Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প632 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ০৮. কুড়ি বছর বাদে আবার

    হ্যাঁ, পিজারো সত্যিই কুড়ি বছর বাদে আবার নিজের দেশ এসপানিয়ায় ফিরেছেন।

    ছন্নছাড়া অভাগা বাউণ্ডুলে হিসেবে দেশ ছেড়ে দুর্গম অজানা বিপদের রাজ্যে অনিশ্চিতের মধ্যে ঝাঁপ দিয়ে ভাগ্য পরীক্ষা করতে যাবার পর এতদিন বাদে অনেক আশা নিয়ে ফিরে দেশের মাটিতে পা দেওয়া মাত্র জেলখানার কয়েদি হতে বাধ্য হওয়া যদি অভাবনীয় হয়, তা হলে পানামা থেকে তোড়জোড় করে তাঁর স্পেনে আসার ব্যবস্থা করাই আশ্চর্য ব্যাপার।

    পানামার গভর্নর পেড্রারিয়াস তো পিজারো আর আলমাগরোর সব আশায় ছাই ঢেলে দিয়েছিলেন। তাদের আকুল প্রার্থনায় কানই দিতে চাননি, নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে চরম দুঃখ দুর্যোগ বিপদের সঙ্গে যুঝে আশ্চর্য এক দেশের যেসব চাক্ষুষ প্রমাণ তাঁরা এনেছিলেন সস্তা ক-টা খেলনা বলে তা অগ্রাহ্যই করেছিলেন।

    পিজারো-আলমিগরো তো বটেই, তাঁদের সঙ্গীসাথী আর মহাজন পর্যন্ত তখন হতাশায় ভেঙে পড়ে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। পেড্রারিয়াস যখন বিমুখ তখন চিরকালের মতো তাঁদের কপাল ভেঙে গেছে বলে তাঁরা মেনেই নিয়েছিলেন।

    তারই মধ্যে হঠাৎ স্পেনে আসার মতলব এল কোথা থেকে!

    এল বার্থালমিউ রুইজ-এর সেই নেশার ঘোরে শোনা ভুতুড়ে নির্দেশ থেকে।

    ইদারায় জল না পেলে নদীতে যেতে হয়।

    মাতালের খেয়ালে কথাটা মুখে আওড়াতে আওড়াতে রুইজ সেদিন মাঝরাত্রে মোরালেস-এর বাড়িতে গিয়ে উঠেছিলেন।

    বন্ধুর ঘরেই রুইজ-এর শোবার ব্যবস্থা। রুইজ-এর মাতাল হয়ে রাত করে বাড়ি ফেরা মোরালেস বন্ধুত্বের খাতিরে মেনেই নিয়েছেন। কিন্তু সেদিন এই বিড়বিড়িনির উপদ্রবে ঘুমোতে না পেরে চটে উঠে বলেছিলেন, মাতাল হওয়ার সঙ্গে পাগলও হয়েছ নাকি! বিড়বিড় করে বলছ কী?

    বলছি, ইদারায় জল না পেলে নদীতে যেতে হয়।

    তার মানে? মোরালেস বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন—রাতদুপুরে জপ করবার এ মন্তর আবার কোথায় পেলে?

    পেলাম ভূতের কাছে!

    থামো! ঘুমোতে দাও, বলে ধমক দিয়েছিলেন মোরালেস। রুইজ কিন্তু থামেননি। বলেছিলেন, সত্যি বলছি তোমায়, এখানে আসতে জলার ধারের রাস্তায় ভূত দেখেছি। অনেক দূরের অজগর জঙ্গল ঘেরা, এক জলাবাদার মাঝখানে যে হঠাৎ যেন হাওয়াতেই মিলিয়ে গেছল একদিন, সেই দোভাষীটাই নির্জন পথে আমায় খানিক আগে থামিয়ে

    ওই কথাটা শুনিয়েছে। শুনিয়েই আবার মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে।

    কী কথাটা আর-একবার বলো তো! মোরালেস হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন। বলো, বলো।

    ইদারায় জল না পেলে নদীতে যেতে হয়, মোরালেস-এর হঠাৎ এত উত্তেজিত হবার কারণ বুঝতে না পেরে একটু হতভম্ব হয়েই বলেছিলেন রুইজ।

    হয়েছে! হয়েছে। ঠিক হয়েছে! মোরালেস বিছানা ছেড়েই উঠে বসেছিলেন।

    কী ঠিক হয়েছে? রুইজ বন্ধুর জন্যেই তখন চিন্তিত। শুড়িখানা থেকে তো তিনিই আসছেন, মোরালেস তা হলে এমন আবোল-তাবোল বকছেন কেন?

    ঠিক হয়েছে—তোমাদের এখন কী করতে হবে তা-ই! উত্তেজনার ভেতরই গম্ভীর হয়ে এবার বলেছিলেন মোরালেস, কালই পিজারো আর আলমাগরোকে ডেকে আনবে। তোমাদের সব সমস্যা মেটাবার এই উপায়টার কথাই আগে মাথায় আসেনি।

    ***

    সে উপায় আর কিছু নয়, পেড্রারিয়াস-এর কাছে বিফল হলেও স্পেনে গিয়ে খোদ সম্রাটের কাছেই একবার হত্যা দেওয়া।

    কুয়োয় জল না পেলে নদীতে যেতে হয়।

    কুয়ো হল পেড্রারিয়াস। পেড্রারিয়াস যদি আশা না মেটায় তা হলে চলো, পেড্রারিয়াস যার হুকুমের চাকর সেই সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর কাছে শেষ চেষ্টা করে দেখতে। .

    কিন্তু যাবে কে এই গুরুভার নিয়ে?

    আলমিগরো?

    না, মুখখু শুধু নয়, বেঁটেখাটো গাঁট্টাগোট্টা চোয়াড়ে চেহারা। রাজদরবারে গিয়ে দাঁড়ালে চাকরবাকর ছাড়া আর কিছু মনে হবে না।

    হ্যাঁ, চেহারার দিক দিয়ে মানায় বটে পিজারোকে। তিনিও মুখখু বটে, এককালে শুয়োরের রাখাল ছিলেন। কিন্তু চেহারা দশাসই হোমরাচোমরা গোছের। বলিয়ে কইয়েও ভাল। অভিযানের কাহিনী ফলাও করে শোনাবার উপযুক্ত লোক।

    সুতরাং ঠিক হয়েছে পিজারোই যাবেন স্পেনে সম্রাটের কাছে নিবেদন জানাতে।

    কিন্তু এদিকে তখন অভিযাত্রী দলের যে ভাঁড়ে মা ভবানী। পানামা থেকে স্পেনের রাজদরবারে পাঠাবার পাথেয় জোগাড় করাই দায় হয়ে উঠেছে। দু-দুটো অভিযানে খরচ তো বড় কম হয়নি। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের হদিস তাতে মিলেছে, কিন্তু লাভ যা হয়েছে তা উজ্জ্বল সোনালি আশা, আসল সোনা নয়।

    অনেক কষ্টে পনেরোশো ড়ুকাট জোগাড় হয়েছে। তাই নিয়ে পিজারো একদিন পানামার বন্দর নোম্বর দে দিয়স থেকে পাড়ি দিয়েছেন। সঙ্গী হিসেবে নিয়েছেন শুধু পেড্রো দে কানডিয়াকে।

    জাতে এসপানিওল নয়, গ্রিক। বিশাল দৈত্যাকার চেহারা।

    পিজারোর অনুগত বিখ্যাত তেরো সঙ্গীর একজন। টমবেজ শহরে তার বিশাল বর্মপরা চেহারা দেখেই সেখানকার মানুষ থ হয়ে গেছল।

    স্পেনের রাজদরবারে তাঁদের অভিযানের প্রমাণ হিসেবে দাখিল করবার জন্যে পিজারো সোনাদানার নানান জিনিসপত্র, গয়না, ও দেশের পশমি কাপড়-চোপড়, আর দু-তিনটি বিচিত্র প্রাণী, গ্লামা তো নিয়েছিলেনই, কয়েকজন ওদেশের আদিবাসীও সঙ্গে নিতে ভোলেননি।

    এইসব লটবহর নিয়ে পিজারোর জাহাজ নিরাপদেই মাঝখানের অকূল সমুদ্র পার হয়ে একদিন সেভিল বন্দরে গিয়ে ভেড়ে।

    অতলান্ত দীর্ঘ সমুদ্রপথে যার দেখা পাননি, সে আপদ তাঁর জন্যে সেভিলের বন্দরেই অপেক্ষা করছিল তা আর পিজারো কেমন করে জানবেন!

    স্পেনে নতুন মহাদেশ থেকে কোনও জাহাজ এসে ভিড়লেই তখনও একটু উৎসুক হয়ে খোঁজখবর লোকে নেয়।

    কোথা থেকে জাহাজ এল? ফার্নানদিনা কি হিসপানিওলা থেকে এলে তেমন কোনও কৌতূহল নেই। মেক্সিকো য়ুকাটান কি নতুন উপনিবেশ পানাম গুয়াতামেলা থেকে এলে আগ্রহ একটু বেশি।

    এ জাহাজ পানামা থেকে এসেছে শুনে দু-চারজন বন্দরে একটু কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়েছেন, দাঁড়িয়ে দেখাটা সার্থকও হয়েছে। কী সব অদ্ভুত জানোয়ার নামানো হয়েছে তক্তা ফেলে জাহাজ থেকে! অ্যাডমিরাল কলম্বাস ছত্রিশ বছর আগে সেই নতুন সমুদ্রপারের দেশ আবিষ্কার করার পর থেকে অনেক কিছু অবাক করবার মতো দেখলেও এমন অদ্ভুত জানোয়ার স্পেনের কেউ কখনও দেখেনি। শুধু জানোয়ারই নয়, একটু ভিন্ন চেহারার আদিবাসীও নেমেছে জাহাজ থেকে।

    কোথা থেকে এসব আমদানি?

    তা কেউ সঠিক বলতে পারে না।

    এনেছে কে?

    এনেছে এমন একজন যার সম্বন্ধে উড়ো খবর এই সেভিলেও কিছু কিছু পৌঁছেছে। লোকটার নাম ফ্রানসিসকো পিজারো।

    ফ্রানসিসকো পিজারো! বন্দরে নতুন জাহাজের মাল খালাস দেখবার জন্যে ছোট্ট যে-ভিড় জমেছিল তার ভেতর থেকে একজনকে উত্তেজিত হয়ে উঠতে দেখা গেছে।

    ফ্রানসিসকো পিজারো? নামটা শুনতে ভুল হয়নি তো? না, ভুল হয়নি। ওই তো পিজারো, একজন দেখিয়েছে। পিজারো তখন জাহাজ থেকে নামবার জন্যে ডেকের ধারে এসে দাঁড়িয়ে আর-এক দৈত্যাকার সঙ্গীর সঙ্গে কথা বলছেন।

    ভিড়ের উত্তেজিত লোকটিকে এবার ব্যস্ত হয়ে যেতে দেখা গেছে বন্দরেরই কোতোয়ালিতে।

    কিছুক্ষণ বাদে পিজারো জাহাজ থেকে বন্দরে নেমে দু-পা যাবারও সময় পাননি। চারজন সেপাই এসে তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়েছে।

    এ কী ব্যাপার! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন পিজারো।

    কী ব্যাপার বুঝতে পারছ না!-সেপাইদের পেছন থেকে ভিড়ের সেই। উত্তেজিত লোকটি এবার এগিয়ে এসেছে—আমায় দেখলে হয়তো বুঝতে পারবে। চিনতে পারছ আমায়?

    পিজারো সবিস্ময়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেছেন, আপনি—আপনি ব্যালির এনসিসো!

    নামটা তো মনে আছে দেখছি! ব্যাচিলর এনসিসো ব্যঙ্গ করে বলেছে, শুধু দেনাটাই ভুলে গেছ বেমালুম। স্মরণশক্তিটা সেদিকে একটু উসকে দেবার জন্যেই এই হাজতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেছি। দেনাটা শোধ করতে পারো ভাল, নইলে হাজতেই পচিয়ে মারব।

    পিজারো সত্যিই তখন হতভম্ব। স্পেনের বীর সেবক সে যুগের সবচেয়ে দুঃসাহসিক অভিযানের নায়ক, দেশের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই দেনার দায়ে

    গ্রেফতার হয়ে হাজতে চলেছেন! তাঁর হয়ে বলবার, তাঁকে বাঁচাবার কেউ নেই?

    বাধা দেবার জন্যে দৈত্যাকার পেড্রো দে কানডিয়া অবশ্য ছুটে এসেছিল। নেহাত সরকারি সেপাই না হলে অমন গোটা দশেক লোককে সে একাই তক্তা বানিয়ে দিতে পারত। কিন্তু মারামারির জায়গা এটা নয়, সেটুকু বুদ্ধি তার ঘটে ছিল।

    কানডিয়া নিজেকে সামলে যতদূর সম্ভব ভদ্রভাবেই জিজ্ঞাসা করেছে ব্যাচিলর এনসিসাকে, কী করছেন আপনি! কাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন, জানেন?

    জানি, জানি! ব্যাচিলর এনসিসো টিটকিরি দিয়ে বলেছে, উনি নাকি সাগরপারে মস্ত এক বীর হয়েছেন আজকাল! বাঁশবনে গিয়ে শিয়াল রাজা! তা উনি রাজাগজা। যা-ই হোন, আমার কাছে উনি খাতক। দেনা শুধতে না পারলে শ্রীঘর যেতেই হবে।

    কত আপনার দেনা? দেনাই-বা কীসের?—জিজ্ঞাসা করেছে পেড্রো দে কানডিয়া।

    তারপর দেনা কত আর কীসের ব্যাচলর এনসিসোর মুখে শুনে কানডিয়া থ হয়ে গিয়েছে একেবারে। পিজারো স্পেন থেকে সমুদ্রে পাড়ি দিয়ে প্রথম ড্যারিয়েন-এই গিয়েছিলেন। এখন যাকে পানামা-যোজক বলি তারই তখনকার নাম ছিল ড্যারিয়েন। সেখানে তখন নতুন উপনিবেশ বসছে। যারা সে উপনিবেশে বসতি করতে চেয়েছে মহাজন হিসেবে তাদের ধার দিয়েছিল এই ব্যালির এনসিসো। পিজারোও এরকম ধার নিয়েছিলেন। সে ধার আর শোধ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। চক্রবৃদ্ধি সুদে বেড়ে প্রতি এক ড়ুকাটের ঋণ বছর কুড়ির মধ্যে একশো ড়ুকাট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই দেনার দায়েই ব্যচিলর এনসিসো এখন পিজারোকে গ্রেফতার করিয়ে কয়েদখানায় চালান করছে।

    সত্যি চোখে অন্ধকার দেখেছে পেড্রো দে কানডিয়া। নেহাত সাদাসিধে মানুষ। চেহারাটা তার যত বিরাট, বুদ্ধিটা তত অল্প। পিজারো বন্দি হবার পর সঙ্গের নজরানার জিনিসপত্র, জন্তুজানোয়ার আর আদিবাসীদের কটাকে নিয়ে কী করবে তাই সে ভেবে পায়নি। তার বুদ্ধিতে মুশকিল আসানের একটিমাত্র যে উপায় সে বার করতে পেরেছে তা হল, সঙ্গে যা কিছু আনতে পেরেছে তা নিলেমে বেচে পিজারোকে দেনা মিটিয়ে খালাস করা।

    কিন্তু সবকিছু বেচেও দেনা শোধ হবে কি না সে বিষয়ে তার কোনও ধারণা নেই। তা ছাড়া এ সব বেচে দিয়ে পিজাররাকে ছাড়ালে মনের দুঃখে তিনি তো আবার আত্মঘাতী হবেন। পিজারো তখন ছাড়াই পাবেন শুধু, কিন্তু সম্রাটের দরবারে কোন মুখে কী নিয়ে যাবেন?

    দারুণ ফাঁপরে পড়ে জাহাজ থেকে নামানো মালপত্র তদারক করতে গিয়ে কানডিয়াকে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়তে হয়েছে।

    জাহাজ থেকে নামানো ক্লামাগুলোর মধ্যে একটা মা নেই। সেই সঙ্গে সুদুর টম্‌বেজ থেকে আনা চারজন আদিবাসীর একটিও নিরুদ্দেশ।

    পিজারোকে ধরে হাজতে নিয়ে যাওয়ার অপ্রত্যাশিত ব্যাপারে বন্দরের লোকজন বেশ উত্তেজিত চঞ্চল থাকবার দরুনই কখন যে আদিবাসীটি আর ক্লামাটা তাদের চোখের সামনে থেকে উধাও হয়ে গেছে কেউ খেয়াল করেনি।

    কিন্তু আদিবাসীটার এমন দুর্বুদ্ধি হলই বা কেন? গ্লামাটাকে সে-ই যে বাঁধন খুলে ছেড়ে দিয়েছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। সঙ্গে করেও যদি নিয়ে বেরিয়ে থাকে তাতে তার লাভটা কী? এই সম্পূর্ণ অজানা বিদেশে একটা অদ্ভুত অচেনা জানোয়ার নিয়ে সে পালাবে কোথায়? পালাবার দরকারটাই বা তার কী ছিল?

    প্রশ্নগুলোর উত্তর দৈত্যাকার পেড্রো দে কানডিয়া অন্তত ভেবে পায়নি।

    সে তখন পিজারোকে ছাড়াবার জন্যে ব্যালির এনসিসোরই হাতে পায়ে ধরা একমাত্র উপায় বলে ঠিক করেছে।

    ব্যাচিলর এনসিস কিন্তু অটল নির্মম। দেনার একটি দামড়ি সে ছাড়তে প্রস্তুত নয়, আর কড়ায় ক্রান্তিতে দেনা শোধ না হলে পিজারোকে।

    দে কানডিয়া নিরুপায় হয়ে যা-কিছু সঙ্গে এনেছে সব নিলেমে তোলার নিয়ম কানুন খোঁজ করতে ব্যস্ত হয়েছে।

    সেটা ১৫২৮ খ্রিস্টাব্দ। গ্রীষ্মকালের শুরু। ইস্টার পরবের আনন্দে সমস্ত সেভিল শহর তখন মেতে উঠেছে।

    পিজারো সম্বন্ধে একটু-আধটু উড়ো খবর আর গুজব অতলান্ত সমুদ্র পার হয়ে এ কূলে মাঝে মাঝে ভেসে এসেছে বটে কিন্তু পিজারোর নামে তখনও সে জাদু নেই। বন্দরের দু-চারজন বাদে উৎসবমত্ত সেভিল শহর সেদিন পিজারোর কারারুদ্ধ হবার খবরেও এমন কিছু চঞ্চল হয়ে বোধহয় উঠত না।

    সে খবর তাদের কাছে কতদিনে কীভাবে পৌঁছোত তারই ঠিক নেই। বাসি ও ফিকে হয়ে সে খবর যখন সাধারণের কানে যেত তখন কানডিয়ার নিলেমে বিক্রি করা জিনিসপত্র শৌখিন সম্ভ্রান্ত ধনীদের প্রাসাদে সাধারণের চোখের আড়ালে হত গায়েব। হাজত থেকে মুক্তি পেলেও বিষদাঁত ভাঙা সাপের মতো পিজারো তখন হতেন নিঃসহায় নিঃসম্বল। : ইস্টার উৎসবে মত্ত সেভিল শহর কিন্তু পিজারো সম্বন্ধে উদাসীন থাকতে পারেনি।

    পিজারোর গ্রেফতারের খবর যাদের কাছে পৌঁছোলেও এমন কিছু সাড়া তুলত না তারাই সচকিত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে একটি অভাবিত ব্যাপারে।

    সেভিল শহরের রাস্তায় রাস্তায় উৎসবমত্ত জনতা হঠাৎ সেদিন বিস্মিত বিহ্বল আতঙ্কিত হয়ে উঠেছে।

    কিঞ্চিৎ সুরা পানে যারা মত্ত তারা আচ্ছন্ন মস্তিষ্কের দুঃস্বপ্নই দেখছে বলে মনে করেছে। যারা সহজ স্বাভাবিক তারা নিজেদের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারেনি।

    সেভিল শহরের রাস্তায়, চিরপরিচিত রাস্তায় রাস্তায় অবিশ্বাস্য অদ্ভুত এক প্রাণী ছুটে বেড়াচ্ছে!

    এ কি শয়তানের প্রেরিত কোনও মূর্ত অভিশাপ, না বাস্তব কোনও প্রাণী?

    মার্শনেস গঞ্জালেস দে সোলিস দুঃসহ রাগে ঘৃণায় স্বামীর কাছ থেকে চলে গিয়েছিল ক্যাথিড্রালের ভেতরে। সেখান থেকে কিছুক্ষণ বাদে বার হয়ে মনের অশান্ত অস্থিরতায় উৎসবের ভিড়ের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এসেছিল সেভিলের মুসলিম যুগের বিখ্যাত প্রাসাদ আলকাজার-এর কাছে। গ্রানাদার আলহামব্রার সঙ্গে তুলনীয় এই প্রাসাদের কাছেই মার্শনেস হঠাৎ জনতার ভীত চিৎকার শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে। তারপর তার চোখের সামনে দিয়ে যে প্রাণীটি ছুটে চলে যায় সেটিকে দেখে আতঙ্কে বিস্ময়বিহ্বলতায় মুহূর্তের জন্যে সম্বিৎ হারিয়ে সে প্রায় টলেই পড়ছিল।

    পেছন থেকে কে যেন তাকে তখন ধরে ফেলে।

    কে ধরে ফেলেছে মার্শনেস-কে?

    দু-এক মুহূর্তের অচেতনতার পরই মার্শনেস সংজ্ঞা ফিরে পেয়ে চমকে পাশে তাকায়।

    আলকাজার প্রাসাদের কোল দিয়ে তখন ভীত বিশৃঙ্খল জনতার স্রোত বইছে। তারই ভেতর এক পাশে একটু সরে দাঁড়িয়ে যিনি তাকে বুকে ঈষৎ ভর দেবার সুযোগ দিয়ে ধরে আছেন, তাঁকে দেখে প্রথমটা মার্শনেস সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।

    এ কোন অজানা অচেনা একটা বুড়ো বাউণ্ডুলে ভিখিরি তাকে ধরে আছে?

    ঝটকা দিয়ে সরে আসতে গিয়ে ভিখিরিটার মুখের হাসি দেখেই মার্শনেসকে একটু থমকে যেতে হয়।

    জট পড়া সাদা কালো দাড়ির ফাঁকের হাসিটা তার যেন চেনা।

    পরমুহূর্তেই আবার ভিখিরীটার বুকের ওপরই মাথা গুঁজে রেখে মার্শনেস উচ্ছ্বসিত গলায় বলে ওঠে, তিয়েন! তুমি? আমি যে তোমায়

    বাউণ্ডুলে ভিখিরি চেহারার লোকটি চাপা গলায় এবার বলে, চুপ! তারপর বেশ একটু জোর করেই মার্শনেসকে দূরে ঠেলে দিয়ে জনতার স্রোতে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে এগিয়ে যায়।

    এক মুহূর্তের জন্যে একটু চমক লাগলেও মার্শনেস আর অবাক হয় না।

    বাউণ্ডুলে ভিখিরি চেহারার লোকটিকে চিনতে তার ভুল হয়নি। মানুষটা যে তার। পাতানো তিয়া অর্থাৎ কাকা, কখনও কখনও আদর করে যাকে সে তিয়েন বলে, সেই কাপিন সানসেদো সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

    কেন যে কাপিন সানসেদো তাকে অমনভাবে ঠেলে সরিয়ে ভিড়ের মধ্যে নিজেকে মিশিয়ে দিয়েছে মার্শনেস তখন তাও বুঝে নিয়েছে।

    শহরের ক-জন পাহারা সেপাই তাদের পাশ দিয়েই তখন ছুটে যাচ্ছে। কাপিন সানসেদোর সন্ধানে অবশ্য তারা ছুটছে না। তবু সাবধানের মার নেই বলেই সানসেদো। নিশ্চয়ই মার্শনেসকে ঠেলে দিয়ে সরে গেছেন।

    মার্শনেস-এর মতো সম্ভ্রান্ত পোশাক ও চেহারার সুন্দরী এক মহিলাকে একটা হাঘরে ভিখিরির সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ হতে দেখলে পাহারাদারদের পক্ষে সন্দিগ্ধ হওয়া স্বাভাবিক।

    কিন্তু রাস্তার ধারের এরকম অদ্ভুত কোনও দৃশ্যও লক্ষ করবার মতো অবস্থা তাদের বোধহয় তখন নয়।

    রাস্তার জনতা যে কারণে তখন উত্তেজিত, ভয়ার্ত, পাহারাদার সেপাইরাও অস্থির ও শশব্যস্ত সেই কারণেই।

    মনের মধ্যে সেই একই আতঙ্ক বিহ্বলতা নিয়েও মার্শনেস জন-প্রবাহের মধ্যে তার তিয়েনকে অনুসরণ করেই এগিয়ে চলে।

    বেশি দূর মার্শনেসকে এভাবে যেতে হয় না।

    আলকাজার প্রাসাদের টরে-দেল-অরো নামে টুঙ্গির নীচে পৌঁছেই মার্শনেস কাপিন সানসেদোর সঙ্গে মেলবার সুযোগ পায়।

    পাহারাদার সেপাইরা সামনে বেরিয়ে যাবার পর সানসেদো সেখানে জনতার প্রবাহ থেকে সরে টুঙ্গির নীচে একটি কোণে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

    মার্শনেসকে বেশি কিছু বলবার অবসর সানসেদো দেন না।

    সে গিয়ে তাঁর কাছে দাঁড়াবার পরই চাপা গলায় ব্যস্তভাবে সানসেদো বলেন, শোনো আনা, তোমার আমার এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলাও নিরাপদ নয়। তোমার মার্কুইস কী করেছে, তা বোধহয় জানো। এখানকার কোতোয়ালিতেও আমার বিরুদ্ধে হুলিয়া বার করিয়েছে! সমস্ত শহরের লোক হঠাৎ অত্যন্ত উত্তেজিত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে তাই।

    সানসেদোকে বাধা দিয়ে, প্রধান প্রশ্নটা আপাতত স্থগিত রেখে, অস্থির উদ্বেগের সঙ্গে আনা জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু ব্যাপারটা কী, তিয়ো? শহরের মানুষের মতো আমিও তো ভয়ে দিশাহারা। এইমাত্র যা দেখেছি তা সত্যি না দুঃস্বপ্ন তা বুঝতে পারছি না। তুমিও দেখেছ নিশ্চয়!

    হ্যাঁ, দেখেছি! অস্বস্তির সঙ্গে বলেন সানসেদো, নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে আমারও মন চাইছে না। কিন্তু সমস্ত শহরের লোকের একসঙ্গে দৃষ্টি বিভ্রম হওয়াও সম্ভব নয়। সুতরাং একটা অদ্ভুত ভয়ংকর কিছু মানে ব্যাপারটার নিশ্চয় আছে। কিন্তু এখন তা নিয়েও কথা বলবার সময় নেই। তোমার সঙ্গে দেখা হবার আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম। ভাগ্যক্রমে তা যখন হয়েছে তখন সন্ধ্যার পর সান মার্কস-এর মিনারের কাছে সাধারণ কিষাণ মেয়ের পোশাকে আমার সঙ্গে দেখা কোরো। ও মুসলিম মিনারের কাছে আজকের পরবের দিন তেমন ভিড় হয়তো না থাকতে পারে। মনে রেখো–

    সানসেদোর কথার মাঝখানেই উত্তেজিত আতঙ্কবিহ্বল জনতার আর্ত চিৎকার হঠাৎ আবার তীব্র হয়ে ওঠে। সামনের দিকে জনতার যে স্রোত বয়ে গিয়েছিল তা আবার বিশৃঙ্খলভাবে সবেগে ঘুরে আসছে।

    কী? কী ওটা, তিয়ো?ছদ্মবেশী সানসেদোর খাটো আলখাল্লা গোছের পোশাকটা সভয়ে আঁকড়ে ধরে মার্শনেস প্রায় চিৎকার করে ওঠে।

    কী তা জানি না। সানসেদো বিচলিত-স্বরে বলেন, তবে এখন তাই জানবার চেষ্টাই আগে করতে হবে।

    ***

    সানসেদো না জানলেও সেভিল-এর নানা জায়গায় খবরটা তখন ছড়াতেও শুরু করেছে।

    জনতার মধ্যে এখানে সেখানে সামান্য একটু কানাকানি। বিরাট জলাশয়ে ছোট ছোট ঢিল পড়লে যেমন হয়, সেই সামান্য খবর তেমনই চারিদিকে ঢেউ তুলে ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে তখন।

    কে যে কোথায় কলকাঠি নাড়ছে তা কেউ জানে না। কিন্তু লোকের মুখে কটা প্রশ্ন আর উত্তর চালাচালি হচ্ছে প্রায় সর্বত্রই।

    কিম্ভুতকিমাকার প্রাণীটার সম্বন্ধে ভয়ের বিহ্বলতাটা তখন তীব্র কৌতূহলে। রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে।

    এটা কী আজগুবি জানোয়ার? কোথা থেকে এল? শংকিত ব্যাকুল প্রশ্ন।

    সে প্রশ্নের উত্তরও কেউ কেউ দিচ্ছে, ঠিক জানি না। তবে ওরা বলছে নতুন মহাদেশ থেকে নাকি আমদানি।

    নতুন মহাদেশের জানোয়ার! সবিস্ময়ে অবিশ্বাসের সুরে বলেছে অনেকে, এরকম জানোয়ার তো সেখান থেকে এ পর্যন্ত কখনও আসেনি!

    তা আসেনি। তবে এ হিসপানিওলা ফার্নানদিনা মেক্সিকো কি দারিয়েন-এর জানোয়ার নয়। একেবারে অজানা আর এক আশ্চর্য মুল্লুক থেকে আনা। কে আনল, কে? এনে এমন করে রাস্তায় ছেড়েই দিয়েছে কেন? ছেড়ে দেয়নি। শুনছি, কেমন করে আপনা থেকেই পালিয়ে এসেছে বন্দরের জাহাজ থেকে।

    তা কেউ ধরছে না কেন এখনও! এ জানোয়ার যে এনেছে সে-ই বা করছে কী? এত অসাবধান সে হয় কেন?

    সে আর কী করবে! সে তো শুনছি কয়েদ হয়েছে বন্দরে পা দিতেনা-দিতে পুরনো দেনার দায়ে।

    দেনার দায়ে কয়েদ!

    জনতার মধ্যে এই শুনেই আর-এক ধরনের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। সুদখোর মহাজনদের ওপর সে যুগের মানুষের ঘৃণা আক্রোশ কিছু কম ছিল না। বিশেষ করে জীবনমরণ তুচ্ছ করে যারা নতুন মহাদেশ আবিষ্কারে সর্বস্ব পণ করছে তাদের প্রতি মুগ্ধ শ্রদ্ধা ও সহানুভূতি তখন এত বেশি যে কোনও মহাজনের হাতে তাদের একজনের নিগ্রহ জনতাকে ক্রমশ অস্থির ক্রুদ্ধ করে তুলেছে।

    কাকে কয়েদ করেছে, কাকে? এই অজানা নতুন মুল্লুক থেকে কে এনেছে এই অদ্ভুত জানোয়ার? উত্তেজিত জিজ্ঞাসা শোনা গেছে নানা জটলায়।

    এনেছেন ফ্রানসিসকো পিজারো! বন্দরে পা দিয়ে তিনিই হয়েছেন বন্দি।

    ফ্রানসিসকো পিজারো!

    অনেকের কানেই নামটা একেবারে নতুন শোনায়নি।

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, এ নামটা তো একটু-আধটু তাদের কানেও পৌঁছেছে। বিশেষ করে দারিয়েন পানামা থেকে যে সব জাহাজ দেশে ফেরে তাদের কোনও কোনও মাঝিমাল্লা গল্প করেছে এক রূপকথার দেশের মতো আজগুবি রাজ্যের। সে রাজ্য খোঁজার দুঃসাহসিক অভিযানের যারা নায়ক তাদের নাম শোনা গেছে এইসব নাবিকদের মুখে। কখনও অবজ্ঞায় বিদ্রূপে, কখনও মুগ্ধ বিস্ময়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে যাঁর নাম বেশি করে রটেছে, তিনি হলেন ফ্রানসিকো পিজারো।

    সেই ফ্রানসিসকো পিজারো দেনার দায়ে বন্দি? কে তাকে বন্দি করেছে?

    করেছে ব্যালির এনসিসো।

    তা দেনা মিটিয়ে দিলেই তো হয়।

    মেটাবে কী করে? জানপ্রাণ কবুল করে নতুন দেশ যারা খোঁজে তাদের নিজের বলতে কিছু থাকে কি। অভিযানের পেছনেই সব কিছু ঢেলে তারা তো ফতুর। ব্যাচিলর এনসিসোর কাছে দেনাও তো কম নয়। প্রায় কুড়ি বছর আগের তিল প্রমাণ দেনা সুদে কেঁপে দশ-বিশটা তাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে দেনা শোধ করবার মতো সম্বল পিজারোর নেই। তাই এখন তাঁকে যতদিন বাঁচেন জেলেই পচে মরতে হবে।

    জেলেই পচে মরতে হবে। অসহায় আক্রোশ ফুটে উঠেছে নানাজনের গলার স্বরে— কেন, কেউ কি নেই তাঁর জামিন হয়ে দাঁড়াবার!

    কে দাঁড়াবে তাঁর হয়ে! সত্যি সে ক্ষমতা যাদের আছে সেই বড়মানুষরা লাভের আশা যাতে অনিশ্চিত তেমন দায় কি ঘাড়ে নয়? এখনও তো তিনি কাম ফতে করে আসতে পারেননি! ফ্রানসিসকো পিজারো দুবারের পর তিনবারের অভিযানের খরচা জোগাড় করতে পারেননি বলেই স্বয়ং সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর কাছে আসছিলেন তাঁর অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে। কিন্তু এখন সম্রাটের কাছে তাঁর খবরই পৌঁছোবে না। আশ্চর্য দেশের সামান্য যে সাক্ষীপ্রমাণ পিজারো সঙ্গে এনেছেন তা কে গাপ করবে কে জানে?

    না, কিছুতেই তা হতে দেব না! আজগুবি জনোয়ারটার ছোটাছুটি এবার আতঙ্কের বদলে একটা কঠিন সংকল্পই জাগিয়েছে নানা জায়গায় ছোট ছোট দলের মধ্যে।

    পিজারোকে দেনার দায়ে কয়েদ করার খবর সম্রাটের দরবারে পৌঁছে দিতেই। হবে। প্রতিজ্ঞা করেছে অনেকে।

    ব্যাচলর এনসিসো-র মতো একটা চামার মহাজনের জুলুমে এতবড় একজন সাহসী বীরের সব চেষ্টা কিছুতেই পণ্ড হতে দেওয়া হবে না। এই কথাই শোনা গেছে। বহুজনের মুখে।

    তাদেরই কেউ কেউ কৌতূহলী হয়ে উঠেছে পিজারোর খবর যার কাছে পাওয়া গেছে তার বিষয়েও।

    কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কী করে? জিজ্ঞাসা করেছে দু-একজন।

    আমি? মানুষটা একটু হেসেছে। তারপর যা উত্তর দিয়েছে তা সব জায়গায় এক নয়।

    কোথাও বলেছে, আমি জানব না তো জানবে কে? আমি যে পিজারোর সঙ্গে এক জাহাজেই আসছি।

    লোকে একটু অবাক হয়ে মানুষটাকে একটু বেশি করে লক্ষ করেছে এবারে।

    হ্যাঁ, মানুষটাকে আগে এ শহরে দেখেছে বলে কারও মনে পড়ে না। লোকটার চেহারা পোশাকও একটু কেমন আলাদা। নেহাত ইস্টারের উৎসবের দিন বলেই এতক্ষণ তেমন চোখে পড়েনি।

    লোকটার ভাল করে খবরাখবর নেওয়ার কিন্তু সুযোগ মেলেনি কারওই। তার আগেই কেমন করে ভিড়ের সঙ্গে মিশে লোকটা যেন হারিয়ে গিয়েছে। দেখা গিয়েছে তাকে আবার আর-এক দলে। সেখানেও পিজারোর বন্দি হওয়ার খবরটা একটু হেরফের করে শুনিয়েছে সে।

    বেশির ভাগ জায়গায় প্রশ্নটা ঘুরে তার নিজের সম্বন্ধেই ওঠবার আগেই সে হাওয়া। হয়ে গিয়েছে। যেখানে তা সম্ভব হয়নি সেখানে কোথাও বলেছে বন্দর থেকে টাটকা খবর শুনেই সে আসছে। কোথাও নিজেকে পিজারোর জাহাজের মাল্লা বলে চালিয়েছে। কোথাও বা তারই অনুচর।

    এ মানুষটার আসল পরিচয় সম্বন্ধে দু-একজন একটু সন্দিগ্ধ যে না হয়েছে তা নয়।

    কিন্তু পিজারো সম্বন্ধে উত্তেজনা সহানুভূতি ও উৎসাহ ক্রমশ দুর্বার হয়ে উঠেছে। সমস্ত সেভিল শহরে সাড়া পড়ে গেছে তখন।

    পিজারোকে কয়েদখানা থেকে ছাড়াতেই হবে। ব্যালির এনসিসো যদি তাঁকে নিজে থেকে না মুক্তি দেয়, তা হলে খোদ সম্রাটের কাছে তার জুলুমের খবর না। পৌঁছে দিয়ে তারা ছাড়বে না।

    সেভিল শহরের এ দৃঢ়সংকল্পের মূলে আছে অজানা অদ্ভুত একটা প্রাণীর। আকস্মিক আবির্ভাব। বন্দরে পিজারোর জাহাজ থেকে নামাবার সময় এই মাটি। ছাড়া পেয়ে না পালালে অমন সচকিত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠে সেভিল-এর নাগরিকেরা সেইদিনই পিজারোর দুর্ভাগ্য সম্বন্ধে অবহিত হয়ে তার প্রতিকারে তৎপর নিশ্চয় হত না। মাটি কেমন করে ছাড়া পেল? কে তাকে ছেড়ে দিয়েছিল?

    নগরের পথে পথে পিজারোর বন্দিত্বের বিবরণ যে সেদিন নানা জটলায় দিয়ে ফিরেছে সে মানুষটাই বা কে?

    বন্দর থেকে ক্লামাটির সঙ্গে আশ্চর্য দেশের অন্যতম জীবন্ত প্রমাণ হিসেবে সুদূর টম্‌বেজ থেকে আনা একজন আদিবাসীও কেমন করে নিখোঁজ হয়েছিল, পিজারোর সঙ্গী পেড্রো দে কানডিয়া তার কিনারা করতে পারেননি।

    গ্লামাটি শেষ পর্যন্ত ছুটে ছুটে ক্লান্ত হয়ে সেভিল-এর রাস্তায় ধরা পড়েছিল। কিন্তু সেই আদিবাসীর কোনও সন্ধান আর মেলেনি।

    সম্পূর্ণ অপরিচিত এক দেশের শহরে অজ্ঞ অসহায় একজন ভিন্নজগতের আদিবাসী ওভাবে উধাও হয়ে কোথায় যেতে পারে?

    দাসমশাই একটু থামতেই মস্তক যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু একটু বাঁকা হাসির সঙ্গে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু শ্রীঘনশ্যাম দাস সে-সুযোগ তাঁকে দিলেন না।

    শিবপদবাবুর মুখের হাসিটা বাঁকা থেকে সোজা করে একেবারে বিমূঢ়তায় পৌঁছে দিয়ে দাসমশাই বললেন, আপনি যা বলতে চাইছেন, তা জানি। এসব প্রশ্নের জবাব আমি যা দেব, সরকারি ইতিহাসে তা পাবেন না ঠিকই। তবে বিখ্যাত স্থপতি হেরেরা-র তৈরি লঙ্কা-র নাম শুনেছেন? তার লাল বাদামি মার্বেল পাথরের সিঁড়ি দিয়ে আচিতভা দে ইনদিয়াস-এ গিয়েছেন কখনও? সেখানে গেলে স্পেনের আদি আবিষ্কারক অভিযাত্রীদের সম্বন্ধে ত্রিশ হাজার বিরল প্রাচীন পুঁথি পাবেনা, সেসব পুঁথির অনেকগুলি এখনও যে পরীক্ষাই করা হয়নি আপনার ইতিহাসের পণ্ডিতদের জিজ্ঞাসা করলেই তা জানতে পারবেন। সেসব পুঁথির পাঠ উদ্ধার হলে স্পেনের

    ইতিহাস নতুন করে লেখা হবে এইটুকু জেনে রাখুন।

    শিবপদবাবুকে নির্বাক করে দিয়ে শ্রীঘনশ্যাম আবার শুরু করলেন—সান মার্কস-এর মিনারের কাছে আনার সঙ্গে সন্ধের সময় দেখা করবেন বলেছিলেন সানসেদো। শহরের অন্য সব রাস্তাঘাটে সন্ধ্যায় উৎসবে মত্ত নর-নারীর ভিড় বাড়বে ভয় করেই মুসলিম মিনারের কাছাকাছি নির্জন জায়গা তিনি বেছে নিয়েছিলেন আনার সঙ্গে গোপন সাক্ষাতের জন্যে।

    সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে সেকালের সেভিল-এর বেশির ভাগই সংকীর্ণ আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে সান মার্কস-এর মিনারের দিকে যেতে যেতে সানসেদো রাস্তায় তেমন কোনও ভিড় কিন্তু দেখতে পান না।

    প্রথমটা একটু অবাক হলেও রাস্তাগুলো এমন ফাঁকা হওয়ার কারণটা তিনি অনায়াসেই বুঝতে পারেন। ইস্টার উৎসবে যে জনস্রোত নানাদিক থেকে শহরে এসে মিলেছিল তার গতি এখন অন্যদিকে! শহরের ভেতর থেকে বেশির ভাগ জনতা এখন সেভিল-এর বন্দরে গিয়ে জমায়েত হয়েছে।

    বেশির ভাগ নাগরিকই সেখানে গেছে নতুন অজানা রহস্য রাজ্য থেকে আশ্চর্য সব জিনিস আর জানোয়ার নিয়ে বন্দরে নেমেই দেনার দায়ে যিনি বন্দি হয়েছে, সেই পিজারো সম্বন্ধে কৌতূহলী হয়ে।

    পিজারোর কিংবদন্তি যারা কিছু কিছু আগে শুনেছে তাদের সঙ্গে নামটা যাদের কাছে একেবারে অজানা, তারাও যোগ দিয়েছে শহরের রাস্তাঘাটের অদ্ভুত কয়েকটা। রটনার উত্তেজনায়। বিকট আজগুবি এক জানোয়ারের সামনে পড়ার ভয়েও সন্ধ্যার পর শহরের মাঝখানে বেশি কেউ আসতে সাহস করেনি।

    আলকাজার প্রাসাদের ধারে দুপুরে আনার কাছে তাড়াতাড়ি বিদায় নেবার পর সানসেদো এই অদ্ভুত জানোয়ারটির রহস্য জানবার জন্যে খোঁজখবর নিয়ে আরও অনেকের মতো পিজারোর সমস্ত বিবরণই পেয়েছেন।

    সত্যি কথা বলতে গেলে এ ব্যাপারে খুব বেশি উত্তেজিত হবার কারণ তিনি পাননি। আর পাঁচজন দুঃসাহসী অভিযাত্রীর থেকে পিজারোর কিছু তফাত আছে সন্দেহ নেই। এ পর্যন্ত যা আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে আরও অজানা বিচিত্র কোনও রাজ্যের সন্ধান যে পিজারো পেয়েছেন ওই অদ্ভুত জানোয়ারটি তার প্রমাণ। কিন্তু নতুন মহাদেশে এখনও অনেক রহস্য-বিস্ময় আবিষ্কারের অপেক্ষায় থাকারই তো কথা। শুধু ওই জানোয়ারটি দেখেই পিজারোর কীর্তি সম্বন্ধে কোনও ধারণা করা তাই উচিত নয়।

    পিজারোর বন্দি হওয়ার দুর্ভাগ্যটা সত্যি অবশ্য শোচনীয়। কিন্তু তাঁদের সময়কার দুনিয়ার হালই তো এই। বিশেষ করে নিজেদের জীবন নিয়ে অজানা মুল্লুকে যারা ভাগ্যের সঙ্গে জুয়া খেলার সাহস করে তাদের ক্ষণে হাতে দড়ি ক্ষণেকে চাঁদ-এর মতো নসিব তো মেনে নিতেই হবে। তাঁর নিজের দুর্ভাগ্যটা কি কম নিদারুণ? ছিলেন এসপানিয়ার রাজদরবারের একান্ত বিশ্বাসী মান্যগণ্য একজন কাপিন। সৎ ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে এমনই ছিল তাঁর সুনাম যে সম্রাটের খাজনা ও নজরানার সোনাদানা মেক্সিকো থেকে এসপানিয়ায় বয়ে নিয়ে আসার ভার তাঁকেই দেওয়া হয়েছে বার বার।

    সেই তাঁকেই আজ ফেরারি হয়ে বাউণ্ডুলে ভিখিরি সেজে চোরের মতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে শহর থেকে শহরে। তাঁর নিজের মেদেলিন শহরের বাড়িঘর সব নিলেম হয়ে গেছে। সেখানে কোয়ালির সেপাইরা তাঁকে খুঁজছে গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে।

    সে শহর থেকে পালিয়ে এসেও তাঁর নিস্তার নেই। রাহুর মতো একজন দুশমন তাঁর পেছনে লেগে আছে। এই শহরেও তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া বার করিয়েছে সে। এ শহরে সুতরাং বেশিক্ষণ থাকা তাঁর পক্ষে নিরাপদ নয়। এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে যাওয়াই ভাল।

    কিন্তু কোথায় বা যাবেন! এসপানিয়ার যেখানেই যান ভয়ে ভয়ে তাঁকে লুকিয়ে ফিরতে হবে। তাতেও আর ক-দিন রেহাই পাবেন! অনিবার্য অভিশাপের মতো এ হুলিয়া তাঁর পিছনে লেগে থাকবেই।

    এসপানিয়া ছেড়ে নতুন মহাদেশে পালাতে পারলে এ অভিশাপ হয়তো এড়ানো সম্ভব। কিন্তু নতুন মহাদেশে জাহাজ যা যায় তা নেহাত গোনাগুনতি। অপরাধীদের দেশ ছেড়ে পালাবার সুযোগ সে সব জাহাজে বন্ধ করবার জন্যেই বন্দরে বন্দরে কড়াকড়িটা একটু বেশি। সাধারণ চোরছ্যাঁচড় সে কড়াক্কড়ির ভেতর দিয়ে গলে যেতে পারলেও, তাঁর মতো স্বয়ং সম্রাটের কাছে যারা অপরাধী তাদের সে আশা নেই। বন্দর-কোতোয়ালদের শ্যেনচক্ষু তাদের জন্যেই সারাক্ষণ সজাগ হয়ে আছে।

    অন্য কোনও উপায় যখন নেই, রাজদ্বারেই আত্মসমর্পণ করে তাঁর বিরুদ্ধে যা অভিযোগ তা খণ্ডন করাবার চেষ্টা কি তিনি করতে পারেন না?

    কেমন করে করবেন? নিজের স্বপক্ষে কোনও সাক্ষ্যপ্রমাণই যে তাঁর নেই। সত্যিই তিনি যে এক হিসেবে হাতে হাতে ধরা পড়েছেন।

    একান্ত বিশ্বাসে তাঁর জিম্মায় মেক্সিকো থেকে এসপানিয়ায় সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এর রাজকর ও উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো প্রচুর সোনাদানা ও মহামূল্য রত্নসম্পদের অধিকাংশ তাঁর জাহাজের গোপন সুরক্ষিত সিন্দুক থেকে কীভাবে খোয়া গেছে সানসেদো তার কোনও কৈফিয়ত দিতে পারেননি।

    এসপানিয়ার বন্দরে নামবার আগে জাহাজের সিন্দুকে রাখা ধনরত্নের হিসাব মেলাতে গেলে এই সর্বনাশা তসরুফের ব্যাপারটা তিনি আগেই টের পেতেন। তখন তাঁর হয়তো এ চুরির রহস্য ভেদ করবার কিছু উপায় থাকত।

    কিন্তু জাহাজের ওপর আর-এক অপ্রত্যাশিত ঘটনায় তুমুল আলোড়ন তখন চলছে। বন্দরে ভেড়াবার আগে সিন্দুক খুলে দেখবার সময়ই তিনি পাননি।

    বন্দরে জাহাজ লাগাবার পর সম্রাটের খাজাঞ্চিখানার কর্মচারীদের কাছে সিন্দুক খুলে হিসেব মিলিয়ে দিতে গিয়েই সাংঘাতিক ঘাটতিটা ধরা পড়েছে।

    কাপিন সানসেদো এসপানিয়া সাম্রাজ্যের অনেক দিনের অত্যন্ত বিশ্বাসী নাবিকপ্রধান। ব্যাপারটা যত গুরুতরই হোক সন্দেহক্রমে তাঁকে বন্দি করার কোনও প্রশ্নই বন্দরের কোনও রাজপুরুষের মনে তাই ওঠেনি। কাপিন সানসেদো তাঁর। নিজের বিবৃতি দিয়ে বিমূঢ় বিহ্বলভাবে তাঁর মেদেলিন শহরের বাড়িতে ক-দিনের জন্যে ঘুরে আসতে গিয়েছেন। ফিরে এসে তাঁর যা বক্তব্য রাজদরবারেই তিনি পেশ করবেন এই স্থির হয়েছে।

    রাজদরবারে কৈফিয়ত দেবার জন্যে আর তিনি ফিরে আসেননি। মেদেলিন শহর থেকেই একদিন হঠাৎ তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।

    নিরুদ্দেশ না হয়ে তাঁর উপায়ও ছিল না। মেদেলিন শহরে নিজের বাড়িতে যাবার পরদিনই তাঁর জাহাজে অত্যন্ত অনুগত ও বিশ্বস্ত এক মাল্লার মারফত তাঁর বিরুদ্ধে কী সর্বনাশা ষড়যন্ত্র যে হয়েছে তা তিনি জানতে পেরেছেন। জানতে পেরেছেন যে স্বয়ং সম্রাটের স্বাক্ষরিত পরোয়ানা নিয়ে সওয়ার সেপাই আসছে মেদেলিনের কোতোয়ালিতে তাঁকে গ্রেপ্তার করাবার জন্যে।

    তখনও কি তিনি নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করবার জন্যে এই অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারতেন না?

    না, তা সম্ভব ছিল না। পৃথিবীর সর্বত্রই তখন ন্যায়বিচারের ধারণা অত্যন্ত অস্পষ্ট। বিচারের ফলাফল বেশির ভাগই দৈবাধীন।

    তা ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে যে সাংঘাতিক অভিযোগ করা হয়েছে বলে তিনি জানতে পেরেছেন সত্যিই তা খণ্ডন করবার মতো কোনও বিশ্বাসযোগ্য যুক্তি-প্রমাণ উপস্থিত করতে তিনি তখন অক্ষম।

    জাহাজের গুপ্ত সিন্দুক তাঁরই জিম্মায় ছিল। তার চাবি নিজের কাছছাড়া করাও তাঁর পক্ষে অপরাধ। সে সিন্দুক থেকে ওই সব অমূল্য সম্পদ তিনি নিজে ছাড়া আর কে সরাতে পারে?

    সরিয়ে তিনি রাখবেন কোথায়? তিনি তো ঝাড়া হাত-পা জাহাজ থেকে নেমে সেই অবস্থাতেই মেদেলিনে গিয়েছেন!

    সানসেদোর প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস যাদের তখনও টলেনি তারা কেউ কেউ ওই প্রশ্ন তুলেছে।

    কিন্তু সানসেদোর বিরুদ্ধে ওই ভয়ংকর অভিযোগ যে সাজিয়েছে, জবাব দিতে তার দেরি হয়নি।

    কাপিন সানসেদো নিজে সরিয়ে রাখবেন কেন! তিনি তাঁর দোসর সেই গোলামটার হাত দিয়ে সব চুরির মাল পাচার করে সাধু সেজেছেন। তাঁর যোগসাজস থাকলে বন্দরের ওই কড়া পাহারার ভেতর দিয়ে সে গোলাম পালাতে পারে? এ ষড় যে তিনি অনেক আগেই করেছিলেন জাহাজে গোলামটার সঙ্গে তাঁর গলাগলি দেখেই তা বোঝা গেছল।

    এ-সব যুক্তি সাজাবার গুণে একেবারে অকাট্য বলে মনে হয়েছে। এর ওপর আর। বলবার মতো কথা কেউ পায়নি। কাপিন সানসেদোর বিরুদ্ধে অভিযোগ তাঁর জাহাজ থেকে একটা ছদ্মবেশী গোলামের রহস্যজনকভাবে উধাও হওয়ার দরুনই। অখণ্ডনীয় হয়ে উঠেছে।

    ক্রীতদাস বলে ধরা পড়বার পর একজন যে তাঁর জাহাজ থেকে পালিয়েছিল। একথা তো মিথ্যে নয়। তাঁর সঙ্গে সেই ছদ্মবেশী গোলামের যথেষ্ট সম্প্রীতি যে ছিল তাও জাহাজের যাত্রীমাত্রেই দেখেছে।

    সুতরাং আত্মসমর্পণের চেষ্টা তাঁর বৃথা। ঘটনাচক্র সম্পূর্ণ তাঁর বিপক্ষে বুঝে সানসেদো নিঃশব্দে নিরুদ্দেশ হওয়াই শ্রেয় মনে করেছেন।

    তার ফলে প্রাণে এখনও বেঁচে আছেন বটে, কিন্তু রাজরোষে যথাসর্বস্বই তাঁকে হারাতে হয়েছে। পালিয়ে যাবার দরুন তাঁর অপরাধ আরও অভ্রান্তভাবে প্রমাণিত বলে যে ধরা হবে তা তিনি জানতেন। তবু এ ছাড়া আর কোনও উপায় তাঁর ছিল না।

    সানসেদো তো সুদূর উদয়সমুদ্রের এক ঐশ্বর্যময় দেশের আশ্চর্য জ্যোতিষবিদ্যা। কিছুটা শেখবার সুযোগ পেয়েছিলেন। ঘনরামের ভবিষ্যৎ তিনিই গণনা করে বলে দিয়েছিলেন অনেকখানি। অন্যের ভাগ্যলিপি যিনি অমন নিপুণভাবে পড়েছেন নিজের অদৃষ্ট জানবার কোনও চেষ্টা কি তিনি করেননি।

    করেননি সত্যিই। জ্যোতিষবিদ্যার হাতেখড়ি যাঁর কাছে তাঁর হয়েছিল এ তাঁর সেই গুরুরই আদেশ।

    মৃত্যুর আগে নিজের বিদ্যা যতখানি সম্ভব সানসেদোকে দান করে এই অলঙ্ঘ্য নির্দেশই তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন যে নিজের ভবিতব্য নির্ধারণের জন্যে এ-বিদ্যা কখনও যেন তিনি প্রয়োগ না করেন।

    সানসেদো তখন অবশ্য বিস্মিত হয়েছিলেন এ আদেশে। একটু ক্ষুণ্ণও বোধহয়।

    আপনি নিজে তো আপনার বিধিলিপি সম্পূর্ণ জানেন বলেই মনে হয়। তা হলে আমার প্রতি কেন এ নির্দেশ? জিজ্ঞাসা করেছিলেন সেই আশ্চর্য প্রৌঢ়কে।

    তোমার প্রতি এ-নির্দেশ প্রথমত বিদ্যা তোমার অসম্পূর্ণ বলে, বলেছিলেন স্থৈর্যের প্রতিমূর্তি সেই সৌম্য মানুষটি, এ খণ্ডিত বিদ্যা নিজের জন্যে প্রয়োগ করলে অকারণ উদ্বেগ আর অশান্তিকেই নিত্যসঙ্গী করে শুধু নিজেকে নিয়েই তুমি তন্ময় থাকবে। এ বিদ্যা তা হলে হবে নিষ্ফলা।

    একটু থেমে তিনি আবার প্রশান্ত গভীর স্বরে বলেছিলেন, এ বিদ্যা তোমার সম্পূর্ণ হলেও নিজের ভাগ্যলিপি পাঠ করার বিষয়ে এই নিষেধই তোমায় জানাতাম।

    কেন?সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছিলেন সানসেদো, সম্পূর্ণ বিদ্যা নিয়ে আপনি কি নিজের অদৃষ্টলিপি আদ্যোপান্ত পাঠ করেননি?

    তা করেছি। স্নিগ্ধ করুণ অপরূপ একটি হাসি ফুটে উঠেছিল সেই আশ্চর্য মানুষটির মুখে। ধীরে ধীরে তিনি বলেছিলেন, কিন্তু নিজের নিয়তি নির্ভুলভাবে জেনেও জীবনের ভার অকাতরে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাওয়ার কঠিনতম পরীক্ষা সকলের জন্যে নয়। যতটুকু বিদ্যা পেয়েছ অপরের জন্যে যথাসাধ্য প্রয়োগ করে, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের বদলে নিজের বেলা প্রত্যক্ষ বর্তমান নিয়েই ব্যাপৃত থেকো।

    সানসেদো গুরুর সেই নির্দেশই একান্ত বাধ্যতার সঙ্গে পালন করে এসেছেন।

    প্রলোভন যে আসেনি তা নয়, দুর্বলতাও হয়েছে। কিন্তু তা তিনি জয় করেছেন শেষ পর্যন্ত।

    এবার এসপানিয়ার মাটি ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাস্য নিদারুণ ভাগ্যবিপর্যয়ের পর নিজের সম্বন্ধে অটল থাকা বুঝি সবচেয়ে কঠিন হয়ে উঠেছিল।

    কিন্তু সে কঠিন পরীক্ষায়ও তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন। ব্যাকুলতা যত তীব্ৰই হোক গণনার সাহায্যে নিজের ভবিষৎ জানবার চেষ্টা তিনি করেননি, সামনে যা উপস্থিত সেই ঘটনাপ্রবাহ থেকেই নিজের গতিবিধি ও কর্তব্য নির্ধারণের চেষ্টা করেছেন।

    মেদেলিন শহর থেকে নিরুদ্দেশ হবার পর যে কোনও মুহূর্তে ধরা পড়বার আশঙ্কা সত্ত্বেও একটি লক্ষ্য নিয়ে এসপানিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত সমস্ত শহর বাউণ্ডুলে ভিখিরির সাজে তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন।

    সে লক্ষ্য হল তাঁর বিরুদ্ধে অতবড় মিথ্যা অভিযোগ যে সাজিয়েছে তাকে খুঁজে বার করা।

    তাকে খুঁজে বার করলেই অবিশ্বাস্যভাবে তাঁর জাহাজের বন্ধ সিন্দুকের ঐশ্বর্য লোপাট হবার রহস্য ভেদ করা সম্ভব হবে কি না সানসেদো জানেন না, কিন্তু তাঁর কল্পনাতীত ভাগ্যবিপর্যয়ের মূল কারণে পৌছোবার আর কোনও উপায় তিনি ভেবে পাননি।

    এক ছদ্মবেশী ক্রীতদাসের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সম্রাটের উদ্দেশ্যে ্পাঠানো মহামূল্য। সব নতুন মহাদেশের সম্পদ চুরি করেছেন বলে সাংঘাতিক অভিযোগ কাপিতান সানসেদোর বিরুদ্ধে সাজিয়েছিল কে, তা বোধহয় আর বলতে হবে না।

    যার সঙ্গে বিশেষ প্রীতির সম্পর্কের দরুনই সানসেদো গভীরভাবে সন্দেহভাজন, এসপানিয়ার বন্দরে জাহাজ ভেড়বার পর রহস্যজনকভাবে পলাতক সেই ছদ্মবেশী ক্রীতদাসই বা কে, তা-ও সম্ভবত এখন কারও অগোচর নয়।

    ক্রীতদাস আর কেউ নয়, সেই ঘনরাম দাস আর কাপিন সানসেদোর বিরুদ্ধে অভিযোক্তা হল ঘনরাম দাসের কাছে জুয়ায় জুয়াচুরির চেষ্টায় চরম শিক্ষা-পাওয়া সেই সোরাবিয়া, মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস বলে এসপানিয়ার খানদানি সমাজে যে এখন পরিচিত।

    কিন্তু মেক্সিকো বিজয়ী কর্টেজ-এর নিজের স্বাক্ষরিত মুক্তিপত্র সত্ত্বেও ঘনরাম দাসকে আবার ছদ্মবেশে ক্রীতদাসের পরিচয় লুকোবার শাস্তি এড়াতে পলাতক হতে হয় কেন?

    নিজেকে রমণীমোহন মনে করার গর্বে আত্মহারা, অসাধু, অপদার্থ জুয়াড়ি সোরাবিয়াই বা মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস হয়ে ওঠে কী করে?

    এ দুই রহস্য হয়তো একসঙ্গেই জড়ানো। একটির সমাধান হলেই আর একটির উত্তর আপনা থেকে মিলে যাবে।

    বাউন্ডুলে ভিখিরির বেশে কাপিন সানসেদো সেই আশাতেই সান মার্কস-এর মিনারের তলায় আনার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে ব্যাকুলভাবে এদিকে প্রায় নির্জন হয়ে আসা সেভিল-এর সংকীর্ণ রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেন।

    আনা-র সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়েছে মাত্র সম্প্রতি। সে যে এখন সামান্য আনা নয়, মার্শনেস গঞ্জালেস দে সোলিস এই সংবাদই তাঁর কাছে বিস্ময়কর। কিন্তু তার। চেয়ে বড় বিস্ময় হল আনার স্বামী মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর আসল পরিচয়। এই জমকালো খানদানি উপাধির আড়ালে সোরাবিয়াই যে গা ঢাকা দিয়ে আছে তা তিনি আগে কল্পনা করতে পারেননি।

    এসপানিয়ার শহরে শহরে ঘুরেও কেন যে সোরাবিয়ার খোঁজ এতদিন তিনি পাননি এই সেভিল শহরে এসে আকস্মিকভাবে আনা-র সঙ্গে দেখা হবার পরই তিনি। প্রথম বুঝতে পেরেছেন। তিনি যেখানে সোরাবিয়াকে সন্ধান করে ফিরেছেন মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস সে জগতের মানুষ আর নয়।

    আনার সঙ্গে দৈবাৎ সেভিল-এর একটি রাস্তায় দেখা না হয়ে গেলে সোরাবিয়ার নামের এ রূপান্তর তাঁর কাছে অজানাই থেকে যেত। আনাকে তাঁর নতুন আভিজাত্যের চেহারা পোশাকে দেখে বিস্মিত হলেও সানসেদো সেই সঙ্গে অত্যন্ত খুশিও হয়েছেন। তিনি যখন সোরাবিয়াকে অধীরভাবে খুঁজে ফিরছেন তখন আনা যে আবার তাঁরই সন্ধানে ব্যাকুল এইটুকু তাঁর জানা ছিল না।

    আনার কাছে অনেক কিছুর উত্তর তিনি চান, কিন্তু আনা তাঁকে কেন খুঁজেছে তা তিনি ঠিক বুঝতে পারেননি।

    বেশ একটু উদ্বেগ-চঞ্চল মন নিয়েই সানসেদো সান মার্কস-এর মিনারের নীচে গিয়ে দাঁড়ান। জায়গাটা একেবারে নির্জন। আনা তখনও সেখানে এসে পৌঁছায়নি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আনার দেখা পাওয়া যায় না। সানসেদো এবার অত্যন্ত উদ্বিগ্ন অধীর হয়ে ওঠেন। হঠাৎ তাঁর মনে হয় আনা বোধহয় আর তাঁর সঙ্গে দেখা করবে না।

    একথা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সানসেদোর মন হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। আনার সঙ্গে দেখা না হলে তাঁর বিরুদ্ধে যে সাংঘাতিক অভিযোগ দাঁড় করানো হয়েছে তার মূল রহস্য জানবার আর বুঝি কোনও উপায় নেই।

    আনা তাঁর সঙ্গে দেখা করার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত মত বদলাতে পারে এমন কথা সত্যিই তিনি ভাবতে পারেননি।

    পারলে যত বিপদই থাক, সেই দুপুরবেলাই আনার কাছে যা জানবার তা জেনে নেবার চেষ্টা করতেন।

    শুধু পথে-ঘাটে ভিড় অত্যন্ত বেশি বলে নয়, সম্ভ্রান্ত মহিলার পোশাকে আনাকে তাঁর মতে ভিখিরির সঙ্গে বেশিক্ষণ দেখলে লোকে সন্দিগ্ধ হয়ে উঠতে পারে এই কারণেও সানসেদো তখনকার মতো আনাকে ছেড়ে দিয়ে সন্ধ্যায় এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিলেন।

    তাঁর সামান্য একটা চিরকুটে লেখা চিঠির ডাকেই সকালে আনাকে অমনভাবে সান্তা মারিয়া দে লা ক্যাথিড্রালে উপস্থিত হতে দেখেই সন্ধ্যায় তার কথা রাখার বিষয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন তিনি।

    এখন কিন্তু তাঁর সন্দেহ গভীর হতে শুরু করে।

    সত্যিই আনার মতো মেয়ে, আজ মার্শনেস গঞ্জালেস দে সোলিস বলে যার। পরিচয়, সে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে এত কষ্ট করে কোনও ঝক্কি নিতে যাবে কেন!

    তাঁকে তিয়ো বলে ভক্তি শ্রদ্ধা এককালে সত্যিই করত সন্দেহ নেই। তাঁর কাছে। সে সময়ে যে স্নেহ, সাহায্য ও প্রশ্রয় পেয়েছে তার জন্যে মনে হয়তো একটু কৃতজ্ঞতাও ছিল। সেই জন্যেই তাঁর প্রথম চিঠি পেয়ে তার আহ্বান উপেক্ষা করতে পারেনি।

    কিন্তু তারপর একটা অভাগা বুড়ো ভিখিরির জন্যে নিজের মান-মর্যাদা যাতে খোয়াতে হতে পারে এমন ঝক্কি নেবার কী দায় তার পড়েছে। একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল তা-ই যথেষ্ট।

    সোরাবিয়া তাঁর নামে এখানেও যে হুলিয়া বার করেছে তা কি আনার অজানা? স্বামীর এ শয়তানিতে তার সায় না থাক, বাধাও সে নিশ্চয় দেয়নি।

    না, আনার সঙ্গে দ্বিতীয়বার দেখা হওয়ার আশা করাই সানসেদোর ভুল হয়েছে। তাঁর কাছে এককালে যত স্নেহ আদরই পেয়ে থাক, সে যে সারাবিয়ার স্ত্রী হয়েছে। এই থেকেই তার স্বরূপ বোঝা তাঁর উচিত ছিল।

    অথচ আনাকে চিনে তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাওয়ার পর কত আশাই না তিনি করেছিলেন! ভেবেছিলেন তাঁর অদৃষ্টকে এইবার বুঝি তিনি রাহুমুক্ত করতে পারবেন।

    আনার দেখা তিনি পেয়েছিলেন অবশ্য নেহাতই দৈবাৎ। তাকে খোঁজবার কোনও চেষ্টাই তিনি ভাগ্য বিপর্যয়ের পর করেননি।

    তিনি সোরাবিয়ার খোঁজেই ভিখিরি বাউন্ডুলের বেশে শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।

    সোরাবিয়া অত্যন্ত নীচ চরিত্রের ইতর জুয়াড়ি। তার মতো লোকের যে রকম। আস্তানা ও আড্ডা হতে পারে সানসেদো প্রতি শহরের সেই সব জায়গার আশেপাশেই টহল দিয়ে ফিরেছেন।

    সোরাবিয়ার দেখা সেসব মহলে কোথাও না পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন সত্যিই।

    সোরাবিয়ার মতো মানুষ হঠাৎ চরিত্র শুধরে সাধুপুরুষ হয়ে উঠেছে এ তো বিশ্বাস করবার মতো কথা নয়। হাঁসকে পুকুর থেকে ঠেকিয়ে রাখা যায়, কিন্তু জুয়ার আড্ডা থেকে সোরাবিয়ার সরে থাকা অসম্ভব।

    বিশেষ করে তাঁর যা অনুমান তা একেবারে ভ্রান্ত না হলে সোরাবিয়ার জুয়ার মহলে এখন বড় চাঁই হিসেবেই পরিচিত হওয়া উচিত।

    সে জগতে তাকে খুঁজে না পেলে আবার সে দরিয়া পার হয়ে নতুন মহাদেশে পাড়ি দিয়েছে ভাবতে হয়।

    কিন্তু মেক্সিকো থেকে যে বেশ একটু দাগি হয়ে ফিরেছে তার পক্ষে আবার সাগর পাড়ি দেওয়া খুব সহজ নয়। তা ছাড়া আসলে লোকটা শুধু কপট শঠ ইতর নয়, অলস আয়েসিও বটে। নতুন মহাদেশে ভাগ্যোন্নতির ধকল সইতে সে সাধ করে পা বাড়াবে না।

    তা হলে মানুষটা হঠাৎ এমন উধাও হতে পারে কী করে কাপিন সানসেদো ভেবে পাননি।

    তিনি যখন শহরের আজেবাজে পাড়ায় জুয়াড়ি সোরাবিয়াকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন তখন সে যে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস হয়ে হয়তো তাঁর চোখের সামনে দিয়েই কখনও-সখনও সাড়ম্বরে চলে গেছে তা তিনি আর কেমন করে জানবেন।

    ও ধরনের রাজাগজার দিকে তখন তাঁর নজরই নেই।

    সোরাবিয়াকে না দেখুন, আনাকে হঠাৎ একদিন সেভিল-এর এক গরিবানী পাড়াতেই তিনি দেখেছেন।

    প্রথমে অবশ্য আনাকেও তিনি চিনতে পারেননি। ভিখিরি সাজলে তার অভিনয়টাও নিখুঁত রাখতে হয়। সানসেদো তাঁর ভবঘুরে ভিখিরির পোশাকে সে দিক দিয়ে ত্রুটি রাখেন না। তাঁর মতে ভিখিরিদের যা দস্তুর, বড় মানুষ দেখলেই সেই মতো ভিক্ষের হাত পাতেন।

    গরিব পাড়া দিয়ে লাগাম ধরে নফরের ধরে নিয়ে যাওয়া জমকালো সাজের ঘোড়ায় চেপে সম্ভ্রান্ত চেহারা পোশাকের এক মহিলাকে যেতে দেখে রাস্তার আরও তাঁর মতো দু-একজন ভিখিরির সঙ্গে হাত বাড়িয়েছিলেন একটা পেসোর জন্যে।

    ভিক্ষে তিনি পাননি। সম্ভ্রান্ত মহিলার নফর তাঁদের ধমকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। কিন্তু সেই সময়টুকুর মধ্যেই আনাকে চিনতে সানসেদোর ভুল হয়নি।

    আনা তাঁকে অবশ্য চিনতে পারেনি। চেনবার কথাই নয়। তাচ্ছিল্য ভরে-সে তাঁর দিকে একবার চেয়েছে কি না সন্দেহ। সেই এক পলকের নজরে ভেঁড়া-খোঁড়া পোশাকের সঙ্গে ফেরার হওয়া অবধি এক মুখ দাড়ি গোঁফে যা চেহারা হয়েছে তার আড়ালে কাপিন সানসেদোকে চেনা সম্ভব নয়।

    আনাকে এই অপ্রত্যাশিত ভূমিকায় দেখে সানসেদোর বিস্ময় কৌতূহল যেমন তীব্র হয়েছে, মনে আশাও জেগেছে তেমনই গভীর।

    তখন আনার সঙ্গে সোরাবিয়ার দাম্পত্য সম্বন্ধের কথা তিনি জানেন না। তবু তাঁর মনে হয়েছে তাঁর জাহাজের রহস্যোদঘাটনের ব্যাপারে আনার কথাটাও তাঁর ভাবা উচিত ছিল।

    আনার সম্ভ্রান্ত মহিলা হিসেবে নতুন পরিচয় জেনে তার সঙ্গে দেখা করার উপায় তারপর সানসেদোকে ভাবতে হয়েছে।

    ভিক্ষে না পেয়ে যেন ক্ষুণ্ণ হয়ে রাস্তার একজনকে তিনি জিজ্ঞাসা করেছেন, কনোথে উস্তেদ আ এসা সেনিয়েরা?

    তাঁর প্রশ্নে যতটা নয় তাঁর মুখের কিনোথে শুনে লোকটা একটু কৌতুকের বাঁকা হাসি হেসে জিজ্ঞাসা করেছে, তুমি আন্দালুসিয়ার লোক নয়, কেমন?

    সানসেদো নিজের ভুলটা ততক্ষণ বুঝে ফেলেছেন। কনোসের বদলে কনোথে বলে গোড়াতেই সেভিল যার প্রধান শহর সেই আন্দালুসিয়ার বাইরের লোক বলে নিজের পরিচয় ধরিয়ে দেওয়াটা তাঁর ঠিক হয়নি।

    তাড়াতাড়ি ভুলটা সামলে বলেছেন, না, এখানকারই লোক, তবে কাস্তিলএ অনেকদিন কাটিয়েছি।

    সে তোমার দুধে জিভের কনোথে শুনেই বুঝেছি, বলে লোকটা একটু অবজ্ঞা ভরেই হেসেছে। ভবিষ্যতে সমস্ত স্পেনের রাজভাষা যা হয়ে উঠবে তখনও তার কদর তেমন বেশি হয়নি।

    আন্দালুসিয়ার কয়েকটা দন্ত্য স কাস্তিল-এর আধো আধো থ হয়ে তখন বিদ্রূপ জাগায়।

    শ্রীঘনশ্যাম দাস তাঁর ভাষাতত্ত্বের গভীর জ্ঞান জাহির করে বোধহয় যথোচিত। তারিফের জন্যেই থেমেছেন, মোক্ষম সংলাপ বলতে রঙ্গমঞ্চের জাঁদরেল অভিনেতারা যেমন হাততালির সময় দেবার জন্যে থামেন।

    তারিফের তাঁর অভাব হয়নি। মুগ্ধ স্তুতি ফুটে উঠেছে উদরদেশ যাঁর কুম্ভের মতো স্ফীত ভোজনবিলাসী সেই রামশরণবাবু আর মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণবাবুর মুখে চোখে।

    শুধু মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই ইতিহাসের অধ্যাপক শিবপদবাবু পাণ্ডিত্যের এ আতশবাজিতে সম্পূর্ণ উদাসীন থেকে জিজ্ঞাসা করেছেন অগোপন ঈষৎ অধৈর্যের সঙ্গে, স আর থ-এর মারপ্যাঁচ এখন রাখুন। আপনার সানসেদো আসলে জিজ্ঞেস করেছিল কী?

    অজ্ঞ বর্বরদের প্রতি যেন করুণার দৃষ্টি বিতরণ করে দাসমশাই একটু হাসলেন। তারপর বললেন, জিজ্ঞেস করেছিল—ওই মহিলাকে কি চেনেন!

    মহিলা! রাস্তার লোকটি আবার হেসে উঠেছিল কৌতুকভরে। তারপর বলেছিল—ওঁকে শুধু মহিলা ভাবছ নাকি, উনি সাধারণ সেনিয়োরা নন, দস্তুরমতো মার্শনেস। কিছুদিন হল স্বামী মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর সঙ্গে সেভিল-এর শোভা বাড়াচ্ছেন।

    আমুদে আর রসিক বলে সেভিল-এর লোকের তখনই খ্যাতি ছিল। সানসেদো তাই লোকটির কৌতুকের খোঁচাগুলো গায়ে মাখেননি। আরও খোঁজখবর নিয়ে শেষ পর্যন্ত মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর আবাস খুঁজে বার করেছেন, আর সেখানেই। আনার সঙ্গে দেখা করবার সুযোগের জন্যে বাইরে ঘোরাঘুরির সময় স্বয়ং মার্কুইসকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছেন। আনার মার্শনেস হওয়া বিস্ময়কর হলেও সোরাবিয়া-র মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস হওয়া তাঁর সত্যিই কল্পনাতীত।

    সোরাবিয়াই মার্কুইস রূপে আনার স্বামী হওয়ায় ব্যাপারটা যত জটিলই হয়ে উঠুক, সানসেদোকে আনার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করতেই হয়েছে! সে বাড়ির একজন পরিচারককে ঘুষ দিয়ে আনার কাছে গোপনে একটি চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। সে চিঠিতে আনাকে সান্তা মারিয়া দে লা সেদে ক্যাথিড্রালের কাছে ইস্টারের পরবের দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ ছিল।

    সে চিঠি আনা ঠিকই পেয়েছে। কিন্তু তার আগে সোরাবিয়া স্বয়ং। কারণ বাড়ির প্রত্যেকটি চাকর তার চর।

    আনাকে লেখা সানসেদোর গোপন চিঠি চর পরিচারক প্রথমে তার প্রভু মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিসকেই দিয়েছিল।

    মার্কুইস অর্থাৎ সোরাবিয়া সে-চিঠি পড়ে ছিঁড়ে ফেলতেও পারত। কিন্তু ছিঁড়ে সে ফেলেনি। বরং আনার হাতে সে-চিঠি পৌঁছে দেবার হুকুমই দিয়েছিল তার পরিচারককে। ” ” আনা চিঠি পড়ে সানসেদোর সঙ্গে দেখা হবার আশায় সান্তা মারিয়া দে লা সেদে ক্যাথিড্রালে গেলে তাকেই টোপ করে সানসেদোকে নিজের হাতে ধরবে এই ছিল সোরাবিয়ার ফন্দি। এইজন্যেই গাঁইয়া চাষির ছদ্মবেশে সে আনাকে অনুসরণ করে ফিরেছে সেদিন।

    তার সে-ফন্দি যে সফল হয়নি, তা আমরা জানি।

    সফল না হবার কারণ এই যে, কাপিন সানসেদোও আগে থাকতে সাবধান হয়ে গিয়ে আনার সঙ্গে ক্যাথিড্রালের কাছে দেখা করবার কোনও চেষ্টা করেননি।

    আনাকে অবশ্য তিনি চোখে চোখে রেখেছিলেন দূর থেকে, আর তারই দরুন আনা না পারলেও সোরাবিয়ার ছদ্মবেশ গোড়াতেই ধরে ফেলেছিলেন আনার পিছনে তার লেগে থাকবার ভঙ্গি দেখে।

    কাপিন সানসেদো আগে থাকতে সাবধান হতে পেরেছিলেন সোরাবিয়ার অতিরিক্ত উৎসাহের দরুন। সানসেদোকে ধরার আগ্রহাতিশয্যে সে তাঁর চিঠি পড়বার পরই সেভিল-এর কোতোয়ালিকে সজাগ করে দিয়ে সেখান থেকে সানসেদোর নামে হুলিয়া বার করাবার ব্যবস্থা করে।

    তেঁড়া পিটে সে-হুলিয়ার কথা শহরে জানানো হয় বলেই কাপিন সানসেদো আগে থাকতে সোরাবিয়ার ফন্দি সম্বন্ধে সাবধান হবার সুযোগ পান।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
    Next Article মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }