গোলোকপুরের পরশ পাথর – ৭
৭
গণপতিবাবুর আজকাল রাতে ঘুম হয় না। চোখ বুজলেই কেমন বুক ধড়ফড় করে। ঘাম হয়। শরীর খারাপ লাগে। কিছুদিন আগেই বাড়িটা তিনতলা হল। শহরে একটা জমি কেনা হয়েছে। তবু কেমন আইঢাই করে সব কিছু।
মেলার সময় হয়ে এল। এত কাজ। তবু মনটা কেমন চোরা টান দেয়। বুক ব্যথা করে, পেটেও কেমন টান। ডান পায়ে কে যেন কাতু কুতু দেয় রাত্রে ঘুমোতে গেলেই। কিছু ভাল লাগে না। কেমন ভয় ভয় লাগে।
বিপিন চোখ পিট পিট করে তার সামনে বসে। বিপিন তার চ্যালা। সে যেখানে যায়, তার সঙ্গে যায়। বিপিন বলল, “দাদা, মন ভাল নেই মনে হয়?”
গণপতি জোরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “না হে বিপিন, মন ভালো নেই। কী জানি, কী হয়েছে”!
বিপিন অনেক চেষ্টা করল। কিছুতেই গণপতিবাবুর মন ভাল হল না। শরীর আরো খারাপ হয়ে গেল। গণপতিবাবু মন খারাপ করে গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন। মাঝে মাঝেই বলেন, “দূর দূর। জীবনে কোন সুখ নেই। চারদিকে শুধু কষ্ট। শুধু মন খারাপ লাগে”।
এর পিছনে কারণটা অবশ্য অন্য। একদিন গবা হঠাৎ করেই তার বাড়িতে ঢুকে গেছিল।
তার ঘরবাড়ি দেখে তাজ্জব হয়ে গবা বলল, “মা, মারে, সব পাপের টাকা। এই গণপতি, এত টাকা নিয়ে কী করবি তুই? শোন রে পাপী, এত টাকা থাকা ভালো না। তুই এক কাজ কর, বিরাট বড় করে মায়ের মন্দির গড়ে দে। তোর শরীর ভাল হয়ে যাবে।”
গণপতি বাবু খুব রেগে গিয়ে গবাকে তাড়া করেছিলেন। গবা যাওয়ার সময় ফিক করে হেসে দিয়ে বলেছিল, “ঠিক আছে। তুই তো আমাকে তাড়া করলি, বেশ করেছিস, ঠিক করেছিস। মা, মারে, গণপতিকে দেখিস মা। ছোঁড়াটা বখে গেল রে মা!”
এই ঘটনার পরে গণপতিবাবুর ঘুম নষ্ট হয়ে গেল। মাঝে মাঝেই তিনি টের পেতে শুরু করলেন তার শরীরে যেন অন্য কেউ বাসা বেঁধেছে। কে বাসা বেঁধেছে, তা তিনি বুঝতে না পারলেও সে মাঝে মাঝেই কানে এসে ঘ্যান ঘ্যান করতে শুরু করল, “ওহে গণপতি, এত টাকা থাকা কি ভালো? তাও যদি নিজের টাকা হতো, তাও কথা ছিল! এ সবই তো অসৎপথে রোজগার করা টাকা”।
গণপতিবাবুর হেঁচকি উঠতে শুরু করল। শরীর খারাপ থেকে খারাপতর হয়ে গেল।
পুজো দিলেন, শান্তি স্বস্ত্যয়ন করলেন, কোন কিছুতেই কোন সুরাহা হল না।
শেষমেশ গবার পায়ে ডাইভ দেবেন কিনা ভাবছিলেন, এর মধ্যে একদিন সকালবেলা থানার ওসি বিশ্বম্ভর বাবু তার বাড়ি চলে এলেন লোক লস্কর নিয়ে।
বিশ্বম্ভর বরাবরই ভদ্রলোক। গণপতিবাবুর সঙ্গে তার অনেকদিনের পরিচয়। এ থানায় আসার পর গণপতিবাবুর কথা শুনেই তিনি চলা ফেরা করেন। এমন লোকের বাড়ি আসতে তার খুবই লজ্জা লাগছিল। তবু তিনি নিরূপায়। গণপতিবাবুর সামনে বিশ্বম্ভরবাবু হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে বললেন, “স্যার, বিশ্বাস করুন। আমার একবারেই কোন ইচ্ছে ছিল না। এ কাজটা করার কথা আমি ভাবতেও পারি নি। কিন্তু এবার আমি নাচার। আমার কিছু করার নেই। খোদ উপর মহল থেকে অর্ডার হয়েছে আপনার বাড়িটা যেন সার্চ করি। একবার যদি আপনি আজ্ঞা দেন। আজ্ঞা না দিলে কোন অসুবিধে নেই। আমি সবাইকে নিয়ে আবার থানায় ফিরে যাবো”।
গণপতি তার মন খারাপ করা মুখ নিয়ে উদাস হয়ে বললেন, “না না, ফিরে যাবেন কেন? এসেছেন যখন, ভালো করে সার্চ করুন”।
কথাটা বলেই গণপতিবাবু বুঝতে পারলেন তার শরীর ভাল লাগছে। শরীরের ভেতরের ভূতটা যেন বেরবো বেরবো করছে। এতদিন তো বেশ ত্যাঁদড়ামি করছিল। তাকে স্বাধীনভাবে কোন চিন্তাভাবনাই করতে দিচ্ছিল না। এখন আবার কী হল ব্যাটার?
বিশ্বম্ভরবাবুর নেতৃত্বে তার পুলিশ খুব নম্রভাবে গণপতিবাবুর বাড়ি তল্লাশি করতে শুরু করল। বসার ঘরের আলমারি থেকে বিনম্রভাবে দু হাজার টাকার গোলাপি নোটগুলো উঁকি ঝুঁকি মারছিল। পুলিশ ট্রাঙ্কে টাকাগুলো ভরে গণপতিবাবুর সামনে রাখল। কী আশ্চর্য! বুকের ব্যথাটা কম কম লাগতে শুরু করল। পেটে ক’দিন ধরে যে টান লাগছিল, মাথার পেছনে ব্যথা, সবই কমে গেলো হঠাৎ করে। ভূতটা যেন তার কানের দোরগোড়ায় এসে গেছে। যে কোন সময় ফুড়ুত করে বেরিয়ে যাবে। প্রবল উৎসাহে গণপতিবাবু বললেন, “ওই শোবার ঘরের আলমারিটা যেন বাদ দেবেন না। আর খাটের তলার মেঝেও। খুঁড়ে দেখুন”।
বিশ্বম্ভরবাবু আবার সবাইকে নম্রভাবে বললেন, “ওরে গণপতিবাবু যা বলছেন, তাই শোন রে”।
কনস্টেবলরা তাই শুনল। থরে থরে টাকা উদ্ধার হল। বিপিন চোখ পিট পিট করতে করতে হায় হায় করতে শুরু করল।
ক’দিন ধরে গণপ্তিবাবুর বাতের ব্যথা হচ্ছিল। ঠিক করে উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। হাত পা নাড়াতে পারছিলেন না।
কী আশ্চর্য! পুলিশ এই টাকা পাবার পরেই সে ব্যথা চলে গেল। শরীরে ঠিক ক’টা ভূত ঢুকেছিল? বাতের ব্যথার ভূতটা কেমন ধীরে সুস্থে বেরিয়ে গেল। খিদে পাচ্ছিল না ক’দিন ধরে। এখন প্রবল খিদে পেতে শুরু করল। খিদের ভূতও কি ছিল তবে?
রান্নাঘর থেকে মুড়ির ধামাটা নিয়ে গণপতিবাবু প্রবল উৎসাহে বাড়ির সব কোণ দেখাতে শুরু করলেন, “ওই ছাদে একটু টোকা মেরে দেখুন”, “হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠাকুর ঘরের আলমারিতে… ওই দিকে না, ডান দিকে”, “গিন্নির খাটের তলায় দেখুন”… বিশ্বম্ভরবাবু বাড়ি ভর্তি টাকা আর গয়না উদ্ধার করছেন আর গণপতিবাবুর শরীরের সব জ্বালা যন্ত্রণা এক এক করে দূরে হয়ে যাচ্ছে। গণপতিবাবু এককালে ক্রিকেট খেলতেন। স্থানীয় টুর্নামেন্টে একটা সেঞ্চুরি করেছিলেন বলে প্রায়ই বলেন। বলও করতেন। ফাস্ট বল।
বহুদিন হল তিনি দৌড়ে বল করার মত অবস্থায় নেই। এখন নিজেই বারান্দায় দৌড়ে কপিল দেবের মত একটা বল করে ফেললেন। খান বিশেক ডন দিয়ে ফেললেন।
দারোগা বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, “স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, একটা কথা বলি?”
গণপতিবাবু উদার গলায় বললেন, “বলুন বলুন?”
বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, “আজ্ঞে, উপরতলা থেকে এই মাত্র কড়া হুকুম এসেছে, আপনাকে যে অ্যারেস্ট করতে হয়”।
গণপতিবাবু হু হু হা হা করে চিৎকার দিয়ে বললেন, “জেলে যেতে হবে? জেলরে কে ভয় পায়? চলুন চলুন। ভাল করে হাতকড়া পরিয়ে নিন। দেখুন, কোন অসুবিধা যেন না হয় আপনাদের। আ হা হা হা, জীবন এত ভালো, তাই তো ভুলে গেছিলুম মশাই। শরীর একবারে সুস্থ হয়ে গেছে। কানায় কানায় যেন আলাদা উত্তেজনা অনুভব করছি। চলুন দেখি, চলুন”।
হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের জিপে তোলা হল গণপতিবাবুকে। বিশ্বম্ভরবাবু যেটুকু সম্মান দেখাতে গেছিলেন, গণপতি সেটাও করতে দিলেন না। বললেন, “ওসব করবেন না। সম্মান দেখালেই শরীর খারাপ করবে। আমি কিন্তু জেল একাদশের হয়ে বোলিং করব। মনে থাকে যেন”।
বিশ্বম্ভরবাবু বললেন, “আমি চেষ্টা করব আপনাকে যেন ভালভাবে রাখা হয়”।
গণপতিবাবু হুঙ্কার দিয়ে বললেন, “কভি নেহি। নো সম্মান। সম্মান দেখালেই আমার শরীর খারাপ করবে। মনে থাকবে?”
বিশ্বম্ভরবাবু কিছুই বুঝতে না পেরে মাথা নাড়লেন, “আজ্ঞে ঠিক আছে”।
গণপতিবাবুকে পুলিশের গাড়িতে স্বেচ্ছায় উঠে বসতেই বুঝলেন তার শরীর থেকে সব ভূতই একে একে বেরিয়ে গেছে। যে বীরত্বের সঙ্গে এতক্ষণ কথা বলছিলেন, যেই মনে পড়ল তার সব টাকা বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে, তিনি চোখ উল্টালেন। ভূত তাড়াতে গিয়ে যে তিনি একবারে নিঃস্ব হয়ে গেলেন!
রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছিল শম্ভু। গণপতিবাবুকে পুলিশের জিপে করে যেতে দেখে সে বুঝল সেদিন তবে ঠিকই দেখেছিল। মনে মনে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে দিয়ে মেলার মাঠের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে।