Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    মৌ-কা-সা-বি-স থেকে রসোমালাই

    হ্যাঁ, পৃথিবীর এমন বিপদ তার সৃষ্টির সময় থেকে আগে কখনও আসেনি। সমস্ত পৃথিবীই তার সমস্ত প্রাণিজগৎ নিয়ে ধ্বংস হতে যাচ্ছে। না, না, পারমাণবিক বিস্ফোরণ নয়, তার চেয়ে ভয়ংকর অপ্রতিরোধ্য কিছুতে। কল্পনাতীত সে সর্বনাশ ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে, ধীরে ধীরে, কিন্তু অমোঘভাবে কোথা থেকে—

    শিবু দম নেবার জন্য থামল। কথাগুলো কিন্তু শিবুর নিজের কিংবা আমাদের কারওর বা স্বয়ং টঙের ঘরের তাঁরও নয়। কথাগুলো সেই তাদেরই, ধৈর্য ধরে বেশ কিছুকাল যাদের জন্য অপেক্ষা করে ছিলাম।

    ধৈর্য না হারিয়ে আমাদের যে লাভই হয়েছে ওপরের উদ্ধৃতিটি তার প্রমাণ। উদ্ধৃতিটি যে সেই অদ্বিতীয় মৌ কাসা-বিস-এর কোনও লেখা থেকে তা অনেকেই এতক্ষণে বুঝে ফেলেছেন বোধহয়।

    প্রায় তিন মাস ধরে এই রকম কোনও কিছু লেখা একটি চিঠির জন্য হা-পিত্যেশ করে আছি। কতবার লোভ হয়েছে মৌ-কা-সা-বি-স-এর দেওয়া একটি বিশেষ খবরের কাগজের নম্বর দেওয়া পোস্টবক্সের ঠিকানায় একটা চিঠি পাঠিয়েই দেখি, ফল কী হয়।

    শেষ পর্যন্ত অনেক কষ্টে সে দুর্বলতা জয় করে আরও কিছুকাল অপেক্ষা করবার পণ করেছি।

    তার ফল সত্যি আশাতীতভাবেই ফলেছে বলা যায়। চিঠি যা এসেছে, ওপরের উদ্ধৃতিটুকু থেকেই বোঝা যাবে যে তা নেহাত মামুলি সাদামাঠা কিছু নয়, রীতিমত তাজা বারুদ-ঠাসা-কিছু, একটু আগুনের ফুলকি লাগলেই যা লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাধাতে পারে।

    চিঠিটা আগের বারের মতোই এক প্রকাশকের মারফত এসেছে। তবে এবার প্রাপকের নামটা আমাদের টঙের ঘরের তাঁর নয়, এবার প্রাপক হিসাবে নাম যা দেওয়া হয়েছে তা একজন বিশেষ কারওর না হয়ে একেবারে পুরোপুরি চারজনের। সে চারজন হচ্ছি আমরা অর্থাৎ গৌর শিবু শিশির ও আমি।

    নামগুলি সবই পদবিহীন। শুধু আদি অংশটুকুর সারি সেখানে এরকম দাঁড়িয়েছে, গৌর শিবু শিশির ও সুধীর।

    যে প্রকাশকের ঠিকানায় এ চিঠিটি পাঠানো হয়েছে তিনি যে বাজে কাগজের ঝুড়িতে না ফেলে এ চিঠি কষ্ট করে আমাদের বাহাত্তর নম্বরের ঠিকানায় রি-ডাইরেক্ট করে পাঠিয়েছেন, এ তাঁর অনেক দয়া।

    ঘনাদার নামে আর উদ্দেশে অনেক আজে বাজে আজগুবি আবদারের চিঠিপত্রই তো আসে। তেমনই একটা উটকো ঝামেলা মনে করে তিনি চিঠিটা আমাদের ঠিকানায় পাঠাবার কষ্ট না করলেই আমাদের কত বড় লোকসান যে হয়ে যেত তা শিবুর পড়তে-শুরু করা চিঠিটার সামান্য নমুনা থেকে বুঝতে পারছিলাম।

    আজ শিবুর অবশ্য মস্ত একটা বাহাদুরির দিন। দুপুরবেলা আমাদের কেউ না কেউ রোজই বাইরের লেটারবক্সটা একবার হাতড়ে আসে। আজ পালাটা ছিল শিবুর।

    মৌ-কা-সা-বি-স-এর প্রথম চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে দুপুরের এই লেটারবক্স হাতড়াতে যাওয়াটার সঙ্গে একটা উত্তেজনা জড়িয়ে গেছে। কী আসে, কী হয় গোছের একটা আগ্রহের অস্থিরতা কিছুতেই যেন চাপা যায় না।

    দিনের পর দিন হতাশ হয়ে বাইরে একটা নির্লিপ্ত উদাসীন ভাব দেখালেও শিবু বেশ একটু ধুকধুকুনি না নিয়ে কি নীচের তলার সিঁড়ির পাশের লেটারবাক্সটা খুলেছে?

    খুলে ভেতরে হাত গলিয়ে যা পেয়েছে তাতেই তুড়ি মেরে লাফ দিয়ে ওঠা খুব অন্যায় হত না। না, ইলেকট্রিকের বিল-টিল গোছের কিছু বা আজেবাজে সস্তা সাপ্তাহিক কাগজের পাওনা প্যাকেট নয়, রীতিমত লম্বা খামের মুখ বন্ধ করা চিঠি।

    লেফাফাটা বার করে এনে তার ওপরের নাম চারটে পড়বার পর শিবুর ধীরেসুস্থে জামা খোলার আর তর সয়নি। একটানে লেফাফাটার একটা মাথা ছিঁড়ে ফেলে ভেতরের চিঠিটা বার করে এক-এক লাফে তিন-তিনটে করে ধাপ ডিঙিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে ওপরের বারান্দায় উঠেই, শোনো, শোনো, বলে চিৎকার করে আড্ডাঘরে ঢুকেই যা পড়তে শুরু করেছে তা আগেই জানিয়েছি।

    দম নিতে একটু থামার পর শিবুর আর শুরু করবার সুযোগ হয়নি। তিনদিক থেকে আমরা তিনজন তার দিকে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে জিজ্ঞাসা করেছি অস্থিরভাবে, কী কীকার চিঠি? সেই মৌ-কা-সা-বি-স—

    আমরাও আমাদের প্রশ্নগুলো শেষ করতে পারিনি। হাত বাড়িয়ে শিবুর কাছ থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নেওয়াও সম্ভব হয়নি। আমাদের উদ্দেশ্যটা অনায়াসে অনুমান করে আগেই চিঠিটা চটপট আমাদের নাগালের বাইরে সরিয়ে নিয়ে সে বলেছে, তিষ্ঠ, তিষ্ঠ। এতকাল যদি ধৈর্য ধরতে পেরে থাকো তাহলে আর কয়েক সেকেন্ড সে ক্ষমতার পরিচয় দাও। নইলে তোমাদের টানাটানিতে সমস্ত বর্তমান পৃথিবীর পক্ষে অমূল্য একটি বিপদ সংকেতের বার্তা ছিন্ন হয়ে–

    আরে, থামো, থামো,—এবার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার আগ্রহটা দমন করেই ধমক দিতে হয়েছে শিবুকে, বাজে বাল্লা না করে চিঠিটায় কী আছে, পড়ো। আমরা ঠাণ্ডা হয়েই শুনছি।

    শান্ত হয়েই তারপর শিবুকে চিঠিটা পড়ে শোনাতে দিয়েছি, কিন্তু সে যা শুনিয়েছে তাতে অস্থির না হয়ে ওঠা আর সম্ভব হয়নি।

    হ্যাঁ, চিঠিটা মৌ-কা-সা-বি-স-এর, কিন্তু তাদের কাছ থেকেও এমন আজগুবি আষাঢ়ে চিঠি পাওয়ার কথা ভাবতে পারিনি। মৌ-কা-সা-বিস এবার যেন নিজেদের আগের সব বাহাদুরির ওপর টেক্কা দিয়েছে।

    চিঠিটা যে টঙের ঘরের তাঁর নামে নয়, আমাদের চারজনের নামে পাঠানো হয়েছে, তা আগেই জানিয়েছি। নাম বদলের কৈফিয়ত দিয়েই চিঠিটা এইভাবে শুরু—

    বন্ধুগণ, ইতিপূর্বে আপনাদের মেসের টঙের ঘরের তাঁহার উদ্দেশে বেশ কয়েকটি পত্র প্রেরণ করিয়াও তাহাতে কোনও প্রকার সাড়া না পাইয়া এবার সেই একমেবাদ্বিতীয়ম এবং চার বাহনকে উদ্দেশ করিয়াই এ পত্র পাঠাইলাম। আশা করি এ পত্রে বিবৃত বিষয়ের গুরুত্ব বুঝিয়া আপনাদের সর্বজ্ঞ ঠাকুরের কাছে বিশ্বের মহাসংকটের কীসে পরিত্রাণ তাহা জ্ঞাত হইবেন।

     

    বিশ্বের মহাসংকটের কথা এবার সহজ ভাষায় সংক্ষেপে বললে এইরূপ দাঁড়ায় বলে মৌ-কা-সা-বি-স যা জানিয়েছে তার খানিকটা শিবুর মুখে আগেই শুনেছি। শিবু যেখানে থেমেছিল তার পরের কথাগুলো হল—আপনাদের সর্বজ্ঞ ঠাকুর সে বিষয়ে কিছু জানেন কি? তিনি কি বলতে পারেন পৃথিবীর কোন এক অভিশপ্ত জায়গা থেকে সমস্ত প্রাণিজগতের চরম সর্বনাশ কেমন করে ঘনিয়ে আসছে? জানেন কি যে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিমান কটি দেশ সম্পূর্ণ খবর না পেলেও সামান্য একটু আঁচ পেয়েই গভীর আতঙ্কে অতি গোপন সব বৈঠকে আরও বিশদ করে ব্যাপারটা জানবার আর সম্ভব হলে তার প্রতিকারের উপায় সন্ধানের চেষ্টা করছেন? তিনি কি জানেন আকারে নেহাত সামান্য পৃথিবীর একটি বিশেষ জায়গা মাত্র কিছুদিন আগে থেকে মানুষের ভূগোল থেকে একরকম বাদ দিয়ে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। বিশ্বে সাধারণ মানুষের মধ্যে উন্মত্ত আতঙ্ক ছড়াবার ভয়ে এই নিয়ে হইচই দূরে থাক, কোনও রকম আলোচনাও বাইরে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু প্রধান প্রধান দেশের সবচেয়ে ওপরের মহলে কর্তাদের এই ব্যাপারে দিনেরাত্রে ঘুম নেই। যে জায়গাটুকু নিয়ে এই ভয়ংকর আতঙ্ক তা এখনও মাপে একশো বর্গমাইলের বেশি হবে না, কিন্তু পৃথিবীর বুকের বলতে গেলে ওই এক বিন্দু জায়গা এখন অমন দশ লক্ষ মেগাটন বোমার চেয়ে সর্বনাশা হয়ে উঠেছে। যে চরম ধ্বংসের নিয়তির দিকে তা আমাদের নিয়ে চলেছে তা ঠেকাবার আর উপায় আছে বলে মনে হয় না। সুতরাং অদূর ভবিষ্যতের অনিবার্য সৃষ্টি বিনাশের পরিণাম মেনে নিয়ে শেষ পর্যন্ত দুটো সাধারণ প্রশ্নই আপনাদের মারফত আপনাদের সেই টঙের ঘরের তাঁকে জিজ্ঞাসা করতে চাই। নিভোচি বলে কারওর কথা কিছু কি তিনি জানেন? আর নিউ এরা শব্দটা শুনলে কিছু তাঁর মনে হয় কি না।

    ঠিক তাল-ঠোকা বাহাদুরির সুরে নয়, এবার যেন খানিকটা সরল আগ্রহের সঙ্গে এসব কথা লিখে মৌ-কা-সা-বি-স এ-চিঠির শেষে যথারীতি একটি দৈনিকের একটি নম্বর দেওয়া পোস্টবক্সে আমাদের উত্তরটা তাদের পাঠাতে অনুরোধ করেছে।

    হ্যাঁ, এবার সত্যিই চিঠির শেষে বেশ একটু নরম অনুরোধের সুর। আমরা যেন তাঁদের এ চিঠি অবহেলাভরে ছেঁড়া কাগজের ঝুড়িতে না ফেলি। আর কিছু না পারি নিউ এরা শব্দটার রহস্যটা যে কী তা একটু জানবার চেষ্টা যেন অতি অবশ্য করি।

    তাল-ঠোকা টিটকিরির বদলে বিনীত অনুরোধ ঠিকই। কিন্তু তারই বা আমরা করতে পারি কী?

    মৌ-কা-সা-বি-স-এর তাগিদের দরকার ছিল না, নিজেরাই এখন আমরা শুধু নিউ এরা নয়, নিভোচির রহস্যটা যে কী তা একটু জানবার জন্য ব্যাকুল।

    কিন্তু জানতে চেষ্টা করার একমাত্র যা উপায় সেই বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাঁধবে কে? আর বাঁধবেই বা কীভাবে।

    টঙের ঘরের তাঁকে বাগে আনার সবচেয়ে সোজা উপায় তো তাঁর জন্য চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়র ঢালাও নৈবেদ্য সাজানো। কিন্তু তাতে এখন চিড়ে ভিজবে বলে তো আশা হচ্ছে না।

    তবু চেষ্টার ত্রুটি আমরা করিনি। আমিষের দিকে তাঁর যা পছন্দ সেই চিংড়ির কাটলেট থেকে শুরু করে সাত্ত্বিকের দিকে বাগবাজারের সেরা রসোমালাই পর্যন্ত কিছুই তাঁর জন্য সাজিয়ে রাখতে ত্রুটি করিনি।

    কিন্তু যাঁর জন্য এত যোঢ়শোপচারের নিবেদন তিনি কোথায়? প্রথমত, নীচের আড্ডাঘরের বারান্দায় আমাদের হইচই টঙের ঘরের টনক নড়াবার কথা। তার ওপর বনোয়ারিকে দিয়ে খবরটাও যথাসময়ে পাঠাতে ভুল হয়নি আমাদের।

    তবু তেতলা থেকে নামবার ন্যাড়া সিঁড়িতে বিদ্যাসাগরি চটির ফট ফট শব্দ কই? কই বারান্দা থেকে আড্ডাঘরে ঢোকবার আগে সেই পেটেন্ট গলাখাঁকারি।

    না, এবার আর নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকা যায় না। পরপর চারজনই ন্যাড়া সিঁড়ি বেয়ে খোলা ছাদে উঠে সটান সেই টঙের ঘরে। আমাদের পিছু পিছু ঢাউস দুটি ট্রেতে সব প্লেট সাজিয়ে বনোয়ারিও।

    না, ভয় ভাবনা করার মতো কিছুই সেখানে দেখলাম না। ঘনাদা সশরীরে সেখানে উপস্থিত এবং বেশ বহাল তবিয়তেই।

    তবে আমাদের আড্ডাঘরের অমন রসালো নিমন্ত্রণে সাড়া না দেবার কারণ কী?

    বনোয়ারির সামনে ট্রে থেকে নামিয়ে প্লেটগুলো বড় টেবিলের অভাবে ঘনাদার তক্তপোশেরই এক ধারে সাজিয়ে রাখবার মধ্যে সেই কথা জিজ্ঞাসা করলাম। ব্যাপার কী, ঘনাদা? বনোয়ারি আপনাকে ঠিক মতো খবর দেয়নি বুঝি?

    খবর? যে খবরের কাগজটি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে পড়ছিলেন তা থেকে মুখ তুলে ঘনাদা যেন একটু বিস্মিতভাবে আমাদের দিকে চেয়ে বললেন, কীসের খবর?

    এই—এই মানে— আমরাই এবার একটু ফাঁপরে পড়লাম নিজেদের কথাটা অর্ধেক ঢেকে জানাতে। আমতা আমতা করে বললাম, মানে, ওই আজ হঠাৎ ক-টা স্পেশ্যাল ডিশ আনাবার সুবিধে পেলাম কিনা, তাই এই।

    শিশিরের বাধো বাধো কথাটা গৌরই প্রাঞ্জল করে দিয়ে বললে, এই যেমন ডাবল সাইজ চিংড়ির কাটলেট, শিক নয়, একেবারে সাচ্চা শিকাবাব।

    হাঁ, ঘনাদা প্লেটগুলোর ওপর দৃষ্টি বোলাতে বোলাতে বাধা দিয়ে বললেন, দেখতে তো পাচ্ছি, প্লেটগুলো। তবে আজ বারটা যে বুধ সেটা তো ভুলতে পারছি না।

    বারটা যে বুধ! বলছেন কী ঘনাদা? বুধবারের সঙ্গে এই সব উপাদেয় ভোজ্যের কী সম্বন্ধ?

    সেই কথাই সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে হঠাৎ সম্বন্ধের সূত্রটা যে কী তা মনে পড়ে গেল।

    দোষটা সম্পূর্ণ শিবুর। আগের বুধবারে বাজারে তেমন ভাল মাছ-টাছ না পেয়ে ফুলকপি, স্কোয়াস কড়াইশুটির মতো অসময়ের বেশ ক-টা দুর্লভ সবজি এনে দোষটা কাটাতে চেয়েছিল। তার সেই নিরামিষ বাজারেও খুব একটা অপরাধ হত না। কিন্তু এর ওপর সবাই মিলে টেবিলে খেতে বসবার পর সে যে টিপ্পনিটা কেটেছিল সেইটিই যে মারাত্মক হয়েছে তা এখন বুঝলাম।

    নিরামিষ হলেও রামভুজের রান্নার বাহাদুরি যাবে কোথায়? একটার পর একটা পদে থালা চেটেপুটে সাফ করতে করতে ঘনাদা আধা ঠাট্টার সুরে একবার বলেছিলেন, কী হে, আজ শুধু বোটানিক্যাল গার্ডেনেই ঘুরতে হবে নাকি?

    কথাটায় ঠিক বরাদ্দ মাফিক হাসলেই ব্যাপারটা চুকে যেত। কিন্তু আহাম্মকের মতো শিবু একথার ওপর বলে বসেছিল, সেইটেই উচিত নয় কি? হপ্তায় একদিন স্রেফ আমিষের বদলে নিরামিষ তো সব শাস্ত্রের বিধান।

    ও! তাই বুঝি! বলে যে ঘনাদা তারপর একটু বেশি রকম গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন অন্য কী-একটা আলোচনার উত্তেজনায় সেটা সেদিন তেমন লক্ষই করিনি। কিন্তু এখন ফ্যাসাদ যা বেধেছে তা থেকে উদ্ধারের উপায় কী?

    কিন্তু কীসে যে কী হয় তা কেউ কি পারে বলতে? যার আহাম্মকিতে আমাদের এই মহাসংকট, সব মুশকিল আসান হয়ে গেল তারই আর-এক আহাম্মুকিতে।

    বারটা যে বুধ ঘনাদার এই কথাটায় হঠাৎ যেন দারুণ মজার খোরাক পেয়ে শিবু হাসতে হাসতে বলল, বারটা যে বুধ! বাঃ, এই সব প্লেট দেখে আপনার বুধবারের কথা মনে হল। আর আমার কী মনে হচ্ছে জানেন? মাথা নেই মুণ্ডু নেই তবু মনে হচ্ছে কী এক নিউ এরার কথা। হঠাৎ খেয়াল হচ্ছে যে ইউরেকার মতো নিউ এরা বলে চেঁচিয়ে উঠি। সেই সঙ্গে নিভোচি বলেও চেঁচাতে পারি।

    আমরা তখন প্রায় জমে পাথর হয়ে গেছি। আহাম্মক শিবুটা শেষ পর্যন্ত করল কী! ঘনাদার দিকে চেয়েই বুঝেছি, সর্বনাশের আর কিছু বাকি নেই। মুখটা তাঁর ঘণ্টায় একশো মাইল বেগে ছুটে আসা সাইক্লোনের পূর্বাভাষের মতো থমথমে। যে কোনও মুহূর্তে আকাশটায় ফেটে পড়তে পারে।

    নিউ এরা!নিউ এরা শব্দটা মনে পড়ে তোমার মজা করে চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে করছে?—এ ঘনাদার গলা না দূর আকাশ থেকে ছুটে আসা মেঘের গুমরানি।

    আহাম্মক শিবুর তবু কি হুঁশ আছে। ঘনাদার কথায় যেন আরও মজা পেয়ে সে বললে, চেঁচিয়ে উঠতে ইচ্ছে না করে পারে? ওরকম অদ্ভুত কথায় গলায় যে সুড়সুড়ি লাগে।

    সুড়সুড়ি লাগে—ঘনাদার গলায় এবার যেন পাখোয়াজি গমক, তারপর যেন চাপা গর্জন—ওই আজগুবি উদ্ভুট্টে শব্দটায় কী বোঝায় তা জানো? জানোনা, একদিন ওই শব্দটা শুনে দুনিয়ার প্রধান প্রধান দেশের যাঁরা হর্তাকর্তা তাঁরা চোখে অন্ধকার দেখে গোপনে গোপনে দিনের পর দিন গোপন পরামর্শ-সভা ডাকছিলেন। সে সব একান্ত গোপন সভার কথা দুনিয়ার কোথাও কোনও খবরের কাগজে বার হয়নি। সেখানে ডাক পড়েছে শুধু সেরা সকল বৈজ্ঞানিকের। সে সব বৈজ্ঞানিকদের মুখ কিন্তু একেবারে তালা বন্ধ। তাঁদের অতি আপনজনও ঘুণাক্ষরে এ বিষয়ে কিছু জানতেন না।

    কেন দুনিয়ার হর্তাকর্তাদের মহলে এই আতঙ্ক? কেন ঘনঘন এ সব গোপন পরামর্শ সভা? সে সব কিছুর সঙ্গে ওই নিউ এরা শব্দটা কীভাবে জড়ানো তা কল্পনা করতে পারলে ও শব্দটায় গলা সুড়সুড় করবার মতো মজা পেতে না।

    ঘনাদা একটু থামলেন। তা থামুন, আমরা এখন তাঁকে লাইনে পেয়ে গেছি। এখন আর আমাদের পায় কে?

    নিজের ভাবনায় যিনি তন্ময় তাঁর অন্যমনস্কতার ভেতরেই চিংড়ির কাটলেটের প্লেটটা তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে শিবু যেন ভয়ে ভয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললে, নিউ এরা মানে সুপার নিউট্রন বোমা গোছের কিছু নিশ্চয়। বড় বড় চাঁইদের আগে ছোটখাটো কোনও রাজ্য বিজ্ঞানের আচমকা-পাওয়া-কোনও-প্যাঁচে যা আবিষ্কার করে বানিয়ে ফেলেছে বলেই বড় বড় চাঁইদের এত ভয়।

    সুপার মেগাটন! অন্যমনস্কভাবে শিবুর এগিয়ে দেওয়া প্লেটের সুপার চিংড়ির কাটলেট জোড়া প্রায় শেষ করে এনে মৃদু নাসিকা ধ্বনি করে ঘনাদা বললেন, ও সব সুপার নিউট্রন-এ চোখে অন্ধকার দেখবার পাত্র ওই বড় বড় চাঁইরা নয়–তাদের হার্টফেল করবার অবস্থা যাতে হয়েছে তা এমন কিছু যা মানুষের কল্পনারও বাইরে।

    ঘনাদা সামান্য কয়েক সেকেন্ড থামতেই পাকা হাতে তাঁর প্লেট বদল করে নিয়ে চিংড়ির কাটলেটের জায়গায় শিকাবাবের থালি ধরিয়ে শিবু বললে, কল্পনার বাইরে মানে আপনিও তখন কল্পনা করতে পারেননি?

    জানতেও পারেননি?—আমাদের গলায় সবিস্ময় অবিশ্বাসের সুর—কোথায় ছিলেন তখন আপনি?

    আমি! ঘনাদা দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করলেন, যেখানকার হোয়াইট হাউসের গোপন বৈঠকে বড় বড় চাঁই আর বৈজ্ঞানিকদের বৈঠক বসেছে, আমি তখন সেই মার্কিন মুলুকেই ওয়াশিংটন শহরেই আছি। সেখানে অবশ্য গিয়েছি ওই—

    এফবিআই-কেজিবি-সিআইএ-এর ডাকে নিশ্চয়! গৌর এবার উচ্ছাসভরে জানিয়ে দিতে দেরি করল না।

    থাক! সে কথা থাক! বলে স্বীকার-অস্বীকারের মাঝামাঝি ভাব দেখিয়ে ঘনাদা বললেন, যেই ডাকুক, একটা খুব জরুরি ধান্দাতেই সেখানে যেতে হয়েছিল। মার্কিন মুলুকে মাফিয়াদের দাপট তখন একটু বেশি রকম বেড়েছে। ইটালির পায়ের তলায় নেহাত এক পাটি জুতোর শামিল সিসিলি দ্বীপে যারা শ-চারেক কি পাঁচেক বছর ধরে গাঁইয়া শয়তানিতে হাত পাকিয়েছে, সিসিলির সেই সব গুণ্ডা শয়তানের বংশ আমেরিকায় গিয়ে মনের মতো জল-হাওয়ায় ফুলে-ফেঁপে উঠে গোসাপ থেকে একেবারে নোনা গাঙের ধেড়ে মানুষ-খেকো কুমির হয়ে উঠেছে। তাদের নিয়ে তখন নতুন করে যে সমস্যাটা জেগেছে সেটা হল তাদের যেন এক আশ্চর্য গায়েব হয়ে যাওয়া বা গায়েব করে দেওয়ার ক্ষমতা। এ গায়েব হওয়া বা করা মানে একেবারে সাবাড় করে দেওয়া বা হয়ে যাওয়া নয়। যারা এমন নিরুদ্দেশ হয়—নিজেদের দরকার মতো তাদেরকে আবার যথাস্থানে হাজিরও করে—এই মাফিয়ার দল। কিন্তু কেমন করে যে তাদের লোপাট করে রাখে সেই রহস্যেরই কোনও কূল-কিনারা দুনিয়ার অন্য ধুরন্ধরেরা তো বটেই, এফবিআই-কেজিবি-সিআইএ মিলেও করতে পারছে না।

    ব্যাপারটা ক্রমশ সঙ্গিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন মুলুকে দুটিই মাত্র রাজনৈতিক দল-রিপাবলিক্যান আর ডেমোক্র্যাট। ধরা যাক প্রেসিডেন্ট পদের জন্য লড়াই চলছে। এ লড়াইয়ে ডেমোক্র্যাট প্রতিনিধিরই জেতবার বারো আনা সম্ভাবনা। তিনিই হঠাৎ দেখা গেল নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন। নিরুদ্দেশ মানে শেষ কিন্তু নয়। কিছু দিন বাদে বাদে তাঁর টাটকা সব ভাষণ নানা বেতার তরঙ্গে শোনা যেতে লাগল। কোথা থেকে বেতার ভাষণ আসছে উপযুক্ত যন্ত্র দিয়ে তা ধরে ফেলে সেখানে যে সন্ধান চালাবে তার উপায় নেই। একদিন যদি নিকারাগুয়ার কোনও অঞ্চল থেকে বেতার ভাষণ আসছে বলে ধরা যায় তার দুদিন বাদে সে ভাষণ আসছে ক্যানাডার টরেন্টো কি কিউবার হাভানা থেকে। তার মানে রেকর্ড করা ভাষণ অমনই করে নানা জায়গা থেকে বেতার তরঙ্গে ছড়াবার ব্যবস্থা আছে।

    শুধু এই ধরনের ব্যাপারই নয়, পর পর অনবরত খুনে ডাকাতদের মতো ফাঁসির আসামিরাও জেল থেকে কেমন করে পালিয়ে উধাও হয়ে গেছে। জেল থেকে পালানো—ঘুষ-ঘাস আর চোর-পাহারাদারদের সঙ্গে যোগসাজশে অসম্ভব কিছু নয়। কিন্তু তারা অমন হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে কী করে? তাদের বেলাতেও হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়া মানে একেবারে নিকেশ হয়ে যাওয়া যে নয় তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ওই রকম দিগ্বিদিক থেকে মাঝে মাঝে ছড়ানো বেতার ঘোষণায়। এদের ঘোষণাগুলো সাধারণত এই রকম যে, আছি, আমরা আছি! বহাল তবিয়তে আছি। মোটা করে গ্যাঁটের কড়ি ছাড়ো, তোমাদেরও আমাদের মতো কোনও গারদ আটকে রাখতে পারবে না। ইলেকট্রিক চেয়ারেরও সাধ্য নেই তোমাদের কোলে বসায়। টাকা ছাড়ো, মোটা টাকা!

    এটা মাফিয়াদেরই কাজ এ বিষয়ে কারও সন্দেহ নেই। তাদের কয়েদি পাচারের কায়দাটা যদি বা অনুমান করে ঠেকাবার কড়া ব্যবস্থার চেষ্টা করা যায়, কোথায় পাচার করছে সেইটেই একেবারে অভেদ্য ধাঁধা।

    মজার কথা হল এই যে কেঁচো খুঁড়তে গোখরো নয়, গোখরো খুঁজতে একেবারে চন্দ্রচূড়ের খাস কোটরের পাত্তা মিলে যাবে তা কে ভাবতে পেরেছিল।

    মাফিয়াদের মানুষ পাচারের ব্যাপারে যা যা করা উচিত সে বিষয়ে যাদের সঙ্গে আলোচনা করবার তা মোটামুটি করে ফেলে ফিরে আসবার আগে দু-একজন ওখানকার বন্ধুর সঙ্গে দেখাশোনা সেরে নিচ্ছিলাম। সেই আলাপি বন্ধুদের প্রধান একজন হচ্ছেন বিখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী প্রফেসর নিভোচি। নিজের দেশ ছেড়ে প্রায় ছ-সাত বছর ধরে যিনি আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন শহরের ধারে মেরিল্যান্ডে একটি বিরাট ল্যাবরেটরিতে তাঁর গবেষণার কাজ করছেন।

    মেরিল্যান্ডে নিভোচির বাড়িটা আমার চেনাই ছিল। সেখানে তাঁর খোঁজ করতে গিয়ে কিন্তু অবাক। বাসাটা ঠিকই আছে, সেখানে তাঁর থাকার প্রমাণস্বরূপ দরজায় নেমপ্লেটও লাগানো। কিন্তু তিনি সেখানে নেই। অনেকক্ষণ দরজায় বেল টেপবার পর সে ফ্ল্যাটবাড়ির ওপর তলার অন্য এক ফ্ল্যাটের বাসিন্দা আমায় হয়রান হয়ে বেল টিপে যেতে দেখে একটু দাঁড়িয়ে বলে গেলেন যে আমি বৃথাই বেল টিপছি। ওই ফ্ল্যাটে কেউ নেই। নেই আজ প্রায় এক বছরেরও বেশি।

    এক বছরের বেশি কেউ ফ্ল্যাটে নেই! ফ্ল্যাটটা তবু প্রফেসর নিতোচির নামেই এখনও রাখা! আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার তাঁর এই রকম উধাও হয়ে থাকা নিয়ে কাগজে কোনও লেখালেখি, এমনকী মাফিয়াদের মানুষ পাচার নিয়ে যে সন্ধানী বৈঠক আমাদের সম্প্রতি চলছে তাতেও কোনও উল্লেখ কারওর মুখে শুনিনি!

    একটা গভীর কিছু রহস্য যে ব্যাপারটার মধ্যে আছে, প্রফেসর নিভোচির ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বার হবার পর থেকেই তার আভাস পেলাম।

    ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমেই অবাক হয়ে দেখি একটা ট্যাক্সি আমার সামনের ফুটপাথ ঘেঁসে দাঁড়িয়েই হর্ন দিয়ে আমায় ডাকছে।

    ট্যাক্সির দরকার আমার ছিল। কিন্তু এমনভাবে রাস্তায় পা দিয়েই সামনে অপেক্ষা করা ট্যাক্সি পাব তা ভাবিনি। বিশেষ করে সদর রাস্তা থেকে বেশ দূরের একটা রীতিমত নির্জন পাড়ায় একেবারে হুজুরে হাজির অবস্থায়।

    ট্যাক্সিটা পেয়ে খুশি হয়েই তাকে আমার গন্তব্যস্থানটা জানালাম। ঠিকানাটা আমাদের গোপন বৈঠক যেখানে এখন চলছে সেই আস্তানার। আমেরিকার ট্যাক্সির একটা মস্ত সুবিধে এই যে ট্যাক্সিওয়ালাদের যাবার জায়গার ঠিকানা বোঝাতে গলদঘর্ম হতে হয় না। ঠিকমত ঠিকানা বলে দিলে তারা নির্ভুলভাবে সেখানে পৌঁছে দেয়। যে শহরে ট্যাক্সি চলে তার সমস্ত রাস্তাঘাট তন্নতন্ন করে জানা যে আছে তার পরীক্ষায় পাশ না করলে কেউ ট্যাক্সি চালাবার লাইসেন্স পায় না। আমার ট্যাক্সিওয়ালা এ নিয়মের ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই নয়।

    কিন্তু খানিক বাদেই খেয়াল হতে চমকে উঠলাম। এ ট্যাক্সিওয়ালা চলেছে কোথায়? ওয়াশিংটন আর তার আশপাশের অঞ্চলের সামান্য যেটুকু পরিচয় আমার জানা তাতে ট্যাক্সি তো সম্পূর্ণ উলটো দিকে কোথায় যাচ্ছে।

    লোকটাকে প্রথমেই দেখে যেমন একটু হাসিখুশি তেমনই বেশ একটু বুদ্ধিমানই মনে হয়েছিল। দেহটা অবশ্য তার বিপুল, ওভারসাইজ পোশাকেও যেন না কুলিয়ে ফেটে বার হতে চাইছে।

    একী? তুমি যাচ্ছ কোথায়? বলে ট্যাক্সিওয়ালাকে হুঁশিয়ার করতে চেঁচিয়ে না উঠে পারলাম না এবার। আর সেই সঙ্গে আমার দিকে সেই বিরাট দেহের ওপর যে জালার মতো আকারের মুখটা সে ফেরাল তাতে সরল কৌতুকের বদলে সে কী বীভৎস টিটকিরির হাসি।

    দেখতেই পাচ্ছিস, মর্কট গাড়িটাকে হঠাৎ এক জায়গায় থামিয়ে সে বলল, তোকে তোর গোরস্থানে নিয়ে এসেছি।

    দেখতে আমি ভাল করেই তখন পেয়েছি। গোরস্থানেই আমায় লোকটা এনে ফেলেছে ঠিকই। কিন্তু মানুষের সাধারণ কবরখানার চেয়ে এ আরও ভয়ংকর জায়গা। আমেরিকায় বড় বড় শহরের কাছাকাছি এই রকম বিরাট গোরস্থান থাকে। তবে মানুষের নয়, ভাঙা অকেজো যন্ত্রপাতির, বিশেষ করে বাতিল পুরনো মোটর গাড়ির এখানে শেষ সমাধি হয়। সে সমাধি আবার ভীষণ। বিরাট আট-দশতলা উঁচু একটি কি দুটি ক্রেন তাদের ঝোলানো চেনের নীচের প্রকাণ্ড কাঁকড়ার দাঁড়ায় বাতিল মোটরগুলো তুলে নিয়ে একটা বিরাট লোহার পাতে ঘেরা কুণ্ডের মতো জায়গার ভেতর ফেলে দেয়, আর তারপর দানবীয় জাঁতার মতো প্রকাণ্ড লোহার চাকতির চাপে বড় বড় মোটরের দেহগুলো পাকিয়ে গুঁড়িয়ে একটা চ্যাপ্টা ধাতুর দলে যাওয়া ডেলা হয়ে যায়। জায়গাটায় ওই বিরাট ক্রেন আর এদিক ওদিকে বাতিল মোটর আর অন্যান্য যন্ত্রপাতির স্তুপ ছাড়া মানুষজন নেই বললেই হয়। ক্রেন যে চালায় সে বসে আছে টঙের ওপর। দলা পাকাবার দানবীয় জাঁতা যারা চালাচ্ছে তারাও আছে বহুদূরে তাদের ইঞ্জিন রুমে।

    বৃত্রাসুর মার্কা লোকটার মতলব বুঝতে আমার আর তখন বাকি নেই। তবু যেন অতি সরল বিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে আমায় নিয়ে কী করবে তুমি? এখানে তো বাতিল যন্ত্রপাতি মোটরের মতো জিনিস গালিয়ে অন্য কাজে লাগাবার সুবিধে করার জন্য দলা পাকিয়ে রাখা হয়।

    ঠিকই বুঝেছিস? সেই বিদঘুটে হাসির সঙ্গে আমার ঘাড়টা এক হাতে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে সে বললে, লোহালক্কড়ের দলার সঙ্গে একটু মানুষের হাড়গোড়ের গুঁড়ো থাকলে মিশেলটা হয়তো বেশি কাজের হবে। তাই ওই যে ক্রেনটার প্রকাণ্ড দাঁড়া দেখছিস–তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে অন্য লোহালক্কড়ের সঙ্গে ওর ভেতর তুলে দেব। তারপর ওই ক্রেনের দাঁড়া তোকে শূন্যে তুলে ওই—ওই লোহার কুণ্ডের মধ্যে টুপ করে ফেলে দিলেই তুই উদ্ধার পেয়ে যাবি

    কিন্তু আমার কী অপরাধ, কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, যে আমায় এমন করে মেরে ফেলছ?

    তোর অপরাধ! নোকটা আমায় যেন ভেংচি কেটে বললে, তোর অপরাধ– তোর কৌতূহল আর আস্পর্ধার! মাফিয়াদের পেছনে লাগতে এখানকার টিকটিকিগুলোর সঙ্গে হাত মিলিয়েও থামিসনি, আবার ওই নিভোচির খোঁজ করতে গেছিস কেন?

    বাঃ, আমি করুণভাবে কৈফিয়ত দিলাম, নিভোচি যে আমার বন্ধু। বন্ধুর খোঁজ নেব না?

    বেশ, নে! আর তার—তার দামটাও দে। বলে দানোটা আমার ঘাড়টা ধরে ক্রেনের সেই দাঁড়াগুলোর দিকে টান দিল।

    দাঁড়াও। দাঁড়াও, কাতর হয়ে এবার বললাম, সেই যখন মরতেই যাচ্ছি, তার আগে প্রফেসর নিভোচি আর তোমাদের মধ্যে কী সম্বন্ধ আর তার রহস্যটা কী একটু যদি জানিয়ে দাও।

    বেশ। তাই দিচ্ছি। দু কথায় শোন, দানোটা আবার দূরের ক্রেনের দাঁড়াটার দিকে আমায় টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললে, তুই মাফিয়াদের পেছনেই লেগে আছিস, এদিকে সারা দুনিয়ার ভয়ে যে নাড়িছাড়া অবস্থা জানিস না। জানবি আর কী করে, এই ওয়াশিংটনেই নানা মুলুকের মানুষের সব মাথাগুলো বড় বড় বিজ্ঞানীদের নিয়ে জড়ো হয়েছে শুধু একটা সর্বনাশ ঠেকাবার জন্য! সর্বনাশটা কী? সর্বনাশ হল এই যে ওই যে তোদের ক্লোরোফিল না কী বলে গাছের পাতার সবুজ ভাগটাকে, যা না হলে কোনও গাছপালাই কোথাও থাকত না আর তার দরুন পোকামাকড় থেকে সমস্ত জন্তুজানোয়ারও আর জন্মাতে পারত না, সেই ক্লোরোফিল—তোদের ওই ভাইরাস

    কী একটা রোগের জীবাণুর এক ভয়ংকর ছোঁয়াচে রোগে পুরোপুরি তৈরি হতে না পেরে—শুকিয়ে যাচ্ছে। আর অন্য প্রাণীও শেষ পর্যন্ত বাঁচবার মতো খাবার না পেয়ে মারা যাচ্ছে। রোগটা আপাতত অতি সামান্য ছোট্ট একটা জায়গায় আরম্ভ হলেও এমন ভয়ংকর ছোঁয়াচে যে একবার কোনও রকমে সুবিধে পেলেই খড়ের গাদার আগুনের মতো সারা দুনিয়ায় দেখতে দেখতে ছড়িয়ে পড়বে। এখন–

    লোকটাকে বাধা দিয়ে বললাম, এই রোগ আর তার সর্বনাশা কলাফল আবিষ্কার করেছেন ওই আমার বন্ধুটি প্রফেসার নিভোচি আর সেই জন্য ক্লোরোফিলে ছোঁয়াচে মহামারি না ছড়াতে দেবার জন্য সেখানে বাইরের কারওর যাওয়া বা সেখান থেকে কারওর বাইরে আসার মানা হয়ে গেছে, কেমন!

    ঠিক, ঠিক? ঘাড়ে একটা রদ্দা দিয়ে লোকটা বললে, তোর যা বুদ্ধি দেখছি, তোকে নিউ এরা-তেই নিভোচির সঙ্গী হতে পাঠালে ভাল হত মনে হচ্ছে! কিন্তু এখন আর সময় নেই।

    নিউ এরা! আমি তার কথার মানেই ভাবতে ভাবতে বললাম, নামটা যেন জানা মনে হচ্ছে! প্রশান্ত মহাসাগরের কুক দ্বীপপুঞ্জের একটা ছোট্ট দ্বীপ কি?

    ঠিক, ঠিক? লোকটা আমার ঘাড়ে আর একটা রদ্দা দিয়ে তারপর ক্রেনের দাঁডার দিকে হিচড়ে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললে, কালা নেংটি হলে কী হয়, তুই তো হাঁ করলেই সব বুঝে ফেলিস দেখি, তবে অত বুদ্ধি থাকাটা ভাল নয়, তাই তোকে—

    দাঁড়াও, দাঁড়াও আমি যেন মিনতি করে তাকে থামিয়ে বললাম, পৃথিবীর বক্ষে সর্বনাশা ক্লোরোফিল-এর ছোঁয়াচে রোগ না ছড়াতে দেবার জন্যে নিউ এরা দ্বীপে এখন আর পা দেবার কথা কেউ ভাবে না, আর এই আসল মহলে এই আতঙ্ক ছড়িয়ে তোমরা এখন ওই ঘাঁটিতে তোমাদের পাচার করা সব আসামি আর রাজনীতির বড় বড় চাঁইদের বিনা ঝামেলায় সেখানে চালান করে রাখবার ব্যবস্থা করেছ।

    ঠিক! ঠিক! বলে লোকটা আমায় আর একটা রদ্দা ঝাড়তে যাচ্ছিল। সেটা এড়িয়ে তারিফ করবার সুরে বললাম, এ কাজে প্রফেসার নিভোচিই তোমাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। তাকে চুপিসাড়ে এখান থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে ওই নিউ এরা দ্বীপে পুরে প্রাণের ভয় দেখিয়ে তার মতো মস্ত সৎ বিজ্ঞানীকে দিয়ে যা রেডিও তরঙ্গ মারফত রটনা করাচ্ছ, দুনিয়ার ওপর মহলে তাতে কারওর সন্দেহ জাগেনি।

    একটু থেমেসাবাস তোমাদের। সত্যি বলিহারি, বলে লোকটার ঘাড়ে এবার একটা চাপড় দিয়েছি। আচমকা মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ে গিয়ে লোকটা আগুনের গোলা হয়ে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছে। পাশ কাটিয়ে একটু ঠেলা দিতেই সে এবার সটান একেবারে ক্রেনের হাঁ করা নীচের দাঁড়াটার ওপরই গিয়ে পড়েছে।

    ওপরের দাঁড়াটা তখন নামতে শুরু করেছে। আতঙ্কে চিৎকার করে সে লাফিয়ে পালিয়ে আসতে গেছে প্রথমে একটু ঠেলা দিয়ে তাকে আবার দাঁড়াগুলোর মধ্যে ফেলে দিয়ে নিজেই আবার টেনে বার করে নিয়ে বললাম, শোনো চর্বির পাহাড়, ক্রেনের দাঁড়ায় লোহা পেষাইয়ের জাঁতাকলে যাবার যদি ইচ্ছে না থাকে তাহলে ভালয় ভালয় যেখানে বলছি, এখনই নিয়ে চলো। কী? তাই করবে, না ক্রেনের ওই দাঁড়াই তোমার পছন্দ?

    না, আর বেয়াড়াপনার চেষ্টা সে করেনি। সুবোধ বালকের মতো আমায় যথাস্থানে। এফবিআই-এর বড় ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়ে গেছে আর প্রফেসর নিতোচিকে অন্য সাধু ও শয়তান ও আরও অনেকের সঙ্গে নিয়ে দ্বীপ থেকে উদ্ধার করে আনার পর পৃথিবীর সেই সর্বনাশা পরিণামের আতঙ্ক দূর হয়ে গেছে।

    ঘনাদা তাঁর বলা শেষ করে হঠাৎ নিজের হাতের দিকে চেয়ে চমকে উঠে বললেন, তা এ কী!

    তা চমকে অমন কথা তিনি বলতেই পারেন। কারণ চিংড়ির কাটলেট থেকে শিকাবাব আর মোরগ তন্দুরা পেরিয়ে তখন তিনি তাঁর হাতে ধরা রসোমালাই-এর প্লেটে এসে পৌঁছেছেন।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }