Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চাঁদের পাহাড় – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    উপন্যাস বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক পাতা গল্প138 Mins Read0

    ০৭. চাঁদের পাহাড় – সপ্তম পরিচ্ছেদ

    তারপর দিন দুই কেটে গেল। ওরা ক্রমশঃ গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করল। পথ কোথাও সমতল নয়, কেবল চড়াই আর উতরাই, মাঝে মাঝে কর্কশ ও দীর্ঘ টুসক ঘাসের বন, জল প্রায় দুষ্প্রাপ্য, ঝরনা এক-আধটা যদিও বা দেখা যায়, আলভারেজ তাদের জল ছুঁতেও দেয় না। দিব্যি স্ফটিকের মতো নির্মল জল পড়ছে ঝরনা বেয়ে, সুশীতল ও লোভনীয়, তৃষ্ণার্ত লোকের পক্ষে সে লোভ সম্বরণ করা বড়ই কঠিন— কিন্তু আলভারেজ জলের বদলে ঠান্ডা চা খাওয়াবে তবুও জল খেতে দেবে না। জলের তৃষ্ণা ঠান্ডা চায়ে দূর হয় না, তৃষ্ণার কষ্টই সব চেয়ে বেশি বলে মনে হচ্ছিল শঙ্করের। এক জায়গায় টুসক ঘাসের বন বেজায় ঘন। তবে উপরে ওদের চারধার ঘিরে সেদিন কুয়াশাও খুব গভীর। হঠাৎ বেলা উঠলে নিচের কুয়াশা সরে গেল। সামনে চেয়ে শঙ্করের মনে হল, খুব বড় একটা চড়াই তাদের পথ আগলে দাঁড়িয়ে, কত উঁচু সেটা তা জানা সম্ভব নয়, কারণ নিবিড় কুয়াশা কিংবা মেঘে তার উপরের দিকটা সম্পূর্ণরূপে আবৃত।
    আলভারেজ বললে— রিখটারসভেল্ডের আসল রেঞ্জ।
    শঙ্কর বললে— এটা পার হওয়ার কি দরকার?
    আলভারেজ বললে— এইজন্যে দরকার যে, সেবার আমি আর জিম দক্ষিণ দিক থেকে এসেছিলুম এই পর্বতশ্রেণীর পাদমূলে কিন্তু আসল রেঞ্জ পার হই নি। যে নদীর ধারে হলদে হীরে পাওয়া গিয়েছিল, তার গতি পুব থেকে পশ্চিমে। এবার আমরা যাচ্ছি উত্তর থেকে দক্ষিণে, সুতরাং পর্বত পার হয়ে ওপারে না গেলে কি সেই নদীটার ঠিকানা করতে পারি?
    শঙ্কর বললে— আজ যে রকম কুয়াশা হয়েছে দেখতে পাচ্ছি, তাতে একটু অপেক্ষা করা যাক না কেন? আর একটু বেলা বাড়ুক।
    তাঁবু ফেলে আহারাদি সম্পন্ন করা হল। বেলা বাড়লেও কুয়াশা তেমন কাটল না। শঙ্কর ঘুমিয়ে পড়ল তাঁবুর মধ্যে। ঘুম যখন ভাঙল, বেলা তখন নেই। চোখ মুছতে মুছতে তাঁবুর বাইরে এসে সে দেখলে আলভারেজ চিন্তিত মুখে ম্যাপ খুলে বসে আছে। শঙ্করকে দেখে বললে— শঙ্কর, আমাদের এখনো অনেক ভুগতে হবে। সামনে চেয়ে দেখ।
    আলভারেজের কথার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে চাইতেই এক গম্ভীর দৃশ্য শঙ্করের চোখে পড়ল। কুয়াশা কখন কেটে গেছে, তার সামনে বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্বতের প্রধান থাক, ধাপে ধাপে উঠে মনে হয় যেন আকাশে গিয়ে ঠেকেছে। পাহাড়ের কটিদেশ নিবিড় বিদ্যুৎগর্ভ মেঘপুঞ্জে আবৃত, কিন্তু উচ্চতম শিখররাজি অস্তমান সূর্যের রঙিন আলোয় দেবলোকের কনকদেউলের মতো বহুদূর নীল শূন্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।
    কিন্তু সামনের পর্বতাংশ সম্পূর্ণ দুরারোহ— শুধুই খাড়া খাড়া উত্তুঙ্গ শৃঙ্গ— কোথাও একটু ঢালু নেই। আলভারেজ বললে— এখান থেকে পাহাড়ে ওঠা সম্ভব নয়, শঙ্কর। দেখেই বুঝেছ নিশ্চয়। পাহাড়ের কোলে কোলে পশ্চিম দিকে চল। যেখানে ঢালু এবং নিচু পাব, সেখান দিয়েই পাহাড় পার হতে হবে। কিন্তু এই দেড়শো মাইল লম্বা পর্বতশ্রেণীর মধ্যে কোথায় সে রকম জায়গা আছে, এ খুঁজতেই তো এক মাসের উপর যাবে দেখছি।
    কিন্তু দিন পাঁচ-ছয় পশ্চিম দিকে যাবার পর এমন একটা জায়গা পাওয়া গেল যেখানে পর্বতের গা বেশ ঢালু, যেখান দিয়ে পর্বতে ওঠা চলতে পারে।
    পরদিন খুব সকাল থেকে পর্বতারোহণ শুরু হল। শঙ্করের ঘড়িতে তখন বেলা সাড়ে ছ’টা। সাড়ে আটটা বাজতে না বাজতে শঙ্কর আর চলতে পারে না। যে জায়গাটা দিয়ে তারা উঠছে— সেখানে পর্বতের খাড়াই চার মাইলের মধ্যে উঠেছে ছ’হাজার ফুট, সুতরাং পথটা ঢালু হলেও কী ভীষণ দুরারোহ তা সহজেই বোঝা যাবে। তা ছাড়া যতই উপরে উঠছে, অরণ্য ততই নিবিড়তর, ঘন অন্ধকার চারিদিকে। বেলা হয়েছে, রোদ উঠেছে অথচ সূর্যের আলো ঢোকেনি জঙ্গলের মধ্যে— আকাশই চোখে পড়ে না তার সূর্যের আলো!
    পথ বলে কোনো জিনিস নেই। চোখের সামনে শুধুই গাছের গুঁড়ি যেন ধাপে ধাপে আকাশের দিকে উঠে চলেছে। কোথা থেকে জল পড়ছে, কে জানে, পায়ের নিচের প্রস্তর আর্দ্র ও পিচ্ছিল, প্রায় সর্বত্রই শেওলাধরা। পা পিছলে গেলে গড়িয়ে নিচের দিকে বহুদূর চলে গিয়ে তীক্ষ্ণ শিলাখন্ডে আহত হতে হবে।
    শঙ্কর বা আলভারেজ কারো মুখে কথা নেই। উত্তুঙ্গ পথে উঠবার কষ্টে দু’জনেই অবসন্ন, দু’জনেরই ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়ছে। শঙ্করের কষ্ট আরও বেশি, বাঙলার সমতল ভূমিতে আজন্ম মানুষ হয়েছে, পাহাড়ে ওঠার অভ্যাসই নেই কখনো।
    শঙ্কর ভাবছে, আলভারেজ কখন বিশ্রাম করতে বলবে? সে আর উঠতে পারছে না, কিন্তু যদি সে মরেও যায়, একথা আলভারেজকে সে কখনোই বলবে না যে, সে আর পারছে না। হয়তো তাতে আলভারেজ ভাববে ইস্ট ইন্ডিজের মানুষগুলো দেখছি নিতান্তই অপদার্থ। এই মহাদুর্গম পর্বত ও অরণ্যে সে ভারতের প্রতিনিধি— এমন কোনো কাজ সে করতে পারে না যাতে তার মাতৃভূমির মুখ ছোট হয়ে যায়।
    বড় চমৎকার বন, যেন পরীর রাজ্য! মাঝে মাঝে ছোটখাটো ঝরনা যেন বনের মধ্যে দিয়ে খুব উপর থেকে নিচে নেমে যাচ্ছে। গাছের ডালে ডালে নানা রঙের টিয়াপাখি চোখ ঝলসে দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। বড় বড় ঘাসের মাথায় সাদা সাদা ফুল, অর্কিডের ফুল ঝুলছে গাছের ডালের গায়ে, গুঁড়ির গায়ে।
    হঠাৎ শঙ্করের চোখ পড়ল, গাছের ডালে মাঝে মাঝে লম্বা দাড়ি-গোঁফওয়ালা বালখিল্য মুনিদের মতো ও কারা বসে রয়েছে! তারা সবাই চুপচাপ বসে, মুনিজনোচিত গাম্ভীর্যে ভরা। ব্যাপার কী?
    আলভারেজ বললে— ও কলোবাস জাতীয় মাদী বাঁদর। পুরুষ জাতীয় কলোবাস বাঁদরের দাড়ি-গোঁফ নেই, স্ত্রী জাতীয় কলোবাস বাঁদরের হাতখানেক লম্বা দাড়ি-গোঁফ গজায় এবং তারা বড় গম্ভীর, দেখেই বুঝতে পারছ।
    ওদের কান্ড দেখে শঙ্কর হেসেই খুন।
    পায়ের তলায় মাটিও নেই, পাথরও নেই— তার বদলে আছে শুধু পচা পাতা ও শুকনো গাছের গুঁড়ির স্তুপ। এই সব বনে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পাতার রাশি ঝরছে, পচে যাচ্ছে, তার ওপরে শেওলা পুরু হয়ে উঠছে, ছাতা গজাচ্ছে, তার ওপরে আবার নতুন ঝরা পাতার রাশি, আবার পড়ছে গাছের ডালপালা, গুঁড়ি। জায়গায় জায়গায় ষাট-সত্তর ফুট গভীর হয়ে জমে রয়েছে এই পাতার স্তুপ।
    আলভারেজ ওকে শিখিয়ে দিলে— এইসব জায়গায় খুব সাবধানে পা ফেলে চলতে হবে। এমন জায়গা আছে, যেখানে মানুষ চলতে চলতে ওই ঝরা পাতার রাশির মধ্যে ভুস করে ঢুকে ডুবে যেতে পারে, যেমন অতর্কিতে পথ চলতে চলতে পুরনো কুয়োর মধ্যে পড়ে যায়। উদ্ধার করা সম্ভব না হলে সেসব ক্ষেত্রে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মৃত্যু অনিবার্য।
    শঙ্কর বললে— পথের গাছপালা না কাটলে আর তো ওঠা যাচ্ছে না, বড় ঘন হয়ে উঠছে।
    ক্ষুরের মতো ধারাল চওড়া এলিফ্যান্ট ঘাসের বন— যেন রোমান যুগের দ্বি-ধার তলোয়ার। তার মধ্যে দিয়ে যাবার সময় দু’জনের কেউই নিরাপদ বলে ভাবছে না নিজেকে, দু’হাত তফাতে কি আছে দেখা যায় না যখন, তখন সব রকম বিপদের সম্ভাবনাই তো রয়েছে। বাঘ, সিংহ বা বিষাক্ত সাপ কোনোটিই থাকা বিচিত্র নয়।
    শঙ্কর লক্ষ্য করছে মাঝে মাঝে ডুগডুগি বা ঢোল বাজনার মতো একটা শব্দ হচ্ছে কোথায় যেন বনের মধ্যে। কোনো অসভ্য জাতির লোক ঢোল বাজাচ্ছে নাকি? আলভারেজকে সে জিজ্ঞেস করলে।
    আলভারেজ বললে— ঢোল নয়, বড় বেবুন কিংবা বনমানুষে বুক চাপড়ে ঐ রকম শব্দ করে। মানুষ এখানে কোথা থেকে আসবে?
    শঙ্কর বললে— তুমি যে বলেছিলে এ বনে গরিলা নেই?
    – গরিলা সম্ভবতঃ নেই। আফ্রিকার মধ্যে বেলজিয়ান কঙ্গোর কিছু অঞ্চল, রাওয়েনজির আল্পস বা তিরুঙ্গা আগ্নেয় পর্বতের অরণ্য ছাড়া অন্য কোথাও গরিলা আছে বলে তো জানা নেই। গরিলা ছাড়াও অন্য ধরনের বনমানুষে বুক চাপড়ে ওরকম আওয়াজ করতে পারে।
    ওরা সাড়ে চার হাজার ফুটের উপরে উঠেছে। সেদিনের মতো সেখানেই রাত্রির বিশ্রামের জন্য তাঁবু ফেলা হল। একটা বিশাল সত্যিকার ট্রপিক্যাল অরণ্যের রাত্রিকালীন শব্দ এত বিচিত্র ধরনের ও এত ভীতিজনক যে সারারাত শঙ্কর চোখের পাতা বোজাতে পারলে না। শুধু ভয় নয়, ভয় মিশ্রিত একটা বিস্ময়।
    কত রকমের শব্দ— হায়েনার হাসি, কলোবাস বানরের কর্কশ চিৎকার, বনমানুষের বুক চাপড়ানোর আওয়াজ, বাঘের ডাক— প্রকৃতির এই বিরাট নিজস্ব পশুশালায় রাত্রে কেউ ঘুমোয় না। সমস্ত অরণ্যটা এই গভীর রাত্রে যেন হঠাৎ ক্ষেপে উঠেছে। বছর কয়েক আগে খুব বড় একটা সার্কাসের দল এসে ওদের স্কুল-বোর্ডিংয়ের পাশের মাঠে তাঁবু ফেলেছিল, তাদের জানোয়ারদের চিৎকারে বোর্ডিংয়ের ছেলেরা রাত্রে ঘুমুতে পারতো না— শঙ্করের সেই কথা এখন মনে পড়ল। কিন্তু এসবের চেয়েও মধ্যরাত্রে একদল বন্য হস্তীর বৃংহিত ধ্বনি তাঁবুর অত্যন্ত নিকটে শুনে শঙ্কর এমন ভয় পেয়ে গেল যে, আলভারেজকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠাল। আলভারেজ বললে— আগুন জ্বলছে তাঁবুর বাইরে, কোনো ভয় নেই, ওরা ঘেঁষবেনা এদিকে।
    সকালে উঠে আবার ওপরে ওঠা শুরু। উঠছে, উঠছে— মাইলের পর মাইল বুনো বাঁশের জঙ্গল, তার তলায় বুনো আদা। ওদের পথের একশো হাতের মধ্যে বাঁ দিকের বাঁশবনের তলা দিয়ে একটা প্রকান্ড হস্তীযূথ কচি বাঁশের কোঁড় মড় মড় করে ভাঙতে ভাঙতে চলে গেল।
    পাঁচ হাজার ফুট ওপরে কত কি বন্য পুষ্পের মেলা— টকটকে লাল ইরিথ্রিনা প্রকান্ড গাছে ফুটেছে। পুষ্পিত ইপোমিয়া লতার ফুল দেখতে ঠিক বাঙলাদেশের বনকলমি ফুলের মতো, কিন্তু রঙটা অত গাঢ় বেগুনী নয়। সাদা ভেরোনিকা ঘন সুগন্ধে বাতাসকে ভারাক্রান্ত করেছে। বন্য কফির ফুল, রঙিন বেগোনিয়া। মেঘের রাজ্য ফুলের বন, মাঝে মাঝে সাদা বেলুনের মতো মেঘপুঞ্জ গাছপালার মগডালে এসে আটকাচ্ছে— কখনোবা আরও নেমে এসে ভেরোনিকার বন ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।
    সাড়ে সাত হাজার ফুটের ওপর থেকে বনের প্রকৃতি একেবারে বদলে গেল। এই পর্যন্ত উঠতে ওদের আরও দু’দিন লেগেছে। আর অসহ্য কষ্ট, কোমর-পিঠ ভেঙে পড়ছে। এখানে বনানীর মূর্তি বড় অদ্ভুত, প্রত্যেক গাছের গুঁড়ি ও শাখা-প্রশাখা পুরু শেওলায় আবৃত, প্রত্যেক ডাল থেকে শেওলা ঝুলছে— সে শেওলা কোথাও কোথাও এত লম্বা যে গাছ থেকে ঝুলে প্রায় মাটিতে এসে ঠেকবার মতো হয়েছে— বাতাসে সেগুলো বারবার দোল খাচ্ছে, তার উপর কোথাও সূর্যের আলো নেই, সব সময়েই যেন গোধূলি। আর সবটা ঘিরে বিরাজ করছে এক অপার্থিব ধরনের নিস্তব্ধতা— বাতাস বইছে তারও শব্দ নেই, পাখির কুজন নেই সে বনে— মানুষের গলার সুর নেই, কোনো জানোয়ারের ডাক নেই। যেন কোনো অন্ধকার নরকে দীর্ঘশ্মশ্রূ প্রেতের দলের মধ্যে এসে পড়েছে ওরা!
    সেদিন অপরাহ্নে যখন আলভারেজ তাঁবু ফেলে বিশ্রাম করবার হুকুম দিলে— তখন তাঁবুর বাইরে বসে একপাত্র কফি খেতে খেতে শঙ্করের মনে হল, এ যেন সৃষ্টির আদিম যুগের অরণ্যানী, পৃথিবীর উদ্ভিদজগৎ যখন কোনো একটা সুনির্দিষ্ট রূপ ও আকৃতি গ্রহণ করেনি, যে যুগে পৃথিবীর বুকে বিরাটকায় সরীসৃপের দল জগৎ‌জোড়া বনজঙ্গলের নিবিড় অন্ধকারে ঘুরে বেড়াতো— সৃষ্টির সেই অতীত প্রভাতে সে যেন কোনো যাদুমন্ত্রের বলে ফিরে গিয়েছে।
    সন্ধ্যার পরেই সমগ্র বনানী নিবিড় অন্ধকারে আবৃত হল। তাঁবুর বাইরে ওরা আগুন করেছে— সেই আলোর মন্ডলীর বাইরে আর কিছু দেখা যায় না। এ বনের আশ্চর্য নিস্তব্ধতা শঙ্করকে বিস্মিত করেছে। বনানীর সেই বিচিত্র নৈশ শব্দ এখানে স্তব্ধ কেন? আলভারেজ চিন্তিত মুখে ম্যাপ দেখছিল। বললে— শোনো শঙ্কর, একটা কথা ভাবছি। আট হাজার ফুট উঠলাম, কিন্তু এখনো পর্বতের সেই খাঁজটা পেলাম না যেটা দিয়ে আমরা রেঞ্জ পার হয়ে ওপারে যাবো। আর কত ওপরে উঠব? যদি ধরো এই অংশে স্যাডলটা না-ই থাকে?
    শঙ্করের মনেও এ খটকা যে না জেগেছে তা নয়। সে আজই ওঠবার সময় মাঝে মাঝে ফিল্ড গ্লাস দিয়ে উপরের দিকে দেখবার চেষ্টা করেছে, কিন্তু ঘন মেঘে বা কুয়াশায় উপরের দিকটা সর্বদাই আবৃত থাকায় তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সত্যিই তো, তারা কত উঠবে আর, সমতল খাঁজ যদি না পাওয়া যায়? আবার নিচে নামতে হবে, আবার অন্য জায়গা বেয়ে উঠতে হবে। দফা সারা!
    সে বললে— ম্যাপে কি বলে?
    আলভারেজের মুখ দেখে মনে হল ম্যাপের উপর সে আস্থা হারিয়েছে। বললে— এ ম্যাপ অত খুঁটিনাটি ভাবে তৈরি নয়। এ পর্বতে উঠেছে কে যে ম্যাপ তৈরি হবে? এই যে দেখছ— এখানা স্যার ফিলিপো ডি ফিলিপির তৈরি ম্যাপ, যিনি পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকার ফার্ডিনান্ডো পো শৃঙ্গ আরোহণ করে খুব নাম করেন, এবং বছর কয়েক আগে বিখ্যাত পর্বত আরোহণকারী পর্যটক ডিউক অব আব্রুৎ‌সির অভিযানেও যিনি ছিলেন। কিন্তু রিখটারসভেল্ডে তিনি ওঠেননি, এ ম্যাপে পাহাড়ের যে কনটুর ছবি আঁকা আছে, তা খুব নিখুঁত বলে মনে তো হয় না। ঠিক বুঝছি নে।
    হঠাৎ শঙ্কর বলে উঠল— ও কি?
    তাঁবুর বাইরে প্রথমে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ, এবং পরক্ষণেই একটা কষ্টকর কাশির শব্দ পাওয়া গেল— যেন থাইসিসের রোগী খুব কষ্টে কাতর ভাবে কাশছে। একবার… দু’বার… তারপরেই শব্দটা থেমে গেল। কিন্তু সেটা মানুষের গলার শব্দ নয়, শোনবামাত্রই শঙ্করের সে কথা মনে হল।
    রাইফেল নিয়ে সে ব্যস্তভাবে তাঁবুর বার হতে যাচ্ছে, আলভারেজ তাড়াতাড়ি উঠে ওর হাত ধরে বসিয়ে দিলে।
    শঙ্কর আশ্চর্য হয়ে বললে— কেন, কিসের শব্দ ওটা?
    বলে আলভারেজের দিকে চাইতেই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করল তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে! শব্দটা শুনেই কি?
    সঙ্গে সঙ্গে তাঁবুর অগ্নিকুন্ডের মন্ডলীর বাইরে, নিবিড় অন্ধকারে একটা ভারী অথচ লঘুপদ জীব যেন বনজঙ্গলের মধ্য দিয়ে চলে যাচ্ছে— বেশ মনে হল।
    দু’জনেই খানিকটা চুপচাপ, তারপর আলভারেজ বললে— আগুনে কাঠ ফেলে দাও। বন্দুক দুটো ভরা আছে কিনা দেখ। ওর মুখের ভাব দেখে শঙ্কর ওকে আর কোনো প্রশ্ন করতে সাহস করলে না।
    রাত্রি কেটে গেল।
    পরদিন সকালে শঙ্করেরই ঘুম ভাঙলো আগে। তাঁবুর বাইরে এসে কফি করবার আগুন জ্বালতে সে তাঁবু থেকে কিছুদূরে কাঠ ভাঙতে গেল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল ভিজে মাটির উপর একটা পায়ের দাগ— লম্বায় দাগটা এগারো ইঞ্চির কম নয়, কিন্তু পায়ে তিনটে মাত্র আঙুল। তিন আঙুলেরই দাগ বেশ স্পষ্ট। পায়ের দাগ ধরে সে এগিয়ে গেল— আরও অনেকগুলো সেই পায়ের দাগ আছে, সবগুলোতেই সেই তিন আঙুল।
    শঙ্করের মনে পড়ল ইউগান্ডার স্টেশনঘরে আলভারেজের মুখে শোনা জিম কার্টারের মৃত্যুকাহিনী। গুহার মুখের বালির উপর সেই অজ্ঞাত হিংস্র জানোয়ারের তিন আঙুলওয়ালা পায়ের দাগ। কাফির গ্রামের সেই সর্দারের মুখে শোনা গল্প।
    কাল রাত্রে আলভারেজের বিবর্ণ মুখও সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল। আর একদিনও আলভারেজ ঠিক এই রকমই ভয় পেয়েছিল, যেদিন পর্বতের পাদমূলে ওরা প্রথম এসে তাঁবু পাতে।
    বুনিপ! কাফির সর্দারের গল্পের সেই বুনিপ! রিখটারসভেল্ড পর্বত ও অরণ্যের বিভীষিকা, যার ভয়ে শুধু অসভ্য মানুষ কেন, অন্য কোনো বন্যজন্তু পর্যন্ত এই আট হাজার ফুটের ওপরকার বনে আসে না। কাল রাত্রে কোনো জানোয়ারের শব্দ পাওয়া যায়নি কেন, এখন তা শঙ্করের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। আলভারেজ পর্যন্ত ভয়ে বিবর্ণ হয়ে উঠেছিল ওর গলার শব্দ শুনে। বোধহয় ও শব্দের সঙ্গে আলভারেজের পূর্বে পরিচয় ঘটেছে।
    আলভারেজের ঘুম ভাঙতে সেদিন একটু দেরি হল। গরম কফি এবং কিছু খাদ্য গলাধঃকরণ করবার সঙ্গে সঙ্গে সে আবার সেই নির্ভীক ও দুর্ধর্ষ আলভারেজ, যে মানুষকেও ভয় করে না, শয়তানকেও না। শঙ্কর ইচ্ছে করেই আলভারেজকে ঐ অজ্ঞাত জানোয়ারের পায়ের দাগটা দেখালে না— কি জানি যদি আলভারেজ বলে বসে— এখনো পাহাড়ের স্যাডলটা পাওয়া গেল না, তবে নেমে যাওয়া যাক।
    সকালে সেদিন খুব মেঘ করে ঝম্‌ঝম্‌ করে বৃষ্টি নামল। পর্বতের ঢাল বেয়ে যেন হাজার ঝরনার ধারায় বৃষ্টির জল গড়িয়ে নিচে নামছে। এই বন ও পাহাড় চোখে কেমন যেন ধাঁধা লাগিয়ে দেয়, এতটা উঠেছে ওরা কিন্তু প্রতি হাজার ফুট উপর থেকে নিচের অরণ্যের গাছপালার মাথা দেখে সেগুলিকে সমতলভূমির অরণ্য বলে ভ্রম হচ্ছে— কাজেই প্রথমটা মনে হয় যেন কতটুকুই বা উঠেছি, ঐটুকু তো।
    বৃষ্টি সেদিন থামল না— বেলা দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে আলভারেজ উঠবার হুকুম দিলে। শঙ্কর এটা আশা করেনি। এখানে শঙ্কর কর্মী শ্বেতাঙ্গ চরিত্রের একটা দিক লক্ষ্য করলে। তার মনে হচ্ছিল, কেন এই বৃষ্টিতে মিছেমিছি বার হওয়া? একটা দিনে কি এমন হবে? বৃষ্টি মাথায় পথ চলে লাভ?
    অবিশ্রান্ত বৃষ্টিধারার মধ্যে ঘন অরণ্যানী ভেদ করে সেদিন ওরা সারাদিন উঠল। উঠছে, উঠছে, উঠছেই— শঙ্কর আর পারে না। কাপড়-চোপড় জিনিসপত্র, তাঁবু সব ভিজে একাকার, একখানা রুমাল পর্যন্ত শুকনো নেই কোথাও। শঙ্করের কেমন একটা অবসাদ এসেছে দেহে ও মনে— সন্ধ্যার দিকে যখন সমগ্র পর্বত ও অরণ্য মেঘের অন্ধকারে ও সন্ধ্যার অন্ধকারে একাকার হয়ে ভীমদর্শন ও গম্ভীর হয়ে উঠল, তখন ওর মনে হল— এই অজানা দেশে অজানা পর্বতের মাথায় ভয়ানক হিংস্র জন্তুসঙ্কুল বনের মধ্যে দিয়ে, বৃষ্টিমুখর সন্ধ্যায়, কোন অনির্দেশ্য হীরকখনি বা তার চেয়েও অজানা মৃত্যুর অভিমুখে চলেছে সে কোথায়? আলভারেজ কে তার? তার পরামর্শে কেন সে এখানে এল? হীরের খনিতে তার দরকার নেই। বাঙলাদেশের খড়ে ছাওয়া ঘর, ছায়াভরা শ্রান্ত গ্রাম্য পথ, ক্ষুদ্র নদী, পরিচিত পাখিদের কাকলি— সেসব যেন কতদূরের কোন অবাস্তব স্বপ্ন-রাজ্যের জিনিস, আফ্রিকার কোনো হীরকখনি সে সবের চেয়ে মূল্যবান নয়।
    কিন্তু তার এ ভাব কেটে গেল অনেক রাত্রে, যখন নির্মেঘ আকাশে চাঁদ উঠল। সে অপার্থিব জ্যোৎস্নাময় রাত্রির বর্ণনা নেই। শঙ্কর আর পৃথিবীতে নেই, বাঙলা বলে কোনো দেশ নেই। সব স্বপ্ন হয়ে গিয়েছে— সে আর কোথাও ফিরতে চায় না, হীরে চায় না, অর্থ চায় না— পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে বহু উর্ধ্বে এক কৌমুদীশুভ্র দেবলোকের এখন সে অধিবাসী, তার চারধারে প্রকৃতির যে সৌন্দর্য, কোনো মানুষের চোখ এর আগে তা দেখেনি। সে গহন নিস্তব্ধতা, এর আগে কোনো মানুষ অনুভব করেনি। জনমানবহীন বিশাল রিখটারসভেল্ড পর্বত ও অরণ্য, এই গভীর নিশীথে মেঘলোকে আসন পেতে আপনাতে আপনি আত্মস্থ, ধ্যানস্তিমিত— পৃথিবীর মানুষের সেখানে প্রবেশ লাভের সৌভাগ্য ক্বচিৎ ঘটে।
    সেই রাত্রে ঘুম থেকে ও ধড়মড়িয়ে উঠল আলভারেজের ডাকে। আলভারেজ ডাকছে— শঙ্কর, শঙ্কর, ওঠো বন্দুক বাগাও—
    – কি, কি?
    তারপর ও কান পেতে শুনলে— তাঁবুর চারপাশে কে যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তার জোরে নিঃশ্বাসের শব্দ বেশ শোনা যাচ্ছে তাঁবুর মধ্যে থেকে। চাঁদ ঢলে পড়েছে, তাঁবুর বাইরে অন্ধকারই বেশি, জ্যোৎস্নাটুকু গাছের মগডালে উঠে গিয়েছে, কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তাঁবুর দরজার মুখে আগুন তখনো একটু একটু জ্বলছে— কিন্তু তার আলোর বৃত্ত যেমন ছোট, আলোর জ্যোতিও ততোধিক ক্ষীণ, তাতে দেখবার সাহায্য কিছুই হয় না।
    হুড়মুড় করে একটা শব্দ হল— গাছপালা ভেঙে একটা ভারী জানোয়ার হঠাৎ ছুটে পালাল যেন। তাঁবুর সকলে সজাগ হয়ে উঠেছে, এখন আর অতর্কিতে শিকারের সুবিধে হবে না— বাইরের জানোয়ারটা যেন তা বুঝতে পেরেছে।
    জানোয়ারটা যাই হোক না কেন, তার যেন বুদ্ধি আছে। বিচারের ক্ষমতা আছে, মস্তিষ্ক আছে।
    আলভারেজ রাইফেল হাতে টর্চ জ্বেলে বাইরে গেল। শঙ্করও গেল ওর পেছনে পেছনে। টর্চের আলোয় দেখা গেল, তাঁবুর উত্তর-পূর্ব কোণের জঙ্গলের চারা গাছপালার উপর দিয়ে যেন একটা ভারী স্টীম রোলার চলে গিয়েছে। আলভারেজ সেইদিকে বন্দুকের নল উঁচিয়ে বার দুই আওয়াজ করলে।
    কোনোদিকে কোনো শব্দ পাওয়া গেল না।
    ফিরবার সময় তাঁবুর ঠিক দরজার মুখে আগুনের কুন্ডের অতি নিকটেই একটা পায়ের দাগ দু’জনেরই চোখে পড়ল। তিনটে মাত্র আঙুলের দাগ ভিজে মাটির ওপর সুস্পষ্ট!
    এতে প্রমাণ হয়, জানোয়ারটা আগুনকে ডরায় না। শঙ্করের মনে হল, যদি ওদের ঘুম না ভাঙত, তবে সেই অজ্ঞাত বিভীষিকাটি তাঁবুর মধ্যে ঢুকতে একটুও দ্বিধা করতো না— এবং তারপরে কি ঘটতো তা কল্পনা করে কোনো লাভ নেই। আলভারেজ বললে— শঙ্কর, তুমি তোমার ঘুম শেষ কর, আমি জেগে আছি।
    শঙ্কর বললে— না, তুমি ঘুমোও আলভারেজ।
    আলভারেজ ক্ষীণ হাসি হেসে বললে— পাগল, তুমি জেগে কিচ্ছু করতে পারবে না, শঙ্কর। ঘুমিয়ে পড়, ঐ দেখ দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, আবার ঝড়বৃষ্টি আসবে, রাত শেষ হয়ে আসছে, ঘুমোও। আমি বরং একটু কফি খাই।
    রাত ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে এল মুষলধারে বৃষ্টি, সঙ্গে সঙ্গে যেমনি বিদ্যুৎ , তেমনি মেঘগর্জন। সে বৃষ্টি চলল সমানে সারাদিন, তার বিরাম নেই, বিশ্রাম নেই। শঙ্করের মনে হল পৃথিবীতে আজ প্রলয়ের বর্ষণ শুরু হয়েছে, প্রলয়ের দেবতা সৃষ্টি ভাসিয়ে দেবার সূচনা করেছেন বুঝি। বৃষ্টির বহর দেখে আলভারেজ পর্যন্ত দমে গিয়ে তাঁবু উঠাবার নাম মুখে আনতে ভুলে গেল।
    বৃষ্টি থামল যখন, তখন বিকেল পাঁচটা। বোধহয় বৃষ্টি না থামলেই ভালো ছিল, কারণ অমনি আলভারেজ চলা শুরু করবার হুকুম দিলে। বাঙালী ছেলের স্বভাবতঃই মনে হয়— এখন অবেলায় যাওয়া কেন? এত কি সময় বয়ে যাচ্ছে? কিন্তু আলভারেজের কাছে দিন, রাত, বর্ষা, রৌদ্র, জ্যোৎস্না, অন্ধকার সব সমান। সে রাত্রে বর্ষাস্নাত বনভূমির মধ্যে দিয়ে মেঘভাঙা জ্যোৎস্নার আলোয় দু’জনে উঠছে, উঠছে— এমন সময় আলভারেজ পেছন থেকে বলে উঠল— শঙ্কর দাঁড়াও, ঐ দেখ—
    আলভারেজ ফিল্ড গ্লাস দিয়ে ফুটফুটে জ্যোৎস্নালোকে বাঁ পাশের পর্বতশিখরের দিকে চেয়ে দেখছে। শঙ্কর ওর হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে সে দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। হ্যাঁ, সমতল খাঁজটা পাওয়া গিয়েছে! বেশি দূরেও নয়, মাইল দুইয়ের মধ্যে, বাঁ দিক ঘেঁষে!
    আলভারেজ হাসিমুখে বললে— দেখেছ স্যাডলটা? থামবার দরকার নেই, চল আজ রাত্রেই স্যাডলের উপর পৌঁছে তাঁবু ফেলব। শঙ্কর আর সত্যিই পারছে না। এই দুর্ধর্ষ পর্তুগিজটার সঙ্গে হীরের সন্ধানে এসে সে কি ঝকমারি-ই না করেছে! শঙ্কর জানে অভিযানের নিয়মানুযায়ী দলপতির হুকুমের উপর কোনো কথা বলতে নেই। এখানে আলভারেজই দলপতি, তার আদেশ অমান্য করা চলবে না। কোথাও আইনে লিপিবদ্ধ না থাকলেও পৃথিবীর ইতিহাসের বড় বড় অভিযানে সবাই এই নিয়ম মেনে চলে। সেও মানবে।
    অবিশ্রান্ত হাঁটবার পরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ওরা এসে স্যাডলে যখন উঠল— শঙ্করের তখন আর এক পা-ও চলবার শক্তি নেই।
    স্যাডলটার বিস্তৃতি তিন মাইলের কম নয়, কখনোবা দুশো ফুট খাড়া উঠেছে, কখনোবা চার-পাঁচশো ফুট নেমে গিয়েছে এক মাইলের মধ্যে, সুতরাং বেশ দুরারোহ— যতটুকু সমতল, ততটুকু শুধুই বড় বড় বনস্পতির জঙ্গল, ইরিথ্রিনা, পেনসিয়ানা, রিঠাগাছ, বাঁশ বা বন্য আদা। বিচিত্র বর্ণের অর্কিডের ফুল ডালে ডালে। বেবুন ও কলোবাস বাঁদর সর্বত্র।
    আরও দু’দিন ক্রমাগত নামতে নামতে ওরা রিখটারসভেল্ড পর্বতের আসল রেঞ্জের ওপারের উপত্যকায় গিয়ে পদার্পণ করল। শঙ্করের মনে হল, এদিকে জঙ্গল যেন আরও বেশি দুর্ভেদ্য ও বিচিত্র। আটলান্টিক মহাসাগরের দিক থেকে সমুদ্রবাষ্প উঠে কতক ধাক্কা খায় পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুণ পর্বতে, বাকিটা আটকায় বিশাল রিখটারসভেল্ডের দক্ষিণ সানুতে— সুতরাং বৃষ্টি এখানে হয় অজস্র, গাছপালার তেজও তেমনি।
    দিন পনেরো ধরে সেই বিরাট অরণ্যাকীর্ণ উপত্যকার সর্বত্র দু’জনে মিলে খুঁজেও আলভারেজ বর্ণিত পাহাড়ী নদীর কোনো ঠিকানা বার করতে পারল না। ছোটখাটো ঝরনা দু-একটা উপত্যকার ওপর দিয়ে বইছে বটে— কিন্তু আলভারেজ কেবলই ঘাড় নাড়ে আর বলে— এসব নয়।
    শঙ্কর বলে— তোমার ম্যাপ দেখ না ভালো করে?
    কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, আলভারেজের ম্যাপের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
    আলভারেজ বলে— ম্যাপে কি হবে? আমার মনেই গভীর ভাবে আঁকা আছে সে নদী ও সে উপত্যকার ছবি— সে একবার দেখতে পেলেই তখুনি চিনে নেব। এ সে জায়গাই নয়, এ উপত্যকা সে উপত্যকাই নয়।
    নিরুপায়! খোঁজ তবে…
    এক মাস কেটে গেল। পশ্চিম আফ্রিকার বর্ষা নামল মার্চ মাসের প্রথমে। সে কি ভয়ানক বর্ষা! শঙ্কর তার কিছু নমুনা পেয়ে এসেছে রিখটারসভেল্ড পার হবার সময়ে। উপত্যকা ভেসে গেল পাহাড় থেকে নামা বড় বড় পার্বত্য ঝরনার জলধারায়। তাঁবু ফেলবার স্থান নেই। একরাত্রে হঠাৎ অতিবর্ষণের ফলে ওদের তাঁবুর সামনে একটা নিরীহ ক্ষীণকায় ঝরনাধারা ভীমমূর্তি ধারণ করে তাঁবুসুদ্ধ ওদের ভাসিয়ে নিয়ে যাবার যোগাড় করেছিল— আলভারেজের সজাগ ঘুমের জন্যে সে যাত্রা বিপদ কেটে গেল।
    কিন্তু দিন যায় তো ক্ষণ যায় না। শঙ্কর একদিন ঘোর বিপদে পড়ল জঙ্গলের মধ্যে। সে বিপদটাও বড় অদ্ভুত ধরনের!
    সেদিন আলভারেজ তাঁবুতে তার নিজের রাইফেল পরিষ্কার করছিল, সেটা শেষ করে রান্না করবে কথা ছিল। শঙ্কর রাইফেল হাতে বনের মধ্যে শিকারের সন্ধানে বার হয়েছে।
    আলভারেজ বলে দিয়েছে তাকে এ বনে খুব সতর্ক হয়ে সাবধানে চলাফেরা করতে— আর বন্দুকের ম্যাগাজিনে সব সময় যেন কার্ট্রিজ ভরা থাকে। আর একটা মূল্যবান উপদেশ দিয়েছে, সেটা এই— বনের মধ্যে বেড়াবার সময় হাতের কব্জিতে কম্পাস সর্বদা বেঁধে নিয়ে বেড়াবে এবং যে পথ দিয়ে যাবে, সে পথের ধারে গাছপালায় কোনো চিহ্ন রেখে যাবে, যাতে ফেরবার সময় সেই সব চিহ্ন ধরে আবার ঠিক ফিরতে পারো। নতুবা বিপদ অবশ্যম্ভাবী।
    সেদিন শঙ্কর স্প্রিংবক হরিণের সন্ধানে গভীর বনে চলে গিয়েছে। সকালে বেরিয়েছিল, ঘুরে ঘুরে বড় ক্লান্ত হয়ে পড়ে এক জায়গায় একটা বড় গাছের তলায় সে একটু বিশ্রামের জন্যে বসল।
    সেখানটাতে চারধারেই বৃহৎ বৃহৎ বনস্পতির মেলা, আর সব গাছেই গুঁড়ি ও ডালপালা বেয়ে এক প্রকারের বড় বড় লতা উঠে তাদের ছোট ছোট পাতা দিয়ে এমন নিবিড় ভাবে আষ্ঠেপৃষ্ঠে গাছগুলো জড়িয়েছে যে গুঁড়ির আসল রং দেখা যাচ্ছে না। কাছেই একটা ছোট্ট জলার ধারে ঝাড়ে ঝাড়ে মারিপোসা লিলি ফুটে রয়েছে।
    খানিকটা সেখানে বসবার পরে শঙ্করের মনে হল তার কি একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কী ধরনের অস্বস্তি তা সে কিছু বুঝতে পারলে না— অথচ জায়গাটা ছেড়ে উঠে যাবারও ইচ্ছে তার হল না— সে ক্লান্তও বটে, আর জায়গাটা বেশ আরামেরও বটে!
    কিন্তু এ তার কী হল? তার সমস্ত শরীরে এত অবসাদ এল কোথা থেকে? ম্যালেরিয়া জ্বরে ধরল নাকি?
    অবসাদটা কাটাবার জন্যে সে পকেট হাতড়ে একটা চুরুট বার করে ধরালে। কিসের একটা মিষ্টি মিষ্টি সুগন্ধ বাতাসে— শঙ্করের বেশ লাগছে গন্ধটা। একটু পরে দেশলাইটা মাটি থেকে কুড়িয়ে পকেটে রাখতে গিয়ে মনে হল, হাতটা যেন তার নিজের নয়— যেন আর কারো হাত, তার মনের ইচ্ছেয় সে হাত নড়ে না।
    ক্রমেই তার সর্বশরীর যেন বেশ একটা আরামদায়ক অবসাদে অবশ হয়ে পড়তে চাইল। কি হবে আর বৃথা ভ্রমণে, আলেয়ার পিছু পিছু বৃথা ছুটে, এই রকম বনের ঘন ছায়ায় নিভৃত লতাবিতানে, অলস স্বপ্নে জীবনটা কাটিয়ে দেওয়ার চেয়ে সুখ আর কি আছে?
    একবার তার মনে হল, এই বেলা উঠে তাঁবুতে যাওয়া যাক, নতুবা তার কোনো একটা বিপদ ঘটবে যেন। একবার সে উঠবার চেষ্টাও করতে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই তার দেহমনব্যাপী অবসাদের জয় হল। অবসাদ নয়, যেন একটা মৃদুমধুর নেশার আনন্দ। সমস্ত জগত্‍ তার কাছে তুচ্ছ। সে নেশাটাই তার সারাদেহ অবশ করে আনছে ক্রমশঃ।
    শঙ্কর গাছের শিকড়ে মাথা দিয়ে ভালো করেই শুয়ে পড়ল। বড় বড় কটনউড গাছের শাখায় আলোছায়ার রেখা বড় অস্পষ্ট, কাছেই কোথাও বুনো পেঁচার ডাক অনেকক্ষণ থেকে শোনা যাচ্ছিল, ক্রমে যেন তা ক্ষীণ হতে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। তারপরে কি হল শঙ্কর আর কিছু জানে না।
    আলভারেজ যখন বহু অনুসন্ধানের পর ওর অচৈতন্য দেহটা কটনউড জঙ্গলের ছায়ায় আবিষ্কার করলে, তখন বেলা বেশি নেই। প্রথমটা আলভারেজ ভাবলে, এ নিশ্চয়ই সর্পাঘাত, কিন্তু দেহটা পরীক্ষা করে সর্পাঘাতের কোনো লক্ষণ দেখা গেল না। হঠাৎ মাথার ওপরকার ডালপালা ও চারধারে গাছপালার দিকে নজর পড়তেই অভিজ্ঞ ভ্রমনকারী আলভারেজ ব্যাপারটা সব বুঝতে পারলে। সেখানটাতে সর্বত্র অতি মারাত্মক বিষ-লতার (Poison Ivy) বন, যার রসে আফ্রিকার অসভ্য মানুষেরা তীরের ফলা ডুবিয়ে নেয়। যার বাতাস এমনি বেশ সুগন্ধ বহন করে, কিন্তু নিঃশ্বাসের সঙ্গে বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে, অনেক সময় পক্ষাঘাত পর্যন্ত হতে পারে, মৃত্যু ঘটাও আশ্চর্য নয়।
    তাঁবুতে এসে শঙ্কর দু-তিন দিন শয্যাগত হয়ে রইল। সর্বশরীর ফুলে ঢোল। মাথা যেন ফেটে যাচ্ছে আর সর্বদাই তৃষ্ণায় গলা কাঠ। আলভারেজ বললে— যদি তোমাকে সারারাত ওখানে থাকতে হত, তা হলে সকালবেলা তোমাকে বাঁচানো কঠিন হত।
    একদিন একটা ঝরনার জলধারার বালুময় তীরে শঙ্কর হলদে রঙের কি দেখতে পেলে। আলভারেজ পাকা প্রসপেক্টর, সে এসে বালি ধুয়ে সোনার রেণু বার করলে— কিন্তু তাতে সে বিশেষ উত্‍সাহিত হল না। সোনার পরিমাণ এত কম যে মজুরি পোষাবে না— এক টন বালি ধুয়ে আউন্স তিনেক সোনা হয়তো পাওয়া যেতে পারে।
    শঙ্কর বললে— বসে থেকে লাভ কি, তবু যা সোনা পাওয়া যায়, তিন আউন্স সোনার দামও তো কম নয়।
    সে যেটাকে অত্যন্ত অদ্ভুত জিনিস বলে মনে করেছে, অভিজ্ঞ প্রসপেক্টর আলভারেজের কাছে সেটা কিছুই নয়। তাছাড়া শঙ্করের মজুরির ধারণার সঙ্গে আলভারেজের মজুরির ধারণা মিল খায় না। শেষ পর্যন্ত ও কাজ শঙ্করকে ছেড়ে দিতে হল।
    ইতিমধ্যে ওরা মাসখানেক ধরে জঙ্গলের নানা অঞ্চলে বেড়ালে। আজ এখানে দু’দিন তাঁবু পাতে, সেখান থেকে আর এক জায়গায় উঠে যায়, সেখানে কিছু দিন তন্ন তন্ন করে চারধার দেখবার পরে আর এক জায়গায় উঠে যায়। সেদিন অরণ্যের একটা নতুন স্থানে পৌঁছে ওরা তাঁবু পেতেছে। শঙ্কর বন্দুক নিয়ে দু-একটা পাখি শিকার করে সন্ধ্যায় তাঁবুতে ফিরে এসে দেখলে, আলভারেজ বসে চুরুট টানছে, তার মুখ দেখে মনে হল সে উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত।
    শঙ্কর বললে— আমি বলি আলভারেজ, তুমিই যখন বার করতে পারলে না, তখন চল ফিরি।
    আলভারেজ বললে— নদীটা তো উড়ে যায়নি, এই বন-পর্বতের কোনো না কোনো অঞ্চলে সেটা নিশ্চয়ই আছে।
    – তবে আমরা বার করতে পারছিনে কেন?
    – আমাদের খোঁজা ঠিকমতো হচ্ছে না।
    – বল কি আলভারেজ, ছ’মাস ধরে জঙ্গল চষে বেড়াচ্ছি, আবার কাকে খোঁজা বলে?
    আলভারেজ গম্ভীর মুখে বললে— কিন্তু মুশকিল হয়েছে কোথায় জানো, শঙ্কর? তোমাকে এখনো কথাটা বলিনি, শুনলে হয়তো খুব দমে যাবে বা ভয় পাবে। আচ্ছা, তোমাকে একটা জিনিস দেখাই, এস আমার সঙ্গে।
    শঙ্কর অধীর আগ্রহ ও কৌতূহলের সঙ্গে ওর পেছনে পেছনে চলল। ব্যাপারটা কী?
    আলভারেজ একটু দুরে গিয়ে একটা বড় গাছের তলায় দাঁড়িয়ে বললে— শঙ্কর, আমরা আজই এখানে এসে তাঁবু পেতেছি, ঠিক তো?
    শঙ্কর অবাক হয়ে বললে— এ কথার মানে কি? আজই তো এখানে এসেছি না আবার কবে এসেছি?
    – আচ্ছা, এই গাছের গুঁড়ির কাছে সরে এসে দেখো তো?
    শঙ্কর এগিয়ে গিয়ে দেখলে, গুঁড়ির নরম ছাল ছুরি দিয়ে খুদে কে D. A. লিখে রেখেছে— কিন্তু লেখাটা টাটকা নয়, অন্ততঃ মাসখানেকের পুরোনো!
    শঙ্কর ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারলে না। আলভারেজের মুখের দিকে চেয়ে রইল। আলভারেজ বললে— বুঝতে পারলে না? এই গাছে আমিই মাসখানেক আগে আমার নামের অক্ষর দুটি খুদে রাখি। আমার মনে একটু সন্দেহ হয়। তুমি তো বুঝতে পারো না, তোমার কাছে সব বনই সমান। এর মানে এখন বুঝেছ? আমরা চক্রাকারে বনের মধ্যে ঘুরছি। এসব জায়গায় যখন এ রকম হয়, তখন তা থেকে উদ্ধার পাওয়া বেজায় শক্ত।
    এতক্ষণে শঙ্কর বুঝলে ব্যাপারটা। বললে— তুমি বলতে চাও মাসখানেক আগে আমরা এখানে এসেছিলাম?
    – ঠিক তাই। বড় অরণ্যে বা মরুভূমিতে এই বিপদ ঘটে। একে বলে death circle, আমার মনে মাসখানেক আগে প্রথম সন্দেহ হয় যে, হয়তো আমরা death circle-এ পড়েছি। সেটা পরীক্ষা করে দেখবার জন্যেই গাছের ডালে ঐ অক্ষর দুটি খুদে রাখি। আজ বনের মধ্যে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎ চোখে পড়ল।
    শঙ্কর বললে— আমাদের কম্পাসের কি হল? কম্পাস থাকতে দিক ভুল হচ্ছে কিভাবে রোজ রোজ?
    আলভারেজ বললে— আমার মনে হয় কম্পাস খারাপ হয়ে গিয়েছে। রিখটারসভেল্ড পার হবার সময় সেই যে ভয়ানক ঝড় ও বিদ্যুৎ হয়, তাতেই কিভাবে ওর চৌম্বক শক্তি নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
    – তাহলে আমাদের কম্পাস এখন অকেজো?
    – আমার তাই ধারণা।
    শঙ্কর দেখল অবস্থা নিতান্ত মন্দ নয়। ম্যাপ ভুল, কম্পাস অকেজো, তার উপর ওরা পড়েছে এক ভীষণ দুর্গম গহনারণ্যের মাঝে বিষম মরণ ঘূর্ণিতে। জনমানুষ নেই, খাবার নেই, জলও নেই বললেই হয়, কারণ যেখানকার সেখানকার জল যখন পানের উপযুক্ত নয়। থাকার মধ্যে আছে এক ভীষণ, অজ্ঞাত মৃত্যুর ভয়। জিম কার্টার এই অভিশপ্ত অরণ্যানীর মধ্যে রত্নের লোভে এসে প্রাণ দিয়েছিল, এখানে কারো মঙ্গল হবে বলে মনে হয় না।
    আলভারেজ কিন্তু দমে যাবার পাত্রই নয়। সে দিনের পর দিন চলল বনের মধ্যে দিয়ে। বনের কোনো কুলকিনারা পায় না শঙ্কর, আগে যাও বা ছিল, ঘূর্ণিপাকে তারা ঘুরছে শোনা অবধি, শঙ্করের দিক সম্বন্ধে জ্ঞান একেবারে লোপ পেয়েছে।
    দিন তিনেক পরে ওরা একটি জায়গায় এসে উপস্থিত হল, সেখানে রিখটারসভেল্ডের একটি শাখা আসল পর্বতমালার সঙ্গে সমকোণ করে উত্তর দিকে লম্বালম্বি হয়ে আছে। খুব কম হলেও সেটা চার হাজার ফুট উঁচু। আরও পশ্চিম দিকে একটু খুব উঁচু পর্বতচূড়া ঘন মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে। দুই পাহাড়ের মধ্যেকার উপত্যকা তিন মাইল বিস্তীর্ণ হবে এবং এই উপত্যকা খুব ঘন জঙ্গলে ভরা।
    বনে গাছপালার যেন তিনটে চারটে থাক্‌। সকলের উপরের থাকে শুধুই পরগাছা আর শেওলা, মাঝের থাকে ছোট বড় বনস্পতির ভিড়, নিচের থাকে ঝোপঝাপ, ছোট ছোট গাছ। সূর্যের আলোর বালাই নেই বনের মধ্যে।
    আলভারেজ বনের মধ্যে না ঢুকে বনের ধারেই তাঁবু ফেলতে বললে। সন্ধ্যার সময় ওরা কফি খেতে খেতে পরামর্শ করতে বসল যে, এখন কি করা যাবে। খাবার একদম ফুরিয়েছে, চিনি অনেকদিন থেকেই নেই, সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে আর দু-এক দিন পরে কফিও শেষ হবে। সামান্য কিছু ময়দা এখনো আছে— কিন্তু আর কিছুই নেই। ময়দা এই জন্যে আছে যে, ওরা ও জিনিসটা কালেভদ্রে ব্যবহার করে। ওদের প্রধান ভরসা বন্য জন্তুর মাংস, কিন্তু সঙ্গে যখন ওদের গুলি বারুদের কারখানা নেই, তখন শিকারের ভরসাই বা চিরকাল করা যায় কি করে?
    কথা বলতে বলতে শঙ্কর দূরের যে পাহাড়ের চূড়াটা মেঘের আড়ালে লুকোচুরি খেলছে, সেদিকে মাঝে মাঝে চেয়ে দেখছিল। এই সময়ে অল্পক্ষণের জন্যে মেঘ সম্পূর্ণ সরে গেল। চূড়াটার অদ্ভুত চেহারা, যেন কুলফি বরফের আগার দিকটা কে এক কামড়ে খেয়ে ফেলেছে।
    আলভারেজ বললে— এখান থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বুলাওয়েও কি সলস্‌বেরি চারশো থেকে পাঁচশো মাইলের মধ্যে। মধ্যে শ-দুই মাইল মরুভূমি। পশ্চিম দিকে উপকূল তিনশো মাইলের মধ্যে বটে, কিন্তু পর্তুগিজ পশ্চিম আফ্রিকা অতি ভীষণ দুর্গম জঙ্গলে ভরা, সুতরাং সেদিকের কথা বাদ দাও। এখন আমাদের উপায় হচ্ছে, হয় তুমি নয় আমি সলস্‌বেরি কি বুলাওয়েও চলে গিয়ে টোটা ও খাবার কিনে আনি। কম্পাসও চাই।
    আলভারেজের মুখে এই কথাটা বড় শুভক্ষণে শঙ্কর শুনেছিল। দৈব মানুষের জীবনে যে কত কাজ করে, তা মানুষে কি সব সময় বোঝে? দৈবক্রমে ‘বুলাওয়েও’ এবং ‘সলস্‌বেরি’ দুটো শহরের নাম, তাদের অবস্থানের দিক ও এই জায়গাটা থেকে তাদের আনুমানিক দূরত্ব শঙ্করের কানে গেল। এর পরে সে কতবার মনে মনে আলভারেজকে ধন্যবাদ দিয়েছিল এই নাম দুটো বলবার জন্যে।
    কথাবার্তা সেদিন বেশি অগ্রসর হল না। দু’জনেই পরিশ্রান্ত ছিল, সকাল সকাল শয্যা আশ্রয় করলে।

    1 2 3 4 5 6 7 8 9 10 11 12 13 14
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleপথের পাঁচালী – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
    Next Article আরণ্যক – বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    Related Articles

    ছোটগল্প বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

    কাদা kada

    August 11, 2025
    উপন্যাস কল্লোল লাহিড়ী

    ইন্দুবালা ভাতের হোটেল – কল্লোল লাহিড়ী

    May 28, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রবার্টসনের রুবি – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    বোম্বাইয়ের বোম্বেটে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    রয়েল বেঙ্গল রহস্য – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    উপন্যাস সত্যজিৎ রায়

    যত কাণ্ড কাঠমাণ্ডুতে – সত্যজিৎ রায়

    April 3, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025

    অনুরাধা

    January 4, 2025

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025
    Our Picks

    নবনীতা দেবসেনের গল্প

    September 1, 2025

    করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025

    হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে – নবনীতা দেবসেন

    September 1, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.