Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘড়ির কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    নারায়ণ সান্যাল এক পাতা গল্প113 Mins Read0

    ঘড়ির কাঁটা – ১

    ১

    —ঘড়ির কাঁটা? তার মানে?—কৌশিক কৌতূহলী।

    —’ঘড়ির কাঁটা’ বোঝ না? সময়! টাইম ফ্যাক্টর। মহাকালের খণ্ডিত রূপ, যাকে আইনস্টাইন বলেছেন ফোর্থ ডাইমেনশন—ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ব্যাপারটাকে আরও গুলিয়ে তোলেন বাসু-সাহেব।

    কৌশিক বললে, তা তো বুঝলাম, কিন্তু ঘড়ির কাঁটায় আপনি এ রহস্যের ‘কু’ কী করে পেলেন?

    —ঘড়ির কাঁটা থেকেই আমি সব ‘কু’ পেয়েছি কৌশিক। তোমরা ঘটনাগুলো বিচার করেছ, বিশ্লেষণ করেছ, কিন্তু গোটা ঘটনাকে তোমরা দেখছ ত্রি-মাত্রিক রহস্য হিসাবে। দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-খাড়াই! ব্যস! এই জগৎ-প্রপঞ্চে যে আর একটি ফোর্থ-ডাইমেনশন আছে—টাইম, মহাকাল—তাঁকেই উপেক্ষা করেছ। অর্থাৎ তোমাদের চিন্তাসূত্র ছিল—’এটা কেন হল? ওটা কেন হল, রাম কেন এ-কথা বলল, শ্যাম কেন ও-রকম আচরণ করল’! আমি প্রশ্নগুলি অন্য দৃষ্টিতে দেখেছি: রাম এ-কথা ‘কখন’ বলল? শ্যাম ও রকম আচরণ ‘কখন’ করল!—ওই ঘড়ির কাঁটাটার দিকে বরাবর নজর ছিল বলেই সমস্যাটা আমার কাছে ছিল চতুর্মাত্রিক। ‘টেনসার ক্যালকুলাস’ ভিন্ন এ সমস্যার সমাধান হয় না! তোমরা সলিড জিয়োমেট্রিতে—

    বাধা দিয়ে কৌশিক বলে, বুঝেছি, আর সরল করে বোঝাতে হবে না। আপনি শুধু বলুন—ঘড়ির কাঁটা থেকে আপনি কেমন করে বুঝতে পারলেন—হত্যাকাণ্ডটা কে করেছে, কেন করেছে?

    ঘনিয়ে এসে বসে কৌশিক, সুজাতা আর রানি দেবী।

    জানি না, এদের সকলের পরিচয় আবার নতুন করে দিতে হবে কি না

    কৌশিক, সুজাতা আর রানি দেবী ঘনিয়ে এসে বসায় বাসু-সাহেব চুরুটটা ধরিয়ে জমিয়ে শুরু করলেন, বেশ বলছি, এখন সব কথা তোমাদের বুঝিয়ে বলতে আর কোনো আপত্তি নেই। কেস যখন জেতা গেছে তখন মন্ত্রগুপ্তি নিষ্প্রয়োজন। শোন—

    … কিন্তু না!

    এ অনুচ্ছেদটি কাহিনির একেবারে শেষ পাতায় লেখার কথা ছিল আমার। সর্বপ্রথমেই ওটা লিখতে বসা আমার ভুল হয়েছে—মানে ভ্রান্তিটা টাইম-ফ্যাক্টরে, টেনসর ক্যালকুলাসের অঙ্গ! যাকে বলে ঘড়ির কাঁটায়। আগের কথা আগে বলি, না হলে বাকি পৃষ্ঠাগুলো আপনারা আর উল্টেই দেখবেন না।

    .

    টেলিফোনটা বেজে ওঠায় আচমকা ঘুম ভেঙে গেল রবির। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে বিছানায়। প্রথমেই নজর পড়ল টেবিল ক্লকটার দিকে। সকাল পাঁচটা পনেরো। টেলিফোনটা থাকে মাঝের ঘরে—খাবার ঘরে। দরজা খুলে বেরিয়ে আসে রবি। টেলিফোনটা তুলে নিয়ে নিজের ফোন নম্বরটা ঘোষণা করে।

    —রবি বলছিস? আমি প্ৰকাশ।

    —কী ব্যাপার? এই কাক-ডাকা ভোরে? কোথা থেকে বলছিস? ডিউটি রুম থেকেই। শোন, বিশ্রী ব্যাপার হয়েছে। কমল একটা মারাত্মক অ্যাকসিডেন্ট পড়েছে। এইমাত্র এমার্জেন্সিতে নিয়ে এল। তুই যেমন আছিস চলে আয়।

    —কমল? আমাদের কমলেশ? বলিস কী?

    —হ্যাঁ। অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিল, হঠাৎ-

    —মারাত্মক আঘাত? বাঁচবে তো?

    —বলা যায় না রে। আমি ওকে পরীক্ষা করে দেখিনি এখনও। এইমাত্র, মানে পাঁচ মিনিট হল এসেছে। অজ্ঞান হয়ে রয়েছে। এমার্জেন্সিতে নিয়ে গেল। এখনই দেখব আমি। হেড ইঞ্জুরি….ইন্টার্নাল হেমারেজ হচ্ছে…

    —ঠিক আছে, আমি এখনই যাচ্ছি। সুদীপকে একটা ফোন করব?

    —না, তুই আগে এখানে চলে আয়। দরকার হয়, এখান থেকেই ফোন করিস।

    —তুই মীনার ফোন নম্বর জানিস? তাকে একটা খবর-

    —মীনা! মীনা কে? ও বুঝেছি। সে সব পরে হবে, তুই চলে আয়…..ইয়েস কামিং। ওরা আমাকে ডাকছে এমার্জেন্সি থেকে। তুই চলে আয় এখনই, যেমন আছিস।

    লাইন কেটে দিল প্ৰকাশ।

    টেলিফোন রিসিভারে নামিয়ে রেখে রবি কয়েকটা মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল স্থাণুর মতো। কমল! কমলেশ মিত্র! ওদের বেপরোয়া বড়লোক বন্ধু। সংবাদপত্রের নিউজ এডিটর। মাঝে মাঝে তাকে নাইট ডিউটি করতে হয়। সারারাত ডিউটি করে ভোরবেলা বেচারি বাড়ি ফিরছিল, আর….

    —কার কী হয়েছে গো? মারাত্মক আঘাত বললে না?

    রবি ঘুরে দাঁড়ায়। দেখে অঞ্জলিও বার হয়ে এসেছে ঘর থেকে। ওর কপালের টিপটা ধেবড়ে গেছে! গায়ে ব্লাউজ নেই—রাত্রে সে খালি গায়েই শুয়েছিল। চোখ দুটো ফোলা ফোলা। রবি বলে, প্রকাশ ফোন করছিল মেডিকেল কলেজ থেকে। এই মাত্র মেডিকেল কলেজ এমার্জেন্সি-রুমে কমলেশকে নিয়ে এসেছে। মারাত্মক একটা মোটর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে তার। মাথাটা থেঁতলে গেছে, না বাঁচারই সম্ভাবনা।

    সাত সকালে এই নৃশংস ঘটনার কথায় মর্মাহত হয় অঞ্জলি। কমলেশ মিত্রকে সে চেনে, ভালো করেই চেনে। লোকটার চোখে-মুখে কথা, আর তার কথায় কোনো আড় নেই। বিয়ের পরেই রবি কিছু বন্ধু-বান্ধবকে একটা ঘরোয়া নিমন্ত্রণ করেছিল। সেই তখনই কমলেশের সঙ্গে অঞ্জলির প্রথম পরিচয়। লোকটা উচ্ছ্বসিত ভাবে নববধুর রূপের প্রশংসা করেছিল। মনে আছে অঞ্জলির—সে রাত্রে সে রবিকে বলেও ছিল: তোমার বন্ধু একটা অসভ্য!

    রবি হাসতে হাসতে বলেছিল, কমলের কথায় কিছু মনে কোরো না। ও একটা পাগল! অঞ্জলি দেখল, ইতিমধ্যে রবি জামাটা গায়ে চড়িয়েছে। বললে, চায়ের জলটা চাপিয়ে দিই, একেবারে বাসি মুখে—

    —পেটে গরম চা পড়লেই এখন বাথরুমে যেতে হবে।

    —তা ও-সব হাঙ্গামা মিটিয়েই যাও না বাপু। কতক্ষণ থাকতে হবে হাসপাতালে কে জানে?

    রবি রাজি হয় না। বলে, মোটর-বাইকে যেতে আমার মিনিট পাঁচেক লাগবে। এত সকালে রাস্তা একেবারে ফাঁকা! ঘণ্টা-খানেকের মধ্যেই ঘুরে আসব।

    সূর্য সেন স্ট্রিট থেকে মেডিকেল কলেজ মোটর বাইকের আরোহীর কাছে পাঁচ মিনিটের পথ। রবি বসুর কাছে বোধ হয় আড়াই থেকে তিন মিনিট। এমনিতেই সে বেপরোয়া, তায় সে পুলিসের ইনস্পেকটার—ট্রাফিক-রুলস্ মানার বালাই নেই!

    অঞ্জলি রাগ দেখিয়ে বলে, এক বন্ধু তো মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ঢুকেছেন, তুমি আর ওই বাহাদুরিটা নাই বা দেখালে।

    মনটা উদ্বিগ্ন না থাকলে রবি হয়তো হাসত, একটু আদর করত অথবা জবাবে জব্বর কিছু শুনিয়ে দিত; কিন্তু তার মন ছিল অন্য রাজ্যে—মেডিকেল কলেজের এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে। যেখানে ইনটারনাল হেমারেজ হচ্ছে ওর এক বন্ধুর মাথার ভিতর। বন্ধু? হ্যাঁ, বন্ধু বইকি! যদিও কমলেশ মিত্রকে বন্ধু বলে স্বীকার করতে আজকাল ওর মন চায় না। তবু এতদিনের অভ্যাসটাও ছাড়তে পারেনি। কমলেশ, প্রকাশ, সুদীপ আর রবি সেই যাকে বলে হাফপ্যান্ট যুগের বন্ধু। চারজনে একই ক্লাসে পড়ত—গোলদিঘির ধারে ওই হিন্দু স্কুলে। একই সঙ্গে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে। প্রকাশ ফার্স্ট ডিভিশনে, ও আর সুদীপ সেকেন্ড আর কমলেশ কোনোক্রমে ঢিকিয়ে। তারপর কিছুটা ছাড়াছাড়ি হয়েছিল অবশ্য—প্রকাশ গেল মেডিকেল পড়তে, সুদীপ কমার্স। রবি নিল পুলিশের চাকরি আর কমলেশ হল ফ্রি-লান্সার। কমলেশ মিত্র বাপের এক ছেলে এবং বাবা রীতিমতো বড়লোক। স্কুলজীবনে পুঁটিরাম মোদকের দোকানে, কিংবা গোলদিঘির পিছনে শরবতের দোকানে বন্ধুদের আড্ডায় বিল মেটানোর দায় বরাবর কমলেশই নিত–সেদিক থেকে ছেলেটা ছিল দিল-দরিয়া। প্রকাশ কলেজে এবং রবি পুলিসের ট্রেনিঙে ঢোকার পরেও কফি হাউসে কমলেশই বরাবর বিল মেটাত। স্কুলে থাকতেই সে বিগড়ে যায়। প্রথমে সিগারেট, পরে গাঁজা, শেষে মদ। কলেজের খাতায় নাম লিখিয়েছিল, কিন্তু ক্লাস করার চেয়ে ক্লাস কাটার দিকেই ঝোঁকটা ছিল বেশি। বছর কয়েক টানা-হেঁচড়া করে ঢাকি শুদ্ধ মা সরস্বতীকে বিসর্জন দিয়ে আসে গঙ্গায়। ঢোকে সিনেমা লাইনে; তখন থেকেই বাপের সঙ্গে মনান্তর। দু’একবার ছোটখাটো সাইড রোল পেয়েছিল। কিন্তু পাত্তা পেল না। কিছুদিন ‘মানিকদার গল্প শোনাল, কিছুদিন ‘ঋত্বিক’দার। নেক্সট বইয়ের সে নাকি হিরো হচ্ছে! নাকে ঝামা ঘষে দেবে এবার উত্তম অথবা সৌমিত্রের। কিন্তু কোথায় কী? কিছু দিনের মধ্যেই ছেড়ে দিল সিনেমা লাইন। বাপের সুপারিশে ঢুকল সংবাদপত্র অফিসে। রবি অবাক হয়ে বলেছিল—তুই সংবাদপত্রের অফিসে কী চাকরি করবি রে? এক পাতা বাংলা লিখতে হলে তুই যে বাইশটা বানান ভুল করিস! কমলেশ বলেছিল ও-সব ম্যানেজ হয়ে যাবে! তা গেছে। এখন সে বেশ মোটা মাইনে পায়। ওর বাবা গত হয়েছেন। ফলে এখন তাকে শুধু সচ্ছল নয়, ধনীই বলা চলত। তা বলা চলে কি না রবি ঠিক জানে না—কারণ এই তিন-চার বছরে কমলেশ যে-হারে টাকা উড়িয়েছে তাতে কুবেরের পক্ষেও দেউলিয়া হওয়া উচিত। কমলেশ থাকে একটা ফ্ল্যাটে—চাকর সম্বল। পৈত্রিক বসত-বাড়িতে ওর মাথা গলানোর উপায় নেই। সেটা ওর বাবা দিয়ে গেছেন কমলেশের স্ত্রী অনুপমাকে। অনুপমার সঙ্গে কমলেশের বনিবনাও নেই। সেপারেশন চলছে। রবি কানাঘুষা শুনেছিল, ডিভোর্সের মামলাও নাকি দায়ের করা হয়েছে। সেটা আদালতে ঝুলছে। কমলেশের নতুন বান্ধবী নাকি মীনাক্ষী—ওই সিনেমা জগতেই আলাপ। সে বেচারিও নাকি রূপালি পর্দায় ঢুকতে পারেনি, এখন সোনালি স্বপ্ন দেখছে। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যের এটাই নাকি মূল কারণ।

    তা হোক। সেটা কমলেশের ব্যক্তিগত ব্যাপার। রবি কমলেশকে শ্রদ্ধা করে না, ভালোও বাসে না, কিন্তু তবু সহপাঠী তো বটে। ছেলেটার মধ্যে একটা অদ্ভুত উন্মাদনা আছে। মাঝে মাঝে এসে হাজিরা দেয় রবির ফ্ল্যাটে। সেদিন তার উচ্চকণ্ঠের দরাজ হাসিতে সচকিত হয়ে ওঠে রবির প্রতিবেশীরা। অঞ্জলিও সেদিন চঞ্চল হয়ে ওঠে ওর বেপরোয়া মদ্যপ বন্ধুর ভয়ে। অনুপমার ব্যাপারে একদিন ঝগড়া করে রবি ওকে মারতে পর্যন্ত উঠেছিল। তা হোক—তবু লোকটা বেঘোরে মারা যাবে!

    .

    অবশেষে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নৈঃশব্দ্যকে বিদীর্ণ করে রবি বসুর মোটর বাইক এসে থামল এমার্জেন্সি বিভাগের সামনে গাড়ি থেকে নেমে রবি এগিয়ে গেল এমার্জেন্সি-রুমে। ঘরে প্রকাশ নেই। ডিউটিতে ছিল আর একজন ছোকরা ডাক্তার। রবি এগিয়ে এসে বললে ডক্টর প্রকাশ সেনগুপ্ত আছেন?

    —আছেন। এইমাত্র একটা এমার্জেন্সি কেস এসেছে। তাকে অ্যাটেন্ড করছেন।

    —মোটর অ্যাকসিডেন্ট কেস?

    —হ্যাঁ। বাঁ পায়ের ‘ফিমার বোন’-এ কম্পাউন্ড ফ্র্যাকচার হয়েছে।

    —বাঁ পা? মাথায় নয়?

    —মাথাতেও হয়ে থাকতে পারে, আমি দেখিনি লক্ষ করে। এই তো মিনিটপাঁচেক আগে এল কেসটা। ভিতরে নিয়ে গেল—

    রবি চমকে ওঠে। তা কী করে হয়। পাঁচ-মিনিট আগে কেসটা এসেছে মানে? কুড়ি মিনিট আগেই তো সে টেলিফোনে খবরটা জানতে পেরেছিল। হঠাৎ ওর মনে হল, ছেলেটি বোধহয় অন্য একটা কেসের কথা বলছে। অর্থাৎ কমলেশের পরে যে কেসটা এসেছে এমার্জেন্সিতে। টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে বললে, আমার নাম রবি বসু, প্রকাশ সেনগুপ্ত আমার ক্লাস ফ্রেন্ড। সে আমাকে টেলিফোন করে জানিয়েছিল যে, আমাদের দুজনেরই কমন-ফ্রেন্ড কমলেশ মিত্র একটা মোটর অ্যাকসিডেন্ট-এ আহত হয়ে হাসপাতালে এসেছে। সে অবিলম্বে আমাকে চলে আসতে বলেছিল। বলেছিল, কমলেশের মাথায় আঘাত লেগেছিল, পায়ে নয়। অথচ—

    ছেলেটি একটা রেজিস্টারের উপর দ্রুত চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, আয়াম সরি। আমি ভেবেছিলাম আপনি অমলবাবুর কথা বলছেন—কমলেশ মিত্র? দাঁড়ান দেখছি

    খাতা উল্টে-পাল্টে দেখে ছেলেটি ফতোয়া জারি করল। না, কমলেশ মিত্র নামে কোনো পেশেন্ট আসেনি আজ সকালে। মোটর অ্যাকসিডেন্ট কেস একটাই এসেছে। এই অমল সোমের।

    রবি চমকে ওঠে, কী নাম বললেন? অমল সোম? সেও আমার আর এক বন্ধুর নাম। আই মীন, আমাদের দুজনেরই বন্ধু-

    —তাহলে ডক্টর সেনগুপ্ত আপনাকে টেলিফোনে ‘অমল’ বলেছেন আর আপনি ‘কমল’ শুনেছেন।

    রবি মাথা নেড়ে বললে, তাও তো সম্ভব নয়। ও যে স্পষ্ট বললে হেড-ইঞ্জুরি, মাথার ভিতর ইনটারনাল হেমারেজ হচ্ছে— পায়ের কথা সে আদৌ বলেনি।

    —তা হলে হয়তো হেড-ইঞ্জুরিও হয়েছে। আমি ঠিক জানি না। এই মাত্ৰ এল তো-

    —এই মাত্র মানে? ঠিক কটায়?

    আবার খাতা দেখে ছেলেটি বললে, আমাদের রেকর্ড অনুযায়ী পাঁচটা সাতাশ।

    —স্ট্রেঞ্জ! প্রকাশ আমাদের ফোন করেছিল ঠিক পাঁচটা পনেরোয়!

    —আপনার ঘড়ি বোধহয় স্লো হয়ে গেছে।

    রবি তার হাতঘড়িটা বাড়িয়ে ধরে। দেখা গেল, এমার্জেন্সি ওয়ার্ডের দেওয়াল-ঘড়ির সঙ্গে সেটা কাঁটায়-কাঁটায় সময় দিচ্ছে।

    ছেলেটি কাঁধে ঝাঁকি দিয়ে বললে, কী-জানি মশাই। ডক্টর সেনগুপ্ত একটু পরেই আসবেন। তখন আপনার এ হেঁয়ালির ফয়সালা হবে! সিগাটে চলবে?

    একটি সিগারেট বার করে দেয়। নিজেও ধরায়। বলে আমার নাম মৈনুল হল চৌধুরী। ডক্টর সেনগুপ্ত আমার এক বছরের সিনিয়ার।

    রবি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল। বললে, কিন্তু ব্যাপারটা কী হতে পারে?

    হঠাৎ ডক্টর হক-চৌধুরী বলে, আমার মাথায় একট আইডিয়া এসেছে। আজ কত তারিখ?

    —পয়লা। কেন?

    —এবং মাসটা এপ্রিল, তাই নয়? দুইয়ে-দুইয়ে চার!

    রবি বিরক্ত হয়ে বলে, অসম্ভব! ডঃ সেনগুপ্ত একজন রেসপন্সিবল অফিসার—চ্যাঙড়া নয়। মানুষের জীবন-মৃত্যু নিয়ে এমন ‘প্র্যাকটিকাল জোক’ সে নিশ্চয় করবে না। আর তাছাড়া কমল না হলেও অমল তো সত্যিই আহত হয়েছে—

    —কিন্তু সে যে হাসপাতালে এসেছে পাঁচটা সাতাশে। তার বারো মিনিট আগে কি ডক্টর সেনগুপ্ত টেলিপ্যাথিতে খবর পেলেন যে, অমন একটা কেস আসছে?

    রবির আবার সব কিছু গুলিয়ে যায়।

    আরও অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর ডঃ সেনগুপ্ত বার হয়ে এল। রবিকে দেখেই বললে, এসেছিস্? অমলের পা-টা বোধহয় বাঁচানো যাবে না। অ্যাম্পুট করতে হবে। অর্থোপেডিক সার্জেন দেখছেন। ওর বাড়ির লোকরা এখনও কিছু জানে না। তুই খবর দিবি?

    —দিচ্ছি –তাহলে হেড-ইঞ্জুরি নয়?

    —না, না—মাথায় কিছু হয়নি। শুধু বাঁ পা-টা

    —কিন্তু তুই যে তখন টেলিফোনে বললি—মাথার ভিতর ইনটারনাল হেমারেজ— প্রকাশ অসহিষ্ণুর মতো বলে ওঠে, সে-সব পরে হবে রবি। আগে অমলের বাড়িতে একটা খবর দেওয়া দরকার। ওদের ফোন নেই—বাড়ি তো তুই চিনিস—

    রবি উঠে দাঁড়ায়। বলে, খবর আমি এখুনি দিচ্ছি প্রকাশ, কিন্তু আমার প্রশ্নটা তুই এড়িয়ে যাচ্ছিস। আমার প্রশ্নের জবাবটা আগে দে। তুই কেন বললি, ‘কমল’ আহত হয়েছে!

    —কমল? আমি বলেছি?

    —হ্যাঁ, বলেছিস। বলেছিস ‘কমল যখন অফিস থেকে ফিরছিল’—তুই জানিস না অমল সোম এ জি. ডবলু বি-তে চাকরি করে? তার ছুটি হয় বিকাল সাড়ে পাঁচটায়?

    —প্লিজ রবি। ওই সব ছেঁদো কথা নিয়ে কি এখন সময় নষ্ট করা উচিত? টেবিলে একটা চাপড় মেরে রবি উচ্চকণ্ঠে বলে, আলবাৎ উচিত! আগে কৈফিয়ত দে?

    একজন নার্স থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এমার্জেন্সি-রুমের দোরগোড়ায়

    প্রকাশ আড়চোখে তাকে দেখে নিয়ে বললে, লুক হিয়ার রবি! এটা হাসপাতাল! চেঁচামেচি করিস না—

    —আলবাৎ করব! বল্–কেন মিথ্যা কথা বলেছিলি?

    ডক্টর হক চৌধুরীও উঠে দাঁড়িয়েছিল। বলে, মিস্টার বোস, আপনি খামকা উত্তেজিত হচ্ছেন-

    রবি এক ধমকে তাকে থামিয়ে দেয়, আপনি থামুন তো মশাই। আই ওয়ান্ট টু নো হোয়াই দিস্ লায়ার….

    —রবি!—এবার প্রকাশও গলা চড়ায়। বলে, পুলিশে চাকরি করিস বলেই ভদ্রতা জ্ঞান থাকবে না এমন কোনো কথা নেই। তুই যদি ভদ্রভাবে কথা বলতে না পারিস তোকে ঘর ছেড়ে চলে যেতে বলতে বাধ্য হব আমি। এটা হাসপাতালের এমার্জেন্সি ওয়ার্ড। তোর থানা নয়-

    এমার্জেন্সির খোলা দরজার সামনে ততক্ষণে রীতিমতো একটা জটলা।

    রবি বললে, ভদ্রলোকের সঙ্গেই ভদ্র ব্যবহার করতে হয় প্রকাশ। তোর মতো ছোটলোক মিথ্যেবাদীর সঙ্গে আবার ভদ্রতা কি রে!

    —আই সে—লিভ দিস্ রুম! ইম্মিডেটলি!

    —ঠিক আছে! আমিও দেখে নেব!—হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে যায় রবি বোস

    ডক্টর মৈনুল হক-চৌধুরীও বেরিয়ে আসে পিছন পিছন। কাছে এসে বলে, আপনার রাগ করবার অবশ্য যথেষ্ট কারণ আছে, কিন্তু মিস্টার বোস—হাজার হোক এটা হাসপাতাল। আর ভুল যাবেন না, উনি এক্ষুনি একটা মরণাপন্ন রুগীকে অ্যাটেন্ড করে এলেন, যে লোকটা…. যে লোকটা আপনাদের দুজনেরই বন্ধু।

    —আয়াম সরি, ডক্টর চৌধুরী। আপনার সঙ্গে আমি অহেতুক রূঢ় ব্যবহার করেছি। আমি… আমি সত্যই দুঃখিত।

    —ঠিক আছে। সেটা কিছু নয়। তাহলে ওই পেশেন্ট-এর বাড়িতে খবরটা আপনিই পৌঁছে দিচ্ছেন তো?

    —নিশ্চয়! কমল-অমল দুজনেই আমার বন্ধু! কিন্তু প্রকাশকে আমি দেখে নেব! ভটভটিয়া গর্জন করতে করতে বেরিয়ে গেল পটুয়াটুলির দিকে। কমলেশ মিত্র নয়, অমল সোমের বাড়ির দিকে।

    .

    কলিং-বেলটা বেজে উঠতেই অঞ্জলি বললে, ও মুন্নির মা, সদরটা খুলে দাও তো। বাবু ফিরে এলেন বোধহয়।

    মুন্নির মা ঠিকে ঝি। সকালবেলা এসে বাসন-মাজতে বসেছিল কলতলায়। গৃহকর্ত্রীর নির্দেশে সে হাত ধুয়ে সদর দরজা খুলে দিতে গেল। তখনই মনে হল অঞ্জলির—কিন্তু কই, মোটরবাইকের শব্দ তো হয়নি! রবি বোস যখন বাড়ি ফেরে তখন সারা পাড়ায় সাড়া পড়ে যায়। চুপি চুপি তার আসার উপায় নেই। তাহলে, কে এল? মাসের প্রথম দিন—এ সময়ে অনেকেই আসতে পারে; খবরের কাগজওয়ালা, মিল্ক সাপ্লাই কোম্পানির লোকটা, কিংবা

    মুন্নির মা ফিরে এসে বললে, একজন ভদ্দরলোক। বাবুর বন্ধু বোধহয়।

    —বন্ধু? বন্ধু কেমন করে জানলে? দেখতে কেমন?

    মুন্নির মাকে জবাব দিতে হল না। তার আগেই দরাজ-গলায় কে যেন বলে ওঠে, দেখতে কন্দৰ্পকান্তি নয়! তবু বন্ধুই!

    রীতিমতো আঁতকে ওঠে অঞ্জলি। খোলা দরজা পেয়ে লোকটা অনায়াসে এগিয়ে এসেছে। অঞ্জলি ঘর দোর সাফ করছিল, তখনও গায়ে ব্লাউজটাও চড়ায়নি। কোনোক্রমে গায়ে আঁচলটা জড়িয়ে বললে, আপনি বাইরের ঘরে বসুন। আসছি!

    কমলেশ বিনা বাক্যব্যয়ে গিয়ে বসল বৈঠকখানায়। অঞ্জলি আয়নায় মুখটা একবার দেখে নেয়। আঁচল দিয়ে ঘষে কপালের টিপটা তুলে ফেলে, ব্লাউজটা গায়ে দেয়। কাপড়টা আর পালটায় না, টেনেটুনে ঠিক করে নেয়। তারপর আঁচলে মুখটা মুছতে মুছতে বাইরের ঘরে এসে ফ্যানটা খুলে দিয়ে বলে, কী ব্যাপার? আপনি বহাল তবিয়তে আছেন, অথচ আজ সাত-সকালে প্রকাশবাবু টেলিফোনে—

    কথাটা তার শেষ হয় না। হঠাৎ নজরে পড়ে কমলেশ মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে তার মুখের দিকে। সে মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে অকারণেই ঘর্মাক্ত হয়ে পড়ে অঞ্জলি। ও থামতেই কমলেশ বললে, ভারি সুন্দর দেখাচ্ছে কিন্তু আপনাকে।

    রীতিমতো বিব্রত হয়ে পড়ে অঞ্জলি। সে তো জানে, প্রসাধনের বাষ্পমাত্র নেই তার সারা অঙ্গে। নিতান্ত ঘরোয়া সাজ—বস্তুত নেহাৎ বাধ্য না হলে এ অবস্থায় সে বাইরের লোকেরা সামনে বের হত না। তাহলে এ ব্যঙ্গোক্তির অর্থ? কমলেশ যে মদ্যপ এ খবর অঞ্জলির না-জানা নয়; কিন্তু এই সাত সকালে সে নিশ্চয় এক পাঁট মদ গিলে আসেনি। তাহলে?

    কমলেশ একই সুরে বলতে থাকে, প্লিজ ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ। আই মীন, এ লক্ষ্মীছাড়ার ঘরে তো আর লক্ষ্মীর ঠাঁই হল না—তাই এমন ঘরোয়া আটপৌরে বেশে আপনাদের দেখতে ভা-রি ভালো লাগে আমার।

    যথেষ্ট দূরত্ব রেখে অঞ্জলি একটি সোফায় বসে পড়ে। চোখে চোখ রাখতে পারে না। তবু বলে, তা লক্ষ্মীছাড়া হয়ে থাকবার দরকারই বা কী? অনুদিকে—

    —থাক ও কথা!—কমলেশ ওকে থামিয়ে দেয়। বলে, রোবে হারামজাদাটা কি বেরিয়ে গেছে?

    একটু ক্ষুণ্ণ হল অঞ্জলি। নির্জন ঘরে বন্ধুর স্ত্রীর সঙ্গে বাক্যালাপে তার স্বামীর উল্লেখে যে বিশেষণগুলি শিষ্টাচার-সম্মত, কমলেশ তার সীমা ছাড়িয়েছে। এক মুহূর্ত আগে ওই লোকটার মুগ্ধ দৃষ্টির সঙ্গে এ-ভাষাটা অত্যন্ত বেমানান। কিন্তু ওই রকমই মানুষ কমলেশ। কোন পরিবেশে কী জাতীয় কথা বলতে হয় তা সে জানে না।

    অঞ্জলি জবাবে বলে, হ্যাঁ, কিন্তু ব্যাপারটা কী?

    —প্রকাশের একটা প্র্যাকটিকাল জোক! কোনও মানে হয়? ভোর পাঁচটার সময় হাসপাতাল থেকে আমার অফিসে ফোন করেছে। বললে, রোবে হারামজাদাটাকে—

    কী জানি কেন আর থাকতে পারল না অঞ্জলি! বাধা দিয়ে ওঠে—না!

    —না? কী না?

    —প্রকাশবাবু নিশ্চয়ই ওই বিশেষণটি ব্যবহার করেননি!

    খেয়াল হয় কমলেশের। ম্লান হাসে। স্বীকার করে অপরাধ—ঠিকই বলেছেন, অঞ্জলি দেবী! প্রকাশ ও-ভাষায় কথা বলেনি। এ অশালীন ভাষাটা আমার, নিতান্তই আমার। কী করব বলুন, আমি সেই আদিম, বর্বর, জংলিই রয়ে গেলাম…

    —যাক্ যা বলছিলেন তাই বলুন।

    সুর কেটে গেছে। তবু পুরানো কথার খেই ধরে শেষ করে, প্রকাশ টেলিফোনে বললে, রোবেটাকে ‘এপ্রিল ফুল’ করা যাক। ওকে টেলিফোন করে বলি, তুই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গাড়ি চালাচ্ছিলি, অ্যাকসিডেন্ট করে আমার এমার্জেন্সিতে এসেছিস। আমি বারণ করেছিলাম, প্রকাশটা শুনলে না। তাই অফিস থেকে সোজা চলে এসেছি আপনারদের বাসায়।

    অঞ্জলি হাসতে হাসতে বললে, এতটা বয়স হল, তবু ‘এপ্রিল ফুল’ করার মতো ছেলেমানুষি ঘুচল না আপনাদের?

    কমলেশ একটা চুরুট ধরাল। বললে, এতটা বয়স হল মানে? কী এমন বয়স হয়েছে আমাদের? পঁয়ত্রিশ? ছত্রিশ? ছেলেমানুষি করার বয়স কি নিতান্তই পেরিয়ে গেছে বলতে চান অঞ্জলি দেবী?

    অঞ্জলি জবাব দিতে সাহস পেল না। বাড়িতে ওরা দুজন ছাড়া মুন্নির মা অবশ্য আছে। কিন্তু ‘আদিম-বর্বর-জংলি’ মানুষটা এ নির্জন ঘরে ছেলেমানুষির প্রমাণ দিতে হয়তো সেটা ভ্রুক্ষেপ করবে না। তাই কথা ঘোরানোর উদ্দেশ্যে বললে, চা খাবেন?

    —অফ কোর্স। তবে খালি পেটে নয়। যা হোক কিছু বানান!

    ফরমায়েস করে সে নিচু হয়ে জুতোর ফিতে খুলতে থাকে। খাওয়ার সঙ্গে জুতোর ফিতে খোলার কী সম্পর্ক অঞ্জলি বুঝে উঠতে পারে না। পরমুহূর্তেই রহস্যটা পরিষ্কার করে দেয় কমলেশ, চা বানাতে আপনার পনেরো-বিশ মিনিটে সময় লাগবে নিশ্চয় আমি বরং ততক্ষণ একটু লম্বা হই। সারারাত ঠায় চেয়ারে বসে বসে মাজা ধরে গেছে! লম্বা হওয়ার মতো আয়োজন বৈঠকখানায় নেই। শয়নকক্ষে কমলেশকে আহবান করা চলে না। অঞ্জলি কাঠের পুতুলের মতো বসে থাকে। জুতো খুলে কমলেশ উঠে দাঁড়ায়। টাইটা খুলে ফেলে, কোটটাও।

    ধুপধাপ ফেলে দেয় সোফায়। বলে, মিনিট পনেরো রোবের খাটে শুয়ে নিলে নিশ্চয় আপনি আপত্তি করবেন না, কী বলেন?

    কাষ্ঠ-হাসি হাসল অঞ্জলি। হাঁ-না বলতে পারল না।

    —চা তৈরি হয়ে গেলে এখান থেকেই হাঁক পাড়বেন। চা নিয়ে আপনাকে পৌঁছে ‘দিতে হবে না। আমি নিজেকেও অতটা বিশ্বাস করি না!

    অঞ্জলি কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জুতো-মোজা পড়ে থাকল; কোট-টাইগুলোও। কমলেশ বিনা অনুমতিতে খাবার ঘরটা পার হয়ে সোজা ঢুকে পড়ল ওদের বেডরুমে। ওখান থেকেই বললে, নেহাৎ যদিও ঘুমিয়ে পড়ি একটু ঘুমোতেই দেবেন—রোবে ফিরে এল সঙ্গে চা খাব–হয়তো ঠ্যাঙানিও!

    খাবার ঘর থেকেই দেখতে পেল অঞ্জলি—কমলেশ ফ্যানটা খুলে দিল। একটানে শার্টটা খুলে ফেলল, ঘামে ভেজা গেঞ্জিটাও। রোমশ একটা চওড়া বুক! রবির বুকে কিন্তু লোম নেই! দরজাটা ভেজিয়ে দিল কমলেশ! খুট করে আওয়াজও হল—ছিটকিনি দিল নাকি? কেন? চকিতে মনে পড়ল অঞ্জলির—আলমারিতে চাবি দেওয়া নেই। অবশ্য ভিতরের লকারটা চাবি দেওয়া। ওর গহনাপত্র, টাকা-কড়ি সবই ভিতরের লকারে। ওদের দাম্পত্যজীবনের কিছু গোপন ইতিহাসও আছে সেখানে। কিন্তু কমলেশ নিশ্চয় বন্ধ ঘরের সুযোগে আলমারি খুলে হাতড়াতে বসবে না। তবে ভিতর থেকে সে ছিটকিনি দিল কেন?

    অঞ্জলি বৈঠকখানায় এসে ওর পরিত্যক্ত কোট আর টাইটা সংগ্রহ করল। ডাইনিং-রুম-এর আলনার হ্যাঙারে টাঙিয়ে রাখল। চায়ের জলটা বসাতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কী মনে হওয়ার থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কোটের পকেটে কমলেশের মানিব্যাগ ফেলে যাওয়া ঠিক নয়। একটু ইতস্তত করে অঞ্জলি ওই কোটের ভিতর পকেটে হাত চালিয়ে দেয়। যা ভেবেছে। ভারি একটা ওয়ালেট। সেটা নিয়ে ও রান্নাঘরে ফিরে আসে। হিটারে চায়ের জলটা বসিয়ে দেয়। মানিব্যাগটা কোথায় রাখবে? প্রশস্ত স্থান হচ্ছে শোওয়ার ঘরের আলমারি। সেখানে রাখা যাবে না। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ না থাকলেও সে সাহস সঞ্চয় করে ওই ঘরে ঢুকতে পারত না। কমলেশই তো বলেছে, সে আদিম, বর্বর, জংলি! তাছাড়া সাবধানবাণী তো সে নিজেই শুনিয়ে গেছে। কথাটা এখনও বাজছে কানে আমি নিজেকেও অতটা বিশ্বাস করি না।

    অঞ্জলির মনে পড়ল—একটু আগেই সে ভেবেছে—আলমারির পাল্লাটা কমলেশ স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধে খুলে দেখবে না। সে নিজে কিন্তু সে আইন মানল না। স্ত্রীলোক বলেই বোধ করি। কমলেশের মানিব্যাগটা সে খুলে দেখল। তাতে একশো টাকার নোট আছে পাঁচখানা, এ-ছাড়া পাঁচ-দশ টাকার কিছু। আর আছে কিছু ভিজিটিং কার্ড। এবং একটি ফোটোগ্রাফ। একটি মেয়ের। অঞ্জলিরই বয়সি। কিন্তু সাজ পোশাক মোটেই আটপৌরে নয়। মুখখানা রীতিমতো এনামেল করা। ভুরু কামিয়ে এসেছে। ভুরু কামানো চেহারা দেখলেই মেজাজ বিগড়ে যায় অঞ্জলির—কী রূপই খোলে! বুঝতে অসুবিধা হয় না—ক্ষৌরীকৃত-ভ্রু সুন্দরীটি মীনাক্ষী মজুমদার। সেই যে মেয়েটা কমলেশের গৃহলক্ষ্মীকে গৃহ-ছাড়া করেছে।

    1 2 3 4 5 6
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleকুলের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল
    Next Article রূপমঞ্জরী – ১ম খণ্ড – নারায়ণ সান্যাল

    Related Articles

    নারায়ণ সান্যাল

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    সোনার কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    মাছের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    নারায়ণ সান্যাল

    পথের কাঁটা – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    আবার যদি ইচ্ছা কর – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    আম্রপালী – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025

    বিশ্বাসঘাতক – নারায়ণ সান্যাল

    September 3, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.