Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    বেড়াজালে ঘনাদা

    চিলের ছাদে কীসের আওয়াজ?

    কীসের আর, একজোড়া বিদ্যাসাগরি চটির।

    বিদ্যাসাগরি চটির আওয়াজ তারপর চিলের ছাদের ওপর থেকে খোলা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায়।

    চটির আওয়াজ গোড়ার দিকে যা ছিল, নীচে নামবার সঙ্গে সঙ্গে তার চেয়ে আস্তে হয়ে আসবে।

    বারান্দায় এসে তা একেবারে থেমে যাবে কি?

    না। একেবারে থামবে না, তবে এখন আওয়াজটা হবে যেমন নিচু তেমনই আবার আস্তে। সে চটাপট চটাপট আর নেই, এখন ক্ষীণ একটু চট, এরপর পটটা অনেক দেরি করে শোনা যাবে।

    কেউ যেন থতমত খাওয়া পা দুটো কেমন হতভম্ব হয়ে কোনও রকমে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।

    বিদ্যাসাগরি চটি-পরা হতভম্ব হয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া পা জোড়া কার?

    তা কি আবার বলে দিতে হবে?

    হ্যাঁ, বুঝতে যা কারও বাকি নেই ব্যাপারটা তাই—ও বিদ্যাসাগরি চটি-পরা পা জোড়া স্বয়ং ঘনাদার।

    তা, তিনি তাঁর টঙের ঘর থেকে বেরিয়ে ছাদের খোলা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বারান্দায় এসে অমন থতমত খাবেন কেন? আর তারপর কেমন হতভম্ব হয়ে যেন পা টেনে টেনে যাওয়ার কারণই বা কী?

    কারণ গুরুতর। ঘনাদা ভোরবেলা উঠে তাঁর নিজের রুটিনমাফিক সব কিছু করার মধ্যে তেমন খেয়াল হয়তো না করতে পারেন, কিন্তু টিকে ধরিয়ে তামাকটি সেজে তাতে সুখটান দেবার জন্য তৈরি হয়ে বেশ একটু অবাক হবেন।

    তাঁর তামাক সাজা শেষ হবার আগেই তো বনোয়ারি বাহাদুরের ভালমন্দ কিছু সমেত ধূমায়িত চায়ের পট পেয়ালার ট্রে নিয়ে হাজির হবার কথা। এখনও তার দেখা নেই কেন?

    একটু খেয়াল করার পর নীচেটা কেমন যেন ঠাণ্ডা বলেও মনে হবে। সকালবেলার নিয়ম মাফিক সাড়া-শব্দ যেন পাওয়া যাচ্ছে না।

    আরও মিনিট কয়েক ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে ঘনাদাকে চিলের ছাদে বেরিয়ে আসতে হবে। সেখান থেকে গম্ভীর গলায় ডাকও দিতে হবে বনোয়ারি বলে।

    তাতেও কোনও সাড়া মিলবে না।

    এবার বেশ একটু চিন্তিত হয়ে ঘনাদাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে হবে আশ্চর্য ব্যাপারটার খোঁজ নেবার জন্য।

    সিঁড়ি দিয়ে বারান্দা পর্যন্ত নামবার পরই কিন্তু চক্ষুস্থির।

    বৈঠকিঘরের দরজা বন্ধ শুধু নয়, তার কড়ায় মজবুত একটা তালা এঁটে ঝোলানো।

    এই দৃশ্য দেখবার পর হতভম্ভ হয়ে পা টেনে চলার আর অপরাধ কী? ঘনাদা ওই অবস্থাতেই সমস্ত বারান্দাটা পার হয়ে নীচে রান্না আর খাবারঘর পর্যন্ত ঘুরে আসবেন নিশ্চয়।

    সব দরজায় তালা ঝুলছে, মায় রান্না ভাঁড়ার খাবারের ঘরে পর্যন্ত।

    কী হল হঠাৎ বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের? রাতারাতি কোনও যখ কি জিন ভোজবাজিতে সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে গেছে নাকি? হঠাৎ মাঝরাতের কোনও হামলার ভয়ে সবাই একসঙ্গে বাড়ি ছাড়া? .।

    তা হলে এতবড় একটা কাণ্ড হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও ঘনাদা কিছু টের পাননি কেন?

    এরকম দিশাহারা অবস্থায় কী করবেন এখন ঘনাদা এই খাঁ-খাঁ শূন্য পুরীতে?

    সেইটেই দেখবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলাম।

    এবার আর শুধু মনে মনে কল্পনা করা নয়, পুরোপুরি ব্যাপারটা ঘটাবার জন্য যা কিছু দরকার তার কোনওটা বাদ দিইনি। রামভুজ আর বনোেয়ারিকে সাচ্চা ঝুট নানা রকম যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে মাঝরাতেই চুপি চুপি বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে রাতটা অন্য কোথাও কাটাতে রাজি করিয়েছি, নীচের রান্নাঘর ভাঁড়ার-খাবার-ঘর সমেত ওপরে বৈঠকিঘর নিয়ে আমাদের সকলের সব কটা ঘরের তালা জোগাড় করবার ব্যবস্থা করেছি আর ঘনাদার নাজেহাল অবস্থাটা স্বচক্ষে দেখবার জন্য নিজেদের মধ্যে লটারি করে একজনকে শেষ তালাটা দিয়ে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবার জন্য বাছাই করতেও ভুলিনি।

    লটারিতে এ দুর্ভাগ্যটা শিশিরের ওপরই পড়েছে। লটারিতে ফাঁকি আছে বলে গোড়ায় বেশ একটু বেয়াড়াপনা করলেও এ ব্যবস্থা শেষপর্যন্ত শিশিরকে মেনে নিতে হয়েছে। বনোয়ারি আর রামভুজ চলে যাবার পর, আমাদের বাকি সকলকে এক এক ঘরে তালা বন্ধ করে রেখে, শিশির বাইরে কোথাও গিয়ে রাতটা কাটিয়ে সকালে এসে আমাদের খালাস করবে এই হল ব্যবস্থা।

    ব্যবস্থাটা একটু অন্যায় বলে মনে হচ্ছে কি?

    ঘনাদাকে জব্দ করার দিক দিয়ে একটু হয়তো বাড়াবাড়ি আছে ব্যবস্থাটায়, তবু তার জন্য নিজেদের খুব বেশি দোষ কি দিতে পারি?

    যা জ্বালান তিনি জ্বালাচ্ছেন কিছুদিন ধরে তাতে একটু দাওয়াই তাঁকে না দিলে নয়। আর যদি দিতেই হয় তা হলে কোনও কাজ যাতে হবে না এমন জাদুর গায়ে হাত বুলোনো গোছের দাওয়াই দিয়ে লাভ কী! তাঁর ওল যতখানি বুনো, আমাদের তেঁতুলও তাই ততখানি বাঘা।

    এমন বাঘা তেঁতুলের ব্যবস্থা করার আগে তাঁর তোয়াজ করতে কি কিছু বাকি রেখেছি? বুঝিয়েছি, মিনতি করেছি, ঘুষও দিয়েছি যতখানি সম্ভব দুটি বেলা, শুধু বাঁকা ঘাড়টা অন্যদিকে একটু হেলাবার জন্য।

    কী বাহার ছাদটার হবে দেখবেন, ঘনাদা! শিবু তাঁকে লোভ দেখিয়েছে, দরজা খুলেই দেখবেন যেন ফুলের দেওয়াল। আর তার সঙ্গে কী সব পাখির মিষ্টি ডাক। বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনে আছেন তাই ভুলে যাবেন।

    আর আপনার ভোলা ছাদ ঢাকা তো পড়ছে না। শিশির বুঝিয়েছে, শুধু মিহি তারের জাল দিয়ে সামনেটা ঘেরা থাকবে।

    এসব শুনতে শুনতে কী করেছেন ঘনাদা? যেন কানেই যাচ্ছে না এমন ভাবে নিজের গড়গড়ার নলে টান দিতেই তন্ময় হয়ে থেকেছেন?

    না। তা থাকেননি বলেই তো মুশকিল। তাঁর কালা বোবা সাজার প্যাঁচ আমাদের। জানা। তা কাটাবার উপায়ও আছে অনেক রকম।

    কিন্তু এবার ঘনাদা যে নতুন চালাকি ধরেছেন! যেন উৎসাহভরে খোঁজ নিয়েছেন আমাদের ওই খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলে প্রকল্পের।

    ও! ছাদটাকে তোমরা ফুলের বাগান আর চিড়িয়াখানা বানাতে চাও? যেন সরল ভাবেই জিজ্ঞাসা করেছেন, তার জন্য লোহার জাল-টাল দিয়ে সব ঢেকে দেবে?

    না, না—সব ঢাকব কেন? আমাকেই মৃদু প্রতিবাদ জানাতে হয়েছে, ওই উত্তরের আলসের ওপর দুটো খুঁটি বসিয়ে তাতে লোহার খানিকটা জাল টাঙাব, আর তার নীচে শুধু একটা লম্বা খাঁচা থাকবে জালের। টাঙানো জালে ফুলের লতা উঠবে আর খাঁচায় থাকবে দুর্গা, টুকটুকি, ফুল-চুকি, মুনিয়া গোছের কটা পাখি।

    খুব ভাল কথা! ঘনাদা যেন আগ্রহই দেখিয়েছেন।

    আর তখন আমাদের পায় কে? উৎসাহভরে আমাদের পেটে যা ছিল সব কিছু ঘনাদার কাছে উজাড় করে দিয়েছি।

    আমাদের ভাগ্যে যে এখন মণিকাঞ্চন যোগ। বলেছে শিশির।

    শিবুর এক মামা এসেছেন আলিপুর হর্টিকালচারাল গার্ডেনে কাজ নিয়ে।–আমি ব্যাখ্যা করেছি, আর গৌরের এক কাকা পেয়েছেন শহরে নতুন এক এভিয়ারি খোলার ভার।

    এই দুজনের ভরসাতেই আমাদের এই মিনি বাগান বানাবার শখ। বলেছে গৌর।

    আর শেষ জোরালো যুক্তিটা জানিয়ে শিবু বলেছে, এমন সুযোগ তো আর রোজ রোজ মেলে না!

    ঠিক! ঠিক! ঘনাদা শিবুর যুক্তিতেই যেন পুরোপুরি কাত হয়ে বলেছেন, তা এতই যখন করছ তখন আমারও কিছু সাধ যদি মেটাতে—

    মেটাতাম মানে! আমরা সবাই তখন একবারে এক পায়ে খাড়া-বলনো কী। চান? আপনার সাধ তো আমাদের কাছে হুকুম! সবার আগে সে সাধ না মেটালে বাগানই বাতিল।

    আমাদের ভক্তির উচ্ছাসেই যেন ভরসা পেয়ে ঘনাদা এবার তাঁর বাসনাটুকু জানিয়েছেন।

    বেশি কিছু নয়, একটু যেন দ্বিধাভরেই বলেছেন ঘনাদা, তোমাদের ওই সব পাখির সঙ্গে আমার পছন্দের দুটো পাখি রাখতে বলছি। তার একটার জন্য অবশ্য একটু স্পেশাল জাল লাগবে!

    তা লাগুকনা যা লাগবার।–আমরা তাঁকে ঢালাও আশ্বাস দিয়েছি–কোনও ভাবনা নেই আপনার। বাজারের একেবারে সেরা জাল আমদানি করব দেখবেন, এখন পাখি দুটো কী বলুন।

    ঘনাদা পাখি দুটোর নাম-গোত্র সব জানিয়েছেন এবার।

    একটাকে পাহাড়ি লৌয়া বলতে পারো, ঘনাদা বিস্তারিত পরিচয়ই দিয়েছেন, পোশাকি নাম হল ওফ্রিসিয়া সুপারসিলিওসা, আর অন্যটাকে গুণগুনিয়া বলা যায়, পোশাকি নাম হল, মেল্লিসুগা হেলেনি।

    ব্যস, আর কিছু বলতে হবে না। গৌর পকেট থেকে নোটবই বার করে পোশাকি আর ডাক নাম টুকে নিতে নিতে জোর গলায় জানিয়েছে, আগে আপনার পাখির ব্যবস্থা করে তার পরে বাগানের কাজ শুরু।

    ঘনাদাকে অত সহজে রাজি করতে পেরে হাতে একেবারে চাঁদ পেয়ে যেদিন নেমে এসেছিলাম, সেইদিনই ঘণ্টা দুয়েক বাদে সবাই চোখে অমন অন্ধকার দেখব তা কি জানতাম!

    অন্ধকার দেখলাম গৌরের কথা শুনে।

    ঘনাদার আবদার নোটবই-এ টুকে নিয়ে গৌর ছুটেছিল তার পক্ষীতত্ত্ববিদ কাকার কাছে।

    সেখান থেকে ফিরে আসার পর তার মুখের চেহারা দেখেই আমরা সন্ত্রস্ত। ভগ্নদূতের পার্ট করতে হলে তার কাছে কিছু শেখা যায়।

    গৌরের মুখে প্রথমে কোনও কথাই নেই।

    ব্যাপার কী? —জিজ্ঞাসা করতেই হল উদ্বিগ্ন হয়ে—ঘনাদার পাখি পাওয়া যাবে তো?

    না। উত্তর নয়, গৌর যেন একটি হাত-বোমা ছাড়ল।

    পাওয়া যাবে না মানে? তবু শেষ আশাটুকু আঁকড়ে ধরে জিজ্ঞাসা করলাম, ঘনাদা বাজে গুল ছেড়েছেন? যা চেয়েছেন সেরকম কোনও পাখি দুনিয়ায় নেই?

    না, আছে ও ছিল! গৌরই হেঁয়ালি ছাড়ল।

    তার মানে? খিঁচিয়ে উঠতে হল আমাকেই, এখন কী তামাশার সময়?

    তামাশা করছি না। গৌর প্রায় করুণ হয়ে বোঝাল—সত্যিই যা বলেছি, তা-ই। উনি যা বায়না ধরেছেন তার একটা পাখি থেকেও নেই, আর অন্যটা এককালে ছিল, কিন্তু এখন নিপাত্তা। দুটোর কোনওটাই তাই জোগাড় করা অসম্ভব।

    আমাদের খোঁচাখুঁচিতে এরপর গৌর সবিস্তারে যা বোঝালে তাতে আমরা সত্যিই অকূল পাথারে।

    ঘনাদা যে দুটি পাখি চেয়েছেন, তার মধ্যে গুনগুনিয়া বা মেল্লিসুগা হেলেনি নিপাত্তা নয়। দুনিয়ায় এ পাখিটা যথেষ্ট সংখ্যাতেই আছে। তবে আমাদের ভারতভূমিতে তো নয়ই, সমস্ত এশিয়া ইউরোপ আফ্রিকাতেও নেই। এ পাখিটিকে পাওয়া যায় শুধু মাত্র আমেরিকার উত্তর ও দক্ষিণের মাঝামাঝি অঞ্চলে। গুনগুনিয়া এর নামও নয়। দুনিয়ার সবচেয়ে ছোট প্রায় একটা ভোমরার মতো খুদে এ পাখির চলতি নাম হামিংবার্ড। ঘনাদা তাই থেকে গুনগুনিয়া বানিয়েছেন। ঘনাদার দ্বিতীয় পাখিটি কিন্তু দুনিয়াতেই আর আছে কি না সন্দেহ। পাখিটি আমাদের দেশের হলেও আঠারোশো ছিয়াত্তরে শেষ পর্যন্ত একবার নৈনিতালের পাহাড়ি জঙ্গলে পাবার পর আর কেউ এ পর্যন্ত এ পাখি কোথাও দেখেনি। পাহাড়ি লৌয়া নামটাও হয়তো ঘনাদারই দেওয়া। পাখিটি কিন্তু নির্বংশ হয়ে গেছে বলেই মনে হয়।

    গৌরের এ বিবরণ শুনে সবাইকে এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হয়েছে।

    ঘনাদা যে ল্যাংটি মেরেছেন, তারপর কী আমাদের করা উচিত?

    সোজা তাঁকে গিয়ে অবশ্য চেপে ধরতে পারি, আজগুবি অন্যায় আবদার করেছেন বলে।

    কিন্তু তাতে নিজেরা গবেট বলে ধরা তো পড়বই, তার ওপর হিতে বিপরীত হতে কতক্ষণ?

    তার চেয়ে সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলির প্যাঁচই ভাল। আমরা যে ডাহা উজবুক বনেছি তা বুঝতে না দিয়ে ঘনাদার আবদারটা কোনওরকমে পালটে দেবার ফিকিরে থাকা।

    সেই ফিকিরেই তোয়াজ সাধাসাধি ঘুষ কিছু আর বাকি রাখিনি। সেদিন বিকেলেই বনোয়ারির সযত্নে বয়ে-আনা জোড়া কবিরাজি কাটলেটের প্লেট তাঁর হাতে ধরিয়ে বলেছি, মিস্ত্রিদের শনিবারই তা হলে কাজ শুরু করতে বলে দিই? কী বলেন?

    শনিবারই কাজ শুরু করতে চাও বুঝি? ঘনাদা কাটলেট জোড়ার সদ্ব্যবহার করতে করতে যেন ভাববার সময় নিয়েছেন।

    তারপর চাঁছাপোঁছা প্লেটটি ট্রের ওপর রেখে চায়ের পেয়ালার দিকে হাত বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন, তোমাদের সব জোগাড়যন্ত্র হয়ে গেছে বুঝি?

    তা একরকম হয়ে গেছে! গৌর অম্লান বদনে বলেছে, একটু শুধু অদলবদল হয়েছে আগের ফর্দের!

    অদলবদল! ঘনাদা চায়ের পেয়ালা মুখে তুলতে গিয়ে নামিয়েছেন।

    হ্যাঁ। গৌর যেন তাঁর কোঁচকানো ভুরু জোড়া লক্ষ না করেই বলেছে, ওই আপনার গুনগুনিয়া আর পাহাড়ি লৌয়ার বদলে আরও ভাল পাখির ব্যবস্থা করেছি।

    আরও ভাল পাখি! ঘনাদার মুখ এক মুহূর্তেই একেবারে আষাঢ়ের মেঘ। জোড়া কাটলেটের খুশির বাষ্পও সেখানে নেই।

    কিন্তু এখন সে দিকে কালাকানা না সেজে উপায় কী? গৌর তাই যেন বাহাদুরি জানাতে বলেছে, ভাল বলে ভাল! আপনার ওই গুনগুনিয়ার বদলে তুরপ আনাচ্ছি। মেল্লিসুগা হেলেনির বদলে মুস্কিকাপা পার্ভা।

    অনেক কষ্টে কাকার কাছ থেকে মুখস্থ করে আসা নাম দুটো বলে গৌরকে থামতে হয়েছে। ঘনাদার মুখে আর তখন কথাই নেই।

    গৌর ততক্ষণে পরের মুখস্থ নাম দুটোও মনে মনে আউড়ে নিয়ে গড়গড় করে বলে গেছে, আর আপনার ওই পাহাড়ি লৌয়ার বদলে আনছি চানক। ওফ্রিসিয়া সুপার সিলিওসার জায়গায় কোটরনিক্স কোরামাণ্ডালিকা।

    হুঁ, যেন পাতাল গুহা থেকে আওয়াজ বেরিয়েছে এবার, তা অত কষ্টই বা করা কেন? তোমাদের চিড়িয়াঘরে তোমাদের পাখি-ই থাক। ভালমন্দ কোনও পাখিরই আমার দরকার নেই।

    এই থেকে শুরু হয়ে একেবারে ছকবাঁধা ধাপে ধাপে ঠাণ্ডা লড়াই তারপর এগিয়ে গেছে। প্রথমে আমাদের আড্ডাঘরে আসা বন্ধ, তারপর নিজের ঘরে রামভুজকে দিয়ে দুবেলার খাবার আনানো, তারপর বনোয়ারি মারফত বার্তা প্রচার।

    হামাকে তো এক গো লরি বন্দোবস্ত কোরতে বোলিয়েছেন বড়াবাবু?

    পরের দিন বিকেলে আড্ডাঘরে চা দিতে এসে বনোয়ারির বিহ্বল করুণ অসহায়তা প্রকাশ।

    লরি! লরি! কী হবে বড়বাবুর? আমার সন্দিগ্ধ প্রশ্ন। আঃ! লরি কী হবে বুঝলে না? শিবুর জ্ঞান দান—বড়বাবু দুর্জন সংসর্গ ত্যাগ করবেন ঠিক করেছেন।

    তা করতে চান করুন। গৌর এবার খাপ্পা—কিন্তু তার জন্য লরি কী হবে? ওঁর যা অস্থাবর তার জন্য একটা টেম্পােও তো লাগে না। টঙের ঘরখানাই উনি লরিতে চাপিয়ে নিয়ে যাবেন নাকি? বেশ, তাই যেন যান, আর যত তাড়াতাড়ি হয়।

    রাগের অভিমানের হলকাটা গৌরের মুখ দিয়ে বার হলেও আমাদের সকলের মনের কথাটা তখন এক।

    হামেশা ভারী ভয় দেখান আমাদের ছেড়ে যাবেন বলে। কথায় কথায় এ হুমকি আর সহ্য হয় না। ছেড়ে যাওয়ার মজাটা ওঁকে বোঝানো দরকার।

    বোঝাবার সেই পণ থেকেই এ কাহিনীর গোড়ার পরিকল্পনার জন্ম। সে পরিকল্পনা অমন বেয়াড়া ভাবে ভেস্তে যাবে তা কি জানি! জোর করে বলা যায়, আমাদের কোথাও গলতি কিছু হয়নি। যেমন ছকা হয়েছিল পরিকল্পনাটা ঠিক সেই লাইন ধরেই এগিয়েছে। রাত ভোর না হতে রামভুজ আর বনোয়ারিকে আগে বিদেয় করে শিশির আমাদের ক-জনকে আড্ডাঘরেই তালা বন্ধ করে, অন্য সব কামরাতেও সেই সঙ্গে তালা লাগিয়ে বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

    বাড়ি ছেড়ে গেলেও বেশি দূরে কোথাও সে যাবে না। সকালে ওঠবার পর খাঁ খাঁ বাড়িতে ঘনাদার একটু উচিত শিক্ষা হবার পরই ফিরে এসে আমাদের তালা খুলে বার করবে।

    শিশির যতদূর সম্ভব নিঃশব্দে তালা এঁটে চলে যাবার পর থেকেই আমরা একেবারে কান খাড়া করে সজাগ।

    কিন্তু যার জন্য এত আয়োজন, ছাদের সিঁড়িতে ঘনাদার সেই ভয়ে ভাবনায় নামা পায়ের আওয়াজ কই?

    ঘনাদার খাওয়া শোয়া ওঠা বসা সব তো একেবারে ঘড়ি ধরা। আজ তাঁর সেই ঘড়িই বিকল হয়ে গেল নাকি? তাঁর এতটুকু সাড়া-শব্দও নেই।

    না। আছে। ওই তো চিলের ছাদে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটির কেমন একটু অধৈর্যের চটপট ফটফট। তারপর খোলা সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সে অধৈর্যের আওয়াজটা একটু দ্বিধা-সংশয়ে ঢিমে হয়ে আসা।

    তারপর ঠিক যেমনটি কষে রাখা হয়েছিল, ঘনাদার পদধ্বনি একেবারে সেই ছন্দে মোনো।

    বারান্দায় নেমেই চটপটের জায়গায় চটি জোড়ায় যেন একটু ঘসটে চলা। ঘনাদা এখন হতভম্ব হয়ে তালাগুলো দেখছেন নিশ্চয়।

    আড্ডাঘরের সামনে থেকে যেন নেহাত দিশাহারা হয়ে পরের কামরাটা পর্যন্ত পা দুটো টেনে নিয়ে যাওয়া।

    তারপরই সভয়ে আবার ওপরের দিকে ছুটের উপক্রম।

    কী, ব্যাপার কী, ঘনাদা!

    ঠিক একেবারে কটায় কাঁটায় লিলিয়ে সেই মুহূর্তে নীচের সিঁড়ি দিয়ে উঠে শিশিরের যেন বিস্মিত সম্ভাষণ।

    সেই সঙ্গে ঝটপট তালা খুলে দেওয়ার সঙ্গে আমাদেরও ও ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ঘনাদাকে ঘিরে ধরা।

    এ কী! আপনি এমন সময় এখানে! আমাদের কেমন একটু সন্দিগ্ধ জিজ্ঞাসা।

    হাতে হাতে ধরা পড়ে এবার ঘনাদা একেবারে বেড়াজালে ঘেরা।

    কোনও দিকে কোনও ফাঁক নেই পিছলে বার হবার। কী করবেন এখন, কী বলবেন?

    ঘনাদা কিন্তু বললেন। যা বললেন, তাতে সবাই আমরা হাঁ। আমরা তাঁকে লজ্জায় ফেলব কি, তিনিই আমাদের অভয় দিলেন।

    না, আর কোনও ভয় নেই। ঘনাদার দাঁড়াবার ভঙ্গি থেকে গলার স্বরে পর্যন্ত পরম বরাভয় আশ্বাস। আর সেই সঙ্গে আমাদের প্রশস্তি—খুব ভাল করেছ দরজায় তালা লাগিয়ে রেখে। ওই তালা দেখেই চলে গেছে।

    এসব শুনে মাথায় চক্কর দেওয়াটা খুব অন্যায় নিশ্চয় নয়। কীসের ভয় ছিল আর কেন তা আর নেই, দরজায় তালা দেখে কে-ই বা চলে যাওয়ায় আমাদের বিপদ কাটল এ সব খোলসা করবার জন্য ঘনাদাকে আর ওপরে যেতে না দিয়ে বৈঠকিঘরেই টেনে নিয়ে যাওয়া ছাড়া কী করতে পারি তখন?

    বনোয়ারি রামভুজের এখনও আসতে দেরি হবে হয়তো, কিন্তু আরামকেদারাটা আছে, শিশিরের সিগারেটের টিনও। তাই প্রণামী দিয়ে জিজ্ঞাসা করতে হল, দরজায় তালা দেখে চলে গেছে কে?

    কে আর? ঘনাদা শিশিরের ধরিয়ে দেওয়া সিগারেটে জুত করে টান দিয়ে বললেন, সেই সেরা দো মার-এর শিকারের আস্তানা থেকে হন্যে হয়ে যে আমায় সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই কার্ল পাউলো।

    কার্ল পাউলো! নামটা দুবার জিভে সড়গড় করে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, সেই পাউলোকেই আপনার ভয়? তা সে আপনাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কেন! মারবে-টারবে নাকি?

    হ্যাঁ, পারলে সে আমায় পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে কাটবে, কিন্তু তার আগে সেরা দো মার-এর ধাঁধাটার উত্তর না বার করতে পারলে শান্তি পাবে না।

    ওই পাউলোকে একটা ধাঁধা শুনিয়ে তার উত্তর না জানিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। বুঝি! আমাদের বলতেই হল, খুব অন্যায় কিন্তু।

    হ্যাঁ, অন্যায় একদিক দিয়ে তো বটেই। ঘনাদা স্বীকার করলেন, তা ছাড়া কার্ল পাউলোর ধারণা, তার সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করেছি।

    সত্যি তাই করেছেন নাকি? আমাদের গলায় অবিশ্বাস।

    হ্যাঁ, যা করেছি তা একরকম বিশ্বাসঘাতকতাই ভাবতে পারে পাউলো। কারণ সে-ই তো আমায় সঙ্গে করে তার নিজের প্লেনে–

    ঘনাদা থামলেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে চোখ ফিরিয়ে দেখি দরজায় স্বয়ং শ্রীমান বনোয়ারি হাজির। আমাদের নির্দেশ মতো ভোরটা পার করে দিয়ে রামভুজের সঙ্গে সে যথাসময়েই ফিরে এসেছে।

    অবস্থাটা আমাদের পক্ষে একটু অস্বস্তির হতে পারত, কিন্তু গৌর চায়ের সঙ্গে টা হিসেবে টোস্ট, ডবল অমলেট আর পাড়ার বিখ্যাত খাস্তা কচুরির লম্বা ফরমাশ দিয়ে সেটা কাটিয়ে দিলে।

    ঘনাদাকে এবার আর উসকে দেবার দরকার হল না। বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন থেকে সোজা কার্ল পাউলো-র প্লেনে গিয়ে উঠলেন আমেরিকার টেক্সাসের ডালাস শহরের এয়ারপোর্টে।

    বললেন, ডালাসের এয়ারপোর্টে আমি পাউলোকে দেখে যতখানি বিব্রত, সে আমায় দেখে ততখানি অবাক আর খুশি।

    আরে দাস! তুমি এখানে কী করছ?দূর থেকে আমায় দেখেই কাছে এসে পেটে একটা বুলডোজার মার্কা আদরের গুঁতো দিয়ে পাউলো বলল, তোমার সঙ্গে এখানে দেখা হবে ভাবতেই পারিনি।

    আমিও পারিনি! পেটের আচমকা তোটার ঠেলা একটু কষ্ট করে সামলে নিয়ে বললাম, তা এখন চলেছ কোথায়?

    কোথায় যাচ্ছি দেখতেই তো পাবে! বলে পাঁচমণি বপুটি কাঁপিয়ে পাউলোর সে কী হাসি!

    আমি দেখতে পাব! তার লাউঞ্জফাটানো হাসির মাঝখানে বলতেই হল অবাক হবার ভান করে, কী বলছ?

    ঠিকই বলছি। হাসির মাত্রাটা একটু শুধু কমিয়ে বললে পাউলো, তুমি তো আমার সঙ্গেই যাচ্ছ। দেখা যখন হয়েছে তখন আর তোমায় ছাড়ি!

    ছাড়লে সত্যিই। কার্ল পাউলোর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার চেয়ে ব্রেজিলের আনাকোন্ডার পাক কি অক্টোপাসের নলোর আলিঙ্গন ছাড়ানো সোজা।

    পাউলোর সঙ্গে দেখা হয়ে তারই প্লেনে সঙ্গী হয়ে যাওয়া নেহাত নিয়তির বিধান বলেই মেনে নিয়ে শেষ পর্যন্ত বেশি আপত্তি করলাম না। নিজের প্লেনের টিকিট আমার পকেটেই রইল, সেইসঙ্গে জুয়ান ভার্গাস-এর চিঠিটাও।

    ডালাসের এয়ারপোর্টে প্লেনে চড়তেই আমি এসেছিলাম। তবে সেটা নেহাত সাধারণ প্যাসেঞ্জার প্লেনে, পাউলোর নিজস্ব জেট বিমানে নয়। প্যাসেঞ্জার প্লেনে গেলে আমার যা গন্তব্য, সেখানে একটু দেরিই হত ঘুরপথে পৌঁছতে। কার্ল পাউলো আমার সে কষ্টটুকু যদি জোর করে বাঁচিয়ে দেয়, তা হলে কত আর আপত্তি করা যায়?

    নিজস্ব প্লেনটা পাউলো একেবারে বাদশাহি মেজাজে সাজিয়েছে। কোনও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যেরই সেখানে অভাব নেই। প্লেনে নয়, পাউলোর নিজের বাড়িতেই যেন বসে আছি।

    সেই বাদশাহি বিলাসের মধ্যে বসিয়ে প্লেনে যেতে যেতে পাউলো তার নতুন পরিকল্পনার কথা সোৎসাহে আমায় শোনালে।

    ব্রেজিলের মাথায় উত্তর-পুব দিকে সেরা দো মার পর্বতমালা। সেই সেরা দো মার-এর দক্ষিণে বিরাট এলাকার সে মালিক। সেখানে সে এতদিন শুধু শিকারে গিয়ে থাকবার একটা আস্তানাই করে রেখে ছিল। এখন সেখানে সে রবারের একটা বিরাট কারখানা বসাতে চায়। মোটর এরোপ্লেন ইত্যাদির টায়ার টিউব থেকে শুরু করে রবারের যা কিছু সম্ভব সব সেখানে তৈরি হবে। ও অঞ্চলে মজুরি সস্তা। দুনিয়ার সেরা বেলেম-এর রবারও কাছেপিঠেই জন্মায়। তা ছাড়া সমুদ্রের কাছে আর আবহাওয়া জুতসই বলে মাল তৈরি আর চালানের অন্য সুবিধেও যথেষ্ট। এমন একটা ললাভের পরিকল্পনা শুধু এক তেওঁটে হাড় বজ্জাতের বদমায়েশির দরুন ভেস্তে যেতে বসেছে।

    এতদূর পর্যন্ত শুনে একটু অবাক হবার ভান করে বলতেই হল, তাই নাকি?

    শোনো না আগে! তার রবারের কারখানায় যে বাদ সাধছে তার ওপরকার রাগটা একটা দুরমুশপেটানো কিলে আমার পিঠেই ঝেড়ে পাউলো বললে, কয়েক বছর আগে এ কারখানার কথা যখন মাথায় আসেনি, তখন না বুঝে এক হতভাগা জুয়ান ভার্গাস-কে ওখানকার অনেকখানি জায়গা ইজারা দিয়েছিলাম। সে হতভাগা জুয়ান সেখানে গোরু ঘোড়ার র‍্যাঞ্চ বসিয়েছে। এখন এত সাধাসাধি করছি, তার ইজারার টাকা ফেরত দিয়ে গোরু-ঘোড়া সমেত সমস্ত র‍্যাঞ্চ কিনে নেব বলছি, তবু সে বদমাশটা কিছুতেই তার দখল ছাড়বে না। ডেকে পাঠালে আসে না। লোক দিয়ে বলে পাঠায় যে রবারের কারখানার চেয়ে গোরু-ঘোড়ার কারবার অনেক পবিত্র জিনিস। প্রাণ থাকতে তার দখল সে ছাড়বে না। এরকম বদমায়েশকে শায়েস্তা করবার সোজা ওষুধ আছে। কিন্তু মুশকিল হয়েছে এই যে কারখানা বসানোর ব্যাপার নিয়ে ওই জুয়ান-এর সঙ্গে গোলমালের কথাটা রাজধানী ব্রাসিলিয়ার খাস দপ্তরে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। খবরের কাগজেও লেখালেখি হয়েছে এই নিয়ে। এখন হঠাৎ ওই বদমাশটার ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে, বড় বেশি জবাবদিহির দায়ে পড়তে হতে পারে। কারখানা তাতে আরও পিছিয়ে যাবে।

    একটু থেমে আমার আগাপাশতলা একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তার আসল মতলবটা জানালে পাউলো।

    গলায় যেন একটু আদর ঢেলে বললে, তোমাকে যে পেয়ে গেছি এইটেই আমার ভাগ্য, দাস। তোমায় একটা কাজ আমার করে দিতেই হবে। সেই জন্যই তোমায় ধরে নিয়ে যাচ্ছি।

    মুখে কিছু না বলে তার দিকে অবাক-হয়ে-চাওয়া চোখেই প্রশ্নটা রাখলাম।

    তুমি প্যাঁচের রাজা।আমায় তাতিয়ে বললে পাউলো, যে কোনও ফিকিরে হোক ওই পাজি জুয়ান ভার্গাসকে তোমায় বাগ মানাতে হবেই।

    আমাকে! এবার বিস্ময়ে সরব হলাম।

    হ্যাঁ, তোমাকে! সঙ্গে সঙ্গে কার্ল পাউলোরও মুখের চেহারার সঙ্গে গলার স্বরটা বদলাল। আগের সে মধু আর নেই।

    না, না, ওসব আমি পারব না! ইচ্ছে করেই আপত্তিটা বেশ জোর দিয়ে জানালাম, আমায় খাতির করে নিয়ে যাচ্ছ, যাচ্ছি। তোমার ওসব ঝামেলায় আমি ঘাড় পাতব কেন?

    সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ের ওপর প্রচণ্ড একটি রদ্দা।

    ঘাড় পাতবি জান বাঁচাবার জন্য রে কেলে নেংটি! পাউলোর গলা যেন এবার কার্বলিক অ্যাসিডে মাখানো, তোর মতো একটা উচ্চিংড়েকে কি এমনই ধরে নিয়ে যাচ্ছি মনে করছিস! ভুজুং দিয়ে, কি তুরুম ঠুকে, যা করে হোক, জুয়ান ভার্গাস-এর ও ইজারা বাতিল করাতে তোকে হবেই। আর কিছু না পারিস, চুরি করবি ওর সে ইজারার দলিল। কী? বুঝেছিস এবার?

    মাথা নেড়ে জানালাম যে বুঝেছি। তারপর বেশ যেন ঢিট হওয়া করুণ বশংবদ গলায় জানালাম, কিন্তু আমায় তা হলে একটু সুবিধে দিতে হবে যে।

    কী সুবিধে? কার্ল পাউলো খেঁকিয়ে উঠল।

    একটু ঘুরে ফিরে বেড়াবার সুবিধে! যেন ভয়ে ভয়ে নিবেদন করলাম—ও তল্লাটে দু-চারদিন টহলদারি করতে করতে ওই তোমার কী নাম জুয়ান না তুয়ানের সঙ্গে ভাব জমাতে হবে তো। নইলে হট করে গিয়ে হাজির হলে সন্দেহ করবে যে!

    থাম, থাম! ধমকে থামিয়ে দিয়ে পাউলো বললে, বেশি বকতে হবে না। ঘোরাফেরা করার জন্য আমার শিকারের আস্তানার একটা জিপ-ই তুই পাবি। আর কিছু চাস?

    না। কৃতজ্ঞতায় প্রায় গলে গিয়ে জানালাম, ওই জিপটা যে দিচ্ছ সেই দয়াই যথেষ্ট।

    কিন্তু তুই?হঠাৎ একটু যেন সন্দিগ্ধ সুরে পাউলো জিজ্ঞাসা করলে, তুই তো শুধু ওই একটা ফোলিওব্যাগই সঙ্গে এনেছিস। আর কিছু নেই?

    না। আর কিছুতে কী দরকার? সবিনয়ে জানালাম, আকাশে উড়তে যত হালকা থাকা যায়।

    কোঁচকানো ভুরু জোড়া সোজা হয়ে এল এবার। পাউলো একটু ঠাট্টার সুরেই জিজ্ঞাসা করলে, কী আছে ওই ব্রিফকেস-এ? কী এমন দামি নথিপত্র?

    না, সে সব কিছু নেই। সরলভাবেই জানালাম, দাঁতমাজা দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম আর এক প্রস্থ হালকা পোশাক বাদে যা আছে তা শুনলে হাসবে।

    বেশ, হাসা তা হলে। পাউলোর মেজাজ এখন খোশ।

    আস্তে আস্তে বেশ স্পষ্ট করে বললাম, আছে খানিকটা জাপানি কুয়াশা, এক কৌটো ভেসলিন, ছোট এক শিশি ডাইফেনাডিয়োন আর এক জোড়া মোটা চামড়ার দস্তানা।

    সেকেন্ড দুয়েক সামান্য ভুরু কুঁচকে থেকে সত্যিই এবার হেসে ফেলল পাউলো। তারপর একটু কড়া গলাতেই বললে, ও সব ভড়কি আর যাকে পারিস দিস। কাজ যা দিয়েছি তা হাসিল করতে না পারলে ওসব ভড়কি তোর সঙ্গে গোরেই যাবে মনে রাখিস। নামবার পর এক হপ্তা তোকে সময় দেব। তার মধ্যে জুয়ান ভাগাসকে বাগ মানানো চাই-ই।

    নীরবে মাথা নেড়ে সায় দিতে দিতে মনে মনে বললাম, আমার পকেটের জুয়ান ভার্গাসের চিঠিটা যদি এখন দেখতে পেতে, পাউলো!

    সেরা দো মার পাহাড়ের ধারে কার্ল পাউলোর শিকারি আস্তানায় নামবার পর নিজের একটা কামরা পেয়ে একটু নিরিবিলি হবার পর জুয়ান ভার্গাস-এর চিঠিটা আবার বার করে পড়লাম।

    চিঠির কথাগুলো আমার প্রায় অবশ্য মুখস্থ হয়ে গেছে। নিউ অর্লিনস থেকে ওয়াশিংটন যাবার পথে আমার ট্র্যাভেল এজেন্সি মারফত এই চিঠিটা পেয়েই আমি প্ল্যান বদলে ডালাস থেকে ব্রেজিলের ব্রাসিলিয়া যাবার প্যাসেঞ্জার প্লেন ধরবার জন্য এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম। সেখানে যেন নিয়তির নিজের কারসাজিতে কার্ল পাউলোর সঙ্গে দেখা। সে অমন জোর করে ধরে না নিয়ে এলে বেশ একটু ঘুরপথে আরও দেরিতে এই জুয়ানের কাছে আমায় পৌঁছতে হত। জুয়ান যে দারুণ ব্যাপারের কথা লিখেছে তাতে, যেমন করে হোক, না এসে অবশ্য আমি পারতাম না।

    জুয়ান তার চিঠিতে প্রায় দিশাহারা হয়ে আমার সাহায্য চেয়েছে। বেশ কয়েক বছর আগে এই অঞ্চলের বিস্তৃত জমি ইজারা নিয়ে সে যখন গোরু-ঘোড়ার পাল বাড়াবার র‍্যাঞ্চ বসায় তখনকার কথা আমি জানি। নিজের যা কিছু সম্বল সব সে এই আদর্শ র‍্যাঞ্চে ঢেলে দিয়েছিল। সে দুঃসাহস তার বৃথা হয়নি। এই কবছরে তার র‍্যা—সব দিক দিয়ে সার্থক হয়ে উঠেছিল। হঠাৎ কোথা থেকে এক সর্বনাশা অভিশাপে সব ছারখার হবার জোগাড়। তার গোরু-ঘোড়ার পালে ভয়ংকর রকম মড়ক লেগেছে। সে মড়কের কারণও অবিশ্বাস্য। পালে পালে তার গোরু-ঘোড়া মরছে জলাতঙ্ক রোগে। ভয়ে দুর্ভাবনায় তার মাথা খারাপ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। তার এ অঞ্চলের জমির মালিক কার্ল পাউলো কিছু দিন থেকে তার কাছে জমিগুলো ফেরত চাইছে। কারখানা বসিয়ে এই পবিত্র সুন্দর অঞ্চলটা নোংরা বিষাক্ত করতে দিতে চায় না বলে এতদিন সে পাউলোর পেড়াপিড়ি বা হুমকি কিছুতেই আমল দেয়নি। কিন্তু এবার বোধহয় হয়ে তাকে নিজে থেকে সেধেই র‍্যাঞ্চ বেচে চলে যেতে হবে। এই বিপদের মধ্যে শেষ পরামর্শের জন্য সে আমায় ডেকে পাঠিয়েছে।

     

    কার্ল পাউলো আমায় সাতদিন মাত্র সময় দিয়েছিল।

    সাতদিন কিন্তু আমার লাগল না। মেয়াদের দুদিন বাকি থাকতেই সেদিন বিকেলে পাউলোর নিজের কামরায় গিয়ে হাজির হলাম। হাতে আমার নিজের ব্রিফকেসটি।

    পাউলো তখন তার আরাম-কেদারায় গা এলিয়ে কী একটা ডায়রি গোছের খাতার পাতা ওলটাচ্ছে।

    কোনও সম্ভাষণ না করে তার কাছেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।

    একটু চমকে ওঠার সঙ্গে মুখটা একটু লাল হয়ে উঠলেও পাউলো নিজেকে সামলাল। তারপর গলার স্বরটা যথাসম্ভব হালকা করে জিজ্ঞাসা করলে, কী? এ ক-দিন তো চুলের টিকিটি দেখতে পাইনি। কেন? আর দু-দিন মাত্র বাকি তা তো মনে। আছে?

    দু-দিন আর লাগবে না।

    আমার গলায় তাচ্ছিল্যের সুরটাতেই কেমন একটু সন্দিগ্ধ হয়ে পাউল এবার সোজা হয়ে উঠে বসে কুটির সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলে, লাগবে না মানে? কাজ হাসিল হয়ে গেছে এর মধ্যে? জুয়ান ভার্গাস রাজি হয়েছে?

    জুয়ান ভার্গাস-এর রাজি না রাজি হওয়ার কী আছে!আগের মতোই তাচ্ছিল্যের সুরে বলেছি, তার সঙ্গে দেখাই হয়নি। হয়নি মানে করিনি।

    তার সঙ্গে দেখাই করিসনি! রাগে পাউলোর মুখ দিয়ে যেন ফেনা বেরুবে মনে হল, আর পাঁচ দিনেও কাজ হাসিল না করে তুই আমার কাছে সাহস করে এসে বসেছিস?

    পাউলো খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ইজি-চেয়ারটার খাল থেকে উঠতে গেল।

    পিঠে একটি ছোট কিল দিয়ে তাকে আবার কেদারাতেই বসিয়ে দিয়ে বললাম, অস্থির হচ্ছ কেন মিছিমিছি? আসল যা কাজ তা পাঁচ দিনে সত্যিই হাসিল হয়ে গেছে যে! আজ এক বছর ধরে মোক্ষম শয়তানি ফন্দি তুমি খাটাচ্ছ বটে। আমার সঙ্গে এবারের প্লেনেও একটি ক্রেট-এ শয়তানি চক্রান্তের সব যমের দূতদের বয়ে এনে নামাতে দেখলাম। তাদের সব খেল কিন্তু এবার খতম। জুয়ান ভাগাসকে বাগ মানাতে না পেরে তাকে একেবারে ধনে প্রাণে মারবার যে ফন্দি তুমি করেছিলে তা যেমন পৈশাচিক তেমনই ভয়ংকর। কোথাও কিছু নেই, তার গোরু-ঘোড়া পালে পালে আচমকা মারা যেতে শুরু করল এক বছর আগে থেকে। আর মারাও যাচ্ছে এ-রোগ সে-রোগে নয়, হাইড্রোফোবিয়া মানে জলাতঙ্ক রোগে, যার চিকিৎসা নেই। কোথা থেকে এ-রোগ এল গূঢ় রহস্য না জানলে কেউ ভেবেও পাবে না। ক-জন জানে যে জলাতঙ্ক রোগ শুধু খ্যাপা কুকুরের কামড়েই হয় না, তার চেয়ে মারাত্মক উৎস এ রোগের আছে।

    পাউলো আবার একবার লাফিয়ে ওঠবার চেষ্টা করতেই একটি আলতো রদ্দায় তাকে কেদারায় কাত করে দিয়ে বললাম, সে উৎস হল প্রাণীজগতের সত্যিকার রক্তখাকি এক রাক্ষসি, ডেসমোডাস রোটনডাস, যার চলতি নাম হল ভ্যাম্পায়ার। বাদুড়। ভ্যাম্পায়ার সম্বন্ধে সত্যি মিথ্যে অনেক রকম কিংবদন্তীই আছে। প্রাণীটিকে চোখে দেখলে তার সর্বনাশা ভীষণতা বোঝা কঠিন। এক কাঁচ্চা থেকে খুব বেশি হলে তিন কাঁচ্চা এই জীবটির ওজন। কিন্তু রাত্রে ঘুমন্ত মানুষ গোরু-ঘোড়ার রক্তই শুধু সে চুষে খেয়ে যায় না, সাংঘাতিক জলাতঙ্ক রোগের বিষও শরীরে ঢুকিয়ে দিয়ে যায়। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের এই ভয়ংকর ক্ষমতার কথা জেনে তুমি অনেক টাকা খরচ করে বিশেষভাবে তৈরি কাঠের খাঁচায় তোমার প্লেনে বেশ কিছু ঝাঁক সে বাদুড় আনিয়ে জুয়ানের র‍্যাঞ্চের কাছাকাছি সেরা দো মার পাহাড়ের গুহায় তো ছাড়বার ব্যবস্থা করেছ। এবারও এক ঝাঁক তুমি এনে ছাড়তে ভোলোনি। কিন্তু সব শয়তনি ফন্দি তোমার ভণ্ডুল। যত ভ্যাম্পায়ার তুমি ছেড়েছ তার একটাও আর বেঁচে নেই। কাল নিজে গিয়ে সবগুলো পরীক্ষা করে তুমি দেখে আসতে পারবে। আসল মরণকাঠি নেড়ে রক্তচোষা মরণ-বিষ-ছড়ানো সব রাক্ষসি আমি শেষ করে দিয়ে যাচ্ছি।

    শেষ একটি থাবড়ায় পাউলোকে ইজি চেয়ারে একেবারে চিত করে শুইয়ে দিয়ে বললাম, অকারণে ব্যস্ত হয়ো না। এখন ওঠার চেষ্টা করে কোনও লাভ নেই। তুমি যতক্ষণে উঠে দাঁড়াবে ততক্ষণে আমি তোমারই দেওয়া জিপে প্লেনে পৌঁছে যাব। সেখানে একজন পাইলটকে আমি সব কথা বলে নিজের দলে টেনেছি। আর একজনকে আগে থাকতে সেখানে বেঁধে রাখবার ব্যবস্থা আছে। তোমার প্লেন আমি চুরি করব না। শুধু কিছুক্ষণের জন্য ধার নিয়ে ওই প্লেনে হন্ডুরাস কী গুয়াতেমেলা কোথাও গিয়ে নামব। বেঁধে রাখা পাইলট ছাড়া পেয়ে সেখান থেকে তোমার প্লেন ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। তোমায় শেষ একটা উপদেশ। এরপর আর কোনও শয়তানি চালাকির চেষ্টা কোরো না। এখানে কারখানা বসানোর মতলব ছেড়ে অন্য কোনও কারবারে তোমার শয়তানি বুদ্ধি খাটাও গিয়ে। আচ্ছা, বিদায়!

    আমি উঠে আসতেই কেদারা থেকে ওঠবার চেষ্টা করে পাউলোর সে কী করুণ মিনতি।

    শোনো, শোনো, দাস! সত্যি তোমার কাছে হার স্বীকার করছি। রাক্ষুসি। ভ্যাম্পায়ারদের মরণকাঠি কী তা-ই শুধু বলে যাও!

    কে তার জবাব দেয়!

    তার আকুল মিনতি জিপের আওয়াজেই তখন চাপা পড়ে গেছে।

     

    ঘনাদা থামলেন।

    দরজায় ট্রে হাতে বনোয়ারি। ট্রে থেকে প্লেট নামানো থেকে সেটি একবারে চাঁছাপোঁছা না হওয়া পর্যন্ত ঘনাদার মুখে আর কথা নেই।

    আমাদের ধৈর্য অসীম।

    প্লেটটা তিনি নামাবার পরই মুখিয়ে থাকা কথাটা জানালাম।

    জবাবটা কিন্তু আমাদের যে চাই! রাক্ষুসিদের মরণকাঠিটা কী, ঘনাদা?

    মরণকাঠিটা হল, শিশিরের এগিয়ে দেওয়া সিগারেটের টিনটা খুলতে খুলতে ঘনাদা বললেন, ওই ডাইফেনাডিয়োন। মানুষের, বিশেষ করে হার্টের রুগির, পক্ষে এটা দামি ওষুধের সামিল, কিন্তু ইঁদুর বাদুড় গোছের প্রাণী মারবার একেবারে ব্রহ্মাস্ত্র। রক্ত চুষে যারা বাঁচে এ ওষুধ তাদের রক্ত জল করে দিয়েই মারে। ওষুধটার গুণ জানবার পরও এটা ব্যবহারের উপায় প্রথমে পাওয়া যায়নি। রাক্ষুসে ভ্যাম্পায়ার বাদুড় এ ওষুধ খেলে মরবে। কিন্তু তাদের খাওয়ানো যাবে কী করে? এক-একটা করে বাদুড় ধরে ওষুধ গেলানো তো যায় না। ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের একটা অভ্যাসের কথা জেনে এ সমস্যার আশাতীত সমাধান বার করা গেছে। ভ্যাম্পায়ারের একটা অভ্যাস হল বাঁদরদের মতো পরস্পরের গা চেটে পরিষ্কার করা। চামড়ার দস্তানা পরা হাতে একটা রাক্ষসিকে ধরে তার গায়ে আধ চামচ ভেসলিনের সঙ্গে মাত্র পঞ্চাশ মিলিগ্রাম ডাইফেনাডিয়ান মিশিয়ে লাগিয়ে দিলেই হল। একটা ওষুধ মাখানো রাক্ষুসির গা চেটে গোটা পঁচিশ ত্রিশ অন্য রাক্ষুসির ভবলীলা শেষ হবে।

    ক-দিন ধরে পাউলোর জিপে ঘুরে ঘুরে ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের গুহাগুলো খুঁজে বার করে এই কাজই করেছিলাম। পাউলো তার শয়তানি ফন্দিতে মোটমাট ষাট-সত্তরের বেশি ভ্যাম্পায়ার আমদানি করতে পারেনি। তার উদ্দেশ্য অবশ্য তাতেই সিদ্ধ হয়েছে। আমারও সুবিধে হয়েছে দিন তিনেকের মধ্যে তাদের সব কটাকে খতম করার।

    ওষুধের গুণ যতই হোক, ওই জাপানি কুয়াশা যাকে বলেছি তা না থাকলে সব কিছুই মিথ্যে হয়ে যেত। জাপানি কুয়াশা আসলে হল কুয়াশার মতো সূক্ষ্ম নাইলনের একরকম অদৃশ্য জাপানি জাল। তার সুতোগুলো এত সূক্ষ্ম যে রাত্রে তা অতি তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টিতেও একেবারে দেখাই যায় না, বাদুড়দের শব্দতরঙ্গও তাতে কাজ করে না। অত বেশি মিহি বলেই এ জালের নাম জাপানি কুয়াশা জাল।

    ভ্যাম্পায়ারদের গুহার মুখে এই কুয়াশা জাল টাঙিয়েই তাদের সব কটাকে আমি ধরতে পেরেছিলাম।

    ঘনাদা মুখের সিগারেট ধরিয়ে যথারীতি শিশিরের টিনটা ভুলে হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন।

    তিনি দরজার কাছে যাবার পর শেষ প্রশ্নটা হঠাৎ মনে পড়ল।

    গলা ছেড়ে জিজ্ঞাসা করলাম, আচ্ছা, এতদিন বাদে ওই কার্ল পাউলো আপনার খোঁজ পেল কী করে?

    ওই জাপানি কুয়াশা থেকে! ঘনাদা ফিরে দাঁড়িয়ে অনুগ্রহ করলেন, চলে আসবার পর নির্দেশ লিখে ওটা ওষুধপত্র সমেত জুয়ান ভার্গাস-এর কাছে পার্শেল করে পাঠিয়েছিলাম কিনা। সেদিন আবার তোমাদের চিড়িয়াঘরের কথায়, আশার গুনগুনিয়া রাখবার জন্য জুয়ানের কাছে সেটা আবার চেয়ে পাঠিয়েছি। সেই চিঠি কোনওভাবে পাউলোর হাতে পড়েছে বোধহয়। জাপানি কুয়াশা সুতরাং আর পাবার আশা নেই। তার দরকারও নেই অবশ্য। ঘনাদা একটু যেন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, তোমরা গুণগুনিয়া তো আর আনছ না।

    ঘনাদা চলে গেলেন।

    এরপর চিড়িয়াঘর বানাবার উৎসাহ আর থাকে?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }