গোলোকপুরের পরশ পাথর – ১১
১১
জেলে ঢোকার পর পুরোপুরিভাবে যখন গণপতিবাবুর জ্ঞান ফিরল, তিনি হায় হায় করতে করতে মাথা চাপড়াতে শুরু করলেন। কতদিনের কত কষ্ট করে জমানো টাকা, কত মানুষের সর্বনাশের টাকা, কোন ভূতের পাল্লায় পড়ে সব পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে এলেন তিনি?
মনমরা হয়ে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। নিজের মাথার চুল নিজেই ছিঁড়লেন। যখন বুঝলেন তিনি একবারে নিঃস্ব হয়ে গেছেন, “ধুত্তোর” বলে হাঁটতে শুরু করলেন। একজন কয়েদি এসে জুটে গেল, “স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
গণপতি বললেন, “কর”।
কয়েদিটা গলা নামিয়ে বলল, “গোলোকপুরটা কোথায় স্যার?”
গণপতি কয়েদির দিকে তাকালেন। এ লোককে তো তিনি আগে দেখেন নি। বললেন, “কে তুমি?”
লোকটা হাসল, “আমাকে চিনবেন না স্যার”।
গণপতিবাবু বললেন, “সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু আমার কাছে এমন আজগুবি প্রশ্ন করছো কেন?”
লোকটা বলল, “স্যার আমি শুনেছিলাম আপনাদের গ্রামের কাছেই ওই জায়গা আছে। ওখানে নাকি অনেক গুপ্তধন আছে”।
এতগুলো টাকা হাতছাড়া হয়েছে। গুপ্তধনের কথা শুনে গণপতিবাবু কৌতূহলী হতে গিয়েও যখন দেখলেন অনেকেই তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে তখন যেন শুনতেই পান নি, এমন ভঙ্গীতে বললেন, “আমি ওসব জানি না। আমাকে এ কথা বলে কোন লাভ নেই”।
লোকটা বলল, “স্যারের কি গুপ্তধন ভাল লাগে না?”
গণপতিবাবু বললেন, “তুমি কি আমাকে লোভ দেখানোর চেষ্টা করছো?”
লোকটা ফিসফিস করে বলল, “স্যার, অনেক টাকা। রাতে তৈরি থাকবেন। নিয়ে যাবো”।
গণপতিবাবু চিন্তিত মুখে লোকটার দিকে তাকিয়ে বললেন, “আচ্ছা”।
লোকটা উশখুশ করে চলে গেল। গণপতিবাবু বসে বসে অনেকক্ষণ ভাবলেন। নাহ, যা করেছেন, তা ঠিক করতে হলে তাকে জেলের বাইরে যেতেই হবে। সারাজীবন জেলে বসে থেকে নিজের পাপের সাজা ভোগার কোন মানে হয় না।
দুপুরে তার ভাই পরাগ তার সঙ্গে দেখা করতে এলে গণপতিবাবু বললেন, “গ্রামের খবর কি? বাইরের লোকজন কি খুব আসছে?”
পরাগ বললেন, “হ্যাঁ। তা আসছে। এখন তো মেলা চলছে। লোক তো আসবেই”।
গণপতিবাবু মাথা নাড়লেন, “ঠিক কথা। এখন অনেক রকম মানুষ আসবে। তোরা খেয়াল রাখিস। নজর রাখবি। বাইরের লোকজন খুব বেশি গ্রামের ভেতরে এলে সবাইকে সতর্ক থাকতে হয়। তারা যেন ঠিক করে ট্যাক্স দেয়, তার দায়িত্বও তো নিতে হবে”।
পরাগ বলল, “সে তো নিতেই হবে। ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আর এদিক সেদিক লুকোনো টাকাগুলো কী করবো দাদা?”
গণপতি বললেন, “যত্ন করে রেখে দে। যেখানে যে টাকা দরকার পড়ে, আগেই কোন কিছু না ভেবে হুট করে খরচ করে ফেলবি না। অনেক হিসাব করতে হবে। খাতা কলম নিয়ে বসতে হবে। আমাকে আবার নতুন করে সব টাকা জমাতে হবে”।
পরাগ অবাক হয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে বলল, “কত টাকা জমাতে হবে?”
গণপতি দেখলেন জেলার তার দিকেই আসছেন। তিনি সঙ্গে সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর পাল্টে নিয়ে বললেন, “সৎপথে উপার্জন করা অর্থের বাইরে যে টাকা পাওয়া যায়, তা নিয়ে আনন্দ করা উচিত না। তা যার টাকা, তাকেই দিয়ে দেওয়া উচিত। তুই যা। আমার কিছু ভাল লাগছে না। মনটা কেমন কু গাইছে”।
পরাগ অবাক হয়ে গণপতির দিকে তাকালো। তার দাদা কি পাগল হয়ে যাচ্ছে? রকম সকম দেখে সেরকমই মনে হচ্ছে বটে।
ভারাক্রান্ত মনে পরাগ জেল থেকে বেরোল। গণপতি তার সেলে ফেরত যাবার পথে দেখলেন সকালের লোকটা তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে আছে। লোকটাকে তিনি কোনদিন দেখেন নি। তবে লোকটার কথা শুনে মনে হয়েছে এ মিথ্যে আশা দেওয়ার লোক না। তাকে যখন বলেছে জেল থেকে বের করে নিয়ে যেতে পারবে, তখন ভরসা করে দেখাই যায়।
নিজের সেলে ফেরত এসে গণপতি দেখলেন মেঝেতে একটা মোহর পড়ে আছে। তার চোখ দুটো চকচক করে উঠল। এই তো, এরকম খান কয়েক পেলেই তো তার সব ক্ষতি উঠে আসবে।
ঝাঁপিয়ে পড়ে মোহরটা হস্তগত করলেন তিনি।
#
রাতে গৌরীনাথের ঘুম এল না। বার বার গবার কথা মনে পড়ছিল। বনের মধ্যে অনেকরকম বিপদ থাকতে পারে, তার উপর গবা আবার কাদের কথা বলছিল। তারা তাদের গ্রামে এসে কী কী ঝামেলা করতে পারে সে কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না।
একসময় সে উঠে বসে পড়ল। ঘড়িতে রাত একটা বাজে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
গৌরীনাথ পকেটে টর্চ নিয়ে সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে তার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
নিশুতি রাতে গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। মেলার মাঠের শব্দেরা থেমে গেছে। পোড়ো বাড়ির কাছে এসে সাইকেল রেখে সে জঙ্গলের ভিতর হাঁটতে শুরু করল।
মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে সে রাস্তা ঠাহর করার চেষ্টা করতে লাগল। জঙ্গল এখানে ঘন হতে শুরু করেছে। কিছুটা আসার পর গৌরীনাথের মনে হল সে পথ হারিয়ে ফেলেছে। বুকটা ঢিবঢিব করতে লাগল।
সে ডাক দিল, “গবাদা, ও গবাদা”।
কানের কাছে কে যেন ফিসফিস করে উঠল, “আ মোলো যা। এভাবে গলা ছাড়তে আছে? কাছে পিঠে কে আছে না জেনেই চিৎকার জুড়ে দিলে?”
গৌরীনাথ ফিসফিস করল, “পাঁচুদা? আমি কী করে জানবো কে আছে”?
গলাটা বলে উঠল, “অনেকেই আছে। সবাই তাকে খুঁজছে। তুমি আলো জ্বেলো না। একবারে নাক বরাবর হেঁটে চলো তো বাছা। কাউকে দেখতে না পেলেও জেনে রেখো এখানে অনেকেই তোমার চারপাশে আছে। ভয় পেও না। শুধু হেঁটে যাও”।
গৌরী চারদিকে তাকিয়ে দেখল। নাহ। কেউ আছে বলে তো মনে হচ্ছে না।
পাঁচু বুঝল গৌরী কী বলতে চাইছে। বলল, “যেটা বোঝো না, সেটা এখন বোঝার চেষ্টা করে লাভ নেই। নাক বরাবর হাঁটতে থাকো”।
গৌরী মাথা নেড়ে “আচ্ছা” বলে হাঁটতে শুরু করল। পাঁচুই তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল।
অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পায়ের মধ্যে জঙ্গলের ঝোপ, আগাছা এসে লাগছে। সব কিছু অগ্রাহ্য করে ঘোরের মধ্যে গৌরী অনেকক্ষণ ধরে হাঁটার পর দেখল জঙ্গলের মধ্যে কারা মশাল জ্বালিয়েছে। অনেক লোক ভিড় করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাদের চোখ জ্বলজ্বল করছে।
গৌরীনাথ অবাক হয়ে বলল, “একী? আমি কোথায় এলাম? কোথায় নিয়ে এলে আমায়?”
পাঁচু বলল, “তোমার এখানেই আসার ছিল। দিয়ে গেলাম। এবার আমি যাই”।
গৌরী অনেক করে ডাকলো। পাঁচুর গলার স্বর আর পাওয়া গেল না।
গৌরী দেখল লোকগুলো তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।