Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    ঘনাদা ফিরলেন

    ফিরে এলেন ঘনাদা?

    তা ফিরতে গেলে তো যেতে হয় আগে। তিনি গেলেন কখন যে ফিরে আসবেন?

    যাবার মধ্যে বাহাত্তর নম্বরে এসে অধিষ্ঠিত হবার পর একবারই এ আস্তানা ছেড়েছিলেন!

    সেই বাপি দত্তের সময়ে।

    বাপি দত্ত মানে যে বিগড়ি হাঁসে অরুচি ধরানো সেই বুনো বাপি দত্ত, তা নিশ্চয় আর বলতে হবে না। কোটি কুবেরের ধনের সমান এক আশ্চর্য ভারী জলের হ্রদের ভৌগোলিক ঠিকানা লেখা চিরকুট যার মধ্যে ভরা, ঘনাদার সেই নস্যির কৌটো উদ্ধার করে দুনিয়ার সব আমিরের ওপর টেক্কা দেবার আশায় যখন সে দিনের পর দিন একরকম বিগড়ি হাঁসযজ্ঞ চালিয়ে যাবে তখন একদিন হঠাৎ সত্যিই এক বিগড়ি হাঁসের পেটে এক খুদে কৌটো পেয়ে সমস্ত বাহাত্তর নম্বর প্রথমে একেবারে থ, তারপর আনন্দে আটখানা হয়ে ঘটা করে কৌটো খোলবার অনুষ্ঠান দেখাবার জন্য ঘনাদাকে প্রায় টেনে হিঁচড়ে ডেকে এনেছিল বাপি দত্ত নিজে।

    সে কৌটো খোলর পর বাপি দত্তের অবস্থা দেখবার জন্য ঘনাদা আর দাঁড়াননি। কৌটো খুলে ভেতরকার চিরকুটটা বার করে গৌর না শিশির কে একজন তা পড়ে দেবার সঙ্গে সঙ্গে ঘনাদাকে সেখানে দেখা যায়নি। দেখা যায়নি বাহাত্তর নম্বরেই আর দিনের পর দিন, হপ্তার পর হপ্তা, মাসের পর মাস।

    বাপি দত্তও সেইদিন বিকাল থেকেই সেই যে বাহাত্তর ছেড়ে দিল আর আসেনি।

    কী ছিল এমন মোক্ষম মারাত্মক ওই নস্যির কৌটোয় ভরা চিরকুটে?

    লেখা ছিল দুটি মাত্র শব্দ—ঘনাদার গুল।

    বাপি দত্ত না ফিরলেও ঘনাদা একদিন আবার ফিরেছিলেন আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবে।

    ফিরেছিলেন সমস্ত ঘনাদা বৃত্তান্তের মধ্যে মাত্র একবারের জন্য দেখা দেওয়া সেই দাদা উপাখ্যানে। তাঁকে নিয়ে দাদার উপহাসের গল্পের যেন জীবন্ত জবাব হয়ে।

    ফিরে আসাটা যেমন নাটকীয়, আগের বারের যাওয়ার মতো সামান্যই হোক, তেমনই একটু হুশিয়ারির ভূমিকা ছিল।

    বিগড়ি হাঁসের পেটে নস্যির কৌটোয় কুবেরের হতাশাখানার হদিস পাওয়ার আশা নেহাত আজগুবি কল্পনার ফাঁপা ফানুস হলেও তা কখন ফাটে বলে মনের মধ্যে কৌতূহলের একটু সুড়সুড়ি অন্তত ছিল।

    এবার কিন্তু একেবারে যেন বিনামেঘে বজ্রাঘাত।

    ছুটির দিন দুপুরবেলায় একটু এলাহি খাওয়া-দাওয়ার পর সন্ধ্যায় জমাটি আড্ডার জন্য তৈরি হতে যে যার ঘরে একটু বিশ্রাম করে নীচে যাবার আগে দু-দশ মিনিটের চুটকি আলাপের ফাঁকে যোলো আনা খোশমেজাজে হাজির দেখে গেছি, দোতলার বারান্দা থেকে ন্যাড়া ছাদের তাঁর টঙের ঘরে যাবার একানে সিঁড়ি দিয়ে ওঠবার আগে যিনি রাত্রের মেনুটা শিশিরের কাছে জেনে নিয়ে প্রুফ দেখার মতো করে তাতে ক-টা কমা-সেমিকোলন বদল করেছেন মাত্র সেই বাহাত্তর নম্বরের একমেবাদ্বিতীয় তিনি হঠাৎ সন্ধ্যা হতে না হতেই একেবারে নিরুদ্দেশ!

    আর সে খবর আমাদের জানতে হল ঘনাদার নতুন শখ বা নেশা করা, জরদা-তবক-জড়ানো বেনারসি খিলি সাজিয়ে নিয়ে যাবার জন্য সারা চৌরাস্তা যার খোশবুতে ভুরভুর করে, মোড়ের সেই হিন্দি বাংলা ইংরেজিতে সাইনবোর্ড মারা পানের দোকানে অপেক্ষা করতে করতে দোকানেরই রেডিয়োয় ঘোষণা শুনে?

    এমনিতে রাস্তাঘাটের বেতারের পরিবেশন আর পাঁচটা শহুরে হই-হট্টগোলের থেকে আলাদা হয়ে কানে বড় একটা যায় না।

    এ বেতার-ঘঘাষণাটা কিন্তু গেল! এবং গেল কর্ণকুহর যেন বিদীর্ণ করে একেবারে মরমে।

    বেতার-ঘোষণাটা হচ্ছিল নিরুদ্দিষ্টের সংবাদের। এবং ভাষাটা ছিল ইংরাজি।

    সেই ইংরাজি ঘোষণায় হঠাৎ বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন শুনেই চমকে উঠেছিলাম। তার পরে যা শুনলাম তাতে শুধু হতভম্ব নয়, সমস্ত শরীর যেন হঠাৎ জমে ঠাণ্ডা পাথর।

    যা শুনেছি তাতে নিজেদের কানগুলোকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। কী বলছে কী বেতার-বিজ্ঞপ্তি? গতকাল বিকাল থেকে বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন থেকে নবীন ও প্রবীণ প্রাজ্ঞ মহলে সুপরিচিত শ্রীঘনশ্যাম দাস মহাশয় নাকি নিরুদ্দেশ।

    নিরুদ্দেশ? ঘনশ্যাম দাস মানে ঘনাদা?

    কী বলছে কী বেতারের প্রলাপ? বলে নিজেদের যখন প্রশ্ন করছি তখন নিরুদ্দিষ্টের সন্ধান পেলে খবর জানাবার ঠিকানা হিসাবে বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের ঠিকানাটাই আবার উচ্চারিত হয়ে ঘোষণাটি শেষ হল।

    না, গভীর নিদ্রার ঘোরে দুঃস্বপ্ন কিছু দেখছি না আমরা। বড় রাস্তার মোড়ে সুবিখ্যাত বেনারসি পানের দোকানের সামনে বহাল তবিয়তে যথার্থই উপস্থিত আছি।

    রাস্তা দিয়ে ট্রাম বাস লরি গাড়ি রিকশ ও পদাতিকের ভিড় যথারীতি প্রবাহিত হচ্ছে। অথচ—অথচ-বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেন থেকে নবীন প্রবীণ দুই মহলে ঘনাদা আর ঘনশ্যাম দাস নামে এক ডাকে সবাই যাঁকে চেনে সেই তিনিই নাকি নিরুদ্দেশ!

    সে নিরুদ্দেশ হবার খবরটা আমাদের জানতে হল আবার বেতার-ঘঘাষণা মারফত!

    বাহাত্তর নম্বরের দিকে সবাই মিলে ছুটে যেতে যেতে শেষ কখন ঘনাদাকে কোথায় কীভাবে দেখেছি তা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করবার চেষ্টা করলাম।

    হ্যাঁ, টঙের ঘরের তাঁর সঙ্গে অদর্শনটা একটু বেশিক্ষণের জন্য হয়ে গেছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই! ব্যাপারটা সত্যিই একটু অস্বাভাবিক। সকালে তাঁর সঙ্গে সবদিন অবশ্য দেখা হয় না। কিন্তু সকালে না হলেও বিকেলে আড্ডাঘরে দেখা যে হবেই তা একরকম ধরেই নেওয়া যেতে পারে। সকালবিকেল দুবেলাই তাঁর দর্শন লাভ থেকে বঞ্চিত হয়েছি এমন ব্যাপার তো আঙুলে গোনা যায়।

    এবারে যা ঘটে গেছে তা কিন্তু আরও একটু বেশি কিছু।

    শুধু গতকালের সকালবিকেল আর আজকের দিনের সকাল নয়, নিজেদের মধ্যে আলাপ করে বুঝতে পারলাম, গতকালের আগে পরশু বিকেলটা দিব্যেন্দু বড়ুয়ার এক নতুন জুড়ি আমদানির হুজুগে মেতে এক দাবা প্রতিযোগিতার খেলা দেখতে গিয়ে আমাদের আড্ডাঘরে হাজিরা দেওয়াটা ফসকে গেছে।

    কিন্তু চার না হোক, আমাদের এই পাঁচ বেলার অন্যমনস্কতাতেই ঘনাদা বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে একেবারে নিরুদ্দেশ?

    দেখাই শুধু হয়নি, নইলে ঘনাদার মেজাজে চিড় ধরাবার মতো এমন কিছু বেয়াদবিও তো করিনি আমরা কেউ!

    আজকের দিন সকাল থেকে যে তাঁকে দেখা দিইনি সেও তো রাত্রের ভোজে তাঁকে একেবারে আহ্লাদে আটখানা করবার জন্য। তাঁর যা-যা বাদশাপসন্দ খানা, তা তো আছেই, তার ওপর একেবারে কিস্তিমাত-এর জন্য ব্যবস্থা আছে, স্মােকড হিলশা অর্থাৎ খই-এর ধোঁয়ায় পাকানো নিষ্কণ্টক মানে কাঁটা-ছাড়া খোশবু সমেত আসল গঙ্গার ইলিশ মাছের লম্বালম্বা কালি। শহরের এক পয়লা নম্বর হোটেলের পুরনো রসুইকরকে ভাড়া করে এনে ভোজের এই পদটি বিশেষ করে বানানো হয়েছে। যেমন ভোজ তার তেমনই তো মুখশুদ্ধির জন্য মোড়ের পানের দোকানের সেরা এই বেনারসি খিলির ব্যবস্থা।

    এসব কিছু তা হলে বরবাদ মানে জলাঞ্জলি?

    তার চেয়ে গুরুতর ব্যাপার হল এই যে ঘনাদা এরই মধ্যে নিরুদ্দেশ। কেন? কোথায় বা তিনি গেলেন? সে খবর বেতারে ঘোষিত হবার ব্যবস্থাই বা হল কী করে।

    বাহাত্তর নম্বরে ফিরে রামভুজ আর বনোয়ারিকেও ডেকে আলোচনা করে এ রহস্যের কোনও কিনারাই হল না। এইটুকু শুধু জানা গেল যে আমাদের সঙ্গে দেখা না হলেও আজ সকাল পর্যন্ত বহাল তবিয়তে আমাদের এই বাহাত্তর নম্বরেই ছিলেন।

    ছিলেন বটে, তবে কেমন একট অস্থির-অস্থির ভাব যে ছিল তা চা দিতে গিয়ে। আমাদের বনোয়ারিরও নজরে পড়েছে। কী এমন একটা তাড়াহুড়ো ভাবে যাতে তাঁর অতি পেয়ারের ফ্রেঞ্চ টোস্টও তিনি দুটোর জায়গায় দেড়খানা খেয়ে চায়ের পেয়ালাটা খালি না করেই চলে গেছেন।

    সকালের চা-টোস্টের প্রতি এই অবহেলা বনোয়ারি অবশ্য সকালের খাবারের ট্রে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেই লক্ষ করেছে। ঘনাদা তখন ঘরে নেই। তাঁকে এর পর সে আর দেখেনি। দেখেনি রামভুজ বা বাহাত্তর নম্বরের আর কেউ।

    কিন্তু সেই সকালে বেরিয়ে ঘনাদা গেলেন কোথায়? তাঁর এই যাওয়াটা যে নিরুদ্দেশ হওয়া এমন খবরই বা বেতারে কে বা কারা পৌঁছে দিল আজকের দিনের মধ্যেই।

    বাহাত্তর নম্বরের আড্ডাঘরে বসে যত আলোচনা করি তত আরও দিশাহাবা হয়ে উঠে শেষ পর্যন্ত এ বাড়ির নতুন সহায়ের পরামর্শ নিতে তাঁর খিদিরপুরের বাসাতেই গেছি।

    খিদিরপুরের বাসা যে পরাশর বর্মার তা বলাই বাহুল্য। ঘনাদার সঙ্গে তাঁকে লাগিয়ে দিয়ে একটু মজা পাবার লোভে একদিন তাঁকে মিথ্যে ছুতোয় ডাকিয়ে এনেছিলাম। ভেবেছিলাম দুই মহামল্লের তাল ঠোকাঠুকিতে আগুনের ফুলকি ছিটোনো যে আতস বাজি হবে মজা করে তা দেখব।

    কিন্তু কোথায় ঠোকাঠুকি! দেখা হওয়ার পর দুজনে যেন আমে দুধে মিশে গিয়েছিল। সেই গলাগলি সেই থেকে এমন চলছে যে বাহাত্তর নম্বরের একটা ঘটিবাটি হারালেও ঘনাদা আমাদের রহস্যভেদের জন্য পরাশর বর্মার কাছে পাঠান।

    সুতরাং তাঁর কাছে তখনই যাব বলে ঠিক করলাম। কিন্তু যাবার জন্য নীচে যাবার সিঁড়িতে পা দেওয়ার আগেই বাধা।

    বোয়ারি এসে খবর দিলে বড়বাবু মানে আমাদের টঙের ঘরের তাঁর সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে।

    দেখা করতে এসেছে তো হয়েছে কী? বনোয়ারিকে ধমক দিয়েই বললাম, বড়বাবু যে বাড়ি নেই তা বলতে পারোনি, হাঁদারাম?

    হাঁদারাম করুণভাবে জানাল যে সেই কথাটা সে বলেছে, কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। বনোয়ারির বড়বাবু আর আমাদের টঙের ঘরের তাঁর জন্যে যিনি এসেছেন তিনি নাকি সে সংবাদে কোনও গুরুত্ব না দিয়েই বলেছেন, এখন নেই তো কী হয়েছে! কোই বাত নেহি—আমি তাঁর জন্য অপেক্ষা করব।

    বনোয়ারির এই বিবরণটুকু দেওয়ার মধ্যেই সিঁড়ির নীচে আগন্তুকদের দেখা গেল। হ্যাঁ, আর একজন নয়, দুজন। প্রথম জন কাশ্মিরি শালওয়ালা আর দ্বিতীয়জন তাঁর বেচতে-আনা শাল-দোশালার বোঝার বাহন।

    ঘনাদার খোঁজে কাশ্মিরি শালওয়ালা আসার মানে? মানেটা শালওয়ালার সঙ্গে একটু আলাপ করে জানা গেল, শালওয়ালা রশিদ খাঁ সাম্প্রতিক ঘনাদা-মোহিতদের একজন। শীতের আগে এই কলকাতায় খানদানিদের মহলে প্রতি বছর সে কাশ্মিরি শাল-দোশালা বেচতে আসে। তার বাহককে নিয়ে কোনও খরিদ্দারের কাছে যাবার পথে ঘনাদার সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, আর সেই পথের দেখাতেই সামান্য কিছু বোলচালেই ঘনাদার কাশ্মিরি শাল-দোশালার কারবার সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান দেখে সে অবাক আর মুগ্ধ হয়ে তাঁকে। তার সেরা এমন কিছু সওদা দেখাতে এসেছে যার কদর তাঁর মতো জহুরিই শুধু বুঝবে। রশিদ খাঁ তারপর মামুলি পাহাড়ি ভেড়ার ললামে তৈরি মাল আর পাঁচ হাজার ফুটের নীচে যারা নামে না সেই ভেড়ার জাতের পশমে বোনা পশমিনার তফাত বোঝার মতো ওস্তাদের যে স্তবগান শুরু করেছে তা নেহাত ঘনাদার নিরুদ্দেশ-রহস্য-ভেদের দায়েই সবিস্তারে শোনার লোভ সংবরণ করে তাকে কোনও রকমে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে—দিন কয়েক বাদে এলেই দেখা হবার আশ্বাস দিয়ে বিদায় করতে হয়েছে।

    অত্যন্ত ব্যথিত আর হতাশভাবে বিদায় নেবার আগে রশিদ খাঁ কিন্তু নাছোড়বান্দা হয়ে একটি দামি মলিদা ঘনাদার জন্য রেখে গেছে। আমাদের ওজর আপত্তি কিছুই সে শোনেনি। দামের কথা তো মুখে আনতেও দেয়নি। ঘনাদা আর আমাদের সাধ্যের কথা ভেবে আমাদের সমস্ত আপত্তি এক কথায় খন্ডন করে বলে গেছে যে দামের জন্য কোনও পরোয়াই নেই। একজন যথার্থ পয়লা নম্বর সমঝদার জহুরির জন্য যে রেখে যেতে পারছে এই তার গর্ব।

    শেষ পর্যন্ত রশিদ খাঁ-কে বিদায় দিয়ে পরাশর বর্মার খিদিরপুরের বাসায় যেতে বেশ একটু দেরি হয়ে গেছে। রাত তখন প্রায় দশটা। অসময়ে তাঁকে বিরক্ত করতে যাওয়া ঠিক হবে কি না ভেবে মনে যা একটু দ্বিধা ছিল বাসায় পৌঁছেই তা দূর হয়ে গেছে। পরাশর বর্মার বাইরের ঘর শুধু খোলা না, সেখানে তখন তিনি বন্ধু কৃত্তিবাস ভদ্রের সঙ্গে কাব্যচর্চায় মশগুল।

    আমাদের দেখে, হেসে ও মাথা নেড়ে, পরাশর সাদর অভ্যর্থনাই জানালেন ঠিক, কিন্তু পরের পর যেরকম ছড়া আর কবিতা তখন পড়ে যাচ্ছেন খাতা থেকে তাতে আমাদের কোনও কথা ধৈর্য ধরে শোনার অবসর আছে বলে মনে হল না। তবু গরজ বড় বালাই।

    তাই তাঁর কবিতা আর ছড়া পাঠের মধ্যে একটু-আধটু যা ফাঁক পেলাম তাতেই আমাদের সমস্যা যতটা সংক্ষেপে সম্ভব, কাতরভাবে তাঁকে জানিয়ে তিনি কী বলেন তো শোনার অপেক্ষায় রইলাম।

    অপেক্ষা যে বৃথা মনে মনে তখন হতাশভাবেই মেনে নিয়ে নেহাত নিরুপায় হয়েই বসে বসে এ কাব্য-যন্ত্রণা কখন শেষ হবে তাই ভাবছি।

    কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার! অপেক্ষা করতে হলই না বলা যায়। একটা কী ছড়া শোনাতে শোনাতেই মাঝপথে থেমে পরাশর আমাদের দিকে ফিরে যা বললেন তাতে আমরা একেবারে তাজ্জব!

    আরে তোমরা আর কতক্ষণ বসে থাকবে! বলে একটু থেমে হঠাৎ বললেন, শোনো শোনো, এই ছড়াটা একটু ভাল করে শুনে নাও!

    ছড়া শুনব? আমাদের মুখগুলো সব হাঁ।

    হ্যাঁ, শোনো! পরাশর নির্বিকারভাবে বলে চলেন, ইচ্ছে করলে টুকেও নিতে পারো! হ্যাঁ, টুকে নেওয়াই বোধ হয় ভাল।

    আমাদের দিকে কাছে-রাখা একটা প্যাড আর পেনসিল ছুঁড়ে দিয়ে পরাশর যে ছড়াটা আউড়ে গেলেন তা এই—

    যে দিকে চাও সে দিকেতেই ধাঁধা
    তবুও জানি, সঠিক
    কারণ বিনা হয় না কার্য—
    দুই-এ যেন শিকল দিয়ে বাঁধা।
    সেই শিকলের একটা শুধু
    আংটা যদি পাই।
    হয়তো টেনে তুলতে পারি।
    আমূল ধাঁধাটাই।

    এতদূর পর্যন্ত শুনিয়ে পরাশর আবার একটু থামলেন। তারপর আচমকা কী যেন একটা ঝিলিক মনের মধ্যে পেয়ে গিয়ে একটানা বলে গেলেন—

    কেউ কি জানে, কোথায় কী হয়,
    কেনই বা হয়, কীসে?
    শাল-দোশালার ধরলে জ্বালা
    সারতে পারে হয়তো নিরামিষে।
    যা করো আর যাই বা ভাবো
    এইটি জেনো সার,
    বাঘের ঘরেই ঘোগের বাসা
    কোথ্‌থাও নয় আর।
    বাঘটা কেমন না থাক জানা
    ভাবনা করা মিছে,
    এই জেনো ঠিক, কুলুপ খোলার
    চাবি ফিরছে তারই পিছে পিছে।

    পরাশর বর্মা যেভাবে তাঁর ছড়া আওড়ানো শেষ করে আবার নিজেদের সামনে রাখা খাতাটা খুলে বন্ধু কৃত্তিবাসের দিকে ফিরলেন তাতে সেটা স্পষ্টই আমাদের বিদায় দেওয়া বলে বোঝা গেল।

    সে অবস্থায় জোর করে সেখানে বসে থাকা যায় না। নিরুপায় হয়েই হতভম্ব মুখে আমাদের সে-ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে হল।

    কিন্তু এখন আমরা করব কী? পরাশর বর্মার বাড়ির গলি থেকে বড় রাস্তায় বেরিয়ে একটা বাস-স্টপের কাছে দাঁড়িয়ে সেই প্রশ্ন নিয়েই আমরা পরস্পরের মুখের দিকে চাইলাম।

    এ আবোল-তাবোল ছড়া আমাদের শোনাবার মানে? গৌর বেশ একটু তেতো গলাতেই তার ক্ষুব্ধ বিস্ময়টা প্রকাশ করলে।

    আমরা কী জানতে ওঁর কাছে এলাম, আর উনি আমাদের সঙ্গে কী রসিকতা করলেন! শিশিরের ঝাঁঝালো মন্তব্য।

    একটা ট্রাম এসে যাওয়ায় তাতে এরপর সবাই চড়ে বসলাম। এত রাত্রে এসপ্ল্যানেডে যাওয়ার ট্রামটা প্রায় খালি। পেছনের দিকে চারজনে সেই একই ব্যাপার নিয়ে উত্তেজিত আলোচনায় মত্ত হয়ে রইলাম।

    আমাদের সঙ্গে পরাশর বর্মার এ ব্যবহারটা কি অপমান বলে ধরব, না শুধু একটু উপহাস?

    উপহাসই যদি হয় তা উনি আমাদের করেন কী অধিকারে? আমাদের কি উনি অবোধ শিশু পেয়েছেন!

    দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমাদের মধ্যে শিবুই মাথাটা একটু ঠাণ্ডা রেখেছিল এতক্ষণ। সে এবার হঠাৎ গম্ভীরভাবেই আমাদের থামিয়ে আলোচনাটার মোড় একটু ফিরিয়ে দিয়ে বললে, আচ্ছা, ছড়া শোনাবার আগে, বন্ধু কৃত্তিবাসকে কবিতা শোনাবার ফাঁকে ফাঁকে উনি দু-একটা কী সব জিজ্ঞাসা করছিলেন না?

    হ্যাঁ, করছিলেন। শিশির গরম মেজাজেই বললে, উনি আমাদের কারওর ওপর বা বাহাত্তর নম্বরের সম্বন্ধে কিছু বিরক্ত হয়েছিলেন কি না এমন কী দু-একটা আজেবাজে প্রশ্ন!

    আমরা ওঁকে তো জানিয়েইছিলাম তখন, গৌর শিশিরের কথাতেই সায় দিয়ে জানালে, সেরকম কোনও কিছুই হয়নি। পাড়ার মধ্যে নতুন একটা হোটেল খোলায় পাড়াটার জাত গেল বলে দু-চারবার একটু গজগজ করেছিলেন বটে, কিন্তু সেটা আমাদের সঙ্গ ছাড়বার মতো রাগ বা বিরক্তি কিছুই নয়।

    বরং তাঁর মেজাজ যে হালে রীতিমত খোশ ছিল তার প্রমাণ হিসেবে কাশ্মিরি শালওয়ালার কথাটা আমি বলেছিলাম, বললে শিশির। মেজাজ খোশ না থাকলে শালওয়ালাকে তার কারবারের বিষয়েই জ্ঞান দিয়ে অমন মোহিত করবার মর্জি তাঁর হয়?

    এসপ্ল্যানেডে ট্রাম গিয়ে পৌঁছনো পর্যন্ত এ আলোচনা আমাদের চললেও কোনও মীমাংসায় পৌঁছনো যায়নি।

    মীমাংসা হয়নি তারপর পাঁচ-পাঁচটা দিন কাটাবার পরও। এ পাঁচ দিন ঘনাদার কোনও হদিস মেলেনি তা বলা বাহুল্য। দিশাহারা হয়ে আর-একবার নিজেদের মান খুইয়ে পরাশর বর্মার কাছেই যাব, না পুলিশে খবর দেব—যখন সব ঠিক করবার জন্য সাতসকালেই আড্ডাঘরে সবাই জড়ো হয়েছি তখন শিবুর হঠাৎ মাথায় যেন কীসের ঝিলিক খেলে গেল। হাতের চায়ের পেয়ালাটা বেসামাল হয়ে ফেলে দিতে গিয়ে সামলে সে উত্তেজিত স্বরে বললে, আচ্ছা, পরাশর বর্মার ধাঁধার ছড়াটা কোথায়? কার কাছে?

    কাগজে টোকা ছড়াটা আমার কাছে ছিল। সেটা পকেট থেকে বার করে শিবুর হাতে দিয়ে ঠাট্টার সুরে বললাম, এ ছড়ার মধ্যেই ঘনাদার অন্তর্ধান রহস্যের হদিস আছে নাকি?

    থাকতেও পারে, বলে গম্ভীর মুখে শিবু আমাদের সকলকে অবাক করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

    বিকেলবেলা ফিরে এল আমাদের তেমনই অবাক শুধু নয়, একেবারে হতভম্ব করে। সে একা ফেরেনি। সঙ্গে তার স্বয়ং ঘনাদা।

     

    হ্যাঁ, ঘনাদা ফিরলেন!

    কিন্তু এ তাঁর কী রকম ফেরা!

    সেই মার্কামারা ধুতি শার্ট আর পায়ে অ্যালবার্ট শু পরা ঘনশ্যাম দাস নয়, পায়ে বিদ্যাসাগরি হলদে চটি, পরনে ধুতি পাঞ্জাবিগুলো সাদা হলেও তার ওপর কাঁধে ঝোলানো গেরুয়া চাদর আর মাথায় গেরুয়া রঙের গান্ধীটুপি।

    এ বেশে তিনি কোথা থেকে এলেন? ছিলেনই বা কোথায়?

    কোথায় যে ছিলেন, তা তাঁকে সমাদরে তাঁর মৌরসি আরাম-কেদারায় বসিয়ে শিবুর পাড়া কাঁপানো হাঁকে নীচের রামভুজকে ফরমাশ দেওয়া থেকেই বুঝি বোঝা গেল। মুরগি-মটন-মছলি-আন্ডার যাবতীয় জানা অজানা খানার সে কী লম্বা ফর্দ! সাতদিন উপোস করা বা প্রাণের দায়ে শাকপাতা চিবানো কেঁদো বাঘের সে যেন প্রথম নিয়মভঙ্গের খাওয়ার ফিরিস্তি।

    কিন্তু পাঁচ-পাঁচ দিনের উপোস-ভাঙা এমন রাক্ষুসে খিদে ঘনাদার হল কেন? মাছ-মাংসের মুখ না দেখে কোথায় ছিলেন তিনি এ ক-দিন?

    কোথায় আর?

    পাড়ার জাত গেল বলে যার সম্বন্ধে বাঁকা টিপ্পনি করেছিলেন একদিন, দেশি-বিদেশি, আর দেশির চেয়ে বিদেশিই বেশি, নবীন সাধুদের নতুন গড়ে ওঠা আমাদের পাড়ার সেই পবিত্র হোটেলে, মাছ-মাংসের নয়, পেঁয়াজের গন্ধও যার ত্রিসীমানায় কেউ পায় না, সেখানেই।

    দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে ঘনাদা ওখানে যাবেন কোন দুঃখে?

    নিজেদের মধ্যেই আলাপের ধরনে কথাটা বললেও, প্রশ্নটা যাঁর উদ্দেশে করা, তিনি উত্তর দিলেন আমাদের চমকে।

    গেছলাম আর কেন? ওই রশিদ খাঁকে এড়াতে।

    আমাদের মনের সন্দেহটা আমাদের মুখের ওপর ঘনাদা অমন করে ছুঁড়ে মারবেন, ভাবিনি।

    অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে তাই যতটা পারি, সামলাবার চেষ্টা বললাম, না, না, সে। কী বলছেন!

    রশিদ খাঁ, মানে ওই শালওয়ালা আপনার কত বড় ভক্ত তা তো নিজেদের চোখেই দেখলাম।

    খাঁটি ভক্ত না হলে কেউ অমন দামি মলিদাটা আপনার জন্য জোর করে গচ্ছিত রেখে যায়!

    না, না, আসল কথাটা লুকোবেন না!

    শেষের কাতর অনুরোধটা বিফলে গেল না!

    তিনি যে একটু গলেছেন, গলার স্বরেই তা বুঝতে দিয়ে যেন একটু দ্বিধাভরে বললেন, নেহাত শুনবে তা হলে?

    শুনব না মানে! শিশির তার সিগারেটের টিনটা খুলে সামনে ধরে তার লাইটারটা জ্বালতে জ্বালতে বললে, পাঁচ-পাঁচ দিন আপনি নিরুদ্দেশ। তারপর দেখা যখন পেলাম তখন এই আপনার বেশ! সত্যি কোথায় ছিলেন সেইটেই না জানলে, উদ্বেগে দুর্ভাবনায় গ্যাসট্রিক আলসার হয়ে মারা যাব।

    তা হবে না! শিবুই এবার ফোড়ন কাটল, উনি ছিলেন আমাদের পাড়ায় ওই নতুন গড়ে ওঠা ওই হোলি ইন মানে পবিত্র সরাইখানা।

    সত্যি, ওই হোলি, মানে ওই–ওই নতুন হিপি হোটেলটায়?

    এবার বিমূঢ় বিস্ময়টা আমাদের স্বতঃস্ফূর্ত আর আন্তরিক। জিজ্ঞাসাগুলোও তাই।

    ওখানে থাকবার জন্য এই সাজ নিয়েছিলেন।

    পাঁচ-পাঁচটা দিন ওখানে কাটালেন ওই হিপি-মার্কা সাধুদের সঙ্গে স্রেফ নিবামিষ খেয়ে?

    কিন্তু কেন?

    কেন?—ঘনাদা এই শেষ প্রশ্নটার জবাব দিলেন গাঢ় গম্ভীর স্বরে—শুধু একটা বাক্সের জন্য। নেহাত খুদে একটা বাক্স, পাঁচ ইঞ্চি লম্বা আর তিন ইঞ্চিটাক চওড়া।

    ওই বাক্সটার মধ্যে–কী আছে ও বাক্সে? হিরে মানিক?

    না। ঘনাদা আমাদের মূর্খতায় ধৈর্য ধরে বললেন, আছে অতি সূক্ষ্ম, মানে চুলের চেয়েও অনেক সরু স্ফটিকের সুতোয় বাঁধা একটি ছোট্ট চুম্বক।

    এই! আমাদের হতাশাটা গলায় লকোনো রইল না।

    হ্যাঁ, ওই, ঘনাদা তেমনই ধৈর্যের অবতার হয়ে ধীরে ধীরে বললেন, সমস্ত মানুষ জাতটাই নিশ্চিহ্ন করে দেবার মতো যে সর্বনাশা পরিণাম আমাদের মাথার ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছে, তার কথা আগে থাকতে জানিয়ে দেবার একমাত্র খেলনা বলতে পারো, যা চালাতে বিন্দুমাত্র কোনও শক্তির দরকার হয় না, অমন পঞ্চাশ ষাট একশো বছর পর যা আপনা থেকেই শূন্যাঙ্কের আশি ডিগ্রি নীচে অতি নিম্নতাপেও কাজ করে যেতে পারে। আর সে কাজটা কী জানো?

    নির্বোধ বিস্ময় দেখাবার জন্য অভিনয় করবার দরকার হল না এবার।

    মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে ঘনাদা বোধহয় খুশি হয়েই বললেন, মানুষ জাতের প্রাণভোমরা আমাদের দুনিয়ার যেসব কাণ্ডকারখানার কাটাকুটির ওপর ভাগ্যের জোরে টিকে আছে তারই মাপজোখ কষা, মাপ করা হল ওই খেলনার বাক্সের কাজ। ওর নাম হল ম্যাগনেটো মিটার, আমাদের প্রাণভোমরার একরকম ইলেকট্রোকার্ডিয়োগ্রাম বলতে পারো। কিন্তু এ যন্ত্রের দরকার কী?

    আমরা এবার নীরব নিস্পন্দ।

    ঘনাদা-ই বলে চললেন, আমরা যে কী ভয়ংকর অবস্থায় পৃথিবীতে টিকে আছি তা কজনই বা জানে? এই পৃথিবীর ওপরে আশি থেকে পাঁচশো কিলোমিটার উচ্চতায় আছে মশারির ঢাকনার মতো একটা চৌম্বকমণ্ডল আর একটা আয়নমণ্ডল। এই দুই ঢাকনা না থাকলে কবে পৃথিবীতে আমাদের মতো প্রাণীরা শেষ হয়ে যেত—যেমন গেছল এককালে সেই ডাইনোসরদের বংশ। কেন শেষ হয়ে যেত সেটাই জানা দরকার। আমাদের সৌরজগতের অধীশ্বর হলেন সূর্য। তিনিই প্রাণদাতা, আবার তিনিই মৃত্যুবিধাতা। থেকে থেকে সূর্যের ভেতরে যে সৌরঝটিকা হয় তার কথা নিশ্চয় শুনেছ। সেই সৌরঝটিকায় কল্পনাতীত দ্রুতবেগে উৎসারিত হয় এমন সব তড়িৎকণার প্রবাহ, যার অধিকাংশই আমাদের চৌম্বকমণ্ডলে আর আয়নমণ্ডলে আটকে না গেলে সবংশে আমাদের ধ্বংস করে দিত।

    এই আয়নমণ্ডল আর চৌম্বকমণ্ডলের পরিচয় আমাদের জানা। কিন্তু তাদের অবস্থার হদিস পাবার কোনও উপায় ছিল না। সেই উপায়ই উদ্ভাবিত হয়েছে এই খেলনার বাক্সের মতো যন্ত্রটিতে!

    ইজমেরন-এর নাম বোধহয় শোনোনি। এটি রাশিয়ার আয়ন আর চৌম্বক মণ্ডল নিয়ে গবেষণা করবার একটি কেন্দ্র। সেই ইজমেরন-এর উদ্ভাবিত এই যন্ত্রে বড় ভয়ানক এক ব্যাপার কিছুকাল আগে ধরা পড়েছে। আমাদের আয়নমণ্ডলের কী সব পরিবর্তন হয়ে চৌম্বক-মেরুই সরে যাচ্ছে। খেলনার বাক্সের মতো মাগনেটো মিটার যন্ত্রটা তাই বৈজ্ঞানিকদের কাছে অমূল্য। সেই যন্ত্রই কিছু দিন আগে চুরি গেছে বলে জানা গেল। পৃথিবীর সব দেশে বড় বড় রাজ্যের গোয়েন্দারা যে কীরকম হন্যে হয়ে সেই যন্ত্র আর চোরকে খুঁজছে বুঝতেই পারো। আমার ভাগ্য, সন্ধানটা আমিই পেয়ে গেলাম সর্বপ্রথম। চোর শিরোমণি বুদ্ধিটা ভাল খাটিয়েছিল। এদেশে ওদেশে পাঁচ-তারা সাত-তারা হোটেল নয়, হিপি সাধু সেজে এক নিরামিষ সরাইতে সে গেরুয়া পরা আধা-সাধু হয়ে জায়গা নিয়েছে। মতলব ছিল, গোলমাল একটু থামলেই আসল জিনিস নিয়ে নিজের মুলুকে পাড়ি দেবে। কিন্তু তা আর বাছাধনের হল না।

    তার মানে আপনি তাকে ধরে ফেলেছেন? আমাদের উত্তেজিত জিজ্ঞাসা। এবার ধরে কী করলেন? পুলিশে দিয়েছেন?

    পাগল! ঘনাদা আমাদের সরল নির্বুদ্ধিতায় হাসলেন। অমন একটা ঝানু আন্তর্জাতিক দুশমনকে চিনে গোপনে চোখে চোখে রাখবার সুবিধে হেলায় নষ্ট করে তাকে পুলিশে দিতে পারি! সে বহাল তবিয়তেই ওই পবিত্র সরাইতেই আছে—একটু অবশ্য ভ্যাবাচাকা হয়ে।

    তার যন্ত্রটা তা হলে নিয়ে এসেছেন বুঝি? আমরা উত্তেজিতভাবে জানতে চাই।

    নিয়ে আসব কী? ঘনাদা আবার আমাদের নির্বুদ্ধিতায় হাসলেন। শুধু ফাঁক পেয়ে যন্ত্রটা ভেঙে দিয়ে এসেছি।

    ভেঙে দিয়ে এলেন? ওই অমূল্য আশ্চর্য যন্ত্র? আমরা ব্যথিত, স্তম্ভিত।

    ভেঙেছি তো কী হয়েছে—ঘনাদা নির্বিকার—ইজমেরন ওরকম বা ওর চেয়ে সূক্ষ্ম যন্ত্র ক-দিনেই বানিয়ে ফেলবে। অন্য কারও হাতে ও যন্ত্র যাতে না পড়ে, তাই জন্য ভেঙে দিয়ে আসা।

    কিন্তু—

    যেসব প্রশ্ন এরপর জিজ্ঞাসা করবার ছিল তা আর করা হল না। শিবুর অর্ডার দেওয়া ষোড়শোপচার আমিষ খানা প্লেটের পর প্লেট এখন আসতে শুরু করেছে। ঘনাদাকে এখন মাইক দিয়েও কোনও কিছু শোনানো যাবে না।

    শিবুর বদলে রামভুজ সিংকেই ঘনাদাকে তোয়াজ করে খাওয়াবার ভার দিয়ে শিবু আর শিশিরকে নিয়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলাম।

    বারান্দায় বেরিয়েই তাকে প্রথম প্রশ্ন—আচ্ছা, পরাশর বর্মার ওই ছড়াতেই ঘনাদার সব হদিস পেলি?

    হ্যাঁ, তাই পেলাম। শিবু গর্বভরেই ব্যাখ্যা করলে, পরাশর বর্মার বিচারে হয়তো ভুল হতে পারে। কিন্তু শাল-দোশালার জ্বালা নিরামিষে সারবে থেকেই হিপি সাধুদের পবিত্র সরাইটার স্পষ্ট ইশারা পেলাম। তার পর কুলুপ খোলার চাবি ফিরছে তারই পিছে পিছে থেকে বুঝলাম, ঘনাদা নিজেই প্রকাশ হবার জন্য ছটফট করছেন। ব্যাপারটা হলও তাই। ওই হোলি ইন বা পবিত্র সরাইয়ের কাছ দিয়ে যেতে গিয়ে প্রথমেই দেখা পেলাম ঘনাদার। উনি যেন আমার অপেক্ষাতেই দাঁড়িয়ে আছেন। এমনিতে হাসিখুশিই বলা যায়, কিন্তু পাঁচ-পাঁচ দিন আমিষের স্বাদ না পেয়ে বেশ একটু কাহিল মনে হল!

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }