Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    ছুঁচ

    আগুন! আগুন!

    সত্যিকার আগুন নয়, ঘনাদাকে তাতাবার একটা ফিকির। ফিকিরটা একেবারে মাঠে মারা যায়নি। ঘনাদা তাঁর সান্ধ্যভ্রমণ সেরে এসে বসবার ঘরে ঢুকতে গিয়ে এক পা চৌকাঠের এপারে চালিয়ে সভয়ে থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখের চেহারাটা দেখবার মতো। প্রায় পিছু ফিরে ছুট মারেন আর কী!

    শেষ পর্যন্ত আমাদের জমায়েত হয়ে বসার ধরনেই বোধহয় সাহস পেয়ে নিজেকে সামলে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘরে এসে ঢুকে তাচ্ছিল্যভরে জিজ্ঞাসা করলেন, কোথায় আগুন হে!

    শিশির ঘনাদার মৌরসি আরাম-কেদারাটা সসম্রমে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আজ্ঞে, বাজারের কথা বলছি।

    আরামকেদারায় নিজেকে এলিয়ে দিয়ে ঘনাদা মৃদু কৌতূহল প্রকাশ করলেন, বাজারে আগুন লেগেছে নাকি?

    আজ্ঞে, লেগেছে তো অনেক দিনই। ক্রমশই বাড়ছে যে! শিবু উদ্বেগ দেখালে।

    বাড়বে, আরও বাড়বে! ঘনাদার নির্লিপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী।

    কী বলছেন, ঘনাদা! তা হলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। এখনই তো কোনও জিনিস ছোঁবার জো নেই। আলু বারো আনা, বাঁধাকপি দেড় টাকা, মাংস চার টাকা, মাছ সাত টাকা।

    আজই সকালের বাজারটা নিজের হাতে করতে হয়েছে বলে যতখানি রয় সয় বাড়িয়ে ফিরিস্তি দিলাম।

    কিন্তু ঘনাদা তাতেও অবিচলিত। নিশ্চিন্ত ভাবে বললেন, ও তো কিছুই নয়। কলির এই তো সবে সন্ধে!

    গৌরকে এবার উলটো দিক থেকে আঁচ দিতে হল। ঘনাদাকেই সমর্থন করে আমাদের জ্ঞান বিতরণ করে বললে, মানুষ কী রেটে বাড়ছে জানিস! পঞ্চাশ বছরে মানুষের ভারেই মেদিনী টলমল করবে। ডাঙার ফসলে তো কুলোবেই না, সমুদ্রে চাষ করেও কূল পাওয়া যাবে না। উপোস করে মরতে হবে।

    গৌরের এ বক্তৃতায় কিছুটা বুঝি কাজ হল। তিনি স্বয়ং উপস্থিত থাকতে আর কারুর মাতব্বরি সহ্য করতে ঘনাদা একান্ত নারাজ। গৌর থামবার পর একটু নাসিকাধ্বনি করে বললেন, উপোস করে মরতে হবে।

    হবে না? গৌর নিজের কথা প্রমাণ করতে ব্যস্ত হল, অত খাবার আসবে কোথা থেকে? সমুদ্রের জলের প্ল্যাঙ্কটন হেঁকে খাবার তৈরির কারখানা বসিয়েও সে রাক্ষুসে দুনিয়ার খিদে মেটাতে পারবে কি? ছাদে ছাদে অ্যালজির চাষ করেও না।

    বটে! ঘনাদার টিটকিরির ধরনে আশান্বিত হয়ে উঠলাম।

    কিন্তু ওই পর্যন্তই।

    পলতেটা ফুরফুর করে দুটো ফুলকি ছেড়েই ঠাণ্ডা। ধরল না।

    তার বদলে শিশিরের কাছে চার হাজার আটশো অষ্টাশিতম সিগারেট ধার করে ঘনাদা শিশিরেরই দেশলাই দিয়ে ধরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, আচ্ছা, উঠি।

    সেকি! এখনই উঠবেন কী! এই তো এলেন! আমরা শশব্যস্ত।

    কিন্তু ঘনাদাকে ঠেকানো গেল না। সত্যিই উঠে দাঁড়িয়ে হাই তুলে বললেন, না, একটু জরুরি কাজ রয়েছে।

    ঘনাদার জরুরি কাজ! এই সান্ধ্যভ্রমণে খিদেটা শানিয়ে আসার পর!

    আমরা কোনও রকমে হাসি চাপলাম।

    কিন্তু এত খেটে শেষে শক্ত অসুখে পড়বেন যে! শিবু গভীর সহানুভূতি জানাল, এক-আধ দিন একটু বিশ্রাম নিলে হয় না?

    ঘনাদা জবাব না দিয়ে যেভাবে ভসনার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে বেরিয়ে গেলেন, তাতে মনে হল য়ুরি গ্যাগারিনকে ভোস্টকে চড়বার মুখে আমরা যেন পিছু ডেকেছি।

    অতএব আবার মন্ত্রণাসভা বসাতে হল।

    ঘনাদাকে এবার চাগানো যায় কী করে?

    গতিক এবার মোটেই সুবিধের নয়। সমস্যাটাই গোলমেলে।

    রাগারাগি ঝগড়াঝাঁটি কিছু হয়নি যে ঘনাদা জেদ করে গুম হয়ে আছেন। দিব্যি খাচ্ছেন-দাচ্ছে, ঘুরছেন-ফিরছেন, আলাপ-সালাপ করছেন, কিন্তু আসল টোপটি গেলাতে গেলেই কেমন পিছলে বেরিয়ে যাচ্ছেন। এ ক-দিন হেন চেষ্টা নেই যে করিনি, কিন্তু সবই পণ্ডশ্রম। আমাদের জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি যেন বারুদের বদলে ভিজে বালিতে পড়ে নিবে গিয়েছে।

    এখন করা যায় কী!

    তোয়াজ করা ছেড়ে চটিয়ে দেখা যাক। শিবুর পরামর্শ।

    আহা, চটাতেই তো গেলাম। গৌরের হতাশা, কিন্তু কাজ হল কই।

    আরও কড়া দাওয়াই চাই। আমার সিদ্ধান্ত।

    আমার ধার দেওয়া সিগারেট সব ফেরত চাইব? শিশিরের দ্বিধা।

    না, তাতে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমাদের আশঙ্কা।

    তা হলে ধার বাড়িয়ে দি? একেবারে পাঁচ হাজার? শিশিরের উৎসুক জিজ্ঞাসা।

    মন্দ নয় মতলবটা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটাও বাতিল করতে হল। প্যাঁচটা পুরোনো। দাঁত কেটে গেছে। ঠিক ধরবে না।

    হঠাৎ গৌর বলে উঠল, ঠিক হয়েছে, আর ভাবনা নেই।

    কী ঠিক হয়েছে, কী? আমরা উৎসুক।

    কানের জল কী করে বেলোয়? গৌর প্রশ্ন করে নিজেই জবাব দিলে, জল ঢেলে। তাই ভাঁওতা দিয়েই ভাঁওতা বার করতে হবে।

    সেটা কী রকম?

    ভাঁওতাটা দেব কী?

    ভবি কি ভুলবে?

    আমাদের প্রত্যেকের নানারকম সন্দেহ।

    চল, দেখাই যাক না।

    আমাদের তেতলার সিঁড়ির নীচে দাঁড় করিয়ে রেখে গৌর ঘরের মধ্যে কী করতে গেল জানি না।

    খানিকবাদে যখন বেরিয়ে এল তখন হাতে তার একটা বাঁধানো খাতা।

    আমাদের সরব ও নীরব কৌতূহল অগ্রাহ্য করে সে আগেভাগে সিঁড়ি দিয়ে বেশ একটু সশব্দেই ওপরে উঠল। আমরা তার পিছু পিছু।

    তেতলায় ঘনাদার একানে একটি ঘর। সামনে ছোট একটু খোলা ছাদ।

    সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই খোলা দরজার ভিতর দিয়ে দেখতে পেলাম ঘনাদা আমাদের পায়ের শব্দ পেয়ে তাড়াতাড়ি একটা জামা আর হাতের ছুঁচসুতোটা তক্তপোশের তলাতেই সরিয়ে ফেলে চোখের চশমাটা খুলছে।

    তাঁকে এ সব তুচ্ছ কাজ যে করতে হয়, ঘনাদা তা জানাতে চান না।

    গৌরই এখন সর্দার। কী তার প্যাঁচ না জেনে শুধু তার মুখের দিকে দৃষ্টি রেখে সকলে মিলে ভেতরে গিয়ে ঢুকলাম।

    ব্যবস্থা সব করে ফেললাম, ঘনাদা! গৌর একেবারে মূর্তিমান উৎসাহ।

    আমরাও চোখেমুখে যথাসাধ্য উজ্জ্বলতা ফুটিয়ে তুললাম দেখাদেখি।

    হুঁ, করে ফেললে তা হলে! ঘনাদা চশমাটা খাপে ভরতে ভরতে এমনভাবে মন্তব্য করলেন যেন গৌর আর তাঁর মধ্যে এক ড্রয়ার ভর্তি চিঠিপত্র চালাচালি ইতিমধ্যে হয়ে গেছে। কমিটি মিটিং-টিটিং পার হয়ে ব্যাপারটা বিশেষজ্ঞদের অনুমোদন নিয়ে এবার শুধু আইনসভায় পাস হবার অপেক্ষায়।

    আমরাই মাঝে থেকে ভ্যাবাচাকা। একবার গৌরের মুখের দিকে তাকাই, আর একবার ঘনাদার দিকে।

    সাংকেতিক গৌর-ঘনাদা সংবাদ আরও কিছুক্ষণ এমনই ভাবে চলল।

    এ তো আর ফেলে রাখবার জিনিস নয়! গৌর যদি বলে তো ঘনাদা তৎক্ষণায় সায় দিয়ে বলেন, ফেলে রাখলে চলবে কেন! সেরকম পরামর্শ কেউ দিচ্ছে বুঝি?

    দিলেই বা শুনছে কে? গৌরের মুখ থেকে খসতে না খসতে ঘনাদা বলেন, না, উচিতই নয়। এ কি একটা ছেলেখেলা!

    এর মধ্যে শিবুও আছে তা ভাবতেও পারিনি। সে হঠাৎ বলে উঠল, একটু অসুবিধে অবশ্য হবে।

    আমার একেবারে চক্ষুস্থির করে দিয়ে শিশির তাতে চটে উঠে বললে, হোক না অসুবিধে, তাতে আমরা পেছপাও নাকি! কাজের উদ্দেশ্যটা তো ভাবতে হবে।

    উদ্দেশ্যটাই তো আসল। কমল হেরি ভ্রান্ত কেন কাঁটাবনে যেতে! না না, কাঁটা হেরি শান্ত কেন কমল, কমল…ওই মানে, যা বলে আর কী! আমার মুখ দিয়েও ফস করে কী ভাবে বেরিয়ে গেল দেখে আমিই অবাক।

    মুখে মুখে পাক খেতে খেতে ব্যাপারটা যখন বেশ ঘোরালো ধোঁয়া হয়ে উঠেছে, গৌর তখন একটুখানি আলো ছাড়ল, মাটি অবশ্য অনেকটা ফেলতে হবে।

    ঘনাদার চোখদুটো একটু বড় হল কি? ও চোখ দেখে বোঝা কঠিন।

    আমরা তখন যা তোক একটা জো পেয়ে গেছি। আর আমাদের পায় কে।

    হ্যাঁ, বেশ ভাল মাটি, বললে শিশির।

    গঙ্গামাটিই ভাল। শিবু সুপরামর্শ দিলে।

    কতই বা আর খরচ! একটা ঠেলা বোঝাই করে আনলেই হবে, আমি ব্যবস্থাটাও করে ফেললাম।

    গৌর আরেকটু আলোকপাতের জন্যেই বোধহয় উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে ছাদটার দিকে তাকিয়ে যেন মনে মনে মেপে ফেলে বললে, ছোটখাটো একটা বাগান হবে— যাকে বলে, roof garden আর কী! তবে ফুল-টুল কিছু নয়, স্রেফ তরি-তরকারি। আলু-বেগুন-ঢ্যাঁড়স-ঝিঙে-পটল—পটলই বা নয় কেন?

    গৌর ঘনাদার দিকে চেয়ে তাঁকে সমর্থন জানাবার সুযোগ দিলে।

    কিন্তু ঘনাদার মুখে কোনও শব্দ নেই। শব্দ যদি বেরোয় তো মেঘের ডাকই শোনা যাবে মনে হয়। কারণ, ঘনাদা ছাড়া আর কারও মুখ হলে আষাঢ়ের মেঘের সঙ্গে তার মিলটা আরও স্পষ্ট বোঝা যেত!

    ঘনাদা কিছু বলুন না বলুন, আমাদের থামলে চলে না। আমরা ধরতাই পেয়ে গেছি।

    শিবুই ঘনাদার হয়ে জবাব দিলে, পটল নয় বা কেন, কী বলছিস! আলবৎ পটল, একশোবার পটল। পাটনাই পটল। পটলই যদি না ফলাতে পারলাম তো ছাদের উপর বাগান করা কেন? চেষ্টায় কী না হয়।

    শিবু দম নেবার জন্য থামতেই আমি ধরে নিলাম, নিশ্চয়! অ্যাব্রাহাম লিংকনের কথা মনে করো না? কুড়ুল দিয়ে সেই গাছ কাটার পর বাবা জিজ্ঞেস করতেই কী বলেছিল?

    জুৎসই দৃষ্টান্তগুলো যথাসময়ে আমার কেমন করে ঠিক জুগিয়ে যায়।

    শিশির শুধু একটু শুধরে দিলে, লিঙকন নয়, স্যার আইজ্যাক নিউটন।

    বন্ধুবিচ্ছেদের সময় এটা নয়। আমি উদারভাবে মেনে নিয়ে বললাম, ওই একই কথা। আসল ব্যাপার হল এই যে, খাদ্য বাড়াতে হবে, যেমন করে পারা, যেখানে পারো।

    গৌর দ্বিগুণ উৎসাহিত হয়ে উঠল, ঠিক বলেছ। Grow more food! পৃথিবীতে খাদ্যাভাব দিন দিন বাড়ছে, দুর্ভিক্ষ রাক্ষসী করাল মুখব্যাদান করে ক্রমশ এগিয়ে আসছে সমস্ত মানবজাতির দিকে। এখন এতটুকু জমি ফেলে রাখলে চলবে না। ছাদ, ছাদই সই।

    আর ঘনাদার ঘরের সামনেই যখন বাগান, তখন দেখাশোনা সম্বন্ধে তো ভাবতেই হবে, না! শিবু ছাদে তরি-তরকারির বাগানের সপক্ষে সব চেয়ে জোরালো যুক্তি দেখাল।

    ঘনাদা তবু নীরব। চোখদুটোতেই শুধু একটু ঝিলিক যেন দিচ্ছে। এই ঝিলিক এখন না নেভে! গৌরকেই উদ্দেশ করে বললাম, নার্সারিতে বীজ-টিজের অর্ডার দিয়েছিস তো?

    তা আর দিইনি! গৌর কর্তব্য সম্বন্ধে হুঁশিয়ারির প্রমাণ দিলে, শুধু বীজ কেন? সিৰ্জি থেকে ফসফেট, ধাপা থেকে হাড়ের গুঁড়ো-সব আনছি।

    ঘনাদা এখনও যদি ফেটে না পড়েন তা হলে তো নাচার।

    এইজন্যই বুঝি ব্রহ্মাস্ত্রটি গৌর এতক্ষণ চেপে রেখেছিল। এইবার বাঁধানো খাতাটা ভক্তিভরে ঘনাদার সামনে খুলে ধরে বলল, এখন এইটিতে শুধু একটা সই দিতে হবে ঘনাদা!

    কেন? সেফটি ভালভ প্রায় ফাটিয়ে বয়লারের যেন স্টিম বেরুল।

    এই আপনার সইটা সবার আগে থাকলে আবেদনটার দাম বাড়বে কিনা? গৌর সগর্বে জানালে।

    কীসের আবেদন?–ছাদে ধান-খেত করার?

    ঘনাদার বিদ্রুপটা গৌর গায়েই মাখলে না৷ বিনীত ভাবে বলল, না, না, ছাদে চাষ তো হচ্ছেই, তার ওপরে আরও কিছু করা তো দরকার এই খাদ্য-সংকটে। তাই আমরা সবাইকে একটা শপথ নেবার আবেদন জানাচ্ছি। এই পড়ুন না। আন্তর্জাতিক আবেদন বলে এসপেরান্টোতে লিখলাম।

    বাঁধানো খাতার প্রথম পাতাটাতেই হিজিবিজি একটা কী লেখা রয়েছে বটে, কিন্তু তার পাঠোদ্ধার করতে লিপিবিশারদ প্রত্নতাত্ত্বিকেরও ক্ষমতায় কুলোবে বলে মনে হয় না।

    ঘনাদা একবার সেদিকে চকিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন, তুমিই পড়ো।

    এসপেরান্টোটা বাংলায় অনুবাদ করেই পড়ো। আমাদের কাতর অনুরোধ।

    গৌর মূল এসপেরান্টো পড়তে না পারায় যেন বেশ ক্ষুন্ন হয়েই বাংলায় অনুবাদ করে যা শোনালে, তার মর্ম হল এই যে, পৃথিবীর অন্ন-সমস্যার আংশিক সমাধানের জন্যে আমাদের সকলকে এখন থেকেই স্বল্পাহারের শপথ নিতে হবে। আধ-পেটা যদি না পারি তো অন্তত সিকি ভাগ খাওয়া সকলে যেন ছাড়ে—এই আবেদন।

    আবেদনটা বুঝিয়ে দিয়েই গৌর সোৎসাহে জানালে, পরীক্ষাটা নিজেদের ওপরই শুরু করছি, ঘনাদা! আজ থেকেই মেসের সিকি মেনু হেঁটে দিয়েছি। কাল সকাল থেকে ভাত ডাল আর স্রেফ একটি তরকারি। মাছ হতেও পারে, না-ও হতে পারে। মাপেও সব কিছু কম। থালায় বাটিতে যা দেবার দিয়ে এক হাতা করে তুলে রাখা হবে। যাকে বলে বাধ্যতামূলক জাতীয় সঞ্চয়।

    এই? ঘনাদা নাসিকাধ্বনি করলেন।

    হ্যাঁ, আপাতত তো এই। গৌর বেশ হতভম্ব। আমরা তো বটেই।

    আপনি আরও কিছু ভেবেছেন নিশ্চয়? শিবুর উসকানির চেষ্টা।

    আরও কিছু নয়, অন্য কিছু। ঘনাদা সংক্ষিপ্ত।

    মানে গোড়াতেই আপনি অন্য কিছু বুঝেছিলেন? আমাদের বিস্ময়।

    হ্যাঁ, ভেবেছিলাম, পেটেন্টটা বুঝি নেওয়ার ব্যবস্থা করে এসেছ। আমার চুঁচটা সত্যিই ফাল হয়ে বেরিয়েছে শেষ পর্যন্ত।

    আপনার ছুঁচ! শিশির তক্তপোশের তলা থেকে ছুঁচসুষ্ঠু গুঁজে রাখা জামাটা তুলে ধরে ছুঁচটা বার করতে করতে বললে, ফাল তো হয়নি। এখনও ছুঁচই আছে দেখছি।

    ও ছুঁচ নয়। ছুঁচের মতোই সরু ছোট কাঁচের পিপেট! ঘনাদা আমাদের প্রতি করুণাকটাক্ষ করে বললেন, একবার রক্তনদী বইয়ে যা সেইসঙ্গে একদিন জলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, যা না থাকলে সূর্যদেবকে বধ করার অস্ত্র এ যুগে আর তৈরি করবার আশা মানুষকে ছাড়তে হত।

    সূর্যদেব মানে, আমাদের এই সত্যিকার আকাশের সূর্য, আপনার সেই ছুঁচেই কাত।

    এক রকম তাই বলতে পারো, ঘনাদার বলার ধরনে বোঝা গেল কোনওরকম বড়াই তাঁর পছন্দ নয়।

    শিশির ছুঁচটা রেখে দিয়ে সিগারেটের টিনটা তখন খুলে ফেলেছে।

    ঘনাদা সিগারেট তুলে নিয়ে, ধরিয়ে, গোটা দুই সুখটান দিয়ে খানিকক্ষণ চোখ দুটি বুজে চুপ করে রইলেন।

    আমরা উদগ্রীব।

    আমাদের বেশ কিছুক্ষণ আশা-নিরাশার দোলায় দুলিয়ে রেখে ঘনাদা অবশেষে চোখ মেলে তাকিয়ে ওপরের ছাদটাকেই সম্বোধন করে বললেন, তখন আমি কোথায়?

    আমরাও তখন আর নেই।

    ঘনাদার এরকম স্মৃতিভ্রংশ আমাদের কল্পনাতীত।

    তাঁর স্মরণশক্তির মরা আঁচ যথাসাধ্য চাগিয়ে তোলার আশায় যে যেমন পারি কাঠকুটো এগিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম।

    কলম্বিয়ায়? আমার কুটো।

    চুকচিদের দেশে! শিবুর প্যাঁকাটি।

    নোভালা জেমলিয়া! গৌরের ক-ফোঁটা কেরোসিন।

    আমাদেরই এই মেসে! শিশিরের এক আঁজলা জল একেবারে।

    আমরা খেপে উঠে শিশিরকে নিয়ে পড়তে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তার দরকার হল না।

    ঘনাদার চোখদুটোর সঙ্গে কান দুটোও বোধহয় ছাদেই ছিল। সেখান থেকে আমাদের দিকে কৃপা করে নামিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ইয়েমেন থেকে লালপানি পার হয়ে ইরিট্রিয়ার ওপর তখন ভাসছি। মার্কিন প্লেন, কিন্তু গাঢ় কমলা আর সবুজে ছোপানো গা, তাতে মান্ধাতার যুগের আম্‌হারিক অক্ষরে সব কিছু লেখা।

    আমার পাশের সিটের ভদ্রলোক নড়ে-চড়ে বসলেন। মনে হল সেই নড়া-চড়াতেই বুঝি প্লেনটাই টালমাটাল হয়ে গোঁত্তা মেরে পড়ে।

    প্লেনের সিটগুলো নেহাত ছোটখাটো নয়। কিন্তু ভদ্রলোক একেবারে বৃত্রাসুরের বড় ভাই। দুটো সিট ভেঙে এক করে দিলে হয়তো তিনি একটু আরাম করে বসতে পারতেন। কিন্তু তার তো উপায় নেই। ইয়েমেন থেকেই পাশের সিটে এই পাঁচমণি লাশের মৃদুমন্দ ঠেলাঠুলি ধাক্কা খেতে খেতে আসছি। তিনি স্বস্তিতে বসতে না পেরে উসখুস করছেন, সেই সঙ্গে আমিও।

    ভদ্রলোক নীচের দিকে চেয়ে হঠাৎ বললেন, এই ইরিট্রিয়া নিয়েও ইতিহাসে এত মারামারি। দেশটার চেহারা দেখেছেন!

    বললাম, যা দেখছেন তা ইরিট্রিয়া নয়।

    ইরিট্রয়া নয়!

    সামনে পেছনে ও পাশে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁরাও চমকে উঠলেন সে আওয়াজে। চমকাবার মতোই আওয়াজ। ভদ্রলোকের গলাখানি তাঁর বপুর সঙ্গেই পাল্লা দেবার মতো। সেই গলা তিনি আবার চটে উঠে ছেড়েছেন সপ্তমে।

    আশেপাশের যাত্রীরা কেউ একটু মুচকে হেসে, কেউ বিরক্তিকর কুটি করে, মুখ ফেরালেন।

    আমি শান্তভাবে বললাম, না, ইরিট্রিয়া ছাড়িয়ে ফরাসি সোমালিল্যান্ডের পাড় ছুঁয়ে আমরা এখন ইথিয়োপিয়ায় পৌছে গেছি।

    ভদ্রলোক খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে যেভাবে তাকালেন, তাতে মনে হল, জানলা ভেঙে আমায় টুপ করে বাইরে ফেলে দেবেন, না, প্লেনের ভেতরেই হাড়গোড়-ভাঙা দ বানিয়ে দেবেন, ঠিক করে উঠতে পারছেন না।

    শেষ পর্যন্ত কী ভেবে বলা যায় না, নিজেকে সামলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন গলাটা সপ্তম থেকে একটু নামিয়ে, আপনি এ সব জায়গা চেনেন? আগে এসেছেন কখনও?

    তা, আসতে-টাসতে হয় মাঝে মাঝে। একটু হেসে কবুল করলাম।

    কেন? বাজখাঁই গলার প্রশ্নে আবার প্লেনটা বুঝি কাঁপল।

    তোজোকে একটু আদর করতে।

    তোজোকে আদর করতে! কে সে?

    হেসে তাঁর দিকে ফিরে গলা নামিয়ে সাবধান করার সুরে বললাম, যা বলে ফেলেছেন, ফেলেছেন। ইথিয়োপিয়ার বুকের ওপর তাদেরই প্লেনে বসে তোজো কে, এ প্রশ্ন আর করবেন না। আগেকার দিন হলে কোতল করতেও পারত।

    কোতল করত? আমাকে! ভদ্রলোকের ওই চেহারাই আরও ফুলে ফেঁপে জামার বোতামগুলো প্রায় ঘেঁড়ে আর কী!

    তাঁকে ঘাড় কাত করে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে যেন সসম্রমে বললাম, না, আপনাকে বোধহয় সাহস করত না।

    ভদ্রলোক এবার একটু খুশি হলেন মনে হল। তাই আবার একটু টিপুনি দিয়ে বললাম, তবে নেস নাগান্তির কানে কথাটা না যাওয়াই ভাল।

    নেগুস নাগান্তি! নামটা শুনেই ভদ্রলোকের গলায় আর যেন তেমন ঝাঁজ পাওয়া গেল না। একটু হতভম্ব হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন, নেগুসই তো জানি, নেগুস নাগান্তি আবার কী? তোজোর সঙ্গে তাঁর কী সম্পর্ক?

    নেগুস বলতে বোঝায় সম্রাট আর নেগুস নাগান্তি মানে সম্রাটের সম্রাট, রাজচক্রবর্তী। তোজো হল তাঁরই পোষা চল্লিশটি সিংহের মধ্যে সবচেয়ে যেটি পেয়ারের, তার নাম। নেগুস-এর প্রাসাদে সে ছাড়াই থাকে সারাক্ষণ।

    ভদ্রলোক আমার দিকে খানিক চেয়ে থেকে কী ভাবলেন কে জানে। তারপর হঠাৎ পাশেই রাখা আমার হাতটা ধরে ফেলে করমর্দনের ছুতোয় হাড়গোড়গুলো কতখানি পলকা পরীক্ষা করতে করতে খুশিতে ডগমগ হয়ে বললেন, আপনার সঙ্গে আলাপ করে অত্যন্ত সুখী হলাম। আপনার নামটা জানতে পারি?

    হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে যেন প্রায় ককিয়ে ককিয়ে বললাম, অধীনের নাম দাস। এখন আপনার নামটা জানবার সৌভাগ্য এই গোলামের হবে?

    কথাবার্তা আরবিতেই হচ্ছিল। এ সব বিনয় সৌজন্য ও-ভাষায় জমে ভাল।

    ভদ্রলোক বাদশাহি চালেই বললেন, শেখ ইবন ফরিদ।

    ইবন ফরিদ! নামটা শুনে আমি গদগদ হয়ে উঠলাম, প্রায় সাড়ে সাতশো বছর আগে এক ইবন ফরিদ আরবকে ধন্য করেছিলেন। তাঁর কথা আর আপনাকে কী বলব। নিশ্চয় জানেন।

    তা আর জানি না। ইবন ফরিদ তাঁর আকর্ণবিস্তৃত গোঁফে চাড়া দিলেন।

    আপনিও তো তাঁর মতো টহলদার দেখছি। তিনি অবশ্য মস্ত বড় ভৌগোলিক ছিলেন। আপনি সেরকম লেখেন-টেখেন নাকি?

    আমার দিকে চেয়ে একবার চোখ মটকে হাসতে হাসতে ইবন ফরিদ বললেন, এখনও লিখিনি। তবে লিখব। সময় হলেই লিখব। আপনি তো আড্ডিস আবাবাতেই থাকবেন?

    ইচ্ছে তো সেইরকম। সবিনয়ে স্বীকার করলাম।

    হ্যাঁ, নেগুস-এর পোষা সিংহ নির্ভয়ে আদর করতে হলে ওখানেই থাকতে হয় আর বুনো সিংহ শিকার করতে হলে যেতে হয় অন্য কোথাও। বলে ইবন ফরিদ আমার পায়ের ওপর বিরাশি সিক্কার একটি আদরের থাপ্পড় দিয়ে প্লেন ফাটিয়ে হাসতে আরম্ভ করলেন।

     

    আড্ডিস আবাবা শহরের সবচেয়ে যা আমার ভাল লাগে, তা সেখানকার গন্ধ। পৃথিবীর ছোট বড় আর কোনও শহরের অমন অপরূপ গন্ধ আছে বলে জানি না। গন্ধটা পোড়া ইউক্যালিপটাস কাঠের। সমস্ত হাবশি জাতিদের যিনি এক রাজছত্রতলে মিলিয়েছিলেন, সেই নেগুস নাগান্তি দ্বিতীয় মেনেলিক সর্বত্র ইউক্যালিপটাস গাছ পুঁতেছিলেন। সে গাছ এত বেড়েছে যে, লোকেরা ইউক্যালিপটাস জ্বালানি কাঠ হিসেবে পোড়ায়। শহরের হাওয়ায় তাই একটা মিষ্টি পরীদের গায়ের মতো সুবাস সারাক্ষণ ভাসছে।

    রাত্রে সে গন্ধটা আরও মন মাতানো। তা-ই নেশায় হোটেল থেকে বেরিয়ে শহরের একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। হোটেলের ম্যানেজার বেরুবার সময় সাবধান করে দিয়েছিল যে, আড্ডিস আবাবার পথে-ঘাটে সারারাত হায়নারা চরে বেড়ায়। আশেপাশের পাহাড় থেকে তারা নেমে আসে, আবার ভোর হতেনা-হতে ফিরে যায়। জ্যান্ত মানুষকে সাধারণত তারা এড়িয়ে চলে, তবে দুনিয়ায় অমন ছিচকে শয়তান জানোয়ার আর দুটি নেই। বেকায়দায় পেলে তারা সব করতে পারে। কোনও রকমে জখম অসহায় অবস্থায় পেলে জ্যান্ত মানুষের মাংস তারা খুবলে খেতে পারে।

    আড্ডিস আবাবার রাস্তাঘাট অত রাত্রে বেশ নির্জন পেয়েছিলাম। দিনের বেলায় গাধা ও ঘোড়ার সে নোংরা ভিড় আর নেই। এখানে সেখানে দু-একটা হায়না দূর থেকে চোখে পড়েছে। দেখতে না দেখতে তারা ছায়ার মতো মিলিয়ে গেছে কোথায়।

    শহরের একদিকের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত এসে যেখানে দাঁড়িয়েছিলাম, সেখান থেকে একটি তেপান্তরের রাস্তা সুডানের খার্তুম হয়ে মরুভূমির দেশে ওয়াদি হালফার দিকে গেছে। এই পথেই ইথিয়োপিয়ার রাজারা একদিন উত্তরের দিকে দিগ্বিজয়ে গিয়েছিলেন!

    কিছুদুরে কোথায় একটা হায়নার হাসির শব্দে চমকে ফিরতেই এমন কিছু দেখলাম, যাতে শরীর-মন এক মুহূর্তে সজাগ হয়ে উঠল। একটা মোটা ইউক্যালিপটাস গাছের গুঁড়ির পেছনে নিজেকে পাথরের মতো নিস্তব্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

    হায়না কিংবা জন্তু জানোয়ার কিছু নয়, মানুষ। আর এই মানুষটিকে অন্তত এত রাত্রে শহরের এই প্রান্তে দেখবার কথা সত্যি বলতে গেলে কল্পনাও করিনি।

    মুখ দেখতে পাওয়ার দরকার নেই। আকার দেখেই মানুষটাকে চিনতে দেরি হয় । আবিসিনিয়ার মানুষরা শক্ত সমর্থ জোয়ান হয় বটে, কিন্তু অমন একটা দৈত্যাকার মাংসের পাহাড় অন্তত এই কদিনে আড্ডিস আবাবার রাস্তায় ঘাটে দরবারে কোথাও চোখে পড়েনি।

    ইবন ফরিদই যে পালের গোদা একটা গণ্ডারের মতো নির্জন রাস্তা দিয়ে শহরের বাইরে কোথাও হনহন করে হেঁটে চলেছে, এ বিষয়ে তখন আর সন্দেহ নেই।

    কিছুদূর সে এগিয়ে যাবার পর নিঃশব্দে তার পিছু নিলাম। খুব নিঃশব্দে নেবার দরকার ছিল না। কারণ, সে নিজেই পদভারে মেদিনী কাঁপিয়ে যেভাবে চলেছে, তাতে আর কোনও শব্দ তার কানে যাবার কথা নয়।

    কিন্তু ইবন ফরিদ সত্যি চলেছে কোথায়? শহর তো এইখানেই শেষ। তারপর তো প্রায় গাছপালাহীন পাথুরে ঢেউখেলানোে তেপান্তর।

    হঠাৎ মনে পড়ল দুদিন আগেই আড্ডিস আবাবার বাজারে যে-শিকারির সঙ্গে আলাপ হয়েছে তার কথা। শখের শিকারি সে নয়। দুর্লভ দামি চামড়ার ব্যবসার খাতিরেই তার শিকার। বিশেষ করে কালো চিতার খোঁজেই সে আবিসিনিয়ার এমন সব দুর্গম দূর জায়গায় দেশি অনুচরদের নিয়ে যায় যে নেগুসের তহসিলদাররাও জানে কিনা সন্দেহ।

    শহরের বাইরেই সম্প্রতি সে তাঁবু গেড়েছে জানি। লোকজন রসদ সংগ্রহ করে নুতন শিকারের সফরিতে বেরুনোই তার উদ্দেশ্য।

    আমার অনুমানই ঠিক। কিছুদূর যেতেই শিকারির সাদা তাঁবুটা অন্ধকারেই রাস্তার ধারে ঝাপসা ভাবে দেখা গেল। কাছে-পিঠে বাঁধা ঘোড়াগুলোরও পা ঠোকার শব্দ শোনা গেল সেই সঙ্গে সঙ্গে।

    ইবন ফরিদের আসাটা যে অপ্রত্যাশিত নয়, শিকারিকে টর্চ হাতে তাঁবু থেকে কিছু দুরে অপেক্ষা করতে দেখেই তা বোঝা গেল।

    শিকারির হাতের টর্চটা একবার জ্বলে উঠতে ইবন ফরিদ হাঁক দিয়ে তার উপস্থিতি জানালে। আমি তখন পথের ধারে মাটির উপর শুয়ে পড়েছি।

    ইবন ফরিদের চালচলনে সন্দেহ করবার মতো সত্যিই অবশ্য তখনও কিছু নেই। হাঁক দিয়ে সাড়া দেওয়াটা অন্তত লুকোচুরি কোনও ব্যাপারের সঙ্গে খাপ খায় না।

    কিন্তু গোপনীয় যদি কিছু না হয়, তা হলে এত রাত্রে এই শহরের বাইরে এসে দেখা করার মানে কী?

    ইবন ফরিদের আড্ডিস আবাবায় এতদিন থাকাটাও তো একটু অদ্ভুত। টিটকিরি দিয়েও আমায় যা সে জানিয়েছিল, তাতে এতদিনে তার তো সিংহ-শিকারে বেরিয়ে যাবার কথা। আড্ডিস আবাবায় প্লেন থেকে নামবার পর এই ক-দিনের মধ্যে কোথাও আর না দেখে আমি তার কথাটা সত্যি বলেই নিয়েছিলাম।

    এতদিন সে ছিল কোথায়? লুকিয়েই বা ছিল কেন?

    হাতে পাঁজি মঙ্গলবার। রহস্য কিছু থাক বা না-থাক, শেষ পর্যন্ত ভাল করে ব্যাপারটা না বুঝে আমি ফিরব না ঠিক করে ফেলেছি।

    ইবন ফরিদকে নিয়ে শিকারি তার বড় তাঁবুটায় ঢোকবার পরই অত্যন্ত সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে গিয়ে বসলাম।

    নিস্তব্ধ রাত। ঘোড়াদের নিঃশ্বাস আর পা ঠোকার শব্দ ছাড়া মাঝে মাঝে এদিক-ওদিক থেকে হায়নার হাসি শুধু শোনা যাচ্ছে।

    ভেতরে কথাবার্তা চলছে বুঝতে পারছি, কিন্তু তাঁবুর কাপড়টা বেশ মোটা। দু একটা শব্দ ছাড়া ভাল করে কোনও কথা বোঝা যাচ্ছে না।

    কথাবার্তা ফরাসিতেই চলছে সন্দেহ নেই। কিন্তু দুজনের কারুরই যে ফরাসি মাতৃভাষা নয়, যেটুকু শুনতে পাচ্ছিলাম তার উচ্চারণ ও বলার ধরন থেকেই বুঝলাম।

    শিকারি লোকটির সঙ্গে আড্ডিস আবাবার বাজারে ইথিয়োপিয়ার আমহারিকেই আলাপ হয়েছিল। তাতে তাকে হাবশি ভাবিনি, ভাবার কোনও কারণও ছিল না। রোদে পোড়া চেহারাটা একেবারে কড়া তামাটে হয়ে এলেও তার মুখ-চোখের গড়ন থেকে চুলের রঙে বোঝা যায় মধ্যোপসাগরের উত্তরে ইউরোপের কোনও দেশের সে লোক। এদেশে অনেক দিন থেকে ভাষাটা দেশের লোকের মতোই বলতে শিখেছে।

    এখন কিন্তু তার অশুদ্ধ ফরাসি উচ্চারণেও কী যেন একটা ইঙ্গিত পাচ্ছিলাম। মদ্রদেশের অনেকের ইংরেজি উচ্চারণে যেমন জাতীয় বৈশিষ্ট্য ধরা যায়, এ-ও অনেকটা প্রায় তাই।

    ফরাসিটা চোস্ত শিখেছিলেন বটে ঘনাদা! শিবু হঠাৎ ফোড়ন পেড়ে বসল, ভুল উচ্চারণ শুধু ধরে ফেলেন না, তা থেকেই ভুল যে করে তার জাতের খবর পর্যন্ত বার করে ফেলেন!

    ঘনাদার সিগারেটটার ধোঁয়াতে আমরা হঠাৎ বোধহয় কাশতে শুরু করলাম। সে কাশিকে হাসি চাপার চেষ্টা বলে যদি কেউ সন্দেহ করে আমরা নাচার।

    ঘনাদা অন্তত করলেন না। শিবুর তারিফটা একটু হেসে অম্লান বদনে হজম করে শুরু করলেন, লোকটা গ্রিক বলে বুঝলাম। শুধু ওইটুকু নয়, বুঝলাম তার চেয়ে আরেকটু বেশি। জন্তু-জানোয়ারের চামড়া শিকারই লোকটার ব্যবসা হতে পারে, কিন্তু সে নেহাত সাধারণ শিকারি মাত্র নয়। ইবন ফরিদ তো নয়ই। একটু দুটো কথা যা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম, তা শিকারের জগতের নয়।

    নিউক্লিয়ার ফিশন অর্থাৎ পারমাণবিক বিস্ফোরণ কোথায় লাগে কিংবা বিজ্ঞানে সত্যিকার যুগান্তর, এ ধরনের কথা কালোচিতার খোঁজে ইথিয়োপিয়ারও পাণ্ডববর্জিত অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়, অথবা বুনো সিংহ-শিকার যার নেশা, সেরকম লোকদের আলাপের বিষয় হওয়া একটু আশ্চর্য।

    আরও একটু ভাল করে যদি শুনতে পেতাম! সেই চেষ্টাতেই তাঁবুর কাপড়ের গায়ে কানটা ভাল করে লাগাতে গিয়েই কেলেংকারি করে ফেললাম। আর তাতেই শাপে বর হয়ে গেল।

    তাঁবুর গায়ে কানটা লেপটে লাগাতে গিয়ে অসাবধানে তাঁবুর বাইরের একটা খুঁটিতে বাঁধা দড়িতে কেমন করে হাত ঠেকে গেছল।

    তাঁবুটা একটু তাতে নড়ে উঠতেই চারিদিক কাঁপিয়ে দড়াম দড়াম করে দুটি পিস্তলের গুলি ছুটল।

    দুটোই কানের পাশ দিয়ে তো? শিবুর আবার সরল জিজ্ঞাসা।

    না, ঘনাদার গলাটা একটু বেশি ভারী শোনাল।

    সন্ত্রস্ত হয়ে আমরা শিবুকে ধমকালাম, শিবুটার কেমন বুদ্ধি! দুটোই কানের পাশে হয় কখনও? রবার্ট ব্লেকের গল্প পেয়েছিস!

    শিবুর দিকে পিস্তলের নলটার মতোই অগ্নিদৃষ্টি ফেলে ঘনাদা বললেন, দুটো গুলিই কাছাকাছি একেবারে মাথার ঠিক ওপর দিয়ে। খানিকটা চুলের ডগা পুড়েই গেল তাতে।

    হাসি দূরে থাক, আমরা কাশি পর্যন্ত চেপে রইলাম প্রাণপণে।

    ঘনাদা আমাদের তদগত চেহারাগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে আবার শুরু করলেন, স্পষ্ট তারপর শুনতে পেলাম গ্রিক শিকারি বলছে, আপনি কি খেপে গেলেন নাকি ফরিদ সাহেব? গুলি ছুঁড়লেন কাকে?

    কেউ যদি থাকে? বলে ইবন ফরিদ হাসল, আপনি বুঝতে পারছেন না, সিয়ে সোলোমাস। সাবধানের মার নেই। তাঁবুটা কী রকম নড়ে উঠল দেখলেন? কেউ থাকতেও পারে ওখানে।

    থাকতে পারে দুটো-একটা হায়না। সোলোমাসের গলাটা প্রসন্ন নয়, রাত্রে মাঝে মাঝে তাঁবুর আশেপাশে খাবারের গন্ধ শুকে অমন ঘোরে। দিলেন তো তাঁবুটা ফুটো করে!

    আরে, ও ফুটো! ক্যাম্বিসের তাঁবুর বদলে রাজপ্রাসাদ পাবেন থাকবার, কাজটা যদি হাসিল হয়। আচ্ছা, তাঁবুর বাইরেটা একবার ঘুরে দেখে এলে হয় না? ইবন ফরিদের সন্দেহটা তখনও যায়নি বোঝা গেল।

    আমি সবে গা ঢাকা দেবার জন্যই তৈরি হচ্ছিলাম। কিন্তু সোলোমাসের কথায় আশ্বাস পেলাম।

    সোলোমাস তখন বলছেন, মানুষ হলে না লাগলেও ভয়ে একবার চেঁচাত। জানোয়ার হলেও তাই। মিছিমিছি আপনি জেগে স্বপ্ন দেখছেন। এখন কাজের কথা সেরে ফেলুন তাড়াতাড়ি।

    এত স্পষ্ট সব কথা শুনতে পাওয়ার কারণ তখন আমি বুঝে ফেলেছি। তাঁবুর ওই দুটো পিস্তলের গুলির ফুটোই আমার সহায় হয়েছে।

    ফুটো দুটো কাছাকাছি হওয়ায় আরও সুবিধে। আলতোভাবে তাতে কান ঠেকিয়ে কাজের কথাও শুনলাম।

    ফরিদ তখন বলছে, ওই চিমসে কালা ছুঁচোটাই আমাদের ভরসা। হাঁটা পথে এখান থেকে যদিও কোথাও যায় তো আপনি আছেন, আর উড়ে কোথাও যেতে চাইলে আমি। আসল ঘাঁটি ওরই শুধু জানা। সেখানেই চলেছে যতটা পারে এলোমলো ঘুরে ফিরে সকলের চোখে ধুলো দিয়ে। ওকে নজরে রেখে পিছু নিলেই কাম ফতে। হতভাগা জানেও না যে, যমকে ফাঁকি দিতে পারে, তবু আমাকে নয়। কাজটা শেষ করে যমের চেহারাই ওকে দেখাব।

    দু-চারটে অন্য কথা বলে ফরিদ তাঁবু থেকে বেরুল। বেরোবার সময় সোলোমাসের টর্চটা ধার নিয়ে তাঁবুর পেছনটা তদারক করে দেখে যেতেও ভুলল না।

    আমি তখন সেখান থেকে সরে গিয়েছি অবশ্য।

    ফরিদ চলে যাওয়ার পর ধীরে-সুস্থে গিয়ে সোলোমাসের তাঁবুর পর্দাটা সরালাম।

    সরাতে না সরাতে সত্যই অবাক।

    আসুন, দাস! বলে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে সোলোমাস আমার দিকেই ফিরে দাঁড়িয়ে হাসছেন, আপনার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছি।

    আমার অপেক্ষায়? আমি সন্দিগ্ধ ভাবে সোলোমাসের দিকে তাকালাম।

    হ্যাঁ, আপনারই। তাঁবুর পেছনে বসে সবই তো শুনেছেন।

    আমিই যে তাঁবুর পেছনে ছিলাম, তা-ও আপনি জানতেন? আমি সত্যই অবাক। প্রথমে কি আর ঠিক জানতাম! কিন্তু দুটো গুলির পরও না চিৎকার, না পালাবার শব্দ শুনে বুঝলাম একটি মানুষ ছাড়া দুনিয়ায় আর কারও পক্ষে এ মনের জোর সম্ভব নয়।

    সেই একটি মানুষের এত পরিচয় আপনি জানলেন কী করে?

    সোলোমাস হাসলেন—তা হলে আর তাঁবুর পেছনে শুনলেন কী? আপনার পরিচয় জানাই তো আমাদের আসল কাজ। পরিচয় না জেনে কি আপনার পিছু নিয়েছি?

    তা হলে আমার পিছু নিয়েছেন সে কথা স্বীকার করছেন!আমি ভেতরে ভেতরে গোলমালে পড়লেও বাইরের কড়া গলায় তা বুঝতে দিলাম না।

    না স্বীকার করে উপায় কী! বিশেষ নিজের কানেই সব যখন শুনে ফেলেছেন।

    ক্রমশ আমিই যেন বেকায়দায় পড়ছিলাম কথা কাটাকাটিতে তাই একটু রেগেই বললাম, আমিই তাঁবুর পেছনে ছিলাম বুঝেও ফরিদ সাহেবকে হায়নার কথা বলেছিলেন কেন?

    আলাপ-আলোচনাটা দীর্ঘ হবে মনে হচ্ছে, সোলোমাস হাসলেন, আপনারও অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করবার আছে, আমারও কিছু বলবার। সুতরাং এমন ভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে একটু বসলে হত না। এত রাত্রে আপনাকে আর কী দিয়ে আপ্যায়িত করতে পারি। খাঁটি জংলি মধু থেকে তৈরি আবিসিনিয়ার নামকরা তেজ আছে। বসুন। তাই একটু চাখতে দিই।

    না, তার দরকার হবে না। আমি এমনিই বসছি। এখন আমার কথাগুলোর জবাব দিলে বাধিত হব। বলে আমি চিতার চামড়ায় ঢাকা একটা নিচু কৌচের উপর

    বসলাম।

    সোলোমাসও পাশে একটা মোড়া টেনে বসে বললেন, কেন ফরিদ সাহেবকে হায়নার কথা বলেছিলাম এই কথা জানতে চাইছেন তো? বলেছিলাম ফরিদ সাহেবকে ধোঁকা দেবার জন্য। হায়নারা রাত্রে শহরের রাস্তায় ধাঙ্গড়ের কাজ করে ঘঘারে, আমার তাঁবুর দড়ি নাড়তে তারা কখনও আসে না আমি জানি।

    ওঃ, আমায় তা হলে অনুগ্রহ করেছিলেন! এ অনুগ্রহের কারণ? এবারে সত্যি অবাক হওয়ার দরুন বিদ্রুপের সুরটা ঠিক গলায় ফুটল না।

    অনুগ্রহ নয়, আত্মরক্ষা যদি বলি!

    আত্মরক্ষা! আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?আমি জ্বলে উঠলাম, শত্রুকে বাঁচাবার চেষ্টা আপনার আত্মরক্ষা!

    কথাটা একটু গোলমেলে বটে! সোলোমাস হাড়-জ্বালানো হাসি হেসে বললেন, আমি অবশ্য বলতে পারি, শত্রুকে বাঁচানোই এ ক্ষেত্রে আমাদের আত্মরক্ষা। ফরিদ সাহেব আহাম্মুক, তাই না বুঝে শুনে অমন গুলি ছুঁড়েছিল! আপনি মারা গেলে আমাদের নিজেদেরই তো সর্বনাশ। যা খুঁজছি তার পথ দেখাত তা হলে কে!

    এই তা হলে আপনার কৈফিয়ত? কিন্তু মারা তো আরেকটু হলে গিয়েছিলাম, টিপটা একটু না দৈবাৎ ফসকালে!

    দৈবাৎ যেটা ভাবছেন, তার পিছনে মানুষের হাতও তত থাকতে পারে? এই সোলোমাসেরই হাত?

    আমি বিস্ময় সামলে ওঠার আগেই সোলোমাস এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, হ্যাঁ, আমিই গুলি ছোঁড়বার সময় হঠাৎ চমকাবার ভান করে হাতটা তার একটু ওপর দিকে নাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

    কেন? তখনও তো আপনি জানেন না যে আমিই ওখানে আছি।

    ঠিক জানি না, কিন্তু আশা একটু করছিলাম বই কী! আপনার এত খবর আমরা রাখছি, আর আপনি আমাদের এই ডেরার খবর নিতে একবার আসবেন না তদন্তে, এ কি হতে পারে।

    মনে মনে লজ্জিত হয়ে অবশ্য স্বীকার করলাম যে ইবন ফরিদকে ঠিক বুঝেও সোলোমাসকে একেবারেই সন্দেহ করতে পারিনি। মুখে কিন্তু ঝাঁজের সঙ্গে বললাম, আমি আসব—তাও জানতেন, এসেছি কি না এসেছি ঠিক না জেনেই প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা করেছেন, এখন আবার আমারই অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিলেন! আপনার রহস্যটা কী বলুন তো? সাপ নেউল দুই-এর মাথাতেই হাত বুলোতে চান নাকি?

    একরকম প্রায় ধরে ফেলেছেন! অন্তত ফরিদ সাহেবের খুব হিতৈষী যে নয় বোঝা উচিত।

    হিতৈষী তা হলে কার? সন্দিগ্ধ ভাবে জিজ্ঞাসা করলাম।

    আপনাদের। সোলোমাসের এবার স্পষ্ট উত্তর।

    তা হলে ফরিদ সাহেবের দলে কেন?

    চোরের উপর বাটপাড়ি করবার জন্য। সোলোমাস হাসলেন।

    হাসিতে চটে গিয়ে বললাম, বিশ্বাস করব কীসে?

    প্রমাণ দিলে। সোলোমাসের জবাবে কোনও দ্বিধা নেই।

    দিন প্রমাণ তা হলে! আমি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে সোলোমাসের দিকে তাকালাম।

    ধরুন, যদি বলি রেনে লাভাল? সোলোমাসের মুখে ঈষৎ হাসি দেখা গেল।

    ওনাম শত্রুরা সবাই জানে।আমিও অবিশ্বাসের হাসি হাসলাম এবারে।

    তাহলে এমন কিছু বলি যা শত্রুদের জানবার কথা নয়?

    তাই তো শুনতে চাইছি, আমি কড়া গলায় বললাম।

    মোট একশো সাঁইত্রিশ। বলে সোলোমাস আমার দিকে চেয়ে মুচকে মুচকে হাসতে লাগলেন।

    আমি তখন সত্যই চমকে গেছি। কোনও রকমে সামলে জিজ্ঞাসা কমলাম, কি রকম মিলিয়ে?

    পাঁচ, চটপট জবাব দিলেন সোলোমাস।

    আমি সত্যই তাজ্জব।

    আমরাও। গৌর তো বলেই ফেলল, ভারী মজার ধাঁধা তো ঘনাদা!

    হ্যাঁ, সাঙ্ঘাতিত মজার! সে মজার ধাঁধার উত্তর খুঁজতে বাঘা বাঘা বৈজ্ঞানিকেরা সারা দুনিয়ায় তখন হিমসিম খাচ্ছে, আর শয়তানেরা ছলে বলে কৌশলে তা আদায় করবার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঘনাদা সিগারেটটায় কয়েকটা রাম টান দিয়ে ফেলে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, সোলোমাস অন্তত সে শয়তানের দলের নন এটুকু তখনই বুঝলাম। কারণ, যেটুকু তিনি বলেছেন শয়তানের কারুর তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু সত্যি সোলোমাস তাহলে কে? শত্রুর দলে তিনি এমন করে পরিচয় ভাঁড়িয়ে আছেনই বা কেন? চোরের ওপর বাটপাড়ি করাই তাঁর উদ্দেশ্য বলছেন। সত্যিই কি তাই? চোরের ওপর বাটপাড়ি তিনি করছেন কী স্বার্থে! কার হয়ে?

    এসব প্রশ্ন মাথার মধ্যে ঘুরছিল বলেই খানিকক্ষণ চুপ করে ছিলাম।

    সোলোমাসই হেসে বললেন, আপনি খুব মুশকিলে পড়েছেন বুঝতে পারছি, দাস। আরও একটা প্রমাণ তাই দিচ্ছি। এমন অকাট্য প্রমাণ যা পেলে অবিশ্বাসের আর কোনও কারণ থাকবে না আশা করি।

    একটু থেমে যেন আমার মুখের ভাবটা পরীক্ষা করে সোলোমাস বললেন, আপনার এখান থেকে নাইরোবি যাবার কথা। কেমন ঠিক না?

    এবার আমি একেবারে থ! আমায় গোপন নির্দেশ যে পাঠিয়েছে, সে এবং আমি ছাড়া দুনিয়ায় এ-খবর কারুর জানার কথা নয়। আড্ডিস আবাবা থেকে যে নাইরোবি যেতে হবে, এ-খবর আমি নিজেই ইয়েমেন থেকে রওনা হবার আগে জানতাম না। ঠিক রওনা হবার কিছু আগে সুইজারল্যান্ডের এক ব্যাঙ্কের ছাপমারা লেফাফার ভেতর সংকেতলিপিতে এই নির্দেশ এসেছে যে, আড্ডিস আবাবার বিশেষ একটি হোটেলে কদিন থেকে আমি যেন নাইরোবিতে রওনা হই। সেখান থেকে কোথায় যেতে হবে তার নির্দেশ নাইরোবির একটি সুইস ব্যাঙ্কের শাখাতেই পাব।

    সোলোমাসকে অবিশ্বাস করার আর কোনও মানেই হয় না। কিন্তু তাঁর রহস্যটা কী তা না বুঝলে আর আমার শান্তি নেই।

    তাঁর অনুমান যে ঠিক, একথা অকপটেই স্বীকার করে বললাম, আপনার কথাই ঠিক। কিন্তু যে-খবর শত্রুপক্ষের তো নয়ই, মিত্রপক্ষেরও কারুর জানা অসম্ভব, তা আপনি জানলেন কী করে? আমি এসব নির্দেশ কার মারফত পাই তা জানেন কি?

    জানি বই কী! সোলোমাস হাসলেন, কোনও সুইস ব্যাঙ্কের মারফত।

    যে কোনও সুইস ব্যাঙ্ক মক্কেলদের স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে কীরকম বিশ্বাসী তা-ও নিশ্চয় জানেন! অবাক হয়ে আমি বললাম, মরা মানুষের পেট থেকে কথা বার হতে পারে, কিন্তু তাদের পেট থেকে হবে না। তাহলে আপনি এ খবর পেলেন কী করে?

    সোজা উত্তরটা বুঝতে পারছেন না কেন? সোলোমাস যেন আমার নির্বুদ্ধিতায় একটু ক্ষুন্ন হয়ে বললেন, আমিও সুইস ব্যাঙ্কের মারফতই ওই খবরটা পেয়েছি। শুধু ওই খবরটুকু নয়, ওটা বাতিল করার নির্দেশও!

    তার মানে?

    তার মানে নাইরোবিতে নয়, আপনাকে এখন যেতে হবে সুদানের খার্তুম শহরে। নাইরোবি যাওয়া বাতিল করে এই নির্দেশ এসেছে।

    মাথাটা সত্যিই গুলিয়ে যাচ্ছিল। যে আজগুবি টহলে একমাস আগে প্যারিস থেকে রওনা হয়ে ইউরোপের ও এশিয়ার নানা শহরে টক্কর খেতে খেতে ইথিয়োপিয়ার এই রাজধানীতে এসে পড়েছি, তাতে মাথা স্থির রাখা কঠিন। কিন্তু সোলোমাস সে অস্থির মাথাটি যেন চরকি বাজির মতো ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

    একটু নিজেকে সামলে জিজ্ঞাসা করলাম, এ নির্দেশ আমার কাছে না এসে আপনার কাছে এসেছে কেন?

    বোধহয় আরও নিরাপদ করবার জন্যে।

    কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার দেখা তো না হতেও পারত? আমি তো দৈবাৎ আজ এখানে এসে পড়েছি। এবার মনে হল অকাট্য যুক্তি দিয়েছি।

    দৈবাৎ এসেছেন সত্যি। দৈবাৎ যদি না আসতেন তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকেই যেতে হত খবরটা পৌঁছে দেবার জন্য। তবে আপনার মতো লোক ইবন ফরিদের সূত্র ধরে আমার কাছে পৌঁছোতেনই আমি জানি। তাই তখন বলেছিলাম, আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। শহরের বাজারে সেদিন আমি নিজে যেচে যে আপনার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম, সে কথাও আশা করি মনে আছে?

    এত ব্যাখ্যাতেও ব্যাপারটা আমার কাছে সম্পূর্ণ পরিষ্কার হল না। সোলোমাসের নিশ্চিত ধারণা দেখলাম, ইবন ফরিদের সূত্র ধরে তাঁর কাছে আমি পৌঁছোতামই। এই ধারণা কেমন করে এত দৃঢ় হল আমি বুঝতে পারলাম না। ইবন ফরিদকে যা-ই সন্দেহ করে থাকি, তোড়জোড় করে অনুসরণ করার মতো দাম তার আছে বলে তো মনে হয়নি।

    অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসেই কি ফরিদকে অগ্রাহ্য করেছি। আর এই অগ্রাহ্য করাটা অনুমান না করতে পেরেই সোলোমাস অমন ধারণা করেছেন।

    নিজের সন্দেহ-সংশয় আপাতত চাপা দিয়ে এবার অন্য প্রশ্ন করলাম, ইবন ফরিদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ হল কী করে? কী করে তার দলে ভিড়লেন?

    ভিড়লাম চেষ্টা করে। এ ব্যাপারে আসল শনি যে কারা, তা তো আমাদের অজানা নয়। সুতরাং, তাদের ওপর নজর রাখতে তাদেরই দলে ভিড়বার ছল করতে হয়।

    সে ছলে তারা ভুলবে কেন? একটু কড়া হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম।

    যাতে ভোলে তার জন্যে পাঁচটা ঝুটোর মধ্যে একটা সাচ্চা খবর দিয়ে তাদের বিশ্বাস জাগাতে হয়।

    তার মানে শত্রুদের সত্যিকার গোপন খবর আপনি জুগিয়েছেন? অবাক আর নয়, এবার আমি জ্বলে উঠলাম।

    বললাম তো, সোলোমাস নির্বিকার ভাবে বললেন, তাদের বিশ্বাস করাবার জন্যই দিতে হয়েছে। অবশ্য এমন খবর দিয়েছি যাতে শেষ পর্যন্ত কোনও ক্ষতি হবার নয়।

    যেমন?

    যেমন ইয়েমেন থেকে আপনি আড্ডিস আবাবা আসছেন।

    এই খবর আপনি দিয়েছেন। আমি একেবারে আগুন হয়ে উঠলাম, ওই ফরিদকে?

    হ্যাঁ দিয়েছি, তাতে লোকসান হয়েছে কী? সোলোমাস হাসলেন।

    আপনি কী বারুদ নিয়ে খেলা করছেন, জানেন?

    জানি, বারুদ নিয়েই আমাদের খেলা, গম্ভীর হয়েই সোলোমাস বললেন এবার। খানিকক্ষণ চুপ করে রইলাম নিজের কর্তব্যটা স্থির করবার জন্য। সোলোমাসকে অবিশ্বাসও যেমন করতে পারা যায় না, তেমনই, বিশ্বাসও নয়। কী তাঁর প্যাঁচ, কী তাঁর মতলব কে জানে? হয়তো শত্রুপক্ষের চর হয়ে আমার ওপরও টেক্কা দেবার এটা এক নতুন ফন্দি।

    মুখে সেসব কিছু না জানিয়ে চলে আসার আগে শুধু বললাম, আপনার কথা মতোই আমার রাস্তা বদলাচ্ছি। এর ভেতর চালাকি যদি কিছু থাকে—

    তাহলে খার্তুমে গেলেই ধরা পড়বে, সোলোমাস নিজেই কথাটা পূরণ করে দিলেন।

     

    খার্তুম গিয়ে সোলোমাসের নির্দেশ যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণও যেমন পেলাম, সেই সঙ্গে আরেকটা এমন ব্যাপার দেখলাম, যেটা অত্যন্ত সন্দেহজনক।

    ওখানকার সুইস ব্যাঙ্কের শাখায় সই দিয়ে সত্যিই একটা শিলমোহর করা নতুন নির্দেশের খাম পেলাম। খামটা নিয়ে খার্তুমের সবচেয়ে খানদানি রাস্তা খেদিভ অ্যাভেনিউ ধরে খেদিভ আর ভিক্টোরিয়া অ্যাভেনিউর মোড়ে যেখানে উটের পিঠে বসা জেনারেল গর্ডনের বিরাট ব্রোঞ্জের মূর্তিটা স্থাপিত সেখান পর্যন্ত এসেছি, এমন সময়ে দুরের আব্বাস স্কোয়ারের দিকে চোখ পড়ায় থমকে দাঁড়ালাম। আব্বাস স্কোয়ারের মাঝখানের জোড়া মিনারের বিরাট মসজিদের কাছ থেকেই যে-লোকটা আসছে তাকে দূর থেকে দেখেও চিনতে যেমন ভুল হবার কথা নয়, তার খার্তুমে আসাও তেমনই অভাবনীয়।

    লোকটা আর কেউ নয়—ইবন ফরিদ।

    সোলোমাস কি তাহলে দু-মুখখা সাপের শয়তানিই করেছে?

    আমায় খার্তুম আসার নির্দেশ দিয়ে ফরিদকেও কি তা আবার জানিয়েছে!

    না, আর ধোঁকার মধ্যে থাকার কোনও মানে হয় না। ব্যাপারটার একটা ফয়সালা এখুনি আজই করে ফেলতে হবে।

    ফরিদ আমায় দেখতে পায়নি। ভিক্টোরিয়া অ্যাভেনিউ দিয়ে সে খেদিভ অ্যাভেনিউর দিকেই আসছে। গর্ডনের মূর্তির আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে খানিক অপেক্ষা করে আমি ফরিদের পিছু নিলাম দুর থেকে।

    ফরিদ খেদিভ অ্যাভেনিউর একটা নামকরা হোটেলে গিয়ে ঢোকার কিছুক্ষণ বাদে সেখানে গিয়ে হোটেল-ক্লার্ককে জিজ্ঞাসা করে ঘরের নম্বর জেনে নিয়ে একেবারে সটান ইবন ফরিদের ঘরের দরজায় গিয়ে টোকা দিলাম! ফরিদের কামরার দরজায় কিন্তু বিরক্ত কোরো না বিজ্ঞপ্তি লটকানো।

    ভেতর থেকে বাঘের মতো গলায় আওয়াজ এল, দূর হও। বাইরের নোটিস পড়তে পারো না!

    কী করে পারব। হিব্রু ভাষায় বললাম, ইংরেজিটা যে জানি না।

    খানিকক্ষণ ভেতরে আর কোনও আওয়াজ নেই। তারপর আবার বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন হল, পড়তে পারো না তো আমার কথা বুঝলে কী করে?

    ফরিদ সে কথা জিজ্ঞাসা করতে পারে অবশ্য। কারণ সে ইংরেজিতেই প্রথম ধমক দিয়েছিল।

    বললাম, শুনে বুঝতে পারলেই কি পড়তে পারা যায়! তুমি তো আরবি বলো খাসা, কিন্তু অক্ষর চেনো কি?

    ওধারে এবার গর্জন শোনা গেল, কী তুমি?

    মোলায়েম মিষ্টি করে বললাম, ইবন ফরিদ।

    দড়াম করে দরজাটা এবার খুলে গেল। ফরিদের মাংসের পাহাড়ে যেন ভূমিকম্প শুরু হয়েছে।

    ও, তুই–মানে আপনি!ফরিদ চটপট সামলে নিয়ে বললে, আসুন, আসুন। তা, এ রকম রসিকতার মানে কী?

    কামরার ভেতরে ঢোকার পর ফরিদ দরজাটা বন্ধ করে দিচ্ছে দেখে বললাম, যেন অবাক হয়ে, রসিকতা কোথায় দেখলেন?

    ফরিদ গর্জন করতে পারলেই বোধহয় খুশি হত। তার বদলে অতি কষ্টে রাগ চেপে রেখে হাসবার চেষ্টা করে বললে, ইবন ফরিদ নামটা নেওয়া যদি রসিকতা না হয় তাহলে মাপ চাইছি।

    ইবন ফরিদ নামটা রসিকতা! আমি যেন আকাশ থেকে পড়ে বললাম, আপনি যদি ও নাম নিতে পারেন, তাহলে আমি নিলেই রসিকতা হবে কেন?

    ও নাম আমার নয় বলতে চান? ফরিদ আর বুঝি নিজেকে সামলাতে পারে না।

    তাই তো বলছি। মধুর হেসে বললাম, আপনি ইবন ফরিদ তো নন-ই, আরবও আপনার দেশ নয়।

    কথাটা বলে ফরিদের মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। এবার হয় সে ফাটবে, নয় প্যাঁচ খেলবে।

    শেষেরটাই ঠিক হল। দু-এক মুহূর্ত কী ভেবে নিয়ে ফরিদ বললে, মানলাম আপনার কথাই সত্যি, কিন্তু আপনি জানলেন কার কাছে?

    কারুর কাছে জানিনি, নিজেই বুঝেছি। আপনি আরবি ভাষা যত ভালই বলুন, সত্যিকারের আরব হলে অন্তত ইবন ফরিদ নামটার দাম জানতেন!

    তার মানে? ফরিদ সত্যিই এবার একটু হতভম্ব।

    মানে, ইবন ফরিদ যে পর্যটক ভূগোলবিদ নয়, আরবি ভাষার অদ্বিতীয় একজন সুফি কবি, এ-খবর শিক্ষিত আরব মাত্রেই শুধু নয়, আরবি সাহিত্যের সঙ্গে কিছু পরিচয় যার আছে সে-ও জানে। ভূগোলবি পর্যটক হিসেবে যাঁর নাম-ডাক ছিল, তিনি ইবন ফরিদ নন, ইবন জুবের।

    ফরিদ হাঁ করে আমার দিকে তখন তাকিয়ে। বলেই ঘনাদা হঠাৎ ভ্রূকুটি করলেন।

     

    আমাদের সকলেরই তখন কোথা থেকে কাশির ছোঁয়াচ লেগেছে।

    শিশির সবার আগে সামলে উঠে লজ্জিত ভাবে বললে, আপনার ঘরে লবঙ্গ আছে, ঘনাদা?

    কেন? ঘনাদার গলা গম্ভীর।

    এই সবাই একটা একটা চিবোতাম। গলাটা কেমন খুস খুস করছে কি না।

    তা লবঙ্গ কেন? উখো দিয়ে চাঁছো না। শিবু ঠিক সময়মতো সুর পালটে দাঁত খিচিয়ে উঠল, না ঘনাদা আপনি বলে যান। ভারি একটু কাশি, তার জন্যে লবঙ্গ চাই, বচ চাই, বাসক সিরাপ চাই! কডলিভার অয়েল যে চাওনি এই আমাদের ভাগ্যি।

    শিশির ও আমরা বকুনি খেয়ে যথাবিহিত কুঁকড়ে গেলাম।

    ঘনাদা মানের গোড়ায় জল পেয়ে আবার শুরু করলেন, ফরিদ খানিক একেবারে বোবা হয়ে থেকে তারপর বললে, আমি ইবন ফরিদ হই বা না হই, আরব আমার দেশ হোক বা না হোক, তাতে আপনার কী আসে-যায় যে আড্ডিস আবাবা থেকে

    এই খার্তুম পর্যন্ত পিছু নিয়ে এই হোটেলে এসে ধাওয়া করেছেন?

    ফরিদের গলায় রাগের ঝাঁজ কিন্তু নেই। সে যেন অন্য মানুষ। নামই ভাঁড়াক আর যা-ই করুক, সে যেন কারুর সাতে-পাঁচে নেই। শুধু নিজের খুশিতে একটু দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি কেন মিছিমিছি তার পিছু নিয়ে তাকে বিব্রত করছি এই তার নালিশ।

    ফরিদের তালেই তাল দিয়ে তার দিকে চেয়ে মুচকে হেসে বললাম, শুধু কি আড্ডিস আবাবা থেকে? পিছু নিয়েছি সেই ইয়েমেন থেকে, তা বুঝি জানেন না?

    আমি এই সুর ধরব ফরিদ ভাবতে পারেনি। তবু যথাসম্ভব নিরীহ ভালমানুষের মতো জিজ্ঞাসা করলে, কেন নিয়েছেন তাই তো জানতে চাইছি।

    তাহলে আমার মুখ থেকেই শুনতে চান? হো হো করে হেসে উঠে তার পিঠে একটা দোস্তির আদরের চাপড় দিয়ে বললাম, আসুন তাহলে বসা যাক।

    ফরিদ তখন মেঝেতেই উপুড় হয়ে বসে পড়েছিল অবশ্য।

    আরে, ওখানে নয়। এই আপনার সোফায়, বলে হাত ধরে তাকে তুলে সোফায় বসিয়ে দিলাম।

    ধরা হাতটা আরেক হাতে টিপতে টিপতে যেভাবে সে আমার দিকে তাকাল, তাতে তার চোখে ঠিক বন্ধুত্বের প্রীতি উথলে উঠছে বলে মনে হল না।

    যেন সেসব কিছু লক্ষ না করেই তার পাশে বসে পড়ে বললাম, কেন আপনার পেছনে ছিনে জোঁকের মতো লেগে আছি, জানেন? বছর দুয়েক হল একটা মানুষ ফ্রান্স থেকে নরওয়ে যাবার পথে হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এমন কত লোকই তো যায়। বিভিন্ন দেশের পুলিশ কিছু দিন একটু খোঁজ-খবর হই-চই করে, তারপর নামটা খরচের খাতায় লিখে দেয়। আর সব দেশের পুলিশ তা করলেও ফ্রান্সের সুরে তা করেনি। না করাটা একটু আশ্চর্য। কারণ লোকটা বৈজ্ঞানিক বটে, কিন্তু কেওকেটা কেউ নয়। পারমাণবিক বোেমা কি গ্রহান্তরে যাবার রকেটের বারুদও তার গবেষণার বিষয় নয়। ফটো কেমিস্ট যাদের বলে, তিনি সেই জাতের রাসায়নিক। তাঁর নামটা বৈজ্ঞানিক মহলে পর্যন্ত খুব বেশি লোক জানে না। তাঁর নাম ধরা যাক রেনে লাভাল।

    একটু থেমে ফরিদের দিকে চাইলাম। ফরিদ সোজা লোক নয়, রেনে লাভালের নাম শুনেও চমকাবার কোনও লক্ষণ তার দেখা গেল না।

    আবার বললাম, রেনে লাভাল নিরুদ্দেশ হবার কিছুকাল পরে ক-টা মজার ব্যাপার ঘটল। দুনিয়ায় এক ফরাসি পুলিশ দপ্তরে ছাড়া যার সম্বন্ধে কারুর কোনও আগ্রহ নেই, সেই লাভালেরই প্যারিসের আগেকার বাসাবাড়িতে একদিন চুরি হল। লাভালের বাসাবাড়ি ফরাসি পুলিশ তালাবন্ধ করে রেখেছিল। সেখানে দামি কোনও জিনিসপত্রও ছিল না। তবু সে বাড়িতে পুলিশের প্রায় নাকের ওপর দিয়ে বেপরোয়া হয়ে কোন চোর কীসের লোভে এল চুরি করতে? চুরির পর পুলিশ সব কিছু মিলিয়ে দেখল। জিনিসপত্র কিছুই খোয়া যায়নি। এমনকী নরওয়ে যাবার সময় বই কাগজপত্র যা লাভাল যেমন ভাবে রেখে গিয়েছিলেন, আর পুলিশ বাড়িতে তালা দেবার সময় শুধু ওপর থেকে ফটো নিয়ে যা ছোঁয়নি, সেসব ঠিক তেমনই রাখা আছে। চোর তাহলে কীসের খোঁজে এসেছিল এত বিপদ ঘাড়ে নিয়ে?

    ফরাসি পুলিশের হাতে চোর শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ল। সাধারণ একটা দাগি সিঁধেল চোর। সে পুলিশের কাছে স্বীকার করল যে, অচেনা একজন বিদেশি একটা বিশেষ ফরমাশ দিয়ে তাকে লাভালের বাসায় চুরি করতে পাঠিয়েছিল। তার জন্যে টাকাও দিয়েছিল।

    প্রচুর বড়লোকের বাড়ির সিন্দুক ভাঙলেও অত টাকা পাওয়া যায় কিনা সন্দেহ। কাজ হাসিল করতে পারলে আরও টাকা দেবে বলেছিল, এবং সে কথা সে-বিদেশি রেখেছে।

    কাজ তাহলে তুমি হাসিল করেছ? ওই অঞ্চলের কমিশেয়ার দ্য পুলিশ স্বয়ং কড়া ধমক দিয়ে চোরকে জিজ্ঞেস করেছিলেন।

    কিন্তু কড়া ধমক খেয়ে চোর হাসতে শুরু করেছিল। পাহারাদার পুলিশকে মারমুখখা দেখে তারপর বলেছিল, আজ্ঞে হাসিল করেছি বই কী! কিন্তু কাজটা কী শুনবেন? শুনলে আপনারাও হাসবেন।

    কী কাজ বললা? আবার ধমক দিয়েছিলেন কমিশেয়ার।

    আজ্ঞে, কাগজ-ফেলার ঝডির হেঁড়া কাগজগুলো নিয়ে গিয়ে সেই বিদেশিকে দেওয়া। হেঁড়া কাগজের বদলে নোট পেয়েছিলাম গাদা গাদা। চোরটা হাসতে গিয়ে নিজেকে সামলেছিল। কমিশেয়ার ভেতরে ভেতরে চমকে উঠলেও বাইরে তা বুঝতে দেননি কাউকে। জিজ্ঞেস করেছিলেন আবার, আর কিছু নাওনি তুমি? ঠিক করে বললা?

    আজ্ঞে, ঠিক বলেছি। মা মেরির দিব্যি! চোরটা সত্যি কথাই বলছে মনে হয়েছিল।

    কমিশেয়ার বিদেশি অচেনা লোকটার চেহারার বর্ণনা জেনে নিয়ে চোরটাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।

    শুধু এই একটা ঘটনা নয়, এরকম আরও দু-একটা অদ্ভুত ব্যাপার তখন ঘটে। যে ল্যাবরেটরিতে লাভাল কাজ কতেন, খোঁজ করতে করতে জানা যায় যে, সেখানে তাঁর এক সহকারীকে তাঁর আগে থাকতেই পাওয়া যাচ্ছে না। সহকারী ফরাসি নয়, ইউরোপের ভিন্ন দেশের লোক। নিজের দেশে যাবে বলে ছুটি নিয়ে লাভাল নিরুদ্দেশ হবার মাস ছয়েক আগে সে চলে যায়। কিন্তু তারপর আর সে ফিরে আসেনি। লাভালের ব্যাপারটা নিয়ে টনক না নড়লে পুলিশ সেই সহকারীর খোঁজ বোধহয় করতই না। কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সত্যিই শেষ পর্যন্ত গোখরো বেরুল। ক্রমশ ফরাসি সরকার জানতে পারল যে, রেনে লাভালের নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে গভীর রহস্য আছে কিছু। কিছুকাল থেকে তিনি যেন খুব ভয়ে ভাবনায় দিন কাটাচ্ছেন মনে হয়েছিল। ল্যাবরেটরির সহকর্মীদের তিনি বিশেষ কিছু বলেননি, কিন্তু তিনি খুব যে বিপদের মধ্যে আছেন এই আভাসটুকু দিয়েছিলেন। বন্ধু ও সহকর্মীরা অবশ্য এসব কথার মানে তখন বুঝতে পারেনি। তাঁর নিরুদ্দেশ হওয়ার সঙ্গে এই সব ব্যাপার জড়িয়ে ফরাসি পুলিশের ধারণা হল যে, রেনে লাভালকে তাঁর শত্রুরা কেউ কোথাও পাচার করেছে, কিংবা তিনি নিজেই গা-ঢাকা দিয়ে কোথাও লুকিয়ে আছেন।

    ফরিদ কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে বললাম, কিন্তু ফরাসি সরকারেরও যা অজানা সে কথা জানে মাত্র দু-একটি লোক। আপনি তাদের একজন।

    আমি! ফরিদ আকাশ থেকে পড়ল যেন।

    হ্যাঁ, আপনি। আপনি জানেন যে চেষ্টা করলেও মসিয়ে লাভালকে শত্রুরা কেউ চুরি করে নিয়ে যেতে পারেনি। তিনি নিজেই তাদের ফাঁকি দিয়ে গা-ঢাকা দিয়ে লুকিয়ে আছেন। কেন তিনি গা-ঢাকা দিয়ে আছেন তা-ও আপনি জানেন, আর ধরুন একজন পরম বিশ্বাসী বন্ধু হিসেবে তাঁরই গোপন নির্দেশ অনুসারে আপনি তাঁকে সাহায্য করতে তাঁর লুকোনো আস্তানায় চলেছেন।

    এই পর্যন্ত বলে একটু থামলাম, তারপর ফরিদের চোখে চোখ রেখে কড়া গলায় আবার বললাম, এখন মনে করুন আমি শত্রুপক্ষের চর, মনে করুন আপনার মারফত লাভালের গুপ্ত আস্তানা খুঁজে বার করবার জন্য আমি সাবধানে ছায়ার মতো আপনার পিছু নিয়েছি, কিন্তু তা সত্ত্বেও আপনি তা জানতে পেরে গেছেন। তারপর এখন হাতে পেয়ে আমার সম্বন্ধে কী আপনি করবেন?

    ফরিদ এতটুকু বিচলিত হল না এ কথাতেও। বরং শান্ত গম্ভীর স্বরে বললে, বিশেষ কিছু করব না, শুধু আজ সুইস ব্যাঙ্কে গিয়ে যে নির্দেশ-দেওয়া লেফাফাটি এনেছেন, সেটি আপনার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে একটি গোল-কিক করে আপনাকে দরজার বাইরে পাঠিয়ে দেব।

    কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পকেট থেকে একটা ছোট রিভলভার বার করে সে আমার দিকে তখন ধরেছে।

    সেদিকে চেয়ে ভয়ে ভয়ে বললাম, সত্যিকার রিভলভার মনে হচ্ছে। শুধু সত্যিকার রিভলভার নয়, ফরিদ হিংস্রভাবে হেসে সেফটি ক্যাচটা সরিয়ে বললে, ছ-ছটা গুলি ভরা আর সেফটি ক্যাচটাও সরানো৷ একটু ট্যাফু করলেই ওই বুকটা ঝাঁঝরা করে দেব!

    কিন্তু তাতে বড় বেশি বিশ্রী আওয়াজ হবে না? হোটেলের লোকেরা মকে উঠতে পারে। এমনকী পুলিশ-টুলিশ নিয়ে ছুটেও আসতে পারে এ-ঘরে। সুদানি পুলিশ বড় বেয়াড়া শুনেছি।

    সুদানি পুলিশ ঘুণাক্ষরেও কিছু জানবে না, এবিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারেন! ফরিদ কুটিল হাসির সঙ্গে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, কারণ, এ হোটেলের মালিক থেকে চাকর পর্যন্ত কেউ সেনর সাবাটিনির ঘরে কী হচ্ছে উঁকি দিয়ে দেখতেও সাহস করবে না।

    ও, আপনি তাহলে সেনর সাবাটিনি! আমি পরিচয় জেনে ধন্য হবার ভাব দেখালাম।

    আমি যে-ই হই, ফরিদ মানে সাবাটিনি কড়া গলায় বললে, তোর পকেটের লেফাফাটা এবার বার কর দেখি, ছুঁচো। এখন বুঝতে পারছিস বোধহয়, ও লেফাফা সঙ্গে নিয়ে সিংহের গুহায় ঢুকে কী বোকামি করেছিস! অবশ, ও লেফাফা তোর কাছ থেকে কেড়ে নিতামই। সেই জন্যই আমার খার্তুম আসা। শুধু হাঙ্গামাটা তুই বাঁচিয়ে দিলি এই যা!

    আমি যেন প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বললাম, এ-লেফাফা আপনাকে দিতে হবেই? নিয়ে আপনি ছাড়বেন না?

    না ছাড়ব না। ভালয় ভালয় দিস তো জ্যান্ত এ-ঘর থেকে বেরুতে পারবি। আর দিলে লেফাফা তো যাবেই, সেই সঙ্গে প্রাণটা। সাবাটিনির কী সে উল্লাসের হিংস্র হাসি!

    কিন্তু এ-লেফাফা নিয়ে কী লাভ আপনার হবে! আমি কাতরভাবে বোঝাবার চেষ্টা করলাম, রেনে লাভাল নিরিবিলিতে কোথায় একটু লুকিয়ে আছেন, তাঁকে কেন মিছিমিছি জ্বালাতন করবেন?

    জ্বালাতন কেন করব? সাবাটিনি আবার হেসে উঠল, তাঁকে জ্বালাতন কিছু করব , শুধু তাঁকে তাঁর যন্ত্রপাতি কাগজপত্র লটবহর সমেত এমন জায়গায় পাচার করব, যেখানে তাঁর গবেষণার কোনও বিষ্ম আর হবে না।

    কোথায়? আপনার নিজের দেশ ইটালিতে? আমার যেন দারুণ কৌতূহল।

    না। সাবাটিনি গর্জন করে উঠল, কোথায় তাতে তোর কী দরকার?

    ও বুঝেছি,আমি ভালমানুষের মতো বললাম, নামটা আপনার ইটালিয়ান হলেও আপনার দেশ জাত বলে কিছু নই। ও সব বালাই ঘুচিয়ে আপনি শুধু নিজের স্বার্থের ধান্দাতেই ঘোরেন। রেনে লাভালকে পাবার জন্য যারা সবচেয়ে বেশি দাম দেবে তাদের কাছেই তাঁকে বেচবেন।

    চুপ কর, ছুঁচো, সাবাটিনি গর্জন করে উঠল, তোর কাছে বক্তৃতা শোনবার আমার সময় নেই। সুবোধ ছেলের মতো লেফাফাটা বার কর। আমি এক থেকে পাঁচ গুনছি। তার মধ্যে লেফাফা না দিলে এই রিভলভারই যা বলবার বলবে। এক…

    দোহাই! দোহাই! আমি কাতর অনুনয় জানালাম, লেফাফাটা তো দিতেই হবে বুঝতে পারছি, কিন্তু তার আগে পৃথিবী থেকে চিরকালের মতো অন্নাভাব ঘোচাবার কল্পনাতীত উপায় যিনি আবিষ্কার করতে চলেছেন, তাঁর গোপন ঠিকানাটা একটু দেখে নিতে দেবেন? সত্যি বলছি, শিলমোহর দেওয়া খামটা খুলেও দেখিনি এখনও।

    তাহলে এ-জন্মে আর তা দেখা তোর ভাগ্যে নেই। সাবাটিনি নির্মমভাবে হেসে উঠে গুনতে আরম্ভ করল, এক…দুই…।

    সাবাটিনির পেছনে কামরার দরজাটা খোলার খুট করে একটু আওয়াজ হল।

    সাবাটিনি চমকে উঠলেও আমার দিক থেকে চোখ বা পিস্তল কিছুই না ফিরিয়ে বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, কে?

    পেছন থেকে চাপা গলায় আওয়াজ এল, আমি সোলোমাস।

    সোলোমাস! সাবাটিনি হতভম্ব হল বুঝতে পারলাম, কিন্তু তার চোখ আর পিস্তল আমার ওপরই নিবদ্ধ রইল। দাঁতে দাঁত চেপে শুধু বললে, এখানে কেন?

    শোনা গেল, তোমায় শেষ করতে!

    আমি হাত তুলে সভয়ে চিৎকার করে উঠলাম, ও কী করছেন, মসিয়ে সোলোমাস? পিস্তল ছুঁড়বেন না! আমার গায়ে গুলি লাগবে যে!

    সাবাটিনি চমকে একটু পিছনে তাকাতেই তার হাতের রিভলভার এল আমার হাতে, আর সে তখন সোফার ওধারে চিৎপাত।

    রিভলভারটার সেফটি ক্যাচ আবার লাগিয়ে দাঁড়িয়ে উঠে বললাম, উঠুন সেনর সাবাটিনি। মেঝেয় অমন শুয়ে থাকা কি ভাল!

    সাবাটিনির কিন্তু ওঠবার কোনও লক্ষণ তখনও নেই। একবার বন্ধ দরজা আর একবার আমার দিকে ভ্যাবাচাকা খেয়ে তাকিয়ে বললে, সোলোমাস কোথায় গেল?

    সোলোমাস আবার যাবে কোথায়? আড্ডিস আবাবাতেই আছে। হেসে বললাম, ভেনট্রিলোকুইজম বিদ্যেটা অনেক সময় খুব কাজে লাগে।

    সাবাটিনি সেই বিরাট দেহ নিয়েও এবারে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে বললে, শয়তান, পাজি, ছুঁচো, শুধু তোর হাতে রিভলভার-তাই, নইলে তোর হাড়-মাংস আমি আলাদা করে রাখতাম।

    রিভলভারটা দুরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললাম, ও আফশোস আপনার তাহলে আর রাখলাম না।

    আমার কথা শেষ হতে না হতেই সাবাটিনি লাফ দিয়ে পড়ল। না, আমার ওপরে নয়, রিভলভারটা যেখানে ছুঁড়েছিলাম সেদিকে। কিন্তু সেখান পর্যন্ত তাকে পৌঁছোতে হল না। তার শয়তানি বুঝেই সোফাটা তৎক্ষণাৎ ঠেলে দিয়েছিলাম। তার ধাক্কায় হুমড়ি খেয়ে সে দেওয়ালের গায়ে গিয়ে ছিটকে পড়ল।

    সেখান থেকে তাকে তুলে একটা ধোবি পাট দিয়ে বললাম, কী ভাগ্যি, সেনর সাবাটিনি, আপনার ঘরে এ-হোটেলের মালিক থেকে চাকরবাকর কেউ উঁকি দিতে সাহস করে না, নইলে আপনার কাছে দুটো লড়াইয়ের প্যাঁচ শেখবার এ সৌভাগ্য হয়তো পেতাম না। হয়তো হোটেলের লোকেরা ভূমিকম্প হচ্ছে বলে এ-ঘরের দরজা ভেঙে ঢুকতে পারত।

    সাবাটিনিকে একটা চরকি পাক দিয়ে মাটিতে ফেলে আবার বললাম, আপনার মতো টনটনে ন্যায়নীতিবোধ কোথাও আমি দেখিনি। ধর্মযুদ্ধে অন্যের হাতে রিভলভার আপনি পছন্দ করেন না, কিন্তু নিজের হাতে সেটা রাখা ন্যায্য মনে করেন! আপনাকে আবার তাই একটা সেলাম জানাচ্ছি।

    সাবাটিনি তার নিজের খাটের ওপরেই মুখ থুবড়ে পড়ে তখন কাতরাচ্ছে।

    পকেট থেকে শিলমোহর দেওয়া চিঠিটা বার করে বললাম, এ চিঠি আপনাকে খুলে এখন আমি দেখাতে পারি, কিন্তু দেখিয়ে কোনও লাভ হবে কি? কারণ, এ চিঠির ঠিকানাতেই আমি নিজে এখন যাচ্ছি। আর সেখানে আপনার এই শ্রীমুখ দেখার কোনও বাসনা কেন জানি না আমার হচ্ছে না। তা সত্ত্বেও যদি আপনি দেখাতে চান, তাহলে আশা করি উইল-টুইল করেই যাবেন। অবশ্য কার জন্যই বা করবেন? আপনার জন বলতে স্বয়ং শয়তান ছাড়া আর কে-ই বা আপনার থাকতে পারে!

    কথাগুলো বলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আমায় ফিরে দাঁড়াতে হল। সাবাটিনি কাতরাতে কাতরাতেই তখন বিষটালা গলায় বলছে, ওই দুমুখো সাপ সোলোমাসই তোকে সব জানিয়েছে, আমি বুঝেছি। কিন্তু এই আমি বলে রাখছি, ওই সোলোমাসের ছোবল তোকেও খেতে হবে। তোর নিপাত যাবার আর বেশি দেরি নেই।

    সাবাটিনির অভিশাপ কানে নিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলাম।

     

    খার্তুম থেকে বেরুবার আগেই সাবাটিনির অভিশাপ কিছুটা অন্তত ফলল।

    যাবার দিনই সুইশ ব্যাঙ্কের সেই চিঠিটা কী ভাবে আমার তালা দেওয়া হোটেলের কামরায় আমার ব্রিফকেস থেকে যে চুরি গেল বুঝতে পারলাম না।

    কী ভাগ্যি আমি লেফাফাটা খুলে আগেই পড়ে রেখেছিলাম। চিঠিটা পড়েই কেন যে পুড়িয়ে দিইনি এই আমার আফশোস৷

    কিন্তু আফশোস করে বা চুরির কিনারা করবার চেষ্টায় সময় নষ্ট করে কোনও লাভ নেই।

    চুরি যাবার দরুনই যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি সব ব্যবস্থা করে পরের দিন সকালেই একটি প্লেনে রওনা হয়ে পড়লাম। কিন্তু সেখানেও বাধা।

    খার্তুম থেকে বেরিয়ে ঝড়ের মধ্যে পড়ে প্লেনটা জখম হয়ে কোনওমতে নুবিয়ার মরুভূমির দক্ষিণপ্রান্তে নীলনদ যেখানে হঠাৎ যেন পিছনে ফিরে যাবার জন্য বাঁক নিয়েছে, সেই ছোট শহর আবু হামেদ-এ গিয়ে নামল। সেখান থেকে তোড়জোড় করে অন্য প্লেনে কায়রো যেতে দিন দশেক লাগল। কায়রো থেকে অবশ্য সোজা দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকার আর এক প্রান্তে অতলান্তিক সমুদ্রের ধারে এক গহন জংলি রাজ্যে গেলাম। লেফাফায় সেই নির্দেশই ছিল।

    জংলি রাজ্যের নাম গ্যাবোঁ। জায়গাটা একেবারে অচেনা নয়। আফ্রিকার দুষ্প্রাপ্য গ্যালাগো ধরতে অনেক আগে একবার ওখানকার জঙ্গলে গেছলাম। কী ধরতে গেছলেন? শিবু হাঁদার মতো জিজ্ঞাসা করে বসল। গ্যালাগো। ঘনাদা নামটা আবার বলে ধৈর্যের পরিচয় দিলেন।

    গ্যালাগো? গৌর উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, গোরিলার মাসতুতো-পিসতুতো ভাই, না ঘনাদা?

    না। ঘনাদা অনুকম্পার সঙ্গে বললেন, লেমুর যাদের বলে, সেইরকম আধা বাঁদর একজাতের ঘোট প্রাণী। কোনওটা ইদুরের চেয়ে বড় হয় না।

    মোটে ইদুর! শিশির ফোঁস করে যেভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, তাতে মনে হল গ্যালাগো জানোয়ারটা তাকে ঠকিয়ে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়েছে।

    আমাদের ভাগ্য ভাল যে ঘনাদা সে দীর্ঘনিশ্বাস অগ্রাহ্য করে আবার শুরু করলেন, বিষুবরেখার উত্তরে অতলান্তিকের ধারে এই ছোট রাজ্যটি ফরাসিদের অধিকারে। রাজ্যটি কঙ্গোরই প্রতিবেশী এবং কঙ্গোর সঙ্গে তার মিলও কম নয়। বেশির ভাগই ঘন জঙ্গলে ঢাকা। এক একটা গাছ একশো থেকে দেড়শো হাত প্রায় লম্বা। বছরের অর্ধেক সময়ে নদী-নালা ভেসে জলা-জঙ্গল একাকার হয়ে থাকে। সিংহের দেখা খুব বেশি না পাওয়া গেলেও আফ্রিকার বিরল জানোয়ার ওকাপি ওই সব জঙ্গলে মেলে, তা ছাড়া চিতাবাঘ আছে, এক জাতের লাল বুনো মোষ, সোনালি বেড়াল, বিরাট সব কাঠবেড়ালি আর ওই গ্যালাগো।

    এই জংলি রাজ্যে ঠিকানা মনে থাকা সত্ত্বেও রেনে লাভালের আস্তানা খুঁজে বার করতে কম বেগ পেতে হল না। প্লেন তো নামিয়ে দিয়ে গেল সমুদ্রের তীরের লিব্রেভিল বন্দরে। সেখান থেকে আঁকাবাঁকা কুইলা নদীতে যতদূর সম্ভব মোটর লঞ্চ ও তারপর জংলি ডিঙি বেয়ে, কোথাও বা হেঁটে, বুনো হিংস্র আদিবাসীদের এড়িয়ে লাভালের নির্দেশ দেওয়া অঞ্চলে পৌঁছোতে প্রায় দু-হপ্তা লেগে গেল।

    এই অঞ্চলটায় দুর্ভেদ্য বন-জঙ্গল শেষ হয়ে গিয়ে পাহাড়ি উপত্যকা শুরু হয়েছে। ওকান্দে জাতের যেসব বাহকেরা এতদূর আমার মালপত্র বয়ে নিয়ে সঙ্গে এসেছিল, তারা আর যেতে চাইলে না। সামনে ফাঙ্গ বলে আরেক জংলিজাতের এলাকা। সেখানে ওকালেদের দেখতে পেলে আর রক্ষা নেই। অগত্যা একটা পাহাড়ে ঢিপির পাশে ছোট একটা কুঁড়ে গোছের তৈরি করিয়ে তারই মধ্যে বেশির ভাগ সঙ্গের জিনিস রাখলাম। তারপর নিতান্ত দরকারি জিনিসপত্র একটা ছোট ব্যাগে ভরে রওনা হলাম রেনে লাভালের ডেরা খুঁজতে। সামনে ছোটখাটো একটা পাহাড় হাজার চারেক ফুট উঁচু। তারই মাঝামাঝি একটা পাহাড়ের খাঁজে লাভালের আস্তানা লুকোনো বলে নির্দেশ পেয়েছি।

    অচেনা পাহাড় বেয়ে উঠে সে আস্তানা খুঁজে বার করতে সন্ধে হয়ে গেল। পাহাড়ের দুটো শাখার মাঝখানে এমন ভাবে আস্তানাটা লুকোনো যে, সহজে চোখে পড়ার কথা নয়।

    আস্তানা বলতে তিনটি ছোট বড় জঙ্গলের কাঠের গুঁড়ি দিয়ে তৈরি ঘর। বড়টি ল্যাবরেটরি আর দুটি শোবার ও রান্নার। কিন্তু তিনটি ঘরের কোথাও কেউ নেই। ঘরদোরের চেহারা দেখলে মনে হয়, অন্তত দু-একদিন আগেও সেখানে কেউ-কেউ ছিল। রান্নাঘরে একটা স্টোভের ওপর একটা জলভরা কেটলি চাপানো। পাশের টেবিলে একটা ডিশের ওপর একটা বাসি অমলেট ভাজা পড়ে আছে। কেউ যেন অমলেট ভাজা সেরে চায়ের জল কেটলিতে চড়িয়ে হঠাৎ চলে গেছে। কেটলিটা নামিয়ে স্টোভটা নেড়ে দেখে বুঝলাম তেল ফুরিয়েই সেটা শেষ পর্যন্ত নিবে গেছে। কেটলির জলও ফুটে ফুটে অর্ধেক হয়ে যে আগুন নেববার পর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, ভেতরে কেটলির গায়ে পরপর জলের গোল গোল দাগেই তা বোঝা গেল।

    এটা যে লাভালের আস্তানা, সে-বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি সরঞ্জাম দেখেই তা ধরা যায়। কিন্তু লাভাল গেছে কোথায়? হঠাৎ অমন করে গেছেই বা কেন?

    কোনও শত্রু তাকে এখানে আক্রমণ করেছিল বলেও মনে হল না। সেরকম কোনও চিহ্ন নেই। ল্যাবরেটরি থেকে ঘরদোরের জিনিসপত্র সব কেউ ছুঁয়েছে বলেও মনে হল না।

    আমার সন্দেহ হয়তো অমূলক। লাভাল হয়তো কাছেই কোথাও গেছে। এখুনি ফিরে আসবে ভেবে অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। কিন্তু বৃথাই।

    এত রাত্রে আর খুঁজতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। ওই আস্তানাতেই রাতটা কাটাবার জন্যে তৈরি হচ্ছি, এমন সময় নিস্তব্ধ পাহাড়ে কোথায় যেন একটা পাথর খসে পড়বার শব্দ পেলাম। তারপর বুঝতে পারলাম পাহাড়ের খাড়াই পথে এই আস্তানার দিকে কে যেন সন্তর্পণে আসছে। পাহাড়ি রাস্তার আলগা নুড়ি পাথর নড়াচড়ার শব্দ একটু ভাল করে কান পাতলেই শোনা যায়।

    কোনও জানোয়ার-টানোয়ার হবে কি? না, তা হওয়া সম্ভব নয়। এখানে সিংহ নেই বললেই হয়। আর সিংহ কি জংলি চিতা মানুষের ব্যবহার করা পথে পারতপক্ষে আসবে না।

    রাতটা খুব অন্ধকার নয়। কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ খানিক আগে পাহাড়ের ওপরে উঠতে শুরু করেছে। তেলের অভাবে আলো-টালো এতক্ষণ জ্বালতে না পারলেও খুব অসুবিধে হয়নি। এখন মনে হল, তেল না থেকে ভালই হয়েছে। যে আসছে, সে লাভাল নিশ্চয়ই নয়। কারণ, তা হলে নিজের আস্তানায় এত সন্তর্পণে সে আসত না। সে যাই-হোক, আস্তানায় আলো থাকলে দেখতে সে পেতই দূর থেকে। তাতে হয় পালাত, নয় আরও সাবধান হয়ে হানা দিত। তার চেয়ে আধা-অন্ধকারে আমি যে তার জন্যে আগে থাকতে প্রস্তুত থাকতে পারছি এই ভাল।

    এক হাতে পিস্তল আর এক হাতে টর্চটা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে কাঠের বাড়িটার পিছন দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমী কি অষ্টমীর লালচে চাঁদ তখন পাহাড়ের মাথায় আরও খানিকটা উঠে এসেছে। চারিদিকে কেমন একটা ছমছমে ভূতুড়ে আবছা অন্ধকার। আমি যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম সেখানটায় সেই চাঁদের আলোর ছায়াতেই অন্ধকার আরও গাঢ়।

    চুপিসাড়ে যে পাহাড়ি পথে উঠে আসছিল, একটা পাথুরে ঢিপি ঘুরে আসতেই তার মূর্তিটা অন্তত দেখা গেল।

    জানোয়ার নয়, মানুষই, আর জংলিও যে নয় ওই আবছা আলোতেই দূর থেকে তার পোশাক দেখেই তা বুঝতে দেরি হল না।

    কে তাহলে লোকটা?

    লাভাল যে নয়, মুখ না দেখে শুধু আকৃতি দেখেই বুঝতে পারলাম। লাভাল গোলগাল ছোটখাটো মানুষ। আর এ লোকটা মোটা তো নয়ই, বরং বেশ রোগা ও লম্বা। সন্তর্পণে আসছে বটে, কিন্তু একটা পা বেশ খুঁড়িয়ে।

    ঠিক সময় বুঝে ধরব বলে নিঃশব্দে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

    লোকটা লাভালের আস্তানার সামনে এসে এদিক-ওদিক চেয়ে ভেতরে গিয়ে ঢুকতেই নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে খোলা দরজার বাইরের দিকে দাঁড়ালাম।

    লোকটা তখন একটা দেশলাই জ্বালাবার চেষ্টা করছে। ড্যাম্প ধরা বলেই বোধহয় কাঠিটা ধরছে না।

    দেশলাই জ্বালাবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখে টর্চটা ফেললাম।

    কে? বলে আঁতকে উঠে সে যতখানি চমকাল, আমি তার চেয়ে কম নয়। লাভালের আস্তানায় চোরের মতো ঢুকেছে আর কেউ নয়, সোলোমাস। সাবাটিনি নিজে শয়তান হলেও সোলোমাস সম্বন্ধে তাহলে মিথ্যে বলেনি!

    প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কাটা সামলে তখন আমি কর্তব্য স্থির করে ফেলেছি। টর্চের আলোটা তার মুখের ওপর রেখেই ভেতরে ঢুকে পিস্তলটা তার দিকে উঁচিয়ে বললাম, আপনার সব খেল খতম, মসিয়ে সোলোমাস।

    সোলোমাস কিন্তু ভয় পাওয়ার বদলে এবার উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, যেন হাতে চাঁদ পেয়ে, ওঃ আপনি! আপনি এসেছেন দাদা! আপনার আশায় কীভাবে যে দিন গুনছি!

    কড়া গলায় বললাম, ওসব চালাকি রাখুন, সোলোমাস। একবার আমায় আহাম্মক বানিয়েছেন বলে কি বার বার পারবেন ভাবছেন? আপনার সব শয়তানি আমি জানি। বলুন, কেন লুকিয়ে এখানে এসেছেন? কোথায় লাভালকে সরিয়েছেন? সরিয়েছেন, না শেষ করে দিয়েছেন?

    এ সব আপনি কী বলছেন! সোলোমাসের গলার স্বর সত্যিই যেন কাতর, একটু ধৈর্য ধরুন। আমায় আলোটা জ্বালতে দিন, তারপর সব কথা শুনুন।

    আমি তখন আর সোলোমাসের অভিনয়ে ভুলতে রাজি নই। কঠোর হয়ে বললাম, আপনাকে আমি আর বিশ্বাস করি না এতটুকু। তা ছাড়া, আলো আপনি জ্বালবেন কীসে? এখানে তেল নেই।

    তেল ছাড়া আলো জ্বলবে! সোলোমাস গম্ভীর গলায় বলে ঘরের একদিকে যেতেই আমি টর্চটা তার ওপর রেখে বললাম, কোনও চালাকির চেষ্টা করেছেন কি গেছেন। আপনার দোস্ত সাবাটিনির পরিণাম তাহলে আপনার হবে।

    সাবাটিনির পরিণাম! তার সঙ্গে তাহলে এখানে আপনার দেখা হয়েছে! বলে সোলোমাস অবাক হয়ে ফিরে দাঁড়ালেন। কোথায় কী একটা টেপায় ঘরের ছাদের একটা গুপ্ত আলো তখন জ্বলে উঠেছে।

    সেই গুপ্ত আলোর রহস্যে যেটুকু কৌতূহল হয়েছিল, সোলোমাসের পরের কথায় তা ভুলে গিয়ে একেবারে থ হয়ে গেলাম।

    সোলোমাস আগের কথার খেই ধরেই উৎসুক হয়ে বললেন, কখন দেখা হল? আজ? তার কী পরিণামের কথা বলছেন?

    এবার আমাকে হতভম্ব হতে হল, কী বলছেন আপনি? আজ তার সঙ্গে কোথায় দেখা হবে? তাকে শেষ দেখেছি খার্তুমে।

    সোলোমাস হতাশভাবে বললেন, বুঝেছি, তাই আপনি অমন উলটো-পালটা কথা বলছেন। সাবাটিনি যে এখানে, তার জন্যই যে আমাদের এই সর্বনাশ—এসব আপনি কিছুই জানেন না।

    সোলোমাসের গলায় সত্যের সুর যতই থাক, সন্দেহ আমার গেল না। কঠিন হয়ে বললাম, আবার আমায় ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছেন, সোলোমাস!

    ধোঁকা আপনাকে কোনও সময়ই দিইনি, দাস! ক্লান্তভাবে বললেন সোলোমাস, আপনিই শুধু সাবাটিনির ছোঁয়াচ লেগে সব কিছু বাঁকা দেখছেন। অবিশ্বাস করতে হয় করবেন, কিন্তু তার আগে ধৈর্য ধরে কথাগুলো একটু শুনবেন?

    তাই শুনলাম এবার। শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম।

    সাবাটিনিকে আমি যতখানি চিনেছিলাম, সে তার চেয়ে অনেক পাকা শয়তান। আমার হাতে ওই লাঞ্ছনাতেও তার মতলবের কোনও পরিবর্তন হয়নি। আমায় নির্দেশ দেওয়া চিঠি চুরির মূলে যে সে-ই ছিল, এ-বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই। সেই নির্দেশ অনুসরণ করে আমার আগেই সে এখানে পৌঁছেছে। সম্ভবত কায়রো যাওয়ার পথে আমার যে দেরিটা হয়েছিল, তাতেই এ সুবিধে সে পেয়েছে। এখানে এসে সে যা চাল চেলেছে, বদমায়েশি বুদ্ধিতে তার তুলনা হয় না। এ-অঞ্চলের জংলি অধিবাসী হল ফাঙ্গ বলে এক অসভ্য জাত। সাবাটিনি কূট কৌশলে তাদেরই লাভালের বিরুদ্ধে খেপিয়ে দিয়েছে। কাছাকাছি নির্জন একটি পাহাড়-ঘেরা জায়গা ফাঙ্গদের পবিত্র দেবস্থান। সেখানকার একটি বিদুঘুটে আকারের পাথর তারা পুজো করে। সাবাটিনি সেই পাথরটা চুরি করে সরিয়ে দিয়ে ফাঙ্গদের ওঝা পুরুতদের ঘুষ দিয়ে বা যেভাবে তোক বুঝিয়েছে যে বিদেশি একটা লোক অন্য দেবতার পুজোর মন্দির বানিয়ে তাদের দেশ অপবিত্র করেছে বলেই ফাঙ্গদের নিজেদের দেবতা তাদের ছেড়ে গেছে। লাভালের ল্যাবরেটরিটাই ফাঙ্গদের দুশমন দেবতার মন্দির বলে সাবাটিনি বুঝিয়েছে। ফাঙ্গরাই একদিন এই ল্যাবরেটরির কাঠের বাড়ি তৈরি করতে ও বহুদুর থেকে সেখানকার যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম বয়ে আনতে সাহায্য করেছিল। এখন সেই ল্যাবরেটরি আর লাভালের ওপরই তারা খাপ্পা। লাভালকে তারা হঠাৎ চড়াও হয়ে ধরে নিয়ে গিয়ে বন্দী করেছে। আর চার মাস বাদে তাদের নিজেদের দেবতার উৎসবের দিন। সেই দিন এই ল্যাবরেটরিতেই লাভালকে বলি দিয়ে সমস্ত কিছু তারা পুড়িয়ে দেবে নিজেদের দেবতাকে সন্তুষ্ট করে ফিরিয়ে আনতে। এই তাদের সংকল্প। লাভালকে যেদিন জংলিরা ধরে নিয়ে যায়, সোলোমাস তার আগেই এ আস্তানায় পৌছোলেও জংলিদের হানা দেবার সময় উপস্থিত ছিলেন না। ল্যাবরেটরির জন্যেই কয়েকটা গাছ-গাছড়া সংগ্রহ করতে বেরিয়েছিলেন। ফিরে এসে লাভালের লেখা চিঠি পড়ে তিনি সব বুঝতে পারেন। লাভাল বন্দী হয়ে চলে যাবার আগে ওই চিঠিটুকু লিখে যেতে পেরেছিলেন।

    সোলোমাস লাভালের লেখা শেষ চিঠি আমায় দেখালেন। তাতে কটি মাত্র কথা তাড়াতাড়ি পেনসিল দিয়ে লেখা।

    মেলাস, আমি বন্দী। সাবাটিনের ষড়যন্ত্র। ল্যাবরেটরি বাঁচাও।

    চিঠি পড়ে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ কদিন আগের কথা?

    পাঁচদিন বললেন সোলোমাস, এ-পাঁচদিন কী করে যে আমার কেটেছে তা বলতে পারি না। এ আস্তানায় এসে ওই চিঠি পেয়েই আবার পালিয়ে যেতে হয়েছে। কখন জংলিরা আবার আসে কে জানে! ল্যাবরেটরি বাঁচাবার কথা লাভাল লিখে গেছেন। কিন্তু জংলিরা এলে বাঁচাব কী করে? একলা তাদের বিরুদ্ধে কী করতে পারি? বিশেষ করে সাবাটিনি যখন তাদের মন্ত্রণাদাতা। জংলিরা কিন্তু ল্যাবরেটরি ভাঙতে আসেনি। সেটাও সাবাটিনির পরামর্শে নিশ্চয়। সাবাটিনি তো সত্যিই ল্যাবরেটরি ভাঙতে চায় না। আপাতত জংলিদের সাহায্যে আমাদের জব্দ করে— পরে ল্যাবরেটরিসুদ্ধ লাভালকে লোপাট করে নিয়ে যাওয়াই তার মতলব। ফাঙ্গরা চার মাসের পর উৎসবের দিন ল্যাবরেটরির সঙ্গে লাভালকেও শেষ করতে চায় এ-খবর তারপর জেনেছি। জেনেছি একটি মাত্র বিশ্বাসী জংলির কাছে। সে-ই ছিল লাভালের ও আমার একমাত্র সঙ্গী ও অনুচর। আপাতত সে দলের লোকের ভয়ে ল্যাবরেটরিতে আসে না। তবে আমি এখান থেকে দূরে যে পাহাড়ের গুহায় লুকিয়ে আছি, খোঁজ করে সেখানে আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তার কাছেই সাবাটিনি ও ফাঙ্গদের সমস্ত খবর পেয়েছি। পেয়ে কী করব কিছুই ঠিক করতে না পেরে শুধু আপনার পথ চেয়ে আছি। আপনার দেরি দেখে তো ভয় হচ্ছিল সাবাটিনি আপনাকেও কোনও ভাবে বন্দী-টন্দি করেছে।

    একটু চুপ করে থেকে ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি যে আলো জ্বাললেন, তাতে কোনও ভয় নেই?

    না। সোলোমাস আশ্বাস দিলেন, পাহাড়ের খাঁজে এমন ভাবে এল্যাবরেটরি লুকোনো যে, বাইরে কোথাও থেকে এর আলো দেখা যায় না। তা ছাড়া, জংলিরা থাকে এখান থেকে অনেক পশ্চিমে জঙ্গলের মধ্যে বোমায় ঘেরা গ্রামে। সেখান থেকে রাত্রে তারা রাজত্বের লোভেও বেরুবে না। ভয় শুধু সাবাটিনিকে। কিন্তু সে-ও এখন মতলব হাসিল করে নিশ্চিন্ত মনে পরের চালের ফন্দি আঁটছে। তার রাত্রে এদিকে আসার কোনও দরকার নেই। আমি যে এখানে এসেছি, তা সে জানে না। আমি তাই প্রতি রাত্রে এসে ল্যাবরেটরিটা দেখে শুনে লুকোনো বিদ্যুতের ব্যাটারিগুলো চালু রেখে যাই।

    আচ্ছা, লাভাল তো চিঠিটা মেলাস বলে কাকে লিখেছেন। এবার আমি না বলে পারলাম না। আপনার নাম অথচ সোলোমাস বলেই জেনেছি।

    সোলোমাস একটু দুঃখের হাসি হেসে বললেন, সন্দেহ দেখছি এখনও আপনার সম্পূর্ণ যায়নি! শুনুন, মেলাস আমার পদবি। আমার পুরো নাম হল সোলোমাস মেলাস। পরিচয়টা লুকোবার জন্যেই শুধু সোলোমাস নামটা নিয়েছিলাম। লাভাল চিরকাল আমাকে মেলাস বলেই ডাকেন।

    একমহর্তে ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। বিস্মিত আনন্দে বললাম, ও, আপনিই তা হলে লাভালের সেই সহকারী, যিনি লাভালের আগেই দেশে যাবার নাম করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান?

    হ্যাঁ, লাভাল ও আমি দুজনে পরামর্শ করেই ওই ব্যবস্থা করেছিলাম। ঠিক হয়েছিল, প্রথমে আমি গা-ঢাকা দেব। তারপর লাভাল। আমার দেশ যে গ্রিস, তা নাম দেখেই নিশ্চয় বুঝেছেন। গ্রিসে যাবার নাম করে, দুনিয়ার কেউ কল্পনাও করতে পারে না, আমি গ্যাবোতে হাজির হব এমন জায়গা খুঁজে বার করে এখানে ল্যাবরেটরি বসাবার ব্যবস্থা আমিই করি। লাভাল পরে পালিয়ে এসে এখানে ওঠেন। শত্রুদের ধোঁকা দেবার জন্যে আমাকে তারপর বাইরে গিয়ে তাদের সঙ্গে মিথ্যে যোগাযোগ করতে হয়। শত্রুরা, বিশেষ করে সাবাটিনি, যাদের হয়ে কাজ করছে তারা কিন্তু ক্রমশই আমাদের চারিধারে জালের বেড়া দুর্ভেদ্য করে আনছে বলে ভয় হয়। বড় বড় রাজাগজাদের সাহায্য চাইতে আমরা নারাজ। রক্ষকই তা হলে ভক্ষক হয়ে দাঁড়াবে। পরামর্শের জন্যে একান্ত বিশ্বাসী বন্ধু হিসেবে লাভাল তাই আপনাকে স্মরণ করেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আপনাকে ডাকাও বৃথা হয়েছে। লাভালের যুগান্তকারী গবেষণা আর সম্পূর্ণ হবে না।

    সোলোমাস দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করবার পর বললাম, আমাদের দেশে একটা কথা আছে, সোলোমাস—যতক্ষণ শাস, ততক্ষণ আশ। সুতরাং আশা ছাড়বেন না। শুধু একটা কথা আগে আমি জানতে চাই। গবেষণা সত্যি কতদূর এগিয়েছে। পুরো সংখ্যা যে একশো সাঁইত্রিশ সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই তো?

    না।

    মূলাধার শুধু একটি?

    হ্যাঁ।

    আর সাজানো কীভাবে?

    ওই মাঝের একটি ম্যাগনেসিয়াম পরমাণুকে ঘিরে পঞ্চান্নটি কার্বন, বাহাত্তরটি হাইড্রোজেন, পাঁচটি অক্সিজেন ও চারটি নাইট্রোজেন পরমাণু। সোলোমাস বলে গেলেন।

    এই সমস্ত পরমাণু মিলিয়ে কৃত্রিম উপায়ে মূল জিনিস তৈরি করতে পেরেছেন ল্যাবরেটরিতে?

    হ্যাঁ, তা পেরেছি। শুধু জিনিসটা এখনও অসাড় বলা যায়। আসল কাজ ঠিক করছে না। সেই আসল কাজ করাবার গবেষণাই চলেছে। মানে এতদিন পর্যন্ত চলছিল। বলে সোলোমাস আবার দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।

    একটু চুপ করে ভেবে নিয়ে এবার বললাম, আপনাদের বিশ্বাসী জংলির নাম কী?

    উজি।

    উজি মানে তো সোয়াহিলি ভাষায় বুড়ো। লোকটা বুড়ো নাকি? জিজ্ঞেস করলাম।

    না, বুড়ো নয়। জোয়ান। ও-ই তার ডাক নাম।

    শুনুন, উজিকে দিয়েই ফাঙ্গদের কাছে খবর পাঠাবেন যে, তাদের মুঙ্গু, মানে দেবতা, এই ক-দিন বাদেই অমাবস্যার রাত্রে তাদের বোমা, মানে, কাঠের দেওয়াল ঘেরা গ্রাম থেকে কিছুদূরে যে টিঙ্গা টিঙ্গা অর্থাৎ জলা আছে, তার ওপারে এক ওকুমে, মানে, আবলুশ কাঠের গাছ থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলবেন।

    সোলোমাস হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এ-খবর পাঠাবার মানে?

    মানে, সত্যিই সেদিন তাদের দেবতা ওই ওকুমে গাছ থেকে তাদের জানাবেন যে, যে বিদেশিকে তারা ধরে নিয়ে গেছে, সে দেবতার দস্তুরমতো পেয়ারের লোক। তাকে এখুনি ছেড়ে দিয়ে তার ঘর-বাড়ি মন্দির মানে ল্যাবরেটরি যদি তারা নিজেরাই পাহারা দেবার ব্যবস্থা এখন থেকে না করে, তা হলে তিনমাস বাদে কুলৌ নদীর যে দুটি শাখা তাদের গাঁয়ের দুদিক দিয়ে বয়ে গেছে, তার একটা রক্তে লাল হবে আর একটায় আগুন জ্বলবে।

    সোলোমাস আমার দিকে সন্দিগ্ধভাবে চেয়ে বললেন, এই সব বিপদ দেখেশুনে আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে, দাস! ফাঙ্গরা যদি সত্যিই ওই জলার ধারে দেবতার কথা শুনতে যায় তো তারা ওই সব আজগুবি কথা বিশ্বাস করে লাভালকে ছেড়ে দেবে মনে করেন? সাবাটিনি তাদের পেছনে আছে একথা ভুলবেন না। যদি তিন মাস তারা দেবতার কথার প্রমাণ দেখবার জন্য অপেক্ষা করে?

    তা হলে প্রমাণ দেখতে পাবে! বলে হাসলাম।

    সোলোমাস অত্যন্ত ক্ষুন্নস্বরে বললেন, এটা কি ঠাট্টা-ইয়ার্কির সময়, দাস?

    ঠাট্টা-ইয়ার্কি করছি না, সোলোমাস। সত্যিই এক নদীতে জল লাল করে আরেক নদীতে আগুন জ্বালব। আপনাদের ল্যাবরেটরিতে সেন্ট্রিফিউজ নিশ্চয় আছে?

    আছে। সোলোমাস তখনও হতভম্ব।

    ভাল। আর শুধু ক-টা টেস্টটিউব আর জোরালো বিদ্যুতের আলো হলেই চলবে।

    কী চলবে? সোলোমাস অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কী করবেন আপনি?

    দুটো নেহাত তুচ্ছ প্রাণীর বংশবৃদ্ধি করাব।

    বংশবৃদ্ধি করাবেন! সোলোমাসের চোখ কপালে উঠল, কী প্রাণীর?

    একটা হল জিম্ননাডিনিয়াম ব্রিভ, আর একটা নটিলিউকা মিলিয়ারিস-নেহাত আণুবীক্ষণিক নগণ্য প্রাণের কণা, দুটো সুতলি চাবুকের মতো শুড় বার করা একরকম ডাইনো ফ্ল্যাজেলেট। হাতের ব্যাগটা খুলে একটা পিপেট বার করে বললাম, তার জন্যে এই কাঁচের সূক্ষ্ম ছুঁচই যথেষ্ট।

    আমি রসায়নের গবেষণা করি, ও সব প্রাণিতত্ত্ব বুঝি না। বলে সোলোমাস যে ভাবে হাল ছেড়ে দিয়ে চুপ করে গেলেন, তাতে মনে হল আমার মাথা খারাপ হওয়া সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ তাঁর আর তখন নেই।

    অমাবস্যার আগের দিন পর্যন্ত, দিনে সোলোমাসের সঙ্গে তার গোপন গুহায় লুকিয়ে থেকে, রাত্রে তাদের ল্যাবরেটরিতে আমি যা করবার করে ফেললাম। তারপর গোপনে উজির হাতে ক-টা দাগ-দেওয়া টেস্টটিউব দিয়ে নদীর কোন শাখায় কোনগুলো ফেলতে হবে বলে দিলাম।

    অমাবস্যার রাতে টিঙ্গা টিঙ্গার ধারে জংলি ফাঙ্গরা সত্যিই এসে জড়ো হল মাঝরাতে! সাবাটিনি তাদের আটকাবার অনেক চেষ্টা অবশ্য করেছিল। উজি বিদেশিদের কাছে কাজ করে বিধর্মীদের চর হয়েছে জানিয়ে, এটা শত্রুদের একটা ফাঁদ বলে বোঝাতে চেয়েছিল। জংলিরা তাতে উজিকে বন্দী করেছিল, কিন্তু কুসংস্কারের কৌতূহলে দল বেঁধে জলার ধারে আসতেও ছাড়েনি।

    জলার ওপারে ওকুমে গাছ থেকে দেবতার আদেশ শুনে ভড়কে গেলেও তারা লাভালকে কিন্তু ছেড়ে দিল না। সাবাটিনির উসকানিতে তারা তিনমাস বাদে প্রমাণের জন্যে অপেক্ষা করে রইল।

    সে তিনমাস কী উদ্বেগের মধ্যে যে কাটল, তা বলে বোঝানো যাবে না। সোলোমাস তো আমার ওপর তখন খেপেই গেছেন, ল্যাবরেটরিটা বাঁচাবার যেটুকু আশা ছিল, আমি যেন পাগলামি করে তা জলাঞ্জলি দিয়েছি।

    তিনমাস বাদে জংলিরাও যেমন প্রতিদিন নদীর দুই শাখার ওপর নজর রাখে, আমিও গোপনে গোপনে তা-ই।

    তারপর হঠাৎ একদিন জংলিদের সে কী তাণ্ডব নৃত্য! গ্রামকে গ্রাম জুড়ো ঙগোমা মানে উৎসবের নাচ শুরু হয়ে গেল। একটা নদীর জল সত্যিই রক্তের মতো লাল হয়ে উঠেছে, আরেকটা আগুনের মতো জ্বলছে।

    আপনার ওই ছুঁচ ফুটিয়েই একটা নদী থেকে রক্ত বার করে আরেকটায় আগুন ধরালেন! শিবু কাশতে কাশতে বলল।

    হ্যাঁ, আমার ব্যাগে ছিল সমুদ্রের জ্যান্ত অ্যানিমোনের টুকরো, দু-জাতের ডাইনো ফ্ল্যাজেলেটে ভরতি। পুয়ের্তোরিকো থেকে এনেছিলাম নকটিলিউকা মিলিয়ারিসের জীবাণু, সেখানকার নদী সমুদ্রের মোহানায় যাতে মাঝে মাঝে জল আগুনের মতো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর যাকে জিম ব্রিভ বলে জেলেরা, সেই জল-লাল করা মাছের মড়ক-লাগানো জিম্ননাডিনিয়াম ব্রিভের জীবাণু এনেছিলাম ফ্লোরিডা থেকে। সেন্ট্রিফিউজে অ্যানিমোনের টুকরোগুলো পাক খাইয়ে ছেতরে আলাদা করে তা থেকে অতি সূক্ষ্ম ছুঁচের মতো পিপেট দিয়ে এক একটি আলাদা জীবাণু তুলে তাদের আহার মেশানো টেস্টটিউবের ভেতর ছেড়ে উজ্জ্বল ইলেকট্রিক বাতির তলায় রেখে দিয়েছিলাম। সেই ইলেকট্রিক আলোই সূর্যের কাজ করছিল। জীবাণুগুলো লক্ষ লক্ষ গুণ তাতে বেড়ে উঠেছিল। তারপর সেই টেস্টটিউবের জীবাণু নদীর শাখায় ফেলবার পর তিনমাসে উপযুক্ত পরিবেশ পেয়ে অসম্ভব বেড়ে একদিন জলকে লাল আর আগুন করে তুলেছিল। ফ্লোরিডায় আর পুয়ের্তোরিকোয় এই ব্যাপার প্রায়ই ঘটে। সাধারণত এক পাঁইট জলে যে জীবাণু পাঁচশোর বেশি থাকে না, ঠিক প্রশ্রয় পেলে তা তিন কোটি হয়ে দাঁড়ায়।

    লাভালকে তা হলে জংলিরা ছেড়ে দিল! আমরা জিজ্ঞাসা করলাম।

    তা আর দেবে না! ছেড়ে শুধু নয়, সে তত ছোটখাটো দেবতা হয়ে উঠল তারপর। তাকে বা তার ল্যাবরেটরিকে ছোঁয় কার সাধ্য!

    আর সাবাটিনি?

    সাবাটিনিকে দেবতার রাগের প্রমাণ পাবার পর তারা ধরে বেঁধে ফেলেছিল। তাকে প্রাণে মারতে বারণ করেছিলাম। কিন্তু সেই সঙ্গে বলে দিয়েছিলাম, টিঙ্গা টিঙ্গার ধারের ওকুমে গাছ থেকে, তাকে পালাতে দিলেই দেবতা আবার খেপে যাবেন। সাবাটিনি ওই ফাঙ্গদের কাছেই বন্দী হয়ে আছে।

    কিন্তু এত কাণ্ড যার জন্যে, লাভালের সেই গবেষণার বস্তুটা কী?

    জিজ্ঞেস করে মনে হল আসল কাজ যখন হাসিল হয়েছে তখন প্রশ্নটা করে ঘনাদাকে ফাঁপরে ফেলার আর দরকার ছিল না।

    ঘনাদা কিন্তু মোটেই ভড়কালেন না। আমাদের দিকে করুণা ভরে তাকিয়ে বললেন, তা-ও এতক্ষণ বুঝতে পারোনি? বস্তুটা হল ক্লোরোফিল। গাছপালা থেকে সমুদ্রের সূক্ষ্ম প্ল্যাংকটন পর্যন্ত যার দৌলতে সূর্যের আলো রাহাজানি করে প্রাণিজগতের খাদ্যের ভিত তৈরি করে, যা না থাকলে পৃথিবীতে মানুষ তো দুরের কথা, প্রাণের অস্তিত্বই থাকত না, সেই ক্লোরোফিল কৃত্রিম উপায়ে তৈরি করবার চেষ্টা নানা দেশের বৈজ্ঞানিকরা করছেন। কিন্তু সে ক্লোরোফিল আসলের সঙ্গে সব দিক দিয়ে মিললেও এখনও আসল কাজ, মানে সূর্যের আলোর কোয়ান্টা ধরে কার্বন-ডায়োক্সাইডকে কার্বোহাইড্রেট করে তুলতে পারছে না জলের হাইড্রোজেনটুকু নিয়ে অক্সিজেন মুক্ত করে দিয়ে। লাভাল সেই গবেষণাতেই অন্যদের চেয়ে অনেক দূর এগিয়েছেন। সত্যিকার ক্লোরোফিল একবার কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হলে পৃথিবীতে অন্নাভাব বলে আর কিছু থাকবে না, মরুভূমির মাঝখানে থেকেও মানুষ নকল ক্লোরোফিল দিয়ে যত খুশি যা ইচ্ছে খাবারের মশলা তৈরি করতে পারবে।

    আমাদের স্বল্পাহার-ব্ৰতটা তা হলে— শিবু কথাটা শুরু করতেই ঘনা শিশিরের সিগারেটের টিনটা ভুলে পকেটে ভরে তাকে থামিয়ে বললেন, তার আর দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না। লাভালের কাছ থেকে খবর এল বলে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }