Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    ঢিল

    ঘনাদা তাঁর তেতলার ঘর থেকে অকারণে কয়েকবার নীচের তলা পর্যন্ত নামাওঠা করেছেন, আমাদের আড্ডাঘরের সামনে ঘুরঘুর করেছেন খানিকক্ষণ, শুধু মান খুইয়ে ভেতরে ঢুকতে পারেননি এ পর্যন্ত।

    এখন হঠাৎ বাইরে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তিনি তাঁর বাজখাঁই গলায় আমাদের বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের নতুন চাকর বনোয়ারিকে তুলোধানা বকুনি দিচ্ছেন শোনা গেল।

    ঘনাদার কর্ণকুহরে জ্বালা ধরাবার জন্যই যে উচ্চহাসিটা ঘরে আমরা তুলেছিলাম সেটা থামিয়ে হঠাৎ ঘনাদার এ-উত্তেজনা ও তম্বির হেতুটা বোঝবার চেষ্টা করলাম।

    শিশির তার ঘর থেকে সিগারেটের টিন আনবার ছলে চট করে একবার ঘুরেও এল বারান্দা দিয়ে, ঘনাদার চোখের সামনে নতুন সিগারেটের টিন খোলাতেই যেন তন্ময় হয়ে।

    ব্যাপার কী? আমরা মুচকি হাসির সঙ্গে উৎসুক।

    ঢেলা। শিশির সিগারেটের টিনটা মাঝখানে টেবিলে রেখে একটি সংক্ষিপ্ত কথাতেই রহস্য ঘনীভূত করে তুলল।

    ঢেলা! আমরা হতভম্ব।

    আমাদের বনোয়ারি ঘনাদাকে ঢেলা মেরেছে। শিবুর বিস্মিত শঙ্কিত অভিনয়ের ধরনে আমরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি জোরেই হেসে উঠলাম। কারণে অকারণে হেসে উঠে আমাদের জটলাটা জানান দেওয়াই অবশ্য আমাদের উদ্দেশ্য।

    না হে না, ঢিল মারার চেয়ে বেশি অন্যায় করেছে। শিশির এবার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে, ঘনাদার ঘরে একটা ভাঙা কাঁচের পেপারওয়েট পড়ে থাকে, দেখেছ তো৷ বনোয়ারি ভাঙা কাঁচের ঢেলা ভেবে ঝাঁট দেবার সময় সেটি কোথায় নাকি ফেলে দিয়েছে?

    এই ব্যাপার।

    আরেক চোট আমাদের হাসির হা উঠল। ব্যাপার যাই হোক আমাদের মতলব যে হাসিল হয়েছে, সামান্য একটা ভাঙা কাঁচের ঢেলা নিয়ে ঘনাদার হইচই বাধানোতেই তা বোঝা গেল।

    ঘনাদার এখন একবার-ডাকিলেই-যাইব গোছের অবস্থা। কিন্তু সেই ডাকটি আর আমরা দিচ্ছি না। আমাদের ক-দিন যা জ্বালিয়েছেন তার একটু শোধ নিতেই হবে।

    কী বিশ্রী কটা দিনই গেছে আমাদের। আমাদের কেন, শহরসুদ্ধ সবার। করপোরেশনের কল্যাণে একটু বর্ষণেই আমাদের মেসবাড়িটি একেবারে দ্বীপ হয়ে যায় বলে আমাদের দুরবস্থা একটু বেশি।

    এদিকে আকাশ যেন ফুটো হয়ে দিনের পর দিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টিতে সমস্ত শহর থইথই, ওদিকে দেশজোড়া ধর্মঘট। মেস থেকে নড়বার উপায় নেই, কিন্তু মেসে সারাক্ষণ ভাজবার মতো ভেরেণ্ডাও কই ছাই!

    তাসপাশায় অরুচি ধরে গেছে, ক্যারম পিটে পিটে আঙুল টনটন। সময় যেন আর কাটে না।

    ঘনাদা একটু কৃপা করলেই এ বন্দীদশা শাপে বর হয়ে ওঠে, কিন্তু তিনি মুখে একেবারে যেন উর্বল তালা লাগিয়েছেন পাছে কিছু বেরিয়ে যায় এই ভয়ে।

    বড় জোর একটু হুঁ কি অ্যাঁ, হ্যাঁ কি না। তার বেশি শব্দজ্ঞানই যেন তাঁর হয়নি।

    সাধ্যসাধনার ত্রুটি আমরা করিনি, ঘুষ দিয়েছি দরাজ হাতে, কিন্তু কিছুতেই ভবি ভোলবার নয়।

    লোভ আমরা কম দেখাইনি, বাকি রাখিনি যত রকম সম্ভব উসকানি দিতে।

    বিকেলবেলা ঘনাদার ঘর খোলা দেখে এক এক করে গিয়ে ঢুকেছি। ঘনাদা আপত্তি অবশ্য করেননি, কিন্তু এমনভাবে দরজার ভেতর দিয়ে বাইরের ছাদের বৃষ্টি পড়া মনোেযোগ দিয়ে দেখেছেন যেন আমরা মশা মাছির মতো অবাঞ্ছিত হলে সইতে বাধ্য হওয়া উপদ্রব মাত্র।

    শিশির তবু সিগারেটের টিনটা খুলে ধরেছে এবং ঘনাদা অন্যমনস্কভাবে তা থেকে সিগারেট তুলে নেওয়ার পর উৎসাহিত হয়ে লাইটার জ্বেলে ধরিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞাসা করেছে, এ রকম নাগাড়ে বৃষ্টি কলকাতায় আগে হত না, না ঘনাদা?

    হুঁ, ঘনাদা সিগারেটে টান দিয়ে শব্দটুকু যেন নাকের ভেতর ধোঁয়ার সঙ্গে ছেড়েছেন।

    এসব অ্যাটম বোস থেকে হচ্ছে, বুঝছিস না? গৌর উসকে দিতে চেয়েছে, দুনিয়ার আবহাওয়া সব বদলে যাবে দেখিস, বাংলা দেশে বরফ পড়বে আর অ্যালাস্কায় চলবে লু!

    ঘনাদা একবার শুধু গৌরের দিকে চেয়েছেন মাত্র, কিন্তু সলতে ধরেনি।

    শিবু আরেক মাত্রা চড়িয়েছে এবার, তা-ই যদি হয় তো নতুন কী এমন? এই পৃথিবী একবার সত্যি উলটে গেছল জানিস? সাইবিরিয়ার তখন এ-হাল নয়। গাছপালা সবুজ ঘাস সবই ছিল। তারপর এক নিমিষে সেই সাইবিরিয়া একেবারে জমে বরফ।

    শিশির সায় দিয়ে বলেছে, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো। সাইবিরিয়ার তুষারে ঢাকা তেপান্তরে যেসব মরা ম্যামথ পাওয়া গেছে তাই থেকেই বোঝা যায় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতে ব্যাপারটা ঘটেছিল। ম্যামথের লাশগুলো পাওয়া গেছে একদম নিখুঁত তাজা। একটা লোম পর্যন্ত নষ্ট হয়নি। তাদের পেটে যে ঘাস পাওয়া গেছে তা গরম দেশে ছাড়া হয়ই না। হঠাৎ পৃথিবী উলটে না গেলে ওরকম গোটা টাটকা ওসব লাশ থাকত না।

    আমরা সবাই আড়চোখে ঘনাদার দিকে চেয়েছি।

    কাকস্য পরিবেদনা।

    ইতিমধ্যে আমাদের গোপন নির্দেশমাফিক ঠাকুর তেলমাখা ডালমুট মেশানো মুড়ির কাঁসি আর বনোয়ারি চায়ের ট্রে নিয়ে এসেছে।

    ঘনাদা চায়ে চুমুক দিতে দিতে মুড়ির কাঁসিতে হাত চালাতে ভোলেননি, কিন্তু মুড়ি কড়াই চিবোনোর আওয়াজ ছাড়া মুখ দিয়ে তাঁর কিছু বার করা যায়নি।

    হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে আমাদের চলে যেতে হয়েছে। রাগও জমেছে মনে মনে।

    ঘনাদার এ-বেয়াড়াপনার কারণ যে বুঝিনি তা নয়, কিন্তু সে তো পান থেকে চুন খসার বেশি কিছু নয়। এত তোয়াজেও তার মাফ নেই!

    বৃষ্টি দুদিন নাগাড়ে পড়বার পরই ঘনাদা বায়না ধরেছিলেন খিচুড়ির সঙ্গে ইলিশ মাছ ভাজার।

    ঘনাদাকে খুশি করতে বৃষ্টির মধ্যে গৌরই গেছল বনোয়ারিকে নিয়ে বাজার করতে।

    তারপর খেতে বসে খিচুড়ির সঙ্গে পাতে মাছভাজা পড়তেই ঘনাদা আইসেনহাওয়ারের দিকে ক্রুশ্চেভের মতো ভুরু কুঁচকে গৌরের দিকে তাকিয়েছিলেন।

    গৌর শশব্যস্ত হয়ে কৈফিয়ত দিয়েছিল, ভাল ইলিশ পেলাম না, ঘনাদা-তাই পারশে নিয়ে এলাম। খেয়ে দেখুন, একেবারে আসল ক্যানিং-এর কুলীন পারশে, ইলিশের মতো হেজি-পেঁজির সঙ্গে এক জলে সাঁতরায় না পর্যন্ত।

    ঘনাদার পাতে আস্ত যে ভাজা পারশেটি পড়েছে, আমাদের সকলের পাতের লিলিপুটদের তুলনায় তা গালিভার। কিন্তু তাতে কী হয়! তখন আকাশের মেঘ ঘনাদার মুখে নেমেছে। ভাজা পার্শের সদ্ব্যবহার করতে করতে তিনি গম্ভীর মুখে যেন কাউকে উদ্দেশ না করে স্বগতোক্তি করেছেন, হুঁ, আমি আর কিছু বুঝি না! কাল ইস্টবেঙ্গল জিতেছে। আজ ইলিশ কখনও আসে!

    বোকনো-সোঝানো, খোসামোদ অনেক তারপর হয়েছে, ইলিশও এসেছে সেদিন রাত্রেই। কিন্তু ঘনাদাকে গলানো যায়নি। বৃষ্টির কটা দিন আমাদের মাঠে মারা গেছে।

    অনেক চেষ্টাচরিত্র করেও কিছু ফল না পেয়ে শেষে আমাদেরও মেজাজ গেছে। বিগড়ে! থাকুন ঘনাদা বোবা কালা হয়ে। ওঁকেও জব্দ না করে আমরা ছাড়ছি না।

    সেই জব্দ করারই ফন্দিতে সেদিন তিনটে না বাজতেই আড্ডাঘরে আমরা সবাই জড়ো। শিবুর এক মামাতো ভাই সম্প্রতি আফ্রিকায় কবছর চাকরি করে ফিরেছেন। সকালে তিনি এসেছিলেন শিবুর সঙ্গে দেখা করতে। তাঁকে পেয়েই বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল। ভদ্রলোক রসিক। সব শুনে-টুনে আমাদের সঙ্গে জুটতে আপত্তি করেননি। জীবনে কোনও দিন বন্দুক না ধরলেও ভদ্রলোকের চেহারাটা জমকালো! আমাদের কথায় আধা মিলিটারি পোশাকে বিকেলে সেজে এসেছেন। আপাতত শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ঘনাদার মৌরসি আরামকেদারায় তাঁকে বসিয়েছি, আর আমরা মুগ্ধ শ্রোতা সেজে তাঁকে নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে উচ্ছ্বাস উল্লাস বিস্ময় ও হর্ষধ্বনিতে যেন বাড়ি সরগরম করে তুলেছি।

    দুপুরের দিবানিদ্রা সেরে ওঠবার পর যথারীতি গড়গড়ায় তাম্রকূট সেবন করতে করতে ঘনাদাও নির্ঘাত সে আওয়াজ মাঝে মাঝে পেয়ে কৌতূহলী হয়েছেন। ঠাকুর রামভুজের মারফত খবরটাও তাঁর কাছে পৌঁছে দিতে ভুল হয়নি। যেমন মহলা দিয়ে শেখানো ছিল , রামভুজ সেইভাবে একটু সকাল সকালই চা নিয়ে গেছে এবং ঘনাদার প্রশ্নের অপেক্ষায় না থেকে নিজে থেকেই নালিশ জানিয়ে বলেছে, তিন বাজতে না বাজতে চা! বোলেন তো বড়বাবু, হামাদের কতো মুশকিল!

    ঘনাদা নীচের গোলমাল সম্বন্ধে প্রশ্ন করবার সুযোগ পেয়েছেন আর রামভুজ তার হিন্দি বাংলার খিচুড়িতে যতখানি সম্ভব বিস্ময় ঢেলে দিয়ে বলেছে, আরে বাস রে! বহুৎ বড়া এক শিকারি আসিয়েছে সমুন্দরকে পারসে! কেনা শের গণ্ডার হাঁথি মারিয়েছে। বাবুলোগ সব ওহি কিত্সা শুনতে আছে!

    আর ঘনাদা স্থির থাকতে পারেন!

    তারপর রামভুজও চা দিয়ে নীচে নেমেছে, আর তার প্রায় পিছু পিছুই ঘনাদা। আড্ডাঘরে একবার এসে দাঁড়াবার জন্য প্রাণটা তাঁর ছটফট করছে তখন, পারছেন

    শুধু মানের দায়ে! ছটফটানিটাই বনোয়ারির ওপর বকুনি হয়ে বেরিয়েছে, কিন্তু তাতেও যা ভেবেছিলেন তা হয়নি।

    গল্প শুনতে আমরা এমন যেন মশগুল যে ঘনাদার ওই পাড়াজাগানো চিৎকার কানেই যায়নি।

    এতক্ষণ পর্যন্ত যাওবা রাশ টানা ছিল—বনোয়ারির এক চেঙাড়ি বেগুনি ফুলুরি পাঁপরভাজা নিয়ে আড্ডাঘরে ঢোকার সঙ্গে তা ছিঁড়ে গেল।

    বনোয়ারি টেবিলের ওপর চেঙাড়িটা রেখে বেরিয়ে যাবার আগেই, যেন ঘরে কেউ আছে কি নেই খেয়াল না করে, টেবিল থেকে খবরের কাগজটা নিতেই ঘনাদা ঢুকে পড়লেন।

    ঢুকে পড়েই দাঁড়ালেন থমকে তাঁরই মৌরসিপাট্টা আরামকেদারায় শিবুর আধা মিলিটারি পোশাক-পরা মামাতো ভাইকে দেখে।

    আমরা কিন্তু তখনও যেন গল্পেই মশগুল।

    তারপর, মি. রাহা, গৌর চোখ বড় বড় করে ভয়ে বিস্ময়ে ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলে, বোমার ভেতর থেকে দুটো কিফারু তিনটে ফারু চারটে কিবাকো ছুটে আসছে আর আপনার হাতে স্রেফ একটা পাঙ্গা। কী করলেন আপনি তখন?

    ঘাস কাটলেন?

    এবার আর চমকে ফিরে ঘনাদাকে লক্ষ না করে উপায় নেই। আমাদের সকলের মুখেই হঠাৎ যেন অবাঞ্ছিত উপদ্রবে বিরক্তির ভান। কিন্তু তাতেও বিস্ময় যেন আর চাপা থাকছে না।

    ঘনাদা আমাদের দিকে অনুকম্পাভরে তাকিয়ে জ্বালা-ধরানো ব্যঙ্গের সুরে বললেন, ঘাস ছাড়া আর কী কাটবে! কারণ আফ্রিকার সোহাইলি ভাষায় ঘাস কাটবার লম্বা ধারালো ছুরিকেই পাঙ্গা বলে। তা ছাড়া বোমা হল গ্রাম কি তাঁবু-টাবুর চার ধারে গাছপালার তৈরি কাঠের দেওয়াল। তার ভেতর মানুষ থাকে, জানোয়ার সেখান থেকে বেরোয় না! আর কিবাকো যদিও হিপোপোটেমাসের সোয়াহিলি নাম, কিন্তু কিফারু আর ফারু—আলাদা জানোয়ার নয়, কিফারুকেই সংক্ষেপে বলা হয় ফারু—মানে গণ্ডার।

    আমরা ধাতস্থ হয়ে কিছু বলবার আগেই ঘনাদা রাহার দিকে আঙুল তুলে হাসিমুখে শাসানির ভঙ্গিতে বললেন, বোকাদের নিয়ে তামাশা করার স্বভাব এখনও তা হলে তোমার শোধরায়নি, কাসিম? এদের কাছে আবার রাহা হয়েছ? মনে আছে। বোদরুম-এ আমার সেই ত্রেচান্দিরি-র কথা?

    আমাদের সঙ্গে রাহারও তখন চোখ কপালে উঠেছে। প্রায় তোতলা হয়ে গিয়ে তিনি বলবার চেষ্টা করলেন, দেখুন, আমি…কী বলে…

    বুঝেছি! বুঝেছি! ঘনাদা রাহাকে কথাটা আর শেষ করতে না দিয়ে বললেন, সেসব দিনের কথা মনে করালে লজ্জা পাও একটু। সেও ভাল। তবে তোমার আর বিশেষ কী দোষ! মনিবের হুকুম তামিল করেছ মাত্র। এখানেও আজ তারই হুকুমে এসেছ জানি। দাম যা চেয়েছিলাম তা নিয়েও এসেছ নিশ্চয়, কিন্তু বড়ই দুঃখের কথা, তোমার মনিব স্যাভেজকে বোলো গিয়ে, সে-জিনিস আর তাকে দিতে পারলাম না। যার জন্যে স্যাভেজ প্রাণটা বাদে সব কিছু দিতে প্রস্তুত, সে-জিনিস আর আমার কাছে নেই!

    ঘনাদার নাক থেকে ফোঁস করে একটা স্টিম ইঞ্জিনের মতো আওয়াজ বার হল। তাঁর বোধহয় ধারণা, তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।

    আমরা তখনও অবশ্য হাঁ হয়ে আছি। রাহাই আমতা আমতা করে বললেন, আমার নাম কিন্তু, ওই কী বললেন, কাসিম নয়, আমি হলাম শিবুর মামাতো ভাই।

    অনিল রাহা।

    কী? ঘনাদা যেন আকাশ থেকে পড়ে রাহার দিকে তাকালেন, তারপর ধীরে ধীরে ভুল ভেঙে গিয়ে লজ্জা পাবার ভঙ্গিতে বললেন, ছি ছি, আমারই ভুল। আশ্চর্য কিন্তু চেহারার মিল! যাক, তবু ভাল, স্যাভেজের কাছে কথার খেলাপটা আপাতত হল না। দেখি, এখনও সেটা খুঁজে পাই কিনা!

    ঘনাদা দরজার দিকে পা বাড়ালেন।

    বলা বাহুল্য এবার আমাদেরই উঠে গিয়ে ধরে আনতে হল।

    শিবুর চোখের ইশারায় রাহা তখন আরামকেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। সেই আরামকেদারায় ঘনাদাকে প্রায় পাঁজাকোলা করে নামিয়ে দিয়ে যে যেখানে পারি বসে পড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কী খুঁজতে চান, ঘনাদা?

    ওই তোমাদের মূর্তিমান বনোয়ারি যা ফেলে দিয়েছে!ঘনাদার রাগটা যেন সঙ্গে সঙ্গে চেঙাড়ির বেগুনি ফুলুরির ওপরই গিয়ে পড়ল! শিশিরের এগিয়ে দেওয়া সিগারেটটা অগ্রাহ্য করে সেগুলো সাবাড় করবার জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন।

    বনোয়ারি ফেলে দিয়েছে? সেটা তো একটা ভাঙা কাঁচের পেপারওয়েট! আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছল।

    ভাঙা কাঁচের পেপারওয়েট!

    প্রায় অর্ধেক চেঙাড়ি শেষ করে মিনিট দশেক বাদে ঘনাদা আমার দিকে কটমটিয়ে তাকালেন, জানো, ওটা কী বস্তু? জানো, ওটা কোথা থেকে পাওয়া?

    রাস্তায় কোথাও পড়ে-উড়ে ছিল বোধ হয়! শিবুর মন্তব্য। কেউ বাজে জঞ্জাল বলে ফেলে-টেলে দিয়েছে! শিশিরের ফোড়ন।  কিংবা কেউ হয়তো কাউকে ছুঁড়ে মেরেছে! গৌরের গবেষণা।

    হ্যাঁ, ছুঁড়ে মারা জিনিসই বলতে পারো ঘনাদার মুখে রাগের বদলে আমাদের ওপর অবজ্ঞা মেশানো অনুকম্পাই ফুটে উঠল, ছুঁড়ে মারা একটা ঢিলই বটে। ওই ঢিলের কল্যাণে ভারতবর্ষের ইতিহাস যদিও বদলে লেখা যেত। কিন্তু ঢিলটা কোথা থেকে এসেছে, ভাবতে পারো?

    আর ঘনাদাকে জ্বালানো উচিত হবে না, তাই মুখে অক্ষমতা ফুটিয়ে আমরা বোকা

    সেজে রইলাম এবার।

    ঘনাদাই নিজের জবাব নিজে দিলেন, এ-ঢিল এসেছে এক-কোটি দু-কোটি নয়, অন্তত দশ হাজার কোটি মাইল দূর থেকে!

    মোটে! শিবু যেন হতাশ।

    আমাদের গলায় কীরকম সব শব্দ, যা হাসি চাপবার চেষ্টা বলে ভুল হতে পারে। হ্যাঁ, তবে তার দশ-বিশ হাজার লক্ষগুণ দূর থেকেও হতে পারে। ঘনাদা নির্বিকার ভাবে বলে চললেন, অঙ্কের শূন্যগুলো যেন কালির ফোঁটা মাত্র।

    কিন্তু আমাদের সবচেয়ে দূর গ্রহ প্লুটোই তো সূর্য থেকে তিনশো ষাট কোটি মাইলের বেশি দূর নয়। গৌর বিদ্যে জাহির করলে দুদিন আগে কোথায় একটা প্রবন্ধে পড়েছিল বলে।

    হ্যাঃ, প্লুটো! ঘনাদা অবজ্ঞার নাসিকাধ্বনিতে প্লুটোকে নস্যাৎ করে বললেন, আমাদের সৌরমণ্ডলের সূর্য যে ছায়াপথ অর্থাৎ নক্ষত্রপুঞ্জের একটা নগণ্য তারা মাত্র, সেই ছায়াপথের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত কুড়ি হাজার কোটি কোটি মাইল দূর। প্লটো-টুটো নয়, এ-ঢিল সেই ছায়াপথেরও বাইরে থেকে এসেছে।

    আমাদের গলা দিয়ে কিছু বেরুবার আগেই প্রতিবাদটা যেন অনুমান করে ঘনাদা আবার বললেন, না, উল্কা নয়, এ সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, বৈজ্ঞানিকেরা এর নাম দিয়েছেন টেটাইট। উল্কার সঙ্গে এর অনেক তফাত। উল্কা আমাদের সৌরমণ্ডলের না হোক, নিজেদের এই ছায়াপথেরই জিনিস। উল্কাপিণ্ডের ভেতর অন্য সব হালকা ধাতুর সঙ্গে লোহা নিকেল থাকবেই। কিন্তু টেকটাইটে লোহা নিকেল নেই। দেখতে তা রঙিন কাঁচের গোলগাল ডেলার মতো। তার ভেতর অ্যালুমিনিয়াম আর বেরিলিয়মের রেডিয়ো-আইসোটোপও পাওয়া গেছে। টেকটাইটের সব রহস্য এখনও জানা যায়নি। কিন্তু পণ্ডিতদের ধারণা, মহাশূন্যের এ সব ঢিল আমাদের ছায়াপথের সীমানার বাইরে অন্য নক্ষত্রলোক থেকে সম্ভবত এসেছে।

    এই টেকটাইট এতদিন আপনার কাছে ছিল! আর আপনি তা হেলায় অছোয় যেখানে সেখানে ফেলে রাখতেন! শিশির অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে।

    তোমাদের ওই ধনুর্ধর বনোয়ারি না আসা পর্যন্ত তাতে তো কোনও ক্ষতি হয়নি। তোমাদের কাছে তো ওটা কাঁচের কাগজচাপা! ঘনাদা টিটকিরি দিলেন।

    যথাসম্ভব লজ্জিত হবার ভান করে বললাম, কিন্তু এ কাঁচের ঢিল থুড়ি টেটাইট আপনি পেলেন কোথায়?

    শিবুটাকে নিয়ে পারা যায় না। হঠাৎ দুম করে বলে বসল, মাথায় পড়েছিল বোধ হয়।

    আহাম্মক কোথাকার! আমরা সামলাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠলাম, দশহাজার কোটি কোটি মাইল, কি তার চেয়ে দূরের ঢিল মাথায় পড়লে কেউ বাঁচে! অবশ্য তোর মতো নিরেট মাথা হলে কথা নেই।

    ঘনাদার মুখের মেঘটা জমতে গিয়েই কেটে গেল। প্রসন্ন মুখে তিনি বললেন, না, মাথায় ওটা পড়েনি। কারুর মাথায় টেটাইট কখনও পড়েছে বলে শোনা যায়নি। যদিও টেষ্টাইট নানাদেশে মাটির ওপরেই ছড়ানো পাওয়া যায়। উষ্কাপিণ্ডের মতো মাটিতে গেঁথে যায় না। হ্যাঁ, কোথায় পেয়েছিলাম জিজ্ঞেস করছ? ও-টোইট পেয়েছিলাম বোদরুম-এ।

    ঘনাদা থামলেন।

    তারপর আমাদের মুখগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, বোদরুম শহর কোথায় জানো না নিশ্চয়! বোদরুম-এর নাম না শুনে থাকো, প্রাচীন হ্যালিকারনেসস-এর কথা আশা করি জানো। সেকালের সপ্তম আশ্চর্যের একটি আশ্চর্য। রাজা মৌসোলস-এর স্মৃতিস্তম্ভ ওইখানেই ছিল। শুধু তা-ই নয়, পাশ্চাত্য জগতের প্রথম ঐতিহাসিক হেরোডেটাস-এর ওই হল জন্মস্থান। সেকেন্দার শাহ এশিয়া জয় করতে যাওয়ার পথে হ্যালিকারনেসস ধ্বংস করে লুট করে যান। সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর পেট্রোনিয়ম বলে এক শহর গড়ে ওঠে। পেট্রোনিয়ম নামটাই তুর্কিদের মুখে বিকৃত হয়ে হয়েছে বোদরুম।

    প্রাচীন ইতিহাস যাই হোক, বোদরুম শহর এখন তুরস্কের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটা নগণ্য বন্দর মাত্র। বড় জাহাজ নয়, ঈজিয়ান সাগরের তলা থেকে স্পঞ্জ তোলা যাদের কাজ তাদেরই ত্রেচান্দিরি নৌকো সেখানে ভিড় করে থাকে।

    স্পঞ্জ তোলার ব্যবসা করার নামে একটা স্রেচান্দিরি নৌকো ভাড়া নিয়ে তখন বোদরুম-এ থাকি। ত্রেচান্দিরি নেহাত ছোট নৌকো। ঠিক লঞ্চও তাকে বলা যায় না। আমার নৌকোটি লম্বায় মাত্র কুড়ি-বাইশ হাত, পালও আছে আবার একটা ঝরঝরে পুরোনো ডিজেল মোটরও। এই দুই-এর জোরেও ঘণ্টায় ছ-সাত মাইলের বেশি যায় না।

    এ সব নৌকোর অবশ্য জোরে যাবার দরকার নেই। জায়গা বুঝে ড়ুবুরি নামিয়ে সমুদ্রের তলা থেকে স্পঞ্জ তোলাই হল তার আসল কাজ। তার জন্য চাই সত্যিকার ভাল ড়ুবুরি। বোদরুম-এর সেরা ড়ুবুরি আঙ্কা কাপকিন মানে কাপকিন খুড়ো আমার নৌকোয় কাজ করে। আমি নৌকো চালাই। আর ড়ুবুরির নিঃশ্বাসের নল ধরা থেকে অন্য ফাইফরমাশ খাটে স্যামি বলে এক নিগ্রো ছোকরা। বোদরুম আর কারাবাকলা দ্বীপের মাঝে চুকা প্রণালী থেকে কুমালি অন্তরীপ ঘুরে সিমি দ্বীপ পর্যন্ত আমাদের ত্রেচান্দিরি ঘোরাফেরা করে। কিন্তু স্পঞ্জ তোলা আর হয় না।

    মাস দুয়েক বিনা কাজে মাইনে নিয়ে কাপকিন খুড়োই একদিন বেঁকে দাঁড়াল। খুড়োর সঙ্গে এই দুমাসে আমার একটা সত্যিকার স্নেহের সম্পর্কই গড়ে উঠেছে। ত্রেচান্দিরির পাটাতনে বসে দুজনে কফি খাচ্ছি, হঠাৎ সে আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে কফির পেয়ালাটা উপুড় করে রেখে বললে, তোমার পয়সায় আর খাব না, দাস। এই শেষ!

    কেন, হল কী খুড়ো? হেসে বললাম, আমার তো আর জাল জুয়াচুরির পয়সা নয়। আর তা ছাড়া তুমি তো নিজের রোজগারের পয়সায় খাচ্ছ!

    নিজের রোজগারের পয়সায় খাচ্ছি? খুড়ো চটে উঠে বললে, এই দুমাসে কবার ড়ুবুরির পোশাক চড়িয়েছি বলো তো? জাত ব্যবসা শেষে ভুলিয়ে ছাড়বে দেখছি। স্পঞ্জ যদি না-ই তোমার দরকার তা হলে আমাকে বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিচ্ছ কেন?

    হেসে বললাম, মাইনে কি মিছিমিছি দিচ্ছি! স্পঞ্জ তোমায় দিয়ে ভোলাব। তবে আমার তো যে-সে স্পঞ্জে চলবে না, আসল ইউস্পঞ্জিয়া অফিসিনালিস মলিসিমা

    চাই।

    আমরা শুধু কেশে উঠলাম। কিন্তু রাহা নতুন লোক—জিজ্ঞাসা না করে পারলেন না, কী বললেন?

    সব চেয়ে দামি স্পঞ্জের বৈজ্ঞানিক নাম। ঘনাদা একটু হেসে বুঝিয়ে দিলেন, চলতি নাম অবশ্য সরেস তুর্কি পেয়ালা। ওরকম নরম মোলায়েম উঁচু দরের স্পঞ্জ আর হয় না। এক সের তুলতে পারলেই শ-খানেক টাকা।

    যেন আমাদের প্রতিবাদের আশায় একটু থেমে ঘনাদা আবার বলতে শুরু করলেন, কিন্তু যা-ই বলি, কাপকিন খুড়োকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। খানিক চুপ করে থেকে সে গম্ভীর হয়ে বললে, তোমার মতলব আমি বুঝেছি!

    কী আমার মতলব? আমি অবাক হবার ভান করলাম।

    আচ্ছা তোমার মতলবই হাসিল করব, বলে খুড়ো সেই যে চুপ করল আর তার কাছ থেকে কোনও কথা বার করতে পারলাম না।

    সত্যি করে মুখ সে খুলল প্রায় দু হপ্তা বাদে। বোদরুম থেকে বেরিয়ে কুমালি অন্তরীপ ঘুরে সিমি দ্বীপের উত্তর দিয়ে তখন মার্মারিস উপসাগরের ভেতর ঢুকে এক সন্ধ্যায় আমরা নোঙর ফেলেছি।

    এতদিন সাধারণ দরকারি আলাপ ছাড়া দুজনের মধ্যে এই অজানা পাড়ির ব্যাপারে কোনও কথাই হয়নি। এবারের যাত্রার আয়োজন খুড়ো কাপকিন একাই সব করেছে আমায় চুপ করে শুধু দেখতে বলে। আমাদের ত্রেচান্দিরিতে এবার মাসখানেকের রসদ তো আছেই, তা ছাড়া আছে ড়ুবুরির পোশাকের বদলে দুজনের অ্যাকোয়া-লাংস বা জল-ফুলফুস। কাঁচের মুখোশ সুদ্ধ এই অ্যাকোয়া-লাংসের হাওয়ার থলি পিঠে বেঁধে আর পায়ে ফ্লিপার বা পা-ডানা পরে সমুদ্রের তলায় মাছের মতোই চরে বেড়ানো যায়।

    নোঙর যেখানে আমরা ফেলেছিলাম সে জায়গাটা একেবারে নির্জন। আমাদের বাঁ দিকে পাথুরে জনমানবহীন সমুদ্রতীর। উত্তরে সংকীর্ণ উপসাগরের ওপারে সন্ধ্যার অন্ধকারে কয়েকটা ঝাপসা পাহাড় মিলিয়ে আসছে।

    অন্ধকার আরও গাঢ় হবার পর পাটাতনে বসে তুর্কি হুঁকোয় তামাক থেকে খেতে খুড়ো প্রথম আমাদের এবারের পাড়ির আসল উদ্দেশ্যের কথা তুললে।

    হেসে বললে, এখানে কী আছে, জানো তো?

    বোকা সেজে বললাম, যে স্পঞ্জের জুড়ি নেই সেই সরেস তুর্কি পেয়ালা বোধ হয়!

    হুঁ, তুর্কি পেয়ালাই বটে। খুড়ো হেসে উঠে বললে, আর চালাকিতে দরকার নেই। শোনো তা হলে—যে খবর আমার সঙ্গে কবরেই নিয়ে যাব ঠিক করেছিলাম তা-ই আজ তোমার কাছে বলছি। বলছি তোমার ওপর আমার মায়া পড়ে গেছে বলে। আর তোমার চামড়া কালো বলে। এই খবর নেবার জন্যে টাকা যাদের কাছে খোলামকুচি সেরকম কত মার্কিন আমির আমায় সোনায় মুড়ে দিতে চেয়েছে। বুড়ো হয়ে আসছি। ড়ুবুরির কাজ করতে করতে একদিন হয়তো দম ফেটে কি পক্ষাঘাত হয়ে মরব। ওদের কাছে এ-খবর বেচে সেই টাকায় শেষ বয়সটা পায়ের ওপর পা দিয়ে কাটাতে পারি। কিন্তু তবু ওদের এ খোঁজ আমি দিইনি, দেব না। চাঁদির জোরে ওরা ধরাকে সরা দেখছে, দুনিয়ার সব জিনিস ওরা যেন পয়সা দিলেই কিনতে পারে। এখানে এই সমুদ্রের তলায় যা আছে ওরা তা চায় শুধু নিজেদের বাড়িতে, বড় জোর জাদুঘরে, রেখে জাঁক দেখাবার জন্য। আমাকে দু বছর ধরে লোভ দেখিয়ে, এমনকী শাসিয়ে, যে অতিষ্ঠ করে মারছে তার এ সব জিনিসের ওপর ভক্তিশ্রদ্ধাও নেই। সে শুধু মালিক হবার দেমাকেই দুনিয়ার সব কিছু দুর্লভ জিনিস কিনতে চায়। কানাঘুষায় আমার এ আবিষ্কারের কথা সে শুনেছে, কিন্তু রাজত্বের লোভ দেখিয়েও পেটের কথা বার করতে পারেনি।

    খুড়োর কথা শুনতে শুনতে মাথায় যেন ঘোর লাগছিল। ধরা গলায় বললাম, সত্যিই এমন দুর্লভ জিনিস এখানে আছে?

    আছে, আছে। সকালেই ড়ুব দিয়ে নিজের চোখে দেখতে পাবে। পাঁচ বছর আগে স্পঞ্জের খোঁজে এ অঞ্চলে এসে দৈবাৎ আমি আবিষ্কার করি। বোদরুম-এ ফিরে গিয়ে দু-চার জন ইয়ার বন্ধুর কাছে আসল জায়গায় হদিস না দিলেও একটু-আধটু গল্প করেছিলাম। তাই থেকেই ওই সব শকুনগুলোর টনক নড়েছে। কিন্তু তারাও কল্পনা করতে পারে না কী ঐশ্বর্য এই নোনা জলের তলায় লুকোনো আছে। আমি আধামুখখু ড়ুবুরি, কিন্তু ডাঙার ওপর বেকুফ হলেও ড়ুব দিলেই আমি খলিফা। জলের তলার জিনিস আমি চিনি। তা ছাড়া দু বছর জার্মানির এক মিউজিয়মের হয়ে ড়ুবুরির কাজও করেছি। বোরুম ছেড়ে যে-জলপথ ধরে আমরা এলাম, হাজার হাজার বছর আগে রোডস সাইপ্রাস রোম, এমনকী মিশর থেকে, এ-ই ছিল সেদিনকার পালতোলা সদাগরি জাহাজের রাস্তা। এখানকার ড়ুবো পাহাড়ে লেগে কত জাহাজ তলিয়ে গেছে। সমুদ্রের তলায় সেসব জাহাজের সওদা ছড়ানো। সেযুগের আশ্চর্য সব জিনিস, কাঁসার, তামার, সোনার। তা ছাড়া অ্যাস্ফোরা যাকে বলে সেই দুদিকে হাতল দেওয়া অপরূপ কারুকাজের গ্রিস ও রোমের মাটির পাত্র তো অঢেল। ইউরোপ আমেরিকা থেকে কত দল এসে ড়ুবুরি লাগিয়ে সেসব জিনিস খুঁজে নিয়ে গেছে, কিন্তু তারা যে সব ড়ুবো জাহাজের জিনিস পেয়েছে সেগুলো বড় জোর দু হাজার বছর আগেকার। কিন্তু এইখানে যা আছে তার বয়স কম পক্ষেও তিন হাজারের ওপর। শুধু পেতল কাঁসা সোনার জিনিস নয়, এখানে যে-জাহাজ ড়ুবেছিল তাতে ছিল কাঁসা আর এক রকম চুনা পাথরের অদ্ভুত কয়েকটা মূর্তি। সমুদ্রের তলায় এতদিন থেকেও সেগুলি একেবারে নষ্ট হয়নি। অন্য কিছু আমি ছুঁইনি, শুধু একটি ছোট বুড়ো আঙুল প্রমাণ মূর্তি কুড়িয়ে নিয়ে গেছলাম। ঘসে ধুয়ে পরিষ্কার করে সে মূর্তি একজনকে শুধু দেখাই। তিনি একজন ফরাসি পণ্ডিত। এক মিউজিয়মের হয়ে এই সব ড়ুবো জাহাজের খোঁজেই এসেছিলেন। মূর্তি দেখে তাঁর চক্ষুস্থির। চমকে বলে উঠেছিলেন, আরে, এ তো ভারতবর্ষের জিনিস। মূর্তিতে খোদাই কটা অক্ষরের মতো চিহ্ন দেখে কী একটা নামও যেন করেছিলেন। মনে পড়ছে না এখন।

    উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, মহেঞ্জদরো? হরপ্পা?

    খুড়ো উৎসাহিত হয়ে বললে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও-ই নাম। কী তাঁর আগ্রহ—কোথায় পেয়েছি জানবার। ও জিনিস এদিকের সদাগরি জাহাজে পাওয়াই নাকি কল্পনার বাইরে। লোকটা ভাল, কিন্তু তবু তাকে বলিনি কিছু। ওদেশের কাউকে এ জিনিস আবিষ্কারের বাহাদুরি নিতে দেব কেন?

    ব্যাকুল হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, জায়গা তুমি ঠিক চিনেছ তো খুড়ো?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিছু ভাবনা নেই। এখান থেকে পঞ্চাশ গজ দুরে এক ড়ুবো পাহাড়ে লেগে জাহাজটা ড়ুবেছিল। ভাগ্যক্রমে তার অনেক জিনিস ডোবা পাহাড়ের একটা গুহা গোছের গহ্বরে গিয়ে পড়েছিল। সেখান থেকে তিন হাজার বছর ধরে যখন তারা খোয়া যায়নি, তিন প্রহর রাতেও…ও কী!

    কথার মধ্যে খুড়ো হঠাৎ চিৎকার করে ওঠায় আমিও চমকে ফিরে তাকালাম। কিন্তু কোথায় কী? চারিদিক একেবারে অন্ধকারে লেপা।

    কী, দেখলে কী খুড়ো? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

    একটা আলো। ওই দূরের সমুদ্রের বাঁকটার কাছে যেন জ্বলেই নিবে গেল!

    এখানে আলো কোথা থেকে আসবে? আর ভুলে কোন নৌকো কি জাহাজ যদি এসেও থাকে, আলো জ্বলেই নিবে যাবে কেন? ও তোমার মনের ভুল।

    তাই হবে বলে খুড়ো সায় দিলে।

    কিন্তু খুড়োর মনের ভুল যে নয়, সাংঘাতিক ভাবে বুঝলাম তার পরের দিন ভোর হতেই।

    উত্তেজনায় প্রথম দিকটা ভাল করে ঘুমই হয়নি। মহেঞ্জদরোর মূর্তি বলতে তো ব্রোঞ্জ বা অ্যালাবাস্টারের তৈরি কোনও দেবীমূর্তিই হবে। ফরাসি পণ্ডিত যদি অক্ষর দেখে মহেঞ্জদরোর বলে চিনে থাকেন তা হলে এ মূর্তিতে সেই মহেঞ্জদরোর মার্কামারা গড়ন নিশ্চয় আছে। এ মূর্তি এখানে পেলে তো ইতিহাস বদলে লিখতে হবে। ভারতের সিন্ধুনদের প্রাচীন সভ্যতার সঙ্গে এদিকের যোগাযোগের এর চেয়ে স্পষ্ট প্রমাণ তো আর হতে পারে না! এই মূর্তি যদি সত্যি এখানে উদ্ধার করতে পারি তো আমায় পায় কে?

    অর্ধেক রাত এই সব ভাবনায় কাটিয়ে শেষে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোরের দিকে খুডোর ঠেলাঠেলিতে ধড়মড় করে জেগে উঠলাম।

    সর্বনাশ হয়ে গেছে, বেটা দাস।

    কী সর্বনাশ, খুড়ো! চোখ রগড়ে তখন উঠে বসেছি।

    আমাদের অ্যাকোয়া-লাংস দুটোই কে চুরি করে নিয়ে গেছে!

    চুরি করে? এই জনমানবহীন জায়গায় আমাদের নৌকো থেকে? এ কী ভুতুড়ে কাণ্ড নাকি।

    ভুতুড়ে নয়। কাল আমি ভুল দেখিনি। দুরের সমুদ্রে একটা আলো কাল সত্যিই জ্বলেছিল। সে আলো জ্বলা আর আমাদের নৌকোয় চুরির রহস্যের পেছনে কী আছে তা-ও আমি বুঝেছি। কিন্তু চলল। এখন ফিরে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

    ফিরেই গেলাম তারপর।

    হপ্তাখানেক বাদে বোদরুম-এর বন্দরে আমাদের ত্রেচান্দিরি ঠেকতে না ঠেকতেই খুড়ো লাফিয়ে পড়ল জেটির ওপরে।

    এখুনি কোথায় যাচ্ছ, খুড়ো? অবাক হয়ে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলাম।

    আঙুল তুলে খুড়ো যা দেখাল সেটা দুরের বড় জেটিতে বাঁধা একটা ঝকঝকে ছোটখাটো শৌখিন জাহাজ।

    আরে, ওটা তো বোদরুম শহরটাই যে প্রায় কিনে রেখেছে সেই স্যাভেজ সাহেবের কেচ—আমিও তখন নেমে খুড়োর পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি।

    খুড়ো আমার দিকে অদ্ভুতভাবে খানিক চেয়ে থেকে বললে, এখনও তুমি কিছু বোঝনি! ওই স্যাভেজ সাহেবের সঙ্গেই আমার বোঝাপড়া। লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে যা পারেনি, স্যাভেজ শয়তানি করে সেই কাজ হাসিল করেছে এতদিনে। সেদিন ওই কেচ-এর আলোই এক মুহূর্তের জন্যে দেখেছিলাম। লুকিয়ে পিছু নিয়ে আসল জায়গাটা জেনে নিতে দুরে ও জাহাজের আলো নিবিয়ে অপেক্ষা করছিল। অসাবধানে একবার বুঝি কোনও আলো হঠাৎ জ্বলে ওঠে। আমি আহাম্মক, তাই সাবধান হইনি। রাত্রের অন্ধকারে আমাদের ঘুমের সুযোগ নিয়ে কেউ সাঁতরে এসে আমাদের ক্ৰেচান্দিরিতে ওঠে। তারপর অ্যাকোয়ালাংস দুটি চুরি করে আমাদের ফুটো করে দিয়ে যায়। আমরা ওখান থেকে যতদিনে এসেছি তার মধ্যে ওখানকার সব কিছু নিশ্চয় লুট করেই ওই জাহাজ ফিরেছে। আমাদের সাতদিনের রাস্তা ও কেচ-এর কাছে একদিনের ওয়াস্তা। না, আমায় বাধা দিয়ো না। যত বড় বিদেশি আমিরই হোক, তুরস্কের বুকে বসে এ শয়তানি করার শোধ আমি নেবই।

    খুড়ো কাপকিন চলে গেল। চেহারা তার দশাশই পালোয়ানের মতো হলেও সরল হাসি-মাখানো মুখই এতদিন দেখেছি। কিন্তু আজ যেন সে সত্যি খ্যাপা দানব হয়ে উঠেছে।

    সমস্ত সকাল খুড়োর জন্য বৃথাই অপেক্ষা করলাম। দুপুরবেলা খবর এল হাসপাতাল থেকে। আঙ্কা কাপকিন নাকি জেটি থেকে পড়ে গিয়ে দারুণ জখম হয়েছে। এখুনি আমার যাওয়া দরকার।

    গিয়ে যা দেখলাম তাতে শরীরের সমস্ত রক্ত আগুন হয়ে উঠল। খুডোর প্রায় সর্বাঙ্গে ব্যান্ডেজ। আমার দিকে করুণ চোখে চেয়ে বললে, পারলাম না, বেটা দাস, পারলাম না। স্বয়ং যমকে যে ও পাহারায় রেখেছে কেমন করে জানব।

    আচ্ছা, যমের চেহারাটাই একবার দেখে আসি, বলে উঠে পড়লাম।

    ওই অবস্থাতেই কাতরে উঠে খুড়ো বললে, না না, যেয়ো না তুমি, দাস। সে যে কী ভয়ানক দৈত্য তুমি ভাবতে পারো না, তোমায় খুঁড়িয়ে পিষে ফেলবে।

    কোনও উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে গেলাম।

    সেখান থেকে সোজা জেটিতে স্যাভেজ সাহেবের কেচ-এ।

    জেটি থেকে জাহাজে পা দিতেই সামনের এক কেবিন থেকে একজন বেরিয়ে এসে অত্যন্ত অমায়িক ভাবে হেসে বললেন, আসুন, আসুন—জাহাজ দেখতে এসেছেন বুঝি? আপনার নামটা একটু জানতে পারি?

    নামটা জানা কি বিশেষ দরকার?

    আজ্ঞে হ্যাঁ, মিছরির মতো মিষ্টিগলায় সে বললে, কার পায়ের ধুলো এ জাহাজে পড়ল আমাদের একটু জানতে ইচ্ছে হয় বইকি!

    বেশ। সাধু ইচ্ছে। নামটা মুখস্থ করে নিন। দাস, ঘনশ্যাম দাস। আপনার নামটা তা হলে?

    অধীনের নাম কাসিম। বিনয়ে লোকটা যেন গলে যাবে। লোকটাকে একটু ভাল করে লক্ষ করলাম। তুর্কি না গ্রিক, মিশরি না সিরিয়ান কিছুই বোঝা যায় না। এমনকী বাঙালিও ভাবা যায়। অবিকল এই রাহার মতো চেহারা।

    নাম তো জেনেছেন, কড়া গলায় এবার বললাম, এখন জাহাজটা একটু ঘুরে দেখতে পারি?

    নিশ্চয়, নিশ্চয়। শুধু ঘুরে দেখতেই চান বুঝি? বিনয়ের অবতার জিজ্ঞাসা করলে।

    না, শুধু ঘুরে দেখতে নয়, জাহাজের মালিক স্যাভেজ সাহেবের একটা পাওনাও মিটিয়ে দিতে। পাওনাটা আঙ্কা কাপকিনের হয়ে।

    তা হলে সে পাওনা আমাকেই দিতে পারিস, মর্কট!

    বাজ পড়ার মতো পিলে-চমকানো আওয়াজে পেছন ফিরে চেয়ে সত্যিই খুশি হলাম। একটা চেহারার মতো চেহারা বটে! জমাট কালো লোহার তৈরি একটা বিরাট দৈত্য! পরনে খাটো প্যান্ট আর একটা সোয়েটার। শরীরে ইস্পাতের পেশিগুলো একটু ফোলালেই যেন সে সোয়েটার ফাটিয়ে দেবে।

    সসম্ভ্রমে বললাম, ও, আপনাকেই! কিন্তু খোদ স্যাভেজ সাহেবকে দিলেই ভাল হয় না?

    তা হলে তো স্যাভেজ সাহেবের নাগাল পাবার জন্যে তোকে তুলে ধরতে হয়। ক্রেনের মতো শক্ত এক হাতেই আমার টুটিটা ধরে সে শূন্যে আমায় তুলে ফেললে।

    আরে করেন কী! করেন কী! ভয় পেয়ে যাচ্ছি যে! কাতর ভাবে বললাম।

    সোনা বাঁধানো দাঁত একটু ফাঁক করে শয়তানের মতো হেসে সে আমায় ওপর থেকেই ছেড়ে দিয়ে বললে, কী! শখ মিটেছে? স্যাভেজ সাহেবের নাগাল আর পেতে চাস?

    তা চাই বই কী! আমি তাঁর নাগাল না পেলে তাঁরই বা তাঁর হয়ে আপনারই আমার নাগাল পাওয়া দরকার।

    এক টানে ডেকের ওপর থুবড়ে পড়ার পর সেই সাক্ষাৎ যমের ভাঁটার মতো চোখ দুটো যেন টাটার কারখানার ফারনেস হয়ে উঠল।

    তবে রে, নোংরা উকুন! লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কলের মুগুরের মতো সে একটি ঘুষি চালাল।

    জাহাজের রেলিংগুলো মজবুত। ভাঙল না, একটু বেঁকে গেল মাত্র। ধীরেসুস্থে গিয়ে তাকে তুলে ধরে বললাম, লাগল নাকি আপনার? আহা, আমাদের আঙ্কা কাপকিনেরও লেগেছিল। তবে এটা বোধ হয় অত লাগবে না।

    এবার তুলতে হল কেবিনের ভেতর থেকে। দরজাটা পলকা ভেঙে গেছে।

    মাপ করবেন। তুলে ধরে সবিনয়ে বললাম, ভুলে ডানদিকে মেরে ফেলেছি। আঙ্কা কাপকিনের বাঁ চোয়ালটা ভেঙেছিল।

    ডেকের ওপর থেকে আবার তাকে তুলে ধরেছি এমন সময় পেছন থেকে গলা-ছাড়া হাসির শব্দের সঙ্গে শুনতে পেলাম—আরে! আরে! করছেন কী? গুণ্ডাদের মতো মারপিট করে কখনও আপনার মতো লোক!

    যমপুরুষকে ডেকের ওপরেই গড়িয়ে দিয়ে ফিরে দাঁড়ালাম।

    হ্যাঁ, স্বয়ং শ্যাভেজই এসে হাজির হয়েছেন। নামে স্যাভেজ বটে, কিন্তু চেহারায় যেন গোলগাল হাসিখুশি সদাশিব। আমার দিকে চেয়ে হাসছেন, যেন কতকালের চেনা।

    আমিও হেসেই বললাম, কী করব, বলুন। গুণ্ডা পোষবার মতো পয়সা তো নেই, তাই নিজেকেই কষ্ট করতে হয়।

    আপনি যেন বড্ড রেগেছেন মনে হচ্ছে! স্যাভেজ হেসে উঠলেন আবার।

    হ্যাঁ, আমারও সেই রকম সন্দেহ হচ্ছে। তবে আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করলেই বোধহয় সব রাগ জল হয়ে যাবে।

    তা হলে আর ভাবনা কী! আসুন, আসুন, যত খুশি আলাপ করবেন। স্যাভেজ আমাকে তাঁর খাস কেবিনের দিকে নিয়ে চললেন।

    যেতে যেতে বললাম, আপনার ওই পুষ্যিটিকে একটু হাসপাতালে পাঠালে হত! আঙ্কা কাপকিনের পাশে একটা বেড বোধহয় খালি আছে এখনও।

    স্যাভেজ হেসে উঠে বললেন, যা বলেছেন। দুজনের পাশাপাশি থাকাই ভাল। ততক্ষণে স্যাভেজের খাস কেবিনে আমরা পৌছে গেছি। বসুন, বসুন। আলাপ করা যাক।স্যাভেজ একটা সোফা আমায় দেখিয়ে দিলেন।

    না, বসবার দরকার হবে না। আলাপও বেশি কিছু করবার নেই। শুধু মারমারিসের উপসাগরের ডোবা জাহাজ থেকে কী আনলেন একটু যদি জানান।

    কী যে বলেন? স্যাভেজের আবার সেই প্রাণখোলা হাসি। ওখানে ডোবা জাহাজ আছে নাকি? আর থাকলেও তাতে আছে কী!

    যা-ই থাক, আমার দরকার শুধু কয়েকটা ব্রোঞ্জ আর অ্যালাবাস্টারের মূর্তির। শুধু সেইগুলোর জন্যই আপনাকে বিরক্ত করতে আসা।

    বিলক্ষণ! বিরক্ত আবার কীসের! কিন্তু মূর্তি-টুর্তি আমি পাব কোথায়? আমার নানান জিনিস জোগাড় করবার বাতিক আছে বটে। কিন্তু এখানে তো শখ করে বেড়াতে এসেছি। এই যা দেখছেন, তা ছাড়া কিছু এ-জাহাজে নেই।

    কেবিনের চারিদিকে সাজানো জিনিসগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে বললাম, এ ছাড়া আর কিছুর কথা তা হলে আপনার মনে পড়ছে না? আপনার স্মরণশক্তিটা সত্যি দুর্বল দেখছি। একটা দাওয়াই দেওয়াই দরকার। আচ্ছা, এখান থেকে একটা কিছু যদি নিয়ে যাই কেমন হয়? যেটা নেই সেটার কথা ভাবতে ভাবতে যা আছে তার কথা মনে পড়ে যেতে পারে।

    আপনার হেঁয়ালি বুঝলাম না, তবে নিন না আপনি যা খুশি! স্যাভেজ উদার হয়ে উঠলেন।

    পাশের টেবিলের ওপর কটা কাগজপত্র যা দিয়ে চাপা দেওয়া ছিল সেইটে তুলে নিয়ে বললাম, এইটেই তা হলে নিই।

    এক পলকের জন্যে স্যাভেজের মুখ ফ্যাকাসে মেরে গেল। তারপরেই হেসে উঠে তিনি বললেন, আরে এত ভাল ভাল জিনিস থাকতে ওই একটা ভাঙা সস্তা পেপারওয়েট নিচ্ছেন!

    সস্তা যদি হয় তত আপনার আপত্তি কীসের! এ তো আর যে জিনিস সংগ্রহ করবার জন্য আপনি ফতুর হতে প্রস্তুত, আপনার চেয়ে যে জিনিসের দুর্লভ সংগ্রহ দুনিয়ার কারুর নেই সেই টেকটাইট নয়!—উঁহু, ওদিকে ঘেঁষতে যাবেন না, স্যাভেজ! কে জানে ওই ড্রয়ারে হয়তো একটা পিস্তল-টিস্তল থাকতে পারে। আপনার যেরকম মুখের চেহারা হয়েছে তাতে পিস্তল হাতে পেলে এই সামান্য পেপার-ওয়েটটার জন্য আপনি হয়তো ছুঁড়েই বসবেন?

    এক লাফে টেবিলটার কাছে গিয়ে ড্রয়ারটা খুলে পিস্তলটা বার করে নিলাম। তারপর দরজা দিয়ে রেলিং ডিঙিয়ে সমুদ্রের জলে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, আমি গরিব চাষাড়ে মানুষ, টেক্টাইটের আর কী জানি। নিজের দেশের বাড়িতেও রেখে আসতে সাহস না করে আপনি সঙ্গে সঙ্গে নিজের কাছে নিয়ে ফেরেন বলে এইটেই দুনিয়ার সবচেয়ে দুর্লভ টেষ্টাইট মনে করে নিয়ে চললাম। সেই মূর্তিগুলোর কথা যদি কখনও মনে পড়ে তা হলে আমার কাছে পৌঁছে দিলেই এ-টেকটাইট থুড়ি পেপারওয়েট ফেরত পাবেন। আমার নামটা আপনার কাসিম জানে, ঠিকানাও একটা যাবার সময় দিয়ে যাচ্ছি।

    সেই টেকটাইট নিয়েই চলে এসেছিলাম। আশা ছিল সুবুদ্ধি হলে স্যাভেজ একদিন সেই মূর্তিগুলো ফিরিয়ে দিয়ে যাবে।

     

    ঘনাদা থামলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিশিরের দীর্ঘ নিঃশ্বাস।

    ওঃ, কী লোকসানটাই হল দুনিয়ার। এখন যদি স্যাভেজের সুবুদ্ধিও হয়, টেকটাইট না পেলে সে কি আর সে মূর্তিগুলো ফেরত দেবে! ভারতের ইতিহাসের হেঁড়া পাতাটা আর জোড়া লাগবে না।

    সব দোষ ওই বনোয়ারির!

    গৌরের আক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় মূর্তিমানের নাটকীয় আবির্ভাব।

    হামি রাস্তাসে বহুত খুঁজে খুঁজে আনলাম হুজুর। ভাল কোরে ধোকে আনিয়েছি! কাঁচুমাচু মুখে ভেতরে ঢুকে টেবিলের ওপর যে জিনিসটি বনোয়ারি রাখল তার দিকে চেয়ে আমরা একেবারে থ!

    হুররে! শিবু চেঁচিয়ে উঠল, এই তো সেই সাত রাজার ধন এক মানিক। ছায়াপথের ওপারের ঢিল! ইতিহাসের হারানো খেই টেনে বার করবার চুম্বক!

    এই? এই আমার সেই টেকটাইট! ঘৃণাভরে টেবিল থেকে কাঁচের ঢেলাটা ফেলে দিয়ে শিশিরের সিগারেটের টিনটা প্রায় ছোঁ মেরে নিয়ে ঘনাদা গট গট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

    পেপারওয়েট, থুড়ি ঘনাদার টেকটাইট মেঝেয় পড়ে চুরমার।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }