Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চন্দ্রনাথ – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক পাতা গল্প92 Mins Read0
    ⤷

    চন্দ্রনাথ

    প্রথম পরিচ্ছেদ

    চন্দ্রনাথের পিতৃ-শ্রাদ্ধের ঠিক পূর্বের দিন কি একটা কথা লইয়া তাহার খুড়া মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের সহিত তাহার মনান্তর হইয়া গেল। তাহার ফল এই হইল যে, পরদিন মণিশঙ্কর উপস্থিত থাকিয়া তাঁহার অগ্রজের পারলৌকিক সমস্ত কাজের তত্ত্বাবধান করিলেন, কিন্তু একবিন্দু আহার্য স্পর্শ করিলেন না, কিংবা নিজের বাটীর কাহাকেও স্পর্শ করিতে দিলেন না। ব্রাহ্মণ-ভোজনান্তে চন্দ্রনাথ করজোড়ে কহিল, কাকা, দোষ করি, অপরাধ করি, আপনি আমার পিতৃতু্ল্য, আমি আপনার ছেলের মত—এবার মার্জনা করুন।

    পিতৃতুল্য মণিশঙ্কর উত্তরে বলিলেন, বাবা, তোমরা কলকাতায় থেকে বি. এ., এম. এ. পাশ করে বিদ্বান্‌ ও বুদ্ধিমান্ হয়েছো, আমরা কিন্তু সেকালের মূর্খ, আমাদের সঙ্গে তোমাদের মিশ খাবে না। এই দেখ না কেন, শাস্ত্রকারেরাই বলেছেন, যেমন, গোড়া কেটে আগায় জল ঢালা।

    শাস্ত্রোক্ত বচনটির সহিত আধু্নিক পণ্ডিত ও সেকেলে মূর্খের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ না থাকিলেও মণিশঙ্কর যে নিজের মনের ভাবটা প্রকাশ করিয়াছিলেন, চন্দ্রনাথ তাহা বুঝিয়া মনে মনে প্রতিজ্ঞা করিল, খুড়ার সহিত আর সে কোন সম্বন্ধ রাখিবে না। আর পিতার জীবদ্দশাতেও দুই সহোদরের মধ্যে হৃদ্যতা ছিল না। কিন্তু আহার-ব্যবহারটা ছিল। এখন সেইটা বন্ধ হইল। চন্দ্রনাথের পিতা যথেষ্ট ধনসম্পত্তি রাখিয়া গিয়াছেন, কিন্তু বাটীতে আত্মীয়-স্বজন কেহ নাই, শুধু এক অপুত্রক মাতুল এবং দ্বিতীয় পক্ষের মাতুলানী।

    সমস্ত বাড়িটা যখন বড় ফাঁকা ঠেকিল, চন্দ্রনাথ তখন বাটীর গোমস্তাকে ডাকিয়া কহিল, সরকারমশায়, আমি কিছুদিনের জন্য বিদেশে যাব, আপনি বিষয়-সম্পত্তি যেমন দেখছিলেন, তেমনি দেখবেন। আমার ফিরে আসতে বোধ করি বিলম্ব হবে।

    মাতুল ব্রজকিশোর তাহাতে আপত্তি প্রকাশ করিয়া কহিলেন, এখন তোমার কোথাও গিয়ে কাজ নেই; তোমার মন খারাপ হয়ে আছে, এ সময় বাটীতে থাকাই উচিত।

    চন্দ্রনাথ তাহা শুনিল না। বিষয়-সম্পত্তির সমুদয় ভার সরকার মহাশয়ের উপর দিয়া, এবং বসত-বাটীর ভার ব্রজকিশোরের উপর দিয়া অতি সামান্যভাবেই সে বিদেশ-যাত্রা করিল। যাইবার সময় একজন ভৃত্যকেও সঙ্গে লইল না।

    ব্রজকিশোরকে নিভৃতে ডাকিয়া তাঁহার স্ত্রী হরকালী বলিল, একটা কাজ করলে না?

    ব্রজকিশোর জিজ্ঞাসা করিলেন, কি কাজ?

    এই যে বিদেশে গেল, একটা কিছু লিখে নিলে না কেন? মানুষ কখন কি হয়, কিছুই বলা যায় না। যদি বিদেশে ভালমন্দ হঠাৎ কিছু হয়ে যায়, তখন তুমি দাঁড়াবে কোথায়?

    ব্রজকিশোর কানে আঙুল দিয়া জিভ কাটিয়া কহিলেন, ছি, ছি, এমন কথা মুখে এনো না।

    হরকালী রাগ করিল। কহিল, তুমি বোকা, তাই মুখে আনতে হয়েছে, যদি সেয়ানা হ’তে, আমাকে মুখে আনতে হ’ত না।

    কিন্তু কথাটা যে ঠিক, তাহা ব্রজকিশোর স্ত্রীর কৃপায় দুই-চারি দিনেই বুঝিতে পারিলেন। তখন পরিতাপ করিতে লাগিলেন।

    এক বৎসর চন্দ্রনাথ নানা স্থানে একা ভ্রমণ করিয়া বেড়াইল। তাহার পর গয়ায় আসিয়া স্বর্গীয় পিতৃদেবের সাংবাৎসরিক পিণ্ডদান করিল, কিন্তু তাহার বাটী ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইল না—মনে করিল, কিছুদিন কাশীতে অতিবাহিত করিয়া যাহা হয় করিবে। কাশীতে মুখোপাধ্যায় বংশের পাণ্ডা হরিদয়াল ঘোষাল। চন্দ্রনাথ একদিন দ্বিপ্রহরে একটি ক্যাম্বিসের ব্যাগ হাতে লইয়া তাঁহার বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। কাশী চন্দ্রনাথের অপরিচিত নহে, ইতিপূর্বে কয়েকবার সে পিতার সহিত এখানে আসিয়াছিল। হরিদয়ালও তাহাকে বিলক্ষণ চিনিতেন। অকস্মাৎ তাহার এরূপ আগমনে তিনি কিছু বিস্মিত হইলেন। উপরের একটা ঘর চন্দ্রনাথের জন্য নির্দিষ্ট হইল, এবং ইহাও স্থির হইল যে, চন্দ্রনাথের যতদিন ইচ্ছা তিনি এইখানে থাকিবেন।

    এ কক্ষের একটা জানালা দিয়া ভিতরের রন্ধনশালার কিয়দংশ দেখা যাইত। চন্দ্রনাথ আগ্রহের সহিত অনেক সময় এইদিকে চাহিয়া থাকিত। রন্ধন-সামগ্রীর উপরেই যে আগ্রহ তাহা নহে, তবে রন্ধনকারিণীকে দেখিতে বড় ভাল লাগিত।

    বিধবা সুন্দরী। কিন্তু মুখখানি যেন দুঃখের আগুনে দগ্ধ হইয়া গেছে! যৌবন আছে কি গিয়াছে, সেও যেন আর চোখে পড়িতে চাহে না। তিনি আপন মনে আপনার কাজ করিয়া যান, নিকটে কেবল একটি দশমবর্ষীয়া বালিকা রন্ধনের যোগাড় করিয়া দিতে থাকে। চন্দ্রনাথ অতৃপ্তনয়নে তাহাই দেখে।

    কিছুদিন তিনি চন্দ্রনাথের সম্মুখে বাহির হইলেন না। আহার্য সামগ্রী ধরিয়া দিয়া সরিয়া যাইতেন। কিন্তু ক্রমশঃ বাহির হইতে লাগিলেন। একে ত চন্দ্রনাথ বয়সে ছোট, তাহাতে এক স্থানে অধিক দিন ধরিয়া থাকিলে একটা আত্মীয়-ভাব আসিয়া পড়ে। তখন তিনি চন্দ্রনাথকে খাওয়াইতে বসিতেন—জননীর মত কাছে বসিয়া যত্নপূর্বক আহার করাইতেন।

    আপনার জননীর কথা চন্দ্রনাথের স্মরণ হয় না—চিরদিন মাতৃহীন চন্দ্রনাথ পিতার নিকট লালিত-পালিত হইয়াছিল। পিতা সে স্থান কতক পূর্ণ রাখিয়াছিলেন সত্য, কিন্তু এরূপ কোমল স্নেহ তথায় ছিল না।

    পিতার মৃত্যুতে চন্দ্রনাথের বুকের যে অংশটা খালি পড়িয়াছিল, শুধু তাহাই পূর্ণ হইয়া আসিতে লাগিল তাহা নহে, অভিনব মাতৃস্নেহ-রসে তাহাকে অভিভূত করিয়া ফেলিতে লাগিল।

    একদিন চন্দ্রনাথ হরিদয়ালকে জিজ্ঞাসা করিল, আপনার নিজের বলিতে কেহ ত নাই বলিয়াই জানি, কিন্তু ইনি কে?

    হরিদয়াল কহিলেন, ইনি বামুন-ঠাকরুন!

    কোন আত্মীয়?

    না।

    তবে এদের কোথায় পেলেন?

    হরিদয়াল কহিলেন, সে অনেক কথা। তবে সংক্ষেপে বলতে হলে, ইনি প্রায় তিন বৎসর হ’ল স্বামী এবং ওই মেয়েটিকে নিয়ে তীর্থ করতে আসেন। কাশীতে স্বামীর মৃত্যু হয়। দেশেও এমন কোন আত্মীয় নেই যে ফিরে যান। তার পর ত দেখছ।

    আপনি পেলেন কিরুপে?

    মণিকর্ণিকার ঘাটের কাছে মেয়েটি ভিক্ষে করছিল।

    চন্দ্রনাথ একটু চিন্তা করিয়া কহিল, কোথায় বাড়ি জানেন কি?

    ঠিক জানি না। নবদ্বীপের নিকট কোন একটা গ্রামে।

    দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

    দিন-দুই পরে আহারে বসিয়া চন্দ্রনাথ বামুন-ঠাকরুনের মুখের পানে চাহিয়া সহসা জিজ্ঞাসা করিল, আপনারা কোন্‌ শ্রেণী?

    বামুন-ঠাকরুনের মুখখানি বিবর্ণ হইয়া গেল। এ প্রশ্নের হেতু তিনি বুঝিলেন। কিন্তু যেন শুনিতে পান নাই, এই ভাবে তাড়াতাড়ি দাঁড়াইয়া বলিলেন, যাই দুধ আনি গে।

    দুধের জন্য অত তাড়াতাড়ি ছিল না। ভাবিবার জন্য তিনি একেবারে রন্ধনশালায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে কন্যা সরযূবালা হাতা করিয়া দুধ ঢালিতেছিল, জননীর বিবর্ণ-মুখ লক্ষ্য করিল না। জননী কন্যার মুখপানে একবার চাহিলেন, দুধের বাটি হাতে লইয়া একবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মনে মনে কহিলেন, হে দীন-দুঃখীর প্রতিপালক, হে অন্তর্যামী, তুমি আমাকে মার্জনা ক’রো। তাহার পর দুধের বাটি আনিয়া নিকটে রাখিয়া উপবেশন করিলে, চন্দ্রনাথ পুনরায় সেই প্রশ্ন করিল।

    একটি-একটি করিয়া সমস্ত কথা জানিয়া লইয়া চন্দ্রনাথ অবশেষে জিজ্ঞাসা করিল, আপনি বাড়ি যান না কেন? সেখানে কি কেউ নেই?

    খেতে দেয় এমন কেউ নেই।

    চন্দ্রনাথ মুখ নিচু করিয়া কিছুক্ষণ ভাবিয়া কহিল, আপনার একটি কন্যা আছে, তার বিবাহ কিরূপে দেবেন?

    বামুন-ঠাকরুন দীর্ঘনিশ্বাস চাপিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, বিশ্বেশ্বর জানেন।

    আহার প্রায় শেষ হইয়া আসিল। চন্দ্রনাথ মুখ তুলিয়া চাহিয়া বলিল, ভাল ক’রে আপনার মেয়েটিকে কখন দেখিনি,—হরিদয়াল বলেন খুব শান্ত-শিষ্ট। দেখতে সুশ্রী কি?

    বামুন-ঠাকরুন ঈষৎ হাসিয়া প্রকাশ্যে কহিলেন, আমি মা, মায়ের চক্ষুকে ত বিশ্বাস নেই বাবা; তবে সরযূ বোধ হয় কুৎসিত নয়। কিন্তু মনে মনে বলিলেন, কাশীতে কত লোক আসে যায়, কিন্তু এত রূপ ত কারও দেখিনি।

    ইহার তিন-চারি দিন পরে একদিন প্রভাতে চন্দ্রনাথ বেশ করিয়া সরযূকে দেখিয়া লইল। মনে হইল, এত রূপ আর জগতে নাই। রান্নাঘরে বসিয়া সরযূ তরকারি কুটিতেছিল। সেখানে অপর কেহ ছিল না। জননী গঙ্গাস্নানে গিয়াছিলেন, এবং হরিদয়াল যথানিয়মে যাত্রীর অন্বেষণে বাহির হইয়াছিলেন।

    চন্দ্রনাথ নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল। ডাকিল, সরযূ!

    সরযূ চমকিত হইল। জড়সড় হইয়া বলিল, আজ্ঞে।

    তুমি রাঁধতে পারো?

    সরযূ মাথা নাড়িয়া কহিল, পারি।

    কি কি রাঁধতে শিখেছ?

    সরযূ চুপ করিয়া রহিল, কেননা, পরিচয় দিতে হইলে অনেক কথা কহিতে হয়।

    চন্দ্রনাথ মনের ভাবটা বুঝিতে পারিল, তাই অন্য প্রশ্ন করিল, তোমার মা ও তুমি দুই জনেই এখানে কাজ কর?

    সরযূ ঘাড় নাড়িয়া বলিল, করি।

    তুমি কত মাইনে পাও?

    মা পান, আমি পাই নে। আমি শুধু খেতে পাই।

    খেতে পেলেই তুমি কাজ কর?

    সরযূ চুপ করিয়া রহিল।

    চন্দ্রনাথ কহিল, মনে কর, আমি যদি খেতে দিই, তা হ’লে আমারও কাজ কর?

    সরযূ ধীরে ধীরে বলিল, মাকে জিজ্ঞাসা করব।

    তাই ক’রো।

    সেইদিন চন্দ্রনাথ হরিদয়াল ঠাকুরকে দুই-একটা কথা জিজ্ঞাসা করিয়া বাটীতে সরকার মহাশয়কে এইরূপ পত্র লিখিল—

    আমি কাশীতে আছি। এখানে এই মাসের মধ্যেই বিবাহ করিব স্থির করিয়াছি। মাতুল মহাশয়কে এ কথা বলিবেন এবং আপনি কিছু অর্থ, অলঙ্কার এবং প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লইয়া শীঘ্র আসিবেন।

    সেই মাসেই চন্দ্রনাথ সরযূকে বিবাহ করিল।

    তাহার পর বাড়ি যাইবার সময় আসিল। সরযূ কাঁদিয়া বলিল, মার কি হবে?

    আমাদের সঙ্গে যাবেন।

    কথাটা বামুন-ঠাকরুণের কানে গেল। তিনি কন্যা সরযূকে নিভৃতে ডাকিয়া বলিলেন, সরযূ, সেখানে গিয়ে তুই আমার কথা মাঝে মাঝে মনে করিস, কিন্তু আমার নাম কখনো মুখে আনিস না। যত দিন বাঁচবো কাশী ছেড়ে কোথাও যাব না। তবে যদি কখনো তোমাদের এ অঞ্চলে আসা হয়, তা হ’লে আবার দেখা হতে পারে।

    সরযূ কাঁদিতে লাগিল।

    জননী তাহার মুখে অঞ্চল দিয়া কান্না নিবারণ করিলেন, এবং গম্ভীর হইয়া কহিলেন, বাছা, সব জেনেশুনে কি কাঁদতে আছে?

    কন্যা জননীর কোলের ভিতর মুখ লুকাইয়া ডাকিল, মা—

    তা হোক। মায়ের জন্য যদি মাকে ভুলতে হয়, সেই ত মাতৃভক্তি মা!

    চন্দ্রনাথ অনুরোধ করিলেও তিনি ইহাই বলিলেন। কাশী ছাড়িয়া তিনি আর কোথাও যাইতে পারিবেন না।

    চন্দ্রনাথ বলিল, একান্ত যদি অন্যত্র না যাবেন, তবে অন্ততঃ স্বাধীনভাবে কাশীতে বাস করুন।

    বামুন-ঠাকরুন তাহাও অস্বীকার করিয়া বলিলেন, হরিদয়াল ঠাকুর আমাকে মেয়ের মত যত্ন করেন এবং নিতান্ত দুঃসময়ে আশ্রয় দিয়েছিলেন, আমিও তাঁকে পিতার মত ভক্তি করি; তাঁকে কিছুতেই ত্যাগ করতে পারব না।

    চন্দ্রনাথ বুঝিল, দুঃখিনীর আত্মসম্ভ্রম বোধ আছে, সাধ করিয়া তিনি কাহারও দয়ার পাত্রী হইবেন না। কাজেই তখন শুধু সরযূকে লইয়া চন্দ্রনাথ বাটী ফিরিয়া আসিল।

    এখানে আসিয়া সরযূ দেখিল, প্রকাণ্ড বাড়ি! কত গৃহসজ্জা, কত আসবাব—তাহার আর বিস্ময়ের অবধি রইল না। সে মনে মনে ভাবিল, কি অনুগ্রহ! কত দয়া!

    চন্দ্রনাথ বালিকা বধূকে আদর করিয়া কহিল, বাড়িঘর সব দেখলে? মনে ধরেচে ত?

    সরযূ অত্যন্ত কুণ্ঠিত হইয়া আঁচলে মুখ লুকাইয়া মাথা নাড়িল।

    চন্দ্রনাথ স্ত্রীর মনের কথা বুঝিতে চাহে নাই; প্রত্যুত্তরে কণ্ঠস্বর শুনিতে চাহিয়াছিল, তাই দুই হাতে সরযূর মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া কহিল, কি বল, মনে ধরেছে ত?

    লজ্জায় সরযূর মুখ আরক্ত হইয়া গেল, কিন্তু স্বামীর পুনঃ পুনঃ প্রশ্নে কোনরূপে সে বলিয়া ফেলিল, সব তোমার?

    চন্দ্রনাথ হাসিয়া কথাটা একটু ফিরাইয়া বলিল, হাঁ, সব তোমার।

    তৃতীয় পরিচ্ছেদ

    তাহার পর কতদিন অতিবাহিত হইয়া গেল। সরযূ বড় হইয়াছে। স্বামীকে সে কত যত্ন করিতে শিখিয়াছে। চন্দ্রনাথ বুঝিতে পারে যে, সে কথা কহিবার পূর্বেই সরযূ তাহার মনের কথা বুঝিয়া লয়। কিন্তু সে যদি শুধু দাসী হইত, তাহা হইলে সমস্ত বিশ্ব খুঁজিয়াও চন্দ্রনাথ এমন আর একটি দাসী পাইত না, কিন্তু শুধু দাসীর জন্যই কেহ বিবাহ করে না—স্ত্রীর নিকট আরও কিছুর আশা রাখে। মনে হয়, দাসীর আচরণের সহিত স্ত্রীর আচরণটি সর্বতোভাবে মিলিয়া না গেলেই ভাল হয়। সরযূর ব্যবহার বড় নিরীহ, বড় মধুর, কিন্তু দাম্পত্যের সুনিবিড়-পরিপূর্ণ সুখ কিছুতেই যেন গড়িয়া তুলিতে পারিল না। তাই এমন মিলনে, এত যত্ন-আদরেও উভয়ের মধ্যে একটা দূরত্ব, একটা অন্তরাল কিছুতেই সরিতে চাহিল না। একদিন সে সরযূকে হঠাৎ বলিল, তুমি এত ভয়ে ভয়ে থাক কেন? আমি কি কোন দুর্ব্যবহার করি?

    সরযূ মনে মনে ভাবিল, এ কথার উত্তর কি? তুমি নিজে জানো না? তাহার পর ভাবিল, তুমি দেবতা, কত উচ্চ, কত মহৎ,—আর আমি? সে তুমি আজও জানো না। তুমি আমার প্রতিপালক, আমি শুধু তোমার আশ্রিতা। তুমি দাতা, আমি ভিখারিণী।

    তাহার সমস্ত হৃদয় কৃতজ্ঞতায় পরিপূর্ণ, তাই ভালবাসা মাথা ঠেলিয়া উপরে উঠিতে পারে না,—অন্তঃসলিলা ফল্গুর মত নিঃশব্দে ধীরে ধীরে হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশে লুকাইয়া বহিতে থাকে, উচ্ছৃঙ্খল হইতে পায় না—তেমনি অবিশ্রাম বহিতে লাগিল, কিন্তু চন্দ্রনাথ তাহার সন্ধান পাইল না—অতি বড় দুর্ভাগারা যেমন জীবনের মাঝে ভগবানকে খুঁজিয়া পায় না। কিন্তু আজ অকস্মাৎ উজ্জ্বল দীপালোকে যখন সে দেখিতে পাইল, পদ্মের মত ডাগর সরযূর চক্ষু দুটিতে অশ্রু ছাপাইয়া উঠিয়াছে, তখন কাতর হইয়া সহসা তাহাকে সে কাছে টানিয়া লইল। বুকের উপর মুখ লুটাইয়া পড়িল। চন্দ্রনাথ কহিল, থাক, ওসব কথায় আর কাজ নেই—বলিয়া দুই হাতে স্ত্রীর মুখ তুলিয়া ধরিল, মুদিত চক্ষের উপর সরযূ একটা তপ্ত-নিশ্বাস অনুভব করিল।

    চন্দ্রনাথ কহিল, একবার চেয়ে দেখ দেখি—

    সরযূর চোখের পাতা দুইটি আকুলভাবে পরস্পরকে জড়াইয়া ধরিল, সে কিছুতেই চাহিতে পারিল না।

    কিছুক্ষণ পরে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া চন্দ্রনাথ কহিল, তোমার বড় ভয়, তাই চাইতে পারলে না সরযূ। কিন্তু পারলে ভাল হ’ত, না হয়, একটা কাজ ক’রো, আমার ঘুমন্ত মুখ ভাল করে চেয়ে দেখো—এ মুখে ভয় করবার মত কিছু নেই। বুকে শুয়ে আছ, ভিতরের কথাটা কি শুনতে পাও না? তাই বড় দুঃখ হয় সরযূ—আমাকে তুমি বুঝতেই পারলে না।

    তবু সরযূ কথা কহিতে পারিল না, শুধু মনে মনে স্বামীর চরণে প্রণাম করিয়া কহিল, আমি পদাশ্রিতা দাসী, দাসীকে চিরদিন দাসীর মতই থাকিতে দিয়ো।

    চতুর্থ পরিচ্ছেদ

    চন্দ্রনাথের মাতুলানী হরকালীর মনে আর তিলমাত্র সুখ রহিল না। ভগবান তাহাকে এ কি বিড়ম্বনার মধ্যে ফেলিয়া দিলেন। এ সংসারটা কাহারো নিকট কণ্টকাকীর্ণ অরণ্যের মত বোধ হয়, তাহাদের চেষ্টা করিয়া এখানে একটা পথের সন্ধান করিতে হয়। কেহ পথ পায়, কেহ পায় না। অনেক দিন হইতে হরকালীও এই সংসার-কাননে একটা সংক্ষেপ-পথ খুঁজিতেছিল, চন্দ্রনাথের পিতার মৃত্যুতে একটা সুরাহাও হইয়াছিল। কিন্তু এই আকস্মিক বিবাহ, বধূ সরযূ, চন্দ্রনাথের অতিরিক্ত পত্নীপ্রেম, তাহার এই পাওয়া-পথের মুখটা একেবারে পাষাণ দিয়া যেন গাঁথিয়া দিল। হরকালীর একটি বছর পাঁচেকের বোনঝি পিতৃগৃহে বড় হইয়া আজ দশ বছরেরটি হইয়াছে, কিন্তু সে কথা যাক। নানা কারণে হরকালীর মনের সুখ-শান্তি অন্তর্হিত হইবার উপক্রম করিয়াছিল।

    অবশ্য আজও সে-ই গৃহিণী, তাহার স্বামী কর্তা—এ সমস্ত তেমনিই আছে। আজ পর্যন্ত সরযূ তাহারই মুখ চাহিয়া থাকে, কোন অসন্তোষ বা অভিমান প্রকাশ করে না। দেখিলে মনে হয়, সে এই পরিবারভুক্ত একটি সামান্য পরিজন মাত্র। হরকালীর স্বামী এইটুকু দেখিয়াই খুশি হইয়া যেই বলিতে যান—বৌমা আমার যেন—, হরকালী চোখ রাঙ্গা করিয়া ধমক দিয়া বলিয়া উঠে, চুপ কর, চুপ কর। য বোঝ না, তাতে কথা কয়ো না। তোমার হাতে দেওয়ার চেয়ে বাপ-মা আমাকে হাত-পা বেঁধে জলে ফেলে দিলে ছিল ভাল।

    ব্রজকিশোর মুখ কালি করিয়া উঠিয়া যান।

    হরকালীর বয়স প্রায় ত্রিশ হইতে চলিল, কিন্তু সরযূর আজও পঞ্চদশ উত্তীর্ণ হয় নাই,—তবু তাহার আসা অবধি দুই জনের মনে মনে যুদ্ধ বাধিয়াছে। প্রাণপণ করিয়াও হরকালী জয়ী হইতে পারে না। একফোঁটা মেয়ের শক্তি দেখিয়া হরকালী মনে মনে অবাক হয়। বাহিরের লোক এ কথা জানে না যে, এই অন্তর-যুদ্ধে সরযূ ডিক্রি পাইয়াছে, কিন্তু তাহা জারি করে নাই। নিজের ডিক্রি নিজে তামাদি করিয়া বিজিত অংশ তাহাকেই সে ফিরাইয়া দিয়াছে এবং এখানেই হরকালীর একেবারে হার হইয়াছে।

    হরকালী বুঝিতে পারে, সরযূ বোবা কিংবা হাবা নহে। অনেকগুলি শক্ত কথারও সে এমন নিরুত্তর অবনতমুখে উত্তর দিতে সমর্থ যে, হরকালী একেবারে স্তম্ভিত হইয়া যায়, কিন্তু না পারিল সে এই মেয়েটির সহিত সন্ধি করিতে, না পারিল তাহাকে জয় করিতে। সরযূ যদি কলহ-প্রিয় মুখরা হইত, স্বার্থপর নির্দয় হইত, তাহা হইলেও হরকালী হয়ত পথ খুঁজিয়া পাইত। কিন্তু সরযূ নিজ হইতে এতখানি করুণা তাহাকে দিয়া রাখিয়াছে যে হরকালী অপরের করুণা ভিক্ষা করিবার আর অবকাশ পায় না।

    সরযূ অন্তরে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারে যে, এ বাটীর সে-ই সর্বময়ী কর্ত্রী, হরকালী কেহ না, তাই বাহিরে সে কেহ না হইয়া হরকালীকেই সর্বময়ী করিয়াছে। ইহাতেই হরকালী আরও ঈর্ষায় জ্বলিয়া পুড়িয়া মরে।

    শুধু একটি স্থান সরযূ একেবারে নিজের জন্য রাখিয়াছিল, এখানে হরকালী কিছুতেই প্রবেশ করিতে পায় না। স্বামীর চতুষ্পার্শে সে এমন একটি সূক্ষ্ম দাগ টানিয়া রাখিয়াছে যে, তাহার ভিতরে প্রবেশ না করিতে পারিলে, আর কেহ চন্দ্রনাথের শরীরে আঁচড়টিও কাটিতে পারে না। এই দাগের বাহিরে হরকালী যাহা ইচ্ছা করুক, কিন্তু ভিতরে আসিবার অধিকার ছিল না। বুদ্ধিমতী হরকালী বেশ বুঝিতে পারে যে, এই একফোঁটা মেয়েটি কোন্‌ এক মায়ামন্ত্রে তাহার নখদন্তের সমস্ত বিষ হরণ করিয়া লইয়াছে।

    এমনি করিয়া দীর্ঘ ছয় বৎসর গত হইল। সে এগারো বছর বয়সে স্বামীর ঘর করিতে আসিয়াছিল, সতরোয় পড়িল।

    পঞ্চম পরিচ্ছেদ

    বয়সের সন্মান-জ্ঞানটা যেমন পুরুষের মধ্যে আছে, স্ত্রীলোকদিগের মধ্যে তেমন নাই। পুরুষের মধ্যে অনেকগুলি পর্যায় আছে—যেমন দশ, কুড়ি, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট প্রভৃতি। ত্রিশবর্ষীয় একজন যুবা বিশ বছরের একজন যুবার প্রতি মুরুব্বিয়ানার চোখে চাহিয়া দেখিতে পারে, কিন্তু মেয়েমহলে এটা খাটে না। তাহার বিবাহকালটা পর্যন্ত বড় ভগিনী, ভ্রাতৃজায়া, জননী, পিসিমা অথবা ঠাকুরমাতার নিকট অল্পস্বল্প উমেদারি করে নারী-জীবনে যাহা কিছু অল্পবিস্তর শিখিবার আছে, শিখিয়া লয়;—তাহার পরই একেবারে প্রথম শ্রেণীতে চড়িয়া বসে। তখন ষোল হইতে ছাপ্পান্ন পর্যন্ত তাহার সমবয়সী। স্থানভেদে হয়ত বা কোথাও এ নিয়মের সামান্য ব্যতিক্রম দেখা যায়, কিন্তু অধিকাংশ স্থলেই এমনি। অন্ততঃ চন্দ্রনাথের গ্রাম-সম্পর্কীয়া ঠানদিদি হরিবালার জীবনে এমনটি দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। সেদিন অপরাহ্নে পশ্চিমদিকের জানালা খুলিয়া দিয়া সরযূ আকাশের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়াছিল। হরিবালা এক থালা মিষ্টান্ন এবং একগাছি মোটা যুঁইয়ের মালা হাতে লইয়া একেবারে সরযূর নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মালাগাছটি তাহাকে পরাইয়া দিয়া বলিলেন, আজ থেকে তুমি আমার সই হ’লে। বল দেখি সই—

    সরযূ একটু বিপন্ন হইল। তথাপি অল্প হাসিয়া কহিল, বেশ।

    বেশ ত নয় দিদি, সই ব’লে ডাকতে হবে।

    ইহাকে আদরই বল, আর আবদারই বল, সরযূর জীবনে ঠিক এমনটি ইতিপূর্বে ঘটিয়া উঠে নাই, তাই এই আকস্মিক আত্মীয়তাকে সে মনের মধ্যে মিলাইয়া লইতে পারিল না। একদণ্ডে একজন দিদিমার বয়সী লোকের গলা ধরিয়া ‘সই’ বলিয়া আহ্বান করিতে তাহার লজ্জা করিতে লাগিল, কিন্তু হরিবালা যে ছাড়েন না। ইহাতে অভিনবত্ব কিংবা অস্বাভাবিকতা যে কিছু থাকিতে পারে, হরিবালার তাহা ধারণায় নাই। তাই সরযূর মুখ হইতে প্রিয়সম্বোধনটির বিলম্ব দেখিয়া একটু গম্ভীরভাবে, একটু ম্লান হইয়া তিনি কহিলেন, আমার মালা ফিরিয়ে দাও, আমি আর কোথাও যাই।

    সরযূ বিপন্ন হইয়াছিল, কিন্তু অপ্রতিভ হয় নাই, ঈষৎ হাসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, সইয়ের সন্ধানে নাকি?

    ঠানদিদি একটুখানি স্থির থাকিয়া বলিলেন, বাঃ! এই যে বেশ কথা কও। তবে যে লোকে বলে, ওদের বৌ বোবা!

    সরযূ হাসিতে লাগিল।

    ঠানদিদি বলিলেন, তা শোন। এ গাঁয়ে তোমার একটিও সাথী নাই। বড়লোকের বাড়ি ব’লেও বটে, তোমার মামীর বচনের গুণেও বটে, কেউ তোমার কাছে আসে না, জানি। আমি তাই আসব। আমার কিন্তু একটা সম্পর্ক না হ’লে চলে না, তাই আজ ‘সই’ পাতালুম। আর বুড়ো হয়েছি বটে, কিন্তু হরিনামের মালা নিয়েও সারা দিনটা কাটাতে পারি না। আমি রোজ আসব।

    সরযূ কহিল, রোজ আসবেন।

    হরিবালা গর্জিয়া উঠিলেন, আসবেন কি লা? বল সই, তুমি রোজ এস। ‘তুই’ বলতে পারবি নে, না?

    সরযূ হাসিয়া ফেলিয়া কহিল, রক্ষা কর ঠানদিদি, গলায় ছুরি দিলেও তা পারব না।

    ঠানদিদিও হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, তা না হয় নাই বলিস। কিন্তু ‘তুমি’ বলতেই হবে। বল—সই তুমি রোজ এস।

    সরযূ চোখ নিচু করিয়া সলজ্জহাস্যে কহিল, সই, তুমি রোজ এস।

    হরিবালার যেন একটা দুর্ভাবনা কাটিয়া গেল। তিনি কহিলেন, আসব।

    পরদিন হইতে হরিবালা প্রায়ই আসেন, শত-কর্ম থাকিলেও একবার হাজিরা দিয়া যান। ক্রমশঃ পাতানো সম্বন্ধ গাঢ় হইয়া আসিল। সময়ে সরযূও ভুলিল যে, হরিবালা তাহার সমবয়সী নহেন, কিংবা এই গলায় গলায় মেশামেশি সকলের কাছে তেমন সুন্দর দেখিতে হয় না।

    এই অন্তরঙ্গতা হরকালীর কেমন লাগিত, বলিতে পারি না, কিন্তু চন্দ্রনাথের বেশ লাগিল। স্ত্রীর সহিত এ বিষয়ে প্রায়ই তাহার কথাবার্তা হইত। ঠানদিদির এই হৃদ্যতায় সে আমোদ বোধ করিত। আরও একটু কারণ ছিল। চন্দ্রনাথ স্ত্রীকে বড় স্নেহ করিত; সমস্ত হৃদয় জুড়িয়া ভালবাসা না থাকিলেও স্নেহের অভাব ছিল না। সে মনে করিত, সকলের ভাগ্যেই একরূপ স্ত্রী মিলে না। কাহারো বা স্ত্রী দাসী, কাহারো বা বন্ধু, কাহারো বা প্রভু! তাহার ভাগ্যে যদি একটি পুণ্যবতী, পবিত্রা, সাধ্বী এবং স্নেহময়ী দাসী মিলিয়াছে ত, সে অসুখী হইয়া কি লাভ করিবে? তাহার উপর একটা কথা প্রায়ই তাহার মনে হয়, সেটা সরযূর বিগত দিনের দুঃখের কাহিনী। শিশুকালটা তাহার বড় দুঃখেই অতিবাহিত হইয়াছে। দুঃখিনীর কন্যা হয়ত সারা-জীবনটা দুঃখেই কাটাইত; হয়ত বা এতদিনে কোন দুর্ভাগ্য দুশ্চরিত্রের হাতে পড়িয়া চক্ষের জলে ভাসিত, না হয় দাসীবৃত্তি করিতে গিয়া শত অত্যাচার উৎপীড়ন সহ্য করিত; তা ছাড়া, এত অধিক রূপ-যৌবন লইয়া নরকের পথও দুরূহ নহে;—তাহা হইলে?

    এই কথাটা মনে উঠিলেই চন্দ্রনাথ গভীর করুণায় সরযূর লজ্জিত মুখখানি তুলিয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিত, আচ্ছা সরযূ, আমি যদি তোমাকে না দেখতুম, যদি বিয়ে না করতুম, এতদিন তুমি কার কাছে থাকতে বল ত?

    সরযূ জবাব দিত না; সভয়ে স্বামীর বুকের কাছে সরিয়া আসিত। চন্দ্রনাথ সস্নেহে তাহার মাথার উপর হাত রাখিত। যেন সাহস দিয়া মনে মনে বলিত, ভয় কি!

    সরযূ আরও কাছে সরিয়া আসিত—এসব কথায় সত্যই সে বড় ভয় পাইত। চন্দ্রনাথ তাহা বুঝিতে পারিয়াই যেন তাহাকে বুকের কাছে টানিয়া লইয়া বলিত, তা নয় সরযূ, তা নয়। তুমি দুঃখীর ঘরে গিয়ে কেন জন্মেছিলে, জানিনে; কিন্তু তুমিই আমার জন্ম-জন্মান্তরের পতিব্রতা স্ত্রী! তুমি সংসারের যে-কোন জায়গায় ব’সে টান দিলে আমাকে যেতেই হ’ত। তোমার আকর্ষণেই যে আমি কাশী গিয়েছিলুম, সরযূ!

    এই সময় তাহার হৃদয়ের ভিতর দিয়া যে ভাবের স্রোত বহিয়া যাইত, সরযূর সমস্ত স্নেহ, প্রেম, যত্ন, ভক্তি এক করিলেও বোধ করি তাহার তুলনা হইত না। কিন্তু তৎসত্ত্বেও দুঃখীকে দয়া করিয়া যে গর্ব, যে তৃপ্তি, বালিকা সরযূকে বিবাহ করিবার সময় একদিন আত্মপ্রসাদের ছদ্মবেশে চন্দ্রনাথের নিভৃত-অন্তরে প্রবেশ করিয়াছিল, এখন শতচেষ্টাতেও চন্দ্রনাথ তাহার সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করিতে পারে না।

    হৃদয়ের এক অজ্ঞাত অন্ধকার কোণে আজও সে বাসা বাঁধিয়া আছে। তাই, যখনই সেটা মাথা তুলিয়া উঠিতে চায়, তখনই চন্দ্রনাথ সরযূকে বুকে চাপিয়া ধরিয়া বার বার বলিতে থাকে, আমি বড় আশ্চর্য হই সরযূ, যাকে চিরদিন দেখে এসেচ, তাকে কেন আজও তোমার চিনতে বিলম্ব হচ্চে। আমি তো তোমাকে কাশীতে দেখেই চিনেছিলুম, তুমি আমার! কত যুগ, কত কল্প, কত জন্ম-জন্ম ধ’রে আমার! কি জানি, কেন আলাদা হয়েছিলুম, আবার এক হয়ে মিলতে এসেচি।

    সরযূ বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া মৃদুকণ্ঠে কহে, কে বললে, আমি তোমাকে চিনতে পারিনি?

    উৎসাহের অতিশয্যে চন্দ্রনাথ সরযূর লজ্জিত মুখখানি নিজের মুখের কাছে তুলিয়া ধরিয়া বলে, পেরেচ? তবে কেন এত ভয়ে ভয়ে থাক? আমি ত কোন দুর্ব্যবহার করিনে—আমি যে আমার নিজের চেয়েও তোমাকে ভালবাসি সরযূ।

    সরযূ আবার স্বামীর বুকের মধ্যে মুখ লুকাইয়া ফেলে। চন্দ্রনাথ আবার প্রশ্ন করে, বল, কেন ভয় পাও সরযূ? সরযূ আর উত্তর দিতে পারে না। স্বামীকে স্পর্শ করিয়া সে মিথ্যা কথা কি করিয়া মুখে আনিবে? কি করিয়া বলিবে যে, ভয় করে না? সত্যই যে তাহার বড় ভয়! সে যে কত সত্য, কত বড় ভয়, তাহা সে ছাড়া আর কে জানে?

    তা কথাটা কি বলিতেছিলাম! চন্দ্রনাথ হরিবালার আগমনে আমোদ বোধ করিত। সরযূ একটি সখী পাইয়াছে, দু’টা মনের কথা বলিবার লোক জুটিয়াছে—ইহাই চন্দ্রনাথের আনন্দের কারণ।

    একদিন সরযূ সমস্ত দুপুরটা হরিবালার প্রতীক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল। আকাশে মেঘ করিয়া টিপিটিপি বৃষ্টি পড়িতেছিল; হরিবালা আসিলেন না । সরযূ মনে করিল, জল পড়িতেছে, তাই আসিলেন না। এখন বেলা যায়-যায়, সমস্ত দিনটা একা কাটিয়াছে, হরকালীও আজ বাটী নাই। সরযূ তখন সাহসে ভর করিয়া ধীরে ধীরে স্বামীর পড়িবার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল। বিশেষ প্রয়োজন না থাকিলে এ ঘরটিতে কেহ প্রবেশ করিত না। সরযূও না। চন্দ্রনাথ বই হইতে মুখ তুলিয়া বলিল, আজ বুঝি তোমার সই আসেনি?

    না।

    তাই বুঝি আমাকে মনে পড়েছে?

    সরযূ ঈষৎ হাসিল। ভাবটা এই যে, মনে সর্বদাই পড়ে, কিন্তু সাহসে কুলোয় না। সরযূ বলিল, জলের জন্য বোধ হয় আসতে পারেনি।

    বোধ হয়, তা নয়। আজ কাকার ছোটমেয়ে নির্মলাকে আশীর্বাদ করতে এসেছে। শীঘ্রই বিয়ে হবে। তারই আয়োজনে ঠানদিদি বোধ হয় মেতেছেন।

    সরযূ বলিল, বোধ হয়।

    তাহার পর চন্দ্রনাথ কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, দুঃখ হয় যে, আমরা একেবারে পর হয়ে গেছি—মামীমা কোথায়?

    তিনিও বোধ হয় সেইখানে।

    চন্দ্রনাথ চুপ করিয়া কি ভাবিতে লাগিল।

    সরযূ ধীরে ধীরে কাছে আসিয়া একপাশে বসিয়া পড়িয়া বলিল, কি ভাবচ, বল না।

    চন্দ্রনাথ একবার হাসিবার চেষ্টা করিয়া সরযূর হাতখানি নিজের হাতের মধ্যে টানিয়া লইয়া আস্তে আস্তে বলিল, বিশেষ-কিছু নয় সরযূ। ভাবছিলাম, নির্মলার বিয়ে, কাকা কিন্তু আমাকে একবার খবরটাও দিলেন না, অথচ মামীমাকেও ডেকে নিয়ে গেলেন। আমরা দু’জনেই শুধু পর!

    তাহার স্বরে একটু কাতরতা ছিল, সরযূ তাহা লক্ষ্য করিয়া কহিল, আমাকে পায়ে স্থান দিয়েই তুমি আরও পর হয়ে গেছ; না হ’লে বোধ হয় এত দিনে মিল হ’তে পারত।

    চন্দ্রনাথ হাসিল, কহিল, মিল হয়ে কাজ নেই। তোমার পরিবর্তে, কাকার সঙ্গে মিল ক’রে যে আমার মস্ত সুখ হ’ত, সে মনে হয় না। আমি বেশ আছি। যখন বিয়ে করেছিলুম, তখন যদি কাকার মত নিতে হ’ত, তা হ’লে এমন ত বোধ হয় না যে, তোমাকে কখনো পেতুম—একটা বাধা নিশ্চয় উঠত। হয় কুল নিয়ে, না হয় বংশ নিয়ে—যেমন ক’রেই হোক এ বিয়ে ভেঙ্গে যেত।

    ভিতরে ভিতরে সরযূ শিহরিয়া উঠিল। তখন সন্ধ্যার ছায়া ঘরের মধ্যে অন্ধকার করিয়াছিল, তাই তাহার মুখখানি দেখিতে পাওয়া গেল না, কিন্তু যে হাতখানি তাহার হাতের মধ্যে ধরা ছিল, সেই হাতখানি কাঁপিয়া উঠিয়া সরযূর সমস্ত মনের কথা চন্দ্রনাথের কাছে প্রকাশ করিয়া দিল। চন্দ্রনাথ হাসিয়া বলিল, এখন বুঝতে পেরেছ, মত না নিয়ে ভাল করেচি কি মন্দ করেচি?

    সরযূ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া বলিল, কি জানি! আমার মত শত-সহস্র দাসীরও ত তোমার অভাব হ’ত না!

    চন্দ্রনাথ সরযূর কোমল হাতখানি সস্নেহে ঈষৎ পীড়ন করিয়া বলিল, তা জানিনে। আমার দাসী একটি, তার অভাবের কথাই ভাবতে পারি। শত-সহস্রের ভাবনা ইছে হয় তুমি ভেবো।

    পরদিন হরিবালা আসিলেন; কিন্তু মুখের ভাবটা কিছু স্বতন্ত্র। ফস করিয়া গলা ধরিয়া সই-সই বলিয়া তিনি ব্যস্ত করিলেন না, কিংবা বিন্তি খেলিবার জন্য তাস আনিতেও পুনঃ পুনঃ সাধাসাধি পীড়াপীড়ি করিলেন না! মলিনমুখে মৌন হইয়া রহিলেন।

    সরযূ বলিল, সইয়ের কাল দেখা পাইনি।

    হ্যাঁ দিদি—কাল বড় কাজ ছিল। ও-বাড়িতে নির্মলার বিয়ে।

    তা শুনেছি। সব ঠিক হ’ল কি?

    হরিবালা সে কথার উত্তর না দিয়া সরযূর মুখের পানে চাহিয়া বলিলেন, সই, একটা কথা—সত্যি বলবি?

    কি কথা ?

    যদি সত্যি বলিস, তা হ’লেই জিজ্ঞাসা করি—না হ’লে জিজ্ঞাসা ক’রে কোন লাভ নেই।

    সরযূ চিন্তিত হইল। বলিল, সত্যি বলব না কেন?

    দেখিস দিদি—আমাকে বিশ্বাস করিস ত?

    করি বৈ কি।

    তবে বল্ দেখি, চন্দ্রনাথ তোকে কতখানি ভালবাসে?

    সরযূ একটু লজ্জিত হইল, বলিল, খুব দয়া করেন।

    দয়ার কথা নয়। খুব একেবারে বড় বেশি ভালবাসে কিনা?

    সরযূ হাসিল। বলিল, বড় বেশি কিনা—কেমন ক’রে জানব?

    সত্যি জানিস নে?

    না।

    সত্যই সরযূ ইহা জানিত না। হরিবালা যেন বড় বিমর্ষ হইয়া পড়িলেন। মাথা নাড়িয়া বলিলেন, স্ত্রী জানে না স্বামী তাকে কতখানি ভালবাসে! এইখানেই আমার বড় ভয় হয়।

    হরিবালার মুখের ভাবে একটা গভীর শঙ্কা প্রচ্ছন্ন ছিল, সরযূ তাহা বুঝিয়া নিজেও শঙ্কিত হইল। বলিল, ভয় কিসের?

    আর একদিন শুনিস। তার পর তাহার চিবুকে হাত দিয়া মৃদুস্বরে কহিলেন, এত রূপ, এত গুণ, এত বুদ্ধি নিয়ে সই, এত দিন কি ঘাস কাটছিলি?

    সরযূ হাসিয়া ফেলিল।

    ⤷
    1 2 3 4
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleনববিধান – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
    Next Article অরক্ষণীয়া – শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    Related Articles

    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস বুদ্ধদেব গুহ

    কোয়েলের কাছে – বুদ্ধদেব গুহ

    May 23, 2025
    চলিত ভাষার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    দর্পচূর্ণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

    May 6, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }