সহযাত্রী – ১০
।। ১০।।
হাতের চেটোতে অসম্ভব ব্যথা হয়েছে দেবলীনার। হাঁটুটাও বোধহয় একটু ছড়েছে। তবুও হার স্বীকার করেনি ও। দিগন্তর পিছন পিছন একবারও আঃ উঃ না করেই উঠেছে ওদের লক্ষ্য পর্যন্ত। তবে নামার সময় ওর ক্লান্ত মুখটা দেখেই বোধহয় বারবার নিজের হাতটা বাড়িয়ে দিচ্ছিল দিগন্ত। না, জেদ করেই দেবলীনা ধরেনি ওর হাত। হেসে বলেছে, আপনার রাই সুন্দরী রাগ করবে। আমি ম্যানেজ করে নেব। নামার সময়েই একবার পা হড়কেছিল দেবলীনার, দিগন্ত প্রায় চিৎকার করে বলেছিল, হাতটা ধরো, বলেছিলাম না, অবাধ্য হবে না। কথা শোনো দেবলীনা প্লিজ। এটা ছেলেমানুষি করার জায়গা নয়। দেবলীনা পাহাড়ের দুর্গম রাস্তা, কাছের আকাশ আর এবড়োখেবড়ো পাথরকে সাক্ষী রেখে চেপে ধরেছিল দিগন্তকে। মনে মনে বলেছিল, আর কেউ আসবে না আমার জীবনে। আজকের এই মুহূর্তটুকুকে নিয়েই বাঁচবো আমি। এটাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পাওয়া হয়ে থাকবে। এক হেঁচকা টানে দিগন্তর বুকের কাছে মুখ রেখেছিলো ও। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাসের উত্তাপে নিজেকে শান্ত করেছিল দেবলীনা। মনে মনে বলেছিল, সব পাওয়ার নামই শুধু ভালোবাসা নয়, হারিয়েও পূর্ণ হওয়ার নাম ভালোবাসা। যেমন দিগন্তকে কোনোদিন নিজের করে পাবে না জেনেও ভালোবাসতে আর বাধা নেই দেবলীনার। রাই আর দিগন্ত ভালো থাক, কিন্তু ওর একতরফা ভালোবাসার অধিকার তো দিগন্ত কখনো কেড়ে নিতে পারবে না, তাই আজ থেকে দিগন্ত ওরও।
কানের কাছে ফিসফিস করে দিগন্ত বললো, প্লিজ বি কেয়ারফুল। এখুনি একটা বিপদ ঘটে যেত। আমার হাত ধরে নামো তুমি। দেবলীনা আদুরে গলায় বলল, আমার তৃতীয় শর্তটাও তুমি মেনে নিলে তাহলে। সব প্রাপ্তির আনন্দে আত্মহারা আমি। আরেকটু থাকি এই পাথরের খাঁজে, এই সবজে ধূসর পাথরটা আমাকে অনেক কিছু দিলো যে। মৃত্যুর মুখে দাঁড় করিয়ে জীবনের মন্ত্র শেখালো, ভালোবাসা শব্দের মানে বোঝালো। আরেকটু থাকি দিগন্ত প্লিজ।
দিগন্ত আরক্ত মুখে বললো, দেবলীনা এভাবে আমায় দুর্বল করে দিও না। আমি রাইয়ের কাছে কথা দিয়েছিলাম, ওকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসবো না। দেবলীনা বললো, কে বলেছে তোমায় প্রতিশ্রুতি ভাঙতে? কিন্তু তোমার আর তোমার রাইয়ের কোনো ক্ষমতাই নেই আমার কাছ থেকে এই অধিকারটাও ছিনিয়ে নেবে!
দিগন্ত খুব সাবধানে হাতটা ধরে ধরে ওকে নামিয়েছিল। দেবলীনা বুঝেছিলো, এই অনুভূতিকেই বলে সর্বস্ব বিলিয়ে দিয়েও পরিপূর্ণ হওয়া। দেবলীনা আজ পরিপূর্ণ। সৃজনের সাথে ব্রেকআপের দুঃখ নেই, দিগন্তকে নিজের করে পাওয়ার আগ্রাসী বাসনা নেই, তবুও ওর সব আছে। ভালোবাসা শব্দের ম্যাজিক্যাল উপলব্ধি আছে ওর মনের গোপন কুঠুরিতে। নীল আকাশ আর অহংকারী পাহাড়কে সাক্ষী রেখেই ও প্রতিজ্ঞা করলো, তুমি ছাড়া এই হাত আর কেউ ছোঁবে না দিগন্ত। এই মনের দরজায় আর কাউকে প্রবেশ করতে দেব না আমি। নিজের ঘরে বসে সকালের অভিজ্ঞতার কথা ভাবছিলো দেবলীনা। শরীরে অসহ্য ব্যথা সত্ত্বেও ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা। দরজায় নক করছে কেউ। উঠে দরজাটা খুলতেই একটা ওষুধ হাতে দিয়ে দিগন্ত বললো, খেয়ে নিও, ব্যথা থাকলে কমে যাবে। তোমার ফেরার টিকিট যেন কবে?
দেবলীনা জোরে একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বললো, তোমার একদিন আগেই। আর মাত্র কালকের দিনটা জ্বালাবো তোমায়। তারপর হারিয়ে যাব তিলোত্তমার জন সমুদ্রে। তবে তুমি নিমন্ত্রণ না করলেও, তোমার আর রাইয়ের সাথে দেখা করতে আমি ঠিক একদিন পৌঁছে যাবো তোমাদের বাড়ি। এই দিগন্ত, তোমাদের বাড়ির অ্যাড্রেসটা দিলে না তো? আর রাইয়ের নম্বরটাও দাও, তার কাছেও আমি ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ, অন্তত একবার ফোন করে থ্যাংকস জানাতে চাই।
দিগন্ত দীর্ঘশ্বাসটা গোপন না করেই বললো, আমাদের পরিচয়টা বোধহয় এখানেই শেষ হলে ভালো হয়।
দেবলীনা আবার আদুরে ঢঙে বললো, বিশ্বাস করতে পারছো না আমায়, তাই তো? ভাবছো নিজের স্বার্থের জন্য ভেঙে দেব তোমাদের জন্মমুহূর্ত থেকে তৈরি হওয়া সম্পর্কটাকে! আরে না দিগন্ত, আমি বেঁচে থাকতে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না।
দিগন্ত বললো, বেশ নোট করে নাও তবে। কিন্তু ফোন না করলেই আমি খুশি হবো। রাই বড্ড অবুঝ, শেষে ভুল না বুঝে বসে। তবে তোমাকে অবিশ্বাস করিনা বোঝাতেই দিলাম নম্বরটা। আমার বাড়ির অ্যাড্রেস তো আগেই বলেছি, সুযোগ হলে এসো একদিন।
দেবলীনা বললো, দেখো জানালা দিয়ে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, পাহাড়ের গায়ে গায়ে কেউ খেলনা বাড়ি দিয়ে ঝুলন সাজিয়ে রেখেছে। আর ঝুলনের বাড়িগুলোতে এখন একটা করে প্রদীপ জ্বলছে। আচ্ছা দিগন্ত, ঝুলন শেষ হলে আমরাও তো যে যার নিজের নিজের খেলনা গুছিয়ে বাড়ি ফিরতাম। ভেঙে যেত সাজানো শহরটা। পড়ে থাকতো কাঠের গুঁড়ো, বালি, ঘাসের চাঁই। কিন্তু কতটা জায়গা জুড়ে তৈরি হয়েছিল ঝুলনের শহর সেটা বেশ বোঝা যেত। একটা দাগ থেকেই যেত তাই না!
যতদিন না বৃষ্টি হতো ততদিন রয়ে যেত ঝুলন সাজানোর চিহ্ন। ধরো কোনোদিনও নামলো না বৃষ্টি, তাহলে তো ওই দাগ রয়েই যাবে, তাই না? আমি যদি রাবাংলার এই স্মৃতিটুকুকে আঁকড়ে ধরে রাখি, যদি ধুয়ে যেতে না দিই চোখের নোনতা জলে, তাহলেও কি তোমার আপত্তি থাকবে? থাকলেও আমি অপারগ দিগন্ত। বিশ্বাস করো, আমি নিরুপায়।
দিগন্ত চলে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বললো, ভালো থেকো দেবলীনা। হয়তো দেখা হবে না আর কোনোদিন, তবু তুমিও থাকবে ঝুলন শেষ হওয়া ভাঙা চিহ্নের মধ্যে।
দিগন্তর চোখ দুটো ছলছল করছে, সেদিকে অপলক তাকিয়ে আছে লীনা। প্রাপ্তি, এই তো ওর প্রাপ্তি। দিগন্তর চোখের কোণে জমে থাকা ওই বিন্দুমাত্র বাষ্পটা অন্তত রাইয়ের জন্য নয়, ও নিশ্চিত ওই বাষ্পটুকু শুধুই ওর, একান্তভাবেই ওর।
পরের দিন ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই দিগন্তকে আর দেখতে পেল না দেবলীনা। রিসেপশনে বললো, খুব ভোরে উঠে গাড়ি চেয়েছিলেন উনি। তারপর বেরিয়ে গেছেন বোরং-এর দিকেই। দেবলীনা নিজের মনেই হেসে বললো, সেকি দিগন্ত, শেষ পর্যন্ত পালাতে হলো তোমাকে আমার কাছ থেকে! পাছে দুর্বলতা প্রকাশ করে ফেল, পাছে অপমান করে ফেল তোমার রাইয়ের ভালোবাসাকে। মনে মনে শ্রদ্ধায় মাথা নত করলো দেবলীনা। রাইয়ের প্রতি এতটা গভীর ভালোবাসা দেখে সত্যিই দিগন্তর প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো ওর। যাক এতদিন পরে অন্তত এমন একটা মানুষের সান্নিধ্য পেল, যাকে সর্বস্ব উজাড় করে ভালোবাসা যায়, অন্তত অপাত্রে দান করা হবে না। দুহাত ভরে ওর অনুভূতিদের আপন করে না নিক দিগন্ত, ওর তো দিতে কোনো বাধা নেই। বন্ধ থাকুক দিগন্তর মুঠো, পড়ে যাক অনামি রাস্তার ধারে, তবুও দেবলীনার দিয়েই শান্তি।
বেশ সন্ধে করে হোটেলে ফিরল দিগন্ত। এসেই হালকা গলায় বলল, তোমার প্যাকিং কমপ্লিট?
দেবলীনা একটা শ্বেত পাথরের বুদ্ধমূর্তি ওর হাতে দিয়ে বললো, একটা ছোট্ট গিফট তোমাদের দুজনের জন্য। আমি কাল ভোরেই বেরোবো দিগন্ত, হয়তো তোমার সাথে দেখা হবে না। একটাই অনুরোধ করবো, আমায় মনে রেখো না। গুড নাইট দিগন্ত।
বুদ্ধ মূর্তিটা হাতে নিয়ে চলে গেল দিগন্ত। দেবলীনা ঝাপসা চোখে তাকিয়ে ওর চলে যাওয়ার মুহূর্তটুকুকে দেখছিলো। মনে হচ্ছিল, একটা দ্রুতগামী ট্রেন স্টেশন ছেড়ে চলে গেল। দেবলীনার ধরার কথা ছিল ট্রেনটা, কিন্তু অনেক দৌড়েও ধরতে পারলো না। চুপচাপ কাঠের চেয়ারে বসে ট্রেনের ঝমঝম আওয়াজটা শুনলো, আর চলে যাওয়া দেখলো।
।। ১১।।
দিগন্ত আশা করেছিল, দেবলীনা যাওয়ার সময় দেখা করে যাবে। কিন্তু রিসেপশনের মেয়েটি জানালো, ম্যাডাম তো ঘন্টাখানেক আগেই বেরিয়ে গেছেন। আপনাদের দুজনের খাওয়া-দাওয়ার সব বিল পেমেন্ট করলেন, তারপর গেলেন। ওহ, আপনার জন্য এই মেসেজটা রেখে গেছেন উনি। দিগন্ত হাত বাড়িয়ে নিলো ছোট্ট চিরকুটটা। আজ আকাশ একেবারে ঝকঝক করছে, ব্যালকনি থেকেই দেখা যাচ্ছে সকলের থেকে নিজেকে স্বতন্ত্র করে রাখা বরফ ঢাকা কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। দেবলীনা বলেছিল, যেদিন আকাশ খুব ক্লিয়ার থাকবে, সেদিন তুমি আর আমি সামনে ধোঁয়া ওঠা কফি নিয়ে বসে দেখবো মহারানী কাঞ্চনজঙ্ঘাকে। দেবলীনার ইচ্ছেপূরণ করতে পারলো না দিগন্ত। গতকালও আকাশ ক্লিয়ার ছিল। কিন্তু ওর থেকে পালাতে হবে ভেবেই ভোর ভোর গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল বোরং-এর পথে। দিগন্ত বুঝেছিলো, চোখের আড়াল হলেও মনের আড়াল করা অনেক সময় সম্ভব হয়না। তাই ওই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামের সীমান্তে বসে বসেও ও ভাবছিলো দেবলীনারই কথা। নিজের দৃষ্টিপথকে স্বচ্ছ করার আপ্রাণ চেষ্টা করলেও দেবলীনার চোখের গভীর চাউনিটা বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিলো দিগন্তর সামনে। অনেক চেষ্টা করেও রাইকে বসাতে পারছিল না চোখের সামনে। কেন যে সব এলোমেলো হয়ে যায়! কেন যে আবার ভালোবাসা নামক মোহময়ী শব্দ জালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে ও কে জানে! নিজের মনকে শক্ত করে ভেবেছিল দিগন্ত, কথাতেই আছে আউট অফ সাইড আউট অফ মাইন্ড। দেবলীনা তো কালকেই ফিরে যাবে কলকাতা, তারপর আর কোনো যোগাযোগই থাকবে না ওর সাথে। তখন তো ওর জীবনে চাকরি, ক্লাবের বন্ধুরা আর ওর রাই। এই কয়েক ঘন্টার দুর্বলতাকে জয় করতে পারলেই জিতে যাবে দিগন্ত। প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হবে না রাইয়ের কাছে। অবশেষে চারদিনের ট্রিপ কাটিয়ে ফিরে গেছে দেবলীনা। ও এখন সম্পূর্ণ মুক্ত। ভয়ে ভয়ে তাকালো দেবলীনার রুমটার দিকে, মনে হলো যেন এখুনি ঘুম চোখে বেরিয়ে এসে বলবে, দিগন্ত, তুমি একা একা কফি খেয়ে নিলে? কি হিংসুটে তুমি! দাঁড়াও নালিশ করবো তোমার পুচু সোনার কাছে। নয়তো আব্দারের গলায় বলে বসবে, আজ ভেবেছি মাথায় পাহাড়ি ফুল গুঁজে ছবি তুলবো। তুলে দেবে ছবিটা?
কতরকমের বায়না যে করছিল এই কটা দিনে তার হিসেব নেই। ভীষণ ফাঁকা ফাঁকা লাগছে দিগন্তর। দেবলীনার রেখে যাওয়া ছোট্ট চিরকুটটা খুললো দিগন্ত।
দিগন্ত,
চললাম, খুব ইচ্ছে করছিল যাওয়ার সময় তোমার ঘুমন্ত মুখটা একবার অন্তত দেখে যাই। আর হয়তো দেখা হবে না আমাদের কোনোদিন। না হলেও ক্ষতি নেই, নিরস, কঠোর পাহাড় আমায় যা দিয়েছে তার ঋণ আমি কখনো শোধ করতে পারবো না। কখনো কখনো আমরা মোহ, ভালোলাগা এগুলোর সমার্থক শব্দ হিসাবে ভালোবাসা শব্দটাকে বসিয়ে ফেলি। বহুদিন পরে আবিষ্কার করি, ওটা আসলে ভালোবাসা ছিলই না। তুমিই একমাত্র মানুষ যে আমাকে ভালোবাসা শব্দের সঠিক অর্থ বুঝতে সাহায্য করেছ। আমি কৃতজ্ঞ তোমার কাছে। ভালো থেকো দিগন্ত তোমার রাই সুন্দরীকে নিয়ে। না, তোমাদের বিয়েতে আমায় নিমন্ত্রণ করো না। আমি জানি ভালোবাসা বড্ড হিংসুটে হয়। তোমাকে স্বচক্ষে অন্যের হতে দেখার থেকে মৃত্যু শ্রেয়। আমার পরিচয় তোমার কাছে শুধুই সহযাত্রী হয়ে থাকুক।
স্যার, এনি প্রবলেম? আপনার গাড়ি রেডি, বেরোবেন বলেছিলেন।
দিগন্ত অপ্রস্তুত হাতে নিজের ভিজে যাওয়া গাল দুটো মুছে নিলো। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, আজ আর বেরোবো না। কাল একেবারে ট্রেন ধরতে যাবো।
ছেলেটি কি বুঝলো কে জানে, তবে চুপচাপ চলে গেল। দেবলীনার ঘরটাতে বোধহয় নতুন বোর্ডার আসবে। ঘরটা ওয়াশ করার জন্য দুটো ছেলে মেয়ে ঢুকতে যাচ্ছিল ঘরটাতে, ওদের দরজার কাছে থামিয়ে দিয়ে দিগন্ত বললো, তোমরা মিনিট দশেক পরে এস।
ঘরে ঢুকে বিছানার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলো দিগন্ত দেবলীনা কাল সারারাত ঘুমায় নি। নিভাঁজ বিছানা, বালিশই তার প্রমাণ বহন করছে। জানালার ধারে একটা চেয়ার রাখা। বোধহয় রাতটা ওই চেয়ারে বসেই কাটিয়েছে মেয়েটা। হয়তো নির্ঘুম রাতের প্রতিটা প্রহর গুণছে বসে বসে। অপেক্ষা করছিল কি অন্ধকার কেটে গিয়ে সূর্য ওঠার! এই পাঁচদিনে কোথা দিয়ে যে কি হয়ে গেল ওরা নিজেরাও বুঝতে পারলো না। তবে দিগন্ত যত চেষ্টাই করুক দেবলীনার চোখে ওর দুর্বলতা ধরা পড়ে গেছেই। দেবলীনার বসা চেয়ারেটাতে মিনিট দুয়েক বসলো দিগন্ত। বেতের চেয়ারে আটকে আছে দেবলীনার মাথার লম্বা একটা চুল। টুকরো স্মৃতির মতই ওটাও রয়ে গেছে দিগন্তর জন্যই। ড্রেসিং টেবিলে দুটো সেফটিপিন, একটা কালো টিপের পাতা। ওই পাতাটা থেকেই দুই ভ্রূর মাঝে টিপ পরছিল দেবলীনা। তিনটে টিপ ব্যবহার হয়েছে দেখা যাচ্ছে। নেহাতই অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো আনমনে নিজের পকেটে ঢুকিয়ে নিলো ও। বেরিয়ে এলো হালকা পায়ে। আজ আর ঘুরতে বেরোতে ইচ্ছে করছে না। একা একা ঠিক করে পৌঁছাতে পারবে তো মেয়েটা। একটা ফোন করে জানবে কি ট্রেন ছাড়ল কিনা!
ধুর, ও কেন এত চিন্তা করছে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক, শিক্ষিতা, চাকুরীরতা মেয়ে এন জি পি থেকে কলকাতা যাবে বাই ট্রেন, তাতে এত ভাবার কি আছে? ফোন করলেই দেবলীনা বুঝতে পারবে দিগন্ত মিস করছে ওকে। কিছুতেই না, এটা ওকে বুঝতে দেওয়া যাবে না।
সারাটা দিন দূরের পাহাড়ের হাতছানির দিকে তাকিয়ে আর গান শুনে কাটিয়ে দিলো দিগন্ত। আনমনে মাঝে মাঝে হেসে উঠছিল ও। দেবলীনার কিছু ছেলেমানুষি মনে পড়ে যাচ্ছিল। দিগন্ত বলেছিল, আপনাকে স্টুডেন্টরা ভয় পায় বলছেন? আমার কেমন যেন সন্দেহ হচ্ছে। বরং মনে হচ্ছে ইলেভেন টুয়েলভের ছেলেরা আপনাকে প্রোপোজ করে বসবে কোনোদিন। যা দিনকাল আসছে!
দেবলীনা রাগী রাগী গলায় বলেছিল, মোটেই না, আমি আপনার সাথে যেমন ফাজলামি করছি, স্কুলেতে সেটা কখনই করি না। তাই ছাত্ররা আমায় ভীষণ ভয় করে। এই দেখুন, আমি এরকম করে চোখ বড় বড় করলেই ওরা ভয় পেয়ে যায়। দিগন্ত দেখেছিলো, দেবলীনা সত্যিই চোখগুলোকে গোল গোল করে বড় করে রয়েছে। মুচকি হেসে ও বলেছিল, ওরে বাবা, আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। দেখি একটু ওয়াশরুম থেকে ঘুরে আসি।
মেয়েটার পাগলামিতে সাথ দিতে মন্দ লাগছিলো না দিগন্তর। একাকীত্ব শব্দটা যে ভয়ঙ্কর একা সেটা দিগন্তও বোঝে। এই কদিন দেবলীনা সঙ্গে থাকায় একাকীত্বের উৎপাত সহ্য করতে হয়নি ওকে।
যত সময় যাচ্ছিল দিগন্তর টেনশন তত বাড়ছিল। ওর হোয়াটসআপ চেক করে দেখলো, লাস্ট সিন দেখাচ্ছে গতকাল রাত দুটো। তারপর আর অন হয়নি মেয়েটা। ফোন নিয়ে খুটখাট করার অভ্যাস তো ভালোই আছে দেবলীনার। দিগন্তর অবশ্য এসব ফেসবুক টেসবুক মোটেই ভালোলাগে না। তবে দেবলীনা ছবি তুলেই পোস্ট করছিল ফেসবুকে। ওর অ্যাকাউন্টে এই প্রথম উঁকি দিলো দিগন্ত। রঙ্গীত নদীর তীরে সেদিন দিগন্তকে দিয়ে একটা ছবি তুলিয়েছিলো ও। সেটাই প্রোফাইল পিকচার করেছে। নীচে ছবি তোলার সৌজন্যে বলে লিখেছে—”আমায় আবার হাসতে শেখাল যে”। সৃজন চৌধুরীর কমেন্টও চোখে পড়লো দিগন্তর। ”লুকিং নাইস” বলে কমেন্ট করেছে। দেখেই অসহ্য রাগে ফেটে পড়তে ইচ্ছে হলো ওর। ব্রেকআপ হয়ে গেছে দেবলীনার সাথে, তারপরেও আবার ন্যাকামি কিসের? দেবলীনাই বা ছেলেটাকে এখনো ব্লক করে নি কেন? বিরক্ত লাগছিল ওর। মাথার মধ্যে জমা রাগটাকে নিয়েই কল করে বসলো দেবলীনাকে।
বার দুয়েক রিং হওয়ার পরে রিসিভও করলো ফোনটা। দেবলীনাকে হ্যালো বলার সুযোগটুকু না দিয়েই দিগন্ত বললো, মিনিমাম ভদ্রতাটুকু আশা করা বোধহয় অন্যায় হয়েছে আপনার কাছ থেকে। চারদিন পাশাপাশি থাকার পরেও যাওয়ার আগে সৌজন্যবোধেও বাঁধলো না, দেখা না করেই চলে গেলেন। ট্রেনে উঠেও একটা কল করার প্রয়োজন অনুভব করলেন না। অদ্ভুত মানুষ বটে! কলকাতা ফিরে যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়োটা একটু বেশিই মনে হচ্ছে আপনার! সৃজন চৌধুরীর কমেন্ট দেখেই বোধহয় উতলা হয়ে উঠেছেন। খুব ভালো, ব্রেকআপের পর প্রাক্তন ফিরে এলে ভালোবাসা দ্বিগুণ হয় শুনেছি। যাইহোক, সহযাত্রী হিসাবে একটু বেশিই চেয়ে ফেলেছিলাম বোধহয়। ফোন না করে আমার জায়গাটা বুঝিয়ে দিলেন। হ্যাপি এন্ড সেফ জার্নি। একবারও দম না নিয়েই ঝড়ের গতিতে কথাগুলো বলে দিল দিগন্ত। তবুও মাথার ডান দিকে দেবলীনার ছবিতে সৃজন চৌধুরীর কমেন্ট করার রাগটা এখনো দপদপ করছিল।
দেবলীনা শান্ত নিরুদ্বেগ গলায় বলল, হ্যাঁ ফোন করেছিল সৃজন। সে নাকি আমাকে মিস করছে, তবে এই মুহূর্তে রাকার সাথে এতটা জড়িয়ে গেছে, যে রাকার কাছ থেকে নিজেকে বের করতে নাকি একটু সময় দিতে হবে ওকে।
আমার বেশ মজা লাগছিল ওর সাথে কথা বলতে। যখনই বুঝলো আমি সৃজন চৌধুরীকে ছাড়াও হাসছি, তখনই মিস করার পরিমাণ বেড়ে গেলো। তবে কি বলতো দিগন্ত, এখন সৃজন কেন, স্বয়ং ভগবানও যদি নেমে এসে বলেন, দেবলীনা আমি তোমায় ভালোবাসতে চাই, তাহলে আমি তার প্রোপোজালও ফিরিয়ে দেব। বললাম না, ভালোবাসা শব্দের অর্থ আমার কাছে এখন রঙ্গীত নদীর জলের মতো স্বচ্ছ। তাই বারবার মোহকে ভালোবাসার প্রতিশব্দ ভেবে ভুল করবো না।
দিগন্ত আমি তোমাকে এই কদিনে সত্যিই ভীষণ বিরক্ত করেছি, অস্বস্তিতে ফেলেছি, রাই তোমার জীবনে আছে জেনেও তোমার দিকে হাত বাড়িয়েছি। জানি, তুমি বারবার পালাতে চেয়েছ আমার কাছে থেকে। তবুও আমি উত্যক্ত করে গেছি, তাই ভাবলাম আজ তোমায় ফ্রি ভাবে এনজয় করার সুযোগটুকু অন্তত দিই।
দিগন্ত কি বলবে খুঁজে না পেয়ে আচমকা বলে বসলো, সবই যে আপনি বুঝে বসে থাকবেন এমন তো নয়। ওই উত্যক্ত করাটাকেই যে আজ মিস করছি আমি, সেটা তো আর কাউকে বলার নেই। যাকগে সাবধানে পৌঁছাবেন। কেউ কিছু ট্রেনে দিলে খেয়ে নেবেন না।
দেবলীনা হেসে বললো, প্যারাসিটামল দিলেও খাবো না তাই তো?
একটু উদ্বিগ্ন হয়ে দিগন্ত বললো, আজও কি জ্বরটা এসেছে নাকি?
দেবলীনা বলল, না আর জ্বর আসেনি। এনজয় ইয়োর লাস্ট ডে ইন রা-বাংলা। আরেকটা কথা, এই যে আবার আপনিতে ফিরে গেলে এটাতেই বুঝিয়ে দিলে, কিছু দূরত্ব কোনোদিন ঘোঁচে না।
ফোনটা কেটে দিলো দেবলীনা। ও নিজেও বুঝছে দিগন্ত হয়তো একটু হলেও দুর্বল হয়ে পড়েছে ওর প্রতি। কিন্তু এই সুযোগটা দেবলীনা কিছুতেই নিতে পারবে না। সারাজীবন রাইয়ের চোখে ছোট হয়ে যাবে ও। হয়তো দিগন্তও কিছুদিন পরে আফসোস করবে নিজের এই সাময়িক ভুলের জন্য। কারণ দেবলীনা বেশ বুঝেছে, দিগন্ত শুধুই রাইকে ভালোবাসে। দেবলীনার খুব ইচ্ছে একবার অন্তত রাইয়ের গলাটা শোনার। দিগন্ত বারবার রাইকে কল করার জন্য আড়ালে সরে যাচ্ছিল, তখন থেকেই ইচ্ছেটা দানা বেঁধেছে ওর। কলকাতা ফিরে একবার অন্তত মিস কলেও শুনবে ওর গলাটা।
।। ১২।।
অফিস জয়েন করেছে দিগন্ত। দু একজন কলিগ এসে বলে গেল, কি ব্যাপার, ঘুরে বেরিয়ে এলে, চাঙ্গা লাগার কথা তো, এত মনমরা কেন লাগছে? কাল রাতে মাও একই কথা বললো, দিগন্ত, তোর কি হয়েছে রে? মনখারাপ? আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছে দিগন্ত। কিসের মনখারাপ? কার জন্য মনখারাপ? সহযাত্রী বৈ তো নয়। তাহলে কেন বারবার দেবলীনা উঁকি দিচ্ছে ওর মনের গোপন কোণে। জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললো, কি যে বলো সাগ্নিকদা, বিন্দাস আছি।
গলার স্বরটাই নিজের কাছে অপরিচিত ঠেকলো যেন। ওর গলার স্বরে আনন্দের রেশ মাত্র নেই, যেন এক মুঠো কান্না ঝরে পড়লো। ধুর, রা-বাংলা থেকে ফিরেছে দিন তিনেক হলো, এখনো মনখারাপি বাতাসটা ওর চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেবলীনা আর কল করেনি, জানায়নি পৌঁছানোর খবরটাও। ও নিজেও আর কল করেনি। ভুলে যাওয়াই ভাল। রাইকে বুদ্ধ মূর্তিটা দিয়ে বলেছে, আমার এক সহযাত্রী গিফট করেছে তোমায়।
নামটা কেন বলতে পারল না রাইয়ের কাছে! তবে কি চোরা পাপবোধই দেবলীনা নামটা উচ্চারণ করতে বাধা দিল ওকে! কাজকর্ম গুছিয়ে একরাশ মনখারাপ নিয়ে সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরল দিগন্ত। ক্লাবে যেতে ইচ্ছে করছিল না। বন্ধু-বান্ধবদের মাঝে নয় বরং একা থাকতে বড্ড ইচ্ছে করছে ওর। বাড়িতে ঢুকতেই মা বললো, তোর বন্ধু এসেছে, তোর ঘরে ওয়েট করছে।
বন্ধু বলতে সুজয় হবে বোধহয়। ক্লাবে দুদিন না দেখে খোঁজ নিতে এসেছে হয়তো। কিন্তু ঘরে ঢুকেই চমকে গেল দিগন্ত। দেবলীনা দাঁড়িয়ে আছে ওর কাঁচের শো কেসের সামনে। ঘন অন্ধকার রঙের একটা শাড়ি পরেছে, সঙ্গে লালচে ব্লাউজ। ঘাড়ের কাছে একটা ব্যাক ক্লিপ ধরে রেখেছে ওর অবাধ্য চুলের গোছা। একমনে তাকিয়ে আছে ছবিটার দিকে। ওর আর রাইয়ের একই দিনে জন্মদিনের ছবি ওটা। একটাই কেক কেটেছিল সেবার।
দিগন্তর পায়ের শব্দ শুনে ঘুরে দাঁড়ালো দেবলীনা। চোখের দৃষ্টিতে তীক্ষ্নতা। যেন এক্সরে মেশিন দিয়ে পড়ে নেবে ওর মনের ভিতরে অলিগলির গোপন কথা।
দিগন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে হালকা গলায় বলল, কি ব্যাপার, খবরাখবর না দিয়ে একেবারে বেডরুমে দিদিমণিকে দেখলে একটুও ভয় করবে না এমন বিচ্চু ছেলে আমি কোনোদিনই ছিলাম না। দেবলীনা ওর কথায় না হেসে সোজাসুজি প্রশ্ন করলো, রাই কোথায়? একবার তাকে এ বাড়িতে ডাকা যাবে? তার সাথে আলাপ করার বড্ড ইচ্ছে হলো। তাই বিনানোটিশে হানা দিলাম। একটু থতমত খেয়ে দিগন্ত বললো, কি মুশকিল রাই কি এ বাড়িতে সব সময় থাকে নাকি! সে এখন গানের ক্লাসে গেছে না অন্য কোথাও, আমি তো জানি না। দেবলীনা নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো, এই যে রাইয়ের নম্বর, একটা কল করুন না প্লিজ।
দিগন্ত থমকে গিয়ে বলল, কেন হঠাৎ ওকে কেন ডাকতে চাইছেন?
দেবলীনা কাটা কাটা তীক্ষ্ন স্বরে বললো, কারণ আপনি তাকে চব্বিশ ঘন্টা ডেকে চলেছেন তো তাই! আরেকবার ডাকুন আমার অনুরোধে প্লিজ।
সামনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো দিগন্ত। দুটো হাত দিয়ে নিজের মুখটা ঢেকে কেঁদে ফেললো ফুঁপিয়ে।
দেবলীনা থামানোর চেষ্টা করলো না। সুযোগ দিলো বুকের মধ্যে পাথরের মত জমে থাকা বরফগুলোকে গলে যেতে। কষ্টগুলো একটু নরম হোক, বড্ড কঠিন হয়ে বসে আছে দিগন্তর হৃদয়ে। একটা ভ্রান্ত স্বপ্নের মধ্যে বাস করে দিগন্ত, এখনো বেঁচে আছে একটা ঘোরের মধ্যে। এর থেকে ওকে বের করতেই হবে দেবলীনাকে। এভাবে শেষ হয়ে যেতে দিতে পারে না ও দিগন্তকে।
ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতেই দিগন্ত বললো, আমি বিশ্বাস করি রাই আছে। না ও মারা যায়নি। ওর অস্তিত্ব আজও আছে। দেখো ওই ছবিটা, রাই হাসছে। দেখো, ওটাতে ও বায়না করছে বেলুন কিনে দিতে হবে বলে। রাই আমার সাথেই আছে।
দেবলীনা বললো, রাই মারা গেছে দিগন্ত। অ্যাকসিডেন্টটা তো অস্বীকার করতে পারো না! গত দুবছর ধরে রাইয়ের নম্বরে তুমি রিচার্জ করে চলেছ। ওই নম্বরে অকারণে ফোন করে ভুলভাল বকো তুমি। ওই তো ফোনটা পড়ে আছে তোমার ডেস্কে। অসুস্থ হয়ে যাচ্ছ তুমি দিগন্ত। তোমার মা বললেন, রাই নাকি সেবার ওর বন্ধুদের সাথে পাহাড়ে যাচ্ছিল, গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে তিনজন স্পট ডেড হয়েছিল, তার মধ্যে রাই বিশ্বাস একজন। তুমিই তো ডুয়ার্সএ গিয়ে ওর বডি সনাক্ত করেছিলে। ওর ফোনটাও বোধহয় তুমিই এনেছিলে ওখান থেকে। দিনে অন্তত বার চারেক বাজে ওই নম্বরটা। সেটা তোমার নম্বর নিশ্চিত জানে বলে কেউ রিসিভও করে না। আমি গতকাল ফোন করেছিলাম রাইয়ের সাথে কথা বলবো বলে। ফোন বেজেই গেল। বার চারেক ফুল রিং হবার পরে একজন মহিলা কন্ঠ ধরে বললেন, কে বলছেন? আমি বললাম, রাই আছে? তিনি একটু থমকে গিয়ে বললেন, রাই? আপনি কে?
আমি বলেছিলাম, ওর বান্ধবী। সেই শুনে তিনি বললেন, আপনি কেমন বান্ধবী, যে দুবছর আগে রাই মারা গেছে জেনেও তার নম্বরে কল করছেন? তারপর আমি স্তব্ধ হয়ে ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম। আজ তোমাদের বাড়িতে এসে সবটা শুনলাম। তুমি না আমায় বাঁচার কথা বললে, স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে নয়, মুহূর্তকে ভালোবেসে বাঁচতে শেখালে। সেই তুমিই আজ দুবছর ধরে রাইয়ের স্মৃতি অঁকড়ে এভাবে ধূসর অতীতের পিছনে ছুটছ!
দিগন্ত ঘাড় নেড়ে বললো, আমি রাইকে কথা দিয়েছিলাম, ওকে ছাড়া আর কাউকে আসতে দেব না জীবনে। প্রতিদিন নিয়ম করে চারবার ওকে ফোন করতেই হতো। তাই সেই নিয়ম আজও বজায় রেখেছি। দেবলীনা বললো, দিগন্ত তুমি ফোন কানে নিয়ে কেন ওসব মিথ্যে বলে চলছিলে আমার সামনে? দিগন্ত ফুঁপিয়ে উঠে বললো, কারণ তোমায় দেখেই আমার ভাল লেগে গিয়েছিল। তাই নিজেকে সতর্ক করার জন্য রাইকে ভুয়ো ফোন করছিলাম। আমি যে কথা দিয়েছিলাম রাইকে।
দেবলীনা দিগন্তর পিঠে একটা হাত রেখে বললো, কিন্তু রাই যে আর নেই। এটা তোমাকে মেনে নিতে হবে দিগন্ত।
তুমি তো ধীরে ধীরে মানসিক রোগী হয়ে যাবে। যে নেই তাকে শ্রদ্ধা করা যায়, কিন্তু তাকে নিয়ে জীবন কাটানো যায় না দিগন্ত।
চোখের জলটা মুছে দিগন্ত বললো, চলে যাও তুমি। চলে যাও দেবলীনা। যেদিন থেকে তোমাকে দেখেছি, আমার সব হিসেব নিকেশ এলোমেলো হয়ে গেছে। কি জানতে এসেছো তুমি, তোমায় আমি ভালোবাসি কিনা? না বাসি না ভালো। এই কদিনে একবারও মনে পড়েনি তোমায়। প্লিজ লিভ মি। চলে যাও এখান থেকে।
দেবলীনা দিগন্তর মাথার ঘন চুলে আঙুল ডুবিয়ে বললো, আমি তোমার সহযাত্রী হিসাবে এসেছিলাম আজ। ভালোবাসা ভিক্ষে করতে নয় দিগন্ত। আমি চললাম, নিজেকে ভালোবেসে ভালো থাকার চেষ্টা করো তুমি। অতীতটাকে একটু একটু করে দূরে সরানোর চেষ্টা করো।
দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেবলীনা। ওর ঘন অন্ধকার শাড়ির আঁচলটা পার হয়ে চলে যাচ্ছে দিগন্তর ঘরের চৌকাঠ। আর স্থির থাকতে পারলো না দিগন্ত, উঠে গিয়ে চেপে ধরলো দেবলীনার একটা হাত। আমাকে আর একা করে দিও না দেবলীনা। একাকীত্বের যন্ত্রণা সহ্য করার সব ক্ষমতা আমি হারিয়ে ফেলেছি।
দেবলীনা বললো, আমার দুটো শর্ত আছে। আমাকেও দিনে চারবার ফোন করতে হবে। আর রেগে গেলেই আচমকা আপনি বলে সম্বোধন করতে হবে, ফেরার দিনে ট্রেনের ফোনটার মত। দিগন্ত লজ্জা পেয়ে বললো, সরি, তোমার ছবিতে সৃজনের কমেন্ট দেখে রেগে গিয়েছিলাম। দেবলীনা দুহাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল, বারবার অমন রেগে যাবে প্লিজ। রাইয়ের মত আমিও কিন্তু খুব হিংসুটে। দিগন্ত, আমার আরেকটা শর্ত আছে। রাইয়ের ছবিগুলো ওখানেই থাক। ও আমাদের দুজনেরই বন্ধু আজ থেকে। দিগন্ত দেবলীনার কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
‘আমি যে নিজেই মত্ত
জানি না তোমার শর্ত
যদি বা ঘটে অনর্থ
তবুও তোমারে চাই।’