গোলোকপুরের পরশ পাথর – ৪
৪
দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল গৌরীনাথ। হঠাৎ করে কে যেন তাকে ডাকল।
সে ধড়মড় করে উঠে বসে দেখল তার সামনে গবা তান্ত্রিক বসে আছে। বড় বড় চুল, কাঁধ অবধি আছড়ে পড়ছে, লাল কৌপীন পরে রয়েছে, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। খাটের পাশের চেয়ারে বসে তার দিকে তাকিয়ে আছে!
গৌরীনাথ অবাক হয়ে দু চোখ কচলালো। সে ঠিক দেখছে তো? গবা কী করে তার ঘরের মধ্যে ঢুকল? সে বলল, “তুমি কোত্থেকে এলে? ঘরের দরজা তো বন্ধ!”
গবা বলল, “সে জেনে তুই কী করবি? ইচ্ছে থাকলে রাস্তা তৈরি করে নেওয়া যায়। রাস্তা নিয়ে ভেবে কী করবি? তোর কী হয়েছে? এমন মন মরা হয়ে শুয়ে আছিস কেন রে পাগল? মেলা হচ্ছে, কোথায় মেলার মাঠে গিয়ে ঘুরে বেড়াবি, এর ওর বাড়ি থেকে কুল চুরি করে নিয়ে আসবি তা না, একা একা শুয়ে আছিস!”
গৌরিনাথ মাথা নিচু করে বলল, “আমি কিছুতেই রান পাচ্ছি না গবাদা। রোজ রোজ শূন্য রানে আউট হয়ে যাচ্ছি”।
গবা মাথা নেড়ে বলল, “ভাল তো। ক’জন শূন্য করতে পারে? শূন্য করা সবার কম্মো নয়”।
গৌরীনাথ বলল, “তাহলে আমাকে টিম থেকে বাদ দিয়ে দেবে। বাবা আমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দেবে। যেটুকু খেলতে পারতাম, সেটুকুও বন্ধ হয়ে যাবে। একবার খেলা বন্ধ হলে সারাজীবনে আর খেলতে পারবো না আমি”।
গবা বলল, “হোস্টেল খুব খারাপ জায়গা বুঝি?”
গৌরীনাথ বলল, “খুব খারাপ জায়গা। খুব মারে ওখানে”।
গবা বলল, “ঠিক আছে। বিকেলে আমার ডেরায় আসিস। দেখি কী করতে পারি”।
গবা চোখের নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।
গৌরীনাথ বড় বড় চোখ করে বসে রইল। সে কি স্বপ্ন দেখছিল? এটা কী করে সম্ভব হল? রুনু পিসি যে মাঝে মাঝে বলে সিদ্ধাইরা যেখানে খুশি যেতে পারে, তাহলে কি সেটা সত্যি? সে তো হেসেই উড়িয়ে দিত এসব কথা। ঘড়ির দিকে তাকালো সে। বেলা চারটে বাজে। বিকেলে গবা তার ডেরায় যেতে বলেছে। এখন তো বিকেলই প্রায়।
রুনু পিসি মুনু মাসির সঙ্গে গল্প করছিল। রুনু পিসি যদি জানে সে গবার কাছে যাচ্ছে, তাহলে বলবে দুপুরেই তো বলেছিলাম, তখন বললি না কেন?
গৌরীনাথ পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে দৌড়তে শুরু করল। সব সময় সাইকেল নিয়ে বেরোয় না সে। দৌড়ে যেখানে সহজে যাওয়া যায়, সেখানে সাইকেল নিয়ে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই।
গ্রামের প্রান্তে শ্মশানের পাশেই গবা বসে। গৌরীনাথ গিয়ে দেখল গঙ্গারামের রিক্সা দাঁড়িয়ে আছে। তাকে গঙ্গারাম চেনে। ছোটবেলায় স্কুলে নিয়ে যেতো। তাকে দেখে অবাক গলায় বলল, “গবার কাছে কী করতে এসেছো?”
গৌরীনাথ ছুটে এসে হাঁফাচ্ছিল। হাঁফ ধরা গলাতেই বলল, “কাজে এসেছি”।
গঙ্গারাম বলল, “যাও। ভিতরে আছে”।
গবা তান্ত্রিক একটা ভাঙা ঘরে থাকে। সারাদিন দরজা খোলাই থাকে। দরজা খুলে গৌরীনাথ দেখল একটা অচেনা লোক বসে আছে। গবা মেঝেতে বসে কীসব মন্ত্র পড়ে যাচ্ছে। তাকে দেখে গবা বলল, “কীরে গৌরী, কি খবর তোর? কী করতে এসেছিস?”
গৌরীনাথ বিস্মিত হয়ে বলল, “তুমি নিজেই আজ এসেছিলে আমার ঘরে। বললে বিকেলে আসতে?”
ঘরে বসে থাকা লোকটা গলা খাঁকড়িয়ে বলল, “আমাকে আগে ছেড়ে দিলে ভালো হয়”।
গবা লোকটাকে পাত্তা না দিয়ে গৌরীনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওটা আমি না, আমার শরীরে স্বয়ং মা তোকে দর্শন দিয়ে এসেছে। তোর তো ভাগ্য খুলে গেল রে পাগলা। এক কাজ কর দেখি, দরজার পাশে দেখ তো কী আছে”।
গৌরীনাথ দরজার পাশে হাত বাড়াল। তার হাতে একটা ব্যাট ঠেকল। অবাক গলায় বলল, “একী! এটা তো একটা ক্রিকেট ব্যাট!”
গবা হেসে উঠে বলল, “তবে? তোর আর চিন্তা কী? আর কোন ভাবনা চিন্তার ব্যাপারই নেই এখন। যা, ওই ব্যাট দিয়ে খেল গে যা। আর শূন্য করতে হবে না”।
গৌরীনাথের বিশ্বাস হচ্ছিল না। কী অদ্ভুত কাণ্ড! অবিকল তার ব্যাটের মতই দেখতে আরেকটা ব্যাট! এখানে ব্যাট এলো কোত্থেকে? সে বলল, “এই ব্যাট দিয়ে খেলবো?”
গবা বলল, “হ্যাঁ, ওই ব্যাট দিয়ে খেলবি। এখন যা। বিরক্ত করিস না। যা যা”।
গৌরীনাথকে যেন একপ্রকার তাড়িয়েই দিল গবা। সে ব্যাটটা নিয়ে ঘরের বাইরে এসে দেখল। এটাতে কী আছে? একই রকম লাগছে তো! তাছাড়া গবা একবার বলল তার শরীরে স্বয়ং মা তার কাছে গেছিলেন, তবে গবা কী করে জানলো সে শূন্য করেছে? গবার কাছে কি সত্যি সত্যি কোন অদ্ভুত ক্ষমতা আছে?
কোন কিছু মাথায় ঢুকছিল না তার। ব্যাটটা নিয়ে বাড়ি ঢুকতেই রুনু মাসী সেটা দেখে জিজ্ঞেস করল, “এটা আবার কে দিল রে?”
গৌরীনাথ বলল, “আমারই ব্যাট। ভুল করে মাঠে ফেলে দিয়ে এসেছিলাম। গিয়ে নিয়ে এলাম”।
মিথ্যা কথাটা বলে তার খারাপ লাগল। কিন্তু কিছু করার নেই।
গবার কথা কী করে বলবে রুনু পিসিকে?