গোলোকপুরের পরশ পাথর – ১২
১২
শম্ভু ঘুমাচ্ছিল। হঠাৎ কে যেন তাকে ঠেলে তুলে দিল।
সে তড়িঘড়ি উঠে দেখল তার সামনে গবা তান্ত্রিক বসে আছে।
শম্ভু অবাক হয়ে বলল, “তুমি?”
গবা বলল, “পোড়োবাড়ির জঙ্গলে যাও শিগগিরি। বড় বিপদ। ওরা এসে পড়েছে”।
শম্ভু বলল, “কার বিপদ?”
গবা বলল, “সবার বিপদ। সবার। যাও। রাজা বাবু এসে গেছে”।
শম্ভু বলল, “সেই লোকটা, যে রাজ পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়?”
গবা হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল।
শম্ভু দু হাত দিয়ে নিজের দু চোখ কচলালো। এ আবার কী? এরকম তো সে কোনদিন দেখে নি? গবার সম্পর্কে এতদিন ধরে যা যা শুনেছে, তার সবই সত্যি নাকি?
শম্ভু বিছানা থেকে উঠে হাতে একটা শক্ত লাঠি নিয়ে রাস্তায় বেরোল।
কিছুটা যেতেই তার চোখে পড়ল সেই লোকটা, যাকে সে বলেছিল তার অনেক সম্পত্তি লাভ হবে। তাকে দেখে সে বলল, “আপনি এখানে?”
লোকটা কেমন সম্মোহিত চোখে তাকে দেখল। উত্তর দিল না। শম্ভু বুঝল এ লোকটা উত্তর দেওয়ার অবস্থায় নেই।
আরেকটু হাঁটতেই সে দেখল গণপতিবাবুও জোরে হেঁটে চলেছেন।
শম্ভু ডাকল, “স্যার, আপনি জেলে ছিলেন না?”
গণপতিবাবু তার দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে বললেন, “কারার ওই লৌহকপাট, ভেঙে ফেল কর রে লোপাট, রাজাবাবু ডেকেছে, রাজাবাবু ডেকেছে। এখন সব কাজ ফেলে তার কাছে যেতে হবে। চলে এসেছি জেল থেকে পালিয়ে। রাজাবাবু যখন ডেকেছে, খাজনা তো দিতেই হবে”।
রাস্তায় একে একে কুলি রামরিখ, হরিপদ বসাক, ভব লাহিড়ী, শহরের খান চারেক ষণ্ডা গুণ্ডা লোক, সবার সঙ্গেই দেখা হয়ে গেল। তাদের সবার হাতে একটা করে মোহর। তারা মোহাবিষ্টের মত জঙ্গলের দিকে হেঁটে চলেছে।
পোড়ো বাড়ির জঙ্গলে এসে শম্ভু গৌরীনাথের সাইকেলটা দেখে বিস্মিত হল। মনে মনে বলল, “এখানে গৌরী কী করছে? তাও এতো রাতে? নাহ, বেশি ভেবে লাভ নেই। আমি বরং জঙ্গলে ঢুকে দেখি”।
শম্ভু জঙ্গলের ভিতর রওনা দিল।
#
পরাণ গান ধরেছে। চারদিকের লোকেরা তার গান শুনে প্রবল উৎসাহে “আহা উঁহু” করছে।
পরাণ উৎসাহিত হয়ে আরো বেসুরো গাইছে।
পরাণের গানের গুঁতোতেই গৌরীনাথের ঘুম একপ্রকার ভেঙে গেলে। লোকগুলোকে দেখে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে ছিল সে।
উঠে বসলেও কেউ তার দিকে ফিরেও তাকালো না। কত অজানা অচেনা লোক চারদিকে। মশালের আলোয় দেখা গেল একজন লোক জরির পোশাক পরে সিংহাসনে বসে আছে। তার পায়ের কাছে গবা পড়ে আছে।
পরাণের গান শেষ হতেই লোকটা এক গাদা মোহর পরাণের দিকে ছুঁড়ে দিল। পরাণ সেগুলো কুড়িয়ে নিয়ে আবার গান ধরতে যেতেই লোকটা হাত তুলে তাকে বারণ করল, “থামো এবার”।
পরাণ ব্যাজার মুখে গান থামাল।
লোকটা বলল, “অনেকদিন পরে গোলোকপুরে এসে ভাল লাগছে”।
সবাই হই হই করে উঠল, “ভালো লাগছে। ভালো লাগছে। জয় রাজা অনঙ্গনাথের জয়”।
গৌরী বুঝল এই লোকটাই তবে রাজা অনঙ্গনাথ। এরকম পোশাক পরে আছে কেন? লোকটার চোখ মুখ কেমন অস্পষ্ট। খানিকটা দেখা যাচ্ছে, খানিকটা নয়। অসম্পূর্ণ একটা মুখ।
রাজা অনঙ্গনাথ বলল, “এবার মজা দেখার সময়”।
সবাই চিৎকার করে উঠল, “ভারি মজা। ভারি মজা”।
রাজা বলল, “এই পৃথিবীর লোভী মানুষ, তোরা গোল্লায় যা”।
রাজা মাটির উপর পদাঘাত করল। তার সামনের মাটি সরে গিয়ে বড় একটা খাদ তৈরি হল।
রাজা চোখ বন্ধ করে ডাকল, “আয় আয়, আয় রে যত মোহর লোভীর দল, আয়, সব তোরা আয়”।
সবার আগে এল রামরিখ। মানুষের ভিড়ে দাঁড়িয়ে ছিল সে। রাজার ডাক শোনার সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে খাদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
তারপর এল হরিপদ, গণপতিবাবু, ভব লাহিড়ী, তারক আর তার দলবল। এক একজন খাদে পড়ছে, আর সবাই হৈ হই করে উঠছে।
গৌরীনাথ অবাক হয়ে দেখল ধীরে ধীরে রাজার চোখ মুখ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
রাজা বলল, “সব মানুষ লোভী হয়ে গেছে। পরদ্রব্য দেখা মাত্রই তারা তা দখল করে নিচ্ছে। এদের আমি পরীক্ষা করছিলাম। এরা সবাই এই পরীক্ষা ফেল করেছে। আর, এই যে, আমি এই ছেলেটাকে একটা পাথর দিয়ে গেছিলাম। বলেছিলাম সামলে রাখিস। ছেলেটা কী করল? পাথর থেকে মোহর তৈরি করল। আমার যখন ফেরার সময় হল, আমায় বলল পাথরটা হারিয়ে ফেলেছে”।
সবাই হই হই করে উঠল, “হারিয়ে ফেলল। ছি ছি ছি। হারিয়ে ফেলল। ধিক ধিক ধিক”।
রাজা অনঙ্গনাথ গবার গায়ের উপর পা তুলে বলল, “তোর শাস্তি হবে। দোষীর গর্দান যাবে”।
সবাই আবার হই হই করে উঠল, “গর্দান যাবে, গর্দান যাবে”।
রাজা বলল, “ওর গর্দান আমি নিজে দেবো। এই, কে আছিস রে, তলোয়ারটা দে”।
সবাই ব্যস্ত সমস্ত হয়ে পড়ল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে রাজার কাছে একটা তলোয়ার চলে এল।
রাজা তলোয়ার নিয়ে নাচতে নাচতে ঘুরতে ঘুরতে বলল, “বল রে পামর, এখনও সময় আছে। তুই কোথায় ওই পাথরটা লুকিয়ে রেখেছিস?”
গবা বলল, “রাজামশাই, আপনি ওই পাথর পেলে এই পৃথিবীটাই শেষ হয়ে যাবে। আমি শুধু আমার কাজ করেছি মাত্র। এই পৃথিবীটাকে বাঁচাতে হবে যে”।
রাজা হো হো করে হেসে উঠে বলল, “জেনে গেছিস তবে? বাহ বাহ, বেশ। তা বল দেখি নিরীহ লোভী মনুষ্য শাবক, তুই এই পৃথিবী বাঁচাবি? ওরে হতচ্ছাড়া, তুই নিজে বাঁচলে তো পৃথিবীর বাঁচার কথা ভাববি। যে পৃথিবীতে এত এত লোভী মানুষ ভর্তি সেই পৃথিবী বাঁচিয়ে রেখেই বা কী হবে? তোর নিজের গ্রামের বিনা পরিশ্রমে মোহর পেয়ে কেমন সব কিছু ভুলে গেছে। লোভী মানুষেরা এই পৃথিবীটা নষ্ট করে দিয়েছে। সবাই লোভী, তুই নিজেও লোভী। তোদের সবার শাস্তি মৃত্যু।”
রাজা তলোয়ার মাথার উপর তুলল।
গবা চোখ বন্ধ করল।
গৌরীনাথ আর পারল না। সে চিৎকার করে উঠল, “গবাদাদাকে মারবেন না। পাথর আমার কাছে আছে”।
সবাই তার দিকে তাকালো। রাজা তলোয়ার নামিয়ে গৌরীনাথের দিকে এগিয়ে এসে তাকে ভাল করে দেখে বলল, “তোর কাছে আছে? দে তবে। কোথায় রে আমাদের পৃথিবী, কোথায়? আয় আয় আয়… আমাদের পাথর পাওয়া গেছে… আমাদের চাবি খুঁজে পাওয়া গেছে।”
রাজা বলার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ ফুঁড়ে একটা বিরাট গোলোক মাঠের মধ্যে এসে হাজির হল।
রাজা গৌরীনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, “দে দে দে… তোর পাথর খানা দে। ওই পাথরটা আমাদের এই গোলোকে জুতে দিলেই গোলোকপুরে আবার আগের মত আমরা সবাই চলে আসবো। দে রে খোকা। শিগগিরি দে”।
সবাই চিৎকার করে উঠল, “দে দে দে দে… দে রে খোকা, দে”।
গবা হতাশ মুখে গৌরীনাথের দিকে তাকালো।
গৌরীনাথের হাত পা কাঁপছিল। তবে সে মন শক্ত করে বলল, “ও পাথর যে আমি এখানে নিয়ে আসি নি”।
রাজা বিফল আক্রোশে মাটিতে লাথি মেরে বলল, “কোথায় আছে সেটা?”
গৌরী বলল, “আমাদের পুকুরে”।
রাজা বলল, “চল। সবাই মিলে তোদের পুকুরে যাবো। চল”।
গৌরীনাথ রাজার দিকে তাকিয়ে বলল, “রাজামশাই ও পাথর আমি পুকুরে ফেলে দিয়েছি”।
রাজা বড় বড় চোখ করে গৌরীনাথের দিকে ঝুঁকে এসে বলল, “ফেলে দিয়েছিস? তোর সাহস তো কম না নেংটি ইঁদুর। তুই জানিস না ও পাথর থেকে সোনা তৈরি করা যায়?”
গৌরীনাথ বলল, “সোনা দিয়ে আমি কী করব? আমার ও সোনা লাগবে না”।
রাজা অবাক হয়ে গৌরীনাথের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “লাগবে না”?
গৌরীনাথ জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, “না, লাগবে না। ও পাথর আমার কোন কাজে লাগবে না। কোন অলৌকিক জিনিসই আমার কোন কাজে লাগবে না। ওই পাথর দিয়ে আমি যা মোহর পেয়েছিলাম, সেগুলিও পুকুরে ফেলে দিয়েছি”।
রাজা অবাক হয়ে গৌরীনাথের দিকে তাকাল। তার হাত থেকে তলোয়ার খসে পড়ে গেল। রাজা বলল, “এখনও নির্লোভ নিষ্পাপ মানুষ এই পৃথিবীতে আছে? এটা সম্ভব?”
গৌরীনাথ শুনতে পেল কে যেন দূর থেকে বলছে, “সাবাস গৌরী, এবার রাজাকে ছুঁয়ে দে… তাহলেই খেল খতম”।
রাজা সেটা শুনতে পেলো। সে ভয় পেয়ে গোলোকটার দিকে ছুটতে শুরু করল।
গৌরীর মনে হল সে যেন ওভারের লাস্ট বলে ফিল্ডিং করছে। বলটা মাঠের বাইরে যাবো যাবো করছে। বলটা না আটকাতে পারলে তার দল গোটা ম্যাচটাই হেরে যাবে। সে ঝাঁপিয়ে পড়ে রান আটকাবার মত করে রাজার গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মুহূর্তের মধ্যে রাজা, অতো বড় গোলোক, রাজার সাঙ্গ পাঙ্গ- সব অদৃশ্য হয়ে গেল।
গৌরীনাথ মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, শম্ভু ছুটে এসে তাকে ধরল, “ভাগ্যিস মনে পড়ে গেছিল এই লোকটার কপালে আবছা আবছা দেখেছিলাম নির্লোভ মানুষের ছোঁয়ায় এর ধ্বংস অনিবার্য। ভাগ্যিস”।
গবা উঠে বসে দৌড়ে এসে গৌরীনাথকে জড়িয়ে ধরে বলল, “সাবাস গৌরী, তুই আজ গোটা পৃথিবীটাকে রক্ষা করলি”।
গৌরীনাথ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কিন্তু গণপতি জ্যেঠু, রামরিখ, আর কারা কারা যে ওই খাদে পড়ে গেল। তারা তো মরে গেলো। ওরা কি আর ফিরে আসবে না?”
দূর থেকে একটা হাই তোলার শব্দ পাওয়া গেল। গণপতিবাবু মাটি থেকে উঠে বসে হাই তুলে বললেন, “বাপরে, কী ঘুমালাম রে”।
গবা বলল, “ওই দেখ, কেউ মরে নি। তুইই সবাইকে ফিরিয়ে এনেছিস”।
তারক লজ্জা লজ্জা মুখ করে উঠে দাঁড়িয়ে গবার হাত ধরে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দে ভাই। আমার বড় ভুল হয়ে গেছে। এবার আমি তোর সঙ্গে বসে ধর্ম কর্ম করব। আর কোনদিন পরদ্রব্যে লোভ করবো না”।
শম্ভু তারকের কপাল দেখে বলল, “হ্যাঁ, আপনার কপালে মানব সেবা লেখা আছে বটে”।
গণপতি বললেন, “আর আমার কপালে কী আছে?”
শম্ভু বলল, “আপনি জেল ভেঙে এসেছিলেন। আবার জেলভোগই আছে”।
গণপতি বললেন, “তা হোক। জীবনে শান্তি থাকলেই হল”।
পূব আকাশ লাল হতে শুরু করেছে।
পরাণ বলল, “এই সুন্দর সকালে একটা গান গাইতে হবে। আমি যে দুখান কালোয়াতি গান তুলেছিলাম, সে গানখানা গেয়ে ফেলি, কী বল ভাই গৌরীনাথ?”
কলকাতার গুণ্ডারা বোঝে নি পরাণ গান গাইলে কেমন গাইবে। তারা হই হই করে পরাণকে গান গাইবার জন্য উৎসাহ দিল। তারপর পরাণ গান ধরতেই দলবল মিলে তাকে তাড়া করল।
গৌরীনাথের মনে পড়ল আজও তার ম্যাচ আছে।
কলকাতা থেকে বড় বড় নির্বাচকেরা শুধু তার খেলা দেখার জন্য ভুবনপুরে আসবে।
সে জেনে গেছে আগের দিনে সে নিজেই রান করেছিল। কোন ব্যাট তার হয়ে রান করে দেয় নি।
তার চোয়াল শক্ত হল।
আবার কত কিছু প্রমাণ করার আছে তার।
অন্য কারো কাছে না।
শুধু নিজের কাছে…
-সমাপ্ত-