Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    কেঁচো

    ঘনাদা এক কথায় রাজি!

    আমরা সবাই তো একেবারে যাকে বলে পপাত ধরণীতলে!

    যে ঘনাদাকে নেহাত তাঁর নিজের মর্জি ছাড়া মেস থেকে এক পা বার করা যায় , শনিবার দিনটা অন্তত পুলিশের হুলিয়া দেখিয়েও যাঁকে মেস ছাড়া করা প্রায় অসম্ভব, তিনি বলা মাত্র শনিবার ভোরে আমাদের সঙ্গে শিবুর জন্মস্থান এক অজ পাড়াগাঁয়ে যেতে রাজি হয়ে গেলেন!

    শিবুর জন্মস্থান যেখানেই হোক, কোনও অজ পাড়াগাঁয়ে নয়। কোথায় যে তার জন্মস্থান তা অবশ্য তার নিজেরও বোধহয় জানা নেই—তবু ঘনাদাকে জব্দ করার ফিকিরেই ভেবেচিন্তে কিচিন্দে বলে একটা গ্রামের নাম উদ্ভাবন করে, আমরা কলকাতা থেকে মাইল ত্রিশেক দূরে আমাদের কাল্পনিক মানচিত্রে বসিয়েছিলাম। গ্রামটি ঘনাদার খাতিরে সুগমও করেছিলাম যথেষ্ট। ট্রেন বা বাস কিছুই সেখানে যায় না। বর্ষাকালে শালতি করে কোনওরকমে একটা জনমানবহীন বাদায় গিয়ে নেমে ক্রোশ পাঁচেক হাঁটুভর কাদা ভেঙে সেখানে পৌঁছতে হয়।

    কিচিন্দে গ্রামের এসব বাহার নিজেদের মান বাঁচাতেই জুড়তে হয়েছিল অবশ্য পরে।

    নিজেদের ফাঁদেই নিজেরা যে অমন করে পড়ব আগে কি জানি!

    শনিবার রাত্রে আমাদের মেসে বেশ জবর গোছের খ্যাট হয়। বাপি দত্ত আমাদের মেস ছেড়ে গেছে বটে, কিন্তু তার মতো মফসলি আরও দু-চারজন আছে। তাদের খাতিরেই রবিবারের বদলে শনিবার রাত্রেই এই ভূরিভোজের ব্যবস্থা।

    ঘনাদা শনিবার দিনটায় তাই মেস থেকে নড়বার নাম করেন না। শুধু নট নড়ন চড়ন হয়ে খ্যাঁটের যাকে বলে সিংহভাগ নিলে বলবার কিছু ছিল না, কিন্তু তাঁর আবার উপরি আবদার বায়নার অন্ত থাকে না সেদিন। সকালে উঠেই হইচই লাগিয়ে তো দেনই কই হে, বাজারে যাচ্ছ আজ কে! বলি মেনুটা কিছু ঠিক করেছ নাকি! তারপর কোনও দিন ফরমাশ হয়: আজ একটু ভেটকি মাছের ক্রোকেট করবে তো হে। দেখো আবার যেখান সেখান থেকে ভেটকি কিনো না! কোনওদিন বা অনুযোগ দিয়ে শুরু হয়—ওহে আগেরবারে বিরিয়ানিটা তেমন জুত হয়নি। মটনটাই ছিল শুটকো! হাতের চর্বি ধুতে একটা বারসোপ না খরচ হয়ে গেলে আবার মটন! মটন একেবারে হগ সাহেবের বাজারে নুরুদ্দিনের দোকানে কিনবে, বুঝেছ। কাবলি ছোলার খোসা না ছাড়িয়ে নুরুদ্দিন ভেড়াকে খাওয়ায় না।

    ফি শনিবার ঘনাদার এরকম নতুন নতুন খাবারের চিন্তার ঢেউ খেলে মাথায়।

    মনে মনে হাসি বা গজরাই, তাঁর আবদার শেষ পর্যন্ত রাখতেই হয়।

    শনিবারের এই ভোজনবিলাস ছেড়ে ঘনাদা এক কথায়—ধাড়ধাড়া গোবিন্দপুরকেও হার মানানো কিস্কিন্ধ্যেরও বটতলা সংস্করণ কিচিন্দে যেতে রাজি হবেন, এ আমাদের স্বপ্নাতীত।

    ঘনাদাকে একটু জ্বালাবার মতলবেই বুধবার বিকেলে কথাটা তুলেছিলাম।

    ঘনাদা তখন তাঁর মৌরসি আরামকেদারায় বসে শিশিরের চতুঃসহ সপ্তশত সপ্তবিংশতিতম সিগারেটটি ধার নিয়ে সবে ধরাচ্ছেন।

    শিবু তখনও ফেরেনি। আমি, গৌর আর শিশির মিলেই ঘনাদাকে সঙ্গ দিচ্ছি। আমাদের ফন্দিমতো শিশিরই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কথাটা পাড়লে, এ শনিবারের খ্যাঁটটা কিন্তু ফসকাল!

    কেন? ঘনাদা সিগারেটের সুখটানটা মাঝপথেই থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন। ঘনাদার গলার স্বরটা বিস্ময়ে আশঙ্কায় উদ্বেগে ঠিক আশানুরূপ তীক্ষ না শোনালেও, মনে হল ওষুধ ধরেছে।

    গৌরই জবাবটা দিলে যেন হতাশভাবে, আর বলেন কেন? শিবুর সঙ্গে তার গাঁয়ে যেতে হবে। গাঁ যেন আমরা কেউ দেখিনি। আর যেতে হবে কিনা শনিবার এখানকার এই খাওয়া ফেলে! কী অন্যায় আবদার বলুন তো!

    ঘনাদার মুখে কথা নেই। সিগারেটটাও না। সেটা আঙুলের ফাঁকে পুড়ছে।

    লক্ষণ সব ভালই বলতে হবে।

    আমি মনসায় ধুনোর গন্ধ দিলাম এবার, আহা, অত চটছ কেন? শিবুর যে ওই গাঁয়েই জন্ম। এই শনিবারই আবার ওর জন্মদিন। আমাদের সবাইকে নিজের গাঁয়ে নিয়ে গিয়ে তাই একটু হই-হুল্লোড় করতে চায়।

    একটু থেমে ঘনাদার মুখের ওপর চট করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ব্রহ্মাস্ত্রটি ছাড়লাম, ঘনাদাকেও তো নিয়ে যাবে বলেছে!

    ডিনামাইটের সলতেয় দূর থেকে আগুন দিয়ে এঞ্জিনিয়াররা যেমন দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা করে, আমাদের তখন সেই অবস্থা।

    এই বিস্ফোরণ হল বলে! শনিবারের যজ্ঞির খাওয়ায় ফাঁকি দিয়ে ঘনাদাকে কিনা নিয়ে যেতে চায় কোথাকার অখদ্দে পাড়াগাঁয়ে! এত বড় আস্পর্ধায় ঘনাদা কীভাবে ফেটে পড়েন তাই দেখবার জন্যেই আমরা উদগ্রীব। শিবুর গাঁয়ে কেন তাঁর যাওয়া অসম্ভব তা বোঝাতে গিয়ে, চাই কি ফেটে-পড়া রাগের বারুদ থেকে একটা-আধটা গল্পের ফুলঝুরিও ঝরে পড়তে পারে।

    কিন্তু কোথায় বিস্ফোরণ! ফটফটাসের বদলে এ যে একেবারে শুধু ফুস!

    ঘনাদা আমাদের একেবারে বসিয়ে দিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, বেশ, যাব।

    অ্যাঁ?

    আমাদের চক্ষু সব বিস্ফারিত, মুখের হাঁ বোজ না। আপনা থেকে বেরিয়ে আসা অ্যার সঙ্গে যাবেন তাহলে?বলে আনন্দোচ্ছাস জুড়ে দেবার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু মাঝখানে বেশ খানিকটা ফাঁক থেকে গেল, সুরেও মিলল না।

    গ্রামটা কোথায়?ঘনাদা আমাদের দুরবস্থা লক্ষ না করেই বোধহয় প্রশ্ন করলেন নিজে থেকে।

    গ্রামটা? আমি চাইলাম গৌরের মুখের দিকে।

    ওঃ, গ্রামটা! গৌর চাইল শিশিরের দিকে।

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, গ্রামটা! ওই যে, বললা না হে গ্রামটার নাম? শিশির নিজেকে বাঁচাতে আমাকেই বাঘের মুখে এগিয়ে দিলো।

    ওঃ, নাম জিজ্ঞেস করছেন? আমি একটা ঢোঁক গিললাম, নাম হল গিয়ে— আমার দুটো ঢোঁক গেলা হল—ওই যে…

    উচ্চারণ করা শক্ত বুঝি? ঘনাদার সরল কৌতূহল।

    না, না উচ্চারণ শক্ত নয়! আমি নাম হাতড়াবার জন্যে সময় নেবার ফিকির খুঁজলাম, বড় বিদঘুটে নাম কিনা! শিবুর জন্মস্থান তো-বিদঘুটে না হয়ে কি মোলায়েম নাম হতে পারে! চট করে তাই মনে আসতে চায় না।

    শিবুর মনে আছে নিশ্চয়! ঘনাদার গলায় যতখানি সম্ভব মধুর সারল্য।

    বাঃ, কী যে বলেন! আমরা ক্ষুণ্ণ হলাম যেন একটু, নিজের জন্মস্থানের নাম মনে থাকবে না। আমাদেরও তো মনে ছিল, এই মাত্র ভুলে গেলাম! এই—এই…

    মধ্যমগ্রাম! বলে ফেলল শিশির।

    মধ্যমগ্রাম? ঘনাদাও উচ্চারণ করলেন চোখ দুটো কেমন একটু সন্দেহে কুঁচকে।

    দূর! মধ্যমগ্রাম কী বলছিস! গৌর তাড়াতাড়ি সামলাল।

    হ্যাঁ, মধ্যমগ্রাম কী? ওটা কি একটা বিদঘুটে নাম হল? আমিও শিশিরের ওপর খাপ্পা হলাম। তারপর হঠাৎ বলে ফেললাম, হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে পড়েছে—কিচিন্দে!

    ভাগ্যিস সামনের টেবিলের খবরের কাগজটার দিকে চোখ পড়েছিল। সেখানে বড় বড় হরফে ইংরাজিতে একটা বিজ্ঞাপন—কিচেন ইউটেনসিলস।

    তাহলে মধ্যমগ্রাম নয়, কিচিন্দে? ঘনাদার প্রশ্নটার সুরটা যেন কেমন!

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, কিচিন্দে। আমরা সমস্বরে সায় দিলাম।

    তা নামটা বেশ বিদঘুটে বটে! আচ্ছা, কিচিন্দেই যাওয়া যাবে। যাওয়া ঠিক তো? ঘনাদা মনে হল দস্তুরমতো উদগ্রীব।

    ঠিক ছাড়া কী? নিশ্চয় ঠিক! বলে ল্যাজেগোবরে হয়ে সেখান থেকে। কোনওরকমে বেরিয়ে পড়ে বাঁচলাম।

     

    বাঁচলাম তো তখনকার মতো। তারপর উপায়?

    নিজেদের ফাঁদেই পড়েছি স্বীকার করে হার মানতেও মান যায়, অথচ ঘনাদাকে নিয়ে যাবার মতো কিচিন্দে গ্রামই বা পাই কোথায়?

    শিবু ফিরে আসতেই গোপন মন্ত্রণাসভায় ডেকে তাকে, খবরের কাগজের ভাষায়, পরিস্থিতিটা জানালাম।

    শুনেই তো সে খাপ্পা। আহাম্মক সব, করেছিস কী! সব মাটি করে দিলি!

    মাটি করে দিলাম! কী? আমরা বিমূঢ়।

    আরে, সব বুদ্ধির গন্ধমাদন! শিকু আমাদের মধুর সম্ভাষণ করে বললে, ঘনাদা কি সাধে,—ওই—তোদের কী বললি, কিচিন্দে যেতে রাজি হয়েছেন। শনিবার যে ওঁকে রামজব্দ করবার ব্যবস্থা করেছিলাম। যা প্যাঁচে ফেলেছিলাম আর বেরুবাব রাস্তা ছিল না। শেষে নিজেরাই প্যাঁচ কেটে পালাবার পথ করে দিলি!

    আমাদের প্রতি জ্বালা-ধরানো আরও কয়েকটি বাছা বাছা বিশেষণ প্রয়োগ করে শিবু তারপর ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে। শনিবারের ভোজের ব্যাপারে ঘনাদার মাতব্বরি চালবাজি ফাঁসিয়ে দেবার সে একটা ভাল ফন্দি করেছিল। ঘনাদা যেরকম ভাবগতিক দেখান তাতে মনে হয় গোটা হগ সাহেবের বাজারটাই তাঁর জমিদারি। বিশেষ করে খাসি মটনের কারবারি নুরুদ্দিন তো তাঁর কথায় ওঠে বসে। শিবু সেই নুরুদ্দিনের নাম নিয়েই ঘনাদাকে কাত করবার ব্যবস্থা করেছিল। ঘনাদাকে এসে বলেছিল যে নুরুদ্দিন তো ঘনাদার নাম করতে অজ্ঞান! বাজারে গেলেই তাঁর কথায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। প্রায়ই সে বলে, এসব খাসি মটন কি ছার, দাসবাবু একবার হুকুম দিলে সে একেবারে খাস তুরুক মুলুকের অ্যাঙ্গোরা খাসির মাংস ভেট দিয়ে আসতে পারে। শুনে ঘনাদা, এ আর এমন কী, ভাব দেখিয়ে একটু ফুলে ফেঁপে উঠতেই শিবু কোপটি বসিয়েছিল। সামনের শনিবারটাই অ্যাঙ্গোরা খাসির মাংসের জন্য নুরুদ্দিনকে একটু হুকুম জানাবার জন্য অনুরোধ জানিয়েছিল সবিনয়ে। বলেছিল, আপনার শুধু একটু লে আও বলবার ওয়াস্তা। বলে পাঠান না ঘনাদা। অ্যাঙ্গোরা খাসির মাংস খেয়ে জীবন ধন্য করি। ঘনাদা আর তখন পিছু হটবার পথ পাননি। বেকায়দায় পড়ে নুরুদ্দিনকে খবর পাঠাতে রাজি হয়েছিলেন।

    ব্যাপারটা বুঝিয়ে তিরিক্ষি মেজাজে শিবু বললে, সেই থেকে ঘনাদা এ শনিবারের ফাঁড়া কাটাবার ফিকির খুঁজছেন। আর সে ফিকির তোরাই জুগিয়ে দিলি নিজে থেকে!

    শুধু তাই! ঘনাদার কাটানো ফাঁড়া যে এখন আমাদের ঘাড়ে! গৌর হতাশভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললে, নিজেদের প্যাঁচে নিজেরাই পড়ে যে এখন হিমসিম। এ প্যাঁচ কেটে বেরোই কী করে?

     

    প্যাঁচ কেটে বেরুবার জন্য সবাই মিলে পরামর্শ করে চেষ্টার ত্রুটি কিছু রাখলাম না।

    বুধবার বিকেলের আগে যে কিচিন্দের অস্তিত্ব ছিল না, বৃহস্পতিবার সকালে তাকে লগি বাওয়া শালতিতে নোংরা খালের রাস্তায় নিয়ে গিয়ে, হাঁটুভর কাদা প্যাচপেচে বাদার ধারে ফেলে যতখানি সম্ভব দুর্গম করে তুলি। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। ঘনাদা নিজে থেকেই যাতে মত বদলান তার জন্য শিবুর কাল্পনিক জন্মস্থান যত বিশ্রী বিদঘুটে করে তুলি, ঘনাদার উৎসাহ তত যেন বেড়ে যায়।

    ক্রোশ পাঁচেক কাদা ভেঙে যেতে হবে শুনে যেন তাঁর আনন্দ আর ধরে না।

    বলেন, বলো কী হে! পাঁচ ক্রোশ কাদার রাস্তা? খুব মজা তো!

    মজাটার জন্য আমরাও যেন উৎসুক, এরকম একটা ভাব দেখাতে হয়। সেই উৎফুল্ল মুখ নিয়েই বলি, শিবুর বাড়িটাও খুব মজার, জানেন ঘনাদা? আস্ত ঘর নাকি একটাও নেই।

    তাই নাকি হে? ঘনাদা শিবুকেই প্রশ্ন করেন।

    একটু আশার ফুলকি দেখে শিবু সজোরে হাওয়া দেয়। এক গাল হেসে বলে, আজ্ঞে তা সত্যি—নেই। যেটার ছাদ আছে তার দেয়াল নেই, আর দেয়াল যেটার খাড়া আছে তার ছাদ একেবারে হাঁ। আর বাড়িময় যা মজার জঙ্গল হয়েছে!

    শিবু থামতেই গৌর উদ্বিগ্ন হবার ভান করে বলে, আপনার অসুবিধে হবে না। তো, ঘনাদা?

    অসুবিধে! ঘনাদা যেন অপমানিত বোধ করেন, আমার অসুবিধে হবে ও বাড়িতে থাকতে! আরে ওই সব অসুবিধের মজা করতেই তো যাওয়া!

    এর পর আর কী করা যায়! অগত্যা যথাসম্ভব সেঁতো হাসি মুখে ফুটিয়ে চলে আসি।

    সেদিন বিকেলেই ঘনাদার সংকল্পের গড় ভাঙবার চেষ্টায় নতুন দিক দিয়ে আক্রমণ চালাই।

    শিবু কী সব খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেছে শুনেছেন তো, ঘনাদা?

    ঘনাদা ঔৎসুক্য দেখান শিবুর দিকে চেয়ে, কী খাওয়াবে হে?

    যত জবর বর্ম-ই এঁটে থাকুন, তার এই একটা জায়গায় ফুটো থাকতে বাধ্য বুঝে, শিবু সেই ফুটো লক্ষ্য করেই মোক্ষম তীর চালায়। যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে বলে, সে যা খাওয়াব, দেখবেন। খুব নতুন ধরনের খাওয়া। গাঁয়ে আর কিছু না পাওয়া যাক, চাল ভাজা তো পাওয়া যাবেই, আর তার সঙ্গে ধরুন—ধরুন, বেগুন পোড়া। বেগুনগুলো আমাদের গাঁয়ে কেমন শুটকো পোকা খেকো বটে! কিন্তু তাতে কী আর হবে! আর বেগুন যদি না জোটে তো, কী বলে, আঁদাড়পাঁদাড় খুঁজে দুটো কচু কি আর পাব না!

    শিবু যতক্ষণ ধনুর্বিদ্যা চালায়, আমরা একেবারে রুদ্ধ নিঃশ্বাসে ঘনাদার দিকে চেয়ে থাকি। বর্ম ভেদ করে বাণ একেবারে মর্মে পৌঁছে ঘনাদাকে কাবু করে কিনা দেখতে!

    কিন্তু বৃথা আশা।

    যেন আর তর সইছেনা এমনভাবে ঘনাদা বলেন, বলো কী হে! এখুনি যে যেতে ইচ্ছে করছে!

     

    শুক্রবার সকাল অবধি সব রকম চেষ্টা করে বিফল হয়ে শেষ পর্যন্ত মরিয়া হয়ে উঠলাম।

    ঘনাদাকে যখন টলানো যাবে না, আর নিজেদের শনিবারের ভোজেরও যখন দফা রফা, তখন কিচিন্দিতেই যাব ঠিক করলাম ঘনাদাকে নিয়ে। কিচিন্দে কোন চুলোয় তা না জানি, কিচিন্দে নামের সঙ্গে মানানসই অতি বিদঘুটে একটা রাস্তায় বেরিয়ে পড়া তো যাবে ঘনাদাকে নাকাল করতে। নাকাল অবশ্য নিজেরাও হব। কিন্তু নিজের নাক কেটেও পরের যাত্রা ভঙ্গ করতে তখন আমরা প্রস্তুত।

    শনিবার সকালে বেরিয়ে পড়ার মতো একটা দিক তখন সলাপরামর্শ করে ঠিক করে ফেলেছি। বেরিয়ে তো পড়া যাবে, তারপর যা হয় হোক।

    ঘনাদাকে সকালে উঠেই তাড়া দেব ঠিক করেছিলাম, কিন্তু সেখানেও আমাদের হার।

    ঘনাদাকে তৈরি হতে বলবার জন্য ওপরে উঠে দেখি, তিনি একেবারে ধড়াচুড়ো পরেই ঘর থেকে বেরুচ্ছেন। তাঁর এই এত সকালে তৈরি হওয়ায় যত না আমরা তাজ্জব, ধড়াচুড়ো দেখেও তেমনই।

    ঘনাদার মাথায় শোলার টুপি, গায়ে খাকি শার্ট-প্যান্ট, পায়ে জুতোর ওপর গামবুট, আর হাতে হুইল ছিপ সমেত মাছ ধরার ঝুলি।

    কী ব্যাপার, ঘনাদা! বেশ খানিক হাঁ হয়ে থাকবার পর আমাদের মুখে কথা সরল।

    কী ব্যাপার, ভুলে গেছ নাকি! বেরুতে হবে না? তোমরা এখনও তৈরিই হওনি? ঘনাদা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন।

    হ্যাঁ, তৈরি এখুনি হচ্ছি। আমরা লজ্জিত হয়ে বলি, কিন্তু এসব কী করেছে?

    কেন? ঘনাদা অবাক, এই পোশাকই তো দরকার কিচিন্দের মতো গাঁয়ে যেতে, কাদা ভাঙতে হবে বলে গামবুটটা নিলাম।

    কিন্তু ওই ছিপ-টিপ? আমাদের বিস্মিত প্রশ্ন।

    বাঃ, মাছ ধরতে হবে না। পুকুর আছে তো? ঘনাদার প্রশ্নটা শিবুর উদ্দেশে।

    হ্যাঁ, পুকুর থাকবে না কেন? শিবু একটু থতমত খেয়ে বললে, কিন্তু সেখানে ও-হুইল ছিপ তো বেকার!

    কেন? ঘনাদা বেশ অসন্তুষ্ট।

    মানে, শিবু আমতা আমতা করে একটা জুতসই জবাব খাড়া করবার চেষ্টা করলে, মানে, পুকুর মানে সব ডোবা কি না। সেখানে হাতছিপে বড় জোর কেঁচো দিয়ে পুঁটি-টুটি ধরা যায়?

    কী বললে? ঘনাদার এ একেবারে অন্য মূর্তি। যেন দিনের বেলায় ভূত দেখছেন এমন ভাবখানা!

    এক মুহূর্তে কী হয়ে গেল বুঝতে না পেরে শিবুও দিশাহারা হয়ে ভয়ে ভয়ে কবুল করলে, বললাম, সেখানকার ডোবায় কেঁচো দিয়ে বড় জোর পুঁটি ধরা যায়!

    হুঁ, গম্ভীরভাবে বলে ঘনাদা সটান ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। আমরাও আশা আশঙ্কায় দুলতে দুলতে তাঁর পিছুপিছু।

    কী হল কী, ঘনাদা?

    ঘনাদা তখন হুইল ছিপটা ঘরের কোণে রাখছেন। আমাদের দিকে না তাকিয়েই বললেন, কিচ্ছু না।

    গৌর তাঁকে উসকে দেবার চেষ্টা করলে, হুইল ছিপ ফেলবার পুকুর নেই বলে রাগ করলেন?

    না। ঘনাদা শোলার টুপি নামালেন।

    তবে? কেঁচো দিয়ে মাছ ধরা পছন্দ নয়? শিবু ফোড়ন কাটল।

    না, নয়। ঘনাদা গামবুট খুলতে খুলতে অগ্নিদৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন।

    কেঁচো দেখলে ভয় পান বুঝি? আমার মুখ থেকে ফস করে কথাটা বেরিয়ে গেল। এবং তাতেই বাজিমাত।

    হ্যাঁ, ভয় পেয়েছিলাম! ঘনাদা অন্য জুতো জোড়াও খুলে তক্তপোশের ওপর পা মুড়ে বসলেন। আমরাও যে যেখানে পারলাম।

    কিন্তু ওই ভয় পেয়েছিলামটুকু বলেই ঘনাদা চুপ। আবার একটু নাড়া দিতে হল সুতরাং, কেঁচো দেখে ভয়! কেঁচো খুঁড়তে গোখরো বেরিয়েছিল বুঝি?

    না, গোখরো নয়, কিন্তু চেহারায় তারও দুশমন, লম্বায় পাক্কা আড়াই হাত।

    আড়াই হাত কেঁচো! আমাদের কণ্ঠে সন্দিগ্ধ বিস্ময়, কেঁচো না কাছি?

    কাছির মতোই মোটা, তবে কেঁচোই। মেগাসকোলাইডিস অ্যালিস! দেখেছিলাম অস্ট্রেলিয়ায়। তার জ্ঞাতি গোত্র অবশ্য অন্য জায়গাতেও আছে— আফ্রিকায়, দক্ষিণ আমেরিকায়, আমাদের দক্ষিণ ভারতেও। দক্ষিণ আমেরিকার কেঁচো-দৈত্যের নাম হল গ্নসাস্কোলেকস জাইগ্যানটিয়স আর…

    থাক, থাক! আমরা সভয়ে বাধা দিলাম।

    কিন্তু কিচিন্দের কেঁচো তো ওরকম দৈত্য-দানো কিছু নয়। শিবুই খোঁচা দিলে, নেহাত নিরীহ পুঁচকে। তাদের আবার ভয় কীসের?

    ভয় নয়, ভক্তি। ঘনাদা যেন মন্ত্র পড়লেন গম্ভীর গলায়।

    ভক্তি কেঁচোতে? আমরা হতভম্ব।

    হ্যাঁ, কেঁচোতে ভক্তি!—কেঁচো না থাকলে পৃথিবী কবে মরুভূমি হয়ে যেত, জানো? জানো এক বিঘে ভালো জমিতে প্রায় দু লক্ষ কেঁচো থাকে? জানো মাটির নীচে আট থেকে দশ হাত গর্ত করে গিয়ে নীচের মাটি ওপরে তারা চালাচালি করে বলেই পৃথিবী এমন উর্বর? জানো গায়ের জোরে পঞ্চাশটা ভীমসেন তাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না? একটা কেঁচো তার চেয়ে ষাট গুণ ওজনের পাথর কুচি সরিয়ে ফেলে অনায়াসে—তা জানো…

    আরও অনেক কিছু পাছে শিখে ফেলতে হয় সেই ভয়ে ঘনাদাকে তাড়াতাড়ি থামিয়ে দিয়ে বললাম, ভক্তি কি ওই সবের জন্য!

    না, শুধু ওসবের জন্য নয়। ভক্তি—এ যুগের সপ্তমাশ্চর্য এক আবিষ্কার ও গবেষণা ওরা সাহায্য না করলে চিরকালের মতো হারিয়ে যেত বলে। ওরা না থাকলে পৃথিবীর এক অসামান্য বৈজ্ঞানিককে সে গবেষণা সম্পূর্ণ করবার সুযোগ দিতে পারতাম না। পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটা উলটে এক বছর পিছনে ফিরে গিয়েও তাহলে কোনও লাভ হত না।

    মাথাটা আমাদের সকলেরই তখন ঘুরছে। গৌরই তবু প্রথম একটু সুস্থির হয়ে মাথা গোলানো ধাঁধার একটা জটকেই ছাড়াবার চেষ্টায় ধরা গলায় জিজ্ঞাসা করলে, ঘড়ির কাঁটা উলটে এক বছর পিছনে ফিরে যাওয়ার কথা কী বললেন যেন?

    ঘনাদা করুণাভরে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, হ্যাঁ, বললাম ১৯৫৩ থেকে ১৯৫২তে ফিরে যাওয়ার কথা।

    সশরীরে? আমাদের চোখ সব ছানাবড়া।

    হ্যাঁ, সশরীরে। ঘনাদা একটু অনুকম্পার হাসি হেসে শুরু করলেন, তখন নরফোক দ্বীপে ক-দিনের জন্য বেড়াতে গেছি। এ-দ্বীপটি অস্ট্রেলিয়ার প্রায় ৯০০ মাইল পুবে আর নিউজিল্যান্ডের সাতশো মাইল উত্তরে। ছোট্ট দ্বীপ, কিন্তু যেমন সুন্দর তেমনই নির্জন। ট্রাম বাস কি ট্রেনের বালাই নেই। একটা আধটা মোেটরের আওয়াজ শুধু মাঝে মাঝে পাওয়া-যায় দ্বীপে মানুষই তো মাত্র হাজার খানেক, ত ওসব ঝামেলা থাকবে কোথা থেকে! ডিসেম্বর মাসের শেষাশেষি হবে। নরফোকের এক পুরোনো বাসিন্দার সঙ্গে গল্প করতে করতে আমার হোটেলের দিকে যাচ্ছিলাম। নরফোকে মানুষের বাস খুব বেশি দিনের নয়। বাউন্টি জাহাজের বিদ্রোহের কথা হয়তো পড়েছ, ছবি অন্তত দেখে থাকবে। সেই বাউন্টি জাহাজের নজন বিদ্রোহী ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে পিটকেয়ার্ন নামে একটি দ্বীপে গিয়ে বসবাস করে। তাদেরই বংশধরেরা আবার ১৮৫৬ সালে আসে এই নরফোক দ্বীপে বাস করতে। এই সব পুরোনো দিনের গল্প শুনতে শুনতে যাচ্ছি, এমন সময় রাস্তার একটি লোককে দেখে হঠাৎ চমকে উঠলাম। বেঁটে-খাটো শুকনো চেহারার এক বৃদ্ধ। আমাদের উলটো দিক থেকে এসে আমায় দেখে একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়েই আবার পাশ কাটিয়ে চলে যাবার চেষ্টা করলে। কিন্তু তা আর যেতে দিলাম না। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে বৃদ্ধকে ধরে ফেলে বললাম, কে? মিস্টার জোয়াকিম না?

    বৃদ্ধ কিন্তু আমার সামনে যেন ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। কাতরভাবে মাথা নেড়ে বললে, না না, আপনার ভুল হয়েছে। আমি জোয়াকিম নয়, আমার নাম হ্যারিস, নম্যান হ্যারিস?

    নর্ম্যান হ্যারিস? একটু বিমুঢ় হয়েই বৃদ্ধকে ছেড়ে দিলাম। প্রায় পনেরো যোলো বছর আগের কথা বটে, কিন্তু এত বড় ভুল তবু কি হয়!

    সেই মুহূর্তে আমার হোটেলের নতুন বন্ধু মি. সিডনি এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় তখনকার মতো ব্যাপারটা মনে চাপা পড়েই রইল।

    মি. সিডনি অবশ্য এসেই জিজ্ঞাসা করেছিলেন হেসে, ও বুড়োকে ধরেছিলেন কেন, মশাই?

    লজ্জিতভাবে নিজের ভুলের কথাটা তাঁর কাছে স্বীকার করে প্রসঙ্গটা বদলে ফেলেছিলাম।

    ব্যাপারটা মনের মধ্যে চাপা দিলেও সন্দেহ আমার যায়নি একেবারে।

    সন্দেহ যে ভুল নয় সেই দিন সন্ধ্যার পরই তার কিছু প্রমাণ পাওয়া গেল।

    মাউন্ট পিট বলে নরফোক দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমের ছোটখাটো একটা পাহাড় থেকে তখন বেড়িয়ে ফিরছি। বেশ অন্ধকার হয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই। দ্বীপের হাসপাতালটি ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়ে হোটেলের দিকে বাঁক নিয়েছি, এমন সময় চাপা গলায় কে যেন কোথা থেকে ডস বলে ডাকল। অন্ধকারে এদিকে ওদিক চেয়ে কাউকেই দেখতে না পেয়ে পথের ধারের পাথুরে টিবিগুলোর ওপাশে খোঁজ করব কিনা ভাবছি এমন সময় টর্চ হাতে একজনকে আমার দিকেই আসতে দেখলাম। কাছে আসবার পর দেখা গেল লোকটি মি. সিডনি।

    হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, কী মি. সিডনি! টর্চ হাতে বেড়াতে বেরিয়েছেন যে!

    সাবধানের মার নেই মশাই! মি. সিডনিও হেসে বললেন, পাথুরে দ্বীপে কোথায় সাপখোপ আছে কে জানে।

    মি. সিডনি টর্চ নিয়ে চলে যাবার পর বেশ চিন্তিত ভাবেই হোটেলে ফিরলাম। আমার নাম ধরে আর কোনও ডাক তারপর শুনতে পাইনি। ব্যাপারটা কি আমার মনের ভুল?

    না, মনের ভুল কখনও নয়। সেদিন রাত্রে হোটেলের ঘরে আলো নিবিয়ে বসে ভাবতে ভাবতে আমার নিশ্চিত ধারণা হল, কোনও ব্যাপারেই আমার ভুল হয়নি। পথে আসতে স্পষ্ট আমার নাম ধরে কাউকে ডাকতে আমি শুনেছি। আর নম্যান হ্যারিস বলে নিজের পরিচয় যে দিতে চায় সে বৃদ্ধ মি. জোয়াকিম ছাড়া আর কেউ নয়। পনেরো-ষোলো বছর আগের কথা বটে, কিন্তু তার সঙ্গে এক-আধ দিন তো নয়, দুটি মাস আমি কাটিয়েছি, আর লোকের ভিড়ের মধ্যে নয়, একেবারে নির্জন এমন এক জায়গায় যেখানে সারাদিন দুজনেই পরস্পরের একমাত্র সঙ্গী। কিন্তু বৃদ্ধ সেই জোয়াকিমই যদি হয় তার এ দশা কেন? আমার কাছেও নাম লুকোবার এখন আর তার কী কারণ থাকতে পারে?

    উত্তরটা মাঝরাতেই পেলাম।

    তখনও এই সব কথা ভেবে ঘুম আমার আসেনি। মনে হল দরজায় কে যেন আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছে। প্রথমে মনে হল মি. সিডনির এটা আরেকটা মোটা রসিকতা হয়তো। সিডনির যেমন দশাসই পাহাড়ের মতো চেহারা, প্রাণে ফুর্তিরও তেমনই অজস্র ফোয়ারা। আমুদে মিশুকে লোক, এখানে এসে ক-দিনের আলাপেই আমার সঙ্গে জমিয়ে ফেলেছে। এই কদিন আগের রাত্রেই জানলার কাছে কী একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে জেগে উঠে দেখি, একটা বিরাট ভালুকের মতো কালো মৃর্তি পাল্লা দুটো একটু ফাঁক করে ঘরে উঁকি দিচ্ছে। ঘরে আলো নেই তখন, কিন্তু হোটেলের দূরের বারান্দার আলোয় তার আকারটা ফুটেছে জানলার ফ্রেমে সাড়া না দিয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ থাকবার পর দেখলাম মূর্তিটা জানলা টপকে সন্তর্পণে ভেতরে নামল। তারপর ধীরে ধীরে এগিয়ে এল আমার মশারির কাছে। মশারিটার একটা কোণ একটু তোলবার চেষ্টা করেই মূর্তিটা ককিয়ে উঠে মেঝের ওপর গিয়ে ছিটকে পড়ল। এক লাফে উঠে আলো জ্বেলে তারপর হেসে আর বাঁচি না। কালো পোশাক পরে মি. সিডনিই মেঝেয় কাত হয়ে পড়ে আছে। মি. সিডনিও একবার করে হাতের যন্ত্রণায় কোঁকায় আর একবার হাসে। হেসে বলতে লাগল, আমায় ভয় দেখাতে এসে এমন শাস্তি হবে জানলে সে আসত না। জব্দ করতে এসে নিজেই কিনা জব্দ। হাসতে হাসতে যাবার সময় জিজ্ঞাসা করে গেল, আমার হাতে সাঁড়াশি লুকোনো আছে। কিনা? নইলে এক মোচড়ে হাতটা ভাঙবার জোগাড় হয়।

    আজ আবার সিডনি রসিকতা করতে এসে থাকলে আর একটু কড়া ওষুধ দেব ঠিক করে চুপি চুপি দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আবার দুটো টোকা পড়ল তারপর। না, সিডনি এমন ভয়ে ভয়ে টোকা দেবার মানুষ নয়।

    দরজাটা হঠাৎ খুলে দিতেই যে-মূর্তিটা ছায়ার মতো নিঃশব্দে এসে ঘরে ঢুকল অন্ধকারেই সে কে বুঝতে আমার দেরি হল না।

    চাপা গলায় বললাম, কী? হ্যারিস, না জোয়াকিম কী বলে এখন ডাকব আপনাকে?

    ফিসফিস করে প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় সে বললে, মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা দিয়ো না, ডস। আমার দুঃখের কাহিনী আগে শোনো।

    শুনতে তো চাই।

    তাহলে এখানে নয়। হোটেলের বাইরে কোথাও নির্জনে গিয়ে বসি, চলো।

    তা-ই গেলাম আর জোয়াকিমের সমস্ত কাহিনীও শুনলাম।

    আমার অনুমানে এতটুকু ভুল হয়নি। এ বৃদ্ধ সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জোয়াকিম, মহাযুদ্ধের কয়েক বছর আগে নাৎসিদের হাত এড়িয়ে নির্বিঘ্নে নিজের যুগান্তকারী গবেষণা করবার জন্যে প্রশান্ত মহাসাগরের একটি জনমানবহীন ছোট্ট দ্বীপ ইজারা নিয়ে নিজেকে যিনি সমস্ত পৃথিবী থেকে নির্বাসিত করে রাখেন।

    সেই দ্বীপেই জোয়াকিমের সঙ্গে আমার তখন পরিচয়। নাৎসি চরেরা তাঁর গবেষণার দাম বুঝে হন্যে হয়ে সন্ধান করতে করতে তাঁর এই গোপন আস্তানারও যে খবর পেয়েছে এবং যে কোনও দিন যে তাঁকে পাকড়াও করতে আসতে পারে এই খবর দিতেই আমি সেখানে গেছলাম। গিয়ে তাঁর গবেষণার মূল্যবান সব কিছু লুকিয়ে রাখবার ব্যবস্থা করে, নাৎসি গুণ্ডারা সত্যিই একদিন হানা দেবার পর, একরকম তাদের নাকের ওপর দিয়ে, জোয়াকিমকে সরিয়েও দিয়েছিলাম সে দ্বীপ থেকে। যাবার সময় বলে দিয়েছিলাম পরে যে কোনও সময়ে যেন ফিরে এসে জোয়াকিম তাঁর গবেষণার কাজ উদ্ধার করেন।

    কিন্তু সে তো প্রায় পনেরো বছর আগেকার কথা। তার মধ্যে অত বড় মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে, নাৎসি জার্মানির অস্তিত্ব আর নেই। এতদিনেও জোয়াকিম তাঁর সেই গবেষণার কাজ সে দ্বীপ থেকে উদ্ধার করতে পারেননি?

    সেই প্রশ্নই অবাক হয়ে করলাম।

    জোয়াকিম হতাশ ভাবে বললেন, কী করব! তুমি তো জানো, ডস, ওয়ালিস দ্বীপাবলির যেটি আমি ইজারা নিয়েছিলাম তা নেহাত নগণ্য পাথুরে একটা সমুদ্রের চড়ার মতো। ওরকম ন্যাড়া পাথুরে ছোট্ট দ্বীপ ওখানে যে কত আছে তার ঠিক ঠিকানা নেই। ইজারা নেবার কাগজপত্রও যুদ্ধের সময় হারিয়ে ফেলেছি। এখন সে দ্বীপ আমি চিনব কী করে? বুড়ো হয়েছি, কবছর আর বাঁচব! কাছাকাছি সব কটা দ্বীপ খুঁজে বেড়াতে হলে তো আমার পরমায়ুতেই কুলোবে না। তা ছাড়া আমার গভীর সন্দেহ হচ্ছে যে নাৎসিরা শেষ হয়ে গেলেও অন্য কোনও দুশমনদের চর আমার পিছু নিয়েছে। তাড়াতাড়ি গোপনে সে দ্বীপ খুঁজে বার করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। আমার গবেষণা যতদূর এগিয়ে রেখেছি তা দুশমনদের কারুর যদি হাতে পড়ে, তাহলে পাষণ্ড কোনও বৈজ্ঞানিকতা থেকেই হয়তো আসল কাজ উদ্ধার করে নেবে।

    হেসে বললাম, দুশমনদের হাতে পড়বে কেন? তারা তো আর সে দ্বীপ চেনে না।

    কিন্তু আমিও যে চিনি না!

    আপনি না চেনেন, আমি তো চিনব!

    তুমি চিনবে! জোয়াকিমের গলার স্বরে বোঝা গেল কথাটা তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না।

    আশ্বাস দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, চিনব। পনেরো বছরে তিন ইঞ্চি, এই হিসেব ধরেই চিনব!

    সে আবার কী? প্রশ্নটা জোয়াকিম করেছিলেন কিনা জানিনা, কিন্তু আমাদের মুখ দিয়ে আপনা থেকেই বেরিয়ে গেল।

    যথাসময়েই জানবে! এসব নির্বোধ প্রশ্ন যে পছন্দ করেন না তা বুঝিয়ে ঘনাদা আবার শুরু করলেন, জোয়াকিমকে সেখান থেকে সাহস দিয়ে বিদায় দেবার সময় হঠাৎ চমকে উঠলাম। অন্ধকারে কাছের একটা ঢিবির আড়াল থেকে কী যেন সরে গেল মনে হল। সেই দিকে যেতে গিয়েও নিজেকে রুখলাম। এই দ্বীপেও শত্রুর উপস্থিতি যে আমি টের পেয়েছি তা আর তাকে না জানানোই ভাল, কিন্তু আমাদের। আর দেরি করা চলবে না। জোয়াকিমের কাছে জানা গেছে যে তাঁর ইজারার মেয়াদ এই ১৯৫২-তেই শেষ। বছর শেষ হবার আগেই সুতরাং নতুন ইজারা নিতে হবে। কিন্তু দ্বীপ না খুঁজে পেলে ইজারা নেওয়া হবে কীসের? দ্বীপটা এই বছরেই না খুঁজে পেলেই নয়।

    কিন্তু খোঁজবার জন্য সেখানে যাওয়া তো দরকার। ওয়ালিস দ্বীপাবলিতে এই বছরের মধ্যে যাব কী করে?

    পরের দিন সকালে খোঁজ করতে গিয়ে একেবারে চক্ষুস্থির। নরফোক দ্বীপে চোদ্দ দিন অন্তর একটি করে প্লেন আসে অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড থেকে আসে শুধু শনিবারে। টেলিগ্রাফও নেই যে অস্ট্রেলিয়া থেকে টেলিগ্রাফে ভাড়া করে একটা সি-প্লেন আনব। আগের দিনই ছিল শনিবার। প্লেন যা আসবার এসে চলে গেছে, সুতরাং আরও তেরোটি দিন অপেক্ষা না করে উপায় নেই। কিন্তু তেরোদিন বাদেই তো একুত্রিশে ডিসেম্বর! বছরের শেষ।

    কী ভাবে যে সেই তেরোটা দিন কাটালাম তা বলে বোঝানো যায় না। এমন শুভ যোগাযোগের পর শুধু একটু সময়ের অভাবে সব আশায় ছাই পড়বে। সম্ভব হলে বোধহয় সাঁতরেই চলে যেতাম। তার বদলে শুধু হাত কামড়েই তেরো দিন কাটালাম।

    একত্রিশে ডিসেম্বর প্লেনে জোয়াকিমকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছেই একটা সি-প্লেন ভাড়া করতে ছুটলাম। কিন্তু ভাগ্য সেখানেও বিরূপ। সেদিন রাত্রে যাবার মতো একটা প্লেনও ভাড়া পেলাম না। রওনা হতে হল বাধ্য হয়েই তার পর দিন সকালে। পাইলটকে বলে দিলাম ওয়ালিস দ্বীপপুঞ্জের ওপর গিয়ে শুধু যেন খানিক চক্কর দিয়ে ফেরে। ভোর না হতে বেরিয়েছিলাম। দুপুর নাগাদ ওয়ালিস দ্বীপপুঞ্জের মাথায় গিয়ে প্লেনটা চক্কর দিতে লাগল। জোয়াকিম ও আমি দুজনেই তখন প্লেনের দুদিকের জানালায় মুখ বাড়িয়ে নীচের দিকে চোখ এঁটে বসে আছি। এক রাশ ছোট ছোট পাথুরে দ্বীপ। সব এক রকম। আলাদা করে চেনে কার সাধ্য। প্লেনটা একটু নীচে নেমে এসে বার কয়েক চক্কর দেবার পরই আমি আনন্দে চিৎকার করে উঠলাম, পেয়েছি, ড. জোয়াকিম! পেয়েছি আপনার সাতরাজার ধন মানিকের দ্বীপ!

    পাইলটকে সে দ্বীপের এক ধারে খানিকটা ঘেরা বন্দরের মতো সমুদ্রে প্লেন নামাতেও বললাম।

    কিন্তু বাধা দিলেন স্বয়ং জোয়াকিম। বেশ একটু সন্দিগ্ধস্বরে বললেন, করছ কী, ডস? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে! এ দ্বীপ আমার হতে পারে না।

    হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন বলুন তো?

    কেন? জোয়াকিম একটু বিরক্তির সঙ্গেই বললেন, দেখতে পাচ্ছ না, দ্বীপটা দস্তুরমতো সবুজ!

    দেখতে পাচ্ছি বলেই তো বলছি এ-ই আপনার দ্বীপ!

    জোয়াকিম হতভম্ব হয়ে বললেন, তার মানে?

    মানে এখুনি বুঝিয়ে দেব। আগে প্লেনটা নামতে দিন।

    প্লেন সে দ্বীপের সমুদ্রে নামবার পর মানেটা জোয়াকিমকে বোঝাবার সময় কিন্তু পাওয়া গেল না। এমন আশ্চর্য সৌভাগ্যে এ-দ্বীপ খুঁজে পাবার পর তা আবার নতুন করে ইজারা নেবার যেটুকু আশা ছিল আমাদের প্লেনের মিনিট দুয়েক পরেই আর একটি অনেক বড় প্লেন নামার সঙ্গে সঙ্গে তা ধূলিসাৎ হয়ে গেল।

    সে প্লেন থেকে আমাদের মতোই ছোট রবারের বোটে তীরে এসে নামল আর কেউ নয়, স্বয়ং সিডনি।

    আমি তখন সমুদ্রের তীরের ওপরই দাঁড়িয়ে এ-দ্বীপ কী করে চিনলাম তাই জোয়াকিমকে বোঝাচ্ছি।

    একগাল হেসে আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সিডনি সমস্ত দ্বীপটাকে যেন শুনিয়ে বললে, আরে, মি. দাস না! পৃথিবীটা বড্ড ছোট মনে হচ্ছে। এখানে আপনাকে দেখব তা তো ভাবিনি!

    বললাম, আমি কিন্তু জানতাম, আপনি আসছেন।

    বলেন কী! সিডনি বিরাট শরীর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করলে, কবে থেকে?

    সাপের ভয়ে যেদিন নরফোক দ্বীপে টর্চ নিয়ে বেরিয়েছিলেন সেই দিন থেকেই।

    তাই থেকেই বুঝে ফেললেন! একটি বেশি হেঁয়ালি হয়ে যাচ্ছে না?

    হেঁয়ালি নয়, ব্যাপারটা অত্যন্ত সোজা! আপনিও জানেন নরফোক দ্বীপে আর যাই থাক, সাপ নেই। ও কৈফিয়তটা দিয়ে সেদিন তাই ভাল করেননি। আমার ঘরে রাত্তির বেলা হানা দিতে এসেও একটু ভুল করেছিলেন বোধহয়।

    কিন্তু এখন বোধহয় ভুল করিনি। সিডনির গলা কর্কশ হয়ে উঠল, সাপ না থাক, নরফোক দ্বীপে একটা নেংটি ইদুর আর ছুঁচো ছিল। সে দুটো আবার এখানে এসে জুটেছে। তাই সে দুটোকে তাড়াবার জন্যই এখানে এসেছি, বুঝতে পারছেন বোধহয়!

    হেসে বললাম, আপনার উদ্দেশ্য খুব সাধু সন্দেহ নেই। কিন্তু সেদিন রাত্রে টিবির আড়াল থেকে সব শুনে ওই নেংটি ইদুর আর ছুঁচোর পিছু নিয়েই তো এ-দ্বীপের সন্ধান পেয়েছেন। এ দ্বীপটাও যে নেংটি ইদুরের না হোক ওই ছুঁচোর, তা-ও ভুলে যাচ্ছেন কেন?

    সিডনি আবার হো হো করে হেসে উঠে বললে, ও, এ-দ্বীপ তোমাদের! মানে ওই ছুঁচো বৈজ্ঞানিক ড. জোয়াকিমের! আজ কত তারিখ তা খেয়াল আছে? ১৯৫৩ সালের ১লা জানুয়ারি, কাল ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত জোয়াকিমের ইজারা ছিল এ দ্বীপের ওপর। কালকের মধ্যে যখন নতুন ইজারা নিতে পারেনি তখন আর ইজারা পাচ্ছে কোথায়? আজকের মধ্যেই অস্ট্রেলিয়ায় ফিরে গিয়ে কাল সকালেই এ-দ্বীপের অবস্থান জানিয়ে আমরা নতুন ইজারা নিচ্ছি।

    ডা. জোয়াকিম এ কথা শুনে কাতরভাবে বলে উঠলেন, কী হবে তাহলে, ডস? সব যে গেল!

    তাঁকে হাত নেড়ে থামিয়ে নিতান্ত নিরীহকণ্ঠে বললাম, তা ইজারা আপনারা নিতে চান, নিন। ড. জোয়াকিমের এ-দ্বীপে লুকিয়ে রাখা গবেষণার জিনিসগুলো আমরা শুধু খুঁজে নিয়ে যাই তাহলে?

    খুঁজে নিয়ে যাবি তোরা, সিডনি হিংস্রভাবে হেসে উঠল, একবার চেষ্টা করে দেখই না!

    সিডনি তখন পিস্তল বার করেছে, তার পেছনেও তার প্লেনের দুজন সঙ্গী এসে দাঁড়িয়েছে পিস্তল উঁচিয়ে।

    তাদের দিকে চেয়ে যেন ভয়ে ভয়ে বললাম, আপনাদের যেন খুঁজতে দেবার ইচ্ছে নেই মনে হচ্ছে?

    বুঝতে পেরেছিস কালা নেংটি! সিডনির সে কী উল্লাসের হাসি, নাৎসিদের ফাঁকি দিয়ে ওই ছুঁচো বৈজ্ঞানিকটা এখানকার গর্তে সেঁধিয়ে যে-গবেষণা করেছে, নাৎসিদের ভয়েই যুদ্ধের আগে যা এখানে লুকিয়ে রেখে গেছে তা আমরাই এবার খুঁজে বার করব।

    ভালমানুষের মতো বললাম, কিন্তু আমরা না থাকলে কোনো জায়গাটা খুঁজতে একটু অসুবিধা হবে না? খুঁজে হয়তো পাওয়া যাবে শেষ পর্যন্ত, কিন্তু দেরি হতে পারে তো!

    হয় হবে? সিডনি গর্জন করে উঠল, যতদিন লাগে খুঁজব। এ-দ্বীপ এখন আমাদের।

    কিন্তু এ দ্বীপের দখল যদি না পান? নির্বোধের মতো সিডনির দিকে তাকালাম।

    পাব কী! পেয়ে গেছি। সিডনি জ্বলে উঠল, আমাদের লোক অস্ট্রেলিয়ায় বসে আছে তৈরি হয়ে। খবরটা নিয়ে গেলেই রেজেস্ট্রি।

    আমরা এখন যদি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে আমাদের দাবি জানাই? আমার সরল জিজ্ঞাসা।

    সিডনি চিড়বিড়িয়ে উঠল একেবারে, তোরা গিয়ে দাবি জানাবি? আমাদের প্লেনটা দেখেছিস? তোদের ও রদ্দি প্লেনের ডবল জোরে চলে। তোদের প্লেন মাঝপথে থাকতেই আমরা পৌঁছে যাব। তা ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার দিকে তাদের প্লেন একবার। চালাবার চেষ্টা করে দেখ না? কত কাল বাদে কে জানে সমুদ্রে একটা রদ্দি সি-প্লেনড়ুবির খবর শুধু বেরুবে! আমাদের প্লেনে ক-টা কামান আছে জানিস?

    যেন সভয়ে বললাম, থাক, জানবার দরকার নেই। আমাদের তাহলে এখান থেকে খসে পড়াই সুবুদ্ধির কাজ?

    হ্যাঁ এবং এই মুহূর্তে!মনে থাকে যেন অস্ট্রেলিয়ার দিকে প্লেন ফেরালে আর রক্ষে থাকবে না? ভালয় ভালয় যে জ্যান্ত ফিরে যেতে দিচ্ছি এই ভাগ্যি মনে কর।

    ধন্যবাদ, মি. সিডনি। বলে গদগদ হয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে হতভম্ব ডা. জোয়াকিমকে নিয়ে আমাদের প্লেনের দিকে চললাম। আমাদের পিছনে পিস্তল উঁচিয়ে চলল সিডনি আর তার সঙ্গীরা। আমাদের প্লেনে উঠিয়ে বিদেয় না করে তারা ছাড়বে না বোঝা গেল।

    ড. জোয়াকিম যেতে যেতে হতাশভাবে বললেন, কোথায় যাবে, ডস?

    দেখি কোথায় যাই! আমিও করুণ স্বরে বললাম, অস্ট্রেলিয়ার দিকে যাওয়া তো বারণ।

    হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া শুধু নয়, নিউজিল্যান্ডেও। পশ্চিমে কি দক্ষিণে কোনও দিকে প্লেন চালালেই মজা টের পাবে! সিডনি হুংকার ছাড়ায় বুঝলাম আমার কথাগুলো তার কানে গেছে।

    দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, না, মজার লোভ আর নেই। পুবদিকেই তাহলে কোথাও যেতে হবে।

    প্লেনে উঠে পুবদিকেই সত্যি রওনা হলাম। চালাকি করে লুকিয়ে কোথাও থেকে মুখ ঘুরিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাবার চেষ্টা করে এখন লাভও নেই। আমাদের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সিডনির প্লেনও আকাশে উঠে চক্কর দিচ্ছে। কোনও রকমে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব হলেও

    সে প্লেনের আগে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছোনো যাবে না।

    কিছু দূর নীরবে যাবার পর জোয়াকিম বুকফাটা যন্ত্রণার সঙ্গে বলে উঠলেন, কী যে সর্বনাশ হল, ডস! শুধু যদি একটা দিন আগে রেজেস্ট্রিটা করে ফেলতে পারতাম!

    শান্তস্বরে বললাম, একটা দিন আগেই রেজেস্ট্রি করবেন, চলুন না!

    এই দুঃখের ওপর আর ঠাট্টা কোরো না, ডস! জোয়াকিমের গলায় ক্ষুব্ধ ভৎসনার স্বর।

    ঠাট্টা তো করছি না!

    ঠাট্টা করছ না! জোয়াকিম যেভাবে আমার দিকে তাকালেন তাতে বোঝা গেল আমার মাথা খারাপ হয়েছে বলেই তাঁর সন্দেহ। একটু রাগের সঙ্গেই তারপর বললেন, একটা দিন আগে যাওয়া যায়! হ্যাঁ, টাইম-মেশিন বলে সত্যি কিছু থাকলে যাওয়া যেত।

    টাইম মেশিনের দরকার নেই। এই প্লেনেই যাওয়া যায়। আর যায় শুধুনয়, আমরা আগের দিনেই সত্যি পৌছে গেছি।

    জোয়াকিম হতভম্ব হয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। বললাম, আমার মুখ কী দেখছেন? নীচের দিকে তাকান। আমাদের প্লেন আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা পার হয়ে সামোয়া দ্বীপপুঞ্জের ওপর এখন এসেছে। এ তারিখ-রেখার ওপারে এখন ১৯৫৩-এর ১লা জানুয়ারি বটে কিন্তু পুবদিকে এপারে এখন ১৯৫২ সালের ৩১শে ডিসেম্বর। আমরা খানিক বাদেই প্রধানতম শহর ও বন্দর প্যাগো প্যাগোতে নামছি— সেখানে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব। তাদের মারফত আপনি ও দ্বীপের ইজারা বছরের এই শেষ দিনেও যদি নতুন করে নিয়ে রেজেস্ট্রি করান, আর কেউ তাহলে তারপর ও-দ্বীপ ছুঁতেও পারবে না। দুশমনদের সব শয়তানি তাহলে ভণ্ডুল!

    ড. জোয়াকিম খানিক বিমূঢ় ভাবে বসে থেকে হঠাৎ আনন্দে চিৎকার করে উঠে প্লেনের মধ্যেই আমায় জড়িয়ে ধরলেন। তারপর সে কী উচ্ছাস! সত্যি একথাটা আমার মাথাতেই আসেনি, ডস। ওয়ালিস আর সামোয়া দ্বীপপুঞ্জ যে পাশাপাশি হলেও আন্তর্জাতিক তারিখ-লাইনের দুধারে এ খেয়ালই আমার হয়নি! তোমায় কী বলে যে ধন্যবাদ দেব!

    হেসে বললাম, ধন্যবাদ আমায় নয়, দিন ওই কেঁচোদের?

    কেঁচোদের! জোয়াকিম আবার হতভম্ব।

    হ্যাঁ, সেই কেঁচোদের, যাদের অনুগ্রহ ছাড়া ও-দ্বীপ অমম সবুজ হত না আজ, আর আমরাও চিনতে পারতাম না, শত চেষ্টাতেও।

    তার মানে?

    তার মানে এই যে গত মহাযুদ্ধের আগে নাৎসি গুণ্ডাদের হাত থেকে বাঁচাতে আপনাকে ও-দ্বীপ থেকে সরিয়ে দেবার সময়ই, দ্বীপটা পরে খুঁজে পাবার ওই বুদ্ধি আমি করেছিলাম। আপনার মনে আছে কিনা জানি না যে মার্কিন মুলুক থেকেই আমি আপনার ও-দ্বীপে যাই। আমেরিকার এক কেঁচো-পালন কেন্দ্র থেকে কেঁচোর ডিমের গুটি আমি সঙ্গে করে এনেছিলাম। সেই ডিমভরা গুটিই আমি ও-দ্বীপে ছেড়ে দিয়ে আসি। জানতাম যে কয়েক বছরের মধ্যেই ওই সব গুটির ডিম থেকে বেরিয়ে সারা দ্বীপ কেঁচোয় ছেয়ে যাবে আর তারাইনীচের মাটি ওপরে তুলে সমস্ত দ্বীপ উর্বর করে তুলবে। করেছেও তাই। সেই উর্বর মাটিতেই ঘাস-ঘাসড়া গজিয়ে সমস্ত দ্বীপ সবুজ হয়ে গেছে। সেই দেখেই আমি ও-দ্বীপ চিনেছি। নরফোক দ্বীপে আমি বলেছিলামপনেরো বছরে তিন ইঞ্চি হিসেব দেখেই আপনার দ্বীপ আমি চিনব। প্রায় পনেরো বছর বাদে এ-দ্বীপে আমরা এলাম। পনেরো বছরে কেঁচোরা সাধারণত তিন ইঞ্চি উর্বর মাটি নীচে থেকে ওপরে তুলে আমায় বলেই ওকথা বলেছিলাম।

    ঘনাদা একটু থামলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার ড, জোয়াকিম তাহলে তাঁর দ্বীপের ইজারা আবার পেলেন?

    পেলেন বইকি! প্যাগো প্যাগোতে নেমেই নতুন করে রেজেস্ট্রি করিয়ে নিলেন। সেখান থেকে সবার আগে অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত রেজেস্ট্রি অফিসেও খবর পাঠিয়ে দেওয়া হল।

    মুখের গ্রাস হারিয়ে সেই সিডনি নিশ্চয় তখন খাপ্পা! গৌর ভোজের শেষে পান মশলাও বাদ দিতে চায় না। জিজ্ঞাসা করলে, আপনার সঙ্গে আর দেখা হয়নি?

    হয়েছিল। প্যাগো প্যাগোতেই এসেছিল আমার দফা নিকেশ করতে!

    তারপর? আমরা উদগ্রীব।

    ঠিক জানি না। হাসপাতাল থেকে এতদিনে বোধহয় বেরিয়েছে! ঘনাদা হাই তুললেন।

    আচ্ছা, আপনার ড. জোয়াকিম তাঁর লুকোনো গবেষণার জিনিস খুঁজে পেয়েছেন তো! আমরা এখনও কৌতূহলী।

    পেয়েছেন। ঘনাদা সংক্ষিপ্ত।

    অত দামি গবেষণার বস্তুটা কী? আমাদের সবিনয় নিবেদন।

    বস্তুটা কী? ঘনাদা অবজ্ঞা ভরে আমাদের দিকে তাকালেন, বস্তুটা কী, তোমরা বুঝবে?

    না বুঝি, তে দোষ কী? আমাদের সবিনয় নিবেদন।

    বস্তুটা একটা অঙ্ক। ঘনাদার মুখে অনুকম্পা মিশ্রিত তাচ্ছিল্যের হাসি।

    অঙ্ক!

    হ্যাঁ, স্রেফ একটা অঙ্ক যার কিছুটা কষা বাকি রেখে জোয়াকিমকে পালাতে হয়েছিল। পুরোনো কাগজপত্র উদ্ধার করে এখনও তিনি যা কষছেন।

    একটা অঙ্কের জন্যে এত! আমাদের সন্দেহমিশ্রিত বিস্ময়।

    হ্যাঁ, একটা অঙ্কের জন্যে। একটা অঙ্কের কী দাম হতে পারে ভাবতে পারো? ঘনাদা আবার উত্তেজিত, ই ইকোয়াল টু এম সি স্কোয়ার অঙ্কটার কথা কখনও শুনেছ?

    না শোনাই যুক্তিযুক্ত বুঝে তাঁর দিকে সসম্ভ্রমে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার অঙ্ক বুঝি ঘনাদা?

    না, ঘনাদা ঝাঁজিয়ে উঠলেন, আইনস্টাইনের আপেক্ষিকদের অঙ্ক, ওই একটা অঙ্কে দুনিয়ার সব মানেই পালটে গিয়েছে। ড. জোয়াকিমের অঙ্ক তার চেয়েও জটিল, সূক্ষ্ম। সে অঙ্ক কষা হয়ে গেলে মানুষের হাতে কী ক্ষমতা যে আসবে তা কেউ ভাবতেও পারে না।

    এই মেসেই বসেই রাজা উজির যা চাই তা-ই হতে পারব! শিবু হঠাৎ রসভঙ্গ করে বসল, হ্যাঁ, ভাল কথা মনে পড়েছে। আপনার নুরুদ্দিনকে হুকুম পাঠিয়েছেন নিশ্চয়, ঘনাদা। কিচিন্দে যাওয়া না হয়ে ভালই হল। অ্যাঙ্গোরা খাসির মাংসটা প্রাণ ভরে খাওয়া যাবে, কী বলেন?

    কেমন করে যাবে? নুরুদ্দিন তো খাসি তৈরিই রেখেছিল, কিন্তু সবাই কিচিন্দে যাচ্ছি জেনে তাকে বারণ করে দিতে হল যে! যা অভিমানী লোক, ওর কাছে আর কিছু কখনও চাওয়াই যাবে না। অম্লানবদনে বলে ঘনাদা শিশিরের দিকে হাত বাড়ালেন, গলাটা কেমন নো-শুকনো লাগছে কেন বলো তো হে?

    আজ্ঞে, বুঝেছি। বলে শিশির সিগারেটের টিন আনতে ছুটল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }