Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    মৌ-কা-সা-বি-স—একবচন, না বহুবচন

    হ্যাঁ, সবুরে মেওয়া সত্যিসত্যিই ফলে।

    বারেবারে না হোক দু-চারবার তো বটেই।

    আমাদের বেলা কথাটা ভালভাবে প্রমাণ হল প্রায় প্রতিটি বার।

    প্রমাণ হল মৌ-কা-সা-বিস-এর চিঠির ব্যাপারে।

    এ চিঠির ব্যাপারে এবারে আমিই একটু বেশি অস্থির হয়েছিলাম। মৌ-কা-সা-বি-স-এর শেষ চিঠি এসেছিল সেই মাস ছয়েক আগে। ঘনাদাকে তাতাবার ব্যাপারে সোজাসুজি লক্ষ্যভেদ না করলেও তেরছাভাবে সেই চিঠি যথাস্থানে খোঁচা দিয়ে ঘনাদাকে দিয়ে মহাভারতের শল্য চরিত্রের নতুন ব্যাখ্যা বার করিয়ে ছেড়েছিল।

    মৌ-কা-সা-বি-স-এর কাছে এইটুকুর জন্যেই কৃতজ্ঞ হয়ে আমাদের একবারের জন্য, অন্তত একটু খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করা কি উচিত ছিল না?

    কিন্তু গৌর শিশিরের তাতে ঘোরতর আপত্তি।

    না, না, কখনও না! গৌরের শাসানি। আমাদের একটু নরম দেখলেই ওরা লেজে খেলতে শুরু করবে।

    কিন্তু আমি একটু প্রতিবাদ না জানিয়ে পারলাম না—আমাদের দিক দিয়ে একটু সাড়া দেওয়া কি উচিত নয়! শেষে আমাদের গা নেই মনে করে ওরাও যদি কারবার বন্ধ করে দেয়। একেবারে ফুটো ঢাক তো নয়। টঙের ঘরে ওঁকে একটু আধটু নাড়াচাড়া দেবার মতো দু একটা প্যাঁচ বাতলাবার চেষ্টা তো করেছে।

    করেছে যেমন, তেমনই আবার করবে, শিশির আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললে, আমরা সাড়া দিই বা না দিই, নাম যাদের মৌ কা-সা-বিস, আমাদের মতো মক্কেল হাতে রাখবার গরজ তাদের খুব বেশি। সুতরাং অধীর না হয়ে শুধু লেটারবক্সটি দিনের পর দিন হাতড়ে যাও, এই তো তোমাদের বিধান।

    শিবু তর্কটাকে আর বাড়তে না দিয়ে মিটমাটের রাস্তায় গিয়ে বললে, বেশ তা-ই মেনে নিলাম। কিন্তু মৌ-কাসা-বি-স হঠাৎ ওরা হয়ে বহুবচনের গৌরব কেমন করে পেল, একটু যদি বুঝিয়ে বললা।

    আরে তাই তো! আমার মতো সবাই বোধ হয় একটু চমকে উঠে ব্যাপারটা খেয়াল করল। ব্যাখ্যা কিন্তু কারও কাছে পাওয়া গেল না। এইটুকুই শুধু স্থির হল যে, এক বা অনেক যাই হোক, মৌ-কা-সা-বি-স-এর গরজ আমাদের চেয়ে বেশি বই কম নয় ধরে নিয়েই আমরা ধৈর্য ধরে থাকব, আর তার ফল ফলবেই।

    সত্যিই তাই ফলল। হপ্তাখানেক যেতে না যেতেই শিবু সিঁড়ির নীচের লেটারবক্স খুলতে গিয়ে হঠাৎ যে উল্লসিত চিৎকারটা ছাড়ল নেহাত বিকেলবেলা তাঁর নিত্য নিয়মিত সরোবর সভার টানে বেরিয়ে না পড়ে থাকলে টঙের ঘর থেকে তিনি নিশ্চয়ই শশব্যস্ত হয়ে বিদ্যাসাগরি চটি পায়ে এক দুর্ঘটনা ঘটাতেন। শিবুর উল্লাসধ্বনিটায় অবশ্য আমরা ওপরের দালান থেকেই ঠিকই বুঝলাম যে আমাদের ধৈর্য নিষ্ফল হয়নি। আমাদের নীরবতায় অস্থির হয়ে মৌ-কা-সা-বি-স-ই নিজে থেকে প্রথমে পত্রাঘাত করেছে। চিঠি অবশ্য লম্বা কিছু নয়। দু-চার ছত্রের মাত্র। তার ওপর বিদ্রুপের খোঁচাটাই প্রধান।

    কী হে বাহাত্তর নম্বরের বালখিল্যরা।

    চিঠির প্রথমেই টিটকারি দেওয়া সম্ভাষণ। সেই সুরেই লেখা—

    সবাই একেবারে ভোক্কাটা হয়ে গেছ মনে হচ্ছে। টঙের ঘরের তাঁর লেঙ্গিতে বুঝি সবাই কাত। তা সুবুদ্ধি না নিলে কাত তো হবেই। সেই মৌ-কা-সা-বি-স-এর কাছে হাত পাততে এখনও মান যায় বলে আর একটা ফাঁদ নিজে থেকেই বাতলে দিচ্ছি। দিচ্ছি মিনি মাগনা। এ ফাঁদের ফাঁস ঠিক মতো টানতে পারলেই ষোলো আনা বাজিমাত। সুড়সুড় করে নিজের গরজে এসেই ধরা দেবে। দুনিয়ার সবাইকার হাহাকার কী নিয়ে? হাইড্রোকার্বন। অতলে পাতালে নয়, সেই সাত সমুদ্রে সাত হাজার রাজার রাজ্যের ধন নদী-নালা-পুকুর-ডোবার কচুরিপানার মতো জোলো ডাঙার আগাছায়। নাম ধরো কচুরিপানার ভাই কচলি ঝাঁটি। শুধু কচলিই বলো না।

    জলাবাদার বুনো আগাছা তো নয়, তার মধ্যে কুবেরের দৌলতখানা। কিন্তু সিন্দুকে কুলুপ দেওয়া। সে কুলুপ কে খুলবে? খোলার আক যে কষে ফেলেছে গেঁয়ো যুগী বলে সে ভিখ পায় না।

    ওদিকে রাক্ষস-খোক্ষসদের দেশের দুশমনরা ললাভে লোভে ঠিক এসে পড়েছে। কচলির মুল্লুকে।

    কচলি-কুলুপ খোলার মন্তর সমেত খোদ গুণী কারিগরকেই যারা এ মুলুক থেকেই পাচার করবার প্যাঁচ করেছে, তার কিছু জানেন কি আমাদের টঙের ঘরের তিনি। একটু খুঁচিয়েই দেখুন না!

    ব্যস, চিঠি ওইখানেই শেষ।

    মৌ-কা-সা-বি-স-এর নামে এ চিঠি কে পাঠিয়েছে? কে, না কারা? এ চিঠি নিয়ে

    কী করব আমরা এখন?

    আমরাও ভাবনায় পড়েছি। কিন্তু ঘনাদাকে খোঁচা দেবার মতো কোনও ফিকির এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

    ঘনাদাকে কীভাবে খুঁচিয়ে তাঁকে দিয়ে যা বলাতে চাই তা বলাব তাই ভেবে বার করতে তিন দিন তিন রাত্রি আমাদের ঘুম নেই। এক-আধটা নয়, চার মূর্তিমান আমরা চার পাঁচে অমন কুড়িটা ফন্দি এঁটে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। কিন্তু কারওর কোনও ফন্দিই শেষ পর্যন্ত যাকে বলে পুরোপুরি ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট পেল না।

    গোড়াতেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম যে একেবারে সর্বসম্মতিক্রমে না হলে কোনও ফন্দিই মঞ্জুর বলে গ্রাহ্য হবে না।

    মুশকিল হল সেখানেই।

    দুজনে যেখানে একমত হয়ে একটা প্রস্তাব তোলে বাকি দুজন সেখানে ঘাড় হেলাতেই চায় না।

    বিশেষ করে আমার বেলা দেখলাম মেজরিটি সবসময়ে আমার বিরুদ্ধে।

    অথচ কী ভালভাবে একটা প্যাঁচই না মাথা থেকে বার করেছিলাম।

    আমাদের লোকসভায় সেটার একটা ইশারা দিতে না দিতে সবাই যেখানে কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে ধন্যিধন্যি করবার কথা সেখানে কিনা সকলের একসঙ্গে গা-জ্বালানো হাসি আর টিটকিরির ধুম!

    আচ্ছা, আমি বিচক্ষণজনেদের কাছে আমার প্রস্তাবটা পেশ করছি সুবিচারের জন্য। তাঁরাই বলুন, আমার ভেবে বার করা ফন্দিটা কি হেসে উড়িয়ে দেবার মতো কিছু! আমি বলেছিলাম কি যে বিকেলের আড্ডার ঘরে সবাই আমরা একটা করে ছোট থলিতে মাঠেঘাটে পার্কে-পার্কে ময়দানে ঘুরে জোগাড় করা আগাছা নিয়ে গিয়ে হাজির হব একদিন। সব টিপয় আর টেবিলের ওপর আগাছা থাকবে ছড়ানো, দেওয়ালেও টাঙানো থাকবে কিছু কিছু। আর সেখানে প্ল্যাকার্ড ঝুলবে বড় বড় হরফে, আগাছা দিবস লেখা।

    এরপরে আর যা যা করবার বুঝিয়ে বলবার আর অবসর মেলেনি।

    আগাছা দিবস! সবাই একেবারে হেসে মেঝেতে গড়াগড়ি দেয় আর কী?

    যত আমি তাদের থামিয়ে নিজের প্ল্যানটা বিশদভাবে জানাতে চাই ততই তারা এক-একবার করে আগাছা দিবস বলে হেসে লুটোপুটি খায়।

    ঠিক! ঠিক! শিবু আবার গম্ভীর হবার চেষ্টা করে ডবল খোঁচা দিয়ে বলে, কত রকম দিবসের কথাই না শোনা গেছে এতদিন বিদ্যুৎ-দিবস, শিক্ষা দিবস, কলের জল দিবস, ডালমুট–

    শিবুকেও আর এগোতে হয়নি।

    গৌর শিশিরই তাকে বাধা দিয়ে বলেছে, ডালমুট দিবস আবার কী!

    কী আবার? শিবু ব্যাখ্যা করবার চেষ্টা করেছে, ডালমুট আর আগের মতো মুচমুচ করছে না, সেই নালিশ জানাবার দিবস।

    ঠিক! ঠিক! শিশির গৌর শিবুকে সমর্থন করার জন্যই বলতে শুরু করেছে, ডালমুট দিবসের মতো ফুচকা দিবস, ডালপুরি দিবস, চুল ছাঁটা দিবস

    এবার বাধা দিয়েছে শিবুই, চুল ছাঁটা দিবস মানে? সে আবার কী?

    সে আবার কী, জানো না? গৌর বুঝিয়ে দিয়েছে! মানে লম্বা চুল রাখার নতুন হুজুগে সেলুন আর প্রাইভেট নাপিতদের দিন খারাপ গেলেও আমাদের মাঝে মাঝে ক্ষৌরির পয়সা বাঁচছিল। ফের ধীরে ধীরে চুল ছাঁটার রেওয়াজ চালু হচ্ছে বলে আমাদের পকেটে টান পড়তে শুরু করেছে। চল ছাঁটা দিবস মানে তাই আবার লম্বা চুলের রেওয়াজ চালু করার আন্দোলন-বুঝলে!

    এমনই সব দিবস খুঁজে বার করার হুজুগে আমাকে ছেড়ে দিলেও আসল কাজ আমাদের এগোয়নি। টঙের ঘরের তাঁকে গরম করে তোলবার মতো খোঁচা ভেবে বার করবার কথাটা ভুলেই গেছি সবাই। আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে তাতে ক্ষতি হয়নি কিছু।

    অর্থাৎ ঘনাদাকে খোঁচা দেবার দরকারই হয়নি মোটে।

    হ্যাঁ, ঘনাদা কখনও কখনও অমাবস্যার চাঁদ হয়ে উঠে কল্পতরু বনে যান। তখন তাঁকে আর খুঁচিয়ে জাগাতে হয় না। হ্যাঁ না করতেই তিনি যেন মনের কথা আঁচ করে ফেলে আশা মিটিয়ে ঝুলি ভরে দেন।

    আমাদের বেলাও তাই হল এক রকম অযাচিতভাবে।

    এবারে বৃষ্টিটা দেরি করে এসে আর যেতেই যেন চাইছে না।

    আকাশ বেশ পরিষ্কার আর আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস দিনটা আজ শুকনোই যাবে শুনে ছাতা না নিয়ে বেরিয়ে হঠাৎ এসে হঠাৎ-চলে-যাওয়া বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে স্নান করে ফিরতে হবে।

    ছুটির দিন হলেও ঘনাদাকে বাগ মানাবার উৎসাহে আমরা কেউ বাইরে কোথাও যাইনি।

    কিন্তু ঘনাদা তাঁর বিকেলের সরোবরসভার টানে যথাসময়ে বেরিয়ে হঠাৎ নামা জোরালো বৃষ্টির পশলাটার মধ্যে আর ফিরতেই পারেননি।

    এ বৃষ্টিতে একেবারে ভিজে দাঁড়কাকটি হয়ে আসবেন বুঝে আমরা তার উপযুক্ত নৈবেদ্যের ব্যবস্থা করতেও ভুলিনি।

    দিনটা অবশ্য খুবই গরম হবার হুমকি দিয়েই শুরু হয়েছিল। অর্থাৎ সকালের আবহাওয়া সংবাদে আগের দিনের তাপমাত্রা আটত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস বলে জানিয়ে গরমটা আজ বাড়বার আশঙ্কাটাই ব্যক্ত করেছিল। এই খাঁ খাঁ রোদের দিনের গরমে হাঁসফাঁস করা বিকেলে যেমনটি হওয়া উচিত তেমনই জলযোগের ব্যবস্থাই করেছিলাম প্রথমে। ফ্রিজে জমিয়ে তরমুজের ফালি, গাছপাকা পেঁপের টুকরো, মজঃফরপুরের সেরা সরেস লিচু, আমের মরসুম পার হয়ে গেলেও অনেক খুঁজে পেতে আসলি চৌষা আম, গেলাস ভর্তি মৌসম্বির রস আর সেই সঙ্গে চৰ্যচোষ্য হিসেবে নাটোরের জাত ময়রার কাঁচাগোল্লা, বাগবাজারের রসমালাই আর লেডিকেনি।

    এ সবের সঙ্গে নোনতা হিসেবে আর কী দেওয়া যায় যখন ভাবছি তখনই শুরু হল এই এক নাগাড়ে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টি তো নয়, আকাশ যেন একেবারে ভেঙে পড়ল শহরের ওপর আর এক ঘণ্টার মধ্যেই ব্যারোমিটারের পারা কিছু না হোক ন-দশ ডিগ্রি দিলে নামিয়ে।

    ঘনাদা তাঁর সরোবরসভা থেকে সময়মত যদি সরে পড়তে পেরেও থাকেন তবু এই বৃষ্টিতে কী মন মেজাজ নিয়ে তিনি যে ফিরবেন তা অনুমান করে তখুনি মেনু পালটাতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। বাতিল হয়ে গেছে তরমুজ আর পেঁপে, খরমুজা আর কাঁচাগোল্লা, রসমালাই। তার জায়গায় তাড়াতাড়িতে যতদূর পারা যায় সেইমত কবিরাজি কাটলেট, শামিকাবাব, মোগলাই পরোটা আর কাশ্মীরি কোপ্তার ব্যবস্থা হয়েছে।

    কিন্তু এ সব কিছুরই যে দরকার ছিল না তা তখন আর কেমন করে বুঝব?

    প্রথমত আমাদের সকলকে অবাক করে ঘনাদা এলেন ভিজে দাঁড়কাকটি হয়ে নয়, রেনকোটে আপাদমস্তক ঢেকে একেবারে শুকনো খটখটে অবস্থায়। আর এসেই কথায় বার্তায় মেজাজে বুঝিয়ে দিলেন যে আজ তিনি একেবারে কল্পতরু হয়েই ফিরেছেন।

    নীচে থেকে দোতলায় এসে ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ি দিয়ে সোজা তিনি তাঁর টঙের ঘরেই চলে যাবেন ভেবেছিলাম। তার বদলে তিনি রেনকোট গায়ে দিয়ে সোজা আমাদের আড্ডাঘরেই এসে ঢুকলেন আর তারপর বর্ষাতিটা গায়ে দিয়েই তাঁর মৌরসি আরামকেদারাটায় বসে বললেন, কই হে, এমন বর্ষার বিকেল আর

    তোমাদের সঙ্গত নেই কেন?

    সঙ্গত মানে? প্রশ্নটা আমাদের করবার দরকারও হয়নি। তার আগে নিজেই উৎসাহভরে ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এমন বাদলা বিকেলের সঙ্গত হল মুচমুচে মুড়ি বুঝেছ! ওই তোমাদের যেমন তেমন চালে নুন মাখিয়ে ভেজে কুলোনো চটের বস্তার মুড়ি নয়, রীতিমত আসল মুড়ির চাল থেকে তৈরি করে শুকোনো আর তারপর পাকা হাতের ঝাঁটা খুন্তিতে বালির কড়াইয়ে ভেজে তোলা শিউলির মতো সাদা আর হালকা মুড়ি। ফুঁ দিলে উড়ে যায়। মুখে দিলে মিলিয়ে যায়।

    আজ্ঞে, মুড়ি মানে—আমরা অপরাধীর মতো নিজেদের গলতির কৈফিয়তটা দেবার চেষ্টা করেছি—আমরা বাদলার দিন বলে কবিরাজি কাটলেট আর শামিকাবাব—

    বেশ করেছ! সে বেশ করেছ? আমাদের কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ঘনাদা বলেছেন, ও সবই ভাল। কিন্তু মুড়ির কাছে কিছু নয়। মুড়ি আর ফুলুরি। গরমগরম ফুলুরি। ওই যে আসবার পথে গলির মোড়ে ভাজতে দেখে এলাম।

    ঘনাদা মুড়ি আর ফুলুরির গুণগান চালাবার মধ্যে বনোয়ারিকে পাড়ার তেলেভাজার দোকানে পাঠিয়ে দিতে হল।

    বনোয়ারি দোকান থেকে ফিরে আসার পর বড় জামবাটি ভর্তি সে মুডিফুলুরি তো বটে, সেই সঙ্গে আগের আনানো কাটলেট কাবাব ইত্যাদিও পর পর পরিষ্কার করার মধ্যে ঘনাদার এই বিরল বদান্য মেজাজের কী করে সুযোগ নেওয়া যায় সবাই মিলে তাই তখন ভাবছি।

    এখন কি হঠাৎ যেন সুন্দরবনে বেড়াতে যাওয়ার শখ হয়েছে বলে নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু করব!

    না, উদ্ভিদবিজ্ঞানের গাছ-গাছড়া নয়, স্রেফ আগাছাদের একটা বিশ্বকোষ কোথাও আছে কি না খোঁজ করার উৎসাহ দেখাব।

    কিছুই এসব করতে হল না।

    ভাগ্য যেন আমাদের ওপর সদয় হবার জন্য ঘুমিয়েই ছিল। ক্যারমবোর্ডে স্ট্রাইকারের এলোপাতাড়ি মার-এ খুঁটিতে খুঁটিতে ঠোকাঠুকি হতে হতে লাল ঘুটিটাই পড়ল গিয়ে এক পকেটে।

    কোনও মতলবটতলব নিয়ে নয়, বনোয়ারির আনা মুড়িফুলুরির, বিশেষ করে মুড়ির, আজগুবি দাম শুনে গৌর বুঝি অবাক হয়ে বনোয়ারিকে বলেছিল, আরে, বলছে কী! মুড়িমিছরির একদর ছিল একটা ঠাট্টা! এখন তাও যে মিথ্যে হতে চলেছে। মুড়ির দাম মিছরিকেও যাচ্ছে ছাড়িয়ে।

    আর যাবে না! অবাক হয়ে ঘনাদার দিকে চাইতে হল। আমাদের এই তুচ্ছ কথাবার্তায় ঘনাদা টিপ্পনি কাটছেন! আর কী সে টিপ্পনি? তার মানেটাই বা কী?

    আর যাবে না মানে? জিজ্ঞাসা করতেই হল ঘনাদাকে।

    মানে, ওসব চড়া-টড়ার পালা এবার শেষ। এবার নামবে। দেশের সুদিন এবার ফিরছে।

    সুদিন ফিরছে বলছেন দেশের? ধরবার হাতলটা পেয়ে গিয়ে আমরা আর ছাড়ি

    দেশ বলতে যদি আমাদের এই বাংলা বলেন-শিশির আলাপটাকে যেদিকে দরকার সেই দিকেই মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়—তাহলে বলব এমন পোড়া কপাল আর কারওর আছে!

    পোড়া কপাল বলব আমাদের এই বাংলার?—ঘনাদার অপেক্ষায় না থেকে আমরাই ধুনিটায় হাওয়া দিয়ে যাই।

    পোড়া কপাল নয়! গৌর শিশিরের হয়ে ব্যাখ্যাটা শোনায়—এই যে দেশের সব বড় বড় নদী—সব নদীর মোহনা থেকেই শুনছি—তেল ওঠবার প্রচুর আশা দেখা যাচ্ছে। যাকে বোম্বে হাই বলি সেখানে উঠছেই, তা ছাড়া ওই কষ্ণা গোদাবরী নর্মদা সব নদীর মোহনায় নাকি একবার ঠিক মতো নল নামাতে পারলেই কলকল করে তেল উঠবে।

    আর আমাদের এই পোড়া বাংলার? আমি খেইটা ধরে নিয়ে চালিয়ে যাই— এমন গঙ্গাভাগীরথীর মোহনা থেকে কোনও সুখবর এখন পর্যন্ত এসেছে? পাবার মধ্যে পেয়েছি একটা খুদে দ্বীপ, দ্বীপ না বলে তাকে একটা চড়া বললেই মানায়। ভাল করে ডাঙার ঘাসও সেখানে এখনও জন্মায়নি, তেলের জন্য খোঁড়াখুঁড়ির কোনও কথাই সেখানে ওঠেনি।

    না ওঠবার কারণ আছে যে!—শিবু আমার একটু সংশোধন করে—আমাদের গঙ্গাভাগীরথীর মোহনার দুঃখটা কী তা জানো তো! বে অফ বেঙ্গলের কালাপানিতে যেখানে এসে আমাদের মা-জননী পড়েছেন সেখানে এমন অতল-পাতাল-দেখা গভীর এক গাড্ডা—যা যুগযুগান্তের নদীর জলে বয়ে আনা পলিতেও ভরাট হতে কত যুগ যে যাবে এখনও তার ঠিকঠিকানা নেই। তাই তেলের জন্য খোঁড়ার কোনও কথাই ওঠে না। খুঁড়বেই বা কোথায়? দরকার হবে না খোঁড়ার! আমাদের সকলের চমকে-ওঠা বিস্মিত দৃষ্টি এক জায়গায় গিয়েই স্থির হয়েছে।

    না, কোনও ভুল নেই! এতক্ষণ ধৈর্য ধরে চুপ করে থাকার পর ঘনাদাই এবার মুখ খুলেছেন। আর সে মুখ খোলার মহিমাটি কী? সমস্ত আড্ডাঘরটা যেন এক মুহূর্তে সম্মোহিত হয়ে গেছে। দেওয়ালেতে টিকটিকিটা ভেন্টিলেটরের ধারে বসা পোকাটাকে তাক করে গুটিগুটি পা চালাতে চালাতে থেমে গিয়ে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নট-নড়নচড়ন নট-কিচ্ছু হয়ে গেল।

    খোঁড়বার দরকার নেই, মানে? আমরা ক্ষীণকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছি, মানে খুঁড়ে কোনও লাভ নেই বলছেন!

    না, বলছি, লাভ যা পাবার তা না খুঁড়েই আমরা পাব, ঘনাদা আমাদের বরাভয় দিয়ে বলেন, অন্যেরা খুঁড়ে মরুক, আমরা শুধু কুড়োব।

    শুধু কুড়োব?ঘনাদা যে আমাদেরই সিনেরিয়ো মাফিক সংলাপ বলছেন তা যেন বিশ্বাস করতে না পেরে একটু বোকা সেজে বলেছি, কী কুড়োব কী? রাস্তার নুড়িপাথর?

    নুড়িপাথর কেন কুড়োবে? ঘনাদা পুরোপুরি বিশদ না করে বলছেন, যার মধ্যে সাত রাজার ধনমানিক হেলায় লুকিয়ে আছে কুড়োবে সেই অমূল্য জিনিস।

    হেলায় লুকিয়ে আছে অমূল্য সাত রাজার ধনমানিক! সে কোন জিনিস? আমরা যেন হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞাসা করি, সে জিনিস আবার শুধু কুড়িয়ে নেবার অপেক্ষায় আমাদের এখানে এই মুল্লুকে ছড়িয়ে আছে?

    আছে! আছে? ঘনাদা গাঢ় গম্ভীর স্বরে ভরসা দিয়ে বলেন, আর যাতে তা থাকে, যাতে কারও লোভী থাবা বাড়িয়ে কেউ সহজে তার নাগাল না পায় তার ব্যবস্থাই করে এলাম।

    সেই ব্যবস্থাই করে এলেন?

    এবার আমাদের তাজ্জব হওয়াটা সিনেরিয়ো ছাড়ানো।

    ঘনাদা ব্যবস্থা করে এলেন বলছেন! কী ব্যবস্থা! কীসের? ঘনাদা ওই ইশারাটুকু দিয়েই চুপ হয়ে যাবেন নাকি? ব্যবস্থা করে এলাম বলে যে নাটকের আভাসটুকু দিয়ে আমাদের ছটফটানি শুরু করিয়ে দিয়েছেন সে-নাটকের যবনিকা আর তুলবেন নাকি! তা তোলাতে কী নজরানা তাঁকে দিতে হবে!

    দিতে হল না কিছুই। ঘনাদা আজ সত্যি কল্পতরু হয়ে শিশিরের বাড়িয়ে দিয়ে ধরিয়ে দেওয়া সিগারেটটায় একটা লম্বা টান দিয়ে যেন নিজের গরজে বলতে শুরু করেন—কেউ লক্ষ করেছ কিনা জানি না, কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার খানিক পরেই বিকেলের অনেক আগে থেকে আমাকে আর বাহাত্তর নম্বরে দেখা যাচ্ছে না। কী! কেউ তোমরা দেখেছ তখন আমাকে

    না, না। সবেগে মাথা নেড়ে চক্ষুকর্ণের সব সাক্ষ্য অস্বীকার করে ডাহা মিথ্যাটায় সায় দিতে হয়।

    দেখবে কেমন করে! ঘনাদা প্রসন্ন হয়ে আবার শুরু করেন—আমি তো তখন বাহাত্তর নম্বরের ধারে কাছে নেই।

    এতটু থেমে নিজের কথাগুলোর গুরুত্বটা বুঝিয়ে দিয়ে ঘনাদা আবার বলেন, তা বলে আমায় আমাদের সরোবরসভাতে দেখা গেছে যেন কেউ ভেবো না। তার বদলে আধময়লা ছেঁড়াছেঁড়া বেঢপ কোট প্যান্টালুন পরা, সুতো দিয়ে ভাঙা-ডাঁটি বাঁধা নাকের ওপর ঝুলে-পড়া একটা নিকেলের চশমা চোখে দেওয়া এক বুড়োটে ভিখিরি গোছের মানুষ, পায়ে তালি দেওয়া ক্যাম্বিশের জুতো আর তারই সঙ্গে তাল রাখা ছেঁড়া ক্যাম্বিশের একটা ব্যাগ নিয়ে ডায়মন্ডহারবারের গঙ্গার ধারের নোঙর ফেলা একটা ছোট্ট লঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

    লঞ্চটা তো গাঙের ধারে এক আঘাটায় বাঁধা। সেখানে ওই শুটকো টেট্যাঁস গোছের চেহারার বুড়োটে লোকটা করছে কী।

    আর কিছু নয়, কাকুতিমিনতি করে কথা বলছে লঞ্চের ওপরে দাঁড়ানো এক খালাসির সঙ্গে।

    খালাসি যাকে বলছি যেমন তেমন সাধারণ খালাসি সে কিন্তু নয়। আঁটসাঁট টি-শার্ট, প্রায় হাঁটু পর্যন্ত গুটোনো লম্বা খাকি ট্রাউজারে তাকে খালাসির মতো দেখালেও সে বোধহয় তার চেয়ে বেশি কিছু।

    প্রথমত, এদেশের মানুষই সে নয়। রোদে জলে তামাটে হয়ে এলেও সে যে আদতে সাদা চামড়ার দেশের লোক তা দেখলেই বোঝা যায়। আর সেই সাদা চামড়ায় সে এক দৈত্যবিশেষ।

    যেমন তার চেহারা, মেজাজও তেমনই বিদঘুটে। চেহারায় সাদা গোরিলা আর মেজাজে একটা খ্যাপা নেকড়ে বললে কিছুটা তাকে বোঝানো যায়।

    শুটকো বুড়োটে মানুষটা যত তাকে কাকুতিমিনতি করে বলছে, শুনুন, শুনুন, আমার নাম আর্কি—আর্কি ট্রেগার—

    কী বললি! ডার্টি বেগার! শোন, ডার্টি বেগার—

    না, না, ডার্টি নয়, আর্কি, আর বেগার নয়—

    আর্কি নামে বুড়োটে মানুষটার আর কথা শেষ করা হয় না। তাকে কথার মাঝখানেই ধমকে থামিয়ে দিয়ে সাদা গোরিলাটা বলে, তুই আর্কি নয়, ডার্টি বেগার। শোন হতভাগা ডার্টি বেগার, এখানে দাঁড়িয়ে আর যদি বেশি জ্বালাতন করিস তো টুটি ধরে তুলে এনে এই ডেকের ওপর আছড়ে গাঙের জলেই ফেলে দেব। এখনও তুই, ভালয় ভালয় বলছি, দূর হ এখান থেকে।

    উটকো বুড়োটে আর্কি তবু নাছোড়বান্দা। কাতরভাবে বলে যায়—-কেন এত নিষ্ঠুর হচ্ছেন? আপনার কর্তাকে একবারটি শুধু খবর দিন এই বলে যে আর্কি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। আপনার কর্তার সঙ্গে আমার এই গাঙের পারের রাস্তাতেই দেখা হয়েছে। তিনি যা চান আমি সেই এ মুলুকের চাষাভুষো মাঝিমাল্লার গানের নমুনা জোগাড় করে তাঁকে শোনাতে এসেছি। একবারটি শুধু দয়া করে—

    ধলা অসুরটা আর্কির কথা শুনতে শুনতে যেভাবে দাঁতে দাঁতে ঘসতে ঘসতে হাতদুটো মুঠো করছিল তাতে মনে হচ্ছিল সত্যি সত্যিই সে এবার সেই শুটকো আর্কিকে টুটি টিপে লঞ্চের ওপর তুলে আছাড় মারবে! কিন্তু তার সুযোগ মিলল না। সে কিছু করার আগেই লঞ্চের মালিক নিজে থেকেই ভেতরের কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে ওদের দুজনকে দূর থেকে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে? কে ওখানে? কার সঙ্গে কথা বলছ, ড্যানি?

    দানো শব্দটারই যেন মোচড়ানো রূপ। ড্যানিই তাহলে লঞ্চের খালাসি দৈত্যটার নাম! ড্যানি কিন্তু কিছু জবাব দেবার আগেই বুড়োটে শুটকো আর্কি কাতরভাবে চেঁচিয়ে জানায়, আজ্ঞে, আমি আর্কি, আর্কি ট্রেগার। আপনাকে সেদিন রাস্তায়—

    আর্কিকে আর কিছু বলতে হয় না। লঞ্চের মালিকও কমবয়সী জোয়ান নন। পোশাকে-আশাকে না হোক, চেহারায় তো দুজনের মধ্যে কোথায় একটা মিল আছে। আর্কির মতো খেতে না-পাওয়া চেহারা না হলেও তিনিও বুড়োটে এবং শীর্ণ। আর্কির মতো চোখেও কম দেখেন।

    আর্কির কথার মধ্যে তিনি সামনে এগিয়ে এসে তাকে দেখে চিনতে পারেন আর সেই সঙ্গে আর্কির আর্জি মঞ্জুর হয়ে যায়।

    আরে তুমি, বলে লঞ্চের মালিক নিজে থেকেই তাকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, তুমি সত্যি এসেছ? আরে এসো এসো, ওপরে এসো।

    এরপর ড্যানির দিকে ফিরে তিনি আর্কির চলে আসার সুবিধের জন্য লঞ্চটাকে আর একটু এগিয়ে একেবারে তীরের গা ঘেঁসে লাগাতে বলেন।

    এবার তাই করতে হয় ড্যানিকে। কিন্তু মুখটা তখন তার দেখবার মতো। চোখ দুটো যেন জ্বলছে।

    সে জ্বলুনির একটা শোধ না নিয়ে ছাড়ে না।

    লঞ্চের মালিক আর্কিকে ওপরে আসার সুবিধে করে দিতে ড্যানিকে হুকুম দিয়ে আবার ভেতরের কেবিনে গিয়ে ঢুকেছিলেন। লঞ্চে উঠে ভেতরের সেই কামরার দিকে যেতে গিয়ে আর্কি সচাপ্টে ডেকের ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।

    পা পিছলেটিছলে নয়, পড়ে যায় আর্কির যাবার পথে ড্যানি হঠাৎ পা বাড়িয়ে তাকে লেঙ্গি মারায়।

    ডেকের ওপর বেশ জোরেই আর্কি মুখ থুবড়ে পড়েছিল। চট করে ওঠা তার হয়।। বেশ খানিক বাদে গা-হাত-পা ঝাড়তে ঝাড়তে সে কিন্তু ড্যানির দিকে একবার ফিরে চেয়েও দেখে না। ক্ষোভও জানায় না কিছু। মুখ বুজে মাথা নিচু করে সে এরপর লঞ্চের কেবিনে গিয়ে ঢোকে।

    কেবিনে ঢুকে আর্কি কি কোনও নালিশ জানায় লঞ্চের মালিকের কাছে? মোটেই না।

    তার বদলে খানিকবাদে তাকে সত্যিই তার তালি-মারা ক্যাম্বিশের ব্যাগ থেকে। একটা টেপ-রেকর্ডার বার করে তা থেকে কয়েকরকম লোকসঙ্গীত বাজিয়ে মালিককে শোনাতে দেখা যায়।

    মালিক খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, খুব ভাল। এ রকম যত গান আমায় সংগ্রহ করে দিতে পারবে আমি তোমায় প্রত্যেকটির জন্য মোটা বকশিস দেব।

    আর্কি যেন এ কথায় কৃতার্থ হয়ে গদগদ স্বরে বলে, আজ্ঞে আপনি খুশি হয়েছেন জেনে আমি ধন্য। আপনি আমাদের এ সুন্দরবনের বনে বাদাড়ে আঁছাড়ে-পাঁছাড়ে এত কষ্ট করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর আপনাকে খুশি করব না। বাঃ! আরও শুনুন তাহলে।

    আর্কি আবার তার টেপ-রেকর্ডটা চালিয়ে দেয়।

    কিন্তু এ কী বার হচ্ছে ভেতর থেকে?

    লঞ্চের মালিক প্রথমে চমকে যান, তারপর কেমন একটু অস্বস্তিতে যেন বেশ। অস্থির হয়ে পড়েন।

    টেপ-রেকর্ডারে তখন আর এ অঞ্চলের লোকসঙ্গীত বাজছে না। তার বদলে লঞ্চের মালিকের নিজের দেশের ভাষাতেই শোনা যাচ্ছে, কোনও ভাবনা নেই, মি. হার্টন! লোকসঙ্গীত খোঁজার নামে সত্যিসত্যি যা আপনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন তারই সন্ধান আমার কাছে আপনি পাবেন। আপনার লোভ তো ওই এখানকার যেখানে সেখানে জন্মানো আগাছাতে। যাকে বৈজ্ঞানিক নামটার বদলে আমরা শুধু কচালিই বলতে পারি।

    কিন্তু এই কচালির জন্য কেন আপনার এমন লালসা তাই একটু আপনার কাছে আগে জানতে ইচ্ছে করে। এ আগাছা যে এখন পৃথিবীর সাত রাজার ধনমানিক সেই হাইড্রোকার্বনে ভর্তি তা আপনি জানেন বুঝলাম। কিন্তু এ অমূল্য আগাছা তো আপনাদের অত বড় দেশের কোথাও পাওয়া যায় না। আপনাদের দেশ কেন, পৃথিবীর খুব কম জায়গাতেই এই কচালির কিছুকিছু পাওয়া যায়। যাও বা পাওয়া যায় তা আমাদের এই এখানকার মতো অজস্র নয়। তাহলে এই আগাছায় আপনাদের এত লোভ কেন! এখান থেকে এ কচালি তুলে নিয়ে চাষ করবেন নিজের দেশে? সে তো ন-মাস ছ-মাসের নয়, কিছু না থোক দশ-বিশ বছরের ব্যাপার

    থামাও! থামাও তোমার রেকর্ডার।লঞ্চের মালিক এতক্ষণে আর ধৈর্য ধরতে না পেরে গর্জন করে ওঠেন, কী শোনাচ্ছ এসব আমাকে?

    লঞ্চের মালিকের ধমকের সঙ্গে সঙ্গে আর্কি তার রেকর্ডার বন্ধ করে দিয়েছিল। এবার যেন ভয়ে ভয়ে মিনতি করে বলে, আপনার ভাল লাগছে না বুঝি! আর একটু শুনুন তাহলে, ভাল লাগবে। না লেগে পারে না।

    আর্কি রেকর্ডার আবার চালু করে দিয়ে বলে, দামি কথা এইবারটা পাবেন।

    রেকর্ডারে তখন শোনা যায়—দশ-বিশ বৎসরই না হয় আপনারা অপেক্ষা করতে রাজি বুঝলাম। কিন্তু শুধু এই কচালি জন্মালেই তো হল না। এ কচালি নিংড়োলে যা বেরুবে সে তো আর আসলি মাল নয়—

    থামাও, থামাও, তোমার রেকর্ডার! আমি শুনতে চাই না, বলে এবার চিৎকার করে ওঠেন লঞ্চের মালিক। কাকে তুমি কী শোনাতে এসেছ?

    লঞ্চের মালিক থামাও বলে চিৎকার করে উঠতে আর্কি তার যন্তরটা বন্ধ করে দিয়েছিল। তারপর ধৈর্য ধরে মালিকের কথা শুনে যেন অবোধকে বোঝাচ্ছে এমনই মিষ্টি করে বলে, আচ্ছা! আচ্ছা, ও টেপ রেকর্ডারে শুনতে হবে না। যা বলবার আমি মুখেই বলছি, শুনুন। ওই কচালিতে প্রচুর হাইড্রোকার্বন আছে এটা ঠিক, কিন্তু সেটা হল মোটা মাল, তাতে দু শিকলি গ্রন্থিতে ১৪টা করে কার্বন অ্যাটম, ২৪টা করে হাইড্রোজেন অ্যাটমের সরু জোড়া। কোনও ইঞ্জিন চালাবার পক্ষে তা অচল—

    আর্কির কথা বলার মধ্যেই লঞ্চের সেই সাদা অসুর খালাসি কেবিনের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে।

    লঞ্চের মালিক রাগে মুখ রাঙা করে তার দিকে তাকিয়ে হুকুম দেন, এই মর্কট আর ওর যন্তরটাকে গাঙের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসো তো ড্যানি—এখুনি দাও গিয়ে।

    এর চেয়ে পছন্দসই কাজ ড্যানির কাছে আর কিছু হতে পারে না। শুধু ছুঁড়ে ফেলা ন্য, সেই সঙ্গে মর্কটটার একটা হাত কাঁধ থেকে মুচড়ে খুলে নেবার সাধু ইচ্ছে নিয়ে ড্যানি আর্কির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

    দাঁড়ান, দাঁড়ান! অত ব্যস্ত কেন? ঝাঁপিয়ে পড়া ড্যানি তখন যেখানে সচাপ্টে মেঝের ওপর আছড়ে পড়েছে সেদিকে এবার করুণার দৃষ্টি ফেলে আর্কি বলে যায়, আমার শেষ ক-টা কথা শুধু বলে যাই। তাতে সময় আর কতটুকু লাগবে! ওই যে অচল হাইড্রোকার্বনের কথা বললাম তাকে যাকে বলে খুচরো চোলাই, অর্থাৎ ফ্র্যাকশন্যাল ডিস্টিলেশন, করে সরল সচল করা এমন কিছু অসাধ্য ব্যাপার নয়। ঠিক মতো একটা ক্যাটালিস্ট খুঁজে বার করা এমন কিছু অসাধ্য ব্যাপার নয়। ঠিক মতো একটা ক্যাটালিস্ট খুঁজে বার করতে পারলেই হল। আরে, এই দেখো! ধীরে সুস্থে কথাটা শেষ করতে দিলে না—

    আর্কির কথার মধ্যে ধলা গোরিলাটা মেঝে থেকে উঠে তখন আর্কির ওপর আবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু ওই ঝাঁপিয়ে পড়াই সার। আর্কিকে জাপটে ধরার বদলে পরমুহুর্তে নিজেই সে বাইরের ডেকে ধরাশায়ী।

    সেদিকে চেয়ে বেশ একটু সহানুভূতির সঙ্গে আর্কি বলে, হাড়গোড় আবার না ভেঙে থাকে বেচারার। সারারাত এখন আবার লঞ্চ চালাতে হবে তো।

    ড্যানির দিক থেকে লঞ্চের মালিকের দিকে মুখ ফিরিয়ে আর্কি এবার বলে, হ্যাঁ, আপনাদের আবার হাতে বেশি সময়ও নেই। তাই যা বলছিলাম তাড়াতাড়ি সারছি। ওই ক্যাটালিস্ট মানে-যে শুধু দু-হাত এক করার ব্যবস্থা করে নিজে বাইরে থাকে। তেমনই গোছের হাইড্রোকার্বনকে মিহি করবার ঘটক আবিষ্কার করার পথে প্রায় বুড়ি ছুঁয়ে ফেলেছেন তার নাগাল পেলেই আপনার সুবিধে হত খুব বেশি। লোকসঙ্গীত খোঁজার নামে তার খোঁজও খুব বেশি করে করেছিলেন। কিন্তু সে খোঁজা সার্থক আর হল না। যাকে খুঁজছিলেন তিনি জানতেও পারলেন না, পারলে তাকে চুরি করে নিজেদের মুলুকে পাচার করবার মতলব নিয়ে এক দুশমনের জুড়ি এই এত কাছাকাছি ঘুরে বেড়াচ্ছিল। যাক, আর দেরি করব না। আপনার ড্যানি ডেকের ধার থেকে একটা লোহার হাতুড়ি জোগাড় করেছে দেখছি। সেই হাতুড়ি আমার মাথায় ভাঙবার সদিচ্ছা নিয়ে আমার দিকে আসছে। তবে এবার আর বুনো মোয-টোষের মতো নয়। যত নিরেটই হোক, মানুষ ঠেকে শেখে। ও তাই এবার হুশিয়ার হয়ে ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমার এ সব মারামারি-টারামারি ভাল লাগে না। তবু বাধ্য হয়ে আর একবার এই কেবিনের ওই কোণের টেবিলটার ধারে ওর ঘাড়মুখ গুঁজে পড়া দেখে যেতে হবে। তবে বেশি জোরে পড়বে না। হাড়গোেড় আস্ত না থাকলে এখন থেকে সারারাত লঞ্চ চালিয়ে সকালের আগেই সাগর দ্বীপে পৌঁছবে কী করে!—হ্যাঁ, এই দেখুন তেমন বেশি জখম হয়নি। দরকার হলে মুখেচোখে একটু লোনাজলের ছিটে দিলেই চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আর তখুনি লঞ্চ চালু করে সাগর দ্বীপের দিকে রওনা হবেন। সেখানে পৌছবার পর কী করতে হবে তা আর আপনাকে বলে দিতে হবে না নিশ্চয়। আগের ব্যবস্থামতো হেলিকপ্টারটা যদি আসে তাহলে কোনও ভাবনাই নেই। হেলিকপ্টারে চড়বার আগে লঞ্চটা ওই দ্বীপের কাছাকাছি সমুদ্রে ড়ুবিয়ে দিয়ে যাবেন। ওরকম একটা লঞ্চের লোকসান গ্রাহ্য না করার ক্ষমতা আপনাদের আছে। আর যদি নেহাত কোনও কারণে হেলিকপ্টার সময়মতো না এসে পৌছয় তাহলে লঞ্চে করে সামান্য একটা পাড়ি দিলেই আপনারা নিরাপদ। তবে এসব কথা মিছে মিছে বকে মরছি। আমি জানি আজ আর একটু রাত হবার পর আপনাদের চুলের টিকি আর এ তটে দেখা যাবে না। কারণ আপনি জানেন যে রাত পোহাবার আগেই এ মুলুক থেকে একেবারে হাওয়া না হয়ে গেলে ধরা পড়ে যে-কেলেঙ্কারিট হবে তাতে আপনাদের নিজেদেরই গোয়েন্দা দপ্তর আনাড়িপনার জন্য কী দারুণ শাস্তি আপনাদের দেবে। সুতরাং গুডনাইট আর গুডবাই জানিয়ে চলে যাচ্ছি। আপনার ড্যানি একটু যেরকম নড়ছে তার মুখে এক জগ জল ঢাললেই উঠে বসবে। আচ্ছা! গুডলাক পরের বার।

    এই বলে আর্কি লঞ্চ থেকে লাফ দিয়ে তীরে নেমে যায়। লঞ্চটাকেও আর বেশিক্ষণ সেখানে দেখা যায়নি। সন্ধে হবার আগেই সে সাগর দ্বীপের পথে মাঝ দরিয়ায়।

    ঘনাদা তাঁর কাহিনী শেষ করে যথারীতি শিশিরের সিগারেটের কৌটোটা পকেটে রেখে তাঁর টঙের ঘরের দিকে রওনা হচ্ছিলেন। একটা বাধা দিয়ে ন্যাকা সেজে বললাম, আচ্ছা আর্কিকে কেমন যেন চেনা-চেনা লাগছে।

    তাই নাকি? ঘনাদা যেতে যেতে বলে গেলেন, তা–সে আর আশ্চর্য কী? আর্কির মতো মানুষের তো পথে-ঘাটে ছড়াছড়ি।

    এ জবাব পাবার পর কারও মুখে আর কোনও কথা ফোটে!

    আমরা এ ওর মুখের দিকে চেয়ে একেবারে চুপ।

    শিবুই প্রথম যেন জিভের সাড় ফিরে পেয়ে জানতে চাইল, কী, মৌ-কা-সা-বি-স-এর হদিস কিছু মিলল! কী বুঝছ! এক, না বহুবচন?

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }