Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    ঘর – আশাপূর্ণা দেবী

    লেখক এক পাতা গল্প105 Mins Read0
    ⤶

    একই ছাদের নীচে – আশাপূর্ণা দেবী

    একই ছাদের নীচে

    ঢং!

    দেওয়াল ঘড়িটা মৃদুগম্ভীর আওয়াজে একটি ঘণ্টাধ্বনি দিলো!…শব্দের এই মৃদু গাম্ভীর্য ঘড়িটার প্রবীণত্বের পরিচায়ক। সেকেলে পুরনো দেওয়াল ঘড়িগুলোই এ রকম আত্মস্থ গৃহকর্তার ভঙ্গীতে ঘণ্টা ধ্বনি দেয় যেন সংসার সদস্যদের সময় সম্পর্কে সচেতন করে দিতে।

    আগে সাধারণ একখানা দেওয়াল ঘড়ি প্রায় সব বাড়িতে থাকতো, সাধারণ গেরস্থ বাড়িতেও। আজকাল সাধারণ গেরস্থ বাড়ির দেওয়ালে, একখানা বড়সড় ঘড়ি ঝুলছে এমন দৃশ্য প্রায় দুর্লভ। যাদের আছে তাদের আছে। অর্থাৎ যারা সাবেক কালের এই প্রাণীটাকে চেষ্টা যত্ন করে এখনো টিকিয়ে রেখেছে। যেমন—সুধামাধবের বাড়িতে।…ঘড়ির সাদা জমিটা পুরনো খবরের কাগজের মত ঘোলাটে ময়লা ঝাপসা হয়ে গেছে, পিতলের কাঁটা দুটো স্রেফ লোহার মত, তবু কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

    আজকাল আর এই কাজ চালিয়ে যাওয়ার চালটাকে কেউ তেমন শ্রদ্ধাসমীহ করে না, নাই বাতিলরা অপসারিত হয়ে হয়তো জঞ্জালের স্তূপে ঠাঁই নেয়, নয় তো শিশি বোতলগুলোর ঝুলিতে চড়ে বিদায় নেয়। নতুন করে ধ্বনিময় একটা দেওয়াল ঘড়ি বড় একটা কেউ কেনে না। অন্ততঃ সাধারণ গেরস্থরা। কারণটা হয়তো তার আকাশছোঁয়া দাম। ঘড়ির দাম তো ঘোড়ার মত ছুটে ছুটে সেকাল থেকে একালে এসে পৌঁচেছে। তাছাড়া সত্যি, জিনিসটা তেমন কাজেও লাগে না আর আজকাল। মেয়েমানুষ নির্বিশেষে প্রায় সকলেরই হাতে হাতে নিজস্ব একটা করে বাঁধা থাকে। বাড়ির সিঁড়ির সামনে দালানের উঁচু দেওয়ালে টাঙানো একটা মাত্র ঘড়ি দেখে নিজেদের নিয়ন্ত্রিত করবার দুঃখজনক অবস্থায় কেউ আর আজ থাকতে চায় না।

    সুধামাধবের বাড়িতেও তাই।

    তবু সুধামাধবের বাবা ব্রজমাধবের কেনা এই বড় ঘড়িটা এখনো বাজে। নির্ভুল নিয়মে আত্মস্থ গৃহকর্তার ভঙ্গীতে মৃদু গাম্ভীর্যে। তার সেই ঘণ্টা ধ্বনিতে বাড়ির আর কেউ কান না দিক, সুধামাধব দেন। আর যখনি ওর আওয়াজটা কানে আসে, বাবার সেই কথাটা মনে পড়ে যায়। ব্রজমাধব এই ঘড়িটাকে বলতেন ‘সময়ের প্রহরী’।

    সুধামাধব ভাবতেন বাবা বেশ শব্দগুলো কথার মধ্যে বসান। সময়ের সেই প্রহরীর ওই একটি মাত্র ধ্বনি শুনেই বিছানায় উঠে বসলেন সুধামাধব।

    এই একটা শব্দ ‘বারোটা বেজে যাওয়া’ দিন রাত্রির আবার নবোদ্যমের সূচনা নয়। এটা অর্দ্ধমাত্রিক স্মারক। আধ ঘণ্টা সময় আগে ঘড়িটা যে চারবার ঘণ্টা বাজিয়েছিল ঘুমন্ত সংসারটার চেতনায় ঘা দেবার বৃথা চেষ্টায়, সেটা ‘অজানা ঘুম’ সুধামাধবও শুনতে পান নি, এটা পেলেন, এবং অনুভব করলেন, এটা ভোর সাড়ে চারটে।

    আষাঢ় মাসের আকাশ এখনি দিনের ধান্ধায় গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েছে।

    সুধামাধবও উঠে পড়লেন।

    নীলিমার মত ঘুম ভেঙে উঠে বহুক্ষণ বিছানায় বসে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্মরণ করবার অভ্যাস সুধামাধবের নেই, তিনি বিছানা থেকে উঠে পড়েই খাটের তলায় রাখা রবারের চটিটা পায়ে গলিয়ে আস্তে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন।

    দালানের সামনের দেওয়ালে পাশাপাশি যে দু’খানি ছবি ঝোলানো আছে, একবার তাদের দিকে তাকিয়ে মনে মনে প্রণাম করে নিয়ে দালানের অন্য একটা দেওয়ালের গায়ে পেরেকে ঝোলানো সিঁড়ির চাবিটা পেড়ে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।

    ছবি দু’খানা সুধামাধবের মা মনোরমা দেবীকে আর বাবা ব্রজমাধবের। দুজনে একত্রে ছবি তোলার সুযোগ আর ঘটে ওঠেনি ওদের জীবনে, তাই পরে সুধামাধব দু’খানা ছবিকে নিবিড় সান্নিধ্যে পাশাপাশি টাঙিয়ে রেখে হয়তো মৃত আহ্লাদের সান্ত্বনা, এবং আপন আত্মার শান্তিবিধান করেছেন।

    সুধামাধবের শোবার ঘর থেকে বেরোতেই সামনেই পড়েন ওঁরা। দেবদ্বিজে ভক্তিমতী নীলিমা একবার ওই দেওয়ালেই ফটো দুখানার মাথার উপর একটা ছোট ব্র্যাকেট বসিয়ে তার উপর একখানি মাটির কালীমূর্তি স্থাপন করেছিলেন, যাতে ঘুম ভেঙে উঠেই দেবী দর্শন হয়, দিন ভাল যায়। কিন্তু স্বল্পভাষী সুধামাধব বলেছিলেন, বাড়িতে তো আরো অনেক দেওয়াল আছে। নীলিমার মুখের দিকে আর তাকাননি।

    বাড়ির সেই অনেক দেওয়ালের একটা দেওয়ালের পেরেক থেকে চাবিটা নিয়ে—সিঁড়ির মুখের কোলাপসিবলের গেটটা খুলে, দুদিকে একটা ঠেলে একটা মানুষ যাতায়াতের মত ফাঁক বার করে আস্তে আস্তে নেমে গেলেন।

    রবারের চটি, তাই বাবার সুঁড়তোলা বিদ্যেসাগরী চটির মত অথবা ঠাকুর্দার খড়মের মত সিঁড়ি নামা ওঠার চটাস চটাস খটাস খটাস আওয়াজ হয় না। ওঁরা হয়তো ভাবতেন গৃহকর্তার পদধ্বনির একটু জানান থাকা ভালো, সংসারের অধস্তন সদস্যরা অবহিত হতে সময় পায়। সুধামাধবের সে ভাবনা নেই, কারণ ওই অবহিত হয়ে ওঠার প্রশ্নটাই নেই। অতএব রবারের চটিটাকেও আস্তে আস্তে চেপে চেপে নিঃশব্দে নেমে আসেন।

    সিঁড়ির তলার পাশেই ক্ষুদে একটা ‘ঘরের মতন’এ লালটু শুয়ে থাকে, ওর ওই ঘটা একেবারে সদর দরজার গায়েই। ভোরবেলা বাসনমাজা মহিলাটিকে দরজা খুলে দেবার দায়িত্ব তার। কিন্তু দায়িত্ব থাকলেই যে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে, এমন তো কোনো কথা নেই?

    অতএব আগে প্রায়ই মহিলা কড়া নেড়ে ফিরে যেতেন, এবং পরে ডাকতে গেলে মুখ নাড়া দিয়ে বলতেন, কার এতো সময় সস্তা, যে চৌপর দিন আপনাদের দরজায় পড়ে থাকব? …ফাষ্ট পালায় দোর খুলে না দিলে লাষ্ট পালাতেই পড়তে হবে।

    চার বাড়ির কাজ, সময়ের দাম সোনার দামে, এ অহঙ্কার তার আছে।

    কিন্তু লালটুও ঝাড়গ্রামের ছেলে, ঘুমেও যেমন পটু কথাতেও তেমন পটু। সে সতেজে বলে, কুসুমদির ফাষ্ট পালা মানেই তো অর্দ্ধেক রাত্তির কে দরজা খুলবে তখন? দরজার ফুটোর কাঁচ দেখে আমার ভয় লাগে। পেতণী শাঁকচুন্নি মনে হয়।…বলাই বাহুল্য এনিয়ে খণ্ড প্রলয় বেধে গিয়েছিল, এবং ‘কে থাকবে, কে যাবে’ এই নিয়ে টাগ অফ ওয়ার চলেছিল, শেষ পর্যন্ত শান্তিচুক্তি হলো সুধামাধবের মধ্যস্থতায়। তিনি বললেন, ঠিক আছে দরজা খুলে দেওয়ার ভারটা আমিই নিচ্ছি। আমি তো ভোরেই উঠি।

    এতে নীলিমা ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, ভোরে ওঠো বলে মাঝ রাত্তিরে? কুসুমের ‘ফাষ্ট পালা’ কখন জানো? রাত সাড়ে চারটেয়।

    সুধামাধব মৃদু হেসেছিলেন, ওটা রাত নয়। শাস্ত্রমতে ব্রাহ্মমুহূর্ত। আমার বরং ভালই হবে। তাছাড়া—ফাষ্ট ট্রেনটা ধরতে না পারলে তো তোমাদের অসুবিধে। সেই লাষ্ট ট্রেনে গিয়ে ঠেকবে! নানান বিশৃঙ্খলা।

    তদবধি কাজটা নিঃশব্দে হচ্ছে এবং সংসার রথখানি বেশ কুসুমাস্তীর্ণ পথেই চলছে। বাড়ির সবাই যদি ঘুম থেকে উঠে দেখে, চারিদিক সব ধোওয়ামোছা—চকচকে, রান্নাঘর শুকনো খটখটে, বাসনের গোছা ধোওয়ামাজা, খাবার টেবিলটা নির্মল বক্ষপেতে বসে আছে চায়ের সরঞ্জাম নামার অপেক্ষায়, তাহলে কুসুমাস্তীর্ণ ছাড়া আর কি বলা যায়? উল্টোটা হলে তো রথের চাকা কাদায় বসে যাওয়া।

    প্রত্যেকে প্রত্যেককে দোষারোপ করবে সামান্যতম অসুবিধে ঘটলেও, যে চায়ের টেবিলে মলয় বাতাস বয়, সেখানে তুফান উঠবে, চেঁচামেচি গোলমালে সকালের রমণীয় স্নিগ্ধতা ছিন্নভিন্ন হবে।

    ‘অসুবিধে’ বড় ভয়ানক জিনিস।

    ওতে মুহূর্তে মানুষকে অভদ্র করে তুলতে পারে, স্বার্থপর করে তুলতে পারে, রুক্ষ করে ফেলতে পারে।…অথচ সে ‘অসুবিধের’ কারণ হয়তো সামান্যই।

    সুধামাধব এইটি অনুধাবন করেই ওই কাজের ভারটি নিয়েছিলেন। কিন্তু শৃঙ্খলা সুবিধে সত্ত্বেও—কথা শোনাতে ছাড়ে না কেউ।

    ‘বাবাই প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে ওই লালটুবাবুর মাথাটি খেলেন। লালটুকে পাছে কাঁচা ঘুমে উঠতে হয়, তাই বাবা নিজে—ভাবা যায় না।…’ ‘বাড়ির কর্তার পোষ্টটা আমার হলে দেখিয়ে দিতাম ঝিকে জাষ্ট ছটার সময় আসতে বাধ্য করা যায় কিনা।… ওর অসুবিধে হবে বলে উনি রাত থাকতে এসে ইলেকট্রিসিটি খরচা করে কাজ করবেন! ভাবা যায় না।’….

    …’সাত জন্মে কেউ’ কখনো শুনেছে চাকর নাক ডাকিয়ে ঘুমোয়, আর বাড়ির কর্তা যান দরজা খুলতে।…’এরপর হয়তো দেখা যাবে বাবা বেডটি বানিয়ে লালটুকে ডেকে খাওয়াচ্ছেন।’ …গোবর গণেশ কর্তা হলেই সবাই পেয়ে বসে, দেখে আসছি তো চিরকাল।’

    ইত্যাকার নানা মন্তব্যই শোনা যায়, সামনে আড়ালে। তবে সুধামাধবের কানে ঢোকে কিনা বোঝা যায় না।…

    সুধামাধব যথারীতি নিজের কাজগুলো করে যান পর পর।

    নীচে নেমেই সিঁড়ির পাশের বসবার ঘরের জানলাগুলো সব খুলে দেন, যদিও এটা লালটুরই করণীয়।…কিন্তু করণীয় কাজ কে কত করে? প্রায়ই দেখা যায় বেলা দশটা পর্যন্ত ঘরটা জানলা দরজা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।

    তাই নিয়ে বাড়িসুদ্ধ সবাই ওই বালক, বা নাবালকটাকে একহাত নেবে। অথচ কাজটা একমিনিটের।

    বাইরের দরজায় ভিতর থেকে ভারী একটা লোহার তালা ঝোলানো থাকে সুধামাধবের বাতিকের চিহ্ন বহন করে। সবাই হাসাহাসি করে, বলে ‘বাড়ির মধ্যে থেকে তালা ভেঙে বেরিয়ে যাবার তাল করবার মত কে আছে?’

    তবু তালাটা ঝোলে, যেমন ঝুলতো ব্রজমাধবের আমলে। তখন ‘নবতাল’ ওঠেনি—গডরেজও না, কে জানে কোন কোম্পানীর, তবু অটুট আছে এখনো।

    তালাটা খুলে দরজার একটা পাল্লা খুলে ধরে দাঁড়িয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দেখলেন সুধামাধব।…মিনিট খানেকও নয়, নির্দিষ্ট মোড়ের মাথায় কুসুমবালার লম্বা রোগা কালো কাঠ ঠকঠকে মূর্তিখানি ফুটে উঠলো, প্রাক উষার আর রাস্তার বিজলি বালবের মিশ্রিত আলোয়।

    ওসময় ও এসে না ঢোকা পর্যন্ত দোরটা খুলে রেখে চলে যাওয়া যায় না। কিন্তু দৈবাৎ একমিনিটের বেশী সময় দাঁড়াতে হয় সুধামাধবকে। এইজন্যে কেবলমাত্র এই জন্যেই ওই কাংসকন্ঠী এবং সত্যিই প্রায় শাঁকচুন্নি সদৃশ কুসুমবালাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন সুধামাধব।

    কুসুমবালা সম্পর্কে শ্রদ্ধা শব্দটা হয়তো হাস্যকর, তত্রাচ ওই শব্দটাই সুধামাধবের মধ্যে কাজ করে। কখনো কখনো ইচ্ছে হয় বাড়ির লোককে বলেন, ‘কুসুমের কাছেও তোমাদের শিক্ষা করবার আছে’—কিন্তু ইচ্ছেটা কাজে পরিণত করতে ইচ্ছে হয়না। কথাটা তো কারুর উপকার বহন করে আনবে না। বরং সুধামাধবেরই অপকার বহন করে আনবে। অবমানিকেরা—অবশ্যই কথার বিষটা ফেরৎ দিতে চেষ্টা করবে।

    কুসুম ঢুকতেই দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন সুধামাধব। বেশ লাগে এ সময় ঠাণ্ডা রাস্তায় একটু পায়চারি করতে।…এক একদিন প্রায় লেকের কাছ পর্যন্ত চলে যান, আর ভাবেন, কে যে কার কিসের নিমিত্ত হয়! ওই বাসনমাজা ঝিটা আমার এই অনির্বচনীয় মাধুর্য স্বাদের নিমিত্ত।…সত্যি, কবে আর এমন উষা ভোরে অকারণ রাস্তা বেড়িয়েছি?

    বাড়ির অন্য সকলের থেকে ভোরে অবশ্য উঠি চিরকালই, কিন্তু এমন সময়? কই আর? …উঠেছি কলঘরে গিয়েছি, দাড়ি কামিয়েছি, নিজস্ব টুকিটাকি কাজ করেছি, তারপর বাজারে বেরিয়েছি।…এমন করে তো কোনোদিন অনুভব করিনি ভোরের বাতাস কত স্নিগ্ধ। ভোরের আকাশ কত সুন্দর। কলকাতার রাস্তাও ভোরে কেমন মোলায়েম।…আগে আগে না হয় চাকরীর দোহাই ছিল, কিন্তু রিটায়ার ও তো করেছেন কম দিন নয়। কই মনে তো পড়েনি, যাই ভোরবেলা উঠে রাস্তায় বেড়াইগে।

    আষাঢ়ের ভোর বড় তাড়াতাড়ি বিলীন হয়, খুব বেশীদূর গেলেন না সুধামাধব…আস্তে ফিরে এলেন।…

    ঘুরে এসে দেখলেন কুসুম সিঁড়ি মুছছে। এটাই কর্ম সমাপনের শেষ সঙ্কেত।…কুসুম ওঁকে দেখেই বলে উঠল, লক্ষ্মীছাড়াটাকে একটু ডাকুন না বাবা! আমি সেই ইস্তক ডেকে ডেকে মরছি। তা নবাবের জামাইয়ের ঘুম আর ভাঙছে না। আপনার সাড়া পেলে তবে যদি…

    সুধামাধব বললেন, উঠবে। আপনিই উঠবে।…বাড়ির আর কেউতো ওঠেও নি। ওকী কাজ করবে?

    কুসুম ধড়াং করে বালতিটা অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে খ্যানখেনে গলায় বলে ওঠে, ওইতো! ওই তো আপনার দোষ বাবু। এতো মায়ার শরীর করলে চলে না। পয়সার বিনিময়ে খাটতে এসেছে বৈ তো আয়েস করতে আসেনি।

    সুধামাধব মনে মনে একটু হাসেন।

    সবাইয়ের যদি এ ‘সেনস’টা থাকতো।

    যদিও এই শান্ত ভোরের পরিবেশে কুসুমের চড়া গলার ক্যানক্যানানি রীতিমত আশ্রমপীড়া ঘটায়, তবে সে কয়েক মুহূর্ত মাত্র। দেখা যায়, কথা শেষ না করেই ঝনাৎ করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে কুসুম।

    তবু ওর সম্পর্কে শ্রদ্ধাশীল সুধামাধব।

    অনেক সময় ভাবেন সবাই যদি ওর মতো সময়নিষ্ট হতো!

    দোতলায় উঠে যাবার আগে একবার ডাক দিলেন, লালটু। এই লালটু! উঠে পড়। আর শুয়ে থাকলে বকা খাবি তো।

    তারপর উঠে এসে দাঁড়ান।

    বাড়ি এখনো নিথর, কেউ ওঠেনি ঘুম থেকে। শুধু দালানের ধারে মাজা বাসনের গোছাগুলো একটা জাগ্রত ভূমির আভাস জানাচ্ছে।

    সুধামাধব নিঃশব্দে স্নানের ঘরে ঢুকে গেলেও যথানিয়মে একেবারে দাড়ি কামিয়ে স্নান সেরে নিজের গেঞ্জি পায়জামা সাবান দিয়ে কেচে নিয়ে যখন পায়জামা গেঞ্জি পরে বেরিয়ে এসে ভিজে দুটো সামনের তারে শুকোতে দিয়ে ক্লিপ আটকে একটু আগে ভেজিয়ে রেখে যাওয়া দরজাটা আস্তে ঠেলে খুলে ঘরে ঢুকলেন, দেখলেন সেখানেও যথানিয়মে নিজের খাটের উপর ধ্যানাসন হয়ে বসে নীলিমা বিজবিজ করে স্তব পাঠ করছেন।

    এ সময় সাড়া শব্দ করা বিধি নয়, তাই বাজারে কী দরকার না দরকার আগের রাত্রে জেনে নিয়ে লিখে রাখেন সুধামাধব। নিঃশব্দে ড্রয়ার খুলে সেই ফর্দটা আর টাকাটা বার করে নিয়ে বেরিয়ে এলেন।

    কারো সম্পর্কে কিছু ভাববোনা সংকল্প থাকলেও না ভেবে পারলেন না, নীলিমা দেবী স্বর্গের রাস্তায় কতদূর এগোতে পারলে?…তোমার এই স্তব স্তোত্র ধ্যান জপ সমাপ্ত করে উঠে এসেই তো তুমি সংসারের সবাইয়ের উপর এক হাত নিতে শুরু করবে।…তখনতো তোমায় দেখে মনে হবে না তুমি এতোক্ষণ ঈশ্বর সান্নিধ্য করে এলে।

    আবার ভাবলেন চিরকাল দেখেছি স্নান শুদ্ধ হয়ে পূজোপাঠ করতে হয়, বিছানায় বসে পূজোটা অভিনব।…অথচ শুনতে পাওয়া যায় নীলিমার গুরু এই সময়টির উপরই বিশেষ জোর দেন।…সারারাত্রিব্যাপী সুখসুপ্তির পর শরীর মন নাকি হালকা আর পবিত্র থাকে।

    হবেও বা। সুধামাধবতো কখনো ও ধার ধারেননি।

    ধারকাছ দিয়ে হাঁটেনও নি।

    নীলিমার আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে অনায়াসে পিছলে বেরিয়ে এসেছেন তিনি।

    নীচের তলায় নেমে এসে দেখলেন, ঝোলা হাফপ্যাণ্ট আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরা লালটু বাইরের দরজায় দাঁড়িয়ে পরপর হাই তুলে যাচ্ছে।

    সুধামাধব হাসি চেপে বললেন, কী? এখনো ঘুমের নেশা কাটেনি? যা হাতেমুখে জল দিয়ে আস্ত জামা প্যাণ্ট পরে আয়।

    লালটু মলিন মুখে বলে, ‘ঠাকমা বলে রাতের শোওয়া ওই ছেঁড়া গেঞ্জি পেণ্টুল পরেই বাজার যাবি।’

    তার মানে? এ হুকুম কেন?

    ঠাকমা বলে, বাজারে ধাঙড় মেথর ছোঁওয়া যায়, এসে একেবারে সাফ সুৎরো হয়ে ‘কাচা জামা’ পরবি।

    সুধামাধব এখন একটু হেসে বলেন, তা’ সেসব তো আমারও ছোঁওয়া যায়। ওরা কি বেছে বেছে ছোঁয়?

    আপনার কথা বাদ দাও দাদু। আপনাকে বলতে আসবে এমন সাধ্য থাকলে তো?

    থাক। খুব কথা শিখেছিস! তোর ঠাকুরমাকে বলিস এরকম ময়লা নোংরা জামাপরা দেখলে আমি তোকে নিয়ে যাব না।…এতো ছেঁড়া পরিসইবা কেন? আর নেই?

    লালটু অপ্রতিভ মুখে বলে, আছে। তা’ ঠাকমা বলে, ছেঁড়া বলে ফেলে দিবি না কি? রাতে শুবি।

    তা’ বেশ ভালই বলেন। তা’ এখন তো আর রাতে শুচ্ছিস না। যা চটপট বদলে আয়, আমি এগোচ্ছি, তুই থলি দুটো নিয়ে চলে আসবি।…

    লালটু বিজ্ঞের ভূমিকা নেয়।

    বলে, এতো সকালে বাজার খোলেনি।

    না খুলে থাকে, খানিক ছাওয়া খাবি।

    বৌদি রাগ করে। বলে চা পর্যন্ত না খেয়ে বাজার যাবার কোনো মানে হয় না। অফিস তো যেতে হবেনা, এতো তাড়া কিসের?

    সুধামাধব এখনো হাসেন। বলেন, বলে বুঝি? আমার আবার এই ভোরবেলাতেই বাজারে আসতে ভালো লাগে, ভীড় থাকে না। যাকগে তুই চটপট চলে আয়। আমি কালোর দোকানের কাছে আছি।

    নীলিমা যে বলেন, বাড়ির লোকের সঙ্গে একটা বৈ দুটো কথা খরচ করতে নারাজ, মিথ্যে বলেন না বোধহয়। …

    সত্যি এই ছেলেটার সঙ্গে অনেক সময়ই একাধিক কথা বলেন সুধামাধব। হয়তো বা অকারণেও। তাছাড়া—একথাও মিথ্যেও নয়, ছেলেটা সম্পর্কে তাঁর একটা দুর্বলতা আছে। যখনই দেখেন—ও একা একা কোথাও উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে, অথবা মলিন মুখে ন্যাতাবালতি নিয়ে ঘর মুছছে, কি বয়েসের অনুপাতে কঠিন কঠিন কাজ করছে, মনটা কেমন করে ওঠে সুধামাধবের।…শুধু অভাবের তাড়নাতে এই ছোট্ট ছেলেটাকে মা বাপ ভাইবোন ছেড়ে দূর দূরান্তরে এসে একটা নিষ্পরের বাড়িতে প্রাণপাত করে খেটে মরতে হচ্ছে।…অনেক ভালো ছিলো চাষী বাপের ছেলেরূপে মাঠে খাটা। তবু তো মায়ের হাতে খেতে পেতো।

    এই দুর্বলতার বশেই সুধামাধব নিত্য বাজার যাবার পথে ওই কালোর দোকানে এসে দাঁড়ান একবার। খান চারেক জিলিপি কি দুখানা গজা কিনে লালুটকে খেয়ে নিতে বলেন, তারপর বাজারে ঢোকেন।

    লালুট অবশ্য এতে খুবই লজ্জা পায় ‘না না’ করে। বলে আপনি কিছু খাননা, আমি গপ গপ করে খাব আমার বুঝি লজ্জা লাগেনা?

    সুধামাধব হেসে ফেলেন।

    তোর মতন দোকানে দাঁড়িয়ে জিলিপি খাবো আমি?

    তারপর আবার হয়তো কৌতুকের গলায় বলে ওঠেন, আমি বাড়ি ফিরলেই আমার জন্যে এই চা আসবে, এই মাখন মাথা টোষ্ট আসবে, ডিম সেদ্ধ আসবে, সন্দেশ আসবে, তোর জন্যে আসবে তা?…তোর ভাগ্যে তো সেই সকলের শেষে—

    আশ্চর্য! ছোট্ট ছেলেটাকে কেউ ছোট ভাবে না। ভাবলে না কি ও সাপের পাঁচ পা দেখবে, মাথায় চড়ে বসবে, বেয়াড়া হয়ে উঠবে।

    অতএব বাবুদের খাওয়ার আগে খেতে দেওয়া চলে না ওকে।…কাজেই কালো দোকানের ওই গজা জিলিপির বরাদ্দ। যদিও জানেন সুধামাধব নামক ব্যক্তিটির প্রতি গঞ্জনার ও লালটু নামক ছেলেটার প্রতি লাঞ্ছনার শেষ থাকবে না, তথাপি বাড়িতে—বলিসনে—এমন ছোট কথাটাও এই ছোট ছেলেটার কাছে বলতে পারেন না।

    তথাপি সহজাত বুদ্ধির বশেই ছেলেটা এই সত্যটি গোপন করে চলে।

    ছুটতে ছুটতেই চলে এলো লালটু, একটা কাচা জামা মাথায় গলাতে গলাতে। হাতের মধ্যে বাজারের থলি গলিয়ে।…জিলিপির ঠোঙাটা হাতে নিয়ে লালটুর চোখে মুখে যে অনির্বচনীয় ভাবটি ফুটে ওঠে, তার দাম কী, আর ওই কটা পয়সা তার কাছে কতটুকু সেটাই ভাবতে চেষ্টা করেন সুধামাধব…

    সামান্যর বিনিময়ে অসামান্য!

    কানাকড়ির বিনিময়ে রাজত্ব।

    ভাল করে হাত ধুয়ে নে—

    বলে বাজারের দিকে এগোন সুধামাধব। পিছনে পিছনে হৃষ্ট মুখ লালটু শূন্য থলি দুটোকে বেদম দোলাতে দোলাতে।

    সুধামাধবের ঘরে ঢোকা, টাকা পয়সা নিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে যাওয়া, গভীর ধ্যানস্থ অবস্থাতেও নীলিমার চোখে এড়ায়নি। নীলিমার চেতনায় এটাও ধরা পড়ে আছে—মাত্র দু’এক মিনিট আগেই অনলস প্রহরী ঘড়িটা পর পর ছটা ঘণ্টা বাজিয়েছে। এই সাত সকালেই বাজারে ছোটা হল বাবুর!

    আসবেন সেই বেলা আটটায়। লক্ষ্মীছাড়া ছোঁড়াটার সঙ্গে গাল গল্প করতে করতে। ছোঁড়া বাজার থেকে ফেরে যেন আহ্লাদে ভাসতে ভাসতে। দাদুর আদরে ধরাখানিকে সরাখানা দেখে পাজীটা।

    সেদিন মৌরলা মাছ কুটতে বলায় বলে কিনা, এসব কি আর আমার দ্বারা হয় ঠাকমা এ হচ্ছে মেয়েছেলের কাজ!

    নীলিমা অবিশ্যি ওর ঘাড় ধরে চড়িয়ে ছাড়লেন, ‘ঠাকমা’ ডেকে আহ্লাদ বাড়ালেই কি তিনি সুধামাধবের মত নাতির আদর করতে বসবেন ওকে?

    আজ পূর্ণিমা। নীলিমা ঠাকুরের জন্যে একটু ফল আনতে বলবেন ইচ্ছে হচ্ছিল, কিন্তু ধ্যানের মাঝখানে তো আর কথা বলতে পারেন না।

    কথা তুললে বলবেন, রাতে কেন বলে রাখোনি?

    মানুষ যেন যন্ত্র। তার যেন আর ভুল হয়ে যেতে পারে না, অথবা হঠাৎ নতুন একটা ইচ্ছে হতে পারে না। কেন, নীলিমা ধ্যানপূজো সেরে উঠে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারা যায় না? রোজই তো শুনতে পাওয়া যায় বৌমা আক্ষেপ করছে, বাবা কেন যে খালিপেটে বেরোন। চা টা খেয়ে তো বাজার যাবেন!…শুনতে লজ্জা করে না নীলিমার?…কেন? কী এমন রাজকার্য তোমার? রিটায়ার বুড়ো তো বেকারের সামিল। …দেব নেই দ্বিজ নেই, ঠাকুর দেবতার নাম মুখে আনা নেই। এখনো যেন উঠতি বয়সের ছোকরা। এখনো মাংস মুর্গী ডিম পিঁয়াজ খাচ্ছেন, সর্বদা ফর্সা জামা কাপড় পরছেন, ঘড়ির কাঁটায় চলছেন। ছিঃ!

    মনে মনে অভিযোগের পসরা সাজাতে সাজাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন নীলিমা। ফুলো ফুলো মুখ, এলোমেলো চুল, মুখের রেখায় বিশ্বের বিরক্তি। সংসারের কিছু তাঁর মনের মত নয়।

    এইতো তাঁর গুরুভগ্নী বাসনাদির বাড়িটি।

    কতবার গেছেন নীলিমা, দেখে যেন চোখ জুড়িয়ে যায়। বাড়িতে ঠাকুর ঘরে বাসনাদি যে গোপাল প্রতিষ্ঠা করেছেন, নিত্য তাঁর ভোগরাগ। বাড়ির সকলেই সেই ঠাকুর অভিমুখী চিত্ত। মেয়েটি সকালবেলা উঠে শুদ্ধবস্ত্রে মায়ের পূজোর গোছ করে দিচ্ছে, ছেলের বৌটি তারপরে আলাদা উনুন জ্বেলে ঠাকুরের নাড়ু ক্ষীর ছানা সুজির পায়েস এইসব বানাচ্ছে, কর্তা পর্যন্ত একখানা স্কেটের ধুতি পরে ঠাকুরের সন্ধেআরতি করে দিচ্ছেন…বাসনাদির ওপর আদেশ আছে নিত্য হাজার জপ করতে, সেই করতেই তাঁর দিন যায়। সবাই মিলে সাহায্য না করলে ঠাকুর সেবাটি ঠিকমত হবে কী করে? সেটি সংসারের সবাই বোঝে। সবাই শুদ্ধাচারী, সবাই সংযমী! বাড়িতে মাছটুকু ছাড়া কোনো অমেধ্য ঢোকে না।

    আর নীলিমার সংসার?

    বাড়ির মাথা থেকে পা অবধি মাছ মাংস মুরগী পিঁয়াজ আর বিস্কুট পাউরুটিতে মাখা। সধবা হয়েও নীলিমাকে বিধবার মত আলাদা রান্না করে খেতে হয়। রাঁধুনী ঠাকুর গোটা কতক আস্ত আলু পটল কপি কুমড়ো আর খান চারেক কাঁচা মাছ একদিকে সরিয়ে রেখে দেয়, নীলিমা সেই কোন বেলায় পূজো করে নেমে এসে একেবারে দুবেলার মত একটা তরকারি রেধে নেন, আর দুটি ভাত ফুটিয়ে নেন। ব্যস। কেন, নীলিমার কি দৈবাৎও ইচ্ছে করতে পারে না পাঁচ রকম খাই দাই। মাছও তো খান না সবদিন, অমাবস্যা, পূর্ণিমা সংক্রান্তি গুরুদেবের জন্মতিথি, আরো কত বার ব্রত থাকে, সে সব দিনে তো নিরামিষ তার মানেই ভাতে ভাত। তাছাড়া আর কি করবেন? অথচ ডাল তরকারি সুক্ত চচ্চড়ি এসব খেতে তো বাধা নেই? কিন্তু জুটবে কোথা থেকে? কর্তা এতোরকম তরিতরকারি আনেন, সব শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখো তুমি নীলিমা দেবী।

    কিন্তু ও বেলায় শুধু বৌয়েরই গৌরব, নীলিমার কচু। নীলিমা কি ওঁদের ওই মাংস মুরগী খাওয়া শরীরের রান্না খেতে যাবেন? চান করে কাচা কাপড় পরে দিতে পারবে? হুঁঃ। কাকে যে ‘শুদ্ধাচার’ বলে তাই জানে না। এই তো সেদিন সদ্য নেয়ে এসেছে দেখে বলেছিলাম, বৌমা একখানা সিল্কের মিল্কের কাপড় জড়িয়ে এসে আমার এই ফুলের মালা কটা গেঁথে দিতে পারবে?

    তা এক গাল হেসে বলা তো হলো, ওমা, কেন পারবোনা? মালা গাঁথতে আমি খুব ভালবাসি।

    কিন্তু করলেন কী? সিল্কের কাপড়ের সঙ্গে বাছা সুতির জামা সায়া পরে এসে দাঁড়ালেন। একে আর কী চৈতন্য করাবো? বললাম, ওই ওখানে বসে আলগোছে গেঁথে দাও। গঙ্গাজল দিয়ে নেব। দিল তাই, তবে সে মালা কি আমি ঠাকুরের গলায় দিতে পারলাম? কাঠটার গায়ে ঝুলিয়ে রাখলাম।

    …এই তো ব্যবস্থা আমার সংসারের। ইচ্ছে হয় একবার বাসনাদির ঘর সংসারটা দেখিয়ে আনি এদের।…তা দেখালেই কি মন মতি ফেরে? আমার যে আসল ঘরেই মুসল নেই। কর্তাদি যদি এমন ম্লেচ্ছ না হতেন, বাসনাদির স্বামীর মত হতেন, তা’হলে সংসারের ছাঁচ বদলাতো। …বলবো কি আমার নিজের পেটের ছেলে মেয়েরাই আমার প্রতিপক্ষ। বৌটির তবু যাহোক সৌজন্য সভ্যতা আছে, কিন্তু আমার ওই হারামজাদা মেয়েটি? কথা শুনলে হাড়পিত্তি জ্বলে যায়।

    বলে কিনা, আহাহা মায়ের খাওয়া নিয়ে বৃথা দুঃখ কোরোনা বৌদি, মা জননী আমাদের কৃচ্ছ্ব সাধনের সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে সশরীরে স্বর্গে যাবার তাল করছেন।….আবার শয়তানী হেসে হেসে বলে, আচ্ছা, মা তোমার এই শরীরেই একদা তুমিও আমাদের মত যত সব অমেধ্য বস্তু খেয়েছ, ওই দাঁতেই মাংসের হাড় চিবিয়েছ। ওদের বিশুদ্ধ করে নিতে পারলে কী ক’রে? আমাদের কাপে চা পর্যন্ত যখন চলে না তোমার। আর ছেলেদের তো কথাই নেই। বড়টাতো উঠতে বসতে ঠাট্টা বিদ্রুপ করে আমার গুরু গোবিন্দ নিয়ে, আর ছোটটা বলে কিনা, মালা জপা বুড়িগুলোই হয় পৃথিবীর সবথেকে কুচুটে। মা সেই দলে গিয়ে ভিড়ছে। অতএব মারও বারোটা বেজে গেছে।

    এই কণ্টকাকীর্ণ সংসারে বাস নীলিমার।

    তবে কিসের সুখে মুখে হাসি আহ্লাদ প্রসন্নতা আসবে?

    কর্তাও কি মাঝে মাঝে চিপটেন কাটতে ছাড়েন? আমাকে শুনিয়ে ছেলে মেয়েদের বলবেন কিনা, দ্যাখ চিরকাল শুনে এসেছি—’প্রসন্ন মন নারায়ণের আসন’, তা তোর মা তার ঠাকুরকে কোথায় বসায় বল দেখি? আসন তো নেই। এই সব সহ্য করে অধ্যাত্ম পথে এগিয়ে যেতে হচ্ছে নীলিমাকে।…গুরুদেব বলেন ‘প্রাক্তন ক্ষয় হচ্ছে—’ ওই চিরকেলে ছেদো কথাটা কি আর মেজাজ ঠিক রাখবে?

    মেজাজ বেঠিক হবার ঘটনা তো অহরহ।

    ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই দেখতে পেলেন নীলিমা দুই ননদ ভাজে চায়ের টেবিলে মুখোমুখি বসে একেবারে আহ্লাদে গড়িয়ে পড়ে কী যেন বলাবলি করছে।

    নিশ্চয় নীলিমার প্রসঙ্গ।

    তা’ নইলে এতো ইয়ে কিসের?

    বিরক্ত নীলিমা বলে না উঠে পারলেন না, সকাল বেলা এতো হাসির কী হল শুনি?

    মেয়ে মুখে হাত চাপা দিয়ে আরো হাসতে লাগল আর বৌ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ও শুভ্রার কলেজের একটা মেয়ের ব্যাপার মা।

    নীলিমা ঘাসের বীচি খান? নীলিমা বুঝতে পারলেন না ওরা নীলিমার কাছে চাপছে? নীলিমা রাগে গরগরিয়ে বলে উঠলেন, এইত একটু আগে সব ঘুমোচ্ছিলে। এখুনি চায়ের বাটি নিয়ে বসা হল? অ্যাড়া বাসি কাপড়গুলো তো ছাড়াই নেই, মুখটাও কি ধুতে ইচ্ছে করেনা?

    শুভ্রা বলে ওঠে, এ মা! আমরা মুখ না ধুয়ে খাই? তোমার থেকে ডবল ভাল করে ধুই।…তোমার মতন অমন বিনা ব্রাশে দাঁত মাজি না আমরা।

    নীলিমা কি তবুও সেখানে দাঁড়াবেন?

    সরে যান। রাঁধুনী ঠাকুরের পিছনে লাগতে যান। না লাগলে হবে কেন? সে শকড়ি হাত ধুলো কিনা, রান্না করে সব আগে নিজের জন্যে তুলে রাখলো কিনা। চাল ডাল তেল মশলা সরাবে? কি না, বড় বড় মাছের চাকাগুলো কাকে দিতে কাকে দিচ্ছে? এসব তদারকি আর কেউ করতে আসবে নীলিমা ছাড়া?

    অথচ বাড়িসুদ্ধু সবাই বলতে আসবেন এতো দেরি করে স্নানে যাও কেন তুমি? এতো দেরী করে পূজোয়?

    সুধামাধব আবার বলেন, সকালে তো একবার পূজো টুজো হয় দেখি, ক’বার করতে লাগে?

    প্রশ্নটি শুনতে নিরীহ, কিন্তু তাৎপর্যটি কি তা বুঝতে বাকী থাকে নীলিমার? কাকে বলে ধ্যান ধারণা, কাকে বলে জপতপ পূজো পাঠ, এ সব জ্ঞান আছে তোমার? নাস্তিকের অগ্রগণ্য। বোঝাতে চেষ্টা করতেও রুচি হয় না। প্রথম দিকে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ওই পাথরের মন গলাবে কে? একদিন হাতজোড় করে বলে বসলেন কিনা, দেখো ওসব যদি বুঝতেই হয়, তো হিমালয়ে চলে গিয়ে গুহায় বসে বুঝতে চেষ্টা করবো, তোমার কাছে কেন?

    অথচ মঠের উৎসবে টুৎসবে কী মধুর দৃশ্যই চোখে পড়ে। সকলেরই কিছুই স্বামী পুত্র সবাই দীক্ষিত নয়, কিন্তু উৎসবে সবাই আসে।…গুরু—ভগ্নীরা মেয়ে জামাই নাতি নাতনী ছেলে বৌ কর্তা সবাইকে ‘বাবা’র কাছে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ নিচ্ছে, আর নীলিমা এক পাশে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন যেন তাঁর কেউ কোথাও নেই।

    ভাগ্য। সবই ভাগ্য।

    গুরু গোবিন্দ গোপাল নারায়ণ জপ তপ, কেউই ভাগ্যকে বদলে দিতে পারে না।…

    অথচ কতটুকুই বা চাহিদা ছিল নীলিমার?

    সংসারে সবাই সদাচার সম্পন্ন হবে,—ঈশ্বরমুখী মন হবে সকলের, নীলিমার জীবনের যা সম্বল, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে, ব্যস। এইটুকুতো চাওয়া। তার এক চিলতেও জুটলনা নীলিমার ভাগ্যে।

    কিন্তু লোকচক্ষে?

    এমন ভাগ্যবতী না কি হয় না।

    সবাইতো তাই বলে। নীলিমার নিজের লোকেরা পর্যন্ত। নীলিমার নাকি সুখে থাকতে ভূতের কীল খাওয়া, সেধে দুঃখু গলায় নেওয়া আর জীবনের মধ্যে বিদঘুটে এক ঝঞ্ঝাট ডেকে এনে সংসারকে অশান্তি দেওয়া।

    নীলিমার নিজের বোন পর্যন্ত বলে কিনা, জামাইবাবুকে তুই যতই ‘নাস্তিক’ বলে ঘেন্না দিস মেজদি, উনি তোর থেকে অনেক জ্ঞানী।

    স্বল্পভাষী সুধামাধবের যেমন ভিতরে বাইরে কোনোখানেই ‘কথা’ নামক বস্তুটার কোনো চাষ নেই, সুধামাধবের চিরসঙ্গিনী নীলিমার তেমনি ভিতরে বাইরে শুধু ওই কথারই চাষ। জপের মন্ত্রের মধ্যে কথারা ঢুকে পড়ে হানা দেয়, ধ্যানের মধ্যে কথারা তৈরী হতে থাকে। অতএব নীলিমা তাঁর অফুরন্ত অনন্ত কথার ভার বাড়িতে যতগুলো কান আছে তাদের বর্ষণ করে চলেন। তা বাইরে না হলেও ভিতরে কথার চাষ চলে এ বাড়ির আর একটি মহিলারও।

    শ্বশুরের মত অত স্বল্প ভাষী না হলেও কথা কমই বলে, অমৃত মাধবের বৌ অসীমা। কিন্তু মনে মনে কথা কয়ে চলে যায়। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই। প্রথম কথা শুরু ওই ‘অমৃত’ মাধব নামক ঘুমন্ত লোকটাকে উদ্দেশ্য করেই।

    আহা কী সুন্দর জীবনটিই বেছে নিয়েছ।

    সকালবেলা যত ইচ্ছে বেলা অবধি ঘুমোবো, তারপর শুধু এক কাপ চা গলায় ঢেলে চাল যাব ‘অঙ্গরাগ’ করতে, ‘অঙ্গরাগই’ বলব, নইলে শুধু দাড়ি ‘কামাতে’, চান করতে, আর সাজসজ্জা করতে সারা সকালটা খরচা হয় একটা ইয়াং লোকের! তোমার থেকে অনেক স্মার্ট তোমার প্রৌঢ় বাবা! তোমরা দু ভাই বিছানায় গড়াগড়ি দাও আর তোমাদের বাবা ছোটেন বাজারে। কারণ ঠাকুর চাকরের কেনা মাছ তরকারি তোমাদের পছন্দ হয় না। হবার কথাও নয় অবিশ্যি। সে যাক।

    ঘণ্টা দেড়েক ধরে দেহ পরিচর‍্যা করে তুমি একেবারে যুটেড, বুটেড, হয়ে টেবিলে এসে বসলে ব্রেকফাষ্ট করতে। যে ব্রেকফাষ্টটির অনেকখানি অংশই প্রোটিন সম্বলিত। কারণ এটাই তোমার বাড়ির আসল খাওয়া। লাঞ্চটা জোটে অফিসের ক্যাণ্টিনে। অফিসারের পোষ্টে উঠেই তুমি বাড়ির ভাত ছাড়লে। কারণ সাত সকালে ভাত পেটে দিয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে অফিসে যাওয়া অফিসারের মানায় না। যদিও ওই পোস্টটায় বসার আগের দিন পর্যন্তও তুমি সকালে ভাতের থালা নিয়ে বসতে। তবু তো এ গ্রেড হতে পারছ না এখনো পর্যন্ত। আর পার টেবিলে বসে তুমি অম্লান মুখে অকুণ্ঠিত চিত্তে, রেলিশ করে বাবার নিয়ে আসা মাছ মাংস ডিম টিমের সিংহভাগটি ভোগে লাগিয়ে কেটে পড়তে। ব্যস। অফিসার হয়ে পর্যন্ত তুমি ‘মিনি বাস’ ছাড়া চড়ছনা, দেরী হয়ে গেলেই ট্যাক্সী। দেখে শুনে মনে হয় যেন অফিসার হয়েই জন্মেছ তুমি। অথচ তোমার বাবার কোনদিনই এরকম ভঙ্গী দেখিনি। তিনিও তো কিছু কম ছিলেন না। তোমার ভঙ্গী দেখে মনে হয় মনুষ্য জীবনের চরম লক্ষ্য সরকারি অফিসের অফিসার হওয়া, এবং তাঁর থেকেও উচ্চতর লক্ষ্য এ গ্রেড হওয়া।

    অথচ আর এক বোকামিতে তুমি তোমার এই পরমতম শ্রেয়কেও এতাবৎ কাল ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে এসেছো, এবং এখনো তাই করে আসছো।

    প্রমোশন দিলেই কলকাতা থেকে বদলি করে দেবে, এই আতঙ্কে তুমি প্রমোশন পর্যন্ত নিতে চাওনি, বারবার বহু কৌশলের পর হঠাৎ তুমি বিনা বদলিতে প্রমোশনটা বাগাতে সক্ষম হয়েছ।

    কিন্তু পরবর্তী পথটি?

    সেও হয়তো ওই একই কৌশলে বাগিয়ে ফেলবে। না পারলে, বরং প্রমোশন ছাড়বে, তবু কলকাতা ছাড়বে না। আশ্চর্য! কী মোহ কলকাতায়।…যেন কলকাতা ছাড়তে হলেই তোমার সর্বস্ব ভেসে যাবে।

    অথচ আমি?

    জন্মেছি এক পাহাড়ের কাছাকাছি দেশে, মানুষ হয়েছি তেমনি সব দেশে, বাবার বদলীর চাকরীর সুযোগে বরাবর খোলামেলা জায়গায় মানুষ হয়েছি। আমার মনের জগতে তেমনি একটা কোনো দেশের ছবি আঁকা ছিল, সেই ছবিটার গায়ে রঙিন তুলি বুলিয়ে বুলিয়ে একখানি ছিমছাম ‘ফিটফাট সংসার’ পেতেছিলাম।

    সেই ছবি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশঃ সেই সংসারটা আর কোনো দিনই পাতা হবে না। কারণ তুমি তোমার পরম স্বর্গ প্রমোশন ত্যাগ করেও কলকাতার মাটি কামড়ে পড়ে থাকবে।

    আমার সেই সোনালী স্বপ্নটা ভেঙেই গেল। আবার তোমার আর এক ফ্যাসানের শিকার হয়ে পড়ে আছি আমি। এতোগুলো বছর বিয়ে হয়েছে আমার, তবু না কি এখনো ‘মা’ হওয়ার অধিকার অর্জন করিনি আমি। আমাদের নাকি আরো অপেক্ষা করতে হবে—প্রতিষ্ঠিত হতে। ভাবছোনা যে আমার দিনগুলো কাটে কী করে!…সকাল থেকে রাত অবধি তোমাদের এই সংসারের তদারকি করা, আর সকলের সঙ্গে অ্যাডজাষ্ট করে চলবার চেষ্টা করা, আর সারাক্ষণ তোমার ওই ‘হরিচরণে লীন’ জননীর অনর্থক বকবকানি শোনা। …তোমার বাবা অবশ্য দেবতুল্য মানুষ। কিন্তু বড় দূরের মানুষ আমার বাবার সঙ্গে অনেক বিষয়েই কোথায় যেন সাদৃশ্য আছে, অথচ আবার কোথায় যেন দারুণ তফাৎ। আমার বাবা যেন বড় কাছের মানুষ, শুধু আমাদের বলেই নয়, সকলের কাছেই।…তোমার বোনটির কথা বাদ দাও, তিনি তো এখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন, কথা বলতে হয় নিক্তির ওজনে। কখন কি হয়ে যায় কে জানে। অতএব তার সঙ্গে শুধু শাড়ি গহনা, সিনেমা গল্পের বইয়ের গল্প করে চালাতে হয়।

    এদিক ওদিক করতে ভয় হয়।

    আর তোমার ভাইটি?

    সে তো পৃথিবীকে তৃণমূল্য আর আত্মীয়জনকে নস্যসম জ্ঞান করে। ব্যঙ্গের ছুরি বিঁধিয়ে ছাড়া কথাই বলতে জানে না সে।

    কিন্তু আমি বেচারা মফস্বলের মেয়ে, অত ব্যঙ্গ বিদ্রূপের ধার ধারি না। আমি তাই সাধ্যপক্ষে ওর সঙ্গে বেশী কথা কই না। আর কথা কইলেই তো তাকে ঠেলে নিয়ে যাবে পলিটিকসের দিকে।

    তোমাদের এই এতো বড় বাড়ি, এতো পুরনো পুরনো আসবাব পত্রে ঠাসা অকারণ ভারী সংসার, এতো কথা, এতো বিশৃঙ্খলা, আর তোমার এই নির্লিপ্ত নিশ্চিন্ততা আমার যেন দম বন্ধ করে আনে।

    ভাগ্যের কাছে অধিক কিছু প্রত্যাশা তো ছিল না আমার। প্রত্যাশা ছিল শুধু হালকা ছিমছাম সুন্দর একটি জীবন। সেখানে আমার পদ্ধতিতে আমি সকলকে যত্ন করবো, সেবা করবো, ভালবাসবো।

    সেটা কি খুব বেশী চাওয়া?

    ধরো আমরা যদি কোনো একটি মফস্বল শহরে সুন্দর একটি সংসার পেতে বসতাম ছোট্ট দু’ একটি বাচ্চা নিয়ে, আমাদের সংসারে ডাকতাম তোমার আপন জনেদের, তাঁরা গেলে আমরা যত্নে আদরে ডুবিয়ে দিতাম তাঁদের, কী মনোরম সেই জীবনখানি। এই জীবন দেখেছি আমার মার। কী প্রসন্ন মুখ ছিল মার, কী নির্মল উজ্জ্বল হাসি! অথচ তোমার মা?…

    থাক, গুরুজন সম্পর্কে সমালোচনা করতে চাই না, শুধু ভাবি ‘ভগবান পেতে হলে কি মানুষকে ত্যাগ করতে হয়, আর অফিসার হতে গেলে?’

    এ বাড়ির সবাই যে বেলা অবধি ঘুমোয় এটা কিন্তু সত্য নয়। হয়তো কেউই তেমন ঘুমোয় না গৃহকর্তার বড় ছেলে অমৃতমাধব বাদে।…ডাকনামে যে ‘অমি’ বলে পরিচিত।

    অমৃতমাধবের ঘুমটা সত্যিই দারুণ ব্যাপার।

    রাত্রে বৌয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অথবা আক্ষরিক অর্থে বৌয়ের কথা শুনতে শুনতে সেই যে হঠাৎ পাশ ফিরে নাক ডাকাতে শুরু করে, সে ডাক থামে সকালের ডাকাডাকিতে।

    বৌ বলে, ‘ক্লাস ওয়ান’ অফিসাররা নাক ডাকায় বলে শুনিনি।

    ‘অমি’ হাই তুলে বলে, তখনো শুনবে না। ইত্যবসরে ডাকিয়ে নিই।

    কথা বলতে বলতে যে কী করে ঘুমিয়ে ষ্টীল হয়ে যাও। আশ্চর্য!

    অমৃতমাধব আলস্য ভাঙতে ভাঙতে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, বলতে বলতে নয়, শুনতে শুনতে।

    তা’ বটে! বর্ষার রাতে ব্যাঙের ডাক শুনতে শুনতেও ঘুম আসে।

    কী মুস্কিল! তোমার সব সময় কেবল একহাত নেবার তাল। বলে স্নানের ঘরে ঢুকে যায় অমৃতমাধব নির্লিপ্ত ভঙ্গীতে।

    বৌয়ের মনের মধ্যেটা যে সর্বদাই একটা বোকাটে অভিমানে বাষ্পে ভারাক্রান্ত হয়ে থাকে তা’ অমৃতমাধবের অজানা নয়। তবে নিজে সে বোকার মত বৌয়ের কাছে সেই জানার খবরটা ব্যক্ত করে ফেলে তার ভারাক্রান্ত চিত্তের ভার লাঘবের চেষ্টা করে না। জিনিসটাকে তো সে গুরুত্ব দেয় না।

    অমৃতমাধবের ধারণায় ‘অসন্তোষ’ মেয়েমানুষের স্বধর্ম; ওর সন্তুষ্ট বিধানের চেষ্টাটি হচ্ছে খাল কেটে কুমীর আনা। অতএব ও ফাঁদে পা দিতে যায় না অমৃতমাধব নামক বুদ্ধিমান ব্যক্তিটি। যতই বিদুষী বিদ্যেবতী হোক, ‘মেয়ে’ সেই আদি অকৃত্রিম মেয়েই। যাদের প্রকৃতিই হচ্ছে সেধে দুঃখু ডেকে আনা, সব থাকলেও সর্বহারা ভাব। তাই তাদের কাজ হচ্ছে অকারণ মনভার, কারণে অকারণে কান্না যে কোনো প্রসঙ্গেই নিজের প্রসঙ্গ এনে ফেলে আক্ষেপোক্তি, ব্যঙ্গোক্তি, ভাগ্যকে আসামী বানিয়ে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। আমি শালা কোথায় কত কাঠ খড় পুড়িয়ে, কত কায়দা কৌশল খেলে ট্র্যান্সফারটা ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে আসছি। আর তুমি শ্রীমতী দুঃখে ভেঙে পড়ছো তোমার বর কলকাতা ত্যাগ করে একটা হাড়—হাভাতে মফস্বল জায়গায় বদলী হচ্ছে না কেন বলে? এখানের সুখটা তোমার নজরেই পড়ছে না।….

    এখানে শালা বাপের হোটেলে আছি, কি তোফা আছি দেখতে পাও না? চক্ষুলজ্জার দায়ে গোটাকতক টাকা ধরে দিই মাত্তর, তাতে যে এ বাজারে কত হয় তা তো আর জানতে বাকি নেই। অফিসের হতভাগ্যদের হাহাকার, শুনতে শুনতে তো কান পচে গেল। ‘বাজার দর’ আর তাই নিয়ে কার কত কষ্ট এটাই তো প্রধান প্রসঙ্গ।

    এ হোটেলে চাঁদু তোমার ঘরভাড়াটি ফ্রী, ইচ্ছেমত আহার, আঙুলটি নাড়তে হয় না, আগুন তাতটি লাগে না, বাড়াভাত খাচ্ছ, ফ্যানের তলায় পড়ে দিবানিদ্রাটি দিচ্ছ, সাজছো গুজছো, দ্যাওর ননদকে জুটিয়ে নিয়ে মার্কেটিং করছো, সিনেমা যাচ্ছো। বাড়ি থেকে বেরোতে দরজায় তালা লাগাবার চিন্তা নেই, ইনসিকিউরিটির প্রশ্ন নেই, খাও দাও কাঁসি বাজাও। এতো স্বস্তি ছেড়ে কোথায় গিয়ে তোমার সোনার সংসারটি পাততে যেতে চাও মানিক? কত মাইনে পাব আমি? যতই ক্লাশ ওয়ান হই, এই আরামটি আর পেতে হয় না!…অন্যত্র গেলে খাটতে খাটতে জান নিকলোবে তোমার। একটু বেড়াতে বেরোলেই ফেরার সময় গায়ে কাঁটা দেবে, গিয়ে কী দৃশ্য দেখবো ভেবে। আরো কত ঝামেলা তার হিসেব আছে? ‘মুক্ত প্রকৃতি’র দৃশ্য দেখে দেখে পেট ভরাবে?…

    কলকাতায় ওনার প্রাণ হাঁপায়।

    দম আটকায়!

    শুনলে মাথা জ্বালা করে।

    বলে হোল ইন্ডিয়ার তাবৎলোক এই কলকাতায় এসে ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে মরছে! দেখছো না? জায়গাটা যদি এতো বিচ্ছিরিই হবে, ভারতসুদ্ধু লোক কেন এখানেই মরতে আসে তাই বল?

    যাকগে, মরুকগে, ও নিয়ে আমি মাথা ঘামাচ্ছি না। আমাকে এখন অনেক অঙ্ক কষে কষে চলতে হবে, যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে।…প্রমোশনটাও হয়, ট্র্যান্সফারটাও রদ হয়।

    এতো অঙ্ক কষে চলে অমৃতমাধব, তবু তার ঘুমের ঘরে ঘাটতি নেই।…দেওয়াল ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি তার ঘুমের দেওয়ালে ফাটল ধরাতে পারে না।

    কিন্তু ওদের ঘুমের দেওয়ালে ফাটল ধরায়। অমৃতমাধবের ছোট ভাই মধুমাধবের আর ছোটবোন খুকুর। ভাল নাম তার একটা আছেই অবশ্য, কিন্তু ওতেই সে পরিচিত।

    ওরা ঘড়ি ঘণ্টা সবাই শুনতে পায়, সেই ভোর থেকেই। ইচ্ছে করে ওঠে না। জেগে জেগে শুয়ে থাকে।…সাবেক চালের বাড়ি, আগে লোক ধরতো না, এক একটা ঘরে গড়াগড় বালিশ পড়তো এক গাদা করে। কমবয়সী ছেলে মেয়েরা স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না প্রত্যেকের নিজস্ব এক একখানা ঘর থাকবে। কিন্তু এদের ভাগ্যে সেটা জুটে গেছে। বাড়ির সদস্য হিসেবে ঘরের স্বচ্ছলতা বেশী, তাই সকলের ভাগ্যে আস্ত এক একখানা ঘর বাদেও, মধুমাধবের ছোট একটা পড়বার ঘর আছে, অমৃতমাধবের ভাগ্যেও তেমনি খুদে বাক্স প্যাঁটরা আলমারি দেরাজ রাখবার জন্যে বাড়তি একটা।…

    অতএব আপন আপন ঘরে সবাই রাজা।

    জেগে জেগে শুয়ে পা নাচালে, সাতবার এপাশ ওপাশ করলে, অথবা জাঙিয়া পরে ডনবৈঠক করলেও কেউ চোখ ফেলতে আসছে না।

    খুকু শুয়ে শুয়েই টের পায় বাবা সিঁড়ির কোলাপসিবলটা ঠেললেন, নীচে নামলেন, যতই চটির শব্দ না করুন তবু টের পায়। মৃদু হলেও সদর দরজা খোলার আওয়াজ পায়, তারপর আওয়াজ পায় কুসুমবালার। কুসুমবালা সুধামাধব নয়, যে ভোরের শান্তি ব্যাহত হবার ভয়ে পা টিপে টিপে হাঁটবে, অথবা বাসনপত্রের ‘ঝনন রনন’ শব্দ তুলবে না।

    খুকুর যে কোনোদিনই উঠে পড়তে ইচ্ছে হয় না তা’ নয়, বিশেষ করে বেশী গরমের দিনের ভোরে। তবু ওঠে না। শুয়ে শুয়ে পা নাচাতে নাচাতে ভাবে এখন উঠে কী করব?…ওঠবার কি উদ্দেশ্য আছে আমার? যতদিন কলেজ ছিল, ততদিন তবু দিনরাত্রির একটা মানে ছিল, এখন তো স্রেফ জাবরকাটা।

    এই জাবরকাটা জীবন থেকে কবে যে উদ্ধার পাবো!…সেই হতভাগাটারও কি তেমনি গোঁ, ভাল চাকরী না পেলে না কি বিয়ের পীড়িতে বসার চিন্তা অচল। আরে বাবা ভাল মন্দ যাই হোক, করছিস তো একটা। তাতে হবে না? তবে পী�ড়িতে বসবার ভাগ্য ঘটবে কি না, জানেন ভগবান, আর শ্রীমতী নীলিমা দেবী, এবং শ্রীযুক্ত বাবু সুধামাধব গুপ্ত।…কারণ ওঁদের মতে তো ‘সে’ সিডিউল কাষ্টের দলে পড়বে।…

    বিপদ তো সেইখানেই।

    ওঁরা যদি ওঁদের সুউচ্চ কুল আর পবিত্র বংশগৌরবের ধ্বজা তুলে এ বিয়ে আটকাতে চেষ্টা করেন, তাহলে ফাইট করে একবস্ত্রে শূন্যহাতে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। কিন্তু সেটা কি একটা কথার মতো কথা হল?…আমি বলে কতকাল থেকে বিয়ের ঘটা আর বিয়ের সাজ সজ্জার স্বপ্ন দেখছি।…তাছাড়া—ওপক্ষেও তো শুনছি ‘অর্দ্ধচন্দ্রের’ ব্যবস্থা। তাহ’লে?

    সংসারটা পাতিয়ে দেবে কে শুনি?

    আর শাড়ি গহনা জাঁকজমক নেমন্তন্ন আমন্তন্ন এসব ছাড়া বিয়ের সুখ কী? অর্থ কী? গৌরব কী?…বরের কাছেইবা মুখ কোথায়? …বাপের দেওয়া পালিশ চকচকে জোলা খাটে ‘ফুলশয্যার’ শয্যা বিছোতে না পেলে জীবনটাই তো মরুভূমি। বৌদিটা অবশ্য আশ্বাস দেয়; বলে যত ভাবছ, তত নয়। আজকাল তো সব বাড়িতেই এরকম হচ্ছে। সেটা আর ওঁরা বুঝবেন না? বাবা মোটেই সেরকম গোঁড়া নন।

    আমার কিন্তু ভয় ভাঙে না। বাবার বিষয় যদিবা নিশ্চিন্ত হবার চেষ্টাটুকুও করা যায়, কিন্তু মা জননীর বিষয়ে? নৈব, নৈব।…তিনি তাঁর গুরু ভ্রাতা ভগ্নীদিগের কাছে মুখ দেখাবেন কি করে? যদি তাঁর বাড়িতে এমন একটা ভয়াবহ নারকীয় ঘটনা ঘটে? অসম্ভব।

    বরং তিনি তাঁর কন্যাকে চাবি বন্ধ করে আটকে রাখবেন, অথবা গুম খুম করে ফেলবেন। তত্রাচ বলতে পারবেন না, ‘বেরো লক্ষ্মীছাড়ি মুখপুড়ি আমার বাড়ি থেকে, যা প্রাণ চায় তোর করগে যা।’

    উঃ! কবে যে সমাজ থেকে এই সব মাথা মুণ্ডহীন কুসংস্কারগুলো দূর হবে।….কুল শীল গাঁই গোত্র, ঠিকুজি কুষ্ঠি, আর সর্বোপরি—অহমিকাস্ফীত অভিভাবকদের আকাশছোঁওয়া বংশমর‍্যাদা। এতগুলো বেড়া ডিঙিয়ে, এতগুলো খানাখন্দ পার করে, তবে একখানা বিয়ে? ধ্যেৎতারি নিকুচি করেছে।

    এক এক সময় ভাবি হতভাগাকে বলে দিই, তুমি তোমার ভাল চাকরীর মগডালের দিকে তাকিয়ে থাকো, তোমার হাতের খাবারের পুঁটুলিটা ততক্ষণে চিলে ছোঁ মেরে নিয়ে যাক।

    আশ্চর্য বাবা? আমাদের ক্লাশের কতগুলো মেয়ের কি পটাপটই বিয়ে হয়ে গেল! প্রেমে পড়া বিয়ে, ছাঁদনা তলায় প্রথম দেখা বিয়ে, অনেক দিন ধরে লুকিয়ে লটকে থেকে, শেষ পর্যন্ত মা বাপকে ভিজিয়ে ভজিয়ে দান সামগ্রী গহনা শাড়ি আদায় করে ড্যাংডেঙিয়ে বিয়ে। কত রকমই দেখলাম। আমার ভাগ্যেই নৌকো বালির চড়ায় আটকে বসে আছে।

    ভাগ্যটাই মন্দ।

    তার সাক্ষী আমার পরিবেশের চেহারা, স্থিতপ্রজ্ঞ নিরুদ্যম পিতা, ‘ভগবৎ চরণে বিলীন’ ঘোরতর সংসারী জননী, পরম স্বার্থপর দাদা, বিশ্বনস্যাৎ কারী ছোট ভাই আর করুণাময়ী, অথচ নিতান্তই ক্ষমতা হীনা এক বৌদি, এই সম্বল।

    যেদিকে তাকাই, অন্ধকার।

    কলেজ যাওয়া আসা বন্ধ হয়ে পর্যন্ত সেটার দেখা হওয়ার স্কোপ কম। কোন উৎসাহে আর ভোরবেলা বিছানা ছেড়ে উঠে ঘুরে ফিরে বেড়াব? একঘেয়ে দৃশ্য একঘেয়ে কথা। ভাল লাগে না। কপাল আমার! মরতে প্রেমে পড়তে গেলাম একটা ‘পকেট ফর্সা’ ছোঁড়ার সঙ্গে। ওর যদি পায়ের তলায় মাটি থাকতো। আমি নিশ্চয় আমার পায়ের তলার মাটি ত্যাগ করে ওর কাছে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম।

    হবে না, কিছু হবে না আমার।

    যতক্ষণ বিছানায় পড়ে পড়ে ভবিষ্যতের সোনার স্বপ্ন দেখি, ততক্ষণই সুখ।

    সেকেলে ধাঁচের বাড়ি, চওড়া দালানের একধারে সারি সারি ঘর, তাই ঘরের বাসিন্দারা প্রকৃত পক্ষে নিতান্তই পাশাপাশি ঘেঁসাঘেসি বসে শুয়ে পরস্পর বিরোধী কথা ভাবে। শুধু ওদের মাঝখানের ওই পনেরো ইঞ্চি দেওয়ালগুলোই প্রত্যেককে এতো নিশ্চিন্ত স্বাধীনতা দান করেছে।

    খুকুর ঘরের একপাশে দাদা বৌদির জিনিসের ঘর, অপর পাশে ছোট ভাই মধুমাধবের।

    এই অদ্ভুত নামের ছেলেটাও ঘুমোয় না বেলা অবধি। তবে সেও অন্য সকলের মতই ঘরের দরজা খোলেনা, তাই এই ভুলধারণা!

    ওর ভাষায় ‘প্রপিতামহের ঘড়িতে, যখন ছটা ঘণ্টা বেজেছে। তখনই ওই বিছানায় উঠে বসে আছে স্রেফ একটা জাঙ্গিয়া পরে। ভোরে উঠে ‘যোগ ব্যায়াম’ করার অভ্যাস তার, এটা তারই প্রস্তুতি।

    মধুমাধবের ভাগ্যে ওর ঘরে মস্ত একখানা ‘দাঁড়া’ আর্শি, দাঁড় করানো আছে দেয়ালের একধারে। দুপাশে ‘গামছা—মোড়া’ গড়নের পাক দেওয়া কালো পালিশের স্ট্যাণ্ড। কাঁচটা ভরে এখানে সেখানে ছোট বড় ‘মেচেতা পড়া’র মত দাগ।…নীলিমা যাকে বলে ‘চিতিধরা’। মধুমাধবের ভাষায় এও ‘প্রপিতামহীর আয়না’।

    তা হোক প্রপিতামহীর, হোক মেচেতাধরা, তবু বিরাট একখানা মালতো বটে। মধুমাধব নামক তরুণ যুবার পুরো অবয়বখানির ছায়াতো পড়ে। সেটাই কি কম লাভ? যোগব্যায়ামের পক্ষে যেটা পরম দরকারী।

    বিছানায় বসে বসেই আর্শির মধ্যে নিজেকে অবলোকন করতে করতে মুখভঙ্গী করছিল মধুমাধব। এটা ওর একটা বিশেষ ‘হবি’, নিজেকে ভ্যাংচানো। এখনও ভেঙচে ভেঙচে বলে, এই যে শ্রীমান মধুমাধব, ইহ পৃথিবীতে একমাত্র যে প্রপার্টিটি আছে তোমার, সেইটিকে সুরক্ষিত রাখতে যত্নবান হও এবার। অনেকক্ষণ তো শুয়ে কাটালে।

    এই! শুধুমাত্র এই দেহখানিইতো তোমার সম্বল, যাকে বলা চলে পিতৃদত্ত ধন। তা প্রপার্টিটা খুব একটা মন্দ নয়।….

    খাট থেকে নেমে এসে আর্শির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মাসল ফুলিয়ে দেখতে দেখতে একটু প্রসন্ন হাসি হেসে বলে, বরং অনেকের থেকেই ভাল। এটিযে পরম পূজনীয় অগ্রজ, শ্রীঅমৃত মাধবের মত ঘাড়ে গর্দানে পেটমোটা হয়নি এ একটা লাক!…কিন্তু ব্যস ওই পর্যন্তই।…ওইটুকু সাপ্লাই দিয়েই, ‘বেশী দেওয়া হয়ে গেল’ ভেবে হাত গুটিয়ে নিলেন গার্জেনরা।…নইলে—কেউ কখনো শুনেছে একটা রেসপেকটেবল ভদ্দরলোকের বাড়িতে বড় সাধের কনিষ্ঠপুত্রের এরকম একখানা নাম রাখে?…এমন দুখানি ওয়ার্ড, যে তার কোনো একটা টুকরো বেছে নিয়েও লোক সমাজে কিছু কিঞ্চিৎ মুখ রক্ষা সম্ভব হবে।…এই যে আমাদের ক্লাশের একটা ছেলে ছিল, নাম গজেশ কুমার, ও শুধু শেষের অংশটুকুই বেছে নিয়েই কাজ চালিয়ে চলতো।

    কুমার! কুমার! এই নামে কেল্লা মারতো সে। শুধু ও কেন, কলেজের রণদাচরণ? সে ও তো ওই ‘চরণটা’ ছেড়ে খানিকটা স্মার্টনেস বজায় রেখেছিল! সবচেয়ে বড় কথা ছোট পিসেমশাইয়ের ভাই? কী একখানা নাম পেয়েছিল সে তার ছমাস বয়েসে! না—নাম হল পাতকী নিধন!…সেই দুগ্ধপোষ্য শিশুটার বুকের ওপর এই গন্ধমাধন খানি চাপিয়ে দিতে এক ফোঁটা মায়াও হয়নি তার বাপ ঠাকুর্দার!

    উঃ! ভাবা যায় না।

    তবে অ—বাক তো চির অ—বাক থাকে না?…নির‍্যাতিত ও চিরদিন পড়ে মার খায় না। কে. জি. ছেড়ে বড় স্কুলে যাবার প্রাক্কালেই ‘পাতকীনিধন’ বেঁকে বসে বলল, আমার নামটা বিচ্ছিরি। ও নাম বদলে দাও।

    শুনে বাড়ির লোক ‘থ’। নামকরণের নাম, রাশিলগ্নে ওটা পুরোহিত নির্দেশিত ব্যাপার, বদলাবো কী?

    তা হলে আমি ইস্কুলে ভর্তিই হব না।

    অতএব আট বছরের সেই ছেলেটা, নামের শেষাংশ ‘নিধন’ শব্দটাকে নিধন করে, আর প্রথম অংশটাকে একটু তেড়িয়ে নিয়ে স্রেফ ‘পতাকী’ হয়ে বুক ফুলিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু হে হতভাগ্য মধুমাধব! তোমার কোনো দিক থেকেই মুক্তির কোনো রাস্তা নেই। তোমার হাত পা বাঁধা।…জগৎ সংসারে ‘মধু’ শব্দটা যতই মধুময় হোক, ওই নামের ফ্রেমে নিজেকে আটকে নিয়ে বেড়ালে, তোমাকে বাড়ির ঘরঝাড়া চাকর ছাড়া আর কিছু মনে হবে না।…আর মাধব? আহা! যেন বৈষ্ণব পদাবলী থেকে হঠাৎ ঝরে পড়েছ।…দূর দূর!

    ছেলে মেয়েদের সম্পর্কে মূল্যবোধ কত কম থাকলে এরকম নাম রাখা সম্ভব? তাও ডাকা হয় ‘মেধো’ বলে।

    একমাত্র বাবা মেধো না বলে মাধব হলেন।

    অবিশ্যি তাতেও আহ্লাদের কিছু নেই।

    তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞার পরস পরিচয় ওই ‘মেধো’র সঙ্গে মাধবের খুব বেশী পার্থক্য নেই আমার কাছে।

    এই বাড়ি তোমার হে মধুমাধব। এই পরিস্থিতি।

    বাবা গৃহে থেকেও বৈরাগী, মা ঘোরতর বিষয়ী হয়েও সন্ন্যাসিনী। তোমার দাদার মোক্ষের জগৎ তোমার কাছে হাস্যকর। তোমার সদা অভিমানিনী বৌদি মাঝে মধ্যে কিছু টাকাকড়ি দিয়ে তোমার উপকার করে বটে, কিন্তু ‘কিপটে সোয়ামীর’ পকেট থেকে কতটুকুইবা খসাতে পারে?

    খালি পকেট নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে জীবনে ঘেন্না ধরে গেছে। হায় মেধো, তোমার দিদিটি তো একটা ভ্যাগাবণ্ডের সঙ্গে লটকে পড়ে হাত, কামড়াচ্ছে তার কাছেও নো হোপ! …কিন্তু এই কি একটা ভদ্র কালচার্ড পরিবার?…যাদের মধ্যে একজনও পলিটিকস কাকে বলে জানে না, দেশের অবস্থা নিয়ে মাথা ঘামায় না, কালচারাল কোনো ব্যাপারের সঙ্গে যোগ রাখে না।…

    এবাড়িতে নিত্য নির্ভুল নিয়মে ঘড়ি বাজবে, নির্ভুল নিয়মে বাজার হবে, রান্না হবে, খাওয়া হবে, চায়ের কোয়ালিটি অথবা সিনেমা সংক্রান্ত একটু আলোচনা হবে, বাড়িতে কোনো বিশৃঙ্খলা ঘটলে পরস্পর পরস্পরকে দোষারোপ করা হবে এবং আবার পরদিন রান্নাখাওয়ার ব্যবস্থায় তৎপর হবে।

    আবার বলি, হায় মধুমাধব! এই তোমার জন্মাগার! এই তোমার পরিবেশ।…ছ্যাঃ।

    ব্যায়াম সেরে মধুমাধব যখন চায়ের টেবিলে এসে বসে, তখন দেখতে পায় বৌদি তার পূজনীয় শ্বশুর ঠাকুরের জন্যে চা ছাঁকছে। আহা দুর্গাঠাকুরের মুখের ঘামতেলের মত, মুখে কেমন একখানা ভক্তির প্রলেপ! ধন্য মহিলা তুমিই ধন্য। পুরু করে মাখন মাখাও শ্বশুরের টোষ্টে।

    মধু প্রতীক্ষা করে সুধামাধব তাকে কিছু বলবেন, সমালোচনা সূচক, অথবা উপদেশসূচক, কিন্তু বললেন না। কিছুদিন থেকেই যেন লক্ষ্য করছে মধুমাধব, বাবা এ ব্যাপারে নীরবতা অবলম্বন করেছেন। তার মানে এখন মধুমাধবকে দুটো পালটা জবাব শুনিয়ে দেবার স্কোপটুকুও দিতে নারাজ।

    কাজেই মধুকে বাবার সামনে বসে বসে নীরবে চা খেতে হয় নিমপাতা চিবোনো মুখ নিয়ে।….শুধু বৌদির দু’একটি সমীহপূর্ণ উক্তি আর দিদির বেজার বেজার কথা কানে এসে পড়ে মনের সঙ্গে কিছুটা কৌতুক রসের সৃজন করে। বৌদি বলে, বাড়িখানকে কিন্তু এবার একবার ভাল করে মেরামত করা দরকার বাবা, অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে।

    আহা শ্বশুরের এই পচা পুরানো ভিটে খানার মুমূর্ষু অবস্থায় মহিলা যেন কতইনা বিচলিত! মনে মনে তো শিকলিকাটা পাখি হয়ে আকাশে উড়ছো।…স্রেফ বাকতাল্লা! শ্বশুরের মনোরঞ্জনের প্রয়াস।…তা শ্বশুর ঠাকুরটি তো আর তোমার মত বোকা নয় যে, এই ছলনাটুকু ধরতে পারবেন না?…তবে হ্যাঁ, ডায়লগের পিঠে একখানা ডায়ালগ তিনি বসান। বলেন, এ বাড়ি মেরামত করা আমার দ্বারা আর হবে না বৌমা!…বাপ পিতামহের কাটা ফসল খেয়ে শেষ করে বিদায় নেব। দিদি অমনি সঙ্গে সঙ্গে বেজার মুখে মামাবাবু হরদম যেকথা বলে বলে যায়, সেই কথাটাই বলে বসে, ‘তোমার দ্বারা হবে না’ এটা তোমার স্বেচ্ছাকৃত নিরুপায়তা বাবা। এই কটা মানুষে এতোবড় বাড়িখানা দখল করে বসে না থেকে খানিকটায় ভাড়াটে বসালে, অনায়াসেই সেই টাকায় বাড়ি সারানো যেতো। আত্মস্থ পিতা অবশ্য এনিয়ে বাদ প্রতিবাদ করতে আসেন না, মৃদু হেসে বলেন, বড় ভুল হয়ে গেছে বটে। এই এক এক বগগা ঝানু আদর্শবাদী পণ্ডিতমূর্খ ব্যক্তি। সেণ্টিমেণ্টের খাতিরে আখের দেখল না। দিদির কথাগুলো চ্যাটাং চ্যাটাং হলেও উড়িয়ে দেবার নয়।

    ‘ভিটেয় ভাড়াটে বসাবো না।’

    অদ্ভুত একখানা গোঁ বটে।

    যাকগে চুলোয় যাক।

    এ বাড়ি কর্পোরেশনে ভেঙে দিয়ে গেলেও আমার কিছু এসে যাবে না। আমি তালে আছি তোমাদের এই সোনার ভারত ছেড়ে কেটে পড়তে পারা যায় কি করে। এই হতভাগা দেশে আবার মানুষে থাকে?

    সুধামাধবের সংসারের দিনের প্রারম্ভের চেহারাটা মোটামুটি এই।…এরপর যে যার তালে সারাদিন ঘুরবে। ঘুরবে রাত পর্যন্ত। ফিরবে খুশীমত। খাবে যার যখন সুবিধে। পরিবারের সবাই দিনান্তে অন্ততঃ একবারও একত্রে বসে খাবে, এ বিধি এখন আর পালিত হয় না। খাবার জন্যে কোনো নিয়মবাঁধা সময় নেই।

    নিয়মী সুধামাধবই শুধু যথানিয়মে রাত্তির সাড়ে নটার ঘণ্টা পড়লেই টেবিলে এসে বসে বলেন, ঠাকুর আমায় দিয়ে দাও।

    প্রকাণ্ড একখানা শূন্য টেবিলের একধারে কোণ ঘেঁসে বসেন, যাতে থালাটা অন্যের না অসুবিধে ঘটায়।

    ব্রজমাধবের সংসারে টেবিল ছিল না, পীড়িই সার।…সুধামাধবই এই প্রকাণ্ড টেবিলখানা বানিয়েছিলেন সবাই মিলে একসঙ্গে গল্প করতে করতে খাওয়া দাওয়া হবে বলে। তখন তো তাঁর ছোট দুইভাইও ছিল, ললিতমাধব আর অমিয়মাধব। তাদের একজন স্ত্রী—পুত্র নিয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে বসবাস করছে। আর একজন সোজাসুজি পৃথিবী ছেড়েই চলে গেছে।

    তবু এরা তখন ছোট ছিল, ‘বাবার সঙ্গে যাব’ বলে বসে থাকতো।… আর নীলিমা? নীলিমাও অবশ্যই। তাঁর তো তখন গুরুমন্ত্র হয়নি।

    খেতে বসে যা কথা ঠাকুরের সঙ্গে।

    লালটুর এ সময় নীচে বসে থাকার ডিউটি। কে কখন ফিরবে, দরজাখোলা পেতে দেরী হলে রেগে যাবে। কে কোথায় গেছে জিগ্যেস করেননা সুধামাধব, তবু ঠাকুর স্বতঃ—প্রবৃত্ত হয়ে যা জানায়, তা সুধামাধবের অজানা নয়। বড়দাদাবাবু যে অফিস ফেরৎ ক্লাবে যায়, ছোড়দাদাবাবু কোথায় না কোথায়, মা গুরুআশ্রমে কীর্তনগান শুনতে, এবং বৌদিদি আর দিদিমনি পাশের বাড়িতে টি.ভি. দেখতে ও তথ্য সুধামাধবকে পরিবেশন না করলেও চলতো।…তবু লোকটা আহার্য পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে কৌশলে ওই তথ্যগুলোও পরিবেশন করে ফেলে।

    হয়তো অন্য কোনো কারণে নয় স্রেফ মমতার বসেই। ভালমানুষটা একা বসে খাচ্ছে, দেখে দুঃখ হয় ওর। যেন কেউ নেই ওনার।

    তাই এটা ওটা কথা বলে পরিস্থিতিটা সহনীয় করে তুলতে চায়। ঠিকে ঠাকুর বটে, তবে অনেক দিনের পুরনো।

    খাওয়ার পর সুধামাধব বেশ কিছুক্ষণ বইটই পড়েন।

    সেটা শোবার ঘর সংলগ্ন ছোট্ট একটু ঘেরা বারান্দায়। কাচের জানালা বসানো এই ঘরবারান্দাটিতে সুধামাধবের একটা ছোট টেবিল আছে, আছে চেয়ার আর একটা টেবিল ল্যাম্প। এখানেই তাঁর পঠন পাঠন।

    বারান্দাটা এমন জায়গায় যে এখানে বসে বসেই তিনি টের পাচ্ছেন, একে একে সবাই আসছে। সকলের আগে ‘অমি’। শুনতে পেলেন এসেই প্রশ্ন করছে বৌদিরা ফেরেনি এখনো?

    বলাবাহুল্য, এই প্রশ্নবাণ নিক্ষেপ শ্রীমান লালটুর প্রতি। তবে তার ক্ষীণ কণ্ঠের উত্তর শোনা যায় না। কিন্তু উত্তর তো নেতি বাচকই হবে।

    সুধামাধব শুনতে পান ক্রুদ্ধ অমৃতমাধবের মন্তব্য, রাবিশ জিনিস এসেছে দেশে। টিভি।

    সুধামাধবের মনের মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে।

    এরপর ভারী ভারী জুতোর শব্দ পান। দোতলায় উঠে এসেছে ‘অমি’। ঘাড় ছোট লোকেদের কি জুতোর শব্দ একটু ভারী হয়?

    নিজের ঘরে ঢুকে গেল। বলে গেল, ঠাকুর এক কাপ গরম জল দাও।

    কী করবে গরম জল? ওষুধ খাবে বোধ হয়। ওই এক বাতিক আছে ওর, ওষুধ খাওয়া। কখনো ডাক্তারী, কখনো হোমিওপ্যাথি, কখনো বা কবিরাজীও। কোনো একটা চিকিৎসার অধীনে ব্যতীত যে থাকতে পারেনা।

    এরপর বাড়ি ঢোকেন বাড়ির গৃহিণী।

    বোধকরি একদল গুরু ভগ্নীর সঙ্গে, কলোচ্ছ্বাসে উচ্ছ্বাস শোনা গেল দরজায়।…

    ‘তোমার এই কাজ হয়েছে ভাই, গাড়ির মধ্যে একটি বাহিনীকে ভরে নিয়ে বাড়ি বাড়ি নামাতে নামাতে ফেরা। গাড়ি থাকার ঝকমারি।’

    হয়েছে, হয়েছে, তোমাকে আর সৌজন্য করতে হবেনা বাবা! কেমন গল্প করতে করতে আসা হল। আহা, কী কের্তনই গাইলেন! কান প্রাণ দুই জুড়িয়ে গেল। একেই বলে সাধনা। ভক্ত কণ্ঠ ভিন্ন এ সুর খেলেনা।

    ধমাস করে গাড়ির শব্দ হল।

    গাড়িবতী চলে গেলেন।

    নীলিমা উঠে এলেন হাঁসফাঁস করতে করতে। আর এসেই উঁকি দিলেন সুধামাধবের পড়ার জায়গায়।

    বসা হয়েছে তো বই মুখে দিয়ে? ওঃ। জগতের আর কিছুই জানলেনা।…একদিন যদি যেতে ওখানে, বুঝতে জীবনটা কী বৃথা অপচয় করেছো।

    সুধামাধব মৃদু হেসে বললেন, সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য।

    হুঁ। জানোতো খালি সকল কথা উড়িয়ে দিতে।

    নীলিমা হাতের ঝকমকে তোলা চুড়ির গোছাটা খুলতে খুলতে বলেন, রাখো ততক্ষণ এগুলো, হাত মুখ ধুয়ে আসি। টেবিলে রাখলেন।

    সুধামাধব এক পলক তাকিয়ে বললেন, এই সব পরে রাত্তিরে রাস্তায় বেরোনো ভাল? আজকালতো শুনি—

    নীলিমা ঝঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন, তবে কি পাঁচজনের আমলে দীন দুঃখীর মতন শুধু এই ক্ষয়া চুড়ি কটা হাতে দিয়ে যেতে হবে? একে তো—নিত্যদিন হ্যাংলার মত পরের গাড়ি চড়ে যাচ্ছি আসছি।…কতজনের যে গাড়ি আছে—

    সুধামাধব একটু হাসলেন, কতজনের আবার নেইও। একজনের নৌকোয় দশজন পার হয়।

    হুঁঃ। এই কথাই বলবে জানি।

    চলে গেলেন পরণের চওড়া জরিপাড় শাড়ি খানি কাঁধ থেকে নামিয়ে পাট করতে করতে। বোঝা যাচ্ছে আজ বিশেষ উৎসবের দিন ছিল।

    এতক্ষণে বোধহয় বাড়ির তরুণী মেয়ে দুটি ফিরল। পাতলা গলার টুকরো টুকরো কথা শোনা গেল।

    ওমা! দাদা! তুমি খেতে বসে গেছ?

    তা’ কী করতে হবে?…অমৃতমাধবের অমৃত কণ্ঠ নিনাদ, তোমরা কখন আড্ডা দিয়ে ফিরবে সেই আশায় পেট জ্বলিয়ে বসে থাকবো?

    আহা! নিজে যখন তাস খেলে দেরী করে ফেরো। দেখছিস বৌদি, দাদার ব্যাভার?

    বৌদির দেখা টেখা হয়ে গেছে। তুমি দেখো।

    তাই দেখছি, ঠাকুর আমাদেরও দিয়ে দাও। বৌদিকে আমাকে।…ছোট বাবু ফেরেননি তো? জানি।…ঠিক আছে। কী আর করবে? ওর খাবার ঢাকা দিয়ে রেখে তুমি খেয়ে নিয়ে চলে যাও। লালটুকেও দিয়ে দিও।

    ঘরের ভিতর থেকে নীলিমার গলা ভেসে এলো, এই খুকু। তোর যে খুব সর্দারি দেখছি। এক্ষুনি আর ওদের খেয়ে না নিলে চলবে না? আর একটু দেখুক না!

    দেখে কী হবে মা? বাবুতো এসে একঘণ্টা চান করবেন। ওরা কতক্ষণ হাঁ করে বসে থাকবে?

    নীলিমার বেজার গলা শোনা যায়। মেধোর কপালে রোজ এই। বাড়িসুদ্ধ সকলের এঁটো পাতের ধারে—

    তা’ যেমন কর্ম তেমনি ফল।

    খুকু ঘরঘরিয়ে ঘরে ঢুকে যায়, বোধ হয় বাইরের সাজ ছাড়তে।

    নীলিমা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন।

    রাগী গলায় বলেন, লালটু সুদ্ধু খেতে বসলে, মেধোকে দোর খুলে দেবে কে?

    এখন সুধামাধবও উঠে আসেন।

    বলেন, আমি দেব।

    ওরা খেতে খেতেই কড়ানাড়ার শব্দ ওঠে।

    খুট করে একটু। এই স্টাইল মধুমাধবের, দাদার মত ভীম বেগে নাড়ে না। সুধামাধবকে দরজা খুলতে দেখে ঈষৎ অপ্রতিভ গলায় বলে, তুমি এলে? আর কেউ নেই?

    সুধামাধব পাশ কাটিয়ে উত্তর দিলেন, আরে, আমাকে তো নামতেই হতো তালা লাগাতে।

    চাবিটা লালটুর কাছে রেখে দিলেও তো হয়।

    পাগল!

    অযৌত্তিক কথা উড়িয়ে দেবার এই পদ্ধতি সুধামাধবের।

    সকলের খাওয়া হয়ে যায়, সব ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। নীলিমা দরজা বন্ধ করেননি বটে, চোখ বন্ধ করে ফেলেছেন। গুরু আশ্রমে আজ উৎসবের ভোগে প্রসাদ, রীতিমত গুরুভোজন হয়ে গেছে।

    সুধামাধব সিঁড়ির কোলাপসিবলটা টেনে বন্ধ করে তালা লাগান, তালাটা টেনে দেখেন। তারপর ওদের পরিত্যক্ত একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে, তার উপর দাঁড়িয়ে ঘড়িটায় দম দেন, আস্তে আস্তে চাবি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে।

    আজ বুধবার।

    দম দেবার দিন।

    নতুন দম খাওয়া যন্ত্র আবার যখন ‘ঢং’ করে একটা ঘণ্টা মারে ‘বারোটা বেজে যাওয়া’ রাত্তিরের পর নতুন তারিখের ঘোষণা জানিয়ে, সেটা সত্যিই আর কারো কানে পৌঁছয় না।

    ততক্ষণে বিক্ষুব্ধ অভিযোগ—ক্লান্ত কয়েকটা ভিন্ন ভিন্ন গ্রহের জীব গভীর অন্ধকারের তলায় তলিয়ে গেছে একই ছাদের তলায় শুয়ে।

    ⤶
    1 2 3
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article১০টি কিশোর উপন্যাস – আশাপূর্ণা দেবী
    Next Article সূর্যোদয় – আশাপূর্ণা দেবী

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }