Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    ০২. সমস্ত ব্যাপারটা আমাদের চোখের ওপর

    সমস্ত ব্যাপারটা আমাদের চোখের ওপর যখন ঘটল, তখন প্রায় কাঁটায় কাঁটায় সকাল সাতটা।

    গাড়ি চলে যাবার পর পল্টুবাবুকে নিয়ে আমাদের একটু ওপরে গিয়ে অপেক্ষা

    করা ছাড়া আর কী করবার আছে।

    ঘনাদা বলেছেন, তাঁকে দু-পা মাত্র পৌঁছে দিতে হবে। তা দু-পা মাত্র যেতে আসতে আর কতক্ষণ!

    কিন্তু সাতটা বেজে সাড়ে সাতটা হল। সাড়ে সাতটা থেকে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছল আটটায়। আটটার পর ন-টা বাজল। বাজল দশটা।

    তবু ঘনাদাকে যথাস্থানে রেখে পল্টুবাবুর গাড়ি ফেরত এল কই?

    ততক্ষণে তিন-তিনবার চায়ের পালা আমাদের শেষ হয়ে গেছে। প্রথমে শুধু পাঁপর ভাজাই ছিল টাকনা, তারপর সেটা পাড়ার দোকানের হিঙের কচুরি থেকে শেষে তেলেভাজা-বেগুনিতে গিয়ে উঠল, তবু গাড়ির দেখা নেই।

    বেগুনি-ফুলুরি তখন আর মুখে রোচে! শিবুর মামাতো ভাই পল্টুবাবুর মুখের দিকে চেয়ে অন্তত নয়। কোনও লাভ নেই জেনেও ওপর থেকে নীচে আর বাহাত্তর নম্বর থেকে বেরিয়ে বনমালি নস্কর লেন ছাড়িয়ে বড় রাস্তা পর্যন্ত এমন বার দুই যাওয়া-আসা করলাম। পল্টুবাবুর গাড়ি তখনও নিপাত্তা।

    দশটা ক্রমে ক্রমে এগারোটা হল। তারপর বারোটা! আরও বার দশেক ওপর-নীচ আর ঘর বার করে, গাড়িটার কোথাও কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে বলেই ধরে নিয়ে আমরা পাড়ার থানায় খোঁজ করতে যাব বলে নামতে যাচ্ছি, এমন সময়ে বনোয়ারি নীচে থেকে খবর দিলে, গাড়ি আওত বানি! অর্থাৎ গাড়ি আসছে।

    সবাই মিলে এর পরে হুড়মুড় করে নীচে নেমে বাইরে গিয়ে দাঁড়ালাম।

    বনোয়ারির খবর ভুল নয়। গাড়ি মানে পল্টুবাবুর গাড়িই আসছে বটে, তবে সেটাকে ঠেলে নিয়ে আসছে রাস্তার ক-জন মজুর।

    কী হয়েছে তা হলে? দারুণ কোনও দুর্ঘটনা? না। গাড়ি সম্পূর্ণ অক্ষত। তা থেকে প্রথমে যিনি নামলেন, সেই ঘনাদাও সম্পূর্ণ তা-ই।

    নেমে এসে বাহাত্তর নম্বরের দেউড়িতে ঢোকবার আগে আমাদের দিকে চেয়ে ঈষৎ যেন দুঃখের সঙ্গে বললেন, একটু দেরি হয়ে গেল, না?

    একটু দেরি হয়ে গেল! সাতটায় দু-পা পৌঁছে দেবার জন্য গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে বেলা বারোটার পরে ফিরে ঘনাদা বলছেন কিনা, একটু দেরি হয়ে গেল!

    বিহ্বল, হতভম্ব তো হয়েই ছিলাম, তার ওপর ঘনাদার এই আত্মধিক্কারের আতিশয্যে অভিভূত হয়ে সবাই যেন বোবা হয়ে গেলাম।

    কথা ঘনাদাই আবার বললেন। যেন হঠাৎ তুচ্ছ একটা কথা মনে পড়ায় আমাদের জানিয়ে দিয়ে বললেন, হ্যাঁ, ওই গাড়ি যারা ঠেলে এনেছে, তাদের মজুরির সঙ্গে কিছু কিছু বকশিশও দিয়ে দিয়ো। কমখানি তো নয়, প্রায় মাইল দুয়েক ঠেলে আনছে।

    প্রায় মাইল দুয়েক ঠেলে আনছে! এবার একসঙ্গে হঠাৎ সলতে ধরে-ওঠা বোমার মতো আমরা ফেটে পড়লাম।

    ঠেলে আনছে কেন? জিজ্ঞাসা করলে শিবু।

    গাড়ির কি কোনও অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে কিছু? জানতে চাইলাম আমি।

    ইঞ্জিন কি কলকবজা কিছু বিগড়েছে? কড়া গলায় জেরা করল গৌর।

    না, না, কলকবজা বেগড়াবে কী! ঘনাদা যেন পল্টুবাবুর গাড়ির অপমানে ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, দস্তুরমতো ভাল নিখুঁত নতুন গাড়ি।

    তবে? শিশিরের মাত্র একটি শব্দের তীক্ষ্ণ প্রশ্ন।

    তবে আর কী! ঘনাদা আমাদের বুদ্ধির স্থূলতাতেই যেন হতাশ হয়ে বললেন, গাড়িতে তেল ছিল না, তাই।

    তেল ছিল না!

    আর্তনাদটা এবার আমাদের নয়, পল্টুবাবুর গলা দিয়ে বার হল, আমি যে এখানে। আসবার আগে নিজে দাঁড়িয়ে ট্যাঙ্ক ভর্তি করে তেল এনেছি। ট্যাঙ্কে কোথাও কোনও ফুটো—

    পল্টুবাবুকে কথার মাঝখানেই থামিয়ে ঘনাদা আশ্বাস দিয়ে বললেন, ট্যাঙ্ক ফুটো-টুটো কেন হবে! পুরো ট্যাঙ্ক-ভর্তি তেলই ছিল। সবটা অমন ফেরবার আগেই ফুরিয়ে যাবে সেইটে ঠিক বুঝতে পারিনি।

    নীচের সিঁড়ি দিয়ে তখন আমরা দোতলার বারান্দায় এসে পৌঁছেছি। ঘনাদার সরল বিনীত স্বীকারোক্তিটুকুর পর কয়েক সেকেন্ড রীতিমত হতবাক হয়ে থাকবার পর নিজেদের আর সামলানো সম্ভব হল না।

    তার মানে, শিশির প্রায় চিড়বিড়িয়ে উঠে বলে, ওই ট্যাঙ্ক-ভর্তি তেল সব আপনি খরচ করে এসেছেন?

    এই আজকের দিনে তেলের জন্য যখন সারা দুনিয়ায় হাহাকার পড়ে গেছে!

    এক ফোঁটা তেলের জন্য যখন দেশে দেশে গলাগলির বন্ধুত্ব গলাটেপাটেপিতে পৌঁছে যাচ্ছে।

    আপনি কি জানেন না যে, তেলের দাম দিন দিন ঘণ্টায় ঘণ্টায় নয়, মিনিটে মিনিটে কীভাবে বাড়ছে! আর আজকের পৃথিবীতে তেলের বাদশা আরবেরা হঠাৎ তেলের বাজারের চাবিকাঠিটি নিজেদের হাতে নেবার পর সারা দুনিয়ার কীভাবে টনক নড়েছে!

    হিসেব করতে বসে কেন সবাই মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছে জানেন? জানেন যে, আরবরা হাতের মুঠো খুলুক বা না খুলুক, দুনিয়ার ভবিষ্যৎ পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে আসতে আর দেরি নেই!

    এই পর্যন্ত বলতে বলতেই টঙের ঘরের ন্যাড়া সিঁড়ির তলা পর্যন্ত আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। আমাদের জবরদস্ত ঘেরাওয়ের ধরনে সিঁড়ির দিকটা আটকানো বলে ঘনাদাকে এবার আড্ডাঘরেই ঢুকতে হয়েছে।

    সেখানে ঢুকেও অবশ্য নিস্তার পাননি। এ-বিবরণ যা দিয়ে শুরু করেছি সেই সব বাক্যবাণ তাঁর ওপর তখন নির্মমভাবে ছোড়া হয়েছে। একজন থামতে-না-থামতে

    আর-একজন শুরু করে। এক মুহূর্তের সামলাবার ফাঁক তাঁকে দেওয়া হয়নি।

    শিশির কয়লার আসন্ন চরম দুর্ভিক্ষের বিভীষিকার কথাটা শুনিয়ে দেবার পরেই গৌর একেবারে সর্বনাশা ছবিটা অঙ্কের হিসেবে এঁকে দিয়েছে। এ সব হিসেবে সে এমনিতেই একটু পাকা। তার ওপর ঘনাদার জন্য সারা সকাল অপেক্ষা করায় অধৈর্য আর যন্ত্রণার মধ্যে নানা কাগজপত্র এই জন্যই সে হাঁটকাচ্ছিল নিশ্চয়।

    আপনি যা করেছেন,গলা থেকে যেন আগুনের হলকা বার করে গৌর বলেছে, তা আজকের দিনে রীতিমত একটা সামাজিক অপরাধ, তা জানেন! মরুভূমির যাত্রী হয়ে খুশির খেয়ালে তেষ্টার জল নষ্ট করা যা, এও তা-ই।

    গৌরের আক্রমণের তোড়ের সামনে দাঁড়াতে না-পেরে ঘনাদা তাঁর অত সম্মানের আর শখের কেদারায় এবার যেন অসহায়ভাবে বসে পড়েছেন।

    গৌর তাতে থামেনি। নির্মমভাবে বলে গিয়েছে, দুনিয়ার সত্যিকার অবস্থাটা কী, তা আপনার জানা আছে? তেল আর মাত্র পাঁচশো পঁয়তাল্লিশ বিলিয়ন ব্যারেল, আর মাত্র ছশো বিলিয়ন টন কয়লা পৃথিবীর এখন সম্বল!

    হ্যাঁ, বেশ একটু অপরাধীর মতো স্বীকার করেছেন ঘনাদা, তেল তো আছে। মাত্র তিন হাজার সাতশো চল্লিশ বি-টি-ইউ! এম-বি-ডি-ও-ই যা বাড়ছে, বছর দশেকের মধ্যেই তা দুশো ছাড়িয়ে যাবে!

    বি-টি-ইউ! এম-বি-ডি-ও-ই! এ সব কী বলছেন ঘনাদা! অন্য সময় হলে এরকম দুটো বুকনিতেই বেশ কাত হয়ে পড়তাম সবাই। কিন্তু আজ মেজাজ যে পর্দায় বাঁধা, তাতে এ সব ভড়কিতে আর আমরা তোলবার পাত্র নই।

    তাই, গলাটা আরও কড়া করে, প্রায় ধমক দিয়েই উঠলাম, রাখুন আপনার ওসব গুল-টুল!

    তারপর পল্টুবাবুকে দেখিয়ে বললাম, দুনিয়ার হিসেব ছেড়ে দিয়ে এই ভদ্রলোকের কথা একটু ভেবে দেখেছেন? ভদ্রলোক নিজে থেকে খাতির করে আপনাকে তাঁর গাড়িটা চড়তে দিলেন। ভদ্রলোকের নিজের গাড়ি নয়, তাঁর কোম্পানির খরিদ্দারদের দেখাবার জন্য তিনি সেটা এখানে-সেখানে নিয়ে যান! সেই গাড়ি তাঁর পিসতুতো ভাই শিবুকে আর সেই সঙ্গে আমাদের একটু দেখাবার আর চড়াবার জন্য তিনি তেলের এই আকালের দিনে ট্যাঙ্ক-ভর্তি করে এনেছিলেন। আপনার অনুরোধে দু-পা যাবার জন্য আপনাকে সে-গাড়ি উনি একটু চড়তে দিয়েছিলেন মাত্র। আপনি-আপনি সেই গাড়ি নিজের খুশি মতো পুরো পাঁচ ঘণ্টা কোথায় না কোথায় চালিয়ে সমস্ত তেল খরচ করে শেষে রাস্তার লোক দিয়ে ঠেলিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে এলেন! ভদ্রলোকের ওপর কী অন্যায় যে করছেন, সে কথা একবার মনে হল না!

    প্রসিকিউশনটা ভালই করেছি নিশ্চয়। অন্যেরা একটু উসখুস করলেও ঘনাদা সারাক্ষণ একেবারে চুপ। আমরা কথা শেষ হবার পর বেশ একটু যেন শুকনো গলাতেই বললেন, না, পল্টুবাবুর ওপর খুবই অন্যায় অত্যাচার হয়েছে, ট্যাঙ্কে গ্যালন কুড়ি তেল ছিল নিশ্চয়!

    না, না, কুড়ি নয়, পল্টুবাবু বিনীতভাবে জানালেন, আটন গ্যালনের বেশি নয়।

    ও একই কথা! ঘনাদা নিজের অপরাধের গ্লানিতেই বোধহয় উদার না হয়ে পারলেন না, আটন গ্যালন তো আর কম তেল নয়, বিশেষ আজকের বাজারে। এ-লোকসান আপনার হবে কেন? দাঁড়ান, দাঁড়ান।

    আমরা এবার বেশ একটু হতভম্ব।

    ঘনাদা বলছেন কী? আর জামার এ-পকেট ও-পকেট হাতড়ে খুঁজছেনই বা কী? ভাবখানা তো পকেট থেকে বার করে তখুনি যেন নগদানগদি পল্টুবাবুর তেলের দামটা দিয়ে ফেলে সব ঝামেলা চুকিয়ে দেবার মতো। কিন্তু পকেটে ওঁর বকেয়া সেলাই ছাড়া আর কিছু কখনও থাকে না। আজ তা হলে এত খোঁজাখুঁজি কীসের?

    খোঁজাখুঁজিতে কিছু অবশ্য পাওয়া গেল না। ঘনাদা কিন্তু তাতে যেন বেশ একটু বিস্মিত হয়ে বললেন, না, কোথায় যে ফেললাম! তেল ফুরিয়ে যাবার ওই ঝামেলার মধ্যেই কোথায় পড়ে গেছে বোধহয়! এখন একটা সাদা কাগজ দিতে পারো?

    হাসব, না জ্বলে উঠব, তখন আমরা বুঝতে পারছি না। কাগজ খুঁজে নিয়ে ঘনাদার হাতে দেবার মতো অবস্থা সুতরাং আমাদের তখন নয়। তবে আমাদের আগেই পল্টুবাবু তাঁর পকেট থেকে নোটবই বার করে তার একটা পাতা ছিঁড়ে ঘনাদাকে এগিয়ে দিলেন।

    ততক্ষণে আমাদের মুখে কথা ফুটল, কী খুঁজছিলেন আপনি, ঘনাদা? কী হারিয়েছে? টাকা?

    না, না, টাকা নয়! ঘনাদা যেন টাকার কথায় অপমান বোধ করে বললেন, হারিয়েছে দুব্যারির সই করা ছাপা কাগজের ছোট একটা খাতা। যাক, এতেই হবে।

    ঘনাদা কলমটাও পল্টুবাবুর কাছে ধার নিয়ে খসখস করে কী লিখে কাগজটা আর কলমটা পল্টুবাবুকে ফিরিয়ে দিয়ে একটু স্নেহের হাসি টেনে বললেন, যত্ন করে রেখে দেবেন?

    যত্ন করে রেখে দেওয়ার মতো কাগজের চিরকুটটা এবার হুমড়ি খেয়ে পড়ে পল্টুবাবুর হাত থেকে টেনে নিয়ে দেখতেই হল।

    দেখে সত্যিই মাথায় চরকিপাক!

    কাগজটার ওপরের ক-টা অক্ষরের নীচে ঘনাদার একটা সই। ঘনাদার সইটাকে বোঝা মহেঞ্জোদরোলিপির পাঠোদ্ধারের চেয়ে শক্ত হতে পারে, কিন্তু তার ওপর তাঁর অদ্বিতীয় হস্তাক্ষরে এসব তিনি কী লিখেছেন? লেখাগুলোর ছিরি যাই হোক সেগুলো পড়া যায়।

    ঘনাদা ওপরে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে ই-ইউ-ডব্লিউ-সি লিখে তার নীচে লিখেছেন পাঁচ এম-বি-ডি-ও-ই এক বছর।

    এম-বি-ডি-ও-ই শব্দটা তাঁর মুখে খানিক আগেই শুনেছি, ই-ইউ-ডব্লিউ-সি-টা নতুন। কিন্তু কী মানে এই হিং-টিং-ছটের?

    ঘনাদা কি ভেবেছেন, এই বুজরুকি দিয়েই আজ আমাদের কাত করে দিয়ে যাবেন? আজ আর সেটি হচ্ছে না। নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে নিয়ে

    অবরোধটা একটু নরম করেই শুরু করলাম।

    বললাম, এই চিরকুটটা পল্টুবাবুকে রেখে দিতে বলছেন যত্ন করে? এতে তাঁর আট-ন গ্যালনের শোক তিনি ভুলতে পারবেন? তাঁর সব লোকসান পুষিয়ে যাবে?

    তা যাবে বইকী! ঘনাদা যেন আমাদের সরল বিশ্বাসের অভাবে বেশ ক্ষগ্ন হয়ে বললেন, অনেক অনেক গুণ যাতে পুষিয়ে যায়, সেইমতই লিখে দিয়েছি।

    আপনার অশেষ দয়া! আমাদের গলায় এবার স্টেনলেস স্টিল ব্লেডের ধার, তা পল্টুবাবুর সব লোকসান ওই চিরকুটেই পুষিয়ে যাবে কেমন করে, তা একটু জানতে পারি? হিজিবিজি কী সাপের মন্তর লিখেছেন ওই চিরকুটে?

    সাপের মন্তরও নয়, হিজিবিজিও না! ঘনাদা যেন ধৈর্যের অবতার হয়ে উঠেছেন হঠাৎ, লেখাগুলো পড়তে পারোনি বুঝি?

    না, পেরেছি! অসাধ্যসাধনের গর্ব নিয়েই বললাম, অক্ষরগুলো ইংরেজিতেই লিখতে চেয়েছিলেন মনে হচ্ছে! কিন্তু মানে কী ওই ই-ইউ-ডব্লিউ-সি আর এম-বি-ডি-ও-ই-র? ও কোথাকার হিং-টিং-ছট?

    হিং-টিং-ছট নয়, শুধু ক-টা আদ্যক্ষর, গভীর সহানুভূতি দেখালেন ঘনাদা, তবে তোমাদের কাছে অক্ষরগুলো ধাঁধার মতোই লাগবার কথা। ওই ই-ইউ-ডব্লিউ-সি-র মানে এনার্জি আনলিমিটেড ওয়ার্লড কার্টেল। অর্থাৎ অফুরন্ত শক্তির বিশ্বসঙ্ঘ। এ নামটা নতুন সাজানো। তবে এম-বি-ডি-ও-ই শক্তি বিজ্ঞানীদের মহলে পুরনো আধুলির মতো সর্বত্র চালু। অক্ষরগুলোর জট ছাড়ালে কথাটা দাঁড়ায়, মিলিয়ন ব্যারেলস ডেইলি অফ অয়েল ইকুইভ্যালেন্ট। মানে, প্রতিদিন দশ লক্ষ পিপে তেল বা তারই সমান কাজ দেবার মতো যে-কোনও বদলি বস্তুর জোগান!

    কী বললেন? আমাদের গলাগুলো একটু ধরাধরা। প্রতিদিন দশ লক্ষ পিপে তেল বা তার বদলি কিছু জোগান দেওয়া! এই এত জোগান দিচ্ছে কে?

    দিচ্ছি আমরাই, ঘনাদা দুঃখের সঙ্গে জানালেন, উনিশশো তিয়াত্তরে আরবরা তেলের দাম আকাশে তুলে দিয়েছে। হাহাকার পড়ে গেছে চারদিকে, তা সত্ত্বেও রুশ দেশ ছাড়াই বাকি দুনিয়া দিনে একাশিরও বেশি এম-বি-ডি-ও-ই খরচ করছে। ওদের পণ্ডিতরা বলছে, বছর কুড়ি বাদে ওই একাশি দুশোয় পৌঁছবে।

    কাজটা ওদের খুব অন্যায় তো তা হলে? আমরা সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।

    তেলের দিক দিয়ে ওদের যা ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা, তাতে অন্যায় বইকী। বলে সায় দিলেন ঘনাদা।

    আর সেই মওকাতেই তাঁকে চেপে ধরলাম। তাঁরই চিরকুটটা তাঁর দিকে এগিয়ে। দিয়ে বললাম, কিন্তু এটা আপনি কী লিখে দিয়েছেন পল্টুবাবুকে? এটা তো তেলের হ্যান্ডনোট বলেই মনে হচ্ছে। পল্টুবাবুকে এক বছর প্রতিদিন পাঁচ এম-বি-ডি-ও-ই দেওয়া হবে, সেইরকমই কি এতে লেখা না? না আমাদের ভুলই হয়েছে পড়তে?

    এবার ঘনাদাকে যে মোক্ষম প্যাঁচে ফেলেছি তাতে নির্ঘাত কুপোকাত! তাঁর নিজের হাতে সদ্য লিখে দেওয়া চিরকুট! এ ফাঁদ থেকে বার হবেন কী করে? নিজের হাতের লেখা আর মুখের ব্যাখ্যা হটজলদি বদলে দেবার চেষ্টা করবেন? তা হলে ফাঁস টানব আরও জম্পেশ করে? অবস্থাটা কত বেগতিক, তা বুঝেই বোধহয় ঘনাদা সেদিক দিয়েই গেলেন না। চিরকুটের লেখাটার মানে বদলে দেবার চেষ্টা না করে একেবারে উলটো সুর ধরলেন।

    আমাদের সন্দেহেই যেন অবাক হয়ে বললেন, পড়তে ভুল হবে কেন? ঠিকই পড়েছ। আর তেলের হ্যান্ডনোট ধরে নিয়ে ও চিরকুটের কড়ারের বহর দেখে যদি অবাক হয়ে থাকে, তা হলে জেনে রাখো যে, ও হ্যান্ডনোট জেনেশুনে বুঝেসুঝেই লিখেছি। সত্যি কথা বলতে গেলে পল্টুবাবুর ঋণ ওতেও পুরো শোধ হবে না।

    তাই নাকি! আমরা গলার সুরটা যথাসম্ভব সরল রেখেই বললাম, ওই আট-ন গ্যালনের ঋণ?

    হ্যাঁ, ওই আইন গ্যালন! ঘনাদা একেবারে গদগদ হলেন, ওই আট-ন গ্যালন আর পল্টুবাবুর গাড়িটা না থাকলে ই-ইউ-ডব্লিউ-সি নামটাই হয়তো পৃথিবীতে অজানা থেকে যেত। তার জায়গায় এস-এস-পি-এস-এর মালিকদেরই আমরা গোলামি করতাম সারা দুনিয়ায়। এত বড় উপকারের জন্যে দিনে পাঁচ এম-বি-ডি-ও-ই লিখে দেওয়া কি বেশি কিছু হয়েছে?

    এস-এস-পি-এস, এম-বি-ডি-ও-ই, ই-ইউ-ডব্লিউ-সি। তার মানে বেড়াজাল কেটে বেরোবার রাস্তা না পেয়ে ঘনাদা ওই সব আবোলতাবোল প্রলাপ বকে আমাদের মাথায় ঘোর লাগাবার চেষ্টা করছেন। উঁহুঁ, সেটি আর হচ্ছে না।

    বললাম, বেশ কাজের মতো কাজই করেছেন। কিন্তু এত যে সব ভেল্কিবাজি হয়ে গেল, সবই তো সাতসকালে পল্টুবাবুর আটন গ্যালন তেল ভরে আনা গাড়িটির জন্যে। সেটি আজ আপনার হাতে না পড়লে দুনিয়ার মস্ত লোকসান হয়ে যেত তা হলে?

    হ্যাঁ, হত। ঘনাদা এতক্ষণের মধুর ভাব ছেড়ে হঠাৎ যেন গর্জন করে উঠলেন, ও গাড়িতে চড়ে না বেরুলে গড়িয়াহাটের মোড়ের ওই বিশ্রী ট্রাফিক জ্যামে পড়তাম না। সেই ট্রাফিক জ্যামে না পড়লে পাশের জানলা-ভোলা একটা বিদেশি সেভান-এর ভেতর থেকে ক-টা কথা কানে গিয়ে চমকে উঠতাম না। তারপর সেই গাড়ির পেছনে ধাওয়া করে অর্ধেক কলকাতা ঘুরে শেষ পর্যন্ত এয়ারপোর্ট হোটেলে গিয়ে আসল পালের গোদার দেখা পেতাম না। আর তার দেখা তখন না পেলে এতক্ষণে ব্যাংককের পথে মালয়ের ওপর একটা অপ্রত্যাশিত বিমান দুর্ঘটনার খবর নিশ্চয়ই বেতারে ছড়িয়ে পড়ত। যাক, এর বেশি আর কিছু বলার নেই এখন। বারোটা বেজে গেছে। এখন ওঠাই ভাল।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }