Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    ভারত-যুদ্ধে পিঁপড়ে

    ভারত-যুদ্ধে পিঁপড়ে! সে আবার কী?

    শুনে হাসি পাচ্ছে তো? কথাটা বিশ্বাস হচ্ছে না? কাঠবিড়ালিরাও যেমন কাজে লেগেছিল, ভারত-যুদ্ধে মানে কুরুক্ষেত্রের সেই মহাযুদ্ধে পিঁপড়েদেরও সেইরকম কোনও মদত ছিল বলে মনে হচ্ছে হয়তো।

    না, সরাসরি ভারত-যুদ্ধে পিঁপড়েদের কোনও পার্ট ছিল বলে জানা নেই। তবে—যাক, বলেই ফেলা যাক—পিঁপড়েদের—না, বহুবচনটা ভুল, আসলে— একটি ক্ষণজন্মা পিঁপড়ে তার কেরামতিটুক না দেখালে ভারত-যুদ্ধের প্রামাণিক ইতিহাসে ওই পাঁচ লহমার ফাঁক মানে ফাঁকিটুকু থাকত না।

    ক্ষণজন্মা পিঁপড়ে! তার কেরামতিতে ভারত-যুদ্ধের ইতিহাসে ফাঁক?

    কেরামতিটা কী?

    তা বোঝবার জন্য গোড়া থেকে শুরু করা উচিত। একেবারে বাহাত্তর নম্বরের সেই দোতলার আড্ডাঘরে বত্রিশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে শুরু এক রবিবারের গুমোেট সকালবেলায়।

    কাগজে আবহাওয়ার পূর্বাভাষ দিয়েছে সারাদিন ভ্যাপসা গরম, বিকালে

    বজ্রবিদ্যুৎসহ প্রচুর বৃষ্টির সম্ভাবনা।

    কাগজে তো হপ্তাভোর রোজই ওই ভাঁওতা দিচ্ছে। কিন্তু সব ভরসাই ফরসা। না আকাশ, না টঙের ঘর থেকে এক ছিটেফোঁটা বর্ষণের লক্ষণ পাচ্ছি।

    আকাশে কি টঙের ঘরে বজ্র-বিদ্যুৎ অবশ্য নেই। কিন্তু তাতেই তো আরও জ্বালা।

    বজ্র-বিদ্যুতের জায়গায় দুবেলা কোকিলের বদলে দাঁড়কাক গিলে খাওয়া গলার অমৃতসমান মহাভারতের কথা শুনছি।

    কখনও—

    গোপালের চরিত্র দেবের অগোচর।
    অন্য কে কহিতে পারে ত্রৈলোক্য ভিতর।।
    ব্রহ্মাণ্ড বলি যে এক চতুর্দশ লোকে।
    বিরাট পুরুষ ধরে এক লোমকূপে॥
    তিল অর্ধ কোটি সে ব্রহ্মাণ্ড ধরে গায়।
    এমত বিরাট যার নিঃশ্বাসে প্রলয়॥

    কখনও বা—

    অশ্বত্থামা নামে হস্তী তার তুল্য অন্য নাস্তি
    এমনই উত্তম গজবর।
    বর্ণে তিনি জলধর, ঈষা সম দন্ত সর
    দেখিতে বড়ই ভয়ঙ্কর॥
    তাহে আরোহণ করি, আসে কুরু অধিকারী
    যথা আছে বীর বৃকোদর।
    হাতে গদা ঘঘারতর, রোষযুক্ত নৃপবর
    ভীমসেন করিতে সমর।

    গলাটি কার তা আর বলে দিতে হবে না নিশ্চয়।

    হ্যাঁ, সেই একমেবাদ্বিতীয়ম তেতলার টঙের ঘরে তিনি কিছুদিন ধরে আর সব ছেড়ে মহাভারত ধরেছেন। আমরাও সেই সঙ্গে পথে বসেছি।

    সময়ে অসময়ে তাঁর নিজস্ব ট্রেডমার্ক-মারা গলায় ওপর থেকে কাশীরাম দাসের পয়ার ভেসে আসে। সে পয়ারের ঢেউ ঠেলে কোনওরকমে যদি তাঁর কাছে গিয়ে পৌঁছই, তিনি যেন মহাভারতের অমৃতরসে ড়ুবে আমাদের দেখতেই পান না।

    তাঁর মতিগতি একটু ফেরাবার আশায় স্বস্ত্যয়নের উপচার জোগাতে আমরা কিছু ত্রুটি করিনি এ পর্যন্ত। কখনও আমিষ কখনও নিরামিষ, সাত্ত্বিক বা তামসিক বেশ কিছু আমাদের সমভিব্যাহারে গিয়েছে।

    নৈবেদ্য সামনে ধরে দিয়ে আমরা একান্ত বশংবদ হয়ে এধারে ওধারে বসেছি। তাঁর শূন্য দৃষ্টি দু-একবার আমাদের দিকে ফিরলেও এ স্থূল বর্তমান ভেদ করে সেই সূদূর হস্তিনাপুরেই বোধ হয় চলে গেছে। আমরা যে তাঁর গোচরীভূত তার কোনও প্রমাণ পাইনি।

    শুধু দক্ষিণ হস্তটা তাঁর নিজের অজান্তেই প্লেটের প্রত্যক্ষ বর্তমানের ওপর প্রসারিত হয়েছে। অচেতনভাবেই মুখে গিয়ে পৌঁছেছে তারপর।

    সেখানে যান্ত্রিক দন্ত নিষ্পেষণ চলতে চলতে হঠাৎ ক্ষণিকের জন্য থামায় আমরা শশব্যস্ত হয়ে বলার সুযোগ পেয়েছি—কবিরাজিটা কি জুত হয়নি, ঘনাদা? একেবারে টাটকা ভাজিয়ে এনেছি কিন্তু!

    ঘনাদার কর্ণকুহরেই বোধ হয় কথাগুলো প্রবেশ করেনি। সাড়ে তিন হাজার বছর ছাড়িয়ে গিয়ে কৃষ্ণার্জুনের কাছে অগ্নিদেবের খিদের বায়নাই তিনি তখন শুনছেন।

    হাসিয়া কহেন পার্থ, কহ বিচক্ষণ।
    কোন ভক্ষ্য দিলে তৃপ্ত হইবা এক্ষণ॥
    আমি অগ্নি, বলি দিয়া নিজ পরিচয়।
    আশ্বাস পাইয়া বলে অগ্নি মহাশয়॥
    ব্যাধিযুক্ত বহুকাল আমার শরীর।
    নিব্যাধি কহ মোরে পার্থ মহাবীর॥
    খাণ্ডব বনেতে বহু জীবের আলয়।
    সেই বন ভক্ষ্য মোরে কর ধনঞ্জয়॥
    উদর পুরিয়া খাই এই অভিরুচি।
    কোনও পশুপক্ষী মৎস্যে নাহিক অরুচি।।

    অগ্নিদেবের খিদের আবদার শোনাতে শোনাতে খাণ্ডব বনের অভাবে সামনে ধরে দেওয়া প্লেটগুলো ঘনাদা চেটে পুটে সাবাড় করেছেন। আমাদের উপস্থিতি টের পাবার কোনও লক্ষণই কিন্তু দেখা যায়নি।

    মনে মনে গজরাতে গজরাতে নীচে নেমে এসেছি সবাই। আর তারপরই ঘনাদাকে কাত কবার এই নতুন মতলব ভাঁজা হয়েছে।

    ফন্দিটা বিষে বিষক্ষয়, মানে যাকে বলে অটোভ্যাক্সিন। যা দিয়ে আমাদের জ্বালাচ্ছেন তাই দিয়ে ঘনাদাকে জব্দ করাই অর্থাৎ তাঁর ওপরই মহাভারত চাপানো।

    সকাল থেকেই আমাদের তর্কটা শুরু হয়েছে। ঘণ্টার কাঁটা ছ-টা থেকে সাতটার দিকে যত এগিয়েছে আমাদের গলা ধাপে ধাপে তত তেতলার টং পর্যন্ত পৌঁছেছে নিশ্চয়।

    একদিকে শিবু আর আমি, অন্য দিকে গৌর আর শিশির।

    তর্ক তো নয়, যেন দ্বিতীয় কুরুক্ষেত্র।

    ছ-টা একুত্রিশে শিবুর হাঁক ন্যাড়া সিঁড়িটা বোধহয় পেরিয়ে গেছে, আলবত হারত পাণ্ডবেরা।

    কখনও না! শিশিরের প্রতিবাদ খোলা ছাদ পর্যন্ত নিশ্চয়।

    কচুকাটা হত তা হলে! আমি গলাটা টঙের ঘরে পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পেরেছি বোধহয়।

    ওপরে ঘনাদার সুরেলা মহাভারত শোলোক আওড়ানো হঠাৎ যেন থেমেছে। এই জিরো আওয়ার বুঝে নিজেদের গলার পেছনে আমরাও এবার ন্যাড়া সিঁড়ি বেয়ে টঙের ঘরের দিকে পা বাড়িয়েছি। পেছন দিকে তাকিয়ে খাবারের ট্রে সমেত বনোয়ারি ঠিক হিসেব মতে হাজির হবার জন্য তৈরি কি না দেখে নিতে ভুলিনি।

    তারপর টঙের ঘরে গিয়ে দোতলার তর্কটা একেবারে যেন তপ্ত ভোলা থেকে নামিয়ে দিয়েছি ঘনাদার সামনে।

    গৌর প্রায় বিধানসভার মেজাজ নিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে ঘনাদার কাছে স্পিকারের রুলিং চেয়েছে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে—শুনেছেন, শুনেছেন এদের কথা! বলে পাণ্ডবরা নাকি গোহারান হারত কুরুক্ষেত্রে!

    হারতই তো, শিবু তাল ঠুকেছে ঘনাদার তক্তপোশটাই চাপড়ে, দুর্যোধন অমন গবেট না হলে তুলো ধোনা হত পাণ্ডবেরা।

    তুলোধোনা হত পাণ্ডবেরা! শিশির আর গৌর যেন অর্জুনের গাণ্ডীব আর ভীমের গদা-ই হাতে নিয়ে হুংকার দিয়েছে, কে তুলোধোনা করত, কে? দুর্যোধনের নিরানব্বই-এর বদলে আরও নশো নিরানব্বইটা ভাই থাকলেও তাতে কুলোত না।

    দুর্যোধনের ভাইদের আবার ডাকা কেন? আমি গলায় একেবারে লঙ্কাবাটা মাখিয়ে বলেছি, তাদের মাঠে নামবার দরকার হত না। গ্যালারিতে বসেই তারা ফাইন্যাল দেখতে পেত। দেখত কর্ণ—হ্যাঁ, একা সূতপুত্র কর্ণ কেমন করে কুরুক্ষেত্রের কাঁকুরে মাটিতে পাঁচ ভাই পাণ্ডবের নাকগুলো ঘসে দেয়। নেহাত দুর্যোধন নিজের আহাম্মুকিতে রেফারিকেই খচিয়ে দিলে তাই।

    কথাগুলো বলতে বলতে আড়চোখে ঘনাদার দিকে অবশ্য নজর রেখেছি। এত পাঁয়তারা যে জন্য কষা সে মতলব একটু হাসিল হচ্ছে কি?

    কোথায়—

    ঘনাদা তাঁর কাশীরাম দাসের বিরাট গন্ধমাদনটি সামনে খুলে ধরে শোলোক আওড়ানো থামিয়েছেন বটে, কিন্তু নিজে যেন তাঁর এই টঙের ঘরেই আর নেই। দেহটা শুধু ফেলে রেখে কুরুক্ষেত্রেই বুঝি চরতে গেছেন।

    তা গেছেন, যান। ফিরতে যাতে হয়, তার জন্য নারাচ, নালিক, পাশুপত থেকে ব্রহ্মাস্ত্র পর্যন্ত সবরকম অস্ত্রের ব্যবস্থা না করে আজ আমরা আসিনি।

    দু-এক সেকেন্ডের ফাঁক যা পড়েছিল রেফারি কথাটার খেই ধরে তা ঢেকে গৌর খিঁচিয়ে উঠল রেফারি! রেফারি আবার কে?

    রেফারি কে জানো না! সঙ্গে সঙ্গে শিবুর টিটকিরি আর আমার নব মহাভারত পাঠ শুরু।

    শিশির আর গৌরের দিকে চেয়ে কানমলা দেওয়া গলায় বললাম, মহাভারতটাও পড়িসনি! শোন তা হলে—

    মহাভারতের কথা কী কহিব আর।
    কী হলে যে কী হইত অন্ত পাওয়া ভার।।
    দুর্যোধন দুর্ভাগার মতিচ্ছন্ন হইল।
    পদতল ছাড়িয়া বুদ্ধ শিয়রে বসিল॥
    তাই না চটে চতুর কৃষ্ণ গাড়োয়ান হইয়া।
    পাণ্ডু বয়েজ টিমকে দিলেন ম্যাচটা জিতাইয়া॥
    চালের ভুলে রুষ্ট যদি না হতেন রেফারি।
    কুরুক্ষেত্রে যায় কুরুরা পেনাল্টিতে হারি?॥

    ঘনাদার দিকে চোখ রেখেই পদগুলো আওড়াচ্ছিলাম, কিন্তু শুভলক্ষণ কিছু দেখলাম না। ঠিক কুরুক্ষেত্রে না থাকলেও এখনও হস্তিনাপুর ছেড়ে তিনি আসতে প্রস্তুত নন মনে হল।

    ঠিক ঘড়ির কাঁটায় সাতটা বাজতে পাঁচ মিনিট। বনোয়ারি তখন ঘরে ঢুকে ঘনাদার সামনে খাস্তা কচুরির আর অমৃতির প্লেট দুটো ট্রে থেকে নামিয়ে রাখছে।

    ঘনাদার মুখের ভাব দেখে মনে হল এবারে তাঁর হস্তিনাপুরের প্রবাস থেকেই তিনি আনমনে সে প্লেটে হাত বাড়াতে দেরি করবেন না। ব্রহ্মাস্ত্রটা চটপট তাই প্রয়োগ করতে হল এবার।

    ঘনাদার লুব্ধ হাত প্লেটে এসে পৌছবার আগেই দুদিক থেকে গৌর ও শিবু চক্ষের নিমেষে দুটি প্লেট তুলে নিয়ে বনোয়ারিকে ধমকে উঠল কী, হচ্ছে কী এসব! যখন তখন খাবার দিলেই হল! এখন এসব কে আনতে বলেছে।

    বনোয়ারি অভিনেতা নয়। আগে থাকতে অনেক শেখানো পড়ানো সত্ত্বেও গৌর শিবুর ধমক খেয়ে সে সব ভুলে তোতলা হয়ে গিয়ে দুবার শুধু হামি হা..মি…তো গোছের কিছু একটা উচ্চারণ করল। আমাদের মতলব হাসিলের পক্ষে তাই কিন্তু যথেষ্ট।

    ঘনাদার মুখের চেহারাটা তখন সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার হস্তিনাপুর। থেকে এক ঝটকায় উনিশশো পঁচাত্তরের বাহাত্তর নম্বরে এসে পড়ার জন্যই বোধহয় বেশ একটু ভ্যাবাচাকা।

    আর যাই হোক এরকম একটা অবস্থার কথা তিনি কল্পনা করতেই পারবেন না জেনে মতলবটা ভাঁজা হয়েছিল।

    কচুরি অমৃতির প্লেট দুটো বোয়ারির ট্রেতে তুলে তাকে চলে যাবার হুকুম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাজ যা হবার হল।

    ঘনাদা অবশ্য এইটুকুর মধ্যেই নিজেকে সামলে নিয়েছেন। সেই ভ্যাবাচাকা ভাবটা মুখ থেকে মুছে এতক্ষণে যেন আমাদের সম্বন্ধে সচেতন আর বনোয়ারির প্রতি করুণাময় হয়ে উঠলেন, আহা, বেচারাকে মিছে কষ্ট দেওয়া কেন? আবার তো সেই আনতেই হবে ওকে!

    ওগুলো রেখে যেতেই বলছেন! আমাদের গলায় একটু মৃদু প্রতিবাদের সুরই ফোটালাম, কিন্তু আমাদের জরুরি কথাগুলো…

    কী তোমাদের জরুরি কথা বলো না! ঘনাদা বনোয়ারির হাত থেকে পুরো ট্রেটা একরকম কেড়ে নামিয়ে নিলেন, এগুলোর তো আর গলা নেই যে গোলমাল করবে। বলে ফেললা কী তোমাদের জরুরি কথা!

    ঘনাদার শেষ কথাগুলো মুখে ঠাসা কচুরি ভেদ করে একটু জড়ানো অবস্থাতেই বার হল। আবার পাছে মুখের গ্রাস ফসকে যায় এই ভয়ে তিনি তখন প্রায় দুহাতে কচুরি আর অমৃতি মুখে বোঝাই করছেন।

    তা যা করেন, করুন। আমরা এতদিনে তাঁকে বাগে পেয়েই খুশি। বেশ একটু জমিয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলাম, জরুরি কথাটা কী, তা এখনও বোঝেননি? শুনুন না ওই আহাম্মকের কথা। বলে কিনা কৌরবরা কিছুতে হারত না!

    আহাম্মকেরা মানে শিশির আর গৌর। তারাও ঠিক সিনেরিও মাফিক ঝাঁপিয়ে উঠল—কখনও হারত না, কিছুতেই হারত না।

    শুনলেন? শুনলেন তো!—একটা জমজমাট বৈঠকের আশায় জ্বলজ্বলে চোখে ঘনাদার দিকে তাকালাম—এই ওদের মহাভারতের বিদ্যের দৌড়! কুরুক্ষেত্রে পাণ্ডবদের জিৎ নাকি হতই! আপনিই বলুন তো ঘনাদা!

    ওই উসকানিটুকু দিয়েই আমরা চুপ। ঘনাদার বাঁধানো দাঁতে মচমচে অমৃতি চিবানোর শব্দ ছাড়া ঘরে আর আওয়াজ নেই। যে খেইটা জুগিয়ে দেওয়া গেছে তা থেকে কী গুলগল্পর গালিচা ঘনাদা বুনে তোলেন তা দেখবার জন্য আমরা একেবারে উদগ্রীব।

    কিন্তু ঘনাদা অমন করে শোধ নেবেন তা কি জানি! শোধ তাঁর মুখের খাবার সরিয়ে নিয়ে তাঁকে দাগা দেবার।

    গালচের আশা একেবারে খঞ্চেপোশে কুঁকড়ে দিয়ে ঘনাদা যেন মর্স কোডে জানালেন, তাই!

    তাই! কী তাই? আমরা যেমন হতাশ তেমনই অস্থির। পাণ্ডবদের জিৎ হত-ই বলতে চান?

    হ্যাঁ। এবার ঘনাদার সংক্ষিপ্ত সরল জবাব।

    দুর্যোধন যদি দলে টানতে গিয়ে ঘুমন্ত শ্রীকৃষ্ণের শিয়রে না বসে পায়ের দিকে বসত তবুও? আমরা শেষ আশায় যেটুকু সাধ্য চাগাড় দিলাম।

    যদি কেন, পায়ের দিকেই তো বসেছিল দুর্যোধন! ঘনাদা এতক্ষণে বোমাটি ছাড়লেন।

    পায়ের দিকেই বসেছিল দুর্যোধন? চোখগুলো যতটা পারি ছানাবড়া করে বললাম, কিন্তু মহাভারতের কোথাও তো নেই! পায়ের বদলে মাথার দিকেই দুর্যোধন বসেছিল বলে তো লেখা আছে।

    লেখা আছে যা তাও ঠিক?

    তাও ঠিক? ঘনাদার ধাঁধায় এবার একটু কাবু হয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, পায়ের দিক মাথার দিক হয় কী করে?

    হবার কারণ অতি সোজা! ঘনাদার মুখে যেন একটু অনুকম্পার হাসি, শ্রীকৃষ্ণ ঘুমের মধ্যে উলটে শুয়েছিলেন বলেই পায়ের দিকটা মাথার দিক হয়ে গিয়েছিল।

    ঘুমের মধ্যে উলটে শুয়েছিলেন শ্রীকৃষ্ণ? এবার আর আমাদের অবাক হবার ভান করতে হল না।

    হ্যাঁ, উলটে শুয়েছিলেন। ব্যাখ্যা করলেন ঘনাদা, দুর্যোধন বোকা যেমন নয়, তেমনই গড়িমসি আলসেমিও তার ধাতে নেই। অর্জুন রথে ঘোড়া জুতে রওনা হতে না হতেই দুর্যোধন শ্রীকৃষ্ণের শিবিরে এসে হাজির। বাসুদেব ঘুমোচ্ছেন শুনে সে শোবার ঘরেই গেল অপেক্ষা করতে। ঘরে ঢুকেই সে কিন্তু একটু ফাঁপরে পড়ল। ঘুমন্ত বাসুদেবের মাথার দিকে যেমন পায়ের দিকেও তেমনই একটি করে আসন পাতা। এখন কোথায় তার বসা উচিত। ভেবে-চিন্তে শেষ পর্যন্ত সে পায়ের দিকেই বসল।

    শ্রীকৃষ্ণ এবার পড়লেন মুশকিলে। তাঁর তো কপট নিদ্রা। যা ভেবেছিলেন দুর্যোধন তার উলটোটা করেছে জেনে, আর কোনও উপায় না পেয়ে নিজেও তিনি ঘুমের মধ্যেই যেন স্বপ্নে উঠে পড়ার ভান করে উলটে শুলেন।

    দুর্যোধন আহাম্মক নয়, কিন্তু অহংকারী। শ্রীকৃষ্ণকে ঘুমের মধ্যে উলটে শুতে দেখে তার দেমাকে একটু সুড়সুড়িই লাগল। ভাবল, বাসুদেবের ঘুমের মধ্যেও তার মতো রাজাগজাকে পায়ের দিকে রাখতে বাধছে। এই দম্ভেই হল তার মরণ। নইলে মাথা থেকে আবার পায়ে গিয়ে বসতে পারত না!

    কিন্তু? আমরা সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এসব কথা মহাভারত থেকে সরালে কে? সেই আপনার ভীমসেন দারুক আর বনবরা মার্কা মূষিক কোম্পানি?

    না। ঘনাদা বনোয়ারির সদ্য এনে হাজির করা চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে একটু হাসলেন, এ বৃত্তান্ত সরাবার দরকার হয়নি, কারণ লেখাই হয়নি মহাভারতে।

    লেখাই হয়নি! আমরা সত্যিই তাজ্জব—কেন?

    কেন জানতে চাও? ঘনাদা শিশিরের ধরিয়ে দেওয়া সিগারেটে রামটান দিয়ে তার ধোঁয়ার সঙ্গেই চোখ বুজে যেন ধ্যানস্থ হয়ে গেলেন।

    এ ধ্যান কি ভাঙবে?

    আমরা গরুড়পক্ষী হয়ে তাঁর দিকে চেয়ে আছি।

    ধ্যান শেষ পর্যন্ত ভাঙল আর চক্ষু উন্মীলন করে সামনের দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে তিনি ত্রিকালদৃষ্টির যে নমুনা দেখালেন তাতে আমরা হাঁ।

    কেন লেখা হয়নি তা, সামনের ফাঁকা দেয়ালটার দিকে সিগারেট ধরা আঙুল দুটোই উঁচিয়ে তিনি বললেন, ওই ওর তস্য তস্য আদি সপ্তশত সংঘ-ভ্রাতা হয়তো বলতে পারত!

    মাথাগুলো তখন ঘুরতে শুরু করেছে। ঘোরার আর অপরাধ কী? সংঘ-ভ্রাতা, তস্য তস্য, আদি সপ্তশত—এ সব কী বলছেন ঘনাদা! আর বলছেন কিনা ওই সেদিনের চুনকাম করা সাদা দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে!

    ওখানে ও সব বলে সম্বোধন করছেন কাকে?

    যাকে করছেন অনেক কষ্টে তাকে আবিষ্কার করা গেল এরপর। আবিষ্কার যা করলাম চক্ষু তাতে চড়কগাছ। ঘনাদার দিকে ফিরে হতভম্ব হয়েই তাই বলতে হল, ওখানে তো একটা শুধু সুড়সুড়ে পিঁপড়েই দেখছি!

    হ্যাঁ, ওই। ঘনাদা ধ্যাননিমীলিত হয়েই বললেন।

    হ্যাঁ, ওই! সুড়সুড়ে পিঁপড়ে। ওরই কী বললেন, তস্য তস্য সার্ধতিনসহস্র-আদি— –

    হ্যাঁ, হ্যাঁ! ঘনাদা আমাদের থামিয়ে দিয়ে জ্ঞান দিলেন। ব্যাখ্যা করে বোঝালেন, কুরুক্ষেত্রের ভারতযুদ্ধের আগে-পরে যা যা হয়েছে দিব্যদৃষ্টিতে সবই ব্যাসদেবের জানা। তিনি রেখে ঢেকে কিছু বলবার মানুষ নন, আর যত ঝড়ের বেগেই বলুন, গণেশঠাকুরের শর্টহ্যান্ডে তা ধরা না পড়েই পারে না। তবু যে মহাভারত থেকে ওই মোক্ষম খবরটুকু বাদ পড়েছে, তার মূল হল ওই সুড়সুড়ে পিঁপড়ে। ও মানে, ওরই সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার তস্য তস্য কোনও বাসাতুতো ভাই। পরমায়ু ওদের চার থেকে সাত বছরের বেশি নয় বলে গড়পড়তা হিসেবে আদি সপ্তশত সংঘ-ভ্রাতা বলছি। কথায় কথায় বুকের মধ্যে যিনি বিশ্বরূপ দেখান, বিশ্বচরাচর যাঁর রেফারিগিরিতে চলে, সেই চতুর চূড়ামণি কৃষ্ণ তাঁর মান বাঁচাতে ওই সামান্য পিঁপড়েটিকেই বেছে নিয়েছিলেন। পিঁপড়ে তো নয়, ও আদি কীটাবতার, একাই পৃথিবীর প্রথম পঞ্চমবাহিনী।

    ঘনাদা থামলেন। আমাদের ধরা গলায় আর টু শব্দটিও নেই দেখে ঘনাদা শেষ জ্ঞানটুকুও দিলেন।

    দুনিয়া যাঁর নখের টেলিভিশনে, কোথায় কী হচ্ছে তা তো আর তাঁর জানতে বাকি থাকে না। দ্বারকায় বসেই তিনি টের পেলেন, ব্যাসদেব তাঁর কপট নিদ্রার বৃত্তান্ত এবার বলতে শুরু করছেন। গড়গড় করে বলে যাচ্ছেন ব্যাসদেব, সড়সড় করে কলম চলছে গণেশ ঠাকুরের, এমন সময় লেখার চৌকির ওপরই গড়িয়ে রাখা গণেশ ঠাকুরের গুঁড়টা সুড়সুড়িয়ে উঠল। অনেক চেষ্টা করেও সামলাতে পারলেন না গণেশ ঠাকুর। দুর্দান্ত একটি হ্যাঁচ্চোতে পুঁথির পাতা উড়ল, কলমও থামল ক-টি পলকের জন্য। আবার যখন চলল ব্যাসদেবের ডিকটেশন, তখন কেষ্টঠাকুরের কারসাজি পার হয়ে গেছে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }