Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    ঘনাদাকে ভোট দিন (পার্ট ৩)

    পরের শনিবার পর্যন্ত ভু-ড়ুর লড়াইয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হল না। হাইতি দেশটাই ভু-ড়ুর নামে পাগল। ছেলে বুড়ো গরিব বড়লোক শিক্ষিত অশিক্ষিত সবাইকারই প্রকাশ্যে বা গোপনে ভু-ড়ুর সঙ্গে একটু আধটু সংস্রব আছেই। আমার কথা দু-তিন দিনের মধ্যেই ললাকের মুখে আর ঢাকের বাদ্যিতে প্রায় সারা হাইতিতেই ছড়িয়ে গেছে।

    যেখানে দরকার সেখানেও যে টনক নড়েছে, তা হপ্তা পুরো হবার আগে বৃহস্পতিবারই বুঝতে পারলাম।

    পোর্ট-অ-প্রিন্সের রুম্যাকাজু নামে একটা রাস্তায় একটা সাধারণ সস্তা গোছের হোটেলে ইচ্ছে করেই তখন আছি।

    বৃহস্পতিবার রাত বারোটার পর হঠাৎ ঘরের ফোন বেজে উঠল।

    নীচে থেকে রাত্রের হোটেল ক্লার্কই ফোন করছে। ইনিয়েবিনিয়ে এত রাত্রে বিরক্ত করবার জন্যে মাপ চেয়ে সে যা বললে তার মর্ম হল এই যে আমার সঙ্গে দুজন ভদ্রলোক হঠাৎ দেখা করতে এসেছেন। আমি কি তাঁদের জন্যে নীচের লবিতে নামব, না তাঁরাই আমার ঘরে যাবেন, জানতে চায় সে। ভদ্রলোকেরা বলছেন, বড় জরুরি দরকার, তাই বাধ্য হয়েই আমাকে এ ভাবে বিরক্ত করতে হচ্ছে বলে হোটেল ক্লার্ক দুঃখিত।

    গলাটা ঘুমে যেন জড়িয়ে আসছে এই ভাবে বললাম, আমিও দুঃখিত। ওদেরকে বলে দিন, এত রাত্রে কোনও ভদ্রলোক কারুর সঙ্গে আগে থাকতে কথা না থাকলে। দেখা করতে আসে না। সুতরাং, যাঁরা এসেছেন তাঁরা আপাতত জাহান্নমে গিয়ে কাল সকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন।

    বলেই ফোনটা সশব্দে নামিয়ে রাখলাম।

     

    মতলব ভেঁজে নিয়েই তারপর বসে ছিলাম। বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হল না। কয়েক সেকেন্ড বাদেই কাঠের সিঁড়িতে চার জোড়া ভারী বুট জুতোর আওয়াজ শুনতে পাওয়া গেল।

    দুজনই দেখা করতে এসেছেন ফোনে শুনেছিলাম। বাকি দুজন বুঝলাম ফাউ।

    প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। দরজায় প্রথম ধাক্কাটায় সাড়া দিলাম না।

    দ্বিতীয়বার ধাক্কা দিতে জড়ানো গলায় বললাম, কে? কে এত রাত্রে বিরক্ত করছে?

    ভারী গলায় হাইতির বিচিত্র ফরাসি উচ্চারণে হাঁক এল, দরজা খোলো।

    কে হে তোমরা বাপু! রাতদুপুরে জ্বালাতন করতে এসেছ? এটা হোটেল, না শুড়িখানা? দরজা খুলব না। কালই আমি এখানকার পুলিশকে সব জানাচ্ছি! বেশ ঝাঁজিয়ে বললাম।

    কাল জানাতে হবে না, এখনই জানাতে পারবে! আমরাই পুলিশ!

    পুলিশ! শুনে যেন আঁতকে ওঠার ভান করলাম। তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দিয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে বললাম, আমার কাছে পুলিশ নে? আমি কোনও অপরাধ তো করিনি।

    কী করেছ না করেছ, যেখানে নিয়ে যাচ্ছি সেখানে গিয়ে বোলো!

    চারজনের মধ্যে সবচেয়ে যার জাঁদরেল চেহারা, সে-ই আমায় ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঠেলে বললে, নাও, তৈরি হয়ে নাও, জলদি!

    কী তৈরি হব? কেন? আমি যেন দিশেহারা।

    চারজন ষণ্ডাই তখন ঘরের ভেতর ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়েছে। সবাইকারই চেহারা যমরাজের চেলার মতন। তার মধ্যে আমার সঙ্গে যে কথা বলেছে সেই-ই সর্দার। একেবারে যমরাজের দোসর বললেই হয়।

    সেই সর্দার একেবারে রক্তচক্ষু হয়ে বললে, কেন সে কৈফিয়ত তোমায় দিতে হবে নাকি? ভালয় ভালয় জামাকাপড় পরে নেবার সময় দিচ্ছি। নইলে ওই শোবার পোশাকেই যেমন আছ সেই হালেই হেঁচড়ে নিয়ে যাব।

    শুনে যেন ঘাবড়ে গেলাম। আমতা আমতা করে বললাম, কিন্তু তোমরা যে পুলিশ তার প্রমাণ কী?

    চারজনের হাতেই এবার একসঙ্গে রিভলভার উঠে এল খাপ থেকে।

    সর্দার বললে, প্রমাণ এই। এখন জ্যান্ত যেতে চাও, না লাশ হয়ে—সেটা ভেবে নাও।

    ভয়ে একেবারে যেন কেঁচো হয়ে বললাম, না, না—লাশ হয়ে যাব কেন! এখুনি আমি তৈরি হয়ে নিচ্ছি। দোহাই তোমাদের, ওই রিভলভারগুলো একটু সরিয়ে রাখো।

    যাক, সুবুদ্ধি তা হলে হয়েছে, বলে সর্দার রিভলভারটার খোঁচা দিয়েই পোশাক ছাড়বার স্ক্রিনের দিকে আমায় ঠেলে দিলে।

    খানিকটা বাদেই তৈরি হয়ে ফ্যাকাশে মুখে বেরিয়ে এসে করুণ মিনতির সুরে বললাম, আচ্ছা, ওই ড্রয়ারটা খুলে আমার একটা জিনিস সঙ্গে নিতে পারি?

    কী? গর্জন করে উঠল সর্দার।

    ছোট্ট একটা পিস্তল। তোমাদের ওই কোল্ট রিভলভারের চেয়ে অনেক ছোট। প্রায় ওর ছানাপোনার মতো। বিপদে আপদে সঙ্গে থাকা ভাল।

    জবাবে ঘাড়ে একটা রদ্দা খেয়ে যেন নেতিয়ে পড়লাম।

    সর্দারের ইঙ্গিতে দুজনে পাঁজাকোলা করে সিঁড়ি দিয়ে আমায় নামিয়ে নিয়ে গেল। নীচে হোটেল ক্লার্ক সভয়ে তার কাউন্টারের পাশে দাঁড়িয়ে কাঁপছে।

    যেতে যেতে করুণ সুরে তাকে বলে গেলাম, তোমাদের হোটেলের বিল কিছু বাকি রইল। বকশিশটাও দিয়ে যেতে পারলাম না!

    মাথায় একটা গাঁট্টা দিয়ে যমদূতেরা হোটেলের বাইরে আমায় এনে ফেললে।

    একটা কালো রঙের ঢাকা গাড়ি সব আলো নিবিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে। গাড়ির ভেতর আমায় ঢুকিয়ে, সামনে দুজন আর পেছনে দুজন আমার দুপাশে বসে আমার চোখের ওপর একটা কালো রুমাল বেঁধে দিলে।

    কাতরস্বরে বললাম, আমি কিন্তু বাবা মুস্তাফা নই।

    কী বকছিস, হতভাগা! সর্দার মুখে একটা থাবড়া দিলে। ককিয়ে উঠে বললাম, আমোক মারছ কেন? বাবা মুস্তাফার নাম শোনোনি? আলিবাবার গল্প তো শুনেছ? না শুনে থাকো তো বলতে পারি। খুব মজার।

    আর একটা থাবড়া দিয়ে সর্দার বললে, তোর নিজের মজার কথা এখন ভাব, হতভাগা। টু শব্দটি আর করেছিস তো দাঁতগুলো উপড়ে দেব।

    অগত্যা ভয়ে ভয়েই যেন চুপ করে রইলাম।

     

    বেশ একটু ঘুরপাক রাস্তায় আধঘণ্টা বাদে এক জায়গায় এসে গাড়িটা থামল। গাড়ি থেকে আমায় টেনে নামিয়ে চোখ বাঁধা অবস্থাতেই একটা বাড়ির ভেতর নিয়ে গেল তারপর।

    যেতে যেতে দুবার আমি কাশলাম, হোঁচট খেলাম একবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার সময়। আর, পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়েই গেলাম একবার প্রায় আছাড় খেয়ে।

    হেঁচকা টানে আমায় তুলে প্রায় ঝুলোতে ঝুলোতে একটা বড় ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়ে সর্দার আমার চোখের বাঁধনটা খুলে দিয়ে বললে, মর্কটটাকে জ্যান্তই এনেছি, হুজুর।

    বাঁধা চোখ এতক্ষণ বাদে খোলার পর প্রথমটা মিটমিট করে তাকিয়ে সব একটু ঝাপসা লাগল। তাতেও হুজুর বলে কাকে সম্বোধন করা হয়েছে বুঝতে কষ্ট হল না।

    আমি যদি মর্কট হই তা হলে তিনি গোরিলার খুড়তুতো ভাই। সমস্ত দরজা-জানালা বন্ধ করা একটি বেশ বড় ঘরের এক পাশের একটি বিরাট টেবিলের ধারে কয়লার পাহাড়ের মতো বসে আছেন।

    তাঁর দিকে কিয়ে বেশ সসম্ভ্রমে কাঁদো কাঁদো গলায় নালিশ করলাম, আপনার

    পোষা গুণ্ডাগুলো মিছিমিছি আমায় হয়রান করেছে, হুজুর।

    ভাঁটার মতো চোখ দুটো কুঁচকে বিদ্রুপের স্বরে হুজুর বললেন, তাই নাকি? বড় অন্যায় তো!

    আজ্ঞে হ্যাঁ, অন্যায় নয়? আমি গলায় সরলতা মাখিয়ে বললাম, আমি পাশের হোটেলে থাকি, সেখান থেকে এখানে আনবার জন্যে আধঘণ্টা এ রাস্তা ও রাস্তা ঘোরাবার কিছু দরকার ছিল?

    গোরিলা-হুজুরের চোখ দুটো এক মুহূর্তে আগুনের ভাঁটাই হয়ে উঠল। গুণ্ডা চারটের দিকে ফিরে ইঞ্জিনের স্টিম ছাড়ার মতো আওয়াজ ছাড়লেন, কী শুনছি!

    খানিক আগে পর্যন্ত কেঁদো বাঘ হয়ে যে হুঙ্কার ছেড়েছে, সেই সর্দার এক নিমেষে নেংটি ইদুর হয়ে চি চি করে যেন কাতরে উঠল, আমরা হুকুমমতো চোখ বেঁধেই এনেছি, হুজুর! আপনার সামনেই তো ওর চোখের বাঁধন খুললাম।

    তা হলে ও জানল কী করে? হুজুর গর্জন করে উঠলেন।

    জানি না হুজুর! সর্দারের গলার সঙ্গে সমস্ত শরীরটাই বুঝি তখন কাঁপছে!

    নেহাত হাঁদা বেকুফ সেজে বললাম, আপনার হয়ে ওর কানটা মলে দেব, হুজুর?

    কী! হুজুর প্রথমটা রাগেই ফেটে পড়বেন মনে হল, তারপর হঠাৎ ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে বললেন, কান মলে দিবি! তুই? তাই দে, দেখি। অবশ্য যদি নাগাল পাস।

    নাগাল ঠিক পাব, হুজুর! কিন্তু গুলিগোলা যদি ছোঁড়ে তাই ভয়!

    না, না গুলি ছুঁড়বে না! হুজুর তখন আমার মতো গাঁইয়া একটা উজবুকের নাকাল দেখবার জন্য মেতে উঠেছেন। হুকুম করলেন, রিভলভার ফেলে দে, গোবো।

    সর্দার, মানে গোবো, রিভলভারটা খাপ থেকে বার করে ফেলে দিয়ে আবার কেঁদো বাঘ হয়েই আমার দিকে ফিরে দাঁড়াল। আক্রোশে অপমানে তার দাঁত কিড়মিড়ের আওয়াজ পর্যন্ত আমি তখন শুনতে পাচ্ছি।

    গাছ থেকে যেন ফুল পাড়তে যাচ্ছি এমনই ভাবে আনাড়ির মতো একটা হাত তুলে গোবোর দিয়ে এগিয়ে গেলাম।

    সেই হাত মুচড়ে ধরে গোবো যে ঝটকানি দিলে তাতে মেঝেয় আছড়ে পড়ে যেন কাতরাতে কাতরাতে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনার গোবো একটু বেয়াড়া হুজুর! কান মলতে দিতে চায় না!

    হুজুরের হাসিতে ছাদটাই বুঝি খসে পড়ে! হাসতে হাসতেই বললেন, তুই কী চাস তা-ই বল। এখনও কান মলার সাধ আছে?

    আছে বই কী হুজুর! আমি একেবারে সাদাসিধে ভালমানুষ, ওর কান না মললে আমার মান থাকবে না যে!

    এবার হুজুরের সঙ্গে তাঁর বাহনদের হাসিও থামতে চায় না।

    হুজুর হাসি থামিয়ে শেষে বললেন, হুঁ, বেজায় মানী লোক তুই বুঝতে পারছি। মানটা যাতে থাকে তা হলে তাই দেখা

    যে আজ্ঞে হুজুর! বলে আবার আগের মতোই একটা হাত তুলে এগিয়ে গেলাম। গোবো মোচড় দিয়ে ধরলও হাতটা কষে। তারপর হুজুরের টেবিলটাই মড় মড় করে উঠল দু-মণি গতরটা সচাপটে তার ওপর পড়ায়।

    জানি! জানি! ধোবিকা পাট! বিশে আর নিজেকে সামলাতে পারল না উচ্ছাসের চোটে, এই একটি প্যাঁচ ঠিক মতো লাগাতে পারলে কুম্ভকর্ণও কাবু!

    না রে না, ধোবিকা পাট নয়, দশরথ মুরুব্বির মতো বিশেকে শোধরালে, ও হল বাংলা কাঁচি।

    উঁহু! ওটা হাফ নেলসন! এতক্ষণ ধৈর্য ধরে থেকে গৌর আর ফোন না দিয়ে পারল না।

    দূর! স্রেফ জুডো। আমিই বা কেন কম যাই!

    উঁহু! সুমো! শিশির আমাদের সকলের উপর টেক্কা দিতে চাইল।

    ঘনাদা অবজ্ঞাভরে আমাদের দিকে চেয়ে, শেষ পর্যন্ত কী বুঝে দশরথকেই গাছে তুললেন। বললেন, না, দশরথবাবুই ঠিক ধরেছেন। বাংলা কাঁচিই চালিয়েছিলাম। হুজুরকে তখন নিজেকে বাঁচাতে পেছনে হেলতে হয়েছে। ধীরে সুস্থে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে আধমরা লাশটাকে তুলে যেন ফাঁপরে পড়ে বললাম, কিন্তু কোন কানটা মলব ঠিক করতে পারছি না যে, হুজুর! আপনি যদি বলে দেন!

    হুজুর তখন সামলে উঠে অত্যন্ত সন্দিগ্ধভাবে আমার দিকে চেয়ে আছেন।

    তাঁর কাছে জবাব না পেয়ে আবার বললাম, কান মলাটা আজ বরং মুলতুবি থাক, হুজুর। কান টানতে কোন মাথা এসে পড়ে, তাই আমার ভাবনা। আজ বরং এদের বিদেয় করে দিন। এত ঘটা করে যখন নেমন্তন্ন করে এনেছেন, তখন নিরিবিলিতে দুটো প্রাণের কথা বলাবলি করি।

    হুজুর কী যেন ভেবে নিয়ে অনুচরদের চলে যাবার ইঙ্গিতই করলেন। তারা গোববাকে ধরাধরি করে নিয়ে যাবার পর আমার দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন, কে তুই?

    সে কী হুজুর! আমি যেন অবাক। আপনি এখানকার পুলিশের চাঁই। আমার পরিচয় না জেনে কি আর মিছিমিছি ধরে আনিয়েছেন। কিন্তু হোটেলের পাশের এ বাড়িটা যে পুলিশের আস্তানা তা তো জানা ছিল না।

    পাশের বাড়িতেই যে তোমাকে আনা হয়েছে, তা কী করে বুঝলে? তুই থেকে তুমি-তে তুলে খাতির দেখালেও হুজুরের গলা বেশ তীক্ষ, চোখের বাঁধন আলগা ছিল?

    না, হুজুর! আমি আশ্বস্ত করলাম, সে বিষয়ে ওদের কোনও কসুর নেই। কিন্তু আমি যে এ ঘর পর্যন্ত আসতে দুবার কেশেছি, একবার হোঁচট খেয়েছি, পায়ে পায়ে জড়িয়ে পড়তে পড়তেও বেঁচেছি।

    তাতে কী হয়েছে! হুজুর খাপ্পা হয়ে উঠলেন, আমার সঙ্গে রসিকতা হচ্ছে!

    জিভ কেটে বললাম, ছিঃ ছিঃ! বলেন কী হুজুর! আপনার সঙ্গে আপনারই থাবার তলায় থেকে রসিকতা করতে পারি? শুধু-হাতে গোবোকেই না হয় একটু শিক্ষা দিয়েছি, কিন্তু এ-বাড়িতে অমন কত গোবো পোষা আছে কে জানে! আপনার একটু ইশারা পেলে এবার শুধু-হাতেও আর লড়তে আসবে না। তা ছাড়া, আপনি নিজেই আমার মতো একটা পোকাকে তো বুড়ো আঙুলে টিপে মারতে পারেন।

    চুপ! হুজুর ধমকে উঠলেন, তোমার বাজে বকবকানি শুনতে চাইনে। তোমার হোটেলের পাশের বাড়ি কী করে বুঝলে?

    ওই তো বললাম, হুজুর। দুবার কেশে তার আওয়াজে বুঝলাম, একবার একটা বড় হল ঘর, আরেক বার একটা ঢাকা করিডরের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। ধাপ গুনতে গুনতে সিড়ি দিয়ে ওঠবার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে, হাত বুলিয়ে বুঝে নিলাম সিঁড়িগুলো মার্বেল পাথরের। ধাপ গুনেও টের পেলাম দস্তুরমতো উঁচু চারতলা বাড়ি ছাড়া এটা হতে পারে না। আর তারপর, পায়ে পায়ে জড়িয়ে প্রায় আছাড় খেয়ে পড়তে পড়তে, একটা বারান্দার রেলিং ধরে ফেলে, তার ওপর যে বাহারে কারুকাজের নমুনা পেলাম তাতে সব সুদ্ধ মিলিয়ে আর সন্দেহ রইল না যে, হোটেলের পাশের বাড়িতেই ঘুরপাক খাইয়ে আমায় আনা হয়েছে। হাইতির পোর্ট-অ-প্রিন্স শহরে একমাত্র রু-ম্যাকাজু রাস্তাতেই একটিমাত্র এতবড় শৌখিন বাড়ি আছে, একথা এখানকার চাষাভুষোও জানে। এ-বাড়িটা হাইতির বিখ্যাত এক সদাগর নিজের শখ মেটাতে অজস্র খরচ করে তৈরি করেছিলেন জানি। আপনাদের কোন রাজনৈতিক দলের কোপে পড়ে তিনি নাকি এক বছর নিরুদ্দেশ। তাঁর বাড়িটা যে কবে পুলিশের আস্তানা হয়েছে, এইটুকু শুধু জানতাম না

    হুজুর আমার কথা শুনতে শুনতে ইতিমধ্যে গোবোর ফেলে যাওয়া রিভলভারটা তুলে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। এবার টেবিলের পেছন থেকে বেরিয়ে এসে আমার সামনে বাজিকরের মতো রিভলভারটা হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, তুমি হাইতির লোক নও জানি। কোথা থেকে কেন তুমি হাইতিতে এসেছ? ভু-ড়ুর আসরে ও-রকম বাহাদুরির জাঁক করবার মানে কী? কী জানো তুমি এল ডোরাডোর সোনার পালকের?

    প্রশ্নগুলো বড় বেশি হয়ে গেল না, হুজুর? সবিনয়ে বললাম, তবে একটা কথা বললেই তা থেকে সব কটা প্রশ্নের জবাব বোধহয় পেতে পারেন। আমি ব্রিটিশ গায়না থেকে হাইতিতে এসেছি এক নরপিশাচের সন্ধান করতে?

    কে সে? হুজুরের চোখ দুটো যেন ছুরির ফলার মতো আমায় চিরে ফেলবে।

    এখানে নাম ভাঁড়িয়ে কী যে হয়েছে জানি না, তবে তার আসল নাম হল সেভিল। ডেভিল হলেই অবশ্য মানানসই হত। হুজুর যেন একটু চমকে উঠলেন! চেনেন নাকি?

    না। হুজুরের গলা থেকে চাপা গর্জন শোনা গেল। কিন্তু তুমিই বা তার কী জানো? তাকে খুঁজছই বা কেন?

    চোখে আগে না দেখলেও তার আসল নাড়ির খবরই জানি। আর তাকে খুঁজছি পৃথিবীর সবচেয়ে দামি এক টুকরো ভাঁজ করা কাগজ তার কাছে থেকে আদায় করব বলে, যে কাগজে কুবেরেরও ঈর্ষা করবার মতো কল্পনাতীত ঐশ্বর্যের ভাণ্ডারের হদিস দেওয়া আছে। যে কাগজে তার সত্যিকার মালিক সরল উদার কাপলান নামে এক বৃদ্ধ পর্যটক, সারা জীবন অজানা ভয়ংকর জলা-জংলায় পদে পদে মৃত্যুর সঙ্গে যুঝে অতি গোপন মানচিত্র আর নির্দেশ টুকে রেখেছিলেন। যে কাগজ বৃদ্ধ কাপলানের বিশ্বাসী সহকারী সেজে তাঁকেই অজানা গভীর জঙ্গলে মুম্ষু অবস্থায় ফেলে সেই শয়তান চুরি করে পালিয়ে এসেছিল।

    উদ্দেশ্য তোমার সাধু! হুজুরের গলায় এবার ঠাট্টার সুর, কিন্তু সেই সেভিল না ডেভিলকে তুমি পাবে কোথায়? সে যদি হাইতিতেই থাকে তবে তোমার হাতে ধরা দিতে হাত বাড়িয়ে নেই নিশ্চয়!

    হাত তাকে বাড়াতেই হবে। ওই সোনার পালকের টানে! হুজরের দিকে চেয়ে হেসে বললাম, বুড়ো কাপলান এল ডোেরাডোর আসল ঘাঁটির সন্ধান তখনও না পেলেও কিছু কিছু সম্পদ উদ্ধার করতে পেরেছিলেন। জলা-জংলায় ঘোরবার সময় তিনি সাংঘাতিক ভাবে একবার অসুস্থ হন। সেই সুযোগে তাঁকে অসহায় ভাবে ওই বিপদের মধ্যে ফেলে সেভিল তাঁর খুঁজে পাওয়া সম্পদ আর ওই কাগজটা চুরি করে পালিয়ে আসে। সে তারপর এসে হাইতিতে রাজনীতির খেলায় মেতেছে, এ বিষয়ে পাকা খবর আমি পেয়েছি। গুপ্তঘাতকের দল গড়ে সে হাইতির দুদলের একটিকে মোটা টাকা নিয়ে যে সাহায্য করছে তা-ও জানি। এখানে একটা বড় দাঁও সে মারতে চায়, কিন্তু এল ভোরাডোর কথাও সে ভোলেনি। তার মতো শয়তান ভুলতে পারে না। এখানকার পালা চুকলে, সে আরেকবার ওই চুরি-করা কাগজের সাহায্যে এল ডোরাডোর আসল ঘাঁটির সন্ধান করে পারবে না। গায়নার সোনার পালকের খবর টোপের মতো ফেলে তাই তাকে গাঁথবার চেষ্টা করেছি।

    হুজুর মোটা মোটা ঠোঁট দুটো একটু ফাঁক করে বিশ্রীভাবে হাসলেন-কিন্তু তাকে টোপে গাঁথতে গিয়ে নিজেই তার জালে জড়িয়ে মরতেও তো পারো!

    তা তো পারিই। সে ঝুঁকি না নিয়ে কি নেমেছি!

    হুঁ! হুজুর যেন দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, শুকনো নারকেল দড়িতে তেল আছে। দেখছি। কিন্তু এ-শব কথা তুমি জানলে কোথা থেকে?

    জেনেছি হুজুর—ওই ওরিনোকো নদীরই দুই শাখাকারোনি আর পারাকুয়ার মাঝামাঝি এক অজানা অঘোর জঙ্গলে। সেখানে নিঃসহায় অবস্থায় মরতে বসা এক বুডোর দেখা পাই। ভাঙা ঘেঁড়াখোঁড়া একটা তাঁবুর তলায় মৃত্যুশয্যায় তিনি আমায় সব কথা জানিয়ে যান। তাঁকে সেখানে কবর দেবার সময় প্রতিজ্ঞা করি—পৃথিবীর যেখানেই লুকিয়ে থাক, শয়তান সেভিলকে খুঁজে বার করে তাকে কিছু শিক্ষা দিয়ে ও কাগজ আমি উদ্ধার করবই।

    হুজুরের ভাঁটার মতো চোখ দুটো তখন আবার জ্বলতে শুরু করেছে। রিভলভারটা ঘোরানো বন্ধ করে, একটু শক্ত করেই যেন চেপে ধরে চাপা গর্জনের আওয়াজে তুমি থেকে আবার তুইতোকারিতে নেমে বললেন, হ্যাঁ, তোর সাধ শিগগিরই পূর্ণ হবে মনে হচ্ছে। কিন্তু ও-জঙ্গলে তুই কী করতে গিয়েছিলি তাই আগে বলে যা।

    বলব বই কী, হুজুর! কৃতার্থ হয়ে বললাম, আপনাকে বলবার এ-সুযোগ ছাড়তে পারি! কিন্তু তার আগে আপনার টেবিলের ধারের ওই ইলেকট্রিক বোতামটা যদি একটু টেপেন।

    কেন? হুজুর অগ্নিমূর্তি হয়েও যেন একটু হতভম্ব।

    না, এক গেলাস জল দরকার ছিল। বোতাম টিপে কাউকে দিয়ে যদি আনাতেন!

    ও! গলা শুকিয়ে গেছে বুঝি! হুজুরের মুখে হিংস্র বিদ্রুপ।

    না, হুজুর! সবিনয়ে প্রতিবাদ জানালাম, এ-শুকনো গলা আর শুকোবে কি? তবে জল এক গেলাস কাছে থাকা ভাল! কখন কী দরকার হয় কে জানে?

    দরকার হলে তখন পাবি? হুজুর আবার গর্জালেন, এখন যা জিজ্ঞেস করছি, বল তাড়াতাড়ি।

    তাড়াতাড়িই বলছি, হুজুর। তবে জলটা আনিয়ে রাখলে পারতেন। অবশ্য ও-বোতাম টিপে জল আনানো যায় কিনা ঠিক জানি না। ওর আওয়াজে আপনার সব ক-টা পোষা নেকড়ে দাঁত বার করে ছুটেও আসতে পারে হয়তো এখানে! বোতামটা সেই জন্যই, কী বলেন?

    হুজুর বুঝি এবার ফেটেই পড়েন। তাঁকে যেন ঠাণ্ডা করতে তাই তাড়াতাড়ি আবার বললাম, রাগ করবেন না, হুজুর। যা বলবার এখনই বলছি। কী করতে ওই জঙ্গলে গেছলাম, জিজ্ঞেস করেছেন তো! একবার গেছলাম ওই ম্যানাটি মানে শুশুকগুলোকে ছাড়তে, আর একবার গেছলাম তাদেরই খবর নিতে।

    কাদের খবর নিতে! হুজুরের জালার মতো মুখের সবটাই বুঝি এখন হাঁ।

    ওই ম্যানাটি, মানে একরকমের শুশুকগুলোর। বছরখানেক আগে ওই অঞ্চলের এক জলায় ছেড়ে এসেছিলাম কি না!

    ওই জঙ্গলে ম্যানাটি ছেড়ে এসেছিলে? আবার খবর নিতে গেছলে তাদের? কেন? হুজুরের মাথাটা তখনও বেশ গুলিয়ে আছে বোঝা গেল।

    আর বলেন কেন হুজুর! আমি যেন বিরক্ত—পাঁচজনের উসকানিতে।

    চালাকি করবার আর জায়গা পাওনি! হুজুরের গলায় আবার এতক্ষণে গর্জন শোনা গেল, পাঁচজনের উসকানিতে অজানা জঙ্গলে তুমি শুশুক ছেড়ে এসে আবার খবর নিতে গেছলে? কার উসকানিতে? কে তারা?

    আজ্ঞে, বললাম তো ওই পাঁচজন। নিরীহ গোবেচারার মতো বললাম, তবে তাদের নাম বললে কি চিনবেন! তাঁরা তো আজকের লোক নয়, এদেশেরও না।

    কে তারা? কবেকার? কোথাকার?

    আজ্ঞে, প্রায় সবাই চারশো বছর আগেকার। তার মধ্যে চারজন স্পেনের আর একজন ইংল্যান্ডের। ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে বাদ দিলে প্রথম যিনি সবচেয়ে উসকেছেন তাঁর নাম হল মার্টিনেজ। ও-অঞ্চলে সবার আগে সবচেয়ে বড় অভিযান যিনি করেছিলেন, সেই দিয়েগো দ্য অর্দাজের লেফটেন্যান্ট ছিলেন মার্টিনেজ। ১৫৩১ সালে জাহাজড়ুবি হবার পর কীভাবে তাঁকে উদ্ধার করে, সোনা যেখানে খোলামকুচি সেই ওমোয়া-য় নিয়ে গিয়ে, সোনায় মোড়া রাজা এল ডোরাডো তাঁর খাতির করেন, মার্টিনেজ তার বিবরণ দিয়ে গেছেন। মার্টিনেজের পর উসকানি পেয়েছি ওরেল্লানার কাছে। তাঁর অভিযান ১৫৪০ থেকে ১৫৪১-এ। তারপর আছেন ফিলিপ হটেন, ১৫৪১ থেকে ১৫৪৬ পর্যন্ত যিনি অভিযান চালান। ইস্পাহানিদের মধ্যে শেষ উসকানি পেয়েছি গনজালো জিমেনেস দ্য কোয়েদার কাছে। তাঁর অভিযান ১৫৬৯ সালের।

    এরপর যিনি উসকানি দিয়েছেন তাঁর নামটা হয়তো শুনে থাকতে পারেন। তিনি হলেন স্যার ওয়ালটার র্যালে। র্যালে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত অসামান্য বীর। কিন্তু তখনকার আরও অনেক বীরের মতো সুযোগ-সুবিধে হলে জলদস্যুতায় তিনি পেছপাও হতেন না। স্পেনের কয়েকটা এমনইভাবে লুট করা জাহাজের কাগজপত্রে, সোনায় মোড়া রাজ্য মানোয়া বা ওমোয়া-র খবর পেয়ে স্যার ওয়ালটার র্যালে ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দে একটি অভিযানে যান। সে অভিযানের পর ১৫৯৬-এ তিনি আবার লরেন্স কেমিস নামে একজনকে এল ডোরাডোর সন্ধানে পাঠান। তারপর শেষবার ১৬১৭ সালে মৃত্যুর একবছর আগে তিনি নিজেই আবার সেই সন্ধানে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল তাঁর ছেলে আর আগেকার প্রতিনিধি সেই লরেন্স কেমিস। এই অভিযান থেকেই স্যার ওয়ালটারের চরম দুর্ভাগ্য শুরু। জ্বরে পড়ে তাঁকে ত্রিনিদাদে আটকে থাকতে হয়। তাঁর ছেলে আর লরেন্স কেমিস পাঁচটি ছোট ছোট জাহাজ নিয়ে এল ডোরাভোর সন্ধানে যাবার পথে ইস্পাহানি দলের সামনে পড়ে। যুদ্ধে স্যার ওয়ালটারের ছেলে মারা পড়ে, কেমিস সে-দুঃসংবাদ নিয়ে ফিরে আসার পর, স্যার ওয়ালটারের বকুনি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। আর এ-অভিযান থেকে হতাশ হয়ে ইংল্যান্ডে ফেরার পর, বন্দী হয়ে এক বছর পরেই স্যার ওয়ালটারকে ফাঁসি কাঠে ঝুলতে হয়। তাই বলছিলাম হুজুর, এই পাঁচজনের উসকানি…

    থাক! হুজুর কথাটা আর আমায় শেষ করতে দিলেন না। এতক্ষণ ধৈর্য ধরে যে চুপ করে ছিলেন সেইটেই আশ্চর্য। এবার গনগনে মেজাতে গর্জে উঠলেন, এ সব পালাকীর্তন তোর কাছে শুনতে চেয়েছি?

    তাই তো চাইলেন, হুজুর। তা ছাড়া শুনতে শুনতে আপনি একটু আনমনা হন কি , ফালতু কথা বাড়িয়ে তা-ও পরখ করে দেখছিলাম!

    তা-ই দেখছিলি? হুজুর চিড়বিড়িয়ে উঠলেন, আমায় আনমনা করে তুই এখান

    থেকে সটকাতে পারবি ভেবেছিস? জানিস তুই কোথায় আছিস?

    জানি বই কী হুজুর। এই চারতলা পেল্লায় যমপুরীর দরজায় দরজায়, সিড়িতে সিঁড়িতে পাহারা। ঘরে ঘরে আপনার সব সাঙ্গপাঙ্গ ছোরা পিস্তল নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছে। ওই বোতাম টিপলেই সব ছুটে আসবে। তবু ভাবছিলাম, ওদিকের বন্ধ জানালাটা খুললে হয়তো একটা খোলা বারান্দা পাওয়া যাবে। ওখান দিয়ে নিয়ে আসবার সময় বাইরের দমকা হাওয়া একটু গায়ে লাগল কি না, তাই ভাবলাম বারান্দায় একবার পৌছোতে পারলে, সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পাশের বাজারের ছাদের ওপর পড়া খুব শক্ত নয়। এ পথে যেতে-আসতে বাজারের ছাদটা অনেকবার চোখে পড়েছে। করোগেটের ঢালু চাল হলেও মাথাটা বেশ উঁচু। আর তেতলার বারান্দা থেকেও খুব বেশি লাফাতে হবে না। তারপর একবার বাজারের মধ্যে গিয়ে পড়তে পারলে…

    আর তোর ভাবনা নেই, কেমন?হুজুরের মুখে, বেড়াল যেন ইদুর ধরে খেলাচ্ছে এমনই হাসি—আমি তখন শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকব। কী বলিস?

    আজ্ঞে, আশা করতে দোষ কী? আমি করুণ সুরে বললাম। চোপ রও! বেয়াদব! হুজুর আবার বজ্রনাদ ছাড়লেন, সোজাসুজি বলবি কি না ও জঙ্গলে কী করতে গিয়েছিলি? কোনও নিশানা কারুর কাছে পেয়েছিলি কিনা!

    সোজাসুজিই তো বললাম হুজুর, নিশানা যা পেয়েছি ওই পাঁচজনের কাছেই, আর গিয়েছিলাম সবাই যে-জন্য যায় সেই জন্যেই। আমি তো আর একলা ও-অপরাধ করিনি হুজুর, আজ চারশো বছর ধরে হাজার হাজার মানুষ জান-প্রাণ তুচ্ছ করে ওই যমের দক্ষিণ দোরের দিকে ছুটেছে, সেই হারানো ওমোয়র সন্ধান করতে। পুমা, জাগুয়ার আর অসভ্য জংলিরা কতজনকে শেষ করেছে, নদী-জলায় অ্যানাকোন্ডা আর ও দেশের রাক্ষুসে কুমির কেম্যানের পেটে কতজন গেছে, দুর্দান্ত বিষধর ল্যাবেরিয়া বুশমাস্টার ব্যাটল সাপের ছোবলে কতজন প্রাণ দিয়েছ তার লেখা-জোখা নেই। তবু মানুষের লোভ, দুঃসাহস আর কৌতূহল কোনও বাধা মানেনি। বহুদিন পর্যস্ত মানুষের ধারণা ছিল, গায়নার পারিমা হ্রদের ধারে ওমোয়া শহর পাওয়া যাবে। অভিযাত্রীরা সেই পারিমা হ্রদ খুঁজেছে হন্যে হয়ে। ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ফন হুমবোন্ড প্রমাণ করে দেন যে, এতদিন দেশবিদেশের মাপে যে পারিমা হ্রদের চিহ্ন দেওয়া থাকত, তার কোন অস্তিত্বই নেই। তবু কি মানুষের অভিযান বন্ধ হয়েছে, হুজুর! কোথাও এল ডোরাডোের সোনায় মোড়া রাজধানী ওই অজানা জলা-জংলার দেশে লুপ্ত হয়ে আছেই এ-ধারণা সহজে যাবার নয়। যাবেই বা কী করে? এখনও ওই দেশের অজানা গহন অঞ্চল থেকে ওখানকার আদিবাসীদের হাত-ফেরতা হতে হতে একটা-দুটো যে আশ্চর্য সোনার পালক সভ্যমানুষের জগতে এসে পৌছোয়, তার রহস্যের তো কিনারা হয়নি।

    ফের বকবকানি ধরেছিস! হুজুর জ্বলে উঠলেন, ওখানে শুশুক ছাড়ার কথা কী বলছিলি?

    সত্যি কথাই বলছিলাম, হুজুর। শুশুক ছাড়ার মতলবটা অবশ্য হঠাৎ মাথায় এসেছিল। দু বছর আগে এমনই জুন মাসের এক গরমের দিনে ত্রিনিদাদ থেকে ব্রিটিশ গায়নার জর্জ টাউনে যাবার একটি জাহাজে কাপলানের সঙ্গে আলাপ না হলে

    অবশ্য এ মতলব খাটাবার কথা ভাবতাম না।

    দু বছর আগে, জুন মাসে কাপলানের সঙ্গে তোর জাহাজে দেখা হয়। হুজুর একেবারে মারমুখখা। আমার কাছে ধাপ্পা!

    আজ্ঞে, ধাপ্পা আপনাকে দিতে পারি! কাপলানের সঙ্গেই সত্যি আমার দেখা হয়। তবে শয়তান সেভিল যে কাপলানের সর্বস্ব চুরি করে জংলিদের মাঝে মৃত্যুর মুখে ঠেলে ফেলে আসে সে কাপলান নয়। কিন্তু সেই বৃদ্ধেরই ছেলে। বহুকাল নিরুদ্দেশ বাপের কোনও খবর না পেয়ে ছোট কাপলান তাঁরই সন্ধানে গায়না যাচ্ছিল। আমিও গায়নার অজানা গহন জঙ্গলে যাবার জন্য বেরিয়েছি জেনে সে আমায় সঙ্গী হতে বলে। সেবারেই বুড়ো কাপলানের সঙ্গে যদি দেখা হত, আর যে-কাগজটা পরে সেভিল তাঁর কাছ থেকে চুরি করে পালায় সেটা যদি তখন পেতাম, তা হলে ওই ম্যানাটি মানে শুশুকগুলোর ভেলকি তখনই দেখিয়ে দিতে পারতাম।

    হাইতি-মার্কা একটা কড়া গালাগাল দিয়ে হুজুর গর্জালেন, নিকুচি করেছে তোর শুশুকের। সেবারে গিয়ে বুড়ো কাপলানের দেখা তা হলে পাসনি! কী করছিলি তা হলে?

    পারিমা হ্রদের পাত্তা যদি পাওয়া যায়, সেই আশায় ওই শুশুকগুলোকে ছেড়ে এসেছিলাম।

    চুলোয় যাক তোর শুশুক! আরও কী হুজুর বলতে যাচ্ছিলেন।

    তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, অমন কথা বলবেন না, হুজুর! ওই শুশুকের ভরসাতেই আছি।

    হ্যাঁ, তোর মতো কুচোচিংড়ির আর কে ভরসা হবে! শুশুকের ল্যাজেই গড় কর।হুজুর খিচিয়ে উঠলেন। এখন আমার কথার চটপট জবাব দে। পারিমা হ্রদ তো গল্প কথা বলে হুমবোন্ড প্রমাণ করে গেছেন। তার পাত্তা পাবার আশা তা হলে কোথায়?

    হুজুরের যেন একটু নেশা লেগেছে মনে হচ্ছে? খুশি মুখে বললাম, শুনুন। আশা এইখানে যে হুমবোন্ডের প্রমাণ তো শেষ কথা নয়। হতে পারে না। ১৫৩১-এ মার্টিনিজ ওমোয়া-য় গেছলেন বলে বিবরণ দিয়েছেন, আর হুমবোল্ড পারিমা হ্রদ বলে কিছু নেই বলে প্রমাণ করেছেন উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। মাঝখানে তিনশো বছর কেটে গেছে। তার মধ্যে পৃথিবীর গায়ের ওপর অনেক কিছু ওলট-পালট হয়েছে, বিশেষ করে গায়নায় ওই অঞ্চলে পাহাড় ডাঙা নদী জলা অনেক ওঠা-নামা করেছে বলে অনেক পণ্ডিতের ধারণা। যে পারিমা হ্রদের ধারে ওমোয়া শহর ছিল, তা যে পৃথিবীর নীচের তলার মাথা ঝাঁকুনিতে পাড় ছাপিয়ে ওমোয়া শহর ভাসিয়ে, হ্রদের বদলে অন্য চেহারা নেয়নি তা কে বলতে পারে! সেইরকম কিছুই হয়েছে বলে আমার অন্তত বিশ্বাস, কারণ পারিমা হ্রদ কি তার তীরের ওমোয়া শহর আর সোনায় মোড়া রাজা এল ডোরাডো নিছক গাঁজাখুরি গল্প হলে সোনার পালকগুলোও তা-ই হত। কিন্তু সেগুলো তো চোখে-দেখা হাতে-ছোঁয়া পরখ করা জিনিস। তাই পারিমা হ্রদকে অন্য চেহারায় খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি। বুড়ো কাপলানও তা-ই মনে করতেন, আর শেষ পর্যন্ত তিনি এমন কিছু হদিস পেয়ে ওই কাগজে টুকে রেখেছিলেন যার সাহায্যে এল ডোরাডোর কুবেরের ভাণ্ডার উদ্ধার করা এখনও অসম্ভব নয়। সেই কাগজখানা সেভিলের কাছ থেকে তাই আমার না নিলেই নয়!

    হুঁ! হুজুরের গলায় আর ঝাঁজ নেই, শোন, তোর সব বেয়াদবি আমি মাপই করে দেব ভাবছি!

    হুজুরের কী মহানুভবতা! আমি গদগদ হলাম।

    গলাটা আরও একটু মোলায়েম করে হুজুর বললেন, এল ডোরাডো সম্বন্ধে তুই বেশ ওয়াকিবহাল মনে হচ্ছে। তোকে তাই একটা কাজ দিতে চাই।

    বান্দা তৈয়ার, হুজুর!

    আমার ফৌজি সেলামে একটু ভুরু কোঁচকালেও গলাটা তেমনই মোলায়েম রেখে হুজুর বললেন, সেভিলের কাছ থেকে সেকাগজ আমিই আদায় করব। তারপর তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে সেই গায়নায়। পারিমা হ্রদ খুঁজে বার করে এল ডোরাডোর কুবেরের ভাণ্ডার যদি সত্যি উদ্ধার করতে পারিস, তা হলে তোকে এমন বকশিশ দেব যা তুই ভাবতে পারিস না।

    শুনেই আমার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে, হুজুর! কিন্তু বেচারা কাপলানের কী হবে তা হলে?

    কাপলান? মানে সেই বুড়োর বেটা? হুজুর নাক সেটকালেন, সে আবার এর মধ্যে আসছে কোথা থেকে?

    আসছে তার বাপের কাছ থেকে। বুড়ো কাপলান হদিস দিয়ে গৈছে বলেই না কুবেরের ভাণ্ডার উদ্ধার করবার আশা করছি। সুতরাং তাকে কী করে বাদ দিই, বলুন? তার চেয়ে আরেক কাজ করুন, হুজুর! সেভিল না ডেভিল যার কাছ থেকে হোক, কাগজটা আমায় ফিরিয়ে দিন। আমি বকশিশ আর আপনাকে কী দেব? একটু বরং আপনার পিঠ চাপড়ে যাই।

    বোমার মতো ফাটতে গিয়েও হুজুর কী যেন ভেবে অতি কষ্টে নিজেকে সামলালেন। তারপর তখানি সাধ্য গলাটা খাটো রেখেই বললেন, শেষ সুযোগ তোকে দিচ্ছি, এইটুকু মনে রাখিস। এক কথায় জবাব দে—আমার কথায় রাজি কি না?

    বড় ফাঁপরে ফেললেন যে হুজুর! এখন আমাকে দেখছি টি-ম্যালিসেরই শরণ নিতে হয়।

    টি-ম্যালিস কে? হুজুর চোখ পাকালেন।

    আজ্ঞে, আপনাদের এই হাইতিরই রূপকথার একজন মানুষ। রাজা টি-ম্যালিসের ওপর কী কারণে চটেছেন। টি-ম্যালিসকে তলব করে বললেন-কাল সুয্যি ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমার পদ্মদীঘির সব কটা রাজহাঁস দুয়ে এক বালতি দুধ আনতে হবে। না আনতে পারলে তোমার গর্দান নেব। পরের দিন রাজা ভোরে উঠে বসে আছেন, টি-ম্যালিস আর আসে না। অনেক বেলায় টি-ম্যালিস আসতে রাজা হুংকার দিয়ে উঠলেন—দুধ কই রাজহাঁসের? ডাকো জল্লাদকে এখনই। টি-ম্যালিসের ভ্রুক্ষেপ নেই। বললেন—একটু সবুর করুন হুজুর, আগে আমার ঝামেলাটা শুনুন। কী তোমার ঝামেলা—রাজা রেগে শুধোলেন। আজ্ঞে পিপড়ের কামড়ে আঙুল ফুলে গেছে, দুধ দুইব কী করে? বললে টি-ম্যালিস। তা আঙুল ফোলে কেন? কেন গেছলে পিপড়ে ঘাঁটাতে? রাজা ধমকালেন। কী করি বলুন, নইলে যে সূয্যি ওঠে না— বললে টি-ম্যালিস। সূয্যি ওঠে না! রাজা হতভম্ব। আজ্ঞে হ্যাঁ, মহারাজ! অম্লানবদনে বললে টি-ম্যালিস-মাঠের শেষে ভেঁয়ো পিপড়ের বাসা ছিল, সুয্যি ঠাকুর জানত না। ভোরবেলা যেই উঠতে যাবে অমনই লাল মিঠাই মনে করে একেবারে হেঁকে ধরলে ঝাঁক ঝাঁক পিপড়ে। ছুটে গিয়ে তাই ছাড়াতে বসতে হল। পিপড়ে না ছাড়ালে সুয্যি উঠবে না। আর সুয্যি না উঠলে রাজহাঁসের দুধ আপনাকে দেখাব কী করে? পিপড়ের কামড়ে তাই তো আঙুল ফুলল। রাজামশাই এবার তেলেবেগুন। বললেনধাপ্পাবাজির আর জায়গা পাওনি? সূয্যির গায়ে কখনও পিপড়ে ধরে? ধরে, মহারাজ, ধরে!—টি-ম্যালিস এক গাল হেসে বোঝালে— রাজহাঁসের দুধ দোয়াতে হলেই ধরে!

    একটু থেমে মুখ কাঁচুমাচু করে বললাম, আপনার কথায় টি-ম্যালিসের মতোই তা হলে রাজি হতে হয়। কোন সুয্যির গায়ে কী পিপড়ে ধরাতে হবে তা না হয় পরে ভাবা যাবে।

    এবার সত্যিই বোমা ফাটল। হুজুর হুংকার ছাড়লেন, তবে রে, চিমড়ে চিমসে ছারপোকা! একটু ঢিলে দিয়েছি বলে কোঁকাকে কাতুকুতু ভেবেছিস! শমনের ডাক তোর এসে গেছে। নে, ইস্টনাম কিছু থাকে তো জপ করে নে।

    কিন্তু কটা কাজ যে বাকি আছে, হুজুর!  করুণ সুরে নিবেদন করলাম, কাপলানের কাছে ওই কাগজটা আর নতুন এক পাল ম্যানাটি না পৌঁছে দিলে যে কথার খেলাপ হবে।

    তা একটু হবে। তবে তুই শুশুক না পৌঁছোত পারিস, তোর ফুটো লাশটা না হয় হাইতির সেন্ট মার্ক উপসাগরের জলে শুশুকদের বদলে হাঙরদের কাছেই পৌঁছে

    দেব। হুজুরের মুখে যেন হাঙরেরই হাসি এবার।

    বললাম, ধ্যেৎ!

    হুজুর শুনেই ভ্যাবাচাকা। লজ্জা লজ্জা ভাব করে এবার বললাম, হাঙরের কামড়ে আমার যে সুড়সুড়ি লাগে। তা ছাড়া কথার নড়চড় আমার যে কিছুতেই হবার নয়। প্রথমবার গায়নায় বাপের খোঁজ না পেয়ে হতাশ হয়ে কাপলান এই হাইতিতে ফিরে এসে রাজনীতির লড়াইতেই মাতে। দ্বিতীয়বার শুশুকগুলোর খোঁজ নিতে গায়নায় গিয়ে, সেগুলো জংলিরা মেরে শেষ করেছে দেখলাম বটে, কিন্তু ভাগ্যক্রমে বুড়ো কাপলানের দেখা পেলাম। তাঁর শেষ খবর নিয়ে হাইতিতে এসে বহু কষ্টে ছোট কাপলানকে খুঁজে বার করি। তারপর কত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তাকে রাজনীতির নেশা ছাড়িয়ে আবার গায়নায় পাঠিয়েছি। কথা দিয়েছি সেভিলের কাছ থেকে কাগজটা আর, ওই যে বললাম, নতুন একপাল শুশুক নিয়ে তার কাছে দুদিন বাদেই যাচ্ছি। আর দেরি করলে তাই যে আর চলে না, হুজুর!

    না, দেরি আর তোকে করতে হবে না। হুজুর রিভলভারের সেফটি ক্যাচটা সরালেন, সেভিল না ডেভিলের কাছ থেকে কী করে কাগজটা নিবি ভেবে রেখেছিস আশা করি।

    তা একটু ভেবেছি বই কী! আপনার মতো সাদাসিধে হোঁৎকা কেউ হলে ভাবনারও বিশেষ কিছু নেই।

    তাই নাকি! হুজুর রিভলভারটা আমার দিকে উঁচোলেন।

    আজ্ঞে হ্যাঁ। যত বড় শয়তানই হোক, আপনার মতো হাঁদা হলে বিশ্বাস করে সেকাগজটা সে বাকস প্যাঁটরা সিন্দুকে কোথাও রেখে স্বস্তি পাবে না। নিজের কাছে আপনার কোমরের বেলটের মতোই কোথাও নিশ্চয়ই রাখবে।

    আর, তুই লড়ে সেটা কেড়ে নিবি! হুজুরের যেন ব্যাঙের লপচপানিতে সাপের ফোঁস।

    আজ্ঞে না, হুজুর! নাক সিটকে বললাম, ও সব ধস্তাধস্তি বড় নোংরা কাজ। টিবিয়া বলে পায়ের হাড়ের নাম শুনেছেন বোধ হয়। এই যে আপনি আমার মুখের দিকেই চেয়ে আছেন। এখন আচমকা দুপায়ের সেই দুই টিবিয়ায় ঠিক জুৎসই ঠোক্কর দিলে সে আপনার মতোই কাহিল দিশাহারা হয়ে নাচতে শুরু করবে। তারপর দুই কনুইয়ের আলনার নার্ভ মানে স্নায়ু যেখান দিয়ে গিয়েছে সেখানে ফানি বোন-এ নির্ভুল জায়গা মাফিক দুটো ঘা দিলেই দুটো হাত ঝিনঝিন করে অবশ হয়ে রিভলভারটা এমনই করে পড়ে যাবে। তারপর সেটা তুলে নিয়ে দু কানের নীচের এই দুটো জায়গায় মোক্ষম একটু টিপুনি দিয়ে কণ্ঠার ডেলাটায় দুবার ওস্তাদের হাতের টোকা দিলেই কিছুক্ষণের জন্য হাত পা শরীর অবশ, জিভ অসাড়। তখন কোমরের বেলটের ব্যাগ থেকে কাগজটা এমনই করে বার করে নিয়ে, সাবধানের মার নেই বলে পেটের উপর সোলার প্লেক্সাসে একটা কিল দিয়ে, টেবিলের ধারের বোতামটা একবার টিপলেই এ-বাড়ির পোষা গুণ্ডাগুলো পড়ি কি মরি করে এই ঘরের দিকেই সবাই ছুটে আসবে। জলের গ্লাসটা আনানো থাকলে আপনার মুখে চোখে জল ছিটিয়ে তারা চাঙ্গা করতে পারত। কিন্তু তা আর হবার নয়। আমি অবশ্য ওধারের জানালাটা তার আগেই খুলে ফেলে খোলা বারান্দায় নেমে সেখান থেকে বাজারের টিনের চালের মটকায় ঝাঁপ দিয়ে এমনই করে হাওয়া!

     

    ঘনাদা থামলেন। সিগারেটটা ক্ষয়ে ক্ষয়ে তখন প্রায় তাঁর আঙুলের ফাঁকে এসে পৌঁছেছে। সেটা ফেলে দিয়ে কৌটোটা নিয়েই উঠে পড়তে যাচ্ছিলেন। আমাদের আর কিছু করতে হল না, ভাড়াটে চারমূর্তিই ধরাধরি করে তাঁকে বসিয়ে দিল।

    আপনি তাহলে সত্যিই অমনই করে কাগজটা কেড়ে নিয়ে পালালেন? সিড়িঙ্গে নফরবাবু যেন এখুনি সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবেন, ওই গোরিলার মতো দুশমনের কাছ থেকে?

    ওই গোরিলাই হল সেভিল! আমি কিন্তু আগেই বুঝেছি! পিপের দোসর বিশে নিজের বুদ্ধির বাহাদুরিতে নিজেই গদগদ।

    আপনি তারপর ওই কাগজ আর শুশুকের পাল সেই কাপলানের কাছে পৌঁছে দিলেন! ভক্তিভরে শুধোল দশরথ।

    তা দিলাম বইকী! ঘনাদা সবিনয়ে জানালেন, কথা যখন দিয়েছি তখন না রেখে পারি।

    আচ্ছা, কাগজটার দাম না হয় বুঝলাম, সিড়িঙ্গে নফরবাবু প্রায় করজোড়ে নিবেদন করলেন, কিন্তু এই শুশুকগুলো কেন, ঠিক ধরতে পারছি না তো।

    পারছেন না! ঘনাদা এরকম অবিশ্বাস্য মূঢ়তায় যেন ক্ষুণ্ণ, ওরাই যে ভরসা! এল ডোরাডোর কুবেরের ভাণ্ডার উদ্ধার হবার হলে ওদের দিয়েই হবে।

    ওরাই মানে ওই শুশুকগুলো দিয়ে! চারমূর্তির সব কটা চোখই তখন কপালে উঠেছে।

    হ্যাঁ! ঘনাদা করুণভাবে ব্যাখ্যা করলেন, ওই ম্যানাটি মানে শুশুকগুলো হল নদীতে জলায় যা কিছু পানা, দাম প্রভৃতি জলজ আগাছা জন্মায় তার যম। পাঁচশো ধাঙড় সাত হপ্তায় যা না পারে, ওদের পাঁচটাতে সাত দিনে তা খেয়েই সাফ করে দেয়। পৃথিবীর থেকে থেকে মাথা চাড়ার দরুন এল ডোরাডোর ওমোয়া রাজধানী, যার ধারে ছিল সেই পারিমা হ্রদ, কোনও কারণে হয়তো পাড় ছাপিয়ে সে রাজধানী ড়ুবিয়ে অন্য চেহারা নিয়েছে—এ সন্দেহের কথা আগেই বলেছি। চারশো বছরে সে জলাবাদা কিন্তু জংলা আগাছায় এমন ছেয়ে গেছে যে হদিস পেলেও খুঁজে বার করা অসম্ভব। ওই ম্যানাটির পাল সেই জন্যেই ও-অঞ্চলে ছেড়ে দেবার ব্যবস্থা করি। ও দেশের জংলিরা বনের আড়াল থেকে বিষমাখানো তীর ছুঁড়ে পালাতেই জানে। তাদের দিয়ে তো আর ধাঙড়ের কাজ হয় না। আর সে অসম্ভব সম্ভব হলেও ম্যানাটির মতো এমন পরিপাটি সাফ করা আর সাফ রাখা মানুষ তো মানুষ, কোনও যন্ত্রেরও সাধ্যে কুলোবে না। ম্যানাটিরা জলা সাফ করলে হারানো হ্রদ পারিমার চৌহদ্দি বেরিয়ে পড়বে, এ বিশ্বাস আমার ছিল।

    তাহলে ওই কুবেরের ভাঁড়ার আবার খুঁজে পাওয়া যাবে? পিপের ভাই বিশের চোখ প্রায় ঠেলে বেরোয়।

    নাঃ, আর কী করে যাবে! ঘনাদা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কাপলান তো আর ওখানে থাকবে না। সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে আসবে।

    কেন? কেন? সমস্বরে আকুল প্রশ্ন।

    আর কেন! হাইতির রাজনীতির লড়াই থেকে অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে যখন তাকে গায়নায় পাঠাই তখন সেই কড়ার-ই আমায় দিয়ে করিয়ে নিয়েছিল যে! বলেছিল—তোমার কথায় আমি যাচ্ছি দাস, কিন্তু তোমাকেও কথা দিতে হবে কোনওদিন কোথাও কোনও ভোটের লড়াইয়ে আর নামবে না। সেরকম কোনও খবর পেলেই জানবে আমি সব ছেড়ে হাইতিতে ফিরেছি।

    সমস্ত ঘরটার চোখেই যেন সরষে ফুল।

    ঘনাদা উদাস ভাবে বললেন, ওই ম্যানটিগুলোর জন্যই একটু দুঃখ হয়। এল ডোরাডোর যখের ধন আর অবশ্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু তার আর কী করা যাবে! আপনারা সবাই যখন দাঁড়াতে বলছেন তখন সে কথা তো আর ঠেলতে পারি লো?

    খুব পারেন! আলবত পারেন!! একশো বার পারেন!!! আপনাকে দাঁড়াতে দিচ্ছে কে? চারমূর্তি একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে যেন আমাদের ওপরই মারমুখখা।

    আপনাকে ব্যাগোত্তা করছি, ঘনশ্যামবাবু, চারজনের মুরুব্বি হয়ে জালা-প্রমাণ দশরথই হাত কচলে আর্জি জানালে, আপনি এ ভোটাভুটির নোংরামিতে নামবেন না। দিন, কথা দিন আমাদের। তারপর দেখি, কে আপনাকে নামাতে চায়!

    শেষ কথাগুলো আমাদের দিকেই চোখ রাঙিয়ে।

    ঘনাদা যেন নিরুপায় হয়ে বললেন, বেশ, আপনারাই যখন মানা করছেন তখন নামব না।

    হঠাৎ আমাদের দিকে নজর পড়ায় যেন অবাক হয়ে বললেন, আরে, তোমরা অমন চুপটি করে বসে কেন? ভদ্রলোকেরা এসেছেন, চা জলখাবার আনাও। আর এই নাও হে শিশির, অনেকক্ষণ শুকনো মুখে আছো, একটা সিগারেট খাও।

    শিশিরের কৌটো থেকেই ঘনাদা উদারভাবে তাকে একটা সিগারেট দান করলেন।

    হ্যাঁ, এখনও সেই বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }