Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প646 Mins Read0

    লাট্টু

    ঘনাদা গম্ভীরভাবে বললেন, না, প্লেন নয়, লাট্টু।

    কোন সূত্রে আমাদের একেবারে থ করে দিয়ে ঘনাদা একথা বললেন, সেইটে আগে তাহলে বলি।

    পুজোর সময় দার্জিলিং যাবার কথা হচ্ছিল। ট্রেনে যাওয়ার হাঙ্গামও যত, সময়ও তত বেশি লাগে। তাই প্লেনেই যাবার ব্যবস্থা ঠিক করছিলাম। ট্রেনেই হোক আর প্লেনেই হোক ঘনাদার পক্ষে একই কথা হওয়া উচিত। কারণ, আসলে পরস্মৈপদী হয়ে তিনি আমাদের ঘাড়ে চড়েই যাবেন। ঘাড় অবশ্য আমরা সাধ করেই পেতে দিয়েছি। বিদেশে তিনি সঙ্গে থাকলে একটু ভাল জমবে বলে। কিন্তু প্লেনের নাম শুনেই তিনি এমন বেঁকে দাঁড়াবেন কে জানত!

    গৌর একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, প্লেনে যেতে আপনার আপত্তিটা কী? কোথায় একরাত একবেলা টিকিয়ে টিকিয়ে যেতেন, তার বদলে ঘন্টা-দেড়েকেই সব ঝামেলা শেষ।

    ঘনাদার কিন্তু তবু ধনুকভাঙা পণ, প্লেনে তিনি কিছুতেই চড়বেন না।

    অনেকক্ষণ ধরে রাজি করাবার চেষ্টা করে আমরা শেষ পর্যন্ত চটেই গেলাম। শিবু তো বলেই ফেললে, ঘনাদার বোধহয় ভয় করে প্লেনে!

    ঘনাদা তার দিকে যে দৃষ্টিটা হানলেন, তাতে শিবুর ভস্ম হয়ে যাবার কথা। কিন্তু শিবুর বোধহয়, অ্যাসবেসটসের চামড়া। এ দৃষ্টির সামনেও বেশ অক্ষত থেকে সে আবার অম্লানবদনে জিজ্ঞাসা করলে, প্লেনে কখনও চড়েননি বুঝি ঘনাদা?

    শুধু চোখের দৃষ্টিতে এ অপমানের উত্তর দেওয়া যায় না, তাই ঘনাদা এবার মুখ খুললেন। যতখানি সম্ভব অবজ্ঞার সঙ্গে বললেন, প্লেনে চড়া ছেড়ে দিয়েছি।

    ছেড়ে দিয়েছেন? কী দুঃখে? এবার প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপটা শিশিরের।

    এর ওপর আবার একটু ফোড়ন দিয়ে গৌর বললে, অত ধীরে-সুস্থে যাওয়া বোধহয় ঘনাদার পছন্দ না। ঘণ্টায় মাত্র তিন-চারশো মাইলে কি ঘনাদার পোয়!

    আহা, তিন-চারশো কেন? শিবু প্রতিবাদ করলে, জেট-প্লেন তো রয়েছে! ঘণ্টায় শুনি, ছশো মাইলও ছাড়িয়ে যায়।

    ঘণ্টায় ছশো মাইলের ওপর শুনেও ঘনাদার মুখে যে অবজ্ঞার হাসি ফুটে উঠল তাইতে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘনাদা যে জেট-প্লেনে চড়েছেন, তার বেগ বুঝি এর চেয়েও বেশি?

    ঘনাদা আমাদের স্তম্ভিত করে বললেন, হ্যাঁ, কিন্তু তা জেট-প্লেন নয়।

    জেট-প্লেন নয়? তাহলে অন্য কোনও প্লেন তো বটে? আমরা হতভম্ব হয়ে প্রশ্ন করলাম।

    কয়েক সেকেন্ড আমাদের দিকে অনুকম্পাভরে তাকিয়ে ঘনাদা বললেন, না, প্লেন নয়, লাটু।

    এই লাট্টু শুনেই বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে আমাদের মুখে আর কথাই সরল না।

    ঘনাদাই এবার করুণা করে তাঁর মন্তব্য পরিষ্কার করে বললেন, হ্যাঁ, লাটু, কিন্তু সে শুধু চেহারায়। তবে লেত্তি দিয়ে লোহার আলবাঁধা যে লাট্টু ছেলেবেলা ঘুরিয়েছ সে লাট্টু নয়, অনেকটা ছোটদের খেলার কলের লাটুর মতো—চেপ্টা চাকতির মতো সেগুলো দেখতে।

    এ পর্যন্ত শুনেই আমরা তখন পরে কী আসছে বুঝে, প্রস্তুত হয়ে বসে গেছি। আমাদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ঘনাদা শুরু করলেন, চার বছর আগে জানুয়ারি মাসের এক দুপুরবেলা ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকায় ত্রিশ জন যাত্রী নিয়ে যেতে যেতে একটি মাঝারি আকারের ড্যাকোটা বিমান আশ্চর্যভাবে যে নিখোঁজ হয়, এ খবর অনেকেরই হয়তো আর মনে নেই। এ দেশে না হোক, ইংল্যান্ডে ও আমেরিকায় এই নিয়ে তখন কিন্তু দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। এ-উত্তেজনা কিন্তু বেশি দিন থাকেনি। প্লেনের মালিকেরা ও মার্কিন সামরিক-বিভাগ একটা কৈফিয়ত দিয়ে সকলকে ঠাণ্ডা করে দিয়ে দিলেন। কৈফিয়তটা কিন্তু সম্পূর্ণ মিথ্যা।

    উড়োজাহাজটির নিখোঁজ হওয়া সত্যিই একটু অদ্ভুত ধরনের। জল ঝড় নেই, প্লেনের যন্ত্রপাতির কোনও গোলমাল হয়নি, তবু একেবারে আমেরিকার কূলের কাছে এসে শূন্য-আকাশে সকলের চোখের সামনে যেন উড়োজাহাজটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

    সকলের চোখের সামনে কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলছি মাত্র। সত্যি সত্যি চর্মচক্ষে দেখলেও, অন্তত দুটো এরোড্রোম ও একটি বোমারু বিমানের র‍্যাডার-স্ক্রিন তখন সেই প্লেনটির সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করছে।

    এই ঘটনার আধ মিনিট আগেও যাত্রীবাহী প্লেনটির সঠিক অবস্থান জানা গিয়েছে। ক্যানাডার পূর্বদিকে সমুদ্রের একেবারে ধারে—নোভা স্কোসিয়া। সেই নোভা স্কোসিয়ার লিভারপুলে, নয় হ্যালিফ্যাক্সের উড়োজাহাজের ঘাঁটিতেই যে প্লেনটি নামতে যাচ্ছে, সে কথাও তখন অজানা নেই। কিন্তু তারপরই লিভারপুল ও হ্যালিফ্যাক্স দুই জায়গার এরোড্রোমের র‍্যাডার-স্ক্রিন হঠাৎ অদ্ভুতভাবে নীরব হয়ে গেছে।

    ইংল্যান্ড থেকে আমেরিকা যাবার প্লেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ঘাঁটিতে না নেমে, নিরাপদ অবস্থাতেও ক্যানাডার মাটিতে কেন নামতে যাচ্ছিল সেটা একটা রহস্য মনে হতে পারে। যে কাহিনী বলতে যাচ্ছি, ওই রহস্যটুকু গোড়ায় না থাকলে তার সূত্রপাতই হত না।

    ইংল্যান্ডের ক্রয়ডন এরোড্রোম থেকে উড়োজাহাজটি যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশেই রওনা হয়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পার হবার পরই প্লেনের বেতার-যন্ত্রী একটি জরুরি আদেশ পায় ইংল্যান্ড থেকে—প্লেন যেন অবিলম্বে ইংল্যান্ডে ফিরিয়ে আনা হয়।

    আদেশের মর্ম না বুঝলেও, প্লেনের পাইলটের তা পালন করা অবশ্য কর্তব্য। ইংল্যান্ডের দিকেই আবার প্লেনের মুখ তাই ঘোরানো হয়, কিন্তু এ ব্যাপারে বিস্মিত ও বিরক্ত হওয়া যাদের পক্ষে স্বাভাবিক, সেই যাত্রীরা খানিক বাদেই বুঝতে পারে যে, কিছুদুর গিয়েই প্লেন আবার আমেরিকার দিকেই ফিরছে।

    ব্যাপারটা তাদের কাছে দুর্বোধ হলেও, ইংল্যান্ডের সামরিক ও পুলিশ বিভাগের কর্তাদের কাছে তখন আর নয়।

    সৌভাগ্য-কি-দুর্ভাগ্যক্রমে জানি না, ক্রয়ডনের পুলিশকর্তা মি. ডোনাটের বাড়িতে সেইদিনই আমি অতিথি। মি. ডোনাট এককালে নিউগিনির পোর্ট মোরেসবি বন্দরে কাজ করতেন। সেখানে গত যুদ্ধের আগে একটি জাপানি গুপ্তচরদের চক্রান্ত ধরে দেওয়ার ব্যাপারে আমি তাঁকে সাহায্য করেছিলাম। মি. ডোনাট সে ঋণের কথা ভোলেননি। যুদ্ধের পর ইংল্যান্ডে একরকম বেড়াতেই গেছি। কী করে জানি না, আমার খোঁজ পেয়ে ডোনাট সাদরে তাঁর বাড়িতে আমার নিমন্ত্রণ করে পাঠান।

    সাদর নিমন্ত্রণ করলেও, অতিথির সম্মান রাখা সেদিন তাঁর ভাগ্যে নেই। খাবার টেবিলে বসে সবে সুপের প্লেট শেষ করেছি, এমন সময় পাশের ঘরে তাঁর ফোন বেজে উঠল। মি. ডোনাট বিরক্ত হয়েই খাবার ফেলে উঠে গেলেন, কিন্তু ফোন সেরে ফিরে যখন এলেন তখন তাঁর মুখ আষাঢ়ের মেঘের মতো গম্ভীর।

    কী করে আপনার কাছে যে ক্ষমা চাইব বুঝতে পারছি না, মি. দাস, কিন্তু আপনাকে একলা ফেলে এখুনি আমার না গেলে নয়। মি. ডোনাট যে অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছেন তা তাঁর গলার স্বরেই বোঝা গেল।

    তাঁকে আশ্বস্ত করে হেসে বললাম, আপনি বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হবেন না। পুলিশের চাকরির মজাই যে এই, তা কি আমি জানি না মনে করেছেন? এখন ব্যাপারটা কী? খুন-জখম নিশ্চয়?

    খুন-জখম! মি. ডোনট একটু দুঃখের হাসি হেসে, টুপিটা মাথায় দিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন, খুন-জখম হলেই ভাল হত, তাহলে অন্তত এই এক সেকেন্ডের নোটিসে, তিন হাজার মাইল পাড়ি দিতে হত না।

    আমার মাথাটি কথার শেষের এই ধাঁধায় গুলিয়ে দিয়ে মি. ডোনাট বেরিয়ে গেলেন। খাওয়ায় তখন আর আমার রুচি নেই, তবু গৃহস্বামীর মান রাখতে যথাসাধ্য সেদিকে মন দিয়ে ব্যাপারটার অর্থ বোঝবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু খানিক বাদেই অবাক হয়ে দেখি, মি. ডোনাট আবার ফিরে এসেছেন।

    ঘরে ঢুকেই উত্তেজিতভাবে তিনি বললেন, আচ্ছা, মি. দাস, সের গ্যালিকো সম্বন্ধে আপনি কিছু জানেন?

    হেসে বললাম, আমায় এমন সবজান্তা মনে করছেন কেন যে, দুনিয়ার যে-কোনও একটা নাম শুনলেই পরিচয় বলতে পারব?

    মি. ডোনাট বেশ একটু অধৈর্যের সঙ্গেই বললেন, রসিকতার সময় নেই, মি. দাস। দু-এক মুহূর্তের দেরিতে হয়তো সমস্ত ইউরোপের সর্বনাশ হয়ে যেতে পারে। সেনর গ্যালিকো সম্বন্ধে যা জানেন, বলুন তাড়াতাড়ি!

    মি. ডোনাটের গলার স্বরে বুঝলাম, সত্যিই ব্যাপারটা গুরুতর। বললাম, সেনর গ্যালিকো সম্বন্ধে কী আপনি জানতে চান, বুঝতে পারছি না। গ্যালিকো তার শত নামের একটিমাত্র, এটা নিশ্চয় জানেন? দুনিয়ায় আজ পর্যন্ত অত বড় গুপ্তচর যে জন্মায়নি, তা-ও নিশ্চয় আপনাকে বলে দিতে হবে না।

    হ্যাঁ, সেসব জানি। কিন্তু গত যুদ্ধের শেষ দিকে প্লেন থেকে সাবমেরিনে ব্রেজিলে পালাতে গিয়ে সে যে সাবমেরিন-ড়ুবি হয়ে মারা যায় বলে খবর রটেছিল, তা সত্যি কিনা?

    সেকথা তো আমার চেয়ে আপনাদেরই ভাল জানবার কথা।

    মি. ডোনাট এবার বেশ বিরক্ত হয়েই উঠলেন, কেন মিছে কথা বাড়াচ্ছেন, মি. দাস! যদি কিছু জানেন তো, তাড়াতাড়ি বলুন।

    মি. ডোনাটের বিরক্তিতে হেসে ফেলে বললাম, বেশ, বলছি শুনুন। সেনর গ্যালিকো সাবমেরিন-ড়ুবি হয়ে মারা যায়নি। নিজের মৃত্যুর মিথ্যে খবর রটিয়ে সে এতদিন বেশ বহাল তবিয়তে আর্জেনটাইনে কাটিয়েছে বলেই আমি জানি। কিন্তু এতবড় জরুরি খবর যার কাছে জেনে নিচ্ছেন, ব্যাপারটা আসলে কী, তার তা জানবার অধিকার নেই?

    খুব আছে। সব কথা, যেতে যেতেই বলব। আসুন।

    অবাক হয়ে বললাম, সে কী! আমি যাব কোথায়?

    কোথায় তা এখনও জানি না। কিন্তু আপনাকে আসতেই হবে আমার সঙ্গে, মি. দাস। সেনর গ্যালিকোর ছদ্মবেশ ভেদ করে তাকে চেনার মতো দ্বিতীয় লোক এখন আর আমাদের হাতের কাছে নেই।

    গাড়ি বাইরেই তৈরি ছিল। রাস্তার নিয়মকানুন, হেলায় লন্ডভণ্ড করে দিয়ে বিদ্যুদবেগে সে গাড়ি, মিনিট কয়েকের মধ্যেই দেখলাম, ক্রয়ডন এরোড্রোমেই আমাদের পৌঁছে দিলে।

    সেখানে নেমে ব্রিটিশ সামরিক-বিভাগের যে মহাশয় ব্যক্তিটিকে দেখা গেল, ব্যাপারটা অত্যন্ত গুরুতর না হলে তিনি সশরীরে সেখানে হাজির থাকতেন না।

    আমাকে দেখে মি. ডোনাটকে কাছে ডেকে তিনি নিচু-গলায় কী জেনে নিলেন, তারপর এগিয়ে এসে আমার করমর্দন করে বলেন, আপনি যে-সাহায্য আমাদের করতে এসেছেন, তার জন্য সমস্ত ইউরোপ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।

    হঠাৎ শিবুর কাশিতে ঘনাদার কথায় ছেদ পড়ল। শিবুর কাশির ধরনটা সত্যি বড় বেয়াড়া। হাসি চাপতে গিয়ে কাশি বলে যদি কেউ তাকে সন্দেহ করে, তাকে খুব দোষ দেওয়া যায় না।

    কাশি শুনেই ঘনাদার মুখের চেহারা যা হল তাতে মাঝনদীতে ভরাড়ুবি হবার ভয়ে আমরা সবাই শিবুর ওপর একেবারে মারমুখো হয়ে উঠলাম।

    কাশবার আর সময় পেলি না! গৌর ধমকে উঠল।

    অত যদি কাশি, তো বাসক সিরাপ খেলেই হয়। শিশির মন্তব্য করলে রূঢ়ভাবে।

    কাশি পায় তো, বাইরে গিয়ে বোস! আমিও বকুনি দিতে ছাড়লাম না।

    বলা বাহুল্য, শিবুর কাশি তৎক্ষণাৎ থেমে গেল এবং ঘনাদা শান্ত হয়ে আবার শুরু করলেন।

    হেসে তখন বললাম, ইউরোপের কৃতজ্ঞতায় আমার কোনও লোভ নেই। গ্যালিকোর কাছে আমার একটা পুরোনো দেনা আছে শোধ দেবার, আমি সেই আশাতেই যাচ্ছি।

    কিছু দূরে যে বিরাট অদ্ভুত চেহারার প্লেনটা দাঁড়িয়ে ছিল, সেই দিকেই এবার সবাই অগ্রসর হলাম।

    প্লেনের কাছে এসে দ্বিধাভরে দাঁড়িয়ে পড়ে সামরিক-বিভাগের বড়কর্তা আমায় বললেন, একটা বিপদের কথা কিন্তু আপনাকে আগে বোধহয় জানিয়ে দেওয়া দরকার, মি. দাস। মি. ডোনাট তাঁর দেশের জন্য কর্তব্যের ডাকে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনি এসেছেন, স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে। যে প্লেনে আপনাদের পাঠাচ্ছি—

    তাঁর কথায় বাধা দিয়ে হেসে বললাম, সেটা কয়েকদিন আগে টেমসের খাঁড়ির ওপর যে জেট-প্লেন ফেটে গিয়ে মি. জিওফ্রে ডে হ্যাভিল্যান্ড প্রাণ হারান, তারই যমজ বলা যায়। আমি দেখেই তা চিনেছি। সুতরাং আপনার সংকুচিত হবার কিছু নেই।

    সামরিক বড়কর্তার নির্বাক বিস্ময়টুকু উপভোগ করেই প্লেনের ভেতরে গিয়ে উঠলাম।

    শব্দের চেয়ে যা আগে ছোটে, সেই সুপারসোনিক জেট বম্বার-এ উল্কাবেগে অতলান্তিক সাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে যেতে ডোনাটের কাছে সমস্ত ব্যাপারটাই ভাল করে জেনে নিলাম।

    ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই—কিছুদিন থেকেই ইংল্যান্ডের কর্তাব্যক্তিরা সন্দেহ করছিলেন যে অত্যন্ত চতুর কোনও গুপ্তচরের কারসাজিতে সামরিক বিভাগের অত্যন্ত গোপন সব সংবাদ কীভাবে যেন অদৃশ্য ছিদ্রপথে বার হয়ে যাচ্ছে। ঠিক আগের দিনই সে সন্দেহ যে মিথ্যা নয় তার নির্ভুল প্রমাণ পাওয়া যায়। দেশরক্ষা বিভাগের একজন বড়কর্তার সুরক্ষিত সিন্দুক থেকে অত্যন্ত মূল্যবান এক তাড়া কাগজ আশ্চর্যভাবে উধাও হয়ে গেছে। ফাইলটি তার আগের দিনই সে-সিন্দুকে রাখা হয়। এ-ফাইলে এমন কিছু আছে, শত্রুপক্ষ যা জানতে পারলে শুধু ইংল্যান্ড নয়, ইউরোপেরও সর্বনাশ হয়ে যাবে। খবরের কাগজে এসব কথা জানানো যায় না। পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ তাই গোপনে যা করবার সবই করেছে। ফাইল কীভাবে চুরি গেছে তারা এখনও বুঝতে পারেনি, কিন্তু ফাইল-এর সঙ্গে দেশরক্ষা বিভাগের অফিস থেকে নগণ্য যে একজন চাকর উধাও হয়ে গেছে, তার খোঁজ করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে গোখরোর সন্ধান তারা পেয়েছে। চুরির অপরূপ কৌশল দেখে তাদের ধারণা হয়েছে যে, বিশ্ববিখ্যাত গুপ্তচর সেনর গ্যালিকোরই কাজ এটা। কিন্তু সেনর গ্যালিকো বছর চারেক হল মারা গেছে বলে সবাই জানে। তা সত্ত্বেও এ মূল্যবান কাগজপত্র যেসব পথে ইংল্যান্ড থেকে বেরিয়ে যেতে পারে, তার সবগুলির ওপরই গোয়েন্দা বিভাগ কড়া নজর রেখেছে। যে-প্লেনটি ক্রয়ডন থেকে আমেরিকায় রওনা হয়, তার যাত্রীদের মধ্যেও একজন গোয়েন্দাকে সেজন্য রাখা হয়। প্লেনটি ছাড়বার সময় তার সমস্ত যাত্রীর পরিচয়ই অবশ্য ভাল করে খুঁটিয়ে দেখা হয়। তাদের কারুর পরিচয়েই কোনও পুঁত পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও প্লেনটি ছেড়ে যাবার পরই গোয়েন্দা পুলিশ এমন একটি সূত্র পায়, যাতে মনে হয়, ওই প্লেনেই গুপ্তচর তার চুরির মাল নিয়ে পালিয়েছে। তৎক্ষণাৎ বেতার-টেলিগ্রামে প্লেনটিকে তাই ফিরে আসবার আদেশ দেওয়া হয়। প্লেনটি ফিরেও আসছিল, কিন্তু হঠাৎ মাঝপথে কী যে হয় কিছুই বোঝা যায় না। প্লেনটি ইংল্যান্ডের দিকে না এসে, আবার ওপারের দিকেই যাত্রা করে। আমেরিকা ও কানাডার পূর্ব-উপকুলের সমস্ত এবোডড্রাম ও সামরিক ঘাঁটিকেই তখন সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে প্লেনটির অপেক্ষায় সতর্ক থাকবার জন্য। গুপ্তচর যদি সেনর গ্যালিকোই হয়, তাহলে অবশ্য তার মতো ধড়িবাজ না বার করতে পারে, এমন ফন্দি নেই। বিরাট আমেরিকার পূর্ব উপকূলে যে কোনও জায়গায় নেমে সে। সরে পড়তে পারে। তাই আমেরিকার যেখানে যত ঘাঁটি আছে, তারা তো র‍্যাডার-স্ক্রিনে আকাশের সমস্ত দিকের ওপর কড়া নজর রাখছেই, আমাদের এই পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুতগামী সুপারসোনিক বম্বারও পেছনে ছুটছে তাকে ধরবার জন্য। যাত্রীবাহী প্লেনটি কয়েক ঘণ্টার সুবিধে পেয়েছে সত্য, কিন্তু তার দৌড় ঘণ্টায় বড়-জোর সাড়ে তিনশো মাইল। আমাদের জেট বম্বার যেভাবে দূরত্বকে গিলে খায়, তাতে কয়েক ঘণ্টার তফাত তার কাছে কিছু নয়।

    কথাটা যে কতখানি সত্য, কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আমাদের র‍্যাডার-অপারেটার হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে জানালে, তার র‍্যাডার-স্ক্রিনে একটি উড়োজাহাজের সন্ধান সে পেয়েছে। আমরা যাকে শিকার করতে যাচ্ছি, সেই যাত্রীবাহী প্লেনটি বলেই মনে হয়। আমাদের বম্বারের বেগ, পাঁচশো থেকে ছশো মাইল বাড়িয়ে দেওয়া হল। আমরা আমেরিকার উপকূলের কাছে এসে পড়েছি। আর খানিক বাদে শুধু র‍্যাডার-স্ক্রিনে নয়, প্লেনটিকে চোখেই বোধ হয় দেখা যাবে।

    মি. ডোনাট ও আমি তখন র‍্যাডার-যন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে তার স্ক্রিনের দিকে উদগ্রীব হয়ে চেয়ে আছি।

    মি. ডোনাট বুঝি কিছুক্ষণের জন্যে অন্যমনস্ক হয়ে সামনের কাঁচের ভেতর দিয়ে বাহিরের দিকে চেয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন, ওটা আবার কী!

    চমকে মুখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে যা দেখতে পেলাম, তাতে একেবারে হতভম্ব হয়ে গেলাম। উইন্ড-শিল্ডের কাঁচের ভেতর দিয়ে, সামনের সমস্ত আকাশটাই দেখা যায়। সেই আকাশ-পটের এক প্রান্ত থেকে একটি অদ্ভুত আকারের জিনিস প্রায় বিদ্যুৎগতিতে আমাদের সামনে দিয়ে দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল।

    আমরা যা খালি চোখে দেখছি, র‍্যাডার অপারেটারও তার পর্দায় তার আভাস তখন পেয়েছে। অবাক হয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে, এটা আবার কী ব্যাপার! বিরাট কোনও উল্কা নাকি!

    উল্কা যে হতেই পারে না, তা তখন ভাল ভাবেই বুঝেছি। কিন্তু সুপারসোনিক জেট-বম্বারকে দ্রুতগতির পাল্লায় যা গোরুর গাড়ির মতো পেছনে ফেলে যেতে পারে—সে আকাশ-যান যে কী ও কাদের হতে পারে, ভেবে কোনও হদিস পেলাম না।

    যত অদ্ভুত ব্যাপারই হোক, আমরা যে উদ্দেশ্যে চলেছি, তা ছাড়া অন্য কিছুতেই আমাদের মন দেওয়া তখন উচিত নয়। কিন্তু হঠাৎ সেদিকেও আশ্চর্যভাবে বাধা পাব কে জানত!

    র‍্যাডার-স্ক্রিন থেকে বুঝতে পারছিলাম, আমাদের সামনের প্লেনটি আর বেশি দূরে নেই। বড়-জোর কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই তাকে আমরা ধরে ফেলব। কিন্তু হঠাৎ আমাদের স্তম্ভিত করে র‍্যাডার-স্ক্রিনটা যেন ঝাপসা হয়ে গেল। যন্ত্রপাতির কোনও গোলযোগ মনে করে অপারেটার সব-কিছু প্রাণপণে পরীক্ষা করে দেখলে, কিন্তু সেখানে কোনও ত্রুটিই পাওয়া গেল না।

    কয়েক সেকেন্ড বাদে, যেভাবে ঝাপসা হয়ে গেছল, সেইভাবেই পর্দা আবার পরিষ্কার হয়ে গেল বটে, কিন্তু চতুর্দিকে র‍্যাডার-তরঙ্গ পাঠিয়ে খোঁজ করেও আমাদের প্লেনটির আর কোনও পাত্তা পাওয়া গেল না। হঠাৎ প্লেনটি যেন শূন্য আকাশে হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেছে।

    এই ব্যাপার নিয়ে কাগজে কিছুদিন সোরগোলের পরই সামরিক বিবৃতিতে সব যে ঠাণ্ডা হয়ে যায় তা আগেই বলেছি। সামরিক বিবৃতিতে বলা হয় যে, প্লেনটি সমুদ্রের ওপরই ভেঙে পড়ে ড়ুবে গেছল। র‍্যাডার-স্ক্রিন ঝাপসা হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা একেবারে অস্বীকার করা হয়।

    কিন্তু, আসল কথা যে তা নয়, তা বলাই বাহুল্য। সাধারণে জানতে পারলে পাছে আতঙ্কগ্রস্ত হয়, সেইজন্যই ওরকম মিথ্যে খবর দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ লোককে আশ্বস্ত করলেও, দেশের ওপরওয়ালারা তখন রীতিমতো চিন্তিত হয়ে উঠেছেন।

    ইতিপূর্বে নানা দিকে বিশেষ করে আমেরিকার বহু জায়গা থেকে রহস্যজনক ওইরকম আকাশ-যানের সংবাদ বহুবার পাওয়া গেছে। দর্শকদের চোখের ভুল ও বাজে লোকের আজগুবি কল্পনা বলে উড়িয়ে দিয়েও সাধারণের গুজব বন্ধ করা যায়নি। এবার সামরিক কর্তারা নিজেরাও মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলেন যে, সাধারণের গুজবের মধ্যে কিছু সত্য অবশ্যই আছে। বাইরে উচ্চবাচ্য করলেও গোপনে গোপনে এ-বিষয়ে ব্যাকুলভাবে তাঁরা অনুসন্ধান চালাতে লাগলেন। সে অনুসন্ধানের কোনও ফলই কিন্তু পাওয়া গেল না। ব্যাপারটার কোনও হদিস না পেয়ে তাঁরা ক্রমশ দিশাহারা হয়ে পড়লেন।

    আজ পর্যন্ত দিশাহারা হয়েই তাঁদের থাকতে হত, যদি নিউ ইয়র্কের বাজারে মিল্ক, সেবল আর মাইন প্রভৃতি বিরল পশুলোমের দাম হঠাৎ অসম্ভব চড়ে না যেত।

    যাত্রী-প্লেনটির খোঁজ না পেয়ে আমরা তখন জেটবম্বার-এ আমেরিকাতেই নেমে নিউইয়র্কের এক হোটেলে আছি। দিন দুই বাদে, বিলেতেই আবার আমাদের ফিরে যাবার কথা। মি. ডোনাট আমার সঙ্গে এক ঘরেই ছিলেন। সেদিন সকালবেলা খবরের কাগজ পড়তে পড়তে বিরক্ত হয়ে তিনি কাগজটা ফেলে দিয়ে বললেন, এমন হুজুগে-জাত দুনিয়ায় নেই।

    ইংরেজরা মনে মনে মার্কিনদের ওপর একটু চটা জেনে হেসে জিজ্ঞাসা করলাম, মার্কিনদের আবার নতুন কী হুজুগ দেখলেন?

    কাগজটা তুলে আমার হাতে দিয়ে ডোনাট বললেন, দেখুন না, এত বড় বড় কাণ্ড দুনিয়ায় চলছে, তার জায়গায় কোথায় ল্যাব্রাডরে পশুলোম দুষ্প্রাপ্য হয়েছে তাই নিয়ে কাগজে হইচই লাগিয়ে দিয়েছে। আবার কোন এসকিমো শিকারি কী আজগুবি গল্প বানিয়ে বলেছে তা-ও সবিস্তারে ছাপা হয়েছে।

    কাগজটা পড়ে দেখলাম, ডোনাট ঠিকই বলেছে। সেবল, মিঙ্ক প্রভৃতি যেসব পশুলোম পৃথিবীর সেরা ধনীদের অত্যন্ত আদরের জিনিস, সেসব মেরুপ্রদেশ বিশেষ করে ল্যাব্রাডরের উত্তর-অঞ্চল থেকেই আমেরিকায় আসে। যারা ফাঁদ পেতে তুষার-অঞ্চলের এসব প্রাণী ধরে তাদের বলে-ট্র্যাপার। এবছর ট্র্যাপাররা তাদের শিকারের জায়গায় একটি প্রাণীর ল্যাজও দেখতে পায়নি। নানুক নামে সেখানকার একজন বুড়ো ট্র্যাপার নাকি এসকিমোদের কাছে এ বিষয়ে একটা আজগুবি গল্পও শুনে এসেছে। গল্পটা এই যে, ল্যাব্রাডরে এককালে যে-দেবতাদের ভয়ে কোনও সাদা মানুষ পা দিতে সাহস করত না, তাঁরা নাকি ফিরে আসছেন। পশুপাখিরা তাই ল্যাব্রাডর ছেড়ে পালাচ্ছে। এর পর মানুষকেও পালাতে হবে।

    এ গল্পের সঙ্গে, পাশে আর একটা খবর পড়ে আমি কিন্তু উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, মি. ডোনাট, তৈরি হয়ে নাও। এখুনি আমাদের ল্যাব্রাডরে যেতে হবে।

    তুমি কি পাগল হলে নাকি! মি. ডোনাট অবাক হয়ে বললেন, পরশু আমাদের বিলেতে যেতে হবে। এখন ল্যাব্রাডরে যাব কী!

    হ্যাঁ, ল্যাব্রাডরেই আমাদের যেতে হবে। বম্বার নিয়ে যাদের ফিরে যাবার তারা যাক। সেনর গ্যালিকো আর যাত্রী-প্লেনের রহস্য যদি ভেদ করতে চাও তো আমার সঙ্গে চলো।

    কিন্তু যাব কীসে? ল্যাব্রাডর তত আর বোস্টন শিকাগো নয় যে, ট্রেনে চেপে বসলেই হল।

    যাব, প্লেন ভাড়া করে। তুমি তৈরি হও।

    প্লেন ভাড়া করে সেইদিনই ল্যাব্রাডরের ব্যাটল হারবারে গিয়ে নামলাম। সেখান থেকে—বিশেষ ধরনে তৈরি, কতকটা শালতির মতো লম্বা মোটর-বোট ভাড়া করে হ্যামিলটন নদী দিয়ে চললাম ডাইক লেকের দিকে। ডাইক হ্রদে পৌঁছোবার আগে লবস্টিক হ্রদের কাছেই বিরাট হ্যামিলটন জলপ্রপাত। সেখান পৌঁছে মোটর-বোট ছেড়ে, হাঁটা-পথে রওনা হলাম একজন পথপ্রদর্শক নিয়ে। সে পথপ্রদর্শক আর কেউ নয়, নিউইয়র্কের কাগজে যার গল্প বেরিয়েছিল সেই এসকিমো ট্র্যাপার নানুক। ব্যাটল হারবারে নেমেই ফার অর্থাৎ পশুললামের ব্যবসাদারদের কাছে নানুকের খোঁজ করে জেনেছিলাম, হ্যামিলটন জলপ্রপাতের কাছে ট্র্যাপারদের প্রথম যে-চটি আছে, সেখানেই তাকে পাওয়া যাবে। ব্যবসা মন্দা হওয়ার দরুন সে আজকাল সেই চটির্তেই ফাইফরমাশ খেটে দিন কাটায়।

    আমরা ডাইক লেকেরও উত্তরে যেতে চাই শুনে প্রথমে নানুক আমাদের পথ দেখাতে রাজিই হয়নি। ভালরকম বকশিশের লোভ দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি করাই। রাজি হয়েও তার বিস্ময় কিন্তু সে চেপে রাখতে পারেনি। ডাইক লেকের উত্তরে কোনও জানোয়ার পর্যন্ত আজকাল পাওয়া যায় না। সেখানে কী সুখে আমরা যেতে চাই?

    তার কথার উত্তর না দিয়ে, পালটা প্রশ্ন করেছিলাম, হঠাৎ ও-অঞ্চলের অমন। দুর্দশা হবার কারণ কী?

    নানুক এমনিতেই কম কথা বলে। এ-প্রশ্নের উত্তরে অত্যন্ত গম্ভীর হয়ে বলেছিল, গেলেই জানতে পারা যাবে।

    জানতে সত্যিই শেষ পর্যন্ত পারা গেল। কিন্তু যা জানলাম তা সত্য, না স্বপ্ন, এখনও মাঝে মাঝে সন্দেহ হয়।

    পাঁচদিন হাঁটা-পথে চলবার পর আমরা সেদিন এ-অঞ্চলের শেষ একটি চটিতে রাত্রের মতো আশ্রয় নিয়েছি। চটিটি অবশ্য পরিত্যক্ত। পশুলোম দুষ্প্রাপ্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, চটি যারা চালায় তারা নিরুপায় হয়ে চলে গিয়েছে! শুধু জংলা-গাছের তৈরি তাদের আস্তানাটা আছে পড়ে।

    রাত্রে খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোতে যাব এমন সময় নানুক এসে খবর দিলে, জঙ্গলের পথে কে একজন লোক আমাদের এই চটির দিকেই আসছে।

    পশুপক্ষী পর্যন্ত সেখানে নেই, সেই শ্মশান রাজ্যে কে লোক এদিকে আসতে পারে! মি. ডোনাট তো অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, এই অন্ধকারে, লোক আসছে, তুমি দেখলে কী করে?

    দেখিনি, শুনতে পাচ্ছি! নানুক সংক্ষেপে জানালে।

    কান পেতে আমরা কিন্তু কিছুই শুনতে পেলাম না। মি. ডোনাট বিরক্ত হয়ে নানুককে কুনি দিতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে বাধা দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম যে, আমাদের কাছে যেমন ছাপানো বই, নানুকের কাছে তেমনই জঙ্গল। সে এখানে সামান্য ঝরাপাতা দেখে বা অস্ফুট একটা শব্দ শুনে যা বুঝতে পারে আমাদের পক্ষে তা অসাধ্য।

    নানুকের কথা যে সত্যি, খানিকবাদেই তার প্রমাণ পাওয়া গেল। বাইরের পদশব্দ এবার আমরাও শুনতে পেলাম। কিন্তু কে এই লোক? বন্ধু, না শত্রু? এ-অঞ্চলের অ্যালগনকুইন জাতির রেড-ইন্ডিয়ানরা, শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচারে আজকাল কখনও কখনও অত্যন্ত হিংস্র হয়ে ওঠে। সুবিধে পেলে, নির্জন জায়গায় তারা যে খুনজখম করতে দ্বিধা করে না, তার যথেষ্ট নজির আছে।

    পিস্তলটা বার করে তাই কোলের ওপর রাখলাম।

    কিন্তু পিস্তলের কোনও প্রয়োজন হল না।

    ক্লান্তপদে প্রায় টলতে টলতে যে-লোকটি কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল তাকে দেখে মি. ডোনাট ও আমি দুজনেই অবাক।

    মি. ডোনাট উঠেই তাকে ধরে ফেলে বললেন, এ কী, কর্নেল মিচেল! আপনি এখানে কোথা থেকে?

    আমিও উঠে দাঁড়িয়ে লোকটাকে ধরেছিলাম। তাকে আমাদের বিছানার ওপর বসিয়ে দিয়ে মি. ডোনাটের দিকে অবাক হয়ে ফিরে জিজ্ঞাসা করলাম, কর্নেল মিচেল কাকে বলছেন?

    বাঃ—এই তো আমাদের সামরিক বিভাগের গোয়েন্দা, কর্নেল মিচেল। যাত্রী-প্লেনে ইনিই তো পাহারা দেবার জন্য ছিলেন।

    তাই নাকি? একটু হেসে বললাম, আমি কিন্তু এঁর আরেকটা নাম জানি।

    আরেকটা নাম! মি. ডোনাট অবাক।

    হ্যাঁ। সে নাম হল—সেনর গ্যালিকো।

    আপনাকে ফাঁকি দেওয়া অসম্ভব, মি. দাস। ক্লান্তভাবে একটু হেসে গ্যালিকো তার জামার ভেতরের পকেটে থেকে একটি কাগজের প্যাকেট বার করে আমার হাতে দিয়ে বললে, যার জন্য এতদূর ধাওয়া করেছেন, এই নিন সেই ফাইল। এতে আর আমার দরকার নেই। গুপ্তচরগিরি আমার শেষ।

    কঠিন স্বরে বললাম, তোমাকে আমি চিনি, গ্যালিকো! তুমি কি ভেবেছ, সামান্য একটু অভিনয় করে আমায় ফাঁকি দেবে! এ ফাইল যে তুমি নকল করে রাখোনি তার প্রমাণ কী?

    প্রমাণ! গ্যালিকো একটু হাসলে, হ্যাঁ, বিপদ যতই থাক, এখনও আমার সঙ্গে গেলে বোধহয় তার প্রমাণ দিতে পারব। তখন আশা করি, বুঝবেন যে, পরস্পরের তুচ্ছ ক-টা অ্যাটমিক অস্ত্রের গোপন কৌশল জানবার জন্য আর জাতিতে জাতিতে আমাদের কাড়াকাড়ি মারামারির কোনও দরকার নেই। এখন শুধু আমায় একটু বিশ্রাম করতে দিন। কাল সকালে আমি আপনাদের প্রমাণ দিতে নিয়ে যাব।

    সত্যিই পরের দিন একটু সুস্থ হয়ে গ্যালিকো,নানুক বাদে, আমাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে, ডাইক হ্রদের উত্তর দিকেই রওনা হল। সেদিকে যত এগিয়ে যাই, ততই অবাক হয়ে যেতে হয়। ল্যাব্রাডর অত্যন্ত ঠাণ্ডা। মেরু-প্রবাহ-ঘেঁষা দেশ হলেও বন্ধ্যা তুষার-প্রান্তর নয়। ভূর্জ দেবদারু ইত্যাদি জাতের গাছ ও নানা লতাগুল্ম সেখানকার অধিকাংশ পাহাড়ি উপত্যকা ছেয়ে আছে। কিন্তু এদিকে সমস্ত গাছপালা কী এক অভিশাপে যেন বিবর্ণ হয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। জন্তু-জানোয়ার অনেক আগে থেকেই বিরল হয়ে আসছিল, এদিকে অগ্রসর হওয়ার পর একটা পাখির ডাকও সারাদিনে শোনা গেল না। দুদিন এইভাবে এগিয়ে আমরা যে অনুচ্চ পাহাড়ের ধারে গিয়ে পৌঁছোলাম, তার মাথা ডিঙিয়ে গেলেই পশ্চিমে ডাইক হ্রদ ও তার চারিধারের উপত্যকা পাওয়া যাবে।

    সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেছল বলে, এপারেই রাতটা কাটিয়ে, পরের দিন সকালে পাহাড়ের মাথা ডিঙিয়ে গিয়ে যা দেখলাম, তাতে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ডাইক হ্রদের চারিধারটা যেন একটা বিরাট ভাগাড়, গোরু-মহিষের নয়, এরোপ্লেনের! এত ভাঙা এরোপ্লেন এখানে কী করে জড়ো হল?

    গ্যালিকোই আমাদের মনের কথা অনুমান করে এবার সেই ভয়ংকর রহস্য আমাদের বুঝিয়ে দিলে।

    বললে, একরকম চোখের ওপর ঘটেছে বলে আমাদের প্লেনের অন্তর্ধানের ব্যাপারটাতেই তোমাদের টনক নড়েছে, কিন্তু তার আগে গত তিন বছর ধরে যে সব এরোপ্লেন নিখোজ হয়েছে, কোনও দুর্ঘটনাই তার কারণ হবে বলে লোকে অনুমান করে। কিন্তু অধিকাংশই তার দুর্ঘটনা নয়।

    কিন্তু এখানে এসব প্লেন এল কী করে? অবাক হয়ে ডোনাট জিজ্ঞাসা করলেন।

    যেমন করে আমাদের প্লেন এসে পড়েছিল। বলে গ্যালিকো সমস্ত বিবরণই এবার দিলে, আসল কর্নেল মিচেলকে তার ঘরেই বন্দী করে-কর্নেল মিচেল সেজে আমি গোপনীয় কাগজ নিয়ে প্লেনে এসে উঠি। ক্রয়ডন থেকে যখন প্লেন ফেরাবার হুকুম আসে, তখন বিপদ বুঝে, বম্বার-এর কন্ট্রোল রুমে গিয়ে কথা বলতে বলতে কৌশলে রেডিও অপারেটারকে বিষাক্ত উঁচ ফুটিয়ে অজ্ঞান করে ফেলি। পাইলট আর অপারেটার ছাড়া সে কামরায় কেউ থাকে না। পাইলট তার নিজের কাজেই তন্ময়। ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক অসুস্থতা বলে সে মনে করে। যেন নেহাত বাধ্য হয়ে আমি তখন অপারেটারের কাজ হাতে নিই এবং খানিক বাদেই পাইলটকে খবর জানাই যে, ক্রয়ডন থেকে ভুল করে প্রথম হুকুম পাঠানো হয়েছিল, এখন ভুল সংশোধন করে তারা আমাদের আবার আমেরিকা যেতেই বলেছে। পাইলট সরল বিশ্বাসে তাই করে। আমেরিকার কাছে প্রায় যখন পৌঁছে গেছি তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটে। হঠাৎ র‍্যাডার যন্ত্র বিকল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে এবোরাপ্লেনের ইঞ্জিনও। কিন্তু পড়ে না গিয়ে, কোনও অদৃশ্য শক্তির টানে আমাদের প্লেন অসম্ভব বেগে আরও উঁচুতে উঠে যায়। ওই অসম্ভব বেগ আর আকাশের ওপরের স্তরের হাওয়ার অভাব ও ঠাণ্ডায় সবাই প্রায় জ্ঞান হারায়। জ্ঞা। যখন ফিরে আসে, তখন দেখি এই এরোপ্লেনের ভাগাড়ে পড়ে আছি।

    কিন্তু আর-সব যাত্রীরা কোথায়?

    জানি না। হয়তো কোথাও চালান হয়ে গেছে। নিজে যে কীভাবে তাদের নজর এড়িয়ে বেঁচে গেছি, তা-ও বলতে পারি না। তবে, বেঁচে গেছি বলা ভুল, কারণ তারা…

    গ্যালিকোর অবান্তর কথায় বাধা দিয়ে বললাম, তারা বলছ কাদের? আর এখানে এসব প্লেন এনে ফেলার মানে-ই বা কী!

    তারা কারা, জানি না। চোখে অন্তত তাদের দেখিনি, দেখা যায় না বলেই আমার ধারণা। কিন্তু এখানে এসব প্লেন এনে ফেলার মানে তো অতি সহজ।

    কী মানে? ডোনাট অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন।

    গ্যালিকো অত্যন্ত দুঃখের হাসি হেসে বললে, কোনও অজানা জঙ্গলের দেশে আমাদের কোনও বৈজ্ঞানিক অভিযান পাঠালে প্রথম কী করা হয়? ভাল দেখে একটা থাকবার জায়গা বেছে, তার চারিধার পরিষ্কার করে যতদূর সম্ভব ওষুধ ছড়িয়ে বিষাক্ত পোকামাকড় ও জন্তু-জানোয়ার মারবার ব্যবস্থা করা হয়। ল্যাব্রাডরের এ-অঞ্চলে যে গাছপালা পশুপক্ষী আর নেই, তার কারণ, এদের এমন কোনও ওষুধ বা রশ্মি আছে যা আমাদের বিজ্ঞানের কল্পনার অতীত। নিজেদের থাকবার জায়গা নিরাপদ করে আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা তারপর কী করে? জঙ্গল থেকে যা-কিছু দরকারি মনে হয়, জ্যান্ত বা মরা, সংগ্রহ করে আনে পরীক্ষা করবার জন্যে। এরাও তাই করছে। এদের কাছে পৃথিবী একটা অজানা জঙ্গলমাত্র।

    কিন্তু এরা কী রকম জীব এবং কোথা থেকে এসেছে তার কিছু আভাস পেয়েছ?

    না, তা কিছুই পাইনি, তবে যাতে এসেছে তার একটা বোধহয় এখনও দেখাতে পারি, বলে গ্যালিকো এবার হ্রদের কাছে আমাদের নিয়ে গেল।

    সবিস্ময়ে দেখলাম, সেখানে ডাইক হ্রদের জলের ওপরে যে জিনিসটি ভাসছে, তাকে একমাত্র ছেলেদের খেলবার চাকতি লাটুর সঙ্গে তুলনা করা যায়। আকারে কিন্তু তা ছোটখাটো একটা জাহাজের মতো বিরাট।

    গ্যালিকো সেটা দেখিয়ে বললে, আমার ধারণা, গত বছর ধরেই এরা এখানে আসছে। এসে ক-দিন তাদের বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার মাল-মশলা সংগ্রহ করে নিয়েই আবার চলে যায়। এবার যাবার সময় কেন যে এটি ফেলে গেছে বলতে পারি না।

    হ্রদের ধারেই অনেক বড় বড় গাছ কাটা পড়েছিল। গ্যালিকোর কথা শেষ হবার আগেই আমি তার একটা হ্রদের জলে ভাসিয়ে তার ওপর ঘোড়ার মতো করে চেপে বসলাম।

    ওটা কী করছ, কী! ডোনাট অবাক হয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

    যা করছি, তোমরাও তা-ই করো। ও-যন্ত্রযানের ভেতর কী আছে দেখতে হবে। এক মুহূর্ত দ্বিধা করলেও গ্যালিকো ও ডোনাট তারপরই আমার মতো দুটি কাঠের গুঁড়ি নিয়ে ভেসে পড়ল।

    সেইভাবে হাত দিয়ে জল কেটে সেই বিরাট যন্ত্রযানটার কাছে গিয়ে, অনেক কষ্টে পোর্টহোলের মতো একটা বড় ফোকর খুঁজে পেয়ে, কোনওরকমে ভেতরে ঢুকলাম।

    ভেতরে তো ঢুকলাম, কিন্তু এ যন্ত্রযানের রহস্য তো কিছুই বোঝা যায় না। চারিধারে শুধু উজ্জ্বল রুপোলি একরকম ধাতুর দেওয়াল-দেওয়া করিডর এদিকে-ওদিকে চলে গেছে। এ যন্ত্রযান যাদের—তারা থাকে কোথায়, খায় কী, যন্ত্রযান চালায়ই বা কী করে?

    কী করে না তোক, কোথা থেকে চালায় খানিকবাদেই বুঝতে পারলাম মনে হল। যন্ত্র-যানের ঠিক মাঝামাঝি আগাগোড়া ঝাপসা কাঁচে-ঢাকা একটা ঘর, তার মাঝখানে একটা প্রকাণ্ড নিচ টেবিলের ওপর অসংখ্য নানা রঙের বোতাম যেন আঁটা আছে।

    আমি সেই বোতামগুলো এলোপাথাড়ি টিপতে শুরু করতেই ডোনাট হাঁ-হাঁ করে উঠল। ও কী করছেন, কী! কীসে কী হয়ে এটা হয়তো চলতে শুরু করবে।

    উত্তেজিতভাবে বললাম, আমি তো তা-ই চাই। এ যন্ত্রযান যদি ভ্য-জগতে নিয়ে গিয়ে, ভেঙে পড়েও মরি, তবু এর ভাঙা টুকরো থেকে আমাদের বৈজ্ঞানিকেরা হয়তো তাদের অজানা-বিদ্যা শিখতে পারবে।

    কথা বলতে বলতে বোতাম টিপে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ ঘরের ঝাপসা কাঁচ পরিষ্কার হয়ে গিয়ে ডাইক লেকের চারিধার ঘরের দেওয়ালে স্পষ্ট হয়ে উঠল। তারপর যেন বিদ্যুৎগতিতে সে হ্রদ নীচে কোথায় তলিয়ে গেল।

    আমরা আকাশে উঠেছি, উল্কাবেগে আকাশে ছুটে যাচ্ছি, কিন্তু কোন দিকে! নীচে যেন সাদা তুষার-প্রান্তর দেখা যাচ্ছে। তবে কি—উত্তর মেরুর দিকেই চলেছি? যেমন খুশি আবার আর কটা বোতাম টিপলাম। হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে যন্ত্রযান ঘুরে চলল। একি? ওই তো সেন্ট লরেন্স উপসাগর। নীচে যেন ম্যাপের মতো আঁকা রয়েছে। ওই তো নিউফাউন্ডল্যান্ড। আমরা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের দিকেই চলেছি। কিন্তু সমুদ্র যেন হু-হু করে আমাদের দিকে ছুটে আসছে! আমরা নীচে পড়ে যাচ্ছি নাকি? আর কয়েকটা বোম টিপলাম। হঠাৎ আবার পাক-খেয়ে আমাদের যন্ত্রযান উঠে যাচ্ছে। এবার শুধু আকাশ, আর নীচে মেঘের ফঁাকে অতলান্তিক সমুদ্র। খানিকক্ষণ এভাবে চললেই বোতামগুলোর রহস্য কিছু হয়তো বুঝতে পারব। তখন নিউ ইয়র্ক বা সেরকম কোনও শহরের কাছে কোনও হ্রদ বা উপসাগরে এ যন্ত্রযান নামানো শক্ত হবে না। উত্তেজনায় আমার সমস্ত শরীর তখন কাঁপছে! খুঁড়তে খুঁড়তে গোখরো নয়, একেবারে অজগর আমিই ধরব। কোথায় গুপ্তচরের সন্ধান, আর কোথায় দুনিয়ায় কেউ যা কখনও ভাবেনি সেই অন্য গ্রহের যন্ত্রযান দখল করে নিয়ে আসা! অ্যাটমিক বোমার যুগকেও যারা পেছনে ফেলে গেছে, তাদের বৈজ্ঞানিক বিদ্যার সন্ধান পাওয়া!

    হঠাৎ গ্যালিকো চিৎকার করে উঠল, ওই দেখো।

    দেখলাম এবং বুঝলাম, আমার সব আশায় ছাই পড়তে চলেছে।

    আকাশে হঠাৎ কোথা থেকে আমাদের মতো আরও তিনটি চাকতি-লাটু এসে উদয় হয়েছে। বুঝলাম, যন্ত্রযানের আসল মালিকেরা ফিরে এসেছে। ফিরে এসে তাদের যন্ত্রযান দেখতে না পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের খোঁজে বেরিয়ে এতক্ষণে সন্ধান পেয়েছে। এরা ওস্তাদ আর আমি চালাবার বিদ্যা কিছুই জানি না। এরা আমায় ধ্বংস করে ফেলবেই।

    তবু উন্মত্তের মতো বোতাম টিপে চললাম। আকাশে যেন চারটে উল্কার পাগলামির খেলা শুরু হয়ে গেল। এই আমি উঠি, তারা নামে। এই তারা আমাদের একেবারে গা ঘেঁষে চলে যায়।

    হঠাৎ কীভাবে জানি না তাদের অনেক দূর পিছিয়ে ফেলে আমাদের যন্ত্রযান ছুটে বেরিয়ে গেল। আমি বোতাম টেপা ছেড়ে দিয়েছি। তারা কিছুতেই আর দৌড়ের পাল্লায় পারছে না। আমাদের যন্ত্রযান অতলান্তিকের ওপর দিয়ে আমেরিকার দিকেই চলেছে। ভেঙে পড়তে হয় সেখানেই গিয়ে পড়ব।

    কিন্তু তা আর হল না। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝাঁকুনি খেয়ে বুঝতে পারলাম, আমাদের যন্ত্রযান থেমে গেছে। থেমে, দুরন্ত বেগে নীচের সমুদ্রে পড়ছে। কোনও অদৃশ্য শক্তিতে তারা আমাদের কল বিগড়ে দিয়েছে।

    সমুদ্রে পড়ার আগে পর্যন্ত মনে আছে। তারপর যখন জ্ঞান হল তখন জেলেদের একটা ট্রলারে শুয়ে আছি। ডোনাট আর গ্যালিকো যন্ত্রযানের সঙ্গেই অতলান্তিকের অতলে তলিয়ে গেছে।

     

    ঘনাদা প্রকাণ্ড একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করলেন। শিবুর কাশি আবার শুরু হতেই, গৌর তাকে ধমক দিয়ে শাসিয়ে বললে, আচ্ছা, আপনি হঠাৎ ডাইক হ্রদের দিকে যাওয়ার হদিস পেলেন কোথায়?

    ঘনাদা একটু হেসে বললেন, ডোনাটও একথা জিজ্ঞাসা করেছিল। হদিস পেয়েছিলাম যে উড়ন্ত-চাকতি নিয়ে আমেরিকায় এখনও হুলুস্থুল চলছে, তার সমস্ত গুজব ভাল করে বিশ্লেষণ করে। সেই সমস্ত গুজব থেকেই মনে হয়েছে এই সব লাট্টু আকারের অদ্ভুত জিনিসগুলি আমেরিকার উত্তর-পূর্ব কোনও দিক থেকেই সাধারণত প্রথম দেখা দিয়েছে। এর সঙ্গে ল্যাব্রাডরের পশুলোমের ব্যবসায়ে মন্দা পড়ার খবর যোগ দিয়েই আমার মনে হয়, পশুলোম যেখান থেকে বেশি পাওয়া যায় সেই ডাইক হ্রদের কাছেই সুত্র পাওয়া যেতে পারে।

    শিবুর কাশি এবার আর ধমক দিয়েও থামানো গেল না। ঘনাদা বিষদৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে মনের ভুলে বোধ হয় শিশিরের গোটা সিগারেটের টিনটাই হাতে নিয়ে উঠে গেলেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র
    Next Article প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }