রে মামা—ভাগ্নীতে এই সম্বন্ধে অনেক গল্প হ’ল। কিন্তু রতনকে নিষেধ না করার ফলে রতন পথের বিপদের কথা বলে ফেলল।

    সেই মুখে মামা কিছু বললেন না কিন্তু সকালেই বইলো ঝড়—

    গম্ভীর কণ্ঠে মামা বলেন—”এতদিন যা করেছো তার জন্যে আমার কোন কথা নেই, কিন্তু এখন এ রকম ভাবে চললে একদিন এমন বিপদে পড়বে যে, কেঁদে কূল পাবে না। আমি তোমায় বলে রাখছি শিখা। তুমি হাজার লেখাপড়াই কর আর যত খুশী গোয়েন্দাগিরিই কর, জেনো তুমি মেয়ে ছাড়া আর কিছু নও। যত কুচরিত্র লোকদের পিছনে ঘুরে বেড়ানোর মন্দ দিকটা একবার ভেবে দেখেছ? তুমি বড় হয়েছো, তোমার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে বাধা নেই কিছু। মেয়েছেলে কত বিষয়ে দুর্ব্বল—তার ওপর তুমি ভরা—সমত্থ মেয়ে। তোমার এখন বিয়ে—থা করে ঘর—সংসার করবার বয়স।”

    শান্তভাবে শিখা বললে—”কিন্তু আমি তো একা ছিলাম না মামাবাবু, রতনও তো ছিল—”

    রুক্ষকণ্ঠে মামাবাবু বলে ওঠেন—”কথা শোনো মেয়ের! ঐটুকু একটা ছোঁড়া চাকর, ও রুখবে কিনা ডাকাত বদমায়েস!”

    তারপর গলার স্বর খাদে নামিয়ে তিনি উপদেশ দেন—”যাই হোক, এ রকম খেয়াল তুমি ছেড়ে দাও। গোয়েন্দার কাজ কর বলেই তুমি ট্রেনে এই ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলে।”

    ”কিন্তু তোমার রমজানের দলকেও তো হটিয়ে দিলুম মেয়েছেলে হয়ে। তোমাদের মতে মত দিয়ে আজ ঘোমটা টেনে, বউ সেজে এলে, কি সর্ব্বনাশ হয়ে যেতো বলতো? বদমায়েসের হাতে গৃহস্থের বউ—ঝিরা কি কখন পড়ে না? কিন্তু সেই বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে পারে কজন বউ—ঝি?”

    তখনকার মত আর কিছু বললেন না মামা। তিনি তখন থানায় চললেন ডাকাতির এজাহার দিতে।

    থানায় গিয়ে তিনি জানিয়ে দিলেন যে, বহুকাল পরে এ পথ আবার বিপদাকীর্ণ হয়ে উঠেছে। তাঁর ভাগিনেয়ী গেল রাত্রে ঘোড়ার গাড়ী করে আসার পথে কয়েকজন লোক দ্বারা লাঠি—সোঁটা নিয়ে আক্রান্ত হয়েছিল। ভাগ্যে তার কাছে রিভলভার ছিল, তাই দস্যুদল পলায়ন করেছে। একজনের পায়ে সে গুলি করেছে, আশপাশের গ্রামে খোঁজ করলে আহত লোকটিকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।

    দারোগা সাহেব তৎপর হয়ে ওঠেন।

    সেদিন ট্রেনে ডাকাতির কথা তিনি শুনেছেন, বিশেষ করে সেই জন্যই তিনি আসামীকে অন্বেষণ করবার ভার নেন।

    শিখা হাসে। বললে—”যদি সত্যই একটা বিরাট ষড়যন্ত্রের ব্যাপার হয় মামাবাবু, আপনার এসব পুলিশে কি কোন কাজ করতে পারবে? এসব পুলিশ তাদের কাছে কত নগণ্য!”

    মামা উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন—”নগণ্য মানে? আমাদের দারোগা সাহেব কি একজন হেঁজিপেঁজি লোক নাকি। এর আগে যে থানাতে ছিলেন তিনি সেখানে প্রচুর সুখ্যাতি পেয়েছেন—তোমরা কলকাতার লোক, কলকাতার পুলিশকেই সব চেয়ে বেশী কর্ম্মঠ মনে কর, তা ছাড়া আর সবাইকে অপদার্থ মনে কর তা জানি।”

    * * * *

    হঠাৎ পুলিশ ইনস্পেক্টর অমরেশবাবুর জরুরী পত্র নিয়ে কাটোয়া থেকে লোক আসে।

    তিনি জানিয়েছেন—রাজাবাহাদুর পূর্ণেন্দুনারায়ণকে কাটোয়া হাসপাতালে ভর্ত্তি করা হয়েছে। রাণীজীকে নিয়ে বদরীপ্রসাদ আর রাজাবাহাদুরের সঙ্গের অন্যান্য লোকেরা তাঁর শ্বশুরবাড়ী চলে গেছে। রাজাবাহাদুর শকটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তদন্ত জোর চলছে। শিখার কথামত কুমার জীবেন্দ্রনারায়ণের ওপর লক্ষ্য রাখা হয়। তার দু’জন সঙ্গী ধরা পড়েছে। জীবেন্দ্রনারায়ণ পলাতক। সে কোনদিনই কুমারবাহাদুর নয়। কুমারবাহাদুরের ছদ্মবেশে ঘুরছে। এ সময় কুমারী শিখাকে অমরেশবাবু পত্রবাহকের সঙ্গে এখনই আসতে বলেছেন। জরুরী প্রয়োজন, শিখা যেন একটুও বিলম্ব না করেন। পুলিশ সাহেব মিঃ ম্যাকডোনাল্ডের আদেশ অনুসারে তিনি জানাচ্ছেন—মিস্ রায় যেন অবিলম্বে উপস্থিত হন। তাঁর জন্য মোটা রকমের একটা পারিশ্রমিকও মঞ্জুর হয়েছে।

    এর সঙ্গে মিঃ ম্যাকডোনাল্ডের অনুরোধপত্রও একখানা ছিল। কুমারী রায়কে তিনি বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন—তিনি যেন পত্রপাঠ কাটোয়ায় আসেন।

    মামার মুখ গম্ভীর হয়ে ওঠে। কিন্তু স্বয়ং ম্যাকডোনাল্ডের অনুরোধ করা চিঠিখানা দেখে অবাক হয়ে যান। পুলিশ সাহেব শিখার সাহায্য চেয়েছেন! কথাটা বিশ্বাসের যোগ্য নয়।

    ঐ দিনই শিখা রওয়ানা হয়।

    কাটোয়া ষ্টেশনে পৌঁছেই শিখা লক্ষ্য করলো যে, ইন্সপেক্টর অমরেশবাবু ষ্টেশনেই অপেক্ষা করছেন।

    ট্রেন থেকে নেমে শিখা তাঁকে নমস্কার করে বললো—”ব্যাপার কি অমরেশবাবু, পুলিশ সাহেব পর্য্যন্ত লিখে পাঠিয়েছেন—এর তদন্তের ভার নেওয়ার কথা বলেছেন, কিন্তু আপনারা আমাকে যা ভেবেছেন আমি ঠিক তা নই, আমি সখের গোয়েন্দা। পারিশ্রমিকের কথা লিখেছেন, ও কথাটা আমাকে আর কখনও বলবেন না।”

    অমরেশবাবু উত্তর দিলেন—”আমার কোন দোষ নেই মিস্ রায়। রাজাবাহাদুরের সঙ্গে পুলিশ সাহেবের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা আছে—বিশেষ রাজাবাহাদুরের শ্বশুর মনোহর মিশ্র নিজে এসে তদ্বির করছেন। পুলিশ সাহেব আমাকে আদেশ দিয়েছেন, যেমন করেই হোক এ কেস—এর কিনারা করতেই হবে। গতকাল তিনি এসেছিলেন। আপনি ঐ ট্রেনে ছিলেন শুনে, এ কেস—এর তদন্তভার আপনাকেই নিতে বলেছেন তিনি।”

    শিখা ভ্রূ কুঞ্চিত করে।

    ”কিন্তু আমি তো এ পর্য্যন্ত হুকুমের চাকর কারুর হইনি অমরেশবাবু—”

    অমরেশবাবু ব্যস্ত হয়ে বললেন—”না না, তিনি আপনাকে কোন হুকুম দেননি, অনুরোধ করেছেন শুধু। তিনি কলকাতার পুলিশের কাছ থেকে আপনার সম্বন্ধে সব কথা জেনেছেন। তিনি বললেন—আপনি নিজে সে ট্রেনে ছিলেন, স্বচক্ষে সব দেখেছেন, সুতরাং আপনার পক্ষে তদন্ত করা সহজ হবে। আমাকে আপনার সহকারী ভাবে কাজ করবার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আপনি সব সময়েই আমাকে পাবেন।”

    হাসপাতালের একটি কেবিনে আছেন রাজাবাহাদুর। শকটা গুরুতর হওয়ার জন্য তাঁকে এখনও কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। শিখা ও অমরেশ তাঁর কেবিনে প্রবেশ করতেই বিস্মিত চোখে রাজাবাহাদুর তাদের দিকে তাকালেন।

    হাসপাতালের চাকর চেয়ার দু’খানা সরিয়ে দিল।

    চেয়ারে বসতে বসতে অমরেশবাবু জিজ্ঞাসা করলেন—”গত কয়েকদিন ধরেই আসছি কিন্তু আপনি অসুস্থ থাকায় ডাক্তারের নির্দ্দেশে বাধ্য হয়ে আমাদের ফিরে যেতে হয়েছে। অনেক সৌভাগ্য আজ আপনাকে একটু সুস্থ দেখছি।”

    রাজাবাহাদুর ক্ষীণকণ্ঠে বললেন—”কিন্তু জ্ঞান হওয়ার চেয়ে না হওয়াই ভালো ছিল। যথাসর্ব্বস্ব হারিয়ে ভিখারীর মত বেঁচে থাকতে চাইনে আমি।”

    অত্যন্ত ক্লান্ত ভাবে তিনি চক্ষু মুদলেন, বেশ বোঝা গেল তিনি কেবল দেহেই নয়, মনেও নিদারুণ আঘাত পেয়েছেন।

    শিখা আস্তে আস্তে জিজ্ঞাসা করলে—”আপনি কি হারিয়েছেন—জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?”

    রাজাবাহাদুর তার পানে চাইলেন—

    অমরেশবাবু শিখার পরিচয় দিলেন—”ইনি কুমারী অগ্নিশিখা রায়, কলকাতায় থাকেন, এঁর নাম হয়তো দেখে থাকবেন খবরের কাগজে। ইনি সরকারের বেতনভুক নন, তবু আমাদের কাজে যথেষ্ট সাহায্য করেন। কিছুদিন আগে কলকাতার কাছেই যে জাল—নোট তৈরীর আস্তানাটা গড়ে উঠেছিল, সেটা ইনিই আবিষ্কার করেন। নিজে বহু কষ্ট সহ্য করে দুর্ব্বৃত্তদলকে ধরিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছেন—পড়েছেন নিশ্চয়ই সে খবর?”

    রাজাবাহাদুর মাথা কাৎ করলেন মাত্র। নার্স পাশেই ছিল, সবিনয়ে জানালো—”রাজাবাহাদুর এখনও ভারি দুর্ব্বল। আপনারা যদি কাল আসেন অমরেশবাবু, তাহলে ভাল হয়। মনে হয় কাল অনেকটা প্রকৃতিস্থ হবেন ইনি।”

    অগত্যাপক্ষে তাই—

    ক্লান্ত রোগীর পানে চেয়ে দেখা যায় তিনি দুই চোখ বুজে শুয়ে আছেন। অমরেশবাবু ও শিখা বাইরের বারান্দায় চলে আসে।

    একটু পরেই হাসপাতালের ডাক্তার এলেন। সঙ্গে দু’জন নার্সও ছিল। অমরেশ ও শিখা তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। ওদের দিকে চেয়েই ডাক্তার প্রথমটা একটু থতমত খেয়ে গেলেন। তারপর নার্সদের সঙ্গে গিয়ে রাজাবাহাদুরের কামরায় ঢুকলেন।

    একটু পরে শিখাও ঢুকল সেই ঘরে। রোগীকে ইনজেকশন দিয়ে ডাক্তার তখন সিরিঞ্জ পরিষ্কার করছিলেন। ইনজেকশনের ছোট্ট শিশিটা মাথা ভাঙা অবস্থায় কেবিনের মেঝেয় পড়ে ছিল। সকলের অলক্ষ্যে শিখা সেই শিশিটা তুলে নিল।

    ইনজেকশনের সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে তুলে ডাক্তার এদিক—ওদিক কি যেন খুঁজতে লাগলেন। একজন নার্স জিজ্ঞাসা করল—”কি খুঁজছেন ডাক্তারবাবু?”

    ”ভাঙা ফাইলটা কোথায় গেল? কারুর পায়ে—টায়ে ফুটবে শেষকালে!”

    নার্সেরাও তন্ন তন্ন করে খুঁজতে লাগল শিশিটা—কিন্তু কোথায় শিশি? শিশি তখন সকলের অলক্ষ্যে শিখার ব্লাউজ গলে তার কোমরের কাছে স্থান লাভ করেছে।

    শিশিটা পাওয়া গেল না শেষ পর্য্যন্ত। ডাক্তার যেন নার্ভাস হয়ে পড়লেন। তিনি নার্সদের ওপর খুব তম্বি করতে লাগলেন।—”এটুকুও খেয়াল রাখতে পারো না সিষ্টার—কি করে রোগীর সেবা করবে তোমরা?”

    নার্সেরা অপ্রস্তুত হয়ে বৃথাই খোঁজাখুঁজি করতে লাগল।

    সাত – পাখার হাওয়া

    অমরেশবাবুর কোয়ার্টার থানা এলাকার বাইরে। শিখাকে তাঁর কোয়ার্টারেই স্থান নিতে হ’ল। প্রথমেই শিখা ইনজেকশনের ছোট শিশিটা কেমিক্যাল পরীক্ষার জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দিল যতীন্দ্রনাথের কাছে। শিশিতে কি ওষুধ ছিল সেটা তার জানা দরকার।

    দুপুরের দিকে অমরেশবাবু বললেন—”আমাকে সাহেব ডেকে পাঠিয়েছেন তাঁর বাংলোয়। আমি ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ফিরে আসছি।”

    যাবার সময় অমরেশবাবু বলে গেলেন—”ভয় পাওয়ার কোন হেতু নেই, কনষ্টেবলরা রইলো। তা ছাড়া সুন্দরলালকে বলে যাচ্ছি তার স্ত্রী যদি এই সময়টায় এসে আপনার কাছে থাকে তবু কথা বলবার একটা লোক পাবেন—”

    শিখা বললে—”কোন দরকার নেই, আমি বেশ থাকতে পারব।”

    অমরেশবাবু চলে গেছেন। শিখা একাই বিশ্রাম করতে থাকে।

    মিনিট পনেরো—কুড়ি পরে একটি মেয়ে এসে দাঁড়ালো শিখার কাছে। তাকে দেখে শিখার মনে হ’ল যে অমরেশবাবু যে স্ত্রীলোকটির কথা বলে গেলেন, এ হয়তো সেই। মেয়েটির হাতে একখানি ছোট্ট হাত—পাখা।

    মনে মনে হাসল শিখা। ধরে আনতে বললে বেঁধে আনে। হাত—পাখাটি পর্য্যন্ত হাতে করে নিয়ে এসেছে!

    শিখা তার পরিচয় নেয়—

    নাম রামপিয়ারী, দ্বারভাঙ্গা জেলায় বাড়ী, স্বামী এখানে বদলী হয়ে আজ মাসখানেক হ’ল তাকে নিয়ে এসেছে। সে এখনও এখানে কাউকে চেনে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

    অমরেশবাবুর দেখা নেই। রামপিয়ারী তার হাত—পাখা দিয়ে মৃদু মৃদু বাতাস করছে শিখাকে।

    ভারী মিষ্টি লাগছে এই হাওয়াটুকু।

    ক্লান্ত শিখার দুই চোখ ঘুমে ঢুলে আসে। রামপিয়ারী সমবেদনার সুরে বলল—”আপনি ঘুমোন, আমি আপনাকে হাওয়া করছি, সাহেব এলে আপনাকে ডেকে দিয়ে বাড়ী যাব।”

    আর কিছু শিখা জানতে পারে না, চেয়ারে বসেই সে ঘুমিয়ে পড়ে।

    অমরেশবাবুর ডাকে ঘুম ভেঙে যায় শিখার। চোখ মেলে সে দেখতে পায়, ঘরে কেবল অমরেশবাবুই নয়, আরও পাঁচ—ছয় জন লোক রয়েছে। তার মাথা আর্দ্র, তাকে চেয়ার হতে মেঝেয় শোয়ানো হয়েছে। ধড়মড় করে উঠে বসতে যায় শিখা,—

    হাঁ—হাঁ করে ওঠেন অমরেশবাবু—”না না, উঠবেন না। উঠবেন না মিস্ রায়, আর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিন—”

    শিখা বললে—”কিন্তু কি হয়েছে আমার? বিশ্রামই বা নেব কেন? আমি কিছু তো বুঝতে পারছি না অমরেশবাবু। আমার বেশ মনে পড়ছে, আমি ওই চেয়ারখানায় বসে ছিলাম। আপনি যে মেয়েটিকে পাঠিয়েছিলেন, সে আমায় বাতাস করছিল; তারপর হঠাৎ ঘুমে আমার চোখ ঢুলে এলো, ঘুমবো না মনে করেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

    ”মেয়ে! কোন মেয়েকে আবার পাঠালাম,” অমরেশ যেন আকাশ হতে পড়েন—”আমি তো কাউকেই পাঠাইনি। এতক্ষণে বুঝেছি—আপনাকে কৌশলে জ্ঞানহারা করে তারা আমার সর্ব্বনাশ করেছে।”

    শিখা জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর পানে তাকায়। তখন খোঁজ করতে ঘটনাটা শোনা যায়।

    অমরেশবাবু মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন শুনে কনষ্টেবলরা তাকে ভিতরে আসতে বাধা দেয়নি। সেই মেয়েটি যে শত্রু—পক্ষের তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যে কোন রকমে শিখাকে ঘুম পাড়ানো বা তাকে অচৈতন্য করাই ছিল তার মতলব। সে মতলব সে সিদ্ধ করে গেছে।

    অমরেশবাবু ফিরবার আগেই সে চলে গেছে। কোথা দিয়ে গেল সে কথাও কেউ বলতে পারে না।

    মাথায় হাত দিয়ে বসেন অমরেশবাবু। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরীখানা অপহৃত হয়েছে। টেবিলের ড্রয়ার খুলে আরও অনেক দরকারী কাগজপত্র নিয়ে গেছে সে। শিখার স্যুটকেশটাও খোলা অবস্থায় পড়ে আছে দেখা গেল।

    এতক্ষণে কথা বললে শিখা। বললে—”এরা দেখছি প্রতি পদে আমাদের অনুসরণ করছে অমরেশবাবু। স্যুটকেশের মধ্যে কয়েকখানা জরুরী চিঠিপত্র ছিল, সেগুলিও নিয়ে গেছে। আর ছিল একখানা ম্যাপ—আমার চাকর রতন কোন সময়ে কুড়িয়ে পেয়েছিল সেদিন ট্রেনের কামরায়।”

    ”ম্যাপ—কিসের ম্যাপ?”—জিজ্ঞাসা করলেন অমরেশবাবু।

    শিখা বললে—”ম্যাপখানাতে কতকগুলো জায়গার নাম চিহ্নিত করা ছিল। সবগুলো মনে নেই, তবে একটা জায়গার নাম মনে আছে ‘লখিমপুর’। কাটোয়ার পর ভাগলপুর লাইনে একটা ছোট রেলষ্টেশনের নাম আছে, তারই কাছাকাছি ঐ জায়গাটা—জায়গাটাতে একটা ক্রশ চিহ্ন ছিল। আমার মনে হয় ওটা ঐ দলের একটা সেণ্টার—”

    ”কি দুর্ভাগ্য, সেইটাই চুরি গেল?” অমরেশবাবু কপালে হাত বুলান।

    আট – রাজাবাহাদুরের খাওয়া

    লখিমপুর!

    অমরেশবাবু নামটাকে ভুলে গেলেও শিখা ভোলেনি।

    যে মেয়েটি তার কাছে সে রাত্রে ছিল, তাকে খুঁজে বের করতে চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু অপরিচিত সহরে তার খোঁজ পাওয়া যায় না।

    শিখার পরামর্শে রাজাবাহাদুরের কেবিনে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা হয়েছে।

    দু’একদিনের মধ্যেই একজন ভদ্রলোক শিখার সঙ্গে দেখা করতে এলেন। অমরেশবাবু তাঁর পরিচয় দিলেন, তিনি রাজাবাহাদুরের শ্বশুর মিঃ মনোহর মিশ্র। কুমারী অগ্নিশিখা রায়ের সঙ্গে তাঁর নাকি কিছু গোপনীয় কথা আছে। তাই দেখা করতে এসেছেন।

    অমরেশবাবু শিখাকে তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি বললেন—”আপনার নাম আমি শুনেছি। কয়েকটি কাজে আপনি যথেষ্ট সুখ্যাতিও অর্জন করেছেন বলে খবর পেয়েছি কিন্তু এখানে আপনি মস্ত একটা ভুল করেছেন—আপনি সোজা পথ ধরতে পারেননি।”

    উত্তেজিত ভাবে অমরেশবাবু কি বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু শিখা তাঁকে বাধা দিল—”আপনি থামুন অমরেশবাবু, আমাকেই কথা বলতে দিন।”

    মিঃ মনোহর মিশ্রের দিকে ফিরে সে বললো—”কোন পথই এখনও ধরতে পারিনি—সোজা পথটা দয়া করে বলবেন কি? তা হলে না হয় সেই পথ ধরেই আমরা চলতে পারি।”

    মিঃ মিশ্র বললেন—”আপনি আমার কাছে বালিকা মাত্র, আমার মেয়ের মতই, সেই জন্যেই আমি কথাটা বলতে পারছি। উপরন্তু ডি, আই, জি, সাহেব উপযুক্ত না বুঝে কি আপনার উপর এ কাজের ভার দিয়েছেন?”

    শিখা শান্তকণ্ঠে বললে—”আমাকে আপনার মেয়ের মতই মনে করবেন, আর সেই রকম কথা বললে আমি ভারী খুশী হব মিঃ মিশ্র।”

    মিঃ মিশ্র প্রসন্নমুখে বললেন, ”আমি এই মাত্র হসপিটাল হতে ফিরছি। আমার জামাইকে, ‘আই মিন’ রাজাবাহাদুরকে আমি মোটেই সুস্থ দেখলাম না মিস্ রায়। আমার সামনেই তাকে যে ইনজেকশনটা দেওয়া হল, সেটার ওপরেও আমার সন্দেহ হয়। পুলিশ পাহারা অবশ্য আছে কিন্তু ডাক্তার বা নার্সের দিক হতেও তো তার জীবন বিপন্ন হতে পারে?”

    শিখা একটু হাসল। বলল—”ওসব দিকের খোঁজ নেওয়া হয়ে গেছে। আপনার অনুমান সত্য। এই দেখুন কলকাতা থেকে রিপোর্ট আনিয়েছি। রোগীর ইনজেকশনের শিশি চুরি করে আমি পরীক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলাম। পরীক্ষার ফলে জানতে পারা গেছে যে, রাজাবাহাদুরকে শ্লো—পয়জন করা হচ্ছে। ওঁকে তাই মেডিকেল কলেজে স্থানান্তরিত করবার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”

    মিঃ মিশ্র অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন। বললেন—”বলেন কি! এত কাজ করেছেন এর মধ্যে?”

    শিখা বললে—”আমি যতটুকু জেনেছি তাতে বুঝেছি রাজাবাহাদুরের বিষয় সম্পত্তিই তাঁর এই বিপদের হেতু।”

    মিঃ মিশ্র বললেন—”সত্যিই তাই। আমি সমস্ত কথাই বলছি।”

    অমরেশবাবু তাঁকে চা দেওয়ার ব্যবস্থা করে এসে বসলেন।

    ”রাজাবাহাদুরের সম্পত্তি নিয়ে বিবাদ চলছে তাঁর কাকার সঙ্গে। রাজাবাহাদুরের পিতামহ বেঁচে থাকতেই তার কাকা রামেশ্বর পাণ্ডে ইউরোপে চলে যান। বহুকাল বাদে তিনি ফিরেছেন এবং সম্পত্তির অর্দ্ধাংশ দাবী করছেন। আমার জামাই, আই মিন রাজাবাহাদুর পিতামহের উইল অনুসারে তাঁর সম্পত্তির মালিক। সুতরাং সে রামেশ্বর পাণ্ডেকে স্বীকার করতে চায়নি, প্রজারাও তাকে স্বীকার করতে চায় না। বলে, ‘কাকা—বাহাদুর’।

    ”খান কতক গহনা চুরি গেছে বলে আমরা মোটেই ভাবছি না। ভয় হচ্ছে যে, ওরা হয়তো রুমাকে জোর করে কারুর সঙ্গে বিয়ে দেবে আর আমার জামাইকে মেরে ফেলে সব সম্পত্তিটাই লোপাট করে দেবে।”

    শিখার চোখের সামনে থেকে যেন একটা কালো পর্দ্দা সরে যায়।

    মিঃ মিশ্র একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—”রামেশ্বরকে যে আপনারা সহজে জব্দ করতে পারবেন তা মনে হয় না অমরেশবাবু। লোকটা অত্যন্ত শিক্ষিত আর বুদ্ধিমান, ধরাছোঁওয়ার মধ্যে তাকে পাবেন না।”

    শিখা জিজ্ঞাসা করলো—”রাজাবাহাদুরের সেই কাকা এখন কোথায় আছেন বলতে পারেন?”

    ”পারি বৈ কি!” মিঃ মিশ্র বললেন—”সে এখন পাটনায় আছে। ওখানে স্বর্গধাম বলে এষ্টেটের যে বাড়ীখানা আছে, সেখানেই সে আছে এখন।”

    শান্ত কণ্ঠে শিখা বললে—”তাহলে পাটনায় গেলে নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে দেখা হতে পারবে? রাজাবাহাদুরকে এখনই আপনি কলকাতায় নিয়ে যান। আমরা কালই পাটনা যাত্রা করব। ওঁকে আর এখানে রাখা উচিত নয়।” অমরেশবাবুর দিকে তাকিয়ে শিখা বললে—”আপনার মত আছে তো?”

    অমরেশবাবু বললেন—”অমত কিসের? আপনি তো জানেন—আপনাকে সাহায্য করবার জন্যে আমায় নির্দ্দেশ দেওয়া হয়েছে,—আপনি আমায় যেখানে যেতে বলবেন, যা করতে বলবেন—আমাকে তাই করতে হবে।”

    শিখা মিঃ মিশ্রের পানে চেয়ে বলল—”আপনিও যদি আমাদের সঙ্গে যান তাহলে—”

    বাধা দিয়ে মিঃ মিশ্র বলেন—”তাতে বরং আপনার কাজ ব্যর্থ হয়ে যাবে মিস্ রায়। রামেশ্বর আমাকে মোটেই পছন্দ করে না, আমার ওপর, আমার মেয়ের উপর তার বিজাতীয় ঘৃণা আছে।”

    শিখা তাঁকে আর অনুরোধ করে না।

    নয় – স্বর্গধাম

    পাটনা শহর থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে রামেশ্বর পাণ্ডের বিরাট সৌধ ‘স্বর্গধাম’।

    বাড়ীখানা দেখে শিখার মুখে হাসি ফুটে ওঠে—স্বর্গধামই বটে; এখন এই স্বর্গাধিপতির সঙ্গে দেখা করতে পারলে এখানে আসা সার্থক হয়।

    কাটোয়ায় আসার দু’দিন পরেই রতন এসে উপস্থিত হয়েছিল। গোকর্ণে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছিল বেচারা। একে পল্লীগ্রাম, তার উপর সবাই তার অপরিচিত, একটা কথা বলবার লোক নেই। শিখার কাছে ফিরে সে যেন বেঁচে গেছে। পাটনায় এসে অমরেশবাবু একটা হোটেলে উঠেছেন। শিখার জন্য একটা আলাদা বাড়ী ঠিক করে দিয়েছেন পুলিশের বড় কর্ত্তা। শিখা আর রতন সেই বাড়ীতে উঠেছে।

    স্বর্গধামের গেটে দরোয়ান মোতায়েন আছে।

    শিখার নাম লেখা কার্ডখানা নিয়ে সে তাদের অপেক্ষা করতে বলে ভিতরে চলে গেল।

    অমরেশবাবু বিকৃত মুখে বললেন—”কায়দাখানা দেখেছেন মিস্ রায়, যেন কোন রুলিং চীফ!”

    দরোয়ান ফিরে আসে, সসম্ভ্রমে সেলাম দিয়ে বলে—”আসুন—”

    ছোট ফুল—বাগানের ভিতর দিয়ে লাল সুরকি ঢালা চমৎকার পথ বেয়ে তাঁরা গোলাকার বারান্দাতে পৌঁছালেন। সামনের বড় ঘরখানা দেখিয়ে দরোয়ান সবিনয়ে অনুরোধ করলে—”বসুন, রাজাবাহাদুর এখনই আসছেন।”

    অমরেশবাবু ও শিখা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

    অমরেশবাবু সামনের টেবিল থেকে সেদিনকার একখানা খবরের কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন। শিখা অনুসন্ধিৎসু চোখে দেয়ালের একখানা ছবির দিকে লক্ষ্য করছিল।

    প্রকাণ্ড সেই অয়েলপেণ্টিংখানা তার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সামরিক পোষাকে সজ্জিত দীর্ঘাকার একটি পুরুষ; মুখ চোখে ফুটে উঠেছে উদ্ধত গর্ব্বের ভাব। শিখার মনে হয় এই মুখ সে কোথায় যেন দেখেছে। মনে করবার চেষ্টা করে সে, কিন্তু অনেক চেষ্টাতেও মনে পড়ে না।

    এইসময় ভিতরের দিককার দরজার লাল ভেলভেটের পরদা সরিয়ে প্রৌঢ় বয়স্ক যে লোকটি দাঁড়ালেন, তাঁকে দেখেই শিখা চিনতে পারে যে এঁরই ছবি দেয়ালে টাঙানো রয়েছে।

    নমস্কার বিনিময়ের পর শিখা বলে—”আমার মনে হয়—আমরা মিঃ রামেশ্বর পাণ্ডের সামনেই উপস্থিত হয়েছি—”

    প্রৌঢ়ের সুগৌর মুখখানা মুহূর্ত্তের জন্য বিরক্তিতে বিকৃত হয়ে ওঠে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মুখের সেই বিকৃত ভাবটাকে তিনি সামলে নিয়ে শান্ত হাসি হেসে বললেন—”তাই বটে; কিন্তু ভুল করেছেন মিস্ রায়—মিঃ রামেশ্বর পাণ্ডে নই, আমি রাজাবাহাদুর, আমার ভাইপোকে বরং কুমারবাহাদুর বলতে পারেন।”

    অমরেশবাবু বলেন—”তা হবে, যাই হোক, রাজাবাহাদুর না বলায় আপনি যদি দুঃখিত হয়ে থাকেন তাহলে আমরা ক্ষমা চাচ্ছি।”

    শিখার ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে,—সে মুখ ফিরায়।

    রামেশ্বর পাণ্ডে মুহূর্ত্তের দৃষ্টিপাতে তার মুখখানা দেখে নিলেন, বললেন—”আপনারা যে এখানে আসবেন আমি তা জানতাম। যাই হোক, আমার ভাইপো, এখন কেমন আছে বলুন? নিশ্চয়ই একটু সুস্থ হয়েছে আশা করছি।”

    অমরেশবাবু বললেন—”মোটের ওপর ভালো হলেও মনে হচ্ছে তাঁর মাথাটা একটু খারাপ হয়ে গেছে। কোন কথা তিনি বলেন না, কেবল চেয়ে থাকেন।”

    উৎকণ্ঠিতভাবে রামেশ্বর বললেন—”কেন? মাথায় কি খুব বেশী লেগেছিল—যাতে তার ব্রেন নষ্ট হয়ে গেল?”

    অমরেশবাবু বললেন—”না, মাথায় লাগেনি, তবে মনে হয় তিনি ভীষণ শক পেয়েছেন। ডাক্তারও এইরকম বলেছেন। তবে আমরা তাঁর জন্য পৃথক ব্যবস্থা করেছি, তাঁর শ্বশুর মনোহর মিশ্র তাঁর সব ভার নিয়েছেন।”

    ”হাঁ—তা বেশ হয়েছে।”

    রামেশ্বর খানিকক্ষণ নীরব থাকেন।

    তারপর শিখার দিকে তাকিয়ে বললেন—”এ নিয়ে আপনাদের এত মাথা ঘামানো অন্যায়। আপনারা সব ছেড়ে দিয়ে এখন আমাকেই দোষী ঠিক করেছেন দেখছি। এতে সত্যই আমি আশ্চর্য্য হয়ে গেছি। কোথায় ট্রেনে ডাকাতি হ’ল আপনাদের বাংলা দেশে, তার জন্যে এনকোয়ারী করতে এসেছেন এখানে—অর্থাৎ কুমারবাহাদুরের বাড়ীতে নয়, আমার কাছে এই পাটনায়। আমার অপরাধ আমি তার কাকা—এবং যে সম্পত্তি সে একাই ভোগ করছে, আইনানুসারে আমি তার অর্দ্ধেকের মালিক। আপনারা আমার বিরুদ্ধে হয় তো অনেক কিছুই শুনেছেন মনোহর মিশ্রের কাছ হ’তে, সে আমি আগেই জানি—”

    শিখা শান্ত কণ্ঠে বললে—”তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের কোন সম্পর্কই নেই মিঃ পাণ্ডে।”

    বার বার ”মিঃ পাণ্ডে” শুনে রামেশ্বর বিরক্ত হন, কিন্তু মনের ভাব প্রকাশ করে কাজ পণ্ড করবেন এরকম বোকা তিনি নন। মুহূর্ত্তের জন্য তিনি উত্তেজিত হয়ে উঠলেও সামলে নেন।

    এর পরে চলে বিবিধ কথাবার্ত্তা, আলাপ—আলোচনা। কথাবার্ত্তা বিশেষ করে চলে অমরেশবাবু ও রামেশ্বরের মধ্যে। অমরেশবাবু প্রশ্ন করেন এবং রামেশ্বর তার উত্তর দেন। তিনি বলেন—ছেলেবেলায় তিনি ছিলেন দুর্দ্দান্ত ও একগুঁয়ে। এই জন্য পিতার সঙ্গে তাঁর কোনদিন বনিবনাও হয়নি এবং সেই জন্যই তিনি ইউরোপে চলে যান। ইউরোপে দীর্ঘকাল তাঁর কেটে গেছে এবং সেখানে থাকতেই জেনেছেন তাঁর পিতা রাজা মহাদেব পাণ্ডে অকস্মাৎ মারা গেছেন এবং তাঁর সম্পত্তি তিনি পূর্ণেন্দুনারায়ণকে উইল করে দিয়েছেন। সেই উইলে উল্লেখ করে গেছেন রামেশ্বর পাণ্ডেকে তিনি ত্যাজ্য পুত্র করে গেলেন, পরে রামেশ্বর ফিরে এলেও সম্পত্তি হতে এক পয়সাও পাবে না। এই পর্য্যন্ত বলে তিনি বেশ জোর নিয়ে বলেন—ঐ উইল সম্পূর্ণ মিথ্যা। তাঁকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করবার উদ্দেশ্যে পূর্ণেন্দুনারায়ণই নাকি ঐ জাল উইল তৈরী করেছে।

    দশ – শয়তানের পরিচয়

    শিখার ঘরে বসে কথা হচ্ছিলো শিখা আর অমরেশবাবুর মধ্যে। শিখা বলে—”ভগবানের কৃপায় আমার স্মরণশক্তিটা একটু বেশী। আমি চিনতে পেরেছি রাজাবাহাদুরকে। ওঁর ফটো আমি এর আগে দেখেছি। কিছুদিন আগে অপরাধতত্ত্ব সম্বন্ধে বিলেতে একখানা পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ বের হয়। এই পত্রিকাখানা আমি পেয়েছিলাম। তাতেই আমি রামেশ্বর পাণ্ডের ফটো দেখেছি, তবে তখন তাঁর অন্য নাম ছিল।”

    অমরেশবাবু আশ্চর্য্য হয়ে বললেন—”সেখানে উনি কি এমন অপরাধ করেছিলেন যাতে ওঁর ফটো ছাপা হয়েছিল?”

    শিখা মৃদু হেসে বললো—”অপরাধ উনি করেছিলেন একটি নয়—অনেক। রীতিমত একটি দল ছিল ওঁর। লণ্ডনে একটি বিরাট দস্যুদল উনি পরিচালনা করতেন। কিন্তু লণ্ডন পুলিশ অনবরত ফলো করায় শেষ পর্য্যন্ত দলটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং মিঃ পাণ্ডে সোজা চলে যান আয়ার্ল্যাণ্ডে। সেখানেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে, ফলে সে জায়গা ছেড়েও তাঁকে পালাতে হয়। প্রত্যেক জায়গাতেই এঁর নামে ওয়ারেণ্ট ঝুলছে।”

    রুদ্ধ নিঃশ্বাসে অমরেশবাবু জিজ্ঞাসা করেন—”তারপর?”

    শিখা বলে—”তারপর ইউরোপ থেকে উনি ফিরে আসেন বোম্বেতে,—ওখানেও কয়েকটা মোটা রকমের দাঁও মারেন উনি, কিন্তু তারপরই হঠাৎ কোথায় উধাও হন। আজ ওঁকে দেখেই আমি চিনেছি—উনি সেই লোক ছাড়া আর কেউ নন। বিলাতের সেই ম্যাগাজিনখানা আমি যতীনবাবুর কাছ থেকে নিয়েছিলাম।

    যতীনবাবু এখন সি, আই, ডি—তে আছেন, তাই আমি তাঁকে এখানে চলে আসবার জন্য টেলিগ্রাম করে দিয়েছি। তাছাড়া ঐ ম্যাগাজিনখানাও সঙ্গে নিয়ে আসতে বলেছি আমি। আমার মনে হয় এখানকার কর্ত্তৃপক্ষকে বললে তারা নিশ্চয়ই যতীনবাবুকে আমাদের সঙ্গে কাজ করতে দেবেন।”

    যতীন্দ্রনাথ আসছেন শুনে অমরেশবাবু ভারি খুশী হয়ে উঠলেন; যতীন্দ্রনাথকে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। তিনি বিশ্বাস করেন যতীন্দ্রনাথ এখানে এসে পড়বার সঙ্গে সঙ্গে সহজ হয়ে আসবে।

    রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল বলে অমরেশবাবুকে ওখানেই থেকে যেতে অনুরোধ করলো শিখা। সে আরও বললো যে হোটেলে না থেকে তিনি যেন কাল থেকে এই বাড়ীতেই থাকেন।

    অমরেশবাবু নীচের ঘরে শুয়েছিলেন। রতন শিখার ঘরের সামনের বারান্দায় নিজের শয়নের স্থান নির্দ্দিষ্ট করে নিয়েছে। রাত্রে উপরের ঘরে পৌঁছে শিখা সতর্কভাবে চারিদিকে দেখে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল।

    তিনদিকে তিনটি বড় বড় জানালা। খোলা জানালা—পথে ফুর ফুর করে বাতাস আসছে ঘরে। আকাশে চাঁদ উঠেছে; তার আলো জানালা দিয়ে ঘরের মেঝেয় ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া ঘরের আলোও জ্বালা রইলো। শিখা পালঙ্কে গা এলিয়ে শুয়ে পড়লো।

    সারাদিনের পরিশ্রমের পর শোওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লো সে।

    অকস্মাৎ একটা ঝাঁকুনি খেয়ে শিখার ঘুম ভেঙ্গে যায়—

    একি! তার পালঙ্ক এত দুলছে কেন, এ শব্দটাই বা আসছে কোথা হতে?

    ধড়মড়িয়ে উঠে বসতে যায় শিখা—

    উঠতে পারে না সে; এতক্ষণে অনুভব করে যে তার হাত দু’খানা বাঁধা। শুধু হাতই নয়, পা দু’খানাও বাঁধা। বেশ বুঝতে পারে সে—তাকে একটা মোটরে তোলা হয়েছে এবং মোটরখানা তীরবেগে ছুটছে। কোথায় ছুটছে কে জানে?

    চীৎকার করতে যায় সে কিন্তু একটি শব্দও তার মুখ থেকে বের হয় না। বদ্ধ হাত দু’খানা সে কোন রকমে মুখের উপর তোলে। কিন্তু মুখের বাঁধন সে খুলতে পারে না। মনে করতে চেষ্টা করে শিখা—সে কোথায় ছিল, কোথায় এসেছে, কোথায় যাচ্ছে। চোখ মেলে দেখে—চাঁদ কখন ডুবে গেছে, আকাশময় নক্ষত্র ছড়ানো—রাত কত হবে কে জানে?

    শিখার মুখ বাঁধা থাকায় যন্ত্রণা হচ্ছে ঠোঁট দুটোতে।

    আশ্চর্য্য! থানার কাছেই দ্বিতলের ঘরে সে শুয়ে ছিল, সেখান থেকে তাকে অপহরণ করলো কে? কি ভাবে তাকে এরা নামিয়ে এনে মোটরে তুললে?

    এ কাজ কার—? ছদ্মবেশী রামেশ্বর পাণ্ডের? শিখা মনে করতে চেষ্টা করে—ম্যাগাজিনে তার নাম দেখেছিল ধরমচাঁদ। ইউরোপে ঐ নামেই সে খ্যাত ছিল। এই লোকটির সম্বন্ধে সে যে সব কথা পড়েছিল, তাতে ভয় পাওয়ারই কথা।

    শিখা দেখতে পায় মোটরখানি বেশ বড়, সীটের এক কোণে তাকে রাখা হয়েছে। আর এক কোণে একজন লোক বসে আছে—মাঝে মাঝে ফিস ফিস করে ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলছিল সে।

    এক সময় হয়তো সিগারেট ধরানোর জন্যই লোকটি দিয়াশালাই জ্বালে।

    সেইটুকু আলোয় শিখা দেখতে পায় লোকটি আর কেউ নয় অসীম বোস।

    মুখ খোলা থাকলে সে হয়তো কিছু বলতো, কিন্তু মুখ বাঁধা থাকায় একটি শব্দও তার মুখ থেকে বের হ’ল না।

    শিখা কি ঘুমিয়ে আছে—স্বপ্ন দেখছে? তার জীবনে সত্যই এমন ক্ষণ এলো—মরার মত পড়ে রইলো সে—জড় শিশুর মতই—অথচ তার বেশ জ্ঞান আছে।

    চক্ষু মুদলো শিখা, মনে হ’ল সে আবার তার চৈতন্য হারিয়ে ফেলবে।

    এগার – বন্দী

    জ্ঞান ফিরে এলো শিখার—।

    আস্তে আস্তে চোখ মেলে সে—।

    হাত—পা সহজেই সে নাড়তে পারছে। দুর্ব্বল হাতখানা মুখের উপর তুলে দেয়, মুখের বাঁধন কখন খুলে দিয়েছে এরা।

    মাথার ভিতরটা ঘুরছে—শরীরটা বড় দুর্ব্বল মনে হচ্ছে। ওঠবার চেষ্টা করে শিখা, কয়েকবার চেষ্টার পরে সে কোনক্রমে উঠে বসলো।

    সে কোথায় এসেছে?

    ছোট একটি ঘর,—একদিকে ছোট একটি দরজা, সম্ভব ওপাশে অন্য ঘর আছে—হয়তো বাথরুম হবে। এদিকেও একটা দরজা দেখা যাচ্ছে—তেমনই ছোট আর অপরিসর। হয়তো এই দরজা দিয়েই এরা তাকে বয়ে এনে ঘরের মেঝেয় একখানা মাদুরের উপর শুইয়ে দিয়েছে।

    পিপাসায় বুক পর্য্যন্ত শুকিয়ে উঠেছে। এদিক—ওদিক তাকাতে ঘরের এক—কোণে একটা কলসী ও গ্লাস দেখতে পায় সে; টিফিন ক্যারিয়ারও একটা দেখা যাচ্ছে। দেয়াল ধরে ধরে দাঁড়ায় শিখা, পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে জলের কলসীর দিকে।

    এক গ্লাস জল ঢেলে একনিঃশ্বাসে পান করে ফেলে। জল খেয়ে যেন অনেকখানি শক্তি পেলো সে। এতক্ষণে প্রাণ ভরে একটা নিঃশ্বাস নিলে।

    টিফিন ক্যারিয়ার খুলতেই দেখা গেল তাতে আহার্য্য হিসাবে নানা রকম ফল, সন্দেশ প্রভৃতি রাখা হয়েছে।

    এবার শিখা সহজ ভাবে হাঁটতে পারে, ফিরে এসে সে মাদুরে বসে।

    ঘরের উপর দিকে লম্বাভাবে খানিকটা জাল দিয়ে ঘেরা, এইখান দিয়ে বাতাস আসা—যাওয়া করছে। আর কোন দিকে একটা জানালা পর্য্যন্ত নাই।

    কিছু খাওয়ার ইচ্ছা শিখার ছিল না, জল খেয়ে সে বেঁচে গেছে আর কিছু তার দরকার নেই। এতক্ষণে ভাববার অবকাশ পায় সে।

    শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং পুলিশ পাহারা দ্বারা সুরক্ষিত বাড়ীর দোতলা থেকে তাকে সরিয়ে আনা হ’ল, অথচ কেউ কিছুই জানতে পারলে না—এ কি আশ্চর্য্যজনক কথা? যে থানায় পুলিশ প্রহরী অসংখ্য তারই প্রায় সংলগ্ন বাড়ী থেকে তাদের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে কে বা কারা কোন কৌশলে তার ঘরে প্রবেশ করলো?

    রামেশ্বর পাণ্ডের কথা তার মনে পড়ে।

    তাকে সরিয়ে আনার মূলে যে, সেই লোকটাই শিখা তা বুঝেছে। রামেশ্বর যে মুহূর্ত্তে বুঝতে পেরেছে তীক্ষ্ন বুদ্ধিশালিনী এই মেয়েটি তাকে সন্দেহ করেছে, সেই মুহূর্ত্তে তার মুখে প্রতিহিংসার চিহ্ন ফুটে উঠেছিল।

    নিঃশব্দে সময় কেটে যায়।

    খুট করে একটা শব্দ হয়। উৎকর্ণ হয়ে উঠে শিখা। আস্তে আস্তে দরজা খুলে যায়। অপরিসর দরজা দিয়ে যে লোকটি ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলে, তার দিকে তাকিয়ে শিখা বিস্ময়ে অবাক হয়ে যায়,—

    অসীম বোস—।

    হ্যাঁ, অসীম বোসই বটে! মুখে তার মৃদু হাসির রেখা। ডান চোখটা কুঞ্চিত করে বাঁ চোখে ভালো করে সে শিখার দিকে তাকালো।

    ”এই যে, জেগেছেন অগ্নিশিখা দেবী? আমি দু’তিনবার লোক পাঠিয়ে জেনেছি আপনি ঘুমোচ্ছেন। যাক, জেগেছেন দেখে আনন্দ হ’ল। অত ঘুম দেখে সত্যি একটু ভয় হয়েছিল আমার।”

    বাঁকা হাসিটা স্পষ্ট হয়েই তার মুখে ফোটে।

    শিখা শান্তকণ্ঠে বললে—”যে আপনাকে আমার খবর দিয়েছে সে ঠিক খবর দেয়নি। আমি অনেক আগেই জেগেছি, তার মধ্যে কাউকে এ ঘরে আসতে দেখিনি তো।”

    অসীম বোস স্মিতমুখে বলল—”সে ঘরে না এলেও এদিককার দেয়ালের ফাঁক অর্থাৎ ওই গর্ত্তটা দিয়ে আপনাকে দেখে গেছে শিখাদেবী। যাক, এখন নিশ্চয়ই একটু ভালো আছেন মনে হচ্ছে। খেয়েছেন কিছু—?”

    চুপ করে থাকে শিখা।

    অসীম বলল—”এখানে খাবার রেখে গেছে জগন্নাথ। বললে যে, আপনি খাননি। যাই হোক, চা খেয়ে নিন,—তারপর আর কিছু খেয়ে নেবেন।”

    দৃঢ়কণ্ঠে শিখা বললে—”না, আমি কিছু খাব না।”

    অসীম হেসে বলল—”না খেয়ে থাকলেই যে আপনি মুক্তি পাবেন তা মনে করবেন না শিখাদেবী। আজ দু’দিন আপনাকে এমনই ভাবে রাখা হয়েছে, কাল সারা দিনরাত আপনার মূর্চ্ছিত অবস্থায় কেটেছে, সেই অবস্থায় আপনাকে কাল রাত্রে আবার মোটরে তুলে এখানে আনা হয়েছে। আপনি মূর্চ্ছিত থাকায় কিছু জানতেও পারেননি। না খেয়ে থাকলে আপনি নিজেই দুর্ব্বল হয়ে পড়বেন। আমার মনে হয়—এ রকম ভাবে বুদ্ধিহীনতার পরিচয় দেবেন না।”

    দরজা—পথে প্রবেশ করে একটি প্রৌঢ়া, তার হাতে ট্রেতে চা—বিস্কুট—শিখার সামনে সে রাখে।

    অসীম বলল—”এই রোমিয়া রইলো, আপনার যা যখন দরকার হবে একে বুঝিয়ে দিলে চলবে। একটা কথা আপনাকে বলে রাখছি, রোমিয়া আপনার ভাষা বুঝবে না। ও ভারতের মেয়ে নয়, অসভ্য জংলী দেশের মেয়ে। আমাদের কর্ত্তা এ রকম অনেক স্ত্রীলোক নিজের কাজের জন্যে এনে রেখেছেন। ইসারায় বুঝিয়ে বললে রোমিয়া সব বুঝতে পারবে।”

    শিখা কথাটা বোঝে,—না খেয়ে শরীর দুর্ব্বল করলে সত্যই কোনদিন সে মুক্তিলাভ করতে পারবে না। বিনা প্রতিবাদে সে চায়ের কাপ তুলে নেয়—

    খুশী মুখে অসীম বলল—”আর একটা কথা আপনাকে বলে যাই,—এখান হতে কোনরকমে পালাবার চেষ্টা করবেন না, জানবেন আপনি রীতিমত সুরক্ষিত অবস্থায় দুর্গের মধ্যে বাস করছেন, এখান হতে এক পা—ও নড়তে পারবেন না। আমাদের কর্ত্তা অত্যন্ত রুক্ষ প্রকৃতির লোক; ক্ষমা, দয়া, মায়া তাঁর নেই, দরকার পড়লে আপনাকেও তিনি কুমারবাহাদুরের মত জড় করে রাখবেন যাতে—”

    শূন্য চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে শিখা জিজ্ঞাসা করলে, ”আপনাদের কর্ত্তা—মানে রামেশ্বর পাণ্ডে তো? যিনি পূর্ণেন্দু পাণ্ডের খুল্লতাত সেজে আছেন—”

    অসীম মৃদু হেসে বলল, ”আপনি তো সবই জানেন শিখাদেবী,—”

    শিখা বললে—”সেই জন্যেই সেই রাত্রে আপনারা আমায় সরিয়ে এনেছেন তা বুঝেছি। কিন্তু আপনি বাঙালী হয়েও, এই দুর্দ্দান্ত রামেশ্বর পাণ্ডের দলভুক্ত কি করে হলেন তা ঠিক বুঝতে পারছি নে।”

    অসীম বোস বলে—”কেবল আমি নই শিখাদেবী, আমাদের কর্ত্তার কাছে এমন বহু দেশের বহু লোক আছে যাদের কথা শুনলে আপনি আশ্চর্য্য হয়ে যাবেন। ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বোম্বাইতে—খুব করিৎকর্ম্মা লোক ইনি। আপনিও যদি এঁর সঙ্গে পরিচিত হন, এত টাকার মালিক হবেন যে জীবনে তা কল্পনাও করতে পারবেন না।—”

    শিখা অধীর হয়ে ওঠে—”আপনি কি ডাকাতের দলে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করতে এসেছেন? আপনাকে বুঝি এই কাজ করবার জন্যে আপনাদের কর্ত্তা পাঠিয়েছেন—”

    অসীমের মুখখানা লাল হয়ে ওঠে। সে বললে—”না, আমি নিজেই এ প্রস্তাব করেছি। হয়তো বাঁচতে পারতেন, কোনদিন মুক্তিলাভ করতে পারতেন, কিন্তু আপনার জেদী স্বভাবের জন্য আপনাকে অনেক কষ্ট পেতে হবে এ কথা বলে রাখছি।”

    ঘৃণায় শিখা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ লোকটার মুখ দেখবার প্রবৃত্তি তার হয় না।

    জংলী মেয়ে রোমিয়াকে ডেকে অসীম দুর্ব্বোধ্য ভাষায় কি উপদেশ দেয়, তারপর বার হয়ে যায়।

    বার – শয়তানের কৃপা

    রোমিয়াকে দেখলে সত্যিই ভয় হয়।

    তামার মত গায়ের রঙ, মাথার চুলগুলি কুঞ্চিত, রুক্ষ—কাঁধ পর্য্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। দীর্ঘাকৃতি শক্তিশালিনী নারী, ছোট ছোট চোখ, চাপা নাক, মোটা উলটানো অধরোষ্ঠ তার দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। দেশে থাকতে হয়তো নিজেদের জাতীয় পোষাকই পরতো, এখানে সে ঘাঘরা আর ওড়না ব্যবহার করেছে।

    শিখার আহার্য্য সে নিয়ে আসে, দু’বেলা চা—বিস্কুট এনে দেয়। হয়তো দরজার বাইরেই সে থাকে, কোন দরকারে দরজায় আঘাত করলে শিখা তার সাড়া পায়—’আউ’—

    হাসিও পায়, কিন্তু শিখা হাসতে পারে না।

    যে ছিদ্রের কথা একদিন অসীম বোস বলেছিল সেই ছিদ্রে চোখ দিয়ে সে ওদিকটা দেখবার চেষ্টা করে। কিছুই দেখা যায় না। মনে হয় সেটা একটা গলি পথ। মাঝে মাঝে লোকের পদশব্দ পাওয়া যায়, হয়তো সে পথ দিয়ে কদাচিৎ লোক যাতায়াত করে।

    দিন যায় রাত আসে, আবার রাত কেটে যায় দিন আসে।

    বন্দিনী শিখার কাছে দিন রাত সমান।

    কথা বলবার দ্বিতীয় লোক নেই। মানুষ হিসাবে একমাত্র আছে রোমিয়া,—শিখা তাকে মানুষ না বলে হিংস্র জাবের পর্যায়ে ফেলেছে। ইঙ্গিতে সে অনেক কিছু বুঝাতে চায়, রোমিয়া কেবল ‘আউ’ উচ্চারণ করে তার ভাব প্রকাশ করে।

    ক্লান্ত হয়ে পড়ে শিখা—

    এ কোথায় সে এসেছে, তাই সে জানতে পারে না। অমরেশবাবু নিশ্চয়ই কোন সন্ধান করতে পারেননি। টেলিগ্রাম পেয়ে যতীন্দ্রনাথও হয়তো এসে পৌঁচেছেন—কি তাঁরা করছেন কে জানে?

    ব্যাকুল হয়ে ওঠে শিখা,—মুক্তির উপায় চিন্তা করে। যে কোনরকমে মুক্তি চাই—আলো চাই, বাতাস চাই, এমন করে এই আলো—বাতাসহীন ক্ষুদ্র ঘরে সে মরতে চায় না।

    মাঝে মাঝে উপরের তারের জাল ভেদ করে মানুষের কণ্ঠস্বর কানে আসে। একদিন রাত্রে বিকট একটা আর্ত্তনাদে ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে সারারাত সে বসে কাটিয়েছে। কোথায় কে এমন ভাবে চীৎকার করলে তা সে ঠিক করতে পারেনি।

    আর একদিন কে যেন করুণ সুরে কাঁদছিল—স্ত্রীলোকের কণ্ঠস্বর—একটি কথাও তার বোঝা যায়নি। শুধু কান্নার শব্দটাই কানে এসেছিল।

    নাঃ—এখানে বেশী দিন এ রকম ভাবে থাকলে শিখা মরে যাবে।

    হয় মুক্তি—নয় মৃত্যু, দুইয়ের মধ্যে একটা তাকে বরণ করতে হবে।

    একদিন সকালে—

    খুট খুট করে দরজাটা খুলে যায়,—উপুড় হয়ে শিখা বিছানায় পড়েছিল, রোমিয়াই এলো—অনুভবে সে বুঝতে পারে। এই বন্য জন্তুর সঙ্গে বাক্যালাপ করার চেষ্টা সে ছেড়ে দিয়েছে, সেই জন্যই সে নড়লো না।

    ”মিস্ রায়—”

    আহ্বানটা কানে আসতে বিস্মিত শিখা ধড়মড় করে উঠে বসলো।

    রামেশ্বর এসেছেন।

    দারুণ বিতৃষ্ণায় শিখা মুখ ফিরায়, লোকটার মুখ দেখবার প্রবৃত্তি তার হয় না।

    কোমলকণ্ঠে রামেশ্বর বললেন—”জানি তুমি আমাকে ঘৃণা করছো মিস্ রায়, কিন্তু আমার পক্ষে তোমাকে না সরানো ছাড়া উপায় ছিল না। আমি অনেক আগে হ’তে তোমার পরিচয় পেয়েছি, জানি তুমি তীক্ষ্ন বুদ্ধিমতী, সেই জন্যেই আমি বিপদ আশঙ্কা করেছি। আমি জানি, কোন দেশের পুলিশ আমায় ধরতে পারবে না, বিশেষ করে এই ভারতীয় পুলিশকে আমি মোটেই ভয় করিনে। তবে তোমাকে আমি একবার দেখেই বুঝেছি যে—”

    একখানা হাত তোলে শিখা, ঘৃণাপূর্ণ কণ্ঠে বললে—”থাক, আপনার বীরত্ব যে কতখানি তা আমি বুঝেছি, মিঃ পাণ্ডে। যাই হোক জিজ্ঞাসা করছি, দিনের পর দিন আমাকে এমনি ভাবে একটা ছোট ঘরে আটক করে রেখে আপনার কি লাভ হবে?”

    ”কি লাভ হবে—?”

    রামেশ্বর হেসে বলেন—”আমার লাভালাভের হিসাব একটি ছোট মেয়ের কাছে দিতে আমার লজ্জা হয় মিস্ রায়। তবে এ কথা তোমায় বলে যাচ্ছি, তোমায় এখানে আর রাখব না, আগামী কাল রাত্রে তোমায় এখান হতে নিয়ে যাব, আমার প্লেন কাল সকালেই এসে পৌঁছাবে। এবার তোমায় স্থানান্তরে নিয়ে যাওয়া হবে, সেখানে এ রকম বন্দিনী হয়ে তোমায় থাকতে হবে না। অনেকটা স্বাধীনতা পাবে। অবশ্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতাও তুমি পেতে পার, যদি তুমি আমার মতে চল।”

    ”আপনার দলভুক্ত হয়ে তো—!”

    শিখার কণ্ঠস্বর তিক্ত।

    রামেশ্বর শান্ত কণ্ঠে বললেন—”সে কথা তুমি অসীম বোসের কাছে শুনেছো। তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীনতা পাবে—প্রচুর ঐশ্বর্য্যশালিনী হবে—রাণী উপাধিটাও তোমার অদৃষ্টে জুটতে পারে—অবশ্য…”

    শিখা চেঁচিয়ে উঠলো—”অর্থাৎ আপনি দয়া করে আমাকে আপনার স্ত্রীর মর্যাদা দিতে চান। মিঃ পাণ্ডে, আপনি যাই হোন, শিক্ষিত লোক, একটি মেয়েকে বন্দিনী করে রেখে আপনি যে এ—রকম বিদ্রূপ করতে পারেন তা আমার কল্পনারও অতীত ছিল।”

    ঘন ঘন হাঁপাতে থাকে শিখা।

    রামেশ্বর বললেন—”বিদ্রূপ নয় মিস্ রায়। এই রকমই একটা আগুনের শিখাকে আমি জীবনসঙ্গিনীরূপে পেতে চাই। যাই হোক, আমি তোমায় পীড়ন করতে চাই নে, ভেবেচিন্তে যা হয় আমায় এর পর জানালেও চলবে। আমি কাল মাদ্রাজে চলে যাচ্ছি, পরশু রাত্রে তুমি, রোমিয়া আরও কয়েকজন সেখানে যাবে—তুমি প্রস্তুত থেকো।”

    বড় দুঃখেও শিখার মুখে হাসি আসে। মনে মনে ভাবে, সুযোগ পেয়ে সবাই একবার করে প্রেম নিবেদন করে নিচ্ছে—আমি কি এতই সস্তা, না মেয়েছেলের দৈহিক পার্থক্যটুকু আমাকে এত সস্তা করে তুলেছে?

    ”আমি এখন কোথায় আছি মিঃ পাণ্ডে, জানতে পারব কি?”

    রামেশ্বর বললেন—”নিশ্চয়! তুমি সাহারাণপুরের এক গ্রামে রয়েছো। এ বাড়ী আমারই দলভুক্ত একজন লোকের—যাকে তুমি অসীম বোসের সঙ্গে ট্রেনে দেখেছিলে মনে করতে পারো—”

    শিখা জিজ্ঞাসা করলে—”অসীম বোস আর আসেনি, সে কি মাদ্রাজে গেছে?”

    রামেশ্বর বললেন—”দুর্ভাগ্যবশতঃ সে আর আমার দলের আরও কয়েকজন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে। তোমাদের বাংলাদেশ হতে যতীন্দ্রনাথ নামে যে পুলিশ অফিসার তোমার টেলিগ্রাম পেয়ে এসেছিলেন, তিনি অসীম বোসকে ধরেছেন। অবশ্য অসীম বোসের বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই। একমাত্র অপরাধ তার সে নিজের পরিচয় গোপন করে নিজেকে কুমার জীবেন্দ্রনারায়ণ বলে পরিচয় দিয়েছিল। এত বড় আহাম্মক, একটুখানির জন্য এমন ভুল করে বসেছে—এদিকে রুমার সঙ্গে তার বিয়ের সব ঠিক—”

    শিখা বললে—”রাজাবাহাদুর এখনও কি হাসপাতালে আছেন?”

    রামেশ্বর হাসেন, বললেন—”না, সে তার শ্বশুরের তত্ত্বাবধানে কলকাতায় মেডিকেল কলেজে গেছে। জ্ঞান ফিরলেও তাকে আর দাঁড়াতে হবে না কোন দিন। পক্ষাঘাতে তার দেহের নিম্নাংশ অচল হয়ে গেছে।”

    উঃ, কি পিশাচ লোক!

    ঘৃণায় শিখার অন্তর পূর্ণ হয়, সে ভাব সে প্রকাশ করে না।

    শিখা বললে—”ওখানকার চিকিৎসায় হয়তো ভালো হতে পারেন।”

    রামেশ্বর কেবল বিকৃত হাসি হাসেন মাত্র। বললেন—”আমি এখন যাচ্ছি, আশা করছি, মাদ্রাজে গিয়ে তোমার সঙ্গে আবার আমার দেখা হবে। আমি জানি ওই জংলী মেয়েটার সাহচর্য্য তোমার অসহ্য হয়ে উঠেছে,—তবু এই দু’দিন তোমার সইতেই হবে। আগেই বলেছি মাদ্রাজে গেলে তোমায় অনেকটা স্বাধীনতা দেব। তোমার দেশের আরও দু’একজন মেয়ে সেখানে আছে, তাদের সঙ্গে কথা বলে তুমি অনেকখানি খুশী হতে পারবে।”

    শিখা নিস্তব্ধ থাকে।

    বিদায় নেন রামেশ্বর। আগামী কাল রাত্রে তাকে যেতে হবে, কথাটা আবার তাকে মনে করিয়ে দিয়ে যান।

    রোমিয়া বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়।

    তের – মুক্তির পথ

    সন্ধ্যার দিকে আহার্য্য নিয়ে আসে আবার রোমিয়া। প্রতিদিনকার মত শিখা আহার করবার জন্য উঠে বসে।

    একটা ল্যাম্প দরজার উপর প্রচুর ধূম উদ্গিরণ করে জ্বলে, ওইটুকু আলোতেই শিখা প্রতিদিনকার আহার্য্য গ্রহণ করে।

    অন্যদিন কলসী হতে সে নিজেই গ্লাসে করে জল নিয়ে আসে, আজ সে জল নেয়নি।

    রাত্রের আহার্য্য রুটি,—সকালের দিকে দেওয়া হয় ভাত। শুধু রুটি নিয়ে কতক্ষণ শিখা নাড়াচাড়া করে, রোমিয়া অদূরে বসে তার খাওয়া লক্ষ্য করে।

    শিখা ইঙ্গিতে জল দেওয়ার কথা জানায়, কলসীটাকে দেখিয়ে দেয় তাকে।

    আগে হতেই মতলব ঠিক করা ছিল, তাই জলের গ্লাস কলসীর কাছে ছিল না, রোমিয়া কলসীর দিকে যায়, জলপাত্রের সন্ধানে এদিক—ওদিক তাকিয়ে দেখতে পায় না।

    যেই মাত্র সে পিছন ফিরেছে শিখা নিজের কাপড়ের আঁচলের দিকটা পিছন দিক দিয়ে তার চোখ—মুখের ওপর ফেলে ত্বরিৎ গতিতে তার মুখ—চোখ বেঁধে ফেলে। কাপড়ের খানিকটা তার মুখের মধ্যে গুঁজে দেয়। তারপর কাপড়ের সবটা খুলে ফেলে খাটের পায়ার সঙ্গে তাকে বেশ শক্ত করে বেঁধে ফেলে। এখন আর লজ্জা করবার সময় নেই।

    রোমিয়ার দেহ—আচ্ছাদন বস্ত্রখানা নিজের গায়ে—মাথায় ভাল করে টেনে দেয়, তারপর এঁটো থালা—বাটি হাতে করে বেরিয়ে পড়ে সে।

    তারপর দরজাটা টেনে শিকল তুলে দিয়ে তালা লাগায়।

    ধীর পদে অগ্রসর হয় শিখা,—দ্রুত চললে প্রহরীদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। খানিকদূর গিয়ে মস্ত বড় দালানটা পার হয়ে সে ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ে।

    উপরে আকাশ দেখা যায়। নক্ষত্রের মৃদু আলোয় সে দেখতে পায় যে, মস্ত একটা বাগানের মধ্যে সে এসে পড়েছে, সু—উচ্চ প্রাচীর দিয়ে এ বাগানটা ঘেরা। প্রাচীরের কাছে এসে সে ভাবতে থাকে কি করে এই প্রাচীর পার হওয়া যায়।

    কুকুরের ডাক শোনা যায়—একটি—আধটি নয়, তিন—চারটি কুকুরের গর্জ্জন,—যেন মেঘ ডাকছে।

    গভীর রাত্রে এই কুকুরগুলিকে বাগানে ছেড়ে দেওয়া হয়, মাঝে মাঝে শিখা তার বন্দী অবস্থায় এই কুকুরের ডাক শুনতে পেত।

    খানিকটা কিংকর্ত্তব্যবিমূঢ় হয়ে শিখা দাঁড়ায়। প্রাচীর পার হবার চিন্তা করে। খাড়া প্রাচীর, দেয়ালে এতটুকু ছিদ্র নেই যার সাহায্যে সে উপরে উঠতে পারে।

    কিন্তু স্বয়ং ভগবান তার সহায়।

    দু’ চার পা এগোতেই সে দেখতে পায় প্রাচীরের এপাশে উঠেছে বিরাটাকার একটি আম গাছ, শাখা—প্রশাখা তার প্রাচীরের এপার হতে ওপারে গিয়ে পড়েছে।

    শিখা আর দেরী করে না,—অভ্যাস অনেকদিন না থাকলেও কোনরকমে সে গাছের উপর উঠে পড়ে।

    অপেক্ষা করা চলে না। রোমিয়া এতক্ষণ হয়তো বাঁধন খুলে ফেলবার চেষ্টা করছে। গায়ে বেশ শক্তি আছে মেয়েটার। প্রহরীরা হয়তো জানতে পেরেছে, এখনই লোক ছুটবে, উজ্জ্বল আলোয় সমস্ত বাগান আলো হয়ে উঠবে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ধরা পড়বে। ধরা পড়লে তার অদৃষ্টে যে শাস্তি জুটবে তা সে জানে।

    প্রাচীরের উপর কাঁচ বসানো, হাত বাড়িয়ে পরীক্ষা করে শিখা।

    না, এর উপর নামা চলবে না। এই ডাল বেয়েই শিখাকে নামতে হবে ওপারে। কতদূর পর্য্যন্ত এ ডাল গেছে তাও শিখা জানে না।

    ডালটা সে দুই হাতে ধরে ঝুলে পড়লো—তারপর একসময় হাত ছেড়ে দিলে।

    অত উঁচু হতে নীচে সে ছিটকে পড়লো।

    পড়লো একটা ঝোপের উপর,—আঘাত বিশেষ লাগলো না। সোজা ভাবে পড়েছে সে। লাগলো কেবল একটা বিরাট ঝাঁকুনি, সামান্য জখম মাত্র হ’ল সে। সঙ্গে সঙ্গে সে সোজা হয়ে দাঁড়ালো; প্রাচীরের দিকে একবার তাকালো। উঃ, কি উঁচু প্রাচীর, ওর ওদিকে কি আছে, কি হচ্ছে—বাইরের লোক তার সম্বন্ধে কিছুই খবর পায় না, নির্ব্বিবাদে এই সব দুর্ব্বৃত্তেরা এখানে নিজেদের গোপনীয় কাজ সম্পন্ন করে যাচ্ছে।

    মুহূর্ত্তক্ষণ দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে একদিক লক্ষ্য করে শিখা ছুটতে আরম্ভ করে।

    চৌদ্দ – ভগবান সহায়

    এতক্ষণ তবুও অন্ধকার ছিল, মধ্যরাত্রের দিকে আকাশের একপাশে ভেসে উঠেছে একফালি বাঁকা চাঁদ। হোক একফালি, তবু তার আলো তো আছে, ম্লান হোক, তবু আবছা সব দেখা যায়।

    শিখা আলোর উদয়ে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে, আবার তাকে অন্ধকারের আশ্রয় খুঁজতে হয়।

    সামনে চক চক করছে রেললাইন, চাঁদের ম্লান আলো পড়েছে তার উপরে।

    হাত দু’খানা কপালে ঠেকায় শিখা—ভগবান পথের সন্ধান দিয়েছেন,—এই রেললাইন ধরে চললে নিশ্চয়ই কোন ষ্টেশনে পৌঁছে যাবে সে।

    অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে পড়েছে শিখা, তবু থামতে পারছে না। কোনরকমে তাকে চলতেই হবে; যেমন করেই হোক নিরাপদ স্থানে পৌঁছতে হবে। ধরমচাঁদকে এখনও ধরা যেতে পারবে, সকালে প্লেন ছাড়বে, তারপর দুর্দ্দান্ত দস্যুসর্দ্দার ধরমচাঁদের সন্ধান আর কেউ পাবে না।

    রোমিয়া হয়তো বিপুল শক্তিতে এতক্ষণ দরজায় ঘা দিচ্ছে, এতক্ষণ হয়তো সবাই জানতে পেরেছে যে শিখা পলায়ন করেছে, তাকে খুঁজতে নিশ্চয়ই দিকে দিকে লোক ছুটছে। এবার তাকে হাতে পেলে রামেশ্বর তার কি শাস্তির ব্যবস্থা করবে মনে করতেও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়।

    অবসাদে ক্ষতবিক্ষত পা দু’খানা ভেঙ্গে পড়ে। রামেশ্বরের কথা মনে করে শিখা আবার দ্রুত চলতে চেষ্টা করে।

    দূরে সিগন্যালের আলো দেখা যাচ্ছে। তাহলে ষ্টেশনের কাছেই এসে পড়েছে সে! এখনই ষ্টেশনে পৌঁছাতে পারবে। কে বলতে পারে পাটনাগামী কোন ট্রেন পাওয়া যাবে কিনা। গেলেও টিকিট কেনবার টাকা সে পাবে কোথায়?

    এখন ওসব ভাবনা থাক—কোনক্রমে যে কোন ট্রেনের কামরায় উঠে পড়তে পারলে হয়—রামেশ্বর পাণ্ডের নাগালের বাইরে যেতে পারলে সে নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচবে।

    পায়ে পায়ে ষ্টেশনে এসে পড়ে সে।

    ছোট ষ্টেশন। নিশীথ রাত্রে দু’ চারজন ছাড়া লোক নেই। কতকটা আশ্বস্ত হয় শিখা। আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে একখানা বেঞ্চের ওপর বসে।

    খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। অনতিদূরে একটি হিন্দুস্থানী পরিবার ট্রেনের অপেক্ষা করছিল। শিখা তাদের কাছে এসে বলল—”একখানা ধুতি বা শাড়ী দিতে পারেন?”

    তাদের সঙ্গে যে পুরুষ লোকটি ছিল সে সচকিত ভাবে তার পানে তাকায়, সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করে—”ক্যা মাংতা মায়ি?”

    শিখা বললে—”একখানা কাপড়। আমার পরণের কাপড়টা অন্ধকারে কাঁটা তারে আটকে একেবারে ছিঁড়ে গেছে।”

    নরম কণ্ঠে সে বললে—”মায়িজী,—থোড়া ঠারো—।”

    নিশ্চিন্ত হয়ে ফিরে এসে বেঞ্চে বসে শিখা। পাতলা অন্ধকারে স্পষ্ট তাকে দেখা যায় না। কেরোসিনের যে দু’একটি আলো ষ্টেশনে জ্বলছে তাতে অন্ধকার দূর হয় না।

    হিন্দুস্থানী ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীর ট্রাঙ্ক খুলে একখানা দামী শাড়ী বের করে এনে দিল। শিখা ধন্যবাদ দেবারও অবসর পায় না। ট্রেন এসে পড়ে প্রায়।

    ট্রেন আসবার পূর্ব্বক্ষণে ষ্টেশন সজীব হয়ে ওঠে,—ষ্টেশন—মাষ্টার গলার বোতাম আঁটতে আঁটতে ছুটাছুটি করেন, যে কয়টা কুলি একটু আগে ঘুমোচ্ছিল তারা উঠে পড়ে। নির্ব্বাপিত আলোগুলোও জ্বলে ওঠে।

    ট্রেন আসছে।

    আস্তে আস্তে প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়ায় শিখা। বিনা টিকিটেই ট্রেনে উঠবে সে, তারপর চেকার এলে তখন যা হয় ব্যবস্থা করা যাবে।

    চারিদিক কাঁপিয়ে বিরাট শব্দে ট্রেন এসে দাঁড়াল।

    দু’ একজন মাত্র যাত্রী নামলো। শিখা তাড়াতাড়ি একখানা ফিমেল কামরায় উঠে পড়লো, কেউ তার পানে দৃকপাতও করলে না।

    মাত্র এক মিনিট—

    ট্রেন হুইসল দিয়ে চলতে সুরু করলে।

    কামরার জানালা হতে শিখা দেখলে—দু’জন লোক প্রাণপণে ছুটে আসছে ষ্টেশনের দিকে। কিন্তু তারা হাল ছেড়ে দিল। তাদের চোখের সামনেই ট্রেনটা হু হু করে বেরিয়ে গেল।

    এতক্ষণ পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে শিখা। কামরায় ঘুমন্ত যাত্রীদের পানে তাকাবার অবকাশ পায়।

    পনের – অভিযান সুরু

    পাটনা ষ্টেশনে যখন ট্রেনখানা থামল তখনও রাতের আঁধার ফিকে হয়নি। শুধু ষ্টেশনের আলোগুলোই সেই নৈশ অন্ধকারের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষীণ চেষ্টা করছে।

    শিখা ষ্টেশনে নেমে পড়ল। সঙ্গে তার কোন মালপত্র নেই, সুতরাং সে নিয়ে দুর্ভাবনাও নেই তার। কিন্তু অনেক বড় একটা দুর্ভাবনা তার সারা দেহ মন জুড়ে জেঁকে বসে রয়েছে, তা থেকে মুক্তিলাভ করবার একটা উপায় তাকে করতেই হবে।

    একটা দুর্দ্ধর্ষ শয়তান দলের অধিনায়ক রামেশ্বর পাণ্ডে। লোকটার প্রকৃত নাম কি সেটাও একটা রহস্য। রামেশ্বর পাণ্ডে তার আসল নাম, না, ধরমচাঁদ তার আসল নাম সে সমস্যার সমাধান এখনও হয়নি। এমনও তো হতে পারে আসল রামেশ্বর পাণ্ডে ইউরোপে গিয়ে দুর্দ্দান্ত কোন দলের সঙ্গে মিশে ধরমচাঁদে পরিণত হয়েছিল। তাহলে এখানকার সম্পত্তির অর্দ্ধেকের মালিক সে একথা স্বীকার করতেই হবে। তবে যদি তার বিরুদ্ধে কোন অপরাধ সপ্রমাণ হয় তাহলে সরকার থেকে তার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করবে।

    আর একটা কথা ভাবছিল শিখা। সে কথাটা একদিন বন্দী অবস্থায় সে অসীম বোসকে বলেছিল। অসীম বোসের কাছ থেকে সে বিষয়ের স্পষ্ট কোন জবাব সে পায়নি। আসল রামেশ্বরকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে তার জায়গায় ধরমচাঁদ নামধারী শয়তানটা রামেশ্বর নাম নিয়ে এসে আবির্ভূত হয়নি তো? এ চালটা ধরমচাঁদের খুব একটা বড় চাল বলতে হবে তাহলে। এক ঢিলে দুটো পাখী মারতে চায়। একদিকে মস্তবড় একটা ষ্টেটের মালিক, অপর দিকে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে সমাজে অবাধে মিশে যাবে সে। এই সকল কথাই সে ট্রেনে বসে এতক্ষণ ভেবেছিল। আর এই সব ভাবনাতেই তার মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে।

    একখানা ট্যাক্সি ডেকে তাতে উঠে বসে সে বললে—পুলিশ ষ্টেশনে চলো। ট্যাক্সির ড্রাইভার ছিল একজন যোয়ান পাঞ্জাবী। তাকে শিখা ভাল করে বুঝিয়ে দিল, যদি সে তাকে নির্ব্বিঘ্নে পুলিশ ষ্টেশনে পৌঁছে দিতে পারে তাহলে মোটা রকম বখশিস তাকে দেওয়া হবে।

    ড্রাইভার শিখার দিকে আশ্চর্য্য হয়ে চেয়ে থাকে। বলে—”কিছু বিপদের ভয় আছে নাকি মায়ি?—তাহলে রাতটা ষ্টেশনেই কাটিয়ে যান না ওয়েটিং রুমে।”

    একা একজন যুবতী মেয়ে, সঙ্গে কোন মালপত্রও নেই, যেতে চাইছে পুলিশ ষ্টেশনে—নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোন রহস্য আছে। ড্রাইভার জিজ্ঞাসু চোখে চেয়ে থাকে শিখার দিকে।

    শিখা ঘাড় নেড়ে বলে যে, সত্যিই একটা বিপদে পড়ে পুলিশে যেতে হচ্ছে তাকে। একদল বদমায়েসের হাতে পড়েছিল সে। তাদের হাত থেকে কোনরকমে পালিয়ে সে পুলিশের সাহায্য নিতে যাচ্ছে—শয়তানেরা হয়তো এখনও তার পিছু ছাড়েনি।

    ড্রাইভার বলল—”কিচ্ছু ভয় নেই মায়ি। আমি একজন লোক সঙ্গে নিচ্ছি, তাছাড়া আমার কাছে কৃপাণ রয়েছে।”

    শিখা উৎসাহিত হয়ে বলল—”তাহলে আর দেরী কোর না, এখনই চল পুলিশের হেড কোয়ার্টারে—”

    ড্রাইভার একজন সঙ্গী ডেকে নিয়ে ট্যাক্সি ছেড়ে দিল।

    হু হু করে ট্যাক্সি এসে দাঁড়াল পুলিশ হেড কোয়ার্টারের সামনে। দরজায় কনষ্টেবল পাহারায় ছিল। তাকে কোন কথা না বলে শিখা একেবারে অফিস ঘরে গিয়ে হাজির হ’ল।

    অফিস ঘরে যে ভদ্রলোক চেয়ারে বসে ওপরের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আকাশ—পাতাল কত কি চিন্তা করছিলেন, তাঁর দিকে দৃষ্টি পড়তেই শিখা হো হো করে হেসে উঠল।

    যতীন্দ্রনাথের চিন্তার স্রোত টুটে গেল। শিখার দিকে চাইতেই লাফিয়ে উঠলেন তিনি।

    ”রাত শেষ হতে চলল—এখনও চেয়ারে বসে কি ভাবছেন?” শিখা হাসতে হাসতে বলল।

    ”তোমার জ্বালায় কি ঘুমুবার জো আছে?—যে রাত্তিরে তুমি নিরুদ্দেশ হয়েছ সেই রাত্তির থেকে কি আমার চোখে ঘুম আছে? এখানকার পুলিশের কোন যোগ্যতা নেই। একটা কথা জিজ্ঞাসা করলে তার তিন রকম জবাব দেয় এরা। শুধু অমরেশবাবুর কথায় বিশ্বাস করে যেটুকু তদন্ত করেছি তার জোরেই দস্যুদের পাঁচ—ছয় জনকে ধরতে পেরেছি। আর এ—সন্ধানও আমি পেয়েছি তুমি নাকি লখিমপুরে বন্দী হয়ে আছো।”

    ”না, না, আমাকে ওরা সাহারাণপুরে একটা গ্রামের মধ্যে রেখেছিল।”

    ”মিথ্যা কথা। তোমার খবর ভুল শিখা—”

    ”আমারও তাই মনে হয়, কেননা সাহারাণপুর থেকে এত তাড়াতাড়ি আমি পাটনা পৌঁছে গেলুম কি করে তা বুঝতে পারছি না।” একটু থেমে শিখা আবার বলল—”যাই হোক, শত্রুদের ঘাঁটি কোথায় সে খবর আমার এখন জানবার দরকার নেই, ধরমচাঁদ সকালেই মাদ্রাজ চলে যাচ্ছে, তাকে তার আগেই অ্যারেষ্ট করতে হবে। তার আগে বাইরে যে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে তার ড্রাইভারকে কিছু বখশিস করতে হবে। ষ্টেশন থেকে এটুকুও যে আমি নির্ব্বিঘ্নে আসতে পারব তা ভাবতে পারিনি।”

    ”তা বটে, পাটনা কেন সারা বিহারে ওদের দলবল ছড়িয়ে আছে। দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবার জন্য ভাল রকম ব্যবস্থাও ওদের আছে। সাহারাণপুরও নয়, লখিমপুরও নয়, কাছাকাছি কোন ঘাঁটিতে ওরা তোমাকে আটকে রেখেছিল। তা তুমি পালিয়ে এলে কি করে?”

    একটু হেসে শিখা বলল—”আমার ঐ এক উপায়, আর ঐ উপায়টাই আমার হাতে খেলে ভাল।”

    ”এবারেও চাকরাণী ঠেঙিয়ে এলে নাকি তাহলে?”

    ”হ্যাঁ—মেয়েমানুষ দেখে বেশী কড়া পাহারার ব্যবস্থা করেনি, তবে যে মেয়েটা খাবার দিত তার গায়ে শক্তি ছিল অনেক পুরুষের চেয়ে বেশী। যাই হোক এখন ওসব কথা বলবার সময় নেই, অমরেশবাবু গেলেন কোথায়? ওঁদের সব ডেকে তুলুন। এখনই বেরুতে হবে। নইলে পাখী উড়ে যাবে একেবারে মাদ্রাজে।”

    হাঁকডাক করে যতীন্দ্রনাথ সকলকে তুললেন। অমরেশবাবু বললেন—”এখনই এরোড্রোমে টেলিফোন করে দেওয়া হোক; যদি ওদের প্লেন যাবার ব্যবস্থা করে তাহলে যে কোন ছুতায় যেন একটু দেরী করা হয়। এর মধ্যেই আমরা সশস্ত্র পুলিশবাহিনী নিয়ে পৌঁছে যাবো—”

    পাটনার পুলিশ সাহেব এ প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেলেন; কেননা প্লেনে যেখানেই যাক এই পাটনা এরোড্রোম থেকেই তাকে যেতে হবে।

    পুলিশ সাহেব এরোড্রোমে ফোন করলেন।

    এরোড্রোম থেকে প্রত্যুত্তর এল। কিন্তু ওদিককার কথা শেষ হবার আগেই পুলিশ সাহেব হতাশ হয়ে ফোন রেখে দিলেন।—”সর্ব্বনাশ হয়েছে; এই মাত্র প্লেন ছেড়ে গেল। হাতে পেয়েও ধরতে পারা গেল না।”

    ”সে কি কথা? সকাল সাতটায় যে যাবার কথা”—শিখা আবার নিজেই ফোন ধরল।

    ”হাঁ—আবার দিন পাটনা এরোড্রোম।” ইংরাজীতে শিখা কনেকসান চাইল।

    কথা শেষ করে শিখা বলল—”তাদের নিজেদের প্লেন, কিন্তু পাইলট গিয়েছে এরোড্রোম থেকে। ওদের নিজেদের পাইলটকে অসময়ে পাওয়া যায়নি, অত্যন্ত জরুরী বলে পাইলট ধার করে প্লেন ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।”

    ”তা হলে এখন উপায়?”—সকলেই জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে থাকে।

    শিখা বলল—”আমাদেরও একটা প্লেন চার্টার করে মাদ্রাজ রওনা হতে হবে। এরোড্রোমের পাইলটকে এখান থেকে ওয়ারলেসে খবর দিতে হবে যে, মাদ্রাজে আমরা না যাওয়া পর্যন্ত সে যেন অপেক্ষা করে।”

    ”আর এক কাজ করলে তো হয়”—পুলিশ সাহেব বুদ্ধি দিলেন। ”একেবারে মাদ্রাজ পুলিশকে টেলিফোন বা ওয়ারলেসে খবর দেওয়া হোক। প্লেন নামলেই সকলকে যেন আটক করে।”

    ”তা হলে তো ভালই হয়। কিন্তু মাদ্রাজে ওদের ঘাঁটি না ধরতে পারলে রুমাকে কোন দিনই উদ্ধার করা সম্ভব হবে না। যে রকম দুর্দ্দান্ত প্রকৃতির লোক ধরমচাঁদ, হয় আমাদের যাবার আগেই সে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালাবে, নয় ওখানেই খণ্ডযুদ্ধ করতে পেছপাও হবে না। লোকটা একজন মিলিটারীম্যান। বিলাতের পুলিশকে বোকা বানিয়ে নির্ব্বিঘ্নে ঘুরে বেড়িয়েছে দিনের পর দিন। ভারতীয় পুলিশকে সে গ্রাহ্যই করে না।”

    ক্রি—রিং—রিং, ক্রি—রিং—রিং—রিং—রিং…….

    হঠাৎ সশব্দে টেলিফোন বেজে উঠল।

    পুলিশ সাহেব টেলিফোন ধরলেন—

    ”হাল্লো,—কি বলছেন, মাদ্রাজ যায়নি—দিল্লী গেছে…….”

    শিখা লাফিয়ে উঠল। পুলিশ সাহেবের হাত থেকে রিসিভারটা ছোঁ মেরে নিয়ে বলল—”হ্যাল্লো, কি বললেন? পাইলট যাবার সময়ে এনট্রি করে গেছে দিল্লী!—আরোহীরা বলছিল মাদ্রাজ! তা পাইলটের লেখার ভুল নয় তো? তা হতে পারে না? দ্যাটস অল রাইট।” শিখা রিসিভার ছেড়ে দিল।

    ”তা হলে আমাদেরও দিল্লী যেতে হয়”….শিখা বলল।

    শিখার মত একটা বালিকার কথায় নেচে দিল্লী লাহোর করবার ইচ্ছা কারো ছিল না। সকলেই গাঁইগুঁই করতে লাগল।

    শিখা বুঝতে পেরে বলল—”চলুন যতীনবাবু, আমরা দু’জনেই যাই—দেরী করলে সব পণ্ড হয়ে যাবে।”

    অমরেশবাবুর চাকরীর ভয় আছে। তিনি বললেন—”আমাকেও যেতে হয় তাহলে—কিন্তু গিয়ে কোন ফল হবে না।”

    ”সে আপনার ইচ্ছা—কিন্তু আমরা যাবোই। দয়া করে আমাদের জন্য একখানা স্পেশাল প্লেন চার্টার করে দিন, আর দিল্লীতে একটা খবর দিয়ে দিন, পাইলট যেন সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে।”

    পাটনার পুলিশ শিখার কথামত সব বন্দোবস্ত ঠিক করে দিল। যতীন্দ্রনাথ, অমরেশবাবু ও শিখা যাবার জন্য তৈরী হ’ল।

    ষোল – দিল্লীর ঘাঁটি

    শিখাদের প্লেনখানা যখন পাটনার এরোড্রোম ছেড়ে গেল তখনও ঠিক ভোর হয়নি। আকাশে আলো—আঁধারের অপূর্ব্ব মিলন সংঘটিত হয়েছে সবে। দু—একটা পাখী ডাকতে সুরু করেছে মাত্র।

    ”আমরা বড্ড দেরী করে ফেললুম, শেষ পর্য্যন্ত বিফল না হতে হয়।”

    শিখার কথায় যতীন্দ্রনাথ শুধু একটু হাসলেন।

    অমরেশবাবু মুখ ভার করে বসে রইলেন। তাঁর মুখের ভাব দেখে মনে হ’ল, তাঁর মত হচ্ছে এই অনিশ্চিতের পিছনে ছোটার কোনই মানে হয় না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে অমরেশবাবু বলে ফেললেন—”তার চেয়ে রামেশ্বর পাণ্ডের বাড়ীটা ঘেরাও রাখলেই হ’ত, একদিন না একদিন ঐখানেই তাকে পাকড়াও করা যেত।”

    শিখা বললে—”অত সহজে যদি ধরমচাঁদকে কায়দা করা যেত তাহলে বিলাতের পুলিশ তার নামে হুলিয়া বের করে হন্যে হয়ে বেড়াতো না। আপনি তাহলে এখনও চেনেননি কার পিছনে আমরা ধাওয়া করছি। হয়তো আমাদের জীবনও বিপন্ন হতে পারে এই সংগ্রামে। তা’ বলে নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকার পক্ষপাতী আমরা নই।”

    যতীন্দ্রনাথ মাথা নেড়ে শিখাকে সমর্থন করলেন। অমরেশবাবু চোখ বড় বড় করে চেয়ে রইলেন ওদের মুখের পানে।

    * * * *

    যথাসময়ে দিল্লীর এরোড্রোমে শিখাদের প্লেন ভূমি স্পর্শ করল। এরোড্রোমের ওয়েটিং রুমে শিখা সকলের আগে খোঁজ করতে গেল কোন পাইলট তাদের জন্যে অপেক্ষা করছে কিনা। যতীন্দ্রনাথ পুলিশের পোষাকে শিখাকে অনুসরণ করলেন। অমরেশবাবু রইলেন ওদের অনেকখানি পিছনে।

    পাইলটের পোষাক পরা একজন তরুণ সুন্দর যুবক সহাস্যে যতীন্দ্রনাথকে অভিবাদন করল। যতীন্দ্রনাথ ইংরাজীতে প্রশ্ন করলেন—”আপনি কি পাটনা থেকে…”

    ”আমি বাঙালী, আমার সঙ্গে বাঙলা কথা বললে আমি আরো সুখী হতুম”—পাইলট জবাব দিল।

    ক্ষমা প্রার্থনা করে শিখা বলল—”রামেশ্বর পাণ্ডের সঙ্গে কে কে ছিল?”

    ”তাঁর মেয়ে। প্রথমে মাদ্রাজে যাবার কথা উনি বলেছিলেন, পরে মেয়েটি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তিনি আগে দিল্লী আসাই ঠিক করলেন, এখানে মেয়েকে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ করে পরে মাদ্রাজে যাবেন।”

    ”মেয়েটির কি অসুখ বুঝলেন কিছু?”

    ”বোধ হয় ফিটের অসুখ আছে। মাঝে মাঝে গোঁ গোঁ শব্দ করে আর অজ্ঞান হয়ে যায়।”

    ”হুঁ—এরকম কতবার ফিট হয়েছিল বলতে পারেন?”

    ”কিছু মনে করবেন না, আপনারা এ রকম প্রশ্ন কেন করছেন বা আমাকেও ডিটেনড করিয়ে রেখেছেন কেন, সে কথাটা এখনও বললেন না। ও—কথাটা যদি আমি জানতে পারতুম তা হলে আপনাদের কিছু উপকারে হয়তো আমিও লাগতে পারতুম। আপনারা কি রাজাবাহাদুর রামেশ্বর পাণ্ডেকে কোন কারণে ফলো করছেন?”

    শিখা একটু ভেবে বলল—”হাঁ, তাঁর নামে ওয়ারেণ্টও আছে।”

    ”রাজাবাহাদুরের নামে ওয়ারেণ্ট!—অবাক হবার কথা বলছেন আপনারা। পাটনায় রাজাবাহাদুরকে কে না চেনে? তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাইপোর মোকদ্দমা চলবে বা চলছে—ন্যায়তঃ অর্দ্ধেক সম্পত্তির মালিক উনিই। তাঁর ভাইপোর চক্রান্তে আপনারা ভুল করছেন না তো?”

    ”ঐ জন্যেই তো কোন কথা বলতে নেই আপনাদের। আপনারা সকলেই যদি একটা একটা মন্তব্য প্রকাশ করে মিছে আমাদের দেরী করিয়ে দেন—”

    ”কিছু মনে করবেন না, আমিই তাঁর মেয়েকে ট্যাক্সিতে তুলে দিতে সাহায্য করেছিলুম। খুব সদালাপী ভদ্রলোক, মেয়েটিও পরমা সুন্দরী। তবে অসুস্থ,—একেবারে অজ্ঞান।”

    ”ট্যাক্সির নম্বরটা মনে আছে কি?”

    অমরেশবাবু প্রশ্ন করলেন।

    ”না, তবে এরোড্রোম থেকে যে সব ট্যাক্সি যাত্রী বহন করে, সেগুলো প্রায়ই আবার ফিরে আসে এখানে।” পাইলট জবাব দিল।

    ”চলুন দেখি সে ট্যাক্সিখানা ফিরে এসেছে কিনা”—

    বাইরের ট্যাক্সি ষ্ট্যাণ্ডে চার—পাঁচখানা ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল কিন্তু সেগুলোকে দেখে পাইলট বলতে পারল না সেই ট্যাক্সিখানা এদের মধ্যে আছে কিনা।

    শিখা বলল—”বুঝেছি, আপনি ঠিক সনাক্ত করতে পারছেন না। তাতে কোন ক্ষতি নেই, কোনখান থেকে তাঁরা ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন সেই জায়গাটা তো মনে আছে আপনার?”

    পাইলটের একটু লজ্জা হ’ল বোধ হয়। নিজের হাতে আরোহীদের ট্যাক্সিতে তুলে দিয়েছে, অথচ এখন তার সব ট্যাক্সিগুলোই একরকমের বলে মনে হচ্ছে। মুখ নীচু করে পাইলট বলল—”এই জায়গাটা থেকে তাঁরা ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন আমার বেশ মনে আছে।”

    খরিদ্দারের আশার দু’ একজন ট্যাক্সিওয়ালা ইতিমধ্যেই সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। একজনকে ডেকে শিখা বলল—”ঘণ্টা দুই আগে এখান থেকে একজন বিহারী ভদ্রলোক আর একটি মেয়ে কোন ট্যাক্সিতে উঠেছিল?”

    অমরেশবাবু ও যতীন্দ্রনাথের পুলিশের পোষাক দেখে তারা হয়তো ঘাবড়ে গেল। মুখ চাওয়া—চায়ি করে সকলেই বলল—তারা জানে না।

    শিখা বলল—”বেশ করে ভেবে দেখ, মিথ্যা কথা বললে কারুরই ভাল হবে না।”

    কিন্তু কেউই স্পষ্ট করে কোন কথা বলতে চায় না।

    এমন সময়ে একখানা বড় ট্যাক্সি হর্ন বাজিয়ে ষ্ট্যাণ্ডে এসে ঢুকে পড়ল।

    পাইলট চুপি চুপি শিখাকে বলল—”চিনতে পেরেছি—ঐ গাড়ীখানাই—”

    সেই ট্যাক্সিখানা ষ্ট্যাণ্ডে লাগতেই একজন ড্রাইভার পাশ কাটিয়ে সেই ড্রাইভারের দিকেই যাচ্ছিল। যতীন্দ্রনাথ এক হুঙ্কার ছাড়লেন—”এই তুম হিঁহা খাড়া রহো।”

    ট্যাক্সিখানা ততক্ষণে সবচেয়ে পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। শিখা তাড়াতাড়ি সেই ট্যাক্সির ড্রাইভারের কাছে গিয়ে বলল—”আর একবার যেতে হবে আমাদের নিয়ে—”

    ”সেই রাজেন্দ্র পট্টি?”

    —”হাঁ হাঁ, যেখানে রাজাবাহাদুরকে আর তাঁর অসুস্থ মেয়েকে রেখে এলে। আমাদের একই প্লেনে আসবার কথা ছিল, মুস্কিল হচ্ছে আমরা কেউই বাড়ী চিনি না। এখান থেকে কত দূর হবে রাজাবাহাদুরের বাড়ী?”

    ”আরে বাব্বা—সেই যমুনার ধার পর্য্যন্ত ছুটতে হবে এখন—কিছু বখশিস দিয়ে দেবেন মায়ি—”

    গাড়ীতে উঠেই অমরেশবাবু বললেন—”একবার পুলিশ হেড কোয়ার্টার হ’য়ে যেতে হবে, সেখানে আমি নেমে যাবো। তুমি গাড়ীটা একটু ঘুরিয়ে হেড কোয়ার্টার হয়েই যেও, তোমাকে মোটা বখশিস দেওয়া হবে।”

    যতীন্দ্রনাথ বললেন—”আমিও তাই ভাবছিলাম। আপনাকে নামিয়ে দিয়েই যাবো আমরা।”

    পুলিশের নাম শুনেই ড্রাইভার ঘাবড়ে গেল। বলল—”কোন গোলমাল নেই তো বাবুজী?”

    অমরেশবাবু ও যতীন্দ্রনাথের পোষাকের দিকে ঘন ঘন চাইছিল ড্রাইভার।

    ”না—না, কোন ভয় নেই তোমার। বরং তোমার ভাল হবে দেখে নিও।”

    দিল্লীর পুলিশ হেড কোয়ার্টার থেকে ট্যাক্সি যখন আবার ষ্টার্ট দিল, তার পিছন পিছন চলল একটি সশস্ত্র পুলিশ—ভ্যান আর শিখাদের গাড়ীতে দু’জন পুলিশ অফিসার।

    ট্যাক্সি চলছে তো চলেছেই। গাড়ীর ভিতরে শিখা অধৈর্য্য হয়ে পড়ে। এ রাস্তা কি আজ ফুরাবে না? সহরের এলাকা কখন তারা ছেড়ে চলে এসেছে। সহরতলীও ছেড়ে গেছে বোধ হয় অনেকক্ষণ। ক্রমশঃ এক গ্রাম্য পথ ধরে অপেক্ষাকৃত মৃদু গতিতে গাড়ী চলতে আরম্ভ করল। দূরে যমুনা নদীর কল্লোল ক্ষীণভাবে বাতাসে ভেসে আসছে। ক্রমশঃ নদীটা স্পষ্টই দেখা যেতে লাগল। তারপর একেবারে নদীর ধারে এসে একখানা সুন্দর সাজানো গোজানো বাংলোর ধারে এসে গাড়ী একেবারে থেমে গেল।

    সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ বাহিনী বাংলোখানি ঘিরে ফেলল। দিল্লীর পুলিশ অফিসার সব দিক একবার ভাল করে লক্ষ্য করে দরজায় বুটের আঘাত করলেন। কিন্তু জনপ্রাণী বাড়ীর ভিতরে আছে বলে মনে হল না। দুমদাম লাথির চোটে দরজা ভেঙ্গে পড়বার উপক্রম হ’ল, তবুও ভিতর হতে কোন সাড়া নেই।

    আর অপেক্ষা করা চলে না। পুলিশ—ভ্যানের ভিতর থেকে দরজা ভাঙ্গার সরঞ্জাম নিয়ে একজন কনষ্টেবল দু—চার ঘা দিতেই হুড়মুড় করে দরজা ভেঙ্গে পড়ল। সদলবলে পুলিশ বাংলোর ভিতরে ঢুকে পড়ল। কিন্তু একটিও প্রাণীরও দেখা নেই বাংলোর ভিতরে। সব ঘরগুলোই বেশ ফিটফাট, দামী আসবাবে সাজানো কিন্তু একেবারেই ফাঁকা। নিশ্চয়ই এখানে মানুষ বাস করে নইলে এত পরিষ্কার ঘরদোরের অবস্থা হতেই পারে না। সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে অতি সন্তর্পণে চারিদিক খোঁজাখুঁজি করতে লাগল।

    কোণের দিকে একটা ঘর তালা বন্ধ ছিল। দরজায় কান পেতে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শিখা। ভিতর থেকে যেন একটা অস্ফুট কান্নার স্বর অতি ক্ষীণভাবে শ্রুতিগোচর হচ্ছে। বাহির থেকে তালা বন্ধ অথচ ভেতর থেকে চাপা কান্নার সুর আসছে, ব্যাপারটা কি? এক এক করে সকলেই কান পেতে শব্দটা শুনলেন। অমরেশবাবু মন্তব্য করলেন, ”ভূতুড়ে বাড়ী—খুব সাবধান।”

    শিখা বলল—”হোক ভূতুড়ে বাড়ী, ভূতের সঙ্গে দেখা না করে আর ফিরছি না—তালা ভেঙ্গে ফেলা হোক!”

    মজবুত তালা ভাঙ্গা গেল না, অবশেষে দরজাই ভাঙ্গতে হল।

    ঘরটি একেবারে অন্ধকার। জানালা বলতে একটিও নেই। বাইরের আলো ঘরে ঢুকতেও ঘরের সবটা পরিষ্কার দেখা গেল না। কিন্তু কান্নার শব্দটা বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। একটি টর্চও নেই কারুর কাছে। কান্নার শব্দ লক্ষ্য করে দিয়াশালাই জ্বেলে কোনরকমে নিরীক্ষণ করতে করতে একটি কোণে গিয়ে শিখা দেখল, একজন মানুষই বটে—থেকে থেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে সে।

    শিখা টেনে হিঁচড়ে তাকে বাইরে বের করে আনতেই দেখা গেল অপূর্ব্ব একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে—শীর্ণ ফ্যাকাসে রোগ—পাণ্ডুর তার মুখখানি। চোখদুটো বুজে আছে, হাত—পা বাঁধা। মেয়েটি ক্ষীণ কণ্ঠে বলল—”একটু জল।”

    ”একটু জল পাওয়া যাবে কি যতীনবাবু?”—শিখা তার হাত—পায়ের বাঁধন খুলতে খুলতে বলল।

    উঠানের মাঝে একটা ইঁদারা ছিল। তার পাড়ে দড়ি বাঁধা একটা বালতিও ছিল। যতীনবাবু বালতিটা ইঁদারায় নামিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছু দূর গিয়েই বালতিটা ঠক করে মেঝেতে ঠেকে গেল।

    একি আশ্চর্য্য ব্যাপার! ইঁদারায় জল কৈ?—হেঁট হয়ে যতীন্দ্রনাথ দেখলেন, কিন্তু কোথায় জল?—পরিষ্কার খট খট করছে সিমেণ্টের মেঝে। এ আবার কি রহস্য! যতীন্দ্রনাথ বার বার বালতিটা নামিয়ে মেঝেটা পরীক্ষা করতে লাগলেন।

    এদিকে হাত—পা বাঁধা মেয়েটি ভয়ে চোখ খুলতেই চায় না। শিখা ধীরে ধীরে অভয় দিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করল—”তোমার নাম কি?”

    ”রুমা।”

    ”কে তোমাকে ধরে এনেছে?”

    ”আমার বাবার কাকা—”

    ”তোমার বাবার নাম কি রাজাবাহাদুর পূর্ণেন্দুনারায়ণ পাণ্ডে?”

    মেয়েটি ঝর ঝর করে কেঁদে ফেলল।

    ”তোমার কোন ভয় নেই, আমরা তোমাকে বাড়ী পৌঁছে দেবো, ওরা কোথায় গেল?”

    ”কারা?”

    ”যারা তোমায় বন্দী করে রেখেছে!”

    মিট মিট করে চেয়ে আঙ্গুল দিয়ে সেই ইঁদারাটা দেখিয়ে দিল রুমা।

    ”ওখান দিয়ে কোথায় গেল?”

    ”নদীতে ওদের নৌকা বাঁধা আছে।”

    ”তুমি জানলে কি করে?”

    ”মাঝে মাঝে আমাকেও ঐ পথে নদীতে নৌকায় নিয়ে যেত ওরা।”

    ”আজ তুমি কোত্থেকে এলে?”

    ”কি জানি, এখান থেকে কোথায় আমায় নিয়ে গিয়েছিল জানি না। শুনেছিলুম আমায় মাদ্রাজে যেতে হবে, সেখানে নাকি আমার বিয়ে দেবে ওরা”—দু—হাতে চোখ ঢেকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে রুমা।

    * * * *

    যতীন্দ্রনাথের হাঁকডাকে সকলেই ইঁদারাটা পরীক্ষা করলেন। শিখা বুঝতে পারলো যে, ওটা ইঁদারা নয়, ইঁদারার মত করে তৈরী একটা গহ্বর। রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে শিখা সেই গহ্বরের ভিতর নেমে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে যতীন্দ্রনাথও। তারপর এক এক করে অনেকেই নামল তার ভিতরে। ভিতরের সিঁড়িটা বেয়ে কয়েকটা ধাপ নামবার পর সমান রাস্তা অনেকখানি। এই পথে আলো আসবারও বেশ বন্দোবস্ত রয়েছে। মাটির নীচে যে এমন সুন্দর যাওয়া—আসার পথ থাকতে পারে বাইরে থেকে তার কল্পনাও করা যায় না। কিছুক্ষণ পরে আলো কম হতে হতে একেবারে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। এখান থেকেই গহ্বরের মুখ বন্ধ। অতএব আর এগিয়ে যাওয়া অসম্ভব। শয়তানেরা পালাবার সময় গহ্বরের মুখ বন্ধ করে রেখে গেছে।

    আবার পিছন ফিরে সবাই ইঁদারার ভিতরের চাতালে এক এক করে ফিরে এল। বাইরের খোলা হাওয়ায় ফিরে আসতে ওদের একটুও দেরী হ’ল না। দিল্লীর পুলিশের জিম্মায় বাংলোখানি রেখে শিখা অমরেশবাবু, যতীন্দ্রনাথ ও রুমাকে নিয়ে এরোড্রোমে ফিরে এল। ধরমচাঁদকে ধরা গেল না এই আক্ষেপে শিখার মনটা খচ খচ করছিল।

    অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে যতীন্দ্রনাথ বললেন—”আমাদের একজন বড় শত্রু আজ হাত থেকে ফস্কে বেরিয়ে গেল। যে রকম সাংঘাতিক প্রকৃতির দস্যু ধরমচাঁদ, আমার মনে হয় শীঘ্রই তার সঙ্গে আবার আমাদের সাক্ষাৎ হবে। তবে আর কোন দিন সে রাজাবাহাদুরের কাকা হিসাবে সম্পত্তির ভাগ চাইতে আসবে না।”

    যতীন্দ্রনাথের অনুমান সত্য। পূর্ণেন্দুনারায়ণের সম্পত্তির ভাগীদার হিসাবে ধরমচাঁদ আর কখন ফিরে আসেনি। তার দলের অন্য সকলে যারা ধরা পড়েছিল তারাই আদালতে বলেছিল, ধরমচাঁদ কোন দিনই রামেশ্বর পাণ্ডে নয়, রামেশ্বর পাণ্ডে বেঁচে আছে কিনা তারা বলতে পারে না।

    পাটনার ”স্বর্গদ্বার” রাজাবাহাদুর পূর্ণেন্দুনারায়ণেরই সম্পত্তি। কিছু দিন পরে রাজাবাহাদুরের বিশেষ অনুরোধে শিখাকে আসতে হ’ল সেখানে রুমার বিবাহ উপলক্ষে।

    বদরীপ্রসাদ ও রুমা দুজনেই শিখাকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের ভাষা খুঁজে পায় না। রাজাবাহাদুর একটি সুন্দর অটোমেটিক পিস্তল শিখাকে উপহার দিলেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরত্নদীপ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
    Next Article গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    Related Articles

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.