Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প632 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ১৩. মার্কুইস আর মার্শনেস গঞ্জালেস

    মার্কুইস আর মার্শনেস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে যাবার মুখে সন্ধ্যার অন্ধকারে কে যে ঘনরাম দাসের পথ আটকে ছিল তা এতক্ষণে বোধহয় বোঝা গেছে।

    পথ আটকে দাঁড়িয়েছিলেন আর কেউ নয়, স্বয়ং কাপিন সানসেদো।

    কাপিন সানসেদো আনার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় বহুক্ষণ অপেক্ষা করার পর প্রথমে অত্যন্ত ক্ষুণ্ণ আর তার পরে সত্যি উদ্বিগ্ন হয়ে তার বাড়িতেই আনার সন্ধানে এসেছিলেন।

    সানসেদো প্রথম ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন আনা তাঁর সঙ্গে দেখা করাটা ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে মনে করে।

    একটু ভেবে দেখবার পর আনার পক্ষে এরকম তাচ্ছিল্য বেশ অস্বাভাবিক বলেই তাঁর মনে হয়েছে।

    সোরাবিয়ার স্ত্রী হিসেবে আনার মার্শনেস হওয়া একটা রহস্য নিশ্চয়। কিন্তু যেভাবেই এ আভিজাত্যের ছাপ সে পেয়ে থাকুক, তাঁর সঙ্গে ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন তার মধ্যে দেখা যায়নি। উন্নাসিক ঔদ্ধত্যে তাঁকে তাচ্ছিল্য করলে তাঁর একটা চিঠির চিরকুট পেয়েই অমনভাবে নিজেকে বিপদে ফেলে ক্যাথিড্রালে তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে সে ছুটে আসত না।

    আনার ভাব-গতিক দেখে তখন এই কথাই মনে হয়েছে যে, তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যে সে নিজেও বিশেষ কোনও কারণে ব্যাকুল।

    তা সত্ত্বেও যথাস্থানে যথাসময়ে আনা যদি উপস্থিত না হয়ে থাকে তা হলে তার অন্য কোনও গুরুতর কারণই সম্ভবত আছে। সেই কারণটা ভাবতে গিয়ে সানসেদো উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

    সোরাবিয়া প্রথম সাক্ষাতের ব্যবস্থার সময় ক্যাথিড্রালে কীভাবে ছদ্মবেশে আনাকে চোখে চোখে রেখেছিল তা তিনি দেখেছেন। তাঁদের এ দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ব্যর্থ করার মূলে তারই কি কোনও শয়তানি আছে? সে শয়তানি কী হতে পারে অনুমান না করতে পারার দরুনই আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে কাপিন সানসেদো শেষ পর্যন্ত আনার বাড়িতেই তার খোঁজ নেবার জন্যে না এসে পারেননি।

    এভাবে আসা যে কতখানি বিপদের তা তাঁর অজানা নয়। যে সোরাবিয়া হিংস্র ব্যাধের মতো তাঁকে সন্ধান করে ফিরছে, এখানে আসা মানে সাধ করে তার-ই খপ্পরে পড়া। তবু কাপিন সানসেদোকে নিরুপায় হয়ে এ দুঃসাহস করতে হয়েছে।

    বাড়ির কাছে এসেও কীভাবে আনার খোঁজ নেওয়া যায় তাই নিয়েই হয়েছে। মুশকিল। সোজাসুজি বাড়ির দেউড়িতে গিয়ে খোঁজ নেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। যা সম্ভব তা হল দূর থেকে লক্ষ রেখে চাকর-দাসী কাউকে বাড়িতে ঢুকতে কি সেখান থেকে বার হতে দেখলে জিজ্ঞাসাবাদ করার সুযোগ নেওয়া।

    বহুক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোনও চাকর-দাসীর সাড়াশব্দ কিন্তু পাননি। বাড়িটাই কেমন অস্বাভাবিক রকম নিস্তব্ধ মনে হয়েছে। সন্দেহ হয়েছে সেখানে বুঝি কেউ নেই।

    সন্দেহ নিরসনের একমাত্র উপায় বাড়ির দরজায় গিয়ে ঘা দেওয়া কিংবা গোপনে। কোনওরকমে ভেতরে গিয়ে ঢোকা।

    দেউড়ির দরজায় ঘা দেওয়া যখন তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়, তখন বাড়িতে গোপনে ঢোকবার উপায় খুঁজতে হয়।

    সোলিস-এর এ সব বাড়ির ছক তাঁর জানা। বাড়িগুলি পুরনো আমলের মুরদের রীতিতে তৈরি। মাঝখানের একটি বিস্তৃত উদ্যান-প্রাঙ্গণকে ঘিরে সাধারণত এ সমস্ত। বাড়ির ঘরগুলি সাজানো থাকে। আনাদের বাড়িটা এ ধরনের একটু উঁচুদরের ইমারতের মতো দোতলা।

    এ সব বাড়ির সুবিধা এই যে, মাঝখানের উদ্যান-প্রাঙ্গণে কোনওরকমে গিয়ে পৌঁছোতে পারলে লুকিয়ে থাকবার ব্যবস্থা একটা করা যায়। বেশির ভাগ উদ্যান প্রাঙ্গণেই একটি করে ফোয়ারা থাকে মাঝখানে। তারই সঙ্গে চারিদিকে নানা ফুলের গাছ ও লতার কুঞ্জ। সে বাগিচায় তেমন কোনও পাহারা থাকে না বললেই হয়।

    বয়সে প্রৌঢ় হলেও সানসেদো অথর্ব একেবারেই হননি। অন্ধকারের মধ্যে বাইরের দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে ঢোকবার সুবিধে কোথাও আছে কি না তিনি এবার খোঁজবার চেষ্টা করেছেন।

    কিন্তু বেশিক্ষণ তার সুযোগ মেলেনি। হঠাৎ রাস্তায় ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনে তাঁকে চমকে উঠতে হয়েছে। নিঃশব্দে রাস্তার এক অন্ধকার কোণে তিনি তারপরে সরে দাঁড়িয়েছেন! ঘোড়ার পায়ের শব্দ তখন থেমে গেছে। ঘোড়াটা রুখে তা থেকে সাবধানে যে নেমেছে আবছা অন্ধকারেও তাকে চিনতে সানসেদোর দেরি হয়নি।

    লোকটি যে সোরাবিয়া তা আমরাও ইতিমধ্যে জেনেছি। নিজের সত্য ভঙ্গ করে ঘনরামকে আনার বিছানায় বাঁধা অবস্থায় ফেলে রেখে সে ইতরভাবে অপমান করবার জন্যে স্ত্রী আনাকেই খুঁজতে গেছল। তাকে না পেয়ে ফিরে চোরের মতো সন্তর্পণে নিজের বাড়িতে ঢুকেছে।

    সানসেদো এসব ব্যাপারের কিছু জানেন না। সোরার্বিয়ার নিজের বাড়িতে ঢোকার অদ্ভুত ধরনে আরও সন্দিগ্ধ ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে তিনি অধীরভাবে বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেছেন। বিপদ যতই থাক, আনার জন্যেই বাড়ির ভেতরে খোঁজ করতে পারেন কি না এই নিয়ে তাঁর মনে তখন প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্ব চলছে।

    ধৈর্য ধরতে না পেরে বাড়ির ভেতরেই ঢুকতে যাবেন এমন সময় ঘনরাম দাস দ্রুতপদে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন।

    মানুষটা যে সোরাবিয়া নয়, শরীরের গড়নেই তা বুঝে সানসেদো আরও বিস্মিত চমকিত হয়ে তার পথ আগলে দাঁড়িয়েছেন। তারপর রুক্ষ স্বরে বলেছেন, দাঁড়াও। কে তুমি?

    এই উত্তেজিত ব্যস্ততার মধ্যে নিরস্ত্র একটা ভিখিরি গোছের পোশাকের লোকের কথা ঘনরাম অনায়াসে অগ্রাহ্য করতেও পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। অগ্রাহ্য

    করবার কারণ এই যে, আবছা অন্ধকারে ভিখিরি গোছের মানুষটার চেহারা দেখা। না গেলেও তার গলার স্বরটা ঘনরামের মনে কোথায় যেন একটা ক্ষীণ সাড়া তুলেছে।

    বিনা প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে পড়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষটাকে অন্ধকারের মধ্যে চেনার চেষ্টা করে মুখে একটু কৌতুকের স্বরে ঘনরাম বলেছেন, এ বাড়ি থেকে বার হবার পরও পরিচয় জিজ্ঞাসা করবার দরকার হয়? সেভিল শহরে কে না জানে যে এ বাড়ি মহামান্য মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর।

    এ বাড়ি তার হতে পারে কিন্তু তুমি সে মার্কুইস নও! সানসেদো কঠিন স্বরে বলেছেন এবার, বলো তুমি কে?

    আমি! ঘনরাম মানুষটিকে চিনতে পেরে এবার হেসে উঠেছেন হঠাৎ, মার্কুইস হলে আমায় তো গোলাম হতে হয়। মনে করুন আমি এক ফেরারি গোলাম।

    বহুকাল আগে কাপিন সানসেদো বলে এক নাখোদার জাহাজ থেকে এই সেভিল-এর বন্দরেই পালিয়ে ছিলাম।

    কয়েক মুহূর্ত বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থেকে সানসেদো উচ্ছ্বসিতভাবে বলে উঠেছেন দাস! তুমি? এ যে আমার কল্পনাতীত!

    আপনাকে এ বেশে এখানে দেখাও আমার পক্ষে তাই! সানসেদোকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যেতে যেতে ঘনরাম বলেছেন, কিন্তু এখানে আর থাকা আমাদের দুজনের কারও পক্ষেই নিরাপদ নয়! পরস্পরের অনেক কিছুই আমাদের জানবার আছে। নির্ভয়ে কিছুক্ষণ কাটাতে পারি এমন আস্তানায় তাই এখন যাওয়া দরকার।

    কিন্তু সে রকম জায়গা সেভিল-এ পাবে কোথায়? বিষণ্ণ স্বরে বলেছেন সানসেদো,ফেরারি গোলাম হয়ে কোন সাহসে কীভাবে এ শহরে তুমি এসেছ জানি

    না, কিন্তু এ শহরে তোমার চেয়ে আমার বিপদ এখন কম নয়। সোরাবিয়া আমার বিরুদ্ধে এখানে হুলিয়া বার করিয়েছে তা বোধহয় জানেন না!

    না জানলেও আপনার চেহারা পোশাক দেখে সে রকম একটা কিছু অনুমান করেছি। তিক্ত স্বরে বলেছেন ঘনরাম, সমস্ত ইতিহাস তাই শুনতে চাই।

    সে ইতিহাস তা হলে এই রাত্রে পথে পথে ঘুরেই তোমাকে শোনাতে হবে। কিন্তু এখন আমার পক্ষে তা সম্ভব নয়। রাস্তার মাঝেই থেমে পড়ে বলেছেন সানসেদো, আমার অভিশপ্ত জাহাজের আনাকে নিশ্চয় তুমি ভোলোনি। সেই আনার খবর না নিয়ে এখান থেকে আমি যেতে পারব না। এ বাড়িতে আসার দুঃসাহস কেন তোমার হয়েছিল জানি না, কিন্তু বাড়িটা যখন তোমার চেনা তখন আনা যে এখন মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস অর্থাৎ সোরাবিয়ার স্ত্রী তা-ও তোমার জানা উচিত। এই আনার খোঁজ নেবার জন্যেই আমি এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার সম্বন্ধে দুর্ভাবনার কারণ সত্যিই ঘটেছে!

    সে দুর্ভাবনা এখন আপনি ঝেড়ে ফেলতে পারেন। ঈষৎ কৌতুকের স্বরে জোর দিয়েই বলেছেন ঘনরাম, আপনার ভাগ্নি আনা সম্পূর্ণ নিরাপদ এটুকু আশ্বাস আপনাকে দিতে পারি। দুর্ভাবনা যদি করতে হয় তা হলে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর জন্যেই বোধহয় করা উচিত।

    তার মানে? সানসেদো বিমূঢ় হয়েই জিজ্ঞাসা করেছেন।

    মানেটা আমার বিবরণ শুনলেই বুঝবেন। একটু হেসে বলেছেন ঘনরাম, আপনার ইতিহাস শোনবার ও আমারটা শোনাবার সুবিধামতো আস্তানায় এখন শুধু যাওয়া দরকার।

    কিন্তু সে আস্তানা সেভিল শহরে তো পাওয়া যাবে না। হতাশভাবে বলেছেন সানসেদো, রাত্তিরটুকু পথে পথে যদিবা কাটাতে পারি, সকাল হলেই সমস্ত শহর তো আমাদের শত্ৰুপুরী।

    না, আশ্বাস দিয়ে বলেছেন ঘনরাম, আমাদের মতো অভাগাদের নিশ্চিন্তে গা-ঢাকা দিয়ে থাকবার জায়গা এ শহরে আছে। সেখানে প্রায় সবাই দাগি, সুতরাং ঝোড়ো কাকের পালে নেহাত হাঁস কি কবুতর না হলে কারও নজর পড়ে না।

    কোথায় সে জায়গা? সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করেছেন সানসেদো।

    এই সেভিল শহরেই নদীর ওপারে ত্রিয়ানায়। জানিয়েছেন ঘনরাম, কুমোরদের কাজ আর গান-বাজনার জন্যে ত্রিয়ানার সারা স্পেনে যত সুনাম তত দুর্নাম চোর আর বেদেদের চিরকেলে আস্তানা বলে। চলুন রাতারাতি নদী পার হয়ে যেতে পারলে কিছু দিনের মতো অন্তত নিশ্চিন্ত।

    নদী পার হয়ে সেই ত্রিয়ানায় গিয়েই দুজনে সে রাত্রে উঠেছেন। বেশি দিন সেখানে কাটানো কিন্তু সম্ভব হয়নি। ত্রিয়ানায় তাঁদের লুকিয়ে থাকার অসুবিধে অবশ্য কিছু ছিল না। সেই ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ত্রিয়ানা সত্যিই বেপরোয়া বাউণ্ডুলেদের স্বর্গ ছিল। স্পেনের বেদেদের সেটা ছিল বড় গোছের একটা ঘাঁটি। যত রাজ্যের চোর-ছ্যাঁচড়দেরও সেটা ছিল মনের মতো আস্তানা। তারাও বেদেদের মতোই ভাগ্যের স্রোতে ভাসা শ্যাওলা। আজকের খোরাক জুটলে কালকের ভাবনা কেউ ভাবে না। তারা যার যেমন মর্জি আর পুঁজি সেই মাফিক সেখানে ফুর্তি নাচ-গান খানা-পিনাতেই মেতে থাকত। সবাই সেখানে ছুঁচ বলে চালুনির পেছনে লাগবার গরজ কারও ছিল না। ইচ্ছে করলে কাপিন সানসেদো আর ঘনরাম যতদিন খুশি। সেখানে অজ্ঞাতবাসে থাকতে পারতেন।

    কিন্তু শুধু নিবাপদ থাকাই তাঁদের লক্ষ্য নয়। পিজারোর পরিণামের সঙ্গে ঘনরাম নিজেকে জড়িয়েছেন। ত্রিয়ানায় নিশ্চিত হয়ে বসে থাকা তাঁর চলে না। সানসেদোর ব্ৰত আলাদা। নিজের অবিশ্বাস্য ভাগ্যবিপর্যয়ের মূলে কী রহস্য আছে তা তাঁর ভেদ

    করলেই নয়। সেই জন্যেই ত্রিয়ানায় নিরাপদ আশ্রয় না ছেড়ে তাঁর উপায় নেই!

    পরস্পরের সমস্ত বিররণ শুনে মূল রহস্য সম্পূর্ণ ভেদ না করতে পারলেও নিজেদের সংকল্পে তাঁরা আরও কঠিন হয়েছেন। ত্রিয়ানায় থাকতে থাকতেই টোলেডোর সম্রাটের দরবারে পিজারোর সসম্মানে নিমন্ত্রণের খবর তাঁদের কাছে পৌঁছেছে। ঘনরাম ও সানসেদো দুজনেই এবার যে যার নিজের পথে যাবেন স্থির করেছেন। আলাদা হবার আগে শুধু একটি দুরূহ কাজ তাঁদের সম্পন্ন করতে হবে। সে কাজ হল সানসেদোর অত্যন্ত মূল্যবান একটি সম্পদ তাঁর মেদেলিন শহরের স্পেন সরকারের বাজেয়াপ্ত বাড়ি থেকে উদ্ধার করে আনা।

    এ মূল্যবান সম্পদ সোনা-দানা হিরে-মুক্তো কিছু নয়। একটি চামড়ার থলের মধ্যে রাখা কয়েকটা কাগজপত্র মাত্র। সেগুলির মধ্যে একটি কাগজ আবার কাপিন সানসেদোর কাছে সবচেয়ে দামি।

    ত্রিয়ানা ছেড়ে যে যার নিজের পথে যাবার সংকল্প করবার পরই সানসেদো অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে এই কাগজটির কথা ঘনরামকে বলেন। নিজের একটা অঙ্গের বিনিময়েও এ কাগজটি উদ্ধার করতে তিনি প্রস্তুত। সানসেদোর মুখে এ কথা শোনবার পর ঘনরাম বেশ অবাক হয়েই জিজ্ঞাসা করেন, কাগজটা কী বলুন তো? কোনও দামি সম্পত্তির দলিল!

    না, দলিল নয়, একটা চিঠি, বলেন সানসেদো।

    একটা চিঠি! ঘনরাম অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেন, একটা চিঠির এত দাম

    আপনার কাছে? কার লেখা সে চিঠি? কাকে লেখা? আপনাকে?

    না, আমাকে নয়। বিষণ্ণ স্বরে বলেন সানসেদো, সে চিঠি কাকে লেখা তা জানি। যে ভাষায় লেখা তা আমার অজানা। সুতরাং সে চিঠি পড়েও কিছু বোঝবার ক্ষমতা আমার নেই। সে চিঠির দাম আমার কাছে এত বেশি যিনি লিখেছেন শুধু তাঁর জন্যে।

    কে তিনি?

    ক্রীতদাস হিসেবে যাঁকে কিনে মুক্তি দিতে পেরে আমি ধন্য হয়েছি, যাঁর কাছে জ্যোতিষ গণনার যৎসামান্য পাঠ নেবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, তিনি সুদূর উদয় সাগরের দেশের সেই অসামান্য পুরুষ।

    একটু থেমে সানসেদো আবার বলেন, তাঁর নিজের গণনা যদি সত্য হয় তা হলে তাঁর এ লিপির বাহক যথাসময়েই পাওয়া যাবে। কিন্তু তার আগে সেটি আমার হাতে থাকা তো দরকার। রাজরোষের খবর পাওয়ার পর গোপনে মেদেলিন শহরের বাড়ি ছেড়ে আসবার ব্যস্ততায় এই কাগজটি আমি ভুলে ফেলে আসি। নিজের সে অপরাধ আমি কখনও ক্ষমা করতে পারব না।

    সানসেদোর কথা শেষ হবার পর ঘনরাম কিছুক্ষণ যেন উদাসীনের মতো নীরব থেকে হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেন, আপনার মেদেলিন শহরের বাড়ি তো সেখানকার কোতোয়ালির জিম্মায়? অন্য কেউ সে বাড়ির দখল নিয়েছে কি না জানেন?

    তা ঠিক জানি না। সানসেদো বলেন, তবে না নেবারই কথা। আমরা তা হলে মেদেলিন শহরেই প্রথমে যাচ্ছি। দৃঢ়স্বরে বলেন ঘনরাম, আপনার পূজনীয় গুরুর গচ্ছিত করা লিপি উদ্ধারই এখন আমাদের প্রথম কাজ।

    কিন্তু–?

    সানসেদোর উদ্বিগ্ন প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়ে ঘনরাম আবার বলেন, কেমন করে তা সম্ভব তা-ই ভাবছেন? চারিদিকে একবার চোখ বুলিয়ে দেখুন, ফিকিরফন্দি সামনে। সাজানো রয়েছে। এই জন্যেই মনে হচ্ছে আমাদের ত্রিয়ানায় আসার মধ্যে নিয়তির হাতই ছিল।

     

    সেভিল শহরে কিছুকাল গা ঢাকা দিয়ে থাকবার জন্যে সানসেদোকে নিয়ে গুয়াদালকুইভির নদীর ওপারে চোর-ছ্যাঁচড় আর বেদেদের আস্তানা ত্রিয়ানায় ওঠার মধ্যে নিয়তির হাত আছে বলে মনে করেছিলেন ঘনরাম।

    নিয়তির হাত ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কারণ ত্রিয়ানায় গিয়ে ক-দিন না কাটালে সানসেদোর গুরুর গচ্ছিত করা লিপি উদ্ধারের অমন ফন্দি ঘনরামের মাথায় বোধহয় আসত না।

    ফন্দিটা অবশ্য ভালই, কিন্তু তার দরুন নিয়তির হাতটা ঠিক কল্যাণের বোধহয় বলা চলে না।

    কারণ মেদেলিন শহরে এই ফন্দি খাটাতে গিয়েই ঘনরাম সানসেদোর সঙ্গে ধরা পড়েন।

    ধরা পড়েন আবার যার-তার নয়, একেবারে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এরই হাতে।

    এইখানেই বুঝি নিয়তির কারসাজি। নইলে মার্কুইস হঠাৎ মেদেলিন শহরে ঠিক ওই সময়টিতেই হাজির থাকে কী করে?

    নিয়তি মানতে হলে বলতে হয় যে তার হাতের চাল অনেক আগেই শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে কর্টেজ যেদিন টোলেডোের মহাফেজখানায় যেতে যেতে মার্কুইসকে দেখে একটু কৌতূহলী হয়ে তার পরিচয় জানতে চেয়েছিলেন সেইদিন থেকেই।

    পরিচয় শুনেও তাঁর মনের ধোঁকা পুরোপুরি যায়নি। ঠিক চিনতে না পারলেও মানুষটা সম্বন্ধে মনে কোথায় একটা যেন খোঁচা থেকে গেছে। কী যেন তার সম্বন্ধে জানলেও স্মরণ করতে পারছেন না বলে মনে হয়েছে।

    মনের এ সংশয় দূর করা কিছু শক্ত নয়। মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর বিশদ বৃত্তান্ত সরকারি দফতরে গিয়ে জানতে চাইলেই হয়। বংশানুক্রমে যাঁরা অভিজাত আর অসামান্য কোনও কীর্তির জন্যে সম্রাট যাঁদের আভিজাত্যে প্রতিষ্ঠিত করেন তাঁদের সকলের বিস্তারিত পরিচয় ও বিবরণ লিপিবদ্ধ করে রাখার বিশেষ দফতর আছে।

    মার্কুইস তো আর যেমন তেমন পদবি নয়। এ পদবি যাঁরা পান তাঁরা হয় খানদানিদের মধ্যে বংশপরিচয়ে নৈকষ্যকুলীন, নয়তো অসামান্য কীর্তিধর।

    গঞ্জালেস দে সোলিস বলে কোনও বনেদি বংশের কথা কর্টেজ মনে করতে পারেননি। তবে সেটা এমন কিছু বড় কথা নয়। তিনি নিজে এমন কিছু খানদানি নন। অর্ধেক জীবন বিদেশে কাটিয়ে স্পেনের সব বড় ঘরোয়ানার নাম জানবার সুযোগই বা কতটুকু পেয়েছেন! সুতরাং মার্কুইস-এর কোনও বনেদি বড় ঘরোয়ানা হওয়া অসম্ভব নয়। আর তা যদি না হয় তা হলে নিশ্চয়ই স্পেনের রাজদরবারকে মুগ্ধ ও বাধিত করবার মতো কিছু তিনি করেছেন।

    মার্কুইস-এর সঙ্গে দেখা হবার পর দিনই কর্টেজ আসল ব্যাপারটা কী জানবার কৌতূহলে উপযুক্ত দফতরে যাবার জন্যে রওনা হয়েছিলেন, সেখানে পৌঁছে মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর বিবরণটুকু জানতে পারলেই সমস্ত রহস্য কর্টেজ-এর কাছে পরিষ্কার হয়ে যেত।

    এ কাহিনীর বেশ কিছু জটও তা হলে ছেড়ে যেতে পারত এখান থেকেই।

    কিন্তু তা হবার নয়। ভাগ্য এইখানেই বাদ সেধেছে।

    দফতরে যাবার পথে কর্টেজ হঠাৎ বাধা পেয়েছেন। রাজদরবারে এক দূত তাঁকে। ছুটে এসে ধরে জানিয়েছে যে, সম্রাটের টোলেডো ছেড়ে যাবার বিশেষ তাড়া থাকায় সেইদিনই কর্টেজকে রাজদর্শনের অনুমতি দিয়ে অনুগ্রহ করেছেন।

    কর্টেজ-এর দফতরখানায় যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। ব্যস্ত হয়ে বাসায় ফিরে রাজ-সাক্ষাতের জন্যে তাঁকে যথোচিত পোশাক-পরিচ্ছদ আর কাগজপত্র নিয়ে তৈরি হতে হয়েছে।

    সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎটা কর্টেজ-এর পক্ষে মোটেই প্রীতিকর হয়নি। মেক্সিকোর মতো রাজ্য আবিষ্কার ও জয় করে কুবেরের ভাণ্ডার যিনি সম্রাটের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁর যথোচিত মর্যাদা দিতে স্পেনের রাজদরবার কার্পণ্য করেছে। আশাভঙ্গের ক্ষোভে দুঃখে কটেজ-এর মন থেকে অন্য সমস্ত চিন্তা দূর হয়ে গেছে তখন।

    মাকুস গঞ্জালেস দে সোলিস-এর সঙ্গে টোলেডোর দরবারে কি রাস্তাঘাটে এরপর এক-আধবার দেখা হলে কর্টেজের কৌতূহলটা আবার হয়তো মাথা চাড়া দিয়ে দিত। কিন্তু সেই প্রথম সাক্ষাতের দিনের পর টোলেডোতে মার্কুইসকে কর্টেজ কেন, কেউই

    আর দেখেনি।

    দেখবে কোথা থেকে? কর্টেজ-এর সঙ্গে দেখা হবার পর সে রাতটা পর্যন্ত মার্কুইস টোলেডোতে কাটায়নি। সেই সন্ধ্যাতেই পাততাড়ি গুটিয়ে টোলেডোের টাগুস নদীর সান মার্টিন পোল পেরিয়ে উধাও হয়ে গেছে।

    এ রকম হন্তদন্ত হয়ে টোলেডো ছাড়ার কারণ কি কটেজ-এর সঙ্গে ওই আকস্মিক সাক্ষাৎ?

    তাই বলেই তো মনে হয়। কর্টেজ না পারলেও এক পলকের দেখাতেই কর্টেজকে চিনতে মার্কুইস-এর ভুল হয়নি। চিনতে পেরে প্রতিক্রিয়া যা হয়েছে তা একটু অদ্ভুত। লক্ষ করবার কেউ থাকলে সেই মুহূর্তে মাকুস-এর ছাই মেড়ে দেওয়া মুখ দেখে একটু অবাকই হত।

    কর্টেজকে এতখানি ভয় করবার কী আছে মার্কুইস-এর? যাই থাক, সে রহস্যের মীমাংসা এখন হবার নয়।

    আপাতত কর্টেজ-এর নজর এড়িয়ে পালিয়ে মার্কুইস ঘনরাম আর সানসেদোরই। জীবনের শনি হয়ে উঠেছে।

    মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস অর্থাৎ সোরাবিয়া টোলেডো থেকে সেভিল-এ ফিরে যায়নি। সেখানে ফিরে যাবার কোনও আকর্ষণও তার নেই। সেভিল-এর বাসা থেকে দলিত ফণিনীর মতো প্রতিহিংসার জন্যে উন্মাদিনী স্ত্রীকে কোনও রকমে ফাঁকি দিয়ে সে রাত্রে যে পালাতে পেরেছে এই তার সৌভাগ্য। আনা সেখানে এখনও থাক বা না থাক, সে বাড়িতে ফিরতে সে এখন আর প্রস্তুত নয়।

    একদিকে কর্টেজ-এর ত্রিসীমানা ছাড়িয়ে আর একদিকে স্ত্রী আনার নাগালের বাইরে নিশ্চিন্তে কিছুদিন কাটাবার পক্ষে মেদেলিন শহরের সুবিধার কথাই সারাবিয়ার প্রথমে মনে হয়েছে। মেদেলিন শহরে কাপিন সানসেদোর ভিটেমাটি স্পেন সরকার রাজদ্রোহের দায়ে বাজেয়াপ্ত করেছে। সে জন্যে আর হুলিয়ার ভয়ে সানসেদো সে শহরের ধার অন্তত মাড়াবে না। আনার পক্ষেও মেদেলিন শহরে যাওয়া তাই প্রায় অসম্ভব। আনা এখন সাহায্য আর পরামর্শের জন্যে তার তিয়ে সানসেদোর সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই যে ব্যাকুল তা সেভিল-এর ক্যাথিড্রালে তার সেদিনকার ব্যাকুল ছোটাছুটি থেকেই বোঝা গেছে। সানসেদোর যেখানে যাবার সম্ভাবনা নেই সেখানে আনা সাধ করে বেড়াতে যাবে না নিশ্চয়। তার নতুন আস্তানা হিসেবে মেদেলিন শহরের সুবিধা তাই অনেক। এ শহর আস্তানা হিসেবে বাছবার সময় শুধু এই কথাটাই সোরাবিয়ার জানা ছিল না যে মেদেলিন কর্টেজ-এর জন্মস্থান।

    মার্কুইসরূপী সোরাবিয়া টোলেডো থেকে একটু ঘুরপথে মেদেলিন শহরেই গিয়ে উঠেছে তারপর। সেখানে গিয়ে কোয়ালি থেকে খবর নিয়ে সানসেদোর বাড়ি তখনও নিলেমে ওঠেনি জেনে খুশি হয়েছে অত্যন্ত। যেখানে যেমন দরকার টাকা খাইয়ে এ বাড়ি সুবিধামতো কিনে নিতে পোরাবিয়াকে খুব বেগ পেতে হয়নি।

    তার সব মতলবই এ পর্যন্ত প্রায় নির্বিঘ্নে হাসিল হবার পর আরও এমন একটি ব্যাপার ঘটেছে যা যেমন সুখের তেমনই তার আশাতীত।

    মেদেলিন শহরে সানসেদোর বাড়িতে সোরাবিয়া তখন সবে সাজিয়ে গুছিয়ে বসবার আয়োজন করছে। নিজে সে তখনও সে বাড়িতে এসে ওঠেনি। শহরের এক সরাই-এ থেকে ঠিকাদারকে দিয়ে বাড়িটার যেখানে যা দরকার অদল-বদল মেরামত করাচ্ছে।

    সেই সময়ে একদিন একদল বেদেকে সেখানে ঘোরাঘুরি করতে দেখে ঠিকাদারই তাদের ভেতরে ডাকে।

    স্পেনে বেদেদের আমদানি তখনও খুব বেশিদিন হয়নি। চুরি-চামারি করার দুর্নাম সত্ত্বেও রকমারি নাচ-গান আর ভূত-ভবিষ্যৎ বলার ক্ষমতার জন্যে সাধারণের কাছে তাদের আদর-খাতির যথেষ্ট।

    ঠিকাদার প্রথমে অবশ্য বেদেদের ধমক দিয়েই সেখানে ঘুর ঘুর করার কারণ জিজ্ঞাসা করে। ধমক-ধামক দিয়ে তাদের কাছে একটু গানবাজনা শোনাই তার। মতলব ছিল বোধহয়। কিন্তু বেদেদের সর্দার গোছের একজন তার ধমকের জবাবে যা বলে তা শুনে ঠিকাদারের চক্ষুস্থির।

    বেদেরা মিছিমিছি এ বাড়ির কাছে ঘোরাফেরা করছে না। এ বাড়িতে কেউ যা ভাবতে পারে না এমন গুপ্তধনের ইশারা নাকি তারা গুণে পেয়েছে।

    অন্য কোথাও হলে যদি বা সন্দেহ হত, কাপিন সানসেদোর বাড়িতে গুপ্তধন থাকা এমন কিছু আজগুবি বলে ঠিকাদারের মনে হয় না। কাপিন সানসেদো যে সম্রাটের জন্যে মেক্সিকো থেকে পাঠানো সোনাদানা গাপ করে ফেরারি, মেদেলিন শহরের কে না তা জানে। সে চোরাই মাল সানসেদোর এই বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে পুঁতে রাখা অসম্ভব কিছু নয়।

    ঠিকাদার লুব্ধ উৎসাহিত হয়ে বেদেদের গুপ্তধন খোঁজবার অনুমতি দেয়। খুঁজে পেলে তাদের মোটা বকশিশ। মালিক সোরাবিয়া তখনও এসে পৌছোয়নি। তার হয়ে এ আশ্বাস দিতে তবু ঠিকাদারের বাধে না।

    বেদেরা গুপ্তধন খোঁজার ক্রিয়া-প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। গুপ্তধন তারা যে বার করবেই এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, শুধু জায়গাটা নির্ভুলভাবে খোঁজবার জন্যে তাদের একটা জিনিস দরকার।

    কী জিনিস?

    এ বাড়ির যে আসল মালিক তার নিজের নাড়াচাড়া জিনিস কিছু।

    এ বাড়ির আসল মালিক তো ছিল সানসেদো। কিন্তু তার জিনিস এখন পাওয়া যাবে কোথায়? নাড়াচাড়া যা যায় সব তো এতদিনে মীরমিদনরাই লুঠপাট করে নিয়ে গেছে।

    কিছুই তা হলে নেই?

    হ্যাঁ, আছে বটে, পুড়িয়ে দেবার মতো কিছু কাগজপত্রের বাণ্ডিল? হবে তাতে কাজ?

    দেখাই যাকবলে বেদেরা।

    কাজ কিন্তু হয় না। বেদেরা সে কাগজ-পত্র ফিরিয়ে দিয়ে আবার খড়ি পেতে গুনতে বসে।

    আর ঠিক সেই সময়ে এসে হাজির হয় নতুন মালিক মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস।

    এ সব কী ব্যাপার? জ্বলে উঠে জিজ্ঞাসা করে সোরাবিয়া।

    ঠিকাদার উত্তেজিতভাবে বেদেদের গুপ্তধন খোঁজার কথা তাকে জানায়।

    কিন্তু নতুন মালিককে দেখে বেদেরাই কেমন যেন গুপ্তধন খোঁজার উৎসাহ হারিয়ে সরে পড়বার জন্যে ব্যাকুল। দু-জন বাদে সবাই তারা সরে পড়বার সুযোগও পায়।

    ধরা যে দু-জন পড়ে প্রথমে তাদের দেখেই হিংস্র উল্লাসে চিৎকার করে লোকজনের ভিড় জমিয়ে ফেলেছে সোরাবিয়া।

    তা সত্ত্বেও একজন বোধহয় ইচ্ছে করলে অনায়াসে সোরাবিয়া আর তার দলবলকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাতে পারত। তা সে দেখায়নি শুধু তার সঙ্গীর জন্যে। সঙ্গীটির প্রথম দিকেই পালাতে গিয়ে বেকায়দায় পড়ে একটি পা মচকে যায়। তাকে নিয়ে পালানো যায় না! তাকে ফেলে যাওয়াও অসম্ভব হয়েছে দ্বিতীয় জনের। সে তাই স্বেচ্ছাতেই ধরা দিয়েছে সঙ্গীর আপত্তি সত্ত্বেও।

    পা-ভাঙা সঙ্গীটি যে কাপিন সানসেদো আর তাঁরই জন্যে নিজের মুক্তির সুযোগ যিনি উপেক্ষা করেছেন তিনি যে ঘনরাম দাস তা বোধহয় বলার প্রয়োজন নেই। ত্রিয়ানার বেদেদের দিয়ে কাজ হাসিলের ফন্দি তাঁদের পক্ষে সর্বনাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    এক সঙ্গে এই দু-জনকে গারদে ভরতে পারার সৌভাগ্য সোরাবিয়া বোধহয় কল্পনাও করতে পারেনি। খুশিতে ডগমগ হয়ে কয়েদখানায় দু-জনের যথোচিত সমাদরের জন্যে মেদেলিন-এর অ্যালগুয়াসিল অর্থাৎ নগর কোটালকে সে একদিন ভোজ দিয়েই আপ্যায়িত করেছে।

    নগর কোটাল অকৃতজ্ঞ নয়। ঘনরাম আর কাপিন সানসেদোকে এমন এক গারদে পাঠাবার ব্যবস্থা হয়েছে যা কবরখানারই শামিল। যারা সেখানে একবার গিয়ে ঢোকে তারা আর কোনওদিন বার হয় না। বাইরের পৃথিবী থেকে তাদের নামই মুছে যায়।

    তাদের নাম বাইরের জগৎ ভুলে গেলেও বাইরের খবর তাদের কাছে পৌঁছোয়। সে রকম আগ্রহ থাকলে যমদূতের মতো রক্ষীদের দিয়েই সে খবর সংগ্রহ অসম্ভব হয় না।

    শুধু আগ্রহ নয়, তার সঙ্গে অবশ্য একটু উৎকোচও দরকার। উৎকোচ দেবার মতো কিছু ঘনরাম বা সোরাবিয়ার কাছে থাকবার কথা নয়। কিন্তু ঘনরাম কী কৌশলে কে জানে বন্দি হওয়ার পরও কিছু পয়সাকড়ি লুকিয়ে সঙ্গে রাখতে পেরেছিলেন। তাঁদের বেদের পোশাকের দরুন তল্লাশিও বোধহয় তেমন ভাল করে কেউ করেনি। তা ছাড়া একরকম জীবন্ত কবরই যাদের দেওয়া হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কী রইল না রইল, তা নিয়ে মাথাব্যথা আর কীসের?

    পেসোটা-আসটা ঘুষ দিয়ে ঘনরাম খবর যা বাইরের জগতের পেয়েছেন তা প্রথমে খুশি হবার মতোই মনে হয়েছে। একটু অস্পষ্ট গোলমেলেভাবে হলেও জানা গেছে যে পিজারো বলে কে একজন নাকি সমুদ্র পারের নতুন এক সোনার দেশ দখল করবার হুকুম পেয়েছে সম্রাটের কাছে। সে নাকি জাহাজ সাজিয়ে তৈরি হচ্ছে পাড়ি দেবার জন্যে।

    সানসেদো আর ঘনরাম যেমন খুশি তেমনই একটু অস্থির হয়ে উঠেছেন এ খবরে। গারখানায় বন্দি অবস্থায় ঘনরাম সানসেদোকে যতখানি দরকার, পিজারোর অভিযান আর তার লক্ষ্য সম্বন্ধে জানিয়েছেন। পিজারোর অভিযানের বিষয়ে সানসেদো তখন আর নির্লিপ্ত উদাসীন নন।

    খুশি হওয়ার সঙ্গে তাঁদের অস্থিরতা শুধু নিজেদের মুক্তির কোনও আশা না দেখে।

    যে গারদে তাঁদের রাখা হয়েছে তার অন্য বিষয়ে শাসন তেমন কড়া না হলেও সেখান থেকে বার হবার কথা ভাবাও বুঝি বাতুলতা। সমুদ্রের তলায় পাতালে বন্দি থাকলে বাইরের জগতের মুখ আবার দেখবার যতটুকু আশা থাকে এ গারখানাতেও তার বেশি কিছু নেই।

    দেখতে দেখতে দুই-তিন-চার-পাঁচ মাস কেটে গেছে। এবার যা খবর পাওয়া গেছে তা বেশ একটু ভাবিয়ে তোলবার মতো।

    এ খবর রক্ষীদের কাছে নয়, পাওয়া গেছে নতুন এক কয়েদির কাছ থেকে। পিজারোর নাকি দারুণ মুশকিল হচ্ছে লোক-লশকর জোগাড় করতে। আর কিছুদিনের মধ্যে তা জোগাড় করতে না পারলে তাঁকে কথার খেলাপের জন্যে কাঠগড়ায় উঠতে হবে।

    এ খবর যে এনেছে সে নিজেও একজন বার দরিয়ার মাল্লা। হিসপানিওলা ফার্নানদিনা পর্যন্ত এর আগে ঘুরে এসেছে জাহাজে। পিজারোর অভিযানের রংদার গুজব শুনে কাজ নিতে সেভিল-এ গেছল। সেখানে কিন্তু উলটো খবর শুনেছে। ওসব খোলামকুচির মতো সোনা সস্তার গালগল্প নাকি শুধু বোকাদের ঠকিয়ে জাহাজে তোলবার ফিকিরে বানানো। পিজারোর জাহাজে নাম লেখাবার চেষ্টা না করেই সে তাই ফিরে এসেছে। তারপর মেদেলিন শহরে এক গুঁড়িখানায় হল্লা মারামারি করে চালান হয়েছে এই গারদে।

    পিজারোর দুরবস্থার এ খবর শোনবার পর সানসেদো হতাশ হয়েছেন, আর ঘনরাম গুম হয়ে থেকেছেন কয়েকদিন।

    তারপর এক রাত্রে পারাহাদার এক রক্ষী ঘনরাম আর সানসেদোর গারদ কুঠুরির পাশ দিয়ে শেষ টহল দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ চমকে থেমে গেছে। ভাল করে নজরবন্দি রাখবার জন্যে সোরাবিয়ার পরামর্শ মতোই এ দুজনকে এক কুঠুরিতে রাত্রে বন্ধ রাখা হয়।

    কুঠুরির ভেতর থেকে চুপি চুপি কী আলাপ শোনা যাচ্ছে। চাপা গলায় হলেও কথাগুলো না বোঝবার মতো অস্পষ্ট নয়।

    সে আলাপের যেটুকু মর্ম রক্ষী বুঝেছে তাইতেই তার চোখ তখন ছানাবড়া। চুপি চুপি আলাপটা তারপর হঠাৎ একেবারে তুমুল ঝগড়া হয়ে উঠে তাকেও চমকে দিয়েছে।

    দু-জনে রাগে খেপে গিয়ে পরস্পরকে যা নয় তাই বলতে বলতে বুঝি খুনই করে ফেলে।

    অন্য রক্ষীরাও ছুটে এসেছে দারুণ গোলমালে। দরজা খুলে দু-জনকে ছাড়িয়ে দিয়ে কুঠুরির দু-পাশে বেঁধে ফেলে রাখবার ব্যবস্থা হয়েছে তারপর।

    এমনিভাবে দু-দিন কেটেছে ঘনরাম আর সানসেদোর।

    দু-দিন বাদেই কিন্তু আর তাদের দেখা যায়নি। গারখানার পাথরের দেওয়াল যেন হাওয়ার চেয়েও সূক্ষ্মদেহে তাঁরা ভেদ করে চলে গেছেন।

    তারপর শেষ পর্যন্ত যেখানে গিয়ে তাঁরা উঠেছেন পিজারোর সেই খাস জাহাজ আচমকা সেভিল-এর বন্দর ছেড়ে কেমন করে লুকিয়ে পালায় সে বিবরণ আমরা আগেই জেনেছি।

    পনেরোশো ত্রিশ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের এক গাঢ় কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রে সেভিল-এর বন্দরে বাঁধা তাঁর জাহাজ বিনা হুকুমেই হঠাৎ যেন ভৌতিক নির্দেশে গুয়াদালকুইভির নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়ায় বিমূঢ় ব্যাকুলভাবে তার কারণ সন্ধান করতে গিয়ে পিজারো হাল চালাবার টঙে কাপিন সানসেদোকে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করে তাঁর কাছে জাহাজ এভাবে নিঃশব্দে গোপনে ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়ায় অদ্ভুত কৈফিয়তের সঙ্গে আর একটি এমন কথা শোনেন যা সত্যিই কৌতূহল জাগাবার মতো।

    কাপিন সানসেদো গোপনে জাহাজ ছাড়ার ব্যাপারে অবিশ্বাস্য যে-সব কাণ্ড-কারখানা করেছেন তাতে তিনি পরামর্শ ও সাহায্য পেয়েছেন নাকি আর-একজনের কাছে। তাঁর সে সঙ্গী সহায় নাকি সেই জাহাজেই বর্তমান।

    কে সে লোকটা? একটু রূঢ়ভাবেই জানতে চান পিজারো। কাপিন সানসেদোর কৈফিয়তটা যতই মনে ধরুক, তাঁর ওপর খোদকারি করে জাহাজ নিয়ে পালাবার ফন্দির স্পর্ধাটা তখনও পিজারো পুরোপুরি বরদাস্ত করতে পারছেন না।

    সে লোকটার পরিচয় আর কী দেব! দেবার মতো কিছু নেই, হেসে বলেন সানসেদো, এই জাহাজেই সে আছে, সময় মতো আপনার সামনে হাজির হবে।

    সময় মতো মানে? বেশ গরম হয়ে ওঠে পিজারোর গলা, এখুনি তাকে ডাকান। নইলে সমস্ত জাহাজ আমি তালাশ করাব। তার দরকার হবে না, আদেলানতাদো!

    পিজারোকে চমকে পেছন ফিরে তাকাতে হয় এবার। শুধু যে পেছনে অপ্রত্যাশিত কণ্ঠ শুনেই তিনি চমকান তা নয়, আদেলানদো বলে সম্বোধনও তাঁকে বিস্মিত করে। যে সোনার রাজ্য তিনি আবিষ্কার ও জয় করতে যাচ্ছেন তার পুরস্কারস্বরূপ টোলেডোর রাজদরবার থেকে তাঁকে অন্যান্য সুবিধা ও সম্মানের সঙ্গে এই পদবির প্রতিশ্রুতিও যে দেওয়া হয়েছে তা তো যার-তার জানবার কথা নয়।

    লোকটাকে দেখবার পর তার মুখে এ সম্বোধন তো আরও অবিশ্বাস্য লাগে।

    চেহারা পোশাক দেখে লোকটা যে জাতে বেদে এ বিষয়ে পিজারোর কোনও সন্দেহ থাকে না। চুরি, হাত-সাফাই ছাড়া বেদেদের অদ্ভুত কিছু কিছু ক্ষমতা থাকার গুজব তিনি বহুকাল আগে স্পেনে থাকতে শুনেছিলেন। কিন্তু টোলেডোর রাজদরবারের গোপন ব্যাপার জানবার মতো বিদ্যে তাদের থাকতে পারে বলে তো বিশ্বাস হয় না।

    আদেলানতাদো বলছ কাকে? ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাসা করেন পিজারো।

    আপনি ছাড়া ও সম্বোধনের যোগ্য আর কে আছে এখানে? সসম্রমে মাথা নুইয়ে বলে লোকটি, শুধু আদেলানতাদো কিংবা আলগুয়ালির মেয়র নয়, কাপিন জেনেরালও আপনাকে বলা উচিত—

    থামো! বেশ একটু অস্বস্তি ও অধৈর্যের সঙ্গে লোকটিকে থামিয়ে দিয়ে পিজারো। বলেন, এসব আবোল-তাবোল কথার মানে কী! কোথায় শুনেছ যে আমি কাপিন। জেনেরাল?

    কোথাও শুনিনি, আদেলানদো। লোকটা অবিচলিতভাবে বলে, ভর হওয়ার সময় জানতে পেরেছি, যেমন আপনার সেভিল ছেড়ে পালাবার উপায়ও জানতে পেরেছি সেই অবস্থায়।

    সেই অবস্থায় জানতে পেরেছ। হতভম্ব হলেও গলাটা কড়া রেখে জিজ্ঞাসা করেন পিজারো, সে ভর হওয়াটা আবার কী!

    কী, তা বোঝাতে পারব না, আদেলানদো। তবে মাঝে মাঝে আমাতে আর আমি থাকি না। চাপা গলায় যেন ভয়ে-ভয়ে বলে লোকটি, তখন আশ্চর্য অনেক কিছু আমি জানতে পারি। আমাদের বেদেদের মধ্যে একেই ভর-হওয়া বলে। দেবতা কি অপদেবতা কেউ তখন আমার মধ্যে এসে ঢোকে।

    দেবতা নয়, অপদেবতাই হবে।মুখে তাচ্ছিল্যের ভান করলেও পিজারোর অন্ধ কুসংস্কারে জড়ানো মনে লোকটা সম্বন্ধে বেশ একটু ভয়-ভক্তিই জাগে। নিজে থেকেই তাই আবার জিজ্ঞাসা করেন, কী নাম তোমার? কোথা থেকে এখানে এসে জুটলে?

    আজ্ঞে নাম আমার গানাদো। লোকটি সবিনয়ে জানায়, আসছি ত্রিয়ানা থেকে। ত্রিয়ানা থেকে আসছ? গানাদো অর্থাৎ গোরু-ঘোড়া নামটা বেদের পক্ষে তেমন বেয়াড়া না লাগলেও, আর ত্রিয়ানাই যে স্পেনের বেদেদের বড় ঘাঁটি তা জানলেও, পিজারো একটু সন্দিগ্ধভাবে জিজ্ঞাসা করেন, সেখানেই ভর হয়ে আমার আর আমার জাহাজের কথা জানতে পেরে চলে এসেছ আমায় সাহায্য করবার জন্যে?

    আজ্ঞে! ভর-হওয়া অবস্থার হুকুম তো অমান্য করবার জো নেই। লোকটি অর্থাৎ গানাদোর গলায় আতঙ্ক মেশানো সন্ত্রম ফুটে ওঠে।

    ভয়ে বিস্ময়ে পিজারোর সন্দেহ করবার মতো মনের অবস্থা তখন আর নেই। একটু দ্বিধাভরেই তিনি শুধু জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু কাপিন সানসেদোকে জোটালে কী করে? তাঁকে পেলে কোথায়?

    ওই ত্রিয়ানাতেই পেলাম, আদেলানতাদো। তাঁকেও আমার ভর-হওয়া দশার হুকুম মেনে এখানে আসতে হয়েছে।

    যত আজগুবিই মনে হোক, দেবতা-অপদেবতার নামে জড়ানো কথাগুলোকে অবিশ্বাস করবার সাহস পিজারোর আর হয় না। বেশ একটু আগ্রহের সঙ্গেই তিনি এবার জিজ্ঞাসা করেন, ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের গোমেরায় গিয়ে অপেক্ষা করবার হুকুমও। কি তুমি ভর-হওয়া অবস্থায় পেয়েছ?

    আজ্ঞে হ্যাঁ আদেলানতাদো! বেদেরূপী গানাদো গলায় সরল বিস্ময় ফুটিয়ে বলে, নইলে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ কি গোমেরার নাম আমি জানব কোথা থেকে!

    এসব নামও তুমি জানতে না! পিজারো সবিস্ময়ে অদ্ভুত বেদেটাকে ভাল করে লক্ষ করবার চেষ্টা করেন। লোকটা তাঁর সম্পূর্ণ অচেনা! গাঢ় কুয়াশার মধ্যে অন্ধকারে তার মুখটা সম্পূর্ণ অস্পষ্ট হলেও দেহের গড়নটা কিন্তু পিজারোকে যেন কার কথা মনে করিয়ে দেয়।

    কাকে যে মনে করিয়ে দেয় সে রাত্রে তো নয়ই, তার পরে অনেক কালের সংস্রবেও পিজারো ধরতে পারেননি।

    শেষ পর্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন নানা খণ্ডরহস্য যখন এক সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় তখন সূর্য কাঁদলে সোনার দেশকে রক্তে ভাসিয়ে তিনি তাঁর ভয়ংকর নিয়তির শেষ ধাপে গিয়ে পৌঁছেছেন।

    সে অবশ্য অনেক পরের কথা।

    আপাতত অদ্ভুত অচেনা বেদেটার কথা আজগুবি মনে হলেও কুসংস্কার জড়ানো ভয়-ভক্তিতে সব সন্দেহ চাপা দিয়ে তার নির্দেশ মেনে পিজারোর সত্যি-সত্যিই যথেষ্ট লাভ বই লোকসান হয় না।

    কাপিন সানসেদো ওই কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাতেই সান লকার-এর বিপজ্জনক চড়ার পাশ কাটিয়ে বারদরিয়ায় জাহাজ এনে ফেলে তাঁর নৌবিদ্যার বাহাদুরি দেখান।

    পিজারো তাঁর জাহাজ নিয়ে নির্বিঘ্নেই তারপর ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের গোমেরাতে গিয়ে ওঠেন। সেখানেই কাপিন সানসেদোর আদেশ মতো পিজারোর ভাই হার্নারেমন্ডো বাকি জাহাজ দুটি নিয়ে গিয়ে যোগ দেন কয়েক দিন বাদে। সেভিল-এর বন্দরে পরের দিনই কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ থেকে যাঁরা তদন্ত করতে এসেছিলেন

    তাঁদের ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে আসা হার্নারেমন্ডোর পক্ষে শক্ত হয়নি!

    ছোট বড় অনেক বাধা এর পর দেখা দিলেও সূর্য কাঁদলে সোনার রহস্য-রাজ্যের অভিযান অনিবার্যভাবেই এগিয়ে গেছে।

    সেই কুয়াশাচ্ছন্ন রাত্রে সেভিল-এর বন্দর থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে জাহাজ ভেসে যাওয়ার সময় উত্তেজনা আর আশঙ্কার মধ্যে কাপিন সানসেদো ছাড়া আর যে-লোকটির পরিচয় পেয়েছিলেন তার বিষয়ে পিজারোর কৌতূহল বেশিদিন খুব সজাগ কিন্তু থাকেনি। পরের পর আরও উত্তেজনা-জোগানো ঘটনায় আর মাথা-ঘোরানো সমস্যায় সে কৌতূহল আপনা থেকে কিছু পরে ফিকে হয়ে গেছে। ব্যাপারটায় অলৌকিকত্বের আভাস থাকলেও বেদেদের সে রকম ক্ষমতা থাকা। অসম্ভব নয়, এই বিশ্বাসে মানুষটা সম্বন্ধে বিশেষ মনোযোগ দেবার কোনও তাগিদ আর তিনি অনুভব করেননি যে গানাদো নামে একজন বেদে আর-সব মাঝিমাল্লার মধ্যে তারপর বেমালুম মিশে গেছে। অভিযান অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে কাপিন সানসেদো এবং সেই এক অজানা বেদের কাছে এ অভিযান সম্ভব করার জন্যে কৃতজ্ঞ থাকার কথা পিজারোর নিশ্চয় মনে থাকেনি। থাকলে বেদের ছদ্মবেশে ঘনরাম দাসই বোধহয় সবচেয়ে অসুবিধায় পড়তেন, কারণ বিশেষ প্রয়োজনে সামনে আসতে বাধ্য হলেও এ অভিযানে তাঁর যা কাজ তা নেপথ্যে থেকেই সারবার।

    ঘনরাম নিজেকে নেপথ্যে রাখবার সুযোগ নিয়ে পিজারোর অভিযানে যে ভূমিকা নিয়েছেন তার বিবরণ দেবার আগে আর একটি রহস্য বোধহয় না পরিষ্কার করলে নয়।

    ঘনরাম আর কাপিন সানসেদোকে যমপুরীর মতো এক গারখানার কুঠুরিতে বদ্ধ অবস্থায় আমরা শেষ দেখে ছিলাম।

    নিজেদের মধ্যে হিংস্র মারামারি করার জন্যে প্রহরীরা তখন তাঁদের হাত-পা বেঁধেই কুঠুরির দু-ধারে ফেলে রেখেছে। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়াই তো অলৌকিক ব্যাপার। কেমন করে তা সম্ভব হল?

    সে অলৌকিক ব্যাপার সম্ভব হয়েছে এক হিসাবে বলতে গেলে অতি সহজ একটি কৌশলে। কৌশল আর কিছু নয়, মানুষের মনের একটি বিশেষ রিপুকে উসকানি দেওয়া।

    গারখানার এক প্রহরী এক রাত্রে ঘনরাম আর সানসেদোর কুঠুরির পাশ দিয়ে শেষ টহল দিয়ে যাবার সময় ফিসফিস কী আলাপ শুনে থমকে থেমে গিয়েছিল।

    কী শুনে অমন চমকিত, বিস্মিত হয়েছিল সে পাহারাদার?

    যা শুনেছিল তা সামান্য একজন প্রহরী কেন, নেহাত সত্যকার সাধুসন্ন্যাসী ছাড়া যে কোনও সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরিয়ে চক্ষু বিস্ফারিত করবার পক্ষে যথেষ্ট।

    প্রহরী কাপিন সানসেদো আর ঘনরামকে চুপি চুপি আলাপ করতে শুনেছে গুপ্তধন নিয়ে। স্বয়ং স্পেনের সম্রাটকে লুব্ধ চঞ্চল করে তুলতে পারে এমন গুপ্তধনের কাঁড়ি! এ গুপ্তধন আসলে সম্রাট পঞ্চম চার্লস-এরই, আর জাহাজে মেক্সিকো থেকে আসবার সময় তা চুরি করে কাপিন সানসেদো এমন গোপন জায়গায় লুকিয়ে পুঁতে রেখেছেন যে তাঁর কাছে হদিস না পেলে হাজার বছরেও কেউ খুঁজে বার করতে পারবে না।

    এই সব বিবরণের সঙ্গে ফিসফিস আলাপে প্রহরী কাপিন সানসেদোর তীব্র আফশোশও শুনেছে। এত বড় কুবেরের ভাণ্ডার চিরকালের মতো মাটির নীচেই পোঁতা থাকবে, দুনিয়ার কাউকে তার হদিস না দিতে পেরে এই গারখানাতেই তাঁরা শেষ হয়ে যাবেন, সানসেদো আর ঘনরাম দু-জনে এই দুঃখই করেছেন।

    নিজেদের ভোগে যখন নেই তখন কাউকে অন্তত হদিসটা দিয়ে গেলে ক্ষতি কী! বলেছেন এবার সানসেদো।

    কিন্তু কাকে এ অনুগ্রহ করা যেতে পারে সে মীমাংসা কিছুতেই আর হয়নি। তা ছাড়া আর এক সমস্যার কথাও উঠেছে। হদিস তো শুধু মুখে বলে দিলেই হবে না, গুপ্তস্থানের মাপ-জোকের এমন শক্ত অঙ্ক আছে যা সেখানে গিয়ে না কষতে পারলে নয়। হদিস দিতে হলে আঁক-জোকে ভুল করবে না এমন কাউকে দিতে হয়। তা না হলে সব গুপ্ত সংকেতই বৃথা।

    হদিস যদি দিতেই হয় তা হলে কাকে দেওয়া যায় সে আলোচনা এবার প্রহরী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে শুনেছে। প্রহরীদের কাউকেই এ সৌভাগ্য যে দেওয়া উচিত এ বিষয়ে একমত হতে শোনা গেছে দুজনকেই। মতভেদ হয়েছে শুধু কোন প্রহরী এ হদিস পাবার যোগ্য তারই বিচার নিয়ে।

    উৎকর্ণ হয়ে যে প্রহরী তাঁদের কথা শুনছে ঘনরাম তার নামই করেছেন প্রথমে। সানসেদো তাতে সায় দেননি। সকাল থেকে দিনের বেলা যে তাঁদের পাহারায় থাকে সে-ই তাঁর মতে গুপ্তধন পাবার যোগ্য।

    দু-জনে এবার নিজের নিজের বাছাই নিয়ে ওকালতি শুরু করেছেন।

    ঘনরাম রাত্রের পাহারাদারের হয়ে লড়েছেন। লোকটা খুব খারাপ নয়। তার ওপর সারা জীবন এই গারখানার কয়েদিদের সঙ্গে একরকম বন্দি হয়েই কাটিয়ে বুড়ো। হতে চলেছে। সাত রাজার ধন পেয়ে জীবনের বাকি কটা দিন তারই সুখভোগ করার সুবিধে পাওয়া উচিত।

    সানসেদো তীব্র প্রতিবাদ করেছন নিজের প্রৌঢ়ত্ব যেন ভুলে গিয়ে। বুড়োর আবার সুখভোগ কী! তার তো জীবন ফুরিয়েই এসেছে। দিনে যে পাহারায় থাকে সে জোয়ান। রাজার ঐশ্বর্য তারই পাওয়া উচিত। পেলে সে তার মান রাখতে পারবে।

    মান রাখবে, না যত রকম বদখেয়ালে উড়িয়ে-পুড়িয়ে দেবে! ঘনরাম গলার স্বর খুব চাপা না রেখে বলেছেন, জোয়ানদের হাতে টাকা মানেই পাপের প্রশ্রয়।

    তাতে হয়েছে কী! সানসেদোও জ্বলে উঠেছেন, মিঠে গির্জায় দেবার জন্যে তো এ গুপ্তধন নয়, এ ফুর্তি করবার টাকা জোয়ানকেই আমি দেব। আসলে গুপ্তধন তো আমার। আমার যাকে খুশি আমি হদিস দিয়ে যাব।

    তাই দিন। বিদ্রূপের স্বরে বলেছেন ঘনরাম, দেখুন কেমন হদিস দিতে পারেন। হদিস লেখা কাগজ আছে আপনার কাছে?

    নেই মানে!—সানসেদো অস্থির হয়ে উঠেছেন—আমার জামার হাতায় তা সেলাই করে রাখা আছে।

    আছে নয়, ছিল। আপনি ঘুমোবার সময় জামার সেলাই খুলে তা আমি বার করে নিয়েছি। ঘনরাম হিংস্রভাবে হেসেছেন—আর এমন জায়গায় রেখেছি, সারা কুঠুরি ভেঙে খুঁড়েও তার খোঁজ পাবেন না।

    তুই বার করে নিয়েছিস? মিথ্যে কথা। সানসেদোর ব্যাকুল হয়ে গায়ের জামা খুলে পরীক্ষা করার শব্দ শোনা গেছে।

    তারপর চিৎকার করে গালাগাল দিয়ে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছেন ঘনরামের ওপর।

    অন্ধকারে ঘনরামেরও পালটা গালাগাল আর দু-জনের ধ্বস্তাধ্বস্তি শোনা গেছে।

    সে গোলমালে অন্য প্রহরীরাও আলো নিয়ে ছুটে এসে দু-জনকে আলাদা করে যখন দু-দিকে বেঁধে রেখেছে তখনও মুখের আস্ফালনে তাঁদের কামাই নেই।

    সে মুখের লড়াই অবশ্য বেশিক্ষণ চলেনি। ক্লান্ত হয়েই দু-জনকে বুঝি থামতে হয়েছে।

    তাদের কুঠুরি সেই থেকে একেবারে নিস্তব্ধ।

    দিন দুই বাদে সে কুঠুরি শুধু নিস্তব্ধ নয়, সকাল হবার পর একেবারে ফাঁকাই দেখা গেছে। কুঠুরির দরজার তালা খোলা। ভেতরে দুজনের কেউ নেই। সঙ্গে সঙ্গে গারখানার দু-জন প্রহরীও উধাও!

    সানসেদো আর ঘনরামের সঙ্গে দু-জন প্রহরীও উধাও হওয়া থেকে রহস্যটার কিছুটা হদিস পাওয়া উচিত।

    দু-দুজন প্রহরীকে কাবু করে ঘনরাম আর সানসেদো যদি পালাতেন, তা হলে জ্যান্ত কি মরা যে-কোনও অবস্থায় তাদের পাত্তা অবশ্য পাওয়া যেত। কোনও চিহ্ন পর্যন্ত না রেখে গারখানা থেকে তারা অমন বেমালুম লোপাট নিশ্চয় হতেন না।

    প্রহরীরা তা হলে কয়েদিদের সঙ্গেই পালিয়েছে। শুধু তাই নয়, কয়েদিদের পালাবার সমস্ত সুযোগ নিজেরাই করে দিয়ে একরকম জোরজবরদস্তি করে তাড়িয়ে বার করেছে তারাই।

    ঘনরাম সেই ফন্দিই এঁটেছিলেন। যে-প্যাঁচ তিনি করেছিলেন তা পুরোপুরি সফল হয়েছে।

    যে প্রহরী রাত্রের টহলে কয়েদি দু-জনের গোপন ফিসফিস থেকে গলাবাজির ঝগড়া শুনেছিল এক রাত্রের বেশি নিজেকে সে সামলে রাখতে পারেনি। স্বপ্নেও যা ভাবতে পারেনি এমন গুপ্তধন বাগাবার এ সুযোগ কি ছাড়া যায়?

    সমস্ত কিছু একলা হাতাতে পারলেই অবশ্য সে খুশি হত। কিন্তু তার তো উপায় নেই।

    বাধ্য হয়েই দিনের পাহারাদারকে গোপনে সব কথা জানিয়ে ভাগীদার করতে হয়েছে।

    সেই রাত্রেই পাহারাদারদের শেষ রোঁদের কিছুক্ষণ বাদে কুঠুরির দু-কোণে মুখ খুঁজড়ে শুয়ে থাকা অবস্থায় ঘনরাম আর সানসেদো অতি সন্তর্পণে কুঠুরির দরজার তালা খোলার আওয়াজ পেয়েছেন। তারপর পা টিপে টিপে কুঠুরির ভেতর ঢাকার শব্দ।

    কানের কাছে তারপর ফিসফিস শোনা গেছে গায়ে মৃদু ঠেলার সঙ্গে।

    এই ওঠো ওঠো, পালাতে চাও তো উঠে পড়ো জলদি!

    ঘনরাম আর সানসেদো দু-জনেই যেন ধড়মড়িয়ে জেগে উঠে বসেছেন। কুঠুরির মধ্যে আচমকা দুই প্রহরীকে দেখে আঁতকে চিৎকারই বুঝি করে ওঠেন তাঁরা।

    তাঁদের মুখে প্রায় হাত চাপা দিয়ে প্রহরীকে সে বিপদ ঠেকাতে হয়েছে। ঘনরাম আর সানসেদোকে নিয়ে তারপরও কম বেগ পেতে হয়নি। প্রহরীদের ধারণা ছিল ছাড়া পাবার নামে দুই কয়েদিই ধেই ধেই নৃত্য করে গারদঘর থেকে বেরিয়ে যাবে। তার বদলে দু-জনের কারওই যেন ছাড়া পাবার তেমন আগ্রহ নেই।

    ছাড়া পেয়ে যাব কোথায়? বলেছেন ঘনরাম, আবার তো ধরে এনে গারদে পুরবে!

    না, না, সে রকম কোনও ভয় নেই, বলে আশ্বাস দিতে হয়েছে পাহারাদারদের। কিন্তু তাতেও যেন চিড়ে ভেজেনি। ঘনরাম যদি বা রাজি হয়েছেন, সানসেদো আপত্তি তুলেছেন। ছাড়া পেয়ে তাঁর লাভ কী! যে গুপ্তধন উদ্ধার করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, তা যখন আর উদ্ধার করা যাবে না তখন বাইরে থাকাও যা, এই গারদঘরেও থাকা তা-ই।

    তা কেন হবে! একটু বেশি উৎসাহই দেখিয়ে ফেলেছে প্রহরীরা। গুপ্তধন উদ্ধার করা আটকাচ্ছে কে? দরকার হলে আমরাই সাহায্য করতে প্রস্তুত।

    তোমরাও সাহায্য করতে প্রস্তুত!ঘনরাম আর সানসেদো দু-জনেই যেন খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠেছেন।

    তারপরই একটু ফ্যাকড়া তুলেছেন সানসেদো, কিন্তু উদ্ধার হলে গুপ্তধনের ভাগটা হবে কীরকম? ঘনরামের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছেন, ওই ঠগটাই সিংহভাগ নেবে তা হতে দেব না।

    তা আমি চাইও না। উদার হয়ে উঠেছেন ঘনরাম, চারজন আছি, চারজনের ভাগ হবে সমান সমান। কিন্তু তার জন্যে আমার একটা শর্ত মানতে হবে।

    কী শর্ত? শর্ত হল গারদঘর থেকে বেরিয়ে আমি যেমনটি যখনটি বলব, তাই মানতে হবে। আমার ওপর কারও কথা চলবে না। হদিস যার, হুকুম তার।

    সানসেদো একটু যেন মৃদু আপত্তি করতে গেছেন। কিন্তু প্রহরীরা তাঁকে থামিয়ে দিয়েছে। হদিস যার হুকুম তার-এ-ব্যবস্থা মানতে তাদের কোনও আপত্তি নেই।

    ফিসফিসিয়ে এসব তর্ক মীমাংসার মধ্যে পাহারাদারদের নিয়ে আসা পোশাক বদল হয়ে গেছে ঘনরাম আর সানসেদোর। নতুন পোশাক আর কিছুর নয়, পাহারাদারদেরই। সেই পোশাক পরে রাতের অন্ধকারে গারখানা থেকে যখন তারা বেরিয়েছে তখন সন্দেহ কেউ করেনি, বাধা তাদের দেয়নি কেউ।

    সে রাত্রে কেউ কিছু না জানলেও পরের দিন হুলুস্থুল পড়ে গেছে গারখানায়। খবর পেয়ে খাপ্পা হয়ে প্রথমেই ছুটে এসেছে সোরাবিয়া। আলগুয়াসিল মানে শহরকোটাল তার হাতের লোক। খোঁজ করবার সে আর কিছু বাকি রাখেনি। মেদেলিন শহর তো তোলপাড় করে তুলেছেই, ত্রিয়ানায় বেদেদের ঘাঁটিতে পর্যন্ত। পরোয়ানা দিয়ে লোক পাঠিয়েছে জায়গাটা চষে ফেলে খোঁজবার জন্যে।

    কিন্তু কোথাও তাদের পাত্তা পাওয়া যায়নি।

    পাওয়া যাবে কী করে? ঘনরাম আর সানসেদো এবার বুঝেসুঝেই ত্রিয়ানার ত্রিসীমানায় যাননি, মেদেলিন শহরেরও ধারে কাছে নয়।

    সোরাবিয়ার লাগানো চর যতদূর পর্যন্ত তাঁদের খোঁজ পায়, তা সে ছোট্ট একটি শহর মনতরো। সেই শহরেই তাঁদের সঙ্গী পাহারাদার দু-জন ধরা পড়ে। তারাও তখন অস্থির হয়ে ঘনরাম আর সানসেদোকে খুঁজে ফিরছে। ঘনরাম আর সানসেদো তাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়েছেন। কী করে কোথায় যে পালিয়েছেন সেইটেই গভীর রহস্য।

    পাহারাদারদের কথায় জানা যায় যে, গুপ্তধনের খোঁজে তাদের মাতব্বর হিসেবে ঘনরাম সকলকে নিয়ে কর্দোভায় আসছিলেন। পথে এই মনতরো শহরে রাতটা শুধু কাটাবার কথা। কর্দোভাও তাদের লক্ষ্য নয়। সেখান থেকে আর একটু থেমে পাসাদাস শহরে গিয়ে গুয়াদালকুইভির-এর উপনদী গুয়াদিয়ানা মেনর ধরে আবার উত্তরে যাওয়াই নাকি তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এই শহরে প্রায় যেন তাদের চোখের ওপর দিয়ে ঘনরাম আর সানসেদো গায়েব হয়ে গেছেন।

    পাহারাদারেরা তো নয়ই, সোরাবিয়া নিজেও চরেদের কাছে খবর পেয়ে মনতরোতে এসে তার দুই শিকারের অন্তর্ধান রহস্যের কোনও কিনারা করতে পারেনি। চেষ্টার ত্রুটি অবশ্য তার ছিল না। কাপিন সানসেদো দুই ফেরারির একজন বলে প্রথমে তাঁদের ধরাটা সহজই মনে হয়েছে। কাপিন সানসেদো মেদেলিন শহরে বেদে সেজে নিজের বাড়িতে খোঁজাখুঁজি করতে যাওয়ার দিন সেই যে খোঁড়া হয়ে ধরা পড়েছিলেন, তারপর তাঁর পা আর পুরোপুরি সারেনি। জখম হয়েই আছে। ঘনরাম অনায়াসে পারলেও কাপিন সানসেদোর পক্ষে হাঁটা পায়ে তাড়াতাড়ি বেশিদূর যাওয়া অসম্ভব। বিশেষ করে উত্তরের দিকে সিয়েরা দে মোরেনার পাহাড়ি অঞ্চলে খোঁড়া পা নিয়ে তিনি যাবার সাহস নিশ্চয় করবেন না। আর ঘনরামও সানসেদোকে ফেলে একলা যে যাবেন না—এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। এইসব বিচার করে সোরাবিয়ার দৃঢ় ধারণা হয়েছে যে, পায়ে হেঁটে নয়, কোনওরকমে সওয়ার হবার মতো ঘোড়া জোগাড় করেই তার শিকার পালিয়েছে। মনতরো শহরে খোঁজখবর করার পর অকাট্য প্রমাণও পাওয়া গেছে তার। আজকালকার দিনে স্পেনের যে ঘোড়ার দারুণ নামডাক, সেই কাস্পিনার ঘোড়ার বনেদি বংশের তখনই পত্তন হয়েছে। মনতরো শহরের সেইরকম ঘোড়ার পালের এক মালিকের কাছে জানা গেছে যে তার দুটি ঘোড়াও ঘনরাম আর সানসেদোর সঙ্গে একই দিনে নিরুদ্দেশ।

    সোরাবিয়া আর একমুহূর্ত দেরি করেনি। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে বেশ কিছু সওয়ার সেপাই ভাড়া করে পাঠিয়েছে সিয়েরা দে মোরেনার দিকে। সেপাইদের বেশি দূর যেতে হয়নি। ফেরারিদের তারা পায়নি। পেয়েছে ঘোড়া দুটোকে শুধু। যারাই সে দুটোকে নিয়ে গিয়ে থাক, কিছু দূর গিয়েই ছেড়ে দিয়ে গেছে।

    ঘোড়া ছেড়ে দুই ফেরারি কীভাবে কোথায় পালিয়েছে, প্রায় টানা জাল দেবার মতো করে সিয়েরা অঞ্চল খুঁজেও সোরাবিয়া কোনও হদিস পায়নি।

    হদিস পাবে কী করে? সবকিছুই সে ভেবেছে, শুধু মনতরো শহরের গা বেয়ে বওয়া সরু নদীটার দিকে তার চোখ পড়েনি। এই নদীই যে কর্দোভা ছাড়িয়ে দুই উপনদীর প্রণামী পেয়ে বিরাট গুয়াদালকুইভির হয়ে উঠেছে, সে খেয়ালই তার ছিল না বোধহয়। চুরি-যাওয়া ঘোড়াদুটোকে উত্তর দিকের রাস্তায় পেয়েই তার হিসেব গিয়েছে গুলিয়ে।

    ঘনরামের প্যাঁচটাই অবশ্য ছিল তাই।

    ঘোড়াদুটোকে চুরি করে তাঁরা সিয়েরা দে মোরেনার দিকে রওনা হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু কিছুদূর গিয়ে ধোঁকা দেবার জন্যে সেগুলো ছাড়বার পর আর উত্তরে পা বাড়াননি। গুয়াদালকুইভির সেখানে সবে শুরু-হওয়া দুঃখিনী একটি সরু খালের শামিল। সেই খালের মতো নদীতেই একটা জেলে ডিঙি জোগাড় করে তাঁরা দক্ষিণদিকে পাড়ি দিয়েছেন। উত্তরের পাহাড়ে যখন তাঁদের তল্লাশ চলেছে তখন

    তাঁরা সেই জেলে ডিঙি নিয়েই পৌঁছেছেন সেভিল-এর বন্দর পর্যন্ত।

    সেখানে গিয়ে পিজারোর জাহাজ খুঁজে বার করতে কোনও অসুবিধাই হয়নি। কিন্তু জাহাজ পেয়ে লাভ কী? ওই বন্দরেই পিজারোর শিরে সংক্রান্তির যে-খবর পেয়েছেন, তাতে হতাশ হয়ে বুঝেছেন যে, নেহাত অঘটন ঘটাবার মন্ত্র ছাড়া সে জাহাজ সমুদ্রে আর পাড়ি দেবে না।

    মন্ত্র না হোক, সেই অঘটন ঘটাবার মন্ত্রণাই ঘনরাম শুনিয়েছেন সানসেদোকে।

    ঘনরামের কাছে দিনের পর দিন নানা বিবরণ শুনে কাপিন সানসেদো আগে পিজারোর অভিযানের বিষয়ে উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সেভিল-এ এসে ব্যাপার-স্যাপার দেখে সমস্যার জট তাঁর অচ্ছেদ্যই মনে হয়েছে। হতাশ হয়ে ঘনরামের কাছে তিনি বিদায় চেয়েছেন। তাঁর সোব্রিনা আনাকে তিনি খুঁজে বার করবার চেষ্টা করবেন। তার বাড়ির দরজা থেকে সেবার ঘনরামের সঙ্গে বাধ্য হয়ে চলে আসার পর থেকে কোনও খবরাখবর তার পাননি। সে সেবারে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে খুঁজেছিল কিছু যেন একটা বলবার বা কোনও সাহায্য চাইবার জন্যে। কী সে চেয়েছিল জানতে না পেরে মনটায় তাঁর একটা কাঁটা বিঁধে আছে। পিজারোর অভিযান যখন আর সম্ভব হবার নয় তখন সব বিপদ সত্ত্বেও আনাকে তিনি খুঁজতে চান।

    ঘনরাম ধৈর্য ধরে সানসেদোর সব কথা শুনেছেন। তারপর হেসে ফেলে বলেছেন, মাপ করবেন, কাপিন। আপনার আদরের সোব্রিনা আনার বিরুদ্ধে কিছু বলছি না, কিন্তু আপনার সাহায্য না পেলে সরলা অবলা হিসেবে সে অকূল পাথারে পড়বে বলে তো মনে হয় না। তা ছাড়া স্পেনে তাকে খোঁজার জন্যে এখন থাকতে চাইলে একূল-ওকূল দুকূলই তো আপনার যাবে। নিজে গারদঘরে গেলে তাঁকে খুঁজবেন কখন?

    কিন্তু স্পেন ছেড়ে যাচ্ছিই বা কোথায়! সানসেদো দুঃখের সঙ্গে বলেছেন, অন্য কোনও জাহাজে আমাদের মতো দাগি ফেরারিদের লুকিয়ে-চুরিয়ে জায়গা পাওয়াও শক্ত। পিজারোর জাহাজে যদি বা যাবার আশা ছিল, সে-জাহাজই তো আজ বাদে কাল ক্রোক করবে কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ।

    কেমন করে করবে? ঘনরামের মুখ গম্ভীর হলেও চোখে যেন একটু হাসির ঝিলিক দেখা গেছে।

    কেমন করে করবে, জানো না! সানসেদো একটু অধৈর্যের সঙ্গে বলেছেন, পরোয়ানা এনে জাহাজে কোতয়ালি পাহারা বসিয়ে দেবে। মেয়াদ ফুরোবার পরও লোকলশকরের বরাদ্দ পুরো যে হয়নি, তা গুণে বার করতে তো তাদের দেরি হবে না। তখন এ-জাহাজ ক্রোক না করে ছাড়বে!

    কিন্তু জাহাজ না পেলে ক্রোক করবে কী? এবার ঘনরামের মুখে হাসির ঝিলিক। আরও স্পষ্ট!

    তার মানে! অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছেন সানসেদো। মানেটা ঘনরাম বুঝিয়ে দিয়েছেন বিশদভাবে। কী যে বুঝিয়েছেন তা আমরা জানি। সানসেদোর কিন্তু মনের সংশয় তাতে কাটেনি।

    দুঃসাহসিক ফন্দিটায় বুদ্ধির পরিচয় আছে বলে স্বীকার করলেও তা সফল হওয়া অসম্ভব বলেই তাঁর মনে হয়েছে।

    কিন্তু তা যে হতেই হবে, কাপিন, এবার গম্ভীর হয়েছেন ঘনরাম, নইলে যাঁর কাছে আপনি পরম দীক্ষা নিয়েছেন, আপনার সেই গুরুদেবের কথাই মিথ্যে হয়ে যাবে!

    আমার গুরুদেবের কথা মিথ্যে? সানসেদো বিমূঢ় যেমন হয়েছেন, অবান্তর কথাটায় তেমনই বেশ একটু ক্ষুব্ধও তাঁর গুরুদেবের অসম্মানে।

    হ্যাঁ! অবিচলিতভাবে বলেছেন ঘনরাম, পিজারো যদি জাহাজ নিয়ে এ অভিযানে যেতে না পারেন, তা হলে আমার নিয়তি যে পূর্ণ হবে না। আর আমার নিয়তি পূর্ণ না হলে আপনার গুরুদেবের শেষ ইচ্ছা আমাকে দিয়ে পূরণ হবে কী করে?

    সানসেদো এবার অবাক হয়ে ঘনরামের দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলেছেন, তার মানে তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণের ভার নিতে যার আসবার কথা বলে গেছেন তুমি সে-ই!

    আমার তো তাই মনে হয়। মৃদু একটু হেসে বলেছেন ঘনরাম, নইলে আপনার সঙ্গে এমন আশাতীতভাবে আমার আবার সেভিল-এর রাস্তায় দেখা হবে কেন? আপনার গুরুদেবের শেষ লিপি উদ্ধার হবেই বা কেন আমার হাত দিয়ে! আর উদয়সাগরের তীরের যে আশ্চর্য দেশ থেকে আপনার গুরুদেব এসেছিলেন, সেই দেশে ফিরে যাওয়ার চেয়ে বড় কামনা আমার কিছু থাকবে না কেন?

    ফিরে যাওয়া!ঘনরামের সমস্ত কথার মধ্যে শুধু এইটুকুই বিশেষ করে লক্ষ করে কাপিন সানসেদো সবিস্ময়ে বলতে গেছেন, তা হলে তুমি–

    হ্যাঁ, কাপিন। সানসেদোকে তাঁর বিস্মিত মন্তব্যটা শেষ করতে না দিয়ে ঘনরাম বলেছেন, আমি সেই সুদূর উদয়সাগরের দেশেরই লোক, সেখানেই ফিরে যাব সময় আর সুযোগ হলে। কিন্তু নিয়তির সমস্ত দাবি চুকিয়ে শাপমুক্ত না হলে সে সময় আর সুযোগও আমার হবে না। তাই বলছি আপনার গুরুদেব সত্যদ্রষ্টা হলে অজানা নিরুদ্দেশে পাড়ি দিয়ে তিনটির পর চতুর্থ এক মহাসাগর আমায় দেখতে হবে, রক্তের নদী বইবে আমার সামনে, আর পৃথিবীর কেউ আজও যা জানে না, এমন এক অচিন রহস্যের দেশে সোনায় বাঁধানো পথেঘাটে আমি এক রাজকুমারীর বরমাল্য পাব।

    কাপিন সানসেদোর মুখে একটু স্নেহের হাসি দেখা দিয়েছে এবার। বলেছেন, কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে মনে রেখেছ দেখছি! কিন্তু এসব তো আমার গুরুদেবের কথা নয়। আমি আমার অসম্পূর্ণ বিদ্যার সামান্য ক্ষমতায় তোমার ওই নিয়তি দেখেছিলাম। তখনই তো বলেছিলাম আমার ও গণনা অভ্রান্ত বলে মনে কোরো না। গুরুদেবের কাছে কতটুকু আর আমি শেখার সুযোগ পেয়েছি!

    কিন্তু যেটুকু শিখেছেন তাতেই আপনার গণনায় আপনার গুরুদেবের হাতের ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।যথার্থ শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছেন ঘনরাম, আমায় যা বলেছিলেন, তার শুরুটা যখন এমন নিদারুণভাবে ফলেছে, শেষটাও তখন আশ্চর্যভাবে ফলবার আশা আমি রাখি। তাই বলছি, পিজারোর অভিযান বন্ধ হতে পারে না, আর গুরুদেবের কাছে আপনার সত্যরক্ষার জন্যে পিজারোর জাহাজ সেভিল থেকে লুকিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আপনাকে উপলক্ষ হতে হবেই।

    সানসেদোর আপত্তির কারণ তখনও হয়তো ছিল কিন্তু তিনি নীরবে এবার নিয়তির নির্দেশ হিসেবেই যেন ঘনরামের কথা মেনে নিয়েছেন।

    এত সব বোঝাপড়া সত্ত্বেও ঘনরাম আর কাপিন সানসেদোর সব ফন্দিফিকিরই বোধহয় ভেস্তে যেত। পিজারোর জাহাজ সেভিল-এর বন্দরেই আটক হয়ে থাকত কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ-এর হুকুমে। কারণ, মনতরো শহর থেকে যে জেলে নৌকো ভাড়া করে ঘনরাম আর সানসেদো গুয়াদালকুইভির নদী দিয়ে দক্ষিণে পালিয়েছিলেন, একটু দেরিতে হলেও শেষপর্যন্ত সোরাবিয়া তার মালিকের কাছে সমস্ত খবর তখন পেয়ে গেছে। খবর পেয়েই জেলে নৌকোর পেছনে ধাওয়া করতে সে দেরি করেনি। আজকালকার দিনে গুয়াদালকুইভির নদী প্রশস্ত জলপথ হিসেবে সেভিল-এ এসেই শেষ। কিন্তু মুরদের আমলে তো বটেই, ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকে পর্যন্ত সে-নদী দিয়ে কর্দোভা পর্যন্ত বড় বড় জাহাজের যাতায়াত ছিল। সোরাবিয়া মনতরো থেকে একটি জেলে নৌকোতেই কর্দোভায় এসে নেমেছিল নদীপথে তাড়াতাড়ি যাবার জন্যে একটা দ্রুতগামী পানসি ভাড়া করবার জন্যে। সে পানসি নিয়ে কর্ডোভা থেকে রওনা হতে পারলে পিজারোর জাহাজ অন্ধকার কুয়াশার মধ্যে গোপনে ভাসিয়ে নিয়ে যাবার সুযোগ ঘনরাম আর সানসেদো পেতেন না। তার আগেই সেভিল-এ এসে পৌঁছে তাঁদের ধরতে পারুক বা না-পারুক, সোরাবিয়া সব ফন্দি ভণ্ডুল করে দিত।

    কিন্তু কর্দোভা থেকে পানসি নিয়ে শিকারের পেছনে ধাওয়া করা সোরাবিয়ার হয়ে ওঠেনি। তাকে নিজেকেই সন্ত্রস্ত হয়ে পালাতে হয়েছে আচমকা।

    পানসি ভাড়া করবার ঘাটে এমন একটি লোকের সঙ্গে তার অকস্মাৎ দেখা, যাঁকে এড়াবার জন্যে টোলেডোর রাজদরবারে ইনামের লোভও সে ছেড়ে এসেছে।

    হ্যাঁ, হার্নারেমন্ডো কর্টেজই সেই ঘাটে সেদিন উপস্থিত। তিনিও সেভিল যাবার পানসি ভাড়া করতে এসেছেন। সোরাবিয়াকে দেখে তিনি থমকে দাঁড়িয়েছেন। সোরাবিয়াও তখন তাঁকে দেখেছে। দেখেও না দেখার ভান করে সরে পড়বার সুযোগ কিন্তু তার মেলেনি।

    কর্টেজ তার পথ আগলে বলেছেন, দাঁড়ান। আপনি কি মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস?

    হ্যাঁ, কেন বলুন তো? সোরাবিয়া বেপরোয়া ঔদ্ধত্যের ভান করবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু গলা তার তখন শুকনো।

    কী করে, কবে মার্কুইস হলেন সেইটুকু জানবার জন্যে। কঠিন কণ্ঠে বলেছেন কর্টেজ, আমি যেন অন্য একটা নাম জানতাম।

    সে অন্য কারও হবে। সোরাবিয়া ছাই মেড়ে-দেওয়া মুখে পাশ কাটিয়ে ব্যস্ত হয়ে চলে গেছে। এবার কর্টেজ বাধা দেননি। কিন্তু সেভিল যাওয়া বাতিল করে তিনি আবার রওনা হয়েছেন টোলেডোতে সেইদিনই।

    সারাবিয়া তার ভাড়া করা পানসির দখল নিতেও আর কর্দোভা ঘাটে আসেনি।

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
    Next Article মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }