গোলোকপুরের পরশ পাথর – ৩
৩
নন্তু টোটোর সঙ্গে গঙ্গারাম রিকশাওয়ালার আজকাল খুব ঝামেলা চলছে। নন্তু নতুন টোটো চালাচ্ছে। আর গঙ্গারাম অনেকদিন ধরে এলাকায় রিক্সা চালায়।
গঙ্গারাম কিছুতেই নন্তুকে দেখতে পারে না। নন্তু তার ব্যবসা কমিয়ে দিয়েছে। এদিকে নন্তুও গঙ্গাকে দেখলেই ঠাট্টা করতে শুরু করে। “ও কাকু, ওই রিক্সা টেনে আর কতদিন? তুমি বরং আমার মত একটা টোটো কিনে ফেলো”।
গঙ্গা বলে, “যা যা। তুই কী বুঝবি পরিশ্রমের মূল্য? ফাঁকিবাজি করে ব্যাটারিতে এদিক ওদিক লোক নিয়ে যাস। এক টাকার বেশি ভাড়াই নেওয়া উচিত না। তুই তো ঠগ”।
নন্তু রেগে গিয়ে বলে, “আর তুমি যে প্রত্যেকবার মেলা হলেই দশ টাকার ভাড়া কুড়ি টাকা করে নাও, তার বেলা? সেটা বুঝি ঠগবাজি নয়?”
গঙ্গা গম্ভীর গলায় বলে, “সেটাকে ডিমান্ড সাপ্লাই বলে। ডিমান্ড বাড়লে সাপ্লাই কমে, তখন দাম বেড়ে যায়। একে ব্যবসা বলে। ঠগবাজি না। মাথায় ব্যাটারি থাকলে বোঝা সম্ভব না, বুঝলে খোকা?”
নন্তু গজগজ করতে থাকে, “এতোই যখন জানো তখন শহরে গিয়ে চাকরি না করে রিক্সা চালাচ্ছো ক্যানে?”
গঞ্জের স্টেশনে বসে দুজনে এদিনও ঝগড়া করছিল, এমন সময় ভুবনপুর স্টেশনে একটা ট্রেন এসে দাঁড়াল। এ ষ্টেশনে খুব বেশি প্যাসেঞ্জার কোন কালেই নামে না। তবু নন্তু আর গঙ্গা দুজনেই আশায় থাকে। যদি কেউ যায়।
একটা লম্বা মত লোক, দেখে বোঝাই যাচ্ছে শহর থেকে এসেছে, গট গট করে এসে নন্তুর কাছে এসে বলল, “গবা তান্ত্রিকের বাড়ি যাবো”।
নন্তু লোকটার আগাপাস্তলা দেখে বলল, “গবার বাড়ি যাবেন? কেন”?
লোকটা বিরক্ত হয়ে বলল, “তাতে তোমার কী হে ছোকরা? যাবে কি না বল?” ছোকরা বলায় নন্তু রেগে গিয়ে বলল, “যাবো না”।
লোকটা বিরক্তমুখে বলল, “ডিজগাস্টিং”।
তারপর গঙ্গার দিকে ফিরে বলল, “তুমি যাবে?”
গঙ্গা বলল, “পঞ্চাশ টাকা নেবো”।
লোকটা গঙ্গার রিক্সায় উঠে বলল, “তাই নেবে। চল”।
গঙ্গা প্যাডেলে চাপ দিয়ে নন্তুর দিকে তাকিয়ে বলল, “ছেলে ছোকরারা বড্ড বেশি কথা শিখে গেছে”।
লোকটা বলল, “তা যা বলেছেন”।
নন্তু কটমট করে গঙ্গার দিকে তাকালো।
শীতের দিনে রিক্সা চালাতে অতো পরিশ্রম হয় না। তবে গঙ্গার বয়স হচ্ছে। আর গবার বাড়িও অনেক দূরে। গ্রামের শেষ প্রান্তে। সামান্য হাঁফ ধরছিল তার। গঙ্গা কথা বলে হাঁফ ধরা কমানোর চেষ্টা করল, “বাবু কি এ গ্রামে নতুন এলেন?”
লোকটা বলল, “হ্যাঁ। আমি কলকাতা থেকে আসছি। গবার সঙ্গে কিছু কাজ ছিল”।
গঙ্গা বলল, “গবার সঙ্গে দেখা করতে অনেক দূর দূরান্ত থেকেই লোকজন আসে। আগে তো গবা বুজরুক ছিল। কিছুই করতো না। কত লোকের থেকে বুজরুকি করে টাকা নিয়েছে। পরে নাকি কোন এক বাবা ওকে দেখা দিয়েছিল। তার পর থেকে গবার ভোলচালই পাল্টে গেছে। এখন গবার নাম হয়েছে”।
লোকটা বলল, “সেই নাম শুনেই তো আসা”।
গঙ্গা বলল, “গবা কিন্তু সব সময় কথা বলতে চায় না। মাঝে মাঝে একবারে থম মেরে যায়”।
লোকটা বলল, “সেকি? তাহলে কী করে হবে? আমি তো আবার রাতের ট্রেনে ফিরবো ভাবছিলাম”।
গঙ্গা বলল, “আপনি টকাই ময়রার দোকানের গজা নিয়ে নিন। গজা খেলে গবা খুব খুশি হয়ে যায়”।
লোকটা বলল, “বেশ। তাই কর। টকাই ময়রার দোকান থেকে গজা কিনে নেওয়া যাক”।
টকাই ময়রার দোকানে এলাকার খুব পুরনো দোকান। আশে পাশের গ্রামের অনেকেই টকাইয়ের দোকান থেকেই মিষ্টি কিনতে আসে। পুরন্দর পাকড়াশীর গেল শীত থেকে মিষ্টি খাওয়া বারণ হয়ে গেছে।
অদ্ভুতভাবে এই মিষ্টির দোকানের সামনে এলেই তার মিষ্টি খেতে ইচ্ছে করে। সে চেয়ারে বসে রসগোল্লা খাচ্ছিল। টকাইয়ের দোকানের সামনে রিক্সা থামালো গঙ্গা। লোকটা গজা কিনতে রিক্সা থেকে নামতেই ভবা পাগলা কোত্থেকে ছুটে এসে লোকটাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওরে তারক, তুই কোথায় ছিলি এতদিন, তোকে কতদিন দেখি নি। এতদিন পরে তোর আমার কথা মনে পড়ল?”
লোকটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কে আপনি? আমি তারক নই। আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে”।
ভবা লোকটার গলা জড়িয়ে ধরে ঝুলে পড়ল। আশে পাশের লোকজন এসে ভবার থেকে লোকটাকে যখন উদ্ধার করল তখন লোকটার গায়ে ধুলো লেগে গেছে। গঙ্গা ভবাকে তাড়িয়ে লোকটাকে বলল, “ও পাগল। এরকম করে। ভয় পাবেন না”।
লোকটা বলল, “ঠিক আছে, ঠিক আছে। হঠাৎ করে এমনভাবে জড়িয়ে ধরল, আমি একটু ঘাবড়ে গেছিলাম আর কী”।
রাম মিত্তির বলল, “তোমাকে তো কেমন চেনা চেনা লাগছে বাপু। কোথায় দেকিচি বল তো”।
লোকটা কিছু বলার আগেই গঙ্গা বলল, “তুমি সবাইকেই দেখো খুড়ো। উনি এই এলেন কলকাতা থেকে। গবার কাছে যাবেন। বাবু, আপনি গজা নিয়ে চলুন তো”।
রাম মিত্তিরের বয়স নব্বই পেরিয়েছে। মাঝে মাঝেই আজে বাজে বকেন। তার কথায় বিশেষ কেউ পাত্তা দিল না। লোকটা গজা নিয়ে আবার গঙ্গার রিক্সায় চেপে বসল। তবে এবার রুমাল বের করে ঘাম মুছল।
ভবা একটু দূর থেকে গঙ্গারামকে ভেংচি কাটল। গঙ্গা চিৎকার করে ভবাকে তাড়াতে তাড়াতে রিক্সার প্যাডেলে জোর দিল।
পুরন্দর সবটাই চুপ করে দেখছিল। মিষ্টির টাকা মিটিয়ে দিয়ে মুখ হাত ধুয়ে সে ভবার কাছে গিয়ে বলল, “তুই হঠাৎ করে তারককে দেখলি কী করে?”
ভবা তার দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ভেংচি কেটে দিয়ে বলল, “তাতে তোর কী?”