Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    কাদা

    ঘনাদা দরজাটা ঠেললেন, বেশ একটু অবাক হয়েই ঠেললেন। বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের বাইরের দরজা তো হাট করে খোলাই থাকে দিনরাত। সেটা এমন বন্ধ থাকার কথা তো ভাবাই যায় না।

    সবে তো সন্ধে পার হয়ে রাতের প্রথম প্রহর। এমন সময় দরজা এভাবে বন্ধ কেন?

    বন্ধ নয়, ভেজানো। ঘনাদা জোরে একটু ঠেলা দিতেই পাল্লা দুটো বেশ একটু যেন ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়ে খুলে গেল। বহুকাল তাদের শান্তিভঙ্গ তো কেউ করেনি। মরচে ধরা কবজাগুলোতে তাই ওই আপত্তির গোঙানি।

    দরজা খুলে যাওয়ায় ঘনাদা যেটুকু আশ্বস্ত হয়েছিলেন, পুরনো আমলের খিলেন দেওয়া দেউড়ি পার হয়ে ভেতরে ঢুকে তা আর থাকতে পারলেন না।

    বুকটা একটু কি হঠাৎ ছ্যাঁৎ করে উঠল?

    তা তো করতেই পারে। ভেতরে যে কোনও সাড়া শব্দ নেই। শুধু কি তাই! নীচের রান্না ভাঁড়ার খাবার ঘরের মহল একেবারে অন্ধকার। কারেন্ট ফেল যদি করে থাকে তাহলে হ্যারিকেন লণ্ঠনটা তত জ্বলবে! রামভুজ সে বিষয়ে দারুণ হুঁশিয়ার। ইলেকট্রিক সাপ্লাই-এর ওপর পুরোপুরি ভরসা সে রাখে না। একটা নয়, দুটো লণ্ঠন তার সন্ধে থেকে তেলভরা পলতে কাটা হয়ে মজুত থাকে।

    সে লণ্ঠনের হল কী? রামভুজই বা কোথায়? রান্নাঘরে তো মানুষজন কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না!

    ঘনাদা একটু দাঁড়িয়ে পড়ে কী যেন ভাবলেন। এ অবস্থায় কী করা উচিত, ভাবনাটা নিশ্চয় তাই। রান্নাঘরটা একবার দেখে আসতে যাবেন, না সোজা ওপরেই উঠবেন, মেসের সকলের খোঁজে?

    দুটোর কোনওটাই না করে ঘনাদা উঠোনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ হাঁক পাড়লেন। হাঁকটা ঠিক হুংকার বলে মনে হল না, কেমন একটা করুণ আর্তনাদের সুর তার সঙ্গে যেন মেশানো।

    হাঁকটা কয়েকজনের নাম ধরে, শিশির! গৌর! সুধীর!

    স্তব্ধ অন্ধকার বাড়িটায় সে হাঁক একটা যেন বিশ্রী প্রতিধ্বনি তুলে মিলিয়ে গেল।

    কোনও জবাব এল না কোথাও থেকে!

    বাড়িতে কেউ নেই নাকি, কিন্তু তা কি সম্ভব? বাহাত্তর নম্বর ছেড়ে নীচে-ওপরে সবাই হঠাৎ এক সঙ্গে উধাও হয়ে গেছে? কোথায়? কেন?

    শিশির! গৌর! ঘনাদার এবারের ডাক বেশ একটু কাঁপতে কাঁপতেই উঠল। স্বরটাও কেমন দুর্বল।

    ঘনাদা তারপর আর উত্তরের অপেক্ষা করলেন না।

    যেভাবে ভেতরের উঠোন থেকে ছুটে বাইরের দরজায় প্রায় হুমড়ি খেয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন, তাকে পড়ি-কি-মরি বললে অতিশয়োক্তি বোধহয় হয় না।

    এ কী! ঘনাদা, আপনি?

    শিশির ডানদিক থেকে বেরিয়ে এসে একেবারে যেন তাজ্জব!

    ছুটে যেন পালিয়ে এলেন?

    বাঁদিক থেকে এসে শিবুর সবিস্ময় জিজ্ঞাসা।

    হ্যাঁ, এখনও তো হাঁফাচ্ছেন!

    সামনে থেকে এসে আমার অস্বস্তিকর মন্তব্য।

    ভয় পেয়েছেন মনে হচ্ছে?

    একেবারে পেছনের অন্ধকার দরজা দিয়েই বেরিয়ে এসে গৌরের চমকে দেওয়া সরব সন্দিগ্ধ অনুমান।

    কী করলেন এবার ঘনাদা? কী আর করবেন? একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়েও পিছলে বেরিয়ে যাবার কোনও ফাঁক তো আর রাখা হয়নি।

    যাকে সত্যকার রাম-জব্দ বলে, তাই হয়ে একেবারে অধোবদন আর তোতলা।

    ঘনাদার যে অবস্থা, দেখলে সত্যি মায়া হয়।

    রোজ কত কী ঘটে যাহা-তাহা,
    এমন কেন সত্যি হয় না, আহা!

    সত্যি তো আর নয়, কল্পনা—ঘনাদাকে জব্দ করার কল্পনা। কিন্তু ওই কল্পনাই থেকে গেছে। বাস্তব হতে ওরা দিলে কই?

    ফন্দিটা কিছু কি খারাপ এঁটেছিলাম? একেবারে যাকে বলে অব্যর্থ প্যাঁচ। ভেস্তে যাবার একটা ফুটোও রাখিনি।

    ঘনাদাকে তাঁর সন্ধেবেলার সরোবরসভা সেরে ফিরতেই হবে। তাঁর ফেরাও একেবারে নিয়মমাফিক, প্রায় ঘড়ি-ধরা, সাড়ে সাতটা বড় জোর আটটা। সাবধানের মার নেই বলে আমাদের সাড়ে ছটা থেকে আলো-টালো নিভিয়ে রামভুজ আর বনোয়ারিকে এ বেলার মতো ছুটি দিয়ে বাইরের দরজা ভেজিয়ে সবাই মিলে যে যার ঠিক করা জায়গায় কিছুক্ষণ ঘাঁটি মেরে থাকা! আমরা সবাই বাহাত্তর নম্বরের বাইরে, গৌর একা নিঃসাড়ে ভেতরে। খুব বেশিক্ষণও অপেক্ষা করতে হত না! বাদলার দিন। পঞ্চাশ-পেরুনোদের সরোবর সভা বেশিক্ষণ জমত না। ঘনাদা গুটি গুটি ঘরে ফিরতেন আর তারপর যা ছকেছিলাম তা অক্ষরে অক্ষরে মিলে যেত।

    কিন্তু এমন সুপরামর্শটা কেউ নিলে?

    নিলে যে নিজেদের খাটো হতে হয়! তাই, কী সব আহাম্মকের মতো ওজর!

    সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব! চোরা টিটকিরিটা শিশিরের, বাঃ, চমৎকার ব্যবস্থা। যাবার আগে বিতস-কে শুধু একটু ফোন করে দিলেই হবে।

    শিশিরের গলার আওয়াজের বাঁকা সুরটা ঠিকই ধরেছি। সাড়ে আটানব্বই তখন নিরানব্বই ছাড়িয়েছে। তবু বিতস শুনে একটু ভড়কে যে গেছি তা অস্বীকার করব না।

    ভুরু কুঁচকে হলেও প্রশ্নটা তাই যেন আপনা থেকেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেছে, বিতস? তাকে ফোন কেন? সে আবার কে?

    সে কে-ও নয়, কী -ও না, শিশিরের সে কী চিবিয়ে চিবিয়ে ব্যাখ্যা, সে হল বি-ত-স অর্থাৎ সংক্ষেপে বিশ্ব-তস্কর-সংঘ। সবাই মিলে বাড়ি ছেড়ে গেলে তাদের ফোন না করলে চলে!

    কী রকম লাগে উজবুক-মার্কা এ রসিকতা? বিশেষ অমন একটা পয়লা নম্বরের মাথার কাজ দেখাবার পর? নিরেনব্বই একশোতে ওঠে কি না?

    যা বলতে চেয়েছিলাম তা আর বলার ফুরসত মেলেনি।

    শিশিরের মুখ থেকে কথাটা যেন লুফে নিয়ে শিবু চোখমুখে ভয় ফুটিয়ে বলেছে, ফোন না করলে রক্ষে থাকবে না! পরের দিন-ই কাগজে কাগজে চোখরাঙানো চিঠি বেরিয়ে যাবে না? পেশাগত মৌল অধিকার ক্ষুণ্ণ করার দায় কেন চাপানো হবে

    তার কারণ দর্শাইবার নোটিশ যে আসবে না, তারই বা ঠিক কী? বি-ত-স-এর হালের ইস্তাহারের পাঁচ দফা দাবি দেখেছ তো!

    তা আর দেখিনি! শিবুর খেইটা চটপট ধরে ফেলেছে গৌর, দাবিগুলো তো আমার মুখস্থ।

    আমি তখন একশো দুই! তবু কত বাড় এরা বাড়তে পারে দেখবার জন্য ফাটো-ফাটো বোমা হয়েও গৌরের ফিরিস্তি শুনেছি।

    পাঁচটা দাবি হল, গৌর তখনও বলে চলেছে, চুরির সাজা চলবে না। তালাচাবি বাতিল করো। গেরস্তর ঘুম বাড়াও। খালি বাড়ির খবর দাও। আর চোরেদের ভোট চাই।

    না, আর একটা দাবিও আছে, একশো তিন হয়ে আমি ফেটেছি, আকাট আহাম্মকদের সঙ্গ ছাড়ো!

    সবাই মিলে ধরে না থামালে আসর ছেড়ে আমি উঠেই আসছিলাম।

    আহা, চটেমটে চলেই যাচ্ছিস যে! সবাই মিলে তারপর আমায় তোয়াজ করবার চেষ্টা করেছে, বুদ্ধিটা তুই ভালই বাতলেছিস, তবে কিনা—

    উজবুক-মার্কা রসিকতার চেষ্টা আর হয়নি, কিন্তু একটার পর একটা তবে-কিনার ছররা-তেই আমার অমন ফন্দিটা তারপর ছেতরে গেছে।

    বাইরের দরজা ভেজানো দেখলে ঘনাদা আর তা ঠেলে ঢুকবেন? আমার প্রস্তাবটা প্রথম ফুটো করেছে গৌর!

    যদি বা ঢোকেন, অন্ধকার দেখে আর পা বাড়াবেন? শিবু ছিদ্রটা আরও বড় করে দিয়েছে।

    সবচেয়ে মোক্ষম ফ্যাকড়া তুলে ফন্দিটা একেবারে বাতিল করে দিয়েছে শিশির।

    রামভুজ আর বনোয়ারিকে যে ছুটি দেবে, তারপর রাত্রের ব্যবস্থা কী হবে? হরিমটর?

    আমার পরামর্শটার পোকা বেছে নিজেরা আরও সরেস কিছু বাতলাতে পেরেছে কি?

    তার বেলায় ঢু-ড়ু! সারা বিকেলটা মাথা ঠোকাঠুকি করেও ঘনাদাকে সত্যিকার জব্দ করার একটা মনের মতো প্যাঁচ কেউ বার করতে পারেনি।

    বিকেল গড়িয়ে সন্ধে হয়েছে। সন্ধে পার হয়ে ঘড়ির কাঁটা আটের ঘর ছুঁতে না ছুঁতে মার্কামারা জুতোর আওয়াজ পাওয়া গেছে সিঁড়িতে। ঘনাদা প্রায় মিলিটারি কদমে উঠে আসছেন। নীচের সিঁড়ি থেকে বারান্দা, বারান্দা থেকে টঙের ঘরের সিঁড়ি।

    ঘনাদার পায়ের আওয়াজ কি একটু ঢিমে হবে না আমাদের আড্ডাঘরের দরজার সামনে এসে? মিলিটারি কদমটা একটু মন্থর?

    বৃথা আশা। বাহাত্তর নম্বরে আমাদের দোতলার আড্ডাঘর বলে কিছু আছে ঘনাদা যেন সে খবরই রাখেন না। একেবারে সমান তালে পা ফেলে তিনি তাঁর টঙের ঘরে উঠে গেছেন।

    আমরা মুখ হাঁড়ি করে পরস্পরের দিকে তাকিয়েছি।

    না, এ তাচ্ছিল্যের একটা জুতসই জবাব না দিলেই নয়। ঘনাদাকে একটিবার অন্তত জব্দ না করলে আর মান থাকে না।

    ঘনাদাকে জব্দ করার জন্য এত ছটফটানি কেন?

    কেন হবে না?

    বিনা দোষে ঘনাদা এবারে যা জ্বালা দিয়েছেন আর দিচ্ছেন, তাতে তাঁর দাওয়াই তাঁকেই একটু খাওয়াবার বাসনা কিছু অন্যায়?

    গত বুধবারেই রাজনৈতিক সম্পর্কে চিড় ধরেছে বলা যায়। বৃহস্পতিবার দূতাবাসে তালাচাবি বলে ব্যাপারটা বোঝানো যেতে পারে। তারপর শনিবার সমস্ত রাষ্ট্রীয় সম্পর্ক ছিন্ন। সীমান্তের সব যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ।

    কিন্তু রাজনৈতিক হাওয়া যতই গরম হোক, ঘনাদা রবিবারের দিন অমন একটা বিলো দ্য বেল্ট মানে অধর্মের ঘা দেবেন ভাবতেও পারিনি।

    সকালবেলায় সেজেগুঁজে সবাই তৈরি হয়ে আড্ডাঘরে জমায়েত হয়েছি এমন সময় আমাদের বারান্দা থেকেই ঘনাদার গলা শুনতে পেলাম। তাঁর মার্কামারা পাড়া-জাগানো সুমধুর স্বরে নীচে রামভূজকে ডেকে বলছেন, ভাত নয়, আজ রুটি করবে রামভুজ। ঠিক বারোটায় খাব।

    সবাই একেবারে থ। অন্য কোথাও নয়, ঠিক আমাদের সামনের বারান্দায় এসে নীচের রান্নাঘরে নয়, যেন ওপাড়ার কোথাও কাউকে হেঁকে হুকুম শোনানোটাতেই প্রমাদ গনবার কথা, তার ওপর হুকুমের তাৎপর্য বুঝে একেবারে চক্ষু চড়কগাছ।

    মান অভিমান ভুলে সবাইকে তৎক্ষণাৎ ছুটে যেতে হয়েছে বাইরে।

    বারোটায় খাবেন কি ঘনাদা? তখন কি আমরা এখানে? স্টিমারে প্রায় ডায়মন্ডহারবারে পৌছে যাব না ততক্ষণে?

    কাকে কী বলছি?

    হয় আমরা সব স্বচ্ছ কাচ হয়ে গেছি, নয় ঘনাদা বাংলা ভুলে গেছেন।

    তিনি মুখ ঘুরিয়ে চেয়েছেন, কিন্তু সোজা আমাদের ভেদ করে যেন তাঁর দৃষ্টি অন্যদিকে চলে গেছে। তাতেও আবছাভাবে আমাদের যদি দেখতে পেয়ে থাকেন, আমাদের ভাষা এক বর্ণও যেন বোঝেননি।

    তাঁকে আবার টঙের ঘরের দিকে ঘুরতে দেখে শশব্যস্ত হয়ে পথ আগলে দাঁড়াতে হয়েছে।

    আজ আমাদের স্টিমার পার্টি তা ভুলে গেলেন নাকি ঘনাদা?

    আউটরাম ঘাটে লঞ্চ বাঁধা, এখুনি রওনা হতে হবে!

    না। এবার ঘনাদা অনুগ্রহ করে সরব হয়েছেন, আমার যাওয়া হবে না। যাবার মতো আমার পোশাক নেই। সব নোংরা!

    সামান্য ক-টি কথা, কিন্তু নিউক্লিয়ার বোমার চেয়ে সাংঘাতিক। ঘনাদা সেইটি ছেড়ে সোজা ওপরে উঠে গেছেন। আমরাও হঠাৎ নির্বাক, নিস্পন্দ হয়ে গেছি রোগের আসল গোড়াটা কোথায় তা বুঝে।

    ওই নোংরা পোশাকটাই যত নষ্টের মূল।

    কিন্তু মূলটাই ঘনাদার একেবারে মনগড়া। সত্যি কথা বলতে, আমাদের কারও কোনও অপরাধ নেই। বনোয়ারির একটা সামান্য ভুল থেকে সব গণ্ডগোল শুরু।

    আমাদের সব জামাকাপড় বড় রাস্তার এক ডাইংক্লিনিং-এ ধোয়ানো হয়। নিয়ে যায় বনোয়ারি। সেদিন আমাদের ধুতি-পাঞ্জাবির সঙ্গে কী ভাবে ভুল করে ঘনাদার একটা ফতুয়া ডাইংক্লিনিং-এ চলে গেছে।

    দুপুরের পর বিকেলে সে ফতুয়ার খোঁজ না পেয়ে ঘনাদা যে রকম হুলস্থূল বাধিয়েছেন তাতে মনে হয়েছে লালবাজারকে বাদ দিয়ে মিলিটারি পুলিশকেই তৎক্ষণাৎ না তলব করলে নয়।

    ভয়ে ভয়ে বনোয়ারি এবার স্বীকার করেছে যে, ফতুয়াটা অন্য কাপড়জামার সঙ্গে ডাইংক্লিনিং-এ দিয়ে এসেছে।

    আমার ফতুয়া ডাইংক্লিনিং-এ? ঘনাদা যেন অপমানিত হয়েছেন।

    তাতে দোষটা কী? গৌর বুঝি প্রবোধ দেওয়ারই চেষ্টা করেছে, ময়লা ফতুয়া পরিষ্কার হয়ে আসবে।

    ব্যস, গৌর অজান্তে যা করে ফেলেছে তা আউরে-ওঠা কড়া মাড়িয়ে ফেলারই। শামিল।

    আমার ফতুয়া ময়লা! চড়ার বদলে ঘনাদার গলা খাদে নেমেই আমাদের বেশি সন্ত্রস্ত করে তুলেছে, হ্যাঁ, ময়লা তো নিশ্চয়ই। আমার তো আর ড্রাই ওয়াশিং করা নয়, নেহাত সাবানে কাচা।

    ঘনাদা সেই যে বিগড়েছেন হাজার সাধাসাধিতেও আর সিধে করা যায়নি। কিন্তু অভিমান যত হোক আমাদের অত সাধের স্টিমার পার্টিটা অমন করে ভণ্ডুল করে দেওয়াটা কোনওমতেই ক্ষমা করবার নয়। ঘনাদাকে জব্দ করে কিছুটা শোধ নেবার জন্য তাই এত জল্পনাকল্পনা।

    কিন্তু জল্পনাকল্পনাই সার হত যদি না ভাগ্য অমন আশাতীতভাবে সহায় হত। সাহায্যটাও ভাগ্যের যেন একরকম রসিকতা। তা না হলে পালাটা অমন গোল হয়ে মিলে গিয়ে মুশকিলের যা মূল তাতেই আসানের ব্যবস্থা হবে কেন?

    হপ্তা ঘুরে আবার এক শনিবার। আড্ডাঘরে আমরা জমায়েত হয়েছি সন্ধে থেকেই, কিন্তু আসর জমেনি। অন্য কিছুর অভাবে তাস নিয়ে বসেছি, কিন্তু তিন নো ট্রাম্পের ওপর পাঁচ ক্লাব ডেকে পাঁচশো ডাউন দিয়েও পার্টনার শিশিরের কাছে গালমন্দ দূরে। থাক, একটা ঠাট্টা পর্যন্ত শুনতে হয়নি। অমন একটা মৌ-কা পেয়ে শিবু গৌর ডবল দিতেই ভুলে গেছে। আর শেষ পর্যন্ত রবার হবার জন্যও অপেক্ষা না করে খেলা ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

    শিবু না শিশির কে একবার যেন মোড়ের দোকান থেকে গরম খাস্তা কচুরি আনাবার কথা তুলেছিল। কথাটা উঠেই আবার আমাদের অন্যমনস্কতায় চাপা পড়ে গেছে।

    রাত অবশ্য প্রায় সাড়ে নটা। শনিবার বলে একটু দেরিতে রাত সাড়ে দশটায় খাবার ডাক আসবে। এই একটা ঘণ্টা কাটানোই দায়।

    তবু বনোয়ারি ডাইংক্লিনিং থেকে এ খেপের ধোয়া কাপড়গুলো এনে ফেলায় একটু উত্তেজনার খোরাক জুটেছে।

    ধোয়া জামাকাপড়গুলো মিলিয়ে নিতে নিতে গৌর হঠাৎ বনোয়ারিকে বকুনি দিয়েছে, এ কী এনেছিস! একটু দেখে আনতে পারিসনি? পয়সা দিয়ে ডাইংক্লিনিং-এ পাঠিয়েছি কাদা মাখাবার জন্য?

    গৌরের বকুনিটা একটু অবশ্য মাত্রাছাড়া একটা পাজামার পায়ের দিকে সামান্য একটু যেন দাগ। সেটা সত্যিই কাদার কি না তাও গবেষণাসাপেক্ষ।

    কিন্তু আসরের ঠাণ্ডা হাওয়াটা একটু চমকে তোলবার জন্য যে কোনও ছুতেই তখন সই।

    আমরা সোৎসাহে গৌরের আর্তনাদে পোঁ ধরেছি।

    আরে, পাজামাটার তো একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে!

    অন্য জামাকাপড়গুলোও খুলে দেখা দরকার। কাদা কি আর শুধু একটায় লাগিয়েছে।

    বেছে বেছে ঠিক এই সময়টিতে ভাগ্য তার রসিকতাটি করেছে।

    হঠাৎ ঘরদোর সব অন্ধকার। আমাদের মেন ফিউজ হয়ে গেছে, না পাড়ার কারেন্টই ফেল করেছে বোঝবার জন্য দু-চার সেকেন্ড অপেক্ষা করেছি।

    না, আমাদের বাহাত্তর নম্বর শুধু নয়, পাড়াকে পাড়াই অন্ধকার।

    এ রকম আকস্মিক বিপদের জন্যে শিশির তার ঘরে মোমবাতি রাখে। তাই সেগুলি আনতে যাচ্ছিল। কিন্তু যাওয়া হয়নি।

    গৌর হঠাৎ অন্ধকারেই তাকে ধরে ফেলে চাপা গলায় বলেছে, চুপ! নড়িস না! শুনতে পাচ্ছিস?

    গুনতে তখন সবাই পেয়েছি। আলো নিভে যাওয়ার পর কয়েক সেকেন্ড যেতে যেতে টঙের ঘরের দরজাটা বেশ একটু জোরে খোলার শব্দ পাওয়া গেছে। অর্থাৎ ঘনাদা ঘর থেকে বেরিয়ে সামনের খোলা ছাদে এসে দাঁড়িয়েছেন।

    গৌর চাপা গলায় বনোয়ারিকে বিশেষ নির্দেশ দিয়ে নিঃশব্দে নীচে নেমে যেতে বলেছে। শহরের বিদ্যুৎ শক্তির যদি কোনও দেবতা থাকেন আমরা তাঁর কাছে আকুল নীরব প্রার্থনা জানিয়েছি।

    দেবতা থাকুন বা না থাকুন, প্রার্থনা আমাদের পূর্ণ হয়েছে। পাঁচ-দশ সেকেন্ড করে পুরো দুটি মিনিট পার হয়ে গেছে। সমস্ত পাড়া তখনও অন্ধকার।

    ঘনাদার গলা খাঁকারি শোনা গেছে ছাদের আলসের ধারে। তারপর গলাটা খুব বেশি না তুলে যেন সহজ স্বাভাবিক ডাক—বনোয়ারি!

    কোনও সাড়া নেই কোথাও। থাকবে কী করে? বনোয়ারিকে সেইরকম শিখিয়ে পড়িয়েই পাঠানো হয়েছে রামভুজকে সুদ্ধ সাবধান করে দেবার হুকুম দিয়ে।

    বনোয়ারি! রামভুজ! ঘনাদার গলা ক্রমশ উদারা থেকে মুদারায় উঠেছে। সেই সঙ্গে একটু কেমন কাঁপনও যেন পাওয়া গেছে তার মধ্যে।

    পায়ের শব্দে এবার বোঝা গেছে যে ঘনাদা সিঁড়ির কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন।

    আমাদের রুদ্ধ নিশ্বাসে অপেক্ষা বিফল হয়নি। ঘনাদা এক-পা এক-পা করে সিঁড়ি দিয়ে নামছেন টের পেয়েছি।

    সিঁড়ি থেকে নেমে বারান্দা। বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে আড্ডাঘরের সামনে এসে একটু বুঝি দ্বিধা। তারপর মরিয়া হয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে একটা প্রায় কাতর স্বগতোক্তি—এখানে কেউ নেই নাকি?

    কলকাতা শহরের বিদ্যুৎ-বিধাতা সেদিন অলক্ষ্যে আমাদেরই সঙ্গী হয়েছেন তা কি জানি!

    ঠিক সেই মুহূর্তেই কারেন্ট ফিরে এসে ঘরের আলো জ্বলে উঠল।

    আজ্ঞে, আছি বই কী!

    কথাটা পুরোপুরি তখনও আমরা উচ্চারণ করতে পারিনি আর ঘনাদা আড্ডাঘরের ভেতরে দু-পা মাত্র বাড়িয়ে থমকে দাঁড়িয়েছেন।

    ঘনাদা এবার রাম-জব্দ যাকে বলে তাই নিশ্চয়? পিছলে গলে পালাবার আর কোনও উপায়ই নেই।

    না। স্বয়ং বিদ্যুৎ-বিধাতাকেও হার মানতে হল।

    ঘনাদা এক মুহূর্তের জন্য যদি একটু ভড়কে গিয়ে থাকেন তাহলেও হঠাৎ আলো জ্বলে ওঠায় চোখধাঁধানিতে তা আমরা দেখতে পাইনি।

    যাক, আছ তাহলে!পরের মুহূর্তেই নির্বিকার মুখে মন্তব্যটা করে ঘনাদা যেভাবে সোজা তাঁর মৌরসি কেদারায় গিয়ে বসলেন তাতে মনে হল মাঝখানে যা যা ঘটেছে তা আমাদের ভ্রান্তি!

    হ্যাঁ, তোমাদের ওই ডাইংক্লিনিং-এর ঠিকানাটা কী হে?

    আমরা সবাই হতভম্ব ও নির্বাক। ঘনাদা তাঁর যাকে বলে সংরক্ষিত আরামকেদারায় বসবার পর শিশির আপনা থেকেই অভ্যাস বশে সিগারেটের টিনটা খুলে ফেলেছিল। ঘনাদার এ প্রশ্ন শুনে টিনটা সে এগিয়ে দিতে ভুলে গেল।

    ঘনাদা নিজেই হাত বাড়িয়ে শিশিরের ত্রুটি সংশোধন করতে গোটা টিনটাই তুলে নিয়ে আমাদের হাঁ করা মুখগুলো যেন লক্ষ না করেই আবার বললেন, ওইখানেই

    এখন থেকে সব কাচাব ঠিক করেছি।

    আমাদের মুখে তখনও রা নেই। ঘনাদার হঠাৎ যেন টিপয়ের ওপরে রাখা ধোয়া

    কাপড়গুলোর ওপরে চোখ পড়ল।

    এই বুঝি তোমাদের কলের কাচা কাপড়! ঘনাদা যেন একটু উচ্ছসিতই হলেন, তা ভালই তো কেচেছে!

    ভাল কী বলছেন! এতক্ষণে আমাদের জিভের সাড় ফিরে এল। সেই সঙ্গে ঘনাদাকে এখনও একটু বেকায়দায় ফেলবার আশা।

    একেবারে যাচ্ছেতাই কাচা! শিবু নাক সিঁটকাল।

    কাচা কাপড়গুলোর দিকে চেয়ে ঘনাদার ভুরুটা একটু কোঁচকাল কি? সেই ভ্রুকুটি আরও বাড়িয়ে দেবার চেষ্টায় বললাম, ডাহা ফাঁকিবাজি!

    ঘনাদার চোখ দুটো সন্দেহে একটু যেন ধোঁয়াটে হতেই গৌর তাতে ধুনো চাপাল, দেখছেন না কী রকম কাদা-মাখানো!

    তা আর দেখছি না! ঘনাদা অম্লানবদনে তাঁর আণুবীক্ষণিক চোখের প্রমাণ দিয়ে যা বললেন তাতেই আমরা সত্যিকারের কাত। বললেন, তা একটু-আধটু কাদা তো ভাল।

    কাদা ভাল! কাচা কাপড়ে কাদায় আপনার আপত্তি নেই?

    আপত্তি! বিলক্ষণ! ঘনাদা আমাদের মূর্খতায় যেন ক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, এক ফোঁটা কাদার দাম কী হতে পারে জানো! একটা কাদার ছিটে দিয়ে একটা রাজ্য উদ্ধার করা যায়?

    সে কী রকম কাদা! আর্মস্ট্রং-অ্যালড্রিনের আনা চাঁদের মাটির নাকি? ঘনাদাকে তখনও কাহিল করবার ক্ষীণ আশা নিয়ে খোঁচাটা দিলাম।

    না, চাঁদের নয়, এই আমাদেরই পৃথিবীর। ঘনাদা খোঁচাটা যেন টেরই না পেয়ে বললেন, দক্ষিণ আমেরিকার বান-ডাকানো দু-একটা নদীর আশীর্বাদ বলা যেতে পারে। এক ছিটে সেই কাদা না পেলে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় র‍্যাঞ্চ জলের দরে বিক্রি হয়ে গিয়ে তার মালিক আজ পথের ভিখিরি হত।

    এক ছিটে কাদায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় র‍্যাঞ্চ-এর মুশকিল আসান হয়ে গেল! মন্তর পড়া দৈব কাদা বুঝি? আমরা তখনও সঙ্গিন উঁচিয়ে আছি।

    না, মন্তর পড়া-টড়া দৈব-টৈব কিছু নয়! ঘনাদা ধৈর্যের অবতার হয়ে বুঝিয়ে আর বাগড়া দেবার অবসর দিলেন না। নেহাত সাধারণ কাদা—দৈব নয়, বরং জৈব বলা যেতে পারে। আমার একটা প্যান্টের একটা পায়ে এক ছিটে যে লেগে ছিল তা আমি নিজেই জানতাম না। আর্জেন্টিনা হয়ে তখন পুরনো বন্ধু বেলমন্টোর খোঁজ নিতে ব্রেজিলের মতো গ্রস্সাে অঞ্চলে আরাগুয়াইয়া নদীর দেশে তার র‍্যাঞ্চ-এ গেছি। গোরু ঘোড়ার র‍্যাঞ্চ, কিন্তু ছোটখাটো কিছু নয়। আমাদের গোটা চব্বিশ পরগণা জেলাটা তার র‍্যাঞ্চ-এর এলাকার মধ্যে ধরিয়ে দিয়েও কলকাতা হাওড়া শহর দুটো ঢোকাবার মতো জায়গা কিছু থাকে।

    বেলমন্টো একটু স্বপ্ন-দেখা গোছের মানুষ। ব্রেজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়ারই তখন সবে পরিকল্পনা চলছে। উত্তরের আমাজনের মোহনায় বেলেম বন্দর থেকে দক্ষিণের রাজধানী ব্রাসিলিয়া পর্যন্ত দু-হাজারের ওপর কিলোমিটারের পাহাড়, জঙ্গল, জলা ফুড়ে যাওয়া সড়ক তখন কল্পনারও অতীত। সেই তখনকার দিনেই বেলমন্টো তার পৈতৃক আর নিজের উপার্জন করা সব কিছু দিয়ে জলাজঙ্গলে এই অজানা অঞ্চল কিনে ছিল। তার স্বপ্ন হল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় র‍্যাঞ্চ তৈরি করা, যেখানে এমন গোরু ঘোড়া সে পয়দা করবে পৃথিবীতে যার জুড়ি মিলবে না।

    এই স্বপ্ন সার্থক করার পথে কতদূর সে এগিয়েছে দেখবার জন্যই সেবার পাহাড় জঙ্গল ভেঙে বেশ কষ্ট করে তার র‍্যাঞ্চ-এর মুলুকে গেছলাম।

    রিও আরাগুয়াইয়া মানে আরাগুয়াইয়া নদীর এলোমেলো বিনুনিগুলো যেখানে এসে মিলেছে সেইখানে বেলমন্টোর প্রধান ঘাঁটি। নেহাত একটা সেকেলে প্লেন ভাড়া পেলে সে ঘাঁটি খুঁজে পাওয়া শক্ত হত।

    ঘাঁটিতে পৌঁছেই ভাড়াটে প্লেনটার পাওনা চুকিয়ে বিদেয় করে দিয়েছিলাম। বেলমন্টোর কাছে এসে তো আর দু-চার দিনে চলে যাওয়া যাবে না, সুতরাং মিছিমিছি প্লেনটাকে আটকে রেখে দিনের পর দিন ভাড়া গোনার দরকার কী!

    কিন্তু বেলমন্টোর সঙ্গে দেখা হবার পর অবাক হলাম। এতকালের বন্ধুর এ কী অভ্যর্থনা।

    দেখা হবার পর তার প্রথম প্রশ্ন হল, প্লেনটা ছেড়ে দিলে? না দিলেই পারতে।

    কেন বলো তো! মিছিমিছি প্লেনটা বসিয়ে রেখে ভাড়া গুনতে যাব কেন?

    না। ভাড়া গুনবে কেন? ও প্লেনে-ই ফিরে যেতে পারতে তাড়াতাড়ি।

    আমি হতভম্ব হয়ে খানিক বেলমন্টোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি বেলমন্টোর হল কী! যা হয়েছে এবার ওই তাকিয়ে থাকার দরুনই ভাল করে চোখে পড়ল।

    তার গলার স্বরে প্রথমেই একটা কেমন হতাশ কিছুতে-কিছু-আর-আসে-যায় না গোছের সুর অবশ্য পেয়েছিলাম। সেটাকে গোড়ায় তেমন আমল দিইনি, এখন লক্ষ করে দেখলাম গলার স্বরে যার আভাস মাত্র পেয়েছি, মুখে তার ছাপটা একেবারে গভীরভাবে পড়েছে। তার চোখের কোলে পুরু করে কালি, কপালের চামড়ায় যেন সূক্ষ্ম লাঙল চালানো আর মুখটা শুকিয়ে প্রায় আমসি। ঘূর্তিতে উৎসাহে ঝলমল যে বেলমন্টোকে জানতাম তার হঠাৎ হল কী!

    বেশ দুর্ভাবনা নিয়েই এবার জিজ্ঞাসা করলাম, কী ব্যাপার কী বলো তো, বেলমন্টো? তুমি কি চাও না যে আমি এখানে থাকি!

    বেলমন্টোর মুখে ফ্যাকাশে একটু হাসি দেখা গেল। প্রায় এরা গলায় সে বললে, আমি নিজেই যখন থাকছি না, তখন তোমায় থাকতে বলব কোন মুখে?

    তুমি নিজেই থাকছ না! আমি আরও হতভম্ব—যাচ্ছ কোথায় তোমার এ র‍্যাঞ্চ ছেড়ে?

    এ র‍্যাঞ্চ আমি বিক্রি করে দিচ্ছি! কথাটা যেন বেলমন্টোর বুক চিরে বেরিয়ে এল।

    বিক্রি করে দিচ্ছ? তোমার এত সাধের র‍্যাঞ্চ! কাকে বিক্রি করছ?

    কাকে আর করব! হতাশ সুরে বললে বেলমন্টো, এ জলা জঙ্গলের নরক অমনি দিলেও কেউ নেবে না। আমি তাই ব্রেজিল সরকারের কাছেই আবেদন জানিয়েছি। গতকাল তাদের জবাব এসেছে।

    বেলমন্টো তারপর ব্রেজিল সরকারের জবাব আমায় দেখাল। সে জবাবে ব্রেজিল সরকার সমস্ত র‍্যাঞ্চ-এর যা দর দিয়েছে তা দেখে আমার তো মেজাজ গরম।

    রেগে বললাম, জায়গা-জমির কথা ছেড়ে দাও, তোমার যে হাজার কয়েক গোরু ঘোড়া আছে তার দামও তো এতে উঠবে না। তবু সবকিছু বেচে পালাবার এ ঝোঁক তোমার কেন?

    কেন তা এখনও যদি না বুঝে থাকো, বেলমন্টো এবার তিক্ত স্বরে বললে, তা হলে সন্ধে হলেই বুঝবে।

    বুঝতে তখনই কিন্তু আমি আরম্ভ করেছি। সন্ধে হবার সঙ্গে সঙ্গে একেবারে মর্মান্তিকভাবে বুঝতে পারলাম।

    রূপকথায় সাতশো রাক্ষুসির হাঁউ মাঁউ খাঁউ করে তেড়ে আসার গল্প আছে। যে বিভীষিকা স্বচক্ষে ও স্বকর্ণে দেখলাম শুনলাম তার তুলনায় সাতশো রাক্ষুসি যেন নিউক্লিয়ার বোমার কাছে পটকা।

    সন্ধে হতে না হতে আকাশ বাতাস যেন আতঙ্কে কাতরে উঠল। সে কী নিদারুণ অদ্ভুত আওয়াজ! বোমারু বিমানের ঝাঁক হানা দেবার সময় বুকের-রক্ত-জমিয়ে-দেওয়া যে গর্জন তোলে তাও বুঝি এ ভুতুড়ে শব্দ-বিভীষিকার চেয়ে ভাল।

    আওয়াজটা কীসের? সন্দিগ্ধ প্রশ্নটা আর চেপে রাখতে পারলাম না, ব্রেজিলের মতো গ্রসো জঙ্গলের কোনও প্রাগৈতিহাসিক জানোয়ারের? দুনিয়ার সেই আদি রাক্ষস টিরানোমোরাস-এর নাতিপুতির?

    না, তার চেয়ে ভয়ংকর কিছুর, ঘনাদা আমাদের হতভম্ব মুখগুলোর ওপর একবার আলতো চোখ বুলিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন, ঘন কালো প্রলয়ের মেঘের মতো সবকিছু ঢেকে-মুছে দেওয়া যোজনের পর যোজন মশার ঝাঁক।

    হাসি চাপতে কাশতে কাশতে যে টিপ্পনিটা সকলেরই গলা পর্যন্ত ঠেলে উঠেছিল

    ঘনাদা আগে থাকতেই তার খোঁচাটা ভোঁতা করে দিয়ে বলল, ভাবছ মশার ঝাঁককে। এত ভয় কীসের? ডি ডি টি কি তখনও আবিষ্কার হয়নি?

    হয়েছে। বেলমন্টোকে সেই কথাই বলেছিলাম। কিন্তু তাতে করুণমুখে সে জানিয়েছিল যে ডি ডি টি-কে ডরাবার মতো মশার জাত এ নয়। বিজ্ঞানের যুগে অনেক পোড়-খাওয়া এ মশার বংশের কাছে ডি ডি টি জলপান। খানায় ডোবায় জলা-জঙ্গলে যে কেরোসিন ঢালা হয় তা এরা শখ করে গায়ে মাখে। এদের ঠেকাতে মশারি ফেলে শুয়ে থাকা যায়, কাজকর্ম চলে না।

    বেলমন্টোর কথা শুনে হায় হায় করে উঠলাম, তারপর তাকে কিছু না বলে ছুটে গেলাম নিজের সঙ্গে আনা সুটকেসটা খুলতে!

    ভাগ্য সত্যিই ভাল। একটা জিনের প্যান্টের পায়ের মোড়া খাঁজে কাদার ছিটেটা পেলাম।

    বেলমন্টো তখন পিছু পিছু এসে হতভম্ব হয়ে আমার কাণ্ডকারখানা দেখছে। বেশ। একটু চিন্তিত হয়ে বললে, আমার এই কবছরে যা হবার উপক্রম, তোমার এক দিনেই তা হল নাকি! মাথা খারাপ হয়ে গেল মশার ডাক শুনে?

    তা যদি হয় তবু তোমার কোনও ভাবনা নেই। বেলমন্টোকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, ব্রেজিল সরকারকে তোমার রাজত্ব বেচা, বেশিদিন না পারো, একটা বছর অন্তত স্থগিত রাখো। আর বর্ষা এলে যা বানে ভাসবে এমন একটা শুকিয়ে আসা খাল-বিল আমায় দেখিয়ে দিয়ো কাল সকালে।

    পাগলের সঙ্গে তর্কে লাভ নেই বলেই বোধ হয় বেলমন্টো পরের দিন সকালে তাই দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল।

    মশারির ভেতর শুলেও সারারাত্রি মশাদের ভয়ংকর অর্কেস্ট্রায় দু-চোখের পাতা এক করতে পারিনি। রাত-জাগা রাঙা চোখে যা আমি করেছি তা দেখে, পাছে বেশি খেপে যাই, এই ভয়েই বোধহয় বেলমন্টো টু শব্দটি করেনি।

    পরের দিন সামান্য কিছু লটবহর নিয়ে বেলমন্টো আমার সঙ্গে তার মোটর লঞ্চে আরাগুইয়া নদী দিয়ে রওনা হল। আমার পাগলামি বাড়লে সামলাতে পারবে কিনা সেই ভাবনায় বেশ একটু ভয়ে ভয়েই গেল বেলেম বন্দর পর্যন্ত সারা পথ।

    ঘনাদা থামলেন।

     

    ব্যস! গল্প শেষ? বিদ্রুপের সুর লাগাবার চেষ্টা করলেও আমাদের আগ্রহটা ঠিক বোধ হয় চাপা দেওয়া গেল না।

    হ্যাঁ, শেষই বলতে পারো। ঘনাদা উদাসীনভাবে বললেন, আমাজনের মোহনায় বেলেম বন্দর থেকে ব্রেজিলের রাজধানী ব্রাসিলিয়া পর্যন্ত এখন পাহাড় জঙ্গল জলা ফুড়ে দু হাজারেরও বেশি কিলোমিটারের সড়ক বেরিয়েছে। ও অঞ্চল তো এখন সোনার দেশ আর বেলমন্টোর র‍্যাঞ্চ দুনিয়ার অদ্বিতীয় বললে ভুল হয় না।

    সব আপনার ওই প্যান্টের পায়ের ভাঁজে পাওয়া এক ছিটে কাদার কেরামতি। আমরা প্রায় চোখ পাকিয়েই জিজ্ঞাসা করলাম, তা দিয়ে করেছিলেন কী?

    শুকনো খাল-বিলে তা একটু গুঁড়ো করে ছড়িয়ে দিয়েছিলাম। ঘনাদার মুখে কোনও ভাবান্তর নেই।

    তাতে হল কী! আমরা অত্যন্ত সন্দিগ্ধ।

    হল সাইনোলেবিয়াস বেলট্টি! ঘনাদা আমাদের দিকে একটু অনুকম্পাভরে তাকালেন।

    কী বললেন!—শিবু প্রায় খাপ্পা ওসব হ-য-ব-র-ল রেখে আসল ব্যাপারটা কী হল তাই বলুন।

    সাইনোলেবিয়াস বেলট্টি ছাড়া আর আসল ব্যাপার তো বোঝানো যাবে না। ঘনাদা যেন দুঃখের সঙ্গে জানালেন, তবু নামটা বাদ দিয়েই বলছি! আমরা চলে যাবার কয়েক হপ্তা পরে ওদেশের যেমন দস্তুর তেমনই তুমুল বর্ষা নামল, বান ডাকল নদীতে। ওই শুকনো কাদার গুঁড়ো জল লেগে ভিজে তার আধঘণ্টার মধ্যে ভেলকি লাগিয়ে দিলে, দিনে দিনে শ থেকে হাজার, হাজার থেকে লাখে লাখ মশার যম হয়ে উঠে। এক বছর পেরিয়ে দু বছর পুরো না হতে হতে ওঅঞ্চলে মশার ডাক গল্প কথা হয়ে দাঁড়াল।

    ওই বেলট্টি না কী তাহলে কাদার গুঁড়ো, মানে ধুলো-পড়া ফুসমন্তর?—একটু বাঁকা হাসি হাসবার চেষ্টা করলে গৌর-এতক্ষণ তা বলতে হয়! ঝাড়ফুঁকে মশার বংশ নির্বংশ করলেন!

    না, ঝাড়ফুঁক নয়। ঘনাদা ধৈর্যের অবতার হয়ে বোঝালেন, সাইনোলেবিয়াস বেলট্টি হল একরকম খুদে মাছ, দেখতে কতকটা আমাদের খলসের মতো। ওদেশে একটা ডাকনাম আছে মুক্তোমাছ বলে। আর্জেন্টিনার বান-ঢাকা নদী যখন মাঠ বন ভাসায় তখন এই মুক্তোমাছ ঝাঁকে ঝাঁকে সেই বেনো জলে জন্মায় আর ডিম ফুটে বেরিয়েই মশার শূক মানে প্রায় বাচ্চা পোকা ধ্বংস করতে শুরু করে। পরীক্ষিৎ রাজা সর্পমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, আর এ মুক্তোমাছের জীবনের ব্রত হল যেন মশকমেধ। একটা মাছ একই দিনে পঞ্চাশটা অন্তত মশার বাচ্চা সাবাড় করে। ডিম ফুটে বার হবার তিন হপ্তা বাদেই মাদি মুক্তোমাছের নিজেরই ডিম পাড়া শুরু হয়। হপ্তায় শ তিনেক ডিম প্রতিটি মুক্তোমাছ পাড়ে। বানের জল নেমে যাবার পর সেসব ডিম মাঠের কাদার মধ্যে তারই সঙ্গে শুকিয়ে জমে থাকে। পরের বছর আবার বানের জলের ছোঁয়া লাগতেই—আধঘণ্টার মধ্যে সে ডিম যেন জেগে উঠে বাচ্চা ফোটায়। এক রত্তি কাদায় দশটা ডিমের ছানা থাকলেই বছর ঘুরতে না ঘুরতে তারা রাবণের গুষ্টি হয়ে ওঠে। বেলমন্টোর কাছে আসবার আগে আর্জেন্টিনার ওই রকম বান-ডাকা ক-টা নদীতে ক-দিন ঘুরেছিলাম। সেখানেই কোথাও ওই কাদার ছিটে প্যান্টে লেগেছিল নিশ্চয়। তা না লাগলে আর সময় মতো সে কথাটা মনে না পড়লে, পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা র‍্যাঞ্চ আজ বিফল স্বপ্ন হয়েই থাকত।

    কাপড়-চোপড় একেবারে নিখুঁত ধোপদুরস্ত রাখার বাতিক সেই থেকে আমার কেটে গেছে।

     

    গল্পের ল্যাজের ওই হুলটুকু আমাদের বেয়াদবির জবাব।

    ঘনাদা সেটা বেশ ভাল করে বিঁধিয়ে, উঠে পড়লেন নীচে খেতে যাবার জন্য। শিশিরের সিগারেটের টিনটা কিন্তু তখন তাঁর হাতে। ভুল করে নয়, এ নেওয়াটা মানহানির খেসারত স্বরূপ।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }