Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গোয়েন্দা শিখা (কুমারিকা সিরিজ) – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী এক পাতা গল্প625 Mins Read0

    ০৪. শিখা ও সবিতা

    শিখা ও সবিতা

    এক – নির্ম্মম স্বপ্ন

    কলকাতার উপকণ্ঠ। জলা জঙ্গল আর মশায় ভরা। মানুষের বসতি যে সেখানে নেই, এমন নয়; দূরে দূরে ছড়িয়ে আছে মানুষের ঘর, বাড়ী, গরীবের কুঁড়ে, ছোটখাটো দু’একটা বস্তী। দিনে মাছি আর রাতে মশার সঙ্গে আপ্রাণ যুদ্ধ করে বাপ—ঠাকুর্দ্দার আমল থেকে বাস করছে ওরা। সহরের সঙ্গে সম্পর্ক ওদের খুবই কম।

    হঠাৎ সহরের লোক ঠেল মারল ঐ দিকেই। ক্রমশঃ জঙ্গল সাফ হয়ে গেল, নীচু জলা—জমি ভরাট হ’ল—এক—একখানা সৌখীন ধরণের বাড়ীও মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল ধীরে ধীরে।

    এখন আর বাসের অযোগ্য নয় এখানটা। একটি সুন্দর সৌখীন সহরতলীতে পরিণত হয়েছে বালীগঞ্জ। বিরাট লেক কাটা হয়েছে। তরতর করছে তার জল। তারই ছোঁয়া লেগে স্নিগ্ধতায় ভরে ওঠে চারিদিকের বাতাস। স্বাস্থ্যকামীদের সকাল—সন্ধ্যা ভিড় লাগে নতুন লেকের চারপাশে।

    কি ছিল আর কি হয়েছে!—পুরানো বাসিন্দারা অবাক হয়ে যায়! বেশী রাতে পথ চলতে আগের মত আর গা ছম—ছম করে না তাদের। উপরন্তু ধনীর প্রতিবেশী ওরা এখন। ছোট্ট চালা—ঘরে গোটাকতক ভাঙ্গা টিনের বাক্স নিয়ে যার ছিল মুদিখানার দোকান, সে এখন চেষ্টা করে তার দোকানখানি বড় করতে আর ভাল জিনিসে ভরে রাখতে। সৌখীন প্রতিবেশীর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে এখানকার ধোপা—নাপিতের কাজও অনেক বেড়ে যায়। প্রতিবেশীর মনস্তুষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের অবস্থার উন্নতির ক্ষীণ আশাও তারা পোষণ করে মনে মনে।

    শিবনাথের গরু ছিল চারটে। এখন রয়েছে সাতটা। এখন সে দুজন লোক রেখেছে সকাল—বিকেল দুধ যোগান দেবার জন্য। অল্প দিনের মধ্যে শিবনাথের উন্নতিটা সকলেরই চোখে পড়ে। আয়—বাড়ার সঙ্গে শিবনাথের খরচের মাত্রাও বেড়েছে অনেক। এখন আর মাঠের তাড়ি খেয়ে তার আশ মেটে না, সন্ধ্যার পর চোরাই মদের আড্ডায় একবার তার যাওয়া চাই। চেহারাটাও তার বেশ চকচকে হয়েছে ইদানীং।

    সেদিন নেশার মাত্রাটা একটু বেড়ে গিয়েছিল শিবনাথের। রাতও কোন ফাঁকে বেড়ে গিয়েছে, খেয়াল ছিল না তার। ভাটিখানা থেকে বাইরে বেরিয়ে এল যখন, পা দুটো তার বেশ টলছে। এক পুরোনো ইয়ারের সঙ্গে অনেকদিন পরে দেখা হয়ে যাওয়াতেই বেসামাল হয়ে পড়েছে সে। খুব আস্তে আস্তে বাড়ীর দিকে এগিয়ে চলে শিবনাথ।

    চেনা পথ। রোজই যাওয়া—আসা আছে তার—হলই বা জনমানবশূন্য! আর তার কাছে মূল্যবান জিনিস আছেই বা কি যার জন্য চোর—ডাকাত ধরবে তাকে?

    এই তো—এই বাঁকটা ঘুরলেই নতুন লেকের রাস্তাটা পেয়ে যাবে সে। তারপর লেকের ধার ধরে ধরে ওটুকু পার হয়ে গেলেই তাদের পাড়ার কাছাকাছি এসে পড়বে।

    কোন—রকমে টলতে টলতে লেকের ধারে এসে পড়ল শিবনাথ। কিন্তু ঠাণ্ডা খোলা হাওয়া গায়ে লাগতেই নেশা যেন তাকে আরো বেশী করে চেপে ধরল। পা যেন আর চলতে চায় না! ধপ করে একবার পড়ে গেল সে রাস্তার ওপরে। আবার উঠল, আবার টলতে টলতে এগিয়ে চলল।

    লেকের মাঝামাঝি এসে তার সব চেষ্টাই বিফল হ’ল। আর বুঝি এক—পাও চলতে পারবে না সে! অনেকদিনের ঘোড়েল মাতাল শিবনাথ। নেশায় যতই অজ্ঞান হোক, নিজের অবস্থা সম্বন্ধে খুবই সজাগ সে। কোন—রকমে রাস্তা থেকে সরে লেকের পাড়ের কাছে এসে একটা গাছের তলায় ঝপ করে বসে পড়ল গাছটা ঠেসান দিয়ে। কিন্তু বসতেও আর পারছে না যেন! গাছের গোড়ার মাটিটা ছিল উঁচু, বেশ একটা ঢিবির মত। সেইখানে মাথাটা রেখে হাত—পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ল। ঠাণ্ডা হাওয়া গায়ে লাগছে তার, বেশ শীত শীত করছে, শুধু গায়ে একটা গেঞ্জী। কোঁচার খুঁটটা খুলে আপাদ—মস্তক মুড়ি দিয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে নেশার ঘোরে বেহুঁশ হয়ে পড়ল।

    রাত ক্রমশঃ গভীর হয়ে এল। শিবনাথের নেশা যখন একটু ফিকে হ’ল, আচ্ছন্ন ভাবটা তার কেটে গেল। তৃষ্ণায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে, মাথা তার ঝিম—ঝিম করছে, এ কি অবস্থায় কোথায় পড়ে আছে সে? মনটা স্থির হতে সব কথাই মনে পড়ে গেল তার। মনে মনে খুবই লজ্জা হ’ল। যা হবার ত হয়ে গেছে, এখন ত আঁজলা ভরে লেকের জল খেয়ে প্রাণ বাঁচানো যাক!

    চোখ রগড়ে উঠে বসতেই শিবনাথ চমকে উঠল। গাছের ওপাশে কারা যেন ফিসফিস করে কথা কইছে। এই নিশুতি রাতে জনমানবশূন্য জায়গায় লোক আসবে কোথা থেকে? কাণ খাড়া করে গাছের আড়াল থেকে শুনতে চেষ্টা করল শিবনাথ—কারা কথা কইছে।

    হ্যাঁ—এ ত মানুষেরই গলার স্বর! অপদেবতার ভয় শিবনাথের খুব বেশী, তাই মানুষের গলা বুঝে কিছুটা আশ্বস্ত হল সে। কিন্তু এমন সময়ে ওরা এখানে কেন? গাছের আড়ালে আরো ভাল করে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল শিবনাথ।

    ক্রমশঃ ওদের কথাগুলো বেশ জোরে জোরে আর স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে।

    ”না, না—রাণীর হুকুম, শত্রুর শেষ রাখলে পরে অনেক ভোগান্তি ভুগতে হয়। ক’মাস চেষ্টা ক’রে তবে আজ পেয়েছি। দাও, ওর মুখটা খুলে দাও, একবার ভগবানের নাম নিতে দাও ওকে!”

    কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। নৈশ—বায়ুর সোঁ—সোঁ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। শক্ত কাঠ হয়ে বসে আছে শিবনাথ। নিজের নিশ্বাসটুকুও অতি—সন্তর্পণে ফেলছে সে।

    অতি—করুণ একটা মিনতি—”আমাকে খুন কোরো না, আমি বিশ্বাসঘাতকতা করিনি, রাণী জানেন। শুধু তোমাদের দল ছেড়ে গিয়েছিলুম। আমার ভয় করে—”

    ”ভয় করে?”—ব্যঙ্গ করে আর—একজন চাপা সুরে বলে ওঠে—”আর কোনদিন জীবনে ভয়—ভাবনা থাকবে না। আমরাও ভয়—ভাবনার হাত থেকে রেহাই পাবো। এখন যদি ইচ্ছা হয়, একবার শুধু মনে মনে ভগবানকে ডাকবার সময়টুকু পাবে। নাও, মৃত্যুর জন্য তৈরী হও!”

    শিবনাথের দম বন্ধ হয়ে আসবার উপক্রম হয়েছে। হাত—পা ঠাণ্ডা, শরীরের রক্ত চলাচলও বুঝি বন্ধ হয়ে গেছে! কিন্তু করবেই বা কি? ঐ হতভাগ্য লোকটিকে বাঁচাতে তার শক্তিই বা কতটুকু? তাতে বরং বিপদকেই ডেকে আনা হবে। মুখটা বাড়িয়ে লোকগুলোকে যে একবার দেখে নেবে, সে সাহসটুকুও তার এখন নেই।

    ”অ্যাঁ—সত্যিই তোমরা আমাকে মেরে ফেলবে? ঐ তো ছুরি বের করেছ! ঐ ছুরিটা যখন কেনা হয়, তখন আমিও তোমাদের সঙ্গে ছিলুম! ঐ ছুরিটাই আজ আমার বুকে বসাবে? দয়া নেই তোমাদের প্রাণে?” লোকটার কথা শেষ হ’ল না। হঠাৎ একটা তীব্র আর্ত্তনাদ আঁ—আঁ—আঁ। তারপরই সব শেষ! মুমূর্ষুর অন্তিম আর্ত্তনাদের রেশটা যেন অতি ক্ষীণভাবে বাতাসে কেঁপে ওঠে। তারপর সব চুপচাপ—সব স্থির।

    অন্ধকারেও চোখ বুজল শিবনাথ। তারপর থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে গাছটা আঁকড়ে ধরল সে।

    মিনিট দুই—তিন নিজের অস্তিত্বটুকুও হারিয়ে ফেলেছিল শিবনাথ। একখানা মোটর—গাড়ীর ষ্টার্ট দেওয়ার শব্দে তার সম্বিত ফিরে এল। গাড়ীখানা কাছেই দাঁড়িয়েছিল কোথাও, এতক্ষণ শিবনাথ দেখেনি সেটা। সে তখন গাছের পাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখল, একখানা কালো রঙের গাড়ী সোজা বেরিয়ে গেল। হাঁ করে শিবনাথ তাকিয়ে রইল গাড়ীখানার দিকে। মুহূর্ত্তের মধ্যে পিছনের লাল আলোটুকুও তার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

    হতভাগ্য ছুরিকাহত লোকটি তখনও পড়েছিল ওখানে। আস্তে আস্তে শিবনাথ এগিয়ে গেল সেখানে। অন্ধকারে মুখটা তার স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। তারই চোখের সামনে একটা জীবন্ত জোয়ান মানুষ খুন হয়ে গেল! এই ভয়াবহ দৃশ্যের সবটাই তার চোখের সামনে ঘটেছে! বেশ ত দেখল সে! একটা চীৎকারও করতে পারল না কেন? শয়তানদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দেওয়ার কোন চেষ্টাই করেনি সে। এখনই বা তার কর্ত্তব্য কি? ছুটে এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারে সে। কিন্তু কোনো পাহারাওয়ালার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে কি জবাব দেবে? কাল যখন এই খুনের কথা জানাজানি হবে, তখন তার দুর্দ্দশা যে কি হবে ভেবে শিউরে ওঠে শিবনাথ! কি কুক্ষণেই সে আজ বাড়ীর বার হয়েছিল!

    সাহসে ভর করে শিবনাথ লোকটির পাশে বসে পড়ল। মুখটা হাঁ করে আছে। ঠেলে দেখল, জন্মের মত নিস্তব্ধ হয়ে গেছে সে। বুকের ভিতর থেকে প্রচুর রক্ত বেরিয়েছে। সেইখানে হাত পড়তেই তাজা রক্তে হাতটা ভিজে গেল। শিউরে উঠে রক্তে ভেজা হাতটা তার নিজের কাপড়ে মুছে ফেলল সে। তারপরই হঠাৎ তার খেয়াল হ’ল, কি সর্ব্বনাশ সে করে বসেছে! খুন—হওয়া লোকের রক্ত তার কাপড়ে মাখামাখি করেছে! এখন চুপি—চুপি বাড়ী পালাতে পারলে বাঁচোয়া! নইলে—

    মাথাটা কি রকম ঘুরে ওঠে শিবনাথের! সব চিন্তা একসঙ্গে তালগোল পাকিয়ে ওঠে তার মাথার মধ্যে। কিছুক্ষণ বুদ্ধি হারিয়ে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে থানার দিকেই চলতে থাকে সে।

    প্রকৃত অপরাধী সে নয়। সব কথা খুলে বললে সেখানে সব দুশ্চিন্তার হাত থেকে সে রেহাই পেতে পারে, উপরন্তু এই খুনের একটা কিনারাও হতে পারে।

    * * * *

    থানার অফিসার—ইন—চার্জ তখন পরম তৃপ্তিতে নিদ্রাসুখ উপভোগ করছিলেন। থানার কাজ—কর্ম্ম মিটিয়ে ওপরে উঠতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। কাজেই তাঁর মেজাজটা বিগড়ে ছিল। এখন আবার অসময়ে তাঁর ঘুম ভাঙাতে তিনি বেশ রুক্ষ মেজাজেই নেমে এলেন।

    কিন্তু অভিজ্ঞ অফিসার তিনি। কর্ত্তব্য—কর্ম্মে বিরক্তির একটুও মুখে প্রকাশ করলেন না। গম্ভীরভাবে শিবনাথের এজাহার লিখতে বসলেন। নাম—শিবনাথ ঘোষ, জাতি—গোয়ালা, পেশা—জাত ব্যবসায় ইত্যাদি।

    এজাহার লেখা হয়ে গেলে দারোগাবাবু জিজ্ঞাসা করলেন—”মৃতদেহটা কি এখনও পড়ে আছে ওখানে?”

    ”হাঁ বাবু, এখনও পড়ে আছে লোকটা।”

    ”তা তুমি অত রাত্রে ওখানে কি করছিলে?”

    ”আজ্ঞে, রাতে একটু নেশা করেছিলুম—বেশ ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল, ওখানে শুয়েছিলুম একটু, একেবারে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম।”

    বড়বাবু মুখ তুললেন। বললেন, ”এখন নেশা কেটেছে তো? না, নেশার ঘোরেই কথা বলছ?”

    ”আজ্ঞে, নেশা ছেড়ে ধাত ছেড়ে যাবার জোগাড় হয়েছে! লোকটার বুকে ছুরি বসালো, একেবারে আমার চোখের সামনে!”

    ”তুমি তখন কি করলে?”—বড়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

    ”আজ্ঞে, আমি তখন শক্ত কাঠ হয়ে একটা গাছের পাশে লুকিয়ে ছিলুম।”

    ”তারপর!”

    ”তারপর তারা কাজ শেষ করে মোটরে উঠে চলে গেল।”

    ”ক’জন ছিল তারা?”

    ”তা চার—পাঁচজন হবে।”

    ”কোনো কথাবার্ত্তা শুনতে পেয়েছিলে?”—অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে বড়বাবু শিবনাথের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

    ”যে খুন হয়ে গেল, সে বার বার মিনতি করছিল।”

    ”কি বলছিল?—সেটাই যে বেশী দরকারী।”

    একটু চুপ করে থেকে শিবনাথ বলল, ”আজ্ঞে, কথাগুলি ঠিক মনে আসছে না। আমি তখন ভয়ে কি রকম হয়ে গেছি—”

    ”আচ্ছা, মনে করে পরে বলবে। এখন চল, জায়গাটা দেখিয়ে দেবে।”

    সাজগোজ করে লোকজন নিয়ে বড়বাবু যখন গাড়ীতে উঠলেন, তখন দু—একটা কাক—পক্ষী ডাকতে সুরু করেছে। পথেও দু—একজন লোক চলতে সুরু করেছে।

    ভোরের আবছা আঁধার ভেদ করে পুলিশের গাড়ী হেডলাইট জ্বেলে লেকের ধারের পিচবাঁধানো রাস্তায় এসে পড়ল। শিবনাথ একটু নড়েচড়ে বসল।

    ”আর কতদূর?”—বড়বাবু জিজ্ঞাসা করলেন শিবনাথকে।

    ”চলুন, ঠিক যাচ্ছে—মাঝামাঝিটাক গিয়ে নামলেই চলবে।”

    আরও কিছুটা পথ যাবার পর শিবনাথ বলল, ”এইখানে—এইখানে থামতে বলুন।”

    গাড়ী ব্রেক কষল।

    তখনও ঠিক ফর্সা হয়নি। বড়বাবু তাঁর হাতের টর্চটা একবার জ্বেলে চারদিকে ঘুরিয়ে নিলেন। শিবনাথ আগে আগে চলেছে, পিছনে বড়বাবু এবং একজন জুনিয়র অফিসার।

    একটা—একটা করে তিন—চারটে গাছের আশেপাশে তন্ন—তন্ন করে শিবনাথ খুঁজে দেখল। কিন্তু কোথায় কি! খুনের কোন চিহ্নই নেই কোনখানে। ছুরি—খাওয়া অত—বড় জোয়ান লোকটা গেল কোথায়? শিবনাথ অবাক হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। সে যে নিজের হাতে নেড়েচেড়ে দেখেছে, লোকটার দেহে প্রাণ নেই! তবে কি সে দিক ভুল করল?

    দেখতে দেখতে চারদিক ফর্সা হয়ে গেল। স্বাস্থ্য—লাভের উদ্দেশ্যে দু—চারজন বেড়াতে সুরু করেছে। পূর্ব্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ চারদিকই দুবার ঘুরে এল শিবনাথ। কিন্তু কোথাও কিছু দেখতে পেল না সে। বড়বাবুর কাছে এসে বলল, ”বড় তাজ্জব ব্যাপার দেখছি, হুজুর।”

    ”আজ্ঞে, কতখানি টেনেছিলে কাল রাত্তিরে?”—বড়বাবু মুখ বিকৃত করে বললেন।

    ”বাবু, আপনি বাপের মত, আপনার কাছে মিথ্যা কথা বলব না। আমি নিজের হাতে নেড়ে দেখেছি—লোকটা মরে পড়ে আছে। এই দেখুন, আমার হাতে এখনো রক্ত শুকিয়ে আছে। কাপড়ে হাত মুছেছি, এই দেখুন দাগ।”

    সত্যিই ত রক্তের দাগ। ছোটবাবুর সঙ্গে বড়বাবু চুপিচুপি কি পরামর্শ করতে লাগলেন। তারপর শিবনাথের দিকে চেয়ে বললেন, ”তুমি আসল কথা চেপে যাচ্ছো। আসল তদন্ত শেষ না হওয়া পর্য্যন্ত তুমি ছাড়া পাবে না। ভাল চাও ত সত্যি কথা বল।”

    শিবনাথ কেঁদে ফেলল। বলল, ”আমি ঠিক বলছি বাবু, এই গাছটাই আমার নিশানা রয়েছে, আর ঐখান থেকে তারা মোটর গাড়ীতে উঠেছে। আর এইখানটাতে লাশটা পড়েছিল।”

    জুনিয়র অফিসার হঠাৎ বলে উঠল, ”মোটরের চাকার দাগ পেয়েছি স্যর—এই যে স্পষ্ট রয়েছে।”

    বড়বাবু পকেট থেকে একখানা ম্যাগনিফাইং—গ্লাশ বের করে ঘাসের ওপরটা পরীক্ষা করলেন। বললেন, ”হ্যাঁ, দেখছি গাড়ীখানাকে এইখানে ঘোরানো হয়েছিল। আর চাকার দাগের ওপর দাগ রয়েছে—একই চাকার দাগ। মনে হয়, দু—একবার ব্যাক করেছে আবার এগিয়েছে—তবে এখানটা থেকে মোড় ঘুরিয়েছে, বেশ বোঝা যাচ্ছে। একটা ফটো তুলে নাও দাগগুলোর।”

    জুনিয়র অফিসার ক্যামেরা বের করে ছবি তুলে নিল চাকার দাগগুলোর।

    শিবনাথের কথামত খুন হওয়ার জায়গাটা পরীক্ষা করে বড়বাবু মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। এখানকার খানিকটা জায়গায় একেবারে ঘাস নেই। যেন কেউ কোদাল দিয়ে এখানকার ঘাস চেঁছে নিয়ে গেছে। এই ফাঁকা জায়গায় খুন হলে রক্তের চিহ্ন থাকবে না? মোটরের চাকার দাগ দেখে ত বলা যায় না এখানে একটা খুন হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে—আর রাতের অন্ধকারে কেউ এসে লাশটা তুলে নিয়ে গেছে! তাছাড়া লাশ নিয়ে কেউ সঙ্গে করে ঘুরবে, এ—কথাই বা বিশ্বাস করবে কে? যত সব গাঁজাখুরি গল্প আর হয়রানি! বড়বাবুর মন্তব্যে চুপ করে যান জুনিয়ার ব্রজেনবাবু।

    অপ্রস্তুতের একশেষ হয়ে শিবনাথ বড়বাবুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। বড়বাবু বললেন, ”নেশার ঝোঁকে খাশা গল্প তৈরী করে তুমি ব্যাটা রসিকতা করতে এসেছো আমাদের সঙ্গে। ব্যাটাকে ফাটকে পুরে ফলশ ইনফরমেশনের চার্জ্জ দিয়ে ঘানি টানালে তবে শায়েস্তা হবে।”

    বড়বাবুর হুকুমে পুলিশের মোটরে ষ্টার্ট দেওয়া হ’ল। দলবল নিয়ে বড়বাবু ফিরে গেলেন। যতক্ষণ না পুলিশের গাড়ীখানা শিবনাথের দৃষ্টির বাহিরে গেল, ততক্ষণ একদৃষ্টিতে শিবনাথ সেই দিকে চেয়ে রইল। তবে কি রাতের সব ঘটনাই তার নেশার ঝোঁকের একটা স্বপ্ন? মুমূর্ষুর কাতর মিনতিটুকু যে এখনও তার কাণে বাজছে! সেটাও কি তাহলে মিথ্যা? রেডিওতে যারা গান গায় তাদেরও তো আমরা দেখতে পাই না? একজন শুধু বলে দেয় অমুকে গাইছেন; তাহলে কি বলব, সেটাও মিথ্যা? সারা খবরের কাগজখানা কি তৈরী—করা যত মিথ্যা গল্প? অশিক্ষিত শিবনাথের এই উদ্ভট প্রশ্নের জবাব কে দেবে?

    দুই – বিপন্নের আহ্বান

    চায়ের সঙ্গে খবরের কাগজ না পেলে শিখার মেজাজ বিগড়ে যায়। রতন সে কথা জানে। খবরের কাগজ আসতে দেরী হচ্ছে বলে রতন চা ছাঁকতে পারছে না। একবার সদর দরজা আর একবার রান্নাঘর করছে। যা হোক—তখনই এসে পড়ল খবরের কাগজের হকার। রতন মারমুখী হয়ে উঠল তার উপর। ”দিন দিন এত দেরী করতে আরম্ভ করেছ! টাকা নেবার বেলায় ত একদিনও তর সয় না! ফের যদি দেরী করবে কাগজ দিতে, তাহলে তোমায় ছাড়িয়ে অন্য লোকের সঙ্গে বন্দোবস্ত করব।”

    রাগ হবারই কথা। দিদিমণি কখন গিয়ে বাইরের ঘরে বসেছেন, এখনও চা দিতে পারল না রতন! একবার দিদিমণির মেজাজ বিগড়ে গেলে সারাদিন বকুনি খেতে খেতে প্রাণান্ত হবে রতনের। তার ওপর মীরা দিদিমণি এখানে এসে রয়েছেন, তিনিই বা ভাববেন কি?

    চা আর খবরের কাগজ একসঙ্গে রতন দিয়ে এল বাইরের ঘরে। শিখা তখন মীরার সঙ্গে গল্পে ব্যস্ত। রতন ভাবল, যাক, ফাঁড়াটা কেটে গেল! একলা থাকলে দিদিমণি অল্পে ছাড়তো না এই দেরী হবার জন্য।

    পরীক্ষার পর মীরার দিল্লীতে যাবার কথা। দিল্লী না গিয়ে মীরা এসে উঠেছে শিখার কাছে। শিখার কাছে তার এ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনে অবাক হয়ে চেয়ে থাকে শিখার মুখের দিকে। শিখা তার সহপাঠিনী। একই বয়স দুজনের অথচ শিখা যেন অন্য ধাতে গড়া। দেহে মনে অদ্ভুত শক্তি নিয়ে জন্মেছে সে। সাহসও অসাধারণ—জল আগুন মানে না। বিপদের মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে, একটুও প্রাণের ভয় করে না। একটা মেয়ের পক্ষে এটা সম্ভবই বা হয় কি করে ভেবে কূল পায় না মীরা! মংপোর হাত থেকে তাকে যেভাবে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল, সেকথা ভাবলে এখনও মীরার গা শিউরে ওঠে!

    মীরার ইচ্ছা করে, শিখার সঙ্গে সেও এ্যাডভেঞ্চারে বেরুবে। কিন্তু কথাটা কোন দিনই শিখাকে বলতে সাহস করেনি সে; আজ চা খেতে খেতে বলে ফেলল।

    শিখা বলল, ”বেশ ত, ট্রেনিং নে। আমার যে সব বই—পত্তর কলেকসন আছে, সেগুলো ভাল করে পড়ে ফেল, আর সাইকলজির বই কিছু দেবো, ষ্টাডি করতে আরম্ভ কর—আমিও একলা আর পেরে উঠছি না, একজন অ্যাসিষ্টাণ্ট খুঁজছি।”

    মীরা সোৎসাহে ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল, সে খুব রাজী আছে।

    রতন একতাড়া চিঠি—পত্র টেবিলের ওপর রেখে গেল। সকালের ডাকে এগুলো এসেছে।

    এক—একখানা করে চিঠি খোলে শিখা আর হেসে মীরার হাতে দেয়। একজন বন্ধু লিখেছে, ”ধরমচাঁদকে দেখতে কেমন? সে ত শিখার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিল। এখনও বোধ হয় শিখার আশা ছাড়েনি। শিখাই বা অমত করছে কেন?” চিঠিটা মীরার হাতে দিয়ে শিখা আর একখানা চিঠি খুলল।

    দু—চার লাইন পড়বার পর শিখার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শিখা চিঠিখানা পড়ে শেষ করল। বলল, ”এই যে অ্যাডভেঞ্চারে বেরুবে বলছিলে, এখনই একটা সুযোগ এসে গেল। পড়ে দেখ—”

    মেয়েলি হাতের লেখা। লেখাটা কিন্তু বেশ পরিষ্কার। মীরা ধীরে ধীরে পড়তে লাগল :—

    দিদি,

    ভীষণ বিপদে পড়ে আপনার শরণ নিচ্ছি। আমার স্বামী আজ চার দিন হ’ল নিখোঁজ হয়েছেন। তাঁকে আমি ভালই জানি—চারদিন কোন খবর না দিয়ে বাড়ীছাড়া হয়ে কোথাও থাকবার মানুষ তিনি নন। আমার মনে হচ্ছে, এর মধ্যে কোন গোলমাল আছে! নিশ্চয় তিনি কোন কুচক্রে জড়িয়ে পড়েছেন। এ পর্য্যন্ত প্রাণে বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না। দিদি, পৃথিবীতে আমার কেউ নেই। আমার স্বামীকে ফিরিয়ে আনুন, নইলে আপনার সামনে মাথা খুঁড়ে আমি জীবন শেষ করব। আমরা বড় গরীব। কিন্তু আমি শুনেছি, আপনি গরীবের দিকেই চোখ তুলে চান—টাকা—পয়সার দিকে নয়। বেশী কথা লেখবার মত মনের অবস্থা আমার নয়। ইতি

    আপনার এক ছোট বোন

    সবিতা

    শ্রীরামপুর

    ”বেচারা সবিতা!”—একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মীরা বলল; তারপর একটু থেমে আবার বলল,—”তা হাসপাতালে বা পুলিশে খবর নিলেই ত পারে।”

    ”অত সহজ হলে আমাকে খোঁজ করবে কেন?—পাড়ার লোকই যথেষ্ট। হয়ত এমন কারণ আছে, যাতে তার বিশ্বাস, ব্যাপারটা খুবই গোলমেলে! তা—এই কেসটার ভার তুই নে না! তোরও হাতে—খড়ি হবে আর এক অসহায় স্ত্রীলোকেরও উপকার করা হবে!” মীরার মুখের দিকে চেয়ে শিখা বলল।

    ”রক্ষে কর! এই বিশাল পৃথিবীর মধ্যে কোথায় আমি ওর স্বামীর খোঁজ করে বেড়াব! আমি বরং তোর সঙ্গে সঙ্গে থাকব। কি ভাবে তুই তদন্ত আরম্ভ করিস দেখব।”

    ”তুই হ’লে কি করতিস—যদি তোর কোন আত্মীয় এরকম নিখোঁজ হত?” —শিখা জিজ্ঞাসা করল।

    ”ঐ ত বললুম, আগে হাসপাতাল, তারপর পুলিশ, সবশেষ খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দিয়ে বসে থাকতুম।”

    ”আর যদি তোর স্বামী হত?”

    ”ঐ সব করে দু’চার দিন দেখে তার আশা ছেড়ে মাষ্টারী করতে বেরিয়ে পড়তুম—শিখা দেবীর দরজায় মাথা খুঁড়ে মরতুম না নিশ্চয়।”

    হো—হো করে হেসে উঠল শিখা। বলল, ”নে, তৈরী হয়ে নে—যাস তো চল, শ্রীরামপুর ঘুরে আসি।”

    ”আমি কিন্তু যাবার সময় ড্রাইভ করব—তুই ফেরবার সময় করবি—রাজী আছিস তো?”—মীরা বলল।

    ”তুই আগাগোড়াই গাড়ী চালাস, আমি ততক্ষণ কেসটার সম্বন্ধে ভাববার একটু সময় পাবো। ঠিকানাটা ব্যাগে পুরে নে, আমি অন্য দরকারী জিনিসপত্রগুলো ঠিক করে নিচ্ছি—চটপট উঠে পড়। বেশী সময় নষ্ট করা উচিত নয়।”

    * * * *

    গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে শিখার টু—সীটার অষ্টিন ছুটেছে। মীরার হাতে ষ্টিয়ারিং। এ গাড়ীখানা সম্প্রতি কলকাতার পুলিশ কমিশনার সাহেব শিখাকে উপহার দিয়েছেন। গাড়ীখানা ছোট হলেও খুব মজবুত আর দরকার হ’লে রেসিংকারের মত স্পীড তোলা যায়। এ গাড়ীটা মীরার খুব ভাল লাগে। বলে, ”দিল্লীতে হ’লে তোর এই গাড়ীখানা নিয়ে আমি ভারত—ভ্রমণে বেরুতুম। এটা নেহাৎ কলকাতা, এখান থেকে কোথায়, কতদূর বা যাব?”

    শিখা বলে, ”কেন, কলকাতা থেকে মানুষ তো যাচ্ছে কাশী, লক্ষ্নৌ, আগ্রা, দিল্লী!”

    মীরা বলে, ”যাচ্ছে, কিন্তু কলকাতা থেকে সেই বরাকর পর্য্যন্ত—এতখানি পথ ভারী বিশ্রী লাগে।”

    টপ স্পীডে গাড়ী ছুটেছে এখন। সামনে দু—একটা গরুর গাড়ী, সাইকেল—রিক্সা পড়ছে। সেগুলোকে কাটিয়ে চলেছে মীরা। শিখা তার সঙ্গে আর কোন কথা বলে না। হয়ত নিরুদ্দেশের কেস সম্বন্ধে কিছু চিন্তা করছিল সে।

    শ্রীরামপুরে এসে পড়ে ওরা। মীরা গাড়ীর স্পীড কমিয়ে দেয়। দোকানের সাইনবোর্ডগুলোতে শ্রীরামপুর লেখা রয়েছে—এখানেই কারুর কাছ থেকে ঠিকানাটা দেখিয়ে নিতে হবে। মিছামিছি ঘুরে অযথা সময় নষ্ট করতে রাজী নয় শিখা।

    ঠিকানা নিয়ে বাড়ী খুঁজে বের করতে একটুও দেরী হল না শিখার। ছোট বাড়ী, দোতলাই বলা চলে। বাড়ীখানা বেশ ভাল করে লক্ষ্য করে শিখা।

    দোতলায় ছোট একটা ছাদ আর একখানা ঘর আর নীচের দু—তিনখানা ঘর নিয়ে এই বাড়ীটা। বাড়ীর পাশ দিয়ে একটা এঁদো সরু গলি। শিখা দরজার কড়া নাড়ল। দরজা খুলে দিল একজন কুড়ি—বাইশ বছর বয়সের তরুণী। একমাথা রুক্ষ চুল। চোখ দুটো কেঁদে কেঁদে ফুলে উঠেছে। ছিপছিপে রোগা গড়ন, মুখখানা সুন্দরই বলা চলে।

    ”আপনিই কি আমাকে চিঠি দিয়েছিলেন? আমার নাম অগ্নিশিখা রায়। ইনি আমার অ্যাসিষ্টাণ্ট মীরা মিত্র।”

    ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল মেয়েটি। ধরা গলায় বলল, ”আসুন।”

    বেশ মন দিয়েই শিখা সবিতার কথাগুলো শুনে গেল। সবিতা মেয়েটিকে বেশ বুদ্ধিমতী বলেই মনে হ’ল শিখার। বেশ গুছিয়ে কথা বলতে পারে সে, বাজে কথা একটিও বলে না। সে বলল, এক বছরের কিছু বেশী হ’ল তার বিয়ে হয়েছে। মা—বাপ নেই, দূর—সম্পর্কের এক আত্মীয় দয়া করে তাকে সংসারে রেখেছিলেন। নিজের চেষ্টায় ম্যাট্রিক ক্লাশ পর্য্যন্ত পড়েছে। স্বামীর নাম শৈলেন চক্রবর্ত্তী—এখানকার জুট মিলে কেরাণীর কাজ করেন। বাড়ীখানা ওদের ভাড়া নেওয়া। বিয়ের পর থেকেই ওরা এই বাড়ীতে আছে। স্বামীর আত্মীয়—স্বজন বলতে এ পর্য্যন্ত কারুকেই দেখেনি সে, কারুর নামও শোনেনি। অফিস থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিট যে বাইরে থাকে না, আজ চারদিন সে বাড়ী—ছাড়া।…বলেই আর কোন কথা বলতে পারল না সবিতা; দু—হাতে মুখ ঢেকে মাথাটা শুধু নীচু করল।

    শিখা বলল, ”আর কিছু বলবার থাকে ত বলুন। আমি কথা দিচ্ছি, যদি তিনি প্রাণে বেঁচে থাকেন, আমি তাঁকে ফিরিয়ে আনতে পারব।”

    আর একটি কথাও বেরুল না সবিতার মুখ থেকে। শুধু চাপা কান্নার মৃদু শব্দটুকু শুনতে পাওয়া গেল।

    গম্ভীরভাবে শিখা বলল, ”এখন কান্নাকাটির সময় নয়, কাঁদবার জন্য সারা জীবন পড়ে আছে! এখন আমি যা জিজ্ঞাসা করি, তার জবাব দিন।”

    মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মুখ নীচু করে সবিতা বলল, ”বলুন।”

    ”আপনার স্বামীর কোন বন্ধু—বান্ধবকে আপনি চেনেন?”

    ”বন্ধু—বান্ধব বলতে তাঁর কেউ নেই। কারুর সঙ্গে মেশেন না তিনি।”

    ”ঝগড়া—ঝাঁটি হয়েছিল কিছু?”

    ”কার সঙ্গে ঝগড়া হবে?—আছেই বা কে বাড়ীতে একটা ঝি ছাড়া? আর আমি কখনো ঝগড়া করি না।”

    ”যেদিন থেকে শৈলেনবাবু বাড়ী আসেননি, সেদিন সব শেষ কার সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিল? অফিসে বা রাস্তায়?”

    ”সেদিন তিনি নাকি অফিস—টাইমে কলকাতার ট্রেনে উঠেছিলেন, পাড়ার একজন দেখেছে!”

    ”সেদিন অফিসে যাননি?”

    ”না। অফিসে খবর নেওয়া হয়েছে, অফিসে যাননি।”

    ”কলকাতার হাসপাতালগুলোয় খবর নেওয়া হয়েছিল?”

    ”হ্যাঁ।”

    ”থানায়?”

    ”তাও নিয়েছিলুম। থানায় গিয়ে খুব কান্নাকাটি করেছিলুম। তাঁরা সব জায়গায় খবর নিয়ে কোন উদ্দেশ করতে পারেননি। তাই ত আপনার খবর পেয়ে চিঠি দিলুম আপনাকে। থানা থেকেই একজন দয়া করে আপনার কথা বলেছিল আর আপনার ঠিকানা দিয়েছিল।”

    ”বেশ। আপনার স্বামীর একখানা ফটো দিন আমাকে। খুব সম্ভব আপনার স্বামী বেঁচে আছেন।”

    ”তাই যেন হয় দিদি, আমার আর কেউ নেই পৃথিবীতে। কিন্তু আমার স্বামীর ছবি ত নেই।”

    ”চলুন, আপনাদের ওপরের শোবার ঘরখানা একটু পরীক্ষা করব, যদি কিছু সন্ধান পাই।”

    শোবার ঘরে টেবিলের ড্রয়ারটা টেনে খুলতেই একখানা ফটো বেরিয়ে পড়ল। শিখা বলল, ”এই ত আপনার স্বামীর ছবি।”

    ”হ্যাঁ।—ঐ একখানি ছবি, কিন্তু ওখানা দিতে মন সরছে না।”

    ”আমি কথা দিচ্ছি, আপনার ছবি আপনাকে ফেরৎ দেব।”

    ছবিখানা উল্টেপাল্টে দেখে শিখার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল। ছবিখানা মীরাকে ব্যাগে রাখতে বলে সবিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ীতে উঠে এসে বসল শিখা।

    মীরা গাড়ীতে ষ্টার্ট দিল। মীরার ব্যাগ থেকে সবিতার স্বামীর ছবিখানা আর একবার বের করে শিখা কিছুক্ষণ দেখে বলল, ”এ—মুখ একজন ক্রিমিন্যালের মুখ! এ যে ভদ্রভাবে জীবন কাটায় না, এ—কথা আমি জোর করে বলতে পারি।”

    ”কি করে জানলি তুই এ—কথা?”

    শিখা বলে, ”মানুষের ভেতরের ছায়া তার মুখে ফুটে থাকে; আর আমাদের চোখে সেটা সহজেই ধরা পড়ে।”

    মীরা ভাবে, হয়ত শিখার কথা ঠিক। আবার সে ষ্টিয়ারিংয়ের দিকে মন দেয়।

    তিন – আত্মহত্যা, না, খুন!

    বাড়ী ফিরে শিখা নিরুদ্দিষ্ট শৈলেন চক্রবর্ত্তীর ছবির কয়েকখানা বড় বড় কপি তৈরী করতে রতনকে পাঠিয়ে দিল ফটোর দোকানে। বলে দিল, ”সন্ধ্যার মধ্যেই ওগুলো চাই।” তারপর মীরার সঙ্গে গোয়েন্দা—কাহিনীর গল্পে মেতে গেল। মীরা বলে, ”তুই ত বউটাকে বলে এলি, তার স্বামীকে ফিরিয়ে আনবি, এখন এই ছবি দেখে কোথায় খুঁজবি?”

    শিখা বলল, ”প্রথমে সব কেসগুলোই অসম্ভব বলে মনে হয়, কিন্তু কোন দিক দিয়ে যে সন্ধানের সূত্র চোখের সামনে এসে পড়ে, বুঝতেই পারা যায় না। ভগবান আমাদের সহায়। তা ছাড়া যদি বদমায়েস শয়তানরা চিরকালই পালিয়ে বেড়াতে পারত, তাহলে দেশটা কিছুদিনের মধ্যেই গুণ্ডা বদমায়েসে ভরে যেত। এই যে বউটার স্বামী নিখোঁজ হয়েছে, তুই দেখে নিস, সে যদি প্রাণে বেঁচে থাকে, তাকে আমি খুঁজে বের করবই।”

    ”কিন্তু কিভাবে তুই তদন্ত আরম্ভ করবি আমি ভেবেই পাচ্ছি না।” মীরা বলল।

    ”প্রথমেই ছবির কপিগুলো প্রত্যেক থানায় পাঠিয়ে দিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখব কোন থানার এলাকায় এই লোক কোন দিন বাস করত কিনা। আমার বিশ্বাস কোন না কোন থানা থেকে এর সম্বন্ধে একটা রিপোর্ট পাওয়া যাবে। শ্রীরামপুরে বাস করছে লোকটা অল্প দিন। এর আগে কোথায় ছিল? নিশ্চয় কলকাতায়। তাছাড়া লোকটার গত জীবনের ইতিহাস জানা সব চেয়ে আগে দরকার। লোকটার বয়স আন্দাজ করছি ত্রিশ—বত্রিশ। জীবনের এতগুলি দিন সে বনে বনে কাটায়নি নিশ্চয়। আগের দিনের পরিচয় পাওয়া গেলে তদন্ত জলের মত সহজ হয়ে যাবে।”

    শিখার কথা শুনে মীরার ভারী আনন্দ হয়। সত্যিই সে এখন বেশ ভাল একজন গোয়েন্দা। পুলিশ কমিশনার ওকে খাতির করেন কি শুধু শুধু!

    হাসি—গল্পে সে দিনটা কেটে গেল। পরের দিন সকালে নিয়মমত শিখা বাইরের ঘরে এসে বসেছে। মীরার কাপড় ছেড়ে আসতে একটু দেরী হ’ল। খবরের কাগজটা সেদিন খুব সকালেই এসেছিল। ততক্ষণে শিখার কাগজ দেখা হয়ে গেছে। একটা খবরের চারপাশে লাল পেন্সিলের দাগ দিয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে শিখা।

    ”কী ব্যাপার? সকাল বেলায় অত ভাবনা কিসের?” ঘরে ঢুকেই মীরা জিজ্ঞাসা করল।

    ”পড়ে দেখ।”

    কাগজখানা টেনে নিয়ে লাল মার্কা করা জায়গাটা পড়ে মীরা শিখার মুখের দিকে চেয়ে রইল। খবরটা খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু শিখার কাছে অনেকখানি।—”কাল বিকালে লেকের জলে একটা মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায়। দেহটা ফুলে ঢোল হ’য়ে ভেসে উঠেছে। সকলে আত্মহত্যা বলেই অনুমান করছে। পুলিশ তদন্ত চলছে।”

    শিখার মুখের ভাব বদলে গেছে। বন্ধুর এরকম মুখের ভাব আগে দেখেনি মীরা। মীরা চুপ করে থাকে। নিজের মনেও কিছু চিন্তা করতে চেষ্টা করে সে।

    ”দেখ ত রতনের চা হ’ল কিনা?—আজ বোধ হয় চা খেয়েই দিন কাটাতে হবে।”

    সঙ্গে সঙ্গে রতন চা এবং প্রাতরাশ নিয়ে ঘরে ঢুকল। দিদিমণির মুখ গম্ভীর দেখে ট্রেটা টেবিলের উপর নামিয়ে দিয়ে পিছু ফিরল।

    শিখা বলল, ”শোন রতন, আমরা এখন বেরিয়ে যাচ্ছি—ফিরতে কত বেলা হবে, বলতে পারি না। তুমি খেয়েদেয়ে আমাদের খাবার ঢাকা দিয়ে রেখো। আর বাড়ী ছেড়ে এক—পা কোথাও যেয়ো না।”

    রতন ঘাড় নেড়ে জানাল, সে বুঝেছে।

    চা খাওয়ার সময়টুকু শিখা আর কোন কথা বলে না। মীরাও চুপ করে চা—টুকু শেষ করে নেয়। চা খাওয়া শেষ হলে মীরা বলল, ”একবার টেলিফোনে টালিগঞ্জ থানায় একটা কানেকসন নাও।”

    টেলিফোনটা হাতে নিয়ে শিখা বলল, ”অফিসার—ইন—চার্জকে চাই।”

    ওদিক থেকে সাড়া পেয়ে শিখা বলল, ”মর্নিং—কাল যে সুইসাইড কেসটা আপনার এলাকায় হয়েছে, হ্যাঁ, লেকের কেসটার কথা বলছি—সে লাশটা কি জ্বালানো হয়ে গেছে? কি বললেন? ফটো নেওয়া আছে?—আর কি বললেন? জুতো জামা রেখে দেওয়া হয়েছে! আমি একবার দেখতে চাই ওগুলো। হ্যাঁ এখনই যাচ্ছি।” তারপর মীরার দিকে চেয়ে বলল, ”তোকে একটি কাজের ভার দিচ্ছি—গাড়ী নিয়ে চলে যা শ্রীরামপুরে, বউটাকে একেবারে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। সোজা চলে আসবি টালিগঞ্জ থানায়। আমি সেখানেই থাকব। লাশ জ্বালানো হয়ে গেছে; নাইলে মর্গে ছুটতে হত। গিয়েই বা কি হত? ফুলে ফেঁপে মুখে—চোখের কোন চিহ্নই ছিল না। সে মূর্ত্তি দেখলে বউটা হয়ত ফিট হয়ে পড়ত! লাশ জ্বালানো হয়ে গেছে ভালই হয়েছে। যা, উঠে পড় আমি রাস্তা থেকে একখানা ট্যাক্সি ধরে নেব’খন।”

    নিরুদ্দিষ্ট শৈলেন চক্রবর্ত্তীর ফটোখানা সঙ্গে নিয়ে শিখা থানার দিকে রওনা হল। মীরা চলল শিখার গাড়ী নিয়ে শ্রীরামপুরের দিকে।

    ট্যাক্সিকে বিদায় দিয়ে শিখা থানার মধ্যে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই থানার বড়বাবু শিখাকে অভিবাদন করে বললেন, ”আপনিই টেলিফোন করেছিলেন নাকি?”

    শিখা হেসে বলল, ”হ্যাঁ, আমার পরিচিত এক মহিলার স্বামী আজ পাঁচদিন নিখোঁজ হয়েছেন। লেকের মৃতদেহটি যদি তার স্বামীর হয়, তা হলে বেচারার ভাগ্য বড়ই খারাপ! একেবারে অসহায়! কেসটা কি সুইসাইড?”

    বড়বাবু চিন্তিত হয়ে বললেন, ”বসুন। চা—টা আনাই, আপনি যখন এসেছেন, এক কথায় সুইসাইড বলে নিষ্পত্তি করে দিতে পারছি না।”

    ”কেন? মৃতদেহ সনাক্ত হয়েছে বুঝি?”

    ”না,—বসুন, সব বলছি।”

    শিখা বসলে বড়বাবু আবার বলতে শুরু করলেন, ”ঠিক পাঁচদিন আগের কথা। রাত দুপুরে এক ব্যাটা গোয়ালা এসে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। লেকের ধারে একটা লোককে গুণ্ডার হাতে খুন হ’তে দেখে ছুটে এসেছিল সে। কিন্তু আমরা গিয়ে দেখি, কোথাও কিছু নেই—সব বাজে কথা। বেচারা গোয়ালা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমি তাকে কসে ধমক দিতেও সে ঐ এক কথাই বলল, সে দেখেছে খুন হতে। তারপর কাল সকালে খবর পাওয়া গেল, একটা লাশ লেকের জলে ভাসছে। মৃতদেহটা একেবারে বিকৃত হয়ে গেলেও তার বুকের উপরে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখে মনে হয় তাকে খুন করা হয়েছিল। তাই মনে হচ্ছে যে, গোয়ালা ব্যাটার কথাগুলো মিথ্যা নাও হ’তে পারে। কিন্তু ওপরওলাকে কি জবাব এখন দেব তাই ভাবছি!”

    একটু ভেবে শিখা বলল, ”সেই গোয়ালাকে একবার পাওয়া যায় না? তাকে আমি একবার গোটা কয়েক কথা জিজ্ঞাসা করতুম।”

    ”খুব পাওয়া যাবে। এখনই তাকে ডাকতে পাঠাচ্ছি।”

    তখনই শিবনাথের খোঁজে থানা থেকে গাড়ী ছুটল। শিখা বলল, ”মৃতদেহের যে ছবি তোলা হয়েছে, তার এক কপি দেখতে পারি?”

    ”নিশ্চয়!” বড়বাবু ফাইল থেকে কয়েকখানা ছবি বের করলেন। মৃতদেহটা বিভিন্ন ভঙ্গিতে রেখে তোলা হয়েছে সেই ছবিগুলো। শিখা নিজের কাছের ছবিখানা বের করে সেগুলোর সঙ্গে মেলাতে বসল।

    বড়বাবু হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ছবিগুলোর উপরে। কিন্তু ছবি রেখে কিছুই ঠিক করতে পারলেন না। শিখা তখন ছবিগুলো তাঁর হাতে তুলে দিয়ে বলল, ”দেখুন ভাল করে।”

    বড়বাবু অনেকক্ষণ দেখলেন, কিন্তু কিছুই ঠিক করতে পারলেন না।

    শিখা বলল, ”নিহত লোকটি যেই হোক, সে যে সবিতার সেই নিরুদ্দিষ্ট স্বামী নয় একথা আমি জোর করেই বলতে পারি।”

    বড়বাবু শিখার কথায় সায় দিতে পারলেন না। বললেন, ”বুঝবার কিছু উপায় নেই যখন, তখন জোর করে বলি কি করে? যাই হোক, জামা আর একপাটি জুতো যখন পাওয়া গেছে, ঐ থেকেই সনাক্ত হয়ে যাবে। যাদের লোক হারিয়েছে, তারাই ছুটে আসবে থানায়। আমি প্রতিমুহূর্ত্তে আশা করছি কেউ না কেউ আসবে।”

    ”সে কথা একশবার—বাড়ী থেকে একটা লোক নিরুদ্দেশ হয়ে গেল, খবরের কাগজে এত বড় চাঞ্চল্যকর ঘটনা প্রকাশ হ’ল, তারপরও বাড়ীর লোক খোঁজ নেবে না, এ কখনো সম্ভব হ’তে পারে না। আপনি জামাটা আর জুতাটা একবার বের করে দিন না। আমি একবার দেখি।”

    বড়বাবুর আদেশে সযত্নে রক্ষিত এক পাটি জুতা আর একটি হাফ—সার্ট একজন কনেষ্টবল এনে দিল। জুতাটা রোদে শুকিয়ে রাখা হয়েছে। জামাটা শুকনো খড় খড় করছে, শুধু রোদে দিয়ে শুকিয়ে তুলে রাখা হয়েছে। জামাটা বিবর্ণ হয়ে গেলেও ওটা যে সাদা রঙের ছিল, সেটুকু বুঝতে কষ্ট হয় না। বড়বাবুও এ সম্বন্ধে শিখার সঙ্গে একমত হলেন।

    কিছুক্ষণ পরে গেঞ্জী গায়ে, খালি পায়ে শিবনাথ এসে হাজির। বড়বাবু বললেন, ”ঐ সেই গয়লা ব্যাটা এসেছে! ব্যাটা খুনটা দেখলি দাঁড়িয়ে আর শেষটুকু দেখলি না!—তা হলে ত আর এই দোটানায় পড়ে আমাদের হাবু—ডুবু খেতে হ’ত না।”

    শিবনাথকে শিখা বেশ করে আপাদ—মস্তক দেখে নিল। বেশ চালাক—চতুর বলেই মনে হ’ল তাকে। কিন্তু খুব ভয় পেয়ে গেছে সে মনে—মনে।

    শিখা বেশ মোলায়েম ভাবে বলল, ”কিছু ভয় নেই তোমার—তুমি থানায় এজাহার দিয়ে ভালই করেছ। তুমি বেশ স্পষ্ট দেখেছিলে ত গুণ্ডার হাতে একটা লোক খুন হয়ে গেল?”

    ”হ্যাঁ।”

    ”কিন্তু একটা লোক যখন বুঝতে পারছে যে, সে মরছে, তখন সে কি একটা কথাও বলল না? যা গুণ্ডারাও কোন কথা বলল না? এমন ত হয় না। নিশ্চয়ই কোন কথাবার্ত্তা হয়েছিল—তুমি তার কিছু শুনতে পেয়েছিলে?”

    ”হুঁ।”

    ”হুঁ।—তবে যে ব্যাটা এজাহারের সময় বললি, কিছু শুনিনি!” বড়বাবু রেগে চাইলেন শিবনাথের দিকে।

    কাঁদো—কাঁদো হয়ে শিবনাথ বলল, ”মাপ করবেন বাবু, তখন একেবারে বেস্মরণ হয়ে গিয়েছিলুম।”

    শিখা বড়বাবুকে চোখ টিপে দিতে বড়বাবু চুপ করে গেলেন।

    শিখা বলল, ”কি বলেছিল?”

    ”বলেছিল—তোমরা ছুরি বের করেছ—সত্যিই কি আমাকে খুন করবে? তোমাদের দলে থাকতে আমার ভয় করে।”

    ”হুঁ। গুণ্ডারা কি বলল?”

    একজন বলল, ”শত্রুর শেষ রাখলে পরে ভুগতে হয়—শেষ করে দাও ওটাকে!”

    ”সো মেনি ওয়ার্ডস!”—বড়বাবু লাফিয়ে উঠলেন, ”তবে তো কালপেবল হোমিসাইড! মার্ডার! কিন্তু—”

    ”আর কিন্তু নয় স্যর, আপনাকে একটু কষ্ট দেবো। আমি একবার স্পটে যাবো। তার আগে কয়েকটা কেমিকেল আমি কিনতে পাঠাবো—একজন বিশ্বাসী লোক দিন।”

    শিখার কথায় বড়বাবু সন্তুষ্ট হলেন; আশ্চর্য্যও হলেন খুব। যে বিষয়টা নিয়ে এত ভাবছিলেন, একজন তরুণী ডিটেকটিভ অতি সহজে তার সমাধান করে দিল—আশ্চর্য্য হবার কথা বটে!

    শিখা তার ব্যাগের ভিতর থেকে ছোট কাগজে লেখা একটা কেমিকেল ফরমুলা বের করল। আগে থেকেই সে তৈরী হয়ে এসেছে। ফরমুলার জিনিষের ওজনগুলো একটু—আধটু কম—বেশী করে দিয়ে বলে দিল, ”ডাক্তারখানায় সবই পাওয়া যাবে।”

    জিনিষগুলো আনতে দিয়ে পুলিশ—বাহিনীর সঙ্গে শিখা লেকের ধারে গিয়ে হাজির হ’ল। যে জায়গায় মৃতদেহ ভেসে উঠেছিল, সেখানে একজন কনষ্টেবল তখনও পাহারায় রয়েছে।

    মনে মনে শিখা ভাবল, এদিকে তোড়জোড়ের কিছু কমতি নেই কিন্তু আসল কাজই শুরু হয়নি। শিবনাথকে বলল, ”তুমি সাঁতার জানো?”

    শিবনাথ ঘাড় নেড়ে জানাল, জানে।

    ”কতক্ষণ ডুবে থাকতে পারো?”

    ”আগে অনেকক্ষণ পারতুম, এখন দম কমে গেছে।”

    ”বেশ, এইখানটাতে ডুব দাও—বেশ চারপাশ হাতড়ে দেখবে, যা হাতে ঠেকবে, তাই তুলবে। এই ধার থেকেই আরম্ভ কর।”

    দু—একবার ডুব দেবার পর কিছুই পেল না শিবনাথ।

    শিখা বলল, ”এবার একটু একটু করে এগিয়ে যাও।”

    বড়বাবু বললেন, ”কি আর পাবে ডুব দিয়ে? কি পাবার আশা করেন আপনি?”

    শিখা বলল, ”নিশ্চয়ই এমন কিছু পাওয়া যাবে, যাতে আমাদের তদন্তের অনেক সাহায্য হবে।”

    হুস করে উঠে পড়ে শিবনাথ বলে, ”পেয়েছি একটি জিনিস। কিন্তু এত ভারী সে তুলতে পারলুম না। এবারে ঠিক তুলবই।” শিবনাথ আবার ডুব দিল। উত্তেজনায় শিখার মুখ আরক্ত হয়ে উঠল। বলল, ”যা পাবার আশা করছিলুম, ঠিক তাই পেয়েছি। নিশ্চয়ই একটা কলসী বা ভারী কোন জিনিষ খুনের পর মৃতদেহের গলায় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল! ছবিতে আমি চিহ্ন পেয়েছি।”

    কয়লা—ওজন করবার আধমনি একটা বাটখারা শিবনাথ এক—এক ডুবে একটু একটু করে টানতে টানতে পাড়ে এনে ফেলল। একটা শক্ত দড়ি ওটার আংটায় এখনও বাঁধা রয়েছে।

    উত্তেজনায় বড়বাবুও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন! তিনি করমর্দ্দনের জন্য শিখার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন, শিখাও ইতস্ততঃ করল না, নিজের হাত বাড়িয়ে দিল।

    করমর্দ্দন করবার পর বড়বাবুর হয়ত জ্ঞান হ’ল, শিখা মেয়েছেলে, তাতে কুমারী—তরুণী! তিনি অপ্রস্তুত হয়ে শিখার দিকে চাইলেন।

    শিখা বুঝল বড়বাবুর অবস্থা। বলল, ”আপনি আমার বাবার মত। বয়সেও সেই রকম—আপনার পায়ের ধুলো নেওয়া আমার উচিত। আশীর্ব্বাদ করুন, আমি যেন খুনীদের গ্রেপ্তার করে এনে দিতে পারি।” শিখা বড়বাবুর পায়ের ধুলো নিল। বড়বাবু অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন শিখার দিকে।

    চার – শিখার বাহাদুরি

    থানায় ফিরে এসে শিখা কেমিকেলগুলো খুব সাবধানে মিশিয়ে জলে গুলে একটা সলিউশন তৈরী করে নিল। তারপর জামাটা ভালভাবে সেই সলিউশনের জলে ডুবিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে জামার ওপর দু—রকম রঙের ছাপ ফুটে উঠল। একটা রঙ হ’ল সাদা মত, আর একটা রঙ হ’ল ফিকে হলদে মত। ফিকে রঙটা ছাবকা ছাবকা হয়ে সারা জামা জুড়ে ফুটে উঠেছে। লাল কালির একটা কলম তুলে নিয়ে শিখা ঐ ফিকে জায়গাটা বর্ডার টেনে মার্কা করে দিল। বলল, ”এই এই জায়গায় রক্তের দাগ ছিল।”

    জামার বুকের কাছে আঙুল দিয়ে বলল, ”এখানটাতে ছুরির ঘা পড়েছিল। যে লোকটা ছুরি চালিয়েছে, তার এনাটমির জ্ঞান আছে ভালই। একেবারে হৃৎপিণ্ডের ওপরে গিয়ে পড়েছিল আঘাতটা। দুটো ঘা মারার আর দরকার হয়নি। সেও ভালভাবে জানত, একটা ঘা—ই মোক্ষম হয়েছে, ওতেই কাজ হাসিল হয়ে গেছে।”

    বড়বাবু শিখার কথা শোনেন আর তার মুখের দিকে চেয়ে থাকেন অবাক হয়ে। প্রবীণ গোয়েন্দার মতই কথা বলে সে! তারপর আর সময় নষ্ট না করে তদন্তের ফলাফলগুলো ভাল করে গুছিয়ে লম্বা রিপোর্ট তৈরী করতে আরম্ভ করলেন। এমন সুন্দরভাবে তদন্ত হয়েছে, ওপরওলার কাছ থেকে একটা রিওয়ার্ড, পরে প্রোমোশন—অনেক কিছু আশা করেন তিনি।

    ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মীরা এসে পড়ল—সঙ্গে সবিতা। সবিতা আসতে চায়নি প্রথমে। সে ধরে নিয়েছে, তারই সর্ব্বনাশ হয়ে গেছে! তবুও মীরা ছাড়েনি, তাকে ধরে এনেছে।

    সবিতার আলুলায়িত কেশ। বড় বড় চোখ দুটো জবাফুলের মত লাল, গাল বেয়ে জলের ধারা নেমেছে, সারা রাস্তা সে কাঁদতে কাঁদতে এসেছে।

    বড়বাবু মুখ নীচু করলেন। সিঁথিতে সিঁদুরের দাগ তখনও তার জ্বলজ্বল করছে। সদ্য—স্বামীহারা তরুণীর সেই মুখ—থানার প্রত্যেকেরই চোখের পাতা ভিজে গেল। সকলেই মুখ ফিরিয়ে নিল।

    শিখা গম্ভীর হয়ে জামাটা দেখাল। দু’হাতে মুখ ঢেকে সবিতা চাপা সুরে কেঁদে উঠল।

    ”আপনি ঠিক চিনতে পেরেছেন?” শিখা জিজ্ঞাসা করল!

    ঘাড় নেড়ে সবিতা বলল, ”হাঁ।”

    তারপর জুতাটা দেখাতেই আছড়ে পড়ল সবিতা। কান্নার মাঝেই বলল, ”দেখুন ওর তলায় নতুন হাফ—সোল মারা আছে, ও রবিবারে হাফ—সোল দেওয়া হয়েছে।”

    বড়বাবু তাড়াতাড়ি জুতাটা নিজের হাতে উল্টে দেখলেন। সত্যই অল্পদিন আগে হাফ—সোল দেওয়া হয়েছে জুতাটায়।

    মুখ থেকে হাত নামিয়ে সবিতা বলল, ”আমার আর দেখবার কিছু নেই, এবারে আমাকে পৌঁছে দিন শিখা—দি। যদি আপনি নিজে যেতে পারেন তবে বড় ভাল হয়। আমার বড় ভয় করছে।”

    শিখা অনেকক্ষণ ধরে সবিতার মুখের দিকে চেয়ে রইল। তার আপাদ—মস্তক নিরীক্ষণ করে আরো গম্ভীর হয়ে বড়বাবুকে বলল, ”দুজন জোয়ান আর্মড কনষ্টেবল সঙ্গে দিয়ে পুলিশের গাড়ীতে সবিতাকে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করুন স্যার। আমাদের হাতে এখন অনেক জরুরী কাজ রয়েছে।”

    ”আমার ছবিখানা ফিরিয়ে দিন শিখা—দি।” সবিতা বলল।

    ”ওটা এখন দিতে পারব না ভাই, তদন্ত শেষ হলে আমি নিজে গিয়ে দিয়ে আসব।”

    ”না শিখা—দি, ওটা আমি ছাড়তে পারব না। আমার আর একখানাও ফটো নেই! আমার স্বামীর শেষ চিহ্ন!”

    বড়বাবু বললেন, ”আচ্ছা, দিয়ে দিন।”

    শিখা জানে, এ ছবির কপি আছে, তবুও মূল ছবিটার ওপর ঝোঁক ছিল, শিখার! অনিচ্ছাসত্ত্বেও শিখা ছবিখানা দিয়ে দিল। জিজ্ঞাসা করল, ”কোন জুট মিলে আপনার স্বামী কাজ করতেন?”

    ”শ্রীরামপুর জুট মিলে তিনি কেরাণীর কাজ করতেন। কোনরকমে দিন চলে যেত। এখন আমি অকূলে ভাসলুম।”

    সবিতা চলে যেতে শিখা বড়বাবুকে বলল, ”ব্যাপারটা খুব সহজ নয় স্যার। এই জামাটা যার গায়ে ছিল, তার ছাতির মাপ চল্লিশের বেশী। ঐ ছবির লোকটা লম্বা ধরণের; আর এই জামাটা যার, সে লোকটা বেঁটে। জামার ঝুলটাও কত ছোট।”

    ”কিন্তু নিজের স্ত্রী এসে সনাক্ত করে গেলেন, তার ওপর আর কি কথা থাকতে পারে?”

    ”সেই জন্যই তো বলছি, ব্যাপারটা এত সহজ নয়। আসল যে লোক খুন হয়েছে, তার নাগালের অনেক বাইরে আমরা ঘুরে মরছি।”

    বড়বাবু রিপোর্ট লেখা বন্ধ করলেন। শিখার কোন কথাই অবিশ্বাসের নয়! সদ্য—পতিহারা সবিতাকেও অবিশ্বাস করা চলে না! বেশ একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন তিনি।

    শিখা বলল, ”চল মীরা, আমাদের এখানকার কাজ মিটে গেছে। আমাকে এবার বিদায় দিন স্যার।”

    শিখা—মীরা উঠে দাঁড়াল; একটুও সময় নষ্ট না করে গিয়ে গাড়ীতে উঠল। যতক্ষণ না ওদের গাড়ী দৃষ্টির বাইরে গেল, ততক্ষণ বড়বাবু সেই দিকে চেয়ে রইলেন।

    * * * *

    বেলা আন্দাজ তিনটা। শ্রীরামপুর জুট মিলের ফটকের সামনে শিখার গাড়ী এসে দাঁড়াল। দুদিক থেকে শিখা আর মীরা গাড়ী থেকে নেমে পড়ল। শিখা বলল, ”গাড়ী সব সময়ে লক করে রাখবি।”

    মীরা গাড়ীতে চাবি দিয়ে দিল। গেটের দরোয়ান অভিবাদন করতেই শিখা তার নামের কার্ডখানা দিয়ে বলল, ”ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।”

    দরোয়ান সেলাম দিয়ে বলল, ”বড় সাহেব নেই, ছোট সাহেব আছেন।”

    তাঁর সঙ্গেই দেখা করতে চাইলে দরোয়ান ভিজিটর্স রুমে ওদের বসিয়ে কার্ড নিয়ে চলে গেল।

    ছোট সাহেব বাঙালী। তাঁর খাশ—কামরায় ডাক পড়ল শিখাদের। একজন লেডি টাইপিষ্ট—বাঙালী মেয়ে—খট খট করে টাইপ করে যাচ্ছিল এক কোণে বসে। মেয়েটি বেশ চটপটে।

    শিখাদের ঢুকতে দেখে সে একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, তারপর আবার নিজের কাজে মন দিল।

    নমস্কার বিনিময়ের পর শিখা বলল, ”দেখুন, আমি এমন একটা কাজে এসেছি, যেটা খুব গোপনীয়। আমি চাই না এখানে আর কেউ থাকে! এমন কি আপনার টাইপিষ্টও নয়।”

    টাইপিষ্ট কাজ বন্ধ করে ছোট সাহেবের দিকে একাগ্র দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল। ছোট সাহেব তার দিকে চেয়ে ইসারায় তাকে বাইরে যেতে বললেন।

    টাইপিষ্ট বাইরে গেলে শিখা বলল, ”আমার কার্ড আপনি পেয়েছেন! পরিচয় দেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইনি আমার এ্যাসিষ্ট্যাণ্ট মিস্ মীরা মিত্র।” মীরা আর একবার নমস্কার করল। সাহেবও সহাস্যবদনে নমস্কার করলেন। বললেন, ”এবারে বলুন, কি কাজ?”

    ”একজন কেরাণী…নাম শৈলেন চক্রবর্ত্তী…এখানে কাজ করেন। এই তাঁর ছবি, তাঁকে আপনি চেনেন?”

    ”না”—ঘণ্টা বাজিয়ে বেয়ারা ডাকলেন সাহেব।

    ”ক্যাশিয়ার—বাবুকো বোলাও। তিনি চিনতে পারবেন। এঁরই সেকসনে তাকে নেওয়া হয়েছিল ক—মাস আগে। ছোকরা নাকি বাড়ী থেকে উধাও হয়েছিল। আজ শুনছি, কলকাতায় লেকের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেছে।”

    ”হাঁ, তার কথাই বলছি।” শিখা বলল।

    ক্যাশিয়ার—বাবু এলেন। ছবিটা দেখে বললেন, ”হাঁ, এই লোক।”

    ”আপনি আর একটু দাঁড়ান। জামাটা, মীরা?” মীরা ব্যাগ থেকে জামাটা বের করে দিল।

    ”এই জামাটা কি সে গায়ে দিয়ে আসত?”

    ঘাড় নেড়ে ক্যাশিয়ার বললেন, ”না—কখনই নয়। সে ফুল বাবু। আদ্দির জামা আর কাঁচি ধুতি ছাড়া পরতই না। পায়ে থাকত বার্ণিশ—করা লপেটা।”

    ”আচ্ছা, আপনি যেতে পারেন।” শিখা নিশ্চিন্ত হ’ল।

    শিখা বলল, ”এবার একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা আপনাকে জিজ্ঞাসা করব। আপনাদের টাকা কোন ব্যাঙ্কে থাকে?”

    ”বেশীটা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে আর কিছু কিছু থাকে এধারে—ওধারে ছড়ানো।”

    ”বেশ। একসঙ্গে একবারে কত টাকা তোলা হয়? আর কোন তারিখে তোলা হয়?”

    ”প্রত্যেক শুক্রবারে হপ্তার টাকা তোলা হয়। শনিবারে শনিবারে এখানকার ‘ওয়েজেজ পেমেণ্ট’ হয়। তবে বেশী টাকা তোলা হয় মাসের শেষ দিকে। ঐ সময় কেরাণীবাবুদের পেমেণ্ট করতে হয় কিনা!”

    ”এবারে যেদিন বেশী টাকা তোলা হবে, তার আগের দিন যদি সম্ভব হয়, খুব গোপনে আমাকে খবর দেবেন। আমার একটু দরকার আছে।”

    ”এ খবর অবশ্য আমাদের খুব গোপন রাখা হয়। টাকা যে আনবে, সে আগের দিনেও জানতে পারে না। দিনকাল যে রকম পড়েছে।”

    অভিবাদন করে শিখা আর মীরা বিদায় নিল। সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল লেডি টাইপিষ্ট। নিজের সীটের দিকে না গিয়ে টাইপিষ্ট গিয়ে দাঁড়াল ছোট সাহেবের চেয়ারের পাশে। বলল, ”ওরা এসেছিল কেন?”

    ছোট সাহেব বললেন—”যে কেরাণীটা আত্মহত্যা করেছে, তার সম্বন্ধে খোঁজ নিচ্ছিল।”

    টাইপিষ্ট বললে, ”আত্মহত্যার আবার খোঁজ কি? এখানে কটা টাকা মাইনে পেত, অথচ কি বাবুগিরি! টাকা—কড়ি ভাঙ্গেনি ত মিলের? ক্যাশে কাজ করতো।”

    ছোট সাহেব বললেন, ”বোধ হয়, না। কিন্তু এসব কথা থাক—কাজ কর।”

    দরজায় আঙুলের টোকার শব্দ হ’ল।

    ”ইয়েস, কাম ইন”—একজন কর্ম্মচারী কি সব কাগজ—পত্র নিয়ে এসে বসলেন ছোট সাহেবের সামনে। ওদিকে টাইপিষ্ট তখন টাইপ করে চলেছে খট…খট খট…খট…

    পাঁচ – নিরাপদ ঘাঁটি

    কলকাতার বড়তলা থানার এলাকার পশ্চিম দিকটা গুণ্ডা বদমায়েসের আড্ডা। থানার পুলিশের তা অজানা নয়। গুণ্ডাদের সকলকেই থানার অফিসাররা ভালো চেনেন। কোন দিন এই এলাকায় কোন গোলমাল হলে পরের দিন গুণ্ডাদের থানায় আনিয়ে অফিসার একটু ধমক দিলেই তারা কিছু দিনের জন্য আবার শান্ত হয়। তবে যে সব গুণ্ডাকে আয়ত্তে আনা সম্ভব হয় না, তাদের সহর থেকে বের করে দেবার হুকুম ম্যাজিষ্ট্রেটের কাছ থেকে বের করে নিয়ে এক্সটার্ণড্ গুণ্ডার দলে ফেলে দেওয়া হয়।

    এ ধরণের গুণ্ডাদের কোন সামাজিক জীবন নেই, সমাজেরও কোন ক্ষতি এরা করে না। কিন্তু পুলিশকে এদের ওপর খুব কড়া নজর রাখতে হয়। প্রত্যহ রাত্রে একবার—দুবার বাঁশ—গাড়ী ঘুরিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ এই এলাকা দিয়ে। আসল গুণ্ডারা এই বাঁশ—গাড়ীকে গ্রাহ্য করে না; এড়িয়ে চলতে জানে।

    এই এলাকার ওপর পুলিশের কড়া নজর থাকলেও কুচরিত্রের স্ত্রী—পুরুষরা এইখানেই আড্ডা জমাতে চায়। ভদ্র পল্লীতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে পারে না বলেই স্থানটি তাদের পক্ষে প্রশস্ত। মদ—ভাং, বড়ঘরের ছেলেকে ভুলিয়ে এনে হুণ্ডি—কাটানো, কিছুরই বাধা নেই এখানে। এক—এক বাড়ীতে পনের—বিশ ঘর পরিবার বাস করে অথচ পাশের ঘরে কি হচ্ছে, পাশের ঘরের লোকের তা জানবার উপায় নেই। সমাজের মাঝে অদ্ভুত এক উপসমাজ!

    এই পল্লীরই এক গলির মুখ থেকে একটা বড় বস্তী। পাশাপাশি অনেকগুলি একতলা খোলার বাড়ী নিয়ে এই বস্তী। বস্তীর শেষে একটি মাটকোঠা—দোতলা টালির বাড়ী। তার পরেই একটা দোতলা পাকা বাড়ী।

    এই দোতলা বাড়ীর মালিক এক বর্ষীয়সী মহিলা। তার বয়স অনুমান করা যায় না। চুলে পাক ধরেছে বটে, কিন্তু সারা দেহে ঠসক খুব। গায়ে যে দু—একখানা গহনা আছে, তা বেশ ভারী ভারী আর মানানসই। বাড়ীর দোতলার জানালায় একটা প্লাকার্ড টাঙানো রয়েছে, ”ঘর খালি আছে”।

    একটি ছোকরা সেই বাড়ীর সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল, হঠাৎ দোতলার দিকে চোখ পড়তেই থমকে দাঁড়াল। জানালায় ঝোলানো লেখাটি আর একবার পড়ে আস্তে আস্তে এসে কড়া নাড়ল।

    একজন ঝি এসে দরজায় দাঁড়াল।

    আমতা—আমতা করে ছোকরাটি জিজ্ঞাসা করল, ”ঘর খালি আছে? একখানা ঘর কত ভাড়া?”

    ”আছে। গেরস্থ—বাড়ী—নটায় সদর বন্ধ হয়ে যায়।”

    ”আমি তার আগেই কাজ থেকে ফিরি। এখান থেকে ছাপাখানা কাছেই হবে, তাই বলছিলুম।”

    ”দাঁড়াও, বাড়ীউলি—মাকে ডাকি।” ঝি চলে গেল।

    ”কই গো দেখি, এদিকে এসোনা!” খনখনে আওয়াজে চারদিক কাঁপিয়ে বাড়ীউলি দেখা দিল।

    ”কই, মেয়েছেলে আসেনি?—কার বাড়ীতে আছো এখন?”

    ”এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আছি। সেখানে সুবিধে হচ্ছে না। ছেলেপুলে নেই, শুধু আমরা দুজন।”

    ”বেশ, বেশ—গেরস্থ—বাড়ী কিন্তু, নটায় সদরে চাবি পড়ে।”

    ”আমি তার আগেই কাজ থেকে ফিরি।”

    ”এই যে ঘর। বারো টাকা দিও আর লাইটের তিন টাকা, ধাঙড়, মেথর, পালা এক টাকা। পাখা নেবে নাকি?”

    ”না, সামান্য চাকরি করি, পাখা নেব কোত্থেকে!”

    ”বেশ বেশ, আয় বুঝেই ত চলা ভাল। আগাম কিছু দিয়ে যাও, ঘর—দোর ধুইয়ে মুছিয়ে রাখি। তোমার নাম কি?”

    পকেট থেকে একখানা পাঁচ টাকার নোট বের করে ছোকরা বলল, ”অনন্তকুমার মিত্তির। এই কাছেই কালী—গঙ্গা আর্ট প্রেসে কাজ করি। নতুন ঢুকেছি। দেশে ঘর—বাড়ী আছে। কাজ—কর্ম্ম কলকাতায়। একটা বাসা না রাখলে চলে না।”

    ”তা ত বটেই, বিয়ে করেছ,—বৌকে কোথায় ফেলে রাখবে? এ—বয়সে সাধ—আহ্লাদ করবে না? তা হলে আজই ত আসছো?”

    ”হাঁ। ছাপাখানায় আজ ছুটি নেব।”

    ”বেশ, বেশ! ওরে কুসমি, ঘর ভাল করে ধুয়ে রাখ—আজ আমার বাড়ী ভর্ত্তি হ’ল। আর টাঙিয়ে দে, ঘর খালি নেই।”

    দুপুর বেলা একখানা ঠেলা—গাড়ী আর একখানা রিক্সা একসঙ্গেই এসে পড়ল। ঠেলা—গাড়ীতে মালপত্র বিশেষ কিছুই নেই। একটা নামমাত্র বিছানা, সামান্য রান্নার সরঞ্জাম, একটা তোরঙ্গ আর একটা স্যুটকেশ। তোলা উনুনটা খুব সাবধানে নিজে হাতে করেই ঘরে রেখে এল অনন্ত মিত্তির। কুসুম এসে সাহায্য করল জিনিসপত্র নামাতে। এরা ঘর গোছাতে ব্যস্ত—কুসুম গিয়ে বাড়ীউলির কাছে রিপোর্ট দিল—”একেবারে কচি বৌ গো মা, আর মুখখানা দুর্গা প্রতিমার মত। বিয়ে করা বৌ ত? এ পাড়ায় বাসা নেয় সিঁদুর—আলতার চটক থাকলে কি হয়, ভয় করে মা! শেষে পুলিশ—হাঙ্গামা না হয়!”

    ”তুই থাম! সকলকে তোর সন্দ!”

    কুসুম চুপ করে গেল।

    রাত নটায় সদর বন্ধ করে বাড়ীউলি বিছানা নিলেন। কুসুম পায়ের কাছে পদসেবায় বসে গেল। বাড়ীউলি ঘুমোলেই তার ছুটি। ওদিকে বাড়ীর অন্য ভাড়াটেরা সব একখানা ঘরে আড্ডা জমিয়েছে। সদর বন্ধ হয়ে গেছে, বাইরে থেকে আর কেউ আসবে না, কাজে কাজেই এটা এখন ভাড়াটেদের নিজেদের একটা রাজত্ব বললেই চলে! ভাড়াটেদের মধ্যে মিলও খুব। হাসি গল্প ইয়ার্কিতে রাত ভোর করে দেয়, পরস্পরে ঝগড়া বা মনোমালিন্য হয় না। এ বাড়ী থেকে কোন দিনের জন্য কোন গণ্ডগোল শোনা যায় না। বাড়ীর সুনামে বাড়ীউলির গর্ব্বেরও শেষ নেই।

    একতলার নতুন ভাড়াটের কথাই ওদের মধ্যে সেদিন আলোচনা হচ্ছিল। যমুনা বলল, ”কে আবার বাইরের লোক এলো! রাণীদি পছন্দ করে না।…হোক স্বামী—স্ত্রী…এত জায়গা থাকতে এ বাড়ীতে?”

    ”বাড়ী কি কলকাতার সহরে মেলে এখন? বলে, ছিটে—বেড়ার আস্তাবলও মানুষ ভাড়া করে বাস করছে।”

    ”স্বামীটা পুলিশে কাজ করে না ত?”

    ”আহা, না, না—সে সন্ধান নিয়েছি। ছাপাখানায় কাজ করে।”

    ”ভাল কথা, তোমাদের মিটিং কবে? রাণীদি আসবেন ত?”

    ”সময় ত এগিয়ে এল। এখন পর—পর মিটিং—হয়ত রোজই।”

    ”মিটিংই হচ্ছে—কাজ হচ্ছে কটা?—আমি ত বেকার বসে আছি!”

    ”রাণীদির কাছে যাও না শ্রীরামপুরে—একসঙ্গে থেকে রাণীদিকে বোঝাও, তোমার এলেম আছে! তেমন এলেম না বুঝলে রাণীদি কাজ দেয় না। তুমি ত এখনও এপ্রেণ্টিশ।”

    যমুনার দুচোখে যেন আগুনের ফুলকি…যমুনা চুপ করে গেল।

    ছয় – বাঘের গর্ত্তে

    অনন্ত মিত্তিরের ছোট সংসারটি বেশ গুছিয়ে নিয়েছে ছেলেমানুষ বৌটি। সকালে অনন্ত নিজের হাতে দোকান—বাজার সেরে চান করতে নামে; তার মধ্যেই যা রান্না হয়, তাই খেয়ে ছাপাখানায় বেরিয়ে যায়। তখন অন্য ভাড়াটেদের ঘুমই ভাঙে না। ছোট্ট বৌটির কাজ—কর্ম্ম খাওয়া—দাওয়া শেষ হয়ে গেলে উঠানে, কলতলায় দু—একজন করে নামতে থাকে। কাঁচের গ্লাস, বাসন, পিকদানি, ছাই ফেলার পাত্র ডাঁই হয়ে জমে ওঠে উঠানে; ঝিয়েরা দু—একজন করে কাজ সেরে নিতে থাকে। তারপর নামে ভাড়াটে মেয়েছেলেরা—বাঁ হাতে ঘটি—গামছা আর ডান হাতে দামী সাবান। সকলেরই চেহারা বেশ চকচকে, গায়ে গয়না।

    ”বাবু বেরিয়ে গেছে?” একজন মেয়েছেলে জিজ্ঞাসা করল। বউটি ঘাড় নেড়ে বলল, ”হ্যাঁ।”

    ”তোমার নাম কি ভাই?”

    ”লতিকা।”

    ”সারাদিন একলাটি কর কি? ঘরে চাবি দিয়ে ওপরে চলে এসো না কেন আমাদের ঘরে!”

    ”উনি পছন্দ করেন না।”

    একটু হেসে মেয়েটি বলল, ”আহা, উনিকে নিয়েই না হয় এসো।”

    ”বড্ড লাজুক—মিশতে চান না কারুর সঙ্গে।”

    ”প্রথম প্রথম লজ্জা করবে। দুদিন যাওয়া—আসা করে ভাব হলে আর লজ্জা থাকবে না।”

    বউটি একটু হাসল বটে, কিন্তু এই পরিবেশ তার যেন ভাল লাগে না। এর চেয়ে দূর—সম্পর্কের মামী—শাশুড়ীর ঝাঁটা—লাথি খাওয়া ঢের ভাল ছিল। তাড়াতাড়ি ঘরের দরজায় খিল দিয়ে একটা মাদুর পেতে শুয়ে পড়ল। সত্যিই শুয়ে বসে আর সময় কাটে না! যতক্ষণ না অফিস থেকে ফেরে অনন্ত, ততক্ষণ লতিকার বড়ই অস্বস্তি বোধ হয়। সারাদিন বাড়ীটা যেন ঘুমিয়ে থাকে। কোথাও কারুর সাড়াশব্দ নেই। সন্ধ্যার পর থেকেই লোক—জনের যাওয়া—আসা সুরু হয়। নটার পর থেকে ঘুমন্ত বাড়ীটা আবার জেগে ওঠে। তখন অনন্ত আর লতিকা খাওয়া—দাওয়া সেরে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়েছে, না হয় গল্প করছে। বাড়ীর অন্য সকলে কে কি করছে, সেদিকে ফিরেও তাকায় না ওরা।

    লতিকা বলি বলি করে ক’দিন বলতে পারছিল না, সেদিন বলে ফেলল, ”দেখ, এখানে আমার ভাল লাগছে না। এরা বোধ হয় খারাপ লোক। এখানে থাকা আমাদের চলবে না।”

    অনন্ত বলল, ”যে খারাপ, সে তার নিজের ঘরে খারাপ। ঝগড়া—ঝাঁটি না হলেই হ’ল। অফিসের কাছে এরকম ঘরই বা পাচ্ছি কোথায়? পুকুরের মত জলের চৌবাচ্চা!”

    লতিকা চুপ করে যায়—স্বামীর বুকের কাছে আরো সরে আসে।

    * * * *

    সে—দিন দোতলায় খাওয়া—দাওয়া হৈ—হল্লার ঘটা খুব। বিকাল থেকে তার আয়োজন চলছিল। ঝিয়েরা অনেক বার দোকানে—বাজারে ছুটল। বাইরের লোকজনও নাকি আসবে দু—চারজন।

    রাত ন’টায় নিয়মিত সদর বন্ধ হ’ল, তার আগেই নিমন্ত্রিতেরা সব ওপরে জমা হয়েছে। তাদের কথাবার্ত্তা শোনা যাচ্ছে। তার আগেই লতিকার ঘরে খিল পড়ে গেছে। পরের ব্যাপারে মাথা—ব্যথার কি দরকার ওদের?

    ওপরের সবচেয়ে বড় ঘরটায় ঢালা বিছানার উপর সকলে বসেছে। একটা সোফার ওপর দামী বেনারসী—শাড়ী পরা একটি মেয়ে, সর্ব্বাঙ্গে তার গয়না—হীরেগুলোতে আলো পড়ে ঝকঝক করছে। রাণীর মত সেজে গম্ভীরভাবে বসে আছে সে।

    ”নারাণদা আসবেন না রাণীদি?”

    ”আসবার ত কথা রয়েছে। তার জন্যই ত অপেক্ষা করছি।”—ভারিক্কি চালে জবাব দিল মেয়েটি।

    ”সদর যে বন্ধ হয়ে গেল!” আর একজন বলল।

    ”তার কাছে আবার খোলা আর বন্ধ! আসবার হলে ঠিক আসবে।” এবারে হাসল রাণী। তার সঙ্গে সঙ্গে সকলেই হাসল।

    ”মিটিংয়ের কাগজপত্রগুলো দাও।”—রাণী হুকুম দিল।

    একজন মেয়েছেলে উঠে দেরাজ খুলে একটা ফাইল আর একটা ফাউণ্টেন পেন বের করে টিপয়ের উপর রাখল; টিপয়টা সরিয়ে সোফার সামনে রেখে দিল। ফাইলটা তুলে নিয়ে গভীর মনোযোগে রাণী তার পাতা ওলটাতে লাগল।

    কিছুক্ষণ পরে হঠাৎ ছাদের ওপর ধুপ করে একটা শব্দ হল। শব্দটা সকলেই শুনেছে। কান—খাড়া করে কেউ বলল, ”কি ব্যাপার?”

    রাণী ফাইল বন্ধ করে বলল, ”কিছুই না—মূর্ত্তিমান এলেন।”

    রাণীর কথাই সত্যি। ঘরের দরজা ঠেলে একজন ছিপছিপে লোক ঢুকল। গায়ে গিলে—করা পাঞ্জাবি, পরণে চুনট—করা কাঁচি ধুতি, পায়ে বার্নিশ—করা লপেটা।

    ”সকলেই হাজির, দেখছি।” নবাগত লোকটি এক পকেট থেকে বের করল একটা চকচকে রিভলভার আর এক পকেট থেকে একটা বিলাতী মদের সুন্দর ফ্লাস্ক। টিপয়ের ওপর সেগুলো রেখে সোফার একপাশে ধপ করে বসে পড়ল।

    রাণী মদের শিশিটা তুলে নিয়ে ভাল করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে একজনকে কি ইঙ্গিত করতে সে উঠে কাচের গ্লাস, সোডার বোতল, ছিপি—খোলার চাবি, সিগারেটের টিন বের করে মেঝেতে সাজিয়ে রাখল।

    রাণী তার কাগজ—পত্র সোফার ওপর তুলে নিয়ে টিপয়টা গ্লাস—বোতলের জন্য খালি করে নিজের হাতে পানীয় পরিবেষণ করতে লাগল। সকলকে পরিবেষণের পর সভার কাজ আরম্ভ হ’ল।

    রাণীই কথা বলল প্রথমে। ”গোবিন্দ ঠাকুরপো কোন ভাড়াটের কথা বলছিলে?”

    ”একতলায় নতুন ভাড়াটে এসেছে—বৌটা সুন্দর দেখতে।” গোবিন্দ বলল।

    ”কারুর কোন প্রস্তাব আছে?” রাণী জিজ্ঞাসা করল।

    ”জোর করে তুলে নিয়ে এসে আমাদের দলে ভর্ত্তি করা—তারপর ছোঁড়াটাকে উত্তম—মধ্যম ঘা—কতক দিলেই পালাতে পথ পাবে না!”—একজন প্রস্তাব করল।

    ”তা ছাড়া আবার কি?—চুনো—পুঁটির ব্যাপার।” আর একজন সায় দিল।

    ”কি নারাণবাবু, গম্ভীর কেন?”—ডান দিকে ফিরে চাইল রাণী।

    নারাণবাবু মৌজ করে সিগারেট টানছিল। বলল, ”উঁহু,—অজানা লোক নেওয়া নয়। আমরা শান্তিপ্রিয় ভদ্রলোক, সারাদিন খেটে—খুটে এসে একটু নিজেদের কাজ—কর্ম্ম করি—এর মধ্যে নতুন লোক।”

    ”দলে মেয়েছেলে আরও ভর্ত্তি হয় যদি—ভাল!”—রাণী আর একটা বোতল থেকে গেলাসে পানীয় ঢালতে সুরু করলে।

    ”কিন্তু কে ভার নেবে, আগে শুনি?”

    গোবিন্দ বলল, ”আমি আছি। আর একজনের নাম লটারি হোক।”

    লটারিতে নাম উঠল রেখার! রেখা হাসতে হাসতে বলল, ”কি দস্তুরী দেবে ঠাকুরপো?”

    ”সে তখন দেখো।”

    ”এখন ঠাট্টা—ইয়ার্কির সময় নয়—প্ল্যানটা তা হলে শুনে নাও।”

    ”বলুন নারাণদা, আমরা শুনছি।”

    প্ল্যানটা সকলেরই মনের মত হ’ল।

    পরের বিষয়টা উত্থাপন করল রাণী। সে বলল, ”এই শিখা মেয়েটিকে সরাতে হবে আমাদের পথ থেকে। মেয়েটা সাংঘাতিক বিচ্ছু। ও যে ভাবে আমাদের পিছনে লেগেছে তাতে মনে হচ্ছে যে, এখনই ওর সম্বন্ধে একটা ব্যবস্থা না করলে ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে। আমার ইচ্ছা দু’ একদিনের মধ্যেই ওকে কিডন্যাপ করে নিয়ে এসে শ্রীরামপুরের আড্ডায় বন্দী করে রাখবো। পারবে কেউ এ কাজের ভার নিতে?”

    ”হুকুম করুন।” বুক বাজিয়ে উঠে দাঁড়াল ভবানীপ্রসাদ।

    ”বেশ! কিন্তু তোমার প্ল্যান?”—রাণী তার মুখের দিকে চাইল।

    ”প্ল্যান আমার ঠিক আছে। আর ঐ শিখা মেয়েটাকেও আমার চেনা আছে। রিপোর্ট পেলুম, লেকের সেই মৃতদেহটা দেখে ও নাকি সন্দেহ করছে যে, ওটা শৈলেনের মৃতদেহ নয়!

    মেয়েটা ভারি চালাক। তবে ও যত চালাকই হোক, নারাণদা যদি আমাকে একটু সাহায্য করে তাহলে ওকে আমি কালই ধরে নিয়ে আসতে পারি।”

    নারাণচন্দ্র বললো, ”কি রকম সাহায্য চাও আমার কাছে?”

    ভবানী তখন তার কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন বলতেই সে খুশী হয়ে উঠে বলল, ”ঠিক আছে! ও ব্যবস্থা আমি নিশ্চয়ই করে দেব।”

    এই সময় রাণী ভবানীর দিকে তাকিয়ে বলল, ”যেমন করে পার ভবানী ঠাকুরপো, ওর একটা ব্যবস্থা কর।”

    ”কিন্তু আমার পুরস্কার?”

    ”তোমার শিকারই হবে তোমার পুরস্কার।”

    ”বেশ, তাহলে হুকুম দিন রাণী বৌদি—আজ রাত্রেই আমি বেরিয়ে যাই! এক পেগ কড়া করে ঢেলে দিন।”

    এক চুমুকে খানিকটা মদ গলায় ঢেলে নিয়ে, আর একবার বুক বাজিয়ে ভবানী ছাদে উঠে গেল; তারপর তর—তর করে ছাদের গঙ্গাজলের পাইপ বেয়ে নীচে বস্তীর পাশে এঁদো গলিটার মধ্যে নেমে অন্ধকারে মিশে গেল।

    ”এবারে আমাদের আসল মিটিং বসবে। যাদের এ মিটিংয়ে থাকবার দরকার নেই, তারা এখন পাশের ঘরে আড্ডা জমাতে পারো। আমরা দরজায় খিল দেব।”

    রাণীর কথায় ঘর প্রায় খালি হয়ে গেল। যারা রইল, তারা সবাই রাণীর ডান হাত।

    সাত – রয়েল বেঙ্গল টাইগার

    রাত প্রায় বারোটা। শিখা তখনও ওপরের ঘরে নিজের ডায়েরি খুলে বসে আছে। উঠি—উঠি করেও উঠতে পারছে না। লেকের সেই কেসটার এখনও কোন কিনারা হ’ল না। শ্রীরামপুরের জুট—মিলের ছোট ম্যানেজারকে সে বলে এসেছিল তাঁদের টাকা যখন ব্যাঙ্ক থেকে উঠবে, তখন একটা খবর দিতে। তাঁর হাবভাব দেখে মনে হয়েছিল, কথাটা তিনি গ্রাহ্য করেননি। অথচ শিখার মন বলছে, শীগগির এই জুট—মিলের টাকার ওপর ডাকাতি হবে। অগত্যা শিখা সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কে খবর দিয়ে রেখেছে, বিশেষ দরকার! সে যেন একটু খবর পায়, যেদিন শ্রীরামপুর মিলের টাকা যাবে। কিন্তু এ পর্য্যন্ত মিল থেকে বা ব্যাঙ্ক থেকে কোন খবরই পায়নি সে।

    হঠাৎ একখানা পুলিশের গাড়ী শিখার বাড়ীর সামনে এসে দাঁড়াল। হর্ণের শব্দে সচকিত হয়ে শিখা জানালা খুলে দেখল, একটা পুলিশের গাড়ী। গাড়ীতে কোন লোক নেই, শুধু ড্রাইভার থেকে—থেকে হর্ণ দিচ্ছে।

    রতন বারান্দায় বসে ঢুলছিল। মীরা তার ঘরে শুয়ে পড়েছে। ঠেলে—ঠুলে রতনকেই শিখা নীচে পাঠাল—কি ব্যাপার শুনে আসবার জন্য। রতন ফিরে এসে বলল, ”আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায় পুলিশের লোক।”

    শিখা নীচে নেমে গেল। ড্রাইভার অভিবাদন করে বলল, ”একবার টালিগঞ্জের থানায় যেতে হবে, এখনই—এই অবস্থায়। বড়বাবু বলে পাঠালেন। চিঠি দেবারও সময় নেই তাঁর। লেকের খুনের আসামী ধরা পড়েছে—আপনাকে এখনই বিশেষ দরকার। ডেপুটি কমিশনারও বসে রয়েছেন আপনার অপেক্ষায়।”

    শিখার মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠল। যাক, একটা দুর্ভাবনা কাটল! বলল, ”আপনি দয়া করে বাইরের ঘরে একটু বসুন। দুমিনিটের মধ্যে আমি রেডি হয়ে আসছি। বড় ভাল খবর শোনালেন।”

    হাসতে হাসতে ড্রাইভার শিখার বাইরের ঘরে এসে বসল। শিখা ওপরে উঠে গেল। মীরাকে ডাকবার দরকার নেই—পুলিশের গাড়ীতে যাবে—আসবে। ডেপুটি কমিশনার বসে অপেক্ষা করছেন—অনর্থক দেরী হয়ে যাবে।

    কাপড় ছেড়ে তৈরী হতে শিখার মনে হ’ল, অনেক দেরী হয়ে গেল। ভদ্রতা হিসাবে একবার টেলিফোন করে মার্জ্জনা চেয়ে নেওয়া ভাল। ওপরের ঘর থেকে শিখা টালিগঞ্জের থানায় ফোন করল।

    থানার বড়বাবুর সঙ্গে কথা হ’ল শিখার। তিনি বললেন, তিনি কোন লোক পাঠাননি, এ সম্বন্ধে কিছুই জানেন না; কোন আসামীও এ পর্য্যন্ত ধরা পড়েনি।

    ঝপ করে টেলিফোন রেখে দিল শিখা। টেবিলের ওপর থেকে রিভলভারটা কোমরে গুঁজে নিয়ে দৌড়ে নেমে গেল।

    শিখাকে এভাবে দৌড়ে নেমে আসতে দেখে ড্রাইভার উঠে দরজার দিকে মুখ করে শিখার সামনা—সামনি দাঁড়াল। শিখা দরজার কড়া দুটো ধরে তখন দাঁড়িয়েছে।

    লোকটা পকেটে হাত দিতেই শিখা দড়াম করে দরজাটা টেনে দিল। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ হল, গুড়ুম!

    দরজা ফুটো হয়ে শিখার গা ঘেঁষে গুলি বেরিয়ে গেল। ঝনঝন শব্দে দরজাটা কেঁপে উঠল।

    দরজার শিকলটা তুলে দিয়ে শিখা একপাশে সরে দাঁড়াল।

    সঙ্গে সঙ্গে আবার দরজার ওপর ফায়ার করল ভেতরের লোকটা।

    গুলির শব্দে মীরার ঘুম ভেঙ্গে গেল; রতনকে ছুটে নীচে আসতে দেখে মীরাও তার পিছুপিছু ছুটে নেমে এল।

    ”কি ব্যাপার শিখা? গুলি আসছে কোত্থেকে?”—মীরার চোখে আতঙ্ক!

    ”রয়েল বেঙ্গল টাইগার ধরেছি মীরা। তুমি তাড়াতাড়ি ওপরে গিয়ে লালবাজারে টেলিফোন করে দাও—সশস্ত্র পুলিশ পাঠাতে। বলবে, শিখা রায়ের বাড়ী রেড করেছে।”

    মীরা দৌড়ে ওপরে উঠে গেল। ভেতরের লোকটার গর্জ্জন বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছে। রতনকে বাইরে রাস্তায় পাঠিয়ে দিল শিখা। বলল, ”জানালা ভেঙ্গে কেউ পালাবার চেষ্টা করলে গুলি করবে পায়ে। যদি অন্য কোন লোককে দেখে সন্দেহ হয়, প্রথমে ওয়ার্নিং দেবে, পরে পায়ে গুলি করবে। এখনই মীরাকে পাঠাচ্ছি তোমার সাহায্যে।—পারবে তো?”

    ”খুব পারব দিদিমণি।”—রতন তার নিজের রিভলভারটা বাগিয়ে ধরে চলে গেল। মীরাও এসে দাঁড়াল একটু পরে। বলল, ”লালবাজার থেকে ফোর্স আসছে।”

    ”বেশ, তুমি যাও রতনের কাছে। হয়ত ওদের দলের লোক আছে কাছেই।”

    মীরা ইতস্ততঃ করতে লাগল। তার বোধ হয় অতটা সাহস হয়নি এখনও।

    ”সময় নষ্ট কোরো না মীরা! না হয় তুমি এখানে দাঁড়াও। দরজা ভেঙ্গে লোকটা বেরুবার চেষ্টা করলেই আগে গুলি করবে পায়ে।”

    শিখা আর দাঁড়াল না। মীরা সেখানে দাঁড়িয়ে মুহূর্ত্ত গুণতে লাগল, কতক্ষণে পুলিশ আসবে! আবার ভাবল, দরকার নেই এরকম দুঃসাহসে। লোকটা যদি সত্যিই দরজা ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়ে, কি করবে সে? যদি গুলি তার নিজের গায়ে লাগে আগে? লোকটার কাছেও ত রিভলভার আছে!

    মিনিট পনেরো কোনও রকমে কাটল। বড় হেড—লাইট জ্বেলে নৈশ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে এসে পড়ল পুলিশের একখানা জিপ গাড়ী আর একটা পুলিশ—ভ্যান।

    গাড়ী থেকে আগে নামলেন যতীন্দ্রনাথ। কি কাজে তিনি তখন লালবাজারেই ছিলেন। শিখার বাড়ী রেড হয়েছে শুনে তিনিও সঙ্গে এসেছেন।

    ”কি হয়েছে? ক’জন এসেছিল রেড করতে?”

    ”একজন। বাইরের ঘরে পুরে রেখেছি তাকে।” শিখা বলল।

    ”তার জন্যই পুলিশ ফোর্স?”

    ”না যতীনবাবু, ভীষণ সাংঘাতিক লোকটা—হাতে রিভলভার আছে—দরজাটা গুলি মেরে ঝাঁজরা করে দিয়েছে।”

    ”পাড়ায় লোক নেই? কেউ এল না চেঁচামেচিতে?”—যতীনবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।

    ”বাইরে পুলিশের গাড়ী দেখে কেউ আসতে ভরসা করেনি। লোকটা একখানা পুলিশের গাড়ী চেপে এসেছে।”

    ”সর্ব্বরক্ষে! বড়তলার পুলিশের গাড়ী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না—থানার দরজা থেকে নিখোঁজ হয়েছে, লালবাজারে শুনে এলুম।”

    মীরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পুলিশের কর্ম্মতৎপরতা দেখছিল। প্রথমে বাড়ীটাকে ঘিরে রাখল অল্প কয়েকজন সশস্ত্র পুলিশ। যতীন্দ্রনাথ উদ্যত রিভলভার হাতে নিয়ে দরজার শিকল খুললেন। একদিকের পাল্লা খুলে আর একদিকের পাল্লায় নিজেকে আড়াল করে ভারিক্কি চালে বললেন, ”হ্যাণ্ডস আপ।”

    উদ্যত রিভলভার দেখে ভবানীপ্রসাদ দু—হাত ঊর্দ্ধে তুলল—মুখে কথা নেই, চোখ দুটো মিটমিট করছে।

    যতীনবাবু তার খাকি—জামার কলারটা ধরে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিলেন। সুড়সুড় করে ভবানী তার রিভলভারটা যতীন্দ্রনাথের হাতে দিল।

    একটা হাতকড়া পরানো হ’ল, কোমরে দড়ি বাঁধা হ’ল ভবানীর। পুলিশ—বাহিনী গাড়ীতে উঠল, আসামীকে তুলল গাড়ীতে। শিখা বলল, ”আজ রাত্রে আমি আর যাব না। কিন্তু একটি কথা”—যতীনবাবুর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে শিখা বলল, ”এমনভাবে এই লোকটিকে হাজত—বন্দী করতে হবে যে, কাক—পক্ষীতে এর সন্ধান না পায়! থানার খুব বিশ্বাসী লোক ছাড়া কেউ যেন এর সঙ্গে কথা বলতে না পারে। বালীগঞ্জের কাণ্ডটা যারা করেছিল, সেই দলের লোক—আমি বেশ বুঝতে পারছি। নাহলে বালীগঞ্জের ব্যাপার ও জানবে কোত্থেকে?”

    আট – অপমৃত্যু

    গরাণহাটার কালী—গঙ্গা আর্ট প্রেস। সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেছে। একটা ছাপার মেসিনের সামনে টুলের উপর বসে ফর্ম্মা ছাপছে অনন্ত। এক—মনে একখানা একখানা করে কাগজ এগিয়ে দিচ্ছে, আর ভাবছে, ছুটি হতে এক ঘণ্টাও নেই! আজ আধরোজ উপরি হল—এই উপরির টাকাটা দিয়ে যাবার সময় চিৎপুর থেকে একটা ভাল ব্লাউজ কিনে নিয়ে যাবে লতিকার জন্য। হঠাৎ দরোয়ান খবর দিলে, একজন ভদ্রলোক তাকে খুঁজছেন।

    এই অসময়ে তাকে খুঁজবে কে? যাই হোক, মেসিনটা একবার বন্ধ করে উঠে এল অনন্ত। বাইরে এসে যাকে দেখল অনন্ত, তার মুখটা একেবারে অচেনা নয়। নতুন বাসাতেই দু—একবার দেখেছে বলে মনে হ’ল।

    ”আমাকে ডাকছেন? ছুটি হতে ঘণ্টাখানেক বাকী আছে। দরকার আছে কিছু?”—অনন্ত জিজ্ঞাসা করল।

    ”এক মিনিটও দেরী করা উচিত নয় দাদু! আপনার বউটি হঠাৎ ফিট হয়ে পড়েছে—মাথায় খুব চোট লেগেছে। এক—বাড়ীতে বাস করি, এটুকু করতেই হয়। রেখাও এসেছে, গাড়ীতে বসে রয়েছে।”

    রেখা মেয়েটি বাড়ীর মধ্যে মিশুকে, লতিকার সঙ্গে সেই যা দু—একটা কথা বলে। গাড়ীর দিকে চেয়ে অনন্ত দেখল, সত্যিই একটি মেয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছে।

    ”আমি এখনই আসছি। চোটটা কি খুব বেশী রকম? জ্ঞান আছে ত?”—অনন্তর মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল।

    ”এতক্ষণে বোধ হয়, জ্ঞান হয়েছে—চোটটা বেশীই বলতে হবে।”

    হাত ধোবারও সময় পেল না অনন্ত—ম্যানেজারকে বলে গাড়ীতে উঠে বসল।

    গাড়ী চিৎপুরে আসতে একটা মোড় থেকে আরো দুজন লোক উঠল। রেখা নেমে যায়। অনন্ত এক কোণ ঘেঁষে জড়সড় হয়ে বসল। গাড়ীটা কিন্তু তারপর উল্টো দিকে মোড় নিয়ে একেবারে গঙ্গার ধারের দিকে যাচ্ছে।

    অনন্ত একবার বলল, ”এদিকে যাচ্ছেন কেন?”—ব্যস, আর কোন কথা তার মুখ দিয়ে বেরুল না। চক্ষের নিমেষে তার মুখের মধ্যে প্রকাণ্ড একটা রুমাল গুঁজে দিয়ে তার মুখ বেঁধে ফেলল! হাত দুটোও পিছন দিকে ঘুরিয়ে বেঁধে ফেলল আর একজন।

    গঙ্গার তীরে সন্ধ্যার আবছা আঁধার নেমে এসেছে। কত লোক বেড়াতে বেরিয়েছে। গাড়ীর মধ্যে একজন অসহায় যুবক দুর্দান্ত গুণ্ডা দলের চক্রান্ত—জালে জড়িয়ে পড়ল—বাইরের একটি লোকও তা জানতে পারল না! অনন্ত নিজেও জানে না, তার বরাতে শেষ পর্য্যন্ত কি আছে! অবাক হয়ে চেয়ে থাকে ফ্যাল ফ্যাল করে! তার অপরাধটা কোথায়? নির্ব্বোধ অনন্ত জানে না, তার কিশোরী স্ত্রী লতিকাই এই চক্রান্তের লক্ষ্য। গাড়ী তখন হাওড়ার পুল পার হয়ে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে বিদ্যুৎ—গতিতে ছুটে চলেছে।

    * * * *

    রাত ন’টা বেজে গেল। বাড়ীর সদর বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ীর সব লোক বাড়ীতে এসে গেছে। ওপরে ওদের আড্ডা নিয়মমত বেশ জমে উঠেছে। লতিকার উৎকণ্ঠার শেষ নেই, অনন্ত এখনও বাড়ী ফেরেনি!

    কয়েকবার ঘর—বার করে লতিকা কুসুমকে ডেকে বলল, ”বাবু এখনও বাসায় ফেরেননি কুসুম।”

    ”এক—আধ দিন যদি নাই আসে, তাতে কি হয়েছে? তোমাকে কি—না দিচ্ছে—থুচ্ছে! এক—আধ দিন সাধ—আহ্লাদ করবে না? ওতে কিছু মনে করো না।”

    ঝিয়ের কথার মানে কিছুই বুঝল না লতিকা। বলল, ”কিন্তু এ—রকম ত হয় না কোন দিন। দৈবাৎ কোন দিন নাইট—ডিউটি করতে হলে বাড়ীতে বলে যান, খাওয়া—দাওয়া করে যান। একেবারেই বাড়ী এলেন না! সদরের চাবিটা আমার কাছে দিয়ে রাখো, যদি বেশী রাতে এসে পড়েন।”

    ”আচ্ছা, বাড়ী—উলি—মাকে বলছি”—কুসুম চলে গেল।

    কিছুক্ষণ পরে বাড়ী—উলি চাবি পাঠিয়ে দিল আর বলে দিল, এরকম যেন আর কোনদিন না হয়—এ বাড়ীর নিয়ম বড় কড়া।

    চাবিটা হাতে করে সদরের ধারে চুপটি করে বসে রইল লতিকা।

    রাত গভীর হয়ে এল। ওপরের হাসি—হল্লা নীচে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে—কিন্তু কিছুই ভাল লাগছে না লতিকার! দুর্ভাবনার শেষ নেই তার। তারপর কখন সদরেই সে ঘুমিয়ে পড়েছে, হাতের মুঠোয় তার সদরের চাবি।

    পরের দিন সকালে কুসুম লতিকাকে ডেকে তুলল।

    ধড়মড়িয়ে উঠে বসল লতিকা। ”বাবু ফেরেননি কুসুম?”—এদিক—ওদিক চাইতে লাগল লতিকা। বেলা অনেক হয়ে গেছে—তবু বাড়ী নিস্তব্ধ। ভাড়াটেদের এখনও ওঠবার সময় হয়নি।

    মুখ টিপে হাসছিল কুসুম। বলল, ”এই এখনই এসে পড়বে। আর যদি নেশা কাটলে আসে একটু দেরী হবে বৈ কি।”

    ”না কুসুম, আমার বড় ভাবনা হচ্ছে। একবার যাওনা, এই কাছেই কালী—গঙ্গা আর্ট প্রেস। একবার খবর নিয়ে এসো, আমি তোমায় পয়সা দেবো।”

    ”অত উতলা হচ্ছ কেন? বাড়ী—উলি—মা উঠুন। তিনি কাউকে পাঠাবেন। বাড়ীতে সব ঘরেই ব্যাটাছেলে—এখনই খবর এসে যাবে।”

    বাড়ী—উলি উঠে চান সেরে, পূজো করে, চা খেয়ে, জর্দ্দা—পান মুখে পুরে নীচে নামতে নামতে বেলা এগারটা বেজে গেল। লতিকা শুকনো মুখে বাড়ী—উলিকে সব কথা বলতে বাড়ী—উলি কথাটা গায়েই মাখল না। তারপর যখন লতিকা কাঁদতে সুরু করল, তখন কথাটা নিয়ে বাড়ীময় ঘোঁট হ’ল। ব্যাটাছেলেরা চা খেয়ে সবে সিগারেট ধরিয়েছে, বাড়ী—উলির অনুরোধে তাদের উঠতে হল। ”এই ত কাছেই কালী—গঙ্গা প্রেস—এখনই খবর এনে দিচ্ছি।” দু—তিনজন ব্যাটাছেলে উৎসাহী হল। পিছু—পিছু আরো দু—চারজন উঠে পড়ল। সত্যিই বাড়ীর মানুষ বাড়ীতে এল না—গেল কোথায়?

    বেলা ক্রমশঃ বাড়তে লাগল। অনন্তরও দেখা নাই। যারা খবর নিতে গেছে, তাদেরও দেখা নেই। তারপর যখন বিকালটাও কেটে গেল—পাথরের মূর্ত্তির মত বসে রইল লতিকা। একরাশ চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়েছে—মুখখানা যেন এতটুকু হয়ে গেছে, চোখের কোণে জল শুকিয়ে রয়েছে।

    চারদিকে সন্ধ্যা—বাতি জ্বলে ওঠবার পর ওরা সকলে এক—জোটে এসে পড়ল। ভিজে কাপড়, রুক্ষ মাথায় জল ঝরছে।

    ”বাড়ী—উলি—মাকে একটু গঙ্গাজল—ছড়া দিতে বল কুসুম”—একজন এগিয়ে এসে বলল।

    ”কি ব্যাপার?” বাড়ী—উলি নিজেই সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

    ”এক—বাড়ীতে বাস করছি, দেখে আর শুধু শুধু ফিরতে পারলুম না, শেষ—কাজটাও করে এলুম। ওরা তো গাদায় দিচ্ছিল।”

    ”কি হয়েছিল?”—বাড়ী—উলি ইষ্টদেবীকে ডাকতে লাগলো।

    ”মেডিকেল কলেজে গিয়ে দেখলুম, চেনবার উপায় নেই—ট্রামের চাকাগুলো সবকটাই বোধহয় বুকের ওপর দিয়ে গেছে—ওদের প্রেসের একেবারে সামনে। প্রেস—শুদ্ধ লোক হা—হুতাশ করছে।”

    আর কোন কথা শুনতে পারল না লতিকা। দড়াম করে আছড়ে পড়ল উঠানের মাঝখানে। দাঁতে দাঁত লেগে গেল তার।

    বাড়ী—উলি একবার বলল, ”ঠিক দেখেছ ত তোমরা?”

    ”জামাটা নিয়ে এলুম শেষ পর্য্যন্ত—শেষ স্মৃতিচিহ্ন।” একটা ছেঁড়া কাদামাখা নীল রঙের সার্ট একজন ছুড়ে দিল বাড়ী—উলির দিকে।

    ”কর কি? কর কি?”—হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে দু—হাত পিছিয়ে গেল বাড়ী—উলি—এখনই ছোঁয়া পড়ত।

    জামাটা একজন ছুড়ে লতিকার ঘরের মধ্যে ফেলে দিল। আর কয়েকজন তার মুখের ওপর জলের ছিটা আর পাখার বাতাস করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

    নয় – শিখার অন্তর্ধান

    ঘুম থেকে উঠে মীরা প্রসাধন শেষ করে নীচে বাইরের ঘরে নিয়মমত নেমে এল। টেবিলের সামনে একখানা চেয়ারে একজন পুলিশের লোক বসে আছে। দেখে অফিসার বলেই মনে হয়। পরণে খাকির ট্রাউজার, গায়ে বুশকোট, মাথায় লোহার টুপি, কোমরে বেল্টের সঙ্গে রিভলভার আঁটা।

    ”কাকে চান আপনি?”—মীরা জিজ্ঞাসা করল।

    ”শিখাকে।” অন্য দিকে মুখ ফিরালেন নবাগত পুলিশের লোকটি।

    ”একটু বসুন—ডেকে দিচ্ছি।”

    রতন আসছিল চা নিয়ে, তার হাত থেকে চায়ের ট্রেটা হাতে নিয়ে মীরা বলল, ”শিখাকে বলো, একজন ভদ্রলোক তার জন্য অপেক্ষা করছেন। আর একজনের মত চা নিয়ে এস।”

    রতন চলে গেল।

    ”শিখা আসছে।” মীরা টেবিলের ওপর চায়ের ট্রে রেখে আর একটা চেয়ারে বসে পড়ল।

    তরুণ পুলিশ অফিসারটি মাথা থেকে লোহার টুপিটা খুলে টেবিলের উপর রাখল। সঙ্গে সঙ্গে শিখার ছোট্ট—খোপাটি বেরিয়ে পড়ল। হো—হো করে হেসে উঠল শিখা।

    কি আশ্চর্য্য! একেবারে চিনতে পারেনি ছদ্মবেশী শিখাকে! মীরার লজ্জা হ’ল খুবই। লজ্জার ভাবটা কেটে যেতে নিজের মনে হেসে ওঠে মীরা।

    অতি সন্তর্পণে চা খেতে খেতে শিখা বলল, ”দু—চার দিন শিখাকে আর দেখতে পাবে না কেউ। এখন আমি মিষ্টার সান্যাল—লালবাজারে পোষ্টেড। আর শিখাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কাল রাত্তির থেকে—খবরের কাগজে এই—রকম একটা খবর ছাপিয়ে দিতে হবে।”

    ”উদ্দেশ্য?” মীরা ছোট্ট করে জিজ্ঞাসা করল।

    ”মহৎ উদ্দেশ্য একটা আছে অবশ্য।”

    কিছুক্ষণ ভেবে মীরা বলল, ”বুঝেছি। যে কোন উদ্দেশ্যেই হোক তুই জানাতে চাস, কাল রাত্রে সেই লোকটা তার উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে ফিরে চলে গেছে, ধরা পড়েনি?”

    ”ঠিক তাই। লোকটা ধরা পড়েছে শুনলে ওর দলের লোক সবাই মাটির নীচে গা ঢাকা দেবে। কিছুদিনের মত আর কারুকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেই জন্য কাল রাত্রের ঘটনাটা উল্টো করে কাগজে ছাপাতে হবে।”

    মীরা একটু চুপ করে থেকে বলল, ”ফন্দীটা মন্দ করিসনি—কিন্তু পুরা দলটার সন্ধান পাবি কোথায়?”

    ”যে লোকটা ধরা পড়েছে, তাকে প্রথমে ভাল কথায় ভুলিয়ে, না হয় শেষ পর্য্যন্ত থার্ড—ডিগ্রী ওষুধ দিলেই সব বেরিয়ে পড়বে। কথা বের করবার জন্য গভর্ণমেণ্টের মাইনে—করা লোক আছে—কত বড় বড় দুর্দ্দান্ত বদমায়েস, দেখেছি, প্রেসারের চাপে চ্যাপ্টা হয়ে গেছে।”

    ”এখন কিন্তু আমার খুব ইনটারেষ্টিং লাগছে।”—মীরা বলল।

    ”কিন্তু কাল রাত্তিরে ত মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল। এখন তৈরী হয়ে নে। বেলা ন’টা আন্দাজ লালবাজারে ছুটতে হবে। তোর ড্রাইভিং ভাল—সেই জন্যেই ত তোকে অ্যাসিসটেণ্ট করলুম।”

    ”সামনা—সামনি ডাকাতকে গুলি করতে দেখে বুক কাঁপে যদিও,—তবু ষ্টিয়ারিংয়ে হাত পড়লে আমি একটুও ঘাবড়াই না—হাত একটুও কাঁপে না।”

    ”এক হাতে ষ্টিয়ারিং আর এক হাতে রিভলভার নিয়ে গাড়ী চালাতে হবে—মন থেকে প্রাণের ভয় একেবারে দূর করে দিতে হবে—তবেই এই লাইনে নাম করতে পারবি, বেসামাজিক জীবগুলোকে জেলে পুরে সাধারণের উপকারও করতে পারবি।”

    মীরা চুপ করে শিখার কথাগুলো ভাবতে লাগল।

    * * * *

    বেলা নটা নাগাদ শিখাদের গাড়ী লালবাজার হেড কোয়ার্টার্সের ফটকের মধ্যে ঢুকে গেল। যতীন্দ্রনাথ আগেই এসেছিলেন। ছদ্মবেশে শিখাকে চিনতে তাঁর একটুও দেরী হ’ল না।

    যতীন্দ্রনাথ হেসে বললেন, ”ব্যাপার কি? এ বেশে?”

    শিখা ফিস ফিস করে যতীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্যটা বুঝিয়ে দিল।

    যতীন্দ্রনাথ শুধু একটু হাসলেন।

    নিরালা হাজতের অন্ধকার কক্ষে আসামী ভবানীপ্রসাদ ঝিম মেরে বসে ছিল। পুলিশ অফিসারের দল তাকে একটা নির্জ্জন ঘরে এনে হাজির করল।

    যতীন্দ্রনাথ বললেন, ”তোমার কেস আমরা হাল্কা করে দেব—যা জিজ্ঞাসা করব তার কিন্তু সত্যি জবাব দিতে হবে। মিথ্যা কথা বললে আমরা বুঝতে পারব। মিছামিছি তোমারই ভোগান্তির এক—শেষ হবে। তোমাদের দলের সকলকেই আমরা চিনি।”

    আসামী বলল, ”আমিও তাই ভাবছি, ধরা যখন পড়েই গেছি, আর পাঁচজনে আমাকে উদ্ধার করতে আসবে না—তখন নিজের উদ্ধারের উপায় নিজেকেই করতে হবে। আপনাদের কাছে আত্ম—সমর্পণ করা ছাড়া গতি কি? হাতের কাজ জানি—বেরিয়ে বরং খেটে খেতে পারব। কি জানতে চান, বলুন? যা জানি, একটুও গোপন করব না।”

    শিখা বলল, ”তোমার নাম বলেছ ভবানী ঘোষ। নামটা ঠিক ত?”

    ”হ্যাঁ। ষ্টার মোটর কোম্পানীর কারখানায় খবর নিয়ে দেখুন—এগার বৎসর মেকানিকের কাজ করে এসেছি।”

    ”তবে গুণ্ডার দলে এসে পড়লে কি করে?”

    ”একজনের গাড়ী কারখানায় আসতো—তাদের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল—তারা বললে, এমন কাজের লোক তুমি, এখানে পচে মরছ কেন? আমাদের দলে ভিড়ে যাও, খেটে খেতে হবে না। ভাবলুম, দেখাই যাক না ব্যাপারটা কি?”

    ”ব্যাপারটা কি দেখলে ওদের সঙ্গে ভিড়ে?” যতীন্দ্রনাথ প্রশ্ন করলেন।

    ”ওরা যা বলেছিল, কথাটা একেবারে খাঁটি।—গাড়ী একবার করে রোজ দেখে শুনে বলতে হবে ”ও—কে”। আর দরকার হলে বেপরোয়া ভাবে গাড়ী চালাতে হবে। গাড়ী ঠিক থাকলে এরোপ্লেনের স্পীডে চালাবার ক্ষমতা আমি রাখি। ওদের সঙ্গে থেকে থেকে ছুরি—ছোরা আর বন্দুক চালাতেও শিখলুম; দলের মধ্যে একজন কেষ্ট—বিষ্টু হয়ে উঠলুম। যে কাজের ভার পড়ে, তুড়ি মেরে হাসিল করি।”

    ”কতগুলো কাজ হাসিল করেছ এ পর্য্যন্ত?”—পুরুষবেশী শিখা জিজ্ঞাসা করল।

    ”আসল কাজ ওরা করত—আমি শুধু গাড়ী কণ্ট্রোল করতুম।”

    ”লেকের ঘটনার দিন তুমিই গাড়ী চালিয়েছিলে?”

    ”হ্যাঁ।”

    ”যে খুন হল, তার নাম কি?”

    ”রমাকান্ত। বেইমানী করেছিল, তাই খুন হয়ে গেল।”

    ”এই ছবিটা কার?”—শিখা শৈলেন চক্রবর্ত্তীর ছবিটা বের করল।

    ”নারাণদার ছবি—আমাদের দলের লীডার।”

    ”শ্রীরামপুরে তুমি রোজ যাও?”

    ”না, রাণীবৌদি নেমন্তন্ন করলে যাই।”

    ”তা হলে তোমাদের দলের আড্ডা কোথায়?”

    ”কিছুই ঠিক নেই—মনুমেণ্টের তলা, ইডেন গার্ডেন—হাইকোর্টের ধার—যেদিন যেখানে হবে, আগের দিনেও কেউ জানতে পারে না।”

    ”বটে! কাল রাত্তিরে কোথায় আড্ডা বসেছিল?”

    ”ভবানীপুর ফুটবল মাঠে। নারাণদা কোত্থেকে একা পুলিশের গাড়ী টেনে এনেছিল, বলল, যাও, শিখা দেবীকে তুলে নিয়ে একেবারে এখানে নিয়ে আসবে। আর বালীগঞ্জের কথাটা সেই শিখিয়ে দিয়েছিল।”

    ”আজ তোমাদের আড্ডা কোথায় বসবে?”

    ”কিছুই জানি না। বোধ হয় ইডেনে, কিংবা আউটরাম ঘাটে।”

    ”আজ সন্ধ্যায় আমাদের সঙ্গে তোমায় যেতে হবে—তুমি দূর থেকে শুধু দেখিয়ে দেবে। কেমন—রাজী আছো?”

    ”পুলিশের সঙ্গে যেতে বাধা কি? তবে আমাকে বাঁচাবার ভার—”

    ”নিশ্চয়, পুলিশ—প্রোটেকসান তুমি পাবে বৈ কি।—নিশ্চিন্ত হয়ে তুমি থাকো এখানে—তোমার কোন ভয় নেই! রাত্তিরে আবার দেখা হবে।”

    * * * *

    সে—রাত্রে অনন্তকে মোটরে তুলে হাত—মুখ বেঁধে যখন গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন শিখা পুলিশ নিয়ে সারা গড়ের মাঠ তন্নতন্ন করে খুঁজেও কারো পাত্তা পেল না। শিখার সঙ্গে পুলিশের গাড়ীতে ভবানী রয়েছে, তার হাতে হাত—কড়া, কোমরে দড়ি। দূর থেকে সে কয়েকটা জায়গা দেখিয়ে দিচ্ছিল যেখানে তাদের আড্ডা বসে, কিন্তু স্বাস্থ্যকামীর ভিড় ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না শিখার।

    একবার শিখা ভাবল, শ্রীরামপুরের আড্ডায় হয়ত এখন কাউকে পাওয়া যেতে পারে! কিন্তু তাতে পুরো দলটা ধরা পড়বে না। আর শ্রীরামপুরে হানা দিতে হলে আরো অনেক বেশী তোড়জোড়ের দরকার, সেরকম ভাবে তৈরী হতে পারবে না সে! অনিশ্চিতের পিছনে অনেকটা ভরসা করে ছুটতে হবে। যাই হোক, সেদিনকার মত শিখা লালবাজারে ফিরে ভবানী ঘোষকে লক—আপে পুরে, একজন ইনফরমারকে শ্রীরামপুরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে এল। সবিতার বাড়ীতে কে ঢুকছে কে বেরুচ্ছে, এটা সে জানতে চায়।

    দশ – বলিদানের ব্যবস্থা

    লতিকার বিপদে দুঃখ আর মমতা জানাচ্ছে শুধু রেখা। রেখা না থাকলে লতিকা হয়ত হার্টফেল করত বা কিছু না খেয়ে এতদিনে মারা যেত! লতিকাকে সান্ত্বনা দেওয়া, দুবেলা নিজের হাতে খাওয়ানো, দরকারী জিনিষপত্র দেওয়া—সবই করে রেখা। বলে, ”আমার যদি ছোট একটা বোন থাকত, তাহলে কি ফেলে দিতে পারতুম?”

    রেখার ব্যবহারে লতিকা শোক অনেকটা ভুলেছে। নিজের ঘরে চুপটি করে বসে ভাবে, এখন করবেই বা কি সে? দেশে যা কিছু ছিল, সব ঘুচিয়ে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক তুলে কলকাতায় চলে এসেছিল অনন্ত। এখন কোথায়ই বা যাবে? দূর—সম্পর্কের এক মামী—শাশুড়ী আছে বটে কলকাতায়—খোঁজ করলে সন্ধান পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু খাণ্ডার মামী—শাশুড়ীর মূর্ত্তি মনে পড়লেই ভয়ে আঁতকে ওঠে লতিকা।

    বাড়ী—উলি এখন ঘন—ঘন খবর নিচ্ছে লতিকার। একদিন মুখ ফুটে বলল, আমারও কেউ নেই, দুটো রাঁধবি—আমার কাছেই থেকে যা। আমার অবর্ত্তমানে যা কিছু থাকবে, তাই নেড়েচেড়ে বাকী জীবনটা তোর কেটে যাবে মা।”

    এমন স্নেহমাখা কথা পরের মুখে কোন দিনই শোনা যায় না। লতিকা ভাবে ভাগ্যিস এই আশ্রয়ে এসে পড়েছিল, নাহলে আজ কোথায় সে ভেসে যেত, ভেবে ঠিক করতে পারে না।

    একদিন রাত্রে অনেক বাইরের লোক ওপরে উঠে গেল, বাইরের মেয়েছেলেও এল দু’ একজন। সদর বন্ধ হবার পর থেকেই ওপরটা বেশ গমগম করতে লাগল।

    লতিকা রামায়ণ পড়ে শোনাচ্ছিল তার বাড়ী—উলি মাকে। একবার থেমে বলল, ”ওপরে আজ বড্ড ভিড়—আজ থাক মা।”

    ”না, না—তুমি পড়। ওপরের দিকে কাণ দিও না। আর দেখ, বাড়ীর কোন মেয়েছেলের সঙ্গে বেশী মিশো না। ব্যাটাছেলেরা নীচে নামলে সামনে বেরুবে না।”

    পর—পুরুষকে এড়িয়ে চলার শিক্ষা লতিকার ছেলেবেলা থেকেই আছে। অন্য ব্যাটাছেলে সামনে দেখলে এক—হাত ঘোমটা টেনে ঘরে ঢুকে যায় সে—এ—কথা নতুন করে বলবার কি আছে? আবার রামায়ণ পড়া সুরু করল লতিকা। কিছুক্ষণ পরে বাড়ী—উলির নাক ডাকার শব্দ শুনে বই বন্ধ করে নিজের ঘরে এসে খিল দিয়ে দিল!

    ওপরে জোর কথাবার্ত্তা ক্রমশঃ কমে আসতে লাগল। শেষকালে সব একেবারে চুপচাপ। যেন ওপরে মানুষ বলতে কেউ নেই! লতিকার কেমন ভয় ভয়—করছে। আবার ভাবে, ভয় কিসের? বাড়ী—উলি নিজের মেয়ের মতই দেখে আজ—কাল। নিজের ঘরের বড় গদি লতিকার ঘরে তুলে দিয়েছে। নিজের আসবাবও দু’একটা নিজের ঘরে বেশী হয় বলে লতিকার ঘরে রেখে দিয়েছে। বড় ঢালা গদি—বিছানার ওপর বালিশের কাঁড়ির মাঝে কুঁকড়ে শুয়ে পড়ল লতিকা।

    ওপরের হল—ঘরে সকলেই জুটেছে। সেদিনের চেয়ে লোক বেশী অথচ কথাবার্ত্তা হচ্ছে খুব চুপিচুপি। মাঝে—মাঝে সোডার বোতলের ছিপি খোলার শব্দ হচ্ছে, কিন্তু সেটাও খোলা হচ্ছে যেন খুব সন্তর্পণে।

    রাণী আজ একটু গম্ভীর। সোফায় রাণী একা বসে—পাত্রমিত্র ঢালা বিছানার উপর। কিছুক্ষণ পরে ছাদে মানুষের পায়ের শব্দ শোনা গেল। রাণীর মুখে একটু হাসি দেখা দিল। ঘরের পর্দ্দা ঠেলে যে ঘরে ঢুকল, সে রাণীর সবচেয়ে অনুগৃহীত নারাণচন্দ্র! সবচেয়ে বেশী কাজের লোক বলে রাণী তাকেই সবচেয়ে বেশী সম্মান দিয়েছে। রাণীর সঙ্গে এক—আসনে বসবার অধিকার শুধু তারই আছে।

    নারায়ণচন্দ্র রাণীর পাশে সোফার খালি জায়গাতেই হয়ত বসতে আসছিল, রাণী ইঙ্গিতে তাকে বিছানায় পাঁচজনের সঙ্গে বসতে বলল।

    রাণী এক—মনে ফাইল দেখতে দেখতে বলল, ”নতুন ভাড়াটের খবর কি রেখা?” রাণীর স্বর অত্যন্ত গম্ভীর।

    রেখা ভয়ে ভয়ে বলল, ”বাড়ী—উলি মাঝখান থেকে গোলমাল করে দিল! একেবারে ডানা মেলে ওকে আগলে রেখেছে। মেয়েটাও বাড়ী—উলির ভয়ানক বাধ্য!”

    ”তোমরা কি করছিলে? তোমাদের বাধ্য হল না কেন? তোমার ওপর ভার ছিল—বলেছিলুম না, ওর স্বামীটাকে সরালে…কেউ কোথাও নেই ওর যত্নআত্তি জানিয়ে তুমি ওকে বশ করে নেবে।…ওকে তৈরী করে নেবো। চেহারা ভালো…কেউ ওকে সন্দেহ করবে না। তার কি করলে? তোমার কাছে আমি কৈফিয়ৎ চাইছি।”

    রেখা চুপ করে রইল।

    ”চুপ করে রইলে কেন? তোমাদের কি টাকার অভাব পড়েছিল? আগে কিছু গুঁজতে পারলে না বাড়ী—উলির হাতে?—জেনে রেখে দিও, রাণীর দল যে—কাজে হাত দেয়, হেরে ফিরে আসে না। ভবানী ঠাকুরপো শিখাকে নিয়ে উধাও হয়েছে, সে খবর রাখো? শিখার সম্বন্ধে এবার নিশ্চিন্ত!”

    রেখা আমতা আমতা করে বলল—”হ্যাঁ, যুগান্তরে পড়লুম। শিখার ছবিও দেখলুম। ঠাকুরপোর বরাত ভাল।”

    ”শুধু ঠাকুরপোর নয়, আমাদের বরাত ভাল। ঠিক সময়ে শিখার মত শত্রুকে আটকে ফেলেছে। দাঁড়াও, কালকের দিনটা ভালয় ভালয় কাটুক, তারপর ঐ শিখার আর এই লতিকার কি করি—তখন দেখো!” রাণীর চোখ দুটো দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে পড়ল।

    রাণী ডাকলো, ”হাসি,—উঠে এসো।”

    একটি মেয়ে উঠে এল রাণীর সামনে।

    ”এবারে মাল কত? পাকা খবর চাই।”

    ”এক লাখ সাতষট্টি হাজার বারো আনা—পাক্কা খবর, আমি ফিগার টাইপ করেছি।”

    ”রুট? হাওড়া না, বালী—ব্রীজ?”

    ”এই যে ম্যাপ এঁকে রেখেছি।”

    ”বেশ। রেখে যাও।”

    নারায়ণচন্দ্রের দিকে আঙুলের ইঙ্গিত করতেই সে উঠে এল।

    ”ঐ এক লাখ সাতষট্টি হাজার বারো আনার—বারো আনা পর্য্যন্ত আনা চাই। এই ম্যাপ রয়েছে। তোমার পয়েণ্ট ঠিক করে নাও।”

    নারায়ণচন্দ্র ম্যাপের এক জায়গায় দাগ দিল।

    রাণী অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে বলল, ”উঁহু। বাঁয়ে গলির মুখ আছে—ডাইনে অসুবিধে। আর একটু এগিয়ে যাও।”

    ”হ্যাঁ, এইখানটা—দি বেষ্ট। ঠিক আগের বারের মত একটা পয়েণ্ট পাওয়া গেছে।”

    ”হ্যাঁ। মন্দ নয় জায়গাটা। মাল—মশলা সব সাজাও আমার সামনে—আমি দেখব।”

    দেরাজের তলা থেকে টেনে টেনে বার করা হল বড় বড় ড্যাগার, আট—দশটা রিভলভার, আর কতকগুলো হাত—বোমা।

    ”হ্যাঁ, ঠিক আছে। তোমার ঠেলা—গাড়ীতে কি থাকছে?”

    ”সেই নতুন যে বোমা বেঁধেছি, একটু ধাক্কা খেলেই একসঙ্গে সব বার্ষ্ট করবে। আর বাজে জিনিষও কিছু কিছু থাকবে—কাপ—ডিসের আর কাচের বাসনের ঝোড়া একটা বিরাট গোছের।”

    ”হ্যাঁ। ঠিক আছে। আমার গাড়ী থাকবে সব—পিছনে—কাজ হাসিল হবার পর আমি স্পীড নেবো—তোমাদের গাড়ী আমাকে ফলো করবে। আজ আর রাত কোরো না কেউ, সকলেই খাওয়া—দাওয়া সেরে শুয়ে পড়।”

    কিন্তু কেউ আর উঠতে চায় না। সকলেই উসখুস করতে লাগল।

    রাণী বুঝল তার কারণ। কিন্তু কঠোর স্বরে হুকুম দিল, ”আজ আর এক ফোঁটাও পাবে না। আজ মেয়েদের নিয়ে আমি এই ঘরে থাকব। বীর—পুরুষরা যাও যে—কোন ঘরে। ওঠো, চিয়ার আপ—গুড নাইট।”

    এগারো – শিকারের পিছনে

    রাত্রে ভাল ঘুম হ’ল না শিখার। নানা চিন্তায় মনটা ভার হয়ে রয়েছে। শ্রীরামপুরের ইনফরমার খবর দিয়েছে, সবিতাদের বাড়ীতে কোন লোক যাওয়া—আসা করে না। বাড়ী সারাদিন বন্ধ থাকে, কিন্তু পাশের একমুখো গলিটাতে মাঝে মাঝে লোক যাওয়া—আসা করে।

    পাশাপাশি তিন—চারখানা ভাড়াটে বাড়ী আছে; সে সব বাড়ীর লোকজনরা হয়ত যাওয়া—আসা করে। অথচ রোজই রাত্রে শিখা মনুমেণ্টের তলায় একবার চক্কর দিয়ে আসে; সন্দেহ করবার মত তেমন কিছুই দেখতে পায় না; দলটাকে যেন ধরি—ধরি করেও ধরতে পারছে না।

    ভবানী ঘোষ নামে যে লোকটা ধরা পড়েছে, তাকে যা জিজ্ঞাসা করা যায়, সঙ্গে সঙ্গেই চটপট জবাব দেয়। বলে, অল্পদিন হ’ল, তাদের দল গড়া হয়েছে। গুণ্ডামি করে ওরা যা পায়, তাতেই বেশ আরামে ওদের মদ জুয়া প্রভৃতির খরচ চলে। দলের পাণ্ডা, নারাণ—দা শ্রীরামপুরে বাস করে। রাণীবৌদি খুব ভাল মেয়ে। নারাণ—দা তার ওপর অত্যাচার করলেও মুখ বুজে সহ্য করে; গয়নাগাঁটি খুব খুইয়েছে। চাকরীটাও ছেড়ে দিয়েছে, এখানে—ওখানে গুণ্ডামি করে বেড়ায়, বাড়ী যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে মাস—খানেক। শিখা রোজ দু—ঘণ্টা ধরে ভবানীর গল্প শোনে। কিন্তু ঐ একই কথা রোজ রোজ বলে। অনর্গল কথা বলে চলে—শেষ পর্য্যন্ত বিরক্ত হয়ে ওঠে শিখা। যখন সে চলে আসে, তখনও ভবানী তাকে ছাড়তে চায় না। বলে, ”শুনুন—রামাকান্ত কি করে প্রাণ হারাল! শুনবেন?”

    শিখা বলে, ”সে তো শুনেছি।”

    ”হ্যাঁ—নারাণ—দা যখন ছুরি ধরে, দুবার ঘা মারতে হয় না, শরীরের মধ্যে কোনখানে কি আছে, দাগ দিয়ে দেখাত আমাদের। কোথায় ঘা দিলে মোক্ষম হবে, চোখ বুজে বলে দিতে পারে।”

    এই সব শুনে শিখা ভাবে, শ্রীরামপুরে গিয়ে মিছামিছি সবিতার দুঃখ বাড়িয়ে লাভ কি? নারাণচন্দ্র যখন শ্রীরামপুর ছেড়ে দিয়েছে, কলকাতাতেই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। অন্ততঃ সবিতা জানবে, তার স্বামী বেঁচে আছে। আহা! গুণ্ডা হোক, বদমায়েস হোক—স্বামী ত!

    বেলা আন্দাজ সাড়ে দশটা। শিখার টেলিফোন হঠাৎ সশব্দে বেজে উঠল। অন্যমনস্ক ভাবে শিখা রিসিভারটা তুলল।

    ”হ্যাঁ। আমিই মিস্ রায়। হ্যাঁ, অগ্নিশিখা রায় কথা বলছি। টাকা নিয়ে জুটমিলের লোকেরা চলে গেল? এইমাত্র যাচ্ছে তারা? সাড়ে দশটায়? কেশিয়ার খবর দিতে দেরী”—

    ঝপ করে রিসিভারটা ফেলে দেয় শিখা। ”মীরা—মীরা—শীগগির গাড়ী বের কর। তুইও একটা রিভলভার সঙ্গে নে।”

    মীরা গাড়ী বের করতে করতে শিখা তৈরী হয়ে নীচে নেমে গেল। তার মধ্যেই সে লালবাজারে একটা ফোন করে দিল, এখনই যেন একটা পুলিশ—ভ্যান সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে শ্রীরামপুর পর্য্যন্ত ফুল—স্পীডে ছেড়ে দেওয়া হয়। সেও যাচ্ছে সেই রাস্তায়।

    মীরা ষ্টিয়ারিং ধরল। হাওড়া ব্রীজ দিয়ে গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে যাবে।

    হাওড়া ব্রীজ পার হয়ে এসে শিখার গাড়ী বাধা পেল। নানারকমের যানবাহনে রাস্তা বন্ধ। ট্রাফিক—পুলিশ কিছুতেই কণ্ট্রোল করতে পারছে না। মালবোঝাই একখানা বড় লরি…টিউব—পাংচার হয়ে খাড়া আছে…পথে এতটুকু সরু ফাঁক…সেই ফাঁকে রাজ্যের গাড়ী যাবে—আসবে। কত দেরী যে হবে! শিখা বলল, ”অপেক্ষা করলে চলবে না, আমাকে দে ষ্টিয়ারিং। পুলিশের ভ্যান ঠিক আসবে।”

    শিখা গাড়ী নিয়ে বেরিয়ে গেল।

    হাঁ হাঁ করে উঠল ট্রাফিক পুলিশ।

    শিখা তখন বেরিয়ে গিয়েছে। পুলিশ তার নম্বর নিয়ে কাজে মন দিল।

    এবারে মীরা আবার ষ্টিয়ারিং হাতে নিল। শিখা বলল, ”শুধু এ্যাকসিডেণ্ট বাঁচিয়ে ফুল স্পীডে বেরিয়ে যাওয়া।”

    হু হু করে শিখার অষ্টিন—গাড়ী ছুটেছে। ঘন ঘন ইলেকট্রিক হর্ণ দিচ্ছে মীরা। ষ্টিয়ারিংয়ে হাতটা শুধু ছোঁয়ানো আছে, লক্ষ্য সামনে রাস্তার দিকে। ক্রমশঃ শহরের পরিবেশ পার হয়ে এসে পল্লীর নিস্তব্ধ পথে পাড়ি। পথে লোকজন নেই বললেই হয়—দু—একটা গরুর গাড়ী পাশের পায়ে—চলা পথ দিয়ে চলেছে, মাঝে মাঝে ওদিক থেকে দু—একখানা মোটর গাড়ী হুশ করে পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাবধান হয়ে মীরা পাশ কাটিয়ে চলেছে।

    হঠাৎ ও কি! দূর থেকে ক্ষিপ্ত একটা কোলাহলের শব্দ ভেসে আসছে—আর পথের দু—পাশ থেকে হৈ—হৈ করে লোক ছুটে চলেছে সামনের দিকে। বাধ্য হয়ে গাড়ীর স্পীড কমাতে হ’ল। শেষে বুঝি, একেবারেই থামতে হয় মীরাকে।

    মীরাকে সরিয়ে দিয়ে ষ্টিয়ারিং নিল শিখা। একবার থেমে একজন পথের ভদ্রলোককে ডেকে জিজ্ঞাসা করল, ”কি হয়েছে?”

    ”ভীষণ মারামারি। দুখানা মোটরে। একদল বোমা ছুড়ছে আর একদল রাইফেল ফায়ার করছে। খুন হয়ে গেছে নাকি দু—একটা। দু—পক্ষই দলে বেশ ভারী।”

    জোরে ইলেকট্রিক হর্ণ বাজিয়ে শিখা এগিয়ে চলল। পথের লোক একবার পিছনে তাকায়, গাড়ীর পথ ছেড়ে আবার সামনে ছুটতে থাকে। তাদের সঙ্গে শিখাও সাবধানে এগিয়ে চলে।

    একখানা ভাঙা—চোরা ষ্টেশন—ভ্যান পথের মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে, পিছনের দরজা খোলা…হাঁ হয়ে রয়েছে।

    হঠাৎ চীৎকার উঠল, ”পালাল, পালাল! ঐ জীপে করে পালাল।”

    শিখা চক্ষের পলকে ভ্যানের ভিতরটা দেখে নিল, বন্দুকধারী দুজন পালোয়ান বন্দুক আঁকড়ে পড়ে রয়েছে গাড়ীর ভেতরে। জ্ঞান নেই, বোধ হয়। বোমার আঘাতে গাড়ীখানা প্রায় চূর্ণ—বিচূর্ণ।

    ঐ পালাচ্ছে জীপ! ঐ—ঐ। শিখা দেখল একখানা জীপ চলেছে সামনে সোজা।

    ঘন—ঘন হর্ণ দিয়ে যখন ভিড় সরাতে পারল না, বাধ্য হয়ে শিখা তখন রিভলভার বের করে ওপরের দিকে দুটো ফায়ার করল।

    নিমেষে পথ ফাঁকা হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একখানা পুলিশের ভ্যান সেখানে এসে দাঁড়াল। পুলিশের গাড়ী দেখে জনপ্রাণীর আর চিহ্ন রইল না সেখানে। শিখা মুখ বাড়িয়ে দেখল, যে সব বীর রাস্তায় ভিড় করেছিল, পুলিশের ভ্যান দেখে কে কোথায় সরে পড়েছে! হাত বাড়িয়ে সে গাড়ীকে ইঙ্গিতে সেখানে অপেক্ষা করতে বলে শিখা সোজা বেরিয়ে গেল ঝড়ের মত। একবার শুধু বলল, ”সিধা রাস্তায় গেছে। জীপখানা ধরতেই হবে।”

    মীরা বলল, ”এতক্ষণে কত দূরে চলে গেছে।”

    ”যত দূরেই যাক পঞ্চাশ মাইলের বেশী স্পীডে যেতে সাহস করবে না। আমরা যাচ্ছি আশী! ঐ ঐ—জীপের পিছনের ষ্টেপনি দেখা যাচ্ছে।”

    মীরা দেখল, তাই বটে।

    মীরা বলল, ”এবার কিন্তু আমার ভয় করছে—সামনা—সামনি গেলেই ওরা বন্দুক ছুড়বে।”

    ”সামনা—সামনি যাব না। তুই রিভলভার রেডি রাখ—দুজনেই একসঙ্গে পিছন থেকে চাকায় ফায়ার করব। চাকার মাডগার্ড ছোট, চাকা দুটোর একটা অন্ততঃ ফুটো করে দিতে পারলে তার পরের ব্যবস্থা আমি করব।” শিখার চোখ দুটো জ্বলছে! তার এমন মূর্ত্তি মীরা আগে কখন দেখেনি।

    জীপখানার আরো কাছে এসে শিখা দেখল, জীপের আগে আর একখানা মোটর চলেছে—তার স্পীড খুব বেশী নয়। তার পিছনে পিছনে যাচ্ছে বলে জীপখানা তেমন স্পীড দিতে পারছে না।

    হু—হু করে ছুটে চলেছে শিখার গাড়ী। আগের গাড়ী দুখানা আগে—পাছে যাচ্ছিল, হঠাৎ গাড়ী দুখানা পাশাপাশি হ’ল। তারপর একটা ক্রসিংয়ের মুখে দুখানা গাড়ী দুদিকে গেল। আগের গাড়ী গেল বাঁ—দিকের রাস্তায়, জীপ গেল ডানদিকে।

    মীরা বলল, ”দুখানা দুদিকে গেল যে!”

    শিখা বলল, ”দেখেছি। জীপে বিশেষ লোক—জন আছে বলে মনে হ’ল না—যে গাড়ীটা বাঁ—দিকে গেছে, ঐখানাই ফলো করি।” সঙ্গে সঙ্গে শিখা বাঁ—দিকে মোড় ঘুরল।

    কিন্তু ফলো করবে কাকে? আগের গাড়ী তখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। আশে—পাশে ছোট—খাটো গলি—রাস্তা। গাড়ী থামিয়ে পথের লোককে জিজ্ঞাসা করে কোন সদুত্তর পাওয়া গেল না। অত—বড় গাড়ীখানা কি আরোহী—সমেত শূন্যে মিলিয়ে গেল?

    মিছামিছি সময় নষ্ট না করে শিখা ক্রসিংয়ের মুখে ফিরে এল। জীপখানা যে দিকে গেছে, সেই দিকে চলল।

    রাস্তা ক্রমশঃ সরু হয়েছে। কিছু দূর যাবার পর দেখা গেল, জীপখানা দাঁড়িয়ে রয়েছে, রাস্তাও শেষ হয়ে গেছে; এখান থেকে সরু একটা গলি—গলিটা গিয়ে গঙ্গার তীরে পড়েছে, মনে হ’ল। জীপের মধ্যে লোক নেই।

    শিখা—মীরা ঘাট পর্য্যন্ত ঘুরে এল, কোথাও কিছু নেই। দু—চারজন পুণ্যকামী স্নানার্থী ছাড়া কারুর দেখা পেল না।

    ”আর কি হবে? হাত থেকে শিকার পালিয়ে গেল।”—অতি—দুঃখে কথাটা বলে শিখা আবার ফিরে আসবার জন্য গাড়ী ঘোরাল।

    ফিরে এসে দেখল কলকাতার পুলিশ আর শ্রীরামপুরের পুলিশ জায়গাটা ঘিরে ফেলেছে।

    লালবাজারের অফিসার শিখাকে দেখে চিনতে পারলেন; বললেন, ”সামান্য কথা কাটা—কাটি থেকে ঝগড়া—ঝগড়া থেকে রীতিমত যুদ্ধ হয়ে গেছে, শুনছি। শ্রীরামপুর পর্য্যন্ত যাবার জন্য অর্ডার ছিল। পথের মাঝে কি রকম আটকে গেলুম শিখা দেবী! আপনি আসছেন কোত্থেকে?”

    শিখা বলল, ”আমিই লালবাজারে ফোন করেছিলুম। এ রকম একটা ঘটনা হবে আমি আগেই মনে করেছিলুম। আর শ্রীরামপুর যাবার দরকার হবে না এখন—পরে হয়ত হতে পারে।”

    ”কিন্তু রিপোর্ট যা পাচ্ছি, তা থেকে মনে হয় আকস্মিক ঘটনা ছাড়া আর কিছু নয়।”

    ”কি রিপোর্ট পেলেন?”—শিখা জিজ্ঞাসা করল।

    ”এই ষ্টেশন—ভ্যানখানা যাচ্ছিল, একখানা ঠেলা—গাড়ী ঠিক সেই সময়ে রাস্তা পার হচ্ছিল। দুটো গাড়ীতে ধাক্কা লাগবার উপক্রম হতে ভ্যানখানা ব্রেক কষে ঠিকই বেঁধে ফেলেছিল। ঠেলা—গাড়ী টানছিল—লুঙ্গী—পরা এক মুসলমান—সে বিশ্রী গালাগাল দিয়েছিল। ভ্যানের মধ্যে আর্মড গার্ড ছিল, তাই ভ্যানের ড্রাইভার গরম হয়ে নাকি দু—চারটে জবাব দিয়েছিল। আর যায় কোথা? দু—চারজন পথের লোকও জুটে গেল। মনে হয়, ঠেলার দলের লোক। ভ্যান অ্যাটাক করে ড্রাইভার, আর্মড—গার্ড সকলকে জখম করে কেউ বলছে জীপে করে পালিয়েছে, কেউ বলছে মোটরে পালিয়েছে। যারা জখম হয়েছে, তাদের এ্যাম্বুল্যান্সে তুলে লালবাজারে ফোন করে দিয়েছি।’

    ”কিন্তু গল্পের এখনও অনেক বাকী রয়ে গেল! এই ভ্যানে শ্রীরামপুর জুট মিলের টাকা ছিল, সেটাও যে লুট হয়েছে।” শিখা বলল।

    অফিসার শিখার মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে রইলেন, বললেন, ”বলেন কি মিস্ রায়!”

    শিখা বলল, ”এখন চলুন, জীপখানার সন্ধান পেয়েছি,—ওর মালিকের সন্ধানও হবে।”

    ”চলুন।”

    সেখানে পুলিশ মোতায়েন রেখে, পুলিশ—ভ্যান আর শিখার গাড়ী চলল গঙ্গার ধারের দিকে।

    জীপটা সেইখানেই পড়ে আছে। আর্মড—গার্ড পোষ্ট করে গঙ্গার ঘাটের দিকে দলবল নিয়ে অগ্রসর হ’ল শিখা।

    কিন্তু কোন—কিছুরই সন্ধান পাওয়া গেল না।

    এমন কখনও হয়নি। শিখা ভাবল, শ্রীরামপুরে সবিতার বাড়ীটা ভাল করে সার্চ করতে হবে—সেখানে যদি কিছু সন্ধান মেলে। তাছাড়া ওরা যদি তাড়া খেয়ে শ্রীরামপুরের বাড়ীতে গিয়ে হাজির হয়! শিখার মনে একটু ক্ষীণ আশা জাগে!

    বারো – শিকারীর জাল

    শ্রীরামপুরে সবিতার বাড়ীর দরজায় একটা তালা ঝুলছে—বাইরে থেকে মনে হয়, অনেকদিন থেকেই বাড়ীর সদর দরজা বন্ধ আছে। পুলিশের ভ্যান দূরে রেখে পুলিশ—বাহিনী এগিয়ে এল। পাশের গলিটায় ঢুকে শিখা পরীক্ষা করে দেখল সবিতাদের বাড়ীর ছাদে যাবার বেশ একটা সহজ উপায় রয়েছে। থাক থাক ইট বেরিয়ে রয়েছে ছাদের কার্ণিশ পর্য্যন্ত।

    শিখা বলল, ”এই বেয়ে ছাদে উঠতে হবে।”

    এমন কিছু কঠিন নয়—সকলেই এক—এক করে ছাদে উঠল। ওপরের ঘরখানা তালা—চাবি বন্ধ। সিঁড়ি দিয়ে শিখা নীচে নেমে গেল, পিছন পিছন আর সকলে এল।

    সিঁড়ির মুখে সবিতার ঝিকে দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেল শিখা। বাড়ীতে তালা বন্ধ অথচ ভিতরে লোক রয়েছে! শিখা আর তার পিছনে পুলিশের এত লোক দেখে, ঝি থরথর করে কাঁপতে লাগল। ভয়ে বিবর্ণ হয়ে বলল, ”ওপরের ঘরে আছে—এই যে চাবি।”

    চাবিটা হাতে নিয়ে শিখা ওপরের ঘরের দিকে ছুটল। পুলিশ—অফিসার তার মধ্যেই জিজ্ঞাসা করলেন, ”কে আছে ওপরের ঘরে?”

    শিখা বলল, ”সবিতা—দলের পাণ্ডার স্ত্রীও বটে আবার গুণ্ডাদের লীডারও বটে। ওকে আগে অ্যারেষ্ট করতে হবে। কিন্তু ঘরে চাবি দেওয়া কেন বুঝতে পারছি না।”

    চাবি খোলা হ’ল। সবিতার বদলে শিখা দেখল, একজন আধমরা ছোকরা মুখ গুঁজে পড়ে আছে। মিট—মিট করে চাইল সে শিখাদের দিকে।

    ”কে তুমি?”—শিখা ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করল।

    অস্ফুট স্বরে ছোকরাটি বলল, ”অনন্ত!”

    ”বাড়ী কোথায়?”

    ”গরাণহাটা।”

    ”এখানে কি করতে এসেছ?”

    ”ওরা ধরে এনে রেখে গেছে।” ছোকরার চোখে জল।

    ”ওদের তুমি চেন?”—শিখা জিজ্ঞাসা করল।

    ”চিনি না। আমাদের বাসায় রোজ রাত্তিরে দেখি।”

    ”বেশ। তুমি এস। তোমার বাসায় তোমাকে আমরা পৌঁছে দেবো।”

    ”ওরা তাহলে আমাকে মেরে ফেলবে।”

    ”এখানেই যে তুমি বাঁচবে, এ ভরসা তোমায় কে দিলে?”—অফিসার বললেন।

    শিখা বলল, ”না,—কেউ মারবে না। আমরা তোমাকে বাঁচাতে এসেছি।—আমরা পুলিশের লোক।”

    অনন্ত উঠে দাঁড়াল। বড় দুর্ব্বল, নড়তে পারছে না।

    শিখা ঝিটাকে ধরে বেশ দু—চার বার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ”বল—ওরা কখন এখান থেকে গেছে?”

    ঝি বলল, ”কাল বেরিয়ে গেছে। এখনও কেউ ফিরে আসেনি।”

    ”সদরে তালা দেওয়া—কোন দিক দিয়ে গেল?”

    ঝি ইঙ্গিতে একতলার কোণের দিকে একখানা অন্ধকার ঘরে শিখাকে আসতে বলল।

    শিখার সঙ্গে সকলেই ঘরের ভিতর এসে ঢুকল। ঘরের একটা জানালার একটা গরাদ সরিয়ে ফেলল ঝি। বাইরে থেকে আসা—যাওয়ার বেশ একটা পথ তৈরী হয়ে গেল। গরাদটা আবার ঠিক জায়গায় বসিয়ে দিতেই জানালা আবার ঠিক আগের মতই হয়ে গেল। ঝি জানালার পাল্লা বন্ধ করে ছিটকানি ফেলে দিল; তারপর শিখার পায়ে ধরে কাঁদতে লাগল। বলল, ”আমি দাসী বৈ নই, আমার কি দোষ? একজন একজন করে ওরা আসবে আর আমি জানালাটা খুলে দেব—তার জন্য আমাকে ওরা অনেক টাকা মাইনে দেয়।”

    ”আজ ওরা কখন আসবে? সত্যি কথা বল, তোর ভয় নেই।” অন্ধকার ঘরের বাইরে এসে শিখা জিজ্ঞাসা করল।

    ”আসার কিছু ঠিক নেই। সারাদিন ধরে আসে আর সন্ধ্যার সময় সবাই বেরিয়ে যায়।”

    ”সবিতাও বেরিয়ে যায় রোজ?”

    ”না। মাঝে মাঝে যায়। ওর নাম সবিতা নয়, সকলে ওকে রাণীবৌদি বলে ডাকে।”

    ”ওর স্বামী শৈলেন নিরুদ্দেশ হয়েছে?”

    ”বাজে কথা। স্বামী—টামি বুঝি না—নারাণবাবুর সঙ্গে ভাব।”

    চমকে উঠল শিখা। আগে থেকেই সন্দেহ হয়েছিল! তবু তার দুর্ভাগ্যে সমবেদনা অনুভব করেছে!

    ঝিটাকে একজন কনষ্টেবলের জিম্মায় দিয়ে অন্ধকার ঘরের মধ্যে জানালাটার দুপাশে বাকী কনষ্টেবলদের লুকিয়ে রাখা হ’ল।

    ঘণ্টাখানেক কেটে গেল। আর ধৈর্য্য থাকে না!

    আরো আধঘণ্টা পরে জানালায় প্রথম টোকা পড়ল।

    নিশ্বাস বন্ধ করে শিখা ক্ষিপ্রহস্তে ছিটকানিটা খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল। বাইরের লোকটা নিজের হাতে জানালার গরাদ খুলে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ল, অমনি কনষ্টেবলরা তাকে জাপটে ধরল।

    শিখা জানালার গরাদটা যথাস্থানে বসিয়ে দিয়ে আবার জানালার ছিটকানি ফেলে দিল।

    সঙ্গে সঙ্গে লোকটার হাত পিছন দিকে বাঁধা হয়ে গেল, আর একটা লোহার পোষ্টের সঙ্গে বেশ শক্ত করে তাকে বেঁধে রাখা হ’ল। দশ মিনিট পরে আবার একজন। এইভাবে জাল পেতে ছ’জন লোক ধরা হ’ল। তারপর অনেকক্ষণ আর কেউ এল না দেখে ওদের একজনকে শিখা একটা ঘরে নিয়ে এল। রিভলভারটা তার সামনে ধরে বলল,—”বল, রাণী কোথায়?”

    ”ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে, সেখানে।”

    ”তোরা এসেছিস কেন?”

    ”অনেক খাটা—খাটনির পর একটু মদ খেতে এসেছিলুম।”

    ”টাকাটা কোথায় রেখেছিস?”

    ”রাণীবৌদির কাছে—নৌকায়।”

    আর কোন কথা জানবার দরকার নেই শিখার। পুলিশের জিম্মায় আসামীদের রেখে শ্রীরামপুরের গঙ্গার ঘাটের দিকে ছুটল শিখা; সঙ্গে মীরা আর পুলিশ—অফিসার।

    একখানা নৌকা রয়েছে। আর পালাবে কোথা? ওরা ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গিয়ে যে তক্তাখানা নৌকা থেকে ঘাট পর্য্যন্ত লাগান ছিল, তার ওপরে উঠে পড়ল। তিনজনের হাতেই রিভলভার।

    হঠাৎ নৌকাখানা ভীষণভাবে দু—পাশে দোলা খেতে লাগল। নৌকা উল্টে যায় আর কি! নৌকার গা থেকে তক্তাখানা সরে কাদার ওপর পড়ে গেল। তিনজনেই লাফিয়ে কাদায় নেমে পড়ল। পুলিশ—অফিসার আগে গিয়ে এক হাতে নৌকা ধরলেন, আর এক—হাতে উঁচিয়ে ধরলেন রিভলভার। এক হাতের জোরে নৌকাটা একটু টেনে এনে তিনজনেই নৌকায় উঠে পড়ল। নৌকার মধ্যে কেউ নেই। দু’জন মাঝি আর একজন মেয়েছেলে সাঁতরে চলেছে ঐ। শিখা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটা ডুব দিল আর মাঝি দুটো হাত তুলে নৌকার দিকেই সাঁতরে ফিরে আসতে লাগল। মাঝিদের মাথার ওপর দিয়ে শিখা আর একটা ফায়ার করল—তারা হাত জোড় করে অনুনয় করতে লাগল। শিখা রিভলভার নামিয়ে ইঙ্গিতে তাদের ফিরে আসতে বলল।

    মাঝিরা তীরে এসে উঠল, তারপর নৌকায় এল। শিখা বলল, ”টাকা কোথায়?”

    নৌকার খোলের ভিতর থেকে তিনটা ক্যাম্বিসের ব্যাগ বেরুল—ব্যাঙ্কের শীল করা।

    শিখার হুকুমে মাঝিরা নৌকা ছেড়ে দিল, শিখা হাল ধরে বসল। যেদিকে সবিতা সাঁতার দিয়ে গিয়েছিল, ভাটার টানে হু—হু করে নৌকা সেইদিকে ছুটল।

    কিন্তু বৃথা চেষ্টা! ঘণ্টা দুই নৌকা নিয়ে ঘুরেও সবিতার কোন উদ্দেশ পাওয়া গেল না।

    উপসংহার

    শ্রীরামপুরের সে—বাড়ী সার্চ করে পাওয়া গেল ছোরা—ছুরি, বোমা, বন্দুক আর লুঠ—করা গহনাগাঁটি, নোটের বাণ্ডিল এবং অনেক—কিছু।

    জানা গেল, বছরখানেক হ’ল শ্রীরামপুরে এই আড্ডা নিয়েছে ওরা। জুটমিলের সেই লেডি—টাইপিষ্ট—তার নাম হাসি—ব্যাঙ্কের সঙ্গে মিলের কারবারের খবরাখবর দেওয়া তার কাজ।

    অনন্তকে শিখা পৌঁছে দিয়েছে তার সেই গরাণহাটার বাসায়। বাড়ী—উলিকে ধমক দিতেই সে হাত—জোড় করে বলল—”অত—শত আমি জানি না মা। আমায় বলল, মেয়েরা এখন যেমন হয়েছে, আপিসে কাজ করে—ব্যাটাছেলে ক’জন কেউ ভাই, কেউ দেওর, কেউ স্বোয়ামী। ডাকাত জানলে বাড়ীতে জায়গা দিই!”

    সবিতা ভেবেছে, রেহাই পাবে? শিখা তার সম্বন্ধে হুঁশ রাখবে। শিখার বিশ্বাস, সে চুপ করে থাকবার মেয়ে নয়—আবার দল গড়ে তুলবে—তুলে আবার নতুন ভাবে তার কাজ চালাবে—তখন তাকে ধরবে, শিখার পণ।

    দায়রার বিচারে নারায়ণচন্দ্র, ভবানী ঘোষ আর বাকিদের জেল হলো তিন—চার বছর করে। মিলের তরফ থেকে শিখা পেল উপহার—বেশ দামী একছড়া জড়োয়া নেকলেশ, আর মীরা পেল লেডিস রিষ্ট—ওয়াচ…বেশ দামী ওয়াচ।

    ***

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleরত্নদীপ – প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
    Next Article গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    Related Articles

    প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Our Picks

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025

    গোয়েন্দা কৃষ্ণা – প্রভাবতী দেবী সরস্বতী

    September 20, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.