গোলোকপুরের পরশ পাথর – ১০
১০
পরাণ সাঁতরার বাড়ির সামনে ভিড় হয়ে গেছে।
পরাণ এলাকার কুখ্যাত গায়ক। সে গান গাইতে বসলে কেউ আর পড়াশুনা করতে পারে না। শুধু বাড়িতে বসেই পরাণ গান করে না, ইচ্ছে হলে সে গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির সামনে গিয়ে গাইতে শুরু করে দেয়। তাকে কেউ মারধোরও করতে পারে না। কানাঘুষো আছে বিশ্বম্ভর দারোগা নাকি পরাণের দূর সম্পর্কের আত্মীয়!
মেলার পরেই পরীক্ষা শুরু হবে। ছাত্রদের বাবা মায়েরা পরাণের বাড়ির সামনে লাইন দিয়েছে। যে করেই হোক, এই সময়টা পরাণের গান বন্ধ রাখতে হবে।
গতবছর পরাণের দু মাসের বাজার করে দিয়েছিল সবাই। এবার পরাণের দাবী বেড়ে গেছে। সে ছ মাসের বাজার দাবী করেছে। সবাই সে ব্যাপারেই দরাদরি করতে এসেছে।
সাদা রঙের ধুতি, খালি গা, আর গলায় লাল গামছা নিয়ে পরাণ বসে আছে।
রাধানাথ তালুকদার বলল, “শোন পরাণ, ছ মাসটা তিন মাস কর ভাই। আমার নাতির এবার তৃতীয়বার। তিনবারেও বেচারা মাধ্যমিক পাশ করতে না পারলে ছেলে এবার বিবাগী হয়ে যাবে”।
পরাণ গামছা দিয়ে মুখ মুছে শ্বাস ছেড়ে বলল, “গান কি অতো সহজ জিনিস গো রাধাদা? গান গাইতে না পারলে আমার পেটে ব্যথা করে, ফুসফুসে সুড়সুড়ি দেয়, লিভার শরীর থেকে বেরিয়ে আসতে চায়। তোমরা বলছো সেই গান আমাকে এক মাস বন্ধ করে বসে থাকতে হবে। সে ক্ষতিপূরণ কি এত সহজে মিটবে গো দাদা?”
পতিতপাবন শতপথী বলল, “তা বলে তোকে ছ মাসের বাজার করে দিতে হবে?”
পরাণ বলল, “দেখো। তোমরা সব বয়োজ্যেষ্ঠ লোকজন। তোমরা বিচার বিবেচনা করে যা ভাল বুঝবে তাই হবে। আমি আর কী বলি? আমি তো এই গেল বছর নিজের মাইকও কিনে ফেলেছি। তোমরা সবাই মিলে মাইকের দোকানে গিয়ে বলেছিলে আমায় মাইক না দিতে। তা বলে আমি কি গান বন্ধ করে ঘরে বসে থাকবো? আমার তো ওই একমাত্র নেশা। ওর জন্যই আমি বেঁচে আছি। এরপরও যদি তোমরা আমাকে দমিয়ে রাখতে চাও, তা কি এত সহজে হবে ভেবেছো?”
পরাণ একটা সুর গুণগুণ করে ভাঁজতে শুরু করল। তার সামনে থাকা লোকজন সে সুর শুনেই ভিরমি খেল। রাধানাথবাবুর বয়স হয়েছে। তিনি মাথা ঘুরে পড়লেন। কে একজন এসে তাকে পাখা করতে শুরু করল।
সবাই বুঝে গেল পরাণকে টলানো এতো সহজ হবে না। ফিসফিস করে সবাই আলোচনা করতে শুরু করল দরাদরি করে কীভাবে পরাণের দাবী কমানো যায়।
হঠাৎ এক ছোটোখাটো চেহারার লোক পরাণের সামনে এসে বলল, “আপনিই পরাণবাবু তো। আপনাকে রাজা বাবু ডেকেছেন। বলেছেন রাজসভায় গান গাওয়াবেন। উপযুক্ত পারিশ্রমিকও পাবেন”।
রাধানাথ পাখার হাওয়া খেতে খেতে বললেন, “রাজা বাবু? রাজতন্ত্র আছে নাকি এখনও? আমি তো শুনেছিলুম সেই কবেই সে সব চলে গেছে”।
লোকটা কটমট করে একবার রাধানাথ বাবুর দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে পরাণের দিকে তাকিয়ে বলল, “আজেবাজে লোকের সঙ্গে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ আছে? এই নিন আপনার অ্যাডভান্স। যখন ডাকবো, তখন চলে আসবেন”।
লোকটা একটা মোহর এগিয়ে দিল পরাণের দিকে। সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পরাণ দাঁত বের করে বলল, “দেখলে তোমরা? এতদিনে আমার প্রতিভার যোগ্য সম্মান দিল কেউ। কোথায় যেতে হবে আমাকে”?
“সময় হলে লোক পাঠানো হবে”, বলে লোকটা চলে গেল।
ভিড়ের লোকেরা হতভম্ব হয়ে গেল। কানাকানি শুরু হয়ে গেল।
পরাণ বলল, “রাজপ্রাসাদ থেকে ডাক এসেছে যখন, তখন তো আর কথাই নেই দাদারা। আমাকে গোটা বছরের খোরাকিই পাঠাবেন সবাই। দর তো আর কমানো যাবে না। দরাদরির ব্যাপারই নেই আর। এত বড় সম্মান প্রাপ্তির পর আর কী করে আপনাদের সঙ্গে ঝগড়া ঝামেলা করি বলুন তো?”
রাধানাথ বলল, “এ কেমন বিচার হল পরাণ? তুই গ্রামের ছেলে মেয়েদের কথা ভাববি না?”
পরাণ বলল, “গাঁয়ের কোন ছেলে আমায় নিয়ে ভেবেছে গো দাদা? ওই তো সেই যে বিশ্বনাথবাবুর নাতির পরীক্ষার সময় তিনি বললেন পরাণ, তুমি গান কোর না, আমার নাতি পাশ দিলে তোমার জন্য বড় উপহার আছে। আমি তো তখন বোকা সোকা ছিলাম। মেনেও নিয়েছিলাম তার কথা। সে নাতি পাশ করার পর বিশ্বনাথবাবু একটা বড় কুমড়ো নিয়ে এসে বললেন, এ নাও পরাণ, তোমার পুরস্কার। আমার সে কী কষ্ট। তোমরা কী ভেবেছো? এখনও আমি সেই রকম বোকা মানুষ আছি? আমি এখন চালাক হয়ে গেছি। যদি ভেবে থাকো আগের মত আমাকে বোকা বানিয়ে তোমরা পালাবে, তাহলে তোমরা ভুল ভেবেছো।”
রাধানাথ বলল, “দেখ গে তুই, যা ভালো বুঝিস কর। তোর এখন ন্যাজ মোটা হয়ে গেছে। কোথাকার কোন রাজা তোকে ডেকে পাঠিয়েছেন। তুই আর আমাদের কথা শুনবি কেন?”
পরাণ বলল, “তোমরা দেখো তোমরা কী করবে? দু খান কালোয়াতি গান তুলেছি, আমার তো সেগুলো সবাইকে শোনাতে হবে, নাকি?”
সবাই ব্যাজার মুখে মুখ চাওয়া চাউয়ি করল। এবার বোধ হয় আর পরাণকে আটকে রাখা যাবে না। গোটা বছরের খোরাকির ব্যবস্থাই করে দিতে হবে!
পরাণ হারমোনিয়াম টেনে গলা সাধতে শুরু করল। তার গানের ঠ্যালায় বাড়ির লাইট পোস্টে একটা কাক হার্ট ফেল করল। মিনু মাসির পোষা বেড়ালটা পাড়া ছাড়া হল। পাড়ার কুকুরেরা দিনে দুপুরেই ডাকাত পড়েছে ভেবে ভেবে ত্রাহি ত্রাহি রবে চিৎকার করতে শুরু করে দিল।
দূর দূরান্তে যে সব ডাকাতেরা ভেবেছিল এ গ্রামে লুঠ করতে আসবে, তারা পরাণের গান শুনে সব রকম পরিকল্পনা শিকেয় তুলে রাখল।
এদিকে কুখ্যাত কৃপণ ভব লাহিড়ী তার বাগানে একটা মোহর খুঁজে পেলেন। তিনি বাগানে বসে রোদ পোহাচ্ছিলেন। হঠাৎ দেখলেন, লাউ গাছের মাচায় কী একটা চকচক করছে। কাছে গিয়ে দেখলেন মোহর।
সেটি হস্তগত করে ভব লাহিড়ী ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলেন।
তার স্ত্রী কাত্যায়নী দেবী অবাক হয়ে বললেন, “কী হল তোমার? কাঁদছো কেন? তুমি তো মাছ কিনে আনো না। দিনের পর দিন ফ্যানা ভাত খেয়ে যাচ্ছি। কাঁদার কথা তো আমাদের। তুমি কাঁদছো কেন?”
ভব লাহিড়ী জানেন গিন্নিকে মোহরের কথা বললে আর রক্ষে নেই। তিনি কাঁদতে কাঁদতেই বললেন, “পায়ে কাঁটা ফুটেছে গিন্নি। তাই কাঁদছি”।
কাত্যায়নী গজগজ করতে লাগলেন।
ভব লাহিড়ী মনে মনে বললেন, “সব অশ্রু কি আর দুঃখের অশ্রু হয় গিন্নি? আনন্দাশ্রুও হয়”।