Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    • English Books
      • Jules Verne
    • 🔖
    • ➜]
    Subscribe
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চাপরাশ – বুদ্ধদেব গুহ

    বুদ্ধদেব গুহ এক পাতা গল্প628 Mins Read0
    ⤷

    ০১-২. কোজাগরী পূর্ণিমা

    ঠিক চারদিন আগে কোজাগরী পূর্ণিমা গেছে। আজ কৃষ্ণা চতুর্দশী। হৃষীকেশ এর ত্রিবেণী ঘাটে যে মস্ত চাতালটি আছে একটি প্রকাণ্ড পিপ্পল গাছের তলার মন্দিরের সামনে, ঘাটে নামার পথের ডানদিকে, সেই চাতালেরই ওপরে দুপা মুড়ে বসে চারণ চট্টোপাধ্যায় নদীর দিকে তাকিয়েছিল।

    সন্ধে তখনও হয়নি। তবে, হবো হবো।

    আজ কোনও একটা ব্যাপার আছে এখানে। সেটা নবাগন্তুক চারণ চাটুজ্যে বুঝতে পারছে কিন্তু কী ব্যাপার তা বুঝতে পারছে না। জিগ্যেস করবে যে, এমন কেউও নেই এখানে পরিচিত। আসলে এই পৃথিবীতে, এই জীবনে, অপরিচিতরাই যে প্রকৃত পরিচিত এবং পরিচিতরাই যে অপরিচিত এই সত্য সম্বন্ধে চারণের জ্ঞান সম্পূর্ণ হয়নি।

    সন্ধে লাগার সঙ্গে সঙ্গেই দলে দলে সুসজ্জিতা, সালঙ্কারা, সুগন্ধি, বিভিন্নবয়সী, কলহাস্যময়ী নারীদের ঘাটের দিকে নেমে যেতে দেখা গেল। যাওয়ার পথে ওই চাতালে পৌঁছনোর আগে বাঁদিকে ও ডানদিকে যে অগণ্য দোকান আছে, সেইসব দোকান থেকে ফুল ও কী একটি গাছের পাতার দোনার মধ্যে বসানো জ্বলন্ত ধুপকাঠি এবং মাটির প্রদীপ নিয়ে তবেই এগোচ্ছিলেন প্রত্যেকে। একা-একা বা দলেবলে, নদীর ঘাটের দিকে।

    নারীদের মধ্যে বৃদ্ধা একজনও ছিলেন না। লক্ষ করল চারণ। দীপাবলীর আগেই কেন এই দীপাবলী চারণ তা না বুঝতে পারলেও সেই সুন্দর দৃশ্যের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল। আনন্দে মন ভরে যাচ্ছে তার অথচ এই আনন্দে তার নিজের কোনওই ভাগ থাকার কথা ছিল না। নেইও। এ আনন্দ সম্পূর্ণই নৈর্ব্যক্তিক। চারণ বুঝতে পারছিল যে, দুঃখেরই মতো আনন্দও বড় ছোঁয়াচে। নানারকম অপসরণীয় দুঃখের ভারে, অকৃতজ্ঞতা, তঞ্চকতা, নীচ মগ্ন স্বার্থপরতার আঘাতে আঘাতে সে ভারাক্রান্ত। অথচ এই মুহূর্তে ওর আনন্দের কোনও শেষ নেই।

    নারীরা কেউই একা আসেননি। প্রত্যেকের সঙ্গেই তাঁদের ভালবাসার পুরুষেরাও আছেন। ওড়াউড়ি-করা জোড়া-জোড়া পাখিদের ভালবাসারই মতন এই নারী আর পুরুষদের স্কুট ও অস্ফুট ভালবাসা, চুড়ির রিনঠিনে, চোখের চকিত ইঙ্গিতে, শাড়ির খসখসানিতে গোচর ও অনুভূত হচ্ছে চারণের।

    গাড়োয়াল হিমালয়ে সন্ধে নেমেছে। কিন্তু তখনও রাত নামেনি। তবে প্রায়ান্ধকার। লছমন ঝুলা, ম ঝুলার নীচ দিয়ে বেগে প্রবাহিত প্রাণদায়িনী পুণ্যতোয়া গঙ্গা এই হৃষীকেশে পৌঁছতেই সমতলে ছড়িয়ে গেছে। আর সেই দ্রুত ধাৰমানা নদী, নারীদের যতন-ভরা আঙুলে ভাসিয়ে-দেওয়া অগণ্য প্রদীপ বুকে নিয়ে এগিয়ে চলেছে হরিদ্বারের দিকে। হেলতে দুলতে, কাঁপতে কাঁপতে চলেছে দ্রুত বেগে ভাসমান প্রদীপগুলি। কোনও প্রদীপ ডুবে যাচ্ছে স্রোতে কিছুটা গিয়েই। ডুবে যাচ্ছে যার প্রদীপ, সেই নারী মনমরা হয়ে আবারও নতুন প্রদীপ আনতে উঠে আসছেন ঘাট ছেড়ে। নগাধিরাজ হিমালয়ের পাদদেশের সমতলে কৃষ্ণা রাতের, নিঃশব্দে কিন্তু অতি দ্রুত ধাবমানা গঙ্গার এই গতিমান আলোকসজ্জাতে, মুগ্ধ, স্তব্ধ হয়ে গেছে চারণ চাটুজ্যে।

    ওই নারীদের এবং নদীর দিকে চেয়ে চারণ ভাবছিল, সুখ অথবা দুঃখও কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি বা হস্তান্তর-অযোগ্য অনুভূতি নয়! সুখ যে নেয়, সুখ তারই হয়। দুখও যে নেয়, দুখও তার ঘরে গিয়েই ওঠে। হয়তো সে কারণেই নিজস্ব কারণে যে সুখি হতে পারেনি জীবনে, সে অতি সহজেই সুখি হয়ে ওঠে পরস্ব কারণে। দুঃখ ধারণ করার মতন আধার বা আত্মা যার নেই সে সেই দুঃখকে অতি সহজেই অন্যের ঘাড়ে চালান করে দেয়। সংসারে এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। যার আত্মা ভাল নয়, তার দুঃখবোধই নেই। যার দুঃখবোধ আছে, পৃথিবীর তাবৎ দুঃখ তাকেই চুম্বকের মতন নিয়ত আকর্ষণ করে। নিজের দুঃখ তো বটেই, পরের দুঃখও।

    চারণের পাশেই ছিপছিপে এক সন্ন্যাসী জোড়াসনে বসে ছিলেন ত্রিবেণী ঘাটের দিকে চেয়ে।

    কে সন্ন্যাসী আর কে নন তা পোশাক দেখে যতখানি না বোঝা যায় তার চেয়ে অনেকই বেশি বোঝা যায় তাঁর মুখের ভাব দেখে। ভেক ধরলেই কেউ শুধুমাত্র ভেকের জোরেই সন্ন্যাসী হয়ে ওঠেন না। আবার কেউ পোশাকে পুরোপুরি গৃহী হলেও তার মুখের ভাবে তিনি অন্যের কাছে ধরা পড়ে যান যে, তিনি সন্ন্যাসী। অবশ্য যাঁদের দেখার চোখ আছে তাঁদেরই চোখে।

    চারণ কিন্তু মানুষটিকে দেখেই বুঝছিল যে, তিনি সন্ন্যাসী।

    একটুক্ষণ পরেই সেই শীর্ণকায় সন্ন্যাসী উলটোদিকে ঘুরে মন্দিরের দিকে মুখ করে বসলেন। তারপর ঝুলি থেকে একটি মলিন চটি বই বের করে দুহাতের পাতা দিয়ে সামনে মেলে ধরে, নিজের মনে মন্দিরের মধ্যের আলোকোজ্জ্বল মূর্তির উদ্দেশ্যে ভজন ধরলেন।

    গান শুরু হতেই চারণ চমকে উঠে নিজেও ঘুরে বসল।

    ঘুরে বসল একাধিক কারণে। প্রথমত সন্ন্যাসীর গলা সুরঋদ্ধ। দ্বিতীয়ত, গভীর ভাব-সমৃদ্ধ। ইদানীং কলকাতা শহরে মশারই মতন গায়কের সংখ্যাবৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিদিনের দৈনিকপত্রে পাতা-জোড়া ক্যাসেটের বিজ্ঞাপনই তার প্রমাণ। আজকাল গান শোনার মানুষেরই বড় অভাব। তাছাড়া, কবিতা লিখলেই বা তা পত্রপত্রিকাতে ছাপা হলেই বা নিজের পয়সা খরচ করে বই ছাপালেই যেমন কেউ শুধুমাত্র সেই দাবিতেই কবি হয়ে ওঠেন না, সভাতে বা অনুষ্ঠানে গান গাইলেই বা ক্যাসেট বের করলেই কেউ IPSO-FACTO গায়ক হয়ে ওঠেন না। সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবিরই মতন সকলেই অবশ্যই গায়ক নন। শুধু কেউ কেউই গায়ক। চারণ নিজে গায়ক নয়। সুর আছে তার কানে, গলায় না থাকলেও। সুর-বেসুরের তফাৎ বোঝে বলেই ইদানীং কারও গান শুনতে খুবই ভীত হয়। যে-গায়কের গলাতে সুর নেই, অথবা সুর কম লাগে, তার গান শুনতে বড়ই কষ্ট হয়। চারণকে তেমন গান, আনন্দ না দিয়ে যন্ত্রণাই দেয়।

    এই যন্ত্রণার কথা সুরজ্ঞানরহিত মানুষদের বোঝাবুঝির বাইরে।

    সন্ন্যাসী, ভজনের মুখটি পেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই চারণ ঘুরে বসে সেই গানে আত্মস্থ হল। বাণীটি চেনা চেনা লাগল খুব। তারপরই মনে পড়ে গেল যে, এই গানটি ওর শোনা। বহুদিন আগে আলমোড়াতে এক অন্ধ গায়কের গলাতে ওই গানটি শুনেছিল। বহু দূরের কোনও বরফাচ্ছাদিত দেশের পরিযায়ী পাখির মতন গানটি এসে চারণের মনের ছোট্ট জলাতে ডানা ছড়িয়ে, জল নাড়িয়ে জল-ছড়া দিয়ে এসে বসল।

    আস্তাই এর মুখ : খোঁজে খোঁজে তুমহে কানহাইয়া মুঝে নয়না ধারে।

    অন্ধ বলেই হয়তো আলমোড়ার সেই গায়কের গলায় সুরসিক্ত এক আকুতি ছিল। অন্ধ বলেই তাঁর দেবতাকে চোখ দিয়ে দেখার তীব্র তাগিদ ছিল। অন্তরের অন্তস্তল থেকে সেই গানটি উঠেছিল বলেই এত দীর্ঘকাল পরেও গানটিকে এবং গায়ক সজনবাবুকে ভুলতে পারেনি চারণ। হৃষীকেশের এই কৃষ্ণা চতুর্দশীতে এই অচেনা অল্পবয়সী সন্ন্যাসীর ভজনের মধ্যে দিয়ে বহু বছর আগের আলমোড়ার মে মাসের অমাবস্যার রাতের কথা এবং সেই গায়কের কথা যেন নিমেষের মধ্যে উড়ে এল। তবে সজ্জনবাবুর গানের সঙ্গে জোড়া তানপুরা ছিল, হারমনিয়ম, তবলা। এবং ঘরের মধ্যে হয়েছিল সে গান। যাঁরা গান সম্বন্ধে কিছুমাত্রও জানেন তাঁরা স্বীকার করবেন যে, কোনওরকম অনুষঙ্গ হাড়া খালি গলাতে চারদিক খোলা জায়গাতে বসে সুরে গান গাওয়া এবং সেই গান অন্যের কানে এবং মরমেও পৌঁছনো বড় সোজা কথা নয়। এই সন্ন্যাসী সেই প্রায় অসাধ্য কর্মটিই করছিলেন।

    গান শেষ হলে চারণ বলল, বড় সুন্দর গান আপনি। ভারী ভাল লাগল।

    সন্ন্যাসী চারণের দিকে চেয়ে রইলেন চুপ করে। কথা বললেন না কোনও।

    তারপর বললেন, গান কি গায়কের? গান চিরদিনই শ্রোতার। তাছাড়া গানের আমি কি জানি! গান জানেন আমার গুরু।

    আপনার গুরু? তিনি কে?

    ওই যে!

    বলেই, সন্ন্যাসী তাঁর বাঁদিকে আঙুল তুলে দেখালেন। চারণ, সন্ন্যাসীর তর্জনী নির্দেশ অনুসরণ করে দেখল যে, চাতালের ডানদিকের (মন্দিরের দিকে পেছন ফিরে বসলে যে দিক ডানদিকে, সেই দিকে) একেবারে শেষ প্রান্তে দু-তিনটি অসমান বাঁশের কঞ্চির উপরে বিছানো, একসময়ে সাদা ছিল কিন্তু এখন কালো হয়ে-যাওয়া প্লাস্টিকের চাঁদরের নীচে, কালো, শীর্ণ, দীর্ঘাঙ্গ একজন মানুষ গেরুয়া লুঙ্গি আর হাতওয়ালা গেঞ্জি পরে, চোখ বুজে নিজের মনে, তাঁর পারিপার্শ্বিক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে অ্যালুমিনিয়ামের একটি দুধের পাত্রর উপর তাল দিতে দিতে পুরোপুরি আত্মস্থ হয়ে গান গাইছেন। তাঁর বাঁ হাতের কব্জিতে একটা সস্তা হাতঘড়ি।

    সন্ন্যাসী বললেন, যাবেন নাকি গুরুর কাছে?

    চারণ মাথা নাড়ল। নেতিবাচক।

    যাবেন না?

    না।

    চারণের কানে গুরু শব্দটাই অসহ্য ঠেকে। জি কৃষ্ণমূর্তির ভক্ত ও। গুরুবাদে বিশ্বাস নেই, মন্ত্রে-তন্ত্রে ভক্তি নেই, দীক্ষা-টিক্ষাতেও আদৌ নয়। তবে একথাও ঠিক যে, যাঁদের আছে, তাঁদের প্রতি কোনও বিরূপতাও নেই।

    তারপর ভাবল, সন্ন্যাসীর কি কোনও ধান্দা আছে? নাহলে সদ্য-পরিচিত তাকে নিয়ে গিয়ে তার গুরুর কাছে ভিড়িয়ে দেওয়ার মতলব কেন?

    তারপর ও আবার ঘুরে বসল ত্রিবেণী ঘাটের দিকে মুখ করে। সন্ন্যাসীও তাই করলেন।

    চারণ জিজ্ঞাসা করল সন্ন্যাসীকে, আজ কি কোনও উৎসব এখানে? কোনও ব্রত-টুত? এত মেয়েরা সব বিয়ের সাজে সেজে বেনারসি-টেনারসি পরে, গা-ভরা গয়না পরে প্রদীপ ভাসাচ্ছেন কেন নদীর জলে? আজকে এখানকার পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে যেন দশেরার দিনে বসে আছি কাশীর দশাশ্বমেধ ঘাটে। সেখানেও মেয়েদের অমন করেই প্রদীপ ভাসাতে দেখেছিলাম উত্তরবাহিনী। গঙ্গাতে।

    হুঁ।

    সন্ন্যাসী বললেন।

    তারপর বললেন, আমি দশাশ্বমেধ ঘাটেও ছিলাম দুবছর। দশেরার দিনে প্রদীপ হেলেরাও ভাসায়। সেই জল-প্রদীপ উৎসর্গ করা হয় পূর্বপুরুষদের প্রতি। তর্পণের এক রকম আর কী।

    তাই?

    হুঁ;

    তা আজ এখানে কিসের উৎসব তা তো বললেন না।

    সন্ন্যাসী বললেন, আজ কড়োয়া চওথ।

    সেটা কি?

    বিবাহিত মেয়েরা, কড়োয়া চওথ মানে, কোজাগরী পূর্ণিমার পরের কৃষ্ণা চতুর্থীতে স্বামীদের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষাতে সন্ধেতে এমনি করেই জলে প্রদীপ ভাসায়। হিন্দু ও জৈন মেয়েরাও এদিন সারাদিন উপোস করে থাকেন, বিবাহিত মেয়েরা। প্রদীপ ভাসানোর পরে তারপরই বাড়িতে গিয়ে খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-আহ্লাদ।

    চারণ জিগ্যেস করল, যে-গারে পাতাতে দোনা বানানো হয়েছে সেগুলো কোন গাছের পাতা? আমি তালগাছ চিনি। তাল নয়। শাল পাতাও তো নয়। এই পাতাগুলো কোন গাছের?

    শাল তো এই পার্বত্য অঞ্চলে হয়ও না। মহানও হয় না। স্যাণী বললেন।

    মহুলানটা কি জিনিস?

    এক রকমের গাছ। সেই গাছের পাতা ব্যবহৃত হয় দক্ষিণ ভারতের সব মন্দিরে। তবে সে গাছ হয় ভারতের অনেক জায়গাতেই।

    তাড় মানে? তাল গাছ?

    সন্ন্যাসী হেসে উঠে বললেন, না, না। তাড়। তাল আমি চিনি। কালিঘাটেও ছিলাম কিছুদিন যে! হিমালয়ে জন্মায় এই তাড় গাছ। দেখাব এখন আপনাকে একদিন।

    বলেই বলল, আছেন কদিন?

    চারণ বললেন, ঠিক করিনি।

    বাঃ।

    সন্ন্যাসী বললেন।

    বাঃ কেন?

    আপনিও সন্ত দেখছি। ক্যালেন্ডার দেখে আসা, ক্যালেন্ডার দেখে যাওয়া, ক্যালেন্ডার দেখে অসা, ক্যালেন্ডার দেখে কাঁদা, ঘড়ি ধরে দিন শুরু করা এবং শেষ করা এর মধ্যে একটা চাকরি-চাকরি গন্ধ নেই কি? এ বড় কঠিন চাকরি! অন্য যে কোনও চাকরিই ছাড়া খুবই সহজ কিন্তু এই ক্যালেন্ডারের চাকরি, ঘড়ির চাকরি ছাড়া ভারী কঠিন। ভারী কঠিন।

    তাই?

    অন্যমনস্ক গলাতে বলল চারণ।

    তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, আপনাকে দেখে বয়স তত বেশি বলে মনে হচ্ছে না। আপনি সন্ন্যাস নিলেন কেন?

    সন্ন্যাসী হাসলেন।

    বললেন, সন্ন্যাস কি কেউ ইচ্ছে করলেই নিতে পারে? শুধু গেরুয়া পরলেই কি সন্ন্যাস নেওয়া সম্পূর্ণ হয়?

    তারপর কিছুক্ষণ ত্রিবেণী ঘাটের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, তবে একথাও ঠিক যে, নেওয়ার চেষ্টাতেই আছি গত পঁচিশ বছর ধরে। সন্ন্যাস ব্যাপারটা যে ঠিক কি?- তা আজও বুঝে উঠতে পারলাম না।

    চারণ একটু অবাকই হল। তারপরই ঘাটের দিকে চেয়ে রইল একদৃষ্টে। বড় নয়নলোভন দৃশ্য। কত রঙের শাড়ি পরা কত বিভিন্ন বয়সী নারীরা ঘাটে যাচ্ছেন। ঘাটের মস্ত বাঁধানো চাতাল পেরিয়ে আবার ফিরে আসছেন। চোখের পক্ষে এও একধরনের Movable Feast. স্রোতের পর স্রোত। কত মানুষের গলার স্বর। বেশিই মেয়েদের। চাতালের একদিকে একটি মন্দির। সেখানে লাউডস্পিকারে মন্ত্রোচ্চারণ হচ্ছে। ভজন হচ্ছে। আর অন্যদিকে সাদা পাথরের মূর্তি। ভগীরথের গঙ্গা আনয়নের দৃশ্য। ঘাটের তিনদিক থেকে সরু পথ এসে পৌঁছেছে চাতালে। আবার অনেক পথ নেমে এসেছে পাহাড়ের গায়ের নানা ধরমশালা এবং আশ্রম থেকেও। অনেকখানি এলাকা জুড়ে দেখবার মতন ঘাট বটে। সিঁড়ির পরে সিঁড়ি নেমে গেছে।

    সন্ন্যাসী, চারণকে মুগ্ধচোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে স্বগতোক্তি করলেন, বর্ষাকালে অধিকাংশ সিঁড়িই ডুবে যায়।

    ওই চাতালে বসে থাকতে থাকতে ভারী এক ঘোর লাগছিল চারণের। চারদিকে এত ঈশ্বর-বিশ্বাসী মানুষ। ভরাট গলার মন্ত্রোচ্চারণ। ফুলের গন্ধ, ধূপের গন্ধ, মন্দিরের ঘটার নানা পর্দার ধাতব ধ্বনি, ভজনের শুদ্ধ ধ্বনি, হংসধ্বনিরই মতন, ওর মনকে আস্তে আস্তে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। হঠাৎই সন্ন্যাসীর প্রশ্নে চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল চারণের।

    উনি বললেন, উঠেছেন কোথায়?

    ওর ইচ্ছে করল, মিথ্যে বলে। কারণ, এই চাতালে, জোড়াসনে বসে-থাকা সাধুর পাশে নিজেও পায়জামা পাঞ্জাবি পরে বসে যে মানসিক তলএ এতক্ষণ বিরাজ করছিল ও, হোটেলের নাম বলার সঙ্গে সঙ্গেই, চারণ জানে যে, এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে তাঁর মানসিক তল-এর তফাৎ হয়ে যাবে।

    চারণ ভাবল, যে মিথ্যে কথা বলে। কিন্তু পর মুহূর্তেই ঠিক করল যে না, মিথ্যে বলবে না।

    সন্ন্যাসী তারই মুখের দিকে চেয়েছিলেন।

    বলল, মন্দাকিনী হোটেল।

    সেটা কোথায়?

    অবাক হল চারণ। আশ্বস্তও। ভাবল এই জন্যেই ওই তরুণ, তার প্রায় সমবয়সী এই মানুষটি সন্ন্যাসী হতে পেরেছেন।

    হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশে আসতে হলে মন্দাকিনী হোটেল পথেই পড়ে। বাঁদিকে। তিনতারা হোটেল। হৃষীকেশে আর একটি মাত্র তিনতারা হোটেল আছে, দেরাদুনের পথে। সন্ন্যাসী যদি প্রকৃত সন্ন্যাসী হতেন তবে হোটেলের নাম শুনেই লোভে চোখ দুটি চকচক করে উঠত হয়তো। কিন্তু হৃষীকেশের বাসিন্দা হয়েও মন্দকিনী হোটেলের নাম-না-শোনা সন্ন্যাসী তাঁর থলেতে হাত ঢুকিয়ে নির্লিপ্ত মনে একটি বিড়ি বের করলেন। তারপর দেশলাই দিয়ে ধরালেন সেটা। চারণের দিকে ভাল করে চাইলেন। হয়তো ভাবলেন, চারণ ধূমপান করলেও নিশ্চয়ই ভাল সিগারেট খায়। তাকে বিড়ি অফার করাটা ভব্যতা হবে না। সুতরাং তা থেকে নিরত থেকে, নিজের বিড়িতে সুখটান লাগালেন একটা।

    আপনি ভারতের কোন প্রদেশের মানুষ?

    চারণ জিগ্যেস করল।

    করেই, মনে পড়ল সন্ন্যাসীদের পূর্বাশ্রমের কথা জিগ্যেস করতে নেই।

    কিন্তু সন্ন্যাসী উত্তর দিলেন। বললেন, মহারাষ্ট্রের। পুনের কাছের।

    বলেই বললেন, সন্ত তুকারামের নাম শুনেছেন?

    নাঃ।

    চারণ বলল।

    বলেই মনে মনে বলল, কোনও সন্ত-

    ফরই নাম শোনেনি সে। চারণের পরলোকগতা মায়ের খুবই ইচ্ছে ছিল যে, এইসব জায়গাতে আসেন তীর্থদর্শনে। কিন্তু তখনও চারণ নিজের পায়ে দাঁড়ায়নি। বাবাও গত হয়েছেন আগেই। ওর সামর্থ্য ছিল না যে মাকে নিয়ে আসে। তখন মাকে আনতে পারেনি। এখন মা নেই। ও একাই এসেছে। ধর্ম-টর্ম মানে না ও। দেব-দেবতা মানে না। গুরু মানে না। কলেজের ছাত্র থাকাকালীন বাম-ঘেঁষা রাজনীতিও করেছিল। তাই ধর্ম, ধর্মস্থান, দেব-দেবী ইত্যাদি সম্বন্ধে জন্মে-যাওয়া এক গভীর অসুয়াও এইসব তীর্থস্থানে মাকে না-নিয়ে আসার হয়তো একটি কারণ ছিল।

    তারপরে কী মনে করে বলল, কে তিনি? সন্ত তুকারাম?

    সন্ন্যাসী বললেন, সন্ত তুকারামও মারাঠি ছিলেন। মহারাষ্ট্রেরই মানুষ।

    তাই? আপনি কি তাঁর চেলা?

    না, না। নাম শুনেছি। তাঁর সম্বন্ধে শুনেছি, পড়েছি। ওঁকে কি আর চোখে দেখেছি কখনও? কত শতাব্দী আগের কথা।

    আপনি কি তাঁর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়েই সন্ন্যাস নিয়েছিলেন?

    সন্ন্যাসী হেসে ফেললেন চারণের কথা শুনে।

    বললেন, আবারও বলছেন সন্ন্যাসের কথা। আগেই বলেছি, সন্ন্যাস আমি নিতে পারিনি এখনও। এখানে অনেক পকেটমার, নেশাখোর, চোরবদমাশও আছে। আমিই যদি সন্ন্যাসী হতে পারতাম

    তাহলে তারা দোষ করল কি?

    তাহলে?

    তাহলে কি?

    বলেই, কটুগন্ধ বিড়িতে কষে এক টান লাগালেন সন্ন্যাসী।

    গন্ধে গা গুলিয়ে উঠল চারণের।

    বলল, তাহলে সংসার ছাড়লেন কেন?

    আমার মা আর বাবা তিন মাসের ব্যবধানে হঠাৎই মারা গেলেন। একেবারেই হঠাৎ।

    অ্যাকসিডেন্টে?

    না, না। এমনি অসুখেই। তবে অ্যাকসিডেন্টেরই মতন। কোনও ভারী অসুখও নয়, কোনও মারীতেও না, অতি সামান্য জ্বর হয়েছিল। দুজনেরই। কদিন আগে আর পরে। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর আগেই গেলেন।

    এই অবধি বলেই সন্ন্যাসী আবার উদাস হয়ে নদীর দিকে তাকালেন। বিড়িটা শেষ করলেন আস্তে আস্তে।

    তারপর বললেন, মায়ের মৃত্যুর সময়ে বাবা তো বটেই, আমিও পাশেই ছিলাম। সন্ধে রাত্তিরে গেলেন মা। যাবার আগে মায়ের মুখচোখে কেমন আতঙ্কের ছাপ দেখলাম। দারুণ আতঙ্ক। আঙুল দিয়ে খোলা জানালার দিকে দেখালেন বারবার। যেন কারওকে বা একাধিক মানুষকে বা জন্ধুকে দেখতে পাচ্ছেন। মানুষ বা জন্তু, যে বা যাদেরই মা দেখতে পেয়ে থাকুন না কেন, তাদের দেখে উনি ভীষণই ভয় পেয়ে গেছিলেন।

    তাই?

    অবাক হয়ে চারণ বলল।

    তারও মনে পড়ে গেল তার বাবার মৃত্যুর কথা। চারণও তার বাবার মৃত্যুর ক্ষণে তাঁর মুখেও দারুণ এক আতঙ্কের ছাপ লক্ষ করেছিল!

    একেবারে ভুলেই গেছিল ব্যাপারটা।

    মায়ের মৃত্যুর সময়ে অফিসের কাজে সে কলকাতার বাইরে ছিল। মায়ের মুখেও আতঙ্ক ফুটেছিল কিনা বলতে পারবে না মৃত্যুর ক্ষণে। এত বছর পরে আজ সন্ন্যাসী এ প্রসঙ্গ তোলাতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল তার বাবার মৃত্যুর কথা। আগে কিন্তু এ নিয়ে তেমন করে ভাবেওনি কখনও।

    তারপর দুজনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলেন।

    আর গান গাইবেন না?

    নাঃ। আজ আর নয়। রোজই যে গান গাই এমনও নয়। যেদিন ইচ্ছে করে, সেদিন গাই।

    ঠাকুরকে শোনাতে?

    না, তাও নয়। তবে যে যাই করুক না কেন সব কাজেরই যেমন একটা উদ্দেশ্য থাকে, তেমন বিধেয়ও থাকে। ওই দিকে মুখ করে গাওয়াটাই বিধেয়, তাই।

    সংসার কেন ছাড়লেন তা কিন্তু বললেন না এখনও।

    চারণ বলল।

    সন্ন্যাসী হাসলেন। ওঁর হাসিটা ভারী মিষ্টি। দুটি গজদন্ত আছে স্যাসীর। হাসলে, সুন্দর দেখায়, কৃশ, তামাটে সন্ন্যাসীকে। বয়সই বা কত হবে? বড় জোর চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। চারণের চেয়েও ছোট।

    সন্ন্যাসী বললেন, আপনি তো খুব হড়বড়িয়া মানুষ।

    তারপর আবারও ঘাটের দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, সংসার ছিলই আর কোথায়? সংসার তো ছিল, বাবা আর মাকেই নিয়ে। মাবাবাই চলে গেলেন। তখন আমার বয়স মাত্র সতেরো। অত অল্প সময়ের ব্যবধানে, মানে, মাত্র দুমাসের ব্যবধানে, দুজনেই চলে যাওয়াতে বড় অসহায় তো হয়ে গেলামই, তাছাড়া আমার মনে নানা প্রশ্ন জাগল, যা ওই বয়সী কোনও ছেলের মনে জাগার কথা ছিল না কোনও। কিন্তু জেগেছিল।

    কী প্রশ্ন? মানে কীরকম প্রশ্ন?

    ওই! জীবন কি? জীবন কেন? মৃত্যুই বা কি? মৃত্যুর পরে কি অন্য কোনও জীবন ……তাই ভাবলাম, বেশ কিছু সময় হাতে থাকতে থাকতেই বেরিয়ে পড়ি ঘর ছেড়ে দুনিয়া দেখতে। ভাবলাম, নানা তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াব, জিগ্যেস করব নানা সাধু-সন্তদের, ভাবব, প্রয়োজনে সাধনা করব। জেনে নেব, মা বাবা কোথায় গেলেন? যাওয়ার সময়ে অমন ভয়ই বা কেন পেলেন? মৃত্যুর পরেও জীবন আছে কি না, এইসব নানা প্রশ্নের উত্তর খুঁজব। আমার নিজের জীবনওতো অনন্তকালের নয়!

    কত বছর হল ঘর ছেড়েছেন?

    চারণ জিগ্যেস করল।

    আঠারো বছর।

    জানলেন কিছু? মানে, আপনার সব প্রশ্নের জবাব কি পেলেন?

    নাঃ। কোনও প্রশ্নের জবাবই পাইনি। জবাব পাইনি যে তা নয়, সে সব জবাব মনঃপূত হয়নি। হতাশ ঠিক নয়, তবে উদাসীন গলায় বললেন সন্ন্যাসী।

    তবে? উত্তর নাই যদি পেয়ে থাকেন তো এখন ঘরে ফেরার বাধা কোথায়?

    নাঃ।

    কী নাঃ।

    ঘরে আর ফিরব না। ঘরকে তেমন করে ছেড়ে এলে ঘর আর ফেরত নেয় না কারওকেই। তাছাড়া, ঘর বলতে তো ছিলও না কিছু আমার। মানে, ভালবেসে থাকার মতন কিছু ছিল না। শুনেছি আমার সম্পত্তি কাকারা জবরদখল করে নিয়েছিলেন আমি চলে আসার পরেই। আমার এক মামা থাকতেন নাসিক-এ। তিনি চেয়েছিলেন আমার বিয়ে দিয়ে আমাকে সংসারী করতে। জমিজমা কম ছিল না। কিন্তু আমিই পালিয়ে এসেছিলাম।

    তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জমিজমা, ঘরবাড়ি যদি থাকতও তবেও ফিরে গিয়ে সেখানে তিষ্ঠোতে পারতাম না। এই আকাশ, বাতাস, এই পাহাড়, নদী, এই শ্মশান এইসব ধর্মস্থানে সারা ভারতের সারা পৃথিবীর সাধু-সন্ত, সন্ন্যাসীদের ভিড়। এদের ছেড়ে যেতে পারব না আর। কত কী জানার বাকি আছে। জানা তো কিছুই হয়নি। এঁরা কেন পড়ে আছেন বিভিন্ন তীর্থস্থানে? কিসের খোঁজে? কিছু কি পেয়েছেন এঁরা? নাকি এঁরাও আমারই মতন তালাশেই আছেন এখনও? কে জানে! হয়তো এঁরাও কিছু পাননি। এঁরাও হয়তো নেশারই ঘোরে, গাঁজা-আফিঙের-ভাঙের নেশা, এই খোলামেলা জায়গার নেশা, এই ক্যালেন্ডার আর ঘড়ির দাসত্ব থেকে মুক্তির নেশাতে মজেছেন। আমারই মতন। সারা জীবনেরই মতন ফেঁসে গেছেন হয়তো।

    ফেঁসে গেছেন কেন বলছেন? বলুন, উৎরে গেছেন। চারণ বলল।

    তারপর মনে মনে বলল, আধুনিক বাংলা সাহিত্যিকেরা বলেন উত্তরণ।

    তারপর বলল, ফেঁসে গেছেন, গেঁথে রয়েছেন তাঁরাই, যাঁরা সংসারে আছেন। আপনার ভাষাতে ক্যালেন্ডার আর ঘড়ির দাসত্ব-করা জীবেরা। টাকা, ব্যবসা, বাণিজ্য, জাগতিক সব প্রাপ্তির পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন অবিরত তাঁরাই।

    সন্ন্যাসী হঠাৎই প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে বললেন, আপনি কি করেন?

    কিছু করি না। মানে, করব না আর এখন।

    কি করতেন?

    বাঙালি হয়ে জন্মেছি, আর কী করব? চাকরি। তবে আমি যা করি তাকে চাকরি ঠিক বলা যায়। কারণ আমার অনেক মালিক, একজন নয়।

    তাই? সংসার করেননি?

    করব করব করেছিলাম, কিন্তু করা হয়নি।

    রুণ চুপ করে থেকে বললেন অলস, এই পাহাড়, নদী, এই মশা না আর। কত

    তাজ্জব কী বাত।

    বলেই, সন্ন্যাসী আবারও আসলেন। গজদন্ত দেখা গেল আবারও।

    .

    তারপরে গানের বইটির ধুলো ঝেড়ে কাঁধের বোলাতে ভরে ফেলে বললেন, এবারে…

    চারণ ভাবল এবারে টাকা চাইবেন নিশ্চয়ই সন্ন্যাসী, এতক্ষণ তার সঙ্গে গল্প করার খেসারত হিসেবে। কিন্তু না। চারণ চাটুজ্যেকে অবাক করে দিয়ে তার মুখনিঃসৃত বাক্যকে সম্পূর্ণ করলেন উনি, এবারে আমি কালিকমলি বাবার আশ্রমে যাব।

    কি করতে?

    চারণ শুধোল।

    খেতে।

    কি খাবেন কালিকমলি বাবার আশ্রমে?

    যা দেবে।

    কি দেয়?

    রুটি, তরকারি। কখনও ডালও।

    তাতেই হয়ে যায়? আর কিছু?

    হয়ে যায়। পেটের খিদেকে সব সময়েই জাগিয়ে রাখা উচিত প্রত্যেকেরই। উপোস থাকতে পারলেই সবচেয়ে ভাল হয়। তখন মাথাটা দারুণ সাফ হয়ে যায়। আগুন পোড়ায় শরীরকে আর চিন্তা পোড়ায় মনকে। কাশীর শ্মশানে এক তান্ত্রিক আমাকে বলেছিলেন কথাটা। ভারী মনে ধরেছিল।

    একেবারে উপোস? উপোস করে থাকেন নাকি?

    হ্যাঁ। তবে, মাঝেমধ্যে, খাই। আমি তো আর উচ্চমার্গে উঠতে পারিনি। আমার গুরু, যাঁকে দেখালাম, তিনি অনেকসময় পনেরোদিন বা একমাস না খেয়েও থাকেন। বকাঝকা করে খাওয়াতে হয়। গুরু বলেন, খেয়ে নষ্ট করার মতন সময় তাঁর নেই। বলেই, হাসলেন সন্ন্যাসী।

    তারপর বললেন…..এ দেশের যারা মালিক, দণ্ডমুণ্ডের কর্তা তারা দেশটাকে ডোবাল খাইখাই করে আর বেশি খেয়েই। এই দেশটার নাম ভারতবর্ষ বাবু। এখানে যে কত আশ্চর্য সব মানুষ, ভাবনা-চিন্তা আছে, কত সাধু, সন্ত, তান্ত্রিক, সফী, সৈয়দ, পীর আছেন, তার খোঁজ এখন গ্রামের মানুষেরাই রাখে না, তা আপনার মতো শহুরে মানুষের দোষ কি? এখন টিভি দেখলেই সব জানা যায়। জানার বাকি আর কি থাকে বলুন? অন্তত আপনারা তাই ভাবেন। বড় অভাগা দেশ তো। হতভাগা মানুষদের দেশ।

    বলেই, পা বাড়াবার আগে বললেন, আপনার নাম কি?

    চারণ চ্যাটার্জি।

    তারপর চারণ জিগ্যেস করল, আপনার নাম, সাধুজি?

    পূর্বাশ্রমের নাম তো নিজেই প্রায় ভুলে গেছি। আমার নাম ভীমগিরি আর আমার গুরুর নাম ধিয়ানগিরি। উনিই আমার নাম রেখেছেন ভীমগিরি।

    ভীমগিরি, কালিকমলি বাবার আশ্রমের দিকে যাবার আগেই চারণ বলল, আপনি রাতে শশাবেন কোথায়?

    কেন? এই চাতালে।

    বলেন কি? এই চাতালে? এখনই যা ঠাণ্ডা।

    হাঃ। গুরুজির সেবা করব ফিরে এসে। তাঁকে গজা সেজে দেব। তারপর ত্রিবেণী ঘাট যখন নিন্দুপ হয়ে যাবে, গভীর রাতে শুধু নদীর স্রোতের শব্দ আর হাওয়ার শব্দ বাজবে আর ছমছমে অন্ধকার, তখন মধ্যরাতে গুরুজি গান গাইবেন। আহা কী গান।

    শেষ রাতে শুক্লপক্ষের চাঁদ উঠবে আমার গুরুজির গান শোনার জন্যে।

    তারপর?

    এমন সময়ে একটি মেয়ে সন্ন্যাসীর দিকে ঘাটের দিক থেকে এসে সামনে দাঁড়াল। তার পরনে একটি ছাইরঙা সিনথেটিক শাড়ি, গায়ে সাদা ব্লাউজ। পিঠের উপরে ছড়ানো বেণীর চুলে নীলরঙা কোনও ফুল গুঁজেছে। চেহারাটা একটু মোটার দিকেই। সুগন্ধ বেরুচ্ছে তার গা থেকে। যদিও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। নাকের খাড়াই-এর উপরেও ঘামের ছোট ছোট বিন্দুর সারি। নাক চিবুক দেখে মনে হয় কোনও শিল্পী যেন কালো পাথরে ছেনিবাটালি দিয়ে তাকে গড়েছেন।

    হাসি হাসি মুখে সেই কৃষ্ণা মেয়েটি এসে ভীমগিরির কাছে দাঁড়াতেই ভীমগিরি বললেন, কি খবর? মাত্ৰী? আসনি কেন দুদিন?

    জ্বরে পড়েছিলাম যে!

    ভাল আছ তো এখন?

    হ্যাঁ। আপনি ভাল আছেন?

    আমি তো সব সময়ে ভালই থাকি। শুধু অম্বলই ভোগায়।

    মেয়েটি হেসে বলল, এই এক বালাই বটে! ভোগী কী যোগী কারওই রেহাই নেই এর হাত থেকে।

    ভীমগিরি হেসে বললেন, যা বলেছ!

    মেয়েটি এবং ভীমগিরির কথোপকথন কিন্তু পরিষ্কার বাংলাতেই হচ্ছিল। ভীমগিরিকেও এমন চমৎকার বাংলা বলতে শুনে অবাক হয়ে গেল চারণ।

    যাই।

    বলল মেয়েটি।

    এসো, রোজ এসো। তোমাকে না দেখলে ভজনে মন বসাতে পারি না। গানের সময়ে এসো।

    আসব। বলেই, সেই কৃষ্ণা সিঁড়ি বেয়ে নেমে ঘাটের চাতাল পেরিয়ে প্রথমে প্রায়ান্ধকারে তারপর অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেল। সম্ভবত পাহাড়ের উপরের কোনও আশ্রমে চলে গেল সে।

    মাদ্রী! ভারী সুন্দর নাম তো। কী মানে, কে জানে? মানে কি আছে কোনও? সব নামের তো মানে হয় না! ভাবল চারণ।

    ভীমগিরি বললেন, এবারে সত্যি সত্যিই যাই।

    চারণ আশ্চর্য এবং মুগ্ধ দৃষ্টিতে চলে-যাওয়া ভীমগিরির দিকে চেয়ে রইল।

    অনেক কথা জানবার ছিল চারণের তাঁর কাছে।

    এই মেয়েটি কে? ভীমগিরি এবং তাঁর গুরু ধিয়ানগিরির সঙ্গে কি সম্পর্ক তার? বাঙালি তো মেয়েটি বটেই কিন্তু বাড়ি তার কোথায় ছিল? কি করে সে হৃষীকেশে? কিছুই জানা হল না।

    বড় ভাল লেগে গেল এই সন্ন্যাসীকে, তার কথাবার্তা এবং সবচেয়ে বড় কথা, তার সম্ভ্রান্ততাকেও।

    দেরাদুন থেকে হৃষীকেশে এসে আজ পৌঁছেই এই সন্ন্যাসীর সঙ্গে আলাপিত হওয়াটা ওর কাছে মস্ত বড় এক প্রাপ্তি বলে মনে হল। কোনও ফেরেরবাজ মানুষ, দুনম্বরী সাধুর সঙ্গেও তো দেখা হতে পারত। দুনম্বরী নেতা, দুনম্বরী সাহিত্যিক, হাকিম, উকিলে দেশ ছেয়ে গেছে। এই প্রেক্ষিতে এই একনম্বরী ভীমগিরি-প্রাপ্তি অবশ্যই এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আত্মানুসন্ধানে প্রায় নিরুদ্দেশে ঘর-ছাড়া চারণের মনে হচ্ছিল এই কাড়োয়া চওথ-এর সন্ধেতে এই সন্ন্যাসীর দর্শন লাভের ঘটনাটির গুঢ় তাৎপর্য আছে।

    হোটেলে পৌঁছে ডাইনিং রুমের দিকেই যাচ্ছিল। তারপর ভাবল, চান করবে। গিজার তো আছেই বাথরুমে।

    দুপুরে এসে পৌঁছনো অবধিই দেখছে লিফটটা একটু গোলমাল করে। কারণ, কয়েক বছর আগে গাড়োয়াল হিমালয়ের ভূমিকম্পতে এই তিনতারা হোটেল বাড়িতেও সামান্য ফাটল ধরেছিল। তাতেই লিফটটার অ্যালাইনমেন্ট নষ্ট হয়ে গেছে, ভূমিকম্পর বাড় হয়েছিল এখান থেকে বহুদূরে যোশীমঠে কিন্তু জের এখানেও পৌঁছেছিল এসে। এখানেও তার আঁচড় লেগেছিল। এখানে ভূমিকম্প হলে কী হতে পারে তা কলকাতাতে বসে অনুমান করাও শক্ত। এই নগাধিরাজের পাদদেশে দাঁড়িয়ে ভূমিকম্পের কথা ভাবলেও বুকে কাঁপুনি ধরে।

    .

    ঘরে গিয়ে চারণ ভাল করে চান করল। ভাবল, রুম-সার্ভিসে বলে রাতের খাবার আনিয়ে নেবে ঘরে। চান সারবার পরেই হঠাৎ ওর মনে হল যে, স্মরণেই আসে না সুস্থ অবস্থাতে ও জীবনে একদিনও স্বেচ্ছাতে একবেলাও অভুক্ত থেকেছে বলে।

    সম্যাসীর উপোস থাকার কথাটা তার মনে আলোড়ন তুলেছিল। চান সেরে, জামাকাপড় বদল করে ও শুয়ে পড়ল। বাসে এসেছিল দেরাদুন থেকে। বাসে চড়ারও অভ্যেস চলে গেছে বেশ কয়েক বছর। তবু বাসে আসতে কষ্ট কিছুই হয়নি। বরং নানা মানুষের নানা কথা, কনডাইরের রসিকতা, এসব শুনতে শুনতে আসতে ভালই লেগেছিল। তবে দিল্লি থেকে দেরাদুন, মক্কেলের মার্সিডিস গাড়িতে এসেছিল। কয়েক বছর হল এমনই হয়েছে যে, তার জীবনটাই স্বাভাবিক আলো হাওয়ার সঙ্গে যেন সম্পর্ক-বিবর্জিত হয়ে গেছিল। অতটুকু পথ বাসে আসতে বেশ লেগেছিল। হরিদ্বার থেকে গা-জোয়ারি করেই বাসে এসেছিল, গাড়ি ছেড়ে দিয়ে।

    কম-বেয়ারা এসে খোঁজ নিয়ে গেল, খাবারের অর্ডার দেবে বা দিয়েছে কি না টেলিফোনে, না সেই নিয়ে যাবে?

    চারণ বলল, খাবে না কিছু।

    তবিয়ং খারাপ হ্যায় ক্যা সাব?

    নেহি। অ্যাইসেহি।

    গুডনাইট সাব। বেড-টি কি বারেমে ইন্টারকমমে রুম-সার্ভিসসে বোল দিজিয়ে গা।

    বেয়ারা চলে গেলে, ঘরের লাগোয়া বারান্দাতে এসে একবার দাঁড়াল চারণ। তীব্র বেগে বয়ে চলেছে গঙ্গা, হৃষীকেশ এর কাছে একটি ছোট ড্যাম হয়েছে। নদীর উপরে। তারই উজ্জ্বল নীলাভ-সবুজ আলো দেখা যাচ্ছে। ঘাটের দিকে যাওয়ার আগে মন্দাকিনী হোটেলের ম্যানেজার বলছিলেন যে, ওই ড্যামের উপরের রাস্তা পেরিয়েই বাঁদিক দিয়ে নদীর গাবরাবর এলে রাজাজি ন্যাশনাল পার্ক-এর মধ্যে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে অনেকখানি উঠে নীলকণ্ঠদেবের মন্দির। নীলকণ্ঠদেবের মন্দিরে অবশ্য রামকুলার হ্যাঁঙ্গিং ব্রিজ-এ গঙ্গা পেরিয়ে পাকদণ্ডী দিয়েও যাওয়া যায়। তবে চার ঘন্টার পথ। চড়াইও খুব। নির্জন বলে জন্তু-জানোয়ারের ভয়ও আছে।

    ও যে মন্দির দেখতে আসেনি। ও যে এসেছে মনকে শান্ত করতে, নিজের মনের মধ্যে যদি কোনও বিশ্বাসের মন্দির অনাবিষ্কৃত থেকে থাকে, তাকেই আবিষ্কার করতে। কিছু স্বার্থহীন মানুষ, কিছু ধান্ধবিহীন মানুষের সঙ্গে মিশে, সাধারণভাবেই সব মানুষের উপরে যে বিশ্বাস ও প্রায় হারিয়েই ফেলতে বসেছিল, সেই বিশ্বাসকে ফেরাতে পারা যায় কি না, তারই সমীক্ষা করতে বেরিয়েছে যে ও। প্রায় নিরুদ্দেশই হয়ে গেছে বলতে গেলে চারণ। ইচ্ছে করেই থ্রি-টায়ারে এসেছে, নন-এসি। যদি কেউ খোঁজ করতে চায় তবে সকলেই বিভিন্ন এয়ারলাইন্স-এর প্যাসেঞ্জার লিস্ট এবং বিভিন্ন ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস এ সি-র প্যাসেঞ্জার লিস্টই চেক করবে। কারও মাথাতেই আসবে না যে, চারণ নন-এসি থ্রি-টায়ার ট্রেনে করে কোথাও যেতে পারে। দাড়ি-গোঁফও কামায়নি। কালই এই হোটেলটা থেকেও চেক-আউট করতে হবে। এখানেই দু-তিন জোড়া সাদা খদ্দরের পাজামা-পাজামা বানিয়ে নেবে। তা নইলে এই ভীমগিরি নামক সন্ন্যাসীদের মতন মানুষদের সমতলে নামা অথবা ওঠা হবে না।

    কাকে নামা বলে আর কাকে ওঠা বলে, তা কে জানে! চারণ অন্তত জানে না। ওঁদের সমতলে না পৌঁছুতে পারলে….

    হোটেলের তিনতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়ে অনতিদূর দিয়ে অন্ধকারের মধ্যে অতি দ্রুত বয়ে-যাওয়া খরস্রোতা গঙ্গার স্রোতের শব্দ শোনা যাচ্ছে ওপারের গভীর জঙ্গল, কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে অন্ধকারতর দেখাচ্ছে। ওই জঙ্গলও রাজাজি ন্যাশনাল পার্কেরই অন্তর্ভুক্ত? চাঁদ সবে উঠেছে, পুবাকাশে। তখনও ছোট। সেই প্রায়ান্ধকারে নদী আর জঙ্গল আর জঙ্গলের পা থেকে উঠে যাওয়া মেঘের শ্রোণিভারের মতন পর্বতশ্রেণী উঠে গেছে পরতের পর পরত। চারদিকে, এই রাতে, বড় রহস্য। পর্বতে কখনই ওঠেনি চারণ আগে। এখন ওঠার সময়ও নয়। আর কিছুদিনের মধ্যেই কেদারনাথ বদ্রীনাথের মন্দির অগম্য হয়ে যাবে। তাছাড়া মন্দিরে যাওয়ার জন্যে কোনও উগ্র বাসনাও নেই, অগণ্য, অন্ধ-ভক্তি লালন করা অথবা হুজুগে-মাতা ক্যাপসুল-পূণ্য প্রত্যাশী তীর্থযাত্রীদের মতন। তবে ওর জীবনে কোনও কাজই সময়ে করেনি ও। তাই অসময়েই পর্বতে উঠতে কোনও মানা, নেই মনের দিক দিয়ে। তবে উঠলে, ভ্রমণার্থী হিসেবেই উঠবে। মন্দিরে গিজাতে মসজিদে তার কোনওই ঔৎসুক্য নেই। প্যারিসে গিয়েও নত্ৰদামের ভিতরে ঢোকেনি।

    চারণ ভাবছিল যে, তার জীবনে এমন মুক্তি এবং আনন্দও কখনওই আগে বোধ করেনি। জীবিকা থেকে মুক্তি, জীবিকার সমস্তরকম যন্ত্রণা থেকে মুক্তি, মিথ্যা সমাজ, মিথ্যা আত্মীয়তা থেকে মুক্তি, এমনকি নিজেকে অক্টোপাসের মতো বহুবাহু দিয়ে বেঁধে রাখা নিজের বহুরকম নিজস্ব সত্তার আভ্যন্তরীণ বন্ধন থেকেও মুক্তি।

    একজন মানুষের মধ্যে যে একাধিক মানুষ বাস করে, এই কথা মাধুকরী নামের একটি বাংলা উপন্যাসে প্রথমবার পড়ে চারণ চমকে উঠেছিল। কিন্তু কথাটা বিশ্বাস করেনি।

    যে কোনও তত্ত্বই জানা এক কথা আর তা জীবনে প্রয়োগ করা অন্য কথা। অধীত আর ফলিত বিদ্যাতে যেমন তফাৎ হয় আর কী! অধ্যয়ন অনেকই বিষয়ে, অনেকেই করেন কিন্তু সেই অধীত বিদ্যা এবং জ্ঞানকে হৃদয় দিয়ে ছুঁয়ে সেই বিদ্যা এবং জ্ঞানে নিজেকে মঞ্জরিত করে তোলা সম্পূর্ণই অন্য ব্যাপার। ফুলের বাগানে গিয়ে বসে বাগানের শোভা দর্শন করা আর নিজের বুকের মধ্যে সেই ফুল ফোঁটানো যেমন সম্পূর্ণই ভিন্ন ব্যাপার।

    সামনের নদী আর বন আর পাহাড়ের দিকে চেয়ে চারণ ভাবছিল, রাজাজি অভয়ারণ্যে যাবে একবার। সে বন বা বন্যপ্রাণী বিশারদ নয়। হবার কোনও সুযোগ অথবা ঔৎসুক্যও হয়নি। মনের বন ছাড়া অন্য কোনও বনেই ও যায়নি বিশেষ। মনে বিচরণ করলেও, মনের অলিগলির খোঁজ রাখেনি তেমন করে। তাই বনের অলিগলির খোঁজের তো কথাই ওঠে না।

    চারণ নাম ভাঁড়িয়ে উঠেছে এই হোটেলে। ও চোর-ডাকাতও নয় বা সাধু সন্তও নয়। সৌভাগ্যবশত ইদানীংকালের কোনও জননেতা বা চিত্রাভিনেতা বা সাহিত্যিক বা গায়কও নয়। দূরদর্শনের দয়া বা অভিশাপে যাঁদের একে-অন্যের মধ্যে তেমন তফাৎ আর অবশিষ্ট নেই। অন্যভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সাধারণের কাছে তার কোনও পরিচিতিই নেই। অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা যেমন নেই কারওই তার সম্বন্ধে, কোনও উচ্ছ্বাসও নেই।

    বাঁচা গেছে। কলকাতা থেকে পালিয়ে, জীবিকা থেকে পালিয়ে, নিজের মধ্যের এককালীন প্রিয় অধিকাংশ সত্তা থেকে নিজেকে নিষ্ঠুরভাবে ছিনতাই করে নিয়ে আসতে পেরে সত্যিই বড় আনন্দ বোধ করছে চারণ।

    ও ভাবছিল যে, এখানে এসে পৌঁছনো অবধি ও নিজের ভেতরটা ভাবনাতে ভাবনাতে এত ফেনিল করে তুলছে কেন! তারপরই ব্যাখ্যা হিসেবে নিজেই নিজেকে বলল যে, জীবিকা, জীবন, সংসার, এই সমস্তও যে সততই ফেনিল। নিরন্তর ফেনা আর বুদ্বুদেরই স্বগতোক্তি সেখানে। সমুদ্রের নির্জন বেলাভূমির ফেনারই মতন। জীবিকা, জীবন, সংসার, সমাজের আবর্তে দলিত, পিষ্ট, মথিত যে ফেনা, তা থেকে সরে আসার কারণ বা স্বরূপ ঠিকমতো বোঝাতে গেলেও তো তা এক কথাতে বোঝানো যায় না। নিজেকেই বোঝানো যায় না! তার, পরকে।

    এর মধ্যেই এখানে বেশ ঠাণ্ডা পড়ে গেছে। ত্রিবেণী ঘাটে যখন বসে ছিল তখনই সন্ধ্যে নামার সঙ্গে সঙ্গে নদীরেখা ধরে হু-হু করে ঠাণ্ডা হাওয়া বইতে শুরু হয়েছিল। তিনতলার বারান্দাতে দাঁড়িয়েও বেশ ঠাণ্ডা লাগছে।

    হৃষীকেশে পৌঁছেই মনটা যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেছে চারণের। একেই কি স্থানমাহাত্ম্য বলে? নিজেই যেন নিজের আয়না হয়ে গেছে। ও ভাবছিল যে, মানুষ-মানুষীর বাড়িতে প্রতি ঘরে ঘরে যত অসাবাব থাকে সেই তুলনাতে আয়নার সংখ্যা অতি কম। অথচ আয়নার মতন প্রয়োজনীয় আসবাব মানুষ আর অন্য কিছুই আবিষ্কার করেনি। অন্য সব আসবাবেরই বিকল্প অবশ্যই থাকতে পারে, কিন্তু আয়নার কোনও বিকল্প নেই। অন্তত ঘরের মধ্যে নেই। আয়নার সামনে মুখ সংসারী মানুষেরা যখন দাঁড়ায়ও তখনও তারা প্রত্যেকেই তাদের বাহ্যিক রূপটিকেই দেখে। শুধুমাত্র শারীরিক রূপই। চোখের কাজল বা সুমা, কপালের টিপ, গোঁফের বা জুলপির হট, ঠোঁটের লিপস্টিক, দাড়ি কামানো নিখুঁত হল কি না। এই সবই। কিন্তু তাদের মনকে কি দেখে কখনও? মানুষের মন কি দেখা যায় কোনও আয়নাতেই? অবশ্য, দেখতে হয়তো কেউ চায়ও না।

    এখানে আসার পরে এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যেন চারণের বুকের মধ্যে অগণ্য আয়নাগুলো সব নড়েচড়ে বসেছে। আশ্চর্য! এতগুলো বছর যে ওরা কোথায় ছিল।

    .

    ০২.

    অন্ধকার থাকতেই ঘুম ভেঙে গেল।

    যখন নিয়মিত গলফ খেলতে যেত কলকাতার টালিগঞ্জ গলফ ক্লাবে, তখন যেমন ভাঙত।

    গত রাতে কিছুই খায়নি বলে শরীরটা খুবই হালকা লাগছিল।

    রুম-সার্ভিসে চা আর টোস্ট আনতে বলে দিয়ে, ও মুখ ধুয়ে বারান্দাতে এসে দাঁড়াল। পূবের আকাশ তখনও স্পষ্ট হয়নি। হবে, আধঘন্টার মধ্যেই।

    ত্রিবেণী ঘাট যেন ওকে হাতছানি দিচ্ছিল। কী এক অদৃশ্য টান বোধ করছিল ও। যেন কতদিনের পরিচিত এবং প্রিয় জায়গা।

    অনেকগুলি হোল খেলবার পরে টলি-ক্লাবের চারদিক-খোলা খড়ের ঘরে বসে ছুটির দিনে বিয়ার খেতে খেতে আড্ডা মারবার নেশার মতন এক নেশাতে আচ্ছন্ন করেছে যেন তাকে ত্রিবেণী ঘাট। আশ্চর্য কাণ্ড!

    চা আসতেই দুটি টোস্ট দিয়ে চা খেয়ে ও তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়ল।

    কেডস-টেডস বা গলফ শু এসব কিছুই তো আনননি। এ তো আসা নয়, পালানো। পালাবার সময়ে তো সকলেই একবস্ত্রেই বেরিয়ে পড়ে। কাবলি-জুতো পরে তাড়াতাড়ি হাঁটাও যায় না। শালটা গায়ে জড়িয়ে নিল ও। একটা টুপিও কিনতে হবে। এই বয়সেই মাথার চুল পাতলা হয়ে গেছে। বাবারও টাক পড়ে গেছিল পঁয়ত্রিশে। আর সবচেয়ে বেশি ঠাণ্ডা লাগে মাথাতেই। আর পায়েও। অথচ কাবলির সঙ্গে মোজা পরলে পা জুতোর মধ্যে ক্রমাগত পিছলে যেতে থাকে, হাঁটা যায় না। তাই পায়েও ঠাণ্ডা লাগছে। ট্রাউজার না পরাতে হাঁটুতেও শীত করছে।

    ঘাটে পৌঁছে দেখল, সূর্য তখনও ওঠেনি। কিন্তু সেই চাতালে রাত কাটানো সব মানুষই প্রায় উঠে পড়েছেন ততক্ষণে। এক-দুজন অবশ্য তখনও ঘুমুচ্ছেন। বোধহয় রাতে দেরিতে শোওয়ার জন্যে অথবা বেশি গঞ্জিকা সেবনের জন্যে। ভীমগিরিকে দেখতে পেল না এদিক-ওদিক তাকিয়ে। তবে তার গুরুকে দেখল। তিনি যোগাসনে, একেবারে স্থির হয়ে চুপ করে বসে ছিলেন। দুর থেকে দেখে মনে হল তাঁর চারপাশের, পৃথিবী যেন মুছে গেছে তাঁর চোখ থেকে। সব কিছুই নড়ছে। কিন্তু তিনি অনড়।

    গুরুর সঙ্গে তো চারণের আলাপ হয়নি, নামও জানে না। তাছাড়া কোনও দেব, দ্বিজ এবং গুরুতে তার ভক্তি নেই। তাই সে ঘাটের দিকে নেমে চলল সিঁড়ি বেয়ে। কয়েকটি সিঁড়ি নেমেই মস্ত বাঁধানো চাতালে এসে পড়ল। এত বড় চাতাল যে পাঁচ-ছ হাজার মানুষ আঁটে সেখানে একসঙ্গে। সূর্যদেব সবে উঠছেন পূবের আকাশ লাল করে। বহু মানুষ, নারী পুরুষ, তার মধ্যে সাধুসন্ত যেমন আছেন, গৃহী এবং অন্য পেশারও নানা মানুষ আছেন, যেমন দোকানি, হালুইকর ইত্যাদি, মনে হল চারণের। ওই সকালে সূর্যোদয়ের আগেই ওই ঠাণ্ডা জলে কী করে চান করছেন তাঁরা কে জানে! গলার শালটাকে দিয়ে ভাল করে গলা এবং কান ঢেকে সে নদীর আরও কাছে এগিয়ে গেল এবং চাতালের পরের অগণ্য সিঁড়ি ভেঙে নেমে যেতেই যেন মনে হল ভীমগিরিকে দেখতে পেল। এক কোমর জলে দাঁড়িয়ে পুবে চেয়ে আছেন জোড় করে দাঁড়িয়ে।

    আরও এগিয়ে যেতেই সঠিক ভাবে চিনতে পারল তাঁকে। ভীমগিরিও চিনতে পারলেন চারণকে। তবে কথা বললেন না কোনও। উনি সূর্যমন্ত্র স্তব করতে লাগলেন।

    নমো মিত্রায় ভাবনবে মৃতোর্মা পাহি
    প্রাজিষ্ণবে বিশ্বহেতবে নমঃ।
    সূর্যদ্ভবন্তি ভূতানি সুর্যেনপালিতানি তু
    সূর্যে লগং প্রাধুবন্তি যঃ সুর্যঃ সোহহমেব চ।
    চক্ষুণো দেবঃ সবিতা চক্ষুর্ণ উত পর্বতঃ।
    চক্ষুধার্ত দধাতু নঃ।

    স্তব করেই চলতে লাগলেন ভীমগিরি মহারাজ।

    চারণের মনে পড়ে গেল দাদু, মানে ওর মায়ের বাবা এই স্তব করতেন রোজ সূর্যোদয়ের সময়ে। উত্তরপাড়ার মামাবাড়িতে যখনই যেত চারণ ছেলেবেলাতে তখনই দাদু তাঁকে অন্ধকার থাকতে বিছানা ছাড়িয়ে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যেতেন। ওই স্তব উনি শিখিয়েও ছিলেন চারণকে। চারণ যখন ক্লাস এইট-এ পড়ে তখন দাদু সজ্ঞানে মারা যান। কে জানে! মৃত্যুর সময়ে তাঁর মুখেও কোনও ভয়ের চিহ্ন ছিল কি না? না কি, সব সময়ে যে গভীর প্রশান্তি তাঁর মুখমণ্ডলে শোভা পেত সেই প্রশান্তি নিয়েই চলে গেছিলেন তিনি যাবার সময়ে?

    মৃত্যুর সময়ে যে ভয় ফুটে ওঠে অনেক মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে এই কথাটা তত সন্নিসী ভীমগিরির মুখে না শুনলে তার এমন করে খেয়ালও হত না।

    ভীমগিরি দ্বিতীয় শ্লোক শেষ করে তৃতীয় শ্লোকে পৌঁছে গেছিলেন ততক্ষণে। ওই খরস্রোতা জলে ভেসে যাবারই কথা ছিল কিন্তু হালকা-পলকা ভীমগিরি কী করে যে দাঁড়িয়ে ছিলেন কে জানে! তারও বোধহয় কোনও ঐশ্বরিক-ক্রিয়াকাণ্ড থাকবে। চারণ হলে তো নামা মাত্রই ভেসে যেত।

    সূর্যমন্ত্রর মানে, তার দাদুই তাকে শিখিয়েছিলেন। এখন একেবারেই ভুলে গেছে। স্তব তত মনে নেই-ই। অথচ ভীমগিরি আবৃত্তি করাতে স্তবের মানে তো অবশ্যই, মন্ত্রও যেন মনে ফিরে এল।

    দাদু তাঁর সুললিত ভরাট গলাতে আবৃত্তি করতেন। নৌকো বেয়ে যেত মাঝনদী দিয়ে মাঝিরা। লাল টকটকে থালার মতন সূর্যটা উঠত পুবাকাশে। শিশুকালের সেই স্মৃতির সঙ্গে চারণের সমস্ত ছেলেবেলাটাই যেন উঠে এল। উত্তরপাড়ার মামাবাড়িতে স্কুলের ছুটির সময়ে কাটানো দিনগুলি, দিদিমা, মেজমামীমা, ছোটমামীমা, মামাতো ভাইবোনেরা সবাই…। মস্ত মস্ত নিমগাছ আর বেলগাছ দুটোর কথাও, গঙ্গার ধারের বাগানে।

    মামাবাড়ির দ্বারোয়ান রামখেলাওন পাঁড়ে বলত, জানো খোকাবাবু, ওই গাছে ভূত আসে। শিংওয়ালা ভূত। সন্ধের পরে তাই বেলগাছের দিকে আদৌ যেত না ও। পরে জেনেছিল যে, সন্ধের পরে ওই বেলগাছতলাতেই খাঁটিয়া পেতে ভাঙ সেবন করত রামখেলাওন, তাই ওই ভূতের পত্তন!

    মনে পড়ে গেল চারণের সূর্যমন্ত্রের মানে : মিত্রকে নমস্কার, ভানুকে নমস্কার; তুমি আমাকে মৃত্যু থেকে রক্ষা কর মার্কন্ড।

    প্রকাশশীল বিশ্বের কারণকে নমস্কার। জীবগণ সূর্য থেকে উৎপন্ন হয়, সূর্যের দ্বারা পালিত হয়, আবার সূর্যেই ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

    যিনি সূর্য, তিনিই আমি।

    সবিতা তেজস্বরূপ বলেই তিনি আমাদের চোখ। তিনি কালস্বরূপ বলেও আমাদের চোখ।

    সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর আমাদের চোখ দান করুন।

    দাদু ঠিক এই ভাষাতেই বলতেন কিনা মনে নেই কিন্তু মানেটা প্রথম দুটি স্তবের মোটামুটি ওইরকমই ছিল। সন্নিসী ভীমগিরি প্রথম দুটি স্তব উচ্চারণ করতেই চারণ সিঁড়ি বেয়ে উঠে ঘাটের চাতালে এসে দাঁড়াল। এত মানুষ খালি গায়ে এবং মেয়েরা ভেজা শাড়ি জড়িয়ে চান করছেন তাই নিজে শাল চড়িয়ে জুতো পায়ে তাঁদের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে অস্বস্তি লাগছিল। অসভ্যতার চরম হচ্ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো অন্য শ্লোকগুলি এবং মানেও মনে পড়ে যেত।

    চারণ ভাবছিল, সংস্কৃত ভাষাটা, যে-ভাষার সঙ্গে হিন্দুদের যাবতীয় ধর্মকর্ম-বিয়ে এবং শ্রাদ্ধ জড়িত, সে ভাষাটাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে কেমন নষ্ট হয়ে গেল। এক জগাখিচুড়ি সরকারি হিন্দি এবং তারও পরে আরও জগাখিচুড়ি বলিউড এর হিন্দি এসে সব কিছুকেই গ্রাস করে ফেলল। টোল উঠে গেল, উঠে গেল চতুম্পাঠী, সংস্কৃত-চচাও উঠে গেল। শিকড়হীন হয়ে গেল একটি জাতি, একটি ধর্ম। অথচ একজনও তার প্রতিবাদ করল না। আশ্চর্য।

    ভীমগিরি জল থেকে উঠে এসে বলল আপনি চা খান তো?

    খাই।

    ভিজে কাপড়ে ওই কনকনে হাওয়াতে সন্ন্যাসীকে নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চারণের শাল গায়ে দিয়েও যেন শীত করতে লাগল।

    তবে, চলুন, চা খাই গিয়ে।

    ধুতিটা ছাড়বেন না? মানে, বদলাবেন না?

    আর ধুতি থাকলে তবেই না বদলাব? শুকিয়ে যাবে রোদ উঠলেই। রোদ তো উঠেই গেছে। বাহুল্যই আসক্তির জন্ম দেয়। দুটো ধুতি থাকলেই চারটের ইচ্ছে জন্মায়।

    একই ধুতি পরে থাকলে নোংরা হয়ে গন্ধ হয়ে যাবে যে!

    কাল সন্ধের সময়ে তো আমার পাশে অনেকক্ষণ বসেছিলেন। কোনও দুর্গন্ধ কি পেয়েছিলেন?

    না। বরং মিষ্টি মিষ্টি কী এক গন্ধ পেয়েছিলাম। অগুরু-টগুরু মাখেন না কি?

    আমি কিছুই মাখি না। যিনি দেহ দিয়েছেন তিনিই নিজে হাতে মাখিয়ে দেন। অদৃশ্য হাতে।

    চারণ জোরে বলে উঠল, বাজে কথা।

    ভীমগিরিও জোরে হেসে উঠলেন।

    বললেন, আমিও জানি বাজে কথা। কিন্তু বাজে কথাও জোরের সঙ্গে বলতে পারলে কেমন সত্যি কথা বলে মনে হয়। হয় না?

    চারণ বলল, চায়ের পয়সা আমি দেব কিন্তু।

    দেবেন। আপনারাটা আপনি দেবেন। আমাকে দোকানি সকালের এক ভাঁড় চা বিনি পয়সাতেই খাওয়ায়। আমি খেয়ে, গুরুর জন্যে নিয়ে যাব। তাঁরটারও পয়সা নেয় না।

    কেন?

    গুরুর কাছে কত ভক্ত আসে। দিশি বিদেশি। তারা কত কিছু খায় এই সব দোকান থেকে কিনে। জানি না, সে জন্যেও দিতে পারে আবার ভালবেসে বা ভক্তিতেও দিতে পারে। কেউ কোনও ভাল কাজ করলে, বা কোনও দান দিলে সঙ্গে সঙ্গেই সেই ভাল কাজের বা দানের পেছনের উদ্দেশ্য খুঁজতে যাওয়াটা সংসারীদের ধর্ম। আমরা যা পাচ্ছি, তাতেই খুশি। ভগবানের কাছে অশেষ কৃতজ্ঞ। দানকে দানের মহিমামণ্ডিত করেই আমরা দেখি। দাতা কেন দান করলেন সে সম্বন্ধে জল্পনা কল্পনা করতে বসে নিজেদের মনকে আমরা আবিল করি না। মন যদি আবিল হয়, তবে ঈশ্বর-চিন্তা করব কী করে?

    চারণ ছেলেমানুষের মতন বলল, জানেন, কাল রাতে আমি উপোস ছিলাম।

    ভীমগিরি হালুইকরের দোকানের সামনে চায়ের অপেক্ষাতে দাঁড়িয়ে হো হো করে জোরে হেসে উঠলেন।

    চারণের খুব ভাল লাগল হাসিটা। এর আগেও লেগেছিল। একেই বোধহয় বলে প্রাণখোলা হাসি। এমন হাসি আজকাল শোনা যায় না বেশি।

    হাসি থামলে ভীমগিরি বললেন, তাহলে তো হাফ-সন্ন্যাসী হয়েই গেছেন।

    চারণ লজ্জা পেল।

    বলল, আমি তো সন্ন্যাসী হতে আসিনি এখানে।

    কী করতে এসেছেন তা আমি জানি। আমার গুরুও জানেন।

    গুরু? গুরু কি করে জানলেন?

    তা তো বলতে পারব না। কাল রাতে আমি যখন কালিকমলি বাবার আশ্রম থেকে খেয়েদেয়ে নেমে এলাম চাতালে, গুরু আপনার কথা অনেকক্ষণ খুঁটিয়ে জিগ্যেস করলেন আমাকে।

    চারণ আরও অবাক হল।

    বলল, আমার কথা? কেন?

    কেন, তা কী করে বলব! কত মানুষই তো রোজই এখানে আসেন সারা দেশ থেকে, বিদেশ থেকে, আমার সঙ্গে, এখানের অগণ্য সব সন্নিসীদের সঙ্গে কথা বলেন, চাতালে দিনের পর দিন বসে থাকেন, মোটা টাকা খরচ করে ভোগ দেন, কাঙালি ভোজন করান, কম্বল বিতরণ করেন, কত ভারী ভারী শেঠ, দিল্লি বম্বে কলকাতার! কই, গুরু তো তাঁদের সম্বন্ধে কিছুই জিগ্যেস করেন না?

    চারণ বলেন, গুরু কি জিগ্যেস করলেন?

    তা নাই বা শুনলেন। নিজেকে একটু কম ভালবাসাই ভাল। নিজের সম্বন্ধে আমাদের ঔৎসুক্য যত কমবে, আর পরের সম্পর্কে বাড়বে, ততই আমাদের চোখে পৃথিবী সুন্দরতর হবে।

    চারণ লজ্জা পেয়ে চুপ করে গেল।

    কাল রাতের আলো-আঁধারিতে লক্ষ করেনি, আজ সকালের আলোতে দেখল ভীমগিরি মানুষটি অবয়বে অতি সাধারণ, কৃশ, গড়পড়তা ভারতীয়র মতন হলেও তাঁর চোখ দুটি অসাধারণ। একবার করবেট পার্কে একেবারে কাছ থেকে বাঘ দেখেছিল চারণ। বাঘের চোখের মতনই চোখ ভীমগিরির। অথচ ভয় করে না তাকালে। শুধু মনে হয় যে, বুকের ভিতরের সব কিছু অব্যক্ত গোপন কথা বুঝি জেনে নিলেন, কোনও আড়ালই বুঝি আর রইল না।

    ভীমগিরি বললেন, গুরু বললেন, আপনার আধার ভাল।

    আধার মানে?

    আধার মানে জানেন না?

    নাঃ।

    তবে জানবেন। সময়ে জানবেন।

    ও মনে মনে বলল, আমার আঁধার ভাল।

    চারণ, পোড়া মাটির সোঁদা সোঁদা গন্ধ ভরা ভাঁড়ে গরম ধোঁয়া-ওঠা বেশি দুধ আর বেশি চিনি দেওয়া চায়ে চুমুক দিতে দিতে ভাবল, ওরা গুরু-শিষ্যে মিলে বোধহয় তাকে ফাঁসাবার মতলবে আছে। বাঁ হাতের কব্জিতে বাঁধা রোলেক্স ঘড়িটা বোধহয় চিনতে পেরেছে সাতঘাটের জল-খাওয়া গুরু। পাটি যে মালদার তা বুঝেই সম্ভবত এই হরকৎ।

    সন্ন্যাসী চায়ে চুমুক দিয়েই বললেন, যা ভাবছেন, তা নয় চারণবাবু।

    চমকে উঠল চারণ। একটু চা চমকে গেল, পড়ল পায়ের কাছে। বলল, কী ভাবছি?

    যা ভাবছেন।

    আমার গুরু, আপনার আধারকে যতখানি ভাল বলে মনে করেছেন, ততখানি ভাল বোধহয় নয় এ আধার।

    চা খাওয়া শেষ করেই ভীমগিরি বললেন, চলি। পরে দেখা হবে।

    কোথায় চললেন?

    তার গলার স্বরে এমন ভাব ফুটে উঠল যে, চারণের নিজের কানেই তা শোনাল অসহায়তার মতন। যেন, এই ভীমগিরি সন্নিসীর ভরসাতেই ও হৃষীকেশে এসেছিল।

    নিজেকে বকল, মনে মনে।

    তা জেনে কি লাভ? সন্ন্যাসীরা কোথা থেকে আসেন আর কোথায় যান তা জানতে চাইতে নেই। যদি পারেন এবং মন করে, তবে সন্ধেবেলাতে আসবেন। থাকব আমি ঘাটে।

    চারণের সকালটা যেন হঠাই ফাঁকা হয়ে গেল। রোদটা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। একদিনের মধ্যেই এই ভীমগিরি সমাসীর উপরে যেন ও বড় বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

    খারাপ। খুবই খারাপ।

    বকল আবারও নিজেকে।

    ভীমগিরি বললেন, কেউ কারও নয় এ সংসারে চারণবাবু। আমিও আপনার নই, আপনিও আমার নন। যান না কুঞ্জাপুরী থেকে ঘুরে আসুন।

    কুজাপুরী। সেটা কোথায়?

    গাড়োয়ালের রাজধানী ছিল নরেন্দ্রনগরে। সেই নরেন্দ্রনগর হয়ে যেতে হয়। বাসে গেলে কুঞ্জপুরীর পায়ের কাছে নেমে, হেঁটে উঠতে পারেন উঁচু পাহাড়ে। তবে অনেক চড়াই। তারপর আবার মন্দিরে উঠতে প্রায় তিনশ সিঁড়ি চড়তে হবে।

    প্রায় তিনশ? বলেন কি?

    হাঁ। কষ্ট না করলে কি সুন্দরের দেখা মেলে? যা কিছুই সুন্দর? তবে আপনার পক্ষে গাড়িতে যাওয়াই সুবিধে হবে। খুব ভাল লাগবে। খুব কম মানুষই জানেন কুঞ্জাপুরীর কথা অথবা যান কুঞ্জাপুরীতে। হয়তো কষ্টের জন্যেই যান না। একেবারে ভিড় নেই। মন প্রসন্ন হয়ে যাবে। যান, ঘুরে আসুন।

    বলেই সন্ন্যাসী তাঁর গুরুর জন্যে এক ভাঁড় চা নিয়ে চলে গেলেন।

    কিছুক্ষণ বোবার মতন দাঁড়িয়ে থেকে চারণ হৃষীকেশের বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে চলল।

    দোকানপাট এখনও খোলেনি সব। শুধু হালুইকরের দোকান আর ফুল ধূপকাঠির দোকানগুলি খুলেছে।

    বড় রাস্তায় পড়ে চারণ ঠিক করল যে আজ কুঞ্জাপুরী না কোন জায়গার কথা বললেন ভীমগিরি, সেখানে যাবে না। তা ছাড়া, মন্দির-টন্দিরে তার কোনও ইন্টারেস্টও নেই। দেখা যাবে পরে। তা ছাড়া, গাড়িতে যেতে হলেও হোটেলে ফিরে গিয়ে কোনও ট্রান্সপোর্ট কোম্পানির গাড়ি ভাড়া করতে হবে। নইলে গলা কাটবে। হিন্দুদের সব ধর্মস্থানেই নিলোভ সাধুসন্ত যেমন থাকেন, ভেক ধরা সাধুও থাকেন অনেক। আর থাকে তীর্থযাত্রীদের, পুণ্য-প্রত্যাশীদের গলা কাটার জন্যে ছুরি-শানিয়ে বসে-থাকা বিভিন্ন ধরনের বানিয়ারাও। আনজান-গাড়ি ভাড়া করলে তারা এখানকার সব ব্যাপার সম্বন্ধেই-অজ্ঞ চারণের গলা কাটবেই। ও যখন পুণ্য-প্রত্যাশী নয়, তখন তাড়াটাই বা কিসের।

    বড় রাস্তাতে পড়ে ভাবল, যে পথ দিয়ে কাতারে কাতারে বাস ও গাড়ি চলেছে কেদারনাথ বীনাথের পথে সেই পথে কিছুটা হেঁটে এগোয়। জায়গাটাকে পায়ে হেঁটে ঘুরেফিরে না দেখলে হবে না। পায়ে হেঁটে ঘোরাটা খুবই জরুরি যে-কোনও জায়গাতেই। পায়ে হেঁটে না ঘুরলে, যাকে বলে, To have a feel of the place তা কখনওই হয় না।

    এক কিমি মতে এগিয়েই লক্ষ করল বাঁদিকে একটা সরু পথ বেরিয়ে গেছে এবং সেই পথের মোড়ে বেশ বড় একটা জটলা। তাতে সন্ন্যাসীর পোশাকে অনেকে আছেন আবার সাধারণ পোশাকেও অনেকে। কিন্তু একজনও মহিলা দেখল না সেই জটলাতে। সমবেত জনমণ্ডলীর কারও মুখে কোনও কথাও নেই কিন্তু সকলেই বাঁদিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছেন গভীর মনোযোগের সঙ্গে।

    হাঁটতে হাঁটতে সেখানে পৌঁছে চারণও দাঁড়িয়ে পড়ল। দেখল, বাঁদিকের গলির মোড়ে একটি পাঁচিলঘেরা বাড়ি। দেওয়ালে উত্তরপ্রদেশ সরকারের অ্যানিম্যাল হাজব্যাভারি দপ্তরের বোর্ড টাঙানো। দপ্তরটা একতলা। তার সামনে অনেকখানি ভোলা চত্বর। সেটি দেখা যাচ্ছে, মস্ত বড় এবং গরাদওয়ালা লোহার ফটকের মধ্যে দিয়ে। সেই চত্বরের মধ্যে একটি জবরদস্ত ষাঁড়কে দিয়ে গরুদের রমণ করানো হচ্ছে এবং এই ধর্মস্থানের বিভিন্ন বয়সী অগণ্য পুরুষ সাতসকালে পরম আগ্রহ নিয়ে আগাপাশতলা আহ্বাদের সঙ্গে সেই প্রক্রিয়া দেখছেন। সমবেত পুরুষদের প্রত্যেকেরই চোখ-মুখেই যেরকম গভীর পরিতৃপ্তি ফুটে উঠেছে, বারংবার অমিত গরুটির চোখেও বোধহয় ততখানি তৃপ্তি ফুটে ওঠেনি।

    হাসি পেল চারণের।

    মীর বলেছিলেন, এখানে মানুষের চেহারার জীব অনেকই আছে, কিন্তু মানুষ অত্যন্ত কম। হিয়া সুর-এ আদম বহত হ্যায়, আদম্ নেহি হ্যায়।

    চারণের মনে হল, মানুষের মতন চেহারার মধ্যে জানোয়ারের সংখ্যা খুবই বেশি। মানুষের মনুষ্যত্বে পৌঁছনোর পথে জানোয়ার পথ আগলে আছে। এবং হয়তো থাকবে আরও বহুকাল।

    ব্যাপারটা হাসিরই।

    বৈরাগ্যর জায়গাতে এত অতৃপ্তি, এত খিদে? ষাঁড়ের রমণসুখেই এত আনন্দ! এ যেন ভক্তিরসেও হবার নয়। ভোগের নিবৃত্তি না হলে যে সন্ন্যাসী হওয়া যায় না এ কথা বহু মানুষের কাছে শুনেছে ও পড়েছে চারণ। হওয়া যে যায় না, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ পেল এইমাত্র। উত্তরপ্রদেশ সরকারকেও বাহাদুরি দিতে হয়। লোহার গেটটা তো চট বা কোনও ধরনের চাটাই বা অন্য কিছু দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেত! পুরো জায়গাটাই দেওয়াল তোলা কিন্তু প্রকাণ্ড ফটকেই কোনও আড়াল নেই।

    বহুদিন হল হাঁটাচলার অভ্যেস চলে গেছে। তাও পায়ে আবার কাবলি জুতো। কষ্ট হচ্ছে চলতে। আরও অনেকটা গিয়ে যেখানে পথটা পাহাড়ে উঠতে শুরু করেছে সেখানে একটি ছোট্ট চায়ের দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চে ও বসে পড়ল।

    নিজে একেবারে স্থির এবং গতিরহিত হয়ে সামনে দিয়ে চলমান, বহমান জনস্রোতের দিকে চেয়ে থাকতে ভারী ভাল লাগে। Introspection এর জন্য যে নির্জনেই যেতে হবে এমন মানে নেই। প্রচণ্ড কলরোলের মধ্যে, অগণ্য মানুষের মধ্যে থেকেও নিজের অন্তরে নির্জনতা নিয়ে আসাও সম্ভবত ভগীরথের গঙ্গা আনার মতনই কঠিন কাজ। চারণ পারে না তা করতে কিন্তু শিশুকাল থেকেই চেষ্টা করে। এই চেষ্টা করার মধ্যে দিয়েও বুঝতে পারে, পারত সব সময়েই যে, আর দশ জন মানুষের সঙ্গে তার তফাত আছে।

    ভাবছিল ও, তেমনটিই তো হবার কথা ছিল। শরীরে এবং মননে সব জন্তুই একরকম। শুধু মানুষই আলাদা। প্রত্যেক মানুষই। এইটেই তো একমাত্র অহংকার হওয়া উচিত প্রত্যেক মানুষেরই। তার স্বাতন্ত্র্যর অহংকার।

    দোকানঘর ঠিক নয়। একটি খুপরি মতন। কেটলিতে দুধ সেদ্ধ হচ্ছে। বয়ামে কিছু সস্তা বিস্কিট ও সন্দেশ। বিড়ি, সিগারেট, দেশলাই। এক গাড়োয়ালি বুড়ো দোকানি। মূল পথ থেকে দোকানটির সামনে দিয়ে ডানদিকে, একটি কাঁচা পথ চলে গেছে নদীর দিকে। বাঁদিক থেকে একটা চওড়া জলহীন নদী এসে মিশেছে গঙ্গাতে। কিছুক্ষণ পর পরই যাত্রীবোঝাই এক-একটি বাস ডানদিকে চলে যাচ্ছে এ পথ বেয়ে নদীর দিকে। এখানে ঘাট নেই কিন্তু নদীর গভীরতা কম। আর বিস্তৃতি বেশি। পুরুষ ও মহিলা যাত্রীরা বাস থেকে নেমে চান সেরে নিচ্ছেন। বাসের পাশেই Instant ঘাট। অধিকাংশ বাসই দেখল, বাঙালিতে বোঝাই। বাঙালিকে ঘরকুনো যাঁরা বলেন তাঁরা কোনও খোঁজই রাখেন না।

    কোনও কোনও বাস কোনও ভ্রমণ সংস্থার। কোনও বাস বা উত্তরপাড়া, বালি, শ্রীরামপুর, রানাঘাট, কৃষ্ণনগর, বর্ধমান ইত্যাদি জায়গার কোনও ক্লাবের যাত্রীদের নিয়ে এসেছে। কোনও বাসে বা একটি বৃহৎ পরিবারের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব। যৌথ পরিবারের চলমান বিজ্ঞাপন। বাসের গায়ে রঙিন সিষ্কের ব্যানারে ক্লাবের নাম লেখা। অধিকাংশই যাচ্ছে কেদারবদ্রী।

    ইংরেজিতে যাকে বলে Cooling off ones heels তাই করছিল চারণ, বেঞ্চে বসে বসে দোকানির সঙ্গে গল্প করতে করতে।

    তার কাছ থেকে এক প্যাকেট বিড়ি দেশলাই কিনে নিতেই সে দোকানির খদ্দের হয়ে গেল। সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে গেল তৎক্ষণাৎ। সে আর অনাহুত রইল না। তারপর চা-ও চাইল এক কাপ। দেশলাই জেলে বিড়ি ফুঁকতে যুঁকতে তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিল।

    কথায় বলে, নাই কাজ তো খই ভাজ, চারণ বলল নিজেকে, নাই কাজ তো বিড়ি ফোঁক। বিড়ি ফুঁকতে যুঁকতে ভীমগিরির কথা মনে হল ওর। চার বাণ্ডিল বিড়ি নিয়ে নিল সন্ন্যাসীর জন্য।

    সেই দোকানে বসে বেশ অনেকক্ষণ সময় কেটে গেল। চারণ লক্ষ্য করল যে অটোগুলোকে এই সমতলের শেষ অবধিই আসতে দেওয়া হয়, পাহাড়ে চড়তে দেওয়া হয় না।

    এই হৃষীকেশে, হয়তো এই সমুদয় অঞ্চলেই যেখানেই সমতল, সেখানেই এই অটোরাই অশান্তির বাহন। যেমন এদের বিকট আওয়াজ, তেমনই কালো ধোঁয়ার ছিরি! সমস্ত পরিবেশ এরা সব চেয়ে বেশি দূষিতও করে। অবশ্য পেট্রলের ধোঁয়াই সব চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক। কিন্তু যেহেতু চোখে দেখা যায় না সেই হেতু তারা কারওই তাৎক্ষণিক বিরক্তি উৎপাদন করে না।

    দোকান ছেড়ে এসে চলতে লাগল ওই পথ ধরে উপরের দিকে। ডানদিকে অনেক পেছনে পড়ে রইল গঙ্গার উপরে লছমনঝুলা এবং রামঝুলা। পথের এই জায়গাটুকুতে পায়ে চলাও খুব বিপজ্জনক। কারণ, রাস্তা খুবই সরু এবং দুপাশ দিয়ে অতি দ্রুতগতিতে নানারকম যানবাহন যাতায়াত করে। যে-কোনও মুহূর্তেই গাড়ি-চাপা পড়া এখানে মোটেই আশ্চর্য নয়।

    তবে, সেই সরু পথ, বেশি দূর অবধি সরু নয়। আরও বেশ কিছুটা ওঠার পরেই রাস্তা ধীরে ধীরে চওড়া হয়ে এল এবং বাঁদিকে একটি পথ বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গিয়ে দেরাদুনের রাস্তাতে গিয়ে মিশেছে। এখানের পথের ম্যাপে দেখেছিল চারণ যে, দেরাদুনের পথে দইঅলা নামে একটি জায়গা পড়ে। পথটি ভারী সুন্দর। সে পথেও অনেক আশ্ৰম আছে এবং দু-একটি হোটেলও আছে।

    চলতে চলতে আধ ঘণ্টার মধ্যে চারণ যেন অন্য এক জগতে পৌঁছে গেল। বাঁদিকে খাড়া পাহাড়ের গা, তার উপরে বাড়িঘর, ফুলের বাগান, টেরাসিংকরা ক্ষেত, তাতে ফসল লেগেছে। আর ডানদিকে খাদ নেমে গেছে খাড়া। সেই খাদ দিয়ে তীব্র বেগে উপলখণ্ড ঘূর্ণন-চূর্ণন করে জলকণা উৎসারিত করে গঙ্গা বয়ে চলেছে হৃষীকেশ-হরিদ্বার হয়ে। আরও অনেক নীচে নেমে গেলে চুনার, বিন্ধ্যাচল, একপাশে এলাহাবাদ অন্য পাশে কাশী তারও পর অনেক জনপদ পেরিয়ে সেই ডায়মন্ডহারবারে গিয়ে মিশেছে সমুদ্রের সঙ্গে। মোহানাতে। অবশ্য তারও আগে পথে তার সঙ্গে আরও অনেকই নদীর ভাব হয়েছে, মিলন হয়েছে, ঝগড়া হয়েছে।

    যে-কোনও নদী যখন সমুদ্রে পড়ে, তখন আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তার অস্তিত্ব বুঝি লীন হয়ে গেল। নদীর সাগরে লীন হওয়ার প্রসঙ্গে চারণের রবীন্দ্রনাথের কিছু কথা মনে পড়ে গেল। নদী যেখানে থামে সেখানে একটি সমুদ্র আছে বলেই থামে। তাই থেমে, তার কোনও ক্ষতি নেই। বস্তুত এ কেবল একদিক দিয়ে থামা, অন্যদিক থেকে থামা নয়। মানুষের জীবনের মধ্যেও এইরকম অনেক থামা আছে। …কোনও একটা জায়গায় যে পূর্ণতা আছে, এ কথা মানুষ যখন অস্বীকার করে তখন চলাটাকেই একমাত্র গৌরবের জিনিস বলে মনে করে। ভোগ বা দান যে জানে না, সঞ্চয়কেই সে একান্ত করে জানে।

    জীবনকে যারা এইরকম কৃপণের মতন দেখে, তারা কোথাও কোনও মতেই থামতে চায় না, তারা কেবলই বলে, চলো চলো চলো। থামার দ্বারা তাদের চলা সম্পূর্ণ ও গম্ভীর হয়ে ওঠে না; তারা চাবুক এবং লাগামকেই স্বীকার করে, বৃহৎ এবং সুন্দর শেষকে তারা মানে না।…

    আমাদের দেশ অবসানকে স্বীকার করে, এই জন্য তার মধ্যে অগৌরব দেখতে পায় না। এই জন্য ত্যাগ করা তার পক্ষে ভঙ্গ দেওয়া নয়। কেন না সেই ত্যাগ বলতে তো রিক্ততা বোঝায় না। পাকা ফলের ডাল ছেড়ে মাটিতে পড়াকে তো ব্যর্থতা বলতে পারি না। মাটিতে তার চেষ্টার আকার এবং ক্ষেত্র পরিবর্তিত হয়। সেখানে সে নিশ্চেষ্টতার মধ্যে পলায়ন করে না। সেখানে বৃহত্তর জন্মের উদ্যোগপর্ব, সেখানে অজ্ঞাতবাসের পালা। সেখানে বাহির হতে ভিতরে প্রবেশ।

    নিজেই অবাক হয়ে গেল চারণ এতখানি গদ্য নির্ভুল ভাবে মনে রেখেছে বলে!

    সত্যি! কত বছর পরে। যেন কমপুটারের চাবি টিপল আর শব্দমঞ্জরী ফুটে উঠল চোখের সামনে। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মতন।

    ভাবছিল। দাদু আরও কিছু দিন বেঁচে থাকলে আরও কত কী জানতে পারত, শিখতে পারত তাঁর কাছ থেকে! একদিকে যেমন সূর্যন্ত শেখাতেন অন্যদিকে তেমনই শেখাতেন আরও কত কিছু। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন প্রবন্ধমালা তাঁর মাথার কাছে থাকত, গীতা এবং বাইবেল-এর সঙ্গে। মাঝে মাঝেই দাদু বলতেন : রবীন্দ্রনাথ ভাল করে না পড়লে, তোর বাঙালিয়ানা এবং হয়তো ভারতীয়ত্বও সম্পূর্ণতা পাবে না। বুঝেছিস। ভাল করে পড়বি।

    কিন্তু তেমন করে পড়া আর হল কোথায়!

    ইতিমধ্যেই ও বেশ হাঁফিয়ে পড়েছিল। খাড়া চড়াই। পথের পাশে ডানদিকে একটি বড় গাছতলার নীচের মত পাথরের উপরে বসে সে নদীর দিকে চেয়ে রইল। যেন সেই প্রথমবার বুঝতে পারল ও, কেন সারা ভারতের অগণ্য মননশীল মানুষ, মুক্তিকামী মানুষ, নির্জনতাপ্রিয় মানুষ এই সব অঞ্চলে এসে থিতু হয়ে যান। পুরো জীবন কাটান। এত শান্তি, এত নিস্তব্ধতা, প্রকৃতির এমন ভয়াবহ অথচ গভীর সৌন্দর্যময় রূপ, Introspection এর এইরকম স্থান হয়তো সত্যিই কম আছে।

    আজ সকালের সুন্দর হু-হু করা ঠাণ্ডা নিষ্কলুষ হাওয়ায় দাঁড়িয়ে দুনাকে জোরে প্রশ্বাস নিয়ে চারণের মনে হল যেন কলকাতা শহরবাসী তার, বুকের সমস্ত কলুষই শুধু নয়, তার মনেও যে সব অদৃশ্য সব কলুষ ছিল, সে সব কলুষও যেন দূরীভূত হয়ে তার সমস্ত শরীর মনকে পুণ্য করল।

    চারণ অনেকক্ষণ সেই পাথরে বসে নীচে গভীর খাদের মধ্যে দিয়ে বয়ে-যাওয়া নদী, ওপারের খাড়া পাহাড়ের দিকে মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। ও পাশের পর্বতের গায়ে বিশেষ গাছপালা দেখল না। তবে একেবারে রুক্ষ্ম নয়। সবুজাভা আছে। তৃণগুল্ম আছে বহুরকম। তবে বড় গাছ নেই বিশেষ। খাড়া নেমেছে পর্বত। কতখানি খাড়া তা নিজের চোখে না দেখলে উপলব্ধি করা অসম্ভব। পর্বতের পর পর্বত, গায়ে গায়ে লেগে মৌন ঊর্ধ্ববাহু সন্নিসীদের মতন দাঁড়িয়ে আছে কতকাল ধরে। ভাবলেও শিহরণ জাগে মনে।

    এদিকে গাছপালা আছে ওদিকে কেন নেই ভেবে পেল না। অবশ্য খাদ এমনই খাড়া নেমেছে যে, গাছপালারও পা রাখার জায়গা নেই। নদীর দিকে চেয়ে ছিল চারণ, হু-হু হাওয়ার মধ্যে বসে, এমন সময়ে অল্পবয়সী একটি স্থানীয় ছেলে উপর থেকে নেমে এল নিজের মনে গান গাইতে গাইতে। তার বাঁ হাতে একটা দড়ি। দড়ির অপর প্রান্ত একটা ধবধবে সাদা ছাগলের গলাতে বাঁধা। আর ডান হাতে একটা হ্যাজাক। ছেলেটি চারণকে সেখানে কবির মতন বসে থাকতে দেখে হেসে বলল, কী বাবু, আত্মহত্যা করবে না কি?

    সেই আচমকা করা উদ্ভট প্রশ্নে চমকে উঠল ও। তারপরই হেসে ফেলে বলল, কেন? আমাদের কলকাতাতে কি বহুতল বাড়ি কম আছে? নাকি সেখানে গঙ্গা নেই? আত্মহত্যা করতে সেখান থেকে এত পয়সা খরচ করে কেউ কি হৃষীকেশে আসে?

    তা জানি না। তবে যদি কখনও আত্মহত্যা করতে মন চায় তো আমাকে বোলো, এর চেয়ে আরও ভাল জায়গাতে নিয়ে যাব। আরও উঁচু জায়গাতে। দেবপ্রয়াগে গেছ?

    না।

    তারপর হেসে বলল, সুক্রিয়াৎ।

    তারপর বলল, তুমি তো বেশ রসিক দেখছি।

    তোমার নাম কি?

    বুদ্ধু  সিং।

    তোমার মা বাবার কি আঙ্কেল বলে কিছুই নেই? এমন বুদ্ধিমানের নাম যুদ্ধ?

    বুদ্ধু  সিং হেসে বলল, তোমার চেয়ে তাঁদের আক্কেল বেশিই আছে। আমার দাদার নাম রেখেছিল মা-বাবা বুদ্ধিরাম। সে ফৌজ-এ নাম লেখাবার বাহানা করে দেরাদুনে গিয়ে একটা মুসলমান মেয়েকে বিয়ে করে মাটন-রোল-এর দোকান দিয়ে মোটা কামাচ্ছে। মোটরবাইক কিনেছে। আর বুড়ো মা বাবা ক্ষেতি করে মরছে। এ দুনিয়াতে বুদ্ধি যারই আছে সেই নিজের ফায়দা ওঠাতে সেই বুদ্ধিকে কাজে লাগায়। তাই মা-বাবা বলেন, বুদ্ধিরাম আমাদের হাঁদা বানিয়েছে, আমাদের বুদুই ভাল।

    তুমি চললে কোথায়?

    কোথায় আবার? হৃষীকেশে।

    বুদ্ধু সিং বলল।

    কেন?

    আলোটা খারাপ হয়ে গেছে। মেরামত করতে হবে। আর বকরীটার গতি করতে হবে।

    কি গতি?

    সদগতি।

    এখানে তো কেউ মাংস খায় না।

    চারণ বলল।

    বুদ্ধু সিং বলল, তোমরা বুঝি ছাগলের মাংস খাও? নাম আমার বুদ্ধু আর তোমার কাম  বুদ্ধু ।

    তারপর বলল, দেখছ না, ওর পেট ফুলেছে। বিয়োবে ও। আমার মাসী ওকে চেয়েছে, মানে, ওর বাচ্চাদের। তাই বাচ্চাদের অগলা-পত্তা যেখানে হবে, সেখানেই তাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। বাচ্চাগুলো একটু বড় হলে ওকে আবার নিয়ে আসব ফেরত।

    ছেলেটাকে ভারী ভাল লেগে গেল চারণের। বলল, থাকো কোথায় তুমি বুদ্ধু সিং?

    ওই তো।

    বলেই, বুদ্ধু সিং ঘুরে দাঁড়িয়ে হ্যাজাক শুন্ধু ডান হাতটা উপরের দিকে তুলে দেখাল।

    চারণ দেখল, সত্যিই তো! ওই খাড়া পাহাড়ের গায়ে গায়ে খাঁজ কেটে ক্ষেত, উঠোন, ঘর, সবই করা হয়েছে। ফুলকপি লাগানো হয়েছে। তার পাতা ছেড়েছে কচি কলাপাতা সবুজের মধ্যে একটু সাদাটে সাদাটে রং-এর। লাল আর হলুদ ঘাগরা পরে একজন বয়স্কা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোমরের উপরে দুহাত রেখে।

    বুদ্ধু সিং বলল, ওই দেখো। আমার পেয়ারী।

    তোমার পেয়ারী?

    জী বাবু। আমার মা। মা ছাড়া  বুদ্ধু সিং-এর সঙ্গে আর কে পেয়ার করবে বল? পেয়ার দুলহার যাই বল, সবই মা।

    আর বাবা?

    সে পেছনের উঠোনে বসে হুঁকো খাচ্ছে বাঁ পায়ের উপরে ডান পা তুলে মাথাতে টুপি চড়িয়ে, খাঁটিয়াতে বসে। বাবা আমার বড় কুঁড়ে। সবই করে মা।

    হবে না কেন? বুদ্ধু সিং-এর মতো ভাল ছেলে যার আছে, সে কাজ করতে যাবে কোন দুঃখে।

    বুদ্ধু সিং হাসল। এক মুখ। খুশি হল খুব।

    চারণ ভাবল, কত সহজে খুশি হল বুদ্ধু সিং।

    চারণ শিলাসন থেকে উঠে পড়ে তার সঙ্গে নীচে নেমে চলল কথা বলতে বলতে।

    পথের দুপাশে ঘন একরকমের ঝোঁপ, তাতে বিভিন্ন রঙা ফুল ফুটেছে। কমলা, নীলচে, বেগুনি, লাল, গাঢ় লাল, নীল এমনকি সাদাও।

    চারণ জিজ্ঞেস করল, এই ফুলগুলোর নাম কি?

    বুদ্ধু সিং বলল, লালটায়েন।

    চারণের মনে হল, এইগুলোই ল্যানটানা। যে সব ঝোঁপের বর্ণনা সে জিম করবেটের বিভিন্ন লেখায় পড়েছে। জিম করবেট তো এই গাড়োয়াল এবং কুমায়ু হিমালয়েই তাঁর কুখ্যাত মানুষখেকো বাঘ এবং চিতা শিকারের বিখ্যাত সব কাহিনী লিখে গেছেন।

    ভাবছিল, এই পথেই তো যেতে হয় রুদ্রপ্রয়াগ। রুদ্রপ্রয়াগের কুখ্যাত মানুষখেকো চিতাবাঘের কাহিনী চারণ স্কুলে থাকতেই পড়েছিল। এখনও পড়ে মাঝে মাঝে, রাতে ঘুম না এলে। সে কথা মনে হতেই আরও অনেক ছবি চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল এবং ওর খুব ভাল লাগল এ কথা ভেবে যে, সেই সব অঞ্চলেই সে পা রেখেছে। এ তো আর তীর্থযাত্রা নয়। সে কোনও মন্দিরে ঢোকেনি কোনও দিনও। ঢুকবেও না হয়তো। কিন্তু এই পথই তার তীর্থ। দেশের মানুষই তার কাছে মন্দিরের মতো। তাদের প্রত্যেকের কাছেই কত কি জানার আছে, শেখার আছে।

    বুদ্ধু  সিং যেন কেমন ঝাঁকি দিয়ে দিয়ে উতরাই নামছিল বড় বড় পা ফেলে। তার সঙ্গে তাল রাখা দুষ্কর হচ্ছিল চারণের।

    চারণ বলল, এমন করে হাঁটছ কেন?

    কেন? উতরাই তো এমন করেই নামতে হয়। কথাতেই বলে, চড়াইমে বুঢ়ঢ়া ঔর উতরাইমে জওয়ান।

    কি বললে?

    চারণ উৎসুক গলাতে আবার জিগ্যেস করল।

    বুদ্ধু সিং বলল, চড়াইমে বুঢ়ঢ়া ঔর উতরাইমে জওয়ান।

    বাঃ।

    স্বগতোক্তি করল ও।

    বুদ্ধু সিং-এর সঙ্গে গল্প করতে করতে চারণ নেমে এল সমতলে। যেখান থেকে সেই কাঁচা রাস্তাটা বাঁদিকে চলে গেছে নদী অবধি। এবং সেই অবধি গিয়েই তার পায়ে যথেষ্ট ব্যথা বোধ করতে লাগল। চড়াই উতরাই এবং প্রায় সাত-আট কিলোমিটার, হোটেল থেকে বেরোনোর পর হাঁটাহাঁটি হয়েছে কম করেও। রামঝুলা, লছমনবুলা সব পেরিয়েই তো এসেছে। বুদ্ধু সিং-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অপেক্ষমাণ একটি অটোতে উঠে বসল হোটেলের দিকে যাবে বলে।

    বুদ্ধু সিং বলল, ফির মিলেঙ্গে।

    কৈসে। আঃ হাঃ। কঁহা?

    আপ ঘঁহা বৈঠেতে পাথল পর, হুঁয়া বৈঠকে  বুদ্ধু সিং কো নাম লেকর পুকারিয়েগা, ম্যায় তুরন্ত উতারকে আয়েগা। খ্যয়ের, আপ রাজি হ্যায় তো আপকো হামারা ঘরমেভি লেতে যাউঙ্গা।

    তুমি কি সকলের সঙ্গেই এমন ব্যবহার কর না কি? সব তীর্থযাত্রীর সঙ্গেই?

    অবাক হয়ে বলল চারণ।

    না, না, তীর্থযাত্রীদের সঙ্গে কখনওই করি না। তাঁদের সময় কোথায় দুদণ্ড বসবার? দেখবার? তাঁরা তো সাতদিনে সব তীর্থ শেষ করে কলকাতাতে ফিরে গিয়ে রিস্তেদারদের আর দোস্তদের বলেন গাড়োয়াল দেখে এলাম! আহাকী অপূর্ব। আপনি যে তীর্থযাত্রী নন, যদিও বাঙালি, তা আপনাকে দেখেই বুঝেছিলাম।

    চারণ হেসে বলল, আসব  বুদ্ধু সিং। আবার আসব দু-এক দিনের মধ্যে। কী নিয়ে আসব বল তোমার জন্যে?

    আমার জন্যে?

    হ্যাঁ।

    পেয়ার, ব্রিফ পেয়ার।

    চারণ মনে মনে বলল, আমিও তীর্থযাত্রী বুদ্ধু সিং। তবে আমার গন্তব্য অন্য। যে তীর্থ সকলের বুকেরই মধ্যে থাকে অথচ যা বহু দূরে এবং অদৃশ্য এবং যেখানে পৌঁছনোর পথ খুবই দুর্গম।

    অটোটা ছেড়ে দিল।

    বুদ্ধু সিং আবার হ্যাজাক-ধরা ডান হাতটা তুলে হাত নাড়ল।

    সকাল থেকে যে সব ঘটনা ঘটল বা যেখানে যেখানে গেল তার বিবরণটুকু দিতে হয়তো সময় বেশি লাগল না, কিন্তু যেতে যেতে দেখল যে তার ঘড়িতে এগারোটা বেজে গেছে।

    হোটেলে ফিরে একটু বিশ্রাম করল।

    অনভ্যস্ত পা দুটো টনটন করছে। ঠিক করল, বিকেলে বেরিয়েই প্রথমে একটা নরম কেডস কিনতে হবে, আর একটা লাঠি। শিশুকাল থেকেই ও হেঁটে বেড়ানোর সময়ে হাতে একটা লাঠি রাখতে ভালবাসত। উত্তরপাড়ায় মামাবাড়িতে যাওয়ামাত্রই দাদু তাকে নিজে হাতে একটি লাঠি বানিয়ে দিতেন উচ্চতা অনুযায়ী। যখন পাঁচ বছরের শিশু, তখন সে লাঠির উচ্চতা একরকম ছিল, যখন সে তেরো বছরের কিশোর তখন তার উচ্চতা অন্যরকম। লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে চারণ যেন পৃথিবী শাসন করত মনে মনে। কত কী ভাবত, হাওয়ায় লাঠি দিয়ে আঘাত করত, বামে ডাইনে, পিছন পানে। আর তার মনের মধ্যে কত কিছু গড়ে উঠত। কত দুর্গ, কত প্রাসাদ, কত প্রাকার, কত গম্বুজ আবার পরক্ষণেই তার নিজেরই লাঠির ঘায়ে সে সব ছত্রখান হয়ে যেত।

    সাম্প্রতিক অতীত থেকে বড় বেশি পুরনো কথা মনে আসছে চারণের। ও কি বুড়ো হয়ে যাচ্ছে?

    বেশ কিছুক্ষণ বিশ্রামের পরে, ভাল করে গরম জলে স্নান করে রুম-সার্ভিসে খাবার অর্ডার করল।

    এখানে এসে অবধি একটা জিনিস দেখছে যে, এখানে কোনও আমিষ খাবারের চল নেই। সকলেই নিরামিষ খায়। সব দোকানেই নিরামিষ, সব হোটেলেই নিরামিষ। তবে, এটাও ঠিক যে, শুনেছে যে হরিদ্বার থেকে হৃষীকেশের পথপাশে ডানদিকে একটি দোকান আছে নাকি যার সামনে দুটি খোঁটার উপরে পেরেক দিয়ে সাঁটা টিনের ছোট্ট হোর্ডিং-এ লম্বকর্ণর ছবি আছে বাইরে। আর লেখা আছে মিট শপ।

    আর একটি দোকানও আছে এক সর্দারজীর। ফরেন লিকার শপ।

    তার মানে, হৃষীকেশে যাঁরা আসেন তাঁরা যে সকলেই নিরামিষাশী কিংবা পান-বিলাসী নন, এমন নয়। তেমন হলে হৃষীকেশে ঢোকার মুখে এসব দোকান থাকতই না।

    চারণ তো নিরামিষাশী নয়, মদ্যপানও করে কখনও সখনও। কিন্তু এবারে ওর ওই হঠাৎ করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়াটা, জীবিকার ওপরে বিতৃষ্ণায়, চারপাশের মানুষজনের ওপরে বিতৃষ্ণায়, আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত সকলের ওপরে বিতৃষ্ণায় এবং নিজের জীবনের গন্তব্য সম্বন্ধে দ্বিধা জন্মানোতেই হঠাই নোঙর তুলে চলে আসা। কোনও শিকড়ই রেখে আসেনি। অন্য কোথাওই যাবার সঙ্গে এ যাত্রা আদৌ তুলনীয় নয়। ও সত্যিই নিজেকে পুনরাবিষ্কার করতেই বেরিয়েছে এবারে এবং ওর মনের পরতে পরতে এতরকম তঞ্চকতা, এতরকম অকৃতজ্ঞতা, এতরকম আঘাত পুঞ্জীভূত হয়েছে মাড়িয়ে-আসা বছরগুলিতে যে, ও যদি এবারে আর তার দাঁড়ে ফিরে নাও যায়, তার অফিসের গুরুদায়িত্ব পূর্ণগ্রহণ না করে, তার প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার শত আরাম-সুবিধা থেকে নিজেকে স্বেচ্ছায় সত্যিই বিযুক্ত করে, তা হলেও আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।

    লাগছে কিন্তু চমৎকার। এই দুদিনেই। হৃষীকেশ, এই ত্রিবেণীঘাট, এই নদী, এই নগাধিরাজ হিমালয়, এই সব সাধু-সন্নিসী,  বুদ্ধু সিং-এর মতন এমন সব আশ্চর্য সরল মানুষ। তাও তো মাত্র একজন সন্ন্যাসীকেই এ পর্যন্ত দেখেছে। এরা সবাই চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই তার জীবনে ইতিমধ্যেই যেন এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে দিয়েছে।

    গতকাল থেকে, যখনই খাওয়ার সময় হচ্ছে এবং কিছু খাচ্ছে, তখনই ভীমগিরির সেই কথাটি তাকে বড়ই ভাবাচ্ছে। বেশি খেলে, মাথা মোটা হয়।

    বেশি খেল না আজকে। ভাত, ডাল, মটর ডাল দিয়ে ভাল করে মেখে, স্যালাড, মুলো, পেঁয়াজ, শশা, কাঁচালঙ্কা আর একটু ছোলার তরকারি, যাকে অবাঙালিরা চানা বলেন, আর একটু টক দই।

    খেয়ে উঠে বিছানাতে গা এলিয়ে দিল। সেই স্কুল-কলেজ জীবনের মতন। আঃ কী আরাম। পায়ে ব্যথা বলেই যেন আরামটা আরও বেশি লাগছিল।

    ⤷
    1 2 3 4 5 6 7 8 9
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Article৭. সুজানী গ্রামের দিকে
    Next Article চান্দ্রায়ণ – বুদ্ধদেব গুহ

    Related Articles

    বুদ্ধদেব গুহ

    বাবলি – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্ৰ ১ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ২ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৩ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    ঋজুদা সমগ্র ৪ – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    বুদ্ধদেব গুহ

    অবেলায় – বুদ্ধদেব গুহ

    May 28, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Generic selectors
    Exact matches only
    Search in title
    Search in content
    Post Type Selectors
    Demo

    Your Bookmarks


    Reading History

    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025
    Our Picks

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১১

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১২

    December 12, 2025

    হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস সমগ্র ১৩

    December 12, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    • Login
    Forgot Password?
    Lost your password? Please enter your username or email address. You will receive a link to create a new password via email.
    body::-webkit-scrollbar { width: 7px; } body::-webkit-scrollbar-track { border-radius: 10px; background: #f0f0f0; } body::-webkit-scrollbar-thumb { border-radius: 50px; background: #dfdbdb }