Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    মাটি

    মাটি

    আয়েষা হঠাৎ যন্ত্রণায় থরথর করে কেঁপে উঠল।

    কে যেন প্রচণ্ড এক বোমা ছুঁড়ে মেরেছে তার গায়ে। বোমা অবশ্য কেউ মারেনি। নিজে থেকেই কোথাও কিছু ফেটেছে। তারই চাপা আওয়াজটা আমরা ককপিটে বসেই পেলাম।

    হ্যাঁ, আয়েষা কোনও মেয়ে-টেয়ে নয়, একটা মাঝারি মাপের জোড়া ইঞ্জিনের ব্রিস্টল পার্সিউস।

    জায়গাটা হল উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার আকাশ আর প্লেন চালাচ্ছি আমি!…

    ব্যস, ওই পর্যন্তই। তারপর খক্‌ খক্ খুক খুক কী যে কাশির হিড়িক পড়ল, বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে যেন কাশ রোগের এপিডেমিক লেগেছে। শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভুর গলার খুকখুকুনিটাই কাশি বলে চালানো একটু শক্ত!

    কী হচ্ছে কী সব? শিবু কড়া গলায় ধমক দিয়ে তার নতুন ঘাঁটা হোমিওপ্যাথিক বিদ্যে জাহির করলে, অত যদি কাশি হয়েছে তো এক ফোঁটা ইপিকাক থার্টি খেতে পারো না? তা না হয়, সকাল বিকেলে দুবার গার্গল…

    গার্গল কথাটাই গলা দিয়ে বার হবার সময় অমন সুড়সুড়ি লাগবে শিবুও বোধহয় ভাবতে পারেনি। নিজেই সে কেশে খুন তারপর।

    রীতিমতো রাগ দেখাতে হল এবার। বললাম, কী সব তোদের আক্কেল। কাশবার আর সময় পেলি না! ওদিকে আফ্রিকার ওপর ঘনাদা জখম প্লেনে আটকা পড়েছেন—সে খেয়াল আছে?

    সেই খেয়ালটা হতেই যেন ধন্বন্তরীর ওষুধ পড়ে সব কাশি থেমে গেল।

    ঘনাদার অবস্থাটা কিন্তু এখন কী।

    চেয়ে দেখতে ভরসা হয় না। মনে হয় বিস্ফোরণটা বুঝি তাঁর দুচোখেই দেখতে পাব।

    ভয়ে ভয়ে বললাম, ককপিটে তারপর কী করলেন, ঘনাদা?

    জবাব নেই ঘনাদার মুখ থেকে!

    আয়েষা কি ফেটে গেল আকাশেই?

    ঘনাদা একেবারে মৌনী।

    তাহলে এত কষ্টের আয়োজন, এত ফন্দি-ফিকির সবই একটু কাশির আহাম্মকিতেই গেল ভেস্তে?

    তাঁর মুখের দিকে এখনও ভরসা করে চোখ তুলিনি। কিন্তু আরামকেদারা থেকে নেমে মেঝের ওপর ছড়ানো তাঁর চরণযুগল তোতা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।

    চরণযুগল তো এখনও যথাস্থানেই আছে। শুধু আছে নয়, রীতিমতো ছন্দে ছন্দে নড়ছে বলা যায়। অর্থাৎ ঘনাদা আরামে তাঁর মৌরসি আসনে গা এলিয়ে দিয়ে পা নাচাচ্ছেন।

    এটা খাপ্পা হওয়ার লক্ষণ তো নয়! তাহলে এতক্ষণে ওই পদযুগলকে তো আসর ঘরের দরজা পার হয়ে তেতলায় টঙের ঘরের দিকেই উঠতে দেখা যেত। ওই কাশির এপিডেমিকের পর ঘনাদা আর এক মুহূর্তও থাকলে এই বর্বরদের মাঝখানে?

    তাহলে এ অভাবনীয় ব্যাপার সম্ভব হল কী করে?

    সাহস করে এবার মুখ তুলে ঘনাদার দিকে তাকালাম। তাকিয়ে তাঁর একাগ্র ও উদগ্রীব দৃষ্টি অনুসরণ করে আসর-ঘরের দরজার দিকে চোখ গেল।

    সেখানে বনোয়ারি একটা বিরাট ট্রে নিয়ে ঢুকছে। ট্রে-টা এমন বিরাট যে বনোয়ারিকে দুহাত ছড়িয়ে সেটা বাগিয়ে ধরতে হয়েছে।

    ট্রে-র ওপর একটা খঞ্চিপাশের ঢাকনা।

    সে-ঢাকার তলায় কী আছে আমরা অবশ্য জানি। কিন্তু বনোয়ারি দরজায় দেখা দেবার আগেই যে-রকম আগ্রহভরে ঘনাদা সেদিকে তাকিয়ে প্রায় বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে গিয়েছিলেন তাতে তিনিও সে খঞ্চিপোশর নীচে ট্রের ওপর সাজানো সব প্লেটে কী আছে যেন তখনই মনে মনে টের পেয়েছিলেন বলে সন্দেহ হয়।

    টের পেলেন কীসে? শুধু গন্ধে?

    আমাদের মতো সাধারণ নগণ্য মানুষের তুলনায় ঘ্রাণশক্তি তাঁর তাহলে সত্যিই অলৌকিক বলতে হয়। বনোয়ারি দরজা পেরিয়ে আসরের একেবারে মাঝখানে এসে দাঁড়াবার আগে শুধু নাসিকা মারফত আমরা কিছুই জানতে পারিনি। ঘরের মাঝখানে ট্রে-টা ঘনাদার সামনের নিচু টেবিলটায় রেখে বনোয়ারি ওপরের ঢাকনাটা সরাতে গন্ধটা অবশ্য উতলা করে তুলল।

    উতলা করে তোলবার মতোই জিনিস। কলকাতার সেরা রেস্তোরাঁর সবচেয়ে বড় ওস্তাদ বাবুর্চির সোনা দিয়ে বাঁধানো হাতের কাজ। মুখে দিলে যেন আর এ-দুনিয়ায় নয়, বেহেস্তেই আছি মনে হবে।

    এসব বিজ্ঞাপনের ভাষা অবশ্য গৌরের। ঘনাদাকে বেঁধে ফেলবার জন্য কদিন ধরে সে এসব পাঁয়তাড়া কষছে। আমাদের কাছে সকালে বিকালে সুবিধে পেলেই শনিবারের আসরে যে আজব খানা সে আমদানি করছে তার আগাম হ্যান্ডলি ছেড়েছে বলা যায়।

    গদগদ হয়ে বলেছে, এ তো আর শুধু ফুটন্ত জলে চোবানো কি হাতখুন্তি নাড়া নয়, সারেঙ্গির ছড় চালানোর মতো এক একটি শিক ঘোরাবার সূক্ষ্ম কেরামতি।

    আজবখানাটা যে কী, রসিকজনের কাছে তা বোধহয় আর ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না।

    হ্যাঁ, উপাদেয় জিনিসটি হল কলকাতার একেবারে সেরা রসুইখানার শিককাবাব। ঘনাদাকে কিন্তু সে কথা জানানো হয়নি। তা সত্ত্বেও চোখে দেখার আগে শুধু গন্ধেই মোহিত হয়ে তিনি যদি আমাদের অমন একটা বেয়াদবি আশাতীত ভাবে মাপ করে ফেলেন তাহলে সেটা আমাদের নেহাত ভাগ্য বলেই ধরা উচিত।

    খটকা অবশ্য মনের ভেতর একটু থেকে যায়। শিককাবাব বা আর কোনও আহামরি খাবারই হোক এসব ঘুষ তাঁর বাঁধা বরাদ্দ। তার জন্য এমন দয়ার অবতার হতে তাঁকে বড় দেখেছি বলে তো মনে পড়ে না।

    কিন্তু খটকাটাকে আমল দেবার দরকারটা কী? ঘনাদা যে বেমালুম সব কিছু ভুলে গিয়ে তাঁর ডবল সাইজের প্লেটে ফালি করা কোল বালিশের মতো দুটি বড় বড়

    কাবাবে মনোনিবেশ করেছেন এতেই কৃতার্থ হয়ে খুশি থাকলেই তো হয়।

    ঘনাদা যতক্ষণ শিককাবাবে তন্ময় হয়ে আছেন ততক্ষণ এ-বৈঠকের ভূমিকাটা সেরে ফেলা যেতে পারে। ঘনাদাকে এ শনিবারে মুখ খোলাবার জন্য যে সব আয়োজন হয়েছে তার একটা হল এই শিককাবাব।

    এর ওপর শিশিরের সিগারেটের টিন তো আছেই—তা ছাড়া আর একটা মোক্ষম ঘুষ বা প্রণামী যা দেওয়া হয়েছে তা একটু অভাবিত নিশ্চয়। তাই দিয়েই শেষ মাত-এর চালের রাস্তা গৌর আগে থাকতে করে রেখেছে।

    ঘনাদা নিজেই একটু যেন চমকে গেছেন প্রথমে।

    আর যা-ই হোক, তাঁকে এক ভাঁড় ঘি কেউ উপহার দিতে পারে, এটা তিনি কল্পনাই করতে পারেননি বোধ হয়।

    এটা কী হে? ঘনাদা একবার ভাঁড়টা আর একবার যে সেটা তাঁর পায়ের কাছে নামিয়ে দিয়েছে তার দিকে সমান সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়েছেন।

    দাতা অবশ্য তার অচেনা।

    তার পরিচয়টা গৌরই উচ্ছ্বসিত হয়ে এবার দিয়েছে, এ হল শম্ভু, মানে শিবুর মাসতুতো ভাই, ঘনাদা। আপনাকে ওর ডেয়ারির ঘি একটু চাখতে দিতে এসেছে।

    চাখবার পক্ষে যথেষ্ট কিনা ঘনাদা সেইভাবে একবার কাগজ দিয়ে মুখ বাঁধা ভাঁড়টার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, শিবুর মাসতুতো ভাইয়ের ডেয়ারি আছে বুঝি?

    না, ডেয়ারি ঠিক নেই, গৌরকে যেন সত্য স্বীকার করতে হয়েছে, তবে যেখানে ও ডেয়ারি করবে ভাবছে সেখানকার ঘির একটু নমুনা এনেছে আমাদের জন্য।

    জায়গাটা কোথায়? ঘনাদা মৃদু একটু কৌতূহল দেখিয়েছেন।

    বেশিদূর নয়, নেফার কাছে, গৌর খুশি করবার মতো খবরটা দিয়েছে, ডেয়ারি করার দারুণ সুবিধে। গোরুর পাল সেখানে ছাড়াই থাকে। বনে নিজেরা চরে খায়, গোয়ালেরও দরকার হয় না। শুধু ধরে দুয়ে নিলেই হল।

    বাঃ! শুধু ধরে দুয়ে নিলেই হল? ঘনাদা রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে উঠেছেন মনে হয়েছে, তাহলে ডেয়ারির আর ভাবনাটা কী?

    না, ভাবনা কিছু নেই। শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভই এবার মহড়া নিয়েছে, আর শুধু ডেয়ারি নে, চাষবাসেরও দারুণ সুবিধে। জমি পড়ে আছে অঢেল, শুধু চষলেই হল!

    জমি খুব সস্তা তাহলে! ঘনাদার গলায় বেশ ঔৎসুক্যই ফুটে উঠেছে যেন।

    সস্তা, মানে জলের দর। শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু সানন্দে জানিয়েছে, জমি যে চষে তার।

    আর ফসলও তাহলে তা-ই! ঘনাদা একটু বেয়াড়া বুঝেছেন কিনা ঠিক ধরা যায়নি, যে কেটে নেয় তারই।

    ভুল যদি ঘনাদা কিছু বুঝে থাকেন তা সংশোধন করবার আর চেষ্টা করেনি কেউ।

    গৌর তার বদলে নিজের উৎসাহটাই প্রকাশ করেছে, এরকম জায়গার কথা শুনলে এখুনি যেন চলে যেতে ইচ্ছে করে। মনে হয় কেন মিছে পড়ে আছি এই নোংরা ঘিঞ্জি খবরের কাগজের ভাষায়—সমস্যাসংকুল শহরে।

    হ্যাঁ, ঘনাদা গৌরকে সমর্থন জানিয়েছেন, এই প্রবলেম সিটি থেকে যেতে হলে নেফাই একমাত্র জায়গা। বুনো আধবুনো গাউর আর গয়ালের পাল আছে, পারো তো। দুয়ে নাও, আর জমি আছে অঢেল, চযো। তুমি না পারো, ফসল না হয় আর কেউ কাটবে। আর যদি ওই গাউর গয়ালের পালই খেয়ে যায় তাহলেও লোকসান নেই। ওরা তো তোমাদের ডেয়ারির সব।

    ঘনাদার কথাগুলো কি একটু বাঁকা?

    অত খুঁত ধরলে চলে না। বাঁকা কথাকে সিধে ভাবলেই তো হয়। যার মাসতুতো ভাই তার হবু ডেয়ারির নমুনা হিসেবে ওই ঘি এনেছে সেই শিবুই এবার হাল ধরেছে আলোচনার।

    যেন আশীর্বাদ চাইবার ভঙ্গিতে বলেছে, আপনি তাহলে ভরসা দিচ্ছেন, ঘনাদা? আপনার কাছে একটু সাহস পেলে এ মেস-টেস তুলে দিয়ে চোখ কান বুজে সবাই নেমে পড়ি। নেফার জমি তো খুব ভাল শুনেছি। মাটিতে সোনা ফলে, তাই না ঘনাদা?

    সোনা ফলে কি না ফলে তা উনি কী করে বলবেন? হঠাৎ বেসুরো গেয়েছে শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভ। বেশ একটু নাক বেঁকিয়ে বলেছে, উনি কি মাটি চেনেন? ওঁর দৌড় তো এই বনমালি নস্করের গলি আর রাজত্ব ওই চিলেকোঠার ছাদটুকু। মাটির উনি কী জানেন?

    আসর-ঘরে বসেই এ আলাপ হচ্ছিল তা বলা বাহুল্য! শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভর এই আচমকা ডিসিশন-এ সমস্ত ঘর একেবারে নিঃসাড় হয়ে গেছে। আমরা অপেক্ষা করছি রুদ্ধনিঃশ্বাসে।

    একটু আধটু নড়ে চড়ে গেলেও লাইন যা পেতেছিলাম সমস্ত সাজানো ব্যাপারটা তার ওপর ঠিক মতোই গড়িয়ে যথাস্থানে এসে পৌঁছেছে।

    ঘি দিয়ে যা শুরু ঘা দিয়ে তা শেষ। এই হল গৌরের নতুন শক-থেরাপি। এখন এসপার ওসপার একটা কিছু হবেই। ঘনাদার পিছলে পালানো আর চলবে না। কিন্তু শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু মাত্রাটা একটু বাড়িয়ে ফেলেছে কি? সলতে যদি ধরেও থাকে, বেশি হওয়ার ঝাপটায় আবার নিভে না যায়।

    শিবু নিজেই তাই একে সামলাবার ব্যবস্থা করেছে। মাসতুতো ভাইয়ের ওপর যেন একটু রেগে বলেছে, তোর তো ল্যাকেসিস দরকার। মাদার টিংচার তিন ফোঁটা! কাক-কাঁকুড় জ্ঞান নেই তোর! ঘনাদা মাটি চেনেন না তো চিনিস তুই?

    না, ঠিকই বলেছে তোমাদের শম্ভুবাবু। ঘনাদা উদার এবং কিছুটা উদাস ভাবে নিজের অক্ষমতা স্বীকার করেছেন, মাটি আমি সত্যি চিনি না। নেহাত কুদুটার শিং দুটো মাপতে গিয়ে খুরের ঝুরো মাটি একটু চোখে পড়েছিল আর তার আগে প্লেনটা কাদুনা থেকে উঠতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তে কোনও রকমে বেঁচে গিয়েছিল তাই, নইলে টাকা-কে ভুল জমি কিনিয়ে প্রায় তো ডোবাতেই বসেছিলাম।

    আপনি আবার জমি কেনাবেচার কাজও করতেন নাকি? জমির দালাল ছিলেন বুঝি? শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু একটু যেন বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে বাহাত্তর নম্বরের হালচাল না বুঝে। আমরা একটু শঙ্কিত হয়েছি।

    তা একরকম বলতে পারো, ঘনাদা কিন্তু অম্লানবদনে মেনে নিয়েছেন, জমির দালাল না হোক জাতের কুলুজিকার খানিকটা তো বটেই। আমার কথায় কান দিলে হাউসা, ইয়োরুবা, ফুলানি আর ইবো-তে মিলে এমন লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয়, না বিয়াফ্রায় দিনে হাজারটা বাচ্চা না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে!

    বিয়াফ্রা শুনেই আমাদের কান খাড়া হয়ে উঠেছে।

    আবার কিন্তু বেয়াদবি করেছে শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু। এ মাসতুতো ভাইটিকে আমদানি করা কতটা সুবুদ্ধির কাজ হয়েছে সন্দেহ জাগতে শুরু করেছে এবার। গোড়ায় একটু সুবিধে হলেও শেষটা তারই উৎপাতে যজ্ঞ নষ্ট না হয়।

    হাউসা-ইয়োরুবা শুনেই শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু টিপ্পনি কেটে বাহাদুরির চেষ্টা করেছে, ওই কী সব কিষ্কিন্ধের নাম বললেন, ওদের নিয়ে আপনিই লঙ্কা জ্বালিয়ে এসেছেন বুঝি? তাই ওই দুর্ভিক্ষ লেগেছে।

    ভেরেট্রাম অ্যালবাম!

    ঘনাদা সহিষ্ণুতার অবতার হয়ে তাঁর দৃষ্টিটা পাতকীর দিকে একটু ফেরাবার আগেই শিবু তার মাসতুতো ভাইকে প্রায় গর্জন করে থামিয়েছে, হ্যাঁ, নির্ঘাৎ ভেরেট্রাম অ্যালবাম—দুশো। সমস্ত লক্ষণ একেবারে হুবহু মিলে যাচ্ছে কখনও সত্য কথা বলে না। নিজে কী বলছে তা নিজে জানে না। নিজেকে একজন কেওকেটা মনে করে। যা এখুনি গিয়ে মোড়ের হোমিওপ্যাথিক দোকান থেকে কিনে খা। ভেরেট্রাম অ্যালবাম বললে না যদি বোঝে তো হেলেবোরাস অ্যালবাম চাইবি।

    শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু হকচকিয়ে তখনকার মতো একটু চুপ।

    সেই ফাঁকে প্রায় কৃতাঞ্জলি হয়ে জিজ্ঞাসা করেছি, আফ্রিকার নাইজিরিয়ার কথা বলছেন, না ঘনাদা? বিয়াফ্রার সঙ্গে ফেডারেল নাইজিরিয়ার তো মরণপণ লড়াই চলছে। ইস, আপনার কথায় তখন যদি কান দিত! কেন দিলে না বলুন তো?

    পাঁচজনের কুমন্ত্রণা! ঘনাদার গলায় গভীর আফশোস ফুটে উঠেছে, কালাদের অত ভাল হবার কথায় যাদের বুক জ্বলে, তারা নিজেদের ভেতর খাওয়া-খাইয়ি করলেও কালাদের মধ্যে ভাঙন ধরাবার বেলা একজোট। নাইজিরিয়ার বড় বড় জাত বলতে চারটে হাউসা, ইবো, ইয়োরুবা আর ফুলানি। এই চার জাতকে এক করে ফেডারেল মানে সংযুক্ত নাইজিরিয়া। কিন্তু যুক্ত হওয়া মানে তো গলায় দড়ি বেঁধে দেওয়া নয়। বুদ্ধিতে ক্ষমতায় উৎসাহে উদ্যমে সবচেয়ে যারা আগুয়ান, সেই ইবোরা সংযুক্ত হওয়া মানে গলায় সেই ফাঁস লাগানোই দেখেছে! ইববাদের বিরুদ্ধে সারা নাইজিরিয়ায় নিধন যজ্ঞ শুরু হবার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল চুকুয়েমেকা ওদুমেগুয়ু ওজুকুয়ু তাই নিরুপায় হয়ে দুনিয়ার যেখানে যে আছে সমস্ত ইবোকে বিয়াফ্রা-য় ডেকে পাঠিয়ে মরণপণ লড়ছেন। বিয়াফ্রা র এ নেতার নাম শুনে আজেবাজে হেঁজিপেজি ভাবে না যেন কেউ। ওজুকুয়ু উজবুক-টুজবুকের মাসতুতো ভাই নয়।

    শিবু একটু ঢোঁক গিলেছে মাত্র। ঘনাদা কিন্তু কোনও দিকে চাননি। শুধু যেন দম নেবার জন্যই একটু থেমে আবার তিনি শুরু করেছেন, ওজুকুয়ুর কাছে বিলেতের সাহেবরাও ইংরেজি বক্তৃতার দু-একটা কায়দা কানুন শিখতে পারে। প্রথমে ইংল্যান্ডে সারের এপসম স্কুলে, তারপর অক্সফোর্ডের লিংকন কলেজে পড়েছেন। রাগবি খেলেছেন কলেজের হয়ে আর একশো পনেরো ফুট সাড়ে আট ইঞ্চি লোহার চাকতি ছুঁড়ে স্কুলে যে-রেকর্ড রেখেছেন আজও তা কেউ ভাঙতে পারেনি সেখানে।

    এই ওজুকুয়ু যখন নাইজিরিয়ার বন্দর-রাজধানী লাগোস-এর স্কুলে পড়ে, তখন অবশ্য ওই সোনার দেশের এই পরিণামের ভয়ই করেছিলাম।

    বলেছিলাম সে কথা ফ্র্যাঙ্ক কেনিকে। বলেছিলাম, কাজটা ভাল করছ না, কেনি। এই যে জাতের অভিমান আর ধর্মের গোঁড়ামিকে খুঁচিয়ে হাউসা-ফুলানি আর ইবো-ইয়োরুবাদের মধ্যে ঈর্ষা-হিংসা আকছা-আকছির বিষ ছড়াচ্ছে, তাতে তোমাদেরই শুধু পোয়াবারোর দান পড়বে তা ভেবো না। এ-দেশের জমিজায়গা সব গ্রাস করে টিনের খনি চালিয়ে যে বাদশাহির মজা লুটছ, ওদের মধ্যে রক্তারক্তি বাধলে সেসবও লোপাট হয়ে যাবে!

    ফ্র্যাঙ্ক কেনি হেসে আমার পিঠটা তার মুষলের মতো হাত দিয়ে চাপড়ে বলেছে, কী যে বলো, দাস? আমি এদের মধ্যে হিংসের বিষ ছড়াব। তুমি তো দেখেছ, টাকা আমার কী রকম প্রাণের দোস্ত।

    হ্যাঁ, তা দেখেছি, স্বীকার করেও আমার সন্দেহটা জানিয়েছি, তোমার মতো খাস ধলা ইংরেজ বেনিয়া সরল প্রাণে কোনও মতলব না নিয়ে কালা কারুর সঙ্গে দোস্তি করছে, এটা বিশ্বাস করতে মন চায় না।

    তোমার বড় ছোট মন, দাস! ফ্র্যাঙ্ক আমার ঘাড়ে গদার মতো তার ডান হাতখানা চালিয়ে একটা আদরের রন্দা দিয়ে বলেছে, তুমি বাঙালি তো! আমার এক মাসতুতো ভাই সুবনসিরিতে মিশনারি হয়ে গেছে। সে বলে–

    নাইজিরিয়ার টিনের খনির মালিক ফ্র্যাঙ্ক কেনির মিশনারি মাসতুতো ভাই কী বলে তা শোনাতে গিয়ে হঠাৎ থেমে ঘনাদা শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভুর দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, সুবনসিরি কোথায় বুঝেছেন তো?

    শিবুর মাসতুতো ভাই একটু কেমন আমতা আমতা করেছে, হ্যাঁ, সুবনসিরি মনে হচ্ছে যেন…

    সুবনসিরির নামটাই ভুলে গেলেন? ঘনাদা যেন বড় দুঃখ পেয়েছেন, তা সুবনসিরির কথা মনে না থাকুক, ডাফলা আপাতানিদের তো ভাল করেই চেনেন?

    হ্যাঁ…তা..এক রকম। শিশুর মাসতুতো ভাইকে বেশ একটু বিপন্ন মনে হয়েছে।

    ওই এক রকম চিনলেই হল।ঘনাদা যেন ম সন্তুষ্ট হয়েছেন শিবুর মাসতুতো ভাইয়ের জবাবে, ওদের এক রকমের বেশি দুরকম চিনতে যাওয়া সুবিধের নয়। তারপর যা বলছিলাম, ফ্র্যাঙ্ক কেনি তার মাসতুতো ভাই যে মিশনারি হত, সুবনসিরিতে আছে তার মতামতটা আমায় শুনিয়ে দিয়েছিল। সেই মিশনারি ভাই নাকি বলে, বাঙালি, অসমিয়া আর ওড়িয়া এদের সঙ্গে আলাপ করবে প্রতিটি কথা সাতপুরু ছাঁকনিতে হেঁকে!

    নইলে এরা আঁতের আসল কথা বড় চট করে ধরে ফেলে, না?আমি রদ্দা-খাওয়া ঘাড়টায় হাত বুলোতে বুলোতে যথাসাধ্য হেসে বলছি কেনিকে, কিন্তু তোমাদের ওই সূয্যিঠাকুরের ভাদ্দর বউয়ের দেশ থেকে খ্রিস্ট ভজাতে, কলোনি বসাতে বা ব্যবসা করতে যারা বিদেশে যায়, তারা মুখে-এক মনে-আর রাখে না—এমন দুর্নাম তো অতি বড় শত্রুও দেবে না।

    তোমার এই ঠোঁটকাটা রসিকতার জন্য তোমায় এত ভালবাসি, দাস! ফ্রাঙ্ক কেনি বদন বিগড়ে দেবার মতো একটি আদরের থাপ্পড় আমার গালে মেরে তার ভালবাসার পরিচয় দিয়ে বলেছে, তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছ বলে কী খারাপই লাগছে কী বলব?

    খারাপ আমারও লাগছে, আন্তরিক সত্য কথাটা জানিয়েছি কেনিকে, ভালবাসাটা এক তরফাই থেকে গেল, যাচ্ছি এই দুঃখ নিয়ে। কিন্তু কাল আমার না গেলেই নয়।

    কেন বলো তো? কেনি যেন সত্যিকার আগ্রহ দেখিয়েছে, কালই যেতে হবে এমন কী তাড়া?

    তাড়া আমার নিজের জন্য নয় আমি কেনির জানা খবরটাই যেন নতুন করে জানিয়েছি, তাড়া টাকার জন্য। বেনুয়ে নদীর ধারের সব সোনা ফলানো চাষের জমি থেকে শুরু করে এ-গোটা অঞ্চলটাই পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে ওর পাওয়া তো জানো। এখন নতুন আইনে সেগুলোর মাপ চৌহদ্দি আবার লিখিয়ে রেজেস্টারি করিয়ে না নিলে হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। টাকা তো ব্যাপারটা গ্রাহ্যই করেনি। আমিই লাগোস থেকে সেদিন সব জেনে এসে ওকে তাড়া দিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।

    লাগোস থেকে প্লেনটা সেইজন্যই নিয়ে এসে রেখেছ বুঝি!তার মাথায় সবে যেন ব্যাপারটা ঢুকেছে এমন ভাব দেখিয়ে কেনি টাকার জন্যই যেন চিন্তিত হয়ে পড়েছে, জমিজমা তো পাবে। কিন্তু এসব ফুলানিদের এলাকা তা জানো তো?ইবো হয়ে টাকা এখানে কতদিন আর টিকতে পারবে তা-ই ভাবছি।

    তা ফুলানিদের কানে কু-মন্তর দিয়ে ফুসলে যে রকম খেপাবার ব্যবস্থা করছ, আমি যেন কেনির কেরামতিতে মুগ্ধ হয়ে বলেছি, তাতে টাকার মতো ইববাদের সত্যিই হয়তো বেশি দিন এখানে থাকা চলবে না। কিন্তু কালা ইবোরা গেলে তোমার মতো ধলা হিল্লোদেরও পাততাড়ি গুটোতে হবে তা মনে রেখো।

    হিপোপটেমাসের দেশে সেই জানোয়ারের সঙ্গেই বপুর পরিধিতে পাল্লা দেওয়া তার চেহারাটার কথা ইঙ্গিত করলে কেনি ভেতরে ভেতরে একেবারে খেপে যায়। বাইরে কিন্তু একেবারে যেন গলে গিয়েছে আমার বন্ধুত্বের পরিচয়ে!

    যদি বা ভুলে যেতাম, ঠিক সময়ে মনে করিয়ে দেবার জন্যে ধন্যবাদ, বন্ধু! বলে বেড়াল হয়ে ইঁদুরছানার মতো আমার গলাটা তার থাবায় ধরে ঘরের মেঝেতে দুবার আছড়ে ফেলে কেনি তার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

    কৃতজ্ঞতা জানানোটা শরীরের ওপর দিয়েই সে শেষ করেছে ভেবেছিলাম। সেইটেই ভুল।

    ভুলটা টের পেলাম পরের দিন টাকাকে নিয়ে প্লেন ছাড়বার পরই।

    প্লেনটা কেনির টিনের খনির ল্যান্ডিং ফিল্ডেই ছিল। কেনির নিজের একটা ছোট প্লেন আছে। হ্যাঙ্গারও আছে তার। আমারটা সে হ্যাঙ্গারে ধরে না বলেই বাইরে রাখা ছিল।

    প্লেন ছাড়বার সময় কোনও গোলমালই হয়নি। ওই ভোরেই কেনি তার একজন মেকানিক নিয়ে আমাদের বিদায় দিতে এসেছিল। তাকে যে-চোখেই দেখি তার এই বিবেচনাটুকুতে খুশি না হয়ে পারিনি। ভেবেছিলাম, ছাড়বার আগে প্লেনের খুঁটিনাটি কিছু তদারকির জন্য নিজে থেকে মেকানিক নিয়ে এসেছে। প্লেনে ওঠবার আগে টাকার তো বটেই, আমারও হাতটা ধরে নেড়ে কেনি প্রায় ধরা গলায় বললে, আর কবে দেখা হবে কে জানে, দাস! দুনিয়ায় কিছুরই ঠিক নেই। সত্যি তোমার অভাবটা টের পাব।

    পাওয়াই তো উচিত! আমিও গদগদ স্বরে বললাম, হাউসা, ফুলানি, ইবো আর ইয়োরুবানাইজিরিয়ার এই প্রধান চার জাতের মশলা এক সঙ্গে মেশালে জমবার সিমেন্ট, না ফাটবার বারুদ হবে তা-ই বোঝবার তথ্য জোগাড় করতে অন্য দিক সেরে এখানে টাকার খোঁজেই এসেছিলাম। টাকার বাবা ছিলেন অসামান্য কৃতী পুরুষ। বিলেত থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসে এদেশের সেই প্রথম ঘুমভাঙার যুগে ইবো হয়ে ফুলানিদের মাঝখানে তাদেরই নিজের করে নিয়ে নানা রকম উন্নতির ব্যবস্থা করে গেছেন। টাকার কাছে তার বাবার অভিজ্ঞতা ও মতামতটা জানবার জন্যই এখানে এসেছিলাম। এসে তোমার সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব হয়ে গেল যা ভোলবার নয়। তোমার অভাবটা আমাকেও বেশ কষ্ট দেবে।

    আচ্ছা! আচ্ছা! আর দেরি করে লাভ নেই। উঠে পড়ো এবার প্লেনে,কেনি তাড়া দিলে।

    তার এই অধৈর্যটা আগেই একটু লক্ষ করেছি বলে আমার বিদায় ভাষণটা ইচ্ছে। করে একটু লম্বা করেছিলাম। তখন কেনির অধৈর্যে একটু অবাক হয়েছিলাম মাত্র। তার অর্থটা বুঝলাম খানিক বাদেই, আয়েষা যখন যন্ত্রণায় হঠাৎ থরথর করে কেঁপে উঠল।

     

    তারপর ঘনাদার এ বিবরণ আমাদের কাশির এপিডেমিকে কোথায় থেমে ডবল শিককাবারের প্লেট শেষ হবার অপেক্ষায় আছে তা আগেই জানানো হয়েছে।

    ঘনাদার কাবাব সাঁটাবার ধরন দেখে তাঁর মেজাজ সম্বন্ধে কিছুটা আশ্বস্ত হলেও খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত একেবারে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি।

    নিশ্চিন্ত হলাম জোড়া কাবাবের সদগতি করে তাঁর প্লেটের মতো চাঁছাপোঁছা । পরিষ্কার মুখ নিয়ে তিনি যখন শিশিরের দিকে মধ্যমা আর তর্জনী ফাঁক করে হাত বাড়ালেন।

    শিশির তার যথাকৰ্তব্য পালন করবার পর দুটি রামটান দিয়ে খুদে গোছের পারমাণবিক বিস্ফোরণেরই যেন ধোঁয়ার কুণ্ডলি ছাড়তে ছাড়তে আমাদের দিকে কৃপা কটাক্ষ করলেন ঘনাদা।

    আমাদের মানে শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভুর দিকেই দৃষ্টিটা তাঁর বিশেষভাবে নিবদ্ধ। চোখে একটু ঝিলিক নিয়ে তাকেই জিজ্ঞাসা করেছেন, প্লেনটা তখনও আকাশে, না?

    মাসতুতো ভাই শম্ভুর জিভের ডগায় যদি বা কিছু জুতসই জবাব এসে থাকে শিবুর কটমটে চোখের দিকে তাকিয়ে সেটা সে এক ঢোঁকে গিলে ফেলেছে। ভেরেট্রাম অ্যালবামের ধাক্কাই সে তখনও ভাল করে সামলাতে পারেনি।

    ঘনাদার স্মরণশক্তি উসকে দেবার ভলান্টিয়ারের অবশ্য অভাব হয়নি।

    তিন দিক থেকে তিনজন আমরা এগিয়ে এসেছি: আয়েষা তখন যন্ত্রণায় থরথর করে কাঁপছে, ঘনাদা!

    কোথায় কী যেন ফেটেছে!

    আপনি তখন ককপিটে বসে প্লেন চালাচ্ছেন।

    চালাবার আর তখন কিছু নেই, ঘনাদা যেন সেদিনের কথা স্মরণ করে একটু শিউরে উঠলেন, চোখটা তখন আপনা থেকে চলে গেছে অলটিমিটারে। মাত্র সাতশো ফুট উঠেছি, কিন্তু সাতশো ফুটে কী হবে? সামনের যে পাহাড়টা ঝড়ের মতো ছুটে আসছে সেটা নেহাত ছোট হলেও অন্তত হাজার তিনেক ফুট! সাতশো থেকে হাজার তিনেক পর্যন্ত উঠব কী করে এই জখম প্লেন নিয়ে?

    কথাটা ভাবতে ভাৰতেই সামনের যন্ত্রের প্যানেলে একটা লাল বাতি দপ দপ করতে লাগল। সেই সঙ্গে আগুন লাগার হুশিয়ারি ঘণ্টা। ডানদিকের ইঞ্জিনে আগুন ধরে গেছে। প্লেন আকাশে আর তোলা তো দূরের কথা, সোজা রাখাই দায়। যে-কোনও মুহূর্তে পাক খেতে খেতে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে নীচের পাহাড়ে জঙ্গলের ওপর।

    টাকা সত্যিকার ইবো-ই বটে। এত বড় বিপদ থেকে বাঁচবার কোনও আশা আর নেই জেনেও এতটুকু অস্থির হয়নি। চোয়াল দুটো শুধু একটু শক্ত হয়েছে তার। সেই কঠিন মুখ নিয়েই জিজ্ঞেস করলে, দু নম্বর ইঞ্জিনে আগুন লাগল কী করে? কাল রাত্রেও তো আপনি আমি সব চেক করে গেছি।

    আবার করা উচিত ছিল আজ সকালে, নিজেকেই ধিক্কার দিয়ে কোনওমতে প্লেনটা বাঁদিকে ঘুরিয়ে টাকাকে সাবধান করেছি, কোথায় আছড়ে পড়ব জানি না। সামনে ঝুঁকে পড়ে মাথা নিচু করে দুহাতে নিজের গোড়ালি দুটো শক্ত করে ধরে থাকো। কিছুতেই মাথা তুলো না।

    পাহাড়টাকে এড়ানো গেছে, কিন্তু সামনে তো জঙ্গলের আর শেষ নেই। সেখানে ক্র্যাশল্যান্ড যাকে বলে সেই ঘাড়মুড় গুজেই বা পড়বার চেষ্টা করব কোথায়? এদিকে প্লেনের একটা ইঞ্জিন জ্বলতে জ্বলতে তো পড়েই গেছে খসে খসে। প্লেনটারও পড়তে আর দেরি নেই।

    তা-ই পড়ল। শুধু অনেক কসরত করে আর ভাগ্যের জোরে ঘন একটা জঙ্গলের মাথায় প্লেনটাকে নামাতে পেরে পড়ার মারাত্মক ধাক্কাটা বাঁচাতে পারলাম।

    জঙ্গলের মাথায় ডালপালায় লতাপাতায় জড়িয়ে প্লেনটা ভেঙেচুরে বেঁকে দুমড়ে থামল। নেহাত কেনির সঙ্গে আমার দেখা বরাতে আছে বলে প্রায় অক্ষত শরীরেই তা থেকে মাটিতে নামতে পারলাম।

    আমি একা হলে সাতদিনেও সে-জঙ্গলের হদিস জেনে তা থেকে বার হতে পারতাম না। টাকা কিন্তু মাটিতে নেমে দুটো গাছ আর ঝোপ একটু লক্ষ করে দেখেই যেন কলকাতার রাস্তা দেখে পাড়া চেনার মতো বললে, এ তো কেনির টিনের খনির কাছেই এসে নেমেছি। দিন চারেক হাঁটলেই পৌছে যাব তার ডেরায়।

    টাকা দিন চারেক হাঁটার কথাটা এমনভাবে বলল যেন সেটা নেহাত মর্নিং ওয়াক।

    এত দুঃখেও হেসে বললাম, সামান্য দিন চারেক না হয় হাঁটব, কিন্তু তাতে লাগোস-এ পৌছতে তো পারব না। দুদিন বাদে নতুন আইনে তোমার জমিজমা যে বেহাত হয়ে যাবে।

    টাকা যা জবাব দিলে তাতে তার ওপর ভক্তি-ভালবাসা আরও বাড়ল। হেসে সে বললে, হলে আর করছি কী! প্রাণটাই বেহাত হতে যাচ্ছিল যে!

    এরপর আর বলবার কিছু থাকে না।

    অন্তত চারদিনের হাঁটা পথ, আর জঙ্গলও বড় সোজা নয়। হাতি গণ্ডার সিংহ চিতা জিরাফ সারা আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ংকর বুনো মোষ—হরিণ শম্বর—কী সে জঙ্গলে নেই। ডাঙায় ওই আর জলে হিপোপটেমাস, কুমির। এছাড়া নানা জাতের বাঁদর সাপখোপ তো আছেই। কী ভাগ্যি প্লেনের ভেতর বন্দুকগুলো ছিল। টাকা জঙ্গলের মাথায় আবার উঠে সেগুলো পেড়ে নিয়ে এল।

    তাই নিয়েই রওনা হলাম। টাকা বলেছিল চারদিনের রাস্তা। হিসেবটা আমাদের পাড়াগাঁয়ের ক্রোশের মতো বোধহয়! যতক্ষণ হয়রানিতে জিভ না বেরিয়ে পড়ে ততক্ষণ ক্রোশ আর শেষ হয় না।

    টাকার চারদিনের রাস্তা পার হতে আমার চার হপ্তা লেগে যেত, যদিনা অভাবিত একটা ব্যাপার যেত ঘটে।

    সকালবেলা উঠেই পাখিটাখি বা খরগোশ-টরগোশ পেলে মেরে তাই বনের কাঠকুটরো জ্বেলে ঝলসে নিয়ে খাওয়া সেরে আমরা রওনা দিই। দুপুরবেলা যেদিন যেমন জোটে তেমনই একটু ছায়া খুঁজে নিয়ে খানিক বিশ্রাম করি। তারপর আবার হাঁটা শুরু করি রোদের তেজ একটু কমলে। অন্ধকার নামবার আগেই থেমে পড়ে আবার সামান্য কিছু বনের ফল-পাকুড় আর ঝলসানো মাংস খেয়ে রাত্রের ডেরা বাঁধি মজবুত কোনও গাছের মাথায়!

    ভাগ্যক্রমে দিন দুয়েকের মধ্যে বড় কোনও বেয়াড়া জানোয়ারের সঙ্গে মোলাকাত হয়নি।

    টাকার কোনও পরোয়াই নেই। কিন্তু হকের সম্পত্তি থেকে তার ফাঁকি পড়া নিয়ে আমার ভেতরের জ্বালাটা আর যেতে চায় না। প্লেনে কেন আগুন লেগেছিল বুঝতে আমার বাকি নেই। আমাদের মারতেই কেনি চেয়েছিল। কিন্তু প্রাণে মরি না মরি তার যা মতলব তা হাসিল হয়ে গেছে। টাকা সময়মতো গিয়ে না পৌঁছোবার দরুন তার বাজেয়াপ্ত দাবি নিজের প্লেনে লাগোস গিয়ে কেনি নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছে। নিশ্চয়ই।

    বনের পথ ভেঙে চলি বটে, কিন্তু কেনির শয়তানিটা মনে হলেই মেজাজ একেবারে গরম হয়ে ওঠে। এমন সময় তিনদিনের দিন সকালে ভাগ্যই যেন আমার বন্দুকের গুলিতে এক কুদুর ভবযন্ত্রণা শেষ করালে। কুদু হচ্ছে আফ্রিকার একটা অমূল্য শিকার। পাঁচটা সিংহ সাতটা হাতি কি গণ্ডার মেরে যা না হয় তার চেয়ে বেশি গর্ব হয় শিকারির একটা নিখুঁত ছন্দে মেলানো জোড়া শিং-এর কুদু মেরে। কুদু তো হরিণ নয়, জঙ্গলের এক দৈবী মায়া। এই আছে এই নেই, কখন কী মূর্তি ধরে দেখা দেবে কেউ যেন জানে না।

    সময় আর অবস্থা অন্য রকম হলে এই কুদু মারা নিয়ে একটা উৎসব পড়ে যেত। আপাতত কোনও রকমে শুধু হিসেবেই খুশি থাকবার জন্য তার শিং জোড়া মাপতে গিয়ে হঠাৎ কুদুটার পায়ের খুরের দিকে নজর গেল। খুরের ফাঁকে যে ঝরো মাটি

    লেগে আছে সেটা যেন কী রকম!

    শিং মাপা ভুলে গিয়ে খুরের সেই মাটি কুরে কুরে নিয়ে পকেটের ভেতরে রাখলাম।

    কী করছেন, কী? টাকা অবাক, পকেটে মাটি রাখছেন কেন?

    কেন রাখছি? ধর্মের কল হয়তো বাতাসে নড়েছে এই মাটিই তার ইশারা বলে।

    হেঁয়ালিটা বুঝুক না বুঝুক, টাকা তা নিয়ে প্রশ্ন আর কিছু করল না।

    বাতাসে ধর্মের কল নড়ার আরও একটা প্রমাণ অত তাড়াতাড়ি তারপর পাব ভাবতে পারিনি।

    তখনও আমার হিসেবে অন্তত দিন চারেকের হাঁটা পথ বাকি। যন্ত্রের মতো পা চালাচ্ছি। হঠাৎ একটা আওয়াজ শুনে চমকে উঠলাম।

    টার্কার কান আমার চেয়েও সাফ। উত্তেজিত হয়ে বললে, এ তো জিপের আওয়াজ শুনছি। জিপ নিয়ে এখানে কেনি ছাড়া আর কে আসতে পারে?

    টার্কার অনুমান নির্ভুল প্রমাণ করে মিনিট খানেকের মধ্যেই জিপটা ডাইনের একটা বড় গাছপালার জঙ্গল ঘুরে আমাদের কাছে এসে থামল।

    জিপের হুইল ধরে আছে কেনি নিজে। পেছনে তার শিকারের লটবহর নিয়ে একজন এদেশি অনুচরর

    আমাদের দেখে কেনি যেমন আহ্লাদে আটখানা তেমনই যেন একেবারে তাজ্জব! আরে, তোমাদের এখানে দেখব ভাবতেই পারিনি। এ-জঙ্গলে কী করছ? লাগোসে যাবার নাম করে তাহলে শিকার করতেই নেমেছ এখানে? তা প্লেনটা কোথায়?

    প্লেনটা হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে এসেছি। বেশ দন্ত বিকশিত করেই বললাম তোমার কাছে কথাটা লুকিয়েছিলাম, কিন্তু ভাগ্যের এমন দয়া যে তোমার সঙ্গে শিকারের সাধটাও আশ্চর্যভাবে মিটিয়ে দিলে!

    ঠিক! ঠিক! আমিও তো তা-ই ভাবছি! কেনি একেবারে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, ভাগ্যই, নইলে হঠাৎ তোমাদের দেখাই পাইয়ে দেবে কেন? এসো, জিপে উঠে এসো। তোমার শিকারের শখটা মিটিয়ে দিই।

    বন্দুক নিয়ে জিপে উঠে বসলাম। আমি সামনে কেনির ডাইনে, আর টাকা পেছনের সিটে।

    আমরা ওঠবার পরই জিপ চালিয়ে দিয়ে কেনি বললে, বড় ভাল সময়ে তোমায় পেয়ে গেছি, দাস। জানো নিশ্চয়ই যে, পশ্চিম আফ্রিকার বুনো মোষের চেয়ে দুর্দান্ত জানোয়ার পৃথিবীতে নেই। এ বুনো মোষ যদি একবার খেপে তাহলে সিংহ হাতি গণ্ডার তার তুলনায় যেন পোষা জানোয়ার। এ অঞ্চলের সেই বিখ্যাত বুনো মোষের এক পালেরই সন্ধান পেয়েছি আজ সকালে। সেখানেই তোমায় নিয়ে যাচ্ছি।

    সত্যিই তোমার বন্ধুপ্রীতির তুলনা নেই।আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, কিন্তু তুমি হঠাৎ এ-সময়ে শিকারে বেরিয়েছ যে! লাগোসে তোমার একবার যাওয়ার কথা ছিল না?

    কেনি তার জালার মতো মুখের ভাঁটার মতো লালচে চোখের দৃষ্টি যেন বল্লমের মতো একবার আমার দিকে ছুঁড়ে রসিয়ে রসিয়ে এবার বললে, ঠিক ধরেছ, দাস। তা লাগোসের কাজটা না সেরে কি এখানে এসেছি মনে করো? তোমরা যাবার পরই আমার প্লেনটা নিয়ে লাগোসে গেলাম। সেখানে কাজটা নিঝঞ্ঝাটে হয়ে গেল বলেই ফিরে এসে একটু ফুর্তি করতে শিকারে বেরিয়ে পড়লাম।

    আমাদের প্লেনটার পাত্তা নেওয়ারও সেই সঙ্গে মতলব ছিল নিশ্চয়ই!আমি তার কেজো বুদ্ধির যেন তারিফ করে বললাম, প্লেনের খোঁজ আর শিকার—একসঙ্গে রথ দেখা আর কলা বেচা দুই-ই যাতে হয়ে যায়।

    কী সাফ তোমার মাথা, দাস! কেনি প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বললে, আমার দেশের কাসল-এর হলঘরে হরিণ গণ্ডার বুনো মোষের মাথার সঙ্গে বাঁধিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে!

    এমন সম্মানের জন্য মাথাটা নিজেই তোমায় উইল করে যেতাম কেনি, আমি একটু যেন আফশোসের সঙ্গে বললাম, কিন্তু দেশে তোমার কাসলটা যেন ডার্টমুরে বলে শুনেছি।

    ডার্টমুর? খোঁচাটা চট করে ধরতে না পেরে কেনি একটু কুঁচকে বলল, ডার্টমুরে কেন হবে? আমাদের কাসল হল—এই কী বলে কেস্টে।

    বাঃ! জেনে খুশি হলাম। আমি যেন মুগ্ধ হয়ে বললাম, ওদিকে কেন্টে না ঘেষ্টে তোমার কাল, আবার এখানে এই। বেনুয়ে নদীর ধারের সমস্ত সেরা চাষের জমিই তো এখন তোমার। টাকার সব জমিই তো নিজের নামে বন্দোবস্ত করে নিয়েছ?

    তা না নিলে কি চুল ছাঁটতে লাগোসে গেছলাম? এবার ফ্র্যাঙ্ক কেনির শয়তানি হাসি আর থামতে চায় না খানিকক্ষণ।

    ততক্ষণে নিদিকে বিরাট জঙ্গলে ঘেরা একটা বন্ধুর পাথুরে ডাঙার ওপর আমরা এসে পড়েছি।

    পাকা হাতে এবড়ো-খেবড়ো জমির ওপর দিয়ে জিপ চালিয়ে জঙ্গলের এক ধারে এসে সে ইঞ্জিন বন্ধ করে হাসতে হাসতেই বললে, টাকার কী জমি নিজের নামে বন্দোবস্ত করেছি শোন তাহলে। ভাল চাষের জমি যেখানে যত ওর ছিল সব।

    আর ওই মেটে পাথরের ডাঙা জমিগুলো? ভেতরের ধুকধুকনি মুখে ফুটতে না দিয়ে নেহাত নির্বিকার গলায় জিজ্ঞাসা করলাম, সেগুলোও লিখিয়ে নিয়েছ?

    সেগুলো লিখিয়ে নেব আমি কি এমন আহাম্মক! কেনি আবার পৈশাচিক হাসি হাসল, আসল শাঁসটা নিয়ে খোসাটা ফেলে রেখেছি তোর মতো উজবুক যার গুরু সেই ইবো ভূতটার জন্য।

    কী ধন্যবাদ যে তোমায় দেব ভেবে পাচ্ছি না, কেনি। এতক্ষণে আমি উচ্ছ্বসিত হয়ে পকেট থেকে সেই মাটির গুঁড়ো খানিকটা বার করে হাতের চেটোয় রেখে বললাম, এটা কী বোধহয় চেনো?

    কী ওটা? কেনি সন্দিগ্ধভাবে চাইল, খানিকটা গুড়ো মাটি তো?

    হ্যাঁ, গুড়ো মাটি!আমি স্বীকার করলাম, তবে একটু ভাল করে লক্ষ করে দেখো, সাধারণ মাটি নয়, শেল যাকে বলে সেই মেটে পাথরের গুড়ো।

    তুই আর আমায় শেল চেনাসনি, সুটকো মর্কট। কেনি এবার জিভ থেকে ভদ্রতার শেষ রাশটুকু খুলে নিয়ে হিংস্র উল্লাসের সঙ্গে বলল, চাষের জমি যা বাগিয়ে নিয়েছি তার পাড় দিয়ে মাইলের পর মাইল তো এই শেল-এর বাঁজা ডাঙা পড়ে আছে এখানে। দুনিয়ার কোনও কাজে লাগে না। না লাগে চাষবাসে, না করা যায় অন্য কিছু, তাই দিয়েছি সব ওই টাকাকে ছেড়ে।

    হ্যাঁ, দিয়েছ! নিজের মুগুর মেরেছ নিজের কপালে। আমি এবার বিধিয়ে বিধিয়ে বললাম, একটা জলা জমির লোভে কুবেরের রাজত্ব হেলায় পায়ে ঠেলেছ।

    কী আছে তোর ওই শেল-এর বাঁজা ডাঙায়? বিদ্রুপ করলেও একটু সন্দেহ ফুটে উঠল কেনির গলায়, সোনা রুপো হিরে মানিক?

    যা আছে, গম্ভীর হয়ে বললাম, তা সোনাদানা হিরে মানিকের খনির চেয়ে অনেক দামি। আছে কেরোজেন।

    কেরোজেন!আমি যেন তাকে ঠারে গাল পাড়ছি এমন ভাবে কেনি আমার দিকে চাইল।

    বললাম, হ্যাঁ, কেরোজেন। আজ তোমার মতো মুখখুরা তো নয়ই, এ ব্যাপারে যারা ব্যাপারি তারা নাম জানলেও এ-জিনিসের কদর বোঝে না। কিন্তু একদিন—খুব বেশি কাল পরেও নয় সারা দুনিয়ায় কাড়াকাড়ি পড়ে যাবে এই মেটে পাথর শেলের বাঁজা ডাঙার জন্য। পৃথিবীর পেট্রল ফুরিয়ে আসতে খুব দেরি নেই। দেরি যদি একটু থাকে তাহলেও দুনিয়ার মোট পেট্রলের পুঁজি এক রকম জানা। পৃথিবীতে এখন তিন লক্ষ কোটি ব্যারেলের বেশি পেট্রল নেই বলে ধরা যেতে পারে। সেই জায়গায় ভাসাভাসা জরিপে এই মেটে পাথরের-শেল-র—যা সন্ধান পাওয়া গেছে, তা থেকে সমস্ত পৃথিবীর পেট্রলের পুঁজির তিন গুণেরও বেশি তেল পাওয়া যেতে পারে। শেল পাথরের রবারের ধরনের আঁট কেরোজেন শুধু সাড়ে আটশো থেকে নশো ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপে গলিয়ে তার গন্ধক আর নাইট্রোজেনের গাদ শোধন করবার ব্যবস্থা করা দরকার। তার কায়দা বার করা কিছু শক্ত নয়। এসব জটিল ব্যাপার তোমার ও নিরেট মাথায় ঢুকবে না, কেনি! শুধু এইটুকু জেনে রাখো যে, নাইজিরিয়ায় দুদিন বাদে যদি জাতে জাতে হানাহানির লঙ্কাকাণ্ড শুরু হয় তাহলে তোমার ওই ফাঁকি দিয়ে বাগানো দাবির ছেড়া কাগজের বেশি দাম থাকবে না। কিন্তু অমন বিশ-ত্রিশ বছর বাদেও নাইজিরিয়া ঠাণ্ডা হলে টাকার একেবারে নিজস্ব হোক, এদেশের মানুষের জন্য এসম্পদ মজুত থাকবে।

    থাক, খুব হয়েছে। কেনি আবার গর্জন করে উঠল, এ-মেটে পাথরের ডাঙা তোর যখন এত পছন্দ তখন এখানেই তোর হাড়গুলো যাতে শুকোয় তার ব্যবস্থা করছি। বুনো মোষ শিকারের কথা তোকে দিয়েছিলাম। সেই শিকারের সুযোগই এবার পাবি। আজ সকালে একটা বুনো মোষকে মারতে গিয়ে হাত ফসকে গেছে। মোষটা আধা জখম হয়ে স্বয়ং যমের দূত হয়ে এখানেই আছে কোথাও লুকিয়ে। অনেকদিন সাধ ছিল খ্যাপা বুনো মোষের সঙ্গে একটা মর্কটের লড়াই দেখব। আজ সেই সুবিধেই হয়েছে। নে, নাম।

    কেনি আমায় প্রচণ্ড একটা ঠেলা দিলে।

    জিপ থেকে পাথুরে জমির ওপরেই পড়লাম। পড়েছি ডান হাতে বন্দুকটা ঠিকমতো সামলেই।

    কেনি তখন মাটির ওপর থুবড়ে পড়া মুখটা সবে একটু হতভম্ব হয়ে তুলছে।

    তার কাছে যেন মাপ চেয়ে বলেছি, কিছু মনে করো না, কেনি, তোমার মতো আমারও বহুদিনের একটা সাধ ছিল, সাদা একটা হিপ্পোর সঙ্গে বুনো মোষের লড়াই দেখব। তুমি সেই সাধটা আজ মেটালে।

    টার্কা জিপ থেকে তখন নামতে যাচ্ছে। তাকে বারণ করে বললাম, না টাকা, নেমো না। এটা আমাদের নিজের নিজের মান রাখবার বাজি। কেনির বন্দুকটা বাইরে ফেলে দিয়ে তুমি জিপটা নিয়ে বনের ওই কিনারে গিয়ে অপেক্ষা করো। জঙ্গলের এধারে ওই ঝোপটার নড়া দেখে বুঝছি, আমাদের খেল শুরু হতে আর দেরি নেই। যাও তুমি।

    থ্যাবড়ানো মুখ নিয়ে কেনি এবার প্রায় আঁতকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল।

    না, না, জিপ নিয়ে যেয়ো না। তার প্রায় আর্ত চিৎকার শোনা গেল সঙ্গে সঙ্গে, ও খ্যাপা মোষের কাছে তাহলে আজ আর রক্ষা নেই!

    টাকা তখন আমার নির্দেশ মতো কেনির বন্দুকটা ফেলে দিয়ে জিপ চালিয়ে দিয়েছে।

    কেনি পাগলের মতো তার পেছনে ছুটে যাবার চেষ্টা করছিল। তাকে এক হাতে টেনে ধরে ঘাড়ে একটা আদরের রন্দা দিয়ে বললাম, তোমার সাহস দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি, কেনি।

    কেনি মাটির ওপর তখন বসে পড়েছে উবু হয়ে। ঘাড়টা পেছন থেকে ধরে তাকে টেনে তুলে গালে একটা থাপ্পড় দিয়ে প্রশংসা জানিয়ে বললাম, আর কী তোমার দয়ার শরীর! নিজে জিপে উঠে পালিয়ে শুধু আমাকে জখম খ্যাপা মোষের মওড়া নেবার সুযোগ দিতে চাও। কিন্তু আর তোমায় সুযোগ দিতে হবে না। ফিরে দেখো, আমাদের নিয়তি নিজেই ছুটে আসছে।

    কেনি আঁতকে ফিরে তাকাল। সাক্ষাৎ যমরাজের বাহনের মতো ঝোপের আড়াল থেকে ফ্রন্টিয়ার মেল ট্রেনের ইঞ্জিনের মতো ছুটে বেরিয়ে মোযটা তখন স্বয়ং শয়তানের হাতে আঁকা সেকেন্ড ব্র্যাকেটের মতো শিং সাজানো মাথাটা একটু নুইয়ে হঠাৎ একটু থমকে থেমেছে মাত্র হাত কয়েক দূরে।

    একবার সেদিকে চেয়েই তার নিজের ইষ্টনাম হেঁকে কেনি পেছনে ফিরে দে ছুট!

    ছুটো না। ছুটো না, কেনি! ছুটলেই সর্বনাশ! তার পেছনে চিৎকার করলাম। কিন্তু কে কার কথা শোনে!

    খ্যাপা মোযটা মাথা নুইয়ে আই-সি-বি-এম-এর মতো তখন তাকে তাড়া করেছে।

    ঘনাদা থামলেন। তারপর? তারপর? শিবুর মাসতুতো ভাইয়ের ব্যাকুল গলাই শুধু শোনা গেল, কী হল ওই ফ্র্যাঙ্ক কেনির?

    কী হল, তা আবার বলতে হবে? শিশির সিগারেটের টিনটা ঘনাদার সামনে খুলে ধরে প্রায় ঘনাদার মতোই বাঁকা হাসি হাসবার চেষ্টা করলে।

    না, না, মাথাটা তেমন সবল নয়। ওকে বুঝিয়ে বলাই দরকার। ঘনাদাই করুণা করলেন, মোষের শিংজোড়া টাকাকেই দিয়ে এসেছি।

    তার মানে আপনি কেনিকে বাঁচাতে ওই খ্যাপা মোষকে মারলেন? বিস্ফারিত চোখে জিজ্ঞাসা করলে শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু।

    মারব কেন? ঘনাদা যেন অবাক হয়ে বললেন, খ্যাপা মোষটা তার শিংজোড়া পায়ের কাছে খুলে রেখে প্রণামী দিয়ে গেল। আপনাদের নেফার ডেয়ারির ওই গয়াল-গাউররা তা দেয় না?

    যাঃ, কী যে বলেন! শিবুর মাসতুতো ভাই শম্ভু এবার লজ্জিত।

    ভুল বললাম বুঝি! ঘনাদাও লজ্জিত হলেন, হ্যাঁ, ভুলের কথায় মনে পড়ল, আপনাদের নেফার ডেয়ারির গাউর-গয়ালরাও এখন বনস্পতি মেশানো দুধ দিচ্ছে দেখছি। এই যে রসিদটা দেখুন না!

    ঘনাদা কখন ঘি-এর ভাঁড়ের কাগজের মোড়কটা খুলেছেন, কেউ দেখিনি। হাতে নিয়ে দেখি, সত্যিই মোড়কের সঙ্গে বনস্পতি কেনার রসিদটা থেকে গেছল।

    কৈফিয়ত কিছু খুঁজে পাবার আগেই ঘনাদা আবার মাসতুতো ভাইকে বললেন, আমি বলি কি, নেফায় ডেয়ারি করেও সুরুসিরি কি ডাফলা আপাতানিদের নাম যখন ভুলে যান তখন আপনি নিজেই কিছু ব্রাহ্মীশাক দিয়ে ফুটিয়ে এই ঘি-টা খান গিয়ে। স্মরণশক্তি বাড়তে পারে।

    না, না, ওসব ব্রাহ্মীঘৃত-টৃত নয়, শিবু সোৎসাহে বলে উঠল, এর ওষুধ আর্জেন্টাম নাইট্রিকাম।

    হাসলাম, কিন্তু শিবুর সাজা মাসতুতো ভাইয়ের জন্য একটু দুঃখও হল। বেচারা আমাদের মদত দিতে এসে গৌরের শক থেরাপির মানে চমক চিকিৎসার শকটা নিজেই খেয়ে গেল। কিন্তু পার্টের মর্ম না বুঝে খোদার ওপর খোদকারি করে স্ক্রিপ্টের বাইরে ডায়লগ সে নিজের মুখে বসাতে যায়ই বা কেন?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }