Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘর – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প105 Mins Read0
    ⤶ ⤷

    কেন যে? – আশাপূর্ণা দেবী

    কেন যে?

    ওই লোকটির মধ্যে যে কোনখানে কোথাও মান—অভিমানের বালাই বলে কিছু ছিল, থাকা সম্ভব, তা কে কবে ভেবেছে? ঘরে পরে?

    নীহারের মুখের বুলিই তো ছিল, মানুষ না জানোয়ার, কী তুমি? লজ্জা নেই, ঘেন্না নেই, মান নেই, অপমান নেই, ইতর ছোটলোক!

    পাড়াপড়শী আত্মীয়জনেরা বলত, আশ্চর্য বেহায়া লোক বাবা! গণ্ডারের চামড়া দিয়ে তৈরি নাকি কে জানে। বলতে তো কিছু কসুর রাখি না। তবু—

    আর লতু? সরকার বাড়ির লতু? যার কথাটা সব থেকে বুকে বাজত অধীরের। রক্তে সব থেকে দাহ ধরাত। লতু তার লাবণ্যময় মুখটাকে করুণ করুণ করে অনায়াসে বলত, মেসোমশাইয়ের কাণ্ড দেখে আমারই গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করে অধীরদা। বাবা কী বলে জানো? বলে, রাস্তার বেড়াল কুকুরটারও যেটুকু ময্যেদা জ্ঞান আছে, এ লোকের তাও নেই। তাদের দূর দূর হেয় হেয় করলে দুটো দিনও সে বাড়ি ঢোকে না। আর এই সুধীর ভট্চায—ছিঃ। শুনে যেন মাথা কাটা যায় অধীরদা! ভগবান যে ওঁকে কেন অমন করে গড়েছেন! কিন্তু ক্রমশ দেখা যাচ্ছে, ভগবানের সৃষ্টিতে পুরো ফাঁকি ছিল না। ওই সুধীর ভট্টচায লোকটার মধ্যে মান—অভিমান বলে বস্তু কিছুটা দিয়ে রেখেছিলেন কোন খাঁজে খোপে। অবশ্য একদিন দু’দিনে তা ধরা পড়েনি।

    প্রথম ক’দিন নীহারই বলেছে, যাবে আবার কোন চুলোয়! কে কোথায় ওঁর জন্যে ভাত বেড়ে নিয়ে বসে আছে? পকেটের পয়সা ক’টা ফুরোলেই সুড়সুড় করে চলে আসবে। খবরদার বিজ্ঞাপন—টিজ্ঞাপন দিতে যাবি না অধীর।

    রণধীর আর বাণ্টি চুপি চুপি বলাবলি করেছে যতদিন না আসে বাবাটা ততদিনই ভালো। বাড়িটা কেমন ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা রয়েছে দেখছিস!

    কিন্তু ওই আলোচনাগুলো ক্রমেই ধূসর হয়ে আসছে। ওই ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাটা যেন সংসারটাকে ঠাণ্ডা সারিয়ে দিচ্ছে। আর এমনি ভাগ্যের ফের, বাপকে গলা ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বিদেয় করার পর থেকেই অধীরের অর্ডার সাপ্লাইয়ের কাজটা যেন ফুলে ফেঁপে উঠছে।

    যখন আশাতীত সব অর্ডার আসে, নোটের গোছাগুলো হাতে নিয়ে মাঝে মাঝে যখন অবিশ্বাস্য লাগে, তখন গোপনে একটা নিশ্বাস ফেলে ভাবে অধীর, এর অর্থ কী? বাপকে গলাধাক্কা দিয়ে (মানে সত্যি সত্যি আক্ষরিক অর্থেই) বাড়ির বার করে দেওয়া তো পাপই। মহাপাপ! তা সে যেমন চরিত্রের বাপই হোক। অথচ সেই তখন থেকেই কেন এমন বাড়বাড়ন্ত। এখন টাকা হাতে নিয়ে এক এক সময় ভারী বিষণ্ণ হয়ে যায় অধীর। তখন যদি এ অবস্থা আসত! এর অর্ধেক আয় হলেও বাপের হাতে নিশ্চয় কিছু কিছু তুলে দিতে পারত সে। তাহলে ওই নোংরামিটা করে বেড়াত না বাবা।

    কী না করেছে সুধীর ভটচায, কত না উঞ্ছবৃত্তি তার নেশার খরচ জোটাতে। লোকের দোরে দোরে হ্যাংলার মতো বারবার গিয়েছে, হাতে পায়ে ধরেছে, পৈতে ছুঁয়ে দিব্যি গেলেছে, এই শেষ আর চাইবে না, আর ছেলেকে শাপমন্যি দিয়েছে বাপের নেশার খরচ বন্ধ করে দেওয়ার জন্যে।

    ভালো হবে না! এই বলে দিচ্ছি অধীর, তোর ভালো হবে না। তোর দুঃখে শ্যাল কুকুর কাঁদবে। বাপের শাপ, ব্রহ্মশাপ, তা মনে রাখিস। ছেলেকেও একদিন পৈতে ছিঁড়ে অভিশাপ দিয়েছিল সুধীর ভট্চায। শেষ অবধি আবার ছেঁড়া পৈতেটা কুড়িয়ে নিয়ে গিঁট দিয়ে পরেছিল, আর আজও শেষ অবধি সেই গিঁট দেওয়া তেলচিটা পৈতেটাই গলায় ছিল তার।

    বাপের সেই ময়লা পৈতে পরা খালি গা চেহারাটা যখনই চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু কই, বাপের শাপ যদি ব্রহ্মশাপ হতো অধীরের ভাগ্যে উল্টোটাই হচ্ছে কেন? বাপ গিয়ে পর্যন্ত অবিরত ভালোই তো হচ্ছে তার। প্রথম যেদিন একসঙ্গে অনেকগুলো টাকা পেয়েছিল অধীর, সেদিন তার থেকে দুখানা বড় নোট হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে ছিল, মনে মনে একখানা শীর্ণ শিরাবহুল হাতের দিকে বাড়িয়ে ধরে। তারপর আস্তে উঠে তুলে রেখেছিল দেরাজের একেবারে নীচে কাপড়—চোপড়ের তলায়। এখনও সে দুটো সেই ভাবেই তোলা আছে! অভাবের থাবা তাকে মুঠোয় চেপে উঠিয়ে নিয়ে যায়নি। কারণ অভাব বলতে অধীরের এখন শুধু সময়ের অভাব। আর কিছু না। হয়তো ভুলেই গেছে অধীর ও দুটোর কথা। অথবা মানতি পূজোর মতো তুলে রেখে দিয়েছে! কে জানে সেই শীর্ণ শিরাবহুল হাতখানা সত্যি প্রত্যক্ষ মূর্তিতে সামনে বাড়ানো থাকলে কী হত! এই মন কেমন, এই বিষণ্ণতা, এই অপরাধ—বোধ, মরুভূমিতে জলের ফোঁটার মতো শুকিয়ে যেত কিনা। দায়হীন ভারহীন তীব্রতার স্পর্শহীন ছায়াটুকুর সঙ্গে দুর্দান্ত দুরন্ত দাপুটে কায়ামূর্তির তফাৎ অনেক। ইচ্ছে করে অনেক সময় অধীর তার এই সাজানো সংসারে সেই দুরন্ত উপস্থিতিটা অনুভব করতে চেষ্টা করে, কিন্তু চেষ্টাটা দানা বাঁধে না। কিছুতেই সেই অসহনীয়তাটা অনুভবে আনতে পারে না। কেবলই কিছু কিছু নোটের গোছা সব আবছা করে দেয়?

    টাকা হাতে পেলে কি অমন হ্যাংলা আর হিংস্র থাকত সুধীর ভটচায নামের মানুষটা? লোকের কাছে হ্যাংলা, বাড়িতে হিংস্র। কিন্তু শুধুই কি হিংস্র, একটা সাধারণ গেরস্থ ঘরের মানুষের পক্ষে যত রকম নিঘিন্নেপনা, মিথ্যে কথা, জোচ্চুরী, হাত সাফাই, আর সর্বোপরি নির্লজ্জ মনোবিকার। বাড়িতে একটা কমবয়সী ঝি রাখবার পর্যন্ত জা ছিল না নীহারের! দৈবাৎ অসুবিধেয় পড়ে রাখতে হলে পাহারা দিয়ে দিয়ে বেড়াতে হত নীহারকে।

    এদিকটা অবশ্য জানা ছিল না অধীরের। বিবাহিত পুরুষ তো নয় যে, সংসারের সর্ববিধ ঘটনার রিপোর্ট পাবে। মনের ঘেন্নায় চক্ষুলজ্জার দায়ে অথবা কী জানি আর কিসের জন্যে বড় ছেলের কাছে অনেক কিছুই লুকাতো নীহার। কিন্তু বাকিগুলো তো হাড়ে হাড়ে টের পেত অধীর।

    টাকা এনে কোথায় লুকিয়ে রাখবে ভেবে পেত না, মায়ের কাছে রেখে দিয়েও তো স্বস্তি নেই। সংসার খরচের জন্যে গুণে গুণে যেটুকু তুলে দেয় মায়ের হাতে, তার থেকেও তো কেড়ে নেয় মায়ের পতি পরম গুরু, খোসামোদ করে পায়ে পড়ে, অথবা খিঁচিয়ে, অকথ্য গালমন্দ করে হাত মুচড়ে।

    দুটো একটা টাকাও প্যাণ্টের পকেটে রাখবার জো নেই, কোন ফাঁকে আলনায় ঝোলানো প্যাণ্টটার পকেটে হাত চালিয়ে সাফাই করেই উধাও হয়ে যাবে অধীরের পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্মঃ…।

    অসময়ে চাকরি খুইয়ে বসে থাকাও তো সুধীরের ওই গুণটির কল্যাণে। একদা তো একটা মাড়োয়ারী কর্ম প্রতিষ্ঠানে হিসাব রক্ষকের কাজ করত সুধীর ভট্টচায, বাড়ির লোকে অবশ্য কোন দিন তার পুরো মাইনের হিসেব জানত না, পেতও না, তবু নেহাৎ খারাপ ছিল না কাজটা। তা ছাড়াও অন্য নানাবিধ সুবিধা ছিল।

    কিন্তু তলায় তলায় তিল তিল করে লোভের গর্ত খুঁড়ে চলেছিল সুধীর, এক সহকর্মী এক গুরুর প্ররোচনায় আর দুঃসাহসে।

    লোভই ছিল সুধীরের, বুদ্ধি ছিল না। অতএব হঠাৎ একদিন সেই তিলের গহ্বরটি তাল প্রমাণ হয়ে মনিবের গোচরে এসে গেল। সুধীরের গুরু সেই পরামর্শদাতাটি দিব্যি গা বাঁচিয়ে রয়ে গেল, সুধীরের চাকরিটি খতম হল। জেল হল না এই ঢের।

    মনিব বলেছিল, নিজের ঝঞ্ঝাট বাঁচাতে থানা পুলিশ করতে গেলাম না, তবে ভবিষ্যতে এইটা যেন তোমার জীবনের শিক্ষা হয়…আর শিক্ষা! কর্মজীবনে সেইখানেই সমাপ্তি—রেখা সুধীর ভট্টচার্যের। তদবধিই উঞ্ছবৃত্তির ওপর থেকেছে। নেহাৎ তখন থেকেই অধীর কিছুটা আনতে শিখেছে, তাই সংসারটা বালির চড়ায় মুখ থুসড়ে পড়েনি। কিন্তু সুধীরের চাহিদা মেটানো সম্ভব ছিল না, ইচ্ছেও ছিল না। বাপের ওপর রাগে ঘৃণায় সর্বদা শরীর রী রী করত অধীরের।

    বাপের সঙ্গে কথা কইতেও প্রবৃত্তি হত না। হবেই বা কী করে? যে লোক কেবল মাত্র উঞ্ছবৃত্তি আর ভিক্ষুক বৃত্তির ওপর চলতে চলতে নেশার মাত্রা বাড়িয়েছে বলে, তার ওপরে কার শ্রদ্ধা ভালোবাসা আসবে?

    লোকটারও হয়তো কর্মহীন দায়হীন শ্রদ্ধা ভালোবাসার সম্বন্ধহীন নিরলম্ব জীবনটার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিল গাঁজা কোকেন ধেনো মদ।

    ক্রমশ ঘৃণ্য এবং ভীতিকর হয়ে উঠছিল লোকটা ঘরে বাইরে। যতক্ষণ বাড়ির বাইরে থাকে শান্তি, বাড়ি ঢুকতে দেখলেই স্ত্রী পুত্র কন্যা সকলের আতঙ্ক। ওই এলো ধূমকেতুর মূর্তিতে।

    আর বাইরের লোক? চেনা লোক রাস্তায় দেখা হলে না দেখার ভান করে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায় পাছে টাকা চেয়ে বসে। বাড়িতে আসছে দেখলে তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিয়ে ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দেয়, বলিস আমি বাড়ি নেই। তবু তার মধ্যে থেকেও নাছোড়বান্দা ভিখিরির মতো—

    সবথেকে বেশী ঘেন্না করেছে বিজন সরকার। লতুর বাবা। বলেছে, আপনার না হয় গায়ে গণ্ডারের চামড়া, কিন্তু আমার পকেটটা তো রবারের নয়! দয়া করে আর আসবেন না। আর এলে কিন্তু অপমানী হতে হবে।

    যেন হচ্ছে না সেটা। যেন এটা অপমান নয়। কিন্তু তবু কি ঠেকাতে পেরেছে? সুধীর ভটচায যে একদা বিজন সরকারের দাদা বিনয় সরকারের ক্লাশফ্রেণ্ড ছিল, সেই কথা তুলে কাকুতি মিনতি করেছে সুধীর।…মরে যাওয়া দাদার ক্লাশফ্রেণ্ড সম্পর্কে কোন রকম দুর্বলতার ভাবই দেখায়নি বিজন সরকার, কিন্তু তার টাকা আছে অনেক, তাই তার কাছেই ধর্ণা দিতে গেছে সুধীর। তাছাড়া আরো একটা কারণ, তার ব্যাটা অধীরের টিকিটা এখানে বাঁধা পড়ে রয়ে আছে, অতএব চক্ষুলজ্জার দায়ে এবং মেয়ের মুখ চেয়ে না দিয়ে পারবে না বিজন।

    কিন্তু আশ্চর্য, এই লোকটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউই গলা খুলে বলছে না, বাঁচা গেছে, আপদ গেছে, হাড়ে বাতাস লেগেছে আমাদের—

    বরং সকলেরই কোথায় যেন একটা অপরাধ—বোধ আলপিনের খোঁচার মতো চিনচিন ধরাচ্ছে। ভাবটা—আহা, লোকটাকে অত দূরছাই না করলেই হত! নশো পঞ্চাশ কিছু তো চাইত না, বড় জোর টাকাটা সিকেটা, তার জন্যে বড় বেশী অপমান করা হয়েছে। কেউ কেউ আরো মমতায় গলে বলেছে, কী করবে, নেশার দাস হয়ে মরেছিল, অথচ ছেলে এক পয়সা হাত খরচ দিত না—তাই অমন করে বেড়িয়েছে। …নেশা যে মানুষকে অমানুষ করে ছাড়ে।

    হঠাৎ অবস্থা ফিরে যাওয়ায় এখন আর মুখোমুখি কেউ কিছু বলছে না অধীরকে। গোড়ার দিকে বলেছে বৈকি। দূর সম্পর্কের আত্মীয়রা এসে এসে বলে গেছে, যতই হোক জন্মদাতা পিতা তো বটে। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়াটা উচিত হয়নি তোমার অধীর! শুনতে পেলাম নাকি যেতে চাইছিল না, দরজা আঁকড়ে বসে পড়েছিল, তুমি ঠেলতে ঠেলতে বার করে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলে!

    কথাটা মিথ্যা নয়, তাই দিয়েছিল বটে, অধীর নামের সেদিনের সেই তীব্র গোঁটা।

    তোমায় আজ আমি বিদেয় করে তবে ছাড়ব—

    কথাটা যেন যখন তখনই হঠাৎ হঠাৎ কানে বেজে ওঠে অধীরের। কথা নয়, গর্জন। কার গলা? অধীরের? এত কটু কঠোর রুক্ষ কর্কশ গর্জন অধীরের গলা থেকে বেরোতে পারে? তা পেরেছিল তো।

    কিন্তু ওরা কি করে জানল? ওদের তো জানবার কথা নয়!

    সংবাদদাতা পরিবেশিতই অবশ্য। কিন্তু কে সেই সংবাদদাতা? রণধীর? বাণ্টি? মা?…কোনটাই সম্ভব নয়। বাণ্টি রণধীরের তো কথাই ওঠে না, মার পক্ষেও অসম্ভব! সত্যি বলতে কি মার জন্যেই তো আরো—

    সেই সন্ধ্যাটাকে মাঝে মাঝেই উঁচু তাক থেকে পেড়ে নামায় অধীর। এদিক থেকে ওদিক থেকে এগিয়ে পিছিয়ে সামনে থেকে অনেক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে, আর গভীর পরিতাপের সঙ্গে অস্থির উত্তেজনা নিয়ে ভাবে—ভেস্তে যাওয়া ফেলার তাসগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে আবার যদি নতুন দান সাজিয়ে বসা যেত! যদি ফিরিয়ে নেওয়া যেত সেই সন্ধ্যাটাকে!

    খুব যথাযথ মনে করতে পারে অধীর সেই সন্ধ্যাটাকে। কারণ সেই কেবলই মনের মধ্যে মেলে ধরে দেখে অধীর।

    বাপের কেলেঙ্কারীতে ধিক্কারে অপমানে লতুদের বাড়িতে আর যাচ্ছিল না ক’দিন অধীর, হঠাৎ রাস্তায় দেখা হল লতুর সঙ্গে। মান—অভিমান দেখাল খানিকটা, তারপরই বলল, তোমার বাবাকে তুমি কিছু কিছু টাকা দিও অধীরদা ওই সব নেশা—ফেশা করার জন্যে। নইলে আমার বাবার কাছে তো আর আমার মুখ থাকছে না। আজ কী হয়েছে জানো? সত্যি করে বাবার পায়ে ধরেছে মেসোমশাই। বলেছে বয়োজ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ হয়ে তোমার পায়ে ধরছি বিজন, পাঁচটা টাকা আজ আমায় দিতেই হবে।…তা মা বলল…লতু মুখটাকে আদুরী আদুরী করে বলে উঠল, মা বলল, বামুন মানুষ পায়ে ধরছে, দিয়ে দাও টাকা ক’টা। পাঁচটা টাকা তো তোমার হাতের ময়লা! কিন্তু এ কথাও বলে বসেছে, অমন হাঘরের ছেলের সঙ্গে তোর বে দিচ্ছিনে আমি।… মাথায় আমার আকাশ ভেঙে পড়েছে অধীরদা।…

    আকাশ—ভাঙাভাঙি আবার কী? বিয়ে—ফিয়ে তো করছি না—বলে অধীর রাগে জ্বলতে জ্বলতে বাড়ি ফিরেছিল।

    শরীরের সব রক্ত যেন আগুন হয়ে উঠেছে, জিভেয় স্বাদ তেতো। মনের অনুভূতি যেন জিভে এসে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। ঢোক গিলতেও যেন তেতো লাগছিল। এই শরীর মন নিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকার পথেই শুনতে পেলো—মরো মরো, এক্ষুনি মরো তুমি! তোমার যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে শাঁখা নোয়া ভেঙে গঙ্গা নেয়ে উঠি আমি।

    কী কুৎসিত! কী অশ্লীল! ছুটে বাড়ির মধ্যে ঢুকে এলো অধীর। দেখতে পেলো মায়ের আঁচলটা টেনে ধরে তাতে দাঁত বসাচ্ছে বাবা। গিঁট বাঁধা আছে মোক্ষম করে, নখের চেষ্টায় খোলবার ধৈর্য নেই, তাই দাঁতে ছিঁড়ে নিচ্ছে গিঁটটা সমেতই। গিঁট মানেই তো টাকা!

    অধীর যে মুহূর্তে ঢুকেছে, সেই মুহূর্তেই খানিকটা শাড়ি ফ্যাঁস করে ছিঁড়ে এসেছে সুধীরের দাঁতে।…বিপর্যস্ত নীহার গা কাপড় সামলাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে।

    কী হচ্ছে কী? গর্জন করে ওঠে অধীর।

    ছেলের সামনে কেঁচো। আর কথা নেই দুর্দান্ত সুধীর ভটচাযের।

    চেঁচিয়ে ওঠে নীহার, তুই এসেছিস! দ্যাখ, দ্যাখ তোর বাপের কীর্তি। বোঝ না কেন গালমন্দ করি। তুই সেই দশটা টাকা দিয়ে গেলি রেশনের জন্যে, আজ আর আনা হয়নি লক্ষ্মীছাড়া ছোটলোক টের পেয়ে আঁচল ছিঁড়ে কেড়ে নিচ্ছে—

    অধীর তাকিয়ে দেখে দেয়ালের ধারে বাণ্টি আর রণধীর ভয়তরাসে চোখে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে এই নাটকীয় দৃশ্য অবলোকন করেছে। আর বাবা গোঁজ হয়ে খুলে পড়ো পড়ো লুঙ্গিটা সামলে বাঁধছে, বোধ করি সটকান দেবার তালে।

    তেড়ে গিয়ে বাপের ঘাড়টা চেপে ধরে অধীর। আর ওই কটু কর্কশ রুক্ষ কঠোর দাঁত পেষা শব্দটা কোথা থেকে যেন উচ্চারিত হয়—তোমায় আজ আমি বিদেয় করে তবে ছাড়ব।

    তখন তো নীহারও আরও কটু আরও কর্কশ।—দে দে, তাই দে! ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দে।…এই ইতর ছোটলোক চামারকে নিয়ে আর পারছি না আমি…দে বার করে দে—হাড় জুড়ুক আমার।

    সত্যিই তাই দিল অধীর।—যাও বেরিয়ে যাও। আর এ বাড়ীতে মাথা গলাতে চেষ্টা কোরো না।

    ঠেলতে ঠেলতে পার করে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল অধীর তার হতভম্ব বাপের মুখের ওপর। হতভম্বই। সত্যি এমনটা হতে পারে তা বোধহয় ভাবতেই পারেনি সুধীর ভট্চায। শেষ চেষ্টা করতে দরজাটা আঁকড়ে ধরল, কিন্তু দুরন্ত রাগে জ্ঞান—শূন্য জোয়ান ছেলের জোরের সঙ্গে পারবে কেন?

    এক ঝটকায় হাতটা খসে পড়তেই লোকটা হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল। তারপর চেঁচিয়ে বলে উঠল, আচ্ছা, ঠিক আছে। আর এ ভিটেয় পা দিচ্ছি না আমি। এই শেষ!

    দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে অধীর হাঁপাতে থাকে, আর কথা বেরোয় না মুখ দিয়ে। কিন্তু নীহার তখনও চেঁচিয়ে চলে, মানুষের রক্ত যদি গায়ে থাকে তো ট্রামলাইনে মাথা পাতগে। লরীর তলায় ঝাঁপ দাওগে—কিছু না পারো, মা গঙ্গা আছেন।

    মা থামো। ক্লান্ত বিধ্বস্ত অধীর ভটচায গম্ভীর খাদে নামা গলায় বলে ওঠে, মা থামো।

    এই নিষেধবাণী কাজে লাগে। হঠাৎ একেবারে চুপ হয়ে যায় গলার শির ওঠা ইস্পাত শক্ত চোয়াল পেশী কঠিন মুখ, একটা ক্ষ্যাপা গোঁ।

    কিন্তু এই দৃশ্যর আর কোন দর্শক ছিল না, বাদে, বাণ্টি রেণু আর মা ছাড়া।…অথচ অধীরের যে যেখানে আছে সবাই জেনে ফেলল, কী কী ঘটনা ঘটেছিল, কোন পরিস্থিতিতে মূল ঘটনাটা ঘটল।…আশ্চর্য হয়ে যায় অধীর।

    নাটকের ক্লাইম্যাক্সের পর যেন কিছুক্ষণের জন্যে মঞ্চে যবনিকা পড়ল। সাড়াহীন শব্দহীন একটা ভয়ঙ্কর স্তব্ধতা। অধীর নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়েছে, জানে না কে কোথায় কি করছে।

    অনেকক্ষণ পরে হঠাৎ ওই স্তব্ধতা বিদীর্ণ করে নীহারের ভাঙা ফাটা গলাটা কথা কয়ে উঠল—এই লক্ষ্মীছাড়ি বাণ্টি মজা করে ঘুম মারতে গেলি যে? জল দেওয়া পিঁড়ি পাতা সেও কি আমায় করতে হবে?

    অধীরের ঘুম এসেছিল, ধড়মড় করে উঠে বসল। সংসারটা তাহলে থেমে যায়নি। নিত্য নিয়মে পিঁড়ি পড়বে, তার পাশে পাশে জলের গ্লাস বসবে, আহার্যপূর্ণ থালাও বসবে সামনে। মায়ের তীব্র অভিযোগের কণ্ঠ সেই পরম আশ্বাসবাহী।

    দাদাকে ডাক। শুনতে পেল অধীর। ডাকের অপেক্ষায় পড়ে রইল।

    বাণ্টি এসে ডাকল, দাদা এসো, মা খেতে দিয়েছে।

    অধীর চৌকী থেকে নেমে দাঁড়িয়ে হাই তুলে সহজ হবার ভঙ্গীতে বলে, বাবা ফিরেছে?

    বাবা! বাণ্টি প্রায় অবাক গলায় বলে, বাবা আবার ফিরবে?

    অধীর আরও সহজ হতে চেষ্টা করে, ফিরবে না তো কি সত্যি সত্যি চলে যাবে নাকি? কোথায় থাকবে রাত্তিরে?—প্রবোধটা বাণ্টিকেই দিল অধীর, না নিজেকে, তা কে জানে।

    অধীর ভেবেছিল ছেলেমেয়েদের খাইয়ে মা নিজের খাবার ঢেকে রেখে বসে থাকবে। এবং অধীরকে বলতে হবে, কেন মিথ্যে বসে থাকবে? আজকে আর আসবে না বাবা—রাতটা রাগ করে কোথাও পড়ে থাকবে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল মা তাদের খেতে দিয়ে দেয়ালের ধারে নিজের জায়গাটায় ঠিকই বসে পড়ল রুটি তরকারি গুছিয়ে নিয়ে। …শুধু একটু তফাতে একটা জায়গা ফাঁকা পড়ে রইল আরো অস্বস্তিকর ফাঁকা—পিঁড়ি নিয়ে।

    তদবধি চলছে সেই ফাঁকার কারবার। তবু প্রথমটা কেউ গায়ে মাখল না। ওই লোকের মধ্যে যে মান অভিমানের বালাই বলে কিছু আছে সে বিশ্বাস তো ছিল না কারুর।…তাই অধীর মাঝরাত্রে দু—একবার উঠে উঠে দেখেছে বাইরের দরজা খুলে—যদি নেশার ঘোরে এসে বসে থাকে।

    সকালবেলা উঠে অধীর দেখল নীহার যথারীতি রান্নাঘরে খটখট করছে, ঘরের বাইরে বালতির উনুনটা যথারীতি গনগনে হয়ে জ্বলে উঠেছে। আগুনটাকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল অধীর—আস্তে আস্তে বেশী লাল হয়ে উঠছে, অল্প অল্প নীলচে শিখা উঠছে বাতাসে কাঁপছে।

    একটু পরে নীহার বেরিয়ে এলো ঘর থেকে—একটা ভিজে গামছা নিয়ে বালতির হ্যান্ডেলটা চেপে ধরে রান্নাঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল উনুটা। …অধীর রান্নাঘরের দরজায় এলো, একটু ইতস্তত ঘরে বলল, রাত্তির দরজা—টরজা ঠেলেনি তো?

    নীহার নীরস গলায় বলল, ঠেললে তুমি শুনতে পেতে না?

    আমি? আমার তো টিন পেটালেও ঘুম ভাঙে না। মানে—

    অধীর আর একটু ইতস্তত করে বলে, ভাবলাম, কি জানি, দরজা ঠেলে খোলা না পেয়ে যদি আবার চলে—টলে গিয়ে থাকে।

    নীহার বলল, কোন চুলোয় যাবে? কে ভাত বেড়ে নিয়ে বসে আছে?

    অধীর আরও একটু দাঁড়িয়ে থেকে বলে, ফিরে এলে তুমি যেন আবার বকাবকি কোরো না।

    বকাবকি করা আমার সাধ তো—তাই করি। বলে নীহার শিল নোড়াটা নামিয়ে মশলা পিষতে বসল।

    আমার জন্যে বেশী তাড়া কোরো না, আমি আজ একটু বেলায় বেরোব। মাকে নির্দেশটা দিয়ে দাড়িটা কামিয়ে নিল অধীর। তারপর বাজারের থলিটা নিয়ে মার কাছে এসে দাঁড়াল, বিশেষ কিছু আসবে।

    নীহার তেমনি নীরস গলায় বলল, বিশেষের আবার কি আসবার আছে।

    না, মানে লেবু কাঁচালঙ্কা কি উচ্ছে—টুচ্ছে?

    যা আসবে, তাই বাঁধা হবে। বলে রান্নাঘরে ঢুকে গেল নীহার।

    অধীর বাজারে বেরিয়ে কেবলই আশেপাশে তাকাচ্ছিল—হয়তো দেখবে কোনখানে বসে আছে বাবা, খালি গায়ে গিঁট বাঁধা পৈতে গলায় ঝুলিয়ে লুঙ্গিটা হাঁটুর ওপর তুলে। কোন পানের দোকানের ধারে কি চায়ের দোকানে সামনের বেঞ্চে, কিংবা কোন বাড়ির রোয়াকে।

    কিন্তু না, কোথাও দেখতে পেল না। অন্যমনস্ক ভাবে বাজার করল অধীর। ভগবান জানেন কেন অন্য দিনের থেকে মাছ খানিকটা বেশীই নিয়ে ফেলল।

    বাড়ি ঢুকেই বুঝল নতুন কোন ঘটনা ঘটেনি। একটা আশা—হয়তো অধীরের কাজে বেরিয়ে যাবার সময়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করে, তারপরে আস্তে আস্তে ঢুকবে। বড় ছেলেকে বড় ভয় সুধীর ভটচাযের, সেটা বড় ছেলের জানা আছে।

    বাবা যতদিন না আসে ততদিনই ভালো, তাই না দিদি?

    রণুর কথায় বাণ্টি চোখ মুখ নাচিয়ে সায় দেয়, যা বলেছিস! আজ দেখ বাড়িটা কী ঠাণ্ডা! যেন ভগবানের হাওয়া বইছে।

    কী জানি, এক্ষুনিই হয়তো এসে যাবে। রণুর গলায় আশঙ্কার সুর।

    এলে মা ঢুকতে দেবে ভেবেছিস?…বাণ্টি গিন্নীর ভঙ্গীতে হাত তুলে একটু বিশেষ ভঙ্গী করে বলে, ঝ্যাঁটা পিটিয়ে বার করে দেবে।

    দেবেই তো—রণুর গলায় উত্তেজনা, মাকে যা করে! কালকে তো মেরেই দিয়েছিল।

    দাদা আজ বেশী করে মাছ এনেছে কেন রে দিদি?

    কেন আবার? বুঝতে পারছিস না। একটু বেশী করে খেতে পাবে বলে। দেখিসনি, কতদিন দাদা সকালে মাছ না খেয়ে তাড়াতাড়ি চলে গেলে মা দাদার রাত্তিরের জন্যে একটু তুলে রাখলে, বাবা ঢাকা খুলে খুঁজে বার করে লুকিয়ে খেয়ে রাখে।…রোজ রান্নাঘরে ঢুকে দেখে কী আছে।

    বাবাটা যেন একটা রাক্ষোস, না রে দিদি?

    ঠিক বলেছিস। আমারও তাই মনে হয়। বাবা হয় তাই বলতে নেই।

    বাবা যদি আর কক্ষনো ফিরে না আসে মা বাঁচে, না রে দিদি?

    তাই তো। যত কষ্ট তো মারই।

    আমরা খুব দুঃখী, না রে? ডাবু, বিশু, লক্ষ্মণ, অপূর্ব কারুর বাবা এ রকম বিচ্ছিরি নয়।

    এই, চেঁচিয়ে বলিসনি, হঠাৎ কখন এসে পড়ে শুনে ফেলবে, আর মেরে শেষ করে দেবে।

    হ্যাঁ, প্রথম দিকে অহরহ এই আশঙ্কা। ওই বুঝি কখন রে রে ঢুকে পড়ে, যাচ্ছেতাই গালমন্দ করে, গাঁউ গাঁউ করে খায়, টাকা কেড়ে নেয় মায়ের কাছ থেকে, আর কারণে অকারণে ছেলে—মেয়ে দুটোকে মারে।…

    বড়ছেলেকে ভয়, এই দুটো ছেলেমেয়ে যেন কবলের মধ্যে, তাই যত আক্রোশ ঝাড়ে তাদের ওপর। অধীরের পর দু—দুটো নষ্ট হয়ে গিয়ে এরা। নীহার বলে, মহারাজ। ছেলে দুটোকে মারতে তোমার লজ্জা করে না।

    সুধীর ভটচায খিঁচিয়ে বলে, লজ্জা তোমারই হওয়া উচিত ছিল। বুড়ো বয়সে দুটো হাঁস মুরগী পুষতে বসা। আগের দুটো যে পথে গেছল, সেই পথেই গেল না কেন?

    মা—বাপ একখানা নাম দিয়েছিল বটে, নীহারও খিঁচোয়, নামে কলঙ্ক! বেহায়া ইল্লুতে! হাঁস মুরগী আমি খানা—ডোবা থেকে কুড়িয়ে এনেছি, না?

    বাপ—মার ঝগড়ার অনেক কথাই বুঝতে পারে না এরা, রণধীর দিদি বিনতাকে নিজের থেকে অনেক বেশী বুদ্ধিসম্পন্ন ভাবে, তাই অনেক সময় চুপি চুপি দিদিকে জিগ্যেস করে, বাবা যা বলল তার মানে কী রে দিদি? মা কী বলল বুঝতে পারলি দিদি?

    দু’বছরের দিদি খেলা হয়ে যাবার ভয়ে বলে, বুঝব না কেন? ছোটদের ওসব শুনতে নেই।

    তুই বুঝি ছোট নোস?

    তোর থেকে তো বড়।

    একটা কদর্য আর নিষ্ঠুর পৃথিবীর অসহায় দর্শক এই ছোট ছেলেমেয়ে দুটো যেন ওই পৃথিবীর কাছ থেকে নিজেদেরকে যতটা সম্ভব গুটিয়ে নিয়ে পরস্পরকে অবলম্বন করে টিঁকে আছে।

    দাদাকেও এরা খুব দূরের মানুষ বলে ভাবে। রুক্ষ তিক্ত, সর্বদা টাকার চিন্তায় ব্যস্ত ওই দাদার কাছে ঘেঁসতে সাহস হয় না। দাদাও কাছে ডাকে না।

    কিন্তু বাবা চলে যাবার পর থেকে দাদার মধ্যে কেমন যেন একটা মমতার আভাস দেখতে পাচ্ছে। দাদা কাছে ডেকে পড়া জিগ্যেস করে, দাদা হঠাৎ হঠাৎ টফি লজেস নিমকি বিস্কুট এনে উপহার দেয়, এবং কেমন যেন অন্য রকম করে তাকায় ওদের দিকে। দেখে ভালো লাগে আবার কান্না কান্না পায়।

    দাদা কেন আজকাল আমাদের এত দয়া মায়া করে জানিস? …একজন বলে অন্যজনকে, দাদা ভাবে বাবার জন্যে আমাদের মন কেমন করছে, তাই। আমাদের তো আর মন কেমন করছে না,—অ্যাঁ? কেন করতে যাবে? বাবা কি আমাদের ভালোবাসত তো?

    অন্যজন বলে, বাসত না। তবে দাদা এখন এত বেশী বেশী করে খাবার আনে, অনেক অনেক দিন মাংস আনে, এই দেখে মনটা কেমন করে ওঠে। বাবা খেতে ভীষণ ভালোবাসত তো।…

    তোর মনে আছে রণু, একদিন সেই মাংস রান্না হয়েছিল, খুব কম কম, বাবা দেখে দাদাকে কিপটে বলে ঘেন্না দিল, দাদা রাগ করে খেল না, তখন মাও খেল না, সবটা বাবাকে দিয়ে দিল? বাবা কেমন চোর চোর মুখে খেল সবটা?

    মনে আছে। মাংস খেতে গেলেই সেদিনের কথাটা আমার মনে পড়ে যায়।…অথচ দ্যাখ, এখন দাদা কত বেশী বেশী সব আনে।

    এখন যে দাদার অনেক বেশী টাকা হচ্ছে। দেখিস না, কেবলই সন্দেশ নিয়ে এসে এসে মায়ের ঠাকুরের কাছে দেয়, আর বলে, তোমার ঠাকুরের দয়ায় আজ কিছু পাওয়া গেল মা। কিছু মানেই টাকা।

    হ্যাঁ টাকা। অনেক টাকা এসে যাচ্ছে আজকাল সংসারের—অপ্রত্যাশিত, আশাতীত। আর মানসিক অবস্থা যেমনই থাক, লক্ষ্মী ঘরে ঢুকলে সংসারের চেহারা লক্ষ্মীমন্ত হয়ে উঠবেই। অবশ্য যদি লক্ষ্মীর বাহক কৃপণ না হয়।

    অধীর কৃপণ নয়। অধীর এ যাবৎ কাল ওই বদনামটা বহন করে এসেছে প্রত্যক্ষ বাপের কাছে, পরোক্ষে মায়ের কাছে। মা বলেছে কী করে সংসার চালাই তা আমিই জানি। কতটুকু কী দাও আমায় হিসেব করে দ্যাখ।

    আর বাপের কথা তো ধরে কাজ নেই। খাওয়া পছন্দ না হলে কী বলেছে আর কী না বলেছে।

    দিন পেয়ে অধীর সেই বদনামটা ঘোচাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু যখন তখনই সুর কেটে যাচ্ছে। মায়ের কাছে টাকা রাখতে এলে, মা বলে, আমি আর নিয়ে কী করব, কোথায় রাখব, তুমিই রেখে দাও। আমাকে সংসার খরচের মতো হাত তুলে যা দেবে দিয়ে রাখ।

    মার গলায় স্বরটা আগেও নীরস ছিল, কিন্তু এমন ধাতব ছিল কী? মা কতদিন ‘তুই’ বলে কথা বলেনি অধীরের সঙ্গে?

    হঠাৎ হঠাৎ আজকাল মনে হয় অধীরের, মা যেন বিশ্বাস করে না এখন অধীরের অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসাটা হঠাৎ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। মনে হয় মা যেন তাকে সন্দেহ করছে, বাপের ভয়ে সে টাকা চেপে রেখে এসেছে এতদিন, এখন নিশ্চিন্ত হয়ে বার করছে।

    মায়ের চোখের শাণিত দৃষ্টিতে, কণ্ঠের ধাতব শব্দে ছুঁড়ে মারা টুকটাক মন্তব্যে সেই সন্দেহ গর্ত থেকে মুখ বাড়ানো জানোয়ারের মতো মুখ বাড়ায়।

    অধীর যেদিন একটা গডরেজের আলমারী এনে হাজির করে বলল, এবার তো টাকা পয়সার ভার নিতে পারবে? এই আলমারী হল তোমার।

    সেদিন নীহার ছেলের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত মাত্র না করে বলল, আমি আর কিছুর ভার নিতে চাই না বাছা, রেখে দাও তোমার বৌয়ের জন্যে। তবে মানুষটা যদি ওপরে উঠে গিয়ে থাকে তো সংসারের ভোল বদল দেখে হাঁ হয়ে যাবে।

    সেদিন বলল, আগে রুটির ওপর সামান্য একটু গুড় জুটত না আর এখন ঘিয়ে ভাজা পরোটার ওপর সন্দেশ! বলতেই হবে সংসারের কুগ্রহ সরে গেছে তাই ভাগের এত বোলবেলাও।

    আর একদিন বলল, হয় এবার বৌ এনে সংসার পাতো, নয় একটা রান্নার লোক রাখো অধীর, এত এত রান্না আমার দ্বারা হয়ে উঠছে না। মাছের ওপর মাংস, মাংসের ওপর ডিম, তার সঙ্গে গুচ্ছের কপি বেগুন মূলো মটরশুঁটি! কে যে খাবার লোক তার ঠিক নেই।

    অধীর অপরাধী ভাবে বলে, বাণ্টি রণু ভালোবাসে—

    ভালো চিরকালই বাসতো—

    অধীর আরও মলিন হয়, তখন তো পেরে ওঠা যায়নি মা।

    মা আনাজপাতিগুলো ধামায় ঢেলে ঘরে তুলতে তুলতে বলে যায়, একেবারে যেতো না সেটাই আশ্চর্য!

    তবু অধীর মায়ের করুণা প্রার্থী হয়ে দাঁড়ায়। এখনকার এই পেরে ওঠার ভারটাও তো তার পক্ষে কম দুর্বহ নয়। মা যদি একটু অন্তরঙ্গ হত।

    জগতে কম সমারোহ, বাজারে কত আয়োজন, অধীর তো তার হতাশ দর্শকের ভূমিকা নিয়েই কাটিয়ে এসেছে এতদিন, এখনও কি তাই থাকবে?…এখনও বাণ্টির ফ্রকের ছেঁড়াটার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেবে? রণুর জুতো থেকে আঙুল বেরিয়ে পড়া দেখে মুচি খুঁজে বেড়াবে?

    মায়া কি ছিল না অধীর নামের ছেলেটার? ছোট ভাইবোন দুটোর ওপর? মায়ের ওপর? সে মায়া প্রকাশের পথ ছিল কোথায়? এখন পথ পেয়েও সে পথে পা বাড়াবার দরজা বন্ধ করে রাখবে মায়ের বাঁকা মন্তব্য, কুটিল নিশ্বাস আর শান্তি চাহনির ভয়ে? কিনে আনবে না ভাইবোনের জন্যে বেশী বেশী জামা জুতো সোয়েটার মাফলার, মায়ের জন্য গরম চাদর।

    কিন্তু মা সে চাদর গায়েই দিল না। বলল, জীবন গেল শুধু আঁচল জড়িয়ে, এখন আবার শীতে গরম চাদর! মরণকালে হরিনাম।

    অথচ হিসেব মতে মায়ের বয়েস মাত্র পঁয়তাল্লিশ। অধীর চেষ্টা করে আসে, পঞ্চাশের পাঁচ বাকি থাকতেই তোমার মরণকাল এসে গেল মা? তা তাই যদিই হয়, বুড়ো হাড়েই শীত লাগে বেশী, সেটা তো মানো?

    রেখে দাও, লাগলে নেব। বলেছিল নীহার, কিন্তু নেয়নি। সারা শীত সে চাদর খাপে মোড়া পড়েই থাকল।

    মাকে বুঝে উঠতে পারে না অধীর। বাবার চিহ্ন বলতে যা কিছু ছিল সব তো ধুয়ে মুছে ফর্সা করে ফেলেছে। অবিশ্যি ছিলই বা কী?…তবু বালিশটা বিছানাটা, থালাটা, গেলাসটা, লুঙ্গিটা, গেঞ্জিটা!…সুধীরের চৌকিটার ওপর এখন রাজ্যের বালিশ—বিছানা—লেপ—কাঁথা ডাঁই করে রেখে দিয়েছে নীহার। রান্নাঘরের ঘটিটা ফুটো হয়ে যাওয়ায় নাকি সুধীরের স্পেশাল লম্বা গেলাসটা নিয়ে রান্না করছে মা, আর সেদিন দেখল বাবার লুঙ্গিটা ছিঁড়ে ঝিকে ঘর মুছতে দিচ্ছে।

    অধীরের মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, বাবার লুঙ্গিটা ন্যাতা করতে দিলে?

    নীহার এমন একটা পাথুরে দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে ছিল যে মাথাটা নীচু করা ছাড়া উপায় ছিল না। ঝি সরে গেলে খুব শান্ত গলায় বলেছিল নীহার, কপালে থাকলে ফিরে এসে জরিপেড়ে শান্তিপুরী ধুতি পরবে।

    কথা তো নয় তীক্ষ্ন তীর। এ তীর সবটাই কি অধীরের প্রাপ্য? অধীরের মুখে কি যখন তখন এসে পড়তে চায় না—তুমিও তো কম বলনি মা। তুমিই তো বলেছিলে ঘাড় ধরে বার করে দে—

    কিন্তু বল ত পারে না। জীবনে একবারই সহিষ্ণুতার মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছিল সে, আর সেই অসহিষ্ণুতার খেসারৎ দিয়ে চলেছে বেচারী অবিরত।

    ছোট ভাইবোন দুটোর মধ্যেও কি সন্দেহের বীজ দানা বাঁধছে? তারাও কি ভাবতে শুরু করছে বাবাকে খেতে দেবার ভয়ে দাদা তখন টাকা লুকিয়ে রাখত, খরচ করত না! ভাবছে—খোঁজাখুঁজি করলে বাবাকে নিশ্চয় পাওয়া যেত, দাদা ইচ্ছে করে খুঁজছে না!

    একদিন তো আরো ভয়ানক একটা কথা বলে বলল রণু, আচ্ছা দাদা, তুমি কি সত্যিই বাবাকে আর কোন দিন দেখতে পাও না?

    অধীরের সারা শরীরে চড়াৎ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠেছিল, দেখতে পেলে নিয়ে আসব না?

    রণু এদিক ওদিক তাকিয়ে দিদির কান বাঁচিয়ে বলেছিল, মা বলছিল, বাবাকে তুমি দেখতে পেয়ে শাসিয়ে রেখেছ খবরদার না আসতে।

    এই কথা বলেছে মা! রণু দাদার ইস্পাত কণ্ঠে ভয় পেয়ে গিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলেছিল—ও দাদা তোমার পায়ে পড়ি, মাকে বোলো না, মা তাহলে আমায় মেরে ফেলবে।

    অথচ নীহার খেতে বসে মাছের ল্যাজা চিবোতে চিবোতে অদ্ভুত একটা বিকৃত হাসি হেসে বলে উঠল সেদিন, মড়মড়িয়ে মাছ মাংসগুলো তো গিলছি, কী হয়ে বসে আছে ভগবান জানে।

    অধীরের খাওয়ার হাত থেমে গিয়েছিল মায়ের কথা শুনে। অধীর পাতে আঙুলের আগায় হিজিবিজি কাটতে কাটতে বলেছিল, দুর্ঘটনার খবর খবরের কাগজে ওঠে মা।

    সেটা তোমরাই জানো। আমি তো আর খবরের কাগজ পড়তে যাই না।

    হঠাৎ বড় রাগ ধরে গিয়েছিল অধীরের। মা যেন বাবার ব্যাপারে সমস্ত দোষটা অধীরের ওপরই চাপাচ্ছে। বলে ফেলেছিল, তুমি না পড়, তোমার আপনজনেরা পড়ে।

    আমার আপনজন? নীহার ভুরু কোঁচকানোর সঙ্গে উত্তর দিয়েছিল, আমার আপনজন যম ছাড়া আর কেউ নেই।

    অধীরের জেদ চেপে গিয়েছিল। অবিরত মেনে নিতে নিতে হঠাৎ যেমন এক ধরনের বিদ্রোহের সাহস এসে যায় সেই সাহসে উঠেছিল, কেন? তোমার সুপরামর্শদাতারা? মেজমামা, ছোটমামা, মেসোমশাই, মাখনদা—

    নীহার হঠাৎ জলের ঘটিটা বাঁ হাতে তুলে নিয়ে ঘাড় উঁচু করে আলগোছে খানিকটা জল খেয়ে নিয়ে বলেছিল, তা তোমার কাছে এ রকম কথা ছাড়া আর কি আশা করব! গুরুজনকে যে মান্য সমীহ করে কথা বলতে হয়, সেটা আর শিখলে কবে? তবে জেনে রাখ, কেউ আমায় কু—পরামর্শ দিতে আসে না, মায়া করে একটু দেখতে আসে কী ভাবে মানুষটার দিন কাটছে। বাড়িতে যে আছে তার তো একবার ‘মা’ বলে ডাকবারও সময় নাই।

    অধীরের ডাক ছেড়ে বলে উঠতে ইচ্ছে করে—মা, একবারও কি তুমি আমায় ‘তুই’ করে কথা বল আজকাল? তোমার এই নিষ্ঠুরতা আমায় তোমার কাছ থেকে ঠেলতে ঠেলতে দূরে অনেক দূরে তাড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ইচ্ছে করলেই কি বলা যায়? কিম্বা সবাই পারে না ইচ্ছে মতো কথা বলতে।

    আবার কেউ কেউ ভীষণ ভাবে পারে। নীহার তাদের মধ্যে একজন। নীহার অনায়াসেই হঠাৎ আবার বলে উঠতে পারে অপঘাতের কথা যদি কাগজে ওঠাই নিয়ম, তো বলতে হয় লোকটা তবে বৈরাগী হয়ে গেছে। অখদ্যে অবদ্যেরও পুনর্জন্ম হতে পারে। জগাই মাধাইও উদ্ধার হয়েছিল। দস্যু রত্নাকর বাল্মীকি হয়ে রামায়ণ লিখেছিল, লালবাবু ‘বেলা গেল’ শুনে সংসার ছেড়েছিল। ছেলের হাতের কোঁৎকা খেয়ে মানুষটার বৈরাগী হয়ে যাওয়া আশ্চয্যি নয়। নচেৎ জলজ্যান্ত মানুষটা তো সত্যি কপ্পুর হয়ে উড়ে যেতে পারে না।

    ছেলের হাতের কোঁৎকা! কী কুৎসিত! কী কদর্য! জগতে এই সব কুৎসিত কদর্য ভাষা চালু আছে এখনও? অধীরের আর একবার বলে উঠতে ইচ্ছে করল—না, তোমার নিষ্ঠুরতাও একটা মানুষকে ঘর ছাড়া বৈরাগী করে ফেলবার পক্ষে যথেষ্ট। আমারই তো মাঝে মাঝে—

    কিন্তু বলে উঠল না কারণটা সেই একই—সবাই পারে না যথেষ্ট কথা বলতে।

    আশ্চর্য! কী উল্টো ধারণাই ছিল অধীরের! নিরুপায় দর্শকের চোখে কেবলই দেখে এসেছে মা এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মধ্যে পড়ে ছটফটাচ্ছে, অধীরের কিছু করার নেই।

    সীমিত আয়, সীমিত সাহস। কী করবে যে? করবার মধ্যে শুধু কল্পনার স্রোতে ইচ্ছের নৌকোখানা ছেড়ে দেওয়া। মসৃণ একখানি সচ্ছলতার স্বপ্ন দেখত অধীর। যে রকম সচ্ছলতার সুধীর ভটচায নামের ওই বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নটাকে অন্যত্র কোথাও সরিয়ে রাখা যায়। আর সেই সরিয়ে রাখার ফলে বাড়ির চেহারাটি কেমন হয়।

    তিল তিল করে সেই সুস্থ শান্ত নিরুদ্বেগ আর কুশ্রীতামুক্ত সংসারটাকে গড়ত অধীর মনে মনে। সেই সংসারের মধ্যমণি মায়ের মূর্তিটি কী উজ্জ্বল জ্যোতির্ময় আনন্দময়ী!

    অধীরের ছেলেবেলার মায়ের সঙ্গে তার কিছুটা আদল আছে। যে ছেলেবেলায় অধীরই ছিল মায়ের একমাত্র। আর যে ছেলেবেলায় বাবা ফর্সা জামা কাপড় পরে নিয়মিত অফিস যেত। মাতে আর অধীরেতে তখন তাদের ভবিষ্যৎ জীবনের ছবি আঁকা চলত। দুজনেরই হাতে রং তুলি ক্যানভাস একটাই। সেই ছবিটা হচ্ছে অধীর যখন ‘বড় হবে’।

    বড় হয়ে অধীর মাকে লাল টুকটুকে জরির শাড়ি কিনে দেবে। কিনে দেবে ঝিকঝিকে ঝিকঝিক সোনার মালা। আর গাদা গাদা জিনিস কিনে দেবে মাকে যত ইচ্ছে করতে। তখন তো আর বাবা বকতে পারবে না—এত খরচ কেন বলে।

    রোজ কত করে আলু কিনবি অধীর?—একমণ, দু’মণ।

    পটল?—ইয়া বড় তিন ঝুড়ি পাঁচ ঝুড়ি।

    মাছ?—বিয়েবাড়ির মতন।

    তেল?—কুড়ি সের।

    ঘী?—কুড়ি সের।

    চিনি?—কুড়ি সের।

    আরও অনেক প্রশ্নমালা!…উত্তর সবই মুখস্থ। রোজই তো প্রশ্নোত্তর। নিত্য এই এক বেলা ছিল মা ছেলের।

    বাবা বাড়ি এলেই চুপ। বাবা তখন এত হিংস্র ছিল না। ফর্সা জামা কাপড় পরে অফিস থেকে ফিরত…বলত, মা ছেলে তো খুব কলকলাচ্ছিলে, হঠাৎ চুপ মেরে গেলে যে? কী গল্প হচ্ছিল?

    ও রূপকথার গল্প…মায়ের মুখটা তখন রূপকথার রাজকন্যার মতোই লাগত অধীরের। চাপা হাসিতে উজ্জ্বল, গোপন কৌতুকে ঝকঝকে চোখ।

    সেই অলৌকিক রূপকথার ওজনে না হোক, দিন পেয়েই তো অধীর মাকে সচ্ছলতার স্বাদ দিতে চাইছে। কিন্তু মা যেন সে স্বাদ পা দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে। যেটুকু নিচ্ছে যেন বাঁ হাতে নিচ্ছে।

    অধীর কি অভিমান করে আবার ‘পুনর্মূষিকোভব’ মন্ত্র পড়বে? তাই বা পড়া যায় কী করে? দরকার তো তার নিজের জীবনেও আসছে।

    কাজ বেড়েছে, বেড়েই চলেছে। বাড়িতে লোক আসছে হরদম। পদস্থ, অ—পদস্থ। বিশিষ্ট অ—বিশিষ্ট। কেউ বা দালাল, কেউ বা মালিক স্বয়ং। তাদের তো ভদ্রভাবে বসতে দেবার জায়গা দরকার?

    সুতরাং নিজের নামের শোবার ঘরখানাকেই বসবার ঘরে পরিণত করতে বা করবার করতে হয়।…শোবার সরু চৌকীখানাই দিনের বেলা ভালো সুজনী গায়ে চাপিয়ে ডিভান। সময়ে কেনা রেডিমেড সোফাসেটি ক’টার সঙ্গে বিশেষ বেমানান লাগে না।

    জানালা দরজায় জীবনে এই প্রথম পর্দা ঝুলেছে। প্রথম পর্দা, প্রথম আব্রু। অধীর বলে, খোলা দরজাটার সামনে দিয়ে তুমি যেন যা তা পরে যাওয়া আসা কোরো না মা। বাড়িতে যে অবস্থা করে থাকো। গামছা পরার কথাটা আর তোলে না, নিজের মুখে আনতেই লজ্জা করেছে, তাই তোলেনি।

    নীহার কথা রেখেছে। রাখেও। কিন্তু সব সময় বলে, বাড়িতে আপিস বসালে বাড়ির লোকের দম আটকে আসে।

    মার দম আটকানো নিবারণ করতে অধীর মা ভাইদের ঘরে একটা সীলিং ফ্যান করে দিয়েছে। নীহার সে বিষয়ে উদাসীন। পাখার হাওয়া খায় না তা নয়, কিন্তু খেয়ে কী ভাবের উদয় হচ্ছে মনে সেটা বলে না। যা কিছুই করে অধীর মায়ের সুবিধার জন্য, সবই যেন ভস্মে ঘী!

    এদিকে লতু তাড়া লাগাচ্ছে। বলছে, আর দেরী করলে কিন্তু বাবা আর কারুর হাতে কন্যে সম্প্রদান করে বসবে তা বলে দিচ্ছি।

    শূন্য পকেট অধীরের মুখে যে জৌলুস ছিল, এখন যেন আর তা নেই। পকেট ভারী হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যেন তার বয়েসটাও বড় তাড়াতাড়ি ভারী হয়ে যাচ্ছে। বুড়িয়ে যাচ্ছে অধীর। লতুর প্রাণে তাই ভয় ঢুকছে। লতু একবার ও বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারলে বাঁচে।

    এ যাবৎকাল বাবা হায়রে বলে নাক সিটকাত, এখন আর তা করে না। বরং মাঝে মাঝে উল্টো সন্দেহ প্রকাশ করে। ও বাড়ির গিন্নী সুদ্দুরের বেটি বলে নাক কোঁচকাবেন নাতো? হাস্যবদনে বৌ বরণ করে ঘরে তুলবেন তো?

    বুড়োটাই একটা কাদাখোঁচা হয়ে রইল। বলে লতুর মা। বাহান্ন বছর বয়সের সুধীর ভটচাযকে বুড়োই বলে। আগে থেকেই বলত। সুধীরের ওপর অনাচারে অত্যাচারে হাড় বুড়োই তো দেখাত তাকে।

    আবার এও বলে লতুর নিজেকে সান্ত্বনা দিত। তবু তো শাশুড়ী শাড়ি পরে বেড়াচ্ছে। বৌ বরণ করে ঘরে তুলতে পারবে। হঠাৎ কোনখান থেকে একটা বিচ্ছিরি খবর এসে পড়ে সব কিছু না ভণ্ডুল করে দেয়।

    তা সে রকম কোন খবর এসে পড়ে না। সুধীর ভটচায যে হঠাৎ একদিন এসে হাজির হবে এ আশঙ্কা, বা এ আশা আর থাকছে না কারো। প্রথম দিকে আশঙ্কাই ছিল, ক্রমশ আশার সময়ের র্যাঁদার ঘষা খেয়ে খেয়ে লোকটা সম্পর্কে আর সবাইয়ের এবড়ো—খেবড়ো কর্কশ অনুভূতিগুলো আস্তে আস্তে পালিশ হয়ে যাচ্ছে। মনের ঘেন্নায় লোকটা যদি গঙ্গায় ঝাঁপ না দিয়ে থাকে তো সন্নিসী হয়ে গেছে এই ধারণাই ক্রমে বদ্ধমূল হয়ে আসছে লোকের।

    মা বারণ করলেও বিজ্ঞাপন কিছুদিন দিয়েছিল বৈকি অধীর।…মামার নাম দিয়ে নীহার মৃত্যুশয্যায় শেষ দেখা দেখে যাবার অনুরোধ জানিয়ে।…তারপর মনে হয়েছে যখন দেখা যাচ্ছে সুধীর ভটচাযের মধ্যেও মান অভিমান বস্তুটা ছিল, তখন তার সম্মান রাখাই দরকার। সঙ্কেতে নিজের গর্হিত আচরণের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে বাপকে অনুরোধ জানিয়েছিল ফিরে আসবার জন্যে।

    কিন্তু অনুতপ্ত পুত্রের সে আবেদনও তো কর্ণপাত করেনি সেই বিতাড়িত ব্যক্তি। যখন বিজ্ঞাপন দিয়েছিল, তখন মার নিষেধ অগ্রাহ্য করার অপরাধে মা পাছে রাগ করে, এই ভয়ে মাকে জানায়নি। (বেচারী অধীর! কী বোকাই ছিল!) তবু মা কি আর সত্যি জানেনি? কাগজে ছাপা অক্ষর, কেউ কি আর মাকে বলে যায়নি? মা যে পড়তে না জানে তা নয়, গল্পের বই তো পেলেই গেলে। সিনেমা পত্রিকাগুলো সংগ্রহ করে আনে এ বাড়ি ও বাড়ি থেকে, কিন্তু খবরের কাগজের দিক দিয়ে যায় না। তাহলেও জেনেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ভাঙে না সে—কথা। অনায়াসে বাতাসকে শুনিয়ে বলে, কুকুর বেড়ালটাকেও দূর দূর করে তাড়িয়ে দিলে লোকে ফিরে উল্টে দেখে—তাইতো, গেল কোথায়! এ সংসারে সেটুকু মনুষ্যত্বও নেই।

    আবার বলে, ওই হতভাগা পায়ের বেড়ি দুটোর জন্যেই তো হয়েছে যত জ্বালা। বেঁধে মার খাওয়া আর সহ্য হয় না। কে যে মারছে সেটা অবশ্য বলে না। ভগবান না মানুষ।

    লতুর বাবা এসে প্রস্তাব করে যাওয়ার পর থেকেই এই উচ্চস্বর স্বগতোক্তি বেড়েছে। ডাঁটুস বিজন সরকার অনেকটাই নম্র হয়ে এসে বলেছিল—অধীর তো অনেকদিন থেকেই—মানে দুজনেই তো এক রকম মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, এখন আপনি অনুমতি করলেই—

    নীহার রস নিংড়ে নেওয়া আখের গলায় বলল, সবই যখন ঠিক হয়ে আছে, তখন আর আমার অনুমতির কথা কেন? বলতে যাচ্ছিল ধাষ্টামো কেন? সেটা সামলে নিল।

    ঘুঘু বিজন সরকার বিনয়ে গলে গিয়ে বলল, সে ঠিক তো খেলাঘরের পুতুলের বিয়ের ঠিক, আপনি দিনস্থির করে না দিলে তো হতেই পারে না।

    নীহার দেখল ধারে কাছে ছেলে নেই। বাইরের পুরুষের সঙ্গে বেরিয়েছে বলে একটা চাদর গায়ে দিয়েছে সেটাকে সাপটে টান টান করে জড়িয়ে নিয়ে উত্তর দেয় নীহার, মনস্থির না করতেই দিনস্থির?

    সে কি! সে কি! সেটা কী একটা কথা নাকি? বিজন যেন আকাশ থেকে পড়েছে—মনস্থির করতে না পারলে তো—তবে কথা হচ্ছে—

    বিজন দুঃখে অভিভূত হয়ে যায়, করুণায় বিগলিত। কথা হচ্ছে আপনার মনের মধ্যে সর্বক্ষণ যে ঝড় বইছে তাতে কি আর মনস্থির হওয়া সম্ভব? মানুষের বাইরে থেকে তো ভেতর বোঝা যায় না, কিন্তু চোখ থাকলে বোঝা যায়। বুঝছি সবই। বাজ পড়া তাল গাছের মতো দাঁড়িয়ে আছেন বৈ তো নয়। তবু মায়ের কর্তব্য করে যেতেও হবে। ছেলে যাতে সুখী হবে, মায়ের তাতেই সুখ। কী বলেন? তাই কিনা?

    বিজন একটু থামে, দেখে ওষুধ ধরছে কিনা। মনে হচ্ছে যেন ধরছে।

    সত্যি, নীহারকে কে কবে এত ভালো ভালো কথা শুনিয়েছে? বাইরের একজন পুরুষ! তবে নীহার সহজে ভাঙে না, আস্তে বলে, সে তো ঠিক!

    সে তো ঠিক। আশাপ্রদ। কিন্তু এটা বিয়ের অনুভূতি নয়। দিনস্থিরও নয়। আরো খেলাতে হবে। লতুর মা অবশ্য বলেছিল বামনী বলে তো অহঙ্কার! সেই সুধীর বামনার বামনী তো? তার পায়ে নাক ঘসটাতে যাবার দরকার কী? ছেলে যখন তোমার হাতের মুঠোয়, তখন সেই বামনীর নাকে ঝামা ঘসে কাজ চালিয়ে যাও।

    কিন্তু বিচক্ষণ বিজন সরকার তাতে রাজী হয়নি। ছেলে যে সত্যিই তার হাতের মুঠোয় এ বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে বিজনের। আজকাল যেন কেমন একবগগা লাগে ছেলেটাকে। আগে মনমরা মনমরা লাগত, এখন ভাব বদলে গেছে। হতেই পারে, বাপটার জন্যে শান্তি নেই।… একদিন তো বলেই ফেলেছিল, আর কিছুদিন যাক না।

    তার মানে এখনো আশা করছে বাপ ফিরে আসতে পারে।…ফিরে আর এসেছে! হুঃ। মাতাল গেঁজেল লোক মনের দুঃখে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছে, কি কোথায় গিয়ে রেললাইনে মাথা দিয়েছে, কে জানে। বেঁচে থাকলে এত দিনে আর ফিরত না? পেটের জ্বালাতেই ফিরত। রোজগারের তো মুরোদ নেই।

    কিন্তু এ সব সন্দেহ প্রকাশ করা চলে না। বলতেই হয়েছে, দেখা তো উচিত।

    নিশ্চয় উচিত। তবে কি জানো বাপু, আমার হল গিয়ে কন্যাদায়। কবে আছি কবে নেই কে বলতে পারে? চার হাত এক হয়ে গেলে নিশ্বাসটা নিয়ে বাঁচি। ভটচায মশাই বৈরাগ্যের পথে চলে গেছেন, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বরং তীর্থ—স্থানে—টানে খোঁজ করলে হয়। তবে বিয়েটা টাঙিয়ে রেখে নয়।

    নীহারের মুখের কাঠিন্য যেন একটু কমে আসছে। এই বিজন সরকার। পাড়ায় যার অবস্থাপন্ন বলে নামডাক। কন্ট্র্যাক্টরীর ব্যবসা। মাঝে মাঝে লাল হয়ে যায়। তবে বড়লোকী কায়দায় থাকে না—এই যা। কিন্তু সেই লোক তো? সে নীহারের বাড়ি বয়ে এসে খোসামোদ করছে! মেয়ে এ বাড়ি পড়লে, বরাবরই করবে।

    বিজন এবার আলগা ঝোপে কোপ মারে। এই সময় বলে ওঠে, তবে এইটি আপনি জেনে রাখুন, আপনি যদি একবার ‘না’ করেন, তবে আমার সাধ্য হবে না আপনার ছেলেকে রাজী করাতে। অধীর যে কী মাতৃভক্ত সন্তান জানেন না আপনি।

    নীহার মনে মনে বলে, মরণদশা! আমি জানি না তুই জানিস। মেয়ে পার করার তালে কত কারসাজি। হয়কে নয়, নয়কে হয়। যা দেখছি বিয়েটা ঘটবেই মাঝখান থেকে আমি কেন আপত্তি করে খেলো হই? বৌ এসে সর্বেসর্বা হবে, এ তো দিব্যচক্ষেই দেখছি। তবু মেনেই নিতে হবে। জোয়ান ছেলে বিয়ে না দিলে আর কী করবে বলা শক্ত। ওই বাপের তো ছেলে।

    নীহার অতএব উদারতা দেখায়, ঠিক আছে। আপনি যা বলছেন তাই হবে।

    চতুর বিজন সরকার মাথা নাড়ে, উঁহু, এতে চলবে না। আপনি যা বলবেন তাই হবে।

    নীহার লোকটার ঘুঘুমি দেখে মনে মনে বিরক্ত হলেও একটু হাসির ভাব দেখিয়ে বলে, বেশ আমিই বলছি পাঁজি দেখান।

    ব্যস ব্যস। বিজন সরকার নীহারের পায়ের কাছের একটু ধুলোয় হাত ঠেকিয়ে মাথায় ঠেকায়।

    নীহার আর একটু রাশ চাপে, আসলে কী জানেন সরকার মশাই, এ বংশে তো আজ পর্যন্ত বামুনের ঘরে ছাড়া কোন কাজ হয়নি, তাই মনটা একটু খুঁৎ খুঁৎ করছিল।

    বিজন সরকারের মুখে আসছিল—আহা ইস! তবু যদি না সেই বামুন—ঠাকুরকে বস্তির ঝিয়ের ঘরে বসে মুড়ি বেগুনী খেতে দেখতাম!…সেই পরম কুলিনটি বিদেয় হয়েছেন, লোকে ভুলে—টুলে গেছে বলেই এ ঘরে মেয়ে দিতে সাধছি। কিন্তু মুখে আসা কথা যারা সামলাতে জানে বিজন তাদের একজন।…

    এত ঝুট ঝামেলার মধ্যে কে আসতে চাইত, যদি মেয়ে অধীরদা বলে আঁধার না হত! একটা মাত্তর মেয়ে, তাকে জবরদস্তি করে দুঃখী বানিয়ে লাভ নেই। বিজন সরকারে এই সাধ্য সাধনা তো থিয়েটার। সেই থিয়েটারই চালিয়ে যায়, সে তো নিশ্চয়। একশোবার। খুঁৎ খুঁৎ তো করবেই। আমারই কি করছে না? তবে কি জানেন, আজকাল তো ঘরে ঘরেই এই। তাই মনকে মানিয়ে নেওয়া। আচ্ছা, তাহলে দিন দেখাইগে।

    চলেই যাচ্ছিল। এই সময় নীহার একটা বোকার মতো কথা বলে বসল। বলল, তা মেয়ে জামাইকে কী দিচ্ছেন—টিচ্ছেন?

    এই সময় ছেলে বাড়ি নেই বলে নিতে পারা গেল।

    কথাটা শুনে কিন্তু চমকাল না সরকার, নীহারের মুখের রেখায় এ প্রশ্ন ছায়া ফেলে ফেলে যাচ্ছিল, তা সে দেখে বুঝছিল। বরং প্রশ্নটা অনুক্ত থেকে গেল দেখে আশ্চর্য হচ্ছিল। এখন বলল, আপনি বলুন?

    আমি আর কী বলব? আপনার মেয়ে—জামাই। আপনি মানী লোক—

    না না, মানী—টানী কিছু না, তবে জানেনই তো আমার সবেধন ওই একটা মাত্তরই মেয়ে, আমার সাধ্যমত গহনা কাপড় খাট—বিছানা আলমারি বাসন—পত্র ঢেলে মেপেই দেব।…তাছাড়া আমার ঘরবাড়ি লতুর মায়ের সাজানো সংসার সবই তো আপনার ছেলে— বৌয়েরই থাকবে। আমরা দুটো বুড়োবুড়ি আর ক’দিন? তবে আপনি যদি আরও কিছু বলেন আদেশ করুন।

    না না, আর কিছু না। এমনি কথার কথা বলেছি। নীহার একটু উদাস গলায় বলে, আমার আর কিসের কী? ওরা সুখী হলেই হল।

    বিজন সরকার বলে, বাঃ, তা বললে হবে কেন? আপনার আর একটি ছেলে নেই? কালে ভবিষ্যতে বিয়ে দিতে মেয়ে নেই?… আপনার যা দরকার জানাবেন।

    বিজন সরকার চলে যায়। লঙ্কাবিজয়ী বিজয় সিংহের মতো বীরদর্পে।

    সেই অবধি বুকের মধ্যে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে নীহারের। ভাবী—বৌটা যে বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে, তা জানা ছিল না। তার যথাসর্বস্ব ভবিষ্যতে নীহারের ছেলে—বৌয়ের হবে, এতে কোন সান্ত্বনা নেই নীহারের।…কার যে হবে তা আর জানতে বাকি নেই নীহারের। দেখছে না পৃথিবীকে?

    আর সব তো ছার, ছেলেটাও যে আর নীহারের থাকবে না, বৌমার বর হয়ে যাবে, তা জানে নীহার। তাই ভেবেই প্রাণের মধ্যে হু হু করে উঠেছে।

    এই তো এখন যতই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখাক নীহার ছেলেকে, ছেলে তো চোদ্দবার মায়ের কাছে এসে দাঁড়াচ্ছে—চূণ চূণ মুখ দিয়ে। মায়ের একটু মন রাখবার জন্যে আকুলি বিকুলি করছে, এরপর আর করবে তা? আর এসে দাঁড়াবে কাছে?

    দোরের কাছে বড়লোক শ্বশুরের বাড়ি, সেইখানেই গিয়ে বসে থাকবে শ্বশুরের মেয়েটিকে নিয়ে। মনোরঞ্জন যা করবার তারাই করবে। একেই তো যুগের ধর্ম, তায় আবার ভাবের বিয়ে। তার মানে মুগুর খাওয়া কপালে নীহারের নতুন মুগুর পড়তে চলেছে।

    ভয়ানক আক্রোশ আসে। ভয়ানক রাগ। ছেলের উদ্দেশ্যে যা মুখে আসে তাই গাল দিতে ইচ্ছে করে। বেহায়া স্বার্থপর ধর্মখেগো ছেলে! ধাপকে গলা ধরে বিদেয় করে দিয়ে এখন সুখের সংসার পাততে বসছ নিজে? বাপ দুটো পয়সার জন্যে ভিখিরির মতন দোরে দোরে ঘুরছে, আর তুমি চোখের চামড়াখোর ছেলে, লুকিয়ে লুকিয়ে টাকা জমিয়েছ পরে লপচপানি করবে বলে। ধর্মে সইবে?

    বুকের মধ্যে রাবণের চিতা। বাতাসে তার দাহ ছড়ায়। বাতাসকে উদ্দেশ্য করে কথা।

    কিন্তু নীহারেরই বা দোষ কী? মাতাল হোক গেঁজেল হোক নীচ নোংরা যা—ই হোক সেই লোকটাই তো নীহারের পায়ের তলার মাটি। নীহারের সামাজিক পরিচয়ের মলাট। নীহারের জীবন আস্বাদনের স্বাদের স্নায়ু।…সেই দুঃস্বপ্নের মতো লোকটা বিহনে নীহারের দিনরাত্রির সব কিছুই অর্থহীন। রান্না খাওয়া ছেলে মেয়ের পাতে ভাত বেড়ে ধরে দেওয়া সবই অর্থহীন।

    অধীর যদি আগের মতো গরীব থাকত, তাহলে হয়তো এতটা জ্বালার সৃষ্টি হত না। এই প্রাচুর্যের জ্বালা অভাবের থেকেও মর্মান্তিক। সামান্যর জন্য কত দুর্বাক্য বলেছে তাকে ভেবে নিদারুণ জ্বালা। সামান্য একখানা দশ টাকার নোটের জন্যে মানুষটাকে জন্মের শোধ হারাতে হল, সে কী দুরন্ত জ্বালা। এখন তো সামান্যই মনে হয় দশ টাকাকে।

    অহরহ ওই জ্বালার ওপর এলো ছেলের ভালোবাসার বিয়ের জ্বালা। যে বিয়েয় নিজের মাতৃমহিমা প্রকাশের কোন পথ নেই, সে বিয়ে জ্বালা ছাড়া আর কী? তাও যদি গরীব গেরস্ত ঘরের পাঁচটা মেয়ের একটা হত। এ একেবারে নৈবিদ্যির মাথার মণ্ডা। বড়লোকের একমাত্র মেয়ে। ওদের সমারোহময় দাম্পত্য জীবনের অভাগিনী দর্শক—এই পরিচয় নীহারের। নীহারের যদি অহরহ মাথা খুঁড়তে ইচ্ছে হয়, দোষ দেওয়া যায় না।

    লতুর মুখে আহ্লাদ উদ্ভাসিত—তুমি এমন ভাব করছিলে যেন তোমার মার মত পাওয়া খুব শক্ত হবে। বাবা গেল আর মত আদায় করে ফিরে এলো।

    আদায়! এইটুকু বলে অধীর।

    আহা ওই হল, না হয় পাওয়া। তোমার সঙ্গে কথা কওয়া শক্ত। পান থেকে চূণ খসবার জো নেই। যাক—এখন লেগে পড়। তোমার তো আর করবার কেউ নেই। মামা মেসো তো কেবল সমালোচনা করতেই ওস্তাদ। নিজের ঘাড়েই সব। নিজেই বর নিজেই বরকর্তা।

    নিজেই বরকর্তা! বুকটা ছাঁৎ করে ওঠে অধীরের। সারা শরীরের মধ্যে একটা তোলপাড় ওঠে।…আর সেই তোলপাড়ের মধ্যে নিত্য দেখা একটা ছেঁড়া লুঙ্গি পরা, গিঁট—বাঁধা ময়লা পৈতে গলায় লোককে হঠাৎ যেন ফর্সা ধবধবে ধুতি পাঞ্জাবী পরে পাট করা চাদর কাঁধে ফেলে গর্বিত ভঙ্গীতে কোন টোপর পরা বরের আগে আগে একটা ফুল সাজানো মটর গাড়ির খোলা দরজা দিয়ে ঢুকতে দেখে।…ওই লোকের মুখের চেহারাটিও তার চলার ভঙ্গীর সঙ্গে দিব্যি মানানসই।

    তোলপাড়টা থামতে চায় না যেন। ওই মুখটা কি সত্যিই পৃথিবী থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গেছে?…গেছেই এইটা ভেবে নিশ্চিন্ত হতে পারার মতো করে কে খুঁজে দেখেছে পৃথিবীটাকে?

    কী হল? অমন চুপ মেরে গেলে যে? লতু ঠোঁট ফোলায়।

    তার ওই কৌতুক উচ্ছ্বসিত কথাটায় যে কারুর মনের মধ্যে আলোড়ন উঠতে পারে, এমন অবিশ্বাস্য কথা ভাবে না লতু।…শয়নে স্বপনে ধ্যানে জ্ঞানে একখানা ফুল সাজানো গাড়ি থেকে লতু একটা মানুষকেই নামতে দেখে তাদের আলোয় মোড়া বাড়ির দরজার সামনে। মাথায় টোপর কপালে চন্দনলেখা গলায় ফুলের মালা। চির পরিচিতকে সেই আকাঙিক্ষত অপরিচিতের মূর্তিতে দেখবার উদ্বেল আবেগের মধ্যে সেই গাড়ি থেকে ফালতু আর কেউ নামল কি না নামল ভাবতে খেয়ালও আসে না লতুর। বলে, কী এমন বললাম যে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলে?

    অধীর বলে, না কিছু না। মাথাটা কেমন ধরে রয়েছে। কিন্তু সত্যি তো—বর নিজেই বরকর্তা হবে? তাই পারে না কি? ধ্যেৎ!…প্রতিকারের চেষ্টার দরকার।

    কিন্তু সেই প্রতিকারের চেষ্টাটা করা যাবে কোন পথ দিয়ে? খবরের কাগজের নিরুদ্দেশ কলমের রাজরাস্তা যখন কাজে দেয়নি তখন নোংরা পচা সরু গলির পথ ধরেই আর কোথায়? যেখানে মুখে মুখে খবরের লেনদেন।…সেই ছেঁড়া ময়লা লুঙ্গি পরা লোকটা যেখানে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে বসে থাকত।…

    মুড়িওয়ালী কেষ্টুর মা বলে, সে তো আজ দু—তিন বছরের কথা দাদাবাবু। আর তো দেখি না তেনাকে।…তবে হ্যাঁ, নিত্যি নে যেতো বটে ত্যাখন মুড়ি ফুলুরি ছোলা সেদ্ধ! নে যেতো আর হেসে হেসে বলত, এ জন্মে আর তোর সব ধার শোধ হবেনি কেষ্টুর মা, আসচে জন্মে হবে।

    অনুসন্ধানকারী চমকে ওঠে। মুখটা লাল হয়ে ওঠে তার। গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলে, কত ধার আছে তোমার কাছে?

    কেষ্টর মা জিভ কাটে, ও মা, অমন কতা বলুনি। বামুন মানুষ খেয়েছেলো খেয়েছেলো, তার জন্যে আমি দোষ ধরি নাই।

    দোষ ধরার কথা নয়, ধারটা শোধ করা দরকার।

    কেষ্টর মা শঙ্কিত গলায় বলে, মারা গ্যাচে বুঝি? তা সে কি আর আমার হিসেব আছে? হবে দশ—বারো টাকা।…কে হও? ছেলে নাকি?

    উত্তর দেবার দায়িত্ব নেয় না লোকটা, প্যাণ্টের পকেট থেকে দু’খানা দশটাকার নোট বের করে কেষ্টর মার মুড়ি ঢালা চটের ওপর ফেলে দিয়ে চলে যায়।

    অনেকক্ষণ তাকিয়ে দেখে নোট দুখানা আঁচলে বাঁধতে বাঁধতে মুড়িওলি কেষ্টর মা আপন মনে বলে, ব্যাটা ছাড়া আর কে হবে? পিত্রিঋণ শুদবার দায়ে ঘুরতেচে। মুকের আদলে বামুনদাদার আদল আছে।

    পানের দোকানের শশী বলল, কথা তো অনেক দিনের বাবু। অনেকজনকে জিগেস করেছি, কেউ বলতে পারে না। বলে, নেশা খোরের খেয়াল। কে জানে কিসের খেয়ালে নিরুদ্দিশ হয়ে গ্যালো। ওই খাল পাড়ে যে একটা রাং ঝালাইয়ের দোকান আছে, ফুটো ঘটি বাটি বদনা গাডু সারাই করে, সেখানে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ওইখানে খুব দহরম—মহরম ছিল।

    তোমার কাছে কোন ধার—টার ছিল সেই লোকের?

    ধার? শশী চকিত হয়। ব্যাপার কী? পুলিশ এনকোয়ারি নয় তো? ধারে পানটা বিড়িটা খেয়েছে অবিশ্যি, সে কথা কবুল না করাই ভালো। কে জানে বাবা কী থেকে কী হয়? বলে, না বাবু, আমার সঙ্গে তেমন কিছু ছিল না। মাঝে মধ্যে বিড়িটা পানটা নিত এই পর্যন্ত।

    রাং ঝালাইয়ের দোকানের ছেলেটা বলল, দু—তিন বছর আগে? ত্যাখন আমার কাকা বসত দোকানে?

    কাকা নেই?

    আছে। তবে না থাকাই। হাঁপানি, ঘরে বসে থাকে।

    ঘরটা কোথায়?

    এই তো দোকানের পেচনে।

    আমায় নিয়ে যেতে পারবে?

    দোকান ছেড়ে যাব কেমন করে? সাফ জবাব।

    অনেক তুতিয়ে—বাতিয়ে একবার ওঠাতে রাজী করানো গেল ছেলেটিকে। একটু এগিয়ে আঙুল বাড়িয়ে বলল, ওই যে, সামনের চালাটা। কেশব বলে ডাক দিলেই হবে।

    ডেকে পাওয়া গেল কেশবকে। কিন্তু কেশবের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ।—এতদিন পরে, কী ব্যাপার বলেন তো?

    ব্যাপার কিছু না। সেই অবধিই খোঁজ চলছে। একজন বলল, এইখানে খবর পাওয়া যেতে পারে।

    কেশব চোখ তুলে বলল, পুলিশের লোক?

    না না, কী মুশকিল, সে সব কিছু না। আসলে সেই লোকের বাজারে কিছু ধার—টার ছিল, তাই খোঁজ নিচ্ছি।

    ধার ছিল তাই এতকাল পরে খোঁজ নিতে এসেছেন!…তাজ্জব তো! বাড়ির লোক? তা তিনি মারা গেছেন বুঝি?

    অনুসন্ধানকারী মৃদু উত্তর দেয়, তাও জানি না।

    তা হক কথা বলব বাবু ধার আমার কাছে নেই কিছু। বরং এখেনে বসে নেশাটা আসটা করত বলে আমাকেই খাওয়াত।…ধার আছে বাবুলের দোকানে—গলা নামায়, বলে, আপনি সেখেনে যেতে পারবেন না বরং লোকটাকে ডাকিয়ে আনাই। কিছু যদি মনে না করেন, একটা পাঁইট—এর দাম দিলে লোক পাঠানোর ছুতো হয়।

    খালপাড়ের এই জায়গাটা যেমন কাদা তেমনি এবড়ো—খেবড়ো। রাং ঝালাই কেশবের বাসাটা পর্যন্ত যদি বা একটু রাস্তা টমতো আছে, তারপর শুধু খানিক জল থই থই আর পাঁকের ‘হদ’! এক কথায় নরককুণ্ড।

    এখন পড়ন্ত বেলা, একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। বেলাবেলি এখান থেকে ফিরতে পারলে হয়।

    টাকা বার করে দিয়ে দেশী মদওয়ালা বাবুলের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা চারিদিকে তাকিয়ে একটু দার্শনিক হাসি হাসে। আমি অধীর ভটচায, ভদ্রলোকের খাতাতেই নাম আছে, দু’দিন বাদে আমার বিয়ে, আর আমি এই নরককুণ্ডের মধ্যে দাঁড়িয়ে এক বোতল ধেনোমদের প্রতীক্ষা করছি।

    কিন্তু প্রতীক্ষার শেষে বড় আশার বাণী শোনা গেল। বাবুলের কাছে ধার ছিল ভালোই। বাবুল ভেবেছিল চারিদিকে দেনা করে মরে লোকটা গা ঢাকা দিয়েছে, ও আর উদ্ধার হবে না।…কিন্তু হঠাৎ একদিন জগদ্দল না কোথা থেকে দশটাকা মনিঅর্ডার এলো বাবুলের নামে, প্রেরক সুধীর ভটচায! সেই থেকে আরো দু’বার দিয়েছে পাঁচ টাকা, পাঁচ টাকা করে। কুপনে লিখেছে আরো পাঠাচ্ছি। ঋণী হয়ে মরতে ইচ্ছে নেই।…

    সেই কুপন আছে?

    শেষ টাকা পাঠানোর রসিদটা এনে দেখায় বাবুল। বাকি সব ধার শোধের বিনিময়ে। ঠিকানাও সাপ্লাই করল বাবুল।

    সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। আকাশে অনেক নক্ষত্র। লোকালয়ে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি নেয় অধীর। বাড়ি ফেরার পথে গাড়ির গদিতে পিঠ ঠেসিয়ে বসে ভাবতে থাকে, ঠিক জায়গায় খুঁজতে জানি না বলেই আমরা অনেক কিছুই সময়ে খুঁজে পাই না।

    আবার ভাবল, অথবা সময়টাই আসল। সে না এলে কিছুই হয় না। তিন বছর আগে আমি কি কখনও ভাবতে পেরেছিলাম এই নরককুণ্ডে আমাকে আসতে হবে আমার জীবনের পরম দুর্গ্রহকে খুঁজতে! সময় আমাদের পিটিয়ে পিটিয়ে ভিন্ন গড়ন দেয়।

    তা হয়তো সময় সবাইকেই দেয় ভিন্ন গড়ন। নইলে সুখস্বর্গের দরজা অবধি খোলা পেয়েও সুধীর ভটচাযের মতো চিরদিনের লোভী হ্যাংলা লোকটা তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ত্যাগের মন্ত্র উচ্চারণ করতে পারে? বলতে পারে—তুই যে আমায় নিয়ে যেতে চাইলি এই আমার যাওয়া হল খোকা।…এই আমার স্বর্গ হাতে পাওয়া। কিন্তু ভেবে দেখছি ভবানীপুরের নীহারকণা দেবীর সংসারে চটকলের কুলি এই পৈতে ফেলা ঘনশ্যাম দাসকে কিছুতেই খাপ খাওয়ানো যাবে না।…এ এক রকম বেশ আছি। যেমন আমার চরিত্তির তেমনিই জীবন। কলের ভোঁ বাজলেই কারখানায় ছুটি, আবার ভোঁ বাজলে ফিরি।…একটা কামিনমাগী ভাত জল করে ঘর সংসার দেখে, চলে যাচ্ছে এক রকম। আমি গেলেই তোদের সাজানো সংসার আবার তচনচ বৈতো নয়।

    বাবা, এখন আর সংসারে তেমন অভাব নেই।

    জানি, খবর পাই, কিন্তু সুধীর ভটচায যা কেলেঙ্কারি করত তার সবটাই তো অভাবে নয় বাবা, করত স্বভাবে। তা স্বভাবের স্বভাব তো জানিস? কথায় বলে স্বভাব যায় না মলে। তুই এলি আমায় আবার বাবা বলে ডাকলি, এতেই আমি বর্তে গেলাম।

    আবার ফিরছে অধীর। রেলগাড়ির কামরায়। বাবা বলেছিল, তোকে কিছু খাওয়াতে পারলাম না এ দুঃখু মলেও যাবে না। কিন্তু এই নরকে তোকে খাওয়াবার চেষ্টা করব না। জীবনটা তো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন নয় বাবা, নিজেকে সর্বদাই অশুদ্ধ মনে হয়।

    অধীরের বুক—পকেটে দুখানা একশো টাকার নোট। সুধীর ভটচায তার শীর্ণ আঙুল ক’টা দিয়ে সেটা অনেকক্ষণ ধরে থেকে আবার ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিল। চোখের জলটা সামলাতে সময় লেগেছিল বলেই একটু পরে বলেছিল, এ আমার টাকা নয় রে খোকা, ভগবানের আশীর্বাদ। মাথায় করে নিলাম। এখন এটা আমার ছেলের বৌয়ের জন্যে নিয়ে যা, শ্বশুরের আশীর্বাদ বলে।

    আমার টাকা তাহলে তুমি নেবে না বাবা?

    ও কথা বলিস না খোকা, কখন কী হয় কে বলতে পারে? তবে এখন আর লোভের ফাঁদে পা দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর তুই দিলেই কি আমার ভোগে লাগবে? ওই হারামজাদি মাগী হাত মুচড়ে কেড়ে নেবে।…দেখ না, ওখানে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে।

    অধীর চকিত হয়ে তাকিয়ে দেখেছিল, অদূরে একটি মাঝবয়সী মেয়েছেলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি টানছে। মুখে বসন্তের দাগ, কপালে চকচকে টিপ। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল অধীর।

    তবু অধীর মনে মনে খসড়া করছে, গিয়ে মাকে কী বলবে। হ্যাঁ, ঠিক করে নিয়েছে, বলবে, মা, তোমার ধারণাই ঠিক জানতে পারলাম, বৈরাগ্যের পথেই চলে গেছে বাবা। বিয়েটা এখন স্থগিত থাক, চল, তোমায় নিয়ে তীর্থে তীর্থে ঘুরে দেখি একটু, এখন চলে যাওয়াই ভালো।

    মা যেন খবর না পেয়ে কোথা থেকে জানতে পারল অধীর।… শুধু একটা কথা মনে যন্ত্রণার পিন ফোটাচ্ছে। আসবার ঠিক আগেই মিথ্যা কথা বলে এসেছে বাপের কাছে। একেবারে চলে আসবার সময় বাবা কেমন একটা ছেলেমানুষী হাসি হেসে বলে উঠেছিল, হ্যাঁ রে, তোমার মার রাগটা পড়েছে?

    অধীর বলে উঠতে পারেনি, মা তোমার জন্যে মরে যাচ্ছে বাবা। অধীর বলেছিল, মার কথা বোঝা যায় না।

    বাবার আশা আশা মুখটা নিভে গিয়েছিল। বলেছিল, ওই তো, ওই তো দুঃখু! কোন দিন বুঝতে পারলাম না মানুষটাকে।

    কিন্তু কেন যে অধীর আসল কথাটা না বলে অন্য একটা কথা বলে এলো, তা নিজেই জানে না।

    ⤶ ⤷
    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article সূর্যোদয় – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }