গোলোকপুরের পরশ পাথর – ২
২
“তাহলে তোমার মেলায় একটা দোকান লাগবে?”
গণপতিবাবু চশমার ফাঁক দিয়ে শম্ভুর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন।
গণপতিবাবু এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। এবার মেলায় দোকান বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছেন। শম্ভু ঠিক করেছে মেলা থেকেই সে তার জ্যোতিষ বিদ্যা জাহির করা শুরু করবে। গণপতিবাবু দোকান বিতরণের দায়িত্ব পেয়েছেন শুনে সে সটান গণপতিবাবুর বাড়িতে চলে এসেছে।
কয়েক বছরের মধ্যেই বিরাট বাড়ি হাঁকিয়ে ফেলেছেন গণপতিবাবু। আগে বাজারে ছোট একটা দোকান ছিল। এখন তার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে একাকার। বড় এক খান ভুঁড়িও বাগিয়েছেন। তবে লোকে বলে গণপতিবাবু এখনও মানুষের ভাল করার চেষ্টাই করেন। তাই শম্ভুর মনের কোণে কিঞ্চিত আশা এখনও টিম টিম করে জ্বলছে।
শম্ভু মাথা নেড়ে বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ”।
গণপতিবাবু বললেন, “কীসের দোকান দেবে তুমি?”
শম্ভু বলল, “আজ্ঞে আমি হাত দেখি, মেলার মধ্যে তারই একটা ছোট চেম্বার মত খুলবো”।
গণপতিবাবু চোখ কপালে তুলে বললেন, “বটে! তুমি হাত দেখো? তা রাধাকান্তবাবুর থেকেও ভাল হাত দেখো নাকি হে?”
শম্ভু জিভ কেটে বলল, “না না। কী যে বলেন? অতো বড় জ্যোতিষী কি আর হতে পারবো? আমি শিক্ষানবিশ আর কী! চেষ্টা চরিত্তিরটুকুই করতে পারি”।
গণপতিবাবু বললেন, “না না। ওসব তুমি যাই কর, তার জন্য আলাদা দোকান দেওয়ার ব্যবস্থা করা যাবে না। তুমি একটা টিয়াপাখি আর শতরঞ্চি নিয়ে মাটিতেই বসে পড়বে না হয়। আলাদা দোকানঘরে কাজ নেই”।
শম্ভু বলল, “আজ্ঞে আমার টিয়াপাখি নেই”।
গণপতি বললেন, “তা যা আছে, তাই নিয়ে মাটিতে বসে পড়বে। আমি মেলার ছেলেদের বলে দেবো। যাও এখন, আমার অনেক কাজ”।
শম্ভু ব্যাজার মুখে উঠল। শতরঞ্চি পেতে মাঠে বসলে কি কেউ পাত্তা দেবে? দোকান না দিলে লোকে গুরুত্বই দেয় না। শুধু তাদের গ্রামের লোকই তো নয়, আশে পাশের গ্রামের লোকেরাও ভিড় করে মেলায় আসে। এত লোকের ভিড়ে যদি তাকে সেই মাঠেই বসতে হয়, তাহলে আর কী লাভ হবে? গণপতিবাবু কেমন চোখ ছোট ছোট করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। শম্ভু ফস করে বলে বসল, “কর্তাবাবু, আপনার হাতটা কি একটু দেখতে পারি?”
গণপতিবাবু বললেন, “তা দেখতে পারো, তবে তা বলে আলাদা দোকান দাবি করে বোস না বাপু। ভদ্রলোকের কিন্তু এক কথা। তোমার জন্য আলাদা কোন দোকান আমি দেবো না”।
শম্ভু মাথা নাড়ল, “না না। আপনার কথাই শিরোধার্য”।
গণপতিবাবু দু হাত এগিয়ে দিলেন তার দিকে। শম্ভু সে হাত দেখার আগে গণপতিবাবুর কপালের দিকে চোখ দিল।
কী সর্বনাশ! মেলার আগেই যে ভদ্রলোককে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে! তার চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠছে ছবিগুলো। বেশি দিনের কথা না, দিন কয়েক হল সে দেখেছে মানুষের মুখের দিকে তাকালে সে ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে। প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না।
পরে পাড়ার কয়েকজনের উপর পরীক্ষা করল। নিজেই অবাক হয়ে গেছিল প্রথমে। পরে যখন নিশ্চিত হল, ঠিক করল বেকার বসে না থেকে মানুষের ভবিষ্যৎ দেখার কাজই করা যাক। পাড়ার গজুখুড়ো বলে এ দৃষ্টি সবার থাকে না। যার থাকে, সে সত্যিই ভাগ্যবান। অন্যের ভাগ্য দেখার চোখ ঈশ্বর খুব কম লোককে দেন।
গণপতিবাবুর কপাল দেখে শম্ভু চমকে উঠল। গণপতিবাবু সন্দিগ্ধ গলায় বললেন, “কীহে, কী হল?”
শম্ভু বলল, “খুব ভাল হাত বাবু। আমি এখন আসি”।
গণপতিবাবু বললেন, “ভাল হাত মানে?”
শম্ভু বলল, “অনেক উন্নতি লেখা আছে”।
গণপতিবাবু বিরক্ত গলায় বললেন, “তা বলার জন্য আবার জ্যোতিষ লাগে নাকি? ও তো আমিই জানি। তুমি বাপু যাও তো। যত আজেবাজে বুজরুক সেজে চলে এলে জ্যোতিষী হবে বলে। এ কি অতো সোজা কাজ নাকি হে?”
শম্ভু আর দাঁড়াল না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
মেলার মাঠে বাঁশ পড়ছে। বড় বড় গাড়ি এসে দাঁড়াচ্ছে। কত লোক আসছে, কত দোকান। দূর দূরান্তের লোক এসে জড়ো হচ্ছে মাঠে। চেনা জায়গাটাই অচেনা হয়ে যাবে আগামী ক’টা দিন।
শম্ভু সাইকেল রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এবার স্বপ্ন ছিল দোকান দেবে, স্বপ্নটা সত্যি হল না। মেলার জন্য আশে পাশের এলাকাসহ তাদের গ্রামের লোকেরা সারা বছর ধরে বসে থাকে। পসার জমাতে হলে এর থেকে ভাল জায়গা আর হয় না।
সে মাঠের মধ্যে হাঁটতে শুরু করল। মাঠের এক কোণে একটা দোকান হয়েছে। দোকানের পাশে লরি এসে দাঁড়িয়েছে।
একটা বড় বোর্ড নামল লরি থেকে। “ভবিষ্যৎ জানুন, মাত্র দশ টাকায়”।
শম্ভু দাঁড়িয়ে গেল। এরা কি গণপতিবাবুকে অনেক টাকা দিয়েছে? একটা লম্বামত লোক নির্দেশ দিচ্ছিল। শম্ভু লোকটার কাছে গিয়ে বলল, “কে ভবিষ্যৎ বলবেন?”
লোকটা তার আগা পাস্তালা দেখে বলল, “মেলার সময় আসবেন। তখন দেখবেন”।
শম্ভু হাত কচলে বলল, “আমিও জ্যোতিষ চর্চা করি। একটু কথা বলতে পারলে ভাল হত”।
লোকটার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। লোকটা বলল, “ভালো তো। মেলায় আসবেন। দশ টাকা নিয়ে আসবেন। তখন বলে দেবো”।
শম্ভু বুঝল এই লোকটাই ভবিষ্যৎ বলবে। সে লোকটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বলল, “আপনি তো জ্যোতিষী নন। এখানে কেন এসেছেন?”
লোকটা চমকে তার দিকে তাকালো। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “কে আপনি?”
শম্ভু বলল, “মেলায় আমি শতরঞ্চি নিয়ে বসব। আসবেন, বলে দেবো”।
লোকটা কেমন ভেবলে যাওয়া মুখে তার দিকে তাকালো। শম্ভু আর দাঁড়ালো না। মেলার মাঠ অনেক বড়। ঘুরতে সময় লাগবে। সে একা একা ঘুরতে লাগল। এই প্রস্তুতির সময়টাই তার দেখতে বেশি ভাল লাগে। মেলা শুরু হওয়া মানেই তো শেষ হয়ে যাবে। তারপর মন খারাপের পালা। গোটা বছর জুড়ে অপেক্ষা করে যাওয়া।
এক কোণে নাগরদোলা বসে, তার পাশে টয় ট্রেন। টয় ট্রেনের লাইন পাতা হচ্ছে। চারদিকে সাজো সাজো রব। দাঁড়িয়ে থেকে সেই কাজই দেখছিল শম্ভু হঠাৎ সে গলা খাকরানির শব্দ পেল। পাশ ফিরে দেখল সেই লোকটা। তাকে দেখে বলল, “বলছি শুনুন না, আপনি কী করে জানলেন, আমি জ্যোতিষী নই?”
শম্ভু উদাস গলায় বলল, “জানি না”।
লোকটা বলল, “আপনি কি জ্যোতিষী?”
শম্ভু বলল, “চেষ্টা চরিত্তির করছি। যদি হতে পারি, তাহলে তো ভালোই”।
লোকটা হাত কচলে বলল, “মানে কী জানেন তো, আমি অনেক চেষ্টা করেছি, গ্রামে বিশেষ নাম করতে পারি নি, কিন্তু অনেক দিন ধরেই লেগে আছি। শুধু একজন সদগুরু পেলে জীবনটা বর্তে যেতো। বলছি দাদা, আপনি কি আমার গুরু হবেন? আমার খুব বড় ব্যবসা আছে জানেন তো, কিন্তু নেশা ওই একটিই। মানুষকে দেখলে বোঝা যায় কে কী পারে। আপনি আর না করবেন না”।
শম্ভু অবাক হয়ে বলল, “আমি তো নিজেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমি কী করে ওসব হব?”
লোকটা শম্ভুর হাত জড়িয়ে ধরে বলল, “আপনি আমার দোকানে বসবেন। আর আমি আপনার থেকে শিখবো। আপনি না করবেন না”।
শম্ভু হাঁ করে লোকটার দিকে তাকালো। আজ এরকমটা হবার কথা ছিল বুঝি?
সে নিজের ভাগ্য কেন নিজেই দেখতে পারে না?