Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চক্রসম্বরের পুঁথি – অভীক সরকার

    লেখক এক পাতা গল্প111 Mins Read0
    ⤶

    ২. সকালে ঘুমটা ভাঙল

    সকালে ঘুমটা ভাঙল তাপসের ঘন-ঘন ঝাঁকানিতে। চোখ খুলতেই ও রুদ্ধশ্বাসে বলল, “জলদি ওঠ সুবোধ, সর্বনাশ হয়ে গেছে। জ্যেঠুর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না, লোবসামও উধাও। তাড়াতাড়ি ওঠ, থানায় যেতে হবে।”

    ব্যাপারটা বুঝতেই আমার খানিকক্ষণ লাগল। তারপর ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলাম, “মানে? জ্যেঠুর কোনও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না মানে?”

    দ্রুতবেগে জামা প্যান্ট পরতে-পরতে তাপস বলল, “সকালে উঠে মর্নিং ওয়াকে যাওয়ার সময় দেখি জ্যেঠুর স্নিকার্সদুটো বাইরে রাখা। তখনই বুঝেছি যে কিছু একটা গন্ডগোল হয়েছে। খুব শরীর খারাপ না হলে জ্যেঠু কখ্খনো মর্নিং ওয়াকটা মিস করেন না। জ্যেঠুকে ডাকতে গিয়ে দেখি দরজা হাট করে খোলা, জ্যেঠু নেই। আর সারা ঘর লন্ডভন্ড হয়ে আছে। লোবসামের নাম ধরে ডেকে-ডেকেও যখন সাড়া পেলাম না, তখন ওর ঘরে গিয়ে দেখি ওর ঘরও ফাঁকা। আলনায় ঝুলতে থাকা কয়েকটা পুরোনো জামা ছাড়া আর কিছুই নেই।”

    তখনও আমার হতভম্ব ভাবটা কাটেনি। কিন্তু এটুকু বুঝলাম যে অ্যাকশনের সময় এসে গেছে। বাথরুমে ঢুকে পড়া থেকে শুরু করে তৈরি হওয়া অবধি সব মিলিয়ে আমার সময় লাগল দশ মিনিটের মতো। যাওয়ার আগে একবার জ্যেঠুর বেডরুমে উঁকি দিয়ে এলাম। মনে হল ঘরের মধ্যে যেন ঝড় বয়ে গেছে। বাকিটা আর দেখতে সাহস হল না।

    বাড়ির দরজা, গ্যারাজ আর গাড়ির চাবি থাকত ডাইনিং রুমের পাশে রাখা একটা কাঠের ক্যাবিনেটের মধ্যে। সেটা টেনে দেখলাম বাড়ির চাবি-সহ সবই আছে, নেই শুধু গাড়ির চাবিটা। মানে যারা এই কাণ্ড করেছে তারা কী-ভাবে আমাদের চলাফেরায় অসুবিধা সৃষ্টি করা যায় সেটাও খুঁটিয়ে ভেবেছে। আর গাড়ির চাবি কোথায় থাকে সেটা যখন ওরা জানে তখন সন্দেহের তির একজনের দিকেই ঘুরে যায়, লোবসাম।

    বাড়ির দরজা তালাবন্ধ করে নীচে নামলাম। জ্যেঠুর বাড়ির সামনে ফুলের কেয়ারি করা বাগান, আর বাগান পেরোলেই কাঠের বেড়া দেওয়া একটা গেট। গেটটা একটা সরু রাস্তার পাশে, রাস্তার ওপাশে খাদ। রাস্তাটা ধরে পুবমুখো কয়েকশো মিটার নেমে গেলে বড় রাস্তা। আমরা বাগানের কাঠের বেড়ার দরজাটা খুলে রাস্তায় পড়েই বাঁ-দিক ধরে সোজা দৌড় দিলাম। যদিও সেটা খুব একটা সহজ হল না। একে খাদের ধার থেকে উঠে আসা আশ্বিনের কুয়াশায় তখন রাস্তার কিছু দেখা যাচ্ছিল না। তারপর রাতভর শিশির পড়েছে বলে রাস্তাটাও পেছল হয়ে ছিল। তারই মধ্যে কোনওমতে আধা হেঁটে, আধা দৌড়ে আমরা বড় রাস্তায় পৌঁছোলাম। মোটা জ্যাকেট আর জিন্স্ পরে থাকা সত্ত্বেও সে-সব ভেদ করে বরফের ছুরির মতো ঠান্ডা আমাদের হাড়-মজ্জা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।

    সদ্য জেগে ওঠা লেবং টাউন তখন বড় রাস্তা ধরে যাতায়াত শুরু করেছে। কুয়াশার মধ্যেই দেখা যাচ্ছিল কাজে বেরিয়ে পড়া মানুষজনের দল। পুবদিকের আকাশে সোনালি রঙ ধরেছে সবে। আশপাশের দৃশ্য ক্রমেই পরিষ্কার হয়ে আসছিল, যেন কোনও দৈত্য তার মস্ত হাত দিয়ে রাস্তার ওপর জমে থাকা কুয়াশার চাদর দ্রুত টেনে নিচ্ছিল খাদের মধ্যে। কিন্তু আমাদের তখন সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার সময় নেই। বুকের ভেতরে কে যেন একটা হাতুড়ি পিটছে, গলার কাছটা শুকনো।

    একটু এদিক-ওদিক তাকাতেই দেখলাম একটা ছোট গাড়ি আসছে এদিকে। হাত নেড়ে চেঁচিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা গেল। তারপর তাকে পটিয়ে-পাটিয়ে থানা পৌঁছতে লাগল মিনিট-চল্লিশেক।

    থানায় তখনও দিনের কাজ-কারবার শুরু হয়নি। আমাদের হাঁকাহাঁকিতে খুবই বিরক্ত মুখে যে কনস্টেবল বেরিয়ে এলেন, তাঁকে দেখামাত্র চিনতে পারলাম। ড্যাফোডিলে যাওয়ার পথে যে-দু’জন কনস্টেবল আমাদের সঙ্গী হয়েছিলেন ইনি তাঁদের মধ্যে একজন। আমাদের দেখামাত্র অবশ্য ভদ্রলোকের মুখের ভাব বদলে গেল। তাপস পুরো ব্যাপারটা বোঝাতে সময় নিল ঠিক পাঁচ মিনিট। আর তারপর ঝটপট গুরুংয়ের বাংলোর দিকে রওনা দিলাম।

    যেতে-যেতে একটা প্রশ্নই করলাম তাপসকে, “ওরা জ্যেঠুকে মেরে ফেলেনি তো?” বলতে-বলতেই বুঝতে পারছিলাম যে আমার দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছে, সেটা যতটা না ঠান্ডার জন্য, তার থেকেও বেশি ভয়ে।

    তাপস দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “খুব সম্ভবত নয়। কারণ আমার মন বলছে যে পুঁথিটা ওরা পায়নি। তবে ওরা জানতে পেরেছে যে পুঁথিটা জ্যেঠু বাড়িতে এনে রেখেছেন, আর আজই সেটা ওদের হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। তাই মরিয়া হয়ে একটা শেষ চেষ্টা করছে ওরা। আমার মনে হয় জ্যেঠুকে আটকে রেখে ওরা পুঁথিটা খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবে। জ্যেঠু ঠিকই বলেছিলেন, পুঁথিটাই ওঁর লাইফ ইনশিওরেন্স। যতক্ষণ ওরা ওটার খোঁজ না পায়, ততক্ষণ জ্যেঠুকে ওরা কিছু করবে না।”

    “কিন্তু ওরা কারা? সেই অষ্টমহাসিদ্ধ না কাদের কথা বললেন জ্যেঠু, ওরা?”

    “সেটা ঠিক করে বলা মুশকিল সুবোধ।” গম্ভীরস্বরে বলল তাপস, “কারণ এখনও অবধি এই পুরো ব্যাপারটায় একটা মস্তবড় ফাঁক থেকে গেছে। সেটা হচ্ছে যে কী করে পুঁথিটা জ্যেঠুর হাতে এল, সেটার ব্যাপারে আমরা কিছুই জানি না। শুধু তা-ই নয়, কে এই তাশি দোরজে, কেনই বা সে জ্যেঠুর সঙ্গে দেখা করল আর কেনই বা কেউ তাকে খুন করল, সে-সব কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।”

    “গুরুং কিছু হেল্প করতে পারবে না?”

    বিরক্ত হল তাপস, “গুরুং না পারলে আর কে পারবে শুনি? পুলিশ পারে না হেন কাজ নেই। ওরা তো তাশি দোরজের খুনের তদন্ত করছেই। এবার তার সঙ্গে জ্যেঠুর উধাও হওয়াটা যোগ হল। তবে দুটো একই লোকের কাজ কি না সেটাও বোঝা যাচ্ছে না। কেসটা যে এবার যথেষ্ট প্যাঁচালো হয়ে উঠেছে তাতে সন্দেহ নেই।”

    “আর লোবসাম?”

    “সে-ই তো পাণ্ডাদের চর রে সুবোধ। সন্দেহ যে আমার একটা হয়নি তা নয়।” চলতে-চলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাপস, “প্রথম দিন যখন দত্তসাহেব এসেছিলেন আর পুঁথিটা নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হচ্ছিল, একবারের জন্য আমার মনে হয়েছিল ছাদের দরজার আড়ালে কেউ যেন একজন দাঁড়িয়ে আমাদের কথা শুনছে। লোবসাম ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু ছেলেটাকে অমন নিরীহ দেখতে বলে সে-নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি, ভেবেছি আমার মনের ভুল। ইশ্, ছেলেটাকে যদি একটু নজরে-নজরে রাখতাম।”

    গুরুংয়ের বাড়ির সামনে আসতে আমাদের বেশিক্ষণ লাগল না। গুরুং তখন বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিল, পরনে ইউনিফর্ম নয়, ঘরোয়া পোষাক। আমাদের দেখে খানিকটা অবাক হল সে। তারপর দ্রুত নেমে এল বারান্দা থেকে, “আরে! কী ব্যাপার? আপনারা? কী হয়েছে?”

    ঠিক চারটে বাক্যে জ্যেঠুর আর লোবসামের উধাও হওয়ার খবরটা দিল তাপস। শোনামাত্র গুরুং দৌড়ে চলে গেল বাড়ির ভেতরে। মিনিট দশেকের মধ্যে যখন ও বাইরে এল তখন ওর পরনে পুরোদস্তুর পুলিশি পোষাক। ওর জিপটা বাড়ির পাশেই রাখা ছিল। চারজনে জিপে উঠতেই জিপ ছুটল জ্যেঠুর বাংলোর দিকে। 

    .

    যেতে-যেতে শুধু একটাই প্রশ্ন করল গুরুং, “আর ইউ শিওর দ্যাট হি হ্যাজ বিন অ্যাবডাক্টেড? হঠাৎ করে কোথাও চলে জাননি তো?”

    “অসম্ভব, প্রশ্নই ওঠে না। জুতো, ঘড়ি, মানিব্যাগ, রিডিং গ্লাস -সব পড়ে আছে। যত আর্জেন্ট কাজই হোক, কাউকে কিছু না বলে, স্রেফ রাতপোষাক পরে একটা লোক বেরিয়ে যাবে?”

    তাপসের যুক্তিটা অকাট্য। গুরুং বোধহয় সেই জন্যই আর কোনও প্রশ্ন করল না।

    জ্যেঠুর বাংলোর সামনে যখন আমরা নামছি, তখন বাজে সকাল ন’টা পঁয়তাল্লিশ। নামতেই দেখি গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন দত্তসাহেব আর প্রফেসর যাদব। আমাদের তিনজনকে হন্তদন্ত হয়ে উঠে আসতে দেখে তাঁরা বুঝে গেলেন কিছু একটা হয়েছে। প্রশ্নটা দত্তসাহেবই করলেন, “কী ব্যাপার সুবোধ? তোমরা গেছিলে কোথায়? ঘরে কেউ নেই? নারান কোথায়? লোবসামকেই বা ডেকে ডেকে পাচ্ছি না কেন?”

    “জ্যেঠুকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, দত্তবাবু।” শান্তস্বরে কথাটা বলল তাপস, “সঙ্গে লোবসামও উধাও।”

    দত্তসাহেবের মুখটা হাঁ হয়ে গেল, একই অবস্থা প্রফেসর যাদবেরও। স্খলিতস্বরে প্রফেসর যাদব বললেন, “অ্যাঁ? সে কী? নারায়ণবাবুকে ধরে নিয়ে গেছে? কারা? কেন? কী করে?”

    ততক্ষণে আমরা তিনজনে ঢুকে পড়েছি বাড়ির মধ্যে, পেছনে-পেছনে কনস্টেবল আর প্রফেসর যাদবকে নিয়ে দত্তসাহেব। হাঁটতে-হাঁটতেই জবাব দিল তাপস, “কেন নিয়ে গেছে সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। কারা আর কী করে নিয়ে গেছে সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।”

    “এমন হতে পারে না যে নারান হঠাৎ করে কোনও আর্জেন্ট কাজে কাউকে না বলে বেরিয়ে গেছে?” উদ্বিগ্নস্বরে প্রশ্ন করলেন দত্তসাহেব।

    গুরুংকে দেওয়া উত্তরটাই আবার রিপিট করল তাপস। দত্তবাবু চুপ করে গেলেন। ততক্ষণে আমরা জ্যেঠুর বেডরুমের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি।

    ঘরটা দেখেলেই বোঝা যায় যে সারা ঘর লন্ডভন্ড করে কিছু খুঁজেছে কেউ। বিছানার চাদর হাঁটকানো, ওয়ার্ড্রোব খোলা, অর্ধেক জামাকাপড় নীচে পড়ে লুটোচ্ছে। বেডসাইড টেবলে একটা নাইট ল্যাম্প ছিল, সেটাও মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ঘরের কোনার দিকে একটা গোদরেজের আলমারি দাঁড়িয়ে আছে, তার পাল্লাদুটো হাট করে খোলা, লকারটাও। আলমারির মধ্যেকার প্রতিটা জিনিস মাটিতে ফেলে রাখা। একটা হাল্কা মিষ্টি গন্ধও নাকে এল। তাপস চাপাস্বরে বলল, “ক্লোরোফর্ম।”

    গুরুং আমাদের বাইরে দাঁড়াতে বলে টিপ-টো করে ঘরের মধ্যে গেল একবার। চারিদিক ঘুরে দেখল। তারপর বাইরে এসে বলল, “ঘরটা সিল করতে হবে। আপনারা কেউ ঘরে ঢুকবেন না, বা দরজার পাল্লায় বা কোথাও হাত দেবেন না, যতক্ষণ না ফিঙ্গার প্রিন্ট এক্সপার্ট আসছেন। বাকি ঘরগুলোও একবার দেখব।”

    বাকি ঘর বলতে আমাদের শোওয়ার ঘর আর আরেকটা গেস্টরুম। সেখানে কিছুই পাওয়া গেল না। ফলে সবাই হাঁটা দিলাম দোতলায়।

    দোতলা থেকে যে কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জের একটা দুর্দান্ত ভালো ভিউ পাওয়া যায় সে তো আগেই বলেছি। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম খাদের গা বেয়ে যাওয়া-আসা করছে বিভিন্ন প্যাসেঞ্জার গাড়ি। এখান থেকে প্রায় খেলনার মতো দেখাচ্ছে। অন্যদিন হলে এইখানেই বসে আড্ডা মেরে পুরো দিনটা কাটিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু আজকে সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করার কথা নয়।

    সবাই এসে দাঁড়ালাম জ্যেঠুর লাইব্রেরির সামনে। এর দরজা খোলাই থাকে। প্রথম দিন যখন আসি, জ্যেঠুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এতে তালা দেওয়া হয় না কেন। তাতে উনি বলেছিলেন, যদি কোনও চোর এখান থেকে বই চুরি করতে আসে, তবে লেবংয়ে বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ আছে এমন লোক আছে জেনে উনি খুবই আনন্দ পাবেন।

    দরজাটা ঠেলা দিতেই ক্যাঁচ করে খুলে গেল। ভেতরে সার-সার বইয়ের ৱ্যাক। পুবদিকের দেওয়ালজোড়া মস্ত-মস্ত কাচের জানালা, তাতে সারা ঘর আলোময় হয়ে আছে। মাঝের জানালার সামনেই একটা গদিআঁটা আরামকেদারা, তার সামনে একটা নিচু পা-দানি। বুঝতে অসুবিধে হয় না, ওইটি জ্যেঠুর পড়ার জায়গা।

    আশ্চর্য লাগল এই দেখে যে পুরো লাইব্রেরিটা প্রথম দিন যেমন দেখেছিলাম ঠিক তেমনই আছে। মানে জ্যেঠুর শোওয়ার ঘর যেমন লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেছে, এখানে সেই তাণ্ডবের চিহ্নমাত্র নেই।

    আমার মনের প্রশ্নটা দত্তসাহেবই করে ফেললেন, “এ কী, ওরা তো মনে হচ্ছে এখানে ঢোকেইনি। এটা কী-রকম হল?”

    “খুবই স্বাভাবিক।” বলল গুরুং, “যারা এসেছিল তারা জানত যে অমন একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস মাস্টারসা’ব সবার চোখের সামনে ফেলে রাখবেন না, নিজের কাছেই রাখবেন। তাই ওরা ওঁর শোওয়ার ঘরটাই টার্গেট করেছিল। চলুন তাপসবাবু, লোবসামের ঘরটা দেখান একবার।”

    আমরা দোতলা থেকে নেমে এসে মেজানাইন ফ্লোরে এসে দাঁড়ালাম।

    জ্যেঠুর বাংলোর একতলায় তিনটে শোওয়ার ঘর, কিচেন, ডাইনিং স্পেস আর ড্রয়িংরুম। শোওয়ার ঘর তিনটে একটা বড় টানা বারান্দার একপাশে। বারান্দাটা শুরু হওয়ার মুখেই দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়িটা একতলা থেকে দোতলায় ওঠার বাঁকের মুখে মেজানাইন ফ্লোরে একটা ছোট ঘর। লোবসাম থাকতো এখানেই।

    ঘরটা একটু নিচু, সিলিং সাত ফিটের বেশি হবে না। নিরাভরণ ঘর। দেওয়ালের একপাশে একটা সিঙ্গল খাট। খাটের পাশে একটা ছোট কাঠের আলমারি আর একটা আলনা। খাটের নীচে একটা ট্রাঙ্ক রাখা। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে একটা জানলা, সেখান দিয়ে যথেষ্ট আলো আসছিল।

    আমি, তাপস আর গুরুং মাথা নিচু করে ঘরে ঢুকলাম। যদিও দেখার বিশেষ কিছু ছিল না। জুতো জামা তোয়ালে কিচ্ছুটি নেই। শুধু আলনায় দুটো পুরোনো জামা আর প্যান্ট ঝুলছে।

    “হুঁ, পাখি নিজের সব জিনিসপত্র নিয়েই উড়েছেন দেখছি। তার মানে প্রিপারেশন গোপনে-গোপনে অনেকদিন ধরেই নিচ্ছিলেন ইনি।” গম্ভীরমুখে বলল গুরুং। তারপর প্রশ্ন করল, “আচ্ছা, এই লোবসামের বাড়ি-ঘরদোর কোথায় জানেন আপনারা?”

    প্রশ্নটা শোনামাত্র দত্তসাহেবের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেল। আমারও মনে পড়ে গেল যে জ্যেঠু বলেছিলেন এই দত্তসাহেবের ড্রাইভার কাম কাজের লোক বীরেন্দ্র থাপা হচ্ছে এই লোবসামের কাকা। লোবসাম এই বাড়িতে বহাল হয় তাঁরই সুপারিশে।

    কথাটা শুনে গুরুংয়ের মুখটা হল দেখবার মতো। একটা চাপা বাঘাটে স্বরে গর্জন করে উঠল সে, “থাপা-র ভাইপো লোবসাম? আপনি কি ইয়ার্কি করছেন দত্তবাবু?”

    ধমকটা শুনে একটু ঘাবড়ে গেলেও একটু পরে নিজের ব্যক্তিত্ব ফিরে পেলেন প্রাক্তন দুঁদে সরকারী আমলা দত্তসাহেব, “কেন, এতে ইয়ার্কি করার কী আছে? আর আপনার সঙ্গে আমার ইয়ার্কি করার শখই বা হবে কেন?”

    “কারণ বীরেন্দ্র-র সারনেম থাপা, অর্থাৎ ও নেপালি। আর লোবসাম হচ্ছে খাঁটি তিব্বতি নাম। এবার বলুন তো দত্তসাহেব, নেপালির ভাইপো টিবেটান হয় কী করে?”

    দত্তবাবু কেন, আমরাও হাঁ-করে চেয়ে রইলাম গুরুং-এর দিকে। কথাটা আমাদের মাথাতেই আসেনি।

    গুরুং গম্ভীর মুখে বলল, “কিছু মনে করবেন না দত্তবাবু, আপনাকে আর আপনার বীরেন্দ্রকে জেরা করার জন্য একটু থানায় নিয়ে যেতে হচ্ছে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই, রুটিন জিজ্ঞাসাবাদ। এমনকি যোগেন্দ্রজি চাইলে তিনিও আসতে পারেন।”

    প্রফেসর যাদব স্থিরস্বরে বললেন, “আমি তো যাবই। ইন ফ্যাক্ট পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে খুব ইন্টারেস্টিং লাগছে। জেএনইউ-র প্রফেসর হওয়ার সুবাদে সরকারি লেভেলে আমার কন্ট্যাক্ট খুব একটা কম নয়। আমি সে-সবও অ্যাক্টিভেট করছি।”

    কথাটা যে গুরুংকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেওয়ার মতো তাতে সন্দেহ নেই। দেখলাম যে দারোগাসাহেবের মুখটা মুহূর্তে রক্তবর্ণ ধারণ করল। আর একটা কথাও না বলে অ্যাবাউট টার্ন করে বাইরের দিকে হাঁটা দিল গুরুং।

    ওঁরা চলে যেতেই তাপসের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর চোখদুটো জ্বলজ্বল করছে। আমাকে বলল, “একটা কাজ কর সুবোধ। জ্যেঠুর লাইব্রেরিটা নাড়াঘাঁটা করে দেখ কাজের কিছু খুঁজে পাস কি না। আমার মন বলছে ওখানে কিছু একটা পাওয়া যাবেই। আমি কতগুলো কাজ সেরে দুপুর নাগাদ ফিরছি। লাঞ্চ তোর আর আমার জন্য প্যাক করিয়ে নিয়ে আসব, সে-নিয়ে চিন্তা করিস না, আর আমি না ফেরা পর্যন্ত বাড়ির বাইরে কোত্থাও যাবি না।”

    আমার বুকের মধ্যে ড্রাম বাজতে লাগল। তাপসের এই ব্যস্ততার কারণ আমি জানি। আমাদের আগেকার অনেক অভিযানে তাপসকে দেখেছি রহস্য সমাধানের একটা সূত্র পেলে এইভাবে ব্যস্ত হয়ে উঠতে। শুধু একটাই প্রশ্ন করলাম, “কিন্তু লাইব্রেরিতে কি কিছু পাওয়া যাবে? মানে গুরুং বলে গেল না যে জ্যেঠু নিশ্চয়ই এখানে পুঁথিটা লুকিয়ে রাখেননি?”

    তাপসের ঠোঁটের কোণে ওর সেই চিরচেনা চাপা হাসিটা ফিরে এল, “গুরুং-ও সেই ভাবেই ভেবেছে যে-ভাবে একজন ক্রিমিনাল ভাববে। এখন ভাব তো, যদি নারানজ্যেঠু ক্রিমিনাল আর দারোগাদের থেকে একটু বেশি ভাবেন? মানে উনি যদি ওরা এইরকম ভাবেই ভাববে সেটা আন্দাজ করে এখানেই কিছু লুকিয়ে রাখেন?”

    সকাল থেকে তো ডিস্টার্বড ছিলামই, এবার অন্যরা কী-রকম ভাববে ভেবে কেউ নিজের ভাবাভাবির পদ্ধতি ভাবছেন ভেবেই মাথাটা স্রেফ আউলে গেল। এ-সব কী বলছে কী তপু?

    আমাকে ওখানে দাঁড় করিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে বেরিয়ে গেল তাপস। শুধু বলে গেল, লাইব্রেরির একটা ইঞ্চিও যেন আমি খোঁজাখুঁজি করতে বাদ না দিই।

    তাপস চলে যেতেই একটা অদ্ভুত ভয়-লাগানো নৈঃশব্দ্য আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। ঘড়িতে তখন প্রায় বেলা সাড়ে এগারোটা বাজে, সূর্য মধ্যগগনে। এই পাহাড়ের বুক ছেয়ে থাকা উপত্যকা আর উপত্যকার গা বেয়ে চলা বাতাসের শিরশিরে আওয়াজ আমাকে ক্ষণে-ক্ষণে মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে আমি একেবারে একলা।

    তাপস নেমে যেতেই আমি একবার নীচে গিয়ে সদর দরজার ল্যাচটা লাগিয়ে এলাম। তারপর ঘুরে একবার ড্রয়িং স্পেসের দিকে তাকালাম।

    কেউ নেই।

    ঘাড় না ঘুরিয়েই আমি একবার আড়চোখে ব্যালকনির দিকে তাকালাম। একটা শুকনো হাওয়া যেন কোথা থেকে উড়ে এসে বারান্দার মেঝেতে পাক খেতে থাকল।

    আমার আর একা থাকা পোষাল না। একদৌড়ে দোতলায় নারানজ্যেঠুর লাইব্রেরিরুমে গিয়ে হাঁফ ছাড়লুম। এখানে তা-ও বই আছে, সূর্যের আলো আছে। নীচে যাওয়ার কথা ভাবতেই আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।

    দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আমি এবার পুরো লাইব্রেরিটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। সব মিলিয়ে এগারোটা ৱ্যাক। পেছনের তিনটে সারিতে তিনটে করে, আর সামনের সারিতে দুটো। আমি একদম পেছনের ৱ্যাক থেকেই শুরু করলাম। প্রতি ৱ্যাকে গাদা-গাদা বই, যদিও খুব যত্ন করে রাখা। লক্ষ করে দেখলাম যে প্রায় প্রতিটা বই-ই ইতিহাস আর সাহিত্যের বিষয়ক, আরও স্পেসিফিক্যালি বলতে গেলে বাংলার ইতিহাসের ওপর।

    একেকটা করে বই নামিয়ে দেখতে লাগলাম কোথাও কিছু আছে কি না।

    কাজটা সময়সাপেক্ষ তো বটেই, পরিশ্রমেরও। ঘণ্টা-দুয়েক লাগল মোটামুটি সবকটা ৱ্যাকের বই নেড়ে-ঘেঁটে দেখতে। ততক্ষণে বইয়ের ধুলোয় আমার অবস্থা কাহিল। কোথাও কিছু পেলাম না। নীচে বাথরুমে গিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে, মুখে-চোখে জল দিয়ে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় মনে হল জ্যেঠুর ঘরটা একবার ভালো করে দেখলে হয় না? যদি কোনও সূত্র পাওয়া যায়?

    বারান্দাটা পেরোতে যা ভয় লাগছিল সে আর বলার নয়। প্রথম আর দ্বিতীয় ঘর পেরিয়ে জ্যেঠুর ঘরের সামনে দাঁড়ালাম। আর তারপর হাতে রুমালটা জড়িয়ে সন্তর্পণে ঘরের দরজাটা খুললাম।

    বুকটা যেন তখন রেলওয়ে ইঞ্জিনের মতো ধক-ধক করছিল। আমি জানি যে ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টকে নিয়ে গুরুং যে-কোনও মুহূর্তে ফিরে আসতে পারে। তখন ঘরের প্রতি ইঞ্চির ফিঙ্গারপ্রিন্ট নেবে ও। আঙুলের ছাপ না-হয় রুমাল জড়িয়ে ম্যানেজ করা যাবে, মেঝেতে পায়ের ছাপ মুছব কী করে?

    ঘরটার চারিদিকে একবার সতর্ক চোখে তাকিয়ে নিলাম। তারপর ধীরে ধীরে যতটা সম্ভব গোড়ালি উঁচু করে ভেতরে পা রাখলাম। লক্ষ রাখলাম মেঝেতে পড়ে থাকা জিনিসপত্র যেন মাড়িয়ে না ফেলি।

    ঘরটার দরজা দক্ষিণমুখী। কোনার ঘর হওয়ার জন্য উত্তর আর পশ্চিমদিকের দেওয়ালে দুটো জানালা, আর সে-দুটোই সারারাত খোলা থাকার জন্য সারা ঘরে একটা ভারী ঠান্ডা যেন জমাট বেঁধে আছে। সূর্য মাথার ওপর, সারা ঘরে আশ্বিনের নীল আলো খেলা করছে। সেই আলোয় আমি খুব ধীরে-ধীরে ঘরের প্রতিটা জিনিস খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম।

    অন্তত মিনিট দশেক ধরে চারিদিকে সতর্ক চোখ বুলিয়েও কোথাও কোনও ক্লু বা সূত্র না পেয়ে বেরিয়ে আসতে যাব, আমার অজান্তেই জ্যেঠুর বিছানার দিকে আমার চোখ গেল।

    জ্যেঠুর বিছানাটা হচ্ছে পুরোনো জমানার দামি মেহগনি কাঠের বিছানা। হালকা হলদেটে বাদামি রঙ, পালিশ পড়ে চকচক করছে। মাথার দিকে একটা দেড়ফুট উঁচু ব্যাকরেস্ট। চকচকে মেহগনি কাঠের ওপর সূর্যের আলোর একটা হালকা আলো এসে পড়েছে। সেই আলোয় আমার মনে হল কাঠের ওপর এক কোনায় খুব সম্ভবত পেন্সিলে কিছু একটা লেখা আছে, যাকে ইংরেজিতে বলে স্ক্রিবল করা। কাছে গিয়ে ঝুঁকে দেখলাম ছোট-ছোট অক্ষরে একটা দু’লাইনের ছড়া লেখা,

    “মঞ্জুশ্রীর শক্তি পীঠে সোনার তরী গাঁথা/ চাইলে পেতে, হে সন্ধানী, ক্ষণেক ছোঁয়াও মাথা।”

    ছড়াটা সহজ, এক-দু’বার আউড়েই মুখস্থ হয়ে গেল। হাতের লেখাটাও যে জ্যেঠুর তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু এখানে এই ছড়াটা লেখার মানেটা কী?

    এবার আরও একটু ঝুঁকে এলাম, অক্ষরগুলোকে আরও কাছ থেকে খুঁটিয়ে দেখব বলে। এবং তখনই বুঝলাম যে এটা খুব সম্প্রতি লেখা হয়েছে এবং লেখা হয়েছে যথেষ্ট তাড়াহুড়োর মধ্যে।

    এই নিয়ে বেশি ভাবার সময় পেলাম না কারণ ঠিক তখনই বাড়ির সদর দরজা থেকে একটা জোরালো ঠকঠক শব্দ ভেসে এল। অর্থাৎ গুরুং ও তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট বা তাপস, কেউ একজন ফিরে এসেছে।

    খুব আস্তে-আস্তে, পা-টিপেটিপে বাইরে বেরিয়ে এলাম। বুকটা যে ধুকপুক করছিল তাতে সন্দেহ নেই। হাতে জড়ানো রুমালটা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে ওটা পকেটে রাখলাম। তারপর দ্রুতপায়ে হেঁটে গেলাম সদর দরজার দিকে।

    দরজা খুলেই চমক। গুরুং আর তার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্ট তো আছেই, সঙ্গে তাপসও আছে। তার হাতে একটা মস্ত বড় প্যাকেট। ভেতরে ঢুকে জুতো খুলতে-খুলতে তাপস খানিকটা কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতেই বলল, “থানাতে একটা কাজে গেসলুম। কাজ-টাজ শেষ হলে দেখি ওনারা এদিকেই আসছেন, তাই আমিও ওঁদের সঙ্গে ঝুলে পড়লুম।”

    গুরুং অবশ্য আমার বা তাপসের দিকে বিন্দুমাত্র মন দিল না। গটগট করে জ্যেঠুর বেডরুমের দিকে রওনা দিল। তাপস আমাকে চোখ টিপে আর একটা হাত মাথার দিকে ইঙ্গিত করে বোঝাল যে গুরুংয়ের মাথা এখন খুব গরম। ওর সঙ্গে যেন বিশেষ কথাবার্তা না বলি।

    .

    *

    ঘণ্টাখানেক বাদে গুরুং অ্যান্ড কোম্পানি জ্যেঠু আর লোবসামের ঘরদুটো সিল করে চলে গেল। যাওয়ার আগে গম্ভীরমুখে বলে গেল অন্তত এক সপ্তাহ যেন আমরা দার্জিলিংয়ের বাইরে না যাই। একটা কেয়ারটেকার কাম কুক ও পাঠিয়ে দিচ্ছে, আপাতত সে-ই আমাদের দেখভাল করবে, যতদিন আমরা এখানে থাকি। বোঝাই গেল যে পুলিশের কাউকে পাঠানো হচ্ছে আমাদের ওপর নজরদারি করার জন্য। গুরুং এ-ও বলে গেল কাল সকাল দশটা নাগাদ ও আবার আসবে, আমাদের জবানবন্দি নিতে।

    .

    ওরা যখন চলে গেল তখন বাজে প্রায় সাড়ে তিনটে। আমি বাংলোর ছাদে বসে তাপসের আনা মোমো আর থুকপা খেতে-খেতে প্রশ্ন করলাম, “সারাদিন কী-কী করলি শুনি?”

    জ্যেঠুর কাঠের আরামকেদারায় প্রায় আধশোয়া হয়ে একটা গোল্ড ফ্লেক ধরিয়ে বলা শুরু করল তাপস।

    “প্রথমে গেলাম ম্যালের ফোন বুথটায়, অনেকগুলো ফোন কল করার ছিল। বেশিরভাগই কলকাতায়, কয়েকটা দিল্লিতে। আমার এক দূরসম্পর্কের মেসোমশাই দিল্লির জেএনইউ-তে ইকোনমিক্সের প্রফেসর, তাঁর সঙ্গেও কিছু কথা হল। বাড়িতে ফোন করাটাই অবশ্য বেশি জরুরি ছিল। জ্যেঠুর উধাও হওয়ার খবরটা আর বাড়িতে বলিনি, বাবা খামোখা টেনশন করবেন। শুধু বলেছি যে আমাদের ফিরতে চার-পাঁচ দিন দেরি হবে, চিন্তা করার কিছু নেই। তোর বাড়িতেও বলে দিয়েছি একই কথা। সে-সব শেষ হলে পর গেলাম অক্সফোর্ড স্টেশনার্সের মালিকের কাছে। উনি একজন হিস্ট্রির প্রফেসরের খবর দিলেন যিনি বজ্রযান বৌদ্ধধর্মের ওপর একজন অথরিটি, নাম অনিমেষ পাল। বহুদিন বিলেতে পড়িয়েছেন, আপাতত রিটায়ার করে কলকাতায় থিতু। তাঁর সঙ্গেও ফোনে অনেক কথা হল। তারপর গেলাম হিমালয়ান রিট্রিট।”

    “সেটা আবার কী?”

    “একটা হোটেল। ম্যালের কাছেই।”

    “নামটা শোনা শোনা লাগছে কেন বল তো?”

    আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে একটা নকল দীর্ঘশ্বাস ফেলল তাপস, “মাসিমা সাধে বলেন তোর মাথার মেমরি সেলগুলো ব্যাটারি সেল হয়ে গেছে? সেদিন দেবাশিস বণিক গাড়ি থেকে নামার সময় বললেন না যে উনি কোথায় উঠেছেন?”

    খোঁচাটা বেমালুম হজম করে গেলাম। নামটা মনে রাখা উচিৎ ছিল। কিন্তু হঠাৎ দেবাশিসদার সঙ্গে দেখা করার দরকার পড়ল কেন?

    তাপস আমার মনের প্রশ্নটা আঁচ করেই বলল, “সেদিন কথা বলতে বলতেই বুঝেছিলাম যে ভদ্রলোক এমন কয়েকটা কথা বলেছেন যেগুলো কাঁচা মিথ্যে। মিলিটারি বুটের ব্যাপারটা তো আছেই। তা-ছাড়াও বেশ কিছু কথাবার্তা উনি বলেছেন যেগুলো সত্যি হতে পারে না।”

    একটা উত্তেজনা টের পাচ্ছিলাম, “তা দেবাশিসদার সঙ্গে কী কথা হল?”

    “বলব বন্ধু, সময় এলে সব বলব। এত অধৈর্য হলে চলে? তারপর সেখান থেকে গেলাম থানায়। সেখানে দেখি গুরুং আমাদের দত্তসাহেবকে একেবারে পেড়ে ফেলেছে। দত্তসাহেব প্রাক্তন আমলা না হলে, আর প্রফেসর যাদব তাঁর প্রভাব না খাটালে, ভদ্রলোক বোধহয় আজকের রাতটা লক আপেই কাটাতেন।”

    “আর দত্তবাবুর সেই ড্রাইভার?”

    “বীরেন্দ্র থাপা? তাকে আর হাজতবাস থেকে বাঁচানো যায়নি। অবশ্য তার কারণও আছে। শ্রীথাপার বক্তব্য বড়ই গোলমেলে। সে এখন বলছে যে লোবসাম তার ভাইপো নয়, তার ছোট না মেজ শালি কোনও এক তিব্বতিকে বিয়ে করেছিল, লোবসাম তাদের ছেলে। সে-মহিলা মারা যাওয়াতে বীরেন্দ্রর বউ নাকি মা-মরা বোনপোকে কাছে এনে রেখেছিল। ছোকরা বসে-বসে ঘরের অন্ন ধ্বংস করছে দেখে বীরেন্দ্রই দত্তসাহেবের সঙ্গে কথা বলে এই বাড়িতে বহাল করায়। আর মিথ্যা কথা বলার কারণ হচ্ছে ছোকরার নাকি ৱ্যাশন কার্ড-টার্ড কিছু নেই, মানে আইনত ও এ-দেশের নাগরিকই নয়, তাই শ্যালিকাপুত্রকে ভাইপো বানানো। তবে বলা বাহুল্য, গুরুং তার কথার একটি বর্ণও বিশ্বাস করেনি, জবানবন্দি শোনামাত্র পুলিশ কাস্টডিতে নিয়েছে। কথাবার্তায় যা বুঝলাম আজ রাতে থাপাবাবু গুরুং-এর থাবার নীচেই থাকবেন। সে যাকগে, তুই তোর দিকের খবর বল।”

    সব খবর ডিটেইলসে বললাম। কিছুই যে পাইনি, সে-কথাও। প্রতিটা কথা মন দিয়ে শুনছিল তাপস। শেষে ওই কাঠের ব্যাকরেস্টে লিখে রাখা দু’লাইনের কবিতাটা বললাম। শোনামাত্র ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো উঠে বসল তাপস, “কী বললি? কাঠের ওপর পেন্সিলে লেখা ছড়া? আবার বল দেখি।”

    আবার আওড়ালাম ছড়াটা, “মঞ্জুশ্রীর শক্তিপীঠে সোনার তরী গাঁথা/ চাইলে পেতে, হে সন্ধানী, ক্ষণেক ছোঁয়াও মাথা।”

    “ওটা জ্যেঠুর হাতের লেখা? তুই শিওর?” তাপস উঠে বসল, স্পষ্টতই উত্তেজিত সে।

    “সেন্ট পার্সেন্ট। এই তো লাইব্রেরির একগাদা বইয়ের মার্জিনে জ্যেঠু নিজের হাতে নোট লিখে রেখেছেন। ও হাতের লেখা জ্যেঠু ছাড়া আর কারও হতেই পারে না। আমি একদম শিওর।”

    তাপস আমার দিকে তীব্র চোখে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর মাথাটা ধীরে-ধীরে পেছনে এলিয়ে দিল। চোখ দুটো বোজা, ভুরুদুটো প্রচণ্ড কুঁচকে আছে। ডান হাতটা মুঠো করে কপালের ওপর রাখা।

    তাপসের এই অবস্থা আমি খুব ভাল করে চিনি। এর মানে ও মগজ তোলপাড় করে কিছু একটা ভাবছে। এখন কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই খ্যাঁক করে উঠবে। তবুও ভয়ে-ভয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “হ্যাঁ রে, এতে কী ওই অষ্টমহাসিদ্ধ না কারা, তাদের খোঁজ লিখে গেছেন জ্যেঠু?”

    “না।” সংক্ষিপ্ত উত্তর ভেসে এলো।

    “তুই শিওর?”

    “সেন্ট পার্সেন্ট।”

    “কী করে এত শিওর হচ্ছিস তুই?” চ্যালেঞ্জ করলাম তাপসকে।

    উঠে বসল তাপস, তারপর আমার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল, “তার কারণ, আজকে আমি প্রফেসর পালের সঙ্গে এ-নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলেছি। উনি জোর দিয়ে বলেছেন যে অষ্টমহাসিদ্ধ একটা হুজুগ মাত্র। অনেক খোঁজখবরের পরেও তারা যে কোনওকালে ছিল সে-ব্যাপারে কংক্রিট কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি, খুব সম্ভবত ব্যাপারটা পুরোটাই ভাঁওতা। জ্যেঠুকে যারা হুমকি চিঠিটা পাঠিয়েছে, তারা পাতি ক্রিমিনাল, ওদের সঙ্গে সিদ্ধ, ভাজা, পোড়া -কোনও দলেরই কোনও সম্পর্ক নেই।”

    খবরটা শুনে বুকে একটা জোর ধাক্কা খেলাম। এই যে গোপন সংগঠন না কী-সব শুনলাম দু’দিন ধরে, সে-সব কিচ্ছু নেই? তাহলে তাশি দোরজিকে খুন করল কে? জ্যেঠুকে তুলে নিয়ে গেল কারা?

    আপনমনে বলতে লাগল তাপস, “পুঁথিটা খুব সম্ভবত এই বাংলোর মধ্যেই কোথাও আছে, বুঝলি। এবং তার সন্ধান করার সূত্রটাই এই ছড়াটায় সাংকেতিক ভাষায় লিখে রেখেছেন জ্যেঠু। ভেবেছেন যে, বাই চান্স যদি ওঁর কিছু হয়ে যায়, তাহলে এই ছড়ার সূত্র ধরে কেউ যেন পুঁথিটা খোঁজার একটা উদ্যোগ নিতে পারে।”

    “কিন্তু তার জন্যে খাটের ব্যাকরেস্ট কেন? লেখার জায়গার কি অভাব ছিল? বিশেষ করে যখন অতবড় লাইব্রেরি পড়ে আছে?”

    একটু সময় নিয়ে উত্তরটা দিল তাপস, “আমার মনে হয় জ্যেঠুকে আমরা যতটা সরল ভেবেছি ততটা সরল উনি নন। তাশি দোরজি খুন হওয়াতে উনি বুঝে যান যে শত্রুপক্ষ জেনে গেছে পুঁথিটা আজ-কালের মধ্যেই পাচার হয়ে যাবে। একটা অ্যাটাক যে আসতে চলেছে সেটা উনি আন্দাজ করেছিলেন বটে, শুধু এটা বুঝতে পারেননি যে সেটা এত তাড়াতাড়ি আসবে। ফলে কাল রাতে যখন অপরাধীদের চলাফেরা টের পেলেন, তখন তাড়াহুড়োয় নাইট ল্যাম্প বা টর্চের আলোতে এমন একটা জায়গায় ক্লু-টা লিখে রাখলেন যেটা রাতের বেলায় কারও চোখে পড়বে না, অথচ জায়গাটা এমন হওয়া চাই যেখানে দিনের বেলায় লোকের আনাগোনা হবে। তাদের কারও-কারও চোখে হয়তো পড়বে। কিন্তু সবাই বুঝবে না। বুঝবে তারাই যাদের বোঝা দরকার।”

    “কিন্তু তাপস, তুই আমাকে একটা কথা বল, যদি ওই অষ্টমহাসিদ্ধ বলে কিছু না-ই থাকে, তাহলে জ্যেঠুকে চিঠিটা পাঠাল কারা? তাশি দোরজিকে খুন করল কারা? জ্যেঠুকে কিডন্যাপই বা করল কারা?”

    “আমার মনে হচ্ছে যে এর পেছনে একটা বড় দল আছে রে সুবোধ। এবং তারা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত। নইলে এইরকম পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ক্রাইম করা চাট্টিখানি কথা নয়, সে তাশি দোরজির খুনই হোক বা জ্যেঠুর কিডন্যাপিং। এরা স্মাগলার হতে পারে, যারা দেশের ঐতিহাসিক জিনিস বিদেশে পাচার করে মোটা টাকা কামায়। অথবা শখের কালেক্টর হতে পারে, শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সংগ্রহ বাড়ানোই যাদের উদ্দেশ্য, তার জন্য দু-চারটে খুনখারাপি করতেও যারা পিছপা হয় না। অথবা ধর…”

    “কিউরিও শপের মালিক?”

    সরু চোখে আমার দিকে তাকাল তাপস, “হ্যাঁ, তা-ও হতে পারে যদি সে-রকম মোটা দাঁও মারার সুযোগ থাকে। এবং শুধু তা-ই নয়, তাদের মধ্যে এমন শিক্ষিত অথচ ধুরন্ধর লোক আছে, যারা চর্যাপদের ভাষায় চিঠিও লিখতে পারে।”

    একটা কথা দুপুর থেকেই মাথায় ঘুরছিল, সেটা জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, “আচ্ছা, দত্তবাবুও তো চর্যাপদের ভাষায় চিঠি লিখতে পারেন, পারেন না?”

    “না পারার কী আছে। যাঁরা এই ভাষা নিয়ে চর্চা করেন তাঁরা নিশ্চয়ই পারেন। চেষ্টা করলে প্রফেসর যাদবও পারবেন হয়তো। বাংলাটা যে উনি পড়তে পারেন সে তো জানাই, নইলে আর জ্যেঠুর কাছ থেকে পুঁথিটার কপি চাইবেন কেন? মোটমাট তারা যে-ই হোক, খুব সুবিধের যে নয় সে তো বোঝাই যাচ্ছে।”

    নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল, এ তো কেউই সন্দেহের বাইরে নন দেখছি। “হ্যাঁ রে, ওরা জ্যেঠুকে মেরে ফেলবে না তো?” প্রশ্ন করলাম আমি। নারানজ্যেঠু আমার কেউ নন, তাপসের কোন দূরসম্পর্কের আত্মীয়। তবুও সকাল থেকে জ্যেঠুর জন্য আমার খুবই উদ্বিগ্ন লাগছিল, আর সেই সঙ্গে তাপসের ঠান্ডা ব্যবহার দেখে একটা অস্বস্তি।

    “নাহ রে সুবোধ, সে-ঝামেলা ওরা নেবে না। ওদের চাই পুঁথিটা, সেটা পেলেই ওদের কাজ হাসিল। পুঁথিটা সেটা যাতে দার্জিলিংয়ের বাইরে না যায় সেটা এনশিওর করার জন্যেই জ্যেঠুকে তুলে নিয়ে যাওয়া। খুন-জখম করা ওদের কাজ নয়, বিশেষ করে ভিক্টিম যদি হন নরনারায়ণ ভট্টাচার্য-র মতো এলাকায় পরিচিতি আছে এমন লোক, তাশি দোরজি-র মতো দাগি ক্রিমিনাল নয়। তাঁকে খুন করলে যে হাঙ্গামা হবে তাতে ওদের অসুবিধাই বেশি। ফলে এখন আমাদের প্রায়োরিটি হচ্ছে পুঁথিটা খুঁজে বের করা। ওটাই জ্যেঠুর প্রাণভোমরা। ওটা আমাদের হাতে এলেই জ্যেঠুকে উদ্ধার করাটা সহজ হয়ে যাবে।”

    “সে কী? পুঁথিটা উদ্ধার করাটাই এখন তোর কাছে প্রায়রিটি? জ্যেঠুকে উদ্ধার করা নয়?” অবাক ভাবে প্রশ্ন করলাম আমি।

    আমার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল তাপস, তারপর বলল, “না সুবোধ। যারা জ্যেঠুকে কিডন্যাপ করেছে তারা অতি বুদ্ধিমান, অতি ধুরন্ধর লোক। আমার মনে হয় পুলিশ পুরো দার্জিলিং খুঁড়ে ফেললেও জ্যেঠুকে অত সহজে উদ্ধার করতে পারবে না। “

    “কেন? পারবে না কেন? পুলিশ পারে না এমন কাজ হতে পারে নাকি? তুই-ই তো বলেছিলি, পুলিশ চাইলে পাতাল থেকেও অপরাধীকে ধরে আনতে পারে?”

    আমার দিকে তাকিয়ে হাসল তাপস, তারপর বলল, “ছোটবেলায় কখনও কানামাছি খেলেছিস সুবোধ? কানামাছির হাত থেকে লুকিয়ে থাকার সবচেয়ে বেস্ট উপায় কী বল তো? কানামাছির পেছনে-পেছনে লুকিয়ে থাকা। কারণ নিজের পিঠের দিকটা সে কখনও দেখতে পায় না।”

    তাপসের কথাবার্তা শুনে আমার এবার বিরক্ত লাগছিল, একটু কড়া গলায় বললাম, “এ-সব হেঁয়ালি করা বন্ধ করবি? এখন জ্যেঠুকে উদ্ধার করার উপায় কী সেইটে বল।”

    তাপস লাইব্রেরির জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, সেখান থেকে বাইরের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “এখন আমাদের হাতে একটাই মাত্র উপায় আছে সুবোধ, টোপ ফেলে ওদের এই বাড়িতে আবার ডেকে আনা, পুঁথিটার খোঁজে। আর তখনই ওরা তিননম্বর ভুলটা করবে। ওটার জন্যই আমি অপেক্ষা করছি।”

    “তিন নম্বর ভুল মানে?” আমার কেমন ধাঁধা লেগে যাচ্ছিল কথাটা শুনে, “তুই কী করে জানলি ওরা এর আগে দুটো ভুল করেছে? মানে ওরা কে সেটাই যখন জানা যাচ্ছে না…”

    তাপস হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল, আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “তার কারণ ওরা যে কারা সেটা পুরোটা না জানলেও দার্জিলিংয়ে ওদের হয়ে কোন মহাপুরুষ এই কাজে নেমেছেন সেটা আমি জানি সুবোধ। আমি জানি কে তাশি দোরজিকে খুন করিয়েছে, আমি এ-ও জানি যে কে বা কোন মহাত্মারা কাল জ্যেঠুর ঘরে পায়ের ধুলো দিয়েছিলেন।”

    শোনামাত্র আমি লাফিয়ে উঠলাম, “মানে? তুই জানিস কে এ-সব বদমাইশি করছে? আর তুই সেটা পুলিশকে বলছিস না?”

    ধীরে-ধীরে মাথা নাড়ল তাপস, “না দোস্ত, এখন নয়। কারণ আদালতে ওদের অপরাধ প্রতিষ্ঠা করার মতো প্রমাণ আমার হাতে এখনও আসেনি, তাই ওদের ধরলেও ছেড়ে দিতেই হবে। আর এখন তাড়াহুড়ো করে ওদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া মানে জ্যেঠুর জীবন বিপন্ন করা। এখন আমাদের উচিত টোপটা খুঁজে বের করা, যেটার হিন্ট জ্যেঠু অলরেডি দিয়ে গেছেন।”

    তাপসের কর্মপদ্ধতির সঙ্গে আমি খুব ভালোভাবেই ওয়াকিবহাল। এখন ও মাথা খাটাবে ওই চারটে লাইন নিয়ে। আমি অ্যাকশনের লোক, মগজমারির কাজ আমার নয়।

    দেখতে-দেখতে সন্ধে হয়ে এল। পাহাড়ি অঞ্চলে অন্ধকারটা হঠাৎ করে নেমে আসে। আমি ঘর থেকে বের হয়ে ছাদে গিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হল এই নিস্তব্ধ জনহীন পাহাড়ি অন্ধকার যেন আমাকে গিলে খেতে আসছে। আমার গা-টা হঠাৎ করেই শিরশির করে উঠল।

    লাইব্রেরিতে ফিরে দেখি লাইট জ্বালিয়ে আরামকেদারায় ভূতের মতো বসে আছে তাপস। সামনে মেঝেতে একগাদা বইপত্র ছড়ানো। আমাকে দেখেই প্রথম প্রশ্ন করল ও, “শক্তিপীঠ বলতে তুই কী বুঝিস সুবোধ?”

    অবাকই হলাম প্রথমে, “একান্নটা শক্তিপীঠের গল্প জানিস না? আরে সেই যে সতীর দেহত্যাগের গল্প রে। শিবের বারণ সত্ত্বেও শিবহীন যজ্ঞে গেলেন সতী। তারপর বাবার মুখে পতিনিন্দা শুনে মারা গেলেন। তারপর শিবের দক্ষযজ্ঞ পণ্ড করা, তাণ্ডব নৃত্য, সেই দেখে বিষ্ণুর তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ একান্ন টুকরোয় কেটে ফেলা, আর সেই একান্নটা টুকরো নিয়ে একান্নটা শক্তিপীঠ। এ-সব গল্প শুনিসনি?”

    উদ্ভ্রান্ত চোখ তুলে আমার দিকে তাকাল তাপস, “গল্পটা জানি রে সুবোধ। কিন্তু এই একান্নটা শক্তিপীঠের মধ্যে তন্ন-তন্ন করে খুঁজেও মঞ্জুশ্রীর নামে কোনও শক্তিপীঠ বা কোনও উপপীঠের খোঁজ পাচ্ছি না কেন বল দেখি?”

    প্রশ্নটা শুনে থমকে গেলাম। আজ অবধি শুনে এসেছি যে একান্নটা শক্তিপীঠ আছে আর কালীঘাট তার মধ্যে একটা, এটুকু জানার পর বাকি শক্তিপীঠগুলো কোথায়-কোথায় সে-সব জানার চেষ্টাই করিনি আজ অবধি।

    “তুই ঠিক জানিস যে মঞ্জুশ্রীর নামে কোনও শক্তিপীঠ নেই?” প্রশ্ন করলাম আমি। তাপস কোনও জবাব দিল না। শুধু সামনে ফেলে রাখা বইয়ের স্তূপের দিকে আঙুল দিয়ে দেখাল।

    কিছুক্ষণ দু’জনের চুপচাপ কাটল। তারপর খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবেই বিড়বিড় করল তাপস, “মঞ্জুশ্রীর শক্তিপীঠ, মঞ্জুশ্রীর শক্তিপীঠ… আচ্ছা… এই মঞ্জুশ্রী ভদ্রমহিলা কে?”

    বিরক্ত হলাম, “ভদ্রমহিলা আবার কী-রকম ভাষা? উনি নিশ্চয়ই কোনও দেবী যাঁর নামে শক্তিপীঠ একটা আছে, আমরা হয়তো জানি না।”

    “বলিস কী রে! ছোটবেলা থেকে রামায়ণ মহাভারত পুরাণ এ-সব পড়ছি, ফি বচ্ছর দুর্গাপুজো কালীপুজো এ-সব করছি, কিন্তু আজ অবধি এই মঞ্জুশ্রী দেবীর নাম শুনিনি কেন বল তো?”

    “কারণ… কারণ…” উত্তরটা মনের মধ্যে হাতড়াবার চেষ্টা করলেও কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না।

    “জ্যেঠুর লাইব্রেরিতে অভিধানগুলো কোথায় আছে জানিস?”

    না জানার কিছু নেই। ঘণ্টা-কয়েক আগেই প্রায় পুরো লাইব্রেরিটা নিজের হাতে ঘেঁটেছি। ফলে একটা মোটকা অভিধান তাপসের সামনে এনে রাখতে আমার মিনিট খানেকের বেশি সময় লাগল না। তাপস দেখলাম ম-এর পাতাটা খুলে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

    তবে সেটা বেশিক্ষণের জন্য না। মিনিট-দুয়েক পরেই মাথা তুলে বলল, “হ্যাঁ রে, মঞ্জুশ্রী চাকী সরকার বলে একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী ছিলেন না?”

    “হ্যাঁ তো। কেন?”

    “তোর মেজো মাসির সেই কানাডায় থাকা কোন এক বান্ধবীর নাম মঞ্জুশ্রী নয়?”

    তাপসের মেমরি যে সাঙ্ঘাতিক ভালো স্বীকার করতেই হবে। “হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। কিন্তু এ-সব জিজ্ঞেস করছিসই বা কেন?”

    এবার সম্পূর্ণ উদ্ভ্রান্তস্বরে একটা বোমা ফেলল তাপস, “তার মানে মঞ্জুশ্রী হচ্ছে গিয়ে মেয়েদের নাম, তাই না? কিন্ত এখানে বলছে যে মঞ্জুশ্রী আসলে বৌদ্ধদের কোনও এক দেবতার নাম?”

    কথাটা পরিষ্কার হল না আমার কাছে, “বুঝলাম না। দেবদেবীর নামে তো লোকজনের নাম রাখা হয়েই থাকে। এতে এত অসুবিধার কী হল?”

    তাপস প্রায় ধমকে উঠল, “অসুবিধা মানে? কথাটা মাথায় ঢুকল তোর? মঞ্জুশ্রী কোনও দেবী নয়, দেবতার নাম! এবার বুঝলি কিছু?”

    এবার ব্যাপারটা বুঝলাম, আর আমার মুখটা হাঁ হয়ে গেল। গীতশ্রী, অনুশ্রী, ভাগ্যশ্রী, দেবশ্রী, মঞ্জুশ্রী এ সবই তো মেয়েদের নাম বলে জেনে এসেছি। আজ হঠাৎ করে মঞ্জুশ্রী পুরুষ দেবতা হয় কী করে?

    ততক্ষণে তাপস ঝটাপট কয়েকটা বৌদ্ধধর্মের মূর্তিটুর্তির ওপর বই নামিয়ে ফেলেছে। প্রায় ঝড়ের বেগে সেগুলোর পাতা উল্টে যাচ্ছিল। আমি চুপচাপ ওকে দেখে যাচ্ছিলাম। এইসব বইপত্তর নাড়াঘাঁটার দায়িত্ব ওর। আমার দায়িত্ব শুধু অ্যাকশনের।

    মিনিট দশেক বাদে শেষ বইটার পাতা বন্ধ করে ফের আরামকেদারায় মাথা এলিয়ে বসল তাপস। তারপর স্বগোতক্তির ঢংয়ে বলল, “মঞ্জুশ্রী যদি কোনও দেবতার নামই হবে সুবোধ, তাহলে শক্তিপীঠের কথা আসে কোথা থেকে বল দেখি? মানে শক্তিপীঠ তো দেবীদের হয়, দেবতাদের নয়, তাই না? ফলে মঞ্জুশ্রীর শক্তিপীঠ কথাটার কোনও মানেই হয় না, কী বলিস?”

    আমার বলার কিছু ছিল না। শুধু বুঝতে পারছিলাম, দৈবাৎ যে ক্লু’টা বের করলাম, তার আর কোনও তাৎপর্যই রইল না। আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি!

    “অথচ… অথচ…” হাঁটাহাঁটি করতে-করতে কী যেন একটা ভাবছিল তাপস, “জ্যেঠু যদি সত্যিই ইম্পর্ট্যান্ট কিছু একটা লিখে রেখে যান, তাহলে সেটা ভুল হওয়ার কথা নয়?”

    আমি জবাব দিলাম না। হাঁটতে-হাঁটতে হঠাৎ করে তাপস আমার সামনে এসে দাঁড়াল, “ছড়াটা বল তো একবার।”

    এবার বেশ থেমে-থেমে, স্পষ্ট উচ্চারণে বললাম ছড়াটা, “ মঞ্জুশ্রীর শক্তি পীঠে সোনার তরী গাঁথা/ চাইলে পেতে, হে সন্ধানী, ক্ষণেক ছোঁয়াও মাথা।”

    তাপস ঝুঁকে পড়ে আমার কাঁধদুটো শক্তহাতে ঝাঁকাল একবার, “ভালো করে ভেবে বল সুবোধ, কোনটা ঠিক। মঞ্জুশ্রীর শক্তিপীঠে, নাকি মঞ্জুশ্রীর শক্তি পীঠে?”

    অবাক হওয়ার আর বাকি ছিল না। বললাম, “বুঝলাম না। দুটোই তো একই।”

    “না, এক নয়। শক্তি আর পীঠের মধ্যে গ্যাপ ছিল কি ছিল না?”

    চোখ বন্ধ করে লেখাটা মনে করার চেষ্টা করলাম। জ্যেঠুর বেডরুম… ব্যাকরেস্ট… তাতে সূর্যের আলো এসে পড়ছে…আলোটা অল্প দুলছে…বাইরে পাখির ডাক…আমি পা-টিপেটিপে এগিয়ে যাচ্ছি… নিচু হলাম…পেন্সিল দিয়ে লেখা… মঞ্জুশ্রীর শক্তি…..

    “ছিল। গ্যাপ ছিল।” চোখ খুলে বললাম আমি। শক্তি আর পীঠ একসঙ্গে নয়, আলাদা করে লেখা ছিল।”

    লাফিয়ে উঠল তাপস। তারপর চাপা অথচ উত্তেজিত স্বরে বলল, “মার দিয়া কেল্লা সুবোধ, মার দিয়া কেল্লা।”

    তাকিয়ে দেখি ওর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ও রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠল, “ওটা মঞ্জুশ্রীর শক্তিপীঠ নয়, মঞ্জুশ্রীর শক্তির পীঠ। শক্তি, মানে যাকে ইংরেজিতে বলে কনসর্ট। যেমন শিবের পার্বতী, বিষ্ণুর লক্ষ্মী, তেমনই বৌদ্ধ দেবতাদেরও শক্তি আছেন। এই মঞ্জুশ্রী একজন বোধিসত্ত্ব গোত্রের দেবতা। আর তাঁর শক্তি কে বল তো?”

    “কে?”

    “সরস্বতী।”

    “তার মানে…”

    “তার মানে খুব লুজলি ট্রানস্লেট করলে ওটা হবে ‘সরস্বতীর পীঠে সোনার তরী গাঁথা/ চাইলে পেতে, হে সন্ধানী, ক্ষণেক ছোঁয়াও মাথা।’ এখন কথা হচ্ছে যে এখানে পীঠ বলতে নিশ্চয়ই পীঠস্থান বলা হচ্ছে, তাই না?”

    “অবশ্যই! এখানে পীঠ যেখানে সাধন ভজন পুজো পাঠ এইসব হয় সেইরকম জায়গা, যেমন আদ্যাপীঠ।” আমার বুকের রক্ত দ্রুত চলাচল করছিল।

    “তাহলে সরস্বতীর পীঠ বা সাধনপীঠ বলতে যেখানে সরস্বতীর সাধন ভজন পুজোপাঠ হচ্ছে এমন জায়গা বোঝায়, তাই নয় কী?”

    “তা বোঝায়। তবে চট করে পীঠ বা সাধনপীঠ শব্দটা শুনলে রেগুলার পুজো বা তন্ত্রসাধনা হয় এমন জায়গার কথাই মাথায় আসে আগে। যেমন ধর সাধক বামাক্ষ্যাপার পঞ্চমুণ্ডীর সাধনপীঠ। বা ধর…”

    “তাহলে সরস্বতীপীঠ বলতে কী বুঝব? যেখানে রেগুলার সরস্বতীর পুজো হয়?”

    “দেখ ভাই, বাংলায় রেগুলার পুজো হয় এমন দেবীর মধ্যে কালী বা দুর্গার নামই সবার আগে মনে আসে। রেগুলার পুজো হয় এমন কোনও সরস্বতী মন্দিরের কথা তো জানি না।”

    “সরস্বতীর পুজো কারা করে?”

    “স্কুল কলেজের ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা করে। হাজার হোক বিদ্যের দেবী তো!” বলতে-বলতেই মাথায় কী-যেন একটা ক্লিক করে গেল, “সারা বাড়ি খুঁজে তো জ্যেঠুর তো পুজো-আচ্চা করার কোনও প্রমাণ পেলাম না। তাহলে কি এখানে পুজো অর্থে বিদ্যাচর্চা ধরতে হবে?”

    “অবশ্যই…” অস্থির দেখাচ্ছিল তাপসকে, “দ্যটস কোয়াইট অবভিয়াস নাউ। সে-ক্ষেত্রে জ্যেঠুর বিদ্যাচর্চার আসন কোথায় হতে পারে?”

    “এই লাইব্রেরিতে, আর কোথায়?”

    দ্রুত সারা ঘরের মধ্যে প্রায় দৌড়ে বেড়াতে লাগল তাপস, রুদ্ধশ্বাসে বলতে লাগল, “এখানেই আছে সুবোধ, জ্যেঠু তাঁর সাধনার ধন এখানেই লুকিয়ে রেখেছেন। ইশ, এত বড় ব্যাপারটা মিস করে গেলাম কী করে রে সুবোধ। এই ঘরে কখনও তালা দেওয়া থাকে না, ফলে কেউ সন্দেহই করতে পারবে না যে অত বড় সম্পদ জ্যেঠু এখানেই লুকিয়ে রেখেছেন। ব্রিলিয়ান্ট, লোকটা সিম্পলি ব্রিলিয়ান্ট।”

    “কিন্তু এখানেই যদি থাকে তো কোথায় আছে? আজ আমি সবক’টা বই নিজের হাতে নামিয়ে দেখেছি তাপস, কোথাও কোনও পুঁথির চিহ্নমাত্র নেই।”

    “মাথা খাটা সুবোধ, মাথা খাটা। সরস্বতীর পীঠে, মানে যেখানে বসে জ্যেঠু সরস্বতীর আরাধনা করতেন, অর্থাৎ কি না যেখানে বসে পড়াশোনা করতেন, সেটাই বোঝাচ্ছে না কি? এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে সেটা কোন জায়গা?”

    বলামাত্র দু’জনের চোখই একইসঙ্গে এক জায়গাতেই গেল।

    জ্যেঠুর আরামকেদারা!

    খুব আস্তে-আস্তে এসে সেখানে বসল তাপস। তারপর প্রায় মন্ত্র পড়ার মতো করে আওড়াল, “চাইলে পেতে, হে সন্ধানী, ক্ষণেক ছোঁয়াও মাথা। আমরা সন্ধানী, সোনার নৌকো বা দাঁড় যাই হোক, পেতে চাইছি। কিন্তু পেতে গেলে মাথা ছোঁয়াতে হবে কেন? কার কাছে ছোঁয়াতে হবে? কোথায় ছোঁয়াতে হবে? কী-ভাবে ছোঁয়াতে হবে?”

    “কী-ভাবে ছোঁয়াতে হবে মানে যে-ভাবে ঠাকুরের পায়ে প্রণাম করার সময় মাথা ছোঁয়ায় লোকে, সে-ভাবেই ছোঁয়াতে হবে।”

    “একদম আক্ষরিক অর্থটাই নিতে হবে বলছিস?” একটা ঘোর-লাগা চোখে আমার দিকে তাকাল তাপস, তারপর বলল, “বেশ, তাই নিলাম।”

    এরপরই ও একটা আশ্চর্য কাণ্ড করল। আরামাকেদারা থেকে নেমে সটান প্রণাম করার ভঙ্গিতে উপুড় হয়ে মাটিতে মাথা ঠেকাল।

    প্রায় পাঁচ-ছ’সেকেন্ড ও-ভাবে থেকে মাথাটা আস্তে আস্তে তুলতে লাগল তাপস, আর ঠিক খানিকটা তুলেই স্থির হয়ে গেল। আমি ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝতে পারলাম কারণটা কী।

    ওর চোখের ঠিক সামনে এখন আরামকেদারার সামনে রাখা ফুটরেস্ট বা পা-দানিটা!

    তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পা-দানিটা নিজের কোলে নিল তাপস। তারপর উলটে ফেলল ওটা। এবারে খেয়াল করলাম যে পা-দানির পাটাতনটা একটু বেশি মোটা, প্রায় ছ’ইঞ্চি। চারিদিকে বর্ডারে সুন্দর কাঠের কাজ করা, ঝালরের মতো। এই বর্ডারটার জন্যই বোঝা যায় না যে পাটাতনটা কতটা পুরু।

    আমার বুকটা ডিজেল ইঞ্জিনের মতো ধক-ধক করছিল। দেখলাম যে এই শীতেও তাপসের কপালে বিন্দু-বিন্দু ঘাম, ওর হাত-পা কাঁপছে।

    পা-দানিটা দু’হাতে তুলে একটু নাড়াল তাপস।

    ভেতর থেকে ভারী কিছু একটা নড়াচড়ার আওয়াজ ভেসে এল। ঠক-ঠক!

    অল্প আলোর মধ্যেই দু’জনে দু’জনের দিকে তাকালাম। তাপসের দৃষ্টিতে উত্তেজনার সঙ্গেও যেটা মিশেছিল সেটা হচ্ছে বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতে যাওয়ার আনন্দ।

    আগেই বলেছি ধাঁধা বা জিগ-স পাজল সলভ করায় তাপসের একটা আশ্চর্য প্রতিভা ছিল। ফলে খুপরিটার দরজাটা যে চারিদিকের বর্ডারের একটা সাইডে, সেটা আবিষ্কার করতে ওর সময় লাগল ঠিক পাঁঁচ মিনিট।

    সেই মুহূর্তটা আমার বহুদিন মনে থাকবে। মনে হচ্ছিল যেন বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা অতুল ঐশ্বর্যের সন্ধান পেয়েছি। কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজা হয়ে যাব। শরীরের সমস্ত রক্ত আমাদের মুখে এসে জমা হয়েছে।

    খুব সন্তর্পণে পা-দানিটা সামান্য কাত করল তাপস।

    প্রথমে বেরিয়ে এল একটা ডায়েরি। চামড়ায় বাঁধানো। সেটা বের করে পাশে রাখল ও। তারপর আরেকটু কাত করল।

    এইবার লাল শালু দিয়ে মোড়া একটা লম্বাটে জিনিস বেরিয়ে এল। খুব ধীরে-ধীরে, অনেক যত্নে লাল শালুটা খুলল তাপস।

    একটা পুঁথি। ওপরে আর নীচে কাঠের মলাট। মাঝখানে হলুদ, বিবর্ণ তালপাতার সারি। মাথার দিকে দু’জায়গায় সোনার সুতো দিয়ে বাঁধা। ওপরের কাঠে আবছা হয়ে এসেছে পুঁথির নাম, লিপিটা আজকালকার বাংলা লিপি বলে বোঝা না গেলেও নামটা পড়তে কষ্ট হল না।

    আবার হৃৎপিণ্ডটা যেন রেলের ইঞ্জিনের মতো দৌড়োচ্ছিল। কাঁপা-কাঁপা স্বরে প্রশ্ন করলাম, “এটা কী তাপস?”

    তাপস ডান হাতের চেটো দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আমার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসল। তারপর চোখ মটকে বলল, “সুবনকেড়ুয়াল।”

    খুব যত্নে পুঁথিটা আবার যেখানে ছিল সেখানে ঢুকিয়ে রাখল তাপস। ডায়েরিটা আমাকে দিয়ে বলল, “এ জ্যেঠুর লেখা ডায়েরি না হয়ে যায় না। আর এ-জিনিস পুঁথির সঙ্গে রাখা আছে মানে জ্যেঠু নিশ্চয়ই ভাইটাল কিছু লিখে রেখেছেন এখানে। তুই এক কাজ কর, এখানে বসে-বসে ডায়েরিটা পুরোটা পড়। আমি ঘণ্টা-দুয়েক বাদে ফিরে আসছি। আর হ্যাঁ, আমরা বোধহয় কাহিনির শেষে এসে পৌঁছেছি। কাল সকালেই এসপার বা ওসপার হয়ে যাবে।”

    “এ কী?” অবাক হলাম আমি, “এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস?”

    বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসিটা আমাকে উপহার দিয়ে গেল তাপস, “ফাঁদ পাততে।”

    তাপস বেরিয়ে যেতে আমি জ্যেঠুর ডায়েরিটা নিয়ে মগ্ন হলাম।

    .

    *

    পরের দিন সকাল প্রায় দশটা। আগের দিন তাপসের ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেছিল। রাতের খাবার খেতে-খেতে আমরা ছকে ফেলেছিলাম আজকের পরিকল্পনা।

    সেই মতো তৈরি হয়ে বসে আছি। ডাইনিং-এর চেয়ারগুলো নিয়ে লাইব্রেরিতে রাখা হয়েছে। আরামকেদারা আর ফুটরেস্টটা রাখা হয়েছে জানালার সামনে।

    ঘড়ির কাঁটা মিলিয়ে ঠিক দশটার সময় দরজায় ঠকঠক শব্দ। দরজা খুলে দেখি গুরুং আর দু’জন কনস্টেবল। তাদের মধ্যে একজন আবার সেই সবসময় চোখে চশমা পরে থাকা পুলিশ জীপের ড্রাইভারটি। ততক্ষণে ওপরে লাইব্রেরিতে সবার বসার ব্যবস্থা করে নিচে নেমে এসেছে তাপস। কনস্টেবল দু’জন বাইরেই রইল, গুরুংকে ওপরে নিয়ে গেল তাপস।

    কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় আবার ঠকঠক। আমিই গিয়ে দরজাটা খুললাম। দত্তসাহেব আর প্রফেসর যাদব। এঁদের অবশ্য আমিই নিয়ে গেলাম লাইব্রেরি রুমে।

    এরা দু’জনে এসে বসতে লাইব্রেরির মধ্যে একটা অস্বস্তিকর আবহাওয়ার সৃষ্টি হল। গুরুংয়ের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে ব্যাপারটা খুব একটা পছন্দ করছে না সে। প্রফেসর যাদবও দেখলাম অদ্ভুত একটা তেতো মুখ করে বসে আছেন। তার মানে দু’জনের মধ্যে কালকে ভালোই কথা কাটাকাটি হয়েছে।

    তবে সেরা চমকটা ছিল এর পরেই। তৃতীয়বারের জন্য সদর দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতে নীচে নেমে দরজা খুলে দেখি দেবাশিসদা!

    দেবাশিসদার মুখে সেই চিরপরিচিত স্মাইল। ভদ্রলোক আমার পিঠ চাপড়ে সহাস্যে বললেন, “কী ভায়া, তোমরা নাকি এখানে কী-সব গোল্ড মাইনের সন্ধান-টন্ধান পেয়েছ, অ্যাঁ? কাল রাতে তোমার ওই তাপস আমাকে যা বলল সে-সব শুনে তো আমি তো এক্কেবারে স্পেলবাউন্ড হে! সে যা বলেছে তার যদি আদ্ধেকটাও সত্যি হয় তাহলে তো কোটি টাকার মামলা, অ্যাঁ?”

    শুনে প্রমাদ গণলাম। তার মানে জ্যেঠুর উধাও হওয়ার ব্যাপারে এঁকে কিছুই বলেনি তাপস। আর গোল্ড মাইনের ব্যাপারটাই বা কী? নাকি এটাও তাপসের পাতা একটা ফাঁদ, পুঁথিটার লোভ দেখিয়ে টেনে এনেছে লোকটাকে?

    তাপস চা বানিয়ে রেখেছিল। নিজের ফ্লাস্ক থেকে গরম চা কাপে ঢেলে সবার হাতে একটা করে কাপ ধরিয়ে দিয়ে বলা শুরু করল ও।

    “জেন্টলমেন, বুঝতেই পারছেন যে আজকে আপনাদের এখানে ডেকে আনার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। গত তিনদিনে এই বাংলোয় এমন দুটো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে যাতে আমি ও আমার বন্ধু হঠাৎ করেই জড়িয়ে পড়েছি। আপনারা প্রায় সবাই জানেন ঘটনাদুটো কী, তবুও পুরো ব্যাপারটা আরও একবার খোলসা করে বলা দরকার।

    ‘আপনারা সবাই জানেন যে আমার জ্যেঠু, অর্থাৎ প্রাক্তন স্কুল শিক্ষক নরনারায়ণ ভট্টাচার্যের হাতে কোনওভাবে একটা অতি দুর্লভ পুঁথি এসে পড়ে, যেটা নাকি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক অমূল্য আবিষ্কার। পুঁথিটা জ্যেঠুর হাতে কী করে আসে সেটা আমরা এখনও জানি না। শুধু এটা জানি যে পুঁথিটা পাওয়ার পরেই জ্যেঠুর পেছনে কেউ বা কারা উঠেপড়ে লাগে। জ্যেঠু তাতে খুব একটা বিচলিত হননি, যতদিন না তাঁর কাছে একটি হুমকি চিঠিও পাঠানো হয়। চিঠিটা পাওয়ার পর জ্যেঠু একটু উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, কারণ উনি চেয়েছিলেন পুঁথিটা যেন কলকাতায় যোগ্য জায়গায় পৌঁছোয়। সেই উদ্দেশ্যেই আমাদের এখানে ডেকে আনা হয়।

    ‘আমরা আসার পরদিনই ম্যালের কাছে একটি লজে তাশি দোরজি বলে একজন খুন হন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, খুন হওয়ার কয়েক-ঘণ্টা আগে এঁকে জ্যেঠুর সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়। জ্যেঠু পরে স্বীকার করেন যে এঁকে জ্যেঠু চিনতেন, চিনতেন কোনও একটি প্রাচীন গুপ্তসংগঠনের সদস্য হিসেবে। বলা বাহুল্য সেই গোপন পুঁথি আর এই গুপ্তসংগঠনের মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে। কিন্তু পুরো ব্যাপারটা জ্যেঠু ডিটেইলসে বলার সময় পাননি। তার আগেই কাল রাতে কেউ বা কারা এসে পুঁথিটার খোঁজে জ্যেঠুর বেডরুমে হানা দেয়, এবং না পেয়ে জ্যেঠুকে কিডন্যাপ করে। তারই সঙ্গে উধাও হয় জ্যেঠুর কাজের লোক লোবসাম।”

    সবাই নেড়েচেড়ে বসলেন। সবার নজর এখন তাপসের দিকে।

    “এখানে বলে রাখা ভালো যে জ্যেঠু আমাদের এত বড় একটা কাজের দায়িত্ব এমনি-এমনি দেননি। আমি আর সুবোধ মিলে এর আগেও কিছু ছোট-খাটো অভিযান করেছি। তাই আমাদের যখন এত ভরসা করে জ্যেঠু ডেকে এনেছিলেন, তখন তাঁকে বিপদের মুখে একলা ফেলে আমরা চলে যেতে পারি না।”

    “তাহলে কি পুলিশের পাশাপাশি আপনারাও গোয়েন্দাগিরি করবেন?” প্রশ্ন করল গুরুং। স্বরে সন্দিহান হওয়ার ছাপ স্পষ্ট।

    “না মিস্টার গুরুং। আমরা গোয়েন্দা নই। আমরা শুধুমাত্র কতগুলো ঘটনা বা তথ্য বিচার করে কয়েকটা সিদ্ধান্তে আসি, আর সেগুলো পুলিশকে জানিয়ে দিই। পুলিশের ওপর আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। শুধুমাত্র তদন্তে সাহায্য করা ছাড়া আমাদের আর কোনও ভূমিকা নেই।”

    উত্তরটা মনে হয় গুরুংকে সন্তুষ্ট করল। একটু সহজ হয়ে বসল সে। তাপস বলতে শুরু করল।

    “আমরা সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হয়েছি যে পুঁথির জন্য এত হাঙ্গামা সেটা এখনও অপরাধীদের হাতে পৌঁছয়নি। পৌঁছলে জ্যেঠুকে কিডন্যাপ করার দরকার হতো না। তাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, পুঁথিটার জন্য অপরাধীরা এই বাংলোয় ফের হানা দেবে।”

    “প্রশ্নই ওঠে না।” গুরুং-এর স্বর শোনা গেল, “কাল বিকেল থেকেই দু’জন কনস্টেবল এই বাড়ির ওপর নজর রাখছে। ওদের সাহস হবে না এই চৌহদ্দিতে ঢোকার। সে মাস্টারসা’ব-এর যত কাছের লোকই হোক না কেন।”

    ইঙ্গিতটা খুব স্পষ্ট। দত্তসাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল তাপস, “আচ্ছা দত্তবাবু, আপনি কোনওদিন জ্যেঠুর মুখে এই ছড়াটা শুনেছেন, ‘মঞ্জুশ্রীর শক্তি পীঠে সোনার তরী গাঁথা/ চাইলে পেতে, হে সন্ধানী, ক্ষণেক ছোঁয়াও মাথা।”

    দত্তসাহেব চোখ বুজে ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ চিন্তা করলেন, তারপর হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “নাহ। মনে পড়ছে না। কেন?”

    নাটকীয় ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল তাপস, তারপর বলল, “তার কারণ কিডন্যাপড হওয়ার আগে জ্যেঠু এই ছড়ার আড়ালে একটি সূত্র কোনওভাবে আমাদের কাছে দিয়ে যেতে সমর্থ হন। এবং সেই সূত্র ধরে কাল সন্ধেবেলা সারা বাড়ি খুঁজে পুঁথিটা আমরা উদ্ধারও করেছি।”

    ঘরের মধ্যে বোম পড়লেও বোধহয় এত চমকাত না লোকে। দত্তসাহেব তো লাফিয়ে উঠলেন, “মানে? ইয়ার্কি হচ্ছে? তোমরা মশকরা করছ আমার সঙ্গে? মশকরা?” তাকিয়ে দেখলাম গুরুং আর প্রফেসর যাদবের চোখেও অবিশ্বাসের ছায়া।

    কঠিনস্বরে ধীরে-ধীরে বলল তাপস, “না দত্তবাবু, আমি আপনাদের সঙ্গে ইয়ার্কি করছি না। পুঁথিটা আমরা সত্যিই খুঁজে পেয়েছি এবং এ-ও বলছি যে সেটা এই মুহূর্তে এই ঘরেই আছে। মুশকিল হচ্ছে যে জ্যেঠুকে খুঁজে পাওয়ার সূত্র না মেলা অবধি সেটা আমি আপনাদের দেখাতে পাচ্ছি না।”

    সারা ঘরে সূচ পড়লেও শোনা যায় এমন নিস্তব্ধতা।

    “এখানে বলে রাখা ভালো, পুঁথির সঙ্গে সঙ্গে আমরা জ্যেঠুর হাতে লেখা একটি ডায়েরিও পাই। তাতে এই রহস্যের অন্য অনেক অজানা দিক জ্যেঠু লিখে রেখে গেছেন। এবার সেগুলো আপনাদের না জানালে বাকি কথাগুলো নিয়ে এগোনোই যাবে না।

    ‘জ্যেঠু তাঁর মা মারা যাওয়ার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিবাগী হয়ে যান। পরলোকতত্ব বা প্রেততত্ব নিয়ে তাঁর মনে আগ্রহ জন্মায়। এই নিয়ে খোঁজ করতে-করতে তিনি এমন এক প্রাচীন বৌদ্ধতান্ত্রিক দলের কথা জানতে পারেন যাঁরা নাকি মৃতদের আত্মাকে জাগ্রত করার পদ্ধতি জানতেন, এবং তার জন্য তাঁরা চক্রসম্বর নামে এক অত্যন্ত ভয়ঙ্করদর্শন দেবতাকে পুজো দিতেন। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে যে এঁরা কোনও মূর্তিপুজো করতেন না। এই চক্রসম্বরের পুজোপদ্ধতি লেখা ছিলো যে পুঁথিতে, সেটাকেই তাঁরা দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন এবং খুব যত্ন করে রক্ষা করতেন। আরও একটি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, এই বৌদ্ধদের গুপ্ত দলটির মধ্যে নাকি এমন আটজন স্পেশ্যালি ট্রেইনড কম্যান্ডোগোছের লোক ছিলেন যাঁদের একমাত্র কাজ ছিল পুঁথিটাকে রক্ষা করা। এঁদের বলা হতো অষ্টমহাসিদ্ধ।”

    এতটা একদমে বলে থামল তাপস। সবার নজর এখন ওর দিকে।

    “এই নিয়ে নাড়াঘাঁটা করতে-করতে জ্যেঠু ওই লাইব্রেরিতেই একজন পণ্ডিত মানুষের সংস্পর্শে আসেন। তিনিও বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস নিয়ে অনেকদিন ধরে গবেষণা করছিলেন। দু’জনের আলাপ ঘনিয়ে আসতে ভদ্রলোক একদিন জ্যেঠুকে জানান যে এই চক্রসম্বরের পুঁথি এবং অষ্টমহাসিদ্ধদের গল্পটা যে অকাট্য সত্যি তার প্রমাণ তাঁর কাছে রয়েছে। বলা বাহুল্য জ্যেঠু তাঁর কথাটা বিশ্বাস করেননি, তাঁকে চ্যালেঞ্জ করেন। তখন ভদ্রলোক এই বিষয়ে জ্যেঠুর আগ্রহ ও নিষ্ঠা দেখে একদিন তাঁর পৈতৃক বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। আর সেদিনই জ্যেঠু জানতে পারেন যে তাঁর পণ্ডিত বন্ধুটিও আসলে সেই অষ্টমহাসিদ্ধদের মধ্যে একজন, এবং শুধু একজন নন, তাদের প্রধান পুরোহিতও বটে!”

    সারা ঘরে আশ্চর্য নিস্তব্ধতা। আড়চোখে একবার সবার দিকে তাকিয়ে নিলাম। নড়াচড়া তো দূরস্থান, কারও চোখের পলক অবধি পড়ছে না।

    “সেখানেই জ্যেঠুকে অষ্টমহাসিদ্ধদের দলের বাকিদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেওয়া হয়। এ-সবের ব্যাপারে অনেক কথাই লেখা আছে ডায়েরিতে। এই অষ্টমহাসিদ্ধদের অনেক গুপ্ত আচার, পদ্ধতি, সাংগঠনিক কার্যকলাপ আর সংকেতের বিবরণ জ্যেঠু দিয়েছেন। এখানে সে-সবের উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই। তবে এ-সবের মধ্যে একটা সংকেত বা চিহ্ন আপনারা অনেকেই গত দু’দিনে একবার না একবার দেখেছেন, সেটা হচ্ছে অষ্টমহাসিদ্ধদের এমব্লেম বা কোট অফ আর্মস। দেখতে ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মতো, মাথার দিকের শুঁড়দুটো একটু বাঁকানো আর মধ্যিখানে একটা স্টার সাইন আঁকা, ওটার নাম বজ্রচিহ্ন। এই বজ্রচিহ্ন আমরা গত তিনদিনে দু’বার দেখেছি। কোথায়-কোথায় দেখেছেন সেটা মনে করতে পারছেন দত্তবাবু?”

    “হ্যাঁ।” চাপা গলায় বললেন দত্তবাবু, “যে হুমকি চিঠিটা নারানকে পাঠানো হয়েছিল তার চার কোনায় এই চিহ্নটা আঁকা ছিল।”

    “কারেক্ট। সেই জন্যই চিঠিটাকে ফাঁকা হুমকি বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি জ্যেঠু। আমাদের ডেকে পাঠান। আর দ্বিতীয়বার এই চিহ্নটা দেখি তাশি দোরজি’র মৃতদেহের পাশে, তাশির রক্ত দিয়ে আঁকা। অতএব যে বা যারা এই পুঁথির ওপর নজর দিয়েছে, তাশি দোরজির হত্যার পেছনে যে তাদের হাতই আছে সেটা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। ওরা নিশ্চয়ই জানতো যে তাশি-র ডেডবডি শনাক্ত করতে জ্যেঠুকে ডেকে আনা হবে। তাই ওই চিহ্নটা এঁকে রাখা, জ্যেঠুকে ওয়ার্নিং দেওয়ার জন্য।” এতটা বলে একবার থামল তাপস। তারপর বলল, “এইখানে আমি মিস্টার গুরুংকে দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করব, যদি কিছু মনে না করেন।”

    গুরুং সপ্রশ্ন চোখে চাইল।

    “তাশি খুন হওয়ার পরে আপনি ওর বডি দেখার আগেই জেনে যান যে সেদিন দুপুরে ম্যালে ওর সঙ্গে জ্যেঠুর কথা হয়। কারেক্ট?”

    “হ্যাঁ, আমাকে আমার ইনফর্মাররা সেরকমই খবর দিয়েছিল।”

    “মানে আপনার ইনফর্মাররা আগে থেকেই তাশির ওপর নজর রাখছিল, ঠিক কি না?”

    “হুম।”

    “কারণটা জানতে পারি?”

    কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে তারপর মুখ খুলল গুরুং, “আজ থেকে দু-সপ্তাহ আগে বেঙ্গল পুলিশের কাছে সিবিআই থেকে একটা নোটিস আসে। তাতে বলা হয় যে এমন একজন কুখ্যাত আর্ট স্মাগলার দার্জিলিংয়ে ঢুকেছে বা ঢুকতে চলেছে যার নাম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঐতিহাসিক সামগ্রী চুরি করায় জড়িত আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এর নামে ইতিমধ্যেই ইন্টারপোলের পক্ষ থেকে রেড কর্নার নোটিশ জারি করা আছে। আমাদের বলা হয়েছিল সতর্ক থাকতে, এমনকি দিল্লি থেকে নাকি একজন সিনিয়র পুলিশ অফিসার দার্জিলিং আসছেন এই সূত্রে। এদিকে আমাদের ইন্টারনাল সোর্স থেকে খবর পাই যে তাশি দোরজি নামের একজন সন্দেহজনক চরিত্রের লোক ভুটান থেকে চোরাপথে নর্থ বেঙ্গলে ঢুকেছে। দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে আমাদের দেরি হয়নি। তাই ওকে চোখে-চোখে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার মধ্যেও যে কে ওকে খুন করে গেল সেটাই বুঝতে পারছি না।”

    “তা এই তাশি দোরজিই যে সেই ইন্টারন্যাশনাল স্মাগলার সে নিয়ে কোনও অকাট্য প্রমাণ ছিল আপনাদের হাতে?”

    “না, তা ছিল না। ইন ফ্যাক্ট কে যে এই মহাপুরুষ, তাঁর নাম ধাম ঠিকানা কী, সে-সব কিছুই আমাদের জানানো হয়নি। ইনি এতই ধূর্ত আর ধড়িবাজ যে সিবিআই-এর কাছে এঁর কোনও ছবি বা অন্য কোনও ইনফর্মেশনই নেই।”

    “হুম। কিন্তু তাশি খুন হওয়ার পরেই জ্যেঠু কিডন্যাপড হন, রাইট? তার মানে তাশি যে-সে লোক নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। অথচ এই গল্পে তাশি-র একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। কারণ জ্যেঠুর ডায়েরি বলছে যে এই তাশি দোরজি হল গিয়ে অষ্টমহাসিদ্ধদের মধ্যে একজন।”

    আবার বোমা বিস্ফোরণ। এবার দেখলাম এমন কি গুরুংয়ের মুখটাও হাঁ হয়ে গেছে।

    “জ্যেঠু যখন এদের দলের মধ্যে আসেন, তখন অষ্টমহাসিদ্ধর মধ্যে চারজনের বেশি কেউ নেই। গুপ্ত সংগঠন ভেঙে চুরমার। একমাত্র যে জিনিসটা রয়ে গেছে সেটা হচ্ছে এই পুঁথিটা। ওই পুঁথিটা তখনও তারা নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি যত্নে রক্ষা করেন।

    ‘জ্যেঠু অনেক চেষ্টায় আর পরিশ্রমে এই দলে ঢোকেন এবং সেই পণ্ডিত মানুষটির স্নেহধন্য হওয়ার সুবাদে দলের প্রায় সেকেন্ড ইন কমান্ড হয়ে ওঠেন। তখনও কিন্তু তিনি পুঁথিটি দেখার বা হাতে নেওয়ার সুযোগ পাননি।

    ‘সে-সুযোগ আসে এক চক্রসাধনার দিন। জ্যেঠুর ডায়েরি অনুযায়ী, বছরে দু’টি পূর্ণিমার দিনে এই চক্রসাধনার আসর বসতো এবং সেইদিনেই পুঁথিটি অষ্টমহাসিদ্ধরা দেখার বা হাতে নেওয়ার সুযোগ পেতেন। জ্যেঠুকে সেই বিশেষ দিনে প্রথমবারের জন্য পুঁথিটি দেখার সুযোগ দেওয়া হয়, এবং তিনি পুঁথিটি হাতে নিয়ে বুঝতে পারেন যে কী ঐশ্বর্য তাঁর হাতে এসে পড়েছে। তখন তিনি সেই পণ্ডিত বন্ধুটি, যাঁকে তিনি এবিডি বলে উল্লেখ করেছেন, তাঁকে প্রস্তাব দেন পুঁথিটিকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের স্বার্থে জনসমক্ষে আনার।”

    এতটা বলে হঠাৎ করে একটা উদ্ভট প্রশ্ন করে বসল তাপস, “আচ্ছা দত্তবাবু, তিনদিন হল আপনার সঙ্গে কথাবার্তা হচ্ছে। কিন্তু আপনার নামটা জানা হল না। কাইন্ডলি আপনার পুরো নামটা একবার জানাবেন প্লিজ?”

    “কেন বলো তো?” ভুরু কুঁচকে পালটা প্রশ্ন করেন দত্তবাবু, “এর সঙ্গে তোমাদের এই গোয়েন্দাগিরির কোনও সম্পর্ক আছে নাকি?”

    “থাকলেও থাকতে পারে, তাই না? কারণ জ্যেঠু বলছেন যেখানে উনি অষ্টমহাসিদ্ধদের দলে যোগ দেন, সেটা ওই এবিডি-র পৈতৃক বাসস্থান। আর সেটা হচ্ছে কুচবিহার রাজবাড়ি। আপনিও তো ওই ফ্যামিলিরই লোক, তাই না?”

    “তাতে কী প্রমাণ হয়?” হঠাৎ করেই তেরিয়া হয়ে উঠলেন দত্তবাবু, “তোমার বক্তব্যটা কী হে ছোকরা, কুচবিহার রাজবাড়িতে ঘটা সমস্ত ঘটনার দায়ভার কি আমার?”

    “না দত্তবাবু, আমি তো সেই দাবি করিনি। শুধু আপনার পুরো নাম জানতে চেয়েছি। সেটা জানাতে আপনার এত আপত্তি কেন?”

    “তা আপনি হঠাৎ করে ওঁর পুরো নাম জানতে চাইছেনই বা কেন, সেটা জানতে পারি কি?” শান্ত ও ইস্পাতকঠিন স্বরে কথাটা বললেন প্রফেসর যাদব।

    “কারণ যে পণ্ডিত মানুষটি জ্যেঠুকে এই অষ্টমহাসিদ্ধ’র দলে নিয়ে আসেন, তিনিও কুচবিহার রাজবাড়ির সন্তান। তাঁর নাম হচ্ছে অব্যয়বজ্র দত্ত, এ বি ডি। আমি খোঁজখবর করে জেনেছি যে উনি আপনার নিজের বড় দাদা। আর আপনার নাম হচ্ছে…”

    “অদ্বয়বজ্র দত্ত।” শান্ত স্বরে বললেন দত্তবাবু।

    সঙ্গে-সঙ্গে গুরুংয়ের হাত চলে গেল কোমরে রাখা হোলস্টারে। সেদিকে তাকিয়ে হাত তুলে গুরুংকে শান্ত হতে ইশারা করল তাপস।

    “শুধু তাই নয় দত্তবাবু, নারানজ্যেঠু-র সঙ্গে আলাপ জমানোর পেছনে আপনার আসল উদ্দেশ্যটা এবার একটু খুলে বলবেন প্লিজ?”

    খানিকক্ষণ স্থির চোখে তাপসের দিকে চেয়ে রইলেন দত্তবাবু। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন অনেক কষ্ট করে ভেতরে থাকা আবেগটাকে চেপে রাখার চেষ্টা করছেন তিনি। তাঁর মুখটা রাগে, ঘৃণায় আর কষ্টে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল। তবে সে কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরেই চেয়ারের হাতলে একটা ঘুঁষি মেরে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি, “এই নরনারায়ণ ভট্টাচার্য, দ্যাট স্কাম অন আর্থ, আমার দাদার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পুঁথিটা আমাদের রাজবাড়ি থেকে চুরি করে নিয়ে পালায়। আমি সেই সময়টা দিল্লিতে ছিলাম, তাই কিছু করতে পারিনি। এই শয়তানটা তারপর উধাও হয়ে যায়, উইদাউট এনি ট্রেস। ওর জন্য আমার দাদা আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়, আমাদের দল ছত্রখান হয়ে যায়। আমি গত সাতটা বছর ধরে পাগলের মতো খুঁজে বেড়িয়েছি লোকটাকে…”

    “আর তারপর এখানে এসে তিনমাস আগে নারানজ্যেঠুর খোঁজ পান, রাইট?” ধারালো প্রশ্ন ছুটে এল তাপসের দিক থেকে, “তারপরেই এখানে বাসা নেওয়া, জ্যেঠুর সঙ্গে আলাপ জমানো, লোবসামকে কাজে ঢোকানো, এ-সবই শুরু হয়, ঠিক কি না?”

    জ্বলন্ত চোখে তাপসের দিকে তাকিয়ে ফুঁসছিলেন দত্তবাবু। অসহ্য রাগে তাঁর ফর্সা মুখখানা টকটকে লাল হয়ে উঠেছিল। তারপরেই নিজের মুখখানা দু’হাতে ঢেকে মাথা নিচু করে ফেললেন তিনি।

    সেদিকে আমল দিল না তাপস। শুধু গম্ভীরমুখে বলল, “আমি এ-ব্যাপারে প্রায় পুরোটাই অনুমান করতে পেরেছি দত্তবাবু। এবং আমি এ-ও জানি যে তাশির খুনটা আপনি করেননি, আর জ্যেঠুকে কিডন্যাপ করার তো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ শেষ অবধি আপনি একজন সিভিলিয়ান, ক্রিমিনাল নন। আপনি শুধু চেয়েছিলেন লোবসামকে দিয়ে জ্যেঠুর ওপর গোয়েন্দাগিরি করাবেন, যাতে পুঁথিটা উদ্ধার করা যায়, তাই তো? চিঠিটাও যে আপনারই কীর্তি সেটা বুঝতেও বেশি মাথা লাগাতে হয় না। কারণ আর যাই হোক, বাংলা ভাষার ইতিহাসের ওপর আপনার ইন্টারেস্টটা খাঁটি। আপনি যে চর্যাপদের ভাষায় চিঠি লিখতে ভালোই পারেন সেটা আপনার ওই দুই পিরিয়ডের মধ্যবর্তী ভাষায় পদ রচনা করতে পারা দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু যেটা আপনি বুঝতে পারেননি সেটা হচ্ছে যে আপনার এনগেজ করা এজেন্ট শ্রীমান লোবসাম কবেই তলে-তলে ভিড়ে গেছে কুমিরের সঙ্গে।”

    “কুমির?” বিস্ময় ফুটে উঠল দত্তবাবুর স্বরে, “এখানে কুমিরের কথা এল কী-করে?”

    “যে কুমিরটাকে আপনি খাল কেটে ঘরে এনেছেন দত্তবাবু।” ধারালো গলায় বলল তাপস, “তাশি-র খুন থেকে শুরু করে জ্যেঠুর কিডন্যাপ অবধি সবই যাঁর অসামান্য প্রতিভার সামান্য নিদর্শন।”

    “কিন্তু তাহলে লোবসাম আছে কোথায় এখন?” বিভ্রান্তস্বরে প্রশ্ন করলেন দত্তবাবু।

    “সেটা বলা খুব মুশকিল দত্তবাবু। খুব সম্ভবত গত রাতে বাংলোতে আততায়ীদের ঢোকার ব্যবস্থা সে-ই করে দেয়, এবং সেটাই ছিল তার লাস্ট ডিউটি। আমার ধারণা হচ্ছে এর পরেই তাকে গোপনে কোথাও একটা পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, অথবা কাজ ফুরিয়ে যাওয়ার পর তাকে আর তার নতুন মালিক বাঁচিয়ে রাখা সমীচীন মনে করেননি। হয়তো তার দেহটা পড়ে আছে এই দার্জিলিংয়েরই কোনও খাদের নীচে।”

    “আর ইউ শিওর অ্যাবাউট ইট?” প্রশ্ন করল গুরুং।

    “না, আমি শিওর নই, এ আমার যুক্তিনির্ভর অনুমান। তবে এটুকু বলতে পারি এ-সব ব্যাপারে আজ পর্যন্ত আমার কোনও অনুমান ভুল প্রমাণিত হয়নি মিস্টার গুরুং।”

    “আর পুঁথিটা… ওটা কোথায় আছে?” শক্ত গলায় কথাগুলো বলে সোজা হয়ে বসলেন দত্তবাবু ওরফে শ্রীঅদ্বয়বজ্র দত্ত, “ওটা আমার চাই… ওটা দত্ত ফ্যামিলির এয়ারলুম।”

    তাপসের ঠোঁটের কোণে ফের সেই বাঁকা হাসিটা ফিরে এল, “ওটা এখন দেশের সম্পদ দত্তবাবু, আপনার ফ্যামিলি এয়ারলুম নয়। তবে সত্যি কথাটা স্বীকার করার জন্যে আপনাকে ধন্যবাদ।” বলে এবার প্রফেসর যাদবের দিকে ফিরল তাপস, “আপনি জে এন ইউতে কোন বিভাগে পড়ান প্রফেসর যাদব?”

    “হিস্ট্রি। মিডেইভাল পিরিয়ড ইন ইন্ডিয়ান হিসট্রি।” দেখলাম যে কথাটা বলতে-বলতে প্রফেসর যাদবের চোয়ালটা অল্প শক্ত হয়ে উঠল।

    “সত্যিই কি তাই?”

    “কেন বলো তো?” প্রশ্ন করলেন দত্তবাবু, “এতে আবার সন্দেহ করার কী পেলে?”

    “কারণ আমার চেনা এক ভদ্রলোক জেএনইউ-তে পড়ান, ইকোনমিক্স। তিনি ইউনিভার্সিটিতে তন্নতন্ন করে খবর নিয়ে আমাকে জানিয়েছেন যে যোগেন্দ্র যাদব নামে হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে কেউ পড়ান না, ৱ্যাদার গোটা ইউনিভার্সিটিতেই ওই নামে কোনও প্রফেসর নেই।”

    কথাটা শুনে প্রত্যেকের মাথা ঘুরে গেল প্রফেসর যাদবের দিকে। তবে মানতেই হবে যে ভদ্রলোকের নার্ভটা স্টিলের তৈরি, তিনি পালটা চ্যালেঞ্জ করে বসলেন, “আপনি কী বলতে চাইছেন মিস্টার তাপস, আমি মিথ্যে কথা বলেছি আপনাদের?”

    প্রফেসর যাদবের দিকে তাকিয়ে ধীরে-ধীরে ঘাড় নাড়ল তাপস। তারপর বলল, “আপনি ঠিক মিথ্যেবাদী নন। এই ব্যাপারে আরও অনেক তথ্য যোগাড় করেছি আমি। আমার ডেটা সোর্স বলছে যে আজ থেকে প্রায় বছর আটেক আগে যজুবেন্দ্র যাদব নামে একজন তরুণ শিক্ষক জেএনইউ-র হিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে জয়েন করেন। ভদ্রলোকের জন্ম-কর্ম-পড়াশোনা সবই কলকাতায়, রেজাল্টও ব্রিলিয়ান্ট। পড়ানোর গুণে তিনি খুব দ্রুত ছাত্র ও অন্যান্য শিক্ষকদের আস্থাভাজন ও প্রিয় হয়ে ওঠেন। পুরোনো পুঁথি আইডেন্টিফাই বা সার্টিফাই করার ব্যাপারে আশ্চর্য প্রতিভা ছিল ভদ্রলোকের, গোটা দেশে এই সার্কিটে ওঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না। সেই বাবদে ভদ্রলোককে দেশের বিভিন্ন মিউজিয়াম ঘুরে বেড়াতে হত।

    ‘এর মধ্যে হঠাতই কলকাতার ন্যাশনাল মিউজিয়াম থেকে গুপ্তযুগের একটা রেয়ার স্বর্ণমুদ্রা চুরি যায়। ব্যাপারটা পেপারেও বেরিয়েছিল, জানি না আপনাদের মনে আছে কি না। অনেক তদন্তের পর পুলিশ বের করে যে এর পেছনে একটি ৱ্যাকেট আছে এবং তার মাথা হিসেবে চিহ্নিত করে জেএনইউ-র সেই তরুণ অধ্যাপককে। ভদ্রলোকের জেল হওয়া অবধারিত ছিল, কিন্তু পুলিশের কাস্টডি থেকে আশ্চর্যজনক ভাবে উধাও হয়ে যান সেই প্রতিভাবান ইতিহাসবিদ। তারপর থেকে আজ অবধি তাঁর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। আমার চেনা সেই ভদ্রলোক এ-ও বলেছেন যে এই যজুবেন্দ্র যাদব প্রায় বারোটা দেশি-বিদেশি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন, অন্যের গলার স্বর হুবহু নকল করতে পারতেন, আর ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে কোনও এক নাটকে নাকি একেবারে নিখুঁত ছদ্মবেশ ধারণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। অত্যন্ত প্রতিভাবান ক্রিমিনাল বলতে হবে।”

    প্রফেসর যাদবের চোখে এতদিন ধরে ঝুলে থাকা উদাস, প্রফেসরসুলভ দৃষ্টিটা বদলে যাচ্ছিল রাগে আর তাচ্ছিল্যে। ঠোঁটটা সামান্য বাঁকিয়ে বলে উঠলেন তিনি, “আপনার কথা বুঝতে পারছি না তাপসবাবু। আপনি কী ইন্ডিকেট করতে চাইছেন? আমিই সেই গড নো’জ হু যজুবেন্দ্র যাদব? এইসব খুনজখম আর কিডন্যাপিং-এর পেছনে আমার হাত আছে?”

    “যদি তা নাই বা হবে যোগেন্দ্রবাবু, প্রফেসর শব্দটা আর ব্যবহার করলাম না…” বলে সামনের দিকে প্রায় ঝুঁকে এল তাপস, “একটা কথার জবাব দিন তো, কাল যখন আমরা থানা থেকে মিস্টার গুরুংকে নিয়ে আসছি, তখন আপনারা দু’জন এই বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আপনারা জিজ্ঞেস করলেন বাড়িতে লোক নেই কেন, কী হয়েছে। আমি জবাব যে দিলাম জ্যেঠুকে সকাল থেকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আপনার উত্তরটা কী ছিল মনে আছে?”

    প্রফেসর যাদব উত্তর দিলেন না। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল যেন কোনও বিষধর কেউটে সাপ ফণা মেলার ঠিক আগের মুহূর্তে ফুঁসছে।

    সেদিকে দৃক্পাত করল না তাপস। অল্প হেসে বলল, “আপনি বললেন, ‘অ্যাঁ? সে কী? নারায়ণবাবুকে ধরে নিয়ে গেছে? কারা? কেন? কী-করে?’ এবার বলুন তো যোগেন্দ্র ওরফে যজুবেন্দ্র যাদব, আমি তো একবারও বলিনি যে জ্যেঠু কিডন্যাপড হয়েছেন। সকাল থেকে খুঁজে না পাওয়ার তো আরও অনেক মানে হয়, তাই না? ধরে নিয়ে যাওয়ার কথাটাই বা আপনার মাথায় এল কেন?”

    স্প্রিং লাগানো পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়তে যাচ্ছিলেন যোগেন্দ্র, ওরফে যজুবেন্দ্র যাদব। তাঁকে আটকাল গুরুং। কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল, “আপনি একজন রেসপেক্টেড প্রফেসরের বিরুদ্ধে যে-সব গাঁজাখুরি অভিযোগ আনছেন, সে-সব প্রমাণ করতে পারবেন তো?”

    দৃশ্যটা খানিকক্ষণ দেখে তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল তাপস। আস্তে-আস্তে ক্ল্যাপস দিতে দিতে বলল, “বাহ বাহ, শাবাস। এই না কালকেই আপনাদের মধ্যে থানায় চুলোচুলি থেকে শুরু করে হাতাহাতি হতে যাচ্ছিল? আর এখন তো এক রেসপেক্টেড প্রফেসরের প্রতি আপনার ভালোবাসা তো একেবারে টইটম্বুর দেখছি মিস্টার গুরুং! তা আপনাদের মধ্যে কবে থেকে এ-রকম ভাব-ভালোবাসা চলছে শুনি? অন্তত মাস তিনেক তো হবেই, তাই না?”

    গুরুংকে দেখে মনে হল পারলে এখনই হোলস্টারে রাখা রিভলবারটা বের করে তাপসকে গুলি করে দেয় আর কি! অতি কষ্টে রাগ প্রশমিত করে দাঁঁতে দাঁত ঘষে সে, “কবে থেকে ভাব-ভালোবাসা মানে? ঠিক কী বোঝাতে চাইছেন একটু খুলে বলবেন তাপসবাবু? আমি তিন মাস ধরে ওঁকে চিনি?”

    “চেনেন না? সত্যিই?” অবাক হওয়ার ভান করল তাপস। তারপর ধারালো স্বরে বলল, “তবে পুরো গল্পটাও না-হয় আমিই বলি? আপনারা না-হয় মাঝখানে ভুল হলে শুধরে দেবেন, কেমন?

    ‘আমাদের দত্তবাবু অনেক খুঁজে-খুঁজে মাস তিনেক আগে দৈবাৎ নারানজ্যেঠুর খোঁজ পান। নারানজ্যেঠু আগে এঁকে চিনতেন না, কোনওকালে দেখেনওনি। তবে ইনি কিন্তু নারানজ্যেঠুকে চিনলেন, কী করে সেটা জানার বিষয় বটে। আমার ধারণা অব্যয়বজ্র দত্ত আত্মহত্যা করার আগে নারানজ্যেঠুর নাম ঠিকানা, ফটো, মায় ঠিকুজি-কুষ্ঠী সবই জানিয়ে দিয়ে গেছিলেন নিজের ভাইকে। সেই সূত্র ধরেই দত্তবাবু অনেক ঘুরে-ফিরে খবর-টবর নিয়ে এই লেবংয়ে এসে আমাদের নারানজ্যেঠুকে স্পট করলেন।

    ‘এর আগে কিন্তু দত্তবাবু একজন শখের ইতিহাসবিদ হিসেবে মোটামুটি নাম কিনেছেন। এইভাবেই কোনও একটা সূত্রে ওঁর সঙ্গে আলাপ হয় প্রফেসর যাদবের। যজুবেন্দ্র তখন বোধহয় যোগেন্দ্র অবতারে বিরাজ করছিলেন। প্রতিভাবান ক্রিমিনালদের একটা বড় গুণ হচ্ছে খুব সহজে লোকের আস্থা অর্জন করে নেন। আমাদের দত্তবাবুও সেই ফাঁদে পড়লেন। একই সাবজেক্টের পণ্ডিত লোক পেয়ে বোধহয় খেয়াল করেননি কতটা বলা উচিত আর কতটা বলা উচিত নয়। একদিন কোনও বিষয় আলোচনা চলতে-চলতে যজুবেন্দ্র ওরফে যোগেন্দ্রকে হড়হড় করে সব বলে দিলেন, মায় তাঁর ফ্যামিলি এয়ারলুমের কথাটি।

    ‘এই চক্রসম্বরের পুঁথি-র কথা শোনামাত্র যজুবেন্দ্র বুঝতে পারে যে কতবড় একটা দাঁও এখন তার হাতের কাছে। ততদিনে সে ইন্টারন্যাশনাল আর্ট স্মাগলার হিসেবে কুখ্যাত হয়ে উঠেছে, তার নামে ইন্টারপোলের হুলিয়া বেরিয়েছে। তার উচিত ছিল কয়েকদিন গা-ঢাকা দিয়ে থাকা। কিন্তু শাস্ত্রে বলেছে নিয়তি কেন বাধ্যতে! সে চট করে তার পুরোনো নেটওয়ার্ক অ্যাক্টিভেট করে। পুলিশ-প্রশাসনের মধ্যেও নিশ্চয়ই তার চর আছে। নইলে এতদিন ধরে সে গ্রেফতারি এড়িয়ে থাকছে কী করে? সেইভাবেই সে এমন একজনের সঙ্গে যোগাযোগ করে যাকে কেউ সন্দেহ করবে না। এবং সেই মানুষটি হচ্ছেন আপনি, মিস্টার গুরুং।”

    “এ-সবের কোনও প্রমাণ আছে গোয়েন্দামশাই?” গুরুংয়ের শক্ত চোয়ালে যে বাঁকা হাসিটা ঝুলছে তার কতটা যে রাগ আর কতটা তাচ্ছিল্য বোঝা মুশকিল।

    “আছে বই কি! নইলে আর সামনে দাঁড়িয়ে এতগুলো কথা বলছি কী করে? তা এতটাই যখন শুনলেন, কষ্ট করে না হয় বাকিটাও শুনে নিন, কোথাও ভুল হলে আপনারা দুই পার্টনার ইন ক্রাইম মিলে একটু শুধরে দেবেন কিন্তু, ওকে?

    ‘প্ল্যানটা দু’জনে মিলে যত্নেই সাজিয়েছিলেন কিন্তু। প্রথমে লোবসামকে হাত করা হয়, খুব সম্ভবত অবৈধ ভাবে এ-দেশে বসবাস করার অভিযোগে তাকে জেলে পাঠানো হবে, এই ভয় দেখিয়ে। সে-বেচারা ডাবল এজেন্ট হয়ে গেল, একই তথ্য দু’জায়গায় সরবরাহ করতে লাগল, দত্তবাবুকে আর আপনাকে।

    ‘এদিকে দত্তবাবু অনেক চেষ্টা করেও পুঁথিটার কোনও খোঁজ না পেয়ে অধৈর্য হয়ে ওঠেন। ওই হুমকি চিঠিটা তারই ফলশ্রুতি। চিঠিটা পাওয়ার পর জ্যেঠু পুঁথিটার নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তায় পড়েন। এদিকে ততদিনে পুঁথিটা নিয়ে তাঁর অ্যাকাডেমিক কাজ শেষ। ওটা তাঁর হাতে রেখে আর লাভ নেই। তাই তিনি আমাদের ডেকে আনেন ওটাকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য। খবরটা লোবসাম যথারীতি আপনাদের পৌঁছে দেয়। আপনারাও বুঝতে পারেন যে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আগত। পুঁথিটা এবার তার গোপন লুকোনোর জায়গা থেকে সামান্য হলেও প্রকাশ্যে আসবে। অন্ততপক্ষে এই বাংলোতে তো বটেই, নইলে পরেরদিন জ্যেঠু ওটা আমাদের হাতে তুলে দেবেন কী করে? তাই সেই রাতেই পুঁথিটা সরাবার প্ল্যান হয়। লোবসামই বোধহয় খবর দেয় যে পুঁথিটা জ্যেঠুর শোওয়ার ঘরেই আছে।

    ‘কিন্তু সেই মুহূর্তে সিনে এন্ট্রি নেয় আরেকজন যার আগমন আপনাদের পুরো প্ল্যান চৌপাট করে দেওয়ার উপক্রম করে। তাশিও বোধহয় দত্তবাবুর মতই নারানজ্যেঠুকে অনেকদিন ধরে খুঁজছিল, এবং শেষ পর্যন্ত সে-ও দার্জিলিংয়ে আসে পুঁথিটা নারানজ্যেঠুর কাছ থেকে উদ্ধার করতেই। আমার ধারণা সেদিন ম্যালে সেই নিয়েই কথা-কাটাকাটি হচ্ছিল দু’জনের মধ্যে।

    ‘যে-মুহূর্তে তাশি-র সঙ্গে জ্যেঠুর দেখা হওয়ার কথা গুরুংয়ের ইনফর্মাররা গুরুংকে জানায়, সেই মুহূর্তে গুরুং এই তাশির সমস্ত ডিটেইলস যোগেন্দ্রকে পাঠিয়ে দেন। যোগেন্দ্র বোঝেন যে পুঁথিটার আরেকজন দাবিদার এসে উপস্থিত। তাশি দোরজি যে অষ্টমহাসিদ্ধদের মধ্যে একজন, সে-খবরটা নিশ্চয়ই দত্তবাবুই জানিয়েছিলেন যোগেন্দ্রকে। এদিকে সব প্ল্যান নিখুঁতভাবে ছকে ফেলা হয়েছে, পিছিয়ে আসার উপায় নেই। ফলে তাশিকে মরতে হল। কী ইনসপেক্টর সাহেব, ঠিক বলছি তো?”

    “তাপসবাবু, ভুলে যাবেন না যে আপনি একজন সরকারি অফিসারের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আনছেন। যদি প্রমাণ না করতে পারেন, আপনাকে কিন্তু এর ফল ভুগতে হবে।” গুরুং এর স্বরে হুমকির সুরটা স্পষ্ট।

    “মিস্টার গুরুং, আপনি যে সরকারি অফিসার, তার ওপর অতি বুদ্ধিমান মানুষ -সে আমরা জানি। মুশকিল হচ্ছে গত কয়েকদিনে আমাদের সামনে অন্তত দু’বার এমন কিছু বেফাঁস বলেছেন বা করেছেন যা আপনার মুখোশ খুলতে আমাদের খুবই সাহায্য করেছে। শুনবেন নাকি সেগুলো?”

    কোনওদিকে ঘাড় নাড়াবার ইচ্ছে বা সময় কিছুই ছিল না আমার। তবুও মনে হল আমার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এলাকার মধ্যে যেন কী একটা সূক্ষ্ম পরিবর্তন হল। কারও বসার ভঙ্গিমায় একটু অতিরিক্ত সতর্কতা, শ্বাসপ্রশ্বাস একটু ধীর হয়ে আসা… আর তারই সঙ্গে… কোথাও থেকে চাপা এবং সতর্ক বুটের আওয়াজ ভেসে এল কি?

    “খেয়াল করে দেখুন মিস্টার গুরুং, যোগেন্দ্র ওরফে যজুবেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনার আলাপ হয় গত পরশু, এই বাড়িতে। আপনার সঙ্গে ওঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় প্রফেসর যাদব বলে। ওঁর নাম যে যোগেন্দ্র, সেটা আমরা জানতে পারি যখন ওঁরা বেরিয়ে যাচ্ছিলেন তখন, তার অনেক আগেই আপনি বেরিয়ে গেছেন। অথচ গতকাল যখন জ্যেঠুর ঘর সিল করার পর আপনি যখন দত্তবাবুকে থানায় হাজিরা দিতে বললেন, তখন আপনি ওঁকে কী বলে সম্বোধন করলেন? যোগেন্দ্রজি বলে, তাই না? আপনি কি কাইন্ডলি জানাবেন, কী করে এক রাতের মধ্যে আপনি ওঁর ফার্স্ট নেম জেনে ফেললেন?”

    সমস্ত ঘরে বজ্রগর্ভ পরিস্থিতি। দত্তবাবু স্থাণু হয়ে বসে আছেন, যোগেন্দ্র ওরফে যজুবেন্দ্র-র মুখে শীতল ক্রোধ, আর হিংসার ছায়া। আড়চোখে দেখলাম যে ভদ্রলোকের ডান হাতটা ক্রমশ গুটিয়ে ওঁর কোমরের দিকে আসছে। গুরুং খর চোখে চেয়ে আছে তাপসের দিকে, তার চোখে যে দৃষ্টি, সেটাকে খুনে দৃষ্টি বললে কম বলা হয়।

    তবে শুধু এই নয়। আমার ইন্দ্রিয়ের ৱ্যাডারে আরও কয়েকটা ইঙ্গিত ধরা পড়ল। যেমন মনে হল বেশ কিছু পায়ের শব্দ ঘিরে ধরেছে এই ঘরটাকে, আকাশে এতক্ষণ ভেসে থাকা আধখানা চাঁদের আলো যেন হঠাৎ করেই কিছুটা চাপা হয়ে এল। কোথা থেকে যেন বেশ কয়েকজনের নিঃশ্বাস বন্ধ করার শব্দ, অতি ক্ষীণভাবে সতর্ক হওয়ার আওয়াজও পেলাম।

    আমার শরীরের প্রতিটি পেশী টানটান হয়ে এল। মাথার মধ্যে কে যেন ফিসফিসিয়ে বলে গেল, “বিপদ আসছে, বিপদ।”

    তাপস অবশ্য সে-সব খুব একটা খেয়াল করল বলে মনে হল না। সে বলেই যেতে থাকল, “শুধু এই নয় মিস্টার গুরুং, আমার কবে থেকে আপনার ওপর সন্দেহ হল জানেন? এখানে আসার পর দ্বিতীয় দিনের শেষে একটা খটকা আমার মাথায় গেঁথে ছিল, যেটা আমি শত চেষ্টাতেও ভুলতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল কেউ যেন এমন একটা বেফাঁস কথা বলেছে যেটা লজিক্যালি কারেক্ট হতে পারে না। কাল যে মুহূর্তে আপনি আপনার পুরোনো স্যাঙ্গাতকে যোগেন্দ্রজি বলে ডাকলেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সেই আগের খটকাটাও ক্লিয়ার হয়ে গেল। আর আপনি, এত যত্নে জাল বিছোনো সত্ত্বেও আপনি ধরা পড়ে গেলেন।”

    কারও চোখে কোনও পলক পড়ছে না। তবু খেয়াল করলাম গুরুং আর যাদব, দু’জনের বসার ভঙ্গি সম্পূর্ণ পালটে গেছে।

    এবং দেবাশিসদা। স্থির এবং ঋজু ভঙ্গিতে বসে আছেন। এখনও বুঝতে পারছি না এখানে ওঁর ভূমিকাটা ঠিক কী।

    “প্রথম দিন যখন জ্যেঠু আপনাকে চিঠিটা হুমকি চিঠিটা দেখান, তখন আপনি বলেছিলেন যে ‘আপনাকে থ্রেট দিয়ে এ-সব চিঠি কে পাঠাবে? না আপনি কোনও বড় বিজনেসম্যান, না আপনি কোনও খাজানার মালিক হয়ে বসেছেন।’ যেন তখনও আপনি পুঁথিটার কথা জানেন না। অথচ পরের দিনই, তাশি দোরজির বডি দেখে এখানে যখন আমরা কথাবার্তা বলছি, জ্যেঠু পুঁথিটার কথা উল্লেখ করা-মাত্র আপনি বললেন, ‘এটাই কি সেই পুঁথি যেটা নিয়ে আপনাকে হুমকি চিঠি পাঠানো হচ্ছে?’ এবার কাইন্ডলি এক্সপ্লেইন মিস্টার গুরুং, কোন অলৌকিক উপায়ে আপনি এক রাতের মধ্যেই জেনে গেলেন যে কোনও একটা পুঁথি নিয়েই…”

    তাপসের কথা শেষ হওয়ার আগেই চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল গুরুং, হাতে উদ্যত রিভলভার। যোগেন্দ্র ওরফে যজুবেন্দ্র যাদব অবশ্য বসেই রইলেন তাঁর সিটে, তাঁর হাতেও এতক্ষণে উঠে এসেছে নাক ভোঁতা একটা বিদেশি পিস্তল। চুক-চুক করতে প্রথম কথাটা তিনিই বললেন, “বাঙালিদের এই একটা দোষ, বুঝলে গুরুং, এরা বড্ড বেশি বোঝে। আরে বেওকুফ, এতই যদি তোর বুদ্ধি হবে তো তোর জ্যেঠুর কাছ থেকে পুঁথিটা ঝেঁপে দিয়ে আমাদের সঙ্গে সওদা করবি তো আগে। তাতে তোরও কিছু ফায়দা হত, আমাদেরও কিছু ফায়দা হত। কী বলো গুরুং?”

    আমার শরীরের প্রতিটি পেশী টানটান হয়ে উঠেছিল। খুব সতর্ক ভাবে বডিটাকে ডানদিকে হেলিয়ে রাখলাম, যাতে দরকার পড়লে বাঁ-দিকে জাম্প করতে পারি। আড়চোখে দেখলাম দত্তবাবুর চোয়ালও ঝুলে পড়েছে। তবে তাপস কিন্তু এখনও দাঁড়িয়ে আছে, হাসিটাও অমলিন, যেন ও জানতই যে এই ঘটনাটা হবে। একমাত্র দেবাশিসদা-ই দেখলাম চোখ বুজে আছেন।

    “তাহলে স্বীকার করছেন যে তাশির খুন আর জ্যেঠুর কিডন্যাপ, এর পেছনে আপনাদেরই হাত আছে, রাইট?” তাপসের গলায় এখনও যে কনফিডেন্সের সুর বাজছে, তার উৎস কোথায় আমি জানি না।

    “অফ কোর্স ইয়েস, সে-কথাটা বুঝতে তোমার মাছ-ভাত-খাওয়া মাথা এত সময় নিল ব্রাদার?” হাতে রিভলবারটা নাচিয়ে বিশ্রীভাবে হাসল গুরুং। ওকে চেনাই যাচ্ছিল না এখন।

    “সে তো বটেই, নইলে আর পুলিশের নজরে থাকা অবস্থাতেও তাশি দোরজি খুন হয় কী করে, যদি না তার পেছনে পুলিশের কারও হাত থাকে? তা খুনটা তো নিজের হাতে করেননি নিশ্চয়ই, কাকে দিয়ে করালেন? আপনার ওই দুই কনস্টেবলের কাউকে দিয়ে, যারা এখন নীচে দাঁড়িয়ে পাহারা দিচ্ছে?”

    “হ্যাঁ হ্যাঁ আপনি ঠিক বলছেন বটে।” ধীরেসুস্থে এবার উঠে দাঁড়ালেন শ্রীযোগেন্দ্র যাদব, হাতের উদ্যত পিস্তলটা সোজা তাপসের বুকের দিকে তাক করা, “তবে কিনা সে-সব আলোচনা না-হয় আমাদের ডেরাতেই হবে কেমন?”

    “তা আপনাদের ডেরাটা কোথায় মিস্টার যাদব?” এতক্ষণ চুপ থাকার পর এই প্রথম বারের জন্য মুখ খুললেন দেবাশিসদা, “গুরুংয়ের বাংলোয়? যেখানে মিস্টার নরনারায়ণ ভট্টাচার্যকে কিডন্যাপ করে রাখা হয়েছে? বেঙ্গল পুলিশ সারা দার্জিলিং খুঁড়ে ফেললেও যেখানে ঢুকেও দেখবে না? অবশ্য সেখানে এখন সিবিআইয়ের লোকজন আপনার পোষা কুত্তাদের ছাল ছাড়াচ্ছে।”

    তাকিয়ে দেখলাম গুরুং এর হাত কাঁপছে, হয় রাগে অথবা ভয়ে। সম্ভবত দুটোতেই। “ইউ ব্লাডি সোয়াইন, হাউ কুড ইউ…” বলে রিভলবারটা দেবাশিসদার দিকে তুলল গুরুং।

    এবার অতি ধীরে এবং শান্তস্বরে উঠে দাঁড়ালেন দেবাশিসদা। তাঁর চাউনি, দাঁড়ানোর ভঙ্গি, মুখের ভাব, সবই বদলে গেছে। কঠিন ইস্পাতের ওপর বিষাক্ত মধু ঢেলে বললেন তিনি, “হাউ কুড আই? কারণ গুরুংবাবু, তুমি বাংলায় পড়াশোনা করলেও কোনওদিন বাংলার বাচ্চাদের সঙ্গে কানামাছি খেলোনি, তাই না? কানামাছি ভোঁ ভোঁ, যাকে পাবি তাকে ছোঁ… কোনওদিন খেলেছো গুরুং? আমার লোকেরা কিন্তু এখন তোমার বাংলোর প্রতিটি ইঞ্চি খুঁড়ে দেখছে…”

    গুরুং অবশ্য অত কথায় কান দিল না, দাঁত চেপে আদেশ দিল, “স্টপ ওয়েস্টিং আওয়ার টাইম, বাগারস। পুঁথিটা চুপচাপ বের করে আমাদের হাতে দাও, ওটা আমাদের চাই, এক্ষুনি। মুভ শার্প বাঙালিবাবু, নইলে তোমাদের চারজনের জন্য আবার বারোখানা বুলেট খরচা করতে হবে আমাদের। হারি আপ, আমাদের টিম নীচে ওয়েট করছে গাড়ি নিয়ে, উই নিড টু মুভ নাউ।”

    আমার শরীর তৈরি হয়েই ছিল। আগেও লক্ষ করেছি, এ-সব ক্ষেত্রে মগজ থেকে পেশীতে নির্দেশ যাওয়ার আগেই আমার হাত আর পা কাজ করতে শুরু করে। ওরা অত্যধিক উত্তেজনার জন্য সামান্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে বুঝেই আমার পুরো ভরটা ডান কাঁধে শিফট করে শরীরটা ক্লকওয়াইজ ঘুরিয়ে দিলাম, বাঁ পা-টা উঁচু করে। সেটা গুরুংয়ের হাতে আছড়ে পড়তেই ওর হাতের রিভলবারটা ছিটকে গেল দেওয়ালের দিকে। উঠে বসে দেখলাম যে দেবাশিসদাও কম খেলুড়ে নন, আমাকে নড়তে দেখেই সামান্য নিচু হয়ে ডান হাতটা সপাটে চালিয়ে দিয়েছেন যোগেন্দ্রর তলপেটে। ভূতপূর্ব প্রফেসরসাহেব যেখানে ওঁক করে একটা আওয়াজ তুলে লুটিয়ে পড়লেন, গুরুং-এর হাতে ধরা রিভলবারটাও সেখানেই ছিটকে পড়েছিল। চকিতের মধ্যে দেখলাম যে গুরুং প্রাণপণে সেদিকে ঝাঁপ দিল রিভলবারটা উদ্ধার করতে। ইতিমধ্যেই দেবাশিসদা যোগেন্দ্রকে পেড়ে ফেলে তার হাত দুটো পিছমোড়া করে ফেলেছেন। আমি গুরুংয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তেই ওর একটা ঘুঁষি আছড়ে পড়ল আমার চোয়ালে। গুরুংয়ের ওপর থেকে গড়িয়ে পড়তে-পড়তে শুনলাম তীক্ষ্ণ সিটির স্বর ভেসে উঠল দেবাশিসদার দিক থেকে, আর চারজন আর্মি কম্যান্ডো দরজা আর জানালা থেকে ঘরের ভেতরে লাফিয়ে পড়ে হাতে ধরা ইনস্যাস তুলে পজিশন নিল! তার মানে এতক্ষণ ধরে আমার ইন্দ্রিয় আমাকে ভুল সিগন্যাল দিচ্ছিল না!

    জামার ভেতরে লুকিয়ে থাকা হোলস্টার থেকে নিজের রিভলবারটা বার করলেন দেবাশিসদা, তারপর সেটাকে গুরুং এর দিকে তাক করে বললেন, “নো মোর হ্যাঙ্কি প্যাঙ্কি জেন্টলমেন। আই অ্যাম মেজর দেবাশিস বণিক, অ্যান্ড উই আর স্পেশ্যাল আর্মড ফোর্সেস ফ্রম সিবিআই। সো, প্লিজ সারেন্ডার ইওরসেল্ফ টু আস পিসফুলি, উই ডোন্ট ওয়ান্ট এনিবডি টু গেট হার্মড। তাপস, সুবোধ, প্লিজ স্টে অ্যাসাইড। লেট মাই টিম হ্যান্ডল দিস। আর দত্তবাবু আপনি প্লিজ এই দুই বন্ধুকে নিয়ে… দত্তবাবু… ও দত্তবাবু…”

    আমরা সবাই একসঙ্গেই দত্তবাবুর দিকে ফিরে তাকালাম। ভদ্রলোক এতটা মানসিক শক বোধহয় একসঙ্গে নিতে পারেননি। উনি চেয়ারেই পড়ে আছেন বটে, তবে অজ্ঞান হয়ে !

    .

    *

    দু’দিন বাদের ঘটনা। আমরা রাতের ট্রেনে কলকাতা ফিরে যাচ্ছি। আমরা বলতে অবশ্য আমরা তিনজন। আমি, তাপস আর নারানজ্যেঠু।

    নারানজ্যেঠুকে গুরুং-এর বাংলো থেকে সেই রাতেই উদ্ধার করে সিবিআই-এর টিম। সামান্য মেন্টাল ট্রমা ছাড়া বিন্দুমাত্র টসকাননি ভদ্রলোক। কিন্তু এত ঘটনার পর জ্যেঠুকে আর দার্জিলিংয়ে রাখতে ভরসা পাইনি আমরা। দেবাশিসদার কাছ থেকে স্পেশাল পার্মিশন বানিয়ে খানিকটা জোর করেই আমাদের সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

    “আমি তো জানতামই যে এ-রকম কিছু একটা ঘটবে।” এসি কম্পার্টমেন্টে বসে জানালায় প্রতিবিম্বিত বাইরের অন্ধকার খুব মন দিয়ে দেখতে-দেখতে বলছিলেন নারানজ্যেঠু, পিঠের কাছে ওঁর নিজেরই স্পেশ্যালি ডিজাইন করা একটা লম্বাটে কুশন, “নইলে আর তোমাদের ডেকে পাঠানো কেন?” অন্যমনস্ক সুরে বললেন জ্যেঠু।

    “কিন্তু তাই বলে এতদূর? যদি আপনার কিছু হয়ে যেত?” জিজ্ঞেস করেছিলাম আমি।

    “সে হতেই পারত। তবে বাঁচোয়া এটাই যে আমাকে মারধোর শুরু করার আগেই তোমরা ফাঁদটা সাক্সেসফুলি পেতে ফেলেছিলে। তা নইলে কী যে হতো সেটা বলা অবশ্য সত্যিই খুব মুশকিল।” বলেই আবার বাইরের অন্ধকারে মগ্ন হয়ে গেলেন মানুষটা।

    “কিন্তু একটা কথা বুঝতে পারছি না তাপস…” ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম।

    “কী?”

    “দেবাশিসদাকে হাত করলি কী করে?”

    “ওঁর ওই মিলিটারি বুট দেখেই বুঝি যে ভদ্রলোক সাধারণ ট্যুরিস্ট নন। তারপর আমাদের সঙ্গে ম্যালে দেখা হওয়ার দিন নিজেকে কিউরিও শপের মালিক প্রমাণ করতে গিয়ে গুচ্ছের ভুল ইনফর্মেশন দিলেন। সন্দেহটা আমার তখনই হয়। কলকাতাতে খবর নিয়ে জানলাম নিজের দোকান বলে দোকানের যে নাম উনি আমাদের জানিয়েছিলেন সেটা আসলে ওঁর এক বন্ধুর দোকান। আমিও অবশ্য কম যাই না। সেই বন্ধুকে পটিয়ে পাটিয়ে অনেক কষ্টে জানলাম যে তাঁর স্কুলফ্রেন্ড শ্রীদেবাশিস বণিক আসলে একজন আইপিএস অফিসার, দিল্লিতে খুব উঁচু পোস্টে কাজ করেন। দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে আমার দেরি হয়নি, আমি ভদ্রলোকের হোটেলে গিয়ে ওঁকে সরাসরি সব জানাই। তখনই জানতে পারি যে উনি এসেছেন সেই আন্তর্জাতিক চোরাচালানের পান্ডাটিকে খুঁজতে। ব্যস, বাকি অ্যাকশনের প্ল্যান তখনই ফাইনাল হয়ে যায়। যোগেন্দ্র অ্যান্ড কোং যখন জ্যেঠুর লাইব্রেরিতে বসে তড়পাচ্ছে, তখন গুরুংয়ের বাংলো সার্চ করানোটা ওঁরই কাজ।”

    “কিন্তু একটা কথা বল, যেটা নিয়ে এত কাণ্ড, সেই পুঁথিটা কোথায়?”

    আড়চোখে জ্যেঠুর দিকে তাকাল তাপস। তারপর তাকাল জ্যেঠুর পিঠের দিকে রাখা লম্বাটে কুশনটার দিকে। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে খুব আস্তে করে বলল, “হ্যাঁ রে তেমন-তেমন সাধনপীঠ হলে বোধহয় পিঠের ব্যথাতেও সমান কাজ দেয়। তাই না রে?”

    ⤶
    1 2
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleমিত্তিরবাড়ির গুপ্তধন – অভীক সরকার
    Next Article কাউরীবুড়ির মন্দির – অভীক সরকার

    Related Articles

    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    ভয় সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সমগ্র – হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়

    December 9, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    প্রকাশ্য দিবালোকে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 18, 2025
    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    তারপর কী হল – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

    November 17, 2025
    মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    শর্ম্মিষ্ঠা নাটক – মাইকেল মধুসূদন দত্ত

    November 11, 2025
    সত্যজিৎ রায়

    মানপত্র সত্যজিৎ রায় | Maanpotro Satyajit Ray

    October 12, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }