Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    কাঁচ

    ঘনাদা কোথায়?

    কোথায় গেলেন ঘনাদা!!

    সবাই মিলে সারাদিন যাঁকে চোখে চোখে পাহারায় রাখা হয়েছে, এই ভর সন্ধের সময় সকলকে ফাঁকি দিয়ে তিনি কোথায় পালালেন—এবং কেমন করে!!!

    নীচে ওপরে ছাদে পর্যন্ত আমরা সবাই ঘুরে এলাম। কোথাও ঘনাদার চিহ্ন নেই।

    সত্যিই কি ঘনাদা তাঁর গল্পের বাহাদুরির খেল আমাদের প্রত্যক্ষ দেখিয়ে দিলেন?

    তেতলার ছাদ থেকে লাফিয়েই পড়লেন আমাদের এড়াতে?

    আমাদের এড়াতে চাইবার কারণ একটা অবশ্য ছিল, কিন্তু সত্যি, সেটা ঘনাদার কাছে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে বাধ্য করবার মতো গুরুতর হতে পারে তা আমরা ভাবিনি।

    আমরা শুধু একটা মজাই করতে চেয়েছিলাম ঘনাদাকে নিয়ে।

    ফন্দিটা শিবুর। ঘনাদা সেদিন তাঁর মৌরসিপাট্টা করা আরামকেদারায় বসে শিশিরের সিগারেটের টিনের সদ্ব্যবহার করতে করতে আমাদের দু-চারটে খোশগল্প শোনাচ্ছেন, এমন সময় শিবু যেন অত্যন্ত ব্যস্তভাবে ঘরে ঢুকে বললে, এই যে, ঘনাদা! আপনাকেই খুঁজছিলাম।

    শিবুর কথার ধরনে আমরা একটু অবাক হয়েই তার দিকে তাকালাম। ঘনাদাই নিজের দরকারে যথাসময়ে আমাদের খুঁজে বার করেন, এক গল্প শোনা ছাড়া তাঁকে গরজ করে খোঁজবার কারণ আর কিছু তো কখনও দেখা যায়নি!

    ঘনাদার পাশেই একটা মোড়া টেনে নিয়ে বসে শিবু বেশ ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞাসা করলে, কাল বিকেলে আপনার তেমন জরুরি কোনও কাজ আছে নাকি!

    আমরা এবার অতিকষ্টে হাসি চাপলাম। ঘনাদার কাজ! এত বড় আজগুবি কথা কখনও আমরা শুনিনি।

    ঘনাদা শিবুর প্রশ্নে বোধহয় আমাদের মতোই হতভম্ব হয়েছিলেন, কিন্তু দস্তুর মতো গম্ভীরভাবে বললেন, কাল বিকেলে? দাঁড়াও…কমিশনারের সঙ্গে একবার…প্রিমিয়ারকে একটা ফোন..

    মনে মনে সশব্দে ঘনাদা যা আওড়ালেন তাতে বোঝা গেল, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে চার্চিল সাহেবকে একদিনে এতগুলো দায় একসঙ্গে সামলাতে হয়নি।

    কিন্তু শেষ পর্যন্ত শিবুর ওপর সদয় হয়ে বললেন, তা খানিকক্ষণ সময় হতেও পারে, কিন্তু কেন বলো তো?

    না, এমন কিছু না। আমাদের Athletic Club-এ কাল একটা ব্যাপার আছে কিনা, তাতে আপনাকে একটু থাকতে হবে।

    ঘনাদার মুখ তাঁর পক্ষে যতখানি সম্ভব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শিবুদের ক্লাবে এর আগে একবার তাঁর যাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেখানে শরীরচর্চা যতটা না হোক, এ সমস্ত অনুষ্ঠানে ভোজটা বেশ জমকালো রকমেরই হয়। ঘনাদা উৎসাহটা যতদূর সম্ভব লুকোবার চেষ্টা করে বললেন, তা বলছ যখন এত করে, তা না হয় যাব-খন। কিন্তু কী ব্যাপারটা বল তো?

    একটা বকসিং কন্টেস্ট—মুষ্টিযুদ্ধের প্রতিযোগিতা—আপনাকে সালিশি অর্থাৎ রেফারির কাজ করতে হবে।

    মুষ্টিযুদ্ধ শুনে ঘনাদার মুখে যেটুকু ছায়া নেমে এসেছিল, রেফারিগিরি শুনেই সেটুকু কেটে গেল। বললেন, রেফারি হতে হবে। বেশ বেশ! তা ভাল রেফারি বুঝি আর কাউকে পেলে না!

    পাব না কেন? শিবু গম্ভীরভাবে বললে, কিন্তু এবারে একটু ফ্যাসাদ আছে। কিনা! জানাশোনা রেফারিরা কেউ রাজি হচ্ছে না!

    কেন বলো তো? ঘনাদার জ একটু কুঞ্চিত মনে হল।

    ব্ল্যাক টাইগারের নাম শুনেছেন কিনা জানি না, মিশকালো নিগ্রো বক্‌সার—আর একেবারে বাঘের মতোই হিংস্র। মাসখানেক হল কলকাতায় এসেছে। তার সঙ্গে আমাদের ওয়েলটার ওয়েট চ্যাম্পিয়ন সুরজিৎ দাসের লড়াই কিনা! তাতে রেফারির ভয়টা কীসের?আমরাই জিজ্ঞাসা করলাম।

    ব্ল্যাক টাইগারের পরিচয় তা হলে জানো না মনে হচ্ছে, শিবু আমাদের দিকে একটু অনুকম্পাভরেই তাকাল, এ পর্যন্ত পাঁচজন রেফারিকে সে হাসপাতালে পাঠিয়েছে, একজন তো আর ফেরেইনি। একটু মেজাজ বিগড়োলে কে রেফারি আর কে তার প্রতিদ্বন্দ্বী তার হুশই থাকে না।

    শিবু ঘনাদাকে লুকিয়ে আমাদের দিকে যৎসামান্য একটু চোখ টিপতেই ব্যাপারটা

    আমাদের আর বুঝতে বাকি রইল না।

    শিশির ন্যাকা সেজে জিজ্ঞাসা করলে, তা এ রকম খুনেদের আসরে ঘনাদাকে রেফারি করা কেন বাপু!

    বাঃ, ঘনাদার মতো রেফারিই তো দরকার। রেফারিকে রেফারিগিরিও করবে, আবার কালা বাঘ কিছু বেয়াড়াপনা করলে একটি আপারকাট-এ তাকে শায়েস্তাও করতে পারবে! বলুন না ঘনাদা, সেই ব্যাটলিং মিকিকে আপনি শুধু স্ট্রেট লেফটে কী রকম নাজেহাল করেছিলেন?

    অন্যদিন হলে ঘনাদাকে আর দুবার বলতে হত না, কিন্তু সেদিন মেজাজটা তাঁর কেমন বিগড়ে গেছে বলে মনে হল। বিরসভাবে একটু হেসে তিনি হঠাৎ উঠে পড়লেন।

    গৌর অবাক হবার ভান করে জিজ্ঞাসা করলে, ও কী, উঠলেন কেন? কাল রেফারি হবেন তো?

    ঘনাদা কিছু বলবার আগেই শিবু বলে উঠল, আরে ওকথা আবার জিজ্ঞাসা করতে হয়। এমন একটা সুবিধে ঘনাদা ছাড়েন কখনও। কাল তা হলে সন্ধে ছটায় ঠিক রইল।

    ঘনাদা কী একটা যেন বলতে গিয়ে না বলে বেরিয়ে গেলেন।

    ওপরের সিঁড়িতে তাঁর পায়ের শব্দ মিলিয়ে যাবার পর আমাদের ঘর হাসির রোলে ফেটে যাবার উপক্রম।

    তারপর আজ সেই সন্ধে থেকে ঘনাদাকে খুঁজছি!

    হঠাৎ অদৃশ্য না হলে ঘনাদা যে আমাদের সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে পারেন না এ বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ। কিন্তু তা হলে তিনি গেলেন কোথায়!

    শিবুর সব কিছুতেই বাড়াবাড়ি। ঘর দোর ছাদ থেকে বাথরুম পর্যন্ত সব তন্ন তন্ন করে খুঁজে হতাশ হয়ে সে হঠাৎ বললে, আচ্ছা, খাটের তলাটা তো দেখা হয়নি।

    আমরা হেসে উঠে আপত্তি জানালাম। আর যেখানে হোক খাটের তলায় গিয়ে ঘনাদা লুকিয়ে থাকবেন, এটা কল্পনা করা যায় না।

    কিন্তু ঘরে ঢুকে খাটের তলায় উঁকি মেরে সত্যিই থ হয়ে গেলাম। ঘনাদা খাটের তলায় মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে আছেন।

    সে দৃশ্যটা ভোলবার নয়। খাটের তলায় ঘনাদা আর বাইরে আমরা বিমূঢ় হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে। আমরা তো এমন হতভম্ব যে হাসতে পর্যন্ত ভুলে গেছি।

    ঘনাদা কিন্তু সেই অবস্থাতেও এক মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে এমনভাবে খাটের তলা থেকে বেরিয়ে এলেন যেন খাটের তলায় শুয়ে থাকাটা তাঁর একটা স্বাভাবিক নিত্য-নৈমিত্তিক অভ্যাস।

    এতক্ষণে আমাদের মুখে কথা ফুটল।

    ব্যাপার কী, ঘনাদা! এমন সময়ে খাটের তলায়। জিজ্ঞাসা করলে শিশির।

    ঘনাদা কিছু না বলে গম্ভীরভাবে শুধু ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন! হাতে যা রয়েছে। সেটা একটা চশমার কাচ বলেই মনে হল।

    এতক্ষণ ধরে খাটের তলায় ওই একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো খুঁজছিলেন! আমি বলে পারলাম না।

    তার উত্তরে ঘনাদা নাকের ভেতর দিয়ে যে শব্দটা বার করলেন, তার অর্থ বিরক্তি অধৈর্য অবজ্ঞা সবই একসঙ্গে হতে পারে। তারপর শব্দটাকে ভাষায় রূপ দিয়ে আমাদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, একটা ভাঙা কাঁচের টুকরো— কেমন?

    গতিক সুবিধে নয় দেখে শিবু তাড়াতাড়ি বললে, ওদিকে বসিং কিন্তু শুরু হয়ে যাবে…

    আর বসিং! ঘনাদার গল্প তখন শুরু হয়ে গেছে, এই ভাঙা কাঁচের টুকরোটি না থাকলে হিরোসিমা নাগাসাকির বদলে লন্ডনেই প্রথম অ্যাটম বোমা পড়ত তা জানো!

    জানবার আমাদের দরকার নেই—শিবু দুর্বলভাবে শেষ চেষ্টা করে বললে,

    এখন আপনি চলুন তো!

    এই যে যাই, বলে খাটের ওপরই বেশ আরাম করে বসে ঘনাদা বললেন, ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর! তারিখটা তোমাদের মনে আছে নিশ্চয়। যে মহাযুদ্ধে সমস্ত পৃথিবী রক্তে ভেসে গেল তার প্রথম ফুলিঙ্গ সেইদিন জার্মানি আর পোল্যান্ডের সীমান্তে জ্বলে উঠেছিল। হিটলারের দুরন্ত বাহিনী সেদিন পোল্যান্ডের ওপর বন্যার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর আমি বেঙ্গুয়েলা বন্দর থেকে ছ্যাকরাগাড়ির মতো এক ট্রেনে চেপে অ্যাংগোলার মাঝামাঝি কুয়াঞ্জা স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হয়েছি। আমার লক্ষ্য অবশ্য কুয়াঞ্জা স্টেশন নয়। সেখানে নেমে কুয়াঞ্জা নদীর যেখানে উৎস সেই বিহে পাহাড়েই যাবার জন্যে আমি বেরিয়েছি।

    একটু হেসে আমাদের মুখের ভাবগুলো একটু লক্ষ করে ঘনাদা বললেন, ভূগোলের পরীক্ষার মতো লাগছে বুঝি। বুঝিয়ে বলছি দাঁড়াও। অ্যাংগোলার নাম নিশ্চয় শুনেছ। না শুনে থাকলে আফ্রিকার ম্যাপটা একবার খুলে দেখো। তলার দিকে পুবের আতলান্তিক মহাসাগরের ধারে একটা সবুজ রঙের ছাপা দেশ পাবে। দেশটা পর্তুগিজদের দখলে, কিন্তু রেলটা ইংরেজদের। আর ওই রেলপথ আর সমুদ্রের ধারের কিছু কিছু জায়গা ছাড়া ভেতরের অধিকাংশ পাহাড় জঙ্গল মরুপ্রান্তর এখনও প্রায় অজানা বললেই হয়। সেখানে বানিগ্রো জাতের কাফ্রিরা একরকম স্বাধীনভাবেই থাকে।

    রেলের যে কামরাটায় উঠেছিলাম সেটা প্রথম শ্রেণীর। নোভা লিসবোয়া স্টেশন পর্যন্ত একাই বেশ আরামে সেটায় কাটালাম। নোভা লিসবোয়াতে নতুন দুজন যাত্রী উঠল। সারা রাস্তা একলাই একটা কামরা দখল করে যেতে পারব এ আশা করিনি, কিন্তু নতুন সঙ্গী দুজন অমন বেয়াড়া অভদ্র না হলে ভাল হত। কথাবার্তা ও চেহারা দেখে গোড়াতেই বুঝেছিলাম তাদের দুজনেই জার্মান। অ্যাংগোলা পর্তুগিজদের দখলে হলেও জার্মানদের আনাগোনা এখানে কিছুদিন ধরে খুব বেড়েছে জানতাম। শুধু নতুন নাৎসি তেলক কেটে তারা যে এখন সাপের পাঁচ পা দেখেছে তা জানা ছিল না।

    নতুন যাত্রীদের লটবহর বড় বেশি। বড় বড় চটে মোড়া থলি প্যাকিং বাক্স প্রভৃতি এক গাড়ি মাল ব্রেকভ্যানে না দিয়ে কামরায় ভোলাই অন্যায়। তবু গোড়ায় তা নিয়ে কোনও প্রতিবাদ করিনি। কিন্তু জার্মান যাত্রীদের অভদ্রতা ক্রমশ সীমা ছাড়িয়ে গেল। একটি কেবিন ট্রাঙ্ক ও একটি হোল্ডঅল ছাড়া আমার সঙ্গে কিছু নেই। কেবিন ট্রাঙ্কটা বার্থ-এর ওপর রেখে হোল্ডঅলটা খুলে তার ওপর শুয়ে শুয়ে আমি নতুন যাত্রীদের নাল তোলা দেখছিলাম, হঠাৎ একজন আমায় অসভ্যের মতো যা হুকুম করলে আমাদের ভাষায় অনুবাদ করলে তার অর্থ দাঁড়ায়, এই কালাভূত, তোর মোট সরা এখান থেকে?

    যেন কিছুই বুঝিনি এইভাবে লোকটার দিকে বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম। দুজনের মধ্যে এই লোকটাই দেখলাম বেশি জোয়ান। ছ-ফুট লম্বা, পাক্কা আড়াই মন লাশ।

    আমায় নড়তে না দেখে একটা গালাগাল দিয়ে লোকটা আমার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে বললে, শুনতে পাচ্ছ না, জানোয়ার কোথাকার! বুটের একটা ঠোক্করে একেবারে গাড়ির বাইরে ফেলে দেব।

    যেন কিছুটা বুঝতে পেরেছি এমনই ভাবে বোকার মতো উঠে দাঁড়িয়েই কেবিন ট্রাঙ্কটা টেনে নামিয়ে নীচে ফেললাম। দুর্ভাগ্যের বিষয় তার ডান পা-টা সেইখানেই ছিল। ট্রাঙ্কটা বেশ ভারী। পায়ের যন্ত্রণায় চেঁচিয়ে উঠে নেংচাতে নেংচাতে লোকটা প্রথম মিনিট কয়েক তো আমার চতুর্দশ পুরুষ উদ্ধার করলে। তারপর বুনো গণ্ডারের মতো তেড়ে এল আমার দিকে।

    এবার একটা সিগারেট ধরালাম।

    লোকটা তখন ডিগবাজি খেয়ে তার সঙ্গীর ঘাড়েই গিয়ে পড়ে দুজনে মিলে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে।

    কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব হয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে দুজনে গা ঝেড়ে উঠে ঘুষি বাগিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে, এমন সময় দরজা থেকে শোনা গেল, আরে, আরে, হের ডস নাকি!

    তিনজনই অবাক হয়ে সেদিকে চাইলাম।

    ট্রেন তখন ছেড়ে দিয়েছে। কামরার দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে পিপের মতো গোল, বেলের মতো চাঁচামাথা মাঝবয়সী যে-জার্মান ভদ্রলোকটি আমার দিকে এগিয়ে এল, প্রথমটা তাকে সত্যিই চিনতে পারিনি।

    আমাদের কাছাকাছি এসে, মারমূর্তি তার দুটি সঙ্গীর দিকে চোখ পড়তে একটু অবাক হয়ে সে বললে, ব্যাপার কী হে! তোমরা লড়াই করছিলে নাকি?

    এবার দুজনের মুখে খানিকক্ষণ খই ফুটল যেন। কালা আদমির কাছে জব্দ হয়ে গায়ের জ্বালা মুখের তোড়ে বার করতে তারা কিছু বাকি রাখলে না।

    তাদের কথা শেষ হবার পর বেলের মতো তেল-মাথা জার্মানের সে কী হাসি। পিপের মতো ভুড়ি তার ফেটে যায় আর কি!

    অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে সে বললে, তোমরা আর ঝগড়া করবার লোক। পাওনি?

    আমার দিকে ফিরে তারপর বললে, কিছু মনে কোরো না, হের ডস, এরা সেদিনের ছোকরা, তোমার পরিচয় কোথা থেকে জানবে।

    হেসে আবার বললে, আমায় চিনতে পারছ তো?

    চিনতে আমি তখনই পেরেছি। মাথার শেষ ক-গাছি চুল উঠে গেলেও এবং ভুড়িটি বেশ কয়েক ইঞ্চি বাড়লেও আগেই তাকে আমার চেনা উচিত ছিল। দুনিয়ার পাণ্ডবর্জিত সব দুর্গম জায়গায় প্রাণ হাতে নিয়ে দুর্লভ ধাতুর খোঁজে যারা ঘুরে বেড়ায়, ফন্দিবাজ প্যাপেনকে তারা সবাই চেনে। অমন একটি ধূর্ত শয়তান এ লাইনে আর দুটি নেই। আমার সঙ্গে দু-চারবার তার ঠোকাঠুকি আগেই হয়ে গেছে বলেই আমার অত খাতির তার কাছে। শুধু দেশ দেখার জন্য এত লটবহর নিয়ে প্যাপেন যে এই জঙ্গল মরুভূমির দেশে আসেনি তা বুঝতে পারলেও, মুখে অমায়িক হেসে আমি তার হাত ঝাঁকানি দিলাম।

    এইবার শেয়ানে শেয়ানে কোলাকুলি শুরু হল। আমি প্যাপেনকে দেখে যতটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছি, প্যাপেনও আমাকে দেখে তার চেয়ে বেশি বই কম নয়। এখন কে কৌশলে কার পেট থেকে কথা বার করে নিতে পারে তারই প্যাঁচ কষাকষি চলল। আমার পাশে বসে প্যাপেন এমন অন্তরঙ্গের মতো গল্প শুরু করলে যেন কোনও রেষারেষি আমাদের মধ্যে নেই। দুজনের কেউই কম যায় না। ঘণ্টা দুয়েক সমানে নানান কায়দা করেও কেউ কারুর মুখ থেকে একটা বেফাঁস কথাও বার করতে পারলাম না। বাঁকা রাস্তায় সুবিধে করতে না পেরে প্যাপেন হঠাৎ হেসে উঠে সোজাসুজিই জিজ্ঞেস করে বসল, আর লুকোচুরিতে লাভ নেই। সত্যি করে বলল তো, ডস, কোথায় চলেছ?

    হেসে বললাম, হয়তো সেখানে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

    আমার সঙ্গে দেখা! প্যাপেন একেবারে আকাশ থেকে পড়ল, আরে আমি তো যাচ্ছি একেবারে অ্যাংগোলার শেষ প্রান্তে লুয়াও স্টেশনে।

    তাই নাকি? হেসে বললাম, মালপত্র দেখে তাই মনে হচ্ছে বটে।

    আরে, ওসব মালপত্র তো লুয়াওর এক হাসপাতালের জন্য নিয়ে যাচ্ছি।

    আজকাল আর পাহাড়ে পর্বতে সোনা রুপো খুঁজে বেড়াবার মতো শরীরে সামর্থ্য নেই, তাই এই সব মাল জোগাবার কাজ নিয়েছি। প্যাপেন আমাকে একেবারে জল বুঝিয়ে দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলে, কিন্তু তুমি কোথায় নামবে তা তো বললে না!

    আগের মতোই হেসে বললাম, যেখানেই নামি, দেখা আমাদের যথাস্থানে হবে বলে মনে হচ্ছে।

    হঠাৎ প্যাপেন গম্ভীর হয়ে বললে, দেখা কিন্তু এবার আমাদের না হলেই ভাল হত।

    কেন বলো তো! একটু বিদ্রুপের সঙ্গেই বললাম, এবার থার্ড রাইখ অর্থাৎ নাৎসি জার্মানির হয়ে টহল দিতে বেরিয়েছ বলে?

    খানিক চুপ করে থেকে প্যাপেন তেমনই গম্ভীরভাবে বললে, হ্যাঁ, তা-ই যদি বলি!

    তা হলে বলব নাৎসিদের সে চরেদের দৌড় কত একবার দেখে মরতে চাই।

    বাকি দুজন জার্মান গোঁজ হয়ে অন্য এক বেঞ্চিতে বসে এতক্ষণ কান খাড়া করে আমাদের আলাপ শুনছিল। আর থাকতে না পেরে তাদের একজন দাঁত খিচিয়ে বলে উঠল, তোমার বাসনা অপূর্ণ থাকবে না।

    তার দিকে ফিরে একটু হাসলাম। ক-দিন বাদে তার অভিশাপ সত্যিই ফলবার উপক্রম হবে তখন ভাবিনি।

     

    দিন পনেরো পরের কথা।

    বিহে অধিত্যকায় একটা খাড়া পাহাড়ের চূড়ার নীচে তাঁবুর মধ্যে বসে লণ্ঠনের আলোয় সে অঞ্চলের একটা ম্যাপ আঁকছিলাম। অন্ধকার রাত, চারিদিক একেবারে নিস্তব্ধ। সারাদিন দক্ষিণ-পূর্ব মুখে যে ঝড়ের মতো হাওয়া বয়েছে তা-ও এখন যেন ক্লান্ত হয়ে থেমে গেছে।

    ম্যাপ আঁকায় খুব যে আমার মন ছিল তা নয়। থেকে থেকে কান খাড়া করে যা শোনবার চেষ্টা করছিলাম হঠাৎ তার আভাস পেয়ে ম্যাপের ওপর নিবিষ্টভাবে ঝুঁকে পড়লাম। একটু পরেই ভারী গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম—একি! এখানেও হের ডস যে!

    মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি প্যাপেন ও তার দুই সঙ্গী যথাসম্ভব নিঃশব্দে আমার তাঁবুর মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে।

    সারাদিন পাহাড়ের চূড়া থেকে লটবহর ও কুলির দল নিয়ে দূর থেকে তাদের আসা যে আমি লক্ষ করেছি, তাদের আসার জন্যই যে এমন করে আসর সাজিয়ে বসে আছি একথা ঘুণাক্ষরে বুঝতে না দিয়ে অত্যন্ত অবাক হবার ভান করে বললাম,

    তাই তো, সত্যিই আমাদের আবার দেখা হল দেখছি।

    হুঁ, কিন্তু না হলেই ভাল হত। প্যাপেনের মুখ রীতিমতো গম্ভীর। কেন বল তো! এ পাহাড়ে সোনাদানা যা আছে তাতে আমি আর কতটুকু ভাগ বসাতে পারব। তোমাদের যত খুশি নাও না।

    সোনাদানার খোঁজে আমরা আসিনি, আর তুমিও না, প্যাপেন বেশ একটু রাগের সঙ্গেই বললে, সোনাদানার জন্যে কেউ গেগার কাউন্টার সঙ্গে আনে না।

    মেঝের ওপর গেগার কাউন্টারটা যেন সেইমাত্র চোখে পড়ল, এইভাবে বললাম, তাই তো, গেগার কাউন্টারটা ভুলে সঙ্গে এনেছি দেখছি। ইউরেনিয়াম রেডিয়াম প্রভৃতি ধাতুর খোঁজে এ-যন্ত্রের দরকার হয় শুনেছি।

    আমার বিদ্রুপে এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে প্যাপেন বললে, তুমি সেই খোঁজেই এসেছ আমরা জানি। কিন্তু এ সন্ধান তোমায় ছাড়তে হবে।

    কেন, নাৎসি জার্মানির হয়ে শুধু তোমরাই সে সন্ধান করবে বুঝি?

    হ্যাঁ, আমরাই করব। এ পাহাড়ে যে ইউরেনিয়াম-ঠাসা পিচব্লেন্ডের শিরা আছে সে খবর পেয়েই আমরা এসেছি। শুধু তুমি কোথা থেকে এ খবর পেলে বুঝতে পারছি না।

    একটু হেসে বললাম, নাৎসিদের ওপর কেউ টেক্কা দিতে পারে তা সহজে বিশ্বাস হয় না, না?

    যার পায়ে কেবিন ট্রাঙ্ক পড়েছিল সে-ই এবার হুংকার দিয়ে উঠল, নাৎসিদের ওপর টেক্কা দিতে চেষ্টা করলে কী হয় এখনই হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দেব।

    হেসে বললাম, তার আগে একটা কথা বুঝিয়ে দিলে খুশি হতাম। নাৎসি জার্মানির হঠাৎ ইউরেনিয়ামের ওপর অত ঝোঁক পড়ল কেন?

    এবার প্যাপেনের সঙ্গী দুজন হেসে উঠল। তারপর ঘৃণাভরে বললে, তোমরা যার গোলাম সেই ইংরেজ-জাতকে তাদের দ্বীপ সমেত একেবারে নস্য করে শূন্যে মিশিয়ে দেবার জন্য।

    প্যাপেন বাধা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ছোকরাদের মুখ তখন খুলে গেছে। থামায় কার সাধ্য। উত্তেজিতভাবে বলে চলল, রেডিয়াম থেকে শুধু সামান্য দু-একটা রোগ সারাবার ছেলেখেলাই এতদিন দেখেছ, জার্মানি এবার এমন কিছু তা থেকে তৈরি করবে, দশ হাজার বজ্র যার কাছে পটকাবাজি।

    সত্যিই অবাক হয়ে বললাম, যে অ্যাটম বোমা এতদিন শুধু কল্পনাতেই ছিল, নাৎসিরা তা তৈরি করবে!

    হ্যাঁ, আর সেই জন্যেই এ তল্লাটে আর কোনও ভাগীদার আমরা সহ্য করব না। সুবোধ ছেলের মতো তোমায় ঘরে ফিরতে হবে।

    যদি না ফিরি? বলার সঙ্গে সঙ্গে দুটো পিস্তল আমার দিকে উঁচু হয়ে উঠল।

    পায়ে চোট খাওয়া জার্মান জোয়ান মুখ বেঁকিয়ে বললে, ভালয় ভালয় এই বেলা যদি সরে না পড়ো তা হলে…

    তার কথা শেষ হবার আগেই প্যাপেন চমকে উঠে বললে, ও কী! ওটা কীসের আওয়াজ!

    পিস্তলের দিকে নজর থাকলেও কান আমার এই আওয়াজের জন্যই এতক্ষণ সজাগ হয়ে ছিল। যাক, কুয়াঞ্জা শহরে নেমে আমার অতি মূল্যবান একটি বেলা নষ্ট করা বিফল হয়নি। আমার পুরোনো অনুচর নোয়ালা তার কথা রেখেছে তা হলে।

    নিস্তব্ধ রাতের বুকের স্পন্দনের মতো সুদূরের দ্রিম দ্রিম আওয়াজটা এবার স্পষ্ট শোনা গেল। প্যাপেন কাঁচা আনাড়ি লোক নয়। আফ্রিকায় এতকাল ঘুরে এ শব্দের ভাষা সে বোঝে।

    সঙ্গীদের একজন কী বলতে যাচ্ছিল, তাকে ধমকে থামিয়ে অনেকক্ষণ ধরে একমনে সে একটানা সমস্ত শব্দগুলো শুনে গেল, তারপর আপনা হতেই তার চোখ আমার ওপরেই এসে পড়ল।

    মুখটা যথাসম্ভব করুণ করে বললাম, আমি সত্যি দুঃখিত, প্যাপেন, মনে হচ্ছে আমায় সরিয়ে দিলেও এ তল্লাটে তোমরা বেশিদিন টিকতে পারবে না।

    প্যাপেনের মুখ তখন বেশ ফ্যাকাশে হয়ে এসেছে। গম্ভীর মুখে বললে, হ্যাঁ, জংলিদের ঢাক তো তা-ই বলছে। কালকের মধ্যেই ওদের পক্ষে আমাদের আক্রমণ করা অসম্ভব নয়।

    এত বড় বিপদের মুখে আমার কথাটা প্যাপেন ও তার সঙ্গীদের কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করবার জন্য তারা বেরিয়ে যাবার পর প্রাণভরে নিজের মনে এক চোট হেসে নিলাম। নোয়ালাকে দিয়ে সময় মতো দূর থেকে ঢাক বাজাবার ফন্দিটা এতখানি সফল হবে কিনা সে বিষয়ে মনে একটু সন্দেহ সত্যিই ছিল।

    নিজের ফন্দিতে নিজের কী সর্বনাশ ডেকে আনছি তখনও কি জানি? বুঝতে পারলাম হঠাৎ শেষরাত্রে ঘুম থেকে চমকে জেগে উঠে। প্যাপেনরা কী করেছিল জানি না, আমি কিন্তু তাদের ভড়কে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত মনেই ক্যাম্প খাটে শুয়ে গভীরভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ জেগে টের পেলাম জনকয়েক কালো মুশকো জোয়ান মুখে কাপড় গুঁজে আমারই খাটের সঙ্গে শক্ত করে আমায় বাঁধছে। তাদের উত্তেজিত কথাবার্তা শুনে বুঝতে তখন আমার বাকি নেই যে আমার দুষ্ট বুদ্ধি আমারই কাল হয়েছে। প্যাপেনকে ভয় দেখিয়ে এ অঞ্চল থেকে তাড়াবার জন্যে নোয়ালাকে দিয়ে যে মিথ্যে ঢাকের বাদ্যি বাজিয়েছিলাম, প্যাপেনের কুলিরাও তা সত্যি বলে ধরে নিয়েছে। কাফ্রি কুলিরা এ ঢাকের ভাষা বোঝে। জংলিরা যখন পরের দিন আমাদের শেষ করে দেবে-ই এবং তখন সঙ্গে থাকলে কুলিদেরও যখন মারা পড়তে হবে তখন সময় থাকতে প্রাণ বাঁচাবার সঙ্গে উপরি লাভ তারা করে নেবে না কেন, এই হল তাদের কথা। জানাশোনা বিশ্বাসী কুলির দল এরকম অবশ্য সাধারণত করে না, কিন্তু ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখবার জন্যে প্যাপেন সম্ভবত নতুন অজানা লোক ভাড়া করে এনেছিল। তাইতেই সর্বনাশ!

    কুলিরা যেভাবে বেঁধে গেছল তাতে পরের দিন নোয়ালা এসে না খুলে দিলে ওই অবস্থাতেই হয় অনাহারে শুকিয়ে, নয় জংলিদের হাতে মরতে হত। কিন্তু নোয়ালা যে খবর নিয়ে এল তা আরও ভয়ংকর। অবশ্য এই দুঃসংবাদ দেবার দরকার না থাকলে নোয়ালা আমার খোঁজে আসত না এবং আমারও মুক্তি হত না। নোয়ালার খবর শোনবার পর কিন্তু মুক্তি পাওয়া না-পাওয়া সমান কথা মনে হল। নোয়ালার মিথ্যে ঢাকের আওয়াজে শুধু কুলিরাই ভুল বোঝেনি, দূর-দূরান্তের জংলি জাতেরাও তাতে উত্তেজিত হয়ে উঠেছে। দিনের বেলা এ অঞ্চলের শুকনো লম্বা ঘাসের জঙ্গলের ওপর দিয়ে উত্তর-পশ্চিম থেকে সারাক্ষণ প্রচণ্ড এক হাওয়া বয়। সে হাওয়ার শব্দের জন্য আর নিজের দুঃখের চিন্তায় এতক্ষণ যা খেয়াল করিনি, এইবার কান পেতে তা শুনতে পেলাম। দক্ষিণের সমস্ত আকাশ ঢাকের আওয়াজে গমগম করছে।

    কী এখন করা যায়! যতদূর বোঝা যাচ্ছে জংলিরা দল বেঁধে অনেক আগেই রওনা হয়েছে। ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই হিংস্র বন্যার মতো তারা এই অধিত্যকায় এসে পৌছবে। এখন পালাবার কথা ভাবা বাতুলতা, অথচ কুলিরা যেভাবে সব লুট করে নিয়ে গেছে তাতে বন্দুক দূরের কথা, যুঝে মরবার মতো একটা লোহার ডাণ্ডাও নেই।

    এইবার প্যাপেনদের কী অবস্থা হয়েছে দেখতে গিয়ে আরও অবাক হলাম। কুলিরা তাদেরও সর্বস্ব লুট করে নিয়ে গেছে সত্যি, কিন্তু বাঁধা পড়ে আছে শুধু একা প্যাপেন। বাঁধন খোলবার পর প্যাপেনের কাছে সব খবর পেলাম। তার সঙ্গী দুজন একেবারে আকাট গোঁয়ার নাৎসি। ঢাকের আওয়াজের মর্ম নিয়ে প্যাপেনের সঙ্গে তাদের ঝগড়া হয়েছে। প্যাপেন তাদের ফিরে যেতে পরামর্শ দিয়েছিল। তাতে তারা তাকে ভীরু কাপুরুষ বলে গাল দিয়ে নিজেরাই বন্দুক টর্চ ও গেগার কাউন্টার নিয়ে সেই রাত্রেই পাহাড়ের দিকে রওনা হয়ে গেছে। জংলিরা আসুক না-আসুক, ইউরেনিয়ামের খনির খোঁজ তারা করবেই।

    ঝোড়ো হাওয়ার শব্দ ছাপিয়ে জংলিদের ঢাকের বাদ্যি আর চিৎকার ক্রমশ আরও কাছে তখন শোনা যাচ্ছে। কিন্তু জংলিদের হাতে প্রাণ যাওয়ার চেয়ে এই বিপদটাই তখন বড় মনে হল। বিহে অধিত্যকায় ইউরেনিয়াম যে কী পরিমাণ আছে তা আমি নিজেই গত কয়েকদিনে জানতে পেরে অবাক হয়েছি। পিচব্লেন্ডের সে সব মোটা মোটা শিরার সন্ধান পাওয়া জার্মান ছোকরা দুজনের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব নয়। এত কষ্ট এত ফন্দি ফিকিরের পর এই ঐশ্বর্য শেষ পর্যন্ত তা হলে নাৎসিদের হাতেই পড়বে! না, তা কিছুতেই হতে পারে না। কিন্তু জংলিদের হাতে খানিক বাদেই যার প্রাণ যেতে বসেছে তার পক্ষে কী এমন করা সম্ভব!

    হঠাৎ প্যাপেনকে একটা চুরুট ধরাতে দেখে মাথার মধ্যে আমার যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। এখনও হয়তো এক ঢিলে দু পাখি অনায়াসে মারা যায়। নাৎসি ছোকরারা দক্ষিণ দিকের পাহাড়েই গেছে, জংলিরাও সেই দিক থেকে আসছে। জংলিদের হাতে তারা

    পড়ুক বা না পড়ুক, এক উপায়ে দুই শত্রুকেই এখন হার মানানো যেতে পারে।

    উত্তেজিত কণ্ঠে বললাম, শিগগির, প্যাপেন, শিগগির, তোমার দেশলাইটা দাও। দেশলাই! দেশলাই কী হবে?

    রেগে উঠে বললাম, জংলিদের হাত থেকে বাঁচতে যদি চাও তো শিগগির দেশলাইটা দাও।

    দেশলাই দিয়ে তুমি হাজার হাজার জংলি ঠেকাবে! প্যাপেন যেভাবে আমার দিকে তাকাল তাতে বুঝলাম আমার মাথা নিশ্চিত বিপদের মুখে খারাপ হয়েছে বলে তার ধারণা।

    এবার ধমকে উঠলাম, দেশলাই তুমি দেবে কি না?

    প্যাপেনের কথায় কিন্তু একেবারে বসে পড়লাম। আমার মারমূর্তি দেখে সভয়ে সে বললে, দেশলাই কোথায় পাব। মাত্র ওই একটা কাঠিই ছিল। কুলিরা কি কিছু রেখে গেছে!

    সত্যিই এবার হতাশ হলাম। সামান্য একটা দেশলাই-এর কাঠির অভাবে এত বড় সুযোগটা নষ্ট হয়ে যাবে। হঠাৎ নিজের পকেটে কী একটা হাতে ঠেকল। তুলে দেখি, একটা কাঁচের টুকরো। আগের দিন দূরবিন থেকে খুলে গেছল বলে পকেটে রেখে দিয়েছিলাম। কুলিরা দূরবিনটা নিয়ে গেছে, কাঁচটায় আর হাত দেয়নি।

    ঘনাদা একটু থেমে সগর্বে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, এই কাঁচের টুকরোর জোরেই জংলিদের হাত থেকে সে যাত্রা বেঁচে ফিরলাম, নাৎসিরাও অ্যাটম বোমা তৈরি করবার মতো ইউরেনিয়াম পেল না।

    শিশির ভুরু কুঁচকে বললে, তার মানে?

    অনুকম্পার হাসি হেসে ঘনাদা বললেন, এই সোজা ব্যাপারটা আর বুঝতে পারলে না! আগেই তো বলেছি বিহে অধিত্যকায় সারাদিন উত্তর-পশ্চিম থেকে একটা ঝোড়ো হাওয়া বয়, সমস্ত অধিত্যকাটা তার ওপর শুকনো ঘাসের জঙ্গলে ঢাকা। এই কাঁচের ভেতর দিয়ে সূর্যের আলো ফোকাস করে সেই ঘাসে আগুন ধরিয়ে দিলাম। দেখতে দেখতে কোটি কোটি নাগনাগিনীর মতো সে আগুন দক্ষিণ দিকে যতদূর চোখ যায় ছড়িয়ে গেল। জংলিরা আমাদের আক্রমণ করবে কি, প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলে তখন বাঁচে। আর নাৎসি ছোকরারা সে আগুনে যদি রক্ষাও পেয়ে থাকে তা হলেও ইউরেনিয়াম খোঁজবার ফুরসত আর তাদের মেলেনি।

    হঠাৎ শিশিরের হাতটা টেনে নিয়ে হাত-ঘড়িটা দেখে ঘনাদা বললেন, তাই তো শিবু, তোমাদের ক্লাবের অনুষ্ঠানটা তো শেষ হয়ে গেল দেখছি। আজ আর গিয়ে তো লাভ হবে না কিছু।

    শিশিরের সিগারেটের টিনটা ভুলে তুলে নিয়ে ঘনাদা উঠে গেলেন। আমরা থ হয়ে বসে রইলাম।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }