Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    গোল্ডেন লায়ন – উইলবার স্মিথ / জাইলস ক্রিস্টিয়ান

    জাইলস ক্রিস্টিয়ান এক পাতা গল্প491 Mins Read0

    ৪. ডেফট নামে জাহাজটি

    ডেফট নামে জাহাজটি-যেটি এখন ক্রিস্টিনা’ নামে পরিচিত-খুব ভোরে জাঞ্জিবার শহরের উপকূলে প্রবেশ করে। একটা লম্বা নৌকোয় করে হাল, জুডিথ আর অ্যাবোলি সাগর উপকূলে বের হয়। পেট বলেছে যে রাষ্ট্রদূত গ্রে-এর সাথে মিটিং না হওয়া পর্যন্ত জাহাজের ভেতরেই থাকতে চায় সে। যেতে যেতে উপকূলের পাশে সাদা রঙের বিল্ডিং-এ ওষুধের একটা দোকান দেখতে পেয়ে জুডিথ আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে। হাল বলল, “দোকানীটা নিশ্চয়ই এখানে জমজমাট ব্যবসা করছে। অসহায় অসুস্থ ভ্রমণকারীদের যার কাছ থেকে যেভাবে পারছে কায়দা করে টাকা পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে।”

    হাল ভেতরে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন অনুভব করল না। জুডিথ-এর জন্য বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল সে। জুডিথ ভেতরে গিয়ে দেখল বৃদ্ধ দোকানদারটি ছোট ছোট বস্তায় ভরা গুল্ম, বিভিন্ন মিশ্রণের বোতল বিভিন্ন রকমের ছোট ছোট ও নানান রকমের পাউডার আলমারির তাকে সাজিয়ে রাখছে। আলমারিটা দেয়ালের একপাশ থেকে অপরপাশ পর্যন্ত বিস্তৃত। বিভিন্ন বোতল এবং বয়ামের গায়ে পরিষ্কারভাবে ওষুধের নাম এবং রোগের নাম লেখা রয়েছে। রক্ত পরিষ্কার করার জন্য সাছাফ্রাস রুট-এর চা, বাতের ব্যথার জন্য জিমসনউইড, হাপানির জন্য চেস্টনাট লিফ-এর চা, এরকম আরও নানান রকমের ওষুধ।

    জুডিথ ব্যাখ্যা করে বোঝাল যে সে একজন মিসরীয়। কপটিক চার্চের একজন সদস্য। সে এখানে তার ইংরেজ বণিক স্বামীর সাথে নতুন জীবন শুরু করতে এসেছে। জাহাজ ছেড়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কয়েকদিন থাকার জন্য তারা একটা জায়গা খুঁজছে। দোকানীটি থাকার জায়গা খুঁজে দেয়ার ব্যাপারে খুব আগ্রহ দেখাল। সে কারণে জুডিথও জানাল যে তার স্বামী থাকার জায়গার জন্য খুব ভাল দামই দিবে।

    তাদের কাছে যে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা আছে, জিনিসপত্র কেনার মাধ্যমে সে ওটা এরইমধ্যে প্রমাণ করেছে। বেশ কয়েক ধরনের ওষুধ কিনেছে সে। বিভিন্ন স্বাদের চা কিনেছে এবং প্রসাধনী হিসেবে ব্যবহারের জন্য বেশ কিছু মিশ্রণ কিনেছে-বেশ ভাল দামেই। জুডিথকে দেখে মনে হচ্ছে সে যদি সমুদ্রযাত্রার মাঝপথে এরকম দুই-একটা দোকান পায় তবে বেশ আনন্দেই সমুদ্রযাত্রা করতে পারবে।

    “আমার খোঁজে কিছু ঘর আছে যেগুলোতে আমি আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সেগুলো হয়ত খুব বেশি বড় নয়। আপনারা যেরকমটাতে থেকে অভ্যস্ত তার চেয়ে হয়ত একটু নিম্নমানের। তবে খুব একটা খারাপ নয়। নয়ত আমি আপনাদেরকে থাকার প্রস্তাব দিতাম না।”

    “আমি কী ঘরগুলো দেখতে পারি?” জুডিথ জিজ্ঞেস করল।

    “অবশ্যই, অবশ্যই…আমাকে একটু সময় দিন। আমি এখুনি সেটার ব্যবস্থা করছি।”

    ওষুধের দোকানীটা খুব দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। কিছু সময় পরে জুডিথ বৈবাহিক কলহের শব্দ শুনতে পেল। দোকানীটা তার বউকে বোঝানোর চেষ্টা করছে যে তারা চাইলেই তাদের বাড়িটা কয়েকদিনের জন্য ভাড়া দিতে পারে। এই কয়েকদিন তারা বাড়ির রাস্তা থেকে একটু দূরে মেয়ের বাড়িতে গিয়ে থেকে আসলেই পারে।

    জুডিথ বুঝতে পারল এই কলহের সমাধানে পৌঁছাতে একটু সময় লাগবে। তাই সে তার কেনা জিনিসপত্রগুলো বাইরে নিয়ে এল। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে লাগতে পারে এরকম দুই-একটা জিনিস রেখে দিল। হাল-কে মিষ্টি করে বাকি জিনিসগুলোর ব্যবস্থা করতে বলল। এই মিষ্টি করে বলার মানে হাল এতদিনে বুঝে ফেলেছে-”দিজ ইজ অ্যান অর্ডার।” হাল তার লোকদের বলল জিনিপত্রগুলো ডেট-এ নিয়ে যেতে।

    জুডিথ ভেতরে ঢুকে আবার নানান রঙের বীজ, গুলু এবং সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা নানান রকমের পাতা দেখতে লাগল। এরইমধ্যে দোকানীটা ফিরে এসে বলল, “আসুন আমার সাথে।” এরপর গোমড়ামুখো বয়স্ক এক মহিলা তাকে মাঝারি ধরনের একটা ফ্ল্যাটে নিয়ে গেল। তিনটি রুম পরিপাটি করে সাজানো এবং পুরনো পাল দিয়ে ছাদের নিচে সিলিং দেয়া। ঘরের সামনের দিকে শহরের কিছু অংশ দেখা যায় এবং পেছন দিকে সাগর। সে জানে হাল যদি ঘরে বসেই তার জাহাজের ওপর দৃষ্টি রাখতে পারে তাহলে বেশ খুশিই হবে। আর সে নিজেও দোকানীর বউয়ের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা দেখে বেশ খুশি হয়েছে। সবকিছু নিপুণ পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছে। একদিক থেকে সাগরের পরিচ্ছন্ন বাতাস এবং অন্যদিক থেকে বিভিন্ন গাছ গাছালি, লতাগুলুর সুবাস ঘরগুলোতে এক অন্যরকম পরিবেশ তৈরি করেছে।

    “হুম, চলবে,” সে দোকানীকে বলল। আবার খুব বেশি আগ্রহও দেখাল না। কারণ সে জানে, এতে ভাড়া আরও ঊর্ধ্বমুখী হবে। এরপর জিজ্ঞেস করল “ভাড়া কত পড়বে?”

    দোকানীটা প্রথমে ভয়ানক এক দাম হাঁকাল। এরপর জুডিথও সেটা কমিয়ে একেবারে মাটিতে মিশিয়ে ফেলল। কয়েক মিনিট দুই পক্ষের বাকৃবিতণ্ডের মাধ্যমে এমন একটা ভাড়া নির্দিষ্ট হল যেটাতে দুই পক্ষই খুশি।

    হাল তার দুজন খালাসি দিয়ে এক সিন্দুক ভরা জিনিসপত্র নিয়ে এসেছে জাহাজ থেকে যেখানে কাপড়-চোপড়সহ আরও অনেক জিনিসপত্র রয়েছে। হাল জানে যে জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে অস্ত্রসস্ত্র ছাড়া থাকা সম্ভব না। সে একটা নেপচুন তলোয়ার এবং তার বাবার দেয়া একজোড়া পিস্তল সাথে করে নিয়ে এসেছে। সিন্দুকটা এনে রাখার পর জুডিথ সেটার জিনিসপত্র বের করতে লাগল। হাল প্রথমে ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে রাষ্ট্রদূত গ্রে-কে চিঠি লিখতে বসল। চিঠির প্রথমেই সে ভুল বোঝাবুঝির জন্য ক্ষমা চেয়ে নিল। কিন্তু এখন ইথিওপিয়ার যুদ্ধ শেষ হয়েছে। সে আশা করছে যে তার কোনো ভুলের জন্য বা ভুল বোঝাবুঝির জন্য কনসালকে কোনো অসুবিধায় পড়তে হয় নি। সে রাষ্ট্রদূত-এর সাক্ষাৎ পাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। রাষ্ট্রদূতকে ব্যাখ্যা করে বোঝায় যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মি, উইলিয়াম পেট বর্তমানে তার সাথেই আছে, যে তার দেশে ফিরতে চায়। লোকটা রাষ্ট্রদূত-এর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে যদি তিনি তাকে এখান থেকে ইংল্যান্ড পৌঁছানোর সুব্যবস্থা করে দেন। হাল আর লিখল, “আমি নিশ্চিত যে আমরা প্রকৃত ইংলিশম্যান-এর মতই সাক্ষাৎ করব। আমাদের দেশ, আমাদের মাতৃভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ অতীতের ছোট খাট ভুলগুলোকে আমরা ভুলে যাবার চেষ্টা করব।” এইটুকুতে লেখা শেষ করে হাল। লেখাতে জুডিথ-এর ব্যাপারে কোনো কথার উল্লেখ ছিল না। জাঞ্জিবার এমন একটা জায়গা যেখানে কোনো কথা গোপন থাকে না। তবে এমন কিছু করা যাবে না যাতে জুডিথ-এর উপস্থিতির কথা অন্যদের কানে পৌঁছে যায়।

    সে তার লেখা চিঠিটা পুনরায় পড়তে লাগল। তার মনে হচ্ছে, এতেই হবে। সে তার একজন বিশ্বস্ত লোককে চিঠিটা পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব দিল। তারপর সে জুডিথ, অ্যাবোলি এবং আরো দুজন পাহারাদার নিয়ে শহরটা ঘুরে দেখতে বের হলো।

    “তোমাদের ওপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক”, এই কথা বলে কিচিরমিচির করতে করতে কয়েকটা ছোট ছেলে হাল এবং জুডিথকে জড়িয়ে ধরে ওদের পারিবারিক দোকানের দিকে নিয়ে যেতে লাগল। অ্যাবোলি ধমক দিয়ে, ভয় দেখিয়ে ওদেরকে থামানোর চেষ্টা করল। কিন্তু এতে খুব একটা লাভ হলো না।

    তারা বিভিন্ন ধরনের রকমারি জিনিসপত্রের সামনে দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগল। আইভরি পাথর এবং অ্যারাবিক আঠা জাতীয় বিভিন্ন পদার্থ রাখা আছে এরকম একটা দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় কিছু জিনিসপত্র কিনল ওরা। ঝুড়িতে করে বিভিন্ন স্পাইসি জিনিসপত্র নিয়ে ছোট ব্যবসায়ীরা বসে আছে। এছাড়াও চকচক করা সিল্ক এবং কার্পেট-এর দোকানীরা কার্পেট-এর ভাঁজ খুলতে খুলতে জুডিথকে দক্ষ ব্যবসায়ীর মতো তাদের জিনিসপত্রের প্রলোভন দেখাতে লাগল। এরপর ওরা কিছু দাসও বিক্রি হতে দেখল। বিভিন্ন বয়সের নারী, পুরুষ, ছেলে, মেয়ে শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। বিক্রেতার হাতে মোটা শেকল শোভা পাচ্ছে। দাস ব্যবসায়ীরা বা তাদের কোয়াটার মাস্টাররা ক্রেতাদের প্রলোভন দেখানোর জন্য পুরুষদের মাংসল বাহু এবং কাঁধ উঠিয়ে দেখাচ্ছে। মহিলাদের শক্ত হাত বা শরীরের আকর্ষণীয় অংশ এমনকি অল্প বয়সি মেয়েদের গোপনাঙ্গ দেখিয়েও ওরা ক্রেতাদের আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। ব্যাপারটা হাল ও তার সঙ্গীদের কাছে এতটাই বিরক্তিকর মনে হলো যে ওরা বিক্রেতাদের নিরুৎসাহিত করার জন্য ওদিকে ফিরেও তাকাল না।

    যেতে যেতে রাস্তা একসময় এত সরু হয়ে গিয়েছে যে একজন আরেকজনকে ধাক্কাধাক্কি করে সামনে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন রক্তনালীর ভেতর রক্ত জমাট বেঁধে শক্ত হয়ে আছে। কিন্তু তারপরও এখানকার আবহাওয়া ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে ওদের কাছে। কারণ সূর্যের আলো বড় বড় বিল্ডিং ভেদ করে এই পর্যন্ত পৌঁছতে পারছে না। বিল্ডিংগুলো এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন একটার মাথা আরেকটা ছুঁয়ে যাচ্ছে। মাথার ওপর দিয়ে কাকের ঝক উড়ে যাচ্ছে শব্দ করতে-করতে।

    রাস্তাটার একটা সংকীর্ণ জায়গায় যেখানে দোকানীরা গ্রিল করা অক্টোপাস, স্কোয়াড় ওয়েস্টার এবং বিভিন্ন লোভনীয় সামুদ্রিক খাবার বিক্রি করছে তার পাশেই এক অন্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে সেইসব লোকদেরকে অভিসম্পাত দিচ্ছে যারা সত্যিকার খোদা বাদ দিয়ে জেসাসকে মিথ্যে খোদা বানিয়েছে এবং নবি হযরত মোহাম্মদ (সা)-এর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

    “তোমাদেরকে দিনের শেষটা দেখার জন্য হলেও বেঁচে থাকতে হবে!” লোকটি বলছে। লোকটির অন্ধ হয়ে যাওয়া চোখটা দেখে হাল-এর খানিকক্ষণ আগের কথা মাথায় আসলো। একটা ছোট ছেলে লিচু বিক্রি করতে চাচ্ছিল ওদের কাছে। এই লোকটার চোখগুলো খোসা ছাড়ানো লিচুর মতোই সাদা। “স্রষ্টার সাথে বেইমানি করার দায়ে তোমাদের জন্য চরম শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে, নরকের আগুনে নিক্ষেপ করা হবে তোমাদের।”

    সেখানে অনেক মুসলমান অন্ধ লোকটিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। না তারা অন্ধ লোকটির দিকে ফিরে তাকাচ্ছে, না তারা নিজেদের জীবনের কথা চিন্তা করে ভীত হচ্ছে।

    “তার অবস্থা হয়েছে দেদা পাখির মতো,” অ্যাবোলি বলল। “সে এত বেশি চিৎকার করছে যে লোকজন একদম অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। তারা এখন আর লোকটির চিৎকার-এ পাত্তা দিচ্ছে না।”

    “এই দ্বীপটা সত্যিই অসাধারণ,” হাল এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বলল। কারও গায়ের রং কালো, কারোটা আবার সাদা। এমনকি বাদামি আর হলদে ভাব যুক্ত গায়ের রঙের মানুষও দেখা যায়। কারো চোখ আলমন্ড-এর মতো, কারোটা আবার কাকৃতি। নাক দেখতে কারওটা চেপ্টা, কারওটা বাঁকানো। চুলের রঙে এবং গড়নেও রয়েছে ভিন্নতা। কারও চুল উলের মতো, কারও সিল্কী, কারও চুলের রং কালো অথবা সোনালি। ইউরোপীয়ান, বান্টু এবং আরব উপমহাদেশে লোকদের রঙের সংমিশ্রণ ঘটেছে ইন্ডিয়া মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত এই দ্বীপটিতে।

    “আইয়াসুর বাবার রাজত্বকালে আমার বাবা যখন ভেনিস-এর অ্যাম্বাসিতে ছিল যখন আমার বিভিন্ন জাতের মানুষ দেখার সুযোগ হয়েছে। তখন এদিক সেদিক বিভিন্ন ক্যানেল-এ ঘুরতে চলে যেতাম। কিন্তু সেখানে উপকূল বা দ্বীপগুলো এরকম ছিল না।” জুডিথ-একটা শুষ্ক হাসি দিয়ে বলল, “কিন্তু ভেনিস ছিল ইউরোপ-এ আর জাঞ্জিবার হচ্ছে আফ্রিকায়। এটা উষ্ণ এবং বন্য একটা উপমহাদেশ।”

    সে হাল-এর বাহু ধরে কাছে টেনে এনে বলল, “আমার সম্ভবত অস্ত্র নিয়ে আসা উচিত ছিল।” হাল মনে করার চেষ্টা করল যখন সে জুডিথকে হউবার্ক পরা অবস্থায় দেখেছিল তখন কত সুন্দরই না লেগেছিল। সুসজ্জিত কালো অ্যারাবিয়ান স্ট্যালিয়ন-এর উপরে চড়ে যাচ্ছিল। যখন হাল জুডিথকে এরকম যোদ্ধার বেশে দেখেছিল সে তাকে একজন পুরুষ বলেই মনে করেছিল। সে তাকে জেনারেল নাজেত নামেই চিনত। কিন্তু কখনও ভাবেনি যে এরকম বিখ্যাত যোদ্ধা একজন নারীও হতে পারে। আর এখন জুডিথের শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি সম্পর্কে ভালভাবে জানার পর তার বেশ অবাকই লাগে যে প্রথম দেখায় তাকে কিভাবে সে পুরুষ ভেবেছিল! “তোমাকে আমার খুব কাছাকাছি থাকতে হবে, ক্যাপ্টেন কার্টনি,” জুডিথ বলল। জুডিথের গরম নিঃশ্বাস হাল-এর কান ছুঁয়ে যাচ্ছে যেটা তাকে তাড়া দিতে লাগল জুডিথকে নরম বিছানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য।

    “কোনো ভয় নেই। মাই লাভ,” সে বলল। “আমি প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি তোমাকে রক্ষা করব। আমার কাছে তুমি নিরাপদ।”

    জুডিথ অল্প করে হেসে দিয়ে হাল-এর খুব কাছে এসে গালে ঠোঁট ছোঁয়াল, এরপর এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখতে লাগল কেউ তাদের দেখে ফেলেছে কি-না। হালও একটা হাসি দিল, এরপর সেও বিস্ময়াভিভূত হয়ে জাঞ্জিবার শহরটা দেখতে লাগল।

    হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে তাদের ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাদের একটু সামনেই একটা জায়গায় দাস বিক্রেতার আশেপাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সেখানে পাতলা লম্বা অ্যামব্রয়ডারি করা গাউন এবং মাথায় স্কার্ফ পরা অ্যারাবিয়ানরা, দৃঢ়চেতা পর্তুগীজ ব্যবসায়ীরা, জাহাজের ক্যাপ্টেন, এজেন্ট এবং ক্রাফটম্যানরা সস্তায় শ্রমিক এবং কর্মচারী খুঁজতে এসেছে। সেখানে অনেক স্টলের দোকানীরাও তাদের দোকান ফেলে চলে এসেছে।

    লোকটা একটা ছোট ছেলেকে লাথি মারছে যার চামড়ার নিচের বক্ষ পিঞ্জরের হাড়গুলো বের হয়ে আছে। কিন্তু ছেলেটা কাঁদতেও পারছে না। তার বদলে সে তার চিকন হাতগুলো দিয়ে খুব শক্তভাবে বিক্রেতার পা জড়িয়ে ধরে আছে। সে ছাড়াও আশেপাশে আরো তিনজন আফ্রিকান এবং একজন ইউরোপিয়ান দাস ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লম্বা অস্ত্র হাতে পাহারাদারেরা ওদেরকে বেঁধে রাখা দড়িগুলো হাতে ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

    নারী ও পুরুষের সমবেত চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা গণ্ডগোল সেখানে হয়েছে। দাস বিক্রেতাটা তার লম্বা পিস্তলের ব্যারেলটা দিয়ে দাস ছেলেটাকে আঘাত করছে। ছেলেটা বিক্রেতাটার পায়ের মাংসে কামড় বসিয়েছে, যে কারণে বিক্রেতটাও চিৎকার করছে এবং আরও জোরে প্রহার করছে।

    “থাম। ছেড়ে দাও ওকে,” জুডিথ অ্যারাবিক ভাষায় চিৎকার করে উঠল। ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে দাস ছেলেটাকে ছাড়াতে চাইল সে। হাল এবং অ্যাবোলি তাকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।

    “এতে তোমার সমম্যাটা কী হচ্ছে?” দাস বিক্রেতাটা জানতে চাইল।

    “চলে আস,” হাল জুডিথকে টান দিয়ে রাগত স্বরে বলল। কিন্তু জুডিথ নড়ল না।

    “আমার সম্যাটা হচ্ছে যে আমি চাই না কেনার আগে আমার দাসের কোনো ক্ষতি হোক।”

    “তুমি এই ছোঁকড়াটাকে কিনতে চাও?” দাস বিক্রেতা অবাক হয়ে জানতে চায়।

    জুডিথ মাখা ঝাঁকাল, “কিন্তু আমি তোমাকে এক সিলভার রুপির একটুও বেশি দিব না।”

    দাস বালকটি অবাক হয়ে জুডিথকে দেখতে লাগল। হালও তাকিয়ে তাকিয়ে জুডিথকে দেখছে। ছেলেটার বয়স বার বছরের বেশি হবে না। নোংরা, ময়লার নিচে ছেলেটার গায়ের রঙ একেবারে জুডিথের মতো।

    “ঠিক আছে”, দাস বিক্রেতাটা খুব দ্রুত বলে উঠল। “এই দাসটি সুন্দরী মহিলাটির কাছে বিক্রিত হল। সে নিলামের কাঠের টেবিলে আঘাত করে বিক্রি নিশ্চিত করল।

    হাল আর না পেরে হাল ছেড়ে দিল এবং তার পকেট থেকে একটা কয়েন বের করে দাস বিক্রেতার দিকে নিক্ষেপ করল। এরপর বদমাসটা তার পা দিয়ে দাস ছেলেটাকে সজোরে একটা ধাক্কা মারল। ছেলেটা দ্ৰতু খরগোশের মতো লাফ দিয়ে জুডিথের বাড়ানো বাহুকে এড়িয়ে পালিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারল না।

    অ্যাবোলি তার লম্বা কালো বাহু দিয়ে ছেলেটাকে ধরে ফেলল। অ্যাবোলি যখন ছেলেটাকে উপরে উঠাল তখন বাতাসে হাত-পা ছুড়ছিল সে।

    “তুমি পালিয়ে কোথায় যাবে ভেবেছ?” সে দয়ামায়াহীনভাবে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করল। “তুমি এখন এই ভদ্রমহিলার সম্পত্তি, মসি।”

    “মসি?” হাল জিজ্ঞেস করল।

    “মসি মানে হচ্ছে চড়ুই পাখি। আমার মনে হয় এটাই ওর জন্য উপযুক্ত নাম।” জুডিথ হেসে ফেলল। “যাই হোক, আমার মনে হয় না তুমি খুব বেশিদূর যেতে পারবে, মসি।” ছেলেটা হাত-পা ছোঁড়া ছেড়ে দিয়ে অ্যাবোলির মুষ্ঠির মধ্যে শরীরের ভার ছেড়ে দিল।

    “আমি দাস হিসেবে খুব একটা ভাল না। তুমি দেখে নিও।” মসি জুডিথ এর দিকে তাকিয়ে বলল।

    হাল-এর মনে হচ্ছিল, এবার কিছু একটা বলা উচিত। সে হাঁটুগেড়ে বসে ছেলেটার চোখের উচ্চতায় নিজেকে নামিয়ে আনল, এরপর বলতে শুরু করল, “আমার জাহাজে কোনো দাস নেই, ঠিক আছে? আর তুমি সেখানেই যাচ্ছ। এরপরেও তুমি যদি নিজেকে দাস ভাবো তাহলে আমি তোমাকে সাগরে নিক্ষেপ করব। ওখানকার হাঙ্গরগুলো সারাবছর ধরে তোমার মতো খাবারের জন্যই অপেক্ষা করে। তুমি কী তাই চাও, মসি?”

    মসি বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাল কিন্তু তার ছোট চোখ দুটো জলে ভরে উঠল-পরিষ্কার ইঙ্গিত দিচ্ছে যে তার মনে এরকম কিছুই কাজ করছে না। হাল এবার জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে ইশারা করল-ব্যাপারটাতে এবার জুডিথ-এর হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

    “মসি, আমি তোমাকে প্রতিমাসে এক পেনী করে দেব যদি তুমি আমার বডিগার্ড হিসেবে কাজ কর। এবং আমি কথা দিচ্ছি যে তোমাকে কখনোই হাঙ্গরের মুখে নিক্ষেপ করা হবে না।” এবার ছেলেটি খুব আগ্রহ নিয়ে জুডিথ এর দিকে তাকাল।

    হাল এবার একটু মজা করার লোভ সামলাতে পারল না। সে বলল, “আমি তোমাকে দুই পেনী করে দিব যদি তুমি আমার বডিগার্ড হিসেবে কাজ

    মসি মাথা নিচু করে হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “না।”

    “কেন না?” হাল জানতে চাইল।

    “কারণ সে আমার ভাষা তোমার চেয়েও ভাল জানে। এছাড়াও…” সে। থেমে গিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইল।

    “এছাড়াও কী?” হাল আবারও জানতে চাইল।

    মসি মাথা নিচু করে তার খালি পায়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, “তার গন্ধ অনেক ভাল। আর…সে দেখতে তোমার চেয়েও অনেক সুন্দর।”

    সামনের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে জুডিথ ছেলেটার গল্প শুনতে চাইল। তার বাবা ছিল একজন জেলে। সোমালিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলে বারাবা গ্রামে তার জন্ম। অ্যারাবিয়ান দাস বিক্রেতারা একবার তাদের গ্রামে আক্রমণ করে তাকে নিয়ে যায় এবং এরপর জাঞ্জিবার-এ পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়।

    “আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারব যাতে তোমরা হারিয়ে না যাও,” ছেলেটা খুব গর্বের সাথে বলল।

    “সেটা তো খুবই ভাল কথা,” হাল উত্তর দিল।

    “তুমি না। আমি মেমকে বলেছি,” মসি বলল। মেম হচ্ছে মেমসাহেব-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এটা হচ্ছে অনেক সম্মানের একটা সম্বোধন যেটা সে জুডিথকে উপহার স্বরূপ দিয়েছে। তারা সেই বৃদ্ধ দোকানীটার ঘরে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত ছেলেটা এটা সেটা কথা বলেই যেতে লাগল।

    যে নাবিকটাকে রাষ্ট্রদূত গ্রে-এর সাথে সাক্ষাতের জন্য পাঠানো হয়েছিল সে ওখানে অপেক্ষা করছিল, উইলিয়াম পেটও তার সঙ্গে রয়েছে।

    “আমাদের ভাগ্য বেশ ভাল বলতে হবে ক্যাপ্টেন,” পেট হালকে দেখে বলল। “রাষ্ট্রদূত আমাদের দুজনের সাথে সাক্ষাতের সম্মতি দিয়েছেন। তিনি আজ মধ্যাহ্ন ভোজনে আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন।”

    “আজকেই?” এত দ্রুত প্রতিক্রিয়া পেয়ে হাল খুব অবাক হলো। “তাহলে আমাদের আর বাইরে না যাওয়াই ভাল। অ্যাবোলি তুমি যদি জেনারেল জুডিথ এবং তার নতুন ছেলেটার দেখাশোনা করতে পার তবে আমি পেট-এর সাথে কনসাল গ্রে-এর সাথে দেখা করতে যেতে পারি। তাহলে আমাদের হয়ত আর থাকার জায়গার প্রয়োজনই পড়বে না। আজ সন্ধ্যার মধ্যেই হয়তো আমরা ডেফটে ফিরে যেতে পারব যাতে খুব ভোরে বাট নিয়ে আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে পারি।”

    *

    যখন থেকে গ্রে জানতে পেরেছে যে কার্টনি এই জাঞ্জিবার শহরেই আছে তখন থেকেই অস্বাভাবিক দ্রুত গতির সাথে সে নিজের কি কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। যে মাস থেকে তার দুর্ভাগ্য ও দারিদ্রতা শুরু হয়েছিল সে মাস থেকেই তার গৃহস্থালীর লোকজন কমতে শুরু করেছিল। কিন্তু এখনো তার একটা রাঁধুনী আছে। তার দেয়ালে টাঙানো বেশ কিছু পেন্টিং আর কিছু পারসিয়ান কম্বল বন্ধক রাখার ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য সে তার পরিচিত একজন দালালের কাছে গেল, যাকে অনুরোধের পাশাপাশি এই কথাটাও বলে দিতে ভুলল না : “আমার ভাগ্য খুব শীঘ্রই বদলে যাবে স্যার, এই কথাটা মনে রাখবেন।”

    তার হাতে যে ক্যাশ আছে তা দিয়ে অন্তত কয়েকজন স্টাফকে-যাদেরকে সে বাদ দিয়েছিল-ধার করে নিয়ে আসতে পারবে। তখন অন্তত বাড়িটাতে ধনী-ধনী ভাব ফুটিয়ে ভোলা যাবে। তার রাধুনীটাকে সে বাজারে পাঠিয়েছে যেন সে ভাল ভাল সব জিনিসপত্র কিনে আনে এবং শহরের ভাল দোকান আর রাধুনীদের মতো খাবার রান্না করতে পারে। হাল কার্টনি এবং তার সঙ্গী মি. পেট যখন পৌঁছাল তখন সেরা খাবারটাই পরিবেশন করল গ্রে-গরুর মাংস ও পটেটো দিয়ে রান্না করা এক ধরনের পিলাফ, পেয়াস, নারিকেলের দুধ, খোলা আগুনে পোড়ানো শার্ক-এর গ্রিল। পিজা ওয়া নাজি নামে একধরনের খাবার আছে যেটা বানানো হয় অক্টোপাস-এর মাংস সেদ্ধ করে। সেই সাথে দেয়া হয় নারিকেলের দুধ, কারি, সিন্নামন, কার্ডামম, গার্লিক, লেবুর রস।

    গ্রে খাবারগুলো সব নামিয়ে রাখছিল। যদিও হাল খেয়াল করে দেখল যে পেট খুব একটা খাবার খাচ্ছে না। খাবার টেবিলে এরকম আচরণ তাদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাবই প্রকাশ পাচ্ছে। গ্রে-কে অবশ্য বেশ আত্মবিশ্বাসীই মনে হচ্ছিল। সে যখন হালকে আশ্বস্ত করে যে উত্তরে অনধিকার প্রবেশের ব্যাপারে তার কোনো বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নেই, তখন হাল নিশ্চিন্ত মনেই সেই আশ্বস্ততা গ্রহণ করে।

    হাল চলে যাওয়ার পর গ্রে কিছুটা আন্দাজ করতে পারে যে সে উপকূলের কাছেই একটা ওষুধের দোকানে থাকার জায়গা বেছে নিয়েছে। কিন্তু জায়গাটা কোথায় সে ব্যাপারে নিশ্চিতভাবে কিছু জানতে পারেনি। গ্রে আরও বুঝতে পারে যে গোল্ডেন বাউ নিয়ে হাল পোতাশ্রয়ে প্রবেশ করেনি। এবং আগামীকাল জোয়ারের সময় সেটা ছাড়বে। কার্টনি চলে যাওয়ার আগে গ্রে এবং তার নিজের ব্যাপারে ভাল কিছুর আশাবাদ ব্যক্ত করে। সেই সাথে পেটকে বিদায় জানায়। সে পেটকে গ্রে-এর সাথে রেখে যায়, সেই সাথে রেখে যায় লন্ডনের উদ্দেশ্যে লেখা কিছু চিঠিও।

    ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর যখন বাড়ির গেট বন্ধ হয়ে যায় তখন গ্রে চিঠিগুলো একজন চাকরের হাতে দিয়ে তার টেবিলে রাখতে বলে। কার্টনির ঔদ্ধত্য ও সাহস দেখে সে মনে মনে বেশ ক্ষুদ্ধ হচ্ছিল। কোনো রকম অনুমতি পত্র ছাড়া সে জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় পা দেয়ার সাহস পায় কী করে।

    এরপর গ্রে পেট-এর দিকে মনোযোগ দেয়। এই রসকষহীন বিরক্তিকর লোকটাকে নিয়ে সে কি করে। গ্রের মনে হচ্ছে হাল অপমানের মাত্রাটা আরও একটু বাড়িয়ে দেয়ার জন্যই পেটকে তার কাছে দিয়ে গিয়েছে।

    এখনো তাকে আরও একটু খেলা খেলতে হবে। স্টেজ-এর পর্দা এখনো নামিয়ে ফেলা হয়নি। তাই সে তার মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে সম্মানিত অতিথির দিকে তাকাল। হাতে তালি বাজিয়ে একজন চাকরকে ডেকে কফি দিতে বলল। এরপর সে পেটকে বলল, “জাঞ্জিবার-এর প্রতিদিনকার দুশ্চিন্তা থেকে সরে গিয়ে পুনরায় রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ শুরু করার সুযোগ পেয়ে আমি গর্বিত। এখন বলুন স্যার আমি আপনার কীভাবে সহযোগিতা করতে পারি? ক্যাপ্টেন কার্টনি বলেছে আমি যেন আপনার গল্প মনযোগ দিয়ে শুনি।

    পেট কফি না নিয়ে গ্রে-র প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করল। “এটা সত্য যে বোম্বে (মুম্বাই) থেকে আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর যাত্রী হিসেবে যখন আমি যাত্রা করেছিলাম, তখনো আমি ভাবতে পারিনি যে আমি এখানে এসে পৌঁছাবো।”

    “ও, হা, আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড। ওটাতে বেশ কয়েকবার জাঞ্জিবার-এ নোঙর ফেলেছে, গ্রে বলল। এরপর টেবিলের দিকে তাকিয়ে কফির পাশে রাখা প্লেটটা নিজের দিকে টেনে নিল। সেটাতে মিষ্টি জাতীয় এক ধরনের গোলাপি রঙের বল রাখা আছে। সে একটা বল চামচ দিয়ে মুখে তুলে নিল।

    “আচ্ছা, আমি, জাহাজটার ক্যাপ্টেন-এর নাম মনে করার চেষ্টা করি।” মুখভর্তি গোলাপি রঙের বলটা নিয়েই সে বলল, “গিডিংস…গ্যাডিংস,..আমার যতদূর মনে আছে এরকমই কিছু একটা।”

    “গোডিংস।”

    “ওহ, হ্যাঁ। অত্যন্ত আমুদে লোক। নিজের আনন্দ ফুর্তি নিয়েই সবসময় ব্যস্ত থাকে। অনেকটা ইয়ং কার্টনির মতো। সে এখন কেমন আছে?”

    “মারা গিয়েছে। তার জাহাজসহ আগুনে পুড়ে গিয়েছে। আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড বোম্বে (মুম্বাই) থেকে ছেড়ে আসার এক সপ্তাহ পর আগুনে পুড়ে যায়। সে জাহাজ ভর্তি সল্টপিটার নিয়ে রওনা হয়েছিল। এ কারণে আগুন লাগার পর কেউ রক্ষা পায়নি, শুধু আমি কোনোভাবে পালিয়ে বেঁচেছি।”

    “আহারে বেচারা লোকগুলো কেউ বাঁচল না?” “আপনার বেশ সৌভাগ্যই বলতে হয়।”

    “আমি জলন্ত জাহাজ থেকে এই বিশ্বাসে লাফ দেই যে আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে রক্ষা করবেন।”

    “আল্লাহ তাআলা সর্বশক্তিমান এবং পরম করুণাময়,” গ্রে বিড়বিড় করে বলল।

    “আমি এই সৃষ্টিকর্তার কথা বলিনি।” পেট খুব ঠাণ্ডা এবং ধীরস্থিরভাবে বলল। গ্রে তার অতিথির আসল প্রকৃতি সম্পর্কে একটু সচেতন হয়ে উঠল।

    “যেভাবেই হোক আমি বেঁচে যাই,” পেট বলা শুরু করল। “ডাচদের একটা জাহাজ আমাকে উদ্ধার করে, যদিও এই মহানুভবতার পেছনে একটা নিষ্ঠুরতম উদ্দেশ্য ছিল। আমাকে একটা নোংরা বন্দিখানায় আটকে রাখা হয়।”

    “কী কারণে তারা এমনটা করেছিল?”

    “জাহাজের ক্যাপ্টেন বলেছিল যে আমার নিজের নিরাপত্তার জন্যই তাকে এটা করতে হয়েছিল। জাহাজে তখন চরম খাদ্য সংকট ছিল এবং সবাই ক্ষুধার্ত ছিল। তার ভয় ছিল যে আগন্তুক হিসেবে যেহেতু জাহাজের লোকদের সাথে আমার কোনো বন্ধন নেই, তাই তারা হয়তো খিদের জ্বালায় আমাকে মেরে আমার মাংস রান্না করে খেয়ে ফেলতে পারে।”

    এখন দেখা যাচ্ছে যেভাবেই হোক আপনি এরকম কিছুর শিকার হন নি।” গ্রে কিছুটা হাস্যরসাত্মকভাবে কথাটা বলল। কিন্তু পেট সেটা বুঝতে পারল না।

    “আমি ক্যাপ্টেন কার্টনির কারণে এই কারাবাস থেকে মুক্তি পাই। সে-ই আমাকে আমার প্রাপ্য সম্মান ফিরিয়ে দেয়।”

    “দেখা যাচ্ছে আপনি অক্ষত অবস্থায়ই কারাবাস থেকে মুক্তি পেয়েছেন। আপনার মুক্তিটা আপনার জন্য একটা পুরস্কারই বলা যায় মি. পেট, গ্রে আরো একটু যোগ করল।

    “আমি বেশ নিরাপদেই আছি। এখন যেভাবেই হোক আমার ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু ফিরে যাওয়ার জন্য যে পরিমাণ টাকা-পয়সা দরকার তা আমার হাতে নেই। এমনকি আমি যে জামাকাপড় পরে আছি এগুলো ছাড়া আমার হাতে কোনো জামাকাপড়ও নেই। কিন্তু একটা কাজ করে দেয়ার সুবাধে ইংল্যান্ডে পৌঁছেই এক ভদ্রলোকের কাছ থেকে পাঁচ’শ গিনী পাব।”

    “পাঁচ’শ গিনী?” আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে যে আপনি এতগুলো টাকা কীভাবে পাবেন। কী এমন কাজ করেছেন যার বিনিময়ে আপনি এতগুলো টাকা পাচ্ছেন?

    পেট অভিব্যক্তিহীন চোখে গ্রে-র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি গোডিংস-কে হত্যা করেছি।”

    গ্রে ক্ষিপ্ত হয়ে এক লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। “গেট আউট।” সে সরাসরি দরজার দিকে ইশারা করে বলল, “আমার মনে হয় কার্টনি ইচ্ছে করেই আপনার এইসব ফালতু গল্পসহ আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমার সাথে এইসব ফালতু গল্প বলে লাভ নেই। আমি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়ার আগে আপনি বের হয়ে যান।”

    পেট একটুও নড়ল না। এমনকি তার অভিব্যক্তিতেও কোনো পরিবর্তন আসল না। বরং গ্রে কথা শেষ করার আগ পর্যন্ত সে নীরবে অপেক্ষা করল। এরপর বলল, “আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি আমি আপনাকে যে কথাগুলো বলেছি তার একচুলও মিথ্যে নয়। আমি এগুলোর প্রমাণ দেখাতে পারি। কিন্তু সেজন্য আপনাকেও আমার খুন করতে হবে। এই ছোট্ট চামচটা যেটা আপনি একটু আগে ব্যবহার করেছেন, কিংবা এই ছোট্ট ট্রেটা যেটার ওপর মিষ্টির প্লেটগুলো রাখা আছে অথবা শুধু আমার হাত দিয়ে কাজটা আমি সহজেই করতে পারি।”

    গ্রে-র মনে হল তার শরীর থেকে সমস্ত রক্ত বের হয়ে গিয়ে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। পেট-এর কথাবার্তার মধ্যেই ভয়ের কিছু একটা ছিল। সে কাউকে কত সহজে হত্যা করতে পারে শুধু সেই কথাটাই জানিয়েছে। এতে খুব স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল যে কাউকে বশে আনতে খুব বেশি পরিশ্রম করতে সে নারাজ।

    “আমি তোমাকে প্রিন্স জাহান-এর কাছে ধরিয়ে দিতে পারি। তিনি তোমাকে শাস্তি দেবেন,” গ্রে খুব তর্জন গর্জন করে বলার চেষ্টা করলেও সে জানে তার কথাগুলোতে কতটা ভয় মিশ্রিত ছিল।

    “না, মি. গ্রে, তুমি তা পার না,” পেট বলল। “আমি জাঞ্জিবার-এ কোনোরকম অন্যায় করি নি। এমনকি সে কিংবা তার ভাই গ্রেট মোগল দ্বারা শাসিত কোনো ভূমিতেও আমি কোনো অন্যায় করিনি। যদি আপনি বলেন যে এই কথাগুলো আমি নিজমুখে স্বীকার করেছি তাহলে আমি বলব যে, আপনি মিথ্যা বলছেন। ঠিক আপনার মতো করেই বলব যে এগুলো গাঁজাখুরি গল্প ছাড়া আর কিছুই নয়।”

    “তাই আসুন শূন্য হাতে এসব হুমকি দেয়া আমরা বাদ দেই। আমি বিশ্বাস করি যে আমি বাড়ি ফেরার জন্য যথেষ্ট টাকা-পয়সা জোগাড় করতে পারব এবং আপনি বা আপনার লোকেরা সেই ফান্ড-এর ব্যবস্থা করে দিবেন। এখন আমাকে বলুন আপনি হাল কার্টনির ব্যাপারে কী ভেবেছেন?”

    ব্যাপারটা খুব একটা কঠিন হবে না। গ্রে-কে ডিভান-এ হেলান দিয়ে বসতে দেখে পেট চিন্তা করল। সে কিছু বলল না কারণ সে জানে তার যা প্রয়োজন সব তথ্যই রাষ্ট্রদূত-এর কাছে আছে। এখন শুধু এটাই দেখার বিষয় যে রাষ্ট্রদূত গ্রে কিভাবে এগোয়।

    আরেকবার গ্রে তুর্কিস মিষ্টিবলগুলোর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। এখনও পেট চুপচাপ আছে। আর গ্রে মিষ্টি বলটা খেয়ে ঠোঁটে লেগে থাকা মিষ্টিটুকু জিব দিয়ে চেটে খাওয়ার পর বলল, “যেহেতু আপনি আপনার গল্প বলেছেন। এবার আমাকে আমার সম্পর্কে কিছু বলতে দিন…?”

    পেট হাত নাড়িয়ে ইশারা করল যার অর্থ। “আচ্ছা, শুরু করুন।”

    “আমি একটা নম্র ও ভদ্র পরিবার থেকে এসেছি। সে জন্য আমি গর্ববোধ করি। আমার জন্ম এবং বেড়ে উঠা ইয়র্কশায়ার-এর হেবডেন ব্রিজ-এ। আমি জানি আমাকে দেখতে হয়ত সেরকমটা মনে হয় না। কিন্তু ইয়র্কশায়ার ম্যান হিসেবে আমি গর্ববোধ করি। আমার বাবা-মা ভ্রমণকারীদের জন্য একটা সরাই খানা চালাত। মাঝে মাঝে আমাদের সরাইখানায় দক্ষিণ থেকে এমনকি লন্ডন থেকে ভ্রমণকারীরা আসত এবং তখন আমার মনে হত আমাকে আমার ভাগ্য অন্বেষণে বের হতে হবে। তাই আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যাই। তখন আমার পকেটে মাত্র কয়েক পেনী ছিল। তার দুই বছর পর আমি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কেরানি হিসেবে যোগদান করি। আমার মা-বাবার কাছে এটা ছিল অনেক বড় ব্যাপার। কিন্তু আমার কাছে এটা ছিল শুধু শুরু।”

    “আপনি দেখেন মি. পেট। সব শ্রেণির মানুষের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলার এক ধরনের ক্ষমতা আমার আছে। আমি ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা পছন্দ করি। এমনকি সুলতান এবং মহারাজার সাথেও আমার বন্ধুত্ব আছে। আমি লর্ড আর লেডিসদের বিনোদনের ব্যবস্থা করি। আমি এমন সব পর্তুগীজদের সাথে আহার করি যাদের সম্পদ সম্পর্কে আপনি ধারণাই করতে পারবেন না। একটা অনুষ্ঠানে ইংল্যান্ডের মহারাজার সাথেও সাক্ষাৎ করেছিলাম আমি।”

    আমার মনে হয় না অনুষ্ঠানটা মহারাজার কাছে এতটা স্মরণীয় ছিল। পেট মনে মনে ভাবল। গ্রে আবার বলতে শুরু করল, “জাঞ্জিবার-এর মতো শহরে কেউ শুধু নিজেকে নিয়ে বাঁচতে পারে না। ছিনতাই, পকেট মার, দাস ব্যবসা কিংবা অন্য কোনো অন্যায়ের সাথে তাকে কোনো না কোনোভাবে যুক্ত হতেই হবে। বিশ্বের যেকোনো মানুষকে হয়ত দেখা যাবে কোনো গলিতে দাঁড়িয়ে এমন কারও সাথে ব্যবসা করছে যে কি-না কিছুক্ষণ আগে তার মেয়েকে বিক্রি করে দিয়ে এসেছে।”

    “এই স্বাতন্ত্র্য সবসময় দেখা যায় না,” পেট বলল।

    “সেটা হয়ত ঠিক,” গ্রে ব্যাখ্যা করে বুঝাল। “আমার মতে একজন মানুষ সেরকম ব্যবহারই করে যেরকমটা পরিস্থিতি তাকে করতে বাধ্য করে। আমি হয়ত আমার আজকের অবস্থানে পৌঁছতে পারতাম না যদি ভীরু, কাপুরুষের জীবন বেছে নিতাম।”

    “কিন্তু স্যার একটা কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না। কিছু মনে করবেন না যদি আমি বলি যে আপনার অবস্থা একসময় যতটা ঈর্ষণীয় ছিল এখন ততটা নেই। আমি এটাও না বলে পারছি না যে, আপনার দেয়ালটা দেখে মনে হচ্ছে, সেখানে আরও কিছু ছবি ছিল যেগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অথবা বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। যদিও আপনার বাড়ির সামনের জায়গাটুকু অনেক মনোরম এবং ঝরনাটার চারপাশে অনেক ফুলের গাছ লাগানো আছে। কিন্তু আমি এটাও উল্লেখ না করে পারছি না যে, আপনার চাকর-বাকরেরা এগুলোর সঠিক যত্ন নেয় না। যদিও তাদেরকে দেখে মনে হয় তারা তাদের মনিবের প্রতি যথেষ্ট বাধ্যগত কিন্তু তাদের কাজের মাধ্যমে সেটা প্রমাণিত হয় না।”

    “পর্যবেক্ষক হিসেবে আপনার প্রশংসা না করে পারছি না, মি. পেট,” বেশ তীক্ষ্ণভাবেই গ্রে কথাটা বলল।

    “আমার ব্যবসার স্বার্থেই আমাকে এটা করতে হয়।”

    “তাহলে আপনাকে একজন দক্ষ ব্যবসায়ীই বলতে হয়। আমিও জানি অন্যায় ও অবিচার এর মধ্য দিয়ে গেলে কতটা দুর্ভোগ-এর স্বীকার হতে হয়। আমি স্যার হেনরি কার্টনির কথা বিশ্বাস করেছিলাম। উনি যে ভদ্রলোকের মুখোশ পরে থাকেন, ওটা আমি আগে বুঝতে পারিনি।”

    “আমি জানতে পেরেছি যে, সে কৌশলে আপনার কাছ থেকে সব তথ্য আদায় করে নিয়েছিল।”

    “সেটা সত্য। সে এখানে আমার বন্ধু হতে এসেছিল। কিন্তু আসলে সে তার জাহাজকে একজন সত্যিকার সৃষ্টিকর্তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নিয়ে এসেছিল। সেই সাথে যুদ্ধ করেছে সেই লোকটার বিরুদ্ধে, যাকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছিল সে।”

    পেট অনেক কষ্ট করে লোকটির এই ব্লাসফ্যামী সহ্য করে যাচ্ছে। এই লোকটিকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে তার মাথার ভেতর থেকে চিৎকার শুনতে পাচ্ছে। কিন্তু সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে কারণ তাকে তার কাজ শেষ করতে হবে। আর সেজন্য মি, গ্রে’র সহযোগিতার প্রয়োজন পড়বে। তাই গ্রে’র আচরণ তার মনে যতই বিদ্রোহ জাগিয়ে তুলুক তাকে চুপচাপ থাকতে হবে।

    “আমি ধারণা করতে পারছি যে কার্টনির কৃতকর্মের জন্যে আপনাকে অন্যায়ভাবে দোষরোপ করা হয়েছে।”

    “একদম ঠিক। আমার জন্য সব দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছে পেট। একজন সম্মানীত ব্যক্তি হিসেবে যে দরজাগুলো একসময় আমাকে স্বাগত জানানোর জন্য সদা প্রস্তুত থাকত, সব। আমার ভাগ্য একসময় যতটা সুপ্রসন্ন ছিল ঠিক ততটাই দুর্ভোগ চলছে এখন। আমার জীবনে এমন ভাটা এর আগে কখনো পড়েনি। কিন্তু কার্টনি আমার সঙ্গে এইরকম মিথ্যে বলার পরেও কীভাবে নির্লজ্জের মতো ধৃষ্টতাভরে এখানে নিজের চেহারা দেখাতে আসে? যদি সে এখানে তার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে আসত এবং পুনরায় বন্ধুত্ব স্থাপন করতে আসত আমি হয়ত দ্বিতীয় বারের মতো একটা সুযোগ দিতাম। কিন্তু ক্ষুদ্র অপরাধবোধ বা অনুশোচনাও তার মধ্যে দেখিনি আমি।”

    “তার তারুণ্যই হয়ত এসব দমিয়ে রেখেছে। কার্টনি হয়ত এখনো তার ভুলের গভীরতা বুঝতে পারছে না। সে এমনভাবে চলছে যে দেখে মনে হচ্ছে, সে কোনো মজার খেলা খেলছে। কিন্তু আমি নিশ্চিত দেখতে পারছি যে সে নিজের গলায় নিজেই ফাঁস পরতে যাচ্ছে।”

    “এর একমাত্র কারণ হচ্ছে, আপনি নিজ হাতে তার ফাঁসি দিতে চাচ্ছেন?”

    “বেঁচে থাকার জন্য একজন লোককে কত কী করতে হয়, সেটা আপনি আমার থেকেও ভাল জানেন, মি. গ্রে।”

    “অবশ্যই জানি। কিন্তু জাঞ্জিবার-এর সেই সব মানুষের কথা চিন্তা করে হলেও এই কাজ করতে হবে যারা তার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারা খুবই খুশি হবে যদি তারা কার্টনির হাত থেকে মুক্তি পায়। সেই সাথে যে আমাকে এই কাজে সাহায্য করবে তার প্রতিও তারা কৃতজ্ঞ থাকবে।”

    “আমি আপনার সহযোগী হতে পারলে খুশি হব। আমাদের আলোচনায় আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নিয়ে আসা উচিত। জাঞ্জিবার-এ কার্টনি কিন্তু একা আসেনি। তার সাথে তার স্ত্রীও রয়েছে যে কি-না তার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে।”

    গ্রে’র চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। সে বিস্ময়াবিভূত হয়ে খাবারের টেবিলের দিকে তাকিয়ে রইল। “সে এখন এখানে আছে? যে গুজব শোনা গিয়েছিল সেটা কী তাহলে সত্যি? হাল কার্টনি জেনারেল নাজেতকে সাথে করে নিয়ে এসেছে। সেই বিখ্যাত, শক্তিশালী ওমানী যোদ্ধা। যে কি-না জেনারেল এল গ্রেং-কে পরাজিত করে ছোট্ট আইয়াসুকে সিংহাসনে বসিয়েছে?” সে বাতাসে আঙুল দিয়ে তুরি মেরে বলল, “অথবা আমার বলা উচিত ক্রিশ্চিয়ান মহারাজা, রাজার রাজা, গালা এবং অ্যামহারার শাসন কর্তা, খ্রিস্টীয় বিশ্বাসে আত্মসমর্পণকারী ব্লা ব্লা ব্লা…কার্টনি তাহলে ইথিওপিয়া থেকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য এই কালো মুক্তোকে বেছে নিয়েছে?”

    “সে আসলেই জেনারেল জুডিথ নাজেত। এবং আমি জানি তাকে কোথায় পাওয়া যাবে। এখন আমাদের আলোচনায় আসতে হবে যে আমাদের কিভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমাকে অবশ্যই একটা পার্স জোগাড় করতে হবে এবং সেই সাথে লাগবে আরও কিছু জিনিস-আর্ল অব কাম্বারল্যান্ড-এর সাথে-সাথে আমার টুলবক্সও তলিয়ে গিয়েছে। আমি আপনাকে আরেকটা পরামর্শ দেই। যদি কার্টনি এবং নাজেতকে কোনোভাবে আলাদা করা যায় তাহলে আমাদের কার্য সম্পাদনে সুবিধা হবে। এক্ষেত্রে একটু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। আর সে ব্যাপারে আমি আপনার পরামর্শ আশা করব।”

    গ্রে হেসে বলল, “ওহ আমি একটা জিনিস জানি যেটা আমাদের দুই বিশ্বাসঘাতক লাভবার্ডকে আলাদা করতে পারে। এটা এমন একটা জিনিস যেটার প্রতি ওরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, এবং সেটার জন্যই ওরা যুদ্ধ করেছে।”

    “আপনি কী সত্যিই আমার সঙ্গে ভাঙ খাবেন না? এটা স্রেফ ঠাণ্ডা শরবত যেটা ইন্ডিয়ানরা হরহামেশাই খেয়ে থাকে। খেতে অনেকটা মিষ্টি এবং সাথে একটু ঝাঁঝালো স্বাদও রয়েছে। এক ধরনের পাতার মিশ্রণে এটা তৈরি করা হয়। মনকে হালকা ও ফুরফুরে রাখতে সহায়তা করে। আমাদের এখন ঠাণ্ডা মেজাজে কাজ করাটা খুব জরুরি।”

    পেট গ্রে-র আমন্ত্রণ অস্বীকার করল। কিন্তু কনসাল এক জগ ঠাণ্ডা আনতে আদেশ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্রতিক্রিয়াও তেমনি হয় যেমনটা সে অনুমান করেছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা তাদের কাজের একটা পরিকল্পনা করতে সমর্থ হয়। এরজন্য কী কী জিনিসপত্র লাগবে সেটারও একটা তালিকা তৈরি করে ফেলে। জাঞ্জিবার-এর অবস্থান মেরুর খুব কাছাকাছি হওয়ায় সূর্য সবসময় সন্ধ্যা ছয়টা থেকে সাতটার মধ্যে অস্ত যায়। পেট যখন আলোচনা শেষ করে বিল্ডিং থেকে বের হয় তখন সূর্যের কড়া রোদ-এ ভাটা পড়ে কোমল আলো ছড়িয়ে পড়েছে।

    গ্রে-ও আলোচনা শেষ করে সতেজ মনে ঠাণ্ডা মস্তিষ্কে প্রিন্স জাহান-এর প্রাসাদের দিকে যাত্রা শুরু করে। যখন সে গার্ডদের কাছে ব্যাখ্যা করে যে সে ক্যাপ্টেন কার্টনি এবং জেনারেল নাজেত-এর খবর নিয়ে এসেছে তখন তাকে বেশ উষ্ণ অভ্যর্থনা দিয়েই ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয় এবং অন্যদিনের চেয়ে বেশ দ্রুতই তার জন্য দ্বার উন্মোক্ত হয়ে যায়। প্রথমে জাহান তাকে একা স্বাগত জানায়। এরপর তার সামনে যে মূর্তিটি এসে দাঁড়ায় গ্রে প্রথমে তাকে মানুষ বলে মনে করেনি। সে মূতির্টি হচ্ছে অ্যাঙ্গাস কোকরান-এর পুড়ে যাওয়া শরীর। এরপর একজন বার্তাবাহককে এক থলে সোনার কয়েনসহ একটা নির্দিষ্ট কফিশপ-এ পাঠানো হয় প্রিন্স-এর পক্ষ থেকে। দোকানীকে জিজ্ঞেস করা হয় যে তাকে দিয়ে যদি কোনো কাজ করানো হয় তবে তাকে কী এর চেয়ে বেশি মূল্য দিতে হবে কি-না? দোকানী তাকে এতটা গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে দেখে বিস্মিত হয়! সে জানায় যে যেকোনো কাজ করে দিতে সে প্রস্তুত আছে। এর পরের প্রস্তুতিটুকু প্রাসাদের ভেতরেই নেয়া হয়।

    যখন জাহান এবং বুজার্ড তাদের পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে এলো তখন গ্রে উঠে দাঁড়িয়ে বাকি দুজনকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলো। যাবার আগে সে মাননীয় প্রিন্সকে একটা অনুরোধ করতে ভুলল না। “মহামান্য প্রিন্স, আমি নিশ্চিত যে আজকে সন্ধ্যার মধ্যেই আপনার পরিকল্পনামাফিক সব কাজ হয়ে যাবে। কিন্তু কার্টনির লোকেরা যখন জানতে পারবে যে তাদের ক্যাপ্টেন-এর কিছু ঘটেছে তখন তারা উত্তর খোঁজার জন্য আমার কাছে আসবে। তখন তারা আমাকে এত সহজে ছেড়ে দিবে না। তাই আমি আপনার কাছে অনুরোধ করব যাতে আপনি অন্তত আপনার এক ডজন লোককে গার্ড হিসেবে আমার নিরাপত্তার জন্য নিয়োগ করেন।”

    জাহান হেসে বলল, “তো, কনসাল, আপনি এখন আপনার নিজের দেশের লোকের হাত থেকে বাঁচার জন্য আমার কাছে নিরাপত্তা চাইছেন।”

    “মহারাজা, আমি ব্যাপারটা নিয়ে ওভাবে চিন্তা করছি না। তবে আমার মনে হয় এতে আপনার একটু গুরুত্ব দেয়া উচিত।”

    “আচ্ছা, ঠিক আছে। আপনি গার্ড পাবেন। কিন্তু আমার মনে হয় ছয় জনই যথেষ্ট।”।

    “আপনি কী ছয়কে কোনোভাবে দশ-এ উন্নীত করতে পারেন না মহারাজা?” গ্রে দরকষাকষি করতে লাগল।

    “আট”, জাহান ইতি টেনে বলল। “এর বেশি একজনও নয়। তবে আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আমার মনে হয় না কেউ আপনার কোনো ক্ষতি করতে পারবে। কোনো গার্ডেরই হয়ত আপনার প্রয়োজন পড়বে না।”

    “মহারাজা। আপনার অশেষ দয়ার কারণে আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ।”

    এখন থেকে গ্রে জাহান-এর অফিসিয়াল সুরক্ষার আওতাভুক্ত হলো। সমাজে তার মর্যাদা এবং সম্মান অনেক উপরে উন্নীত হলো। গরমে একা একা বেশ খুশি মনে রাস্তা দিয়ে যেতে লাগল কনসাল গ্রে। অবশেষে সে হয়ত সুদিনের দেখা পেতে যাচ্ছে। তার অর্থনৈতিক অবস্থা দিনের শুরুতে যেমনটা ছিল সেটাও হয়ত বদলে যেতে শুরু করেছে।

    সে বাড়ির ভেতর ঢুকতে না ঢুকতেই খাবার এবং পানীয় আনতে আদেশ করে। তাকে একটা লম্বা, ব্যস্ত রাত পার করতে হবে। এজন্য তাকে খেতে হবে যথেষ্ট পরিমাণ শক্তির যোগান পাওয়ার জন্য। গ্রে একজন সচেতন মানুষ। রাতে হয়ত সবকিছু তার পরিকল্পনামত নাও ঘটতে পারে। তাই যেসব চাকর দিনের বেলায় তার বাড়িতে কাজ করে তাদেরকে সে রাতেও থাকতে বলে দিল। এরা সবাই তার প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত লোক। রাতের বেলায় গোল্ডেন বাউ-এর লোক যেন কোনো গণ্ডগোল বাধাতে না পারে সে কারণেই এই বাড়তি চেষ্টা।

    *

    হাল দোকানীর বাড়ির ছাদের ওপর খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে অ্যাবোলির সাথে কথা বলছিল। দুজনেই তাকিয়ে তাকিয়ে উপকূলবর্তী শহর দেখছিল। টর্চ আর লণ্ঠনের আলোতে জাহাজগুলো আলোকিত মনে হচ্ছিল। সেই আলোকরশ্মি পানির ঢেউয়ের ওপরও নাচানাচি করছিল। ডেট উপকূল থেকে যদিও বেশ দূরে নোঙর করা আছে কিন্তু এরপরেও একটা লম্বা নৌকো ঘাটে বাঁধা আছে। নৌকোয় সবসময় একজন লোক তৈরিই থাকে যেন যেকোনো জরুরি মুহূর্তে হালকে জাহাজে পৌঁছে দিতে পারে। হাল জুডিথকে সন্ধ্যায় জাহাজে পাঠানোর অনেক চেষ্টা করেছে। জুডিথ যখন জানতে চেয়েছে রাতের অন্ধকারেই তারা জাঞ্জিবার ত্যাগ করবে কি-না তখন হাল জানায় ভোর হওয়ার আগে তারা জাঞ্জিবার ত্যাগ করবে না।

    “খুব ভাল হবে তাহলে,” জুডিথ বলে, “তাহলে আমি আরও একটা রাত উপকূলে কাটাতে পারব। সত্যিকারের বিছানায় আমার ঘুমটাও বেশ ভাল হবে, আর আরেকটা কাজও খুব ভালভাবেই করা যাবে…”

    হাল ভেতরে গিয়ে দেখতে পায় জুডিথ ছোট ছোট কম্বল সেলাই করছে বাচ্চার জন্য। আর মসি অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে সেটা দেখছে। এমন সময়ে মি. পেট দেখা করতে আসল।

    “গুড ইভিনিং মি. পেট,” হাল তাকিয়ে দেখে পরিচিত চেহারার চিকন চাকন লোকটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। “গ্রে কী আপনাকে সাহায্য করতে রাজি হয়নি?”

    “ঠিক তা নয় ক্যাপ্টেন,” হাল এবং অ্যাবোলি উভয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকিয়ে পেট জবাব দেয়। বরং তিনি আমাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার জন্য সমস্ত ব্যবস্থা করতে একমত হয়েছে এবং অফিসিয়ালি কোম্পানির পক্ষ থেকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে। এমনকি তিনি আমাকে কিছু অগ্রিমও দিয়েছেন যাতে আপনি আমাকে যে আতিথেয়তা দেখিয়েছেন আমি যেন তা কিছু প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে পারি। আপনি এবং অ্যাবোলি আমার সাথে ডিনার করবেন। যদি সেটাও সম্ভব না হয় তবে অন্তত এক কাপ চা বা পানীয় হলেও আহার করবেন।”

    হাল উত্তর দেয়ার আগেই পেট সামনে ঝুঁকে আরও বিনয়ের সুরে বলতে শুরু করল, “যখন আমি রাষ্ট্রদূত-এর বাড়িতে ছিলাম তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ খবর সেখানে পৌঁছায়। আমার মনে হয় সেই খবরটা আপনার শোনা উচিত। তবে আপনাকে অনুরোধ করব জেনারেল নাজেত-এর সামনে খরবটা না শুনতে।”

    “এখন পর্যন্ত এমন কিছু নেই যেটা আমি জেনারেল নাজেকে বলি নি,” হাল উত্তর দেয়।

    “এমনও হতে পারে যে এটা শোনার পর সে ইথিওপিয়ায় ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়বে-এমনকি যদি আপনি তার সাথে না যান তবুও…”

    হাল কঠোর দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বলল, “এরকম কিছু ঘটার কোনো সম্ভাবনা নেই। আপনি এসব হেয়ালিপনা বন্ধ করে সত্যি করে বলুন আসলে কী বলতে চান?”

    পেট দীর্ঘশ্বাস ফেলে এদিক সেদিক তাকিয়ে এরপর হাল-এর দিকে তাকিয়ে বলল, “দ্য গ্রেইল, ক্যাপ্টেন কার্টনি। আমি হলি গ্রেইল নিয়ে কথা করতে এসেছি। এরপরও কী আপনার মনে হয় না ব্যাপারটা নিয়ে গোপনে কথা বলা প্রয়োজন?”

    হাল অদৃশ্য দৃষ্টি দিয়ে সুদূর অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইল। তার মন চলে গিয়েছে ইথিওপিয়ার অ্যাডেন-এর গালফ পাহাড় এবং রক পাহাড়ের বাইরে। অনেক রক্ত ঝরেছে সেখানে। অনেক মৃত্যু ঘটেছে শুধু গ্রেইল উদ্ধার করার জন্য। এটাই সেই পাত্র যেটার মধ্যে খ্রিস্টের ক্ষত থেকে ঝরে পড়া রক্ত জমা করা হত, খ্রিশ্চিয়ানদের জন্য যেটা রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে। ইথিওপিয়ার খ্রিশ্চিয়ান মহারাজার হয়ে জুডিথ এই হলি গ্রেইল রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞা করেছে। নউটনিয়ার নাইট হিসেবে হলও একই রকম শপথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ইথিওপিয়া থেকে যখন এটা চুরি যায় তখন হাল এবং জুডিথ দুজনে মিলে এটা উদ্ধারে সহায়তা করে। পেট হয়ত ঠিকই বলেছে। এখন যদি আবার এটার কোনো ক্ষতি হবার সম্ভাবনা থাকে তাহলে জুডিথ-এর সম্মান তাকে ইথিওপিয়ায় ফিরে যেতে বাধ্য করবে।”

    অ্যাবোলিও একই দিক বিবেচনা করে বলে, “আমাদের মি. পেট-এর সাথে যাওয়া উচিত। এমন অনেক সময় আসে যখন কোনো পুরুষের তার নারীর প্রতি মনোযোগ দেয়া দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। আবার এমনও কিছু সময় আসে যখন নারীর স্বার্থেই কিছু-কিছু কথা তাকে না বলাটাই উচিত কাজ হিসেবে ধরা যায়। তাই এ ব্যাপারটা নিয়ে আমাদেরই আলোচনা করা উচিত।”

    হাল হাঁ-সূচক মাথা নাড়ায়। “আচ্ছা ঠিক আছে মি. পেট। আমাদের আলোচনার পর আপনি আমাকে এবং অ্যাবোলিকে পথ দেখিয়ে এখানে ফিরিয়ে আনবেন, ঠিক আছে?” এরপর হাল বাড়ির ভেতর ফিরে যায় এবং জুডিথ-এর একটা হাত নিজের হাতের ওপর নিয়ে বলে, “মাই ডিয়ার, মি. পেট আমাকে এবং অ্যাবোলিকে নিমন্ত্রণ করার মাধ্যমে কিছুটা প্রতিদান ফিরিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কথা দিচ্ছি, আমরা যতদ্রুত সম্ভব তোমার কাছে ফিরে আসব।”

    জুডিথকে বেশ ভাল করেই জানে যে কোনো সম্মানিত নারীর এধরনের পুরুষালি আয়োজনে যাওয়া উচিত নয়। জুডিথ বলল, “খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।” এবং এরপর পেটকে শুনিয়ে বলে, “ক্যাপ্টেন কার্টনিকে দ্রুত ছেড়ে দেবেন কিন্তু। কাল ভোরেই আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা। তাই যাত্রার আগে আমাদের অন্তত কিছুটা সময় একান্তে কাটানো দরকার।”

    “আমি বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম। আপনার কথার অন্যথা হবে না,” পেট উত্তর দিল। “তবে ম্যাডাম, ক্যাপ্টেন কার্টনি আমাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করে আমার যে উপকার করেছেন সেটুকুর কৃতজ্ঞতা জানানোর সুযোগ আমাকে দিন।”

    হাল দেয়ালের কাছে গিয়ে হুক থেকে তলোয়ার লাগানো বেল্টটা খুলে নিয়ে কোমড়ে পরতে শুরু করল। হালকে অস্ত্র সাথে নিতে দেখে পেট বলল, “এসবের কোনো প্রয়োজন নেই ক্যাপ্টেন। আমার মনে হয় না আমরা মিষ্টি এবং পানীয় খেতে গিয়ে কোনোরকম বিপদের সম্মুখীন হব।”

    “আমি রাতের বেলা একটা বিদেশি শহরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, স্যার। কে জানে কখন কী ঘটতে পারে?” হাল উত্তর দেয়।

    পেট অদ্ভুত দৃষ্টিতে হাল-এর দিকে তাকায় এবং কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে। “আপনার যেমন ইচ্ছে, ক্যাপ্টেন। আমার সাথে আসুন।”

    পেট হাল আর অ্যাবোলিকে সাথে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা বেশ কয়েকটা রাস্তার বাঁক ঘুরে একটা সরু রাস্তা দিয়ে এগুতে থাকে। অবশেষে তারা একটা কফি শপ-এ আসে যার ভেতর এবং বাইরে টেবিল পাতা আছে। কফিশপ-এর বাইরের একটা টেবিলে পেট তাদেরকে নিয়ে বসল। জাঞ্জিবার এর লোকেরা চারপাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

    পেট প্রথমে কথা বলতে শুরু করে, “কনসাল গ্রে আমাকে জানিয়েছেন যে এটা বেশ ভাল কফি শপ। বেশ ভাল খাবার-দাবার পাওয়া যায়। যে কেউ নির্ভয়ে এখানে খেতে পারে। এছাড়াও এটার দোকানীটা একটা দুটো ইংরেজি শব্দ বলতে পারে। যেটা আমার জন্য খুবই সহায়ক হবে।”

    “চিন্তা করবেন না। যদিও আমি ওদের ভাষা তেমন জানি না। কিন্তু আমি মোটামুটি বুঝতে পারব,” হাল তাকে আশ্বস্ত করে। আর তখনই তার মনে পড়ে যে অ্যাবোলি খুব ভাল অ্যারাবিক বলতে পারে। কিন্তু সেই কথাটা সে চেপে গিয়ে অ্যাবোলির দিকে তাকায়-ওকে দেখে মনে হচ্ছে, সেও একই কথাই ভাবছে। হাল আবার বলল, “মি. গ্রে’র মতো একজন লোকের অনুগ্রহে আপনাকে পাঠিয়েছি বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”

    “আপনি যদি তার দাস ব্যবসার কথা বলে থাকেন তবে আমি বলব যে দাস ব্যবসার অর্থ হচ্ছে, সরাসরি খোদার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া, যিনি আমাদেরকে তার নিজের আমেজে তৈরি করেছেন।”

    হাল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “দাস ব্যবসাকে ঘৃণা করলেও দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ওর সাথে যোগাযোগ রাখা ছাড়া আমাদের ইংরেজদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। কারণ এই জায়গার রাষ্ট্রদূত সে। কিন্তু এখন আমাকে বলুন হলি গ্রেইল সম্পর্কে সে কী খবর দিয়েছে?”

    “আমি আপনাকে সব বলব,” পেট দাঁড়াতে দাঁড়াতে জবাব দেয়। কিন্তু প্রথমে আমাকে কিছু খাবার অর্ডার করার অনুমতি দিন। অ্যালকোহল যদিও ইসলাম ধর্মে নিষিদ্ধ, কিন্তু মি. গ্রে আমাকে বলে দিয়েছেন যে এখানে কি অর্ডার করলে ভাল হবে। প্লিজ সেই ইংরেজি জানা লোকটাকে আমাকে খুঁজে বের করতে দিন। আমি অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে আসব।”

    “কিন্তু মি. পেট…,” হাল বাধা দিল। কিন্তু সে বাক্য শেষ করার আগেই পেট কফি হাউজের ভেতর হারিয়ে যায়। হাল, হাল ছেড়ে দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল।

    “আমাদের চলে যাওয়া উচিত, গান্ডওয়েন,” অ্যাবোলি বলল। “আমি এই লোকটাকে বিশ্বাস করি না।”

    “তুমি হয়ত ঠিকই বলেছ।” কিন্তু আমরা এখন চলে যেতে পারি না। হাল বলতে লাগল, “এত আতিথেয়তা অস্বীকার করে আমরা যদি চলে যাই তাহলে হয়তো ব্যাপারটা মি. পেট স্বাভাবিকভাবে নিবেনা। সে ধরনের মানুষ সে নয়। তাই আমাদের ধৈর্য ধরে এখানে অপেক্ষা করতে হবে।”

    কিছু সময় পরে মি. পেট সাদা আলখাল্লা পরা, মাথায় টুপি পরা দাড়িসহ একজন অ্যারাবিয়ান লোককে সাথে নিয়ে হাজির হলো। অ্যারাবিয়ান লোকটি কিছুক্ষণ আগে ঘেউ ঘেউ করে তার একজন চাকরকে বকাবকি করছিল। “ইনি হাচ্ছেন মি, আজার, এই দোকানের মালিক,” পেট ব্যাখ্যা করল। “যখন আমি তাকে বললাম যে আমার অতিথি এক মহান ইংলিশ নাবিক তখন সে আপনাদের সম্মান জানাতে উঠে এসেছে।”

    হাল উঠে দাঁড়িয়ে মি. আজার-এর সাথে পরিচিত হলো। চাকরগুলো একটা টেবিল টেনে এনে ওদের টেবিলের ঠিক নাক বরাবর রাখল। টেবিলটাতে বিভিন্ন রকম খাবার রাখা আছে-কফির কাপ, বিভিন্ন রকম চা, মিষ্টি এবং পেস্ট্রি। চাকরগুলো হাল, পেট এবং অ্যাবোলির সামনে একটা করে হুক্কার পাইপ রাখল।

    পেট দেখতে পায় হাল বেশ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নকশা করা পিতলের জিনিসটার দিকে তাকিয়ে আছে। একটা লম্বা পাইপ পেতলের জিনিসটা থেকে বেরিয়ে আছে।

    “আপনি কী এর আগে হুক্কাহ দেখেন নি?” পেট জিজ্ঞেস করে। কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই সে আবার বলতে শুরু করে, “এটা দিয়ে ধূমপান করা হয়। আমি ইন্ডিয়ায় এটা প্রথম দেখেছি। বেশ মজার একটা জিনিস…”

    “আমার বাবা সবসময় ধূমপান বিরোধী ছিলেন।” হাল বলতে শুরু করে। “আমার বাবা মনে করতেন ধোয়া দিয়ে ফুসফুস ভর্তি করলে তা কোনোরকম উপকার বয়ে আনতে পারে না। এরচেয়ে বরং সমুদ্রের বাতাস দিয়ে ফুসফুস ভর্তি করা ভাল।”

    “আমি জানি আপনার বাবা খুব ভাল মানুষ ছিলেন ক্যাপ্টেন কার্টনি। কিন্তু তিনি এখন নেই। তাই সমস্ত সিদ্ধান্ত আপনার দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই নিতে হবে। এছাড়া এই যন্ত্রটির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী করে বানানো বিশেষ ধরনের তামাক সেবন করা। এছাড়া বিভিন্ন রকম স্বাদ এবং গন্ধ এর সাথে মেশানো আছে। মি. আজার এর সাথে পুদিনা পাতা এবং লেবুর খোসার মিশ্রণ মিশিয়েছেন। ধোয়াটা একটা পানির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এরফলে ক্ষতিকর পদার্থ দূরীভূত হয়। তাই আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এটার ধোয়া কোনো রকম ক্ষতি করবে না।”

    “আমি একবার স্যার ফ্রান্সিস-এর সাথে হুক্কার ধোয়া টেনেছিলাম। অ্যাবোলি বলল। ওটা বেশ ভালই ছিল।”

    “তাহলে সে আমার কাছে অস্বীকার করেছিল কেন?” হাল জিজ্ঞেস করল।

    অ্যাবোলি হেসে বলে, “গান্ডওয়েন তুমি দেখবে খুব কম সময়ই মানুষ নিজে যা করে তা তার ছেলের কাছে প্রকাশ করে।”

    “আমি একটা প্রস্তাব দেই,” পেট বলল। “আপনারা দুজন যদি আমার সাথে পাইপ টানায় যোগ দেন তাহলে আমি যা জানি সেটার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে বলব…” সে এদিক সেদিকে তাকিয়ে দেখে যে কেউ তাদের কথা শুনছে কি-না। “গ্রেইল-এর বর্তমান অবস্থা।”

    হাল তার মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “আমি এখনো আমার বাবার কাছে দেয়া কথায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যখন আমি সেটা থেকে মুক্ত হতে পারব তখন আমি আপনার সাথে যোগ দেব। সেদিন আসার আগ পর্যন্ত অ্যাবোলি আপনাকে সঙ্গ দিবে…”

    “অবশ্যই…তাহলে বলি,” শুনুন। “আপনারা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে গতকাল মার্কেটের সামনে অন্ধ ভবিষ্যদ্বক্তাটা কী বলছিল? আমার ধারণা সে আসলে ওমানের রাজা জেনারেল আহমেদ এল গ্রেং-এর অনুসারীদের কথা বলছিল, যারা আবারো হলি গ্রেইল আত্মসাৎ করেছে। আপনি এল গ্রেং-এর নাম শুনেছেন?”

    “আমি ভাল করেই জানি এই এল গ্রেং-কে ছিল। আমি তার সাথে যুদ্ধও করেছি,” হাল বলল।

    “ও আচ্ছা… আর সেই দিন ভবিষ্যদ্বক্তা অন্ধ লোকটি বলছিল যে এই ঘটনা পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিবে। হলি গ্রেইল-এর চোর আমাদেরকে অন্ধকারে পতিত করবে।”

    হাল একটা বিস্ময়সূচক অভিব্যক্তি দিয়ে বলে, “হুম… আমার মনে হয় না অন্ধ লোকটির ভবিষ্যদ্বাণী কোনো গুরুত্ব বহন করে।”

    “গ্রে-ও তাই মনে করে, পেট উত্তর দেয়। “সে জানতে খুবই আগ্রহী ছিল যে সেই অন্ধ লোকটির কথায় আদৌ কিছু ছিল কি-না। আপনারা জানেন যে বিভিন্ন লোকজনের সাথে মি, গ্রে-র বেশ ভাল যোগাযোগ আছে। আমি আগেই বলেছি আমি সেখানে থাকাকালীন সময়েই সে বেশ কিছু খবর পায়। মি. গ্রে সেই লোকটির সাথে আরবিতে কথা বলছিলেন। কিন্তু লোকটির সাথে কথা বলার সময় তার চেহারা গম্ভীর হতে থাকে।” এরপর লোকটি চলে যাওয়ার পর তিনি আমার দিকে ফিরে বলেন, “আমি যা ভয় পেয়েছিলাম, সেটা সত্য।” “ক্রিশ্চিয়ানদের সেই মূল্যবান গুপ্তধন যেটার জন্য ক্যাপ্টেন কার্টনি এবং জেনারেল নাজেত প্রাণপ্রণে সাহসের সাথে যুদ্ধ করেছেন, সেটা পুনরায় এল গ্রেং-এর হাতে গিয়ে পড়েছে।”

    “সে কী আপনাকে আরো কিছু বলেছে?” হাল ভ্রূ কুঁচকে বলল।

    “হ্যাঁ বলেছে… সে বলেছে যে সেই ইথিওপিয়ান বালক রাজা অথবা তাকে যে বিশপটা উপদেশ দেয় সে বলেছে…”

    “ফেসিলাইডস।”

    “হ”, “ফেসিলাইডস-ই তার নাম”… “সেই ফেসিলাইস গুপ্তচর পাঠিয়েছে জেনারেল নাজেকে খুঁজে বের করার জন্য।”

    হাল চোখ বড় বড় করে বলে, “আপনি কী তাকে কিছু বলেছেন? জেনারেল নাজেত এখানে আছে-আপনি কী তাকে একথা বলে দিয়েছেন?”

    “মাই ডিয়ার ক্যাপ্টেন কার্টনি। আমি আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে পারি আপনারা সেখানে উপস্থিত থাকার সময় যতটা বিচক্ষণ ছিলাম আপনারা চলে আসার পরও ঠিক ততটাই ছিলাম। কিন্তু আপনি যখন আমার বিচক্ষণতা এবং বিশ্বস্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তখন ব্যাপারটা আমার মনে দাগ কেটেছে। আমার বিশ্বস্ততার কারণেই কোম্পানির পরিচালকরা খুবই সংবেদনশীল ব্যাপারে আমার ওপর ভরসা রেখেছেন, আর…”

    “আমি ক্ষমাপ্রার্থী মি. পেট। একজন স্বামী হিসেবে স্ত্রীকে নিয়ে আমারও চিন্তা হয়। আমি কথাগুলো আপনাকে অপমান করার জন্য বলিনি। কিন্তু তারপরেও যদি আপনি সেরকম ভেবে থাকেন…”।

    “না, না, আমি সেরকম কিছু ভাবছি না।” পেট ভ্রুকুটি করে বলে। “মি. অ্যাবোলি। আপনাকে এমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে কেন?”

    হাল খুব দ্রুত অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে বলল, “অ্যাবোলি, আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

    অ্যামোডোডা যযাদ্ধার চেহারা রক্তশূন্য হয়ে গিয়েছে। তার চোখ দৃষ্টিশূন্য, মুখে কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। তার নিজের ভাষায় বনের লোকদের সাথে যেভাবে কথা বলে এখন সে ঠিক ওভাবেই কথা বলছে। হালকে ছোটবেলা থেকেই সে এই ভাষা প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তবে ওর কথাগুলোর সারমর্ম বুঝতে পেরেছে হাল।

    “তার অবস্থা ভাল নয়।” কিছু একটা তাকে এরকম অসুস্থ করে দিয়েছে। মি. পেট, আমি এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, “আপনার এই উপকারী ধোঁয়া, যেটা আপনি তাকে নিতে বাধ্য করেছেন, সেটাই তার এই অবস্থা করেছে, হাল খুব ক্রুদ্ধস্বরে কথাগুলো বলে উঠল।

    পেট একটা দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে। “সেটা হতে পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সবাইকে সমান করে তৈরি করলেও আমরা সবাই কিন্তু সমান নই। আমি অনেক ইন্ডিয়ান এবং অ্যারাবিয়ানদের দেখেছি কোনোরকম প্রতিক্রিয়া ছাড়াই এই হুক্কা সেবন করতে।” “পার্সিয়ানরাও এটার উপাদানে অভ্যস্ত। কিন্তু সম্ভবত আফ্রিকানরা এটার উপাদানে অভ্যস্ত নয়। তাছাড়া এমনও হতে পারে যে হয়ত এখানকার বাতাস ওর সহ্য হয়নি, বা সে এমন কিছু খেয়েছিল যাতে তার এই অবস্থা হয়েছে।”

    “সে যাই হোক, সেটা নিয়ে আমি এখানে বিতর্কে জড়াতে চাই না। আমি দ্রুত তাকে নিয়ে আমাদের জায়গায় ফিরে যেতে চাই। তার সঠিক যত্ন প্রয়োজন। ওষুধের দোকানীটা হয়ত তার জন্য কোনো ঔষধী গাছ অথবা মিশ্রণ খুঁজে দিতে পারবে।”

    “সেটাই ভাল হবে,” পেট বলল, “আমি আপনাকে সাহায্য করছি।”

    সে এবং হাল উঠে দাঁড়ায়। অ্যাবোলির দুপাশ দিয়ে দুজনে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। মনে হচ্ছিল লম্বা কোনো গাছ ঝড়ের বাতাসে হেলে পড়ে যাচ্ছে। “উঠুন, মি. অ্যাবোলি,” পেট অ্যাবোলির বাহু নিজের কাঁধের ওপর ফেলে তাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করে। হালও অপর পাশ থেকে অ্যাবোলিকে ধরে রাখে। “আমরা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেব। আমাদের খাবারের মূল্য নিয়ে আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। আপনাদেরকে পৌঁছে দিয়েই হিসাব চুকানোর জন্য আমি আবার এখানে ফেরত আসব।”

    .

    ওহ আমি আমার হিসাব তো চুকাবোই-এতে কোনো ভুল নেই, পেট মনে মনে চিন্তা করতে লাগল। তারা তিনজনে কফি শপ পার হয়ে সরু রাস্তা দিয়ে দোকানীর বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।

    যেতে যেতে মি. পেট মনে মনে হাসতে লাগল। বৃদ্ধ ব্লাসফেমার মি. গ্রে ঠিকই ধারণা করেছিল। হুক্কার ধোঁয়ায় মেশানো হাসিস এবং আফিমের মিশ্রণ বেশ ভালভাবেই কাজ করেছে।

    সরু রাস্তা পার হয়ে তারা আরও একটি সরু গলির প্রবেশমুখে এসে দাঁড়াল। এদিক দিয়ে নিচে যেতে হবে। হাল এবং অ্যাবোলিকে দুটি উঁচু দেয়ালের মাঝপথ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার পায়তারা করছিল পেট।”

    “আপনি নিশ্চিত এই পথ দিয়ে?” হাল জিজ্ঞেস করে। অ্যাবোলির ভারী শরীর বয়ে আনতে আনতে হাঁপিয়ে পড়েছিল হাল।

    “অবশ্যই,” পেটও জবাব দেয়। সেও হাঁপাতে হাঁপাতে এমনভাবে কথা বলছিল যেন আর একটি কথা বলার শক্তিও তার নেই। যদিও তার সমস্ত মনোযোগ ছিল ভেতর মুখী। এখন সে তার মাথার ভেতর আরও স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছে সেই কণ্ঠস্বর, যেমনটা শুনেছিল কয়েক সপ্তাহ আগে। “নাও! ডু ইট নাও!”

    এটাই উপযুক্ত সময় এবং স্থান যেখানে ওপরওয়ালা হেনরি কার্টনিকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। “তুমি দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেছো, এখন অপেক্ষার পালা শেষ হয়েছে। দ্রুত কাজটা সেরে ফেল।”

    পেট-এর মনে এবং শরীরে এক ধরনের প্রশান্তির বাতাস বয়ে যাচ্ছিল। সে মনে মনে চিন্তা করছিল এই অপ্রকৃতিস্থ মাতাল আফিসারটি তার জন্য কোনো অসুবিধাই বয়ে আনবে না। তার হাত পকেটে চলে যায় যেখানে সে একটি ধারালো ছুরি লুকিয়ে রেখেছে। এই ছুরিটা মি, আজার তার প্লেটের পাশে রেখেছিল। এখন যেহেতু তার ডান হাত মুক্ত রয়েছে, তাই সে এটা সহজেই ব্যবহার করতে পারবে। হাল যদিও শেষমুহূর্তে তলোয়ার আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কিন্তু সেটা সে কোনো কাজেই লাগাতে পারবে না। কারণ সে ডান বাহু দিয়ে আফ্রিকান লোকটাকে বয়ে চলেছে। আফ্রিকান লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে সে কোনোভাবেই তার তলোয়ার-এর সঠিক ব্যবহার করতে পারবে না।

    পেট শক্তভাবে ছুরিটার হাতল ধরে রাখল। সে তাড়াহুড়ো না করে আস্তে আস্তে এগোতে থাকে। ছুরিটা পকেট থেকে বের করে হাতটা শরীরের পাশে ঝুলিয়ে রাখল সে। তারা গলিটার প্রায় অর্ধেকটা পার হয়ে গিয়েছে। এখন যে কোনো দিকে পালিয়ে যেতে হলে সমান দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। এটাই সঠিক সময় কাজ সারার।

    “ডু ইট!” অদৃশ্য কণ্ঠটি পেটকে আদেশ দেয়।

    এবং উইলিয়াম পেট এত দ্রুততার সাথে আঘাত করে যাতে তার ভিকটিম কোনোভাবেই বুঝতে না পারে। অ্যাবোলিকে পাশ কাটিয়ে তার হাতটা সোজা কার্টনির বরারব নিয়ে আসে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রতিবোধহীন হেনরীকে আঘাত করে।

    .

    “চোখের দিকে তাকাও, গান্ডওয়েন!” অ্যাবোলি সবসময় তাকে শিক্ষা দিয়েছে। তুমি যদি ব্লেড-এর দিকে তাকাও তাহলে তুমি অনেক দেরিতে প্রতিরক্ষা করতে পারবে। ব্লেড বলে দিবে প্রতিপক্ষ এখন কী করছে। কিন্তু চোখ বলে দেবে যে এরপর সে কী করবে।

    ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, বছরের পর বছর অ্যাবোলি তাকে এই শিক্ষা দিয়েছে-যতদিন পর্যন্ত না এটা তার স্বাভাবিক প্রকৃতিতে পরিণত হয়েছে। তাই কোন পরিস্থিতে তাকে কী করতে হবে এটা তাকে আর চিন্তা করে বের করতে হয় না। কারণ এখন এটা তার অভ্যাস-এ পরিণত হয়েছে।

    সেই স্বাভাবিক নিয়মেই হাল পেট-এর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল-অনেক আগে থেকেই। যখন থেকে দোকান মালিকের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে তাদের টেবিলে এত খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল, যখন থেকে হুক্কার সুবিধার কথা বলে ওটা টানতে পেট তাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছিল, কিংবা যখন থেকে অ্যাবোলি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল-তখন থেকেই সে পেটের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তার মন বোঝার চেষ্টা করছিল।

    আর এইভাবেই হাল গ্রে-এর সাথে কথাবার্তা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং তার মনে জেগে উঠা সন্দেহকে যাচাই করছিল। সে মনে করেছিল গ্রে হয়তো ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুনজর পাওয়ার আশায় পেটকে দেশে পাঠানোর ব্যাপারে আগ্রহী হবে। কিন্তু হঠাৎ করেই এই মুসলিম দাস ব্যবসায়ী লোকটির পেটের মতো একজন পাগলাটে লোকের সাথে এত বেশি বন্ধুত্ব দেখানোর ব্যাপারটা তার কাছে মোটেও স্বাভাবিক মনে হয়নি।

    এর একটাই অর্থ হতে পারে-গ্রে এবং পেটকে দেখতে যতটা সহজ-সরল মনে হয় আসলে তারা তা নয়। হাল-এর মনে ভয় কাজ করছিল যে সে নিশ্চয়ই গ্রে-কে চিনতে বড় কোনো ভুল করেছে। গ্রে নিশ্চয়ই গোল্ডেন বাউকে বড় কোনো সমস্যায় ফেলতে যাচ্ছে। সেই অনুমান এখন বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। গ্রে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য মরিয়া হয়ে আছে।

    যেদিন হাল ঘুম থেকে উঠে পেটকে বিছানার পাশে দেখতে পেয়েছিল সেদিনই তার মনে হয়েছিল যে পেট কিছু একটা নিয়ে ফন্দি আঁটছে। সে নিশ্চয়ই ট্রোম্পকে কোনো কারণে যুদ্ধ করার জন্য বাধ্য করতে চাচ্ছিল। এরপর বন্দুক যুদ্ধের সময় ইচ্ছে করেই চুপচাপ থাকা, ট্রোম্প গুলি করার পর আস্তে ধীরে নিশানা ঠিক করে গুলি করা, এবং সেই গুলি যখন ট্রাম্পকে হত্যা করতে ব্যর্থ হয় তখন তার ক্রুদ্ধ মুখভঙ্গি, এগুলো মোটেও কোনো শান্তিপ্রিয় ব্যবসায়ীর বৈশিষ্ট্য নয়। এগুলো একজন খুনির বৈশিষ্ট্য।

    আর তারপর এখন পেট হালকে অন্ধকার জায়গায় নিয়ে এসেছে। কোনো ভাল লোকই আলোকিত স্থান ছেড়ে অন্ধকারকে বেছে নেয় না।

    হঠাৎ হাল-এর খেয়াল হলো যে তার ডান হাত এবং তলোয়ার-এর মাঝে অ্যাবালির দেহ আছে। সে বুঝতে পারল যে পেট কতটা সতর্কতার সাথে তার অবস্থানে দাঁড়িয়েছে, সেই সাথে হাত মুক্ত রেখেছে। কিন্তু পেট-এর হাতে কোনো তলোয়ার নেই। নিশ্চয়ই তার কাছে কোনো লুকানো অস্ত্র আছে।

    যতই তারা গলির ভেতর দিয়ে এগুতে লাগল অন্ধকার ততই বাড়ছিল। আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছিনা, হাল মনে মনে ভাবল। আর যদি আমি দেখতে না পাই…

    হঠাৎ তাদের উপরের দিকে কোথাও একটা শাটার খোলার শব্দ হলো। লাইটের আলোতে দেখা গেল, জানালা দিয়ে দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা ফেলা হচ্ছে। হাল সাথে-সাথে পেট-এর দিকে তাকাল। তীব্র আলোর ঝলকানিতে পেট-এর চোখ দেখতে পেল সে।

    আর এরপরেই…সে দেখল।

    সাথে-সাথেই প্রতিক্রিয়া দেখাল হাল-একজন প্রকৃত বুদ্ধিমান যোদ্ধার মতই। সে অ্যাবোলিকে ধাক্কা দিয়ে পেটের দিকে ঠেলে দিল। ধাক্কা খেয়ে পেট ডানে সরে গেল, ফলে ওর আঘাতটাও হাল-এর শরীর স্পর্শ করতে পারেনি। এরপর হাল অ্যাবোলির গোড়ালিতে এমনভাবে আঘাত করল যেন অ্যাবোলি হোঁচট খেয়ে পেটকে নিয়ে নিচে পড়ে যায়।

    ভয় পেয়ে গেল হাল। সে হয়ত তার প্রিয় বন্ধুকে শত্রুর তলোয়ার-এর ওপরেই নিক্ষেপ করেছে। কিন্তু তখনই সে অন্ধকারের মধ্যেও দেখতে পায় যে পেট-এর হাত অ্যাবোলির শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে। ওর তলোয়ার এখন তার আওতার বাইরে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। এরপর সে পেট-এর হাতে আঘাত করে ওকে একেবারে পঙ্গু করে দিল। তখনই হাল পরিষ্কার উচ্চারণে সেই বন্য ভাষা শুনতে পায়, “ওকে হত্যা কর গান্ডওয়েন।”

    পেট একেবারেই প্রতিরোধহীন হয়ে পড়েছে। এরকম মুহূর্তে প্রতিপক্ষকে সম্মান প্রদর্শন করা যেতে পারে অথবা ক্ষমা করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু উইলিয়াম পেট এ দুটোর কোনোটাই পাওয়ার যোগ্য না। আর তাই, হাল একটানে তার নেপচুন তলোয়ারটা খাপ থেকে বের করে আনলো।

    না দেখেও পেট-এর অভিব্যক্তিহীন চোখগুলো অনুভব করতে পারছিল হাল। সেই চোখে ভয়ের কোনো ছিটে ফোঁটাও ছিল না। শুধু ছিল অনুভূতিহীন ঘৃণ্য দৃষ্টি। “তুমি নরকে যাবে, হেনরি কার্টনি! সেই সাথে তোমার বংশধররাও!”

    হাল দুইহাতে তলোয়ারটা উঁচিয়ে ধরে সোজা নিচের দিকে তাক করে। এরপর শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিচের দিকে আঘাত করে পেট-এর গলায় ঢুকিয়ে দেয়। গলার পেছনদিকে দুই ভার্টিব্রার মধ্যবর্তী জয়েন্ট তলোয়ার-এর অগ্রভাগ দিয়ে আলাদা করে দিল সে।

    হাল চারদিকে তাকায়। গলিটা মরুভূমির মতোই নীরব অন্ধকার। সকালের সূর্য উঠার আগে কেউ এখান থেকে কিছু দেখতেও পাবে না বা শুনতেও পাবে না। তাদের উপরের দিক থেকে যে জানালা খোলার শব্দ হয়েছিল সেটাও ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অ্যাবোলি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সাহায্য ছাড়া সে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না। কিন্তু নষ্ট করার মতো সময় হাল-এর হাতে নেই। সে অ্যাবোলির দিকে তাকিয়ে বলে উঠে, “জুডিথ।” তারপর অন্ধকার গলি ধরে দ্রুত দৌড়াতে শুরু করে।

    *

    “উঠে পড়ন, মাই লেডী, আপনাকে উঠতেই হবে,” জুডিথ জেগে উঠে দেখতে পায় মসি তাকে অনুনয়-এর সুরে আস্তে আস্তে S ডাকছে। তার গলার স্বরে ভয় উপচে পড়ছে। আমি ভয় পাচ্ছি। জিনটা আসছে। এখন আমরা কী করব?”

    জুডিথ ঘুমের ঘোরে চোখ মিট মিট করতে থাকে। একমুহূর্তের জন্য তার মনে হয় ছেলেটি হয়ত দুঃস্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছে। পৃথিবীতে জিন বা প্রেতাত্মা বলে কিছু নেই। এ কারণে তার বুঝতে একটু ভুল হয়েছিল। তাই দরজাটা যখন লাথি মেরে ধাক্কা দিয়ে খোলা হয় তখনও সে বিছানায় শুয়ে ছিল। এখনও সে চাইলে ঘুরে বালিশের নিচ থেকে কাসকারা তলোয়ারটা হাতে নিতে পারে। কিন্তু কম্বলটা এখনো তার গায়ের ওপরেই আছে। একটানে কাসকারা হাতে নিয়ে যখনই সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল তখনই পাঁচজন লোক ঘরের ভেতর প্রবেশ করে জুডিথ-এর দিকে তলোয়ার তাক করল।

    এরপর আরও একজন প্রবেশ করে। তার দিকে তাকিয়ে জুডিথ মসির ভায়ের কারণ বুঝতে পারে। লোকটির মুখে অদ্ভুত রকমের চামড়ার মুখোশ পরানো আছে, চাঁদের আলোতে যেটাকে ভয়াবহই মনে হচ্ছে। মসি এটা দেখেই শয়তান ভেবে ভুল করেছে। : আরও একটা চিন্তা তার মাথায় উদয় হলো। মসি কোথায়? সে কোথায় গেছে? তবে এটা ভেবেই জুডিথ একটু নিশ্চিন্ত হলো যে এই আগমনকারীরা কেউই মসির অস্তিত্ব সম্পর্কে জানে না।

    কোনো মরিচা ধরা তলোয়ার তার খাপ থেকে বের করার সময় যেমনটা বিশ্রী, খসখসে শব্দ হয়, অনেকটা সেরকম কণ্ঠে মুখোশ পরা লোকটা কথা বলে উঠল, “যুদ্ধ করার কোনোরকম চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনি এবং আপনার পেটের ভেতর বেড়ে ওঠা সন্তান দুজনেই মারা যাবেন।”

    জুডিথ জানে লোকটি ঠিকই বলেছে। সে একজন পুরুষের মতো করে যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার মনের গভীরে লুকোনো কোনো সত্তা তাকে মনে করিয়ে দিল যে একজন নারী যেভাবে প্রতিরোধ করে তাকেও এখন সেভাবেই প্রতিরোধ করতে হবে। আর সেটা যুদ্ধ করে নয়, সহ্য করে। একজন পুরুষকে শুধু তার নিজেকে নিয়ে ভাবলেই হয়। কিন্তু একজন মাকে তার নিজের চেয়ে তার সন্তানের কথা বেশি ভাবতে হয়।

    সে তরবারিটা রেখে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে আসে। সে শুধু লিলেন এর পাতলা একটা নাইটগাউন পরে আছে। তাই সে জিজ্ঞেস করে, “আমি কী আমার গাউনটা পরে নিতে পারি?”

    “না, ম্যাম। আপনি তা পারেন না,” মুখোশ পরা লোকটি মাথাটা নাড়িয়ে এমনভাবে জুডিথ-এর দিকে তাকাল যেন সে তার একচোখ দিয়ে জুডিথকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। এই লোকটির ক্ষুধার্ত চোখ থেকে বাঁচার জন্য জুডিথ তার যুদ্ধের বর্মটাকে খুব অনুভব করতে লাগল। নিজেকে এখন খুব নরম ও দুর্বল মনে হচ্ছিল ওর। যে নারী এতদিন পুরুষের সাথে তাল মিলিয়ে যুদ্ধ করতে পারতো, অজস্র উপায়ে শত্রুকে হত্যা করতে পারতো, সেই তারই কি-না এখন আকুল নয়নে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে।

    না, আমি কোনোভাবেই এই লোকটিকে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিতে দেব না! জুডিথ চিন্তা করল এবং নিজেকে খুব জোরালোভাবে তাগিদ দিল সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সরাসরি ওই ঈর্ষাপরায়ণ লোকটির দিকে তাকানোর।

    “আপনি কী আমাকে চিনতে পেরেছেন?” কণ্ঠটি জিজ্ঞেস করল। “ওহ, কীভাবে আপনি চিনবেন? আমি তো মৃত। আপনি আমাকে মারা যেতে দেখেছেন।”

    জুডিথের স্মৃতি যুদ্ধের ময়দানে ফিরে গেল। সে সাগরের প্রান্তরে যুদ্ধের ছবি মনে করতে লাগল এবং একজন মানুষকে তার জাহাজসহ আগনে পুড়ে ডুবে যেতে দেখল। না, এটা কী করে সম্ভব! কিন্তু এছাড়া..?

    “বুজার্ড, সে তার কণ্ঠটাকে যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বলার চেষ্টা করল। কিছুতেই তার বিস্ময় এই লোকটার কাছে প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে সেটা হয়ত তার আরেকটা বিজয় হবে তা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন।

    “হ্যাঁ, আমি বেঁচে আছি…এটাকে যদি বেঁচে থাকা বলে তাহলে আমি বেঁচে আছি। আপনার বাস্টার্ড স্বামী যেভাবে আমাকে বেঁচে থাকতে বাধ্য করেছে। আমি সেভাবেই বেঁচে আছি। ওহ আমি সেটার প্রতিশোধ তার নারীর ওপর দিয়ে নিতে চাচ্ছিনা। তার ওপর প্রতিশোধ নেয়ার আরও অনেক রাস্তা আছে। কিন্তু আরো একজন আছে যে আপনার সাক্ষাৎ পেতে চায়। আপনি আপনার গাউন পরে নিন। আপনার তৈরি হওয়া শেষ হলে আমার সঙ্গে আসুন।”

    বুজার্ড-একজন সম্ভ্রান্ত নারীকে সম্মান প্রদর্শনের মতো করে মাথা নিচু করে। বলল, “আপনার বাহন তৈরি, মাই লেডি…”

    সে চলে গিয়েছে। কামরা খালি পড়ে আছে। বোকামির জন্য হাল নিজেকে অভিশাপ দিতে লাগল। হঠাৎ সে ঘর থেকে এক ধরনের শব্দ শুনতে পেল। শব্দটা একটা বাচ্চার কান্নার শব্দ যেটা খাটের নিচ থেকে আসছে। হাল মেঝে পর্যন্ত নেমে আসা বিছানার চাদরটা উঠিয়ে দেখে সেখানে গুটিসুটি মেরে মসি বসে আছে।

    হাল তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে নরম সুরে বলল, “ভয় পেয়ো না। তুমি এখন নিরাপদ। বের হয়ে এসো।”

    ছেলেটি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হাল আবার চেষ্টা করে। কিন্তু কোনো লাভ হয় না। তাই সে এবার ভিন্ন পথ ধরে বলল, “তুমি কী আমাকে সাহায্য করবে, মসি? আমাকে বলবে এখানে কী ঘটেছিল? জুডিথকে কারা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে? তুমি যদি আমাকে সাহায্য কর তবে আমি অতি দ্রুত জুডিথকে খুঁজে বের করতে পারব।”।

    হাল-এর এই পন্থায় কাজ হয়। মসি নিচ থেকে বের হয়ে আসে এবং আস্তে আস্তে কথা বলতে শুরু করে। যদিও হাল প্রথমে জুডিথ-এর মতোই মসির কথা বুঝতে পারে না। জিন কী জিনিস বা কোথা থেকে এসেছে কিছুই বুঝতে পারে না। কিন্তু মসির পরের কথাগুলো এরকম ছিল : “জিনটা কথাও বলতে পারে! দানবটা আমার ম্যাডাম-এর সাথে কথা বলেছে এবং আমার মনে হয় ম্যাডাম ওকে চেনে। উনি তার নামও উচ্চারণ করেছেন। বোজুরড।”

    হাল ভ্রু কুঁচকে মনে করার চেষ্টা করল। কিন্তু মসির কথা বুঝতে পারছিল না সে। তাই ছেলেটা আবারো একই নাম বলল, “বজরড! বজরঙ!”

    এবার হাল তা শুনতে পায়। মসির কথা শুনে অবিশ্বাস্যভাবে সে আঁতকে উঠে। মৃত শত্রুর কথা মনে পড়ে যায় তার। সে মসিকে জিজ্ঞেস করে, “সে কী বুজার্ড বলেছিল?”

    ছেলেটি উপরে নিচে কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে বলতে থাকে। “হ্যাঁ, হ্যাঁ! বুজার্ড।”

    কয়েক মুহূর্তের জন্য হাল সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল এবং ভাবতে চেষ্টা করল আসলে কী ঘটতে পারে। গ্রে এবং বুজার্ড দুই বিশ্বাসঘাতক একত্র হয়েছে শুধু ক্যাপ্টেন স্যার হেনরি কার্টনিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে। তারা দুজন সম্ভবত তৃতীয় কোনো পক্ষের সহযোগিতায় জুডিথ এবং তার শেষ দেখতে চায়। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করতে চায়। কিন্তু সে এখনো বেঁচে আছে। এখন কেবল একজনই বলতে পারে জুডিথকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

    “মসি, আমার পিস্তলটা নিয়ে এসো,” সে বলল। সেই সাথে মনে মনে প্রত্যাশা করতে লাগল যেন ওগুলো ঠিক জায়গাতেই পাওয়া যায়।

    “তুমি কী করতে যাচ্ছ?” অ্যাবোলি জিজ্ঞেস করে।

    “আমি মহামান্য রাষ্ট্রদূত-এর সাথে দেখা করতে যাচ্ছি,” সে বলল। “তুমিও আমার সঙ্গে যাচ্ছ। এমনকি জাঞ্জিবার-এ আমাদের যত লোক আছে সবাই যাবে আমার সাথে। আমি আশা করি সে আমাকে সবকিছু খুলে বলবে।”

    “না,” অ্যাবোলি তার মাথা নাড়ায়। এটা সঠিক উপায় নয়। ভেবে দেখ গান্ডওয়েন। রাষ্ট্রদূত-এর বাড়ির চারপাশ গার্ড দিয়ে ঘেরা থাকবে। যখনই সে জানতে পারবে যে তুমি বেঁচে আছ তখনই সে তার দরজা বন্ধ করে দেবে। আমাদেরকে অন্য পন্থায় যুদ্ধ করতে হবে নয়ত শহরের গার্ডেরা হায়েনার মতো রক্তের গন্ধে ছুটে আসবে।”

    হাল রাগে ফেটে পড়ছিল। কিন্তু সে জানে অ্যাবোলি ঠিক বলেছে। এভাবে তাদের গ্রে’র বাড়ির দিকে অগ্রসর হওয়া উচিত নয়। গ্রে হচ্ছে জাঞ্জিবার-এর একজন শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। হাল যদি স্থানীয় ওমানী লোকজনের সাথে যুদ্ধ করতে যায় তাহলে গোল্ডেন বাউকে দুর্গের দেয়ালে রাখা বন্দুকের গুলির সম্মুখীন হতে হবে।

    “তাহলে তুমি কী প্রস্তাব করছ অ্যাবোলি?” সে তার কোমড়ের বেল্ট বেঁধে তার মধ্যে মসির দেয়া পিস্তল দুটি আটকাতে আটকাতে বলে।

    অ্যাবোলি ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমরা কত লোকজন নিয়ে যেতে পারব সেটা এখানে কথা নয়, কথা হচ্ছে, আমরা কত কম লোজন নিয়ে যেতে পারব।”

    “তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছ সম্মুখ যুদ্ধের চেয়ে নীরবে কাজ করলে আমাদের বেশি সুবিধা হবে?”

    “ঠিক তাই”! অ্যাবোলি ঠোঁটজোড়া শক্ত করে জবাব দিল।

    তারা দুজন আরও কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। এরপর তারা মসিকে সাথে নিয়ে জাহাজের সেখানে আসে যেখানে লম্বা নৌকোগুলো লাগানো রয়েছে। সে মসিকে নৌকোর পেছনদিকে চুপচাপ অপেক্ষা করতে বলে। এরপর হাল এবং অ্যাবোলি বাউ-এর বাকি লোকদের বুঝিয়ে বলে যে তারা কী করতে যাচ্ছে। শহরের রাস্তা-ঘাট ফাঁকা হয়ে যাওয়া এবং মানুষজন ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। এরপর হাল আর অ্যাবোলি বাউ-এর আরও দুজন শক্তিশালী যোদ্ধা বিগ ডেনিয়েল ফিশার এবং উইল স্ট্যানলিকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে।

    *

    জুডিথকে যে বাহনে করে জাঞ্জিবার-এর রাস্তা দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল সেটার জানালাগুলো পর্যন্ত বন্ধ ছিল। তাই কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সে ব্যাপারে জুডিথ-এর কোনো ধারণাই নেই। একসময় সে শুনতে পায় দরজা খোলার আদেশ দেয়া হচ্ছে। এরপর বড় একটা দরজা খুলে যায়। ঘোড়ার খুর এবং চাকার শব্দে বোঝা যায় বাহনটা একটা বাঁকানো আর্চওয়ের নিচ দিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় আরেকটা দরজা পার হয়ে থেমে গিয়েছে।

    বাহনটার দরজা খোলার পর মধ্যবয়স্ক একজন লোক দরজার পাশে এসে দাঁড়ায়। তার সমস্ত দাড়ি এবং মাথার চুল পরিষ্কার করে ফেলে দেয়া। অনেকটা মেয়েলি কণ্ঠে সে বলে উঠে, “আমার সাথে আসুন। মহামান্য রাজা আপনার সাথে দেখা করতে সম্মতি জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি আপনাকে ঠিক এই অবস্থায় দেখতে চান না।”

    লোকটা নিশ্চয়ই হিজড়া! ওর কণ্ঠ শুনে মনে মনে চিন্তা করল জুডিথ। এরপর লোকটি তাকে একটি সুসজ্জিত কামরায় নিয়ে যায়। কামরাটির মেঝেতে মার্বেল পাথরের মোজাইক করা ছিল যেগুলো নানান রকমভাবে নকশা করা ছিল। গোলাপ এবং অ্যাম্বার-এর সুগন্ধিতে ঘরটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে। মোমবাতির সোনালি আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়ছে। অর্ধনগ্ন নারীরা অলস ভঙ্গিতে ডিভান-এর ওপর হেলান দিয়ে সময় কাটাচ্ছে। জুডিথ এক চমকেই বুঝতে পারে যে তাকে একটা হারেম-এ নিয়ে আসা হয়েছে।

    লোকটি তাকে কামরার মাঝখানে নিয়ে আসে যেখানে নরম পানির ঝর্নাধারা সমৃদ্ধ একটি গোসলখানা রয়েছে, যেটাতে গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাখা হয়েছে। দুজন দাসী তাকে স্বাগত জানানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। “মহামান্য রাজার জন্য একে প্রস্তুত কর,” হিজড়া লোকটি দাসীদের আদেশ করল।

    “আপনার গোসলের সবকিছু প্রস্তুত রাখা হয়েছে, মাই লেডি।” দাসী মেয়েদুটির একজন বলে উঠে। “আমি কী আপনার গাউনটি নিতে পারি?”

    জুডিথ অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে উত্তর দেয়, “না, তোমরা পার না।” কিন্তু যাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই তাদেরকে বাধা দেয়া বা তাদের সাথে যুদ্ধ করাটা বৃথা। তাকে যুদ্ধ করতে হবে সেই লোকটির সাথে যে এদেরকে শাসন করছে। আর সেই লোকটির কাছাকাছি পৌঁছানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে এদের কথা মেনে নিয়ে নিজেকে প্রস্তুত করা। তাই জুডিথ ওদের কথা মেনে নেয়। তাকে গোসল করিয়ে শুকিয়ে শরীরে সুগন্ধি তেল মাখানো হয়। দাসী মেয়েদের একজন তাকে বসতে বলে। তার চোখে স্মোকি কাজল লাগানো হয়। ঠোঁটে লাল রঙ্গা কিছু একটা লাগানো হয়। চুলগুলো সুন্দরভাবে বেঁধে ওখানে নানানরকম মুক্তার গহনা বসানো হয়। মিতসিওয়ায় হাল-এর সাথে দেখা হওয়ার দিন যেগুলো পরেছিল, মুক্তার গহনাগুলো দেখতে অনেকটা সেরকম। দাসীদের একজন তার কানে দুল পরিয়ে দেয়। এরপর তাকে কাপড় পরানোর জন্য উঠে দাঁড়াতে বলে।

    “ওহ্, মাই লেডি আপনি দেখতে অনেক সুন্দর।” জুডিথ যখন উঠে দাঁড়ায় তখন দাসীদের একজন বলে উঠে। “মহামান্য প্রিন্স আপনাকে পেয়ে অনেক অনেক তৃপ্ত হবেন।”

    “এলিনা হিংসায় মরে যাবে”, অন্য মেয়েটি টিপ্পনী কেটে বলে উঠে।

    “আপনি তার নতুন প্রিয়তমা হতে যাচ্ছেন।”

    তাকে কাপড় পরানো হয়। যদি এটাকে কাপড় পরানো বলে তবেই। তাকে ছোট হাতার একটা ব্লাউজ পরানো হয় যেটা জাঞ্জিবার-এর রাস্তায় ইন্ডিয়ান নারীদের শাড়ির নিচে পরতে দেখা যায়। ব্লাউজটা সুতা অথবা সিল্কের তৈরি এবং যেটার ওপর নানান রকম ছোট ছোট পাথর দিয়ে সোনালি রঙের সুতা দিয়ে নকশা করা রয়েছে। এটা কোনোরকমভাবে জুডিথ-এর বুকের অংশটা ঢেকে রেখেছে। এরপর তাকে কোনো শাড়ি পরানো হয় না। তার বদলে তাকে একজোড়া প্যানট্যালুন পরানো হয় যেটা তার কোমড় থেকে গোড়ালি পর্যন্ত নেমে এসেছে। এটাতেও নানাধরনের চকচকে নকশা করা রয়েছে। সবশেষে তাকে সোনালি সুতা দিয়ে কাজ করা একজোড়া তুর্কিস পাদুকা পরানো হয়।

    “আসুন…দেখুন, আপনাকে কতটা সুন্দর লাগছে, প্রথম দাস মেয়েটি জুডিথকে কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা লম্বা আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কথাটা বলল। জুডিথ নিজের প্রতিবিম্ব দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। হাল-এর জন্য নিজেকে নানান সময় নানানরকমভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে সে। কিন্তু তার আজকের রূপটা সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তার নিজেকে অনেকটা নর্তকী কিংবা হারেমের মেয়েদের মতো মনে হচ্ছে। তবে এই সাজেও সে মনে মনে রোমাঞ্চিত বোধ করত যদি এটা হাল-এর জন্য হতো। কিন্তু কোনো অচেনা অদ্ভুত মানুষের জন্য নিজেকে এইভাবে সাজানো অবস্থায় দেখে মনে মনে বিপদের গন্ধটা আঁচ করে ফেলল জুডিথ। ভয় এবং আতঙ্ক ইতিমধ্যে তাকে গ্রাস করা শুরু করে দিয়েছে।

    তার চিন্তায় ছেদ পড়ল-হিজড়াটা আবারও তার ঘরে প্রবেশ করেছে। লোকটি তাকে ভালভাবে দেখে ঠোঁট ভাঁজ করে শুধু একটাই শব্দ করে : “হাহ।” যেন তার এই রূপ দেখে লোকটি খুব অবাক হয়েছে। এরপর বলল, “আসুন আমার সাথে।”

    তাকে পুনরায় একটা সুবৃহৎ কক্ষের মাঝ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। কক্ষের ভেতর থাকা অন্যান্য রমণী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে। হিজড়া লোকটি ওই মেয়েগুলোকে হাত দিয়ে সরিয়ে জুডিথকে জায়গা করে দেয়ার চেষ্টা করছে। এরপর তাকে নিয়ে একটা লম্বা করিডোর পার হয়ে একটা দরজার সামনে আসলো সে। তারা ভেতরে ঢোকার পর দরজাটা আবারও বন্ধ করে দেয়া হলো।

    জুডিথ দেখতে পায় তাকে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট কিন্তু সুসজ্জিত কক্ষে নিয়ে আসা হয়েছে। সেখানে অন্যান্য উপপত্নীদের তাদের মনিবকে আনন্দ দেয়ার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কক্ষটির প্রতিটা জায়গা অমূল্য সোনা, মার্বেল পাথর, অনিক্স, গাঢ় কালো রঙের অবসিডিয়ান এবং চকচকে আয়নায় সাজানো রয়েছে। যখন সে একটা করে আয়নার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছিল, তখন সে দেখতে পাচ্ছিল যে চকচকে পাথরের আলোক রশ্মিগুচ্ছ আয়নায় প্রতিফলিত হচ্ছে। আয়নার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে যে পোশাক পরানো হয়েছে। সেটার পাথরগুলোও চকচক করে উঠছিল।

    হিজড়া লোকটি সোনালি রঙের ডিভান-এ বসে থাকা একটা লোকের সামনে গিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “মহামান্য, প্রিন্স, এই সেই রমণী যাকে আজ সন্ধ্যায় নিয়ে আসা হয়েছে। আশা করি সে আপনার মনের আশা মিটিয়ে দেবে।”

    এটা বলার পর লোকটি জুডিথকে তার মনিবের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে সরে দাঁড়ায়। তার সামনে বসা লোকটি যাকে দাসী মেয়েরা প্রিন্স বলে সম্বোধন করেছিল সে নানারকমের অলংকার খচিত ঝাকজমকপূর্ণ পোশাক পরে আছে। উজ্জ্বল গোলাপি রঙের কোট পরে আছে লোকটা, যেটার সাথে মিলিয়ে ট্রাউজার পরেছে সে। তার পাগড়ির সামনের দিকে বেশ বড় আকারের ডায়মন্ড বসানো আছে। ডায়মন্ডটার পাশ দিয়ে আবার ছোট ছোট পালক আটকানো আছে।

    জুডিথ লক্ষ করে মধ্য ত্রিশে গিয়েও লোকটিকে বেশ হ্যান্ডসামই বলা যায়। পুরুষ হিসেবে তাকে বেশ আকর্ষণীয় বলতে হয়।

    একজন রমণী ডিভানে হেলান দিয়ে লোকটির পাশে বসে ছিল। রমণীটি তার সমস্ত নির্লজ্জতা বিসর্জন দিয়ে লোকটির কানে আলতো করে নিজের ঠোঁট ছোঁয়াছিল সে, সেই সাথে নিজের আঙুলগুলো লোকটির ঊরুর ওপর দিয়ে টেনে আনছিল ক্রমাগত। জুডিথ-এর মনে হলো যে মেয়েটি নিজের কাজকে বেশ উপভোগই করছে।

    জুডিথ ধারণা করেছিল সেখানে হয়ত আরও বডিগার্ড আছে। ঘরের একপাশ থেকে গানের সুর ভেসে আসছে। কিন্তু সেখানে শুধু একজন মানুষই ছিল-বুজার্ড। সে ডিভান-এর পাশে দাঁড়িয়েছিল। তার একমাত্র হাতটি শরীরের পাশে ঝুলানো। তার নড়াচড়ার মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে তা হল : এদিক সেদিক পাখির মতো মাথা দুলানো।

    ‘মাই ডিয়ার জেনারেল নাজেত।” প্রিন্স লোকটি বলে উঠে। জুডিথ আন্দাজ করল যে এটিই সেই এলিনা নামের মেয়েটি যার নাম সেই প্রথম দাসী মেয়েটি উল্লেখ করেছিল। মেয়েটা এখন তার কাজ বাদ দিয়ে ভ্রু কুঁচকে জুডিথ-এর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিন্স লোকটি আবার বলতে শুরু করে। “গত দুই বছর ধরে যদিও আমাদের ভাগ্য একই সূত্রে বাঁধা ছিল কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হচ্ছে, এটাই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ। আমি মহারাজা সাদিক খান জাহান। আপনার পুরনো শত্রু, ওমানী আরব নেতা সুলতান আহমেদ এল গ্রাং আমাকে সেভাবেই শ্রদ্ধা করতো যেভাবে আপনি সেই বাচ্চাটিকে করতেন যে কি-না নিজেকে ইথিওপিয়ার রাজা হিসেবে দাবি করে।” প্রিন্স লোকটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আপনি কী জানেন যে আপনার মতো সুন্দরী রমণী নিজেকে যুদ্ধক্ষেত্রে স্রেফ অপচয় করছে?”

    “না।” জুডিথ বলল, “আমার মতো অভিজ্ঞ যোদ্ধা নিজেকে এই হারেমখানাতেই বরং অপচয় করছে।”

    “প্রিয়তম, আমি কিছু বুঝতে পারছি না, এলিনা নামের মেয়েটি সোজা হয়ে বসে বলে উঠল। তুমি কেন এই নারীটিকে জেনারেল বলছ? আর কেনই বা বলছো যে সে একজন যোদ্ধা।”

    “কারণ সে শুধু সৌন্দর্যে তোমার সমকক্ষই নয়, সে এল গ্রং-এর সমকক্ষ যযাদ্ধাও বটে। তুমি যেভাবে গার্ডদের আদেশ কর তারচেয়ে কঠিনভাবে সে নিজের সৈন্যদের আদেশ করে। তুমি এখন যাও। আমি এই জেনারেল-এর সাথে কথা বলব। আবার যখন প্রয়োজন হবে তখন আবার তোমাকে ডাকব।”

    “এর সাথে বেশি সময় নষ্ট করো না, এলিনা অনুনয়ের স্বরে বলে উঠে। “তোমাকে ছাড়া আমার প্রতিটা মুহূর্তই শূন্য লাগে।” এরপর এলিনা ডিভান থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। যাওয়ার সময় সে জুডিথ এর দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকায় যেটাতে যুদ্ধের স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল।

    প্রিন্স একটা আত্মতৃপ্তির হাসি দিয়ে সামনে ঝুঁকে বসে সরাসরি জুডিথ-এর দিকে তাকাল। আমি একজন সভ্য জগতের মানুষ এবং আমি গর্বিত যে আমি ওপরওয়ালার নীতি অনুযায়ী চলি। কিন্তু আমি স্বীকার করছি যে আমার মধ্যে কিছু অদ্ভুত জিনিস রয়েছে। আপনি যদি জেনারেল সমমর্যাদার কোনো পুরুষ হতেন তবে আমি যুদ্ধক্ষেত্রে আপনার মুখোমুখি হতাম এবং আপনাকে বন্দি করতাম। এরপর আপনাকে আপনার জনগণের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করতাম। আপনার মতো কমান্ডার-এর মুক্তিপণ নিশ্চয়ই কল্পনার চেয়েও বেশি হত। ইথিওপিয়ার মহারাজা নিশ্চয়ই নিজের গুপ্তধন থেকে সেই মুক্তিপণটা মেটাতে চাইত। আর সে যদি সেটা মেটাতে না পারত তাহলে আপনাকে সম্মানের সাথে মৃত্যুবরণ করতে হত।”

    “কিন্তু আপনি কোনো পুরুষ নন এবং সেটাই ব্যাপারটাকে এত জটিল করে তুলেছে। আপনি আপনার জনগণের কাছে এমনকি আমার কাছেও অনেক সম্মানের পাত্রী। এমনকি যে কোনো পুরুষের কাছেই আপনি জাদুকরী মানবী। আপনার মতো যুবতী রমণীর-যাকে ঠিক বালিকাও বলা যায় না-কখনও এরকম বিশাল সৈন্য বাহিনীকে শাসন করা উচিত নয়। সত্যি বলতে, আপনার মতো নারীর অবস্থান সাধারণ মানুষের চেয়েও উর্ধ্বে। আমি জানি যে আপনার জনগণ বিশ্বাস করে আপনি স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোনো এঞ্জেল।”

    “আর তুমি মনে কর আমি নরক থেকে নেমে আসা কোনো অপদেবী, তাই না।” জুডিথ বলে উঠে। “কিন্তু আমি কোনো এঞ্জেলও নই, কোনো অপদেবীও নই। আমি অতি সাধারণ একজন নারী। এখন তুমি কী করতে চাও সেটা বল?”

    প্রিন্স অনেক চিন্তাপূর্ণ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। “আহ, এখন সেটাই প্রশ্ন। আমি অনেক দিন ধরে এই ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করেছি। আমি যদি আপনাকে হাতের কাছে পাই তাহলে আমি কী করব? আমি অনেকবার আমার মনকে পরিবর্তন করেছি। আবারও পরিবর্তন করতে পারি।”

    “এবং…?”

    সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, “তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যান যেটা ছিল সেটা হচ্ছে, আপনাকে কোনো দাস বিক্রেতার কাছে বিক্রি করে দেয়া। কিন্তু আপনার মতো একজনকে এত চড়া দামে কে কিনতে পারে? কিন্তু আপনার হাতে যারা নির্যাতিত হয়েছে তারা কী এতে কোনো আনন্দ পাবে? আর আপনাকে এভাবে ছেড়ে দেয়া কী অনেক বড় অপচয় হবে না? এতে আমি কী কোনো আনন্দ পাব নাকি উপকৃত হব?”

    “এছাড়ও আপনি আকর্ষণীয় সৌন্দর্যের অধিকারী এবং প্রজননশীলও বটে। এসব গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের বিচারে আমি আপনাকে একটা আকর্ষণীয় প্রস্তাব দিতে পারি।”

    আমার ভাই গ্রেট মোগল অথবা কনস্টান্টিনোপাল-এর সুলতান-এর উপপত্নী হিসেবে নিজের জীবন বেছে নিন। যদি তাদেরকে একটা পুত্র সন্তান দিতে পারেন তবে তাদের জন্য সেটা অনেক মূল্যবান কিছু হবে। কিন্তু এরপরেও…” জাহান আপনমনেই বলতে শুরু করে দিল, “কেনই বা আমি ওই দুইজন লোককে সেই সুবিধা নিতে দিব? যতদিন আমি আছি ততদিন আমার উচিত আপনাকে আমার উপপত্নী করে রেখে দেয়া।”

    জুডিথ রাগে লোকটিকে প্রায় থাপ্পড় দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, “তোমার উপপত্নী হওয়ার চেয়ে বরং মরে যাওয়া ভাল। এমনকি তোমার প্রাসাদে তোমার গড-এর আওতায় বড় হওয়ার আগেই আমি আমার সন্তানকে নিজ হাতে খুন করে ফেলব।”

    “হাঁ, আমি সেটাই ভয় পাচ্ছিলাম।” প্রিন্স লোকটি তার মাথা নাড়িয়ে বলে উঠে। এক্ষেত্রে আমি আপনাকে বন্দি খানায় নিয়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত হারেমে রেখে দিতে পারি। কিন্তু এখানেও আপনি একজন শত্রু তৈরি করে ফেলেছেন। সে হচ্ছে এলিনা। সে যেমন মুরগির বাচ্চার মতো কোমল তেমনি বাঘিনীর মতই হিংস্র। এছাড়া আমার অন্যান্য উপপত্নীর কথাও মাথায় রাখতে হবে। তারা যদিও বিভিন্ন জায়গা থেকে উঠে এসেছে কিন্তু তারা সকলেই অনুন্নত পরিবেশ থেকে এসেছে। তারা যে জীবন পেছনে ফেলে এসেছে সে জীবনের তুলনায় এখানে তারা স্বর্গে বসবাস করে। তার বদলে তাদের যেটা করতে হয় তা হলো আমাকে সম্মান ও সন্তুষ্ট করা। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে তারা কখনোই আমার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে যাবেনা। তথাপি আপনি হয়ত তাদের মাথায় এমন সব ধারণা ঢুকিয়ে দিবেন যেটা তাদের মনে ঝড় তুলবে, আমাকে অসম্মান করতে বাধ্য করবে, তাদেরকে বিদ্রোহী করে তুলবেন। ব্যাপারটা আমাকে খুব অসুবিধায় ফেলে দিবে। তখন তাদের সবাইকে খুন করে আমাকে আবার নতুন উপপত্নী আনতে হবে।”

    “আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, আমি তোমার জন্য এধরনের অসুবিধা বয়ে আনব না,” জুডিথ অত্যন্ত দৃঢ় কণ্ঠে বলে উঠে। “কিন্তু এখন বল, তুমি আমাকে নিয়ে যে সম্ভাব্যতার কথাগুলো বলেছে, তার সবই প্রায় উড়িয়ে দিয়েছে। তাহলে তুমি আমাকে নিয়ে কী করতে চাও?”

    “প্রথমত, আপনি আজকের রাতের ডিনারে আমার সংগে যোগ দিবেন। ইথিওপিয়ায় সামরিক অভিযান সম্পর্কে আমি আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রয়োগের জন্য আপনি অগ্রিম কী ধরনের যুদ্ধ কৌশল নিয়েছেন, আপনার সৈন্যবাহিনীকে কীভাবে সাজিয়েছেন সে ব্যাপারে শুনব। তবে আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন যে কোনোরকম অসম্মান আপনার জন্য অপেক্ষা করে নেই। আপনি কী এতে সম্মত আছেন?”

    “তুমি আশা করো না যে, আমি তোমার দেয়া ডিনার উপভোগ করব, প্রিন্স জাহান। কিন্তু হ্যাঁ আমি আলোচনায় অংশ নিব।”

    “আপনি কত মহানুভব, ম্যাডাম। আলোচনা শেষে আপনাকে আপনার কোয়ার্টার-এ নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে আপনি আগামী তিন সপ্তাহ বন্দি থাকবেন। কিন্তু আপনি আপনার পদমর্যাদার জন্য আলাদা কোনো সুবিধা পাবেন না। দুঃখের বিষয় যে আমি আপনাকে দাসদের বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য। তবে ভয় নেই। আপনাকে অন্য কারো কাছে বিক্রি করার কোনোরকম ইচ্ছে আমার নেই।”

    “তাহলে কেন আমাকে বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন? শুধু আমাকে অপমান আর হেয় করার উদ্দেশ্যে?”

    “ব্যাপারটা ভেবে দেখুন। জেনারেল নাজেতকে অপমান করা অনেক বড় একটা ব্যাপার”, প্রিন্স বলতে শুরু করে। “এই খবরটা জাঞ্জিবার-এর সব ব্যবসায়ীরা লুফে নিবে। শুধু তা-ই নয়, এই খবরটা যখন আরও বহুদূর ছড়িয়ে পড়বে, যখন আপনার জনগণের কাছে পৌঁছবে তখন তাদের মনে কী পরিমাণ আঘাত হানবে এটা, বুঝতে পারছেন? কিন্তু আমার কাছে এটার সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে অন্যরকম। আপনাকে উক্ত স্থানে বিক্রয়ের জন্য নিয়ে যাওয়া মানে হচ্ছে একটা টোপ ফেলা…”

    “স্যার হেনরী কার্টনিকে নিয়ে আসার জন্য। যদি সে এখনো জীবিত থাকে।”

    প্রিন্স-এর চেহারা চকচক করে উঠে, “একদম ঠিক। আহ! আপনার মতো বুদ্ধিমান রমণীর সাথে কথা বলা কতই না আনন্দের যে কি-না সবকিছু না বলতেই বুঝতে পারে। এরপর আমি দুজনকেই ক্রীতদাস বানিয়ে ছাড়ব। এবং তারপর কী করব সেটা অবশ্য এখনো ঠিক করিনি। কিন্তু যদি আমি হেনরি কার্টনিকে পাই তাহলে আপনার জন্য হিসেবটা সহজ হয়ে যাবে। আপনি নিজেকে আমার কাছে সপে দেবেন নতুবা আমি তাকে হত্যা করব।”

    “না…, আমি কখনোই…।”

    “নিজেকে খুন করবেন? কিন্তু আপনি যদি নিজেকে হত্যা করেন তাহলে আমিও তাকে হত্যা করব। কিন্তু আপনি যদি নিজেকে একরাতের জন্য আমার কাছে সঁপে দেন তাহলে সে শুধু বেঁচেই থাকবে না আপনাদের পুনরায় একত্র হওয়ার একটা সুযোগও মিলবে।”

    “কী ধরনের সুযোগ দেয়া হবে?”

    “সহজ হিসেব। স্যার হেনরি কার্টনিকে আমার সৃষ্ট এই দানবের সাথে লড়তে হবে। প্রিন্স অলস ভঙ্গিতে একটা হাত বুজার্ডের দিকে দেখিয়ে বলে। এরা দুই চিরশত্রু একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত তলোয়ার যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন কে বিজয়ী হয়। আর যে বিজয়ী হবে, সে-ই পুরস্কার হিসেবে আপনাকে গ্রহণ করবে।”

    চামড়ার মুখোশের ভেতরে গলা পরিষ্কার করার আওয়াজ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রিন্স লোকটি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠে, “বুজার্ড, কোনো কথা বলবে না। তুমি জান তোমাকে কী শর্তে এখানে আনা হয়েছে। যদি তুমি কোনো কথা বল তবে তুমি নিজেই তোমার জীবন বিপন্ন করবে। তুমি শুধু তাকিয়ে দেখ তোমার জন্য কী পুরস্কার অপেক্ষা করছে। যাকে তুমি সবচেয়ে ঘৃণা করো তার মৃত্যু এবং সে যে নারীকে ভালবাসে তার শরীর, দুটোই পাবে তুমি।”

    “এই দানবটা কোনোদিনই আমার শরীর পাবে না।”

    “হাঁ হাঁ, তার আগেই আপনি মৃত্যু বেছে নিবেন। সেটা আপনি অনেকবার বলেছেন।” প্রিন্স অত্যন্ত বিরক্তির স্বরে বলে উঠে। “কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করি না। একজন মা কী তার নিজেকে এবং সন্তানকে হত্যা করতে পারে? একজন মা তার সন্তানকে বাঁচানোর জন্য যে কোনো কিছু করতে পারে…যে কোনো কিছু।” “আপনি কী সেটার ব্যতিক্রম?” “আর বুজার্ড তুমি আজকে অনেক ভাল কাজ করেছে। জেনারেল নাজেতকে আমার কাছে নিয়ে এসেছে। সেটার বিনিময়ে আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই। আজ রাতের জন্য তুমি শহরে বের হয়ে ফুর্তি করার মতো জায়গা খুঁজে বের কর। পান কর, পছন্দের নারী বেছে নাও। আজ রাতের জন্য প্রমাণ করে দাও যে তুমি এখনো একজন পুরুষই আছে।”

    1 2 3 4 5 6 7 8
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleদামেস্কের কারাগারে – এনায়েতুল্লাহ্ আলতামাশ
    Next Article অ্যাডগার অ্যালান পো রচনাসমগ্র / অনুবাদ : জাকির শামীম
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }