Close Menu
এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    What's Hot

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)
    • 📙
    • লেখক
    • শ্রেণী
      • ছোটগল্প
      • ভৌতিক গল্প
      • প্রবন্ধ
      • উপন্যাস
      • রূপকথা
      • প্রেমকাহিনী
      • রহস্যগল্প
      • হাস্যকৌতুক
      • আত্মজীবনী
      • ঐতিহাসিক
      • নাটক
      • নারী বিষয়ক কাহিনী
      • ভ্রমণকাহিনী
      • শিশু সাহিত্য
      • সামাজিক গল্প
      • স্মৃতিকথা
    • কবিতা
    • 🔖
    • লিখুন
    • চলিতভাষার
    • শীর্ষলেখক
      • রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
      • বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
      • শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়
      • বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
      • সত্যজিৎ রায়
      • সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      • বুদ্ধদেব গুহ
      • জীবনানন্দ দাশ
      • আশাপূর্ণা দেবী
      • কাজী নজরুল ইসলাম
      • জসীম উদ্দীন
      • তসলিমা নাসরিন
      • মহাশ্বেতা দেবী
      • মাইকেল মধুসূদন দত্ত
      • মৈত্রেয়ী দেবী
      • লীলা মজুমদার
      • শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়
      • সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
      • সমরেশ মজুমদার
      • হুমায়ুন আহমেদ
    Subscribe
    সাইন ইন
    এক পাতা গল্প বাংলা গল্প | Bangla Golpo | Read Best Bangla Stories @ Ekpatagolpo (Bangla)

    চার-ইয়ারী কথা – প্রমথ চৌধুরী

    প্রমথ চৌধুরী এক পাতা গল্প88 Mins Read0

    ৪. সোমনাথের কথা

    সোমনাথ এতক্ষণ, যেমন তার অভ্যাস, একটির পর আর একটি অনবরত সিগারেট খেয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মুখের সুমুখে ধোয়ার একটি ছোটখাটো মেঘ জমে গিয়েছিল। তিনি একদৃষ্টে সেইদিকে চেয়ে ছিলেন,—এমন ভাবে, যেন সেই ধোঁয়ার ভিতর তিনি কোন নূতন তত্ত্বের সাক্ষাৎ লাভ করেছেন। পূর্ব পরিচয়ে আমাদের জানা ছিল যে, সোমনাথকে যখন সবচেয়ে অন্যমনস্ক দেখায়, ঠিক তখনি তাঁর মন সব চেয়ে সজাগ ও সতর্ক থাকে, সে সময়ে একটি কথাও তার কান এড়িয়ে যায় না, একটি জিনিষও তার চোখ এড়িয়ে যায় না। সোমনাথের চাচাছোলা মুখটি ছিল ঘড়ির dial-এর মত, অর্থাৎ তার ভিতরকার কলটি যখন পূরোদমে চলছে তখনও সে মুখের তিলমাত্র বদল হত না, তার একটি রেখাও বিকৃত হত না। তার এই আত্মসংযমের ভিতর অবশ্য আর্ট ছিল। সীতেশ তার কথা শেষ করতে না করতেই সোমনাথ ঈষৎ কুঞ্চিত করলেন। আমরা বুঝলুম সোমনাথ তার মনের ধনুকে ছিলে চড়ালেন, এইবার শরবর্ষণ আরম্ভ হবে। আমাদের বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। তিনি ডান হাতের সিগারেট বাঁ হাতে বদলি করে দিয়ে, অতি মোলায়েম অথচ অতি দানাদার গলায় তাঁর কথা আরম্ভ করলেন। লোকে যেমন করে গানের গলা তৈরী করে, সোমনাথ তেমনি করে কথার গলা তৈরী করেছিলেন,–সে কণ্ঠস্বরে কর্কশতা কিম্বা জড়তার লেশমাত্র ছিল না। তার উচ্চারণ এত পরিষ্কার যে, তাঁর মুখের কথার প্রতি-অক্ষর গুণে নেওয়া যেত। আমাদের এ বন্ধুটি সহজ মানুষের মত সহজভাবে কথাবার্তা কইবার অভ্যাস অতি অল্প বয়সেই ত্যাগ করেছিলেন। তাঁর গোঁফ না উঠতেই চুল পেকেছিল। তিনি সময় বুঝে মিতভাষী বা বহুভাষী হতেন। তার অল্পকথা তিনি বলতেন শানিয়ে, আর বেশী কথা সাজিয়ে। সোমনাথের ভাবগতিক দেখে আমরা একটি লম্বা বক্তৃতা শোনবার জন্য প্রস্তুত হলুম। অমনি আমাদের চোখ সোমনাথের মুখ থেকে নেমে তার হাতের উপর গিয়ে পড়ল। আমরা জানতুম যে তিনি তাঁর আঙ্গুল কটিকেও তার কথার সৎ করতে শিখিয়েছিলেন।

    .

    সোমনাথের কথা

    তোমরা আমাকে বরাবর ফিলজফার বলে ঠাট্টা করে এসেছ, আমিও অদ্যাবধি সে অপবাদ বিনা আপত্তিতে মাথা পেতে নিয়েছি। রমণী যদি কবিত্বের একমাত্র আধার হয়, আর যে কবি নয় সেই যদি ফিলজফার হয়, তাহলে আমি অবশ্য ফিলজফার হয়েই জন্মগ্রহণ করি। কি কৈশোরে, কি যৌবনে, স্ত্রীজাতির প্রতি আমার মনের কোনরূপ টান ছিল না। ও জাতি আমার মন কিংবা ইন্দ্রিয় কোনটিই স্পর্শ করতে পারত না। স্ত্রীলোক দেখলে আমার মন নরমও হত না, শক্তও হত না। আমি ও-জাতীয় জীবদের ভালও বাসতুম না, ভয়ও করতুম না,—এক কথায়, ওদের সম্বন্ধে আমি স্বভাবতঃই সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলুম। আমার বিশ্বাস ছিল যে, ভগবান আমাকে পৃথিবীতে আর যে কাজের জন্যই পাঠান, নায়িকা-সাধন করবার জন্য পাঠাননি। কিন্তু নারীর প্রভাব যে সাধারণ লোকের মনের উপর কত বেশি, কত বিস্তৃত, আর কত স্থায়ী, সে বিষয়ে আমার চোখ কান দু-ই সমান খোলা ছিল। দুনিয়ার লোকের এই স্ত্রীলোকের পিছনে পিছনে ছোটা-টা আমার কাছে যেমন লজ্জাকর মনে হত, দুনিয়ার কাব্যের নারীপুজাটাও আমার কাছে তেমনি হাস্যকর মনে হত। যে প্রবৃত্তি পশুপক্ষা গাছপালা ইত্যাদি প্রাণীমাত্রেরই আছে, সেই প্রবৃত্তিটিকে যদি কবিরা সুরে জড়িয়ে, উপমা সাজিয়ে, ছন্দে নাচিয়ে, তার মোহিনী শক্তিকে এত বাড়িয়ে না তুলতেন, তাহলে মানুষে তার এত দাস হয়ে পড়ত না। নিজের হাতে গড়া দেবতার পায়ে মানুষেযখন মাথা ঠেকায়, তখন অভক্ত দর্শকের হাসিও পায়, কান্নাও পায়। এই eternal feminine-এর উপাসনাই ত মানুষের জীবনকে একটা tragi-comedy করে তুলেছে। একটি বর্ণচোরা দৈহিক প্রবৃত্তিই যে পুরুষের নারীপূজার মূল, এ কথা অবশ্য তোমরা কখনও স্বীকার করনি। তোমাদের মতে যে জ্ঞান পশুপক্ষী গাছপালার ভিতর নেই, শুধু মানুষের মনে আছে,—অর্থাৎ সৌন্দর্যজ্ঞান,—তা-ই হচ্ছে এ পূজার যথার্থ মূল। এবং জ্ঞান জিনিষটে অবশ্য মনের ধৰ্ম্ম, শরীরের নয়। এ বিষয়ে আমি তোমাদের সঙ্গে কখনও একমত হতে পারিনি, তার কারণ রূপ সম্বন্ধে হয় আমি অন্ধ ছিলুম, নয় তোমরা অন্ধ ছিলে।

    আমার ধারণা, প্রকৃতির হাতে-গড়া, কি জড় কি প্রাণী, কোন পদার্থেরই যথার্থ রূপ নেই। প্রকৃতি যে কত বড় কারিকর, তার সৃষ্ট এই ব্রহ্মাণ্ড থেকেই তার পরিচয় পাওয়া যায়। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, এমন কি উল্কা পর্যন্ত, সব এক ছাঁচে ঢালা, সব গোলাকার,—তাও আবার পূরোপূরি গোল নয়, সবই ঈষৎ তেড়া-বাঁকা, এখানে ওখানে চাপা ও চেপ্টা। এ পৃথিবীতে যা-কিছু সর্বাঙ্গসুন্দর, তা মানুষের হাতেই গড়ে উঠেছে। Athens-এর Parthenon থেকে আগ্রার তাজমহল পর্যন্ত এই সত্যেরই পরিচয় দেয়। কবিরা বলে থাকেন যে, বিধাতা তাদের প্রিয়াদের নির্জনে বসে নির্মাণ করেন। কিন্তু বিধাতা-কতৃক এই নির্জনে-নির্মিত কোন প্রিয়াই রূপে গ্ৰীকশিল্পীর বাটালিতে কাটা পাষাণ-মুর্তির সুমুখে দাঁড়াতে পারে না। তোমাদের চাইতে আমার রূপজ্ঞান ঢের বেশি ছিল বলে, কোনও মর্ত্য নারীর রূপ দেখে আমার অন্তরে কখনও হৃদরোগ জন্মায়নি। এ স্বভাব, এ বুদ্ধি নিয়েও আমি জীবনের পথে eternal feminine-কে পাশ কাটিয়ে যেতে পারিনি। আমি তাকে খুঁজিনি,—একেও নয়, অনেকেও নয়, কিন্তু তিনি আমাকে খুঁজে বার করেছিলেন। তার হাতে আমার এই শিক্ষা হয়েছে যে, স্ত্রীপুরুষের এই ভালবাসার পূরো অর্থ মানুষের দেহের ভিতরও পাওয়া যায় না, মনের ভিতরও পাওয়া যায় না। কেননা ওর মূলে যা আছে তা হচ্ছে একটি বিরাট রহস্য,—ও পদের সংস্কৃত অর্থেও বটে, বাঙ্গলা অর্থেও বটে—অর্থাৎ ভালবাসা হচ্ছে both a mystery and a joke.

    একবার লণ্ডনে আমি মাসখানেক ধরে ভয়ানক অনিদ্রায় ভুগছিলুম। ডাক্তার পরামর্শ দিলেন Ilfracombe যেতে। শুনলুম ইংলণ্ডের পশ্চিম সমুদ্রের হাওয়া লোকের চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দেয়, চুলের ভিতর বিলি কেটে দেয়; সে হাওয়ার স্পর্শে জেগে থাকাই কঠিন ঘুমিয়ে পড়া সহজ। আমি সেই দিনই Ilfracombe যাত্রা করলুম। এই যাত্রাই আমাকে জীবনের একটি অজানা দেশে পৌছে দিলে।

    আমি যে হোটেলে গিয়ে উঠি, সেটি Ilfracombe-এর সব চাইতে বড়, সব চাইতে সৌখীন হোটেল। সাহেব মেমের ভিড়ে সেখানে নড়বার জায়গা ছিল না, পা বাড়ালেই কারও না কারও পা মাড়িয়ে দিতে হত। এ অবস্থায় আমি দিনটে বাইরেই কাটাতুম,—তাতে আমার কোন দুঃখ ছিল না, কেননা তখন বসন্তকাল। প্রাণের স্পর্শে জড়জগৎ যেন হঠাৎ শিহরিত পুলকিত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। এই সঞ্জীবিত সন্দীপিত প্রকৃতির ঐশ্বর্যের ও সৌন্দর্যের কোন সীমা ছিল না। মাথার উপরে সোণার আকাশ, পায়ের নীচে সবুজ মখমলের গালিচা, চোখের সুমুখে হীরেকষের সমুদ্র, আর ডাইনে বাঁয়ে শুধু ফুলের-জহরৎ-খচিত গাছপালা,—সে পুষ্পরত্নের কোনটি বা সাদা, কোনটি বা লাল, কোনটি বা গোলাপী, কোনটি বা বেগুনি। বিলেতে দেখেছ বসন্তের রং শুধু জল-স্থল-আকাশের নয়, বাতাসের গায়েও ধরে। প্রকৃতির রূপে অঙ্গসৌষ্ঠবের, রেখার-সুষমার যে অভাব আছে, তা সে এই রঙের বাহারে পুষিয়ে নেয়। এই খোলা আকাশের মধ্যে এই রঙীন প্রকৃতির সঙ্গে আমি দুদিনেই ভাব করে নিলুম। তার সঙ্গই আমার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, মুহূর্তের জন্য কোন মানব সঙ্গীর অভাব বোধ করিনি। তিন চার দিন বোধ হয় আমি কোন মানুষের সঙ্গে একটি কথাও কইনি, কেননা সেখানে আমি জনপ্রাণীকেও চিনতুম না, আর কারও সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করা আমার ধাতে ছিল না।

    তারপর একদিন রাত্তিরে ডিনার খেতে যাচ্ছি, এমন সময় বারাণ্ডায় কে একজন আমাকে Good evening বলে সম্বোধন করলে। আমি তাকিয়ে দেখি সুমুখে একটি ভদ্রমহিলা পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বয়েস পঞ্চাশের কম নয়, তার উপর তিনি যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। সেই সঙ্গে নজরে পড়ল যে, তার পরণে ঢক্‌চকে কালো সাটিনের পোষাক, আঙ্গুলে রঙ-বেরঙের নানা আকারের পাথরের আংটি। বুঝলুম যে এর আর যে-বস্তুরই অভাব থাক, পয়সার অভাব নেই। ঘোটলোকী বড়মানুষীর এমন চোখে-আঙ্গুল-দেওয়া চেহারা বিলেতে বড় একটা দেখা যায় না। তিনি দু’কথায় আমার পরিচয় নিয়ে আমাকে তার সঙ্গে ডিনার খেতে অনুরোধ করলেন, আমি ভদ্রতার খাতিরে স্বীকৃত হলুম।

    আমরা খানা-কামরায় ঢুকে সবে টেবিলে বসেছি, এমন সময়ে একটি যুবতী গজেন্দ্রগমনে আমাদের কাছে এসে উপস্থিত হলেন। আমি অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইলুম, কেননা হাতে-বহরে স্ত্রীজাতির এ-হেন নমুনা সে দেশেও অতি বিরল। মাথায় তিনি সীতেশের সমান উঁচু, শুধু বর্ণে সীতেশ যেমন শ্যাম, তিনি তেমনি শ্বেত,—সে সাদার ভিতরে অন্য কোন রঙের চিহ্নও ছিল না,না গালে, না ঠোটে, না চুলে, না ভুরুতে। তাঁর পরণের সাদা কাপড়ের সঙ্গে তার চামড়ার কোন তফাৎ করবার জো ছিল না। এই চুনকাম-করা মূর্তিটির গলায় যে একটি মোটা সোণার শিকলি-হার আর দু’হাতে তদনুরূপ chain-bracelet ছিল, আমার চোখ ঈষৎ ইতস্ততঃ করে তার উপরে গিয়েই বসে পড়ল। মনে হল যেন ব্ৰহ্ম-দেশের কোন রাজ-অন্তঃপুর থেকে একটি শ্বেত হস্তিনী তার স্বর্ণ-শৃঙ্খল ছিঁড়ে পালিয়ে এসেছে। আমি এই ব্যাপার দেখে এতটা ভেড়ে গিয়েছিলুম যে, তার অভ্যর্থনা করবার জন্য দাঁড়িয়ে উঠতে ভুলে গিয়ে, যেমন বসেছিলুম তেমনি বসে রইলুম। কিন্তু বেশিক্ষণ এ ভাবে থাকতে হল না। আমার নবপরিচিতা প্রৌঢ়া সঙ্গিনীটি চেয়ার ছেড়ে উঠে, সেই রক্তমাংসের মনুমেন্টের সঙ্গে এই বলে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন

    “আমার কন্যা Miss Hildesheimer—মিস্টার?”

    “সোমনাথ গঙ্গোপাধ্যায়”

    “মিস্টার গ্যাঁগো—গাঁগো–গাগো—”

    আমার নামের উচ্চারণ ওর চাইতে আর বেশী এগোলো না। আমি শ্ৰীমতীর করমর্দন করে বসে পড়লুম। এক তাল “জেলির” উপর হাত পড়লে গা যেমন করে ওঠে, আমার তেমনি করতে লাগল। তারপর ম্যাডাম আমার সঙ্গে কথাবার্তা আরম্ভ করলেন, মিস্ চুপ করেই রইলেন। তাঁর কথা বন্ধ ছিল বলে যে তার মুখ বন্ধ ছিল, অবশ্য তা নয়। চর্বণ চোষণ লেহন পান প্রভৃতি দন্ত ওষ্ঠ রসনা কণ্ঠ তালুর আসল কাজ সব সজোরেই চলছিল। মাছ মাংস, ফল মিষ্টান্ন, সব জিনিষেই দেখি তার সমান রুচি। যে বিষয়ে আলাপ শুরু হল তাতে যোগদান করবার আশা করি, তার অধিকার ছিল না।

    এই অবসরে আমি যুবতীটিকে একবার ভাল করে দেখে নিলুম। তার মত বড় চোখ ইউরোপে লাখে একটি স্ত্রীলোকের মুখে দেখা যায় না—সে চোখ যেমন বড়, তেমনি জলো, যেমন নিশ্চল, তেমনি নিস্তেজ। এ চোখ দেখলে সীতেশ ভালবাসায় পড়ে যেত, আর সেন কবিতা লিখতে বসত। তোমাদের ভাষায় এ নয়ন বিশাল, তরল, করুণ, প্রশান্ত। তোমরা এরকম চোখে মায়া, মমতা, স্নেহ, প্রেম প্রভৃতি কত কি মনের ভাব দেখতে পাও—কিন্তু তাতে আমি যা দেখতে পাই, সে হচ্চে পোষা জানোয়ারের ভাব; গরু ছাগল ভেড়া প্রভৃতির সব ঐ জাতের চোখ,–তাতে অন্তরের দীপ্তিও নেই, প্রাণের স্ফুর্তিও নেই। এর পাশে বসে আমার সমস্ত শরীরের ভিতরে যে অসোয়াস্তি করছিল,তার মা’রকথা শুনে আমার মনের ভিতর তার চাইতেও বেশী অসোয়াস্তি করতে লাগল। জান তিনি আমাকে কেন পাকড়াও করেছিলেন?—সংস্কৃত শাস্ত্র ও বেদান্ত দর্শন আলোচনা করবার জন্য! আমার অপরাধের মধ্যে, আমি যে সংস্কৃত খুব কম জানি, আর বেদান্তের বে দূরে থাক, আলেফ পর্যন্ত জানিনে, এ কথা একটি ইউরোপীয় স্ত্রীলোকের কাছে স্বীকার করতে কুষ্ঠিত হয়েছিলুম। ফলে তিনি যখন আমাকে জেরা করতে সুরু করলেন, তখন আমি মিথ্যে সাক্ষ্য দিতে আরম্ভ করলুম। “শ্বেতাশ্বতর” উপনিষদ শ্রুতি কিনা, গীতার “ব্ৰহ্মনির্বাণ” ও বৌদ্ধ নির্বাণ এ দুই এক জিনিষ কিনা,–এ সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি নিতান্তই বিপন্ন হয়ে পড়েছিলুম। এ সব বিষয়ে আমাদের পণ্ডিত-সমাজে যে বহু এবং বিষম মতভেদ আছে, আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বারবার সেই কথাটাই বলছিলুম। আমি যে কি মুস্কিলে পড়েছি, তা আমার প্রশ্নকর্তী বুঝুন আর নাই বুঝুন, আমি দেখতে পাচ্ছিলুম যে আমার পাশের টেবিলের একটি রমণী তা বিলক্ষণ বুঝছিলেন।

    সে টেবিলে এই স্ত্রীলোকটি একটি জাঁদরেলি-চেহারার পুরুষের সঙ্গে ডিনার খাচ্ছিলেন। সে ভদ্রলোকের মুখের রং এত লাল যে, দেখলে মনে হয় কে যেন তার সদ্য ছাল ছাড়িয়ে নিয়েছে। পুরুষটি যা বলছিলেন, সে সব কথা তার গোঁফেই আটকে যাচ্ছিল, আমাদের কানে পৌঁছচ্ছিল না। তার সঙ্গিনীও তা কানে তুলছিলেন কিনা, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে। কেননা, স্ত্রীলোকটি যদিচ আমাদের দিকে একবারও মুখ ফেরাননি, তবু তার মুখের ভাব থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে, তিনি আমাদের কথাই কান পেতে শুনছিলেন। যখন আমি কোন প্রশ্ন শুনে, কি উত্তর দেব ভাবছি, তখন দেখি তিনি আহার বন্ধ করে, তার সুমুখের প্লেটের দিকে অন্যমনস্ক ভাবে চেয়ে রয়েছেন,—আর যেই আমি একটু গুছিয়ে উত্তর দিচ্ছি, তখনি দেখি তার চোখের কোণে একটু সকৌতুক হাসি দেখা দিচ্ছে। আসলে আমাদের এই আলোচনা শুনে তার খুব মজা লাগছিল। কিন্তু আমি শুধু ভাবছিলুম এই ডিনার ভোগরূপ কর্মভোগ থেকে কখন উদ্ধার পাব! অতঃপর যখন টেবিল ছেড়ে সকলেই উঠলেন, সেই সঙ্গে আমিও উঠে পালাবার চেষ্টা করছি, এমন সময়ে এই বিলাতি ব্ৰহ্মবাদিনী গার্গী আমাকে বললেন—”তোমার সঙ্গে হিন্দুদর্শনের আলোচনা করে আমি এত আনন্দ আর এত শিক্ষা লাভ করেছি যে, তোমাকে আর আমি ছাড়ছিনে। জান, উপনিষদই হচ্ছে আমার মনের ওষুধ ও পথ্য।” আমি মনে মনে বল্লুম—”তোমার যে কোন ওষুধ পথ্যির দরকার আছে, তাত তোমার চেহারা দেখে মনে হয় না! সে যাই হোক, তোমার যত খুসি তুমি তত জর্মনীর লেবরেটরিতে তৈরী বেদান্ত-ভস্ম সেবন কর, কিন্তু আমাকে যে কেন তার অনুপান যোগাতে হবে, তা বুঝতে পারছিনে?” তার মুখ চলতেই লাগল। তিনি বললেন—”আমি জর্মনীতে Duessen-এর কাছে বেদান্ত পড়েছি, কিন্তু তুমি যত পণ্ডিতের নাম জান, ও যত বিভিন্ন মতের সন্ধান জান, আমার গুরু তার সিকির সিকিও জানেন না। বেদান্ত পড়া ত চিন্তা রাজ্যের হিমালয়ে চড়া, শঙ্কর ত জ্ঞানের গৌরীশঙ্কর! সেখানে কি শান্তি, কি শৈত্য, কি শুভ্রতা, কি উচ্চতা,—মনে করতে গেলেও মাথা ঘরে যায়। হিন্দুদর্শন যে যেমন উচ্চ তেমনি বিস্তৃত, এ কথা আমি জানতুম না। চল, তোমার কাছ থেকে আমি এই সব অচেনা পণ্ডিত অজানা বইয়ের নাম লিখে নেব।”

    এ কথা শুনে আমার আতঙ্ক উপস্থিত হল, কেননা শাস্ত্রে বলে, মিথ্যে কথা——”শতং বদ মা লিখ”! বলা বাহুল্য যে আমি যত বইয়ের নাম করি তার একটিও নেই, আর যত পণ্ডিতের নাম করি তারা সবাই সশরীরে বর্তমান থাকলেও, তার একজনও শাস্ত্রী নন। আমার পরিচিত যত গুরু, পুরোহিত, দৈবজ্ঞ, কুলজ্ঞ, আচার্য, অগ্রদানী-—এমন কি বঁধুনে-বামন পর্যন্ত আমার প্রসাদে সব মহামহোপাধ্যায় হয়ে উঠে। ছিলেন। এ অবস্থায় আমি কি করব না ভেবে পেয়ে, ন যযৌ ন তস্থে ভাবে অবস্থিতি করছি, এমন সময় পাশের টেবিল থেকে সেই স্ত্রীলোকটি উঠে, এক মুখ হাসি নিয়ে আমার মুখে এসে দাঁড়িয়ে বল্লেন—”বা! তুমি এখানে? ভাল আছ ত? অনেক দিন তোমার সঙ্গে দেখা হয়নি। চল আমার সঙ্গে ড্রয়িংরুমে, তোমার সঙ্গে একরাশ কথা আছে।”

    আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার পদানুসরণ করলুম। প্রথমেই আমার চোখে পড়ল যে, এই রমণীটির শরীরের গড়ন ও চলবার ভঙ্গীতে, শিকারী-চিতার মত একটা লিকলিকে ভাব আছে। ইতিমধ্যে আড় চোখে একবার দেখে নিলুম যে, গার্গী এবং তার কন্যা হাঁ করে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছেন, যেন তাদের মুখের গ্রাস কে কেড়ে নিয়েছে–এবং সে এত ক্ষিপ্রহস্তে যে তারা মুখ বন্ধ করবার অবসর পাননি!

    ড্রয়িংরুমে প্রবেশ করবামাত্র, আমার এই বিপদ-তারিণী আর দিকে ঈষৎ ঘাড় বাঁকিয়ে বললেন, “ঘণ্টাখানেক ধরে তোমার উপর যে উৎপীড়ন হচ্ছিল আমার আর তা সহ্য হল না, তাই তোমাকে ঐ জর্মণ পশু দুটির হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছি। তোমার যে কি বিপদ কেটে গেছে, তা তুমি জান না। মা’র দর্শনের পালা শেষ হলেই, মেয়ের কবিত্বের পালা আরম্ভ হত। তুমি ওই সব নেকড়ার পুতুলদের চেন না। ওই সব স্ত্রীরত্নদের জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, যেন তেন প্রকারেণ পুরুষের গললগ্ন হওয়া। পুরুষমানুষ দেখলে ওদের মুখে জল আসে, চোখে তেল আসে, বিশেষত সে যদি দেখতে সুন্দর হয়।”

    আমি বল্লুম—”অনেক অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু তুমি শেষে যে বিপদের কথা বললে, এ ক্ষেত্রে তার কোনও আশঙ্কা ছিল না।”

    -কেন?

    —শুধু ও জাতি নয়, আমি সমগ্র স্ত্রীজাতির হাতের বাইরে।

    —তোমার বয়স কত?

    —চব্বিশ।

    —তুমি বলতে চাও যে, আজ পর্যন্ত কোনও স্ত্রীলোক তোমার চোখে পড়েনি, তোমার মনে ধরেনি?

    –তাই।

    —মিথ্যে কথা বলাটা যে তুমি একটা আর্ট করে তুলেছ, তার প্রমাণ ত এতক্ষণ ধরে পেয়েছি।

    —সে বিপদে পড়ে।

    –তবে এ-ই সত্যি যে, একদিনের জন্যেও কেউ তোমার নয়ন মন আকর্ষণ করতে পারেনি?

    —হাঁ, এ-ই সত্যি। কেননা, সে নয়ন, সে মন একজন চিরদিনের জন্য মুগ্ধ করে রেখেছে।

    –সুন্দরী?

    —জগতে তার আর তুলনা নেই।

    —তোমার চোখে?

    —না, যার চোখ আছে, তারই চোখে।

    —তুমি তাকে ভালবাসো?

    –বাসি।

    –সে তোমাকে ভালবাসে?

    –না।

    —কি করে জানলে?

    –তার ভালবাসবার ক্ষমতা নাই।

    -কেন?

    —তার হৃদয় নেই।

    –এ সত্ত্বেও তুমি তাকে ভালবাসো?

    —”এ সত্ত্বেও” নয়, এই জন্যেই আমি তাকে ভালবাসি। অন্যের ভালবাসাটা একটা উপদ্রব বিশেষ—

    —তার নাম ধাম জানতে পারি?

    —অবশ্য। তার ধাম প্যারিস, আর নাম Venus de Milo.

    এই উত্তর শুনে আমার নবসখী মুহূর্তের জন্য অবাক হয়ে রইল, তার পরেই হেসে বললে,

    —তোমাকে কথা কইতে কে শিখিয়েছে?

    —আমার মন।

    –এ মন কোথা থেকে পেলে?

    –জন্ম থেকে।

    –এবং তোমার বিশ্বাস, এ মনের আর কোনও বদল হবে না?

    –এ বিশ্বাস ত্যাগ করবার আজ পর্যন্ত ত কোনও কারণ ঘটেনি।

    —যদি Venus de Milo বেঁচে ওঠে?

    —তাহলে আমার মোহ ভেঙ্গে যাবে।

    –আর আমাদের কারও ভিতরটা যদি পাথর হয়ে যায়?

    এ কথা শুনে আমি তার মুখের দিকে একবার ভাল করে চেয়ে দেখলুম। আমার statue-দেখা চোখ তাতে পীড়িত বা ব্যথিত হল না। আমি তার মুখ থেকে আমার চোখ তুলে নিয়ে উত্তর করলুম—

    –তাহলে হয়ত তার পূজা করব।

    –পূজা নয়, দাসত্ব?

    —আচ্ছা তাই।

    –আগে যদি জানতুম যে তুমি এত বাজেও বকতে পার, তাহলে আমি তোমাকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করে আনতুম না। যার জীবনের কোনও জ্ঞান নেই, তার দর্শন বকাই উচিত। এখন এস, মুখ বন্ধ করে, আমার সঙ্গে লক্ষী ছেলেটির মত বসে দাবা খেল।

    এ প্রস্তাব শুনে আমি একটু ইতস্ততঃ করছি দেখে সে বললে–“আমি যে পথের মধ্যে থেকে তোমাকে লুফে নিয়ে এসেছি, সে মোটেই তোমার উপকারের জন্য নয়। ওর ভিতর আমার স্বার্থ আছে। দাবা খেলা হচ্ছে আমার বাতিক। ও যখন তোমার দেশের খেলা, তখন তুমি নিশ্চয়ই ভাল খেলতে জান, এই মনে করে তোমাকে গ্রেপ্তার করে আনবার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না।”

    আমি উত্তর করলুম—

    “এর পরেই হয়ত আর একজন আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে বলবে ‘এস আমাকে ভানুমতীর বাজি দেখাও, তুমি যখন ভারতবর্ষের লোক তখন অবশ্য যাদু জান’!”

    সে এ কথার উত্তরে একটু হেসে বললে,–

    “তুমি এমন কিছু লোভনীয় বস্তু নও যে তোমাকে হস্তগত করবার জন্য হোটেল-সুদ্ধ স্ত্রীলোক উতলা হয়ে উঠেছে! সে যাই হোক, আমার হাত থেকে তোমাকে যে কেউ ছিনিয়ে নিয়ে যাবে, সে ভয় তোমার পাবার দরকার নেই। আর যদি তুমি যাদু জান তাহলে ভয় ত আমাদেরি পাবার কথা।”

    একবার হিন্দুদর্শন জানি বলে বিষম বিপদে পড়েছিলুম, তাই এবার স্পষ্ট করে বললুম—

    “দাবা খেলতে আমি জানিনে।”

    “শুধু দাবা কেন?—দেখছি পৃথিবীর অনেক খেলাই তুমি জান না। আমি যখন তোমাকে হাতে নিয়েছি, তখন আমি তোমাকে ও-সব শেখাব ও খেলাব।”

    এর পর আমরা দুজনে দাবা নিয়ে বসে গেলুম। আমার শিক্ষয়িত্রী কোন্ বলের কি নাম, কার কি চাল, এ সব বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে উপদেশ দিতে সুরু করলেন। আমি অবশ্য সে সবই জানতুম, তবু অজ্ঞতার ভাণ করছিলুম, কেননা তাঁর সঙ্গে কথা কইতে আমার মন্দ লাগছিল না। আমি ইতিপূর্বে এমন একটি রমণীও দেখিনি, যিনি পুরুষমানুষের সঙ্গে নিঃসঙ্কোচে কথাবার্তা কইতে পারেন, যার সকল কথা সকল ব্যবহারের ভিতর কতকটা কৃত্রিমতার আবরণ না থাকে। সাধারণতঃ স্ত্রীলোক—সে যে দেশেরই হোক—আমাদের জাতের সুমুখে মন বে-আব্রু করতে পারে না। এই আমি প্রথম স্ত্রীলোক দেখলুম, যে পুরুষ-বন্ধুর মত সহজ ও খোলাখুলি ভাবে কথা কইতে পারে। এর সঙ্গে যে পর্দার আড়াল থেকে আলাপ করতে হচ্ছে না, এতেই আমি খুসি হয়েছিলুম। সুতরাং এই শিক্ষা ব্যাপারটি একটু লম্বা হওয়াতে আমার কোনও আপত্তি ছিল না।

    মাথা নীচু করে অনর্গল বকে গেলেও, আমার সঙ্গিনীটি যে ক্রমান্বয়ে বারান্দার দিকে কটাক্ষ নিক্ষেপ করছিল, তা আমার নজর এড়িয়ে যায়নি। আমি সেই দিকে মুখ ফিরিয়ে দেখলুম যে, তার ডিনারের সাথীটি ঘন ঘন পায়চারি করছেন এবং তার মুখে জ্বলছে চুরেট, আর চোখে রাগ। আমার বন্ধুটিও যে তা লক্ষ্য করছিল, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই, কেননা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল যে, ঐ ভদ্রলোকটি তার মনের উপর একটি চাপের মত বিরাজ করছেন। সকল বলের গতিবিধির পরিচয় দিতে তার বোধ হয় আধ ঘণ্টা লেগেছিল। তারপরে খেলা শুরু হল। পাঁচ মিনিট না যেতেই বুঝলুম যে, দাবার বিদ্যে আমাদের দুজনের সমান,—এক বাজি উঠতে রাত কেটে যাবে। প্রতি চাল দেবার আগে। যদি পাঁচ মিনিট করে ভাবতে হয়, তারপর আবার চাল ফিরিয়ে নিতে হয়, তাহলে খেলা যে কতটা এগোয় তা ত বুঝতেই পার। সে যাই হোক, ঘণ্টা আধেক বাদে সেই জাদরেলি-চেহারার সাহেবটি হঠাৎ ঘরে ঢুকে, আমাদের খেলার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে, অতি বিরক্তির স্বরে আমার খেলার সাথীকে সম্বোধন করে বল্লেন–

    “তাহলে আমি এখন চল্লুম!”

    সে কথা শুনে স্ত্রীলোকটি দাবার ছকের দিকে চেয়ে, নিতান্ত অন্যমনস্কভাবে উত্তর করলেন—”এত শীগগির?”

    –শীগগির কি রকম? রাত এগারটা বেজে গেছে।

    -তাই নাকি? তবে যাও আর দেরী করো না—তোমাকে ছ’মাইল ঘোড়ায় যেতে হবে।

    -কাল আসছ?

    —অবশ্য। সে ত কথাই আছে। বেলা দশটার ভিতর গিয়ে পৌঁছব।

    -কথা ঠিক রাখবে ত?

    –আমি বাইবেল হাতে করে তোমার কথার জবাব দিতে পারিনে!

    –Good-night.

    –Good-night.

    পুরুষটি চলে গেলেন, আবার কি মনে করে ফিরে এলেন। একটু থমকে দাঁড়িয়ে বললেন-“কবে থেকে তুমি দাবা খেলার এত ভক্ত হলে?” উত্তর এল “আজ থেকে।” এর পরে সেই সাহেবপুঙ্গটি “হুঁ” এইমাত্র শব্দ উচ্চারণ করে ঘর থেকে হন্ হন্ করে বেরিয়ে গেলেন।

    আমার সঙ্গিনী অমনি দাবার ঘরটি উল্টে ফেলে খিল্ খিল্ করে হেসে উঠলেন! মনে হল পিয়ানোর সব চাইতে উঁচু সপ্তকের উপর কে যেন অতি হালকাভাবে আঙ্গুল বুলিয়ে গেল। সেই সঙ্গে তার মুখ চোখ সব উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তার ভিতর থেকে যেন একটি প্রাণের ফোয়ারা উছলে পড়ে আকাশে বাতাসে চারিয়ে গেল। দেখতে দেখতে বাতির আলো সব হেসে উঠল। ফুলদানের কাটা-ফুল সব টাটকা হয়ে উঠল। সেই সঙ্গে আমার মনের যন্ত্রও এক সুর চড়ে গেল।

    –তোমার সঙ্গে দাবা খেলবার অর্থ এখন বুঝলে?

    -না।

    —ঐ ব্যক্তির হাত এড়াবার জন্য। নইলে আমি দাবা খেলতে বসি? ওর মত নিবুদ্ধির খেলা পৃথিবীতে আর দ্বিতীয় নেই। George-এর মত লোকের সঙ্গে সকাল সন্ধ্যে একত্র থাকলে শরীর মন একদম ঝিমিয়ে পড়ে। ওদের কথা শোনা আর আফিং খাওয়া, একই কথা। -কেন?

    —ওদের সব বিষয়ে মত আছে, অথচ কোনও বিষয়ে মন নেই। ও জাতের লোকের ভিতরে সার আছে, কিন্তু রস নেই। ওরা স্ত্রীলোকের স্বামী হবার যেমন উপযুক্ত, সঙ্গী হবার তেমনি অনুপযুক্ত।

    —কথাটা ঠিক বুঝলুম না। স্বামীই ত স্ত্রীর চিরদিনের সঙ্গী।

    —চিরদিনের হলেও একদিনেরও নয়–এমন হতে পারে, এবং হয়েও থাকে।

    —তবে কি গুণে তারা স্বামী হিসেবে সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে?

    –ওদের শরীর ও চরিত্র দুয়েরই ভিতর এতটা জোর আছে যে, ওরা জীবনের ভার অবলীলাক্রমে বহন করতে পারে। ওদের প্রকৃতি ঠিক তোমাদের উল্টো। ওরা ভাবে না–কাজ করে। এক কথায়—ওরা হচ্ছে সমাজের ব্যস্ত, তোমাদের মত ঘর সাজাবার ছবি কি পুতুল নয়।

    —হতে পারে এক দলের লোকের বাইরেটা পাথর আর ভিতরটা শীশে দিয়ে গড়া, আর তারাই হচ্ছে আসল মানুষ, কিন্তু তুমি এই দুদণ্ডের পরিচয়ে আমার স্বভাব চিনে নিয়েছ?

    —অবশ্য! আমার চোখের দিকে একবার ভাল করে তাকিয়ে দেখ ত, দেখতে পাবে যে তার ভিতর এমন একটি আলো আছে, যাতে মানুষের ভিতর পর্যন্ত দেখা যায়।

    আমি নিরীক্ষণ করে দেখলুম যে, সে চোখ দুটি “লউসনিয়া” দিয়ে গড়া। লউসনিয়া কি পদার্থ জান? একরকম রত্ন–ইংরাজীতে যাকে বলে cats-eye–তার উপর আলোর “সূত” পড়ে, আর প্রতিমুহূর্তে তার রং বদলে যায়।–আমি একটু পরেই চোখ ফিরিয়ে নিলুম, ভয় হল সে আলো পাছে সত্যি সত্যিই আমার চোখের ভিতর দিয়ে বুকের ভিতর প্রবেশ করে।

    —এখন বিশ্বাস করছ যে আমার দৃষ্টি মর্মভেদী? —বিশ্বাস করি আর না করি, স্বীকার করতে আমার আপত্তি নেই।

    —শুনতে চাও তোমার সঙ্গে George-এর আসল তফাৎটা কোথায়?

    —পরের মনের আয়নায় নিজের মনের ছবি কি রকম দেখায়, তা বোধ হয় মানুষমাত্রেই জানতে চায়।

    -একটি উপমার সাহায্যে বুঝিয়ে দিচ্ছি। George হচ্ছে দাবার নৌকা, আর তুমি গজ। ও একরোখে সিধে পথেই চলতে চায়, আর তুমি কোণাকুণি।

    —এ দুয়ের মধ্যে কোটি তোমাদের হাতে খেলে ভাল?

    —আমাদের কাছে ও-দুইই সমান। আমরা স্কন্ধে ভর করলে দুয়েরই চাল বদলে যায়। উভয়েই একে বেঁকে আড়াই পায়ে চলতে বাধ্য হয়!

    —পুরুষমানুষকে ওরকম ব্যতিব্যস্ত করে তোমরা কি সুখ পাও? এ কথা শুনে সে হঠাৎ বিরক্ত হয়ে বল্লে—

    “তুমি ত আমার Father Confessor নও যে মন খুলে তোমার কাছে আমার সব সুখদুঃখের কথা বলতে হবে! তুমি যদি আমাকে ওভাবে জেরা করতে সুরু কর, তাহলে এখনই

    আমি উঠে চলে যাব।”

    এই বলে সে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে। আমার রূঢ় কথা শোনা অভ্যাস ছিল না, তাই আমি অতি গম্ভীরভাবে উত্তর করলুম “তুমি যদি চলে যেতে চাও ত আমি তোমাকে থাকতে অনুরোধ করব না। ভুলে যেও না যে আমি তোমাকে ধরে রাখিনি।”—এ কথার পর মিনিটখানেক চুপ করে থেকে, সে অতি বিনীত ও নম্রভাবে জিজ্ঞাসা করলে–

    “আমার উপর রাগ করেছ?”

    আমি একটু লজ্জিতভাবে উত্তর করলুম—

    “না। রাগ করবার ত কোনও কারণ নেই।”

    –তবে অত গম্ভীর হয়ে গেলে কেন?

    —”এতক্ষণ এই বন্ধ ঘরে গ্যাসের বাতির নীচে বসে বসে আমার মাথা ধরেছে”—এই মিথ্যে কথা আমার মুখ দিয়ে অবলীলাক্রমে বেরিয়ে গেল। এর উত্তরে “দেখি তোমার জ্বর হয়েছে কিনা” এই কথা বলে সে আমার কপালে হাত দিলে। সে স্পর্শের ভিতর তার আঙ্গুলের ডগার একটু সসঙ্কোচ আদরের ইসারা ছিল। মিনিটখানেক পরে সে তার হাত তুলে নিয়ে বললে—”তোমার মাথা একটু গরম হয়েছে, কিন্তু ও জুর নয়। চল বাইরে গিয়ে বসবে, তাহলেই ভাল হয়ে যাবে।”

    আমি বিনা বাক্যব্যয়ে তার পদানুসরণ করলুম। তোমরা যদি বল যে সে আমাকে mesmerise করেছিল, তাহলে আমি সে কথার প্রতিবাদ করব না।

    বাইরে গিয়ে দেখি সেখানে জনমানব নেই–যদিও রাত তখন সাড়ে এগারটা, তবু সকলে শুতে গিয়েছে। বুঝলুম Ilfracombe সত্য সত্যই ঘুমের রাজ্য। আমরা দুজনে দুখানি বেতের চেয়ারে বসে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলুম। দেখি আকাশ আর সমুদ্র দুই এক হয়ে গেছে—দুইই শ্লেটের রঙ। আর আকাশে যেমন তারা জ্বলছে, সমুদ্রের গায়ে তেমনি যেখানে যেখানে আলো পড়ছে সেখানেই তারা ফুটে উঠছে,–এখানে ওখানে সব জলের টুকরো টাকার মত চকচক করছে, পারার মত টম করছে। গাছপালার চেহারা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, মনে হচ্ছে যেন স্থানে স্থানে অন্ধকার জমাট হয়ে গিয়েছে। তখন সসাগরা বসুন্ধরা মৌনব্রত অবলম্বন করেছিল। এই নিস্তব্ধ নিশীথের নিবিড় শান্তি আমার সঙ্গিনীটির হৃদয়ান স্পর্শ করেছিল— কেননা সে কতক্ষণ ধরে ধ্যানমগ্নভাবে বসে রইল। আমিও চুপ করে রইলুম। তারপর সে চোখ বুজে অতি মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করলে

    “তোমার দেশে যোগী বলে একদল লোক আছে, যারা কামিনী কাঞ্চন স্পর্শ করে না, আর সংসার ত্যাগ করে বনে চলে যায়?”

    –বনে যায়, এ কথা সত্য।

    —আর সেখানে আহারনিদ্রা ত্যাগ করে অহর্নিশি জপতপ করে?

    —এইরকম ত শুনতে পাই।

    —আর তার ফলে যত তাদের দেহের ক্ষয় হয়, তত তাদের মনের শক্তি বাড়ে,—যত তাদের বাইরেটা স্থিরশান্ত হয়ে আসে, তত তাদের অন্তরের তেজ ফুটে ওঠে?

    –তা হলেও হতে পারে।

    –”হতে পারে” বলছ কেন? শুনেছি তোমরা বিশ্বাস কর যে, এদের দেহমনে এমন অলৌকিক শক্তি জন্মায় যে, এই সব মুক্ত জীবের স্পর্শে এবং কথায় মানুষের শরীরমনের সকল অসুখ সেরে যায়।

    –ও সব মেয়েলি বিশ্বাস।

    —তোমার নয় কেন?

    —আমি যা জানিনে তা বিশ্বাস করিনে। আমি এর সত্যি মিথ্যে কি করে জানব? আমি ত আর যোগ অভ্যাস করিনি।

    —আমি ভেবেছিলুম তুমি করেছ।

    -এ অদ্ভুত ধারণা তোমার কিসের থেকে হল?

    —ঐ জিতেন্দ্রিয় পুরুষদের মত তোমার মুখে একটা শীর্ণ, ও চোখে একটা তীক্ষ্ণ ভাব আছে।

    —তার কারণ অনিদ্রা।

    -আর অনাহার। তোমার চোখে মনের অনিদ্রা ও হৃদয়ের উপবাস,—এ দুয়েরি লক্ষণ আছে। তোমার মুখের ঐ ছাইচাপা আগুনের চেহারা প্রথমেই আমার চোখে পড়ে। একটা অদ্ভুত কিছু দেখলে মানুষের চোখ সহজেই তার দিকে যায়, তার বিষয় সবিশেষ জানবার জন্য মন লালায়িত হয়ে ওঠে। George-এর হাত থেকে অব্যাহতি লাভ করবার জন্য যে তোমার আশ্রয় নিই, এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা; তোমাকে একবার নেড়েচেড়ে দেখবার জন্যই আমি তোমার কাছে আসি।

    —আমার তপোভঙ্গ করবার জন্য?

    —তুমি যেদিন St. Anthony হয়ে উঠবে, আমিও সেদিন স্বর্গের অপ্সরা হয়ে দাঁড়াব। ইতিমধ্যে তোমার ঐ গেরুয়া রঙের মিনে-করা মুখের পিছনে কি ধাতু আছে, তাই জানবার জন্য আমার কৌতূহল হয়েছিল।

    —কি ধাতু আবিষ্কার করলে শুনতে পারি?

    —আমি জানি তুমি কি শুনতে চাও।

    —তাহলে তুমি আমার মনের সেই কথা জান, যা আমি জানিনে।

    —অবশ্য! তুমি চাও আমি বলি—চুম্বক।

    কথাটি শোনবামাত্র আমার জ্ঞান হল যে, এ উত্তর শুনলে আমি খুসি হতুম, যদি তা বিশ্বাস করতুম। এই নব আকাঙ্ক্ষা সে আমার মনের ভিতর আবিষ্কার করলে, কি নির্মাণ করলে, তা আমি আজও জানিনে। আমি মনে মনে উত্তর খুঁজছি, এমন সময়ে সে জিজ্ঞাসা করলে “কটা বেজেছে?” আমি ঘড়ি দেখে বল্লুম- “বারোটা।”

    “বারোটা” শুনে সে লাফিয়ে উঠে বললে—

    “উঃ! এত রাত হয়ে গেছে? তুমি মানুষকে এই বকাতেও পার! যাই, শুতে যাই। কাল আবার সকাল সকাল উঠতে হবে। অনেক দূর যেতে হবে, তাও আবার দশটার ভিতর পৌঁছিতে হবে।”

    —কোথায় যেতে হবে?

    –একটা শীকারে। কেন, তুমি কি জান না? তোমার সুমুখেই ত George-এর সঙ্গে কথা হল।।

    —তাহলে সে কথা তুমি রাখবে?

    –তোমার কিসে মনে হল যে রাখব না?

    —তুমি যে ভাবে তার উত্তর দিলে।

    —সে শুধু George-কে একটু নিগ্রহ করার জন্য। আজ রাত্তিরে ওর ঘুম হবে না, আর জানই ত ওদের পক্ষে জেগে থাকা কত কষ্ট!

    —তোমার দেখছি বন্ধুবান্ধবদের প্রতি অনুগ্রহ অতি বেশি।

    —অবশ্য! George-এর মত পুরুষমানুষের মনকে মাঝে মাঝে একটু উস্‌কে না দিলে তা সহজেই নিভে যায়। আর তা ছাড়া ওদের মনে খোঁচা মারার ভিতর বেশি কিছু নিষ্ঠুরতাও নেই। ওদের মনে কেউ বেশি কষ্ট দিতে পারে না, ওরাও এক প্রহার দেওয়া ছাড়া স্ত্রীলোককে অন্য কোনও কষ্ট দিতে পারে না। সেই জন্যই ত ওরা আদর্শ স্বামী হয়। মন নিয়ে কাড়াকাড়ি ছেঁড়াছিঁড়ি, সে তোমার মত লোকেই করে।

    —তোমার কথা আমার হেঁয়ালির মত লাগছে—

    —যদি হেঁয়ালি হয় ত তাই হোক। তোমার জন্যে আমি আর তার ব্যাখ্যা করতে পারিনে। আমার যেমন শ্রান্ত মনে হচ্ছে, তেমনি ঘুম পাচ্চে। তোমার ঘর উপরে?

    -হাঁ।

    –তবে এখন ওঠ, উপরে যাওয়া যাক।

    আমরা দুজনে আবার ঘরে ফিরে এলুম।

    করিডরে পৌঁছবামাত্র সে বল্লে—-”ভাল কথা, তোমার একখানা কার্ড আমাকে দেও—”

    আমি কার্ডখানি দিলুম। সে আমার নাম পড়ে বললে—

    “তোমাকে আমি ‘সু” বলে ডাকব।”

    আমি জিজ্ঞাসা করলুম “তোমাকে কি বলে সম্বোধন করব?”

    উত্তর—যা-খুসি-একটা-কিছু বানিয়ে নেও না। ভাল কথা, আজ তোমাকে যে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছি, তাতে তোমার আমাকে saviour বলে ডাকা উচিত!

    —তথাস্তু।

    —তোমার ভাষায় ওর নাম কি?

    —আমার দেশে বিপন্নকে যিনি উদ্ধার করেন, তিনি দেব নন–দেবী,—তার নাম “তারিণী”।

    “বাঃ, দিব্যি নাম ত! ওর তা-টি বাদ দিয়ে আমাকে “রিণী” বলে ডেকো।” এই কথাবার্তা কইতে কইতে আমরা সিড়িতে উঠছিলুম। একটা গ্যাসের বাতির কাছে আসবামাত্র সে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে, আমার হাতের দিকে চেয়ে বললে, “দেখি দেখি তোমার হাতে কি হয়েছে?” অমনি নিজের হাতের দিকে আমার চোখ পড়ল, দেখি হাতটি লাল টক্ টক্ করছে, যেন কে তাতে সিদুর মাখিয়ে দিয়েছে। সে আমার ডান হাতখানি নিজের বাঁ হাতের উপরে রেখে জিজ্ঞাসা করলে—

    “কার বুকের রক্তে হাত ছুপিয়েছ– অবশ্য Venus de Miloর নয়?”

    —না, নিজের।

    —এতক্ষণ পরে একটি সত্য কথা বলেছ! আশা করি এ রং পাকা। কেননা যে দিন এ রং ছুটে যাবে, সেদিন জেনো তোমার সঙ্গে আমার ভাবও চটে যাবে। যাও, এখন শোওগে। ভাল করে ঘুমিও, আর আমার বিষয় স্বপ্ন দেখে।–

    এই কথা বলে সে দু’লাফে অন্তর্ধান হল।

    আমি শোবার ঘরে ঢুকে আরসিতে নিজের চেহারা দেখে চমকে গেলুম। এক বোতল শ্যাম্পেন খেলে মানুষের যেরকম চেহারা হয়, আমার ঠিক সেই রকম হয়েছিল। দেখি দুই গালে রক্ত দেখা দিয়েছে, আর চোখের তারা দুটি শুধু জ্বল জ্বল করছে। বাকি অংশ ছল্ ছল্ করছে। সে সময় আমার নিজের চেহারা আমার চোখে বড় সুন্দর লেগেছিল। আমি অবশ্য তাকে স্বপ্নে দেখিনি,কেননা, সে রাত্তিরে আমার ঘুম হয়নি।

    .

    (২)

    সে রাত্তিরে আমরা দুজনে যে জীবন-নাটকের অভিনয় শুরু করি, বছরখানেক পরে আর এক রাত্তিরে তার শেষ হয়। আমি প্রথম দিনের সব ঘটনা তোমাদের বলেছি, আর শেষ দিনের বলব, কেননা এ দু’ দিনের সকল কথা আমার মনে আজও গাঁথা রয়েছে। তা ছাড়া ইতিমধ্যে যা ঘটেছিল, সে সব আমার মনের ভিতর-বাইরে নয়। যে ব্যাপারে বাহ্যঘটনার বৈচিত্র্য নেই, তার কাহিনী বলা যায় না। আমার মনের সে বৎসরের ডাক্তারি-ডায়রি যখন আমি নিজেই পড়তে ভয় পাই, তখন তোমাদের তা পরে শোনাবার আমার তিলমাত্রও অভিপ্রায় নেই।

    এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, আমার মনের অদৃশ্য তারগুলি “রিণী” তার দশ আঙ্গুলে এমনি করে ধরে, সে-মনকে পুতুল নাচিয়েছিল। আমার অন্তরে সে যে-প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলেছিল, তাকে ভালবাসা বলে কি না জানি নে; এইমাত্র জানি যে, সে মনোভাবের ভিতর অহঙ্কার ছিল, অভিমান ছিল, রাগ ছিল, জেদ ছিল, আর সেই সঙ্গে ছিল করুণ, মধুর, দাস্য ও সখ্য এই চারটি হৃদয়রস।–এর মধ্যে যা লেশমাত্রও ছিল, সে হচ্ছে দেহের নাম কি গন্ধ। আমার মনের এই কড়িকোমল পর্দাগুলির উপর সে তার আঙ্গুল চালিয়ে যখন-যেমন ইচ্ছে তখন-তেমনি সুর বার করতে পারত। তার আঙ্গুলের টিপে সে সুর কখনও বা অতি কোমল, কখনও বা অতি-তীয়র হত।

    একটি ফরাসী কবি বলেছেন যে, রমণী হচ্ছে আমাদের দেহের ছায়া। তাকে ধরতে যাও সে পালিয়ে যাবে, আর তার কাছ থেকে পালাতে চেষ্টা কর, সে তোমার পিছু পিছু ছুটে আসবে। আমি বারমাস ধরে এই ছায়ার সঙ্গে অহর্নিশি লুকোচুরি খেলেছিলুম। এ খেলার ভিতর কোনও সুখ ছিল না। অথচ এ খেলা সাঙ্গ করবার শক্তিও আমার ছিল না। অনিদ্রাগ্রস্ত লোক যেমন যত বেশি ঘুমতে চেষ্টা করে, তত বেশি জেগে ওঠে,আমিও তেমনি যত বেশি এই খেলা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করতুম, তত বেশি জড়িয়ে পড়তুম। সত্য কথা বলতে গেলে, এ খেলা বন্ধ করবার জন্য আমার আগ্রহও ছিল না,– কেন না আমার মনের এই নব অশান্তির মধ্যে নব জীবনের তীব্র স্বাদ ছিল।

    আমি যে শত চেষ্টাতেও “রিণী”র মনকে আমার করায়ত্ত করতে পারি নি, তার জন্য আমি লজ্জিত নই—কেন না আকাশ বাতাসকে কেউ আর মুঠোর ভিতরে চেপে ধরতে পারে না। তার মনের স্বভাবটা অনেকটা এই আকাশের মতই ছিল, দিনে দিনে তার চেহারা বদলাত। আজ ঝড়-জল বজ-বিদ্যুৎ,কাল আবার চাঁদের আলো, বসন্তের হাওয়া। একদিন গোধূলি, আর একদিন কড়া রোদ্দর। তা ছাড়া সে ছিল একাধারে শিশু, বালিকা, যুবতী আর বৃদ্ধা। যখন তার স্মৃর্তি মন তার আমোদ চড়ত, তখন সে ছোট ছেলের মত ব্যবহার করত; আমার নাক ধরে টানত, চুল ধরে টানত, মুখ ভেংচাত, জিভ বার করে দেখাত। আবার কখনও বা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে, যেন আপন মনে, নিজের ছেলেবেলাকার গল্প করে যেত। তাকে কে কবে বকেছে, কে কবে আদর করেছে, সে কবে কি পড়েছে, কবে কি প্রাইজ পেয়েছে, কবে বনভোজন করেছে, কবে ঘোড়া থেকে পড়েছে; যখন সে এই সকলের খুটিয়ে বর্ণনা করত, তখন একটি বালিকা-মনের স্পষ্ট ছবি দেখতে পেতুম। সে ছবির রেখাগুলি যেমন সরল, তার বর্ণও তেমনি উজ্জ্বল। তারপর সে ছিল গোঁড়া রোমান ক্যাথলিক। একটি অল্পস কাঠের ক্রুশে-আঁটা রূপোর ক্রাইস্ট তার বুকের উপর অষ্টপ্রহর ঝুত, এক মুহূর্তের জন্যও সে তা স্থানান্তরিত করে নি। সে যখন তার ধর্মের বিষয়ে বক্তৃতা আরম্ভ করত, তখন মনে হত তার বয়েস আশী বৎসর। সে সময়ে তার সরল বিশ্বাসের সুমুখে আমার দার্শনিক বুদ্ধি মাথা হেঁট করে থাকত। কিন্তু আসলে সে ছিল পূর্ণ যুবতী,—যদি যৌবনের অর্থ হয় প্রাণের উদ্দাম উচ্ছাস। তার সকল মনোভাব, সকল ব্যবহার, সকল কথার ভিতর এমন একটি প্রাণের জোয়ার বইত, যার তোড়ে আমার অন্তরাত্মা অবিশ্রান্ত তোলপাড় করত। আমরা মাসে দশবার করে ঝগড়া করতুম, আর ঈশ্বরসাক্ষী করে প্রতিজ্ঞা করতুম যে, জীবনে আর কখনও পরস্পরের মুখ দেখব না। কিন্তু দু’দিন না যেতেই, হয় আমি তার কাছে ছুটে যেতুম, নয় সে আমার কাছে ছুটে আসত। তখন আমরা আগের কথা সব ভুলে যেতুম—সেই পুনর্মিলন আবার আমাদের প্রথম মিলন হয়ে উঠত। এই ভাবে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেটে গিয়েছিল। আমাদের শেষ ঝগড়াটা অনেকদিন স্থায়ী হয়েছিল। আমি বলতে ভুলে গিয়েছিলুম যে, সে আমার মনের সর্বপ্রধান দুর্বলতাটি আবিষ্কার করেছিল তার নাম jealousy।—যে মনের আগুনে মানুষ জলে পুড়ে মরে, “রিণী” সে আগুন জ্বালাবার মন্ত্র জানত। আমি পৃথিবীতে বহুলোককে অবজ্ঞা করে এসেছি—কিন্তু ইতিপূর্বে কাউকে কখনও হিংসা করিনি। বিশেষতঃ George-এর মত লোককে হিংসা করার চাইতে আমার মত লোকের পক্ষে বেশি কি হীনতা হতে পারে? কারণ, আমার যা ছিল, তা হচ্ছে টাকার জোর আর গায়ের জোর। কিন্তু “রিণী” আমাকে এ হীনতাও স্বীকার করতে বাধ্য করেছিল। তার শেষবারের ব্যবহার আমার কাছে যেমন নিষ্ঠুর তেমনি অপমানজনক মনে হয়েছিল। নিজের মনের দুর্বলতার স্পষ্ট পরিচয় পাবার মত কষ্টকর জিনিষ মানুষের পক্ষে আর কিছু হতে পারে না।

    ভয় যেমন মানুষকে দুঃসাহসিক করে তোলে, আমার ঐ দুর্বলতাই তেমনি আমার মনকে এত শক্ত করে তুলেছিল যে, আমি আর কখনও তার মুখ-দর্শন করতুম না—যদি না সে আমাকে চিঠি লিখত। সে চিঠির প্রতি অক্ষর আমার মনে আছে,—সে চিঠি এই :–

    “তোমার সঙ্গে যখন শেষ দেখা হয়, তখন দেখেছিলুম যে তোমার শরীর ভেঙ্গে পড়ছে—আমার মনে হয় তোমার পক্ষে একটা change নিতান্ত আবশ্যক। আমি যেখানে আছি, সেখানকার হাওয়া মরা মানুষকে বাঁচিয়ে তোলে। এ জায়গাটা একটি অতি ছোট পল্লীগ্রাম। এখানে তোমার থাকবার মত কোনও স্থান নেই। কিন্তু এর ঠিক পরের স্টেসনটিতে অনেক ভাল ভাল হোটেল আছে। আমার ইচ্ছে তুমি কালই লণ্ডন ছেড়ে সেখানে যাও। এখন এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি —আর দেরি করলে এমন চমৎকার সময় আর পাবে না। যদি হাতে, টাকা না থাকে, আমাকে টেলিগ্রাম করো, আমি পাঠিয়ে দেব। পরে সুদসুদ্ধ তা শুধে দিয়ো।”

    আমি চিঠির কোন উত্তর দিলুম না, কিন্তু পরদিন সকালের ট্রেনেই লণ্ডন ছাড়লুম। আমি কোন কারণে তোমাদের কাছে সে জায়গার নাম করব না। এই পর্যন্ত বলে রাখি, “রিণী” যেখানে ছিল তার নামের প্রথম অক্ষর B, এবং তার পরের স্টেসনের নামের প্রথম অক্ষর W.

    ট্রেন যখন B স্টেশনে গিয়ে পৌঁছল, তখন বেলা প্রায় দু’টো। আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলুম “রিণী” প্ল্যাটফরমে নেই। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি, প্ল্যাটফরমের রেলিংয়ের ওপরে রাস্তার ধারে একটি গাছে হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। প্রথমে যে কেন আমি তাকে দেখতে পাইনি, তাই ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেলুম, কেননা সে যে রংঙের কাপড় পরেছিল তা আধক্রোশ দূর থেকে মানুষের চোখে পড়ে—একটি মিমিসে কালো গাউনের উপর একটি ডগন্ডগে হলদে জ্যাকেট। সেদিনকে “রিণী” এক অপ্রত্যাশিত নতুন মূর্তিতে, আমাদের দেশের নববধূর মূর্তিতে দেখা দিয়েছিল। এই বজ্রবিদ্যুৎ দিয়ে গড়া রমণীর মুখে আমি পূর্বে কখন লজ্জার চিহ্নমাত্রও দেখতে পাইনি। কিন্তু সেদিন তার মুখে যে হাসি ঈষৎ ফুটে উঠেছিল, সে লজ্জার রক্তিম হাসি। সে চোখ তুলে আমার দিকে ভাল করে চাইতে পারছিল না। তার মুখখানি এত মিষ্টি দেখাচ্ছিল যে, আমি চোখ ভরে প্রাণভরে তাই দেখতে লাগলুম। আমি যদি কখনও তাকে ভালবেসে থাকি, ত সেই দিন সেই মুহূর্তে! মানুষের সমস্ত মনটা যে এক মুহূর্তে এমন রং ধরে উঠতে পারে, এ সত্যের পরিচয় আমি সেই দিন প্রথম পাই।

    ট্রেন B স্টেসনে বোধ হয় মিনিটখানেকের বেশি থামেনি, কিন্তু সেই এক মিনিট আমার কাছে অনন্তকাল হয়েছিল। তার মিনিট পাঁচেক পরে ট্রেন W স্টেশনে পৌঁছল। আমি সমুদ্রের ধারে একটি বড় হোটেলে গিয়ে উঠলুম। কেন জানিনে, হোটেলে পৌছেই আমার অগাধ শ্রান্তি বোধ হতে লাগল। আমি কাপড় ছেড়ে বিছানায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম। এই একটি মাত্র দিন যখন আমি বিলেতে দিবানিদ্রা দিয়েছি, আর এমন ঘুম আমি জীবনে কখনও ঘুমোইনি। জেগে উঠে দেখি পাঁচটা বেজে গেছে। তাড়াতাড়ি কাপড় পরে নাচে এসে চা খেয়ে পদব্রজে B-র অভিমুখে যাত্রা করলুম। যখন সে গ্রামের কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছলুম, তখন প্রায় সাতটা বাজে; তখনও আকাশে যথেষ্ট আলো ছিল। বিলেতে জানইত গ্রীষ্মকালের রাত্তির দিনের জের টেনে নিয়ে আসে; সূর্য অস্ত গেলেও, তার পশ্চিম আলো ঘণ্টার পর ঘণ্টা রাত্তিরের গায়ে জড়িয়ে থাকে। “রিণী” কোন পাড়ায় কোন বাড়ীতে থাকে, তা আমি জানতুম না, কিন্তু আমি এটা জানতুম যে, W থেকে B যাবার রাস্তায় কোথায়ও না কোথায়ও তার দেখা পাব।

    B-র সীমাতে পা দেবামাত্রই দেখি, একটি স্ত্রীলোক একটু উতলা ভাবে রাস্তায় পায়চারি করছে। দূর থেকে তাকে চিনতে পারিনি, কেননা ইতিমধ্যে “রিণী” তার পোষাক বদলে ফেলেছিল। সে কাপড়ের রংয়ের নাম জানিনে, এই পর্যন্ত বলতে পারি যে সেই সন্ধ্যের আলোর সঙ্গে সে এক হয়ে গিয়েছিল—সে রং যেন গোধূলিতে ছাপানো।

    আমাকে দেখবামাত্র “রিণী” আমার দিকে পিঠ ফিরিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। আমি আস্তে আস্তে সেই দিকে এগোতে লাগলুম। আমি জানতুম যে, সে এই গাছপালার ভিতর নিশ্চয়ই কোথাও লুকিয়ে আছে–সহজে ধরা দেবে না—একটু খুজে পেতে তাকে বার করতে হবে। আমি অবশ্য তার এ ব্যবহারে আশ্চর্য হয়ে যাইনি, কেননা এতদিনে আমার শিক্ষা হয়েছিল যে, “রিণী” যে কখন কি ব্যবহার করবে, তা অপরের জানা দূরে থাক, সে নিজেই জানত না। আমি একটু এগিয়ে দেখি, ডান দিকে বনের ভিতর একটি গলি রাস্তার ধারে একটি oak গাছের আড়ালে “রিণী” দাঁড়িয়ে আছে, এমন ভাবে যাতে পাতার ফাঁক দিয়ে ঝরা আলো তার মুখের উপর এসে পড়ে। আমি অতি সন্তর্পণে তার দিকে এগোতে লাগলুম, সে চিত্র-পুত্তলিকার মত দাঁড়িয়েই রইল। তার মুখের আধখানা ছায়ায় ঢাকা পড়াতে, বাকি অংশটুকু স্বর্ণমুদ্রার উপর অঙ্কিত গ্রীকরমণীমূর্তির মত দেখাচ্ছিল,—সে মূর্তি যেমন সুন্দর, তেমনি কঠিন। আমি কাছে যাবামাত্র, সে দু’হাত দিয়ে তার মুখ ঢাকলে। আমি তার সুমুখে গিয়ে দাঁড়ালুম। দুজনের কারও মুখে কথা নেই।।

    কতক্ষণ এ ভাবে গেল জানিনে। তারপর প্রথমে কথা অবশ্য “রিণী”ই কইলে—কেননা সে বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারত না। বিশেষতঃ আমার কাছে। তার কথার স্বরে ঝগড়ার পূর্বাভাস ছিল। প্রথম সম্ভাষণ হল এই “তুমি এখান থেকে চলে যাও! আমি তোমার সঙ্গে কথা কইতে চাইনে, তোমার মুখ দেখতে চাইনে।”

    —আমার অপরাধ?

    -তুমি এখানে কেন এলে?

    —তুমি আসতে লিখেছ বলে।

    —সেদিন আমার বড় মন খারাপ ছিল। বড় একা একা মনে হচ্ছিল বলে ঐ চিঠি লিখি। কিন্তু কখনও মনে করিনি, তুমি চিঠি পাবামাত্র ছুটে এখানে চলে আসবে। তুমি জান যে, মা যদি টের পান যে আমি একটি কালো লোকের সঙ্গে ইয়ারকি দিই, তাহলে আমাকে বাড়ী ছাড়তে হবে?

    ইয়ারকি শব্দটি আমার কানে খট্‌ করে লাগল, আমি ঈষৎ বিরক্তভাবে বললুম—”তোমার মুখেই তা শুনেছি। তার সত্যি মিথ্যে ভগবান জানেন। কিন্তু তুমি কি বলতে চাও তুমি ভাবনি যে আমি আসব?”

    —স্বপ্নেও না।

    —তাহলে ট্রেন আসবার সময় কার খোঁজে স্টেসনে গিয়েছিলে?

    —কারও খোঁজে নয়। চিঠি ডাকে দিতে।

    –তাহলে ওরকম কাপড় পরেছিলে কেন, যা আধক্রোশ দূর থেকে কাণ লোকেরও চোখে পড়ে?

    –তোমার সুনজরে পড়বার জন্য।

    —সু হোক, কু হোক, আমার নজরেই পড়বার জন্য।

    –তোমার বিশ্বাস তোমাকে না দেখে আমি থাকতে পারিনে?

    —তা কি করে বলব! এইত এতক্ষণ হাত দিয়ে চোখ ঢেকে রেখেছ।

    —সে চোখে আলো সইছে না বলে। আমার চোখে অসুখ করেছে। “দেখি কি হয়েছে”, এই বলে আমি আমার হাত দিয়ে তার মুখ থেকে তার হাত দুখানি তুলে নেবার চেষ্টা করলুম। “রিণী” বল্লে, “তুমি হাত সরিয়ে নেও, নইলে আমি চোখ খুলব না। আর তুমি জান যে, জোরে তুমি আমার সঙ্গে পারবে না।”

    —আমি জানি যে আমি George নই। গায়ের জোরে আমি কারও চোখ খোলাতে পারব না। এ কথা শুনে “রিণী” মুখ থেকে হাত নামিয়ে নিয়ে, মহা উত্তেজিত ভাবে বললে, “আমার চোখ খোেলাবার জন্য কারও ব্যস্ত হবার দরকার নেই। আমি আর তোমার মত অন্ধ নই! তোমার যদি কারও ভিতরটা দেখবার শক্তি থাকত, তাহলে তুমি আমাকে যখন-তখন এত অস্থির করে তুলতে না। জান আমি কেন রাগ করেছিলুম? তোমার ঐ কাপড় দেখে! তোমাকে ও-কাপড়ে আজ দেখব না বলে আমি চোখ বন্ধ করেছিলুম।”

    –কেন, এ কাপড়ের কি দোষ হয়েছে? এটি ত আমার সব চাইতে সুন্দর পোষাক।

    —দোষ এই যে, এ সে কাপড় নয়, যে কাপড়ে আমি তোমাকে প্রথম দেখি।

    এ কথা শোনবামাত্র আমার মনে পড়ে গেল যে, “রিণী” সেই কাপড় পরে আছে, যে কাপড়ে আমি প্রথম তাকে Ilfracombe-য়ে দেখি। আমি ঈষৎ অপ্রতিভ ভাবে বললুম, “এ কথা আমার মনে হয়নি যে আমরা পুরুষমানুষ, কি পরি না পরি তাতে তোমাদের কিছু যায় আসে।”—

    –না, আমরা ত আর মানুষ নই, আমাদের ত আর চোখ নেই! তোমার হয়ত বিশ্বাস যে, তোমরা সুন্দর হও, কুৎসিত হও, তাতেও আমাদের কিছু যায় আসে না।

    —আমার ত তাই বিশ্বাস।

    -তবে কিসের টানে তুমি আমাকে টেনে নিয়ে বেড়াও?

    –রূপের?

    —অবশ্য! তুমি হয়ত ভাব, তোমার কথা শুনে আমি মোহিত হয়েছি। স্বীকার করি তোমার কথা শুনতে আমার অত্যন্ত ভাল লাগে, শুধু তা নয়, নেশাও ধরে। কিন্তু তোমার কণ্ঠস্বর শোনবার আগে যে কুক্ষণে আমি তোমাকে দেখি, সেইক্ষণে আমি বুঝেছিলুম যে, আমার জীবনে একটি নূতন জালার সৃষ্টি হল, আমি চাই আর না চাই, তোমার জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের চিরসংঘর্ষ থেকেই যাবে।

    –এ সব কথা ত এর আগে তুমি কখন বলনি।।

    –ও কানে শোনবার কথা নয়, চোখে দেখবার জিনিষ। সাধে কি তোমাকে আমি অন্ধ বলি? এখন শুনলে ত, এস সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসি। আজকে তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

    যে পথ ধরে চল্লুম সে পথটি যেমন সর, দু’পাশের বড় বড় গাছের ছায়ায় তেমনি অন্ধকার। আমি পদে পদে হোঁচট খেতে লাগলুম। “রিণী” বললে “আমি পথ চিনি, তুমি আমার হাত ধর, আমি তোমাকে নিরাপদে সমুদ্রের ধারে পৌঁছে দেব।” আমি তার হাত ধরে নীরবে সেই অন্ধকার পথে অগ্রসর হতে লাগলুম। আমি অনুমানে বুঝলুম যে, এই নির্জন অন্ধকারের প্রভাব তার মনকে শান্ত, বশীভূত করে আনছে। কিছুক্ষণ পর প্রমাণ পেলুম যে আমার অনুমান ঠিক।

    মিনিট দশেক পরে “রিণী” বললে—”সু, তুমি জানো যে তোমার হাত তোমার মুখের চাইতে ঢের বেশি সত্যবাদী?”

    –তার অর্থ?

    —তার অর্থ, তুমি মুখে যা চেপে রাখ, তোমার হাতে তা ধরা পড়ে।

    –সে বস্তু কি?

    —তোমার হৃদয়।

    –তারপর?

    তারপর, তোমার রক্তের ভিতর যে বিদ্যুৎ আছে, তোমার আঙ্গুলের মুখ দিয়ে তা ছুটে বেরিয়ে পড়ে। তার স্পর্শে সে বিদ্যুৎ সমস্ত শরীরে চারিয়ে যায়, শিরের ভিতর গিয়ে রি রি করে।

    –”রিণী’, তুমি আমাকে আজ এ সব কথা এত করে বলছ কেন? এতে আমার মন ভুলবে না, শুধু অহঙ্কার বাড়বে।—আমার অহঙ্কারের নেশা এমনি যথেষ্ট আছে, তার আর মাত্রা চড়িয়ে তোমার কি লাভ?

    —সু, যে রূপ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছে, তা তোমার দেহের কি মনের, আমি জানিনে। তোমার মন ও চরিত্রের কতক অংশ অতি স্পষ্ট, আর কতক অংশ অতি অস্পষ্ট। তোমার মুখের উপর তোমার ঐ মনের ছাপ আছে। এই আলো ছায়ায় আঁকা ছবিই আমার চোখে এত সুন্দর লাগে, আমার মনকে এত টানে। সে যাই হোক, আজ আমি তোমাকে শুধু সত্যকথা বলছি ও বলব, যদিও তোমার অহঙ্কারের মাত্রা বাড়ানোতে আমার ক্ষতি বই লাভ নেই।

    —কি ক্ষতি?

    —তুমি জান আর না জান, আমি জানি যে তুমি আমার উপর যত নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছ, তার মূলে তোমার অহং ছাড়া আর কিছুই ছিল না।

    –নিষ্ঠুর ব্যবহার আমি করেছি?

    —হাঁ তুমি।—আগের কথা ছেড়ে দাও—এই এক মাস তুমি জান যে আমার কি কষ্টে কেটেছে। প্রতিদিন যখন ডাকপিয়ন এসে দুয়োরে knock করেছে, আমি অমনি ছুটে গিয়েছি— দেখতে তোমার চিঠি এল কি না। দিনের ভিতর দশবার করে তুমি আমার আশা ভঙ্গ করেছ। শেষটা এই অপমান আর সহ্য করতে না পেরে, আমি লণ্ডন থেকে এখানে পালিয়ে আসি।

    —যদি সত্যই এত কষ্ট পেয়ে থাক, তবে সে কষ্ট তুমি ইচ্ছে করে ভোগ করেছ—

    —কেন?

    –আমাকে লিখলেই ত তোমার সঙ্গে দেখা করতুম।

    —ঐ কথাতেই ত নিজেকে ধরা দিলে। তুমি তোমার অহঙ্কার ছাড়তে পার না, কিন্তু আমাকে তোমার জন্য তা ছাড়তে হবে! শেষে হলও তাই। আমার অহঙ্কার চূর্ণ করে তোমার পায়ে ধরে দিয়েছি, তাই আজ তুমি অনুগ্রহ করে আমাকে দেখা দিতে এসেছ!

    এ কথার উত্তরে আমি বল্লুম—

    “কষ্ট তুমি পেয়েছ? তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে অবধি আমার দিন যে কি আরামে কেটেছে, তা ভগবানই জানেন।”

    –এ পৃথিবীতে এক জড়পদার্থ ছাড়া আর কারও আরামে পাকবার অধিকার নেই। আমি তোমার জড় হৃদয়কে জীবন্ত করে তুলেছি, এই ত আমার অপরাধ? তোমার বুকের তারে মীড় টেনে কোমল সুর বার করতে হয়। একে যদি তুমি পীড়ন করা বল, তাহলে আমার কিছু বলবার নেই। এই সময় আমরা বনের ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি, সুমুখে দিগন্ত বিস্তৃত গোধূলি ধূসর জলের মরুভূমি ধূ ধূ করছে। তখনও আকাশে আলো ছিল। সেই বিমর্ষ আলোয় দেখলুম, “রিণী”র মুখ গভীর চিন্তায় ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছে, সে একদৃষ্টে সমুদ্রের দিকে চেয়ে রয়েছে, কিন্তু সে দৃষ্টির কোনও লক্ষ্য নেই। সে চোখে যা ছিল, তা ঐ সমুদ্রের মতই একটা অসীম উদাস ভাব।

    “রিণী” আমার হাত ছেড়ে দিলে, আমরা দুজনে বালির উপরে পাশা পাশি বসে সমুদ্রের দিকে চেয়ে রইলুম। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকবার পর আমি বল্লুম-”রিণী”, তুমি কি আমাকে সত্যই ভালবাসো?”

    –বাসি।

    –কবে থেকে?

    –যে দিন তোমার সঙ্গে প্রথম দেখা হয়, সেই দিন থেকে। আমার মনের এ প্রকৃতি নয় যে, তা ধুইয়ে ধূইয়ে জ্বলে উঠবে। এ মন এক মুহূর্তে দপ করে জ্বলে ওঠে, কিন্তু এ জীবনে সে আগুন আর নেভে না। আর তুমি?

    —তোমার সম্বন্ধে আমার মনোভাব এত বহুরূপী যে, তার কোনও একটি নাম দেওয়া যায় না। যার পরিচয় আমি নিজেই ভাল করে জানিনে, তোমাকে তা কি বলে জানাব?

    —তোমার মনের কথা তুমি জান আর না জান, আমি জানতুম।

    —আমি যে জানতুম না, সে কথা সত্য—কিন্তু তুমি জানতে কিনা, বলতে পারিনে।

    —আমি যে জানতুম, তা প্রমাণ করে দিচ্ছি। তুমি ভাবতে যে আমার সঙ্গে তুমি শুধু মন নিয়ে খেলা করছ।

    –তা ঠিক।

    —আর এ খেলায় তোমার জেতবার এতটা জেদ ছিল যে, তার জন্য তুমি প্রাণপণ করেছিলে।

    —এ কথাও ঠিক।

    —কবে বুঝলে যে এ শুধু খেলা নয়?

    —আজ। –কি করে?

    —যখন তোমাকে স্টেসনে দেখলুম, তখন তোমার মুখে আমি নিজের মনের চেহারা দেখতে পেলুম।

    –এতদিন তা দেখতে পাওনি কেন?

    —তোমার মন আর আমার মনের ভিতর, তোমার অহঙ্কার আর আমার অহঙ্কারের জোড়া পর্দা ছিল। তোমার মনের পর্দার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের পর্দাও উঠে গেছে।

    —তুমি যে আমাকে কত ভালবাস, সে কথাও আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করব না।

    –কেন?

    —তাও আমি জানি।

    —কতটা?

    —জীবনের চাইতে বেশি। যখন তোমার মনে হয় যে আমি তোমাকে ভালবাসিনে, তখন তোমার কাছে বিশ্ব খালি হয়ে যায়, জীবনের কোনও অর্থ থাকে না।

    —এ সত্য কি করে জানলে?

    —নিজের মন থেকে।

    এই কথার পর “রিণী” উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “রাত হয়ে গেছে, আমার বাড়ী যেতে হবে; চল তোমাকে স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে আসি।”—”রিণী” পথ দেখাবার জন্য আগে আগে চলতে লাগল, আমি নীরবে তার অনুসরণ করতে আরম্ভ করলুম।

    মিনিট দশেক পরে “রিণী” বললে—”আমরা এতদিন ধরে যে নাটকের অভিনয় করছি, আজ তার শেষ হওয়া উচিত।”

    —মিলনান্ত না বিয়োগান্ত?

    —সে তোমার হাতে। আমি বল্লুম—”যারা এক মাস পরস্পরকে ছেড়ে থাকতে পারে না, তাদের পক্ষে সমস্ত জীবন পরস্পরকে ছেড়ে থাকা কি সম্ভব?”

    –তাহলে একত্র থাকবার জন্য তাদের কি করতে হবে?

    –বিবাহ।

    —তুমি কি সকল দিক ভেবে চিন্তে এ প্রস্তাব করছ?

    —আমার আর কোন দিক ভাববার চিন্তবার ক্ষমতা নেই। এই মাত্র আমি জানি যে, তোমাকে ছেড়ে আমি আর একদিনও থাকতে পারব না।

    —তুমি রোমান ক্যাথলিক হতে রাজি আছ?

    এ কথা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। আমি নিরুত্তর রইলুম।

    —এর উত্তর ভেবে তুমি কাল দিয়ো। এখন আর সময় নেই, ওই দেখ তোমার ট্রেন আসছে—শিগগির টিকেট কিনে নিয়ে এস, আমি তোমার জন্য প্ল্যাটফরমে অপেক্ষা করব।

    আমি তাড়াতাড়ি টিকেট কিনে নিয়ে এসে দেখি “রিণী” অদৃশ্য হয়েছে। আমি একটি ফাস্ট ক্লাস গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় সেখান থেকে George নামলেন। আমি ট্রেনে চড়তে না চড়তে গাড়ি ছেড়ে দিলে।

    আমি জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখি “রিণী” আর George পাশাপাশি হেঁটে চলেছে।

    সে রাত্তিরে বিকারের রোগীর মাথার যে অবস্থা হয়, আমার তাই হয়েছিল,–অর্থাৎ আমি ঘুমোইওনি, জেগেও ছিলুম না।

    পরদিন সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে আসবামাত্র চাকরে আমার হাতে একখানি চিঠি দিলে। শিরোনামায় দেখি “রিণীর” হস্তাক্ষর।

    খুলে যা পড়লুম তা এই–

    “এখন রাত বারোটা। কিন্তু এমন একটা সুখবর আছে, যা তোমাকে এখনই না দিয়ে থাকতে পারছিনে। আমি এক বৎসর ধরে যা চেয়ে ছিলুম, আজ তা হয়েছে। George আজ আমাকে বিবাহ করবার প্রস্তাব করেছে, আমি অবশ্য তাতে রাজি হয়েছি। এর জন্য ধন্যবাদটা বিশেষ করে তোমারই প্রাপ্য। কারণ George-এর মত পুরুষমানুষের মনে আমার মত রমণীকে পেতেও যেমন লোভ হয়, নিতেও তেমনি ভয় হয়। তাতেই ওদের মন স্থির করতে এত দেরি লাগে যে আমরা একটু সাহায্য না করলে সে মন আর কখনই স্থির হয় না। ওদের কাছে ভালবাসার অর্থ হচ্ছে jealousy; ওদের মনে যত jealousy বাড়ে, ওরা ভাবে ওরা তত বেশি ভালবাসে। স্টেসনে তোমাকে দেখেই George উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল, তারপর যখন শুনলে যে তোমার একটা কথার উত্তর আমাকে কাল দিতে হবে, তখন সে আর কালবিলম্ব না করে আমাদের বিয়ে ঠিক করে ফেললে। এর জন্য আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ রইব, এবং তুমিও আমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থেকো। কেননা, তুমি যে কি পাগলামি করতে বসেছিলে, তা পরে বুঝবে। আমি বাস্তবিকই আজ তোমার Saviour হয়েছি।

    তোমার কাছে আমার শেষ অনুরোধ এই যে, তুমি আমার সঙ্গে আর দেখা করবার চেষ্টা করো না। আমি জানি যে, আমি আমার নতুন জীবন আরম্ভ করলে দু’দিনেই তোমাকে ভুলে যাব, আর তুমি যদি আমাকে শীগগির ভুলতে চাও, তাহলে Miss Hildesheimer-কে খুঁজে বার করে তাকে বিবাহ কর। সে যে আদর্শ স্ত্রী হবে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তা ছাড়া আমি যদি George-কে বিয়ে করে সুখে থাকতে পারি, তাহলে তুমি যে Miss Hildeslheimer-কে নিয়ে কেন সুখে থাকতে পারবে না, তা বুঝতে পারিনে। ভয়ানক মাথা ধরেছে, আর লিখতে পারিনে। Adieu।”

    এ ব্যাপারে আমি কি George, কে বেশি কুপার পাত্র, তা আমি আজও বুঝতে পারিনি।

    এ কথা শুনে সেন হেসে বললেন “দেখ সোমনাথ, তোমার অহঙ্কারই এ বিষয়ে তোমাকে নির্বোধ করে রেখেছে। এর ভিতর আর বোঝবার কি আছে? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তোমার “রিণী” তোমাকে বাঁদর নাচিয়েছে এবং ঠকিয়েছে—সীতেশের তিনি যেমন তাকে করেছিলেন। সীতেশের মোহ ছিল শুধু এক ঘণ্টা, তোমার তা আজও কাটেনি। যে কথা স্বীকার করবার সাহস সীতেশের আছে, তোমার তা নেই। ও তোমার অহঙ্কারে বাধে।”

    সোমনাথ উত্তর করলেন—

    “ব্যাপারটা যত সহজ মনে করছ, তত নয়। তাহলে আর একটু বলি। আমি “রিণীর” পত্রপাঠে প্যারিসে যাই। মনস্থির করেছিলুম যে, যতদিন না আমার প্রবাসের মেয়াদ ফুরোয়, ততদিন সেখানেই থাকব, এবং লণ্ডনে শুধু Innএর term রাখতে বছরে চারবার করে যাব, এবং প্রতি ক্ষেপে ছ’দিন করে থাকব। মাসখানেক পরে, একদিন সন্ধ্যাবেলা হোটেলে বসে আছি—এমন সময়ে হঠাৎ দেখি “রিণী” এসে উপস্থিত? আমি তাকে দেখে চমকে উঠে বললুম যে, “তবে তুমি George-কে বিয়ে করনি, আমাকে শুধু ভোগা দেবার জন্য চিঠি লিখেছিলে?”

    সে হেসে উত্তর করলে–

    “বিয়ে না করলে প্যারিসে Honeymoon করতে এলুম কি করে? তোমার খোঁজ নিয়ে তুমি এখানে আছ জেনে, আমি George-কে বুঝিয়ে পড়িয়ে এখানে এনেছি। আজ তিনি তাঁর একটি বন্ধুর সঙ্গে ডিনার খেতে গিয়েছেন, আর আমি লুকিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”

    সে সন্ধ্যেটা “রিণী” আমার সঙ্গে গল্প করে কাটালে। সে গল্প হচ্ছে তার বিয়ের রিপোর্ট। আমাকে বসে বসে ও ব্যাপারের সব খুঁটিনাটি বর্ণনা শুনতে হল। চলে যাবার সময়ে সে বললে—

    “সেদিন তোমার কাছে ভাল করে বিদায় নেওয়া হয়নি। পাছে তুমি আমার উপর রাগ করে থাক, এই মনে করে আজ তোমার সঙ্গে দেখা করতে এলুম। এই কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার শেষ দেখা।”

    সোমনাথের কথা শেষ হতে না হতে, সীতেশ ঈষৎ অধীর ভাবে বললেন,–

    “দেখ, এ সব কথা তুমি এইমাত্র বানিয়ে বলছ! তুমি ভুলে গেছ যে খানিক আগে তুমি বলেছ যে, সেই B-তে “রিণীর” সঙ্গে তোমার শেষ দেখা। তোমার মিথ্যে কথা হাতে হাতে ধরা পড়েছে?”

    সোমনাথ তিলমাত্র ইতস্ততঃ না করে উত্তর দিলেন “আগে যা বলেছিলুম সেই কথাটাই মিথ্যে—আর এখন যা বলছি তা-ই সত্যি। গল্পের একটা শেষ হওয়া চাই বলে আমি ঐ জায়গায় শেষ করেছিলুম। কিন্তু প্রকৃত জীবনে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যা অমন করে শেষ হয় নি। সে প্যারিসের দেখাও শেষ দেখা নয়, তারপর লণ্ডনে “রিণীর” সঙ্গে আমার বহুবার অমন শেষ দেখা হয়েছে।”

    সীতেশ বললেন—

    “তোমার কথা আমি বুঝতে পারছিনে। এর একটা শেষ হয়েছে, হয়নি?”

    –হয়েছে।

    —কি করে?

    —বিয়ের বছরখানেক পরেই George-এর সঙ্গে “রিণীর” ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আদালতে প্রমাণ হয় যে, George “রিণী”কে প্রহার করতে সুরু করেছিলেন, তাও আবার মদের ঝোঁকে নয়, ভালবাসার বিকারে। তারপর “রিণী” Spain-এর একটি Convent-এ চিরজীবনের মত আশ্রয় নিয়েছে।

    সীতেশ মহা উত্তেজিত হয়ে বললেন, “George তার প্রতি ঠিক ব্যবহারই করেছিল। আমি হলেও তাই করতুম।”

    সোমনাথ বললেন–

    “সম্ভবতঃ ও অবস্থায় আমিও তাই করতুম। ও ধর্মজ্ঞান, ও বলবীর্য আমাদের সকলেরি আছে! এই জন্যই ত দুর্বলের পক্ষে—

    ‘O crux! ave unica spera’ * এই হচ্ছে মানবমনের শেষ। কথা।”

    সীতেশ উত্তর করলেন—

    “তোমার বিশ্বাস তোমার ‘রিণী” একটি অবলা— জান সে কি? একসঙ্গে চোর আর পাগল!”

    সোমনাথ ইতিমধ্যে একটি সিগরেট ধরিয়ে, আকাশের দিকে চেয়ে অম্লান বদনে বললেন–

    “আমি যে বিশেষ অনুকম্পার পাত্র, এমন ত আমার মনে হয় না। কেননা পৃথিবীতে যে ভালবাসা খাটি, তার ভিতর পাগলামি ও প্রবঞ্চনা দুইই থাকে, ঐ টুকুইত ওর রহস্য।”

    সীতেশের কাণে এ কথা এতই অদ্ভুত, এতই নিষ্ঠুর ঠেকল যে, তা শুনে তিনি একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন। কি উত্তর করবেন ভেবে পেয়ে অবাক হয়ে রইলেন।

    সেন বললেন “বাঃ সোমনাথ বাঃ! এতক্ষণ পরে একটা-কথার মত কথা বলেছ—এর মধ্যে যেমন নূতনত্ব আছে, তেমনি বুদ্ধির খেলা আছে। আমাদের মধ্যে তুমিই কেবল, মনোজগতে নিত্য নতুন সত্যের আবিষ্কার করতে পার।”

    সীতেশ আর ধৈর্য ধরে থাকতে না পেরে বলে উঠলেন–

    “অতিবুদ্ধির গলায় দড়ি—এ কথা যে কতদূর সত্য, তোমাদের এই সব প্রলাপ শুনলে তা বোঝা যায়!”–

    সোমনাথ তাঁর কথার প্রতিবাদ সহ্য করতে পারতেন না, অর্থাৎ কেউ তার লেজে পা দিলে তিনি তখনি উল্টে তাকে ছোবল মারতেন, আর সেই সঙ্গে বিষ ঢেলে দিতেন। যে কথা তিনি শানিয়ে বলতেন, সে কথা প্রায়ই বিষদিগ্ধ-বাণের মত লোকের বুকে গিয়ে বিঁধত।

    সোমনাথের মতের সঙ্গে তাঁর চরিত্রের যে বিশেষ কোনও মিল ছিল, তার প্রমাণ ত তাঁর প্রণয়কাহিনী থেকেই স্পষ্ট পাওয়া যায়। গরল তাঁর কণ্ঠে থাকলেও, তার হৃদয়ে ছিল না। হাড়ের মত কঠিন ঝিনুকের মধ্যে যেমন জেলির মত কোমল দেহ থাকে, সোমনাথেরও তেমনি অতি কঠিন মতামতের ভিতর অতি কোমল মনোভাব লুকিয়ে থাকত। তাই তাঁর মতামত শুনে আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হত না, যা হত তা হচ্ছে ঈষৎ চিত্তচাঞ্চল্য, কেননা তার কথা যতই অপ্রিয় হোক, তার ভিতর থেকে একটি সত্যের চেহারা উকি মারত,–যে সত্য আমরা দেখতে চাইনে বলে দেখতে পাইনে।

    এতক্ষণ আমরা গল্প বলতে ও শুনতে এতই নিবিষ্ট ছিলুম যে, বাইরের দিকে চেয়ে দেখবার অবসর আমাদের কারও হয়নি। সকলে যখন চুপ করলেন, সেই ফাঁকে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি মেঘ কেটে গেছে, আর চাঁদ দেখা দিয়েছে। তার আলোয় চারিদিক ভরে গেছে, আর সে আলো এতই নির্মল, এতই কোমল যে, আমার মনে হল যেন বিশ্ব তার বুক খুলে আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছে তার হৃদয় কত মধুর আর কত করুণ। প্রকৃতির এ রূপ আমরা নিত্য দেখতে পাইনে বলেই আমাদের মনে ভয় ও ভরসা, সংশয় ও বিশ্বাস, দিন রাত্তিরের মত পালায় পালায় নিত্য যায় আর আসে।

    অতঃপর আমি আমার কথা সুরু করলুম।

    1 2 3 4 5
    Share. Facebook Twitter Pinterest LinkedIn Tumblr Email Reddit VKontakte Telegram WhatsApp Copy Link
    Previous Articleসনেট-পঞ্চাশৎ – প্রমথ চৌধুরী
    Next Article কেরী সাহেবের মুন্সী – প্রমথনাথ বিশী

    Related Articles

    প্রমথ চৌধুরী

    সনেট-পঞ্চাশৎ – প্রমথ চৌধুরী

    September 22, 2025
    প্রমথ চৌধুরী

    বীরবলের হালখাতা – প্রমথ চৌধুরী

    September 22, 2025
    প্রমথ চৌধুরী

    প্রবন্ধ সংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    প্রমথ চৌধুরী

    গল্পসংগ্রহ – প্রমথ চৌধুরী

    September 20, 2025
    Add A Comment
    Leave A Reply Cancel Reply

    Demo
    Most Popular

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Demo
    Latest Reviews

    বাংলা গল্প শুনতে ভালোবাসেন? এক পাতার বাংলা গল্পের সাথে হারিয়ে যান গল্পের যাদুতে।  আপনার জন্য নিয়ে এসেছে সেরা কাহিনিগুলি, যা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। সহজ ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক উপস্থাপনায়, এই গল্পগুলি আপনাকে এক নতুন অভিজ্ঞতা দেবে। এখানে পাবেন নিত্যনতুন কাহিনির সম্ভার, যা আপনাকে বিনোদিত করবে এবং অনুপ্রাণিত করবে।  শেয়ার করুন এবং বন্ধুদের জানাতে ভুলবেন না।

    Top Posts

    হর্ষবর্ধনের বাঘ শিকার

    January 4, 2025

    দোকানির বউ

    January 5, 2025

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025
    Our Picks

    দারোগার দপ্তর ৩ – প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়

    September 22, 2025

    আরব জাতির ইতিহাস – ফিলিপ কে. হিট্টি (অনুবাদ : প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ)

    September 22, 2025

    নিউ মুন – স্টেফিন মেয়ার

    September 22, 2025
    Facebook X (Twitter) Instagram Pinterest
    • Home
    • Disclaimer
    • Privacy Policy
    • DMCA
    • Contact us
    © 2025 Ek Pata Golpo. Designed by Webliance Pvt Ltd.

    Type above and press Enter to search. Press Esc to cancel.

    Sign In or Register

    Welcome Back!

    Login below or Register Now.

    Lost password?

    Register Now!

    Already registered? Login.

    A password will be e-mailed to you.