গোলোকপুরের পরশ পাথর – ৯
৯
গায়ে জরির কাজ করা রাজপোশাক পরে লোকটা মেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখদুটো লাল। মেলার ভিড়ে কেউ খেয়ালই করল না এমন বিচিত্র পোশাক পরা একটা লোক মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা খেয়াল করল, তারা ভাবল লোকটা “যেমন খুশি তেমন সাজো”র জন্য কোন পোশাক পরে মেলায় এসেছে।
হরিপদ বসাক আফিম খেয়ে নাগরদোলার সামনের টিকেট কাউন্টারে দুলছিল। লোকটা এসে হরিপদর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “গোলোকপুরটা কোথায়?”
লোকটার ঝলমলে জরির পোশাক দেখে হরিপদ হকচকিয়ে গিয়ে বলল, “কে বাওয়া তুমি? যাত্রায় রাজা হবে? তা কী পার্ট করবে? নবাব সিরাজদৌল্লা?”
লোকটা বলল, “যাত্রায় কেন হব? আমি তো এমনিই রাজা”।
হরিপদ ফিক ফিক করে হাসতে হাসতে বলল, “তুমিও আমার মতই আফিম খেয়ে এসেছো নাকি? ভাল জিনিস থাকলে তবে আমাকেও দাও। আমিও খেয়ে দেখি সে কেমন জিনিস!”
লোকটা বিরক্ত গলায় বলল, “আজেবাজে কথা বলার সময় নেই আমার। গোলোকপুরটা কোথায়?”
হরিপদ বলল, “গোলোকপুর? আ মোলো যা। সে আবার কোন মুলুক! ও নামে তো এখানে কোন জায়গা নেই”।
লোকটা হরিপদর দিকে কিছু একটা ছুঁড়ল। হরিপদ বলল, “কী এটা?”
লোকটা বলল, “দেখো কী”!
জিনিসদুটো মাটিতে পড়ে গেছিল। হরিপদ কোন মতে ঝুঁকে তুলে নিয়ে দেখল দুটো মোহর। সে হাঁ করে লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল, “ও বাবা, তুমি সত্যিই রাজা নাকি?”
লোকটা এগিয়ে এসে হরিপদর কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলল, “গোলোকপুর কোথায়?”
হরিপদ বলল, “আমি কী করে জানবো বল তো? আমি তো এ গাঁয়ে ঘরজামাই থাকি। তুমি মেলার মাঠ থেকে বেরিয়ে স্টেশনে গিয়ে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে খোঁজ নাও বাবা”।
লোকটা বিরক্তিমাখা মুখে হরিপদর দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে। যাচ্ছি”।
হরিপদ বলল, “আরো দুটো মোহর দিয়ে যাও বাপ। তোমার তো কোন কাজে লাগলাম না, তুমি তো আমার অনেক সময় নষ্ট করলে বল?”
লোকটা রেগে গেল না। বরং খুশি হয়ে বলল, “সবাই শুধু লোভী হয়ে গেছে। শুধু লোভ আর লোভ। বেশ তো। তাহলে আমারই ভালো। এ নাও”।
লোকটা আরো দুটো মোহর দিয়ে দিল।
হরিপদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার নেশাটা জাঁকিয়ে এল। বেজায় ঘুম পাচ্ছিল বলে সে আর কিছু বলল না।
লোকটা বেশ কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে মেলায় ঘুরল। তারপর দশ টাকার জ্যোতিষের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। শম্ভুর এখন পসার বেড়েছে। আগে কেউ আসছিলো না, এখন অনেক লোক হচ্ছে। শম্ভু হিমশিম খাচ্ছিল।
হঠাৎ করে জরির পোশাক পরা লোকটাকে দেখে সে অবাক হল। লোকটা শম্ভুর দিকে তাকিয়ে বলল, “বল আমার সম্পর্কে কী বলবে?”
শম্ভু চোখ বন্ধ করল। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ খুলে লোকটার কপালের দিকে তাকাতে তার মাথা ঘুরে উঠল। দু চোখ ঝলসে গেল যেন! শম্ভু তড়িঘড়ি নিজের দু চোখ ঢাকা দিয়ে বলল, “আপনি কে?”
লোকটা শম্ভুর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “চোখ খোলো। ভয় নেই। আমি তোমার কোন ক্ষতি করব না”।
শম্ভু ভয়ে ভয়ে চোখ খুলল।
লোকটা বলল, “আমি কিছুতেই গোলোকপুর খুঁজে পাচ্ছি না। তুমি জানো সেটা কোথায়?”
শম্ভু বলল, “আমি অনেক ছোটবেলায় শুনেছিলাম এই নামটা। আমার জ্যেঠিমার কাছে। তিনি চলে গেছেন অনেকদিন হল। তিনি বলেছিলেন বটে এ গ্রামের নাম একসময় গোলোকপুর ছিল। পোড়োবাড়ির জঙ্গলের কাছে সে জায়গার ভাঙ্গা ঘরবাড়িও আছে শুনেছি”।
লোকটার মুখ হাসিতে ভরে উঠল।
শম্ভু বলল, “আপনি কে?”
লোকটা বলল, “আমি এই অঞ্চলের রাজা। নিজের রাজত্ব হারিয়ে ফেলেছিলাম। এখন দখল করতে এসেছি”।
শম্ভু বলল, “আপনি আমার কাছে কেন এসেছেন?”
লোকটা বলল, “আমার পাথরটা কোথায় আছে, তুমি জানবে”।
শম্ভু বলল, “কোন পাথর”?
লোকটা বলল, “আমার হাত গুণে বল। আমার কপাল দেখে বল”।
শম্ভু বলল, “আমি আপনার কপালের দিকে তাকাতে পারছি না ঠিক করে। আমার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে”।
লোকটা বলল, “তবু তোমাকেই বলতে হবে। বল শিগগিরি। আমি তোমাকে পুরস্কৃত করব”।
শম্ভু বুঝতে পারছিল এ লোককে কোন উত্তর না দিতে পারলে তার কপালে অশেষ দুঃখ আছে। সে প্রাণপণে চেষ্টা শুরু করল।
কিন্তু লোকটার দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করতেই সে আবার চোখে সর্ষেফুল দেখল। চোখ খুলে বলল, “আপনি আমাকে ক্ষমা করুন স্যার, আমি কিছুতেই পারছি না”।
লোকটা মাথা নেড়ে বলল, “তোমাকেই বলতে হবে”।
বাইরে লাইন দেওয়া লোকেরা ঝামেলা শুরু করেছে। শম্ভু প্রাণপণে চোখ বন্ধ করে ঈশ্বরের নাম করতে শুরু করল।
হঠাৎ তার মাথার মধ্যে একটা ছবি ফুটে উঠল। সে বলল, “একটা জলাশয়…”
লোকটা উৎসাহিত হয়ে বলল, “এই তো… বল বল”।
শম্ভু বলল, “তার গভীরে… আমার ঘুম পাচ্ছে…সবাই হেরে যাবে… একটা নিষ্পাপ নির্লোভ…” বলতে বলতেই শম্ভু জ্ঞান হারিয়ে ফেলল।
লোকটা শম্ভুকে ঝাঁকুনি দিল।
শম্ভুর সাড়া দিল না।
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “জলাশয় তাই তো? ঠিক আছে। তাই হবে”।
হাঁটতে হাঁটতে লোকটা পোড়ো বাড়ির জঙ্গলের দিকে রওনা দিল।
#
রাতে ঘুমনোর সময় গৌরীনাথ পাথরটা পকেট থেকে বের করল। কী এমন ব্যাপার থাকতে পারে এই পাথরটায় যে এটাকে অতো দূর থেকে লোকেরা এসে পাগলের মত খুঁজে বেড়াচ্ছে?
পেন্সিলবাক্সে পাথরটা রাখতে যেতে সে একটু হোঁচট খেল। টেবিলের ওপর একটা কয়েন রাখা ছিল।
পাথরটা কয়েনটায় ছুঁতেই সেটা মুহূর্তের মধ্যে সোনার কয়েনে পাল্টে গেল।
গৌরী অবাক হয়ে সেটা দেখল। পরক্ষণে চোখ মুছে আরেকটা কয়েনে পাথরটাকে স্পর্শ করল। একই ব্যাপার।
নিজের চোখকেই সে বিশ্বাস করতে পারছিল না। ঘরে যা কয়েন ছিল, সব সোনার কয়েন করে ফেলার কয়েক মিনিট পর তার বোধ বুদ্ধি ফিরে এল। বুঝল এটাই সব নষ্টের গোঁড়া।
জিভ কেটে সব কয়েনের সঙ্গে পাথরটাকেও লুকিয়ে ফেলল সে।