Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চতুষ্কোণ – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প160 Mins Read0

    ০২. রিণি চমৎকার গান গাহিতে পারে

    রিণি চমৎকার গান গাহিতে পারে। অন্তত লোকে তাই বলে। গলাটি তার মৃদু ও মিহি, সুরগুলি তার কোমল ও করুণ, গান সে শিখিয়াছে নামকরা এক ওস্তাদের কাছে। ওস্তাদের বুদ্ধি ছিল তাই তিনি শিষ্যাকে কিছুমাত্র ওস্তাদি শিখাইবার চেষ্টা করেন নাই, শুধু শিখাইয়াছেন মোলায়েম সুর। কেউ কেউ অবশ্য বলে যে রিণি গান করে না, বিড়াল ছানার ছাড়া ছাড়া করুণ আওয়াজটাকেই একটানা উচ্চারণ করিয়া যায়, তবু অনেকের কাছেই রিণির গান ভালো লাগে। মনটা উদাস হইয়া যায় অনেকের, ঘুমের বাহন ছাড়াই স্বৰ্গত স্বপ্ন নামিয়া আসে অনেকের চোখে, লজ্জা ও বেদনার সঙ্গে অনেকের মনে হয় যে এত ঘষামাজার পরেও তো তারা মার্জিত জীবনযাত্রার পথে বিনা চেষ্টায় পিছলাইয়া চলিবার মতো মোলায়েম হইতে পারে নাই।

    স্যার কে. এল-এর বাড়ির সদরের সুশ্রী দরজাটি পার হইয়া ভিতরে পা দেওয়ামাত্র টের পাওয়া যায়, বাহিরের রাস্তাটা কি নোংরা। কতবার রাজকুমার এ দরজা পার হইয়াছে। কিন্তু একবারও দরজাটি পার হওয়ার একমুহূর্ত আগে এই অভিজ্ঞতা তার মনে পড়ে না। স্যার কে. এল-এর বাড়ির ভিতরটা শুধু দামি ও সুশ্রী আসবাবে সুন্দরভাবে সাজানো নয়, সদর দরজার এপাশে এ বাড়ির বিস্ময়কর রূপ ও শ্রীর মহিমাটাই শুধু স্পষ্ট হইয়া নাই, কি যেন একটা ম্যাজিক ছড়ানো আছে চারিদিকে–পার্থক্য ও দূরত্বের ইঙ্গিতভরা এক অহঙ্কারী আবেষ্টনীর দুর্বোধ্য প্রভাবের ম্যাজিক।

    বাড়িতে ঢুকিলেই রাজকুমার একটু ঝিমাইয়া যায়। একটা অদ্ভুত কথা তার মনে হয়। মনে হয়, অনেকদিন আগে একবার এক পাহাড়ে একজন সংসারত্যাগী কৌপীনধারী সন্ন্যাসীর গুহায় ঢুকিয়া তার যেমন গা ছমছম করিয়াছিল, এখানেও ঠিক তেমনি লাগিতেছে। আরাম উপভোগের আধুনিকতম কত আয়োজন এখানে, তবু তার মনে হয় এ বাড়িতে যারা বাস করে তারা যেন ধূলামাটির বাস্তব জগৎকে ত্যাগ করিয়াছে, রক্তমাংসের মানুষের হাসিকান্নায় ভরা সাধারণ স্বাভাবিক জীবনকে এড়াইয়া চলিতেছে।

    উপরে গিয়া রাজকুমার টের পাইল, রিণি বড় হলঘরে গান গাহিতেছে। আজ পার্টিতে যে গানটি গাহিবে খুব সম্ভব সেই গানই প্র্যাকটিস করিতেছে। ঘরে গিয়া রাজকুমার রিণির কাছে দাঁড়াইয়া গান শুনিতে লাগিল। বড় কোমল গানের কথাগুলি, বড় মধুর গানের সুরটি। রাজকুমার হয়তো একটু মুগ্ধ হইয়া যাইত, কিন্তু সে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে টের পাইয়াও রিণি টের না পাওয়ার ভান করিয়া আপন মনে গাহিয়া চলিতেছে বুঝিতে পারিয়া গানটা আর রাজকুমারের তেমন ভালো লাগিল না।

    গান শেষ করিয়া রিণি মুখ তুলিল। রাজকুমারের উপস্থিতি টের পাইয়াও টের না পাওয়ার ভান করিয়া এতক্ষণ গান করুক, ভাবাবেশে কি অপরূপ দেখাইতেছে রিণির মুখ।

    এ গানটা গাইলেই আমার এমন মন কেমন করে? মনে হয় আমি যেন একা, আমি যেন—

    ধীরে ধীরে রাজকুমারের হাত ধরিয়া রিণি তাকে আরেকটু কাছে টানিয়া আনিল, নিজের মুখখানা আরো উঁচু করিয়া ধরিল তার মুখের কাছে। গান গাহিয়া সে সত্যই বিচলিত হইয়া পড়িয়াছে। রাজকুমারের কাছে আর কোনোদিন সে এভাবে আত্মহারা হইয়া পড়ে নাই।

    প্রথমটা রাজকুমার বুঝিতে পারে নাই, তবে রিণির চোখ ও মুখের আহ্বান এত স্পষ্ট যে বুঝিতে বেশিক্ষণ সময় লাগা রাজকুমারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। বুঝিতে পারিয়াই সে বিবর্ণ হইয়া গেল।

    না, ছি।

    ও!

    রিণি উঠিয়া দাঁড়াইয়া একটু তফাতে সরিয়া গেল। চোখে আর আবেশের ছাপ নাই, মুখে উত্তেজনার রং নাই। চোখের পলকে সে যেন পাথরের মূর্তি হইয়া গিয়াছে।

    কি চাই আপনার?

    কিছু চাই না, এমনি তোমায় একটা কথা বলতে এসেছিলাম। আমার বড় মাথা ধরেছে, আজ আর তাই তোমার সঙ্গে পার্টিতে যেতে পারব না।

    রিণি বলিল, তা নিজে অসভ্যতা করতে না এসে, একটা নোট পাঠিয়ে দিলেই পারতেন? যাকগে, মাথা যখন ধরেছে, কি করে আর যাবেন!

    রাজকুমার মরিয়া হইয়া বলিল, তোমার সঙ্গে বসে একটু গল্প করব ভেবেছিলাম রিণি!

    রিণি যেন আশ্চর্য হইয়া গেল–আমার সঙ্গে গল্প। আচ্ছা বলুন।

    গল্প তাই জমিল না। একজন যদি মুখ ভার করিয়া বসিয়া থাকে আর থাকিয়া থাকিয়া সুকৌশলে অতি সূক্ষ্ম ও মার্জিত ভাবে খোঁচা দিয়া জানাইয়া দেয় যে অপর জন মানুষ হিসাবে অতি অভদ্র, গল্প আর চলিতে পারে কতক্ষণ?

    কয়েক মিনিট পরেই রাজকুমার উঠিয়া গেল।

    বিদায় নিয়া রাজকুমার তো ঘরের বাইরে চলিয়া আসিল, সঙ্গে সঙ্গে রিণি আবার আরম্ভ করিয়া দিল তার গানের প্র্যাকটিস। রাজকুমার তখন সবে সিঁড়ি দিয়া কয়েক ধাপ নামিয়াছে। রিণির গানের সেই অকথ্য করুণ সুর কানে পৌঁছানোমাত্র সে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল। এত তাড়াতাড়ি রিণি নিজেকে সামলাইয়া উঠিতে পারিয়াছে! সে তবে লজ্জা পায় নাই, অপমান বোধ। করে নাই, বিশেষ বিচলিত হয় নাই? ব্যাপারটা রাজকুমারের বড়ই খাপছাড়া মনে হইত লাগিল। সাগ্রহে মুখ বাড়াইয়া দিয়া চুম্বনের বদলে ধিক্কার শোনাটা এমনভাবে তুচ্ছ করিয়া দেওয়া তো মেয়েদের পক্ষে স্বাভাবিক নয়।

    রেলিং ধরিয়া সেইখানে দাঁড়াইয়া রাজকুমার ভাবিতে থাকে। তার ব্যবহারকে রিণি অসভ্যতা বলিয়াছিল। লজ্জা পাওয়ার বদলে সমস্তক্ষণ রিণির কথায়, ব্যবহারে ও চোখের দৃষ্টিতে একটা অবজ্ঞা মেশানো অনুকম্পার ভাবই স্পষ্ট হইয়া ছিল। তখন রাজকুমার ভাবিয়াছিল, ওসব প্রত্যাখ্যানের প্রতিক্রিয়া। এখন তার মনে হইতে লাগিল, তার মনের সঙ্কীৰ্ণতার পরিচয় পাইয়া প্রথমে একটু রাগ এবং তারপর বিরক্তি ও অনুকম্পা বোধ করা ছাড়া আর কোনো প্রতিক্রিয়াই বোধহয় রিণির মনে ঘটে নাই। শ্রীমতী গিরীন্দ্রনন্দিনী ও তার মাকে আজ যেমন তার বর্বর মনে হইয়াছিল, তার সম্বন্ধেও রিণির ঠিক সেই রকম একটা ধারণাই সম্ভবত জন্মিয়াছে।

    এবং সেজন্য রিণিকে দোষ দেওয়া চলে না। সত্যই সে রিণির সঙ্গে ছোটলোকের মতো ব্যবহার করিয়াছে। কি আসিয়া যাইত রিণিকে চুম্বন করিলে? চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার চেয়ে। এমন কি গুরুতর নরনারীর আলগা চুম্বন? একটু প্রীতি বিনিময় করা, একটু আনন্দ জাগানো, মৈত্রীর যোগাযোগকে কয়েক মুহূর্তের জন্য স্পষ্টতরভাবে অনুভব করা। রিণি তাই চাহিয়াছিল। কিন্তু নিজে সে গিরীন্দ্রনন্দিনীর পর্যায়ের মানুষ কিনা, চুম্বনের জের চরম মিলন পর্যন্ত টানিয়া না চলাটাও যে যুবক-যুবতীর পক্ষে সম্ভব এ ধারণাও তার নাই কিনা, তাই সে ভাবিতেও পারে নাই। রিণির আহ্বানে সাড়া দিলেও তাদের সহজ বন্ধুত্বের সম্পর্কটা বজায় থাকিবে, অসঙ্গত ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হইয়া যাইবে না।

    চুম্বন অবশ্য নরনারীর মিলনেরই অঙ্গ, সুপবিত্র কোনো আধ্যাত্মিক মিথ্যার ধোঁয়া সৃষ্টি করিয়া রিণির সঙ্গে তার চুম্বন বিনিময়কে সে ব্যাখ্যা করিতে চায় না। কেন সে ভাবিতে পারে নাই চুম্বনের ভূমিকাতেই সমাপ্তি ঘটানোর মতো সংযম তাদের আছে? চোখ মেলিয়া রিণির রূপ সে দেখিয়া থাকে, কাছাকাছি বসিয়া হাসিগল্পের আনন্দ উপভোগ করে, মাঝে মাঝে স্পৰ্শ বিনিময়ও ঘটিয়া যায় কিন্তু আত্মহারা হইয়া পড়ার প্রশ্নও তো তাদের মনে জাগে না। সে কি কেবল এই জন্য যে ওই পর্যন্ত ঘনিষ্ঠতা দশজনে অনুমোদন করে? চুম্বন বিনিময়ে অনুমতি দেওয়া থাকিলে তো আজ তার মনে হইত না রিণিকে চুম্বন করা বিবেকের গায়ে পিন ফুটানো এবং একবার পিন ফুটাইলে একেবারে ছোরা বসাইয়া বিবেককে জখম না করিয়া নিস্তার থাকিবে না।

    কেবল সে একা নয়, সকলেই এই রকম। অনেক পরিবারে পনের বছরের মেয়েরও বাপভাই ছাড়া কোনো পুরুষের সামনে যাওয়া বারণ। এমন একটি মেয়ে যদি কেবল চুপি চুপি দুটি কথা বলার জন্যও পাশের বাড়ির ছেলেটাকে ডাকে, ছেলেটা কি ভাবিবে? রিণি চুম্বন চাওয়ার খানিক আগে সে যা ভাবিয়াছিল।

    এমন একটা বিকৃত আবেষ্টনীর মধ্যে তারা মানুষ হইয়াছে যে, অস্বাভাবিক মিথ্যা অসংযমকেই ভারা স্বাভাবিক সত্য বলিয়া জানিতে শিখিয়াছে। মানুষ কেবল পরের নয়, নিজেরও সংযমে বিশ্বাস করে না। অসংযমের চেয়ে সংযম যে মানুষের পক্ষে বেশি স্বাভাবিক, এ যেন কেউ কল্পনাও করতে পারে না।

    হঠাৎ রিণির গান বন্ধ হইয়া যাওয়ায় রাজকুমার সচেতন হইয়া উঠিল যে, সিঁড়ির মাঝখানে সে অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া আছে। তাড়াতাড়ি সে নিচে নামিয়া গেল।

    নিচে হলঘরের এক কোণে অবনীবাবুর মেয়ে মালতী বসিয়া ছিল। সামনে ছোট টেবিলটিতে একটি বই ও খাতা। খুব সম্ভব কলেজ হইতে ফিরিবার সময় স্যার কে. এল-এর বাড়িতে ঢুকিয়াছে। এখানে একা বসিয়া দুহাতের আটটি আঙুলে টেবিলের উপর টোকা দিয়া টুকটাক আওয়াজ তুলিবার কারণটা রাজকুমার ঠিক বুঝিতে পারিল না। আট আঙুলে টোকা দেওয়ার কারণ নয়, এখানে একা বসিয়া থাকিবার কারণ। মালতী বড় চঞ্চল। চাঞ্চল্যটা শুধু আঙুলে সীমাবদ্ধ রাখিয়া সে যে স্থির হইয়া বসিয়া আছে, এটা সত্যই আশ্চর্যের ব্যাপার।

    রাজকুমারকে দেখিবামাত্র টোকা দেওয়া থামিয়া গেল। চোখে-মুখে তার যে দুষ্টামি ভরা চকিত হাসি খেলিয়া গেল, বনের হরিণী হাসিতে জানিলেও তার নকল করিতে পারি না। সোজাসুজি তাকানো বদলে মাথা একটু কাত করিয়া কোনাকুনি রাজকুমারের দিকে তাকাইয়া বলিল, এর মধ্যে তাড়িয়ে দিল?

    তাড়িয়ে দিল মানে?

    ও, তাড়িয়ে দেয় নি? আপনি নিজে থেকে চলে যাচ্ছেন? আমি ভাবলাম আপনাদের বুঝি ঝগড়া হয়েছে, আপনাকে তাড়িয়ে দিয়ে রিণি বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদছে।

    কাঁদছে নাকি?

    দিনরাত কাঁদে মেয়েটা, সময় অসময় নেই। আচ্ছা, অর্গান বাজিয়ে কাঁদে কেন বলুন তো? এ আবার কোন দেশী কান্না! আমি যদি কখনো কাঁদি, রিণির মতো আপনার জন্যেই কাঁদি, আমাকে আবার একটা অর্গান কিনতে হবে নাকি?

    রাজকুমার মৃদু হাসিয়া বলিল, রিণিকে জিজ্ঞেস কোবরা অর্গান বাজিয়ে কাদে কেন। খুশি হয়ে তোমার একটা চোখ কানা করে দেবেন।

    পুরোপুরি গম্ভীর হওয়া মালতীর পক্ষে এক রকম অসম্ভব ব্যাপার, যতটা পারে গাম্ভীর্যের ভান করিয়া সে বলিল, জিজ্ঞেস করি নি ভাবছেন বুঝি? ও যে আমাকে দুচোখে দেখতে পারে না, আমিও কখনো ওদের বাড়ি আসি না, সেটা তবে কি জন্যে?

    ওদের বাড়ি আস না মানে? এই তো এসেছ সশরীরে।

    আজকের কথা বাদ দিন। আজ না এসে উপায় ছিল না, কলেজ থেকে ফিরছি। দেখি আপনি সরাসরি এ বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। ব্যাপারটা ভালো করে না জেনে আর কি তখন বাড়ি ফিরতে পারি, আপনিই বলুন?

    রাজকুমার রাগ করিয়া বলিল, ব্যাপার আবার কিসের? শরীরটা ভালো নেই, আজ ওর পার্টিতে আসতে পারব না, তাই বলতে এসেছিলাম।

    মালতী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলার মতো সজোরে একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, তা ঠিক। শরীর খারাপ বলে যে পার্টিতে আসতে পারবে না, সে নিজেই খারাপ শরীর নিয়ে খবরটা দিতে আসে বটে। বাড়িতে যখন একটার বেশি চাকর নেই।

    অন্য কারও ছিল।

    আমিও তো তাই বলছি।

    দরকার ছিল মানে–

    মানে বুঝিয়ে বলতে হবে না স্যার। এ তো অঙ্ক নয় যে আপনি বুঝিয়ে না দিলে মাথায় ঢুকবে না। তার চেয়ে বরং কাছে আসিয়া গলা নামাইয়া ফিসফিস করিয়া বলিল–সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অতক্ষণ কি ভাবছিলেন তাই বলুন। বলুন না, কাউকে বলব না আমি, আপনার গা ছুঁয়ে প্ৰতিজ্ঞা করছি।

    মালতী কখনো তাকে স্যার বলে না। রাজকুমার তাকে পড়ায় বটে রোজ, কিন্তু ঠিক গুরু-শিষ্যার সম্পর্ক তাদের নয়। তার কথা বলার ভঙ্গি রাজকুমারকে আরো বেশি বিব্রত করিয়া তুলিল। রিণির সঙ্গে সত্য সত্যই কিছু না ঘটিয়া থাকিলে হয়তো সে রাগ করিতে পারিত, যদিও মালতীর উপর রাগ করা বড় কঠিন। মালতী তামাশা করে, সব সময়ে সব বিষয়ে এরকম হালকা পরিহাসের ভঙ্গিতেই কথা বলে, কিন্তু কখনো খোঁচায় না। পরিচিত সকলেই যেন তার কাছে নতুন জামাই আর সে তার মুখরা শ্যালিকা। মনে যদি কারো খোঁচা লাগে তার কথায়, সেটা তার মনের দোষ, মালতীর নয়।

    হঠাৎ রাজকুমারের একটা কথা মনে পড়িয়া গেল।–কি দরকারে এসেছি, দেখবে? বলিয়া ঘরের একপাশে টেলিফোনের কাছে আগাইয়া গিয়া রিসিভারটা তুলিয়া নিল। কাল সে কাজে যাইতে পারিবে না রাজেনকে এই খবরটা দিয়া আরো কতগুলি আজেবাজে কথা বলিয়া রিসিভারটা নামাইয়া রাখিল।

    দেখলে?

    মালতী এতক্ষণ তার দুষ্টামির হাসি মুখে ফুটাইয়া রাখিয়াছিল, চার-পাঁচবার মাথা হেলাইয়া সায় দিয়া বলিল, দেখলাম বৈকি, নিশ্চয় দেখলাম। অমন কত দেখছি রোজ! শ্যামল করে কি জানেন, যখন তখন আমাদের বাড়িতে এসে হাজির হয় আর আমাকে ডেকে বলে–একটা ফোন করব। অন্য সবাই রয়েছে বাড়িতে, তাছাড়া ফোন করার জন্য কারো অনুমতি চাওয়ারও ওর দরকার নেই, কিন্তু আমাকে ডেকে ওর বলা চাই। আমি বলি, বেশ তো, ফোন করুন। তার পর একথা সেকথা বলতে বলতে গল্প জমে যায়, বেচারির দরকারি ফোনটা আর করা হয় না।

    কথার মাঝখানে রিণি ঘরে আসিয়াছিল। একবার বলিয়াছিল, মালতী নাকি? কিন্তু মালতী তার দিকে চাহিয়াও দ্যাখে নাই। কথা শেষ হইতে সে তাই আবার বলিল, এই যে মালতী!

    মালতী বলিল, হ্যাঁ, আমিই মালতী। চলুন রাজুদা, যাই। বড্ড দেরি হয়ে গেল।

    এতক্ষণ রিণির মুখে মৃদু ও স্পষ্ট একটা বিরক্তির ভাবের উপর মাখানো ছিল সবিনয় ভদ্রতার প্রলেপ, এক মুহূর্তে সমস্ত মুছিয়া গিয়া মুখ তার অন্ধকার হইয়া গেল। এমনভাবে একবার সে ঢোক। গিলিল যেন কড়া কড়া কতগুলি অভদ্ৰ কথাই গিলিয়া ফেলিতেছে। মন চিরিয়া দেওয়ার মতো ধারালো দৃষ্টিতে কয়েক সেকেণ্ড মালতীকে দেখিয়া হঠাৎ সে মুখ ফিরাইল রাজকুমারের দিকে।

    শুনে যাও, তোমার সঙ্গে একটা কথা আছে।

    মালতী ততক্ষণে আগাইয়া গিয়াছে বাহিরের দরজার কাছে, সেখান হইতে সেও তাগিদ দিয়া বলিল, শিগগির আসুন রাজুদা। দাঁড়াবেন না, চলে আসুন।

    সুতরাং রাজকুমারের বিপদের আর সীমা রহিল না। তরুণী দুটির দৃষ্টিবিনিময় দেখিয়া তার মনে হইতে লাগিল, এই বুঝি একটা খুনোথুনি ব্যাপার ঘটিয়া যায়। রাগে আর আত্মসংযমের চেষ্টায় রিণির সমস্ত শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। মালতীর মুখখানা এখনো হাসি হাসি বটে, কিন্তু সে হাসি যেন লড়াই করার ধারালো অস্ত্র। চোখের পলকে চোখের সামনে দুটি ভদ্রঘরের শিক্ষিতা মেয়ে যে এমন একটা নাটক সৃষ্টি করিতে পারে, রাজকুমারের সে অভিজ্ঞতা ছিল না। আড়ালে আড়ালে ভূমিকার অভিনয়টা নিশ্চয় ঘটিয়া গিয়াছে, এ পর্যন্ত সে টেরও পায় নাই। যত আয়োজনই হইয়া থাক, আকাশে তো প্রথমে মেঘ দেখা দেয়, তারপর বিদ্যুৎ চমকানোর সঙ্কেত পাওয়া যায়, তারপর বজ্ৰপাত। এ যেন ঠিক বিনা মেঘে বজ্ৰপাত ঘটিয়া গেল।

    কি করা যায় এখনঃ একজন তাকে ডাকিতেছে অন্দরে, একজন ডাকিতেছে বাহিরে। কারো ডাকে সাড়া দিবার উপায় নাই। নিজেকে যদি দুভাগ করিয়া ফেলা যায়, তবু দুজনকে খুশি করা। যাইবে না। এমন হাস্যকর অথচ এমন গুরুতর অবস্থায় কি মানুষ কখনো পড়ে? রাজকুমার বেশ বুঝিতে পারিতেছিল, দুজনের মধ্যে একটা সাময়িক ও কৃত্রিম আপস ঘটাইয়া দেওয়া সম্ভব হইবে না। তার কাছে ছেলেমানুষি মনে হইতেছে, কিন্তু এটা ওদের ছেলেমানুষি নয় যে সমস্ত ব্যাপারটাকে হাসিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলিবে। তার কথার কোনো দাম এখন ওদের কাছে নাই। আর কিছুই তার কাছে এখন ওরা চায় না, শুধু চায় যে একজনের হুকুম মানিয়া আরেকজনের মাথা সে হেঁট করিয়া দিবে।

    রিণি অধীর হইয়া বলিল, এস?

    মালতী হাসিমুখে বলিল, আসুন?

    তখন রাজকুমার সেইখানে স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া মালতীকে বলিল, এদিকে এস তো একটু।

    মালতী বলিল, আবার ওদিকে কেন? চলুন যাই।

    কিন্তু মালতী কাছে আসিল। যুদ্ধক্ষেত্র হইতে পলাতক ভীরু ও কাপুরুষ সৈনিকের মতো। রাজকুমার তার পাশ কাটাইয়া পালাইয়া গেল বাহিরে! বাহির হইতে দরজার পিতলের কড়া দুটিতে বাঁধিয়া দিল পকেটের নস্যমাখা ময়লা রুমালটি। গেট পার হইয়া রাস্তায় পা দিয়া তার মনে হইতে লাগিল, মাথাধরাটা একেবারে সারিয়া গিয়াছে। একটু যেন কেবল ঘুরিতেছে মাথাটা, ছেলেবেলায় নাগরদোলায় অনেকক্ষণ পাক খাইয়া মাটিতে নামিয়া দাঁড়াইবার পর যেমন ঘুরিত।

    রিণি আর মালতী যে তারপর কামড়াকামড়ি করে নাই, সেটা জানা গেল সন্ধ্যার পর সরসীর মিটিঙে গিয়া।

    রাজকুমার বাড়িতেই ছিল। শ্যামল একেবারে স্যার কে. এল-এর গাড়ি লইয়া আসিয়া খবর দিল, সরসী ডাকিয়া পঠাইয়াছে, অবিলম্বে যাইতেই হইবে।

    মালতীর কাছে আপনি যাবেন না শুনে সরসী একদম ক্ষেপে গেছে। শিগগির চলুন।

    রাজকুমারের অচেনা এক ভদ্রলোকের প্রকাণ্ড বাড়িতে মিটিং বসি বসি করিতেছিল। জন ত্রিশেক মেয়ে পুরুষ উপস্থিত আছে। সকলে স্বেচ্ছায় আসিয়াছে কিনা সন্দেহ, খুন সম্ভব সরসী। সকলকে ঘাড় ধরিয়া টানিয়া আনিয়াছে। রিণি এবং মালতীও উপস্থিত আছে। কারো মুখে আঁচড় কামড়ের দাগ নাই। রাজকুমার এক ফাঁকে মালতীকে জিজ্ঞাসা করিল, তার পর কি হল?

    মালতী হাসিয়া বলিল, কিসের পর? আমি চলে যাওয়ার পর? কি আর হবে? ঘণ্টাখানেক গল্প করে আমিও চলে এলাম। রাজকুমার বিশ্বাস করিল না। মাথা নাড়িয়া বলিল, উঁহু, মিছে কথা।

    তখন মালতী তার দুষ্টামির হাসিকে সরল হাসিতে পরিণত করিয়া বলিল, সত্যি মিছে কথা। ওর সঙ্গে এক ঘণ্টা গল্প করতে হলে আমি দম আটকে মরে যেতাম না। সত্যি সত্যি কি হল। তারপর শুনবেন? চাকর পাশের দরজা দিয়ে গিয়ে রুমালটা খুলে দিল। রিণি বলল, যাচ্ছ নাকি? আমি বললাম, হা যাচ্ছি। বলে চলে এলাম। আপনার রুমালটা আমার কাছে আছে, ওটা আর ফেরত পাচ্ছেন না।

    তা না পেলাম। কিন্তু রিণি শুধু যাচ্ছ নাকি বলেছিল, যাচ্ছ নাকি ভাই বলে নি?

    হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক। ও বলল, যাচ্ছ নাকি ভাই, আর আমি বললাম, হা ভাই যাচ্ছি।

    সরসী খুব সম্ভব এ বাড়ির মেয়েদের বুঝাইয়া সভায় আনিতে অন্দরে গিয়াছিল, লজ্জা সঙ্কোচে একান্ত বিপন্না আট-দশটি মেয়ে-বৌকে গরু তাড়ানোর মতো সভায় আনিয়া হাজির করিল। রাজকুমারকে দেখিয়াই অনুযোগ দিয়া বলিল, বেশ মানুষ তো? তোমার বক্তৃতার জন্য মিটিং, তুমি বলে বসলে আসতে পারবে না?

    সরসীর রং একটু কালো, দেহের গড়নটি অপরূপ। অতি অপরূপ। কালো মেয়েরও যদি রূপ থাকে, তার মতো রূপসী মেয়ে সহজে চোখে পড়িবে না। সাধারণভাবে কাপড় পরার কোনো এক নতুন কায়দা সে আবিষ্কার করিয়াছে কিনা বলা যায় না, আবরণ যেন তার দেহশ্ৰীকে ঢাকা দেওয়ার বদলে ছন্দ দিয়াছে।

    সমিতি গড়িতে আর মিটিং করিতে সরসী বড় ভালবাসে। ঘরে তার মন বসে না, সারাদিন এইসব ব্যাপার নিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়। ঘুরিয়া বেড়ায়, কিন্তু কখনো ব্যস্ত হয় না। সব সময় তাকে ধীর স্থির শান্ত প্রকৃতির মেয়ে বলিয়া মনে হয়। এদিক দিয়া সে মালতীর ঠিক উল্টো। মালতী চঞ্চল কিন্তু অলস, তার চাঞ্চল্য নাচের মতো, ছোটাছুটি বা কাজের নামেই তার আতঙ্ক উপস্থিত হয়। সরসী একদিন পঞ্চাশটি জায়গায় কাজে যাইতে পারে অনায়াসে, কিন্তু চলে সে ধীরে ধীরে পা ফেলিয়া, আস্তে আস্তে উচ্চারণ করে কথা, শান্ত দৃষ্টিতে তাকায়, কখনো উত্তেজিত হয় না।

    প্রথমে যাকে প্রেসিডেন্ট করা হইয়াছিল হঠাৎ কয়েক ঘণ্টার নোটিশে তিনি একেবারে শহর ছাড়িয়া পলাইয়া যাওয়ায় স্যার কে. এল-কে প্রেসিডেন্ট করা হইয়াছে। সরসী ছাড়া আর কেউ তাকে এতটুকু সভায় আরেকজনের বদলিতে সভাপতিত্ব করিতে রাজি করাইতে পারি কিনা সন্দেহ।

    সরসীই সভাপতিকে অভ্যর্থনা জানাইল। গাম্ভীর্য ও সহৃদয়তাব্যঞ্জক একটা অদ্ভুত মুখভঙ্গি করিয়া স্যার কে. এল এতক্ষণ যেখানে বসিয়া ছিলেন, একবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া আবার সেইখানেই বসিয়া পড়িলেন। তারপর সরসী বক্তা ও বক্তৃতার বিষয়বস্তু সম্পর্কে পরিচয়মূলক কয়েকটি কথা বলিয়া নিজেও বসিয়া পড়িল।

    রাজকুমার একদৃষ্টিতে এতক্ষণ সরসীর দিকে চাহিয়া ছিল, শুধু তার এই বসিবার ভঙ্গিটি দেখিবার জন্য। সরসীর ওঠাবসা চলাফেরার মধ্যে কি যেন একটা আকৰ্ষণ আছে, কেবলই তার চাহিয়া দেখিতে ইচ্ছা হয়। সরসীর আকর্ষণ তার কাছে খুব বেশি জোরালো নয়, কিন্তু সরসীর প্রত্যেকটি সর্বাঙ্গীণ অঙ্গ সঞ্চালন মৃদু একটা উত্তেজনা জাগাইয়া তাকে মুগ্ধ করিয়া দেয়।

    উঠবেন না?

    অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য লজ্জিতভাবে রাজকুমার বক্তৃতা দিতে উঠিয়া দাঁড়াইল। সম্প্রতি সে মাস চারেক মাদ্রাজে কাটাইয়া আসিয়াছে, আজ তাকে মাদ্রাজের নারীজাতির সাধারণ অবস্থা ও প্রগতি সম্বন্ধে বক্তৃতা দিতে হইবে। একবার রাজকুমার মালতীর দিকে চাহিল। তাকে সচেতন করিয়া দিয়া মালতী ঘাড়ের পিছনটা খুঁটিতে খুঁটিতে দুষ্টামির হাসি মুখে ফুটাইয়া তুলিয়াছিল, এখনো সে হাসি তেমনি স্পষ্ট হইয়া আছে। মালতীর এই হাসি দেখিয়া হঠাৎ সরসীর উপর রাজকুমারের বড়ই রাগ হইয়া গেল। চার মাস একটা দেশে থাকিয়াই সে দেশের মেয়েদের সম্বন্ধে বক্তৃতা দেওয়ার মতো জ্ঞান একজন সঞ্চয় করিয়া আসিতে পারে, এমন কথা সরসীর মনে হইল কেমন করিয়া? মাথার কি ঠিক নাই মেয়েটার? কি সে বলিবে এখন এতগুলি লোকের সামনে!

    কি বলিবে আগে হইতেই কিছু কিছু সে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিল, কিন্তু মনের মধ্যে সব এমনভাবে এখন জড়াইয়া গিয়াছে যে কি বলিয়া আরম্ভ করিবে ভাবিয়া পাইল না। তিনবার বক্তৃতা শুরু করিয়া তিনবার থামিয়া গেল। কান তার গরম হইয়া উঠিল। লজ্জায় নয়, আতঙ্কে। শেষ পর্যন্ত কিছুই যদি বলিতে না পারে, এমনিভাবে তোলার মতো দু-চারটি শব্দ উচ্চারণ করিয়া যদি তাকে বসিয়া পড়িতে হয়।

    অবরুদ্ধ উত্তেজনায় সভা থমথম করিতেছে, একটা অঘটন ঘটিবার সম্ভাবনা দেখা দিয়াছে, তারই প্রত্যাশার উত্তেজনা। মরিয়া হইয়া মনে মনে রাজকুমার বলিতে থাকে, একটা কিছু করা দরকার, দু-এক সেকেত্রে মধ্যে তার কিছু করা দরকার, শুধু ওইটুকু সময় হয়তো তার এখনো আছে। বক্তব্য? নাইবা রহিল বক্তব্য তার বক্তৃতার? বড় বড় কথা নাইবা সে বলিতে পারি? যা মনে আসে বলিয়া যাক, অন্তত বক্তৃতা তো দেওয়া হইবে। চুপ করিয়া এভাবে দাঁড়াইয়া থাকার চেয়ে সে অনেক ভালো।

    একবার সে চাহিল রিণি মালতী সরসীর দিকে, তারপর বলিতে আরম্ভ করিল মাদ্রাজের মেয়েদের সম্বন্ধে। কি সে বলিবে মাদ্রাজের মেয়েদের সম্বন্ধে? যে চিরন্তন রহস্য যুগে যুগে দেশে দেশে নারীজাতিকে দুর্বোধ্য করিয়া রাখিয়াছে, মাদ্রাজের মেয়েরা তো তার কাছে সে রহস্যের ঘোমটা খুলিয়া তাদের জানিবার বুঝিবার সুযোগ তাকে দেয় নাই। সুতরাং সাধারণভাবে দু-চারটি কথা বলাই ভালো। গরম কান ঠাণ্ডা হয়, কথার জড়তা কাটিয়া যায়, মৃদু মৃদু রহস্যের সুরে কখনো গম্ভীর ও কখনো হাসিমুখে রাজকুমার বলিয়া যায়। মাঝে মাঝে তার মনে হইতে থাকে বটে যে সে। আবোল তাবোল বকিতেছে, কিন্তু নারীজাতি সম্বন্ধে তার জ্ঞানের পরিচয় পাইয়া সভার মেয়েরা একেবারে অভিভূত হইয়া যায়।

    রাজকুমার আসন গ্রহণ করিলে শ্যামল উঠিয়া দাঁড়াইল। রাজকুমারের চেয়ে বয়সে দু-এক বছরের ছোট হইলেও লম্বা চওড়া চেহারা আর মুখের ভারিকি গড়নের জন্য তাকেই বড় দেখায়। এতক্ষণ সে মালতীর পাশে মুখ ভার করিয়া বসিয়া ছিল। তীব্র দৃষ্টিতে রাজকুমারের মুখের দিকে চাহিয়া বক্তৃতা শুনিতে শুনিতে মাঝে মাঝে নিজের মনে বিড়বিড় করিয়া মন্তব্য করিতেছিল : পাগলের মতো কি যে বকে লোকটা! মাথা খারাপ নাকি? যত সব চালবাজি!–

    মালতী ছাড়া আর কেউ মন্তব্যগুলি শুনিতে পাইতেছিল কিনা বলা যায় না, একটা অত্যধিক কড়া কথা কানে যাওয়ায় মালতী একবার শুধু বলিয়াছিল : কি বললেন?

    আপনাকে বলি নি। রাজুদা কি রকম আবোল তাবোল বকছেন, শুনছেন তো? দাঁড়ান, ওঁর বাহাদুরি ভেঙে দিচ্ছি। মেয়েদের ধোঁকা দিয়ে।

    কি করবেন?

    দেখুন না কি করি।

    ছোটছেলের স্বপ্ন কাম্য খেলনা পাওয়ার মতো রাজকুমারকে জব্দ করার কি যেন একটা সুযোগ পাইয়া সে সযত্নে পুষিয়া রাখিতেছে, ফাঁক করিতে চায় না, ভাগ দিতে চায় না।

    সে উঠিয়া দাঁড়াইতে তার উদ্দেশ্য কতকটা আন্দাজ করিয়া মালতী চাপা গলায় বলিল, না না থাক, বসুন। তার পাঞ্জাবির প্রান্ত ধরিয়া আলগোছে একটু টানও সে দিল, কিন্তু শ্যামল বসিল না।

    আপনি কিছু বলবেন শ্যামলবাবু? এদিকে আসুন।–সরসী বলিল।

    এখান থেকেই বলি?

    আচ্ছা বলুন।

    অনেকগুলি চোখের, তার মধ্যে বেশির ভাগ মেয়েলি চোখ, প্রত্যাশাপূর্ণ দৃষ্টি মুখে আসিয়া পড়িয়াছে অনুভব করিয়া এক মুহুর্তের জন্য শ্যামলের উৎসাহ যেন উবিয়া গেল। এখন মালতী আরেকবার তার পাঞ্জাবির কোণ ধরিয়া একটু টানিলেই সে হয়তো বসিয়া পড়িত। অসহায়ের মতো এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে তার চোখে পড়িয়া গেল, রাজকুমারের মুখে মৃদু অমায়িক হাসি ফুটিয়া আছে, ছোটছেলে বাহাদুরি করিতে গেলে স্নেহশীল উদার গুরুজন যেমন প্রশ্রয়ের হাসি হাসেন।

    দেখিয়া শ্যামলের মাথা গরম হইয়া গেল।

    –আমার কথা শুনে আপনারা অনেকেই ক্ষুণ্ণ হবেন। আমাকে … কয়েকটি অপ্রিয় সত্য কথা বলতে হবে। বিশ্বনারী বা মাদ্রাজী মহিলাদের সম্বন্ধে নতুন কিছু আপনাদের শোনাবার জন্য আমি উঠে দাঁড়াই নি, রাজকুমারবাবুর বক্তৃতার কয়েকটা মারাত্মক ভুল দেখিয়ে দেওয়া আমার। উদ্দেশ্য। ব্যক্তিগতভাবে রাজকুমারবাবুকে আমি শ্ৰদ্ধা করি, উনি আমার অনেক দিনের বন্ধু–

    রাজকুমারের মুখে আর হাসির চিহ্নও ছিল না। কি সৰ্বনাশ, এতগুলি লোকের সামনে তাকে অপদস্থ করার জন্য শ্যামল উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। নিরীহ শান্ত ভালেমানুষ শ্যামল! রাজকুমারের কোনো সন্দেহই ছিল না যে সে অনেক ভুল করিয়াছে। এখন তার আতঙ্ক জন্মিয়া গেল যে ভুলগুলি নিশ্চয় সাধারণ তুচ্ছ ভুল নয়, শ্যামল চোখে আঙুল দিয়া ভুলগুলি দেখাইয়া দিলে তার আর মাথা উঁচু করিয়া বসিয়া থাকিবার উপায় থাকিবে না। সাংঘাতিক হাস্যকর ভুল না হইলে শ্যামল কি সাহস করিয়া মুখ খুলিতে পারি? না জানি কি ভাবিবে সকলে, মনে মনে কত হাসিবে, তার জ্ঞান বুদ্ধি অভিজ্ঞতার খোলসটা যখন শ্যামল ছিড়িয়া ফেলিতে থাকিবে। রাজকুমারের সর্বাঙ্গ ঘামিয়া গেল। এতদিন সে জানি, তার সম্বন্ধে মানুষ কি ধারণা পোষণ করে সে বিষয়ে তার কিছুমাত্র মাথাব্যথা নাই, এই সমস্ত অল্পবুদ্ধি অগভীর নরনারীর মতামতকে সে গ্রাহ্য করে না। এক মুহূর্ত আগেও সে নিজের কাছে স্বীকার করিত না বক্তৃতা না জমিলে মন তার খারাপ হইয়া যাইবে। এখন শ্যামলের উদ্যত আঘাতে নিজের বাহাদুরির প্রাসাদ ভাঙিয়া পড়ার উপক্রম করিয়াছে দেখিয়া সে বুঝিতে পারিল, লোকে তাকে কি ভাবে তা কত দামি তার নিজের কাছে। অবজ্ঞার ভয়ে মরণ কামনা করার মতো দামি সকলের তাকে বাহাদুর মনে করা।

    রাজকুমারের অপরিচিত একটি মেয়ে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছিল, দেখিলেই বোঝা যায় সে খাঁটি মাদ্ৰাজী মেয়ে। আর দশজন মেয়ের মধ্যে বসিয়াছিল বলিয়া এতক্ষণ সে রাজকুমারের নজরে পড়ে নাই, আসরে খাঁটি একজন মাদ্ৰাজী মেয়ে উপস্থিত আছে জানিলে রাজকুমারের বক্তৃতাটা আজ কি রকম দাঁড়াইত কে জানে!

    মেয়েটি বলিল, রাজকুমারবাবু নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন। ভুল দেখিয়ে দেবার প্রশ্ন ওঠে কি? এটা ডিবেটিং সোসাইটির মিটিং নয় আশা করি?

    সকলে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করিতে লাগিল। ঠিক তো, রাজকুমার যাই বলিয়া থাক, তার বক্তৃতায় সমালোচনা করিবার কি অধিকার শ্যামলের আছে?

    স্যার কে. এল হাসিমুখে বলিলেন, শ্যামল রাজকুমারের ভুল দেখিয়ে দিচ্ছে না, আমাদের যাতে ভুল ধারণা না জন্মায় সেজন্য নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছে। কি বল শ্যামল?

    শ্যামল তাড়াতাড়ি বলিল, আজ্ঞে হ্যাঁ। যেমন ধরুন রাজকুমারবাবু বিশ্বের নারীজাতির বিস্ময়কর মিলের কথা বলেছেন। পৃথিবীর যে কোনো একটি দেশের পুরুষের সঙ্গে অন্য যে কোনো একটি দেশের পুরুষের যতটা পার্থক্য দেখা যায়, দুটি দেশের মেয়েদের পার্থক্য নাকি তার চেয়ে অনেক কম। কথাটা কি ঠিক? আমাদের দেশের পুরুষরা যখন বিলিতি পুরুষদের সাজপোশাক চালচলন অনুকরণ করে তখন অতটা খারাপ দেখায় না, কিন্তু মেয়েরা ওদেশের মেয়েদের অনুকরণ করলে সেটা উদ্ভট আর হাস্যকর হয়ে দাঁড়ায়। ভারতীয় পুরুষ সহজেই সাজপোশাক চালচলনে তো বটেই, প্রকৃতিতে পর্যন্ত সায়েব হতে পারে, কিন্তু ভারতীয় মেয়েরা কোনোদিন মেমসায়েব হতে পারে না। রাজকুমারবাবু যে বিশ্বের নারীজাতির কথা বলেছিলেন তার কারণ বিশ্ব শব্দের একটা মোহ আছে, প্রথমে সকলে বিশ্বের কথাটা মনে পড়িয়ে দিলে সকলের মন উদার হয়ে যায়, বাজে কথাও সকলে বড় বড় অর্থে গ্রহণ করে। ও একটা প্যাচ ছাড়া কিছু নয়। রাজকুমারবাবু

    মাদ্ৰাজী মেয়েটি আবার উঠিয়া দাঁড়াইয়া প্রতিবাদ জানাইল, এটা কি ব্যক্তিগত আক্রমণ হচ্ছে না?

    স্যার কে. এল হাসিমুখেই সায় দিয়া বলিলেন, খানিকটা হচ্ছে বৈকি!

    শ্যামল জোর দিয়া বলিল, না না, ব্যক্তিগত আক্রমণ হবে কেন, রাজকুমারবাবুর সঙ্গে তো আমার শত্রুতা নেই! আমি বলছিলাম, মাদ্রাজের নারীদের অবস্থা সম্বন্ধে রাজকুমারবাবুর ধারণা খুব স্পষ্ট নয়, তিনি তাই বিশ্বের নারীজাতির কথা তুলেছিলেন, সমগ্ৰতার অস্পষ্টতায় যাতে খুঁটিনাটির অভাবটা চাপা পড়ে যায়। মাদ্রাজের নারীরাও বিশ্বের নারীজাতির অন্তর্গত বৈকি! মাদ্রাজের নারীদের সম্বন্ধে রাজকুমারবাবু যে সব কথা বলেছেন তার অধিকাংশ বিশ্বের যে কোনো দেশের নারীজাতির সম্বন্ধে বলা যায়। মাদ্ৰাজী মেয়েদের একটিমাত্র বৈশিষ্ট্যের কথা রাজকুমারবাবু স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন, যুগোপযোগী সংস্কারকে অত্যন্ত সহজে গ্রহণ করবার অশিক্ষিতপটুতা তাদের নাকি। বিস্ময়কর। স্কুল-কলেজের শিক্ষার হিসাবে তারা নাকি ভারতের অন্যান্য প্রদেশ, বিশেষ করে বাংলার তুলনায় অনেক পিছনে পড়ে আছেন, কিন্তু জীবনযাত্রাকে নতুন ছাঁচে ঢালবার চেষ্টায় সব প্রদেশকে হার মানিয়েছেন। এ ধারণা রাজকুমারবাবু যে কোথায় পেলেন কল্পনা করা কঠিন। মাদ্রাজের মেয়েরা তাদের সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে বিশেষ কোনো সংস্কারের আমদানি করেছেন, অথবা ও বিষয়ে তাঁদের উল্লেখযোগ্য উৎসাহ দেখা গিয়েছে বলে তো মনে হয় না। নতুন আলো চোখে লাগা আর সেই আশোয় নতুন দৃষ্টিতে জীবনকে যাচাই করার অসুবিধা ও সুযোগের অভাব অন্য সব প্রদেশের মতো মাদ্রাজের মেয়েদেরও কিছুমাত্র কম নয়।

    রাজকুমার চুপ করিয়া শুনিতেছিল এবং ভাবিতেছিল, এইবার সে উঠিয়া দাঁড়াইল। সব সময় তার মুখে যে মৃদু একটু বিবৰ্ণতার ছাপ থাকে, রাগে এখন তাহা মুছিয়া গিয়াছে। তবু সে শান্ত কণ্ঠেই বলিল, আমার কথা তুমি ঠিক বুঝতে পারনি শ্যামল। আমি বলেছি অন্য প্রদেশের চেয়ে মাদ্রাজের মেয়েরা পরিবর্তনকে গ্রহণ করছে একটু ব্যাপকভাবে, সামান্য হলেও তার ব্যাপ্তি আছে। বাংলায় মেয়েদের খুব সামান্য একটা অংশ অনেক এগিয়ে গেছে, তাদের সংখ্যা এত কম যে ধর্তব্যের মধ্যেই বলা চলে না। বাকি সকলে অর্থাৎ বাংলাদেশের মেয়ে বলতে যাদের বোঝায় তারা পড়ে আছে একেবারে পিছনে। মাদ্রাজের মেয়েদের একটা ক্ষুদ্র অংশবিশেষ এভাবে এগিয়ে না গিয়ে সকলে মিলে অল্প অল্প অগ্রসর হচ্ছে। ব্যাপারটা কেমন হয়েছে জান, বাংলায় একটুখানি নারীপ্রগতি যেন সঞ্চিত হয়েছে কাচের সরু নলে, গভীরতা আছে কিন্তু ব্যাপ্তি নেই আর মাদ্রাজের নারী প্রগতিটুকু সঞ্চিত হয়েছে থালায়, গভীরতা নেই কিন্তু বিস্তার আছে। আমি মনে করি, মৃতদেহের একটা আঙুল প্রাণ পেয়ে যতই তিড়িং তিড়িং করে লাফিয়ে জীবনের প্রমাণ দিক, তার চেয়ে সর্বাঙ্গে একটুখানি প্রাণ সঞ্চার হয়ে শরীরটা যদি এক ডিগ্রিও গরম হয়, তাও অনেক ভালো।

    রাজকুমার ধপ্‌ করিয়া বসিয়া পড়িল। তার ডবল উপমার ধাক্কায় শ্যামলের এতক্ষণের বড় বড় কথাগুলি যেন ধুলা হইয়া বাতাসে উড়িয়া গেল।

    কিন্তু শ্যামল তখন মরিয়া হইয়া উঠিয়াছে। রাজকুমারকে জব্দ করিতে উঠিয়া নিজে জব্দ হইয়া আসন গ্রহণ করার মতো মানসিক অবস্থা তার ছিল না। প্রাণপণ চেষ্টায় একটু অবজ্ঞার হাসি হাসিয়া সে বলিতে গেল, রাজকুমারবাবু যে সব–

    রিণি তীক্ষকণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি কখনো মাদ্রাজে গেছেন শ্যামলবাবু?

    শ্যামল দমিয়া গেল, আমতা আমতা করিয়া বলিল, আমি–? না, যাই নি।

    ও! কিছু মনে করবেন না, এমনি জিজ্ঞেস করছিলাম।

    শ্যামল বোধহয় আরো কিছু বলিতে যাইতেছিল সুযোগ পাইল না। পাঞ্জাবির ডানদিকের পকেটে তার এমন জোরে টান পড়িল যে আপন হইতেই সে বসিয়া পড়িল।

    মালতী বলিল, চুপ করে বসে থাকুন।

    কেন? আমার যা বলবার আছে—

    চুপ। একটি কথা নয়। মুখ বুজে বসে থাকুন।

    না বস্‌ব না। আমি যাই।

    বসে থাকুন। সকলের সঙ্গে যাবেন।

    মালতীর চাপা গলার তীব্র ধমকে শ্যামল যেন শিথিল, নিস্তেজ হইয়া গেল।

    তারপর রিণি যখন সভাশেষের গান ধরিয়াছে, মেয়েরা মৃদুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা আরম্ভ করিয়াছে, মাদ্ৰাজী মেয়েটির সঙ্গে সরসী রাজকুমারের পরিচয় করাইয়া দিল। মেয়েটির নাম রুক্মিণী, সরসীর সঙ্গে পড়িত। এখন নিজে আর পড়ে না, একটি স্কুলে মেয়েদের পড়ায়।

    আপনি সুন্দর বলেছেন। রাজকুমার সবিনয়ে হাসিল।

    আমি ভাবছিলাম একজন বাঙালি ভদ্রলোক আমাদের দেশের মেয়েদের সম্বন্ধে বলবেন, এ তো ভারি আশ্চর্য, আমাদের দেশের মেয়েদের কথা তিনি ভালো করে জানবেন কি করে? খুব। আগ্রহ নিয়ে তাই আপনার কথা শুনতে এসেছিলাম। ভারি খুশি হয়েছি আপনার বক্তৃতা শুনে। কেবল একটা কথা দ্বিধা ও সঙ্কোচের ভঙ্গিতে রুক্মিণী এতক্ষণ ইতস্তত করিল যে রাজকুমারের মনে হইল কথাটা বুঝি শেষ পর্যন্ত না বলাই সে ঠিক করিয়াছে–একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাকে। আচ্ছা, মাদ্রাজের দু-চার জন মেয়েও কি বাংলার কাচের নলের মেয়েদের–মানে, যারা খুব এগিয়ে গেছেন তাদের সমান হতে পারেন নি?

    রাজকুমার ব্যস্ত হইয়া বলিল, তা পেরেছেন বৈকি, অনেকেই পেরেছেন।

    রুক্মিণী খুশি হইয়া বলিল, থ্যাঙ্কস।

    তাই বটে। একজন মাদ্ৰাজী মেয়েও যদি চরম-কালচারী বাঙালি মেয়েদের সমান না হইতে পারিয়া থাকে, রুক্মিণী তবে দাঁড়ায় কোথায়? রাজকুমার মনে মনে ভাবিল, রুক্মিণী মেয়েটি বেশ।

    সকলের আগে স্যার কে. এল বিদায় নিলেন। তাঁর অম্বলের অসুখ, লাইট রিফ্রেশমেন্টও সহ্য হইবে না। তাছাড়া, এই সব ছেলেমানুষের সভায় যদি বা এতক্ষণ থাকা গিয়াছিল, সভা এখন বৈঠকে পরিণত হইয়াছে, এখন আর থাকা চলে না। তাঁর কাজও আছে।

    রাজকুমার বলিল, চলুন আমিও আপনার সঙ্গে যাই।

    পথে স্যার কে. এল আপন মনেই নিঃশব্দে হাসিতে লাগিলেন, উপভোগ্য একটা রসিকতার রস যেন মন হইতে তার কিছুতেই মিলাইয়া যাইতেছে না।

    অনেকদিন আগে এমনি একটা আসরে উপস্থিত ছিলাম রাজু। বিলাতে।

    এমনি আসর?

    অবিকল এই রকম। ইয়ং বয়েজ অ্যাণ্ড গার্লস্। আমার মতোই একজন আধুবুড়োকে। প্রেসিডেন্ট করেছিল। একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ রাজু। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা সভা করে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট করে বুড়োকে? কম বয়সী কাউকে প্রেসিডেন্ট করতে বোধহয় তাদের হিংসা হয়। কিংবা হয়ত প্রেসিডেন্ট বলতেই এমন একটা গম্ভীর জবরদস্ত মানুষ বোঝায় যে বুড়ো ছাড়া প্রেসিডেন্টের আসনে কাউকে বসাবার কথা তারা ভাবতেও পারে না।

    রাজকুমার হাসিল। –বর্ণনাটা কিন্তু আপনার সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না।

    স্যার কে. এলও হাসিলেন। কিছু কিছু খাপ খায় বৈকি। বয়স তো হয়েছে, আমি হলাম অতীতের জীব, তোমাদের কাছে আমি বুড়ো, স্থিতি লাভ করেছি। আমাকে প্রেসিডেন্টের আসনে বসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে চপলতা করা কত সুবিধা বল তো!

    চপল স্যার কে. এল?

    চপল রাজু, নিছক চপলতা। তোমাদের কপাল ভালো, এত সহজে এত সস্তায় চপল হতে পার। আমার আধ বোতল শ্যাম্পেন দরকার হয়, তিন চারটা ককটেল। তাও কি তোমাদের মতো চপলতা আসে! হয় দার্শনিক চিন্তা আসে, নয় ঘুম পায়।

    স্যার কে. এল-এর বাড়ির দরজায় গাড়ি দাঁড়াইল। স্যার কে. এল কিন্তু নামিলেন না।

    এক কাপ কফি খেয়ে যাবে রাজু?

    কফি? কফি খেলে রাত্রে ঘুম হয় না।

    রাজকুমার নামিয়া গেল। আসরে তার ভালো লাগে নাই, বক্তৃতা শুনিয়া সকলে খুব হৈচৈ করিয়াছে বটে শেষের দিকে, নিজে কিন্তু সে ভুলিতে পারে নাই আগাগোড়া সবটাই তার কিছু সকলকে ভাওতা দিয়া সে হাততালি পাইয়াছে এবং একটু চিন্তা করে এমন যারা আসরে ছিল তাদের কাছে তার ফাঁকি ধরা পড়িয়া গিয়াছে। সাফল্যের আনন্দের সঙ্গে সে তাই লজ্জাও বোধ করিয়াছিল, এখনো করিতেছে। শ্যামলের ব্যবহারেও মনটা বড় বিগড়াইয়া গিয়াছিল। সেখানে যেন বাতাসে পাখা মেলাইয়া উড়িয়া বেড়ানোর মতো হালকা মনে হইয়াছিল নিজেকে। তখন বুঝিতে পারে নাই। এখন স্যার কে. এল-এর সঙ্গে এতটুকু পথ গাড়িতে আসিয়া এমন ভারি বোধ হইতেছে নিজস্বতাকে যে সাধ যাইতেছে ফুটপাতে গা এলাইয়া শুইয়া পড়ে।

    স্যার কে. এল ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন, ক্লাব।

    বাড়ির দরজা পর্যন্ত আসিয়া স্যার কে. এল ফিরিয়া গেলেন ক্লাবে এবং কোথাও যাইবার কথা। ভাবিতে না পারিয়া রাজকুমার ফিরিয়া গেল নিজের ঘরে।

    আবার কি মাথা ধরিয়াছে তার? কেমন একটা ভে যন্ত্রণা বোধ হইতেছে মাথার মধ্যে। চারকোনা ঘরের বাতাস যেন চারিদিক হইতে মাথায় তার চাপ দিতেছে।

    1 2 3 4 5 6 7
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleচিহ্ন – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article অহিংসা – মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025
    Our Picks

    ঘনাদা সমগ্র ৩ – প্রেমেন্দ্র মিত্র

    September 24, 2025

    মহাস্থবির জাতক – প্রেমাঙ্কুর আতর্থী

    September 24, 2025

    হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত – প্রেমময় দাশগুপ্ত

    September 24, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    • Sign Up
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }