Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    ছড়ি

    ফন্দিটা ভালই আঁটা হয়েছিল।

    ঘনাদাকে জব্দ করার ফন্দি।

    রোজ রোজ তিনি আমাদের মাথায় আষাঢ়ে গল্পের চাঁটা মেরে যাবেন, আর আমরা মুখ বুজে তাই সয়ে থাকব, সেটি আর হচ্ছে না।

    এবার তাঁর ওপরেও টেক্কা দেওয়া চাই।

    ঘনাদা তখনও এসে পৌঁছোননি।

    ইতিমধ্যে চর পাঠিয়ে খবর নেওয়া হয়েছে যে সন্ধেবেলায় লেকের ধারে বেড়ানো সেরে তিনি এইমাত্র মেসের গলির মুখে দেখা দিয়েছেন।

    সিড়িতে তাঁর পায়ের শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বেশ তন্ময় হয়ে যে যার জায়গায় বসে পড়লাম।

    ঘনাদা যখন ঘরে ঢুকলেন তখন আমরা রুদ্ধনিঃশ্বাসে সবাই শুনছি আর গৌর বলে যাচ্ছে, যেদিকে তাকাই, শুধু সাদা বরফ—আকাশ সাদা, সব কিছু সাদা, আর ঠিক আমার পেছনে সেই সাদা ভালুক, সাক্ষাৎ যমের মতো পেছনের দু-পায়ে ভর দিয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে আসছে।

    ঘনাদা যে ঘরে ঢুকেছেন আড়চোখে সবাই দেখে নিলেও বাইরে একেবারে কেউ টের পাইনি এমনই ভান করে রইলাম। ঘনাদার মুখখানা সত্যি তখন দেখবার মতো। এরকম অবস্থায় আগে কখনও বোধহয় পড়েননি। চিরকাল সভার মধ্যমণি হয়ে জাঁকিয়ে বসাই যাঁর অভ্যাস—তাঁর প্রতি আজ কিনা কারুর ভ্রুক্ষেপও নেই!

    গৌর তখন উত্তেজিত ভাবে বলে চলেছে, রাইফেলের সব গুলি আগেই ফুরিয়ে গেছল। এবার কোনও উপায় না দেখে সেটা লাঠির মতো করে ধরে ফিরে দাঁড়ালাম…

    ভয়ে শিবুর গলা দিয়ে যেন স্বর বার হচ্ছে না, এমনই ভাবে বললে, তারপর?

    কিন্তু গৌর কিছু বলবার আগেই ঘনাদার গলা-খাঁকারি শোনা গেল।

    এবার আর তাঁকে অবজ্ঞা করা যায় না। গৌর তাঁর মৌরসিপাট্টা ইজিচেয়ারটা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললে, আরে, ঘনাদা যে! কখন এসেছেন টেরই পাইনি!

    নির্বিকার মুখে ইজিচেয়ারটায় এসে বসে ঘনাদা বললেন, তা পাবে কী করে? যে রকম মশগুল হয়ে গল্প করছিলে। তা গল্পটা হচ্ছিল কোথাকার?

    আজ্ঞে, দক্ষিণ মেরুর। পাছে ঘনাদার দিকে চাইলে নিজেকে সামলাতে না পারে সেই ভয়ে গৌর মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে যতদূর সম্ভব সহজ গলায় বলে গেল, সেবার একটা অভিযানে দক্ষিণ মেরুতে যেতে হয়েছিল কিনা!

    হাসি চাপবার জন্য আমরা মুখ নিচু করে রইলাম।

    ঘনাদার কিন্তু কোনও প্রকার ভাবান্তর দেখা গেল না। গৌরের পক্ষে দক্ষিণ মেরু যাওয়াটা যেন নিতান্তই বোটানিক্স কি চিড়িয়াখানা যাওয়ার শামিল এইভাবে তিনি বললেন, তা, সাদা ভাল্লুকটাকে করলে কী? বন্দুকের বাড়িতেই সাবাড় করে দিলে নাকি?

    গৌরের সেইরকমই কিছু বলবার বাসনা ছিল, কিন্তু ঘনাদার ওপর আর এক কাঠি সরেস হবার এমন সুযোগ কি ছাড়া যায়! একটু হেসে সে বললে, আজ্ঞে না, তার দরকার হল না। বন্দুকের ঘা দেবার আগেই দেখি ভালুক ভায়া চিৎপটাং। বরফের মেঝে একেবারে কাঁচের মতো তেলা কিনা! ।

    ঘরময় এমন কয়েকটা শব্দ শোনা গেল যা অন্য কেউ হলে চাপা হাসি বলেই মনে করত।

    কিন্তু ঘনাদার সেদিকে গ্রাহ্য নেই। গম্ভীরভাবে বললেন, সাদা ভাল্লুকটার ছাল-চামড়া না হোক নিদেনপক্ষে একটা দাঁত কি নখও যদি আনতে পারতে বিজ্ঞানের রাজ্যে হুলুস্থুল পড়ে যেত।

    এবার আমাদেরই হতভম্ব হবার পালা।

    কেন বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে গৌর, বৈজ্ঞানিকেরা কি সাদা ভাল্লুক দেখেননি?

    অন্তত দক্ষিণ মেরুতে কখনও দেখেননি। পেঙ্গুইন পাখি ছাড়া সেখানে ডাঙায় চরবার মতো কোনও প্রাণীই নেই। ঘনাদা হাই তুলে দুবার তুড়ি দিলেন।

    এমনভাবে জব্দ হব ভাবিনি। কথাটা তাড়াতাড়ি ঘুরিয়ে দিয়ে শিবু জিজ্ঞেস করলে, দক্ষিণ মেরুতেও গিয়েছিলেন আপনি?

    হ্যাঁ, গেছলাম একবার। যা গরম।

    এবার আমাদের চোখ কপালে উঠল। ঘনাদাকে আমরা চিনি, তবু তাঁর মুখে দক্ষিণ মেরুতে গরম শুনে খানিকক্ষণ মুখ দিয়ে কথা বেরুল না।

    শুধু বললাম, দক্ষিণ মেরুতে গরম!

    হ্যাঁ, গরম বলে গরম! কবে সেখানে গরমে গলে পচে মরতাম। ভাগ্যিস এই ছড়িটা ছিল।ঘনাদা হাতের ছড়িটা যেন আমাদের দিকেই দুবার আস্ফালন করলেন।

    আমাদের আর কিছু বলতে হল না। ঘনাদা শিশিরের দিকে ফিরে বললেন, কই। হে, একটা সিগারেট ধার দাও না!

    ঘনাদার আবার হিসেবে ভুল হবার জো নেই। শিশিরের কাছে সিগারেট নিয়ে ধরিয়ে বললেন, এই নিয়ে ৩২৯৮টা হল কিন্তু।

    তারপর সিগারেটটায় একটা সুখটান দিয়ে শুরু করলেন, সেবার সমুদ্রে যেন তিমির গাঁদি লেগেছিল। দক্ষিণ মেরুর দিকে তিমিধরা জেলেদের নজর কয়েক বছর হল তখন পড়েছে। অবাধ বেপরোয়া তিমি শিকারের দরুন উত্তর অঞ্চলের তিমি প্রায় নিঃশেষ হওয়ার ফলেই দক্ষিণ দিকে ইংরেজ, নরউইজিয়ান, জাপানি আর আর্জেন্টাইন জেলেরা হানা দিতে শুরু করে বটে, কিন্তু দক্ষিণ মেরু অঞ্চলেও এত তিমি এর আগে কখনও দেখা যায়নি। নেহাত আনাড়ি জেলে-জাহাজও সেবার তিমির চর্বিতে বোঝাই হয়ে ঘাঁটিতে ফিরেছে! তুখোড় তিমি-শিকারিদের তো কথাই নেই।

    আমার জাহাজ যে তিমির চর্বিতে বোঝই তা বোধহয় বলতে হবে না। নরওয়ের এক জেলে-জাহাজ আধাআধি বখরায় বন্দোবস্ত করে আর সব দল থেকে আলাদা হয়ে ক্যাম্পবেল দ্বীপে তখন আমার ঘাঁটি করেছি। আমার বখরাদারকে আমি সেন বলে ডাকি। তবে সে বাঙালি নয়, নরওয়ের লোক। পুরো নাম ওলাফ সোরেনসেন। আমি তাকে ছোট করে নিয়েছি সেন বলে।

    সেন পাকা তিমি-শিকারি। বিশ বছর ধরে উত্তর দক্ষিণের দুই মেরুর হেন জাতের তিমি নেই, সে শিকার করেনি। দূর থেকে শুধু তিমির নিঃশ্বাসের ফোয়ারা দেখে সে নারওয়াল না স্পার্ম, কুঁজো না নীল তিমি, বলে দিতে পারে। আমাদের জাহাজের নাম আমি রেখেছিলাম যমুনা। জাহাজ বললে অবশ্য খানিকটা ভুল বোঝানো হয়। মাত্র চারশো টনের বড় স্টিমার, মোট ১৭৫ ফুট লম্বা। তবে তিমি-ধরা জাহাজের মধ্যে একেবারে সেরা আর সবচেয়ে হালফ্যাশানের। এই পিল্যাজিক জাহাজে তিমি ধরে চর্বি ছাড়াবার জন্য আর ঘাঁটিতে বয়ে নিয়ে যেতে হয় না। জাহাজের খোলের ভেতরেই সব বন্দোবস্ত আছে।

    আমাদের জাহাজে মাঝি-মাল্লা নিয়ে তোক সবসুদ্ধ আমরা ১৮ জন। সেন জাহাজের কাকের বাসা অর্থাৎ মাস্তুলের ওপরকার পাহারা-মাচায় দূরবিন ধরে সমুদ্রে তিমির সন্ধান করে। আর আমি হারপুন-ছোঁড়া কামান চালাই। আমাদের জাহাজে সম্পূর্ণ আধুনিক ভেণ্ড ফয়েন (Svend Foyn) হারপুন কামান বসানো। তা থেকে চার ফুট লম্বা সওয়া মন ওজনের হারপুন বিদ্যুৎগতিতে তিমির গায়ে গিয়ে বেঁধে। সে হারপুনের মাথায় আবার ছোট বোমা গাঁথা। একবার ঠিক মতো তাগ করতে পারলেই তিমির গায়ে বেঁধবার তিন সেকেন্ডের মধ্যে সে বোমা ফেটে গিয়ে তিমিকে কাবু করে ফেলবেই।

    ডিসেম্বর মাসের শেষ। তিমি ধরার মরশুম প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। আর কিছুদিন রবে। আমাদের জাহাজ তিমির চর্বির ভারে ড়ুবুড়ুবু। যা চর্বি আমরা পেয়েছি তাতে বছর তিনেক দুহাতে খরচ করেও রাজার হালে বসে বসে আমরা কাটাতে পারব। সেন রোজ তাই ফেরার জন্যে পেড়াপিড়ি করে। কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি নই।

    সেদিন সকালবেলা কাকের বাসায় পাহারা দিতে দিতে সেন হঠাৎ নীচে নেমে এল। আমি তখন একজন খালাসিকে দিয়ে হারপুন কামানটা পরিষ্কার করাচ্ছি। সেনকে দেখে একটু অবাক হয়ে বললাম, নেমে এলে যে বড়! এইটুকুর মধ্যে বড় কোনও শিকার যদি ফসকে যায়।

    ফসকে গেলে ক্ষতিটা কী! সেনের মুখ বেশ বিরক্ত, আর শিকার গাঁথলে মাল কোথায় রাখবে বলতে পারো? জাহাজে আর জায়গা আছে?

    সেনের বিরক্তি দেখে একটু হেসে বললাম, আমি যে শিকারের সন্ধান করছি তার মাল রাখবার যথেষ্ট জায়গা এখনও জাহাজে আছে। আর সে মালের কাছে তোমার জাহাজভর্তি চর্বি নেহাত তুচ্ছ।

    সেন খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললে, তার মানে এখনও তুমি অ্যাম্বারগ্রিস-এর আশায় আছ?

    আমাদের মুখের ভাব দেখে ঘনাদা গল্প থামিয়ে একটু যেন করুণার সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন, অ্যাম্বারগ্রিস কাকে বলে, জানো না বুঝি?

    আমরা মাথা নাড়লাম। ঘনাদা ঈষৎ বিদ্রুপের হাসি হেসে বললেন, সাপের মাথার মণির কথা শুনেছ তো? সে মণি শুধু আজগুবি কল্পনা, কেউ কখনও পায়নি। কিন্তু অ্যাম্বারগ্রিস তিমির মাথার নয়, পেটের সত্যিকার মণি। শুধু একজাতের তিমির নাড়িভুঁড়ির মধ্যে পাওয়া যায়। তাও আবার সে জাতের সব তিমির নয়, দু-চারটির। তিমির পেট থেকে ছাড়া সমুদ্রের জলে আর সমুদ্রের ধারের পলিতেও অনেক সময় হালকা নুড়ির মতো কালচে ধোঁয়াটে রঙের অ্যাম্বারগ্রিস পাওয়া যায়। এসেন্স আতরের কারবারে সে নুড়ির দাম তার ওজনের সোনার চেয়ে কম নয়।

    হ্যাঁ, তারপর যা বলছিলাম। সেনের কথা শুনে একটু হেসে বললাম, অ্যাম্বারগ্রিস-এর আশায় আছি মানে? তুমি কি মনে করো তোমার ওই নোংরা চর্বির লোভে এই যমের দক্ষিণ দুয়ারে তিমি-শিকারে এসেছি। না হে, না, আমার নজর আরও অনেক উঁচুতে। অ্যাম্বারগ্রিস বেশ ভাল রকম আছে এমন একটা তিমি যদি পাই, তাহলে ও চর্বির বখরা তোমায় এমনিই দিয়ে দেব।

    তোমার উদারতার জন্য ধন্যবাদ। সে একটু বিদ্রুপ করেই বললে, তবে অ্যাম্বারগ্রিস তো আর যেখানে সেখানে ছড়ানো নেই। স্পার্ম-তিমি ছাড়া ও-জিনিস পাওয়া যায় না, জানো বোধহয়, আর স্পার্ম-তিমি এ অঞ্চলে খুব কমই পাওয়া যায়।

    হেসে বললাম, কিন্তু পাওয়া যা যায় তা দস্তুর মতো বড় গোছের। এ অঞ্চলে ছুটোছাটা ছিটকে যেকটা স্পার্ম-তিমি এসে পড়ে সেগুলো সবই বুড়ো ধাড়ি। অ্যাম্বারগ্রিস তাদের পেটেই পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

    যেন আমার কথার মান রাখবার জন্যেই আধ মাইলটাক দূরে একটা জলের ফোয়ারা হঠাৎ সমুদ্র থেকে লাফ দিয়ে উঠল।

    হাজার হলেও সেন জাত-শিকারি। এক মুহূর্তে ঝগড়াঝাঁটি ভুলে দূরবিন চোখে লাগিয়ে সে উত্তেজিত হয়ে উঠল।

    তিমি! স্পার্ম-তিমি! সমুদ্রের দেবতা তোমার কথা শুনেছে, দাস! আর ভাবনা নেই।

    হায়! সমুদ্রের দেবতার মনে কী ছিল তখন যদি জানতাম!

    উত্তেজনার ঝোঁকে সেন দুরবিন ছেড়ে তখন হারপন-কামানে হাত দিয়েছে। আমি বাধা দেবার আগেই প্রচণ্ড শব্দে ভেন্ড-ফয়েন কামানের হারপুন ছুটে বেরিয়ে গেল।

    সেন এমনিতেই বেশ ভাল শিকারি। কিন্তু উত্তেজনাতেই তার টিপ তখন বুঝি খানিকটা নষ্ট হয়ে গেছে। বোমামুখো হারপুন তিমিটার গায়ে না লেগে কাছাকাছি পড়ে ফেটে গেল। আর তাইতেই হল সর্বনাশ। সঙ্গে সঙ্গে একটি ফোয়ারা ছেড়ে তিমিটা এমন ড়ুব মারল যে আর পাত্তাই নেই।

    কিন্তু আমরাও তখন নাছোড়বান্দা। এত বড় একটা স্পার্ম-তিমির সন্ধান পাওয়ার পর আমরা তাকে বেহাত হতে দিই! যত গভীর জলেই ড়ুব দিক না কেন, বাছাধনকে নিশ্বাস নিতে, দূরে তোক কাছে হোক, কোথাও উঠতেই হবে। খুব বেশিক্ষণ ড়ুবে থাকাও তার চলবে না, কারণ আমাদের হারপুনের হুমকিতে ভাল করে নিঃশ্বাস নেবার ফুরসত তার মেলেনি। তিমিরা নিঃশ্বাস নেবার পর বহুক্ষণ ড়ুবে থাকতে পারে বটে, কিন্তু পুরোপুরি দম নেওয়া তাদের একেবারে সারা হয় না। জল থেকে হাওয়ায় এসে তারা বারকয়েক ফোয়ারা ছেড়ে, নিঃশ্বাস নিয়ে, তবে আবার অনেকক্ষণের জন্য ড়ুব মারে। এ বেচারাকে কিন্তু একটিবার ফোয়ারা ছেড়েই তাড়াহুড়ো করে ড়ুব দিতে হয়েছে। সুতরাং সাধারণ অবস্থায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ ড়ুব মেরে থাকা সম্ভব হলেও এখন মিনিট দশ-পনেরোর বেশি জলের তলায় থাকতে সে পারবে না।

    সেনকে কাকের বাসায় পাঠিয়ে হারপুন কামান ধরে আমি সজাগ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সারেং আমাদের হুকুম মতো তখন মাইলখানেক ব্যাস ধরে জাহাজটাকে চক্কর দেওয়াতে শুরু করেছে।

    কিন্তু স্পার্ম-তিমি নয়, নিয়তিই ওই ছদ্মবেশে আমাদের নাকাল করতে এসেছে কী করে বুঝব! তিমির দেখা আমরা আবার কেন, অনেকবার পেলাম, কিন্তু সে যেন মন্ত্ৰপড়া তিমি, হারপুন দিয়ে তাকে কিছুতেই ছুঁতে পর্যন্ত পারা গেল না। সে যেন ভেলকি জানে। হারপুন কামান থাকে জাহাজের সামনের দিকে। তিমিটা যেন তা জেনেই প্রত্যেকবার ঠিক জাহাজের পেছন দিকে ভেসে ওঠে। জাহাজ ঘুরিয়ে ভাল করে তাকে তাগ করবার আর সুযোগ মেলে না। তার আগেই সে ড়ুব দেয়। দু-চারবার এমনই করে ফসকাবার পর হঠাৎ আমাদের হারপুন কামানটাই গেল আশ্চর্যভাবে বিগড়ে। কামান মেরামত যতক্ষণ না হয় ততক্ষণ তিমিটাকে নজরে রাখা ছাড়া আর আমাদের কোনও উপায় নেই। তিমিটা যেন আমাদের মতলব বুঝেই তখন ক্রমশ আরও দক্ষিণে পাড়ি দিতে শুরু করেছে। কিন্তু আমরাও তখন মরিয়া হয়ে উঠেছি। হারপুন কামান ঠিক যদি না হয় তাহলে হাতে-ছোঁড়া হারপুন দিয়েও আগেকার যুগের তিমি-শিকারিদের মতো তাকে আমরা ধরবই এই আমাদের পণ।

    কিন্তু সে পণরক্ষা আর হল না। দুদিন দুরাত্রি তার পিছু পিছু ধাওয়া করে আমরা তখন মেরুবৃত্তের দিকে অনেকখানি এগিয়ে গেছি। হঠাৎ তারপর এল ঝড়। দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের ঝড় কী বস্তু, এখানে কল্পনাই করা যায় না। ঘণ্টায় একশো মাইল ঝড়ের বেগ সেখানে নেহাত স্বাভাবিক ব্যাপার।

    কোথায় রইল তিমি-শিকার, নিজেদের জাহাজ বাঁচাতেই তখন আমাদের প্রাণান্ত। ক-দিন করাত্রি যে ঝড়ের সঙ্গে যুঝলাম খেয়ালই নেই। এইটুকু শুধু বুঝতে পেরেছিলাম যে ক্রমশ দক্ষিণ দিকেই আমাদের ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। তুষারঝড়ে দিগ্বিদিক অন্ধকার, তারই ভেতর উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ আর পাহাড়ের মতো বিরাট সব বরফের স্তৃপ প্রতি মুহূর্তে যেন আমাদের পিষে ফেলবার জন্য ষড়যন্ত্র করছে। সে ষড়যন্ত্র শেষ পর্যন্ত সংলই হল। কয়েকদিন ঝড়ের সঙ্গে অবিরাম যুদ্ধের পর বিরাট এক বরফের পাহাড়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে আমাদের জাহাজ চৌচির হয়ে গেল। কী যে তারপর হয়েছে, কী যে করেছি, কিছুই মনে নেই।

    জ্ঞান যখন হল তখন দেখি বিরাট এক তুষার-প্রান্তরের ওপর পড়ে আছি। চোখ মেলতেই মনে হল কেতাদুরস্ত ভাবে ডিনার সুটের সাদা শার্ট কালো কোটপরা ক-জন ভদ্রলোক যেন আমায় নিবিষ্ট মনে দেখছে।

    চোখের ঘোর একটু কাটবার পর বুঝলাম কোটপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক নয়, সেগুলি পেঙ্গুইন পাখি।

    পেঙ্গুইনরা এই তুষারের রাজ্যে মানুষ কখনও দেখেনি। ভয় না পেয়ে তারা নিজেদের ভাষায় আমার সম্বন্ধে খোলাখুলি ভাবেই তখন আললাচনা শুরু করে দিয়েছে।

    উঠে বসে এবার চারিদিকে তাকালাম। আমাদের জাহাজের নানা টুকরো তুষারময় তীরের ওপর চারিদিকে ছড়ানো। বুঝলাম একই ঢেউয়ের মাথায় ভাঙা জাহাজের টুকরোর সঙ্গে আমি এই তুষার-উপকূলে এসে পৌঁছেছি। পেঙ্গুইনদের কথা আগে অনেক শুনেছি। এখানে তাদের আস্তানা দেখে মনে হল রস দ্বীপের কাছাকাছি কোনও জায়গায় আছি। এ জাতের পেঙ্গুইন এই অঞ্চলেই শীতের আগে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে বড় করতে আসে।

    কিন্তু আমি ছাড়া আমাদের জাহাজের আর কেউ কি রক্ষা পায়নি?

    চারিধারে অনেক দূর পর্যন্ত খুঁজে দেখলাম। জীবিত দূরে থাক, কোনও মানুষের মৃতদেহও একটা দেখতে পেলাম না। দেখবার আশা করাই অবশ্য ভুল। তুষার ঝড়ে জাহাজড়ুবির পর যদি কেউ বেঁচে গিয়ে থাকে, এখানকার সমুদ্রের হিংস্র গ্রাম্পস তিমির কবল থেকে তার রক্ষা পাওয়া অসম্ভব। এই দিকের সমুদ্রে নেকড়ের পালের মতো ঝাঁকে ঝাঁকে তারা ঘুরে বেড়ায়। তাদের নজরে পড়লে বিরাট নীল তিমি থেকে অক্টোপাস আর সীল পর্যন্ত কারুর আর রক্ষা নেই। হাঙরের চেয়ে তারা অনেক বেশি বুদ্ধি ধরে। শক্তি, সাহস এবং হিংস্রতা—তাতেও তারা অনেক ওপরে।

    আমি যে তাদের কবলে পড়িনি এটা নেহাত আমার সৌভাগ্য! কিন্তু খানিকক্ষণ সেই তুষার-শ্মশানে কাটাবার পর বেঁচে যাওয়াটা সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য বেশ একটু সন্দেহ হতে লাগল। জলে ড়ুবে বা হাঙর-তিমির কবলে পড়ে মারা গেলে সঙ্গে সঙ্গে সব চুকে যেত, কিন্তু সেসব বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়ে এই তুষার রাজ্যে যে তিলে তিলে মরতে হবে। এখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনও সম্ভাবনাই কখনও নেই। তিমি-ধরা জাহাজ সাধ করে এ জায়গার ধারে কাছে কখনও আসে না। কালেভদ্রে তোড়জোড় করে যারা মেরু অভিযানে এ অঞ্চলে আসে তাদের সঙ্গে দেখা হওয়ার আশা সমুদ্রের বালির গাদায় একদানা চিনি খুঁজে পাওয়ার সমান।

    তবু প্রাণ থাকতে হাল ছেড়ে দিতে নেই। যতদিন পারা যায় এই তুষার মরুভূমিতে বেঁচে থাকবার জন্য যা সাধ্য তাই করবার চেষ্টায় মন দিলাম। জাহাজের ভাঙা যে সব টুকরো-টাকরা চারিধারে ছড়িয়ে ছিল তা থেকে এত সাহায্য পাব ভাবিনি। সে সাহায্য

    পেলে একটা দিনও আমায় টিকে থাকতে হত না বোধহয়।

    বরফের ওপর ঘুরতে ঘুরতে প্রথমেই পেলাম এই ছড়িটি। সাউথ জর্জিয়ার বন্দর থেকে তিমি-শিকারে বেরুবার সময়ে শখ করে এই ছড়িটি কিনেছিলাম। এই তুষার রাজ্যে ছড়িটিকে পেয়ে যেন পুরোনো বন্ধুকে ফিরে পেলাম মনে হল। ছড়িটা বাদে কিছু টিনে ভর্তি খাবার-দাবারও এখানে সেখানে কড়িয়ে পেলাম। দিন-দশেক অন্তত সে। খাবারে চলে যেতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে দরকারি যে-জিনিসটি পেলাম সেটি একটি রেশম আর পাতলা রবারের তৈরি গোল তাঁবু! এমনিতে গোটা তাঁবুটা এমন হালকা যে পাকিয়ে কাঁধে ফেললে একটা আলোয়ানের চেয়ে বেশি ভারি লাগে না। কিন্তু ফাঁপিয়ে মাটিতে খাটালে জন চারেক লোক তার মধ্যে অনায়াসে রাত কাটাতে পারে। তিমি ধরা জাহাজ বিগড়ে হঠাৎ যদি দক্ষিণ মেরুর কোন দ্বীপে শীতকালটা কাটাতে হয় সেই জন্য সেন এই তাঁবুটা দেশ থেকে বিশেষভাবে অর্ডার দিয়ে তৈরি করিয়ে এনেছিল। সেটা যে দক্ষিণ মেরুর তুষার রাজ্যেই কাজে লাগবে সে বা আমি ভাবতেই পারিনি।

    এই তাঁবুটি না পেলে এই রক্ত-জমানো শীতের দেশে এসকিমোদের মতো বরফের ঘর তৈরি করবার চেষ্টাই হয়তো আমায় করতে হত। তাও কতদূর কী পারতাম জানি না।

    তাঁবু খাটিয়ে বসবার পর কয়েকটা দিন ভাঙা জাহাজের টুকরো-টাকরা থেকে আর কী পাওয়া যায় তারই খোঁজে কেটে গেল।

    পেঙ্গুইন ও সামুদ্রিক স্কুয়া চিলই আমার একমাত্র সঙ্গী। যে জায়গায় আমি তাঁবু ফেলেছিলাম তা থেকে মাইলখানেক দূরে হাজার হাজার পেঙ্গুইন ডিম ফুটিয়ে বাচ্চা বড় করবার জন্যে তখন নুড়ি সাজিয়ে বাসা তৈরি করতে ব্যস্ত। পুরুষ পাখিরা নুড়ি মুখে করে নিয়ে আসে। মেয়ে পাখিরা তা সাজায়। পেঙ্গুইনদের হাব-ভাব চাল-চলন দেখলে পাখির বদলে মানুষ বলেই ভুল হয়। তাদের আচার-ব্যবহারে সামাজিক সভ্যতার আভাস বেশ স্পষ্ট।

    স্কুয়া চিলেরা পেঙ্গুইনদের চিরশত্রু। ইতিমধ্যেই তারা পেঙ্গুইনদের জ্বালাতন করতে শুরু করেছে। পেঙ্গুইনরা ডিম পাড়বার পর তাদের লুটতরাজ আরও বেড়ে যাবে। পেঙ্গুইনদের সজাগ পাহারা একটু ঢিলে হলেই ছোঁ মেরে ঠোঁটে ডিম বিধে নিয়ে যাওয়া তাদের দস্তুর।

    কিন্তু পেঙ্গুইন আর স্কুয়া চিলের ঝগড়া দেখে দিন কাটালে আমার চলবে না। মাত্র দশ দিনের খোরাক আমার হাতে। পেঙ্গুইনরা ডিম পাড়ার পর স্কুয়া চিলদের মতো আমাকেও হয়তো তাদের ওপর ডাকাতি করতে হবে। কিন্তু তার আগে কিছু খাবার সংগ্রহ না করলেও নয়। ভাঙা জাহাজের ছড়ানো মাল থেকে একটা লম্বা লোহার শিক

    জোগাড় করেছিলাম। তাই দিয়ে এ অঞ্চলের একটা চিতা-সীল শিকার করবার চেষ্টায় বেড়িয়ে পড়লাম। জলে নেমে সড়কিতে সীল মাছ গাঁথা অসম্ভব। কিন্তু সীল অনেক সময়ে বরফের মধ্যে নিঃশ্বাসের একটা ফুটো তৈরি করে তার তলায় শীতটা কাটায়। সেইরকম একটাকে সুবিধেমতো পাওয়াই আমার উদ্দেশ্য।

    বরফের ওপর দিয়ে একমনে শিকার খুঁজতে খুঁজতে কতদূর গিয়ে পড়েছিলাম জানি না, হঠাৎ চোখ তুলে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। মাত্র আধ-মাইলটাক দূরে বরফের প্রান্তরের ওপর একটা বহুদূরব্যাপী লম্বা সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা যাচ্ছে। যেন মেঘের একটা লম্বা ফিতে বরফের ওপর নেমে এসেছে।

    সীল শিকার মাথায় রইল। এ রহস্যের মীমাংসা আগে না করলে নয়। কাছে গিয়ে যা দেখলাম তাতে আরও হতভম্ব হয়ে গেলাম। মেঘের ফিতের মতো দুর থেকে যা দেখেছিলাম তার তলায় তরতর করে একটা জলের ধারা বয়ে যাচ্ছে আর সে জল। আগুনের মতো গরম। এখানকার দারুণ ঠাণ্ডায় সেই জল থেকে বাষ্প উঠে তুষারকণা হয়ে জমে যাবার দরুনই তার চেহারা দূর থেকে মেঘের মতো দেখাচ্ছে।

    এই তুষার-রাজ্যে এরকম জলের স্রোত কোথা থেকে আসছে?

    সেদিন তৈরি ছিলাম না। তাই পরের দিন লম্বা পাড়ির জন্যে প্রস্তুত হয়েই বেরিয়ে পড়লাম। প্রস্তুত হওয়া মানে আর কিছুই নয়, কাঁধের একটা ঝোলায় টিনের খাবারের কৌটোগুলো, কোমরে চাদরের মতো জড়ানো সেই তাঁবু, আর হাতে এই ছড়ি। যদি দরকার হয় যেখানে খুশি তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটাতে পারব এই জন্যেই এসব নেওয়া।

    ঘণ্টা চারেক বরফের ওপর দিয়ে হাঁটবার পর গরম জলের স্রোতের রহস্য পরিষ্কার হয়ে গেল বটে, কিন্তু যা দেখলাম সে আরেক বিস্ময়।

    সামনে তুষার-প্রান্ত ঢালু হয়ে ওপর দিকে উঠে গেছে আর তারই মাঝে আকাশে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক খাড়া পাহাড়ের চূড়া। পাহাড় এখানে চারিদিকেই কিন্তু সেগুলি আগাগোড়াই বরফে ঢাকা। এই পাহাড়ের গায়ে শুধু নেড়া পাথর ছাড়া একটি বরফের কুচিও নেই। এই পাহাড়ের নীচের দিকের একটি গুহা থেকে ফুটন্ত গরম জলের স্রোত বেরিয়ে আসছে তা বলাই বাহুল্য।

    দক্ষিণ মেরুতে মাউন্ট ইরেবাস ও আরেকটি আগ্নেয়গিরি আবিষ্কৃত হয়েছে বলে আগেই জানতাম। আমি কি তাহলে ভাগ্যক্রমে সে দুটির চেয়েও আশ্চর্য আরেকটি আগ্নেয়গিরি আবিষ্কার করে ফেলেছি! আনন্দের সঙ্গে দুঃখও হল এই যে, এ-আবিষ্কারের কথা পৃথিবীর কেউ জানতেও পারবে না। এই তুষার-রাজ্যে এ-আবিষ্কার আমার সঙ্গেই শেষ হয়ে যাবে।

    তবু এ-আগ্নেয়গিরির সন্ধান ভাল করে না নিয়ে ফিরতে পারি না।

    সামনের দিকে পাহাড় অত্যন্ত খাড়াই। ডানদিকের পাহাড় কিছুটা ঢালু দেখে সেই দিক দিয়েই উঠতে শুরু করলাম। | ওপরে গিয়ে যখন পৌঁছোলাম তখন দক্ষিণ মেরুর এই সময়কার ছোট রাত শুরু হয়ে গেছে। সন্তর্পণে কিছুদূর যেতেই আগ্নেয়গিরির বিরাট মুখটার প্রান্ত দেখা গেল। সাধারণ আগ্নেয়গিরির চেয়ে এই পাহাড়ের হাঁ অনেক বেশি প্রকাণ্ড।

    কিন্তু ঠিক মুখটার কাছে ওটা কী প্রাণী!

    দক্ষিণ মেরুতে পেঙ্গুইন ছাড়া ডাঙায় চরবার মতো কোনও প্রাণীই নেই জানি। এ বিশাল প্রাণীটা তা হলে কোথা থেকে এল? আবছা অন্ধকারে সেটাকে প্রকাণ্ড একটা পাখি বলেই মনে হচ্ছিল। কিন্তু এত বড় আকারের কী পাখি এখানে থাকতে পারে। দক্ষিণ মেরুর সম্রাট পেঙ্গুইনই সবচেয়ে বড় আকারের পাখি, কিন্তু সে পাখি তো কখনও এত বিশাল হতে পারে না। তা ছাড়া সেরকম পাখি একলা এই পাহাড়ের চূড়ায় কী করে আসবে।

    ভাল করে একটু খোঁজ নেবার জন্যে সন্তর্পণে যেই একটু এগিয়েছি, অমনই বিরাট পাখিটা হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে কী একটা চিৎকার করে উঠল।

    পরমুহুর্তে হঠাৎ চমকাবার দরুনই হোক বা তলার পাথর সরে গিয়েই তোক সে সশব্দে আগ্নেয়গিরির মুখের ভেতর গড়িয়ে পড়ল এবং এক লাফে তাকে ধরতে গিয়ে দেখলাম সঙ্গে সঙ্গে আমিও সবেগে নীচে গড়িয়ে যাচ্ছি।

    একেবারে নীচে এসে গড়িয়ে পড়ার পর জখম খুব বেশি না হলেও আরেক দিক দিয়ে অবস্থা যা হল তা বর্ণনা করা যায় না।

    দারুণ গ্রীষ্মের দিনে দার্জিলিং থেকে শিলিগুড়িতে নামলে যে অবস্থা হয় তা এর। কাছে কিছুই নয়। পাহাড়ের ওপর ছিল দক্ষিণ মেরুর দুরন্ত শীত আর পাহাড়ের এই গহ্বরের তলায় একেবারে যেন আফ্রিকার কঙ্গোর জঙ্গলের দারুণ ভ্যাপসা গরম। সমস্ত শরীর জ্বলে গিয়ে যেন দম বন্ধ হয়ে মরে যাবার জোগাড় হল।

    যার জন্যে এই গহ্বরে পড়তে হল সেও তখন উঠে বসে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। বিরাট কোনও অজানা পাখি নয়, সে আমারই বন্ধু সেন।

    সেনের মুখে সমুদ্র থেকে উদ্ধার পাওয়া আর পাখি সাজার বৃত্তান্ত তারপর শুনলাম। আমার মতো সমুদ্রের ঢেউ তাকেও তুষার-তীরের ওপর ফেলে যায়। কিন্তু আমার মতো রবারের তাঁবুর সুবিধে না থাকায় শীতে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে কয়েকটা পেঙ্গুইন পাখি মেরে তাদের চামড়া আর পালক তাকে গায়ে আঁটতে হয়। তারপর গরম জলের স্রোত দেখে আমারই মতো কৌতূহলী হয়ে সে এই পাহাড়ের সন্ধানে আসে।

    অন্য সময় হলে এ গল্প হয়তো যথেষ্ট উপভোগ করতাম, কিন্তু দারুণ গরমে যখন প্রাণ যাবার উপক্রম তখন অন্য কিছুতে কি মন যায়!

    দুদিন দুরাত সেই আগ্নেয়গিরির খোল থেকে বেরুবার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম, কিন্তু কোনও ফল হল না। চারধারে পাথরের দেওয়াল কতকটা ঢালু হলেও এমন উলটোভাবে খাঁজ কাটা যে তা বেয়ে গড়িয়ে পড়া সহজ হলেও ওঠা একেবারে অসম্ভব।

    ইতিমধ্যে আগ্নেয়গিরির গরম জলের স্রোতের রহস্য আমরা বুঝে ফেলেছি। যে খোলের ভেতর আমরা পড়েছি তার দুদিকে দুটি ছোট ছোট ফোকর আছে। একদিকের ফোকর দিয়ে বাইরের তুষার ভেতরে এসে মাঝখানের একটা কড়াই এর মতো গর্তে জমা হয়ে নীচেকার প্রচণ্ড উত্তাপে ফুটে উঠছে। তারপর সেই ফুটন্ত জল আর একদিকের ঢালু ফোকর দিয়ে স্রোত হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। নামমাত্র একেবারে সেদ্ধ হয়ে যাবার ভয় না থাকলে সেই স্রোতের জলের সঙ্গেই বেরুবার চেষ্টা হয়তো আমরা করতাম, কিন্তু তার কোনও উপায় নেই।

    এদিকে প্রচণ্ড গরমে মারা যাবার আগেই আমাদের পাগল হবার উপক্রম। আগ্নেয়গিরিটা এখনও একরকম ঘুমন্ত বলা চলে। স্রোতের জলকে ফুটিয়ে তোলা ছাড়া তার কোনও উপদ্রব এখনও দেখা দেয়নি। কিন্তু দেখা দিতে কতক্ষণ!

    বাইরের তুষার-প্রান্তরে থাকলেও খুব বেশি দিন আমরা বেঁচে থাকতে পারতাম জানি, কিন্তু এই বদ্ধ গুহায় মরার চেয়ে সে যেন অনেক ভাল।

    দুদিন দুরাত ধরে এ গহ্বর থেকে বেরুবার ব্যর্থ চেষ্টায় হয়রান হয়ে সেনকে সেই কথা বলতে গিয়ে রাগের মাথায় ছড়িটা যে-ই গহ্বরের মেঝেতে ঠুকেছি অমনই এক ভয়ংকর আশ্চর্য কাণ্ড ঘটে গেল।

    দমকলের মুখ দিয়ে যেমন তোড়ে জল বেরোয় আমার ছড়ির ডগায় মেঝের সেই জায়গাটা ফুটো হয়ে তেমনই প্রচণ্ড বেগে সাতটা ইঞ্জিনের শিষের মতো আওয়াজ করে ধোঁয়াটে গ্যাসের পিচকিরি আগ্নেয়গিরির মুখ ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠল। গ্যাসের সে ফোয়ারা আর থামে না!

    সেই গ্যাসের তোড়েই সে যাত্রা বেঁচে গেলাম, বলে ঘনাদা থামলেন।

    অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, গ্যাসের তোড়ে বাঁচলেন কী রকম?

    একটু অনুকম্পার হাসি হেসে ঘনাদা বললেন, এটা আর বুঝতে পারলে না? কোমরে যে তাঁবুটা বাঁধা ছিল সেটা খুলে ধরে গ্যাসে ভর্তি করে নিলাম। তারপর দুজনে সেই বেলুনের দুদিকে দড়ি দিয়ে নিজেদের বেঁধে হাওয়ায় ভেসে গুহা থেকে বেরিয়ে এলাম।

    সেই বেলুনেই দক্ষিণ মেরু থেকে দেশে পৌঁছোলেন নাকি? গৌর গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলে।

    না, ও বেলুনে আর কতদূর যাওয়া যায়!ঘনাদা একটু যেন বিরক্ত হয়ে বললেন, সে বেলুন থেকে গিয়ে পড়লাম এক পাহাড়ের ওপর। সাধারণ পাহাড় সেটা নয়— বিরাট Iceberg অর্থাৎ বরফের পাহাড়। এই সময়ে এই সব বরফের পাহাড় ঝড়ের বেগে ক্রমশ উত্তর দিকে ভেসে যেতে যেতে গলতে থাকে। আমাদের পাহাড়টা যখন গলতে গলতে কোনওরকমে দুজনের দাঁড়াবার মতো ছোট হয়ে এসেছে তখন ভাগ্যক্রমে একটা তিমি-ধরা জাহাজ সেইখান দিয়ে যেতে যেতে আমাদের দেখতে পেয়ে আমাদের তুলে নেয়। আমরা ভাসতে ভাসতে যে ম্যাকওয়ারি দ্বীপ পর্যন্ত এসে পড়েছিলাম তা ভাবতেও পারিনি।

    ঘনাদা বলা শেষ করে শিশিরের দিকে ৩২৯৯তম সিগারেট ধার করবার জন্যে হাত বাড়ালেন।

    গৌর হঠাৎ বলে উঠল, ছড়িটা আপনি সাউথ জর্জিয়া থেকে কিনেছিলেন বললেন না! আমাদের পাড়ার মিত্র ব্রাদার্সও বোধহয় সেখান থেকে ছড়ি আমদানি করছে আজকাল। ঠিক এইরকম ছড়ি সেখানে ক-টা দেখলাম যেন!

    ঘনাদার সিগারেট ধার করা আর হল না। আমাদের, বিশেষ করে গৌরের, দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }