চিত্রাঙ্গদা – ০৩
৩ |
|
তরুতলে চিত্রাঙ্গদা |
|
চিত্রাঙ্গদা। | হায়, হায়, সে কি ফিরাইতে পারি! সেই থরথর ব্যাকুলতা বীরহৃদয়ের তৃষার্ত কম্পিত এক ষ্ফুলিঙ্গনিশ্বাসী হোমাগ্নিশিখার মতো; সেই, নয়নের দৃষ্টি যেন অন্তরের বাহু হয়ে কেড়ে নিতে আসিছে আমায়; উত্তপ্ত হৃদয় ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্বাঙ্গ টুটিয়া, তাহার ক্রন্দনধ্বনি প্রতি অঙ্গে যেন যায় শুনা। এ তৃষ্ণা কি ফিরাইতে পারি? বসন্ত ও মদনের প্রবেশ হে অনঙ্গদেব, এ কী রূপহুতাশনে ঘিরেছ আমারে, দগ্ধ হই, দগ্ধ করে মারি। |
মদন। | বলো, তন্বী, কালিকার বিবরণ। মুক্ত পুষ্পশর মোর কোথা কী সাধিল কাজ শুনিতে বাসনা। |
চিত্রাঙ্গদা। | কাল সন্ধ্যাবেলা সরসীর তৃণপুঞ্জ তীরে পেতেছিনু পুষ্পশয্যা, বসন্তের ঝরা ফুল দিয়ে। শ্রান্ত কলেবরে শুয়েছিনু আনমনে, রাখিয়া অলস শির বামবাছ’পরে ভাবিতেছিলাম গতদিবসের কথা। শুনেছিনু যেই স্তুতি অর্জুনের মুখে আনিতেছিলাম তাহা মনে; দিবসের সঞ্চিত অমৃত হতে বিন্দু বিন্দু লয়ে করিতেছিলাম পান; ভুলিতেছিলাম পূর্ব ইতিহাস, গতজন্মকথাসম। যেন আমি রাজকন্যা নহি; যেন মোর নাই পূর্বপর; যেন আমি ধরাতলে একদিনে উঠেছি ফুটিয়া, অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল; শুধু এক বেলা পরমায়ু, তারি মাঝে শুনে নিতে হবে ভ্রমরগুঞ্জনগীতি, বনবনান্তের আনন্দমর্মর; পরে নীলাম্বর হতে ধীরে নামাইয়া আঁখি, নুয়াইয়া গ্রীবা, টুটিয়া লুটিয়া যাব বায়ুস্পর্শভরে ক্রন্দনবিহীন, মাঝখানে ফুরাইবে কূসুমকাহিনীখানি আদিঅন্তহারা। |
বসন্ত। | একটি প্রভাতে ফুটে অনন্ত জীবন, হে সুন্দরী। |
মদন। | সংগীতে যেমন, ক্ষণিকের তানে, গুঞ্জরি, কাঁদিয়া ওঠে অন্তহীন কথা। তার পরে বলো। |
চিত্রাঙ্গদা। | ভাবিতে ভাবিতে সর্বাঙ্গে হানিতেছিল ঘুমের হিল্লোল দক্ষিণের বায়ু। সপ্তপর্ণশাখা হতে ফুল্ল মালতীর লতা আলস্য-আবেশে মোর গৌরতনু’পরে পাঠাইতেছিল নিঃশব্দ চুম্বন; ফুলগুলি কেহ চুলে, কেহ পদতলে, কেহ স্তনতটমূলে বিছাইল আপনার মরণশয়ন। অচেতনে গেল কত ক্ষণ। হেনকালে ঘুমঘোরে কখন করিনু অনুভব যেন কার মুগ্ধ নয়নের দৃষ্টিপাত দশ অঙ্গুলির মতো পরশ করিছে রভসলালসে মোর নিদ্রালস তনু। চমকি উঠিনু জাগি। দেখিনু, সন্ন্যাসী পদপ্রান্তে নির্নিমেষ দাঁড়ায়ে রয়েছে স্থিরপ্রতিমূর্তিসম। পূর্বাচল হতে ধীরে ধীরে সরে এসে পশ্চিমে হেলিয়া দ্বাদশীর শশী, সমস্ত হিমাংশুরাশি দিয়াছে ঢালিয়া, স্খলিতবসন মোর অম্লাননূতন শুভ্র সৌন্দর্যের ‘পরে। পুষ্পগন্ধে পূর্ণ তরুতল ঝিল্লিরবে তন্দ্রামগ্ন নিশীথিনী; স্বচ্ছ সরোবরে অকম্পিত চন্দ্রকরচ্ছায়া; সুপ্ত বায়ু; শিরে লয়ে জ্যোৎস্নালোকে মসৃণ চিক্কণ রাশি রাশি অন্ধকার পল্লবের ভার স্তম্ভিত অটবী। সেইমতো চিত্রার্পিত দাঁড়াইয়া, দীর্ঘকায় বনষ্পতিসম, দণ্ডধারী ব্রক্ষ্ণচারী ছায়াসহচর। প্রথম সে নিদ্রাভঙ্গে চারি দিক চেয়ে মনে হল, কনে কোন্ বিস্মৃত প্রদোষে জীবন ত্যজিয়া, স্বপ্নজন্ম লভিয়াছি কোন্ এক অপরূপ মোহনিদ্রালোকে, জনশূন্য ম্লানজ্যোৎস্না বৈতরণীতীরে। দাঁড়ানু উঠিয়া। মিথ্যা শরম সংকোচ খসিয়া পড়িল শ্লথ বসনের মতো পদতলে। শুনিলাম, “প্রিয়ে, প্রিয়তমে!” গম্ভীর আহ্বানে, মোর এক দেহমাঝে জন্ম জন্ম শতজন্ম উঠিল জাগিয়া। কহিলাম, “লহো, লহো, যাহা কিছু আছে সব লহো জীবনবল্লভ!” দুই বাহু দিলাম বাড়ায়ে।– চন্দ্র অস্ত গেল বনে, অন্ধকারে ঝাঁপিল মেদিনী। স্বর্গমর্ত দেশকাল দুঃখসুখ জীবনমরণ অচেতন হয়ে গেল অসহ্য পুলকে। প্রভাতের প্রথম কিরণে, বিহঙ্গের প্রথম সংগীতে, বাম করে দিয়া ভর ধীরে ধীরে শয্যাতলে উঠিয়া বসিনু। দেখিনু চাহিয়া, সুখসুপ্ত বীরবর। শ্রান্ত হাস্য লেগে আছে ওষ্ঠপ্রান্তে তাঁর প্রভাতের চন্দ্রকলাসম, রজনীর আনন্দের শীর্ণ অবশেষ। নিপতিত উন্নত ললাটপটে অরুণের আভা; মর্ত্যলোকে যেন নব উদয়পর্বতে নবকীর্তি-সূর্যোদয় পাইবে প্রকাশ। উঠিনু শয়ন ছাড়ি নিশ্বাস ফেলিয়া; মালতীর লতাজাল দিলাম নামায়ে সাবধানে, রবিকর করি অন্তরাল সুপ্তমুখ হতে। দেখিলাম চতুর্দিকে সেই পূর্বপরিচিত প্রাচীন পৃথিবী। আপনারে আরবার মনে পড়ে গেল, ছুটিয়া পলায়ে এনু, নবপ্রভাতের শেফালিবিকীর্ণতৃণ বনস্থলী দিয়ে, আপনার ছায়াত্রস্তা হরিণীর মতো। বিজনবিতানতলে বসি, করপুটে মুখ আবরিয়া, কাঁদিবারে চাহিলাম, এল না ক্রন্দন। |
মদন। | হায়, মানবনন্দিনী, স্বর্গের সুখের দিন সহস্তে ভাঙিয়া ধরণীর এক রাত্রি পূর্ণ করি তাহে যত্নে ধরিলাম তব অধরসন্মুখে– শচীর প্রসাদসুধা, রতির চুম্বিত, নন্দনবনের গন্ধে মোদিত-মধুর– তোমারে করানু পান, তবু এ ক্রন্দন! |
চিত্রাঙ্গদা। | কারে, দেব, করাইলে পান! কার তৃষা মিটাইলে! সে চুম্বন, সে প্রেমসংগম এখনো উঠিছে কাঁপি যে-অঙ্গ ব্যাপিয়া বীণার ঝংকার-সম, সে তো মোর নহে! বহুকাল সাধনায় এক দণ্ড শুধু পাওয়া যায় প্রথম মিলন, সে মিলন কে লইল লুটি, আমারে বঞ্চিত করি। সে চিরদুর্লভ মিলনের সুখস্মৃতি সঙ্গে করে ঝরে পড়ে যাবে অতিষ্ফুট পুষ্পদলসম, এ মায়ালাবণ্য মোর; অন্তরের দরিদ্র রমণী, রিক্তদেহে বসে রবে চিরদিনরাত। মীনকেতু, কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়াছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি ছায়ার মতন– কী অভিসম্পাত! চিরন্তন তৃষ্ণাতুর লোলুপ ওষ্ঠের কাছে আসিল চুম্বন, সে করিল পান। সেই প্রেমদৃষ্টিপাত– এমনি আগ্রহপূর্ণ, যে-অঙ্গেতে পড়ে সেথা যেন অঙ্কিত করিয়া রেখে যায় বাসনার রাঙা চিহ্নরেখা– সেই দৃষ্টি রবিরশ্মিসম, চিররাত্রিতাপসিনী- কুমারী-হৃদয়পদ্মপানে ছুটে এল, সে তাহারে লইল ভুলায়ে। |
মদন। | কল্য নিশি ব্যর্থ গেছে তবে! শুধু কূলের সন্মুখে এসে আশার তরণী, গেছে ফিরে ফিরে তরঙ্গ-আঘাতে? |
চিত্রাঙ্গদা। | কাল রাত্রে কিছু নাহি মনে ছিল দেব। সুখস্বর্গ এত কাছে দিয়েছিল ধরা, পেয়েছি কি না পেয়েছি করি নি গণনা আত্মবিস্মরণসুখে। আজ প্রাতে উঠে, নৈরাশ্যধিক্কারবেগে অন্তরে অন্তরে টুটিছে হৃদয়। মনে পড়িতেছে একে একে রজনীর কথা। বিদ্যুৎবেদনাসহ হতেছে চেতনা অন্তরে বাহিরে মোর হয়েছে সতিন, আর তাহা নারিব ভুলিতে। সপত্নীরে স্বহস্তে সাজায়ে সযতনে, প্রতিদিন পাঠাইতে হবে, আমার আকাঙক্ষা-তীর্থ বাসরশয্যায়; অবিশ্রাম সঙ্গে রহি প্রতিক্ষণ দেখিতে হইবে চক্ষু মেলি তাহার আদর। ওগো, দেহের সোহাগে অন্তর জ্বলিবে হিংসানলে, হেন শাপ নরলোকে কে পেয়েছে আর। হে অতনু বর তব ফিরে লও। |
মদন। | যদি ফিরে লই, ছলনার আবরণ খুলে ফেলে দিয়ে কাল প্রাতে কোন্ লাজে দাঁড়াইবে আসি পার্থের সন্মুখে, কুসুমপল্লবহীন হেমন্তের হিমশীর্ণ লতা? প্রমোদের প্রথম আস্বাদটুকু দিয়ে, মুখ হতে সুধাপাত্র কেড়ে নিয়ে চূর্ণ কর যদি ভূমিতলে, অকস্মাৎ সে আঘাতভরে চমকিয়া, কী আক্রোশে হেরিবে তোমায়। |
চিত্রাঙ্গদা। | সেও ভালো। এই ছদ্মরূপিণীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আমি শতগুণে। সেই আপনারে করিব প্রকাশ; ভালো যদি নাই লাগে, ঘৃণাভরে চলে যান যদি, বুক ফেটে মরি যদি আমি, তবু আমি– আমি রব। সেও ভালো, ইন্দ্রসখা। |
বসন্ত। | শোনো মোর কথা। ফুলের ফুরায় যবে ফুটিবার কাজ তখন প্রকাশ পায় ফল। যথাকালে আপনি ঝরিয়া প’ড়ে যাবে, তাপক্লিষ্ট লঘু লাবণ্যের দল; আপন গৌরবে তখন বাহির হবে; হেরিয়া তোমারে নূতন সৌভাগ্য বলি মানিবে ফাল্গুনী। যাও ফিরে যাও, বৎসে, যৌবন-উৎসবে। |