Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প884 Mins Read0

    ০১. প্রথম মহাপ্রলয়ের বন্যা

    প্রলয়পয়োধিজলে ধৃতবানসিবেদং
     বিহিতবহিত্ৰচরিত্রমখেদ…

    প্রথম মহাপ্রলয়ের বন্যায় সমস্ত সৃষ্টিকে যিনি চরম বিলুপ্তি থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই মৎস্যাবতারের যথার্থ পরিচয় বিজ্ঞান কি আজও জানে?

    সেই মৎস্যাবতার স্বয়ং যদি আদি মনুর রক্ষক হন, তা হলে একমাত্র মান্ধাতার টোপই তাঁকে ধরবার যন্ত্র নয় কি?

    কে সেই আদি মংসাবতার? মান্ধাতার টোপের রহস্যই বা কী? এ সব অতল রহস্যের মীমাংসা যথাস্থানে ও যথাসময়ে হবে আশা করে, আর কেউ নয়, স্বয়ং ঘনাদার বিরামহীন আলাপন এবার শোনা যেতে পারে বোধহয়।

    হ্যাঁ, আমাদের সকলকে বিস্মিত বিহ্বল করে তিনি সম্প্রতি দাঁড়ি কমা-ছেদহীন যে ভাষণ দিয়ে চলেছেন, কোনও দিক দিয়ে তার কোনও কূলকিনারা না পেয়ে আমরা সত্যিই দিশেহারা।

    বোঝসোঝার চেষ্টা না করে সেই কলস্বর-প্রবাহে ভেসেই না হয় যাওয়া যাক। ঘনাদা বলে যাচ্ছেন:

    তা আমার কাছে কেন? শার্লক হোমস না হয় নেই, কিন্তু অ্যারকিউল পোয়ারোর কাছে গেলেই তো পারতেন? আর তা-ও না পেরে উঠলে পেরি ম্যাসনকে ভুলে গেলেন কেন?

    বলতে গেলে সারা দুনিয়া তন্নতন্ন করে খুঁজে ভূমধ্যসাগরের এই নিতান্ত খুদে আর তখনকার প্রায় অজানা নির্জন দ্বীপে ভাড়া করা জেলে-নৌকোয় কোনওক্রমে যাঁরা আমার সন্ধান করে এসে নেমেছেন, তাঁদের মুখে প্রথমে কোনও কথাই নেই।

    আমার গলার স্পষ্ট বিরক্তিতে বেশ একটু বেসামাল হয়ে দুই নতুন আগন্তুকের মধ্যে বয়স যাঁর একটু বেশি, সেই রোগাটে চিমসে চেহারার টাকমাথা মানুষটি আমতা-আমতা করে বললেন, আজ্ঞে, দেখুন—মানে—

    আজ্ঞে দেখুন—অর্থাৎ কিনা—মানে-ও সব বুকনি ছেড়ে একটু ঝেড়ে কাশুন দেখি। একটু ধমকে দিয়েই এবার বললাম, ব্যাপার যা বুঝছি, তাতে মনে হচ্ছে হঠাৎ গা-ঢাকা-দেওয়া দুনিয়ার এক সেরা ধাপ্পাবাজকে হন্যে হয়ে আপনারা খুঁজছেন। কিন্তু তাকে খুঁজতে দুনিয়ার সব বাঘা বাঘা ফাটকা বাজার ছেড়ে আমার কাছে কেন?

    তোর কাছে কেন? শোন তবে উচ্চিংড়ে! দুই আগন্তুকের মধ্যে বয়সে যে ছোট, কিংকং-এর ছোট ভাইয়ের মতো চেহারা, সেই দৈত্যটি আমার একটা হাত মুচড়ে ধরে এবার বললে, শোন তবে তেলাপোকাটা, দুনিয়ার টিকটিকি-মহলে মস্ত এক ঝানু ঘুঘু বলে তোর নাকি দারুণ সুনাম! তাই তোকে আমাদের মক্কেলকে এক মাসের মধ্যে খুঁজে বার করবার হুকুম দিতে এসেছি। পারিস যদি তা হলে একটা মেডেলই হয়তো পেয়ে যাবি, আর না পারলে গর্দানটাই দেব মটকে। বুঝলি?

    বাঃ, বাঃ। মনে-মনে তখন আমি যে দারুণ খুশি হয়েছি, তা বোধহয় আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। মৎস্যাবতারের আশায় কবছরের আজব এক তল্লাশির টহলদারিতে কখনও জেলেদের, কখনও সাধারণ ব্যবসায়ীদের ডিঙিতে আর সুলুপে ঘুরতে-ঘুরতে নেহাত নরম নরম মানুষজনের সঙ্গে দিন কাটিয়ে হাত-পাগুলোয় যখন বাত ধরে গেছে, তখন একটু হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারলে যেন বাঁচি।

    কিংকং-এর ছোট ভাই তখন দাঁতে-দাঁত-চাপা গলায় বলে যাচ্ছেন, তা আমাদের কথায় একটু কান দেবেন, না একটার বদলে দুটো কানই মেরামতের জন্য আমরা ছিঁড়ে নিয়ে যাব?

     

    ওপরে যে বাক্যালাপের বিবরণটুকু এ-পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে, তা যে আমাদের এই কলকাতা নগরীর বাহাত্তর নম্বর বনমালি নস্কর লেনের ঠিকানায় একটি নাতিজীর্ণ নাতিনবীন আড়াইতলা বাড়ির একটি বিশেষ আড্ডাঘরে ছাড়া আর কোথাও হতে পারে না, এবং সে-বিবরণদাতা যে স্বয়ং তেতলার টঙের ঘরের তিনি, মানে একমেবাদ্বিতীয় ঘনাদা ছাড়া আর কারও হওয়া সম্ভব নয়, সে কথা বিশদ বুঝিয়ে বলবার প্রয়োজন নিশ্চয় নেই।

    হ্যাঁ, বিবরণ যা শুনছি তা স্বয়ং ঘনাদাই দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, দিচ্ছেন প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে বলা যেতে পারে। দিনের পর দিন সাধনা করে বড় রাস্তার মোড়ের হালুইকরের ক্ষীরের পান্তুয়া লেডিকেনি থেকে শুরু করে চৌরঙ্গিপাড়ার সেরা মোগলাই পরোটা আর মুরগমসল্লমের ঘুষ দিয়ে যাঁকে দিয়ে এক-এক সময় একটা অব্যয় শব্দও বলানো যায় না, সেই ঘনাদার এ কী অবিশ্বাস্য রূপান্তর। আজকের বিকেলের আড্ডাঘরে আর কেউ আসবার আগেই ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ি দিয়ে রেডিয়োর সিগন্যাল টিউনের মতো তাঁর বিদ্যাসাগরি চটির স্বাক্ষর চটপটি ধ্বনি তুলে নিজের মৌরসি কেদারাটি দখল করে সবাই এসে হাজির হবার আগেই একনাগাড়ে সেই যে বলে চলেছেন তার আর বিরাম নেই। বলা মানে একেবারে লাগাতার, যেন এক নিশ্বাসে বলা। আর সে-বলায় থামলে যেন কেউ তাঁকে কোতল করবে, এমনই তাঁর অস্থিরতা।

    কিন্তু বলছেন তিনি কী? আর কী নিয়ে?

    শ্যামবাজারে গল্প শুরু করে হঠাৎ টালা হয়ে একেবারে নিউ আলিপুর গেলেও তবু তার মধ্যে কিছু মানে থাকতে পারে, কিন্তু এ যে জামতাড়া দিয়ে শুরু করে পাজামার কথায় জড়িয়ে পড়ে জামরুল কিনতে ছোটা!

    কত কী-ই না তিনি আমাদের এর মধ্যেই শুনিয়েছেন। এক কথায়, কোথায় না নিয়ে গিয়েছেন!

    আরম্ভই করেছিলেন, নরেশ্বর নামটা শুনে একেবারে নরওয়ের উত্তরে পোলার বিয়ার মানে সাদা ভাল্লুকের জন্য চোখের জল ফেলে।

    থাকবে না, থাকবে না! প্রায় চাপা কান্নার সুরে বলেছিলেন, নরওয়ের ওই কড়া আইন সত্ত্বেও সাদা ভাল্লুক সেখানে কেন, দুনিয়াতেই আর থাকবে না। এখন অবশ্য সারা বছরে গোনাগুনতি কটি মাত্র মারবার অনুমতি দেওয়া হয় শিকারিদের। কিন্তু চোরাশিকারিরা লুকিয়ে লুকিয়ে ছাল পাচারের লোভে আরও কত অমন মেরে শৌখিন মেরু-টহলদারদের খুদে প্লেনে সরিয়ে ফেলছে, কে তার হিসেব রাখে! তাই বলছি, নরওয়ের কথা আমায়, ভাই, বোলো না। বড় আফশোস হয়।

    না, না। নরওয়ের কথা বলিনি আপনাকে, শিশির সংশোধনের চেষ্টা করে বলেছিল, বলছিলাম ওঁর নাম হল নরেশ্বর। উনি

    আর বেশি কিছু বলবার ফুরসত পায়নি শিশির। ঘনাদা তখন নরওয়ের সাদা ভাল্লুক ছেড়ে একেবারে নামাবলির রহস্য নিয়ে মেতে উঠেছেন।

    নাম? নামের মজার কথা যদি বলতে হয়, ঘনাদা নামকীর্তনের মত গদগদ হয়ে বলতে শুরু করেছেন, তা হলে দুনিয়ার সেই সবচেয়ে সৃষ্টিছাড়া আজগুবি নামটার কথাই বলতে হয় নিশ্চয়। সেই আজগুবি, কিন্তু মিথ্যে ধাপ্পা-টাপ্পা কিছু নয়, সত্যিকার একটা ছাপার অক্ষরে ছাপা সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বলে করে লেখা নাম। খুব বেশি নয়, মোট আটান্নটি অক্ষর সে নামের। নামটা আর কিছুর নয়, একটা রেল স্টেশনের। জংশন-টংশন গোছের বড় স্টেশন নয়, নেহাত খুদে একটা সামান্য স্টেশন। ইউরোপ, আমেরিকা, চীন কি রাশিয়ার বিরাট কোনও রেললাইনেরও নয়, জায়গাটা বিলেত হলেও তার মফসসলের মফসসল ওয়েলসের একটা লেভেল ক্রসিং-এর চেয়ে মান্যে বড় কিছু নয়। কিন্তু সেই বিলেতি ধ্যাড়ধাড়া গোবিন্দপুরের নাম কী একখানা! কী, মনে পড়ছে নিশ্চয়ই নরহরিবাবুর?

    ঘনাদার দৃষ্টিটা এবার সোজাসুজি নরেশ্বর বলে শিবু যাকে পরিচিত করতে চেয়েছিল, সেই বেশ একটু যেন ঘামতে-শুরু করা, মোটাসোটা নিরীহ চেহারা ভদ্রলোকের দিকে।

    ঘনাদার আজকের এতক্ষণের বন্ধুাছাড়া বাক-বিস্তারের রহস্যের খেই কি এখানে আছে মনে হয়?

    তা নিয়ে ভাববার ফুরসত তখন আর মেলেনি। ঘনাদা তাঁর দৃষ্টি আবার আমাদের সকলের উপর বুলিয়ে নিতে নিতে যেন একটু লজ্জিতভাবে বলেছেন, আমারই কি আর সব ঠিক মনে পড়বে? এক-আধটা তো নয়, পুরো আটান্ন হরফের নাম। আর সে এমন ভাষায়, যাতে বেশিদিন কথা বললে মাথায়-জিভে জট পাকিয়ে ঘিলুতেই গোলমাল হয়ে যায় মনে হয়। তবু-

    মানে? আবার আমাদের সবিস্ময় জিজ্ঞাসা, সেই আটান্ন হরফের স্টেশনের নামটা আপনার মনে আছে নাকি?

    থাকা কি আর সম্ভব? ঘনাদা কেমন একটু তাল ঠোকার ভঙ্গিতে শিবুর আনা অতিথি নরেশ্বরবাবুর দিকে চেয়ে তারপর যেন গলায় কিছুটা বিনয়ের সুর আনবার চেষ্টা করে বললেন, তবু দেখি একবার চেষ্টা করে। এই যেমন—

    ঘনাদা একটু থামলেন। আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে তাঁর মুখের দিকে তখন তাকিয়ে।

    কী করবেন এবার ঘনাদা?

    সত্যি সত্যি রামধাপ্পা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে মগডাল থেকে মুখ থুবড়ে পড়বেন নাকি মাটিতে?

    ধাপ্পায় উনি ধুরন্ধর, একথা মেনে নিয়েও বলি, সব গুলবাজিরই যে একটা সীমা আছে, তাও তো ওঁর জানা উচিত!

    বিলেতের ওয়েলস অঞ্চলের একটা খুদে রেলস্টেশনের যে শুধু দাঁতভাঙা নয়, পুরোটা বলতে দম ফুরিয়ে যাবার মতো একটা নাম আছে, সেই খবরটা কেউ কি আর আমরা শুনিনি? দু-চারটে নয়, পুরো বানান করে বলতে গেলে তাতে সাতান্ন না আটান্নটা অক্ষর লাগে, তাও আমাদের অজানা নয়, কিন্তু তাই বলে সেই আটান্ন অক্ষরের নামটা হরফ ধরে ধরে পুরোটা বলে যাওয়ার স্পর্ধা?

    কী ভেবেছেন ঘনাদা? ক-এ আকার কা, আর খ-এ আকার খা যাদের কাছে এক, তেমন গোমুখদের যা শুনিয়ে দেবেন, তাই তারা না মেনে নিয়ে করবে কী?

    কেন, আমাদেরও করবার কিছু নেই নাকি? আর কিছু না জানি, গিনেসের বুক অব রেকর্ডস-এর নামটা তো অজানা নয়। দেখি না একবার এবার ঘনাদার দৌড়টা। টেবিলের উপর বাজারের হিসেবের খাতাটা পড়ে রয়েছে। সেটাই টেনে নিয়ে ঘনাদাকে একটু উসকানি দিয়ে বললাম, তা আপনি পারেন নাকি সত্যি ওই আটান্নটা হরফের নামটার কিছুটা অন্তত বলতে? সব না পারেন, আটান্নর মধ্যে তিন-আটে চব্বিশটা পারলেই বাজিমাত।

    না, না, চব্বিশটা কেন? বলতে গেলে পুরো আটান্নটাই না বললে তো বাহাদুরি না করতে যাওয়াই ভাল। ঘনাদা আমাদের বেশ একটু অপ্রস্তুত করে এই মজলিশে শিবুর আনা আজকের অতিথির দিকে ফিরে বললেন, কী বলেন, নরেশ্বরবাবু?

    আজ্ঞে, আমি, মানে— শিবুর আনা আজকের অতিথি চারবার ঢোক গিলে কেমন যেন একটু তোতলা হয়ে যা বলবার চেষ্টা করলেন, তা ঠিক মতো প্রকাশ করতে পারার আগেই ঘনাদা তাঁকে যেন ভুলে গিয়ে নিজের আগের কথাতেই ফিরে গেলেন। বললেন, হ্যাঁ, পারি না-পারি চেষ্টা তো করে দেখতে দোষ নেই। এই যেমন নামটার প্রথম পাঁচটা অক্ষর হল—এল, এল, এ, এন, এফ।

    ঘনাদার কথা আরম্ভ হবার সঙ্গে সঙ্গেই আমি বাজারের হিসেবের খাতার একটা সাদা পাতায় অক্ষর ক-টা লিখে নিয়েছি।

    এরপর ঘনাদাও যেমন বলে যান, আমিও এক নাগাড়ে সব লিখে নিই আমার খাতায়। ঘনাদা কত বড় স্মৃতিধর বাহাদুর, তার প্রমাণ এই খাতাই এরপর দেবে। গৌর আছে আমার পাশেই বসে। ঘনাদার উচ্চারণগুলো এক এক করে খাতায় লেখার সময় তা সাক্ষী হিসেবে তাকে দেখিয়ে তো রাখছি আমি।

    প্রথম পাঁচটা অক্ষরের পর ঘনাদা তখন বলছেন, এ, আই, আর, পি, ডব্লু, এল, এল, জি, ডব্লু, ওয়াই, এন, জি, ওয়াই, এল, এল, জি, ও, জি , ই , আর, ওয়াই, সি, এইচ, ডব্লু, ওয়াই, আর, এন, ডি, আর, ও, বি, ডব্লু, এল, এল, এল, এল, আই, এ, এন, টি, ওয়াই, এস, আই, এল, আই, ও, জি, ও, জি, ও, জি, ও, সি, এইচ।

    ঘনাদার বলা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমার লেখাও শেষ করে সামনের টেবিলের ড্রয়ারে খাতাটা রেখে দিয়ে একটু বোকা সেজেই বললাম, এতগুলো অক্ষর তো আউড়ে গেলেন, কিন্তু সেগুলো ঠিক না ভুল তার প্রমাণ তো আর আমাদের হাতে নেই। আবোলতাবোল বলে গেলেই বা ধরব কী করে?

    ধরতে পারা যাবে না বলেই ঘনাদার মুখে একটু বাঁকা হাসি। আপনি কী বলেন, নরোত্তমবাব? ঘনাদা আবার সেই শিবর আনা অতিথির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, কী বলেন নরসিংহবাবু, হরফগুলো ঠিক না বেঠিক, তা ধরবার কোনও উপায় নেই?

    শিবুর নিয়ে আসা নতুন অতিথির এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো মুখ। প্রায় মিনতির সুরে তিনি বলবার চেষ্টা করলেন, দেখুন, আমি মানে, আপনাকে মিনতি করে বলছি—

    না, না, মিনতি করবেন কেন? ঘনাদা ভদ্রলোকের মুখের চেহারা আর গলার করুণ সুরে এতক্ষণে বুঝি নিজের ধারণা আর ব্যবহার সম্বন্ধে একটু সন্দিগ্ধ হয়ে সুর একটু পালটে তাঁকে যেন সাহস দিয়ে বললেন, যা বলবেন তা একেবারে তাল ঠুকেই বলবেন। বলার মুরোদ যার আছে, যা বলবার, সে তো তা সাহস করে বলবে। বলুন না আপনি, আটান্নটা হরফ, যা শোনালাম, তা প্রলাপ না সাচ্চা বানান, তার হদিস কোথাও মেলা কি সম্ভব?

    নরেশ্বর বা নরোত্তম, নামটা যাই হোক, শিবুর নিয়ে আসা ভদ্রলোক এবারে মরিয়া হয়েই বুঝি একটু সাহস সংগ্রহ করে বললেন, আজ্ঞে হ্যাঁ, সম্ভব।

    সম্ভব?

    আমরা সবাই তো বটেই, স্বয়ং ঘনাদাও এবার বুঝি কেমন একটু চমকিত।

    সম্ভব বলছেন তো আপনি? জোর দিয়ে বলার চেষ্টা সত্ত্বেও ঘনাদার কেমন একটু দ্বিধান্বিত জিজ্ঞাসা, ঠিকঠাক, না আবোলতাবোল বানান বলেছি, তা ধরে ফেলার উপায় তা হলে আছে বলছেন আপনি?

    হাঁ, বলেছি। শিবুর নিয়ে আসা অতিথি নরহরি বা নরেশ্বরবাবু আরও যেন বেপরোয়া হয়ে বললেন, আর কোথাও না হোক, আপনাদের এখানে শুধু তা কেন, সাপের পাঁচ পা-ও হওয়া সম্ভব।

    সাপের পাঁচ পা? আমাদের আর বিস্ময়ের ভান করতে হল না এবার।

    আমাদের সকলের বক্তব্যই ঘনাদার মুখ দিয়েই বার হল, সাপের পাঁচ পা? সাপের পাঁচ পা আবার কোথা থেকে এল?।

    কোথা থেকে এল? নরেশ্বর না নরহরি নামের ভদ্রলোক অনেক সয়ে এবার যেন পুরোপুরি খাপচুরিয়াস—এল আপনাদের এই গারদ মানে পাগলাগারদের গুণে। সাপের পাঁচ পা কেন, আপনাদের এই বদ্ধ পাগলের গারখানায় সবকিছু হওয়া সম্ভব। এখানে যাহা বাহান্ন, তাকে আপনারে তেষট্টি মাত্র নয়, পোস্তার আলুপট্টি করে দিতে পারেন। তিন-তিরিক্ষে নয়-ও আপনাদের এই মাথার ঘিলু-গলানো আসরে তিরুপল্লির তিন্তিড়ি হয়ে যেতে পারে—

    শাবাশ, শাবাশ। শিবুর নিয়ে আসা নরহরি না নরেশ্বরবাবুর তাল-মেলানো গজরানির মাঝে ঘনাদার অমন তারিফ শুনে আমরা অবাক। শাবাশ বলে তারিফ জানিয়েই ঘনাদা থামলেন না, সোৎসাহে শিবুর আনা অতিথি নরহরি না নরেশ্বরবাবুকে নিজের সমর্থন জানিয়ে ঘনাদা বলে চলেছেন, চালিয়ে যান, চালিয়ে যান।

    কিন্তু নরহরি বা নরেশ্বরবাবুর মেজাজটা তখন ওই দুটো শাবাশ ছিটিয়ে শান্ত করবার নয়। তপ্ত তেলের কড়ায় জল পড়ায় তিনি যেন আরও চিড়বিড়িয়ে উঠে বললেন, চালিয়ে যেতে বলছেন আমাকে? বলতে লজ্জা করছে না? সাতে নেই, পাঁচে নেই, আমি মশাই নেহাত সাদাসিধে কলের জলের কনট্রাকটর। করপোরেশনের কলের জলের পাইপ লাগানো আর মেরামতের মিস্ত্রিও বলতে পারেন। সেই আমাকে আপনাদের কোথায় কলের জলের নতুন পাইপ লাগাতে হবে বলে ডাকিয়ে এ কী জুলুম আর শাস্তি!

    একটু থেমে থেকে শিবুর দিকে আঙুল তুলে করপোরেশনের জলের কলের কনট্রাকটর আবার বলতে শুরু করলেন, উনি, ওই উনিই তো আমায় ডাকিয়ে এনেছেন। এখানে আসবার আগে অবশ্য আগে থাকতে একটু সাবধান করে বলে দিয়েছিলেন, আমি যেন নিজে থেকে কথা বলে নিজের পরিচয়-টরিচয় না দিই। ওই ওঁর ইশারা না পাওয়া পর্যন্ত চুপ করে সব শুনেই যাই। কিন্তু সেই শুনে যাওয়া মানে কি এই যন্ত্রণা? আমার নামটা নিয়ে পর্যন্ত কী হেলাফেলা! পেঁচিয়ে দুমড়ে থেঁতলে নরহরি না নরেশ্বর বানানো! শুনুন, আমার নাম নরহরি বা নরেশ্বর-টর নয়। সরল সোজা তিন অক্ষরের নবীন। বুঝেছেন?

    নবীনবাবু তাঁর গায়ের জ্বালায় অনেক কথা যখন বলে যাচ্ছেন, ঘনাদার এই ক-দিনের লাগাতার ভাষণের ঝোঁকের রহস্যটা তখন ধরে ফেলেছি। কেরামতিটা অবশ্য শিবুর।

    মাঝে-মাঝে যেমন হয়, বাহাত্তর নম্বরে তেমনই কিছুদিন আগে থেকে একটা গুমোটের পালা চলছিল। খুচখাচ তোয়াজ-তারিফ যা কিছু সম্ভব, যোলো আনার জায়গায় আঠারো আনা করেও ঘনাদাকে একটু হাঁ করাতেও যেন পারছিলাম না।

    ঘনাদার বেয়াড়াপনা এবার ছিল একটু নতুন ধরনের। না অসহযোগ-টোগ নয়, তার বদলে যেন একেবারে ন্যাকা সেজে যাওয়া। আমাদের কথায় কান দেন না এমন নয়, কিন্তু ফল তার হয় বিপরীত। ধান শুনতে কান তো শোনেন বটেই, সে কানও আবার শব্দ শোনবার সহায়, না জল থেকে নিশ্বাসের হাওয়া সংগ্রহের জন্য মাছেদের কানকোর অক্ষর-সংক্ষেপে কিনা, তাই যেন ঠিক করতে পারেন না।

    বেয়াড়াপনাটা আরম্ভ করেছিলেন অবশ্য শিবুরই দোষে। কথায় কথায় কেমন করে দক্ষিণ আমেরিকায় যার জন্ম, পৃথিবীর সেই সবচেয়ে হালকা বালসা কাঠের ভেলায় যাঁরা পেরু থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়ে পলিনেশিয়ার এক নগণ্য দ্বীপে এসেছিলেন, তাঁদের কথা হচ্ছিল। শিবু তার মধ্য দিয়ে নিজের বিদ্যে জাহির করবার জন্য একটু ফোড়ন কেটে বলে ফেলেছিল, নামগুলো একটু সাবধানে উচ্চারণ করতে হয় কিন্তু, ঘনাদা। এক-আধটা তো নয়, অমন পাঁচ-সাতটা ভাষার খিচুড়ি। বানান ঠিক রাখাই প্রায় অসম্ভব।

    ও, তাই বুঝি? ঘনাদা যেভাবে হঠাৎ যেন অপ্রস্তুত হবার ভঙ্গিতে শিবুর দিকে ফিরে তাকিয়েছিলেন, শিবুর তাতেই হুঁশ হওয়া উচিত ছিল।

    তার বদলে আহাম্মকটা আরও মাতব্বরির চালে বলেছিল, হ্যাঁ, এই দেখুন না, ওই বালসা কাঠের পালতোলা একটা ভেলা, কোনওরকম লোহা পেতল কি তামার পেরেক ইস্ক্রপ ছাড়া শুধু বুনো লতার দড়িতে বেঁধে যিনি পেরু থেকে প্রায় গোটা প্রশান্ত মহাসাগরটাই পার হবার আজগুবি কল্পনায় ক-জন নিজেরই মতো আধপাগলা বন্ধু জোগাড় করে সমুদ্রে ভেসেছিলেন—

    নিজের উৎসাহে নাগাড়ে বকে যেতে যেতে হঠাৎ ঘনাদার দিকে চোখ পড়ায় শিবু একটু থেমেছিল।

    ঘনাদা তখন তার দিকে আদার ব্যাপারির কাছে যেন সওদাগরি জাহাজের খবর বলা হচ্ছে, কিংবা বলা যায় প্রথমভাগের পড়ুয়ার কাছে যেন মুগ্ধবোধের শ্লোক পড়া হচ্ছে, এমনভাবে বোকা সেজে চেয়ে আছেন।

    এ চেহারা দেখেও হুশ কি হয়েছে শিবুর? মোটেই নয়। নিজের বাহাদুরিতে সে যেন আরও উৎসাহিত হয়ে ঘনাদাকে জ্ঞান দিয়ে বলেছে, হ্যাঁ, ওই থর হেয়ারডালের কথাই বলছি। উচ্চারণটা হেয়ারডাল কি না তারই বা ঠিক কী?

    হ্যাঁ, শিবুর কথার মধ্যেই ঘনাদা হঠাৎ তাঁর আরামকেদারায় সোজা হয়ে বসে তাঁর বিদ্যাসাগরি চটিতে পা গলাতে গলাতে বলেছেন, ও সব ঝামেলায় না যাওয়াই ভাল।

    তারপর আমরা কেউ কিছু বলবার করবার আগেই ঘনাদাকে বারান্দার দরজা দিয়ে সোজা ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াতে দেখা গেছে।

    কিন্তু আমাদের মতোই হতভম্ব শিবুর মুখ দিয়ে শুধু ওই শব্দটি যখন বেরিয়েছে, ঘনাদার বিদ্যাসাগরি চটি তখন ন্যাড়া ছাদের সিঁড়ির প্রথম ধাপ ছাড়িয়ে গেছে। বিদ্যাসাগরি চটির তাল দেওয়া চটপটির সঙ্গে ঘনাদার শেষ যা কথা শোনা গেছে, তা হল, ঠিক! ঠিকই বলেছ। হাতেখড়ি না হতেই চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নিরেট আহাম্মকেরাই করতে যায়।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39 40 41 42 43 44 45 46 47 48 49 50 51 52 53 54 55 56 57 58 59 60 61 62 63 64
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray
    Next Article ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025
    Our Picks

    ইলিয়াড – হোমার

    October 13, 2025

    ওডিসি – হোমার

    October 13, 2025

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }