Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    খাণ্ডবদাহে ঘনাদা

    না, নেই।

    বাজখাঁই গলাটা শিশিরের। তবে শুধু আমাদের আড্ডাঘরের চার দেয়ালের মধ্যে থাকবার জন্যে নয়, বাহাত্তর নম্বরের সব কটা তলা ছাড়িয়ে বনমালি নস্কর লেনে বাঁক পর্যন্ত পৌঁছবার মতো।

    গলাটা অত চড়াবার অবশ্য দরকার ছিল না। তেতলার টঙের ঘরে যাবার ন্যাড়া সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছবার মতো হলেই চলত। কারণ সেখানে তালতলার চটিজোড়ার পেটেন্ট আওয়াজ শোনামাত্রই পালাটা শুরু করা হয়েছে।

    বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের টঙের ঘরে যাবার ন্যাড়া সিঁড়িতে তালতলার চটির আওয়াজটা যে কার পায়ের তা নিশ্চয় কাউকে বলে দিতে হবে না।

    আওয়াজটা ঘনাদারই পায়ের, আর উঠতি নয়, নামতি। মানে ঘনাদা তাঁর টঙের ঘর থেকে নেমে আসছেন। আসছেন মানে আসতে বাধ্য হচ্ছেন। না এসে যাবেন। কোথায়? দু-দিন ধরে প্ল্যান করে সেই ব্যবস্থাই করেছি। মাছের জন্য যেমন চার ফেলা, তেমনই তাঁকে টঙের ঘর থেকে টেনে বার করে আনার জন্য সকাল থেকেই গন্ধ ছড়ানো হচ্ছে বাতাসে।

    প্রথমেই সকাল সাতটা না বাজতে বাজতে নীচের রসুইঘরে রামভুজের তেলের কড়ায় ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে কী যেন ভাজার শব্দ।

    সে শব্দ যদি তেতলা পর্যন্ত না পৌঁছয়, যা ভাজা হচ্ছে তার সুবাস গোটা বাড়ি তো বটেই, ছাদ ডিঙিয়ে পাশের বাড়ির মানুষের জিভেও জল না ঝরিয়ে ছাড়বে না।

    সে হিঙের কচুরির মোহিনী সুরভিতে যদি কাত না হন, তার পরেই পাড়া আমোদ করা চাকাচাকা গঙ্গার ইলিশ ভাজার গন্ধ।

    হিঙের কচুরির সঙ্গে ইলিশ ভাজা কি রসে রুচিতে মেলে?

    মিলুক না মিলুক, কার্যোদ্ধার হওয়া নিয়ে কথা। তা যে হয়েছে ন্যাড়া সিঁড়িতে চটির আওয়াজেই তো বোঝা যাচ্ছে। নীচে থেকে এসব গন্ধ তাঁর ঘরে গিয়ে পৌঁছচ্ছে অথচ বনোয়ারির চুলের টিকিও দেখা যাচ্ছে না ওপরের ছাদে, এ যন্ত্রণা কতক্ষণ আর সহ্য হয়!

    আমাদের গণনা মতো ঘনাদাকে নিজেই একবার তাই সরেজমিনে তদন্ত করবার জন্য নামতে হচ্ছে।

    তাঁর নেমে আসার খবর জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের দোসরা চাল শুরু। সে চাল হল শিশিরের ওই পাড়া কাঁপানো গলায়-না, নেই।

    নেই? গৌরের পাল্লা দেওয়া গলার প্রতিবাদ—মহাভারতে খাণ্ডবদাহের ঠিক বিবরণ নেই? শোন তাহলে—

    শতেক যোজন বন খাণ্ডব বিস্তার।
    লাগিল অনল, উঠে পর্বত আকার॥
    কৃষ্ণার্জুন দুই দিকে রহে দুই জন।
    নিঃশঙ্কে দহয়ে বন দেব হুতাশন॥
    প্রলয়ের মেঘ যেন, শুনি গড়গড়ি।
    নানা জাতি বৃক্ষ পোড়ে শুনি চড়বড়ি॥
    নানাজাতি পশু পোড়ে নানা পক্ষিগণ।
    নানাজাতি পুড়িয়া মরয়ে নাগগণ॥

    গৌর এ পর্যন্ত আওড়াবার মধ্যেই ঘনাদা আড্ডাঘরে পৌঁছে যান। দরজা থেকে ভেতরে আসবার মধ্যেই সবাই আমরা দাঁড়িয়ে উঠে নিঃশব্দে অভ্যর্থনা জানাই তাঁর মৌরসি আরামকেদারাটা ওরই মধ্যে একটু ঝাড়ামোছার ভান করে এগিয়ে দিয়ে।

    ঘনাদা সে কেদারায় যথারীতি গা এলিয়ে দেওয়ার পরও আমাদের পালা কীর্তন কিন্তু থামে না। এতক্ষণ ধরে সবকিছুর মধ্যে তা সমানে চলে এসেছে। গৌর তার আবৃত্তি শেষ করতে না করতে শিবু পয়ার থেকে ত্রিপদীতে নামার ভূমিকা করে বলেছে, শুধু ওই খাণ্ডবদাহ ঠেকাবার জন্যে যুদ্ধটার কথা কি ভুলে যাব নাকি? সব ক-টি দেবতা আর চর অনুচর নিয়ে স্বয়ং দেবরাজ ইন্দ্র এসেছেন খাণ্ডব বন বাঁচাতে–

    এই মত গুটিগুটি দেবতা তেত্রিশ কোটি
    গেল বন রক্ষার কারণে।
    আইল গরুড় পক্ষী সঙ্গে লক্ষ লক্ষ পক্ষী
    রক্ষা হেতু নিজ জ্ঞাতিগণে।
    যক্ষরক্ষ ভূতদানা সহ নিজ নিজ সেনা
    নানা অস্ত্র শেল শূল লৈয়া।
    এমত লিখিব কত ত্রিভুবন আছে যত
    রহে সবে আকাশ জুড়িয়া।
    তবে দেব পুরন্দরে আজ্ঞা দিল জলধরে
    বৃষ্টি করি নিবায় অনল।
    আজ্ঞামাত্র অতি বেগে সম্বর্তাদি চারি মেঘে
    মূষল ধারায় ঢালে জল।
    প্রলয় কালের বৃষ্টি যেন মজাইতে সৃষ্টি
    শিলা জলে ছাইল আকাশ।
    মহাঘোর ডাক ছাড়ে ঝনঝনা ঘন পড়ে
    তিন লোকে লাগিল তরাস।
    দেখি পার্থ মহাবল না পড়িতে বৃষ্টি জল
    শোষক বায়ব্য অস্ত্র এড়ে।
    শূন্যে অস্ত্র উঠে রোষে শোষকে সলিল শেষে
    বায়ব্যে সকল মেঘ ওড়ে॥

    গৌর শিবুর চেয়ে আমি-ই বা কম যাই কেন? শিবু দম নিতে একটু থামতেই আমি একেবারে মূল মহাভারত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম –আদি মহাভারতে স্বয়ং ব্যাসদেব কী বলে গেছেন জানিস? বলে গেছেন, ভগবান হুতাশন সপ্ত শিখা বিস্তার করিয়া চতুর্দিকে প্রজ্জ্বলিত হইয়া খাণ্ডবারণ্য দগ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন, তৎকাল যুগান্ত কালের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল—

    গুল! শিশির বাধা দিয়ে মাতব্বরি চালে বললে, গুল না হলে বেবাক ভুল!

    শিশিরের এই টিপ্পনিই করবার কথা। কিন্তু আমাদের রিহার্সেল দেওয়া সিনেরিওর। মতো আমায় কথাটা শেষ করতে দেওয়া উচিত ছিল নাকি! আর দুটো লাইন মাত্র বলাটুকুর তর সইল না!

    তখুনি ঘনাদার সামনে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়ে খাণ্ডবদাহ পালার ভুষ্টিনাশ করে দিতে ইচ্ছে করে কি না?

    তবু নিজের মহানুভবতায় রাগটা সামলে পরের সংলাপটা সিনেরিও মাফিক-ই বললাম, গুল! গুল না হলে ভুল? মহাভারতের? কী বলছ, কী?

    ঠিক কথাই বলছি। শিশির যেন তুরীয়লোক থেকে বললে, মহাভারতে কি ভুল কোথাও নেই?

    তুমি যখন বলছ তখন আছে হয়তো! আড়চোখে একবার ঘনাদার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু ভুল বা গুলটা কী জানতে পারি?

    তা পারো বইকী, শিশির যেন বাণী বিতরণের ভঙ্গিতে ঘনাদাকেও টেক্কা দিয়ে বললে, খাণ্ডব বন জ্বালাতে নয়, তার আগুন নেভাতেই কৃষ্ণ আর অর্জুনকে লেজে-গোবরে হতে হয়েছিল।

    তার মানে খাণ্ডব বনে আগুন লাগাতে কৃষ্ণ আর অর্জুন সাহায্য করেননি? তাঁরা আগুন নেভাবার জন্যই অস্থির হয়েছিলেন?

    একেবারে যেন হাঁ হয়ে প্রশ্নটা শিশিরকেই করলাম বটে, কিন্তু চোখগুলো আমাদের আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দেওয়া ঘনাদারই দিকে।

    কী করছেন কী ঘনাদা? এত রকম টোপ ফেলে তাঁকে নামিয়ে আনা, তার ওপর তাঁর মুখের সামনে তাঁরই দেখানো চাল চেলে এই সব বাজে বুকনির বেয়াদবি করা, এতেও ঘনাদা খেপে উঠবেন না? তাঁকে একেবারে চিড়বিড়িয়ে তোলবার জন্য আয়োজনের কোনও ত্রুটি তো কোথাও রাখিনি। আমাদের এই গা-জ্বালানো বাজে বুকনির সঙ্গে নীচের রসুইঘর থেকে হিঙের কচুরি আর ইলিশ ভাজার গন্ধটুকুই শুধু তাঁকে পেতে দিয়েছি, আসল মালের এখনও পর্যন্ত দেখাই মেলেনি।

    এসব জ্বালার ওপর খাণ্ডবদাহের এই নয়া ব্যাখ্যায় ঘনাদার তো নিজেরই আগুন হয়ে হুংকার দিয়ে ওঠবার কথা!

    কিন্তু তার বদলে ঘরে ঢোকা মাত্র শিশিরের কৌটো খুলে বার করে ধরিয়ে দেওয়া সিগারেটটি মৌজ করে টানতে টানতে তিনি যেন নির্বিকার হয়ে আমাদের কথা শুনছেন মনে হচ্ছে।

    এ দিকে আমাদের কথার প্যাঁচের পুঁজি যে ফুরিয়ে এসেছে।

    এতদূর পর্যন্ত পৌঁছবার আগেই ঘনাদা তেতে উঠতে উঠতে একেবারে দাউ দাউ করে জ্বলে আমাদের বেয়াদপির উচিত শিক্ষা দেবেন এই ছিল আমাদের হিসেব।

    কিন্তু দাউ দাউ করে জ্বলা কোথায়, ঘনাদার একটু উষম গরম হবার লক্ষণও যে নেই।

    শিশির ইতিমধ্যেই বেশ ফাঁপরে পড়েছে বোঝা যাচ্ছে।

    রিহার্সেল মাফিক আমাদের তখন একটু বাঁকা সুরে শেষ প্রশ্নটা ঝুলি থেকে ছাড়তে হয়েছে।

    জ্বালাবার বদলে কৃষ্ণ আর অর্জুন তো আগুন নেভাতে হন্যে হয়েছিলেন। খাণ্ডব বনে আগুনটা তাহলে লেগেছিল কেন?

    কেন লেগেছিল? জবাবের পুঁজি ফুরিয়ে ফেলে শিশিরের অবস্থা তখন কাহিল। হালে পানি না পেয়ে আমাদের জিজ্ঞাসাটাই সে আবার আউড়ে বললে, কেন লেগেছিল জিজ্ঞাসা করছ?

    হ্যাঁ, করছি।–কথার পিঠে খোঁচাটা দিতেই হল—অর্জুন শ্রীকৃষ্ণ তো আর বনের মধ্যে লুকিয়ে সিগারেট থুড়ি তামাক খাচ্ছিলেন না!

    তামাক খাবেন কেন! সুরটা চড়া হলেও শিশিরের গলায় তখন আর যেন জোর নেই—তামাক বলে কিছু তখন ছিল? ভারতে তো নয়ই, ইউরোপে এশিয়াতেও কেউ এ জিনিস জানত না।

    শিশিরের এ বিদ্যে জাহিরের চেষ্টাতেও কিন্তু আসল সমস্যার সুরাহা কিছু হল না। আমরা শিশিরকে নাকাল করতে চাই না। কিন্তু যেমন করে তোক তর্কটাকে গরম রাখবার জন্য শিশিরকেই না খুঁচিয়ে আমাদের উপায় কী?

    থাক, তামাক নিয়ে আর জ্ঞান দিতে হবে না! বলতেই হল আমাদের, খাণ্ডব বনে আগুন কী করে লাগল, সেইটেই আগে শোনাও।

    আগুন লাগল মানে—শিশির এবার তোতলা হতে শুরু করেছে—আগুন, কী বলে বনে আগুন কি কখনও লাগে না?

    নিশ্চয়ই লাগে!-আমরাও তখন জুতসই জবাব খুঁজতে দিশাহারা।

    কিন্তু কথাটা হচ্ছে যে আলাদা—” বলে কোনও রকমে খেইটা টেনে রেখে ঘনাদার দিকে চাইলাম। দৃষ্টিটা এবার সত্যিই অসহায় করুণ। সত্যি, হল কী ঘনাদার? এখনও তিনি নির্বিকার। আমাদের বেয়াদবির শোধ নেবার এমন মৌ-কা পেয়েও মুখ বুজে থাকবেন! এই ভারত-যুদ্ধে সত্যিই অস্ত্রগ্রহণ করবেন না একেবারে?

    আমাদের তো তাহলে নাকে খত দিয়ে রণে ভঙ্গে দিতে হয়। নইলে ওদিকে হিঙের কচুরি আর ইলিশ ভাজা তপ্ত খোলা থেকে নেমে যে ক্রমশ জুড়িয়ে মিইয়ে যাবে।

    মরিয়া হয়ে তাই সোজা ঘনাদাকেই মুরুব্বি মানলাম—শুনেছেন তো, ঘনাদা, আজগুবি কথা! মহাভারতের গুল না ভুল বার করেছে শিশির!

    কিন্তু কই, তাঁর সাড়া কই। ঘনাদার চোখ দুটো যেন একটু কোঁচকানো, কিন্তু মুখ দিয়ে তো স্রেফ খানিকটা ধোঁয়াই ছাড়লেন!

    আর কোনও আশা আমাদের নেই ভেবে যখন হাল ছেড়ে দিয়েছি তখন হঠাৎ অঘটন ঘটে গেল। ঘটল শিশিরেরই ড়ুবতে গিয়ে কুটো ধরার এক চালে।

    আমরা যখন ঘনাদার মুখের দিকে আকুল হয়ে চেয়ে আছি তখন হঠাৎ বারান্দা থেকে তার বাজখাঁই গলা শোনা গেল—বনোয়ারি, রামভুজ! বলি, তোমরা কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছ নাকি! খাবারগুলো কি ভিজে ন্যাকড়া করে আনবে!

    ব্যস, ওই ক-টা কথাতেই অমন ভোজবাজি হয়ে যাবে কে ভেবেছিল!

    ঘনাদাকে আরাম-কেদারায় হেলান দেওয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসতে দেখা গেল।

    তারপর আমাদের সকলের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে তিনি মুখও খুললেন!

    কিন্তু যা আশা করছিলাম সে বজ্রস্বর কোথায়? তার বদলে নরম গলায় যেন একটু আসকারা দেওয়া জিজ্ঞাসা—শিশির খাণ্ডবদাহের বৃত্তান্তটা বেঠিক বলছে, না?

    তা গলাটা খাদেই হোক বা নিখাদে, আমরা ওই মুখ খোলাটুকুতেই কৃতার্থ। আগুনের ওই ফুলকিটুকুই গনগনে করে তোলবার আশায় প্রাণপণে হাওয়া দিলাম।

    শিশির তখন বারান্দা থেকে তার জায়গায় এসে বসেছে। তাকে প্রায় খুনের আসামির কাঠগড়ায় তুলে কড়া নালিশ জানালাম, শুধু বেঠিক কী! ও বলছে ভুল না হলে গুলও হতে পারে। কৃষ্ণ আর অর্জুন নাকি খাণ্ডব বনে আগুনই লাগাননি!

    তা, শিশির ভুল আর কী বলেছে?

    একেবারে হাঁ হয়ে গিয়ে ঘনাদার দিকে তাকালাম। না, আমাদের শোনার কিছু ভুল হয়নি। কথাগুলো ঘনাদার মুখ থেকেই বেরিয়েছে।

    কিন্তু, খাণ্ডব বনে আগুন তাহলে লাগল কী করে? হতভম্ব মুখে আগের মিথ্যে করে বানানো প্রশ্নটা এবার সত্যি করেই বললাম ঘনাদাকে।

    উত্তর তখনই মিলল না। ঘনাদার চোখ তখন বনোয়ারি যেখান দিয়ে ঢুকছে সেই দরজার দিকে।

    উত্তরের জন্য একটু অপেক্ষা করতে হল তাই। একটু মানে, আলুর দম সমেত ডজন খানেক হিঙের কচুরি আর প্রায় ততগুলি ইলিশ ভাজার সদগতির পর বোয়ারির দেওয়া প্লেটটি চাঁচাপোঁছা হয়ে যতক্ষণ না ঘনাদার কোল থেকে আবার সামনের টেবিলে নামল।

    প্লেট নামিয়ে চায়ের পেয়ালাটা মুখে তোলবার পর নিজে থেকেই আমাদের প্রশ্নটা স্মরণ করে বললেন, কেমন করে খাণ্ডব বনে আগুন লাগল জিজ্ঞাসা করছ? কেমন করে আর! অগ্নিদেব নিজেই আগুন লাগালেন নিজের গরজে।

    মহাভারতেও তো তাই আছে—আমরা উৎসাহিত হয়ে যা বলতে যাচ্ছিলাম তা আর বলা হল না।

    ঘনাদা তর্জনী আর মধ্যম আঙুলের মাঝে শিশিরের জ্বালিয়ে দেওয়া পরের সিগারেটটি ধরে বাধা দিয়ে বললেন, ওইটুকুই মহাভারতে ঠিক আছে, তার বেশি নয়।

    তার মানে? আমাদের বিস্ফারিত চোখে বলতেই হল, ইন্দ্রদেব মেঘের পাল নিয়ে বৃষ্টিতে আগুন নেভাতে আসেননি?

    আসবেন না কেন? ঘনাদা এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ইন্দ্রদেবও বৃষ্টি নামিয়েছেন, কৃষ্ণার্জুনও সে বৃষ্টি উড়িয়ে দিয়েছেন অস্ত্রের কেরামতিতে, কিন্তু সে লড়াই তো আপোসের। তলায় তলায় ইন্দ্রদেবের সঙ্গে কৃষ্ণার্জুনের সড়-ই ছিল ওই রকম।

    ইন্দ্রের সঙ্গে কৃষ্ণ আর অর্জুনের সড়!—আমরা সত্যিই এবার থ– অগ্নিদেবের বিরুদ্ধে?

    বিরুদ্ধে কেন হবে! তাঁরই মঙ্গলের জন্য! ঘনাদা কেদারায় হেলান দিয়ে এবার করুণা করে একটু বিশদ হলেন——আসলে কৃষ্ণ অর্জুন খাণ্ডব বনে এসেছিলেন ময়দানবকে খুঁজতে। দুনিয়ায় ময়দানবের মতো এত বড় কারিগর আর নেই। ইন্দ্রপ্রস্থে পাণ্ডবদের যে সভাঘর তৈরি হবে তার জন্যে ময়দানবকে দরকার।

    কিন্তু খাণ্ডব বনের কাছে পৌঁছতে এক চিমসে হাড্ডিসার বামুন পুঁকতে ধুকতে তাঁদের সামনে এসে হাজির। ধনঞ্জয় চিনতে না পারলেও বাসুদেব তাঁকে দেখেই চিনেছেন।

    এ কি অগ্নিদেব? এ কী চেহারা হয়েছে আপনার?

    আর বলো কেন! বলে অগ্নিদেব তাঁর অসুখের যে লম্বা ইতিহাস শুরু করলেন তা আর শেষই হতে চায় না। শেষ পর্যন্ত তা থেকে মোদ্দা কথা যা জানা গেল তা এই যে, শ্বেতকী নামে এক রাজার যজ্ঞের বাতিকেই অগ্নিদেবের শরীরের এই দশা। শ্বেতকী রাজার যজ্ঞ করে আর আশ মেটে না। বছরের পরে বছর এক পুরুত হার মানলে রাজা অন্য পুরুত দিয়ে শুধু যজ্ঞই করে যায়, আর অগ্নিদেবকে সেই অফুরন্ত যজ্ঞে বসে বসে জালা জালা ঘি খেতে হয়। সেই ঘি খেয়ে খেয়েই অগ্নিদেবের এমন অগ্নিমান্দ্য যে কিছু আর হজম হয় না, কিছু মুখে রোচে না। সারাক্ষণ শুধু পেট জ্বালা আর চোঁয়া ঢেকুর।

    তা আপনাদের স্বর্গের অত বড় কবিরাজ অশ্বিনীকুমারদের একবার দেখালেই তো পারেন! না বলে পারলেন না ধনঞ্জয়।

    তা কি আর দেখাইনি! করুণ স্বরে বললেন অগ্নিদেব, আর তাঁদের বিধান শুনেই তো আপনাদের কাছে এসেছি।

    তাঁদের বিধান শুনে আমাদের কাছে?অর্জুনও অবাক, কী তাঁদের বিধান? বড় কুমার বলেছেন, মাংস খান যত পারেন আর ছোট বলেছেন, সেদ্ধ-টেদ্ধ নয়, শুধু আগুনে ঝলসানো টাটকা মাংস খেতে। অগ্নিদেব নিজের সমস্যাটা ব্যক্ত করলেন, তাই এই খাণ্ডব বনটা জ্বালাতে এসেছিলাম। কিন্তু এ বন আবার দেবরাজ ইন্দ্রের খাস তালুক। কোথাও দুটো মরা গাছের শুকনো কাঠ একটু ধরাতে না ধরাতেই একেবারে আকাশ-ফুটো করা জল ঢেলে নিভিয়ে দেন। এই দুঃখেই আপনাদের কাছে এসেছি। দোহাই আপনাদের, দেবরাজ ইন্দ্রকে যেমন করে তোক ঠেকিয়ে খাণ্ডব বনটা আমায় পুড়িয়ে খেতে দিন।

    অগ্নিদেবের মিনতি শেষ হতে না হতেই শ্রীকৃষ্ণ বলে দিলেন, তথাস্তু। আপনি খুশিমত খাণ্ডব বন পোড়ান গিয়ে যান। দেবরাজ ইন্দ্রকে আমরা সামলাচ্ছি।

    অগ্নিদেব তো শুনেই খুশি হয়ে চলে গেলেন। অর্জুন কিন্তু হতভম্ব।

    এ কী করলে, বন্ধু! কৃষ্ণকে তিনি অবাক হয়ে বললেন, কিছু না ভেবে-চিন্তে অগ্নিদেবকে তথাস্তু বলে দিলে! খাণ্ডব বন আমরা পোড়াতে দেব কেন? এত কষ্ট করে যাঁকে খুঁজতে এসেছি সেই ময়দানব ওখানে থাকেন। তা ছাড়া বনের জন্তু জানোয়ার আমাদের কী করেছে যে, তাদের এমন সর্বনাশে সাহায্য করব! দেবরাজ ইন্দ্রের সঙ্গেও বা এমন অন্যায় করে যুদ্ধ করতে যাব কেন?

    আহা—সত্যি কি ওসব করব নাকি! হেসে বললেন শ্রীকৃষ্ণ, দেবরাজকে স্মরণ করে এখুনি চালটা সব বুঝিয়ে দিচ্ছি। অগ্নিদেব নিজে যা পারেন করুন, আমরা বাইরে থেকে তাঁর হয়ে দারুণ যুদ্ধ করার ভান করে ইন্দ্রদেবকে আগুন নেভাতেই সাহায্য করব।

    বলছ কী? ধনঞ্জয়ের দুচোখ এবার কপালে—অগ্নিদেবকে অমন মিথ্যে ভরসা দিলে?

    দিলাম ওঁরই ভালর জন্য! আশ্বাস দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন বাসুদেব, শুধু ঘি খেয়ে তো নয়, নাগাড়ে যজ্ঞস্থানে থুম হয়ে বসে বসে ভুজি খেয়ে ওঁর পেটের ওই অবস্থা। মাংসের চেয়ে ওঁর বেশি দরকার একটু ছোটাছুটি। তা এই খাণ্ডব বনে ছোটাতে ছোটাতে ওঁর কালঘাম বার করবার ব্যবস্থা করব। উনি কোথাও দুটো শুকনো কাঠ ধরাতে না ধরাতেই দেবরাজ পশলা পশলা বৃষ্টি ঢালবেন তা নেভাতে, আমরাও তা ঠেকাবার নামে পবনদেবকেই রাখব রুখে, যাতে আগুন না ছড়ায়। তাতে অগ্নিদেবকে সারাক্ষণ ছোটাছুটিই করতে হবে সারা বন, শুকনো জায়গার খোঁজে। তাতে শিকার পান বা না পান, তাঁর পেটের রোগ একেবারে যাবে সেরে।

    কিন্তু–

    অর্জুন একটু আপত্তি জানাতেই শ্রীকৃষ্ণ হেঁকে বললেন, অগ্নিদেব যদি জানতে পারেন সেই ভয় করছ তো? না, সে ভয় নেই। অগ্নিদেব জানবেন আমরা দুজনে যুদ্ধ করে একেবারে ফাটিয়ে দিয়েছি। কেমন করে জানবেন? ওই যে বায়স ক-টি দেখছ, মাথার ওপর কা কা করছে, ওরা হল বাত বিশারদ, সংবাদ দেবার নেবার সাংবাদিকও বলতে পারো। কা কা করে ওরা খবর কুড়িয়ে আর ছড়িয়ে বেড়ায়। ওদের মুখেই আমাদের চুটিয়ে লড়াই করার খবর অগ্নিদেবকে আমি পাঠাবার ব্যবস্থা করছি। আপাতত ইন্দ্রপ্রস্থের রাজসভাতেও এই বিবরণই যাবে। শেষকালে শুধু ছোট একটু টীকা থাকবে,—এ অলীক বিবরণের কারণ বুঝিয়ে তা সংশোধন করার।

    ঘনাদা থামলেন।

    তারপর নিজে থেকেই আমাদের জিজ্ঞাসাটা আঁচ করে নিয়ে বললেন, মহাভারতে সে টীকাটা কেন নেই জানতে চাইছ তো? না, দারুক মূষিক কোম্পানি কি বল্মী বিশারদের কাজ এটা নয়। দোষ তালপাতা জোগান যে দিয়েছিল সেই ব্যাপারীর। গণেশঠাকুরকে যেসব তালপাতার জোগান দেওয়া হয়েছিল তার কিছু ছিল রীতিমতো পুরনো, ঘুন-ধরা, মুচমুচে। পুঁথির রাশ নাড়াচাড়ার সময় তার খাস্তা হয়ে যাওয়া একটা টুকরো কখন কোথায় খসে পড়েছে কেউ টেরই পায়নি। টীকাটুকু ওখানেই ছিল।

    ঘনাদা কেদারা ছেড়ে উঠলেন। তাঁকে আর চাইতে হল না। পকেট থেকে গোটা একটা সিগারেটের টিন বার করে শিশির নিজেই তাঁর হাতে গুঁজে দিল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }