Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পাতা গল্প632 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    ৩৪. ফেরারি গোলাম বলে চিহ্নিত হয়ে

    পানামার হুলিয়া নোমব্রে দে দিয়স-এ পৌঁছেলে ফেরারি গোলাম বলে চিহ্নিত হয়ে এ বন্দর থেকে বার হওয়া তাঁর পক্ষে কঠিন হবে এই ভয় করেছিলেন গানাদো।

    তার চেয়ে কত বড় অভাবিত নিদারুণ দুর্ভাগ্য যে তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তিনি তখন কল্পনাই করতে পারেননি।

    নোমব্রে দে দিয়স-এ কয়েক দিন ফিরতি জাহাজে জায়গার খোঁজে হতাশ ভাবে কাটাবার পর সেদিন ফেলিপিলিও একটা আশার খবর এনেছে। সেদিন সকালেই একটি ছোট কারাভেল বন্দরে এসে ভিড়েছে। পানামা থেকে স্পেনে নিয়মিত যে সব জাহাজ যাতায়াত করে তাদের কোনওটি নয়। এ কারাভেল-এর বন্দর-ঘাঁটি হল নিকারাগুয়ার পুণ্টা গোরদা। সেখান থেকে রওনা হয়ে ঝড়ের মুখে বিপথে এসে পড়ে নোমরে দে দিয়স-এ আশ্রয় নিয়েছে শুধু দিনের বেলাটায় কিছু মেরামতি সেরে নেবার জন্যে। সন্ধে বেলাতেই আবার অনুকূল হাওয়ায় রওনা হবে।

    এ অঞ্চলের জাহাজ নয় বলে হয়তো তাতে জায়গা পাওয়া অত কঠিন হবে না। কাপিন সানসেদো আর ডন মোরালেসকে নিয়ে গানাদো তাই ভেবে জাহাজের নাখোদার সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছেন।

    গিয়ে শেষ পর্যন্ত হতাশই হতে হয়েছে। এ জাহাজে কাপিন সানসেদোকে নিয়ে তাঁর ও কয়ার মতো জায়গা ছিল ঠিকই। ভাড়াও তাঁদের সাধ্যের অতিরিক্ত ছিল না। কিন্তু তাঁদের পৌঁছোতে দেরি হয়ে গেছে। সকালবেলা বন্দরে ভিড়বার কিছু পরেই এখানকার একজন সব কটি জায়গাই আগাম মূল্য দিয়ে নিয়ে রেখেছেন।

    কে সে লোকটি? না জিজ্ঞেস করে পারেননি গানাদো। সেই সঙ্গে উৎসুকভাবে বলেছেন, হয়তো তাঁর দরকার আমাদের মতো জরুরি নয়। ঠিক মতো বোঝাতে পারলে হয়তো আমাদের জন্যে জাহাজের জায়গা তিনি ছেড়েও দিতে পারেন। আপনি শুধু তাঁর নাম আর পরিচয়টা আমাদের দিন।

    নাম আর পরিচয় কি আমি মুখস্থ করে রেখেছি! এবার যেন একটু অধৈর্যই ফুটে উঠেছে জাহাজের নাখোদার গলায়, ভাড়া বুঝে পেয়ে জাহাজে জায়গা কবুল করে দিয়েছি, ব্যস ব্যাপার চুকে গেছে। তা ছাড়া নাম-ধাম মনে থাকলেও আপনাদের বলতাম না। তার বারণ আছে।

    আর কথা বাড়ানো বৃথা বুঝে গানাদো মোরালেস আর কাপিতানকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছেন। সামান্য একটু দেরির জন্যে এমন একটা বিরল সুযোগ হাতছাড়া হওয়ায় মনটা খিচড়ে গেছে বড় বেশি। তিক্ত হতাশা নিয়ে তিনজনে বন্দর শহরের পুকে পান করবার একটা দোকানে গিয়ে খানিকক্ষণ বসেছেন। সেখান থেকে বার হতে প্রায় সন্ধে হয়ে গেছে।

    পুলকে পানশালায় ওই সময়টুকু কাটানোই হয়েছে মারাত্মক ভুল। সর্বনাশ হয়ে গেছে ওই বিলম্বটুকুর মধ্যেই।

    সর্বনাশের খবরটা প্রথম পেয়ে বিশ্বাসই করতে পারেননি। বিশ্বাস করা সত্যিই শক্ত।

    পানশালা থেকে বেরিয়ে নগর-সীমানায় তখন নিজেদের আস্তানায় দিকে তিনজনে বিষণ্ণ মনে চলেছেন। হঠাৎ দুর থেকে একটি মূর্তিকে ছুটে আসতে দেখে চমকে উঠেছেন গানাদো।

    এ কী! এ তো আনা! কিন্তু আলুথালু বেশে অবিন্যস্ত কেশে এমন উন্মাদিনীর মতো চেহারা কেন?

    উন্মাদিনীর মতোই ছুটে এসে আনা গানাদোর একটা হাত ব্যাকুলভাবে জড়িয়ে ধরেছে! তারপর হাঁফাতে হাঁফাতে এক নিঃশ্বাসে যা বলেছে তা পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কী হতে পারে?

    সোরাবিয়া গানাদোদের আস্তানা থেকে কয়াকে জোর করে ধরে নিয়ে একটা জাহাজে পালাচ্ছে। এখনও বন্দরে ছুটে গেলে তাকে বাধা দেওয়া যায়। এই হল আনার উত্তেজিত যন্ত্রণাকাতর কণ্ঠের নিবেদন।

    বিশ্বাস করা যায় এরকম আজগুবি অসম্ভব সংবাদ।

    সোরাবিয়া কোথা থেকে এল এখানে? তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অনেকগুলি প্রশ্ন করেছেন। গানাদো, তুমি হঠাৎ এ খবর দেওয়ার জন্যে ছুটে এসেছ কেন? কয়া তো অসাড় গাছ-পাথর নয়। তাকে এই দিনের আলোয় নগরের রাস্তা দিয়ে বন্দর পর্যন্ত নিয়ে। গেল কী করে? জাহাজেই বা তুলল কীভাবে?

    এসব প্রশ্ন এখন করবার নয়। আকুল অস্থিল হয়ে উঠেছে আনা, তোমার কয়াকে যদি বাঁচাতে চাও এখনই বন্দরে গিয়ে ধরবার চেষ্টা করো সোরাবিয়াকে।

    কয়া-কে বাঁচাবার জন্যে এত ব্যাকুল কখন থেকে হলে! তীব্র বিদ্রূপের স্বরে বলেছেন গানাদো, সোরাবিয়া তো মন্ত্র পড়ে আমাদের হদিস পায়নি। আমাকে ও কয়াকে ধরিয়ে দেবার জন্যে তুমিই তো তাকে সব জানিয়েছ?

    হ্যাঁ, জানিয়েছি! কান্না-চাপা গলায় বলেছে আনা, ঈর্ষা আর প্রতিহিংসার জ্বালায় আমি তখন উন্মাদ হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করো, আজ নিজের জীবন দিয়েও সে ভুল, সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আমি প্রস্তুত! কিন্তু এসব কথায় কাটাবার সময় এখন নেই! তুমি এখনও বন্দরে গেলে হয়তো তাকে ধরতে পারবে। আমায় তুমি যত খুশি ঘৃণা করো, দাস, সেই ঘৃণার ভেতর দিয়েই তোমার মনে একটু জায়গা পেয়ে আমি এখন খুশি থাকব। কিন্তু আমায় তুমি অবিশ্বাস করো না। আর এক মূহূর্ত দেরি না করে তুমি বন্দরে যাও।

    গানাদো কিন্তু নিজের সমস্ত প্রশ্নের উত্তর না শুনে সেখান থেকে এক পা নড়েননি। এমনই অবুঝ সর্বনাশা জেদ হয়েছিল তাঁর সেদিন।

    অপ্রকৃতিস্থর মতো অস্থির উত্তেজিত কণ্ঠে আনা এবার যা জানিয়েছে তার সার কথা হল এই যে সোরাবিয়া কয়েক দিন আগে পেরু থেকে পানামায় ফেরে। আনার মতো সে-ও মার্কুইস গঞ্জালেস দে সোলিস হিসাবে পানামার গভর্নর-এর অতিথি হয়। বলে দুজনের দেখা হয় আপনা থেকেই। আনার কাছে গানাদোর খবর জানতে পেরে সোরাবিয়া তখনই আনাকে নিয়ে নোমৰ্বে দে দিয়স বন্দরে আসার ব্যবস্থা করে। এখানেই যে গানাদো আর কয়াকে সে ধরতে পারবে এ বিষয়ে তার কোনও সন্দেহ। ছিল না। আগেকার এক সপ্তাহের মধ্যে কোনও জাহাজ বন্দর থেকে ছাড়েনি জেনে সে আরও নিশ্চিন্ত হয়। নিজেকে প্রচ্ছন্ন রেখে সে গোপনে গানাদোর হদিস পাবার চেষ্টা করে। নগরের পথে একদিন ফেলিপিলিওকে দেখে তাকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে গানাদোর সন্ধান সে পেয়েও যায়। সেই সঙ্গে কয়াকেও সে দেখে। এবার সে যে শয়তানি মতলব ভাঁজে তা বাহাদুরি করেই হিংস্র বিদ্রূপের সঙ্গে আনাকে জানায়। গানাদোকে ফেরারি গোলাম হিসেবে সে ধরিয়ে দেবে, কিন্তু শুধু তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকবে না। কয়াকেও সে লুঠ করে নেবে। আনা যে তার বিবাহিতা স্ত্রী হয়েও গানাদোর প্রেমে হাবুড়ুবু, এ লুণ্ঠন হবে তারই প্রতিশোধ। পানামা থেকে রওনা হবার পর থেকেই নিজের অপরাধের পরিমাণটা বুঝতে পেরে আনা অনুশোচনায় দগ্ধ হতে শুরু করেছে। এবারে সে সোরাবিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যেই বেঁকে দাঁড়ায়। গানাদো যে আর গোলাম নয়, মুক্ত স্বাধীন নাগরিক, সম্রাটের সই করা সনদ দেখিয়ে বন্দরের কোতোয়ালকে তা সে জানিয়ে দেবে বলে। হিতে বিপরীত হয় এ শাসানিতে। সোরাবিয়া প্রথমে আনার কাছ থেকে গানাদোর মুক্তিপত্র জোর করে আদায় করবার চেষ্টা করে। কোথায় আনা সে সনদ লুকিয়ে রেখেছে জানবার জন্যে যতখানি সম্ভব শারীরিক উৎপীড়ন করতে সে দ্বিধা করে না। তা সত্ত্বেও বিফল হয়ে আনাকে প্রায় অজ্ঞান অবস্থায় তাদের এখানকার আশ্রয় নিবাসের একটি ঘরে বন্ধ করে রেখে সোরাবিয়া তার ভাড়াকরা গুণ্ডাদের নিয়ে গানাদোর আস্তানায় হানা দেবার মতলব আঁটতে বসে পাশের ঘরেই। গানাদোর আস্তানায় হানা দিয়ে জোর করে হাত পা মুখ বেঁধে তারা কয়াকে বার করে আনবে। তারপর কফিন-এর বাকসে পুরে মৃতদেহের মতো তাকে বয়ে নিয়ে যাবে বন্দরের দিকে। সেদিকের নির্জন রাস্তায় একবার পৌঁছোতে পারলে থলির মধ্যে ভরা কোনও চালানির মাল হিসেবে কয়াকে জাহাজে তুলে তখনকার মতো সোরাবিয়ার নিজের ভাড়া করা কেবিনে বন্দি করে রাখা মোটেই শক্ত হবে না। এই পরামর্শ করে ভাড়াটে গুণ্ডাদের নিয়ে সোরাবিয়া বেরিয়ে গেছে। প্রতিবেশীদের একজন আনার চিৎকার আর দরজায় আঘাত শুনে যখন এসে তাকে মুক্ত করেছে তখন আনার নিজে থেকে কিছু করবার আর উপায় নেই। এইটেই তাঁর যাতায়াতের পথ জেনে আনা তাই আকুলভাবে গানাদোর জন্যে এখানে অপেক্ষা করে আছে। সোরাবিয়ার পৈশাচিক ষড়যন্ত্র শেষ মুহূর্তে যদি ব্যর্থ করা যায় এই আশায়।

    এত কথা শোনবার পরও যদি গানাদো বন্দরের বদলে তাঁর আস্তানাতেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হবার জন্যে না ফিরে যেতেন।

    আস্তানায় ফিরে গিয়ে নিজের চোখে অবশ্য তিনি রক্তাক্ত মুমূর্ষ ফেলিপিলিওকে দেখেছেন। শেষ নিঃশ্বাস পড়বার আগে শুনেছেন তার ক্ষীণ স্তব্ধপ্রায়, কণ্ঠে সোরাবিয়ার পৈশাচিক আক্রমণের কথা। সেই আক্রমণ ঠেকাবার জন্যেই প্রাণ দিয়ে ফেলিপিলিও তার দেশদ্রোহিতার প্রায়শ্চিত্ত করে গেছে।

    কাপিন সানসেদো আর ডন মোরালেস-এর ওপর ফেলিপিলিওর উপযুক্ত সৎকারের ভার দিয়ে গানাদো তারপর বন্দরে ছুটে গেছেন।

    কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে একটু বেশি। রাতের অন্ধকার গাঢ় হয়ে তখন নেমে এসেছে পৃথিবীর ওপর। সেই অন্ধকার। উত্তর আকাশের ঈষৎ ফিকে পশ্চাৎপটে সোরাবিয়ার সঙ্গে বন্দিনী কয়াকে যা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে সেই জাহাজটার গাঢ় কৃষ্ণ রেখাকৃতি আর তার মধ্যে একটা নাতি উজ্জ্বল আলোর বর্তিকা ক্রমশ দূরে সরে যেতে দেখা গেছে। আর মাত্র কিছুক্ষণ আগে এলে বুঝি এ জাহাজের নোঙর ভোলা বন্ধ করবার চেষ্টা করা যেত।

    শ্রীঘনশ্যাম দাস চুপ করলেন আর সেই সঙ্গে সঙ্গে ককিয়ে উঠলেন কুম্ভোদর রামশরণবাবু, ওই পাপিষ্ঠ সোরাবিয়া কয়াকে অমন করে অবাধে লুঠ করে নিয়ে চলে গেল?

    না, তা আর যেতে পারল কই! শ্রীঘনশ্যাম দাস আর সকলের তো বটেই, মর্মর মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবুর মুখেও অস্ফুট একটু প্রসন্ন হাসি ফুটিয়ে বললেন, বন্দরের সীমানা ছাড়িয়ে খোলা দরিয়ায় পড়তে না-পড়তে জাহাজের হালি গায়ের ওপর কয়েক ফোঁটা জল পড়ায় চমকে উঠেছে।

    মেঘের বাষ্প কোথাও নেই। এমন ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ থেকে জলের ফোঁটা ঝরে কেমন করে?

    ওপর দিকে চেয়ে শিউরে উঠেছে হালি। শিউরে উঠেছে সোরাবিয়াও। জাহাজ বন্দর থেকে ছাড়বার পর থেকে এতক্ষণ পর্যন্ত সে ডেকের ওপরেই আছে, নির্বিঘ্নে খোলা দরিয়ায় পৌঁছোনোটুকু দেখে যাবার জন্যে।

    খোলা দরিয়ায় পৌঁছোবার পর নিশ্চিন্ত হয়ে এবার সে তার বন্দিনীর খবর নেবার জন্যে ফিরতে যাচ্ছিল। ফেরার মুখেই ওপর থেকে কয়েক ফোঁটা জল পড়তে সে চমকে উঠেছে হালির মতো, তারপর শিউরে উঠেছে ওপর দিকে চেয়ে।

    ওপরে যা দেখেছে তাতে নিজের চোখকেই প্রথমত বিশ্বাস সে করতে পারেনি। একেবারে জাহাজের মাথার কাছের পাল ফোর-টপ-সেল-এর আড়াল থেকে একটা অদ্ভুত আবছা ছায়ামূর্তি বেরিয়ে এসেছে।

    ছায়ামূর্তি নিছক ছায়া কিন্তু নয়। জলের ফোঁটাগুলো তার গা থেকেই যেন পড়ছে।

    এবার।

    ফোর-টপ-সেল থেকে মাস্তুলের দড়ি বেয়ে ছায়ামূর্তিটা মিজেন পালের দিকে নেমে এসেছে এবার।

    কাঁপা হলেও তীক্ষ্ণ গলায় সোরাবিয়া জিজ্ঞাসা করেছে, কে? কে ওখানে? ছায়ামূর্তিটা তখন টপ-মাস্ট মাস্তুলের কাছে। সেখান থেকে বুকের রক্ত হিম করে দেওয়া গলায় উত্তর এসেছে, তোমার নিয়তি!

    মিজেন মাস্তুল বেয়েই মূর্তিটা তারপর খানিকটা নেমে এসে লাফিয়ে পড়েছে। ডেকের ওপর।

    তুমি! তুই! ভয় বিস্ময় আর হিংস্র উল্লাস মেশানো একটা অদ্ভুত চিৎকার বেরিয়ে এসেছে সোরাবিয়ার গলা থেকে। তারপর পৈশাচিক একটা অট্টহাসি।

    হ্যাঁ আমি, সত্যিই তোমার নিয়তি—সোরাবিয়ার অট্টহাসি থামবার পর জবাব দিয়েছে সে মূর্তি—তোমার সঙ্গে শেষ হিসেব-নিকেশ বাকি ছিল এতদিন। সেই জন্যেই আজ এসেছি।

    হিসেব চুকোবার সাধ তোর সত্যিই আজ মিটিয়ে দেব! কোমরের খাপ থেকে একটানে নিজের হিংস্র আক্রোশের মতোই ধারালো তলোয়ারটা খুলে বার করে বলেছে সোরাবিয়া, তুই নিজেকে আমার নিয়তি ভাবছিস? নিয়তি নয়, তুই আমার নিয়তির উপহার। আমার অনেক দিনের দারুণ একটা সাধ মিটিয়ে দেবার জন্যেই তোকে এমন করে আজ পাঠিয়েছে। তা না পাঠালে বন্দর থেকে ছেড়ে-যাওয়া এ জাহাজ সাঁতরে এসে ধরা তোর সাধ্যে কুলোত! নে এবার তৈরি হয়ে, ইষ্টনাম যদি কিছু থাকে তো জপ করে নে! এ আর চার দেয়ালের বন্ধ ঘর নয় যে, নাচের পা চালিয়ে বেঁচে যাবি। এ খোলা জাহাজের ডেক। এই হালিকে সাক্ষী রেখে বলছি, এই ডেকে তোর ঝাঁঝরা করা লাশ আজ শোয়ব।

    সোরাবিয়া খোলা তলোয়ার নিয়ে প্রায় লাফ দিয়ে এগিয়ে গেছে এবার! তলোয়ার খুলে দাঁড়িয়েছে সে মূর্তিও। কিন্তু দু-জনের দ্বন্দ্বযুদ্ধের ধরন দেখে মনে হয়েছে, আস্ফালন যা করেছে তা-ই যেন সফল করে দেখিয়ে দেবে সোরাবিয়া।

    সোরাবিয়ার নিপুণ আক্রমণে মূর্তিকে ধীরে ধীরে পিছিয়ে যেতে দেখা গিয়েছে। জাহাজের সামনের মাস্তুল ফোর-মাস্টের দিকে। একেবারে প্রায় কিনারা পর্যন্ত গিয়ে আর পেছোবার উপায় নেই বলেই বোধহয় মূর্তিকে এবার সোরাবিয়ার মার ঠেকাবার ফাঁকে ফাঁকে মাস্তুল বেয়ে ওপরে উঠতে দেখা গেছে।

    পৈশাচিক উৎসাহে আনন্দে এবার চিৎকার করে উঠেছে সোরাবিয়া। সে দক্ষ নাবিক। পাল মাস্তুলের রাজ্য তার চোখ বুজে ঘোরা ফেরার জায়গা। ছায়ামূর্তির ভড়ংকরা নির্বোধ গানাদো সেই পাল মাস্তুলের জটলার মধ্যে তাকে এড়িয়ে পালাতে পারবে ভেবেছে!

    গানাদোর ধরন দেখে উদ্দেশ্যেটা তাঁর সেই রকমই মনে হয়েছে। ফোর-মাস্ট থেকে তিনি টপ-গ্যালান্ট মাস্তুলে গিয়ে উঠেছেন, সেখান থেকে রয়্যাল পালের আড়াল দিয়ে ফোর-রয়্যাল মাস্তুলে।

    এর পর আর ওঠবার জায়গা নেই। সোরাবিয়া তার হিংস্র উল্লাস আর চেপে রাখতে পারেনি। অনায়াসে রয়্যাল পালের একটা রশি বাঁ-হাতে ধরে তারই তলার আড়া কানাতে পা রেখে তীব্র অবজ্ঞার স্বরে বলেছে, এখান থেকে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পাবি, ভেবেছিস! ঝাঁপ দিতে হয়তো পারবি, কিন্তু তার আগে এফোঁড়-ওফোঁড় না হয়ে নয়। মিছেই এতটা কষ্ট করলি?

    না, মিছে নয়। এতক্ষণ বাদে প্রথম কথা বলেছেন গানাদো, তুমি ডেকের ওপর আমার লাশ শোয়াতে চেয়েছিলে, আমি কিন্তু এ জাহাজ তোমার রক্তে নোংরা করতে চাইনি। তাই তোমায় লোভ দেখিয়ে উঠিয়ে এনেছি এই মাস্তুলের ডগায়। এখান থেকে তোমার লাশটা আর জাহাজের ডেকে পড়বে না, পড়বে সমুদ্রের জলে যা অপবিত্র করার সাধ্য তোমার মতো শয়তানেরও নেই।

    গানাদোর কথা শেষ হবার আগেই উন্মাদের মতো তলোয়ার চালিয়েছে। সোরাবিয়া। সে তলোয়ার গানাদোর কাছেও পৌঁছোয়নি। একটি অদ্ভুত আঘাতে অনেক নীচের ডেকের ওপর ঝনঝন শব্দে আছড়ে পড়েছে।

    এইবার তোমার পালা। বজ্রস্বরে বলেছেন গানাদো, আমার তলোয়ারটাও তোমার রক্তে নোংরা করতে চাই না। শেষযাত্রায় গায়ে জড়াবার মতো একটা চাদর শুধু তোমার সঙ্গে দিচ্ছি।

    গানাদো পালের মাথার রশিতে কোথায় কী তলোয়ারের ঘা দিয়েছেন কে জানে। সমস্ত পালটা খুলে সোরাবিয়ার ওপর পড়ে তাকে জড়িয়ে নিয়ে বহু নীচের সমুদ্রের জলের ওপর একটা শব্দ তুলে অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেছে।

    সেদিকে একবার চেয়ে গানাদো ধীরে ধীরে মাস্তুলের মাথা থেকে ডেকের ওপর নেমে এসে হালিকে সোরাবিয়ার ভাড়া করা কেবিনটা কোথায় জিজ্ঞাসা করেছেন।

    সে যুগের জাহাজের মাল্লা, অস্ত্রবিদ্যার চেয়ে মানুষের মূল্য আর মর্যাদা মাপবার আরও বড় কোনও কিছু তারা জানে না। কম্পিত সমভরা গলায় হালি কয়া তখনও যেখানে বন্দি সে কেবিনের নির্দেশ জানিয়ে দিয়েছে।

     

    তার মানে, দাসমশাই থামতেই মাথার কেশ যাঁর কাশের মতো শুভ্র সেই হরিসাধনবাবু উৎসুক আশান্বিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছেন, ওই কয়াকে নিয়ে গানাদো শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরতে পেরেছিলেন?

    তা পেরেছিলেন বইকী! অনুকম্পা-মেশানো গম্ভীর স্বরে বলেছেন দাসমশাই; নইলে আমার নাম ঘনশ্যাম দাস হবে কেন? আর কিছুর জন্যে না হোক কাপিন সানসেদোর কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখবার জন্যেই তাঁকে ফিরতে হয়েছিল। ভাগ্যচক্রে ক্রীতদাস হয়ে যাঁকে স্পেনে আসতে হয়, আর কাপিন সানসেদো যাঁকে শ্রদ্ধাভরে মুক্তি দিয়ে গুরু হিসেবে বরণ করেন ঋষিতুল্য পরম পণ্ডিত সেই বৃদ্ধ ভারতীয় জ্যোতিষীর অন্তিম লিপি গানাদো অর্থাৎ ঘনরাম দাস সত্যিই যথাস্থানে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন।

    কোথায়? কার কাছে? মর্মর মসৃণ যাঁর মস্তক সেই শিবপদবাবু জিজ্ঞাসা না করে পারেননি।

    এখনকার কাটোয়ার কাছে ঝামটপুর বলে এক গ্রামে। দাসমশাই শিবপদবাবুর কৌতূহল মেটাতে জানিয়েছেন, কৃষ্ণদাস নামে এক সজ্জনের কাছে।

    কী ছিল সেই অন্তিম লিপিতে? এ জিজ্ঞাসা কুম্ভোদর রামশরণবাবুর। যা ছিল তা যথাযথ বলতে পারব না। শ্রীঘনশ্যাম দাস এ কৌতূহলও মিটিয়েছেন, তবে বৃদ্ধ জ্যোতিষী এই রকম কিছু লিখেছিলেন বলে জানি—গণনায় জানতে পারছি ১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস সমস্ত পৃথিবীর এক দুঃসময়। বিশ্বের অনন্য এক যুগাবতার তিরোহিত হতে চলেছেন ওই সময়ে। পারেন তো সেই পরম জ্যোতির্ময় সত্তার দীপ্ত দিব্যোন্মত্ত জীবনকথা অমর কাব্যে গেঁথে রাখবার চেষ্টা করুন।

    ১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস? কুম্ভোদর রামশরণবাবু একটু দ্বিধাভরে জিজ্ঞাসা করেছেন।

    হ্যাঁ, ১৪৫৫ শকাব্দের আষাঢ় মাস হল ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের জুলাই! উদার হয়ে তারিখটার তাৎপর্য বুঝিয়ে দিয়েছেন দাসমশাই, নীলাচলে শ্রীচৈতন্যদেবের তিরোধান ঘটে ওই সময়েই।

    একটু থেমে দাসমশাই আবার বলেছেন, কে জানে বৃদ্ধবয়সে বৃন্দাবন প্রবাসী হয়ে তাঁর শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত লেখবার প্রেরণা কৃষ্ণদাস কবিরাজ ওই লিপি থেকেই পেয়েছিলেন কিনা!

    —–x—–

    ⤶ ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14 15 16 17 18 19 20 21 22 23 24 25 26 27 28 29 30 31 32 33 34 35 36 37 38 39
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী
    Next Article মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    Related Articles

    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    প্রেমের প্রান্তে পরাশর – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ১ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    প্রেমেন্দ্র মিত্র

    ঘনাদা সমগ্র ২ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    October 13, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }