Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    হাঁস

    গৌর শিশির শিবুনয়, এ একেবারে বুনো বাপি দত্ত। যেমন গোঁয়ার তেমনই ষণ্ডা।

    এহেন লোককে মেসে নতুন জায়গা দিয়ে কী ভুলই হয়েছে সেদিন রাত্রে হাড়ে-হাড়ে বুঝে আমরা সবাই ইষ্টদেবতা স্মরণ করতে লাগলাম।

    কুরুক্ষেত্রের বুঝি আর বাকি নেই। বিরাট-পর্ব শুরু হয়ে গেছে। এথম বোমা ফেটেছে।

    বোমাটা ফাটল রাত্রের খাওয়া-দাওয়ার পর।

    খাওয়া-দাওয়াটা বেশ ভালই হয়েছিল। মফস্বলে যাদের বাড়ি তাদের কল্যাণে শুক্রবার রাত্রের খাওয়াটা আজকাল এই রকমই হয়। শুক্রবারের পর শনিবার হাফ । হলিডেতে তাঁরা সকাল সকাল বাড়ি যান আর ফেরেন সেই সোমবার সকালে। রবিবারের খ্যাঁটটার অভাব শুক্রবারের রাত্রের ভোজ দিয়েই তাঁরা তাই উশুল করে নেন।

    মফস্বলীদের মধ্যে বাপি দত্ত একজন। সাঁটিয়েদের ভেতরও।

    তিনবারের জায়গায় চারবার চেয়ে খেয়ে যেভাবে সে পাত চাটছিল ঘনাদা দেখলে বোধহয় ঈর্ষান্বিত হতেন। তাঁদের খাওয়ার রেষারেষির পাল্লায় ঠাকুর চাকরের জন্য কিছু থাকত কিনা সন্দেহ। কী ভাগ্যি ঘনাদা আজ শরীর খারাপ বলেনা, না-খেয়ে নয়—আগেই খেয়ে দেয়ে তাঁর ঘরে চলে গেছেন।

    পেতলের থালাটা মাজবার দায় থেকে লছমনিয়াকে প্রায় নিষ্কৃতি দিয়ে নিজের হাত চুষতে চুষতে বাপি দত্ত বললে, বাঃ চমৎকার!

    তা মাংসটা সত্যিই অপূর্ব রান্না হয়েছিল।

    আঙুল চোষা শেষ করে ঝকঝকে থালাটার দিকে একবার যেন করুণ ভাবে চেয়ে বাপি দত্ত বললে, কেমন, আমি বলি কিনা যে মাংস খেতে হয়তো হাঁসের। ও মুরগি বলো আর পায়রা বলল হাঁসের কাছে কিছু না! যদি জাত বিগড়ি হাঁস হয়।

    কেন, উটপাখি হলে মন্দ কী! শিব একটু ফোড়ন কাটল।

    উটপাখি! উটপাখি আবার খায় নাকি? বাপি দত্তর বুদ্ধিটা চেহারার-ই মাপসই।

    খেলে দোষ কী! একটাতে তোমারও কুলিয়ে যায়। অন্যদের জন্যেও মাংসের হাঁড়িতে টান পড়ে না। শিবু উৎসাহ দিলে।

    একটু যেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বাপি দত্ত বললে, না না, উটপাখি খাওয়াই যায় না, আর তাছাড়া হাঁসের তুলনা নেই—আসল বিগড়ি হাঁস। হাঁস আবার চেনা চাই।

    কথাটা বলেই বাপি দত্তর কী যেন মনে পড়ে গেল। ঠাকুরকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলে, আজ হাঁস কিনে আনল কে, ঠাকুর?

    ঠাকুর আমাদের ভালমন্দ বাজার করে। সে কিন্তু সামনে এলেও নীরবেই দাঁড়িয়ে রইল।

    কই, কে কিনে এনেছে বললে না, তুমি? আজ্ঞে না, বাবু!

    সে আমি জানতাম! বাপি দত্ত গর্বের হাসি হাসল। এ হাঁস চিনে আনা তোমার কর্ম নয়। কিন্তু কিনে আনল কে?

    আজ্ঞে, কিনে আমরা কেউ আনিনি।

    তোমরা কেউ আনননি! তাহলে বিগড়ি হাঁস কি নিজে থেকে উড়ে এসে তোমাদের হাঁড়িতে ঢুকল নাকি! ন্যাকামি কোরো না। বলো!

    আজ্ঞে, আপনিই কিনে এনেছেন! ঠাকুরকে সভয়ে বলতেই হল।

    আমি কিনে এনেছি! খানিকক্ষণ বাপি দত্তর মুখ দিয়ে আর কথা সরল না। তারপর আমরা টের পেলাম, পলতেয় আগুন লেগেছে। আমি মানেকাল বাড়িতে নিয়ে যাব বলে আমি যে কটা হাঁস কিনে রেখেছি, তা-ই কেটে রান্না হয়েছে! তাই তোমরা সবাই মিলে ফুর্তি করে খেয়েছ আর আমায় খাইয়েছ!

    ঘরে কী বলে—আধুনিক কবিতার মতো—শিশির পড়লে শোনা যায়।

    এইবার বোমা ফাটল।

    কে? কে আমার হাঁস কেটেছে? কার এই শয়তানি আমি শুনতে চাই।

    আমাদের চোখ যার যার থালার ওপর। কিন্তু উত্তর না দিলে ঠাকুরের নিস্তার নেই।

    আজ্ঞে, বড়বাবু কেটেছেন।

    বড়বাবু! বড়বাবু! বড়বাবু মানে তোমাদের সেই শুটকো মর্কট গেজেল চালিয়াৎ ঘনাদা!

    হে ধরণী দ্বিধা হও—আমরা তখন ভাবছি।

    কিন্তু ভাববার সময়ও পাওয়া গেল না।

    সকড়ি হাতে এঁটো মুখ না ধুয়েই বাপি দত্ত তখন সিঁড়ি দিয়ে রওনা হয়েছে ওপরে! আমাদের ছুটতে হল পেছনে।

    আরে শোনো! শোনো, দত্ত।

    কে কার কথা শোনে।

    ছাদ পর্যন্ত পৌঁছোবার আগেই শুনতে পেলাম ঘনাদার ঘরের দরজা সারা পাড়াকে সজাগ করে সশব্দে আর্তনাদ করছে। বর্মা নয়, সি-পির সামান্য সেগুন কাঠ। তার আর কতটুকু জান!

    বাপি দত্তকে এখন সামলানো বুনো মোষের মওড়া নেওয়ার চেয়েও শক্ত। তবু মরিয়া হয়ে তাকে ধরতে যাব এমন সময় দরজা ভেতর থেকেই খুলে গেল।

    কী ব্যাপার! ঘুম চোখে যেন সদ্য বিছানা থেকে উঠে এসে হাই তুলে ঘনাদা বললেন, এত রাত্রে দরজায় টোকা কেন?

    টোকা শুনেই বোধহয় বাপি দত্ত কাত। পাড়ার লোক যে আওয়াজে ডাকাত পড়ার ভয়ে এতক্ষণে হয়তো লালবাজারে ফোন করেছে তার নাম টোকা!

    কিন্তু ভেতরের বারুদ তখনও জ্বলছে। বাপি দত্ত গর্জন করে উঠল, কেন, আপনি জানেন না! কে আমার হাঁস কেটেছে?

    আমিই কেটেছি। ঘনাদা নির্বিকার।

    আপনিই কেটেছেন তা আমি জানি। নইলে এত বড় আস্পর্ধা কার হবে। কিন্তু কার হুকুমে কোন সাহসে আপনি আমার হাঁস কেটেছেনবাড়ি নিয়ে যাব বলে বাছাই করে কেনা আমার চার চারটে হাঁস!

    চারটে তো মোটে! ঘনাদা যেন দুঃখিত।

    ওঃ, চারটে হাঁস কিছু নয় আপনার কাছে! বাপি দত্ত আগুন।

    কিছুই নয়। এ পর্যন্ত কেটেছি বারোশো বত্রিশটা। আরও কত যে কাটতে হবে কে জানে! ঘনাদা তাঁর খাটের দিকে বিষণ্ণ ভাবে পা বাড়ালেন। আমরাও সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু তখুনি থামতে হল।

    যাচ্ছেন কোথায়? বাপি দত্ত হুংকার দিয়ে উঠল, আপনার ওসব গুল আমার কাছে ঝাড়বেন না। ওসব চালাকি আমি সব জানি।

    জানো! ঘনাদা যেন অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। জানো গারুসেরচ কাকে বলে!

    কী বললেন! বাপি দত্ত ক্ষিপ্ত।

    ঙগারুসেরচঙ্‌! তুমি নয়, হাঁসের নাম। ঘনাদা আশ্বস্ত করলেন, জানো, তিনশো সেরা শিকারি দুনিয়ার সমস্ত জলা জঙ্গলে এই হাঁস খুঁজে ফিরছে? জানো, একটা হাঁসের জন্য গলায় গলায় যাদের ভাব এমন দু-দুটো রাজ্য এ ওর গলা কাটতে পারে? জানো একটা হাঁসের পেট কেটে এই কলকাতা শহরটা কিনে নিয়েও যা থাকে, তাতে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা ইজারা নেওয়া যায়!

    এই শেষের কথাতেই বাপি দত্ত কাবু। তবু গলাটা চড়া রেখেই শুধোল, কী আছে সে হাঁসের পেটে? হিরে, মানিক?

    হিরে মানিক! ঘনাদা অবজ্ঞার হাসি হাসলেন, এই বুদ্ধি না হলে হাঁস শুধু এতকাল খেতেই কেনো!

    কী আছে তা হলে? বাপি দত্ত এবার উদগ্রীব।

    কী আছে? ঘনাদা জুত করে নিজের খাটের ওপর বসলেন। আমরাও যেখানে যেমন পারলাম বসলাম। শিশির সদ্য খাওয়া থেকে উঠে এসে সিগারেটের কৌটোটা আর সঙ্গে আনতে পারেনি। তার দিকে একটু ভৎসনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘনাদা গম্ভীর ভাবে বললেন, আছে একটা নস্যির কৌটো।

    নস্যির কৌটো! আমি ভাবছিলাম কলকে বুঝি কিছুর! বাপি দত্তর বিদ্রুপে কিন্তু আর তেজ নেই। খাটের ধারেই সে-ও জায়গা নিয়েছে।

    ঘনাদার মুখে তীব্র ভ্রুকুটি দেখা গেল। রাত তো অনেক হয়ে গেল, এখন শুতে গেলে হয় না। তিনি হাই তুললেন।

    আমরা সন্ত্রস্ত, বাপি দত্ত নাছোড়বান্দা। নস্যির কৌটো কেন? চার চারটে হাঁসের শোক সে প্রায় ভুলেছে মনে হল।

    কেন? উনিশশো পঁয়ত্রিশ সালের জুলাই মাসের সতেরোই তারিখে পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু মালভূমিতে তুষারঝড়ে পথ হারিয়ে মরতে বসেছিলাম বলে, দুনিয়ার সেরা শয়তান ফন ব্লুল সদলবলে নেকড়ের পালের মতো আমার পিছু নিয়েছিল বলে, প্রাণ যায় যাক, মান বাঁচাবার আর কোনও উপায় ছিল না বলে, যোল হাজার দশ ফুট উঁচু গুরলা গিরিদ্বারের তিন মাইল সোজা খাড়াই-এর পথে ভূত দেখেছিলাম বলে, আর বন্দুকের শেষ গুলিতে চাঙ্গু-টাকে মারতে পেরেছিলাম বলে!

    বাপি দত্তের মুখের হাঁটা আমাদের সকলের চেয়ে বড়।

    কোনওরকমে হাঁ বুজিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে, ভূত! ভূতের নাম চাঙ্গু? সেই ভূত গুলিতে মারলেন!

    ভূত নয়, মারলাম চাটাকে। চাঙ্গু হল ও অঞ্চলে নেকড়ে বাঘের নাম। ঘনাদা যেন ক্লান্তভাবে একটু থেমে আবার বললেন, তোমরা তো হাত মুখও ধোওনি দেখছি।

    হাত মুখ! বাপি দত্তই সবাই আগে রুমাল বার করে হাত মুখটা চটপট মুছে ফেলে বললে, নেমন্তন্ন খেতে এসেছি মনে করলেই হয়! হ্যাঁ, তারপর শুনি।

    তারপর নয়, তার আগে। ঘনাদা শুরু করলেন, কৈলাসটা চক্কর দিয়ে মানস সরোবর আর রাক্ষসতাল হয়ে টাকলাকোটে এসে তখন আটকে গেছি। টাকলাকোট ভারতে আসতে তিব্বতের শেষ গ্রাম। তার পরই বিপুলেখ গিরিদ্বার হয়ে ভারতে নামতে হয়। টাকলাকোটে এসেই শুনলাম বিপুলেখ গিরিদ্বার বরফ পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। পারাপার হওয়া মানুষের অসাধ্য! অসময়ে আসার দরুন এধরনের বিপদ যে হতে পারে তা অবশ্য আগেই জানতাম। মানস সরোবরের যাত্রীদের মরশুম অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। খাস তিব্বতিরাও এ অসময়ে শীত কাটাবার জন্যে তৈরি হয়ে গাঁ থেকে নড়ে না। টাকলাকোটের মোড়ল জানালে শীতটা আমায় তাদের গাঁয়েই কাটাতে হবে। আপত্তি করলাম না। কাছাকাছি দেখবার শোনবার অনেক কিছুই আছে। দশ বারো মাইলের মধ্যে সিম্বিলিঙ গুম্ফা, খেচরনাথ গুফা তো বটেই, তাছাড়া কিছুদূরে গেলে এ অঞ্চলে এখনও নাকি ডং পাওয়া যেতে পারে। আর ডং যদি না মেলে তো গোয়া কি চো কি না আঁধিয়ান পেলেই বা মন্দ কী?

    শিবুর কাশির শব্দে ঘনাদা থামলেন। গৌর বললে, এই সবে একপেট খেয়ে আসছি কিনা। মাথাটা কী রকম ঝিমঝিম করছে!

    একটু ভ্রূকুটি করে ঘনাদা বললেন, ও, মাথায় ঢুকছে না বুঝি! আমারই দোষ। তিব্বতের কথা বলতে সেখানকার ভাষাই এসে যায়। গোয়া আর চো হল ছোট আর বড় দু-জাতের তিব্বতি হরিণ আর না আঁধিয়ান হল সেখানকার বুনো ভেড়া।

    আর ডং বুঝি গাধা! উংকি থেকে? বাপি দত্ত সোৎসাহে শুধোলে।

    আরে না! ডং গাধা হবে কেন? ঘনাদা যেন বিশেষ তাৎপর্যের সঙ্গে বাপি দত্তের দিকে তাকালেন। ডং হল বুনো চমরি গাই। খুব কমই পাওয়া যায় আজকাল।

    হ্যাঁ, টাকলাকোটে থাকি আর এদিক সেদিক বন্দুক নিয়ে শিকারে বেরোই! শীতটা সেবার একটু আগেই পড়েছিল। যেদিকে যাই শুধু তুষার আর তুষার। জন্তু জানোয়ারও সব শীতের ভয়ে আগেই নীচে নেমে গেছে বোধহয়। বেশির ভাগ দিন শুধু হাতেই ফিরতে হয়।

    এর মধ্যে একদিন খেয়াল হল এই শীতের দিনে গিরিদ্বার থেকে আর-একবার কৈলাস আর মানস সরোবর দেখব। ভারতবর্ষ থেকে যেতে এই গুরলা গিরিদ্বার পার হবার সময়ই প্রথম কৈলাস আর মানস সরোবরের দর্শন পাওয়া যায়।

    মোড়ল মানা করলে। গুরলা গিরিদ্বার এখন বরফে মানুষের অগম্য। তা ছাড়া আকাশের লক্ষণও নাকি ভাল নয়। তবু কে কার কথা শোনে। বারফু পর্যন্ত বারো মাইল এক রকম নির্বিঘ্নেই গেলাম, তারপর কিছুদুর যেতে না যেতেই কোথায় আকাশ কোথায় মাটি আর খেয়াল রইল না। তিব্বতের তুষারঝড় যে কী বস্তু যে নিজের চোখে দেখেছে তারও বর্ণনা করতে ভাষায় কুলোবে না। একেবারে প্রলয় কাণ্ড! ছেড়া ঘুড়ির মতো সে ঝড়ে কখনও শূন্যে কখনও মাটিতে পাক খেয়ে—কোথা গিয়ে যে পৌঁছোলাম, জানি না। হাত-পাগুলো যে আস্ত আছে তাইতেই তখন অবাক।

    শিবুর কাশিটা নিশ্চয়ই ছোঁয়াচে। এবার গৌর শিশির দুজনে কাশি চাপতে গিয়ে বিষম খেয়ে কেলেঙ্কারি। ঘনাদার আগে বাপি দত্তই বিরক্ত হয়ে উঠল-কী সব কেশো রুগি এখানে জুটেছে। হাসপাতালে গেলেই তো পারো।

    কাশির রেশ মেলাবার আগেই ঘনাদা আবার ধরলেন, কিন্তু অবাক হওয়ার তখনও বাকি আছে। তুষারঝড় যেমন হঠাৎ খেপে ওঠে তেমনই হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়। গা ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দেখি, চেনা কোনও কিছুই চোখে পড়ছে না। এক-একটা বড় বড় পাহাড় ছাড়া সবই যেন নতুন। তিব্বতের তুষার-তেপান্তরে হারিয়ে যাওয়া মানে যে কী আমার চেয়ে ভাল করে আর কে জানবে। দশ দিন দশ রাত হেঁটে, মানুষের আস্তানা খুঁজে পাওয়া অসাধ্য। আর দশ দিন দশ রাত টিকলে তো! সঙ্গে তো মাত্র দিন দুয়েকের রসদ ছিল, তাও ঝড়ে কোথায় গেছে ছড়িয়ে আছে শুধু হাতের বন্দুকটি। তবু যতক্ষণ খাস ততক্ষণ আশ। যে-কোনও দিকে যাবার চেষ্টা করতেই হবে। পা বাড়াতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠলাম।

    ঝড়ের ঝাঁকানিতে শেষে মাথাই খারাপ হয়ে গেল নাকি! নইলে এ অদ্ভুত ব্যাপার কী করে সম্ভব?

    সেই জনমানবহীন ধুধু তুষার-প্রান্তরে বিশুদ্ধ ফিনিস ভাষায় কে ডাকছে—কে আছ কোথায়? কাছে এসো, আমার কথা শুনে যাও।

    গায়ে কাঁটা দিয়ে শিরদাঁড়াটার ভেতর শিরশির করে উঠল। যে দিকে চাই কোথাও মানুষ দূরে থাক, একটা কাক পক্ষীও তো নেই।

    খানিক চুপ করার পর আবার সেই ডাক এল। এবার ফরাসিতে।

    নিজের গায়ে চিমটি কাটলাম। সাতানব্বই হাজার সাতশো সাতান্নকে একাশি হাজার নশো বাইশ দিয়ে গুণ করলাম মনে মনে। না, মাথা তো খারাপ হয়নি একেবারে। এ অশরীরী আওয়াজ তা হলে কেমন করে শুনছি?

    আবার সেই ডাক। এবার ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে। আশ্চর্য, এ গলা যে খানিকটা চেনাই মনে হচ্ছে। কিন্তু তাই বা কী করে হতে পারে! সাত বছর বাদে এ গলা তো শোনবারই কথা নয়!

    মিনিট কয়েক থেমেই ঘুরে ঘুরে সেই ডাক আসছে। যেদিক থেকে ডাকটা আসছিল সেই দিকেই এবার গুটি গুটি এগুলাম। কোথাও কোনও একটা ছায়া পর্যন্ত নেই। শুধু থেকে থেকে ওই আওয়াজ।

    খানিক দূর গিয়েই একেবারে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ঝুরো তুষারে অর্ধেক প্রায় ঢাকা একটা মানুষের দেহ।

    এ কী! এ যে সত্যই ড. ক্যালিও—ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। সাত বছর আগে সিনকিয়াং থেকে তিব্বতে যাবার পথে দস্যুদের হাতে যিনি মারা পড়েছেন বলে সবাই আমরা জানি। তাঁর তিব্বতে যাওয়ার খেয়াল নিয়ে তখন লেখালেখিও হয়েছিল অনেক কাগজে।

    এবার ব্যাকুলভাবে সেখানে বসে পড়ে ড. ক্যালিওর দেহটা পরীক্ষা করলাম। না, সাত বছর আগে মারা না পড়লেও অন্তত সাত দিন আগে যে তিনি মারা গেছেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। বরফের দেশ বলে দেহটা তেমন বিকৃত হয়নি। পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ রাসায়নিকের এর চেয়ে বুঝি সাত বছর আগে দস্যর হাতে মারা যাওয়াই ভাল ছিল। এই তুষার প্রান্তরে তিল তিল করে মরতে কী কষ্টই না পেয়েছেন, কে জানে।

    পর মুহূর্তেই শরীরের লোমগুলো খাড়া হয়ে উঠল। ড. ক্যালিওর গলার স্বরে সেই ডাক আবার। তুষার-ঢাকা নিস্তব্ধ প্রান্তরে সে-ডাক কোথা থেকে আসছে? সভয়ে চেয়ে দেখলাম, তাঁর মৃতদেহ থেকে অন্তত নয়।

    উন্মাদ করে দেবার মতোই অলৌকিক ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হবে। তা রাখতে না পারলে আর সহজ-সুস্থ মানুষ হিসেবে সেখান থেকে ফিরতে হত না, আর তার পর ফন ব্রুলের সন্ধান পাওয়া যেত না।

     

    গুরলা গিরিদ্বারের প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে এই দুর্দান্ত শীতে ফন ব্রুল একান্ত নির্জনে সদলবলে তার ছাউনি যেখানে গেড়েছে সেখানে কয়েক দিন বাদে সকালে এক পথ-হারানো ডোকপা মানে রাখাল গিয়ে হাজির। তুষারঝড়ে তার সব খোয়া গেছে। উপোসে ঠাণ্ডায় সে আধমরা। একপাল চমরী আর ঝাকুস অর্থাৎ ভারতবর্ষের গোৰু আর তিব্বতের চমরী মেশানো পশু নীচের টাকলাকোটে পৌঁছে দিয়ে সে দু-জন বন্ধুর সঙ্গে কিছু রসদ নিয়ে যুগোলো গুম্ফায় ফিরছিল। মাঝে তুষার ঝড়ে কে কোথায় গেছে সে জানে না।

    ফন ব্লুল যেমন শয়তান তেমনই চৌকশ। তিব্বতি ভাষা সে ভাল করেই জানে। সামান্য একটা তিব্বতি রাখাল হলেও তবু নানারকমে প্রশ্ন করে ডোকপাকে পরীক্ষা করে তবে তাকে ছাউনিতে ঠাঁই দিলে। ছাউনি মানে গোটা পাঁচ-ছয় তাঁবু। কিন্তু তিব্বতের শীতের সঙ্গে যোঝবার মতো করে তৈরি। একটিতে থাকে ব্রুল নিজে। আর একটিতে তার অনুচরবৃন্দ আর রসদ যন্ত্রপাতি ইত্যাদি। অনুচরের ভেতর তিব্বত, লাদাক, সিনকিয়াং সব জায়গার লোকই আছে।

    ডোকপা লোকটা কাজের। একদিন খেয়ে দেয়ে একটু চাঙ্গা হয়েই শুধু কাজের গুণে সে ব্রুলের নজরে পড়ে গেল। তাঁবু পরিষ্কার, বন্দুক সাফ থেকে সাহেব-সুবোর হেন কাজ নেই, সে জানে না।

    দুদিন বাদে তাকে দিয়ে হ্যাসাক বাতি সাফ করাতে করাতে ব্লুল হঠাৎ একটা বুটের (ঠাক্কর দিয়ে জিজ্ঞাসা করলে, এই বেটা ভূত! এসব সাহেব-সুবোর কাজ শিখলি কোথায়?

    আজ্ঞে, হেডিন সাহেবের সঙ্গে ছিলাম যে কবার।

    হেডিন সাহেব! বুল অবাক। কে হেডিন?

    আজ্ঞে গরিবের মা বাপ সোয়েন হেডিন।

    ব্রুল সাহেব এবার যেন একটু হতভম্ব। সোয়েন হেডিনের সঙ্গে তুই কাজ করেছিস। তিব্বতের এ-অঞ্চল তো তুই তা হলে জানিস কিছু?

    আজ্ঞে তা আর জানি না! এমন সব পাহাড়, নদী, হ্রদের খবর রাখি, এ দেশের লোকেরাও যার নাম জানে না।

    বেশ বেশ! তোকে আমার কাজে লাগবে। বলে ব্রুল বেরিয়ে গেল, তার পরদিন তাঁবু উঠিয়ে নতুন পথে রওনা হবার ব্যবস্থা করতেই বোধহয়।

    পরের দিন পর্যন্ত ঢুলকে অপেক্ষা করতে হল না।

    সেদিনই বিকেলের দিকে কাছাকাছি বুঝি শিকারে গেছল একটু। সন্ধের পর ফিরে এসে ঘরে ডোকপাকে দেখে একটু বিরক্তই হয়ে উঠল।

    কী করছিস কী এখানে এখন, ভূত কোথাকার!

    হ্যাসাক বাতিটা তুলে এদিক ওদিকে ঘোরাতে ঘোরাতে ডোকপা বললে, আজ্ঞে, একটা জিনিস খুঁজছি।

    জিনিস খুঁজছি! হতভাগা জানোয়ার! এটা তোমার জিনিস খোঁজবার সময়! কী খুঁজছিস, কী?

    আজ্ঞে, একটু জল।

    জল! প্রথমটা ব্লুল হাসবে না রাগবে ঠিক করতে পারল না। তার পরমুহূর্তেই তার প্রকাণ্ড বাঘের মতো মুখখানা লাল হয়ে উঠল রাগে। হুংকার দিয়ে বললে, কী এখানে খুঁজছিস?

    আজ্ঞে একটু ভারী জল, ডিউটোরিয়াম অকসাইড।

    পায়ের তলায় হঠাৎ পৃথিবীটা সরে গেলেও ঝুল বোধহয় এমন চমকে উঠে ফ্যাকাশে মেরে যেত না। সামলাতে তার কিন্তু বেশিক্ষণ লাগল না। তবে রে, শয়তান! বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! বলে পাক্কা সাড়ে ছফুট দুমনী লাশটা নিয়ে ডোকপার ওপর এবার সে ঝাঁপিয়ে পড়ল। অত বড় লাশটা তো আর চারটিখানি কথা নয়! একদিকের দড়ি ছিঁড়ে তাঁবুর একটা কোণ ঝুলে পড়ল।

    হ্যাসাক বাতিটা একটু সরিয়ে রেখে বললাম, তাঁবুটা বড়ই ছোট। এর মধ্যে অত লাফালাফি দাপাদাপি কি ভাল?

    বাপি দত্ত হঠাৎ লাফ মেরে উঠল উত্তেজনায় ও! আপনিই তাহলে ডোকপা! আমিও তাই ভাবছিলাম, ডোকপাটা এল কোথা থেকে।

    করুণামিশ্রিত অবজ্ঞার সঙ্গে বাপি দত্তর দিকে একবার চেয়ে ঘনাদা আবার শুরু করলেন, গা-টা ঝেড়ে ঝুড়ে উঠে বুল বেশ একটু হতভম্ব হয়েই আমার দিকে এবার তাকাল। যা শিক্ষা ওইটুকুতেই হয়েছে তাতে গায়ের জোর পরীক্ষা করবার উৎসাহ আর তার তখন নেই। কিন্তু ভেতরের জ্বালা যাবে কোথায়! গলা দিয়েই সেটা বেরুল আগুনের হলকার মতো—কে তুই! কী মতলবে এখানে ঢুকেছিস?

    বললাম তো, শুধু একটা ভারী জলের খোঁজে। এক শিশি যে-জল এই হাইড্রোজেন বোমার যুগে বেচলে সারা জীবন পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যায়। ড. ক্যালিও প্রাণের মায়া ত্যাগ করে এই সদুর তিব্বতে এসে যে ভারী জলের এমন স্বাভাবিক এক গুপ্ত হ্রদ খুঁজে পেয়েছেন, পিপে পিপে চালান দিলেও যা একশো বছরে ফুরোবে না। ড. ক্যালিও কাজ সেরে দেশে ফেরবার মুখে নিরীহ সাধারণ পর্যটক ভেবে যে-জলের হ্রদ আবিষ্কারের কথা তোমার মতো শয়তানকে বলেছিলেন, আর ড. ক্যালিওর কাছে যে জলের হ্রদের গুপ্ত মানচিত্র কেড়ে নিয়ে তাঁকে তুষার ঝড়ের মধ্যে একলা মরতে ছেড়ে দিয়ে তুমি এখন হ্রদের সন্ধানে চলেছ।

    এসব কথা তুই জানলি কী করে! রাগে বিস্ময়ে ব্রুলের গলাটা তখন কাঁপছে।

    জানলাম ড. ক্যালিওর কাছে।

    হতে পারে না! বুল চেঁচিয়ে উঠল, ড. ক্যালিওকে কথা বলবার অবস্থায় আমি রেখে আসিনি।

    তাই নাকি! শয়তানের নিজের মুখের এই স্বীকারটুকুই চাইছিলাম।

    কোথা থেকে তুই জানলি আগে বল। ব্লুল পারলে আমায় ছিঁড়ে খায়।

    তাহলে শোন। জানলাম ড. ক্যালিওর ভূতের কাছে!

    ভুতের কাছে! ব্রুল বুঝি খেপেই যায়।

    হেসে বললাম, হ্যাঁ, ভূতের কাছে। আর জেনেছি যে ঠিক তাতে কোনও সন্দেহ আছে কি?

    কিন্তু জেনে তোর লাভ কী! হঠাৎ ব্রুল তাঁবুর ধারে রাখা তার বন্দুকটা তুলে নিয়ে আমার দিকে উঁচিয়ে তার চাল আর গলা দুই-ই পালটে ফেললে, এ-জলের হ্রদ কি তুই কখনও খুঁজে পাবি ভেবেছিস? আর পেলেও তোর মতো কালো মর্কটের কাছে ও-জল কিনবে কে?

    বিদ্রুপের হাসি হাসতে গিয়ে হঠাৎ ব্রুল থমকে আমার দিকে হাঁ করে চেয়ে রইল। টুপি সমেত মাথার চুলটা আর তিব্বতিদের চেহারার ধরনের সামান্য যে কটা দাড়ি-গোঁফ মুখে ছিল তা আমি তখন খুলে ফেলেছি।

    দাস।

    হ্যাঁ, মূলার, সেই দাস, তোমার সঙ্গে অনেক দিনের বোঝাপড়া যার বাকি। ড. ক্যালিও তোমায় নিরীহ ব্রুল বলেই জেনেছিলেন। কিন্তু আমি তোমার আসল পরিচয়টা ভুলিনি-বিজ্ঞানের কলঙ্ক, জালিয়াৎ খুনে ফাঁসির আসামি জেল-পালানো মূলার! জীবনের প্রথমে ল্যাবরেটরির রেডিয়াম চুরি করে ধরা পড়ার পর অনেকবার যে নাম পালটেছে, সে-ই!

    মূলার এবার সত্যিই হো হো করে হেসে উঠল, যাক, ভালই হয়েছে, দাস, নিজে থেকে এ সুযোগটা আমায় দিয়েছ বলে। মূলার নামটা যারা ভোলেনি তাদের সংখ্যা আমি কিছু কমাতে চাই।

    মূলার বন্দুকটা আমার দিকে বাগিয়ে ধরল। হেসে বললাম, শিকার করে তো এই ফিরলে বন্দুকে আর টোটা আছে কি? হিংস্রভাবে হেসে মূলার জবাব দিলে, আছে একটাই আর সেই একটাই তোমার মতো মর্কটকে মারবার পক্ষে যথেষ্ট।

    কিন্তু মর্কট মারা গেলে ভারী জলের হ্রদ আর খুঁজে পাবে কি?

    পাব না মানে? রাগে খিচিয়ে উঠলেও মূলারের চোখ দেখে বুঝলাম সে অত্যন্ত বিচলিত হয়েছে।

    সে ম্যাপ—ম্যাপ তুই চুরি করেছিস? রাগে মুলার প্রায় তোতলা।

    নইলে কি শুধু তোমার খিদমতগারি করতে এ তাঁবুতে ঢুকেছি! আরে, সামলে সামলে! আমায় মারলে ম্যাপ পাবে কোথায়! সে কি আমার বুক পকেটে তোমার সুবিধের জন্য রেখে দিয়েছি?

    কোথায় রেখেছিস? তবু মূলার বন্দুকটা বুঝি ছুঁড়েই দেয়।

    বলব, কিন্তু হ্রদের জলে আমার আধা বখরা চাই।

    আধা বখরা? মূলার চট করে কী ভেবে নিয়ে বললে, তাই সই। কোথায় ম্যাপ?

    বলছি বলছি, অত ব্যস্ত কেন? আগে বখরাটা কী রকম শোনো!

    কী রকম?

    যে শিশিতে এ-জল চালান যাবে সেইটে তোমার, জলটা আমার!

    কী! এই অবস্থায় এই ঠাট্টায় একেবারে চিড়বিড়িয়ে উঠে মূলার এক পলকের জন্য বুঝি একটু অসাবধান হল।

    এক হাতে বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে আর এক হাতে হ্যাসাক বাতিটা আছড়ে ফেলে আমিও তৎক্ষণাৎ তাঁবু থেকে ছুট।

    হ্যাসাক বাতিটা বৃথাই পড়েনি। ছুটতে ছুটতে দূর থেকে ফিরে দেখলাম তাঁবুগুলো দাউ দাউ করে জ্বলছে।

    কিন্তু মূলারের মতো শয়তানকে যে ওইটুকুতে ঠেকানো যায় না, পরের দিন সকালেই তা টের পেলাম।

    তিব্বতের মত উঁচু মালভূমির পাতলা হাওয়ায় প্রাণপণ ছুটে, ক্লান্তিতে খিদেয় সত্যিই তখন আমার অবস্থা কাহিল। সেই অবস্থায় মাঝারি গোছের একটা তুষার চুডোর ওপর উঠে চারদিক দেখতে গিয়ে বুকটা হঠাৎ ধ্বসে গেল।

    পিঁপড়ের মতো হলেও বহুদুরে একটা চলন্ত প্রাণীকে দেখা যাচ্ছে। সেটি আর কিছু নয়—মূলার স্বয়ং—আর তার পায়ে স্কি। শয়তানটা যে সঙ্গে স্কি-ও এনেছিল এইটিই ভাবতে পারিনি। শুধু পায়ের দৌড়ে তার সঙ্গে আর কতক্ষণ পারব! হাতের বন্দুকটা ভার হলেও ফেলে দিতে তো পারি না।

    প্রাণও যদি যায় এ-ম্যাপ মূলরাকে পেতে দেব না। এই পণ করে খোলা প্রান্তর ছেড়ে এবার পাহাড়ের গায়ে গায়ে যেতে লাগলাম। কিন্তু খিদেয় যে বত্রিশ নাড়িতে পাক দিচ্ছে। পেটে কিছু না পড়লে আর তো দাঁড়াতেই পারব না।

    হঠাৎ পাহাড়ের একটা বাঁক ঘুরেই হাতে যেন স্বর্গ পেলাম। সামনের একটা চুডোর ওপর কটা গারুসেরচঙ নামে ব্রাহ্মিণী বালিহাঁস। শীতের সময় ভারতের গরমে সব জলায় উড়ে যাবার পথে বোধহয় বিশ্রাম করতে নেমেছে। বন্দুকে একটা মাত্র গুলি, কিন্তু তাতেই আহারের সমস্যা মিটে যাবে মনে করার সঙ্গে সঙ্গেই আর-একটা মতলব বিদ্যুতের মতো মাথায় খেলে গেল।

    কিন্তু গুলি না করে হাঁস ধরি কী করে!

    সে সমস্যা ভাগ্যই মিটিয়ে দিলে। চমকে দেখি পাহাড়ের অন্যধার দিয়ে নিঃশব্দে একটা চাঙ্গু মানে নেকড়ে বাঘ ওই হাঁসের লোভেই গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসছে। দুরুদুরু বুকে বন্দুক বাগিয়ে বসে রইলাম। পাঁচ, দশ, পনেরো সেকেন্ড নেকড়েটা ঝাঁপিয়ে হাঁস ধরবার সঙ্গে সঙ্গেই গুলি। নেকড়েটা লুটিয়ে পড়ল মরে, আর তার মুখ থেকে গড়িয়ে পড়ল, ভয়েই আধমরা অজ্ঞান হাঁসটা।

    ছুটে গিয়ে হাঁসটা তুলে নিলাম। না, জখম কিছু হয়নি, শুধু ভয়েই অসাড়। দেখতে দেখতেই সাড় ফিরল তার, আর ম্যাপটা পাকিয়ে দলা করে যার মধ্যে রেখেছিলাম সেই ছোট কৌটোটা তার মুখে পুরে দিয়ে বেশ করে ঝাঁকুনি দিলাম। কোঁৎ করে হাঁসটা সে-কৌটোটা গিলে ফেলতেই তাকে শূন্যে দিলাম ঠুড়ে। পড়-পড় হয়ে দুবার পাখা ঝাপটা দিয়েই সে দূর আকাশে উধাও হয়ে গেল। বুঝলাম, হিমালয় পার

    হয়ে আর সে থামবে না। সে হাঁস এই ভারতবর্ষের না হোক, দুনিয়ার কোনওনা-কোনও জলায় শীতকালে আসেই। আজও তাকে তাই খুঁজছি। ক-জন বড় বড় বৈজ্ঞানিককে গোপনে এ কথা জানিয়েছি। তাঁদের ভাড়া করা অন্তত তিনশো শিকারিও এই খোঁজে ফিরছে।

    তা হলে এখনও হাঁসটা পাওয়া যেতে পারে? বাপি দত্ত উৎসাহিত।

    আলবত পারে। ঘনাদা নিঃসংশয়।

    কিন্তু মূলার কী করলে? বন্দুকের শব্দ পেয়েও আপনাকে ধরতে পারলে না? শিশির যেন সন্দিগ্ধ।

    তা পারল বই কী? আর তাই তার কাল হল। হাঁস উড়িয়ে দিয়ে লুকিয়ে পালাবার চেষ্টাতেই ছিলাম। কিন্তু তার আর তখন উপায় নেই। চেয়ে দেখি স্কি-তে চড়ে সে একেবারে পাহাড়ের তলায় পৌছে গেছে। স্কি ছেড়ে সে ওপরে উঠতে শুরু করল এবার। আমার হাতে খালি বন্দুক, তার হাতে গুলি-ভরা বন্দুক। চুডোর এমন জায়গায় আছি যে লুকোবারও উপায় নেই। ক্রমশই সে এগুচ্ছে। আর একটু উঠলেই অনায়াসে গুলি করতে পারবে। খালি বন্দুকটাই তার দিকে ছুঁড়ে মারলাম। সেটা বেয়াড়া একটা পাথরে ঠোক্কর খেয়ে একরাশ তুষার গুঁড়ো উড়িয়ে সশব্দে নীচে গিয়ে পড়ল। তাকে ছুঁতেও পারল না।

    কী পৈশাচিক তার আনন্দের হাসি তখন।

    আর উপায় নেই। নড়াবার মতো একটা পাথরও নেই কাছে। বরফও ঝুরো।

    নীচে মূলার তখন ভাল করে বন্দুক বাগিয়ে ধরে তাগ করছে।

    বন্দুকের গুলি তার ছুটল, কিন্তু একটু দেরিতে। মূলার তখন খাড়া পাহাড় দিয়ে তুষার গুডোর সঙ্গে গড়াতে গড়াতে নীচের বরফের নদীর মধ্যে কবর হতে চলেছে। তার সঙ্গে সেই চাঙ্গু মানে নেকড়েটাও। সেইটেরই লাশটা শেষ পর্যন্ত কিছু না পেয়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলাম।

    ঘনাদা থামতেই গৌরের বেয়াড়া প্রশ্ন আচ্ছা, নস্যির কৌটো পেলেন কোথায়? নস্যি নিতেন নাকি তিব্বতে?

    নস্যির কৌটো বলেছি বলেই—তাই না? ফিল্ম যাতে থাকে সেই ছোট অ্যালুমিনিয়ামের কৌটো। মূলারের তাঁবুতেই পেয়েছিলাম।

    এবার বাপি দত্ত আসল কথাটা তুলল, ভাগ্যিস ড. ক্যালিওর ভূত আপনাকে ডেকেছিল। তার কাছেই তো সব জানতে পারেন?

    তা ভূতই বলতে পারো, তবে আসলে জিনিসটা একটা টেপ রেকর্ডার। ঘনাদা মুখ টিপে হাসলেন।

    টেপ রেকর্ডার! আমরাও অবাক।

    হ্যাঁ, ড. ক্যালিও জন্তুজানোয়ার থেকে পাখি-টাখির আওয়াজ ও তিব্বতিদের কথাবার্তা তুলে নেবার জন্যে ওটি সঙ্গে রাখতেন। শেষ পর্যন্ত মূলারের মতলব বুঝতে পেরে ওই যন্ত্রটি কাজে লাগাবার অদ্ভুত ফন্দি বার করেন। নিজের সব কথা ওই যন্ত্রে তুলে নিয়ে ওইটিই লুকিয়ে এক জায়গায় রেখে আসতে পেরেছিলেন মারা যাবার আগে, যন্ত্রটির এমন প্যাঁচ করেছিলেন যে ফিতেটা নিজে থেকেই একবার গুটিয়ে আর একবার খুলে যায় কথাগুলোও ঘুরে ঘুরে শোনা যায়। আওয়াজ ধরে আমি যন্ত্রটা খুঁজে বার করি একটা পাথরের তলায়। অন্য কটা ফিতে থেকে বাকি কথাগুলোও কিছুটা জানতে পারি। কিন্তু যন্ত্রটা বরফের গুঁড়ো দুকে ঝড়ের ধাক্কায় পাথরে ঠোকাঠুকি খেয়ে প্রায় তখন বিকল হয়ে এসেছে। আমি কিছুটা চালাতেই একেবারে বন্ধ হয়ে যায়।

    ফিতেটা খুলে সঙ্গে আনলে পারতেন! বুনো হাঁসের পেছনে ধাওয়া করার দরকার হত না। শিবুর কেমন বাঁকা মন্তব্য।

    ঘনাদা কিছু বলবার আগে বাপি দত্তই শিবুর ওপর মারমুখো হয়ে উঠল, আনবার হলে ঘনাদা আনতেন না, আহাম্মক!

    বলা বাহুল্য বাপি দত্তই সেই থেকে ঘনাদার সবচেয়ে বড় ভক্ত।

    হাঁস খেতে খেতে আমাদের অরুচি ধরে গেল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }